০৭. নদীয়া জেলার টুঙ্গি গ্রামে

নদীয়া জেলার টুঙ্গি গ্রামের এক টুলো পণ্ডিত ছিলেন বেণীমাধব অধিকারী। ছাত্র পড়ানো ছাড়া সংস্কৃত সাহিত্য ও শাস্ত্র চর্চা করে তিনি সময় কাটাতেন। পণ্ডিতের অন্তরালবর্তিনী স্ত্রীর ভূমিকা সারাদিন ধরে রান্নাবান্না করা ও নিয়মিত সন্তান প্রসব। সাতটি পুত্র কন্যার জন্ম দিয়ে পণ্ডিতজায়া একদিন নিঃশব্দে বিগত হলেন।

গৃহিণী গৃহমুচ্যতে। গৃহিণী বিগত আর গৃহ রেখে লাভ কী, পণ্ডিত গ্রাম ছেড়ে বিবাগী হয়ে গেলেন। দণ্ড ধারণ করে হলেন সন্ন্যাসী, নতুন নাম নিলেন স্বামী যোগানন্দ সরস্বতী।

সারা ভারত পর্যটন করে যোগানন্দ সরস্বতী এবসময় স্থিত হলেন কাশীতে। ততদিনে তাঁর কিছু ভক্ত ও শিষ্য জুটেছে, এক ধনী ভক্ত তাঁকে একটি বাড়ি ও সংলগ্ন জমি দান করে, সেখানে গড়ে ওঠে আশ্রম। ব্রহ্মকুণ্ডের সেই আশ্রমে রাম-লক্ষ্মণ-সীতা ও শিব মূর্তির পূজা ও নিয়মিত সাধন ভজন হয়।

সন্ন্যাসী হলেও যোগানন্দ সরস্বতী পূর্ব জীবনের স্মৃতি একেবারে মুছে ফেলেনি। মাঝে মাঝে সন্তানদের খোঁজ খবর নেন। তাঁর সন্তানদের মধ্যে একজন খুবই কৃতবিদ্য হয়েছে, সংস্কৃত ও দর্শনের খ্যাতনামা অধ্যাপক, ক্রমে তিনি দিল্লির হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ হন।

একেবারে শেষ বয়েসে যোগানন্দ কোনও একজন সন্তানকে কাছে পাবার জন্য উতলা হয়ে ওঠেন। দিল্লি থেকে ডেকে পাঠান ফণিভূষণকে। পিতার অনুরোধ অমান্য করতে পারলেন না ফণিভূষণ, দিল্লির চাকরি ছেড়ে সপরিবারে চলে এলেন কাশীতে, কিন্তু আশ্রমে উঠলেন না। পাশেই একটা নতুন বাড়ি বানালেন। কাশী শহর বিদ্যা চর্চার একটি বৃহৎ কেন্দ্র, সেখানে অধ্যাপনার কাজ পেতে তাঁর কোনও অসুবিধে হল না।

ফণিভূষণের নিজের পরিবারটিও বেশ বড়। পাঁচটি ছেলেমেয়ে, স্ত্রী, আশ্রিত আত্মীয়-পরিজন, দাস-দাসী, জমজমাট সংসার। এ পরিবারে গান বাজনার খুব চর্চা হয়, যদিও ছেলেমেয়েদের পড়াশুনোর ব্যাপারে অধ্যাপক মশাই কড়া নজর রাখতেন।

দুই পুত্র সন্তানের মৃত্যুর পর প্রথম কন্যা আশা, তাকে বেশ কিছুদিন ছেলে সাজিয়ে রাখা হয়েছিল, সবাই ডাকত নন্দদুলাল বলে, রজঃস্বলা হবার পর আশা ওই নাম শুনলেই রেগে যায়, ছেলেদের মতন জামা টামা ছুড়ে ফেলে দিয়েছে, এখন শাড়ি ছাড়া কিছু পরে না। পড়াশুনোয় দারুণ মেধাবিনী, এই বয়েসেই সে আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝুঁকেছে। প্রায়ই সে বিরলে বসে ধ্যান করে।

দ্বিতীয় বোন শান্তি মুখচোরা, লাজুক, বাড়িতে তার অস্তিত্ব যেন টেরই পাওয়া যায় না। তার পরের বোন প্রীতির ডাক নাম রাণু, স্বভাবে সে আগের দুই বোনের সম্পূর্ণ বিপরীত, বাড়ির মধ্যে সে-ই সবচেয়ে দুরন্ত। সব সময় সে প্রাণচাঞ্চল্যে অস্থির, বেশিক্ষণ এক জায়গায় বসে থাকতে পারে না, সে যেন সর্বক্ষণ বাড়ির সর্বত্র পরিদৃশ্যমান।

লক্ষ্মী মেয়ে ও সুবোধ বালকদের খুব প্রশংসা হয় বটে, কিন্তু দুরন্ত সন্তানটিকেই বয়স্করা বেশি পছন্দ করেন। তিন-চার বছর বয়েস থেকেই রাণু পাশের আশ্রমে গিয়েও হুটোপাটি করে, যোগানন্দ সরস্বতী এই নাতনিটির দিকে প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। তাকে কোলে বসিয়ে আদর করতে চান। কিন্তু চুপ করে বসে থাকার পাত্রীই নয় রাণু, সে ছটফটিয়ে উঠে যায়। যোগানন্দ ছড়া কেটে বলেন, রাণু আমার মানিক। নাড়বও না, চাড়বও না, দেখব খানিক খানিক।

তান্য বোনদের সঙ্গে রাণু ইস্কুলে যায় বটে, কিন্তু ইস্কুলের পড়ার দিকে রাণুর মন নেই। সে পড়ে যত রাজ্যের গল্পের বই, বড়দের হোক, ছোটদের হোক, বাছ-বিচার নেই কিছু। এ বাড়িতে বই প্রচুর, কলকাতা থেকেও পত্র-পত্রিকা আসে। ছেলেমেয়েরা জন্ম থেকেই আছে দিল্লি ও বারাণুসীতে, স্কুলে শিক্ষার মাধ্যম হিন্দি, তবু সবাই খুব ভাল বাংলা শিখেছে। মা সরযূবালা চন্দননগরের মেয়ে, হাতেখড়ির সময় থেকেই তিনি প্রতিটি সন্তানকে বাংলা ভাষায় দীক্ষা দিয়েছেন। প্রথমে তিনি ওদের রামায়ণ-মহাভারত আর রূপকথার গল্প পড়ে শোনান, তারপর বই ধরিয়ে দেন।

সাত বছর বয়েস থেকেই রাণুর গল্পের বই পড়ার নেশা। অনেক বই। পড়তে পড়তে সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামে একজন লেখকের লেখাই বেশি পছন্দ করে ফেলল। যা পড়ে তাই-ই ভাল লাগে, তাঁর অনেক পদ্য সে মুখস্ত করে ফেলেছে, কিছু কিছু লেখা সবটা বুঝতে পারে না, তবু পড়তে ছাড়ে না। দশ বছর বয়েসেই সে এই রবিঠাকুরের একনিষ্ঠ ভক্ত।

রবিবাবু গানও লেখেন। মা রবিবাবুর বেশ কয়েকটা গান গাইতে পারেন, সেই সব গান শোনার সময় রাণুর দুরন্তপনা ঘুচে যায়, চুপটি করে শোনে। রাণু নিজে অবশ্য গাইতে পারে না, তার গানের গলা নেই। সেজন্য তার খুব দুঃখ হয়।

 

স্কুলের পড়ার বই বিশেষ ছোঁয় না রাণু, শুধু পরীক্ষার আগে তার রাত জেগে পড়াশুনো করার ধুম পড়ে যায়। একবার তার পরীক্ষার ফলাফল দেখে সবাই হতবাক। স্কুল থেকে প্রায় ছুটতে ছুটতে বাড়ি চলে এল রাণু। তার এক মামা কালীপ্রসন্ন প্রায়ই এসে থাকেন এখানে, তিনি ভাল বাংলাই বলতে পারেন না, কথা বলেন অনেক হিন্দি শব্দ মিশিয়ে। তার সামনে এসে রাণু রেজাল্টের কাগজটা নিয়ে লাফাতে লাফাতে বলতে লাগল, আমি হিন্দিতে ফাস্ট হয়েছি, আমি হিন্দিতে ফার্স্ট হয়েছি।

শুধু নিজের ইস্কুলে নয়, সারা উত্তর প্রদেশে হিন্দি পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে এই বাঙালি বালিকাটি।

কালীপ্রসন্ন খুশি হলেন অবশ্যই, তবু কৌতুক-ছলে হাত বাড়িয়ে বললেন, দেখি, দেখি, আউর সব সাবজেক্টমে গাড়ু মিলা, না কেয়া?

আশ্চর্যের ওপর আশ্চর্য, রাণু সব বিষয়েই ক্লাসে প্রথম হয়েছে। এ কি জাদুর ভেকি নাকি?

এরপর থেকে অভিভাবকরা ঠিক করেছেন, রাণুর ইস্কুলের পড়া নিয়ে আর খবরদারি করা হবে না। ও ওর নিজের নিয়মেই পড়ুক!

এই ক্ষুদ্র জীবনে রাণু তার প্রথম চিঠি লিখেছিল প্রিয় লেখক রবিবাবুকে। তিনি একবার উত্তর দিতেই শুরু হয়ে গেছে নিয়মিত পত্র বিনিময়। রাণু আর কারুকেই চিঠি লেখে না।

 

চিঠিতে এখন চলেছে নাম নির্বাচন নিয়ে বোঝাপড়া। সবই ওঁকে বলে গুরুদেব কিংবা রবিবাবু। গুরুদেব সম্বোধন রাণুর একেবারে পছন্দ হয় না, শুনলেই মনে হয় যেন ঠাকুর্দার মতন গেরুয়া পরা, মাথায় জটাওয়ালা বুড়ো। উনি তো সন্ন্যাসী নন, কবি। তাই রাণু এতদিন রবিবাবুই সম্বোধন করেছে, সেটা কবির পছন্দ নয়। উনি লিখেছেন, রবিবাবুর বদলে রবিদাদা কেমন?

ওই নামেও দু’একজনকে ডাকতে শুনেছে রাণু। এমন নাম চাই, যা হবে রাণুর নিজস্ব, ওই নামে আর কেউ ডাকবে না।

কিন্তু রবি নামটা যে কবির খুব পছন্দ। এক যে ছিল রবি, সে শুধু এক কবি। বদলাতে হলেও এমন নাম দিতে হবে, যার অর্থ হবে রবিই।

রবি মানে তো সূর্য। সূর্যদাদা? এ নামে ডাকলেই একদম অচেনা হয়ে যাবেন মানুষটি। মার্তণ্ড? ধুৎ! শুনলেই মনে হয় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। দিবাকর? ওই নামে কাশীতে একজন চেনা মানুষ আছে, মোটেই সুবিধের লোক নয়।।

কবি নিজেই আর একটা নামের প্রস্তাব দিলেন। খুব কম বয়েসে তিনি ভানু সিংহ ছদ্ম নামে কিছু কবিতা ও গান লিখেছিলেন, তারপর আর অনেকদিন সে নাম কেউ মনে রাখেনি। ভানুদাদা কেমন হয়, ও নামে আর কেউ ডাকবে না।

রাণুর খুব পছন্দ হয়ে গেল।

ভানুর সঙ্গে রাণু নামটারও চমৎকার মিল। অন্য কেউ ডাকতে চাইলেও বলা হবে, তোমাদের নামের সঙ্গে মেলাও আগে। কাদম্বিনী কিংবা জগদম্বারা পারবে? এমনকী সীতা, শান্তার সঙ্গেও মিলবে না।

ভানুদাদা শুধু একলা রাণুর।

আর যিনি গুরুদেব, কিংবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তিনি অন্য সকলের হোন গে যান!

সেবারে কলকাতায় গিয়ে প্রথম দেখা হল, তারপর এক মাস শান্তিনিকেতনে ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে। তারপর থেকেই রাণুর মনে হয়, পৃথিবীতে তার এত আপন মানুষ আর কেউ নেই।

কী অপরূপ সুন্দর সেই মানুষটি। দীর্ঘকায়, শক্তিমান পুরুষ, অথচ চক্ষু দুটি ভারী কোমল, মাথায় অনেক চুল, মুখ ভর্তি কাঁচা পাকা দাড়ি, অথচ যখন হাসেন তখন মনে হয়, ওঁর শরীরে বয়েসের কোনও ছাপই পড়েনি। ভরাট, সুরেলা কণ্ঠস্বর, সব সময় মজা করে কথা বলেন। এ মানুষটার শরীরে বুঝি একটুও রাগ নেই।

অবশ্য উনি যখন অন্য মানুষদের সঙ্গে কথা বলেন, রাণু তো অনেকবার পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছে ও শুনেছে। তখন উনি গম্ভীর হতে পারেন, শক্ত কথা বলেন, অন্যদের বকুনিও দেন। আবার শুধু রাণুর সামনে একেবারে বদলে যান। যেন একেবারে মনের মানুষ। রাণু ওঁর লেখা থামিয়ে দিলেও বিরক্ত হন না। একদিন বলেছিলেন, তোমাকে দেখেই তো আমার নতুন গান মনে আসছে।

আহা রে, ওঁর মেয়ে মাধুরীলতা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল! রাণু তাকে দেখতে পেল না। এক একসময় কবি রাণুর হাত ধরে বলতেন মাধুরীলতার কথা। তখনও তাঁর চোখ ছলছল করেনি, শুধু দৃষ্টি যেন চলে যেত অনেক দূরে।

শান্তিনিকেতন ছেড়ে আসতে রাণুর খুবই কষ্ট হয়েছিল। এখন অনেকটা সহ্য হয়ে এসেছে, মা-বাবার কথাও তো মানতে হবে। মা বলেছেন, আবার শান্তিনিকেতনে যাওয়া হবে শিগগিরই।

দিন যায়, দিন যায়। সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধে আর রাত্রি নিয়ে এক একটা লম্বা লম্বা দিন। সানাইয়ের সুরে ভোর হয়। সেতারে ভৈরবী ও আশাবরী রাগিণীর মতন গড়িয়ে যায় সকাল, তবলার বোলের মতন দুপুর, বেহালার ছড়ে পূরবীতে বিকেলের শেষে সূর্যাস্ত হয় গঙ্গায়, তারপর অন্ধকারে স্বল্প আলোকিত এক একটা বজরায় শোনা যায় নূপুরধ্বনি আর গান, সিন্ধু বারোয়াঁর উদাস সুরের মতন নেমে আসে ঘুম।

বর্ষা কাল পেরিয়ে শরৎ এল। পুজোর ছুটিতেও শান্তিনিকেতনে যাওয়া হল না, বাবা খানিকটা সুস্থ হয়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। রাণুর অভিমান হয়। আগে কাশী তার এত ভাল লাগত, এখন শান্তিনিকেতনই সর্বক্ষণ মন টানে।

একদিন আশ্রম বাড়ির ইদারার কাছে কোথা থেকে একটা ময়ুর উড়ে এসে বসেছে। খবর পেয়েই সকালবেলা পড়ার বই ফেলে রাণু এক ছুটে গেল দেখতে। সারা শরীরে অজস্র রঙের বাহার নিয়ে ময়ূরটি মাথা তুলে বসে আছে দৃপ্ত ভঙ্গিতে।

অত সুন্দর দেখতে হলেই বা, ছোট ছেলেমেয়েদের ময়ূরের কাছে যেতে দেওয়া হয় না। ওরা নাকি চোখ খুবলে নেয়। রাণুর ভয় ডর নেই, কে তাকে বাধা দেবে! সে পায়ে পায়ে এগিয়ে যায়।

তার মনে পড়ল, শান্তিনিকেতনে দুটো ময়ূর আসার কথা ছিল। এতদিনে কি এসে গেছে? কবি কি নিজের হাতে তাদের খাওয়ান?

কথা নেই বার্তা নেই, ময়ূরটা যেমন হঠাৎ এসেছিল, তেমনই হঠাৎ আবাব উড়ান দিয়ে চলে গেল।

যেখানে ময়ূরটি বসে ছিল, এখন আর সেখানে নেই, তবু যেন আছে। দেখতে পাচ্ছে রাণু। সে একদৃষ্টিতে সেই শূন্যতার মধ্যে একটি ময়ূর সৃষ্টি করে তাকিয়ে রইল সেদিকে।

আর এক সন্ধেবেলা রাণু পড়তে বসেছে দিদিদের সঙ্গে। সবে বইতে শুরু করেছে শীতের বাতাস। মাঝে মাঝেই রাণুর মন উতলা হয়ে যায়। সে ভাববার চেষ্টা করে, শীতকালে শান্তিনিকেতন কেমন দেখায়? তখন কি পাতা ঝরে যায় সব গাছের? জল থাকে কোপাই নদীতে? ছাত্ররা কি শীত কাটাবার জন্য সন্ধের সময় আগুন জ্বালে?

কে যেন কড়া নাড়ছে সদর দরজায়।

সন্ধের সময় ফণিভূষণের সঙ্গে কাশীর বিশিষ্ট ব্যক্তিরা দেখা করতে আসেন। বৈঠকখানা ঘরে উচ্চাঙ্গের কথাবার্তা হয়। এক একদিন গান বাজনার আসর বসে পেছন দিকের দালানে।

আজকের আগন্তুকটি অপরিচিত। ফণিভূষণ তার সঙ্গে কথা বলছেন। পাশের ঘর থেকে একটু একটু শুনতে পাচ্ছে রাণু।

অপরিচিত ব্যক্তিটির নাম ভীমরাও শাস্ত্রী। তিনি মহারাষ্ট্রের লোক, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে শান্তিনিকেতনে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। নিজস্ব একটি কাজে এসেছেন বারাণুসীতে, আসবার সময় গুরুদেব এই ঠিকানা দিয়ে তাঁকে বলেছেন, রাণু নামে একটি এ বাড়ির মেয়ে কেমন আছে, একবার খবর নিয়ে আসতে।

শান্তিনিকেতন শব্দটি কানে যাওয়া মাত্র দৌড়ে চলে এল রাণু।

ফণিভূষণ মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে সহাস্যে বললেন, এই আমার মেয়ে রাণু। রবিবাবুকে বলবেন, সে দিব্যি আছে, তরতরিয়ে বড় হচ্ছে। রবিবাবুর নামে একেবারে পাগল!

ভীমরাও শাস্ত্রীকে খাতির করে ভেতরে বসানো হল। শান্তিনিকেতনে গুরুদেব এই পরিবারটিকে কত যত্ন করেছেন, এখন তাঁর দৃতকে আপ্যায়ন না করে ছাড়া হবে কেন? তাঁকে দেওয়া হল মালাই, জিলিপি, নিমকি, গজা। ভীমরাও ভোজনরসিক, এ সবে তাঁর আপত্তি নেই।

তিনি একজন গায়ক, গান শোনাবেন না?

বসে গেল গানের আসর। ভীমরাও খেয়াল-তরানায় বিশেষজ্ঞ। তবে শান্তিনিকেতনে দিনুবাবুর কাছ থেকে তিনি কিছু কিছু গুরুদেবের গানও কণ্ঠে তুলেছেন, শোনালেন সেগুলিও। রাণুকে বললেন, এইটা গুরুদেবের নতুন গান : ওহে সুন্দর, মরি-মরি–

তিন চারদিনের গানের আসরে শান্তিনিকেতনের আবহাওয়া যেন অনেকটা বইতে লাগল ব্ৰহ্মকুণ্ডে।

শেষদিনে রাণু ভীমরাওকে বলল, আপনার হাত দুটো দেখি।

বিস্মিত ভীমরাও-এর বাড়ানো দু হাত জড়িয়ে ধরে রাণু জিজ্ঞেস করল, শান্তিনিকেতনে গিয়ে আপনি কবিকে প্রণাম করবেন তো?

ভীমরাও বলল, জরুর। গুরুদেবের চরণ স্পর্শ করনে সে মেরা তনুমন পবিত্র হো যাতা!

রাণু বলল, এই যে আমি আপনার হাত ধরলাম, তারপর আপনি এই হাতে কবিকে ছোঁবেন, তাতে আমারও একটু ছোঁয়া হবে। রেলে যাবার সময় কিন্তু আপনি আর কারুকে ছোঁবেন না, শান্তিনিকেতনে পৌঁছেও না, প্রথমেই কবিকে–

সরবালা হাসতে হাসতে বললেন, দেখেছেন তো, এ মেয়েটা সত্যিই পাগল!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *