০৭. ধর্ম

ক.

মসজিদ থেকে শুক্রবার জুম্মার নামাজ পড়ে এলে পকেটে বাতাসা থাকত নানার। খেজুরের গুড় দিয়ে বানানো হলুদ চাকতি। জুম্মার পর মসজিদে বাতাসার দেওয়ার নিয়ম। পুকুর ঘাটের কাছে নানাকে দেখে বাড়ির ছোটরা, আমি ফেলু মামা, ছটকু ইয়াসমিন নানার কাছে দৌড়ে গিয়ে বাতাসা নিয়ে আসতাম। নানা বাড়ির ছোটদের প্রতি সদয় হলেও বড়দের প্রতি নন। আমাদের বাতাসা বিলিয়ে বাড়ি গিয়ে তিনি বড়দের হাড় মাংস জ্বালাতেন। জ্বালাতেন শব্দটিই নানি ব্যবহার করেন, যখন এই লাডি লইয়া আয়, কেডা কেডা মসজিদে যাস নাই ক। পিডাইয়া শ্যাষ কইরা ফালাইয়াম–বলে বাড়ি মাথায় তুলতেন নানা। ছেলেদের অন্তত জুম্মা পড়তে মসজিদে যেতে হবে, মেয়েদের যেহেতু মসজিদে যাওয়ার বিধান নেই, নামাজ পড়বে ঘরে। মেয়েরা ঘরের বাইরে যাক, ক্ষতি নেই, যেতে হবে বোরখা পরে। নানা জুম্মার দিন খানিকটা আলস্য করেন, এ তাঁর চিরকালের স্বভাব। মসজিদ থেকে বাড়ি ফিরে দুপুরের ভাতঘুমটি দেওয়ার আগে তাঁর হিশেব করা চাই কে কে ফাঁকি দিল, কোন ছেলে মসজিদে যায়নি এবং কোন মেয়ে বাড়িতে নেই, বাইরে সে মেয়ে বোরখা পরে গিয়েছে কি না। এত প্রশ্নে নানি অতিষ্ঠ হতেন। ঘুমিয়ে ওঠার পর নানা আবার ভাল মানুষ। লুঙ্গি কষে বেঁধে ডান হাত লুঙ্গির তলে রেখে বাঁ হাত নেড়ে নেড়ে যেন বাতাস সরাতে সরাতে, হেঁটে চলে যান নতুন বাজার। কে বাড়ি নেই, কে আছে, খোঁজ আর করেন না। বিকেলে রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসলে সাত লোকের সঙ্গে কথা হবে, ওই আকর্ষণ নানাকে আর বাড়িতে রাখে না। এক নানি ছাড়া বাড়ির কোনও বয়ষ্ক মেয়ে স্বেচ্ছায় বোরখা পরেন না। রুনু খালা ঝুনু খালা বোরখা হাত ব্যাগে ভরে বাইরে বেরোন, পুকুরঘাট থেকে ছটকু বা কাউকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন নানা বাড়ি আছেন কি না, নেই জানলে তো ঢুকে গেলেন বাড়ি, আর থাকলে পড়শি কারও বাড়িতে অপেক্ষা করেন, নানা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে খবর পাঠানো হয়, খালারা বাড়ি ঢোকেন; অপেক্ষা না সইলে ব্যাগের বোরখা গায়ে চাপিয়ে আসেন।

নানা এক বড়মামাকেই মাদ্রাসায় পড়িয়েছেন, বাকি ছেলেমেয়েদের ইস্কুল কলেজে। নানার কড়া আদেশ ছিল, অবশ্য কেবল ছেলেদের বেলায়, বিদ্যা অমূল্য ধন, পড়ালেখায় যেন গাফিলতি না হয় কারও। মেয়েদের বেলায় মাইয়া মানষের অত নেকাপড়া করন লাগব না। রুনু খালা বিএ অবদি পড়েছেন, নানা ক’দিন পরপরই তাঁর বিয়ের ঘর আনেন, রুনু খালা মুখে ধুলো কালি মেখে চুল উস্কোখুস্কো বানিয়ে ছেলে পক্ষের সামনে আসেন যেন কারও তাঁকে পছন্দ না হয়। সুলেখার মা প্রায়ই নানির খাটে বসে শাদা পাতা মুখে পুরে বলেন–রুনুরে কি বাড়ির খুঁডি বানাইবাইন? বিয়া দেইন না কেন এহনও? ঈদুন আর ফজলির ত কি সুন্দর বিয়া হইয়া গেল।

নানি পানের খিলি বানাতে বানাতে বলেন–লেহাপড়া আরও করুক। নিজে চাকরি বাকরি করব। বিয়া পরে বইব নে। আইজকাইলকার যুগে মেয়েগোরেও টেকা কামাইতে অইব। জামাইয়ের উপরে নির্ভর থাহন ভালা না, কহন কি অয়, ঠিক আছে!

ঝুনু খালা ফর্সা বলে তাঁর বিয়ের ঘর আসে বেশি। নানি কড়া গলায় বলে দেন– মেয়ে আরও লেহাপড়া করব। এত তাড়াতাড়ি বিয়া কিয়ের! আর বড় বইনের বিয়া না হইলে ছুডু বইনের আবার বিয়া অয় কেমনে!

বড় মামা মাদ্রাসা থেকে ফাজিল পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি ভাষায় এম এ পড়ে ঢাকাতেই একটি চাকরি জুটিয়ে নিয়েছেন। শাদা বউটি তাঁর সঙ্গে থাকেন। আজও কোনও ছেলেপুলে হয়নি। লোকে বলে শাদা হইলে কী হইব, বউ ত বাঁজা। বউএর মাজায় বাঁধার জন্য পাড়ার লোকেরা অনেক তাবিজ কবজ নিয়ে এসে বড় মামাকে দেন। লোক চলে গেলে ওসব তিনি ছুঁড়ে ফেলে দেন কুয়োয়। বড় মামা ছুটিছাটায় বাড়ি আসেন, কখনও বউ নিয়ে, কখনও একাই। এ বাড়িতে এসে তিনি পায়ে খড়ম পরে যখন উঠোনে হাঁটেন, মনে হয় না যে কেবল ক’ সপ্তাহের জন্য তিনি এসেছেন, মনে হয় হাজার বছর ধরে এখানেই ছিলেন তিনি।

হাশেম মামা ইস্কুল কামাই করে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে বেড়াতেন। মেট্রিক পরীক্ষায় দু’তিনবার ফেল দিয়ে আর পড়ালেখা করেননি। ঝুনু খালাকে বড় মামা ঢাকায় নিয়ে ইডেন কলেজে ভর্তি করে দেবেন, এ রকম সিদ্ধান্ত। বাকিরা, ফকরুল, টুটু, শরাফ, ফেলু ইস্কুলের পড়ালেখাও যেমন আধাখেচড়া, নামাজ রোজাতেও। বন্ধু বাড়ছে, আড্ডা বাড়ছে। রাত করে আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফেরেন, বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে টুটু মামা সিগারেট ধরেছেন। নানা সবকটিকে প্রায়ই থামে বেঁধে পেটান। গাধা পিটিয়ে মানুষ করার মত। মানুষ হওয়ার লক্ষণ তবু কারও মধ্যে নেই। পরীক্ষায় ভাল ফল করছেন না কেউ। বড় মামার সঙ্গে পরামর্শ করেন নানি, এদেরও এক এক করে ঢাকায় নিয়ে ইস্কুলে ভর্তি করে দিতে হবে, অন্তত মানুষ হবে।

ছেলেমেয়েরাও না আবার লেখাপড়া না করে বাউন্ডুলে হয়ে যায় এই দুশ্চিন্তায় নানির যখন চুল পাকতে বসেছে, নানা ঘোষণা করলেন তিনি হজ্বে যাবেন। হজ্বে যাওয়ার টেকা পাইবেন কই? নানি ক্ষেপে গেলেন! টেকা আল্লাহই দিব! নানার হেঁয়ালি উত্তর। টাকা শেষ অবদি আল্লাহ দেননি, দিয়েছিলেন বাবা। কথা, নানা হজ্ব থেকে ফিরে এসে সে টাকা শোধ করে দেবেন। বড় এক টিনের সুটকেসে কাপড় চোপড় মুড়িমুড়কি ভরে সুটকেসের গায়ে শাদা কালিতে মোহাম্মদ মনিরুদ্দিন আহমেদ, ঠিকানা আকুয়া মাদ্রাসা কোয়ার্টার, ময়মনসিংহ লিখিয়ে যে বছর নানা জাহাজে করে হজ্বে চলে গেলেন, সে বছরই নীল আর্মস্টং চাঁদে গেলেন। নানা হজ্বে, নীল আর্মস্টং চাঁদে।

চাঁদ নিয়ে বাড়ির সবারই আবেগ প্রচন্ড। বাচ্চা কোলে নিয়ে উঠোনে চাঁদনি রাতে মায়েরা গান করেন আয় আয় চাঁদ মামা, চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা। চাঁদনি নামলে উঠোনে বসে কিচ্ছা শোনা চাই সবার। কানা মামুর কিচ্ছাই, বাড়ির লোকেরা বলে জমে খুব। রুনুখালা গান করেন আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে। ঈদের আগে চাঁদ দেখার ধুম পড়ে, চাঁদ দেখতে পেলে নানি বলেন–আসসালামু আলায়কুম।

সেবারও বলেছেন, আর ঈদের ছুটিতে বাড়ি আসা বড় মামা নানিকে ফস করে বললেন–মা, নীল আর্মস্ট্রং পেশাব কইরা আইছে চান্দে। খ্রিস্টানের পেশাব পড়া চান্দেরে সালাম দেন ক্যা?

ফজলি খালার জ্বিন ছাড়ানো হলে, পেট খারাপ করলে, গায়ে জ্বর জ্বর লাগলে আর মাথাব্যথা হলে বাপের বাড়ি গিয়ে ক’দিন থাকার অনুমতি পান আব্বাজির কাছ থেকে। সেবার ফজলিখালা এসেছিলেন মাথাব্যথার কারণে, বড় মামার মন্তব্য শুনে বললেন– আব্বাজি বলেছেন আসলে চাঁদে কেউ যায়নি। আল্লাহই চাঁদ সূর্য্যর স্রষ্টা। আল্লাহতায়ালা চাঁদ সুর্যকে উদয় করেন, অস্ত যাওয়ান। চাঁদ পবিত্র, চাঁদ দেখে মুসলমান ঈদ করে, রোজা করে। চাঁদে মানুষ গেছে, এসব খিস্টানদের রটনা।

বড় মামা ঠা ঠা করে হেসে বলেন–ফজলি, তরে ত আমি ছোডবেলায় বিজ্ঞান পড়াইছিলাম। পড়াই নাই পৃথিবী কি কইরা সৃষ্টি হইল! সব ভুইলা গেছস?

ফজলিখালা কুয়ো থেকে অযু করার পানি তুলতে তুলতে বললেন–বিজ্ঞানীরা কি আল্লাহর চেয়ে বেশি জ্ঞানী? কি বলতে চাও তুমি মিয়াভাই! আল্লাহ যা বলেছেন তাই সত্য, বাকি সব মিথ্যা।

পানি ভরা বালতি উঠোনে নামিয়ে তিনি আবার বলেন–তরে ত আর জিনে আছড় করে না, করে তর শ্বশুরে!

আমি ঠিক বুঝে পাই না কার কথা সত্য। বড়মামার নাকি ফজলিখালার! এ বাড়িতে দু’পক্ষেরই আদর বেশি। বড়মামা বাড়ি এলে যেমন পোলাও মাংস রান্না হয়, ফজলিখালা এলে তা না হলেও তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোক এলে এলাহি কারবার শুরু হয়। বড়মামাকে যেমন দূরের মানুষ মনে হয়, ফজলিখালাকেও, তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকদের তো আরও। ওঁরা বেড়াতে এলে আমার মত রোদে পোড়া নাক বেয়ে সর্দি ঝরা মেয়ের চলাচলের সীমানা কুয়োর পাড় পর্যন্ত। কুয়োর পাড় ছাড়ালেই নানি বলেন–এইদিকে ঘূরঘুর করিস না। মেমান গেলে পরে আইস। দূরে দাঁড়িয়ে দেখতাম ঘরের বিছানায় তোষক যা গুটিয়ে রাখা হয় দিনের বেলা সেটি পেতে দিয়েছেন নানি, তার ওপর নতুন চাদর, ওতে বসে ফজলিখালার শ্বশুর আর স্বামী খাচ্ছেন। নানি পাকঘর থেকে গরম গরম তরকারি বাটি ভরে দিয়ে আসছেন, ফজলিখালা ঘোমটা লম্বা করে বাটি থেকে তরকারি তুলে দিচ্ছেন ওঁদের পাতে। ওদের খাওয়া শেষ হলে ওঁরা পান চিবোতে চিবোতে বিছানায় গড়াতেন। খেতে বসতেন ফজলিখালা, তাঁর শাশুড়ি, ননদ, মেয়েরা, হুমায়রা, সুফায়রা, মুবাশ্বেরা। নানি খেতেন সবার পরে, মেহমান চলে গেলে, বাড়ির লোকদের খাইয়ে। তখন আমার সীমান্ত খুলে যেত। আমাদের আর নানির উঠোনের মাঝখানে যে কুয়োর বেড়া, তা আমি অনায়াসে ডিঙোতে পারি।

বড়মামা পাকা উঠোনে খড়মের ঠকঠক শব্দ তুলে হাঁটতে হাঁটতে বলেন–ঠিক আছে আল্লাহর কথাই সত্যি, তাইলে আল্লাহ যেমনে কইছেন অমনে চল। তর জামাইয়ে তগোর বাড়ির দাসীর সাথে থাকতে পারব, অসুবিধা নাই। কারণ আল্লাহ কইছে, লা এহেল্লু লাকান্নিসাউ মিন বায়াদু ওলা আল তাবাদাল্লা বিহিন্না মিনা আযোআযেউ ওলাও আয়যাবকা হুসনু হুন্না ইল্লামা মালাকাতু ইয়ামিনুকা। মানে দাসীরা সঙ্গমের জন্য বৈধ। বালতির পানি বালতিতেই থেকে যায়। ফজলিখালার আর অযু করা হয় না, তিনি শব্দ করে পা ফেলে ঘরে ঢুকে আলনা থেকে একটানে বোরখাখানা নিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন। কাঁদলে ফজলিখালার গাল হয়ে যায় পাকা আমের মত লাল। দেখতে বেশ লাগে। পটে আঁকা ছবির মত।

–মা, আমি যাচ্ছি। এই বাড়িতে আর এক মুহূর্ত থাকা সম্ভব না আমার। এত অপমান আমার সহ্য হয় না। ফজলিখালা চেঁচিয়ে বলেন।

নানি শুনে উঠোন থেকে দৌড়ে ঘরে গিয়ে ফজলিখালার হাত থেকে বোরখা ছিনিয়ে বলেন–কান্নাকাটির কি হইছে তর! সিদ্দিকের মুহের লাগাম নাই। দু’একটা আবোল তাবোল কথা কয়। এইল্লিগা তর রওনা হইতে হইব, এই রাইতেবেলা? শ্বশুরবাড়ির মাইনষে খারাপ কইব। যাইবি যা, ঈদটা কইরা যা।

বোরখাখানা নানির হাত থেকে এক ঝটকায় টেনে গায়ে পরতে পরতে ফজলিখালা বলেন–আর এক মুহূর্ত না। আমি কি শখে আসি এখানে। বাড়িতে এত লোকের শব্দে আমার মাথাব্যথা হয়, সে কারণেই তো আসি। এলে যদি ভাইরা অপমান করে, তাহলে আর কেন! ভেবেছিলাম বাপের বাড়িতে ঈদ করব। তাও হল না। হুমায়রার আব্বাকে নিয়ে কথা বলল মিয়াভাই। উনার মত পবিত্র মানুষ দুনিয়াতে আর কজন আছে!

নানি বেঁধে রাখতে পারেন না ফজলিখালাকে। তিনি যাবেনই। হাশেমমামা যান ফজলিখালাকে শ্বশুরবাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে। বাড়িটি থমথম করে সে রাতের জন্য। আমি নীরবে বসে আকাশের চাঁদের দিকে অবাক তাকিয়ে ভাবি কি করে চাঁদে মানুষ গেল, ওই টুকুন ছোট চাঁদে। মা বলতেন চাঁদে এক বুড়ি আছে, চাঁদের বুড়ি, ও বসে চরকা কাটছে। কিন্তু বড়মামা বলেন চাঁদে কোনও বুড়ি টুড়ি নেই, গাছপালা নেই, পানি নেই। চাঁদের দিকে তাকালে ওই যে বুড়ির মত দেখতে, আসলে ও অন্য কিছু, গর্তের ছায়া। চাঁদ যেমনই হোক, চাঁদের সঙ্গে আমার গোপন সখ্য গড়ে ওঠে। আমি যেখানে যাই, আকাশের হেঁটে চাঁদটিও যায় সেখানে। আমি খানাখন্দো হাঁটি, পুকুরঘাটে দাঁড়াই, সেও হাঁটে, দাঁড়ায়। নানির উঠোনে খানিক জিরোই, সেও জিরোয়। শর্মিলাদের বাড়ি থেকে দিব্যি এ বাড়িতে চলে এল।

নানির উঠোন থেকে আমার পেছন পেছন আমাদের উঠোনেও। বাঁশঝাড়ে গেলে ওখানেও।

ঈদের সকালে কলপাড়ে এক এক করে বাড়ির সবাই লাল কসকো সাবান মেখে ঠান্ডা জলে গোসল সারেন। আমাকে নতুন জামা জুতো পরিয়ে দেওয়া হয়, লাল ফিতেয় চুল বেঁধে দেওয়া হয়, গায়ে আতর মেখে কানে আতরের তুলো গুঁজে দেওয়া হয়। বাড়ির ছেলেরা শাদা পাজামা পাঞ্জাবি আর মাথায় টুপি পরে নেন। তাঁদের কানেও আতরের তুলো। সারা বাড়ি সুগন্ধে ছেয়ে যায়। বাড়ির পুরুষদের সঙ্গে আমিও রওনা দিই ঈদের মাঠে। সে কি বিশাল মাঠ! বড় বড় বিছানার চাদর ঘাসে বিছিয়ে নামাজে দাঁড়ান বাবা, দাদা ছোটদা, আর সব মামারা, বড় মামা ছাড়া। মাঠে মানুষ গিজ গিজ করছে। নামাজ শুরু হলে যখন সবাই উবু হন, দাঁড়িয়ে মুগ্ধ চোখে দেখি সেই দৃশ্য। অনেকটা আমাদের ইস্কুলের এসেম্বলিতে পিটি করার মত, উবু হয়ে পায়ের আঙুল ছুঁই যখন, এরকম লাগে হয়ত দেখতে। নামাজ সেরে বাবারা চেনা মানুষের সঙ্গে কোলাকুলি করেন। কোলাকুলি করার নিয়ম কেবল ছেলেদের। বাড়ি ফিরে মা’কে বলেছিলাম চল ঈদের কোলাকুলি করি। মা মাথা নেড়ে বলেছেন মেয়েদের করতে হয় না। ক্যান করতে হয় না? প্রশ্ন করলে বলেছেন নিয়ম নাই। কেন নিয়ম নেই? প্রশ্নটি চুলবুল করে মনে। মাঠে গরু কোরবানি দেওয়ার আয়োজন শুরু হয়। তিন দিন আগের কেনা কালো ষাঁড়টি বাঁধা কড়ইগাছে, কালো চোখ দুটো থেকে জল গড়াচ্ছে। দেখে বুকের ভেতর হু হু করে ওঠে আমার, কী জীবন্ত একটি প্রাণী জাবর কাটছে লেজ নাড়ছে, আর কিছুক্ষণ পরই হয়ে উঠবে বালতি বালতি মাংসের টুকরো। কড়ই গাছের গোড়ায় বসে ছুরি ধারান মসজিদের ইমাম। হাশেম মামা বাঁশ যোগাড় করে আনেন। বাবা পাটি বিছিয়ে দেন উঠোনে, বসে মাংস কাটা হবে। ছুরি ধারিয়ে মাঠ থেকে হাঁক দিলেন ইমাম। এক হাঁকেই হাশেম মামা, বাবা আর পাড়ার কিছু লোক ষাঁড়কে দড়িতে বেঁধে বাঁশে আটকে পায়ে হোঁচট খাইয়ে মাটিতে ফেললেন, ষাঁড় হাম্বা ডেকে কাঁদছিল। মা আর খালারা জানালায় দাঁড়িয়েছেন কোরবানি দেখতে। আনন্দো নাচছে সবার চোখে। লুঙ্গি পরা, গায়ে আতর না মাখা বড় মামা মাঠের এক কোণায় দাঁড়িয়ে বললেন এইভাবে নৃশংস ভাবে একটা বোবা জীবরে মাইরা ফালতাছে, আর মানুষ কি না এইসব দেইখা মজা পায়, আর আল্লাহও নাকি খুশি হয়! দয়া মায়া বলতে কারও কিছু নাই আসলে।

কোরবানির বিভৎসতা থেকে সরে যান বড় মামা। আমি দাঁড়িয়েই থাকি। হাত পা ছুঁড়ে ষাঁড় কাঁদে। সাত সাতটি তাগড়া লোককে ফেলে ষাঁড় উঠে দাঁড়ায়, আবারও তাকে পায়ে হোঁচট খাইয়ে ফেলা হয়। ফেলেই ইমাম তাঁর ধারালো ছুরিটি আল্লাহু আকবর বলে বসিয়ে দেন ষাঁড়ের গলায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে। আধখানা গলা কাটা পড়লেও ষাঁড় হাত পা ছুঁড়ে চিৎকার করে। বুকের ভেতর আমার চিনচিন করে একরকম ব্যথা হতে থাকে। এটুকু দায়িত্বই আমার ছিল, দাঁড়িয়ে কোরবানি দেখা, মা তাই বলেছিলেন, বলেন প্রতি কোরবানির ঈদের সকালে। ইমাম যখন চামড়া ছাড়াচ্ছিলেন, তখনও ষাঁড়ের চোখ ভরা জল। শরাফ মামা আর ফেলু মামা দৃশ্যটির পাশ থেকে মোটে সরতে চান না। আমি চলে যাই মনুমিয়ার দোকানে বাঁশিবেলুন কিনতে। গরুর মাংসর সাতটি ভাগ হয়। তিন ভাগ নানিদের, তিন ভাগ আমাদের, এক ভাগ বিলোনো হয় ভিখিরি আর পাড়া পড়শিদের। ঈদের দিনের মজা এই, বাবা সারাদিনই মোলায়েম স্বরে কথা বলেন, পড়তে বসতে বলেন না, মারধোর করেন না। সারাদিন সেমাই জর্দা খেয়ে, পোলাও কোরমা খেয়ে হৈ হৈ করে বেড়ানো হয়, সাত খুন মাফ সেদিন। সারাদিন মাংস কাটা চলে। বড় বড় চুলোয় বড় বড় পাতিলে গরুর মাংস রান্না হতে থাকে, বিকেলে রান্নাবান্না সেরে গোসল সেরে মা আর নানি ঈদের শাড়ি পরেন। রুনু খালা আর ঝুনু খালা সেজেগুজে ফাঁক খোঁজেন বান্ধবীদের বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার। বাড়িতে অতিথি আসতে থাকে। বড় মামা লুঙ্গি আর পুরোনো এক শার্ট পরে পাড়া ঘুরে এসে বলেন–সারা পাড়া রক্তে ভাইসা গেছে। কতগুলা যে গরু মারা হইল, হিশাব নাই। এই গরুগুলা কৃষকদেরে দিয়া দিলে ত চাষবাস কইরা চলতে পারত। কত কৃষকের গরু নাই। মানুষ এত রাক্ষস কেন, বুঝলাম না। পুরা গরু মাইরা এক পরিবার খাইব গোসত। এইদিকে কত মানুষ ভাতই পায় না।

বড় মামাকে গোসল করে ঈদের জামা কাপড় পরতে তাগাদা দিয়ে লাভ নেই। হাল ছেড়ে নানি বলেন–ঈদ ত করলি না। এল্লা খাইবিও না! খাইয়া ল।

— না খাওয়ার কি আছে, খাওন দেন। গরুর গোসত ছাড়া অইন্য কিছু থাকলে দেন। বড় মামা লম্বা শ্বাস ফেলে বলেন।

চোখে জল জমছিল নানির। বড়মামা কোরবানির ঈদে গরুর মাংস খাবেন না, এ তিনি কি করে সইবেন! নানি আঁচলে চোখ মোছেন এই পণ করে যে তিনিও মাংস ছোঁবেন না। ছেলের মুখে না দিয়ে মায়েরা আবার খায় কি করে কিছু!

বড় মামার মাংস না খাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ল বাড়িতে। শুরু হল বড়দের মধ্যে একধরনের অস্বস্তি। মা আমাদের পাতে খাবার বেড়ে দিতে দিতে বলেন–মিয়াবাই ঈদের গোসত না খাইয়া ঢাকায় ফিইরা যাইব। গরু জবো করা নাকি তার সহ্য হয় নাই। গরুর গোসত যে বাজার থেইকা কিইনা খাওয়া হয়, হেই গোসত কি গরু না মাইরা হয়!

ঈদ শেষ হলে আবার আগের জীবনে ফিরতে হয় আমাকে। শরাফ মামা আমার সামনের সারিতে দাঁত নেই বলে গায়ে খোঁচা মেরে বলতে থাকেন–

দাঁত পড়া আনারস
গু খায় তিন কলস।

দাঁত পড়লে মা ইঁদুরের গর্তে সে দাঁত ফেলে বলেছেন–

ইন্দুর রে ইন্দুর
আমার পঁচা দাঁত নে,
তর সুন্দর দাঁত দে।

ইঁদুর তার দাঁত যতদিন আমাকে না দিচ্ছে, ততদিন আমাকে শরাফ মামার দাঁতাল হাসি দেখতে হবে। রুনু খালা অবশ্য বলেন–গু না খাইলে দাঁত উঠে না।

গু দেখলেই আমার বিবমিষা হয়। পায়খানায় বসে নিচের দিকে চাইলেই গু উপচে পড়া চারিটি দেখতে হয়, নীল মাছি ভন ভন করে ওড়ে চারির চারপাশে। নাক মুখ বন্ধ করে যত কম সময় থাকা যায়, থাকি। দাদা অবশ্য পায়খানায় গেলে দু’ ঘন্টার আগে বেরোন না। কী করে যে অত দীর্ঘ সময় ওখানে টিকে থাকেন দাদা! এদিকে বাড়িতে মেথর এলেও নাক চেপে ঘরে বসে থাকি আর থুতু ফেলি উঠোনে। মেথর মাসে একবার এসে চারির গু সরিয়ে নেয়। নানি দিব্যি মেথরের সঙ্গে দরদাম করে পয়সা দেন হাতে। রুনু খালার কথায় আমার রাগ ধরে, গু আবার খাওয়া যায় নাকি! বলেছিলাম–তোমার ত দাঁত আছে। তুমিও কি গু খাইছ রুনু খালা!

রুনু খালা দিব্যি বলে ফেলেন–হ খাইছি। ছুট বেলায়।

শরাফ মামা আমার চেয়ে আরও এক কাঠি ওপরে। ভাতের থালা ফেলে দেন উপুড় করে যদি খেতে বসে দেখেন উঠোনে মুরগি হাগছে বা কেউ উচ্চারণ করছে গু শব্দটি। শরাফ মামা খেতে বসলে একদিন ভাল মানুষের মত বলেছিলাম গু না খাইলে নাকি দাঁত ওঠে না শরাফ মামা, জানো? ব্যস, ছুটে এসে ধুম্মুর করে এক কিল বসালেন পিঠে আর ভাত সুদ্ধ থালা ইটের টুকরোর মত ছুঁড়ে দিলেন উঠোনে।

আমাকে গু খায় তিন কলস বললে আমি শরাফ মামার পিঠে কিল বসাতে পারি না। তিনি আমার বড় বলে। বড়দের গায়ে হাত তুলতে হয় না। বড়রা আমাকে যখন খুশি ন্যাংটো করে সে কথা কাউকে না বলতে বললে সে কথা বলাও যায় না। বড়রাই হয়ত, বড়রা যে কোনও এক মন খারাপ করা বিকেলে কোনও এক সুনসান ঘরে ছোটদের ন্যাংটো করে, বিশ্বাস করবে না। মাঝখান থেকে কিলচড় খেতে হবে আমাকেই। বড়দের কিলচড়কে রুখে দাঁড়ানোও যায় না, মাথা নুয়ে মেনে নিতে হয় বড়রা যা দেন, শাস্তি হলে শাস্তি, সোহাগ হলে সোহাগ। বড়রা যা করেন ভালর জন্যই, বড়রা শিখিয়েছেন। গুণি এসে টুটুমামা আর শরাফ মামার নুনুর আগা কেটে মুসলমানি করিয়ে যাওয়ার পর নতুন লুঙ্গি পরিয়ে ওঁদের বসিয়ে রাখা হয়েছিল ঘরে, হাঁটলে ওঁরা লুঙ্গির সামনেটা আঙুলে উঁচু করে পা ফাঁক করে হাঁটতেন যেন কাঁটা নুনতে ব্যথা না লাগে, দেখে হাসি পেলে দু’জনই কিলোতেন আমাকে। আমার হাসতে মানা, এমনকি ওঁদের লুঙ্গির দিকে, হাঁটার দিকে তাকানোও মানা। বড়রা, চাইলেই এঁকে দিতে পারেন আমার মানা না মানার সীমানা।

সেবার ঈদের ছুটিতে বড় মামা অনেকদিন ছিলেন। প্রায় সারাদিনই শুয়ে শুয়ে বই পড়েছেন, বিকেলে উঠোনে খড়ম পায়ে হেঁটেছেন। কখনও কখনও রাতে বাবার সঙ্গে গল্প করতে এসেছেন আমাদের ঘরে। বড়মামা ধীরে কথা বলেন, চেঁচিয়ে নয়। কারও চেঁচানো শুনলে তিনি জিভে চু চু শব্দ করেন। হাশেমমামা হঠাৎ হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠেন, পইড়া গেলাম পইড়া গেলাম। চিৎকার শুনে বাড়ির সবাই ছুটে এসে দেখেন হাশেম মামার শরীর কুয়োর ভেতরে ঝুলছে। নানি ধমকে বলেন–এই সব্বনাশা খেলা বাদ দে হাশেম। একদিন ঠিকই পইড়া যাইবি!

হাশেম মামা হাসতে হাসতে উঠে আসেন। বড় মামা বোকা চোখে তাকিয়ে থাকেন হাশেম মামার দিকে। হাঁ মুখে শব্দ উঠে আসে–এইটা কি ধরনের খেলা? এই খেলার মজাটা কি বুঝলাম না ত! হাশেম কি পাগল হইয়া গেল নাকি!

হাশেম মামা আরও একটি কাজ করেন, আমাকে বা ফেলু মামাকে মাঝে মাঝেই কুয়োর ভেতর উপুড় করে ধরে বলেন ফালাইয়া দিলাম ফালাইয়া দিলাম। আমার গলা ফাটা চিৎকার শুনে ঘর থেকে লোক বার হয়ে হাশেম মামার কান্ড দেখে। বড় মামা একই রকম বোকা চোখে তাকিয়ে থাকেন।

ফজলিখালা এর মধ্যেই একদিন আসেন, জেনেই আসেন যে বড় মামা বাড়ি আছেন। এসেই, কাউকে কি খবর কেমন আছ বলাটুকুও নেই, বড় মামাকে–তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।

বড় মামা শুনে ফজলিখালার কাঁধে হাত রেখে হেসে বলেন, তর এত রাগ ক্যান? এরম ত আগে আছিলি না! বোরখা টোরখা খুল, ব। তারপর কথা ক।

ফজলিখালা হাতের নাগাল থেকে কাঁধ সরিয়ে বলেন–না, এই বাড়িতে আমি বসতে আসি নাই। যা বলার বলে চলে যাব।

বোরখার মাথাটুকু খুলে খাটে পা ঝুলিয়ে বসে যে কথা বলতে এসেছেন তিনি, বলেন, — তুমি যে সেদিন বললে আল্লাহতায়ালা বলেছেন পুরুষেরা দাসীর সঙ্গে সহবাস করতে পারে। কোন আয়াতে তুমি পেয়েছ! ভুল ভুল। আল্লাহতায়ালা দাসীর কথা বলেননি। কোরানে স্পষ্ট লেখা আছে, ক্রীতদাসীর কথা। ক্রীতদাসীর সঙ্গে সম্পর্ক বৈধ। কিন্তু, এখন তো আর ক্রীতদাসী নেই! আমরা ত আর কাজের লোককে পয়সা দিয়ে কিনে নিই না! বলে তিনি হাসেন। বিজেতার হাসি।

বড় মামা খাটে পা তুলে আসন করে কোলের ওপর বালিশ চেপে বলেন–ও এই কথা! এইডা কুনো জরুরি কথা হইল যে তুই বোরখা খুলবি না, ঠান্ডা হইয়া বইবি না, কথা কইয়াই চইলা যাইবি। তা ক ত দেখি দাসপ্রথা এহন নাই কেন! পারবি কইতে! দাসপ্রথাডা তুলল কে? তর আল্লায়? নাকি তর রসুলে? তুলছে মানুষে, বুঝলি! প্রথাডা মানুষে না তুললে, কী ছ্যাদাব্যাদা কারবার অইত, ক? আর, চিন্তা কর, ক্রীতদাসী হোক দাসী হোক, আল্লাহ কি কইরা এই বিধান দেয় যে ..

কথা শেষ না হতেই ফজলিখালা গলা চড়ান–সেই সময়ের জন্য আল্লাহ লিখেছেন। সেই সময়ে মেয়েদের নিরাপত্তা ছিল না। ক্রীতদাসীর আর কোথায় যাওয়ার জায়গা ছিল না। তাই আল্লাহতায়ালা ..

এবার, ফুললিখালার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বড় মামা বলেন–যদি মনে করস, কোরান সেই সময়ের জন্য লেখা, ভাল কথা। তাইলে কোরান সেই সময়ের জন্যই রাইখ্যা দে, এই সময়ে এইডা লইয়া নাচনের মানে কি! আর আল্লাহ খালি সেই সময়ের কথা কইছেন ক্যান! এইডাও একটা প্রশ্ন। আল্লাহ অতীতের কথা জানেন, ভবিষ্যতের কথা জানেন, সব দেখেন, সব বোঝেন তাইলে ভবিষ্যতে যে দাসপ্রথা থাকব না, এইডা লিখলেন না ক্যান! দুনিয়াতে বিজলিবাত্তি আইব, মোটর গাড়ি, উড়োজাহাজ, রকেট– রকেটে কইরা চাঁদে যাওনের খবরটাও লিখতে পারতেন। এই যুগে যেইডা চলে না, সেইডা লইয়া মাতামাতির কারণডা কি আমি বুঝি না। তগোর ডরটা এট্টু বেশি।

মুখ কালো করে উঠে পড়েন ফজলিখালা। বোরখার মাথাটুকু হাতে নিয়ে বলেন তুমি এত নিচে নেমেছ মিয়াভাই। ছি ছি ছি। তোমার মুখ দেখাও আমার পাপ। নানির চৌচালা ঘর থেকে বেরিয়ে আমাদের শোবার ঘরে এসে–বড়বু এই ঘরে একটু ঘুমাব আমি, খুব মাথা ব্যথা করছে–বলে সটান শুয়ে পড়লেন। মা ফজলিখালার জন্য পাকঘরে রাঁধতে চলে গেলেন। বিরুই চালের ভাতের সঙ্গে কবুতরের রোস্ট।

বাবার সঙ্গে বড় মামার বেশির ভাগ আলাপ হয় জমি নিয়ে। বড় মামা বলেন– ঢাকায় একটা জমি কিইনা ফালাও রজব আলী। সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে। এই দামে পরে আর পাইবা না।

বাবা মাথা নেড়ে বলেন–দেখি দেখি। কিনব।

আমার খুব ইচ্ছে করে বড় মামার কাছে ঢাকার গল্প শুনি। ঢাকা কেমন দেখতে, ওখানে কি কি আছে এসব। কিন্তু তাঁকে লক্ষ করি কখনও তিনি আমার দিকে ফিরে তাকান না। তাঁর রাজকন্যাটি এখন ধুলো কাদায় মিশে আর যে রাজকন্যা নেই, সম্ভবত তাই। তবে একবার, তাও ঢাকা চলে যাওয়ার আগের দিন, তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয় সরাসরি। পায়খানায় যাওয়ার রাস্তায় আরবি লেখা একটি ছেঁড়া কাগজ কুড়িয়ে পেয়ে মা’র কাছে দিচ্ছিলাম। এরকমই নিয়ম, মা বলে দিয়েছেন হরফ চেনার পর থেকেই, যে, এই হরফের কোনও কাগজ মাটিতে পড়ে থাকতে দেখলে, যেহেতু সে কাগজ পবিত্র, কোনও ময়লায় না মেশে, পায়ের তলায় না পড়ে, পানিতে ফেলে দিতে। তাই করি অন্যদিন, টুকিয়ে ওতে চকাশ করে চুমু মেরে নৌকোর মত ভাসিয়ে দিই জলে। পায়খানার রাস্তায় পাওয়া কাগজটি, আমি যে লক্ষ্মী মেয়ে, মাড়িয়ে যাইনি, মা’কে তাই দেখাতে আসা আমার। মা উঠোনের দড়িতে কাপড় নাড়ছিলেন, বললেন আমার হাত বন্ধ, তর বড়মামার হাতে দে। বড় মামা ছেঁড়া টুকরোটি নিয়ে গড়গড় করে পড়ে ফেললেন। শুনে, মা তাকালেন মুগ্ধ চোখে বড়মামার দিকে। আরবি জানা মানেই তো বড় ঈমানদার হওয়া। যদিও বড়মামা শুক্রবারেও জুম্মা পড়তে মসজিদে যান না, ঈদের নামাজেও না। এতে কারও কোনও আপত্তি নেই।

বড় মামা বললেন–কি করবি এই কাগজরে!

মা’র আঁচল ধরে, খানিকটা ভর রেখে, শরীরের না হোক, মনের, বললাম–চুমা দিয়া পুস্কুনিত ফালাইয়া দিয়াম।

বড় মামা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে কাগজটি, বললেন–এই লেখারে চুমা দিতাছস? কি লেখা আছে জানস এতে! লেখা আছে হালার পু, তর মায়েরে চুদি।

মা’র মুখ মুহূর্তে লাল হয়ে গেল শরমে। তাঁর ভেজা কাপড় পড়ে থাকে কাঁধে, দড়িতে নাড়া হয় না। ফুলবাহারি পানি ভরা কলস নিয়ে কলপাড় থেকে যাচ্ছে ঘরের দিকে, থমকে দাঁড়ায়। নানি মরিচ গাছে পানি ঢালছেন, হাত থেকে বদনি পড়ে উঠোন ভিজে যায়। আমি বড় মামার দিকে দু’পা এগিয়ে, চোখে অপার বিস্ময়, বলি–বড় মামা, আরবি না আল্লাহর ভাষা? এই ভাষায় গালিগালাজও লেখা হয়!

বড় মামা খড়ম পায়ে ঠকঠক শব্দে হাঁটেন আর বলেন–হইব না ক্যান! আরবি আরবগোর ভাষা। আরবেরা মদ খায়, খারাপ কাজ করে, মানুষ খুন করে। গালিগালাজ করে। পুরুষ লুকেরা চৌদ্দটা বিয়া করে। কেউ কেউ একশটাও করে।

নানি বলেন–সিদ্দিক থাম ত।

নানির বড় ছেলে, ননীটা ছানাটা খাইয়ে মানুষ করেছেন, মাদ্রসায় পড়া, আরবি জানা, থামেন।

বড়মামার দিকে খুব সন্দোহ-চোখে তাকিয়ে থাকেন মা। তাঁর বিশ্বাস হতে চায় না এই মানুষটির সঙ্গে একদা তিনি বেড়ে উঠেছেন এই বাড়িতে, এই উঠোনে, কড়ইগাছতলায়। ইস্কুল থেকে ফিরে কোনওরকম নাকে মুখে কিছু ভাত দিয়ে দৌড়ে দু’জন চলে যেতেন নাসিরাবাদ মাদ্রাসার পুকুরে। সারা বিকেল সাঁতরে যখন জল থেকে উঠতেন, চোখ লাল। লাল চোখে বাড়ি গেলে নানির মার খেতে হবে এই ভেবে দু’জনে ঘাটের সিঁড়িতে বসে কচুপাতায় মন্ত্র-মত পড়ে চোখে বুলোতেন যেন শাদা হয়। চোখ শাদা করে ভালমানুষ সেজে বাড়ি ফিরতেন। রাস্তায় তখন দু’একটি ঘোড়ার গাড়ি চলত কেবল। গলির মোড়ে এসে মা খানিক দাঁড়াতেন, মোড়ের দোতলা বাড়িতে এক মেমসাহেব থাকতেন, তাঁকে দেখতে। বিকেলে বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে মেমসাহেব হাসতেন, ধবল পা জোড়াও মেমসাহেবের হাসির সঙ্গে হাসত। বড় মামা মা’র ফ্রক ধরে টেনে গলিতে ঢোকাতেন আর বলতেন–ওরা খ্রিস্টান, ওগোর দিকে এত চাইয়া থাকলে আল্লাহ গুনাহ দিব।

বড় মামার লেখাপড়ার জন্য টেবিল চেয়ার এল বাড়িতে, মা’র জন্য এল না। বড়মামার জন্য গোপনে আঙুর আনতেন নানা, কমলা আনতেন। পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে রেখে রেখে ওসব খেতেন তিনি, একটি আঙুরের দানাও মা’কে দেননি কখনও। সেই কুচুটে ছেলেটির বইখাতা, জামা কাপড় গুছিয়ে রাখার দায়িত্ব ছিল মা’র ওপর। টেবিলে কোথাও কালির দাগ পড়ল কি কিছু এদিক ওদিক হল, ধুমধুম কিল বসাতেন মা’র পিঠে। হঠাৎ কখন যে বড় মামা বড় হয়ে গেলেন, বড় হতে হতে আকাশ স্পর্শ করছেন তিনি আর যে মাটিতে ছিলেন মা, সে মাটিতেই রয়ে গেলেন। মা’র আজও ঈর্ষা হয়, কিন্তু ঈর্ষা কি এই মানুষটির প্রতি! মা’র মনে হয়, এ মানুষটিকে, যাকে তিনি মিয়াবাই বলে ডাকেন, আদপেই চেনেন না।

খ.

একাত্তরের যুদ্ধ শেষ হলে মা আবার পীরমুখো হন। পীরের অবশ্য কোথাও পালাতে হয়নি, বহাল তবিয়তে ছিলেন শহরে। দু’চারটে বিহারির সঙ্গে খাতিরও করেছিলেন, ভারত ছেড়ে মুসলমানের দেশ বলেই না এখানে এসেছেন, পাকিস্তান ভেঙে গেলে এ দেশে থাকার তাহলে কি মানে হয়! নওমহলের দশটি বাঙালি বিচ্ছুর বাড়িতে পীরের সম্মতি নিয়ে মুরিদানরা আল্লাহু আকবর বলে আগুন ধরিয়েছেন। পীরসাব ওঁদের পিঠে হাত বুলিয়ে বলেছেন, এতে কোনও দোষ নেই বান্দারা, শত্রুর কবল থেকে এ ইসলাম বাঁচানোর জেহাদ। জেহাদ সম্পর্কে মা’র ধারণা তেমন স্পষ্ট না হলেও যেহেতু তিনি পীরের মুরিদ এবং যেহেতু পীরের কোনও কথা ও কাজ নিয়ে কোনও মুরিদের সংশয় থাকা উচিত নয়, মা কোনও প্রশ্ন করেন না, যে প্রশ্নে পীরের আহত বা বিচলিত হওয়ার কোনওরকম ফাঁক থাকে। মা মাথা পেতে জেহাদ পরবর্তী যে ফতোয়া ঘোষিত হয়, তা মাথা পেতে বরণ করে শাদা থান কাপড় কিনে লম্বা লম্বা সালোয়ার কামিজ বানিয়ে ফেলেন নিজের জন্য। শাড়ি ছেড়ে এখন থেকে তাই পরবেন, পীর আমিরুল্লাহ সাফ সাফ বলে দিয়েছেন–নবীজির পত্নীরা যেরকম পোশাক পরতেন, সেরকম পোশাক পরতে হবে সব মেয়েদের। চুল বড় করা যাবে না। চুল হবে ছেলেদের মেয়েদের, বাবরি ছাট। কাঁচিতে ঘ্যাঁচ করে পাছায় পড়া লম্বা চুল, সে ফিনফিনে হোক, টাসেল বেঁধে ঘন করতেন, কেটে ফেললেন মা। ঘাড় অবদি চুল নিয়ে ঢিলে সালোয়ার কামিজ পরে মাথায় বুকে ওড়না পেঁচালেন। মা’কে দেখে আর মা বলে মনে হয় না। মন খারাপ করে বলি –এইগুলা পরছ ক্যান মা?

মা বলেন–শাড়ি আর পরতাম না। শাড়ি হিন্দুগোর পোশাক। কাফেরের পোশাক। শাড়ি পরলে গুনাহ হইব।

পীরবাড়ি থেকে যে ফতোয়াই জারি হয়, মা মাথা পেতে বরণ করেন। মা ভুলে যান তাঁর ছোটবেলার সই অমলার কথা। ভুলে যান রথের মেলা থেকে খই, খেলনা, আর পুতলা কেনার দিনগুলো, লক্ষ্মী পুজোয় সরস্বতীদের বাড়ি গিয়ে মিষ্টান্ন খাওয়া, সখীদের হাত ধরে পাড়ার পুজোমন্ডপ দেখা। মা ভুলে যান মা’কে না জানিয়ে একা একা আমি পিঠের চুল কেটে ঘাড়ে ওঠালে মা মনের ঝাল মিটিয়ে আমাকে কিলিয়ে বলেছিলেন– কি সুন্দর চুলগুলা কাইটা ভূত বানাইছস। তর চুল আমি তেল পানি দিয়া কী যত্নই না করছিলাম!

সেই মা, চোখের সামনে বদলে গেলেন। খাবার টেবিলে বসে সবাই খাচ্ছে, মা থালায় খাবার বেড়ে টেবিল ছেড়ে মেঝেয় বসে, নয়ত বিছানায়, হাতে থাল, খান। কেন, কী ব্যাপার? মা বলেন–টেবিল চেয়ারে বইসা খাওয়া হারাম। ইহুদি নাছারারা টেবিল চেয়ারে বইসা খায়।

পুরো পাড়ায় দু’তিনঘর মুসলমান, বাকি সব হিন্দু। বারো মাসে তেরো পুজো লেগে থাকে পাড়ায়। হিন্দুরা কালো ফটক পেরিয়ে বাড়ি ঢুকে বেলপাতা চায়, পুজোয় লাগবে বলে। হ্যাঁ বলে দিই, ওরা গাছে উঠে বেলপাতা পেড়ে নেয়। ফটকের ওপর পেঁচিয়ে থাকা মাধবীলতা গাছ থেকে ফুল ছিঁড়ে নেয়। পাতার তলে কেউ কেউ দুটো তিনটে বেলও নেয়। নিক, বেল আমার বড় অপছন্দ। মা বেলের শরবত বানিয়ে মুখের কাছে ধরলে আমি নাক কুঁচকে হাত সরিয়ে দিই মা’র। মা বেলপাতা নিতে আসা অনেকের সঙ্গে ভাবও জমিয়ে ফেলেছিলেন–কি গো মেয়ে, তোমার নাম কি? কোন বাড়িতে থাকো? বাবা কি করে? ভাই বোন কজন? সেই মা পীরবাড়ি গেলেন আর বাড়ির ধারা বদলে ফেললেন। বেলপাতা নিতে আসা পাড়ার হিন্দু ছেলেমেয়েকে দূরদূর করে তাড়িয়ে আমাদের বললেন–পূজার লাইগা আর বেলপাতা দিবি না কাউরে। ওরা কাফের। ওদের পূজায় কিছু দিলে গুনাহ হইব।

আমি মন খারাপ করে বলি–ওদেরে কাফের কও ক্যান? আমি তো চিনি ওদের, ওরা ভাল মানুষ খুব।

মা তসবিহ জপতে জপতে বলেন–যারা মুসলমান না, তারা সব কাফের। হিন্দু বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সব।

মা’র নাগাল থেকে নিজেকে খানিক দূরে রেখে বলি–ধর, একটা বাচ্চা আজকা জন্ম নিল, তার বাবা মা হিন্দু, নয়ত খ্রিস্টান। সে বাচ্চার কোনও হাত ছিল না কোন বাবা মার ঘরে সে জন্মাইব। সে তোমার কিম্বা মসজিদের ইমামের ঘরেও জন্মাইতে পারত। বাচ্চার তো কোনও দোষ নাই, তারে বাবা মা যা শিখাইছে তাই শিখছে, পূজা করতে, কীর্তন গাইতে, গির্জায় যাইতে, এই বাচ্চা কি দোযখে যাইব না কি বেহেসতে!

মা’র ঠোঁট নড়ে, তসবিহ গুনছেন। আমার প্রশ্নের কোনও জবাব দেন না। আমি দু’পা এগিয়ে এসে আবার বলি–কও মা, দোযখে না বেহেসতে?

মা বলেন–সে যদি মুসলমান হয়, ঈমান আনে, তাইলে বেহেসতে। তা না হইলে দোযখে।

— দোযখে? তার কি দোষ? চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করি।

সে যে জন্মাইছে বিধর্মীর ঘরে, মা চিবিয়ে চিবিয়ে বলেন, ওইটাই তার দোষ।

আমি এবার সুযোগ পেয়ে ধনুক গলা থেকে ছুঁড়ে দিই শব্দের তীর–আল্লাহ হও না কইলে কোনও কিছু হয় না, তুমি নিজেই কও। আল্লায় বাচ্চাটারে হওয়াইছেন বিধর্মীর ঘরে। দোষ তো তাইলে আল্লাহর। জানে না বোঝে না বাচ্চারে দোষ দেওয়া ঠিক না।

মা’র যে হাতে তসবিহ ছিল, সে হাতেই খপ করে ধরে আমাকে এক ঝটকায় কাছে এনে চুল মুঠি ধরে হেঁচকা টান লাগিয়ে বলেন–আল্লাহ নিয়া কথা কস! কত বড় সাহস তর! কার কাছে শিখছস এইসব! আর যদি একদিন শুনি আল্লাহ রসুল নিয়া বাজে কথা কইতে, তরে আমি গলা টিইপা মাইরা ফালাইয়াম। আমি জন্ম দিছি, তর মত দুষমনরে আমার মাইরা ফেলার অধিকার আছে। এমন পাপীরে মারলে আমার আরও সওয়াব হইব।

আমি ঠিক বুঝে পাই না আল্লাহ রসুলের কথা আমি মন্দ কি বলেছি। কেবল মা’কে বোঝাতে চেয়েছিলাম একটি শিশুর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই কোন ঘরে সে জন্ম নেবে, কোন ধর্ম সে বরণ করবে। যেহেতু আল্লাহতায়ালাই সিদ্ধান্তটি নেন, দায়িত্বটি তাঁর। আল্লাহর ওপর কোনওরকম জটিল দায়িত্ব দিতে পছন্দ করেন না মা। মা’র অপছন্দোর পরিসর এত দ্রুত বাড়তে থাকে, যে আমি যা কিছুই করি, মা বলেন গুনাহ করছি।

টিউবয়েল থেকে গ্লাসে জল ভরে খাচ্ছি, মা বললেন–খাড়ইয়া পানি খাস ক্যান? খাড়ইয়া পানি খাইলে শয়তানের মুত খাওয়া হয়।

পেশাবখানা থেকে এলে হাত পরীক্ষা করেন ভেজা কি না, না ভেজা থাকলে–মুইতা পানি লইছস? হিন্দুরা মুইতা পানি লয় না। কাফেরের একমাত্র স্থান দোযখ।

পুবের জানালা ঘেসে হাসনুহেনা গাছ, সারারাত ফুল ফুটে সুগন্ধে ভরে থাকে ঘর। জানালার দিকে মাথা রেখে যখনই শুই, মা তেড়ে আসেন–পশ্চিম দিকে পা দিয়া শুইছস ক্যা? জানস না পশ্চিমে কাবা শরিফ? গুনাহ হইব। পশ্চিমে মাথা দিয়া শ।

আমার তখন দিকের ধারণা হয়েছে, পাড়ার পশ্চিম দিকে একটি মন্দিরও আছে জানি। মা’কে বললে মা শয়তানের দোসর বলে গাল দেবেন, পিঠে কিলও হয়ত দেবেন ধুমুর ধুমুর, এই ভয়ে পা সরিয়ে রাখি। বেচারা পা দু’খানা যদিও মক্কার কাবা শরিফ থেকে হাজার মাইল দূরে ছিল, মাঝখানে খাল বিল পাহাড় পর্বত, পায়খানা, পেশাবখানা, মন্দির গির্জা সবই ছিল।

আমি যুক্তি খুঁজে পাই না মা’র ধর্মের। প্রশ্ন করে যে মামুলি উত্তরগুলো মেলে, তা এরকম, আল্লাহ মাটি দিয়ে মানুষ বানিয়েছেন আর আগুন দিয়ে বানিয়েছেন জ্বিন। হাশরের ময়দানে বিচার হবে ইনসান এবং জিনের। জিন কোথায় আছে, আছে বাতাসে বাতাসে, আমরা দেখতে পাই না। আল্লাহ কোথায় আছেন, আল্লাহ হচ্ছেন নূর, আল্লাহকেও দেখতে পাওয়া যায় না, আল্লাহ ওপরে থাকেন, মানে আকাশের কোথাও। আল্লাহ যেখানেই থাকুন সব দেখতে পান, সব শুনতে পান।

আবার শবেবরাতের রাতে রুটি সেমাই রেঁধে সারারাত নামাজ পড়ার আয়োজন করে মা বলেন–আজ আল্লাহ সাত আসমানের নিচে নাইমা আইছেন, এইখান থেইকা ভাল কইরা দেখবেন দুনিয়ায় কারা কি করতাছে।

ফস করে বেরিয়ে যায় মুখ থেকে–মা, সাত আসমানের ওপর থেইকা কি আল্লাহ ভাল দেখতে পারেন না দুনিয়ার মানুষদের? ভাল কইরা দেখতে হইলে কি নিচে আসতে হয়?

মা দাঁতে দাঁত পিষে বলেন–এত প্রশ্ন করতে হয় না। আল্লাহকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করবি। আল্লাহ সর্বশক্তিমান। আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবুদ নাই। আল্লাহ গফুরুর রাহিম। আল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয়।

পীর আমিরুল্লাহকে আমি ঠিক এই বাক্যগুলোই বলতে শুনেছি। মা’কে ময়না পাখির মত মনে হয়। নানিবাড়ির খাঁচায় বসে থাকা ময়না পাখিটি বাড়িতে কেউ ঢুকলেই বলত– মেমান আইছে, খাওন দেও। রুনুখালা শিখিয়েছিলেন বলতে। ব্যস, শিখে অবদি ময়না নিজের বুলি ভুলে, কেবল তা আওড়াত।

পীরবাড়ি থেকে মা যা শিখে আসেন, কেবল যে আওড়ান তা, তা নয়, আমার ওপর, বিশেষ করে আমারই ওপর, তার বিরামহীম চর্চা চলে। আমাকে সংক্রামিত করতে মা মরিয়া হয়ে ওঠেন, যদিও সময় সময় বলেন–তরা নিজের পথ নিজে দেখ। আমার নছিহত করার আমি করছি। হাশরের মাঠে আল্লাহ তগোরে জিগাস করবেন তোমাদেরে কেউ কি জানাইছিল আমার কথা, তখন না করতে পারবি? আসলে আল্লাহ রসুলের কথা আমি যে বলি, তা আল্লাহ আমারে দিয়া তগোরে বলাইতাছেন। আমি উছিলা মাত্র।

ভেতরের ঘরে বসে মা এবং বারান্দায় বসে সুলতান ওস্তাদজী আমাকে কলেমা শিখেয়েছিলেন, কতটুকু তার মনে রেখেছি, মাঝে মাঝেই ঝালাই করেন মা, নছিহত করার উছিলা হয়ে, বেশ মোলায়েম স্বরে–কলেমা এ তৈয়বটা কও তো মা!

আমি ফটাফট বলে দিই–লা ইলাহা ইল্লালল্লাহু মহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।

শেষ হতে না হতেই মা আবার–কলেমা শাহাদাৎ?

–আশহাদু আন লাইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকালাহু ওয়া আশহাদু আন্না মহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু।

নির্বিকার, যেন আওড়াচ্ছি ফুল পড়ে পাতা নড়ে, যে আমি ফুলও চিনি না, পাতাও না।

মা’র মুখে হাসি ফোটে। প্রসারিত ঠোঁট সংকুচিত হতে মা’র সময় নেয়নি যেদিন বলেছিলাম–তুমি যে বল আল্লাহ মাটি দিয়া মানুষ বানাইছে। মা শুধরে দিয়েছিলেন–বানাইছে না বানাইছেন।

–বানাইছেন, তাইলে আমগোর শইলে মাটি কই! আছে চামড়া, চামড়ার তলে মাংস, মাংসের তলে হাড্ডি!

মা তাঁর কালো ঠোঁট আরও কালো করে আনেন কুঁচকে, মোলায়েম স্বর মিলিয়ে গিয়ে ঝাঁজ কেবল–আল্লাহর মাটি কি ভাবছস যেই সেই মাটি! দুনিয়ার মাটি?

শরাফ মামা প্রায়ই গায়ের চামড়ার ওপর নখের আঁচড় কেটে শাদা দাগ করে বলতেন –এইযে দেখ মাটি। আল্লাহ আমগোরে মাটি দিয়া বানাইছে।

আমি খানিকটা দমে যাই, হবে হয়ত, আল্লাহর মাটি যে দুনিয়ার মাটির মত, এর কোনও মানে নেই। সাত আসমানের ওপর হয়ত অন্যরকম মাটি পাওয়া যায়। আমাকে গালে হাত দিয়ে ভাবতে দেখে মা বলেন–আল্লাহর কুদরতের কোনও সীমা নাই। সবর করবি আল্লাহর কাছে। এই যে ধর ডাবের মধ্যে, খানিক থেমে, উঠোনে নারকেল গাছগুলোর দিকে বিহ্বল-চোখে তাকিয়ে আবার শুরু করেন–আল্লাহ কি সুস্বাদু পানি দিছেন। মানুষের শক্তি আছে ডাবের মধ্যে পানি দিতে? উখের কথা ধর, আল্লাহর কি কুদরত, লাডির মধ্যে শরবত!

মা’র মুগ্ধ দৃষ্টি নারকেল গাছ ছাড়িয়ে উঠোনের আরও গাছের ওপর ছড়িয়ে যায়।

— তারপর হইল গিয়া কাঁঠাল, কেমনে কোয়া কোয়া কইরা আল্লাহ বসাইয়া দিছেন! কোন মানুষের শক্তি আছে কাঁঠাল বানাইতে! আল্লাহর কাছে সবর কর। এত ফলফলান্তি দিছেন বান্দাদের খাইতে।

ডালিম গাছের ওপর চোখ ফেলে–ডালিমের কথাই ধর। কী কইরা দানাগুলার মধ্যে আল্লাহ চিনি ভইরা দিছেন! আল্লাহ ছাড়া কার ক্ষমতা আছে বানানির!

আমাকে কাবু করে ফেলে মা’র বর্ণনা। কাবু হলে মা স্থির হন। দু’চোখে মমতা উপচে ওঠে।

কালো বোরখায় সারা শরীর ঢেকে মা রওনা হচ্ছিলেন পীরবাড়িতে, হঠাৎই, মা’র এক পা যখন সিঁড়িতে, আরেক পা মাঠে, বলি–মা, মেয়েদের বোরখা পরতে হয় কেন?

মা বলেন, মা’র চোখে সুর্মা, মাঠের পা’টিকে সিঁড়িতে ফের উঠিয়ে–আব্রু রক্ষা করার লাইগ্যা। আল্লাহ কইছেন মেয়েদের শরীর যেন বাইরের মানষে না দেখে। দেখলে গুনাহ হইব।

সিঁড়ির দু’ধাপ নেমে এসে প্রশ্ন করি–আল্লাহ ছেলেদের বোরখা পরতে কন নাই ক্যান? তাদের শরীল যদি বাইরের মানষে দেখে?

মা’র ছাইরঙা চোখদুটো উনুনের মত জ্বলে ওঠে–আল্লাহ যা আদেশ করছেন তাই মানতে হইব। ছেলেদের বোরখা পরার আদেশ করেন নাই, মেয়েদের বোরখা পরতে কইছেন। মুখ বুইজা মানতে হইব আল্লাহর আদেশ। প্রশ্ন করলে গুনাহ হইব।

গুনাহ গুনাহ গুনাহ। তিন ধাপ পিছিয়ে দাঁড়াই। ডানে ফিরলে গুনাহ। বামে ঘুরলে গুনাহ। প্রশ্ন করলে গুনাহ। গুনাহ করলে আল্লাহ দোযখে ছুঁড়বেন। দোযখে সাপে কামড়াবে, বিচ্ছু কামড়াবে। সাপ বিচ্ছুকে আমার ভীষণ ভয়। কিন্তু ওদিকে যে ইস্কুলে অঙ্কের মাস্টার অঙ্ক একটি বোর্ডে লিখেই বলেন কোনও প্রশ্ন থাকলে কর। প্রশ্ন যে করে না, সে অঙ্ক বোঝে না।

যাক্কুম গাছের ফল খাওয়াবেন আল্লাহ, সে এক ভয়ংকর জিনিস, খেলে পেটের নাড়িভুড়ি উগলে আসে। নানার মুখে যাক্কুম গাছের নাম আমি প্রথম শুনি।

ও নানা যাক্কুম গাছ কি রকম দেখতে!

খালি কাঁটা! কাঁটার উপরে কাঁটা! নানা গা ঝাঁকুনি দেন ভয়ে।

ফণিমনসার মত! সম্ভবত।

আমার মনে হত নানা বোধহয় জীবনে একবার হলেও খেয়ে দেখেছেন যাক্কুম ফল। তিনি আর দ্বিতীয়বার এর ধারে কাছে যেতে চান না, এমন বিস্বাদ।

হজ্ব থেকে ফিরে এসে অবদি আর দোযখের নয়, বেহেসতের খাবারের বর্ণনা দিতে শুরু করেছেন নানা। চোখ বুজে, যেন তাঁর সামনে বেহেসতর খানা সাজানো, মুখে স্মিত হাসি, বলেন আহা বেহেসতে এমন খানা, একবার খাইলে ঢেক একটা আইব তো মেসকাম্বর। দেখে মনে হয় বেহেসতের সুস্বাদূ খানা খাবার লোভে নানা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পরেন, খাবারের পর সুগন্ধী ঢেঁকুরটির জন্যও। নানা যেদিন হজ্ব থেকে ফিরলেন, তাঁকে ঘিরে গোল হয়ে বসেছিল বাড়ির সবাই, যেন নানা ফিরেছেন স্বয়ং আল্লাহর সঙ্গে মোলাকাত করে। নানা কখনও কেঁদে কখনও হেসে বলছিলেন কি করে তিনি কাবার চারদিকে ঘুরেছেন, হযরে আসওয়াদ নামের কালো পাথরে চুমু খেয়েছেন, লোকের পাপ শুষে নিয়ে পাথরটি কালো বর্ণ হয়ে গেছে, জুতো ছুঁড়ে মেরেছেন পাহাড়ে, মাথা ন্যাড়া করেছেন, সেলাই ছাড়া কাপড় পরেছেন। হযরতের রওজা মোবারক জিয়ারত করেছেন। নানাকে দেখতে পড়শিরাও ভিড় করেছিল, পড়শিদের মধ্য থেকে সুলেখার মা বললেন–আহা একবার হজ্বে গেলে মানষের সব গুনাহ মাপ হইয়া যায়। আপনের কপাল ভাল।

আমি পা ছড়িয়ে মেঝেয় বসা পুঁচকে, বড়দের কথার মধ্যে নাক গলিয়ে বলি–যারা খারাপ কাজ করে, মানুষ খুন করে, যে পুলিশগুলা মিন্টুরে মাইরা ফেলছে গুলি কইরা, সবার গুনাহ মাপ কইরা দেন আল্লাহ?

নানা পুঁচকের প্রশ্নের উত্তরে বলেন–হ। সব গুনাহ।

মা বলতেন গুনাহ অনেক রকম। কবিরা গুনাহ সবচেয়ে খারাপ। এই গুনাহর কোনও মাপ নাই।

— কবিরা গুনাও? জিজ্ঞেস করি।

নানা এবার আর পুঁচকেকে উত্তর দেন না। নানাকে ঘিরে থাকা বৃত্ত থেকে উঠে পুঁচকের বাহু ধরে টেনে কলপাড়ে নিয়ে অখুশি মা ফুলবাহারি বালতিতে পানি ভইরা রাখছে কহন, গুসল কর, বলেন।

বালতি থেকে লোটা ভরে ঠান্ডা টিউবয়েলের পানি মাথায় ঢালতে থাকি, এখানে দাঁড়িয়েই বাড়ির ছেলে বুড়ো নাতির গোসল সারতে হয়। নানি আর তাঁর ডাঙর মেয়েরা করেন গোসলখানায়, ওটি আবার পেশাবখানাও। মাথার ওপর খোলা, সাড়ে তিনখানা দেয়াল, আধখানায় পর্দা ঝুলিয়ে দেওয়া। আমাদের উঠোনের এক কিনারেও এরকম একটি মাথা খোলা দরজা ফরজা নেই গোসলপেশাবখানা আছে, মুতের হলুদ দাগ পড়ে গেছে মেঝেয়। টিউবয়েল নানির উঠোনে বলে এখানেই আমরা গোসল সারি। বাবা অবশ্য দাগ পড়া গোসলখানায় সারেন। খুব ভোরে ফুলবাহারি বালতি ভরে দিয়ে আসে পানি। বেশিদিন হয়নি নানির উঠোনে টিউবয়েল বসেছে, আগে কাপড় ধোয়ার, গোসল করার এমনকি খাওয়ার পানিও কুয়ো থেকে নেওয়া হত। রাস্তায় সরকারি কল বসলে সেই কল থেকে কাজের বেটি পাঠিয়ে কলসি ভরে খাওয়ার পানি নিয়ে আসা হত। মা যখন ছোট, খাওয়া হত পুকুরের পানি, পুকুরে তখন গোসল করা, কাপড় ধোয়া ছিল নিষেধ। মা’র আমলের আর আমার আমলের দিনের মধ্যে বিস্তর তফাৎ, মনে মনে ভাবি। কলপারে বসে গোসল করতে করতে, গায়ে গন্ধ-সাবান মাখতে মাখতে সাবানের গন্ধের চেয়ে নাকে লাগে কাঁঠালের গন্ধ। নানির গাছে কাঁঠাল পাকছে গরমে। কাঠাঁলের গন্ধে আমার গলার ভেতরে সুরসুর করে চলে যায় পিচ্ছিল কিছু। প্রথম কাঁঠাল খেতে গিয়ে গলায় আমার আটকে গিয়েছিল রসালো কোয়া, ওয়াক করে আধ গেলা কোয়া ফিরিয়ে এনেছিলাম। এরপর থেকে মা কাঁঠাল চিপে রস বানিয়ে দুধ মুড়ির সঙ্গে খেতে দেন, ওতে গলায় আটকায় না ঠিক, কিনতু গন্ধ সয় না আমার। মা বলেন, এক হাতে নাক চিইপা ধর, আরেক হাতে খা। শুনে হাসি, এ ঠিক খাটা পায়খানায় হাগার মত, চারিতে গু পড়ে, গুএর গন্ধ ঠেকাতে এক হাতে নাক চেপে রাখতে হয়।

গায়ে সাবান মাখতে মাখতে উঠোনে বসে জিভ বের করে হাঁপাতে থাকা কুকুরটিকে বলি–এই কুত্তা, কাডল আর গুএর রঙও ত একরকম, সত্যি না?

কুকুরের লাল জিভখানা বেরিয়েই থাকে, উত্তর নেই। এই কুকুরটির বড় দুর্নাম পাড়ায়। পাকঘরে ঢুকে পাতিলে মুখ দেয়, মাংস মুখে নিয়ে লেজ তুলে দেয় দৌড়। পাড়ার ছেলেরা একে দেখলেই ঢিল ছোঁড়ে।

সাবান মেখে লোটা ভরে পানি নিয়ে গায়ে ঢালি, আর কুকরটিকে বলি–হজ্বে যাইবি? তর সাত খুন মাপ হইব। কবিরা গুনাও।

কুকুরের গায়ে আমার গোসলের পানি ছিটকে পড়ে, সে কোনওরকম ঘেউঘেউএ না গিয়ে ভালমানুষের মত গা ঝেড়ে চলে যায়। ঘরে তখন নানা মক্কা থেকে আনা জমজমের পানি দিচ্ছেন খেতে বৃত্তের প্রত্যেককে। নানি দৌড়ে গেছেন পাকঘরে চিতই পিঠা বানাতে। নানা চিতই পিঠা খেতে বড় ভালবাসেন।

যে মাসে নানা মক্কা থেকে ফিরলেন, সে মাসেই বড়মামা গেলেন বিদেশ, উড়োজাহাজে করে, করাচি। করাচি থেকে ফটো পাঠিয়েছেন ঘোড়ায় চড়া, মাথায় হ্যাট, গায়ে স্যুট। নানি ছবিটি বাঁধিয়ে, টাঙিয়ে রেখেছেন ঘরে, বাঁশের ব্যাংকের পাশে। বিদেশে থাকা ছেলের ফটো দেখতেও পড়শিরা এ বাড়ি আসেন। সুলেখার মা নানির পানের বাটা থেকে পান বানিয়ে মুখে পুরে, এক চিমটি শাদা পাতা আর আঙুলে চুন তুলে জিভে লাগিয়ে, উঠোনে পিচ করে প্রথম পিচকি ফেলে এসে এদিক ওদিক দেখে, ঘরে যখন কেউ নেই, বলেছেন নানির কানের কাছে মুখ নিয়ে, ঘোমটাখানা মাথায় টেনে দিয়ে আরও, ডান হাতের বাকি সব আঙুলে চুনের আঙুল ছাড়া, সেটি খাড়া–সিদ্দিকে শুনি কমুনিস্ট হইছে। বিদেশের চাকরিডাও কমুনিস্টির।

পীরবাড়িতে নিয়মিত যাওয়া শুরু করার আগে মা দোযখের সাপ বিচ্ছুর কথা এত বলতেন না। নামাজও দ্রুত সারতেন, বাড়িতে বাবার ফেরার, দাদার-ছোটদার আসার, পাকঘরে চিনেমাটির থাল ভাঙার শব্দ হলেও মা নামাজের ফরজ পড়ে সুন্নত আর পড়তেন না, জায়নামাজ গুটিয়ে উঠে পড়তেন। আর এখন বাড়িতে তুফান বয়ে গেলেও মা ধ্যানে বসে থাকেন, সুন্নত না পড়লেও চলে কিন্তু মা’র পড়া চাই। মোনাজাত ততক্ষণ করা চাই, যতক্ষণ না মা’র মনে হয় তিনি প্রাণ মন সব ঢেলে দিতে পেরেছেন, এবং আস্থা হয় যে আল্লাহ তাঁর মোনাজাত কবুল করবেন, সাপ বিচ্ছুর কামড় থেকে বাঁচাবেন। সাপ বিচ্ছুর ব্যাপারটি আমার মাথায় কিলবিল করে, দোযখ মানে হচ্ছে বিশাল এক গর্ত, গর্তে আগুন জ্বলছে, সাপ বিচ্ছু কামড়াচ্ছে মানুষদের, আর আল্লাহতায়ালা শাদা মুখ, শাদা দাড়ি, শাদা পাজামা পাঞ্জাবি টুপি পরে ছড়ি হাতে দাঁড়িয়ে দেখছেন ওপর থেকে আর খুশিতে হা হা করে হাসছেন, সিনেমার খারাপ লোকদের মত। এর মধ্যে আমার আবার কুঁচ বরণ কন্যা, বেহুলা, রূপবান সিনেমাগুলো দেখা হয়েছে। মা সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন ক’দিন। ইস্কুল থেকে দেখিয়েছে দর্শন আর কাবুলিওয়ালা। সিনেমায় খারাপ লোকেরা মানুষকে কষ্ট দিয়ে আরাম পায়, দেখেছি। মা’কে সাহস হয় না বলতে যে আল্লাহ নিশ্চয় খারাপ লোক, না হলে মানুষকে কষ্ট দেওয়ার কথা এত বলেন কেন! তবে আঙুলে তুড়ি বাজিয়ে বলি–দোযখে যদি ওঝারা যায়, তাইলে ত সব সাপগুলারে বশ কইরা ফালাইব। সাপ খেলা দেখ নাই? ওঝা যা কয়, সাপ তাই শোনে!

আমি এ সময় বাংলা ইংরেজি বিজ্ঞান পড়া, পরীক্ষায় ভাল নম্বর পেয়ে তরতরিয়ে ক্লাস ডিঙোনো, দাদাদের বালিশের তলে রাখা বড়দের গল্পের বইও গোগ্রাসে পড়ে ফেলা মেয়ে। মা নামাজ পড়তে আদেশ করলে, কলপাড়ে বসে অযু করে, কাপড়ে মাথা ঢেকে, মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে, হাঁটু ভেঙে, বসে, বিড়বিড় করে যা বলতে হয় আরবি ভাষায়, যেহেতু তার অর্থ কখনও বুঝিনি, মা’কে বলি–ইস্কুলে মাস্টাররা বলে না বুইঝা কোনও কিছুই মুখস্ত করতে নাই, গাধা ছাত্রীরা মুখস্তবিদ্যা আওড়ায়, আর ভাল ছাত্রীরা বুইঝা পড়ে, পইড়া নিজের ভাষায় লেখে। ধর, আরবিতে না পইড়া বাংলায় নামাজ পড়লে অসুবিধা কি, আল্লাহ কি বাংলাভাষা জানে না?

মা ফুঁসে উঠে বলেন–এত কথা কইবি না। তুই আমারে আরে জ্বালাইস না। কত আশা ছিল মেয়ে একটা পবিত্র দিনে জন্মাইছে, মেয়ে নামাজ রোজা করব। ঈমানদার হইব।

মা এড়িয়ে যান প্রশ্ন।

তিনি অন্ধকার একলা ঘরে আল্লাহু আল্লাহু বলে ডানে বায়ে মাথা ঝাঁকিয়ে জিকির করতে নামছেন ইদানীং। স্বর আনতে হয় কলব থেকে, গলার স্বরে চলবে না। ঘন্টা পেরিয়ে যাবে, আল্লাহু থামবে না। আল্লাহু চলবেই। আল্লাহু আল্লাহু। সারা ঘর কেঁপে উঠবে শব্দে। ঘরের বেড়াল ভয়ের চোটে এক দৌড়ে পাঁচিলের ওপর গিয়ে বসে থাকবে। সেই অদ্ভুত শব্দে পোষা কুকুর ঘেউ ঘেউ রব তুলবে। মা তবু থামবেন না, কারণ জিকির যাঁরা করেন, তাঁদের কাঁধ থেকে পাখা গজায়, তাঁরা এই জগত থেকে উড়ে আরেক জগতে পৌঁছে যান, সে জগতে কেবল এক আল্লাহ আছেন, আর আছেন জিকিরঅলা, সাত আসমানের ওপর। আল্লাহ তাঁর জিকিরি বান্দার চিবুক উঁচু করে ধরে ঠোঁটে গাঢ় চুমু খান, দেখে বান্দা মুর্ছা যান মুহূর্তে। আল্লাহকে দেখতে আমিরুল্লাহর মত লাগে, কখনও ছোটবেলার জায়গির মাস্টারের মত, কখনও বা লম্বা আলখাল্লা পরা সুলতান ওস্তাদজির মত। মা মাথা ঝাঁকান জোরে, না আল্লাহতায়ালা নওমহলের হুজুর বা অঙ্কের মাস্টার বা সুলতান ওস্তাদজির মত হওয়ার কথা নয়, আল্লাহর কোনও আকার থাকতে নেই, আল্লাহ নিরাকার। আল্লাহ আকার হয়ে যত দেখা দেন, তিনি তত মাথা ঝাঁকিয়ে মনের ভূত তাড়ান। বেড়াল বসেই থাকে পাঁচিলের ওপর।

বাবা, মা’র জিকির করার সময়ে, এক বিকেলে অসময়ে বাড়ি ফিরে, এদিক ওদিক উৎস খুঁজতে খুঁজতে শব্দের, সন্ধান পান।

যে বাবা আমার ঘরে এসে ছাত্রাণাম অধ্যয়নং তপ, সংস্কৃত শ্লোক না আওড়ে তাঁর বাণী শুরু করেন না, তিনি সেদিন বলেন, এক হাত কোমরে, আরেক হাত প্যান্টের পকেটে–তর মা কি পাগল হইয়া গেল নাকি! এইসব কি করে?

আমি রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর বইটি ভুগোল বই মেলে আড়াল করে, চোখ রেখে বঙ্গোপসাগরে, বলি–মা জিকির করতাছে।

— বেহেসতের জন্য মানুষটা বেহুঁশ হইয়া গেছে। সমাজ সংসার ফালাইয়া আল্লাহরে ডাকলে কে কইছে আল্লাহ খুশি হয়? কবি বইলা গেছেন কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর, মানুষের মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতে সূরাসুর।

বাবা আমার পড়ার টেবিলের দিকে দু’পা এগিয়ে আসেন। ওপরের বইখানা দুহাতে চেপে রাখি যেন আবার তলেরটি কোনও ফাঁক ফোকর দিয়ে বাবার চোখে না পড়ে।

–লেখাপড়া মন দিয়া কর। জীবনের এইটাই সম্বল। তোমার সম্বল তুমি আমারে দিয়া দিবা না, তোমারই থাকবে। আমি কষ্ট করে লেখাপড়া করছি, ইস্কুল থেইকা ফিইরা গরু চড়াইতে হইত আমার, রাত্রে কুপি জ্বালাইয়া লেখাপড়া করে ক্লাসে ফার্স্ট হইতাম। তোমাদের যেন কোনও কষ্ট না হয়, সেই ব্যবস্থা আমি করে দিছি। মন দিয়া লেখাপড়া কর, যেন ফার্স্ট হও। বইএর প্রথম পাতা থেইকা শেষ পাতা পর্যন্ত ঠোঁটস্থ কইরা ফালাও।

বাবার বাণীর কোনও উত্তর নেই, নীরবতা ছাড়া।

মা জিকির শেষ করে বেরিয়ে আসেন অন্ধকার থেকে আলোয়। মা’র ফোলা চোখ, ভোঁতা নাক, কালো ঠোঁট, হাড় বেরোনো গাল তৃপ্তিতে হাসে।

বাবার চলে যাওয়ার শব্দ পেয়ে ওপরের ভুগোলকে তলে পাঠিয়ে তলেরটিকে ওপরে নিয়ে আসি। পাঠ্য বইএর বাইরের কোনও বই পড়লে মাও ধমকাতেন আগে। সেদিন ফিরেও তাকালেন না আমি পাঠ্য কি অপাঠ্য পড়ছি। মা’র কাছে দুনিয়াদারির সব বিদ্যাই অপাঠ্য।

মা হাসি মুখে নিয়ে অপ্রকৃতিস্থের মত হেঁটে যান উঠোনের গোলাপ গাছের কাছে, গোলাপে হাত বুলোন। ডালের কাঁটা হাতে ফোঁটে মা’র, ফুঁটুক, কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল বুলোতে! হাত বুলোতে বুলোতে মা’র মুখের হাসি বেড়ে কানের লতি অবদি পৌঁছোয়, দু’গালের হাড়ের ওপর সুপুরির মত গোল হয়ে জমা মাংস। বই থেকে চোখ তুললেই খোলা দরজা, দরজার ওপাশে ছত্রিশ রকম ফুল ফলে ছাওয়া উঠোন, সেই উঠোনে মা আর পাঁচিল থেকে নেমে আসা বেড়াল, গালে মা’র সুপুরি হাসি। গভীর অরণ্যে ধাবমান হরিণের দ্যুতির মত মা’র হাসিটি আমাকে টেনে নেয় গোলাপ গাছের কাছে।

— কি মা, ফুলে হাত বুলাও কেন!

আমার প্রশ্ন শেষ হতে না হতেই মা বলেন–আল্লাহ কি সুন্দর লাল রং দিছেন ফুলের, পাপড়িগুলা কি পাতলা কি নরম, পরতে পরতে পাপড়ি বসানো, এক মাপের, কুনো ছুটো বড় নাই। কী সুন্দর গন্ধ, কোনও মানুষের ক্ষমতা আছে এমন একটা ফুল বানানোর! আল্লাহর যে কত দান!

মা এত বিভোর হয়ে থাকেন ফুলের সৌন্দর্য্য যেন জীবনে প্রথম তিনি কোনও ফুল দেখছেন, ফুলের গন্ধ শুঁকছেন। যেন প্রথম আজ জেনেছেন যে আল্লাহতায়ালার সৃষ্টি এই আসমান ও জমিনের যা কিছু, সব। মা বলেন–একটা ফুলের থেকে আরেক ফুল ভিন্ন, একটা ফুলের থেকে আরেক ফুলের সুবাস ভিন্ন। পাতাগুলা হরেক রকম হরেক গাছে। একটা থেকে আরেকটা ফলের স্বাদ ভিন্ন। কী অসীম ক্ষমতা আল্লাহতায়ালার।

ফুল থেকে চোখ তুলে মা আমার চোখে তাকান কিন্তু আসলে আমাকে তিনি দেখেন না, দেখেন মুখের ডৌলে সৃষ্টিকর্তার ক্ষমতা। মুখ থেকে চোখ যায় আকাশে, সেখানেও ক্ষমতা, মা’র মুখে মিষ্টি হাসি, মা জগত সংসারের অনেক উর্ধে।

সন্ধে হচ্ছে, মা এখন ঘরে যাবেন, আয়াতুল কুরশি পড়ে ফুঁ দেবেন ঘরগুলোয়, এতে বালা মুসিবত দূর হবে। কিন্তু বালা মুসিবত আসলে দূর হবে না। কারণ আকাশে কুন্ডুলি পাকাচ্ছে কালো মেঘ। গুড়ুম গুড়ুম শব্দে এক মেঘ আরেক মেঘকে গুঁতোচ্ছে। ঘুর্ণিঝড় শুরু হয়ে যাবে কিছু জানান না দিয়ে, ছুটে যাওয়া কিশোরীর চুলের মত উড়বে নারকেল গাছের পাতা। জাম গাছের ডাল ভেঙে পড়বে পেয়ারা গাছে, পেয়ারা গাছের ডাল লটকে থাকবে আম গাছে। আমের মুকুল ঝুরঝুর করে ঝরে পড়বে উঠোনে। ঝড়ে কারও বাড়ির টিনের চাল উড়ে এসে পড়বে আমাদের কাঠাল গাছের মাথায়। শেকড় উপড়ে থুবড়ে পড়ে থাকবে আমাদের আতা গাছ, কাঁঠালি চাপার গাছ। মা তখন আল্লাহর দরবারে চিৎকার করবেন আল্লাহ গো এই ঝড় থামাও। জিকির করা, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া মা, রোজা করা, কোরান পড়া মা, ঘাড় অবদি চুল কাটা, নবীজির বিবিদের কায়দায় পোশাক পরা, বেহেসতের টিকিট প্রায় হাতে পাওয়া মা’র কান্না এক আকাশ থেকে দুই আকাশে ওঠে, বড়জোর তিন কি চার আকাশে, সাত আকাশে ওঠার আগেই মা’র কান্না ধপাশ করে পড়বে নিচে, পড়বি পড় ঝড়ের ঘাড়ে। দরজা জানলা সেঁটে, ডাল ভাঙা চাল ভাঙা প্রায় দালান ভাঙা শব্দে কাতর হয়ে আমি, ইয়াসমিন, মণি মা’কে ঘিরে থাকব, মা ওপরঅলার সঙ্গে যোগাযোগ করে কিছু একটা ব্যবস্থা করবেন বলে। মা সশব্দে আওড়াতে থাকবেন–ওয়া ক্বীলা ইয়া আরদুবলায়ী মাআকি ওয়া ইয়াসামাউ আক্বলিয়ী ওয়া গীদাল মাউ ওয়া ক্বদিআল আমরু ওয়াসতাওয়াত আলাল জুদিয়্যি ওয়া ক্বীলা বুদাল্লিল কাওমিজ জালিমীন।

মা, হঠাৎ, অন্তত আমাকে, তাজ্জব করে দিয়ে বলবেন–তর বাবা না জানি কই, নোমানকামাল না জানি কই!

মা’কে আবার সেই আগের মা বলে মনে হবে। স্বামী ছেলেমেয়ের জন্য উতলা, আকুল। যেন ঝড়ে মচকে গেছে মা’র অসংসারি চরিত্র।

কপাল ঠুকে মেঝেয়, যেন সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করছেন মা কালিকে, বলবেন–ওরা যেইখানেই থাক, ওদেরে বাঁচাও আল্লাহ।

ঝড় থামবে আরও পড়ে, আমার মন বলবে এ ঝড় থামাতে মা’র বা আল্লাহ তায়ালার কোনও হাত ছিল না। আমার মন কেন এ কথা বলবে, আমি তার বুঝব না কিছু। আমি হাতড়াব খুঁজতে মনের শরীর, খুঁজে পাব না।

কিন্তু কাল বৈশাখি গেলে, জ্যৈষ্ঠ গেলে, আষাঢ়, শ্রাবণ গেলে, পৌষ মাঘ ফাল্গুন গেলে পাব, চৈত্রে গিয়ে। চৈত্রে গিয়ে মা’র আলমারিতে পাব অনুবাদ কোরানের। পড়ব। কারণ আমার জানার ইচ্ছে ছিল যা পড়ি তার মানে, সুরা ফাতিহা, সুরা নিসা, লাহাব, এখলাসের মানে। আরবির তলে বাংলা, মুখোশের তলে মুখ।

কাঠ ফাটা রোদ বাইরে। সারা পাড়া ঝিমোচ্ছে নিঝুম দুপুরের হাঁটুতে মাথা রেখে। পা ছড়িয়ে রকেট ঘুমোচ্ছে বারান্দায়। গাছগুলোও ঝিমোচ্ছে হাত পা অবশ ফেলে রেখে। মণি ছাদের সিঁড়িতে বেলগাছের ছায়ায় শুয়ে ঘুমোচ্ছে, বালতির ভেজা কাপড় বালতিতে পড়ে আছে, ছাদের দড়িতে নাড়া হয়নি এখনও। আমার এক হাতে তেঁতুলের গুলি, জিভে চাটছি, আরেক হাতে কোরানের তরজমা। পড়তে পড়তে আমার গায়ের রক্ত হিম হয়ে আসে, চাঁদের নিজস্ব আলো আছে! পৃথিবী স্থির হয়ে আছে, পাহাড়গুলো পৃথিবীকে কিলকের মত আটকে রেখেছে, তাই পৃথিবী কোথাও হেলে পড়ছে না। আমি একবার দু’বার তিনবার পড়ি। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়ি। ডান কাতে বাম কাতে মাথা রেখে পড়ি। কিন্তু, পৃথিবী তো স্থির নেই, পৃথিবী ঘুরছে সূর্য্যর চারদিকে।

কোরানে তাহলে ভুল লেখা! নাকি ইস্কুলের বইয়ে যা লেখা, তা ভুল। আমি ধন্দে পড়ি।

মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বলে কিছু নেই তাহলে! পাহাড়ের কারণে কি পৃথিবী হেলে পড়ছে না ডানে বামে! কিন্তু বিজ্ঞান বইয়ে পড়েছি পৃথিবী চব্বিশ ঘন্টায় একবার নিজের কক্ষপথে ঘোরে। পৃথিবী তো হেলছেই তবে!

কে সত্য! বিজ্ঞান না কোরান?

হাতের তেঁতুল হাতেই থাকে। আমি থ হয়ে বসে থাকি মেঝেয় পা ছড়িয়ে, হাঁটুর ওপর খোলা পড়ে থাকে বই। বাইরের লু হাওয়া এসে জানালার নীল পর্দাগুলো ওড়ায়, চুল ওড়ায়, বইয়ের পাতা ওড়ায়।

আমার মনও ওড়ে। উড়তে উড়তে যত দূরে যায় তত তার আকার বাড়ে আর নিজের অস্তিত্বটি হতে থাকে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র। আমি পড়ে থাকি একটি বিন্দুর মত একা, অসহায়, নিষ্পন্দ। ঘুঘুর ডাকে আবার সজাগ হই, চোখের তারা নড়ে। নড়ে নড়ে দেখতে থাকি পুরুষের পাঁজরের একটি হাড় থেকে বানানো হয়েছে তার সঙ্গিনী। মেয়েদের ঘাড়ের একটি হাড় বাঁকা, তাই তারা সিধে কথা বলে না, সিধে পথে চলে না। মেয়েরা হচ্ছে শস্যক্ষেত্র, পুরুষেরা যেমন ইচ্ছে গমন করবে, মেয়েরা স্বামীর অবাধ্য হলে স্বামী তাদের বিছানা থেকে তাড়াবে, তারপর বোঝাবে, তারপরও অবাধ্য হলে পেটাবে। মেয়েরা বাপের সম্পত্তির ভাগ পাবে তিন ভাগের এক ভাগ, পুরুষেরা পাবে দুইভাগ। পুরুষেরা এক দুই তিন করে চারটি বিয়ে করতে পারে। নারীদের সে অধিকার নেই। পুরুষেরা তালাক দিতে পারে কেবল তিনবার তালাক উচ্চারণ করেই। নারীদের অধিকার নেই তালাক দেবার। সাক্ষী দিতে গেলে এক পুরুষ সমান দুই নারী।

চাঁদের নিজস্ব আলো আছে কি নেই, সূর্য ঘুরছে কি থেমে আছে, পৃথিবী থেমে আছে কি ঘুরছে তা আমি না হয় নিজের চোখে দেখিনি, কিন্তু মানুষে মানুষে তফাৎ কেন হবে, নারী এবং পুরুষে! ছোটদা আর আমি পাড়ার এক চিকিৎসাবিদ্যার ছাত্রের জানালায় উঁকি দিয়ে আস্ত একটি নরকঙ্কাল দেখেছিলাম ঘরে ঝুলছে। কঙ্কালটি, ছোটদা বলেছিলেন, মেয়েরও হতে পারে, ছেলেরও। দু’শ ছ’টি হাড় আছে মানুষের শরীরে। ইস্কুল মাস্টাররাও বলেন সে কথা। দাদার ঘাড় আর আমার ঘাড়ে তফাৎ তো কিছু দেখি না! তাঁরটি যেমন সোজা, আমারটিও। তাঁর বরং হাড় ফোটানোর অভ্যেস আছে। হাত পায়ের আঙুল টেনে ফোটান, ঘাড় ধরে হেঁচকা টান দেন ডানে বামে, মটমট করে হাড় ফোটে, পিঠের হাড়ও ফোটান গা মুচড়ে। কেবল নিজের হাড় ফুটিয়ে দাদার মন ভরে না, অন্যের হাড়ও তাঁর ফোটানো চাই। আমাকে ঠেসে ধরে ঘাড়ের হাড় ফুটিয়ে দেন, একই রকম শব্দ হয় হাড় ফোটার। দাদার কিংবা ছোটদার বুকের যতগুলো হাড়, আমারও ততগুলো। বাবার পাঁজরে যতগুলো, মা’র পাঁজরেও। বাবার বুকে তো একটি হাড় কম নেই, যা দিয়ে মা’কে বানানো হয়েছে! এক লোকে যদি চার বিয়ে করে, তার পাঁজর থেকে চারটি হাড় কমে যাবে! আমার বিশ্বাস হতে চায় না। নানা যে হঠাৎ এক মেয়েকে বিয়ে করে বাড়িতে পনেরোদিন রেখেছিলেন, নানার সে সঙ্গিনীকেও কি নানার পাঁজরের হাড় দিয়ে বানানো হয়েছে!

সাক্ষী দিতে হলে দু’জন নারী দরকার হয় কেন যেখানে পুরুষের বেলায় একজন হলেই চলে! নারী কি সত্য কথা বলে না! কেবল পুরুষই কি সত্য বলে! শরাফ মামা কি সত্যবাদী! ঝুনুখালার সোনার দুল শরাফ মামা বলেছিলেন নেননি। সে দুল শেষ অবদি পাওয়া গেছে তাঁর লুঙ্গির গিঁটের ভেতর। ঘুমোচ্ছিলেন, গিঁট আলগা হয়ে বেরিয়ে এসেছিল দুলদুটো। নানি দেখে সরিয়ে রেখেছিলেন। শরাফ মামা ঘুম থেকে উঠেই বাড়ি ছেড়ে পালালেন। তাঁকে খুঁজে পেয়ে মারধোর করা হবে না এই শর্ত দিয়ে ফেরত আনা হয়েছিল বাড়িতে।

বাপের সম্পত্তির বেশির ভাগ পাবে ছেলে, মেয়ে পাবে কম ভাগ, কেন এই অবিচার! এ বাড়িতে দাদার অধিকার আমার চেয়ে এক ভাগ বেশি হওয়ার কারণ কি! দাদাও যেমন সন্তান, আমিও তেমন। তফাতের মধ্যে এই, দাদার নুনু লম্বা, আমার নুনু চ্যাপ্টা। বুদ্ধিসুদ্ধি মা মাঝে মধ্যেই বলেন, নোমানডার এক্কেবারে নাই। তবুও দাদার ভাগে বেশি, কারণ একটিই, তাঁর নুনু। যে কোরানকে চুমু দিয়ে নামাতে হয়, তুলতে হয়, সে কোরানে এমন বৈষম্যের কথা লেখা, আমার বিশ্বাস করতে মন চায় না। কোরান পড়তে আমার ইচ্ছে না হতে পারে, কিন্তু কোরানে মন্দ কথা লেখা আছে এরকম আমার কখনও মনে হয়নি আগে। আল্লাহও তাহলে সমান চোখে দেখেন না মেয়েদের! আল্লাহও তাহলে গেঁতুর বাবার মত, গেঁতুর মা’কে বেদম পেটাতো, গেঁতুর মা তার হুকুম মানে না, তাই। গেঁতুর মার চিৎকারে যেদিন পুরো আকুয়া পাড়া কাঁপছিল, আমি ফেলু মামার পেছন পেছন দৌড়ে, বাঁশঝাড়ের তল দিয়ে গেঁতুর মার উঠোনে থেমেছিলাম। আরও লোকের ভিড় ছিল উঠোনে। হাঁটুর ওপর লুঙ্গি, গা খালি, পা খালি, ঘাম ঝরছে দরদর করে গা বেয়ে ঠান্ডার বাপের গরম জিলিপির দোকানের সামনে দই মাঠা বিক্রি করা কদম ছাটা চুলের হোঁদল কুতকুতে চোখের গেঁতুর বাবার।

হারামজাদি মাগী, শইল্যো তর তেল বাইড়া গেছে, নুন ছাড়া রাইন্ধা থস, আবার কাইজ্যা করস! বলতে বলতে পিঠে পেটে মুখে লাথি মারছে সে গেঁতুর মা’র, চুলোর ভেতর থেকে আগুনজ্বলা খড়ি এনে পেটাচ্ছে সারা গায়ে, ছ্যাঁত ছ্যাঁত করে গেঁতূর মা’র গা পুড়ছে, গেতুঁর মা কাটা মুরগির মত লাফাচ্ছে, উঠোনে ভিড় করা লোকের দু’হাত আড়াআড়ি করে পেটের ওপর রাখা, পিঠের ওপর রাখা, বাহুর শেকলে বাহু বাঁধা। আঙুলের ভেতর আঙুল ঢুকোনো হাত মাথার পেছনে রাখা, মাথার ভর হাতে অথবা হাতের ভর মাথায়। মেয়েদের ডান হাতে ঠোঁট ঢাকা, বাম হাতে কনুই ধরা ডান হাতের, কনুইয়ের ভর বাম হাতে। কারও বাম হাত ঝুলে আছে কাঁধ থেকে, ডান হাতের ভর কোমরে। চোখগুলো হাতের মত অলস নয় কারও, চোখ গিলছে গেঁতুর বাপের গায়ের জোর, গেতুঁর মা’র নাক মুখ মাথা থেকে বেরিয়ে আসা রক্ত। এরপর যে কান্ডটি করেছিল গেতুঁর বাবা দেখে ভিড়ের হাতগুলো মাথা থেকে কোমর থেকে পেট থেকে পিঠ থেকে মুখ থেকে ধীরে ধীরে খসে পড়ে, ঝুলে থাকে, আঙুলগুলো থোড় থেকে বের হওয়া কচি কলার মত। উঠোনের মাঝখানে যুদ্ধ জয়ের মত দাঁড়িয়ে বলেছিল তরে আমি তালাক দিলাম মাগী, এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক, বাইন তালাক।

জবাই করা মুরগি তখন আর নড়ছে না, কাতরাচ্ছে না। চোখগুলো উৎসুক। চোখগুলোয় ক্ষিধে। পরনের কাপড় ছিঁড়ে ত্যানা ত্যানা গেতুঁর মার, রোদে পোড়া উড়ো খুড়ো লাল চুল ধুলো কাদায় মাখা। এক এক করে চোখ সরে যাচ্ছে, হাত সরে যাচ্ছে, পা সরে যাচ্ছে ভিড়ের। শেষ উত্তেজক দৃশ্যের পর বায়োস্কাপের যবনিকা পতন ঘটলে তো তাই হয়। ছোট শনের ঘর, চালের ওপর লতিয়ে ওঠা লাউ শাক, এক চিলতে গোবর জলে লেপা উঠোন, উঠোনে পড়ে থাকা তালাক হয়ে যাওয়া গেঁতুর মা। লোকের চোখের ক্ষিধে মিটেছে। শেষ দৃশ্য পেছনে রেখে লোক সরে যাচ্ছে। ফেলু মামাও সরে যাচ্ছেন, ফেলু মামার পেছন পেছন সরে যাচ্ছি আমি।

সরে যাওয়া লোকের মুখে খই ফুটছে তখন, নুন দিছে না তরহারিত, জামাই চেতব না তো কি করব! বেডিডাও আছিল আস্তা কাইজ্যাকুড়নি, অহন বুঝব মজা! গেতুঁর বাপের খেদমত করে নাই মাগী, হুত্যা থাকছে; উঁচ কপাইল্যা চিরন দাঁতি, রাইত পুহাইলে হারায় পতি। গেতুঁর মা শেষ দৃশ্য থেকে উঠে এসে পুকুর ঘাটে বসে সারাদিন বিনিয়ে বিনিয়ে কেঁদেছে। কেউ আর ভিড় করেনি তাকে দেখতে। কেবল জানালায় থুতনি রেখে আমি তাকিয়ে ছিলাম বর্ষায় জল ভরে উপচে ওঠা পুকুরের দিকে। ঘাটে বসে গেঁতুর মা কাপড় কাচত, গায়ে কাপড় কাচা সাবান মেখে ডুব দিয়ে গোসল সারত, গোসল সেরে ভেজা কাপড়ে সপ সপ করে হেঁটে ঘরে ফিরত, হাতে ঝুলে থাকত জল নিংড়ানো কাচা কাপড়। সেই পুকুর ঘাট খালি পড়ে আছে, গেতুঁর মা আর গেতুঁর বাবার লুঙ্গি গেঞ্জি কাচছে না, গেতুঁর মুতের কাঁথা কাচছে না, পুকুর পুকুরের মত পড়ে আছে একা, খলসে মাছ খলসে মাছের মত, গেঁতুর মা বসে থাকে গেতুঁর মা’র মত নয়, উঁইএর ঢিবির মত।

মা আমাকে ধমকে জানলা থেকে সরান–ছেড়িডার খালি ছুডুলুকের দিকে নজর। নানির বাড়ির সবাই বস্তির মানুষদের ছোটলোক বলে। আর দালানে থাকা মানুষদের বলে বড়লোক। বড়লোকেরা বাড়ি এলে নানির বাড়িতে বড় ঘরের গদিঅলা চেয়ারে বসতে দেওয়া হয়, শেমাই পায়েস রান্না করে গরম গরম খেতে দেওয়া হয় পিরিচে করে, চামচে তুলে তুলে বড়লোকেরা শেমাই পায়েস খায়। পায়েস খেয়ে কাচের গ্লাসে টিউবয়েলের পানি। পানি খেয়ে চিনেমাটির কাপে চা, চায়ের সঙ্গে গ্লুকোস বিস্কুট। ছোটলোকেরা এ বাড়ি এলে মেঝেয় বসে, পিরিচে করে তাদের শেমাই খেতে দেওয়া হয় না, চা বিস্কুটও না।

গেতুঁর মা’কে তালাক দেওয়ার সাতদিনের মাথায় কুতকুত খেলার বয়সী এক মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তোলে ছোটলোক গেঁতুর বাবা। মা শুনে বলেছিলেন–গেঁতুর বাপটা একটা আস্তা শয়তান। গেঁতুর মারে খামাকা তালাক দিল।

ফুলবাহারির জামাইয়ের চার বউ ঘরে। মা বলেন–ফুলবাহারির জামাইডা বড় বদমাইশ। কত্তগুলা বিয়া করছে।

মা বাবাকেও বলেন বাবার নাকি হাড়ে হাড়ে বজ্জাতি, কোনও একদিন রাজিয়া বেগমকে বাবার বিয়ে করার সম্ভাবনা আছে বলে। কিন্তু মা’র এ কেমন আল্লাহর আদেশ নিষেধ মানা! পুরুষকে আল্লাহ অবাধ অধিকার দিয়েছেন যখন ইচ্ছে বউকে তালাক দেওয়ার, যখন ইচ্ছে বিয়ে করার, এক দুই তিন করে চারটে। ওরা তো আল্লাহর বেঁধে দেওয়া নিয়মের মধ্যেই চলছে। মা কি সাহসে ওদের গাল দেন তবে! আল্লাহর আদেশ এ কেমন মাথা পেতে নেওয়া তবে মা’র! মা কি জানেন মা যে নিজেই গুনাহ করছেন! আমার হাঁটুর ওপর পড়ে থাকে বই, লু হাওয়ায় পাতা ওড়ে বইয়ের, জানলার পর্দা ওড়ে, ফিনফিনে চুল ওড়ে। আমার মনে হতে থাকে আমি যক্ষের ধন দেখেছি কারও, গোপনে। গোপনে দেখেছি মোহর ভরা কলসির গলায় পেঁচিয়ে থাকা সাপ। কলসিতে মোহর আছে বলেই জানে লোকে! আসলে কি মোহর, নাকি কলসি খালি। খালি কলসি বাজে বেশি।

3 Comments
Collapse Comments

তোকে জুতা মারার মানুষ নাই. তোর মত মূর্খ পৃথিবীতে নাই

তসলিমা তুমি একজন বিকৃত রুচির মানুষ ।যদি পার তবে জাকির নায়েকের লেকচার দেখো োঅথবা আহমদ দিদারের লেকচার ।অনেক কিছু জানতে পারবে তুমি পুরুষ মানুঁষের খারাম সাইড গুলি শুধু কাউন্ট করেছ ওদের অনেক ভাল ভাল দিকও আছে সেগুলি তোমার চোখে কেন পড়েনা ?

দুই চারজন মানুষ দিয়ে পৃথিবীর সব মানুষকে বিচার করা যায় না কিছু পুরুষ মানুষ সমাজে খারাপ তার মানে এই নয় যে সবাই খারাপ তুমিকি কাজী নজরুলের সেই বিখ্যাত কবিতা পড় নাই যেখানে নারী পুরুষ উভয় মিলে পৃথিবীকে গড়ে তুলেছেন । ধিক তোমায় তুমি সমাজের অভিসাপ তোমার মত জঘন্য মানুষ তোমার বাবা জন্ম দিয়েছেন কারন তোমার বাপ ও তোমার মত নষ্ট চরিত্রহীন ছিলেন I mean like father like son isn’t it true?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *