০৭. নলিনী বাবু যে ক্লিনিকে আছেন

নলিনী বাবু যে ক্লিনিকে আছেন সেটা ঢাকা শহরে। সঙ্গত কারণেই ক্লিনিকের নাম বলছি না।

সকাল দশটার দিকে ম্যানেজার বুলবুলকে নিয়ে আমি ক্লিনিকে ঢুকলাম। মনে হলো মিনি জেলখানায় ঢুকেছি। কয়েকটা কলাপসিবল গেট। ভেতরে-বাইরে জেলখানার প্রহরীর মতো দারোয়ান। একজন দারোয়ানকে দেখে মনে হচ্ছে সে বডি বিল্ডার। মিস্টার বাংলাদেশ হবার চেষ্টায় আছে।

এই দারোয়ানের গায়ে লাল রঙের গেঞ্জি। তার হাতে লাঠি।

ক্লিনিকের প্রধান (ধরা যাক তার নাম আলিফ, ডা. আলিফ) অতি কৃশকায় মানুষ। মুখের তুলনায় বেমানান গোফ রেখেছেন। কলপ দেয়া মাথার চুল চকচক করছে। গোঁফে কলপ দেয়া হয়নি তবে মেহেদি দেয়া হয়েছে। গোঁফ লাল-সাদা। তার চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। তার প্রধান কাজ চশমাটা খানিকটা নাকের সামনে এগিয়ে আনা এবং পেছানো। ভদ্রলোককে আমার মানসিক রোগী বলে মনে হলো। আমি নলিনী বাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাই শুনে তিনি বললেন, কেন দেখা করতে চান? আমার দিকে তাকিয়ে বললেন না, জানালার দিকে তাকিয়ে বললেন।

আমি বললাম, নলিনী বাবু আমার পরিচিত। রোগীর সঙ্গে দেখা করার নিয়ম নিশ্চয়ই আছে।

নিয়ম নাই।

নিয়ম নাই মানে? কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে পারবে না?

না।

কারণটা ব্যাখ্যা করবেন?

মানসিক রোগীদের আলাদা রাখা হয়। আত্মীয়স্বজন বা পরিচিত জনদের সঙ্গে দেখা হলে তাদের সমস্যা হয়। তাদের যে আলাদা করা হচ্ছে এটাও চিকিৎসার একটা অংশ।

আমি বললাম, ভাই আমি পাঁচ মিনিট থেকে চলে যাব।

ডা. আলিফ চশমা আগ-পিছ করতে করতে বললেন, সম্ভব না। সম্ভব না। সম্ভব না।

নলিনী বাবুর যে আত্মীয় চিকিৎসার খরচ দিচ্ছেন তার ঠিকানাটা কি পেতে পারি?

না।

না কেন? মানসিক রোগী এবং তার আত্মীয়স্বজনদের সব ইনফরমেশন ক্লাসিফায়েড।

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি, ম্যানেজার বুলবুল আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, স্যার আপনি বাইরে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট খান আমি ব্যবস্থা করছি।

ম্যানেজার কিভাবে কি করল আমি জানি না। নলিনী বাবুর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পাওয়া গেল। বডি বিল্ডার দারোয়ানকে সঙ্গে নিয়ে আমি নলিনী বাবুর ঘরে ঢুকে হতভম্ব হয়ে গেলাম।

রট আয়রনের খাটে নলিনী বাবু বসা। তার দুই হাত খাটের সঙ্গে বাঁধা। তিনি হাঁ করে আছেন। তাঁর মুখ দিয়ে লালা পড়ছে। তার চোখ রক্তবর্ণ। নলিনী বাবুর সামনে মেলামাইনের একটা থালায় দুটা রুটি। একটা বাটিতে খানিকটা ডাল। একটা সিদ্ধ ডিম। ডালের বাটিতে ভনভন করে মাছি উড়ছে।

আমি বডি বিল্ডারকে বললাম, মনে হচ্ছে উনাকে সকালের নাশতা দেয়া হয়েছে। হাত বাঁধা অবস্থায় উনি খাবেন কি করে?

বডি বিল্ডার বলল, খাওয়া মুখে তুলে দেওয়ার লোক আছে।

ইনার হাত বাঁধা কেন?

রোগী ভায়োলেন্ট। মারতে আসে। এই জন্যই বাঁধা।

রাতে যখন ঘুমান তখনো কি হাত বাঁধা থাকে?

রাতে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়ায় দেই। হাত বান্ধার প্রয়োজন পড়ে না। এক ঘুমে রাইত পার।

কি ইনজেকশন দেন?

সেটা ডাক্তার সাব জানে। আমি কি জানি?

আপনার হাতে লাঠি দেখতে পাচ্ছি। আপনি কি লাঠি দিয়ে মারধোর করেন?

প্রয়োজনে করতে হয়। ধরেন একজন রোগী আপনার উপর ঝাপ দিয়া পড়ল। আপনি কি করবেন? মাইর খাবেন না মাইর দিবেন? বুঝেন না কেন এরা সাধারণ রোগী না, এরা মেন্টাল কেইস। আপনার কথা যা বলার তাড়াতাড়ি বলেন। মেন্টাল রোগীর সামনে বেশিক্ষণ থাকার নিয়ম নাই।

আমি নলিনী বাবুর সামনে দাঁড়ালাম। তিনি চোখ তুলে তাকালেন।

নলিনী বাবু আপনি কি আমাকে চিনেছেন?

নলিনী বাবু জবাব দিলেন না। বড় বড় নিশ্বাস নিতে লাগলেন।

আমি যদি আপনাকে এখান থেকে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করি আপনি কি যাবেন?

এইবার নলিনী বাবু হ্যাসূচক মাথা নাড়লেন। আমি ঘর থেকে বের হয়ে ডা. আলিফের কাছে গেলাম। তাঁকে বিনীতভাবে বললাম, আমি যদি নলিনী বাবুকে এখান থেকে নিয়ে যেতে চাই আমাকে কি করতে হবে?

ডা. আলিফ বললেন, আপনার করার কিছু নাই। রোগীর বিষয়ে তাঁর আত্মীয় সিদ্ধান্ত নিবে।

সেই আত্মীয়ের ঠিকানা দিন। আমি যোগাযোগ করি

আপনাকে আগে একবার বলেছি, তারপরে বলি–হে ব ফার আত্মীয়স্বজনের সব ইনফরমেশন ক্লাসিফায়েড।

আমি রাগ সামলাতে না পেরে বললাম, আপনার এখানে কি নিউক্লিয়ার এনার্জি নিয়ে গবেষণা হচ্ছে যে সনফরমেশন ক্লাসিফায়েড?

ম্যানেজার কানে কানে বলল, স্যার চলে আসেন। জায়গা ভালো না। আগে বের হই।

পাশের একটা ঘর থেকে গোঁ গোঁ শব্দ হওয়া শুরু করল। গোঁ গো শব্দের সঙ্গে হুটোপুটি; ঝনঝন শব্দে কিছু একটা ভাঙল। লাল গেঞ্জি দ্রুত সেখানে গেল। আমি চিৎকার শুনতে পাচ্ছি। মেয়ে গলায় চিৎকার–মারবেন না। খবরদার গায়ে হাত তুলবেন না।

এত কিছুতেও আমার সামনে বসা ডাক্তার আলিফের কোনো ভাবান্তর হচ্ছে না। তিনি একটা ইংরেজি খবরের কাগজ চোখের সামনে ধরে আছেন।

পাশের কামরার মেয়েটি বিকট আর্তচিৎকার করল। সেই শব্দে ডা. আলিফ মুখের সামনে থেকে খবরের কাগজ নামিয়ে আমাকে বললেন, আপনারা দাঁড়িয়ে আছেন কেন?

আমি আর থাকা সমীচীন মনে করলাম না।

বাংলাদেশ খুবই ছোট একটা জায়গা। ছোট জায়গার বিশেষত্ব হচ্ছে এখানে সবাই সবাইকে চেনে। মুদির দোকানদারও কোনো না কোনো সূত্রে প্রধানমন্ত্রীর পরিচিত। যে আইসক্রিমের গাড়ি নিয়ে বের হয় তারও আত্মীয়ের আত্মীয় পুলিশের ডিআইজি বা আইজি।

আমিও অনেককে চিনি তবে তারা গুরুত্বপূর্ণ কেউ না। ট্রাকের পেছনে লেখা থাকে একশ এক হাত দূরে থাকুন। আমি গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের ট্রাকের মতো মনে করি। তাদের কাছ থেকে একশ এক হাত দূরে থাকি। এতে তারাও ভালো থাকেন, আমিও ভালো থাকি।

সমস্যা হয় যখন গুরুত্বপূর্ণ কাউকে প্রয়োজন পড়ে। এখন যেমন পড়েছে। নলিনী বাবুকে জেলখানা থেকে উদ্ধার করতে হবে। আমার পক্ষে তা সম্ভব না। গুরুত্বপূর্ণ কাউকে দরকার। পরামর্শের জন্য আমি ধানমণ্ডি থানার ওসি কামরুল সাহেবকে খবর পাঠালাম।

তিনি একজন শখের অভিনেতা। আমার কিছু নাটকে অভিনয় করেছেন। একই সঙ্গে শখের সম্পাদক। হাতে কিছু টাকা-পয়সা জমলে পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকার নাম–সোনা রঙ। এই ভদ্রলোক কিছু দিন পর পর আমার কাছে আসেন এবং বিনীত ভঙ্গিতে বলেন, স্যার একটু দোয়া নিতে এসেছি। দোয়া করে দেন।

ওসি কামরুল খবর পেয়েই উপস্থিত হলেন। এবং বললেন, স্যার কি আদেশ।

আমি বললাম, আদেশ না, অনুরোধ। আমার একটা ইনফরমেশন দরকার। ইনফরমেশনটা হচ্ছে–পুলিশের কোনো কর্তাব্যক্তি কি আছেন যিনি হুমায়ূন আহমেদের বই পড়েন। যার কাছে এই লেখকের কিছু গুরুত্ব আছে। যাকে লেখক কোনো অনুরোধ করলে তিনি রাখবেন।

কি অনুরোধ করতে চান স্যার?

আমি নলিনী বাবুর ঘটনাটা বললাম। তাঁকে ক্লিনিক থেকে বের করা দরকার এটা জানালাম।

ওসি কামরুল বললেন, নলিনী বাবুকে বের করার জন্য আইজি, ডিআইজি লাগবে কেন? অধম কামরুলকে আপনার যথেষ্ট মনে হয় না?

তাঁকে কি আপনার এই উত্তরার বাসায় নিয়ে আসব?

না তাকে নুহাশ পল্লীতে নিয়ে আসতে হবে। এখানে অসুস্থ মানুষটার দেখাশোনার কেউ নাই। নুহাশ পল্লীতে অনেকেই আছে। তাকে দেখে-শুনে আসবে।

ওসি সাহেব চলে যাওয়ার তিন ঘণ্টার মাথায় নুহাশ পল্লীর ম্যানেজার জানাল, কিছুক্ষণ আগে নলিনী বাবুকে ওসি সাহেব নুহাশ পল্লীতে নামিয়ে দিয়ে গেছেন। নলিনী বাবু ভালো আছেন।

আমি বললাম, ভালো আছেন বলতে কি বুঝাচ্ছ?

উনি কথা বলেছেন।

কি কথা?

আমাকে বলেছেন, স্নান করব। আমি ব্যবস্থা করেছি। গরম পানি দিয়ে আমি নিজে গোসল দিব।

ডাক্তার এজাজকে খবর দাও। একজন ডাক্তারের পাশে থাকা দরকার।

স্যার আপনি বলার আগেই আমি ডাক্তার সাহেবকে খবর দিয়েছি। উনি আধাঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাবেন। আপনি কি আসবেন?

এখন আসব না। উনার শরীর একটু সারুক। কথা বলা শুরু হলে আসব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *