০৭. নতুন আমি

০৭. নতুন আমি

দুলি খালা আমাকে দেখে অসম্ভব খুশি হয়ে উঠল, বলল, পাগলী মেয়েটা তোমারে খুঁইজা পাইছে?

আমি মাথা নাড়লাম। দুলি খালা বলল, এই রকম মাইয়া আমি জীবনে দেখি নাই। কইলজাটা এক দিকে মাখনের মতো নরম অন্যদিকে পাথরের মতোন শক্ত।

আমি বললাম, সেইটা কেমন করে হয়?

দুলি খালা জ্ঞানী মানুষের মতো বলল, হয়। প্রথম যখন আসছে আমি তারে কিছু বলি নাই। সে বলছে তোমার পড়ার টেবিলে একটা বই রেখে যাবে। আমি বলছি তোমার নিজের পড়ার টেবিল নাই। তখন বলছে তোমার বিছানার উপর রাখবে। আমি বলছি নিজের বিছানা নাই। তখন বলছে তুমি যেখানে ঘুমাও সেইখানে রাখবে। আমি আর কী করি? এই স্টোররুমে নিয়া আসছি।

আমি বললাম, ও!

দুলি খালা বলল, এক নজর দেইখাই বুইঝা গেছে। তখন ভেউ ভেউ করে কান্দা শুরু করছে। এই জন্যে বলি কইলজাটা মাখনের মতো নরম।

আমি বললাম, ও।

দুলি খালা বলল, যখন শুনলো তুমি চইলা গেছ তখন পাগলের মতো হয়া গেল। বলল, আমি খুঁইজা বার করব। আমি বললাম ঢাকা শহরে লাখ লাখ মানুষ! তুমি খুঁজবা কেমনে? সে বলল জানি না। কিন্তু আমি চেষ্টা করমু। খোদা যদি সায্য করে তাহলে বার করমু। দুলি খালা হেসে বলল, খোদা তারে সাহায্য করছে।

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, হ্যাঁ। তারপর পকেট থেকে দুমড়ানো মোচড়ানো নোটগুলো বের করে দুলি খালার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, নাও দুলি খালা, তোমার টাকা।

দুলি খালা বলল, রাখো তোমার কাছে।

আমি বললাম, না দুলি খালা। আমার কাছে রাখলে অনেক বিপদ হতে পারে। আম্মু যদি খুঁজে পায় তাহলে আমাকে খুন করে ফেলবে।

দুলি খালা মাথা নাড়ল, বলল, সেইটা সত্যি কথা। আমার কাছ থেকে টাকাগুলো নিয়ে তার শাড়ির খুটে বেঁধে রেখে বলল, ঠিক আছে। আমি আমার কাছে রাখলাম, তোমার যখন লাগবে তখন আমার কাছ থেকে নিয়ো।

আমি মাথা নেড়ে স্টোররুমে ঢুকে গেলাম। প্রিয়াংকা আমাকে যে বইটা দিয়েছে সেটা পড়ার জন্যে আমি আর এক সেকেন্ডও অপেক্ষা করতে পারছিলাম না।

মানুষ যেভাবে ডিটেকটিভ বই পড়ে আমি সেভাবে গণিতের বইটা পড়ে শেষ করলাম। আমি আর দুলি খালা রান্নাঘরে বসে বসে খাই, আজকে খাবার সময়েও বইটা পড়েছি। শুধু দশটার সময় আমার বই পড়া বন্ধ করতে হলো, তখন মিচকি বেড়াতে এলো। আজকাল তার সাহস বেড়েছে, আমার শরীরের উপর দিয়ে ছুটোছুটি করে। ভাল খেয়ে-দেয়ে তার স্বাস্থ্যটাও একটু ভাল হয়েছে। মনে হলো। পেটটা নাদুসনুদুস। আমি তার সাথে একটু গল্প গুজব করলাম, ভাব দেখে মনে হয় সে আমার সব কথা বুঝে!

রাত্রে ঘুমাতে ঘুমাতে অনেক দেরি হলো, শোওয়ার পরও চট করে চোখে ঘুম এলো না, মাথার মাঝে জিটা ফাংশন আর অয়লার ইকুয়েশন ঘোরাঘুরি করতে লাগলো! শেষ পর্যন্ত যখন ঘুমিয়েছি তখন নিশ্চয়ই অনেক রাত।

 

সকালে ঘুম ভাঙল ভাইয়ার ডাকাডাকিতে। আমি চোখ কচলে ভাইয়ার ঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে ভাইয়া?

তুই কাপড় ইস্ত্রি করতে পারিস?

আমি ইতস্তত করে বললাম, আগে কখনও করি নি।

আগে না করলে কী হয়েছে? এখন করবি। আমার এই প্যান্টটা একটু ইস্ত্রি করে দে দেখি। সাবধান পুড়িয়ে ফেলিস না যেন।

আমি তাই ভাইয়ার প্যান্টটা ইস্ত্রি করে দিলাম, খুব সাবধানে করেছি যেন পোড়ে। ভাইয়া দেখে খুব খুশি হয়ে গেল, বলল, বাহ! তুই দেখি ভাল ইস্ত্রি করতে পারিস।

আমি কিছু বললাম না। ভাইয়া তার চেয়ারের উপর রাখা কয়েকটা শার্ট প্যান্ট দেখিয়ে বলল, এগুলোও ইস্ত্রি করে রাখিস। ঠিক আছে?

আমি কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম।

 

স্কুলে গিয়ে আমার প্রিয়াংকার সাথে দেখা হলো, প্রিয়াংকা এমন ভাব করল যেন কিছুই হয় নি। এমন কী বসলও অন্য জায়গায়, আমার কাছে নয়। আমি একেবারে লিখে দিতে পারি অন্য যে কোন ছেলে-মেয়ে যদি আমার ব্যাপারটা জানতো তাহলে এতক্ষণে পুরো স্কুলে সেটা জানাজানি হয়ে যেতো। অনেক দিন পর আজকে আমি ক্লাসে কী পড়াচ্ছে সেটা একটু মনোযোগ দিয়ে শোনারও চেষ্টা করলাম। দীর্ঘদিন পড়াশোনা না করে করে আমার অভ্যাসও চলে গেছে, স্যারদের কথাবার্তায় মনোযোগও ধরে রাখতে পারি না। ফোর্থ পিরিয়ডে ক্লাসে একটা নোটিশ এলো, স্যার নোটিশটা পড়ে ভুরু কুঁচকে বললেন, জয়ন্ত, মামুন আর মৌটুসি তোরা তিনজন ক্লাস ছুটির পর শিরীন ম্যাডামের সাথে দেখা করবি।

জয়ন্ত মামুন আর মৌটুসি হচ্ছে ক্লাসের প্রথম দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ছাত্রছাত্রী। কাজেই তাদের কোন ঝামেলার মাঝে পড়ে শাস্তির জন্যে যেতে হচ্ছে।

সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। মৌটুসি হাত তুলে জিজ্ঞেস করল, কেন স্যার?

স্যার ভুরু কুঁচকে নোটিশটা আরেকবার পড়ে বললেন, কী জানি! গণিত অলিম্পিয়াড না কী যেন হচ্ছে।

সেটা কী স্যার?

স্যার আবার নোটিশটা পড়লেন, পড়ে বললেন, মনে হয় গণিতের একটা কম্পিটিশান হবে সেখানে তোরা যাবি।

মৌটুসি চোখ বড় বড় করে বলল, গণিতের কম্পিটিশান? তারপর হি হি করে হেসে ফেলল। চিন্তা করলে ব্যাপারটা আসলেই হাস্যকর কয়েকজন কাগজে কলমে হাঁসফাঁস করে অঙ্ক করছে, কার আগে কে করতে পারে সেটা নিয়ে প্রতিযোগিতা!

প্রিয়াংকা হাত তুলে বলল, স্যার, এই গণিতের কম্পিটিশনে সবচেয়ে ভাল যে গণিত পারে তাদেরকে পাঠানো উচিত না?

স্যার বললেন, তাই তো উচিত।

তাহলে স্যার আলাদা করে ক্লাসে একটা গণিতের কম্পিটিশন করা উচিত না? কে ভাল গণিত পারে সেটা বের করা উচিত না?

স্যার চোখ পিটপিট করে প্রিয়াংকার দিকে তাকালেন, কেন? তোর কী খুব যাবার শখ নাকী?

না স্যার। প্রিয়াংকা মাথা নাড়ল, বলল, আমার শখ নেই স্যার। আমি গণিতে খুব দুর্বল! কিন্তু অন্য কেউ তো থাকতে পারে যারা গণিতে খুব ভাল!

তা নিশ্চয়ই পারে। বলে স্যার হাত নেড়ে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দিলেন। প্রিয়াংকা মন খারাপ করে বসে পড়ল, সে নিশ্চয়ই আমার জন্যে চেষ্টা করছিল! আমার অবশ্যি গণিতের কম্পিটিশনে যাবার এক বিন্দু ইচ্ছে নেই! এইসব কম্পিটিশন আমার জন্যে নয়!

প্রিয়াংকা অবশ্যি চেষ্টা করা ছাড়ল না, শিরীন ম্যাডামের কাছে গিয়ে চেষ্টা করল, শিরীন ম্যাডাম নতুন করে ঝামেলা করতে রাজি হলেন না, স্কুলের ফার্স্ট সেকেন্ড আর থার্ড ছাত্রছাত্রী নিয়েই সন্তুষ্ট থাকলেন। প্রিয়াংকা তখন সাহস করে। একেবারে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের কাছে হাজির হলো, প্রিন্সিপাল ম্যাডাম মন দিয়ে তার কথা শুনে বললেন, এবার হাতে একেবারে সময় নেই। পরেরবার চেষ্টা করা যাবে। তা ছাড়া গণিতের কম্পিটিশন একটা বিচিত্র বিষয়–আগে কখনো এরকম কিছু হয় নি। যারা আয়োজন করছে কয়দিনের ভিতরেই তাদের উৎসাহ ফুরিয়ে যাবে। কাজেই বিষয়টা নিয়ে বেশি হৈচৈ করার কোন প্রয়োজন নেই।

গণিত প্রতিযোগিতায় আমাকে ঢোকাতে না পেরে প্রিয়াংকা খুব মন খারাপ করল, তার ধারণা আমি যদি কোনভাবে সেখানে যেতে পারি তাহলেই একটা ফাটাফাটি কিছু করে ফেলতে পারব। আমার অবশ্য এমন কিছু মন খারাপ হলো না–অনেক দিন থেকেই এসব জিনিস থেকে আমি অনেক দূরে চলে গেছি। আগে আমি খুব ভাল ডিবেট করতাম এখন শুদ্ধভাবে কথাই বলতে পারি না।

তবে প্রিয়াংকা আমাকে নিয়ে হাল ছাড়লো না। স্কুল ছুটির পর প্রতিদিন প্রিয়াংকা আমার সাথে হেঁটে যেতে শুরু করলো। হেঁটে হেঁটে সে আমাকে নানারকম উপদেশ দিতো–তার উপদেশ যে খুব কাজের উপদেশ তা নয়, কিন্তু একজন মানুষ আমার জন্যে চিন্তাভাবনা করছে, আমাকে নিয়ে ভাবছে সেটাই আমার জন্যে অনেক কিছু। বিকালবেলা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তার সাথে আমার এ ধরনের কথাবার্তা হলো :

বুঝলি তপু কখনো হাল ছেড়ে দিবি না। সব সময় বুকের মাঝে আশা ধরে রাখবি।

আমি বলতাম রাখব।

বড় কিছু করতে হলে বড় কিছু স্বপ্ন দেখতে হয়।

ও।

তোকেও বড় স্বপ্ন দেখতে হবে। বুঝেছিস?

বুঝেছি।

শরীরটাকে ঠিক রাখতে হবে। তোকে নিয়মিত খেলাধুলাও করতে হবে।

ও।

শুধু অংকে ভাল করলে হবে না। সব সাবজেক্টে ভাল করতে হবে।

ও।

সব সাবজেক্ট মন দিয়ে পড়তে হবে।

আচ্ছা।

দেরি করে ঘুমাবি না। ভাল শরীরের জন্যে ঘুম খুব দরকার।

ও।

আর তোর একা একা থাকার অভ্যাস ছাড়তে হবে।

তাই নাকি?

অবশ্যই। ক্লাসের ছেলেমেয়েরা এতো সুইট অথচ তোর কোন বন্ধু নেই।

আমি বললাম, কে বলেছে বন্ধু নাই! তুই আছিস।

আর কে আছে?

আমার আরেকজন বন্ধুর নাম মিচকি।

মিচকি? প্রিয়াংকা ভুরু কুঁচকে বলল, ফাজলামি করবি না।

খোদার কসম। আমি হাসতে হাসতে বললাম, তোর সাথে একদিন। পরিচয় করিয়ে দেবো। ভয় পাবি না তো?

ভয় পাব কেন?

অনেকে ইঁদুরকে ভয় পায় তো!

ইঁদুর? প্রিয়াংকা মুখ বিকৃত করে বলল, ছিঃ! মাগো ঘেন্না!

মিচকি মোটেও সেরকম ইঁদুর না। খুব লক্ষ্মী। প্রত্যেকদিন রাত দশটার সময় আমার কাছে বেড়াতে আসে।

আমি প্রিয়াংকাকে মিচকি সম্পর্কে অনেক ভাল ভাল কথা বলি কিন্তু তাতেও কোন লাভ হয় না, প্রিয়াংকা মুখ বিকৃত করে বলে, ছিঃ! মাগো ঘেন্না!

 

আমি টের পেলাম খুব ধীরে ধীরে আমার একটা পরিবর্তন হলো। আমি নিজেকে খুব খারাপ ভাবতে শুরু করেছিলাম সেটা আস্তে আস্তে পরিবর্তন হতে শুরু করল। আমি পড়াশোনা শেষ করে একজন বড় ম্যাথমেটিশিয়ান হতে পারব সেটাও আজকাল খুব অসম্ভব মনে হয় না। প্রিয়াংকা বড় মানুষের মতো অনেক উপদেশ দেয়, বেশিরভাগ উপদেশই হাস্যকর তবে একটা উপদেশ মনে হয় সত্যি। নিজের ওপরে বিশ্বাস রাখা খুব জরুরি, খুব আস্তে আস্তে মনে হয় আমার নিজের ওপর বিশ্বাস ফিরে আসছে।

যেমন সেদিন সকালে আমি প্রিয়াংকার গণিত বইটাতে একটা সিরিজ খুঁজে পেলাম যেটার যোগফল দুটো ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যা হতে পারে। একভাবে যোগ করলে এক রকম অন্যভাবে যোগ করলে অন্য রকম, আমি ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছি তখন হঠাৎ ভাইয়া আমাকে ডাকতে শুরু করল। আমি উঠে ভাইয়ার ঘরে গেলাম। ভাইয়া কলেজে যাবার জন্যে কাপড় পরছে, আমাকে একটা প্যান্ট ছুড়ে দিয়ে বলল, তপু এই প্যান্টটা আমাকে ইস্ত্রি করে দে দেখি।

আমি মাথা নেড়ে বললাম, না।

ভাইয়া অবাক হয়ে বলল, না? ইস্ত্রি করে দিবি না?

না।

কেন?

আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারি না কিন্তু আজকে কী হলো কে জানে খুব সুন্দরভাবে গুছিয়ে উত্তর দিলাম। একেবারে ঠাণ্ডা গলায় বললাম, তিনটা কারণে। প্রথম কারণ হচ্ছে আমি ব্যস্ত, পড়াশোনা করছি। দ্বিতীয় কারণ প্যান্ট ইস্ত্রি করা এমন কিছু কঠিন না। তোমার নিজের শার্ট-প্যান্ট তুমি নিজে ইস্ত্রি করবে, অন্যকে করে দিতে বলবে না। তৃতীয় কারণ, আমি তোমার ছোট ভাই। তুমি আমাকে বেতন দিয়ে তোমার শার্ট-প্যান্ট ইস্ত্রি করে দেয়ার জন্যে রাখ। নাই।

ভাইয়া বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, প্রথমে অবাক হলো তারপর আস্তে আস্তে রেগে উঠতে লাগলো। দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, তোর বেশি সাহস হয়েছে?

আমি এবারেও একটা ফাটাফাটি উত্তর দিয়ে দিলাম, প্রিয়াংকার সাথে সাথে থেকে আমিও মনে হয় কথা বলা শিখে যাচ্ছি! বললাম, উঁহু। আমার বেশি সাহস হয় নাই, যতটুকু দরকার ঠিক ততটুকু হয়েছে।

ভাইয়া তখন যেটা করবে বলে ভাবছিলাম সেটাই করল, গলা উঁচিয়ে আম্মুকে ডাকল। বলল, আম্মু! তপু আমার প্যান্ট ইস্ত্রি করে দিচ্ছে না!

আম্মু অফিসে যাবার জন্যে রেডি হচ্ছিলেন সেইভাবে ভাইয়ার ঘরে এসে ঢুকলেন। কোন কথা না বলে আমার চুল ধরে হ্যাচকা টান দিয়ে গালে একটা চড় দিলেন, তারপর আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে মারার জন্যে কিছু একটা খুঁজতে লাগলেন। আমার কপাল ভাল ভাইয়ার বেল্টগুলো কাছাকাছি কিছু নেই–টেবিলে তার রুলারটা পেয়ে গেলেন, শক্ত লোহার রুলার কিন্তু সাইজে ছোট বলে মারতে খুব অসুবিধে। সেটা দিয়েই মারতে লাগলেন। আমি সাবধানে থাকার চেষ্টা করলাম তারপরেও একটা মুখে লেগে গেলো এবং আমার ঠোঁটটা কেটে গেল, আম্মু হঠাৎ করে থেমে গেলেন দেখে বুঝতে পারলাম নিশ্চয়ই অনেকখানি কেটেছে। আমার দিকে হিংস্র চোখে তাকিয়ে বললেন, বেশি সাহস হয়েছে তোর?

আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। আম্মু বললেন, এই মুহূর্তে রাজীবের প্যান্ট ইস্ত্রি করে দে।

আমি মাথা নেড়ে ভাইয়ার প্যান্টটা তুলে নিলাম। আম্মুর অফিসের গাড়ি চলে এসেছে বলে আম্মুকে চলে যেতে হলো। আমি খুব যত্ন করে ভাইয়ার প্যান্টটা ইস্ত্রি করলাম, আমার কাটা ঠোঁট থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে, সেগুলো যেন তার প্যান্টে না পড়ে সে ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকলাম। প্যান্টটা ইস্ত্রি করে আমি সেটা দুই হাতে ধরে ভাইয়ার দিকে এগিয়ে দিলাম, ভাইয়া প্যান্টটা হাতে নিয়ে বলল, গাধা কোথাকার, আমার কথা শুনলে তোর এরকম মার খেতে হতো না!

আমি রক্তমাখা মুখে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে হাসলাম, বললাম, কিন্তু তোমার কথা আমি শুনব না! যতবার তোমার প্যান্ট ইস্ত্রি করতে হবে ততবার তোমাকে আম্মুকে দিয়ে আমাকে পিটাতে হবে। বুঝেছ?

ভাইয়া কেমন যেন অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো, আমি একেবারে সোজা তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম, আর কী আশ্চর্য শেষ পর্যন্ত ভাইয়া তার চোখ ফিরিয়ে নিল। আমি দেখলাম তার চোখে আমার জন্যে ঘেন্না আছে সত্যি কিন্তু তার সাথে সাথে সম্পূর্ণ নতুন একটা জিনিস যোগ হয়েছে, সেটা হচ্ছে ভয়। হঠাৎ করে ভাইয়া আমাকে দেখে ভয় পাচ্ছে। কী আশ্চর্য!

মুখে কাটাকাটি থাকলে, মারের চিহ্ন থাকলে আমি সাধারণত এক দুইদিন স্কুলে যাই না কিন্তু আজকে আমি স্কুলে গেলাম। ঠোঁটটা শুধু যে খারাপ ভাবে কেটেছে তা না, বেশ ফুলেও উঠেছে। আমাকে দেখে ছেলে-মেয়েরা ভয় পেয়ে। সরে গেলো, আমি আমার জায়গায় গিয়ে বসলাম। দূর থেকে প্রিয়াংকা আমাকে দেখে এগিয়ে এলো, কছে এসে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোর ঠোঁটটাকে দেখাচ্ছে পাখির ঠোঁটের মতো।

হাসতে গিয়ে আমার ঠোঁটে ব্যথা করে উঠল বলে আমি ঠিক করে হাসতে পারলাম না, বললাম, ফাজলেমি করবি না।

প্রিয়াংকা মাথাটা আরেকটু কাছে এনে বলল, আজকে কী দিয়ে মেরেছেন?

লোহার রুলার।

ইস! প্রিয়াংকার মুখে একটা বেদনার ছায়া পড়ল। একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কেন?

আমি হাসি হাসি মুখে বললাম, কারণ ছিল।

প্রিয়াংকা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোকে দেখে মনে হচ্ছে মার খেয়ে তোর খুব মজা হয়েছে। হাসছিস বোকার মতো।

আমি সাবধানে আমার ফুলে ওঠা ঠোঁটটা একবার ছুঁয়ে বললাম, আসলেই আজকে একটু মজা হয়েছে। আমার ভাইয়া আজকে আমাকে দেখে ভয় পেয়েছে। আমার সারা মুখে রক্ত তখন আমি যখন ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে ভিলেনের মতো হাসলাম তখন তার জান শুকিয়ে গেছে!

প্রিয়াংকা নিশ্চয়ই আমাকে উপদেশ দেওয়া শুরু করতো কিন্তু ঠিক তখন কাছাকাছি আরও কয়েকজন চলে আসায় আর শুরু করতে পারল না।

 

ভাইয়ার সাথে সেই ঘটনা ঘটে যাবার পর থেকে ভাইয়া আর কখনও আমাকে তার শার্ট-প্যান্ট ইস্ত্রি করে দেয়ার কথা বলে না। তাই বলে আমার যে কাজ কমেছে তা নয়। আজকাল মাঝে মাঝেই আমাকে বাথরুম ধুয়ে দিতে হয়। একদিন বাসার সবগুলো বই থেকে ধুলা ঝাড়তে হলো–এই কাজটা অবশ্যি খুব খারাপ না, বসে বসে অনেক দিন পর বইগুলো দেখতে পারলাম। যখন সবকিছু ঠিক ছিল তখন আল্লু আর আম্মু আমাকে অনেক বই কিনে দিতেন, বেশিরভাগ বইয়ে আম্মুর হাতে লেখা সোনামনি তপুকে আম্মু দেখে আমার চোখে হঠাৎ করে পানি এসে যায়। আমার আজকাল দুলি খালাকেও সাহায্য করতে হয়। দুলি খালার যে সাহায্য দরকার তা নয়, আম্মুর ধারণা আমাকে নানা ধরনের কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে। আম্মু যদি ধারেকাছে না থাকেন তাহলে দুলি খালা আমাকে কিছু করতে দেয় না। তবে কিছু কিছু কাজ আমার খারাপ লাগে না, দুলি খালাকে দেখে দেখে আমি মোটামুটি রান্না শিখে গিয়েছি। রান্নাঘরে অবশ্যি অনেক মজার মজার ঘটনা দেখা যায়, যেমন গরম ডেকচিতে এক ফোটা পানি দিলে সেটা সাথে সাথে বাষ্পীভূত না হয়ে রীতিমতো জীবন্ত একটা প্রাণীর মতো ডেকচিতে ছোটাছুটি করতে থাকে। পেঁয়াজ কাটার সময় নাক চেপে ধরে রেখে মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস নিলে চোখে পানি আসে না, একটা ভাতের সাথে দুই ফোটা লেবুর রস মিশিয়ে ভাল করে কচলে একটু লবণ দিলে লবণটা বেগুনি হয়ে যায়–এই রকম নানা ধরনের মজার মজার জিনিস আমি রান্নাঘরেই আবিষ্কার করেছি! দুলি খালাকে আমি বলেছি যে রান্নাঘর আসলে বিরাট একটা ল্যাবরেটরি, সেটা শুনে তার সে কী হাসি।

সবকিছু মিলিয়ে আমার সময়টা এখন আগের থেকে একটু ভাল কারণ আমি মোটামুটি নিয়মিতভাবে পড়াশোনা শুরু করেছি। এই প্রথমবার আমার সবগুলো বই আছে, যেগুলো ছিল না প্রিয়াংকা সেগুলো জোগাড় করে দিয়েছে। শুধু যে বইগুলো জোগাড় করেছে তা না প্রত্যেক দিন আমাকে জিজ্ঞেস করে আমি কী কী পড়েছি। আমার সেটা ভালই লাগে তবে আমি সেটা স্বীকার করি না, ভান করি খুব বিরক্ত হচ্ছি!

 

আমরা গণিত প্রতিযোগিতার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম, স্কুল থেকে কয়েকজনের নাম পাঠানোর পর আর কোন সাড়াশব্দ নেই, তাই আমরা ধরে নিয়েছি এটা আসলে হচ্ছে না। কবিতা আবৃত্তি, ডিবেট কিংবা গানের প্রতিযোগতা হতে পারে। কিন্তু গণিতের প্রতিযোগিতাটা আবার কেমন করে হবে? আর সত্যিই যদি হয় কার মাথা খারাপ হয়েছে কাগজ-কলম নিয়ে সেখানে হাজির হবার?

কিন্তু হঠাৎ করে খবরের কাগজে গণিত প্রতিযোগিতার খবর ছাপা হতে শুরু করল। বিভিন্ন স্কুল থেকে ছেলেমেয়েরা সেখানে আসবে, সারাদিন ধরে প্রতিযোগিতা, বিকেলে বিজয়ীদের পুরস্কার দেওয়া হবে! পৃথিবীতে কতো রকম পাগল যে আছে, যারা এর আয়োজন করছে তাদের নিশ্চয়ই খেয়েদেয়ে আর কোন কাজ নেই!

গণিত প্রতিযোগিতার আগের দিন ক্লাসের শুরুতে প্রিয়াংকাকে দেখা গেল খুব উত্তেজিত, কোন একটা কারণে তার চোখ-মুখ আনন্দে ঝলমল করছে। সে ক্লাসের সামনে দাড়িয়ে চিৎকার করে সবাইকে ডাকতে লাগলো, সবাই শুনো। জরুরি ঘোষণা। জরুরি ঘোষণা।

ক্লাসের অন্য যে কোন ছেলে বা মেয়ে এভাবে জরুরি ঘোষণা দেওয়ার চেষ্টা করলে কেউ তাকে পাত্তা দিতো না। কিন্তু প্রিয়াংকার যে একটু মাথা খারাপ সেটা এতদিনে সবাই জেনে গেছে, তার নানারকম পাগলামীর জন্যে সবাই তাকে নিয়ে একদিক দিয়ে হাসাহাসি করে অন্যদিক দিয়ে পছন্দ করে! সবাই প্রিয়াংকার জরুরি ঘোষণা শোনার জন্যে কাছাকাছি এগিয়ে এলো।

প্রিয়াংকা হাত নেড়ে বলল, গণিত প্রতিযোগিতার কথা তোদের মনে আছে?

বেশিরভাগ ছেলে-মেয়েরাই সেটা নিয়ে মাথা ঘামায় নাই তাই তারা চিক্কার করে বলল, না, মনে নাই।

মনে না থাকলে শোন! আমাদের স্কুলের সব ক্লাস থেকে তিনজনের নাম পাঠানো হয়েছে, মনে আছে?

অনেকেই এবারে মাথা নাড়ল। প্রিয়াংকা বলল, কিন্তু আমাদের ক্লাসে তিনজন থেকে বেশি ছেয়ে-মেয়ে অঙ্কে খুব ভাল। সেইজন্যে আমি ভাবছিলাম আমাদের ক্লাস থকে আরো বেশি ছেলে-মেয়ে পাঠানো দরকার!

ভাল করে প্রিয়াংকার কথা শোনার জন্যে আমি এবারে একটু এগিয়ে গেলাম। প্রিয়াংকা বক্তৃতা দেওয়ার মতো করে হাত-পা নেড়ে বলল, আমি পত্রিকায় এই গর্ণিত প্রতিযোগিতার কমিটির ঠিকানা দেখে তাদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।

আমরা অবাক হয়ে বললাম, সত্যি?

সত্যি। প্রিয়াংকা যুদ্ধ জয়ের ভঙ্গি করে বলল, আমি কমিটির প্রেসিডেন্টকে বলেছি আমাদেরকে আরো বেশি ছেলেমেয়েদের নাম দিতে হবে।

জয়ন্ত জিজ্ঞেস করল, তখন তারা কী বলল?

প্রথমে তারা বলেছে রেজিস্ট্রেশনের সময় পার হয়ে গেছে। কিন্তু আমি তখন ঘ্যান ঘ্যান করতে লাগলাম।

মৌটুসি জিজ্ঞেস করল, কেমন করে ঘ্যান ঘ্যান করলি?

প্রিয়াংকা তখন অভিনয় করে দেখালো সে কেমন করে ঘ্যান ঘ্যান করেছে, দুই হাত জোড় করে মাথা ঝাঁকাতে আঁকাতে কান্না কান্না গলায় নেকু নেকু ভঙ্গিতে বলতে লাগলো, প্লিজ প্লিজ প্লিজ প্লিজ…

তার অভিনয়টা এতো মজার হলো যে দেখে আমরা সবাই হি হি করে হেসে ফেললাম। প্রিয়াংকা নিজেও হেসে ফেলল, বলল, আমার ঘ্যান ঘ্যানানিতে বিরক্ত হয়ে কমিটির প্রেসিডেন্ট বলল, ঠিক আছে, বলো তোমার আর কতোজন দরকার? আমি বললাম চল্লিশজন–সেটা শুনে প্রেসিডেন্টের হার্ট এটাকের মতো অবস্থা! সে বলল, দুইজন আমি বললাম, তিরিশজন সে বলল, তিনজন এইভাবে শেষ পর্যন্ত মুলামুলি করে দশজনে রাজি করিয়েছি! প্রিয়াংকা তখন বিজয়ীর মতো ভঙ্গি করে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়ালো এবং আমরা সবাই হাততালি দিলাম।

মামুন জিজ্ঞেস করলো, কোন দশজন?

আমার তক্ষুণি রেজিস্ট্রেশান করাতে হবে, তাই যার যার নাম মনে এসেছে লিখে দিয়ে এসেছি। পাঁচজন ছেলে আর পাঁচজন মেয়ে। প্রিয়াংকা তার ব্যাগ। থেকে কিছু কাগজ বের করে বলল, এই যে রেজিস্ট্রেশান কার্ড। কালকে কম্পিটিশনের সময় এই কার্ড সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে।

প্রিয়াংকা একজন একজন করে দশজনের নাম পড়ে তাদেরকে কার্ডটা দিয়ে দিল। সে যখন আমার নামটা পড়লো সবাই বিস্ময়ের একটা শব্দ করল, আমার মতো একজন ছেলে যে এরকম প্রতিযোগিতায় যেতে পারে কেউ সেটা বিশ্বাসই করতে পারে না। সবাই ভাবল এটা এক ধরনের রসিকতা, আমিও সেরকম ভান করে কার্ডটা নিলাম। কেউ জানে না, শুধু আমি জানি, আমাকে প্রতিযোগিতায় নেবার জন্যে প্রিয়াংকা এতো পরিশ্রম করেছে। আমি এই মেয়েটাকে যতই দেখছি, ততই অবাক হয়ে যাচ্ছি। এই দশজনের ভিতরে প্রিয়াংকার নিজের নাম নাই কেন শিউলি সেটা জানতে চাইল। প্রিয়াংকা তখন দাঁত বের করে হেসে বলল, অঙ্ক আমি দুই চোখে দেখতে পারি না! সবাই তখন প্রতিবাদের মতো একটা শব্দ করতেই প্রিয়াংকা হাত তুলে সবাইকে শান্ত করে বলল, কিন্তু ভাবিস না আমি ফাকি দেব। আমি কালকে কম্পিটিশনে থাকব ভলান্টিয়ার হিসাবে। প্রিয়াংকা দাত বের করে হেসে বলল, আমার উৎসাহ দেখে কমিটির প্রেসিডেন্ট আমাকে ভলান্টিয়ার বানিয়ে দিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *