০৭. দ্রোণপর্ব

দ্রোণপর্ব

॥ দ্রোণাভিষেকপর্বাধ্যায়॥

১। ভীষ্ম-সকাশে কর্ণ

কৌরব ও পাণ্ডব পক্ষীয় ক্ষত্রিয়গণ শরশয্যায় শয়ান ভীষ্মের রক্ষার ব্যবস্থা করে তাঁকে সসম্মানে প্রদক্ষিণ করলেন এবং পরস্পর আলাপের পর পুনর্বার বৈরভাবাপন্ন হয়ে যুদ্ধের জন্য উদ্যোগী হলেন। শ্বাপদসংকুল বনে পালকহীন ছাগ ও মেষের দল যেমন হয়, ভীষ্মের অভাবে কৌরবগণ সেইরূপ উদবিগ্ন হয়ে পড়লেন। তারা বলতে লাগলেন, মহাযশা কর্ণ এবং তার অমাত্য ও বন্ধুগণ দশ দিন যুদ্ধ করনেনি। যিনি অতিরথের দ্বিগুণ সেই কর্ণকে ভীষ্ম সকল ক্ষত্রিয়ের সমক্ষে অর্ধরথ বলে গণনা করেছিলেন। সেজন্য ক্রুদ্ধ হয়ে কর্ণ ভীষ্মকে বলেছিলেন, আপনি জীবিত থাকতে আমি যুদ্ধ করব না; আপনি যদি পাণ্ডবগণকে বধ করতে পারেন তবে আমি যুর্যোধনের অনুমতি নিয়ে বনে যাব; আর যদি পাণ্ডবগণের হস্তে আপনার স্বর্গলাভ হয় তবে আপনি যাদের রথী মনে করেন তাদের সকলকেই আমি বধ করব। এখন ভীষ্ম নিপাতিত হয়েছেন, অথএব কর্ণের যুদ্ধ করবার সময় এসেছে। এই বলে কৌবরগণ কর্ণকে ডাকতে লাগলেন।

সকলকে আশ্বাস দিয়ে কর্ণ বললেন, মহাত্মা ভীষ্ম এই কৌরবগণকে যেমন রক্ষা করতেন আমিও সেইরূপ করব। আমি পাণ্ডবদের যমালয়ে পাঠিয়ে পরম যশস্বী হব, অথবা শক্তহস্তে নিহত হয়ে ভূতলে শয়ন করব।

কর্ণ রণসজ্জায় সজ্জিত হয়ে রথারোহণে ভীষ্মের কাছে এলেন এবং বাষ্পকুলনয়নে অভিবাদন করে কৃতাঞ্জলিপুটে বললেন, ভরতশ্রেষ্ঠ, আমি কর্ণ, আপনি প্রসন্ননয়নে চেয়ে দেখুন, শুভ বাক্য বলুন। সৎকর্মের ফল নিশ্চয় ইহলোকে লভ্য নয়, তাই আপনি ধর্মপরায়ণ বৃদ্ধ হয়েও ভূতলে শয়ন করেছেন। কুরুবীরগণকে বিপৎসাগরে ফেলে আপনি পিতৃলোকে যাচ্ছেন, ক্রুদ্ধ ব্যাঘ্র যেমন মৃগ বিনাশ করে, পাণ্ডবগণ সেইরূপ কৌরবগণকে বিনাশ করবে। আমি অসহিষ্ণু হয়েছি, আপনি অনুমতি দিলে আমি প্রচণ্ডবিক্রমশালী অর্জুনকে অস্ত্রের বলে বধ করতে পারব।

ভীষ্ম বললেন, কর্ণ, সমুদ্র যেমন নদীগণের, ভাস্কর যেমন সকল তেজের, সাধুজন যেমন সত্যের, উর্বরা ভূমি যেমন বীজের, মেঘ যেমন জীবগণের, তুমিও তেমন বান্ধবগণের আশ্রয় হও। আমি প্রসন্নমনে বলছি, তুমি শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ কর, কৌরবগণকে উপদেশ দাও, দুর্যোধনের জয়বিধান কর। দুর্যোধনের ন্যায় তুমিও আমার পৌত্রতুল্য। মনীষিগণ বলেন, সজ্জনের সঙ্গে সজ্জনের যে সম্বন্ধ তা জন্মগত সম্বন্ধের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। কৌরবসৈন্য যেমন দুর্যোধনের, সেইরূপ তোমরাও, এই জ্ঞান করে তাদের রক্ষা কর।

ভীষ্মের চরণে প্রণাম করে কর্ণ সত্বর রণস্থলের অভিমুখে প্রস্থান করলেন।

২। দ্রোণের অভিষেক ও দুর্যোধনকে বরদান

দুর্যোধন কর্ণকে বললেন, বয়স বিক্রম শাস্ত্রজ্ঞান ও যোদ্ধার উপযুক্ত সমস্ত গুণের জন্য ভীষ্ম আমার সেনাপতি হয়েছিলেন। তিনি দশ দিন শত্রুবিনাশ ও আমাদের রক্ষা করে স্বর্গযাত্রায় প্রস্তুত হয়েছেন। এখন তুমি কাকে সেনাপতি করা উচিত মনে কর? কর্ণ বললেন, এখানে যেসকল পুরুষশ্রেষ্ঠ আছেন তারা প্রত্যেকে সেনাপতিত্বের যোগ্য, কিন্তু সকলেই এককালে সেনাপতি হতে পারেন না। এঁরা পরস্পরকে স্পর্ধা করেন, একজনকে সেনাপতি করলে আর সকলে ক্ষুগ্ন হয়ে যুদ্ধে বিরত হবেন। দ্রোণ সকল যোদ্ধার শিক্ষক, স্থবির, মাননীয়, এবং শ্রেষ্ঠ অস্ত্রধর, ইনি ভিন্ন আর কেউ সেনাপতি হতে পারেন না। এমন যোদ্ধা নেই যিনি যুদ্ধে দ্রোণের অনুবর্তী হবেন না।

দুর্যোধন তখনই দ্রোণকে সেনাপতি হবার জন্য অনুরোধ করলেন। দ্রোণ বললেন, রাজা, আমি ষড়ঙ্গ বেদ ও মনুর নীতিশাস্ত্রে অভিজ্ঞ; পাশুপত অস্ত্র ও বিবিধ বাণের প্রয়োগও জানি। তোমার বিজয়কামনায় আমি পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ করব, কিন্তু ধৃষ্টদ্যুম্নকে বধ করব না, কারণ সে আমাকে বধ করবার জন্যই সৃষ্ট হয়েছে। আমি বিপক্ষের সকল সৈন্য বিনষ্ট করব, কিন্তু পাণ্ডবরা আমার সঙ্গে হৃষ্টমনে যুদ্ধ করবেন।

দুর্যোধন দ্রোণাচার্যকে যথাবিধি সেনাপতিত্বে অভিষিক্ত করলেন। দ্রোণ বললেন, রাজা, কুরুশ্রেষ্ঠ গাঙ্গেয় ভীষ্মের পর আমাকে সেনাপতির পদ দিয়ে তুমি আমাকে সম্মানিত করেছ, তার যোগ্য ফল লাভ কর। তুমি অভীষ্ট বর চাও, আজ তোমার কোন্ কামনা পূর্ণ করব বল। দুর্যোধন বললেন, রথিশ্রেষ্ঠ, এই বর দিন যে যুধিষ্ঠিরকে জীবিত অবস্থায় আমার কাছে ধরে আনবেন। দ্রোণ বললেন, যুধিষ্ঠির ধন্য, তুমি তাকে ধরে আনতে বলছ, বধ করতে চাচ্ছ না। আমি তাকে মারব এ বোধ হয় তুমি অসম্ভব মনে কর, অথবা ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের দ্বেষ্টা কেউ নেই তাই তুমি তার জীবনরক্ষা করতে চাও। অথবা পাণ্ডবগণকে জয় করে তুমি তাদের রাজ্যাংশ ফিরিয়ে দিতে ইচ্ছা কর। যুধিষ্ঠির ধন্য, তার জন্ম সফল, অজাতশত্রু নামও সার্থক, কারণ তাকে তুমি স্নেহ কর।

দ্রোণের এই কথা শুনে দুর্যোধন তার হৃদ্গত অভিপ্রায় প্রকাশ করে, ফেললেন, কারণ বৃহস্পতিতুল্য লোকেও মনোভাব গোপন করতে পারেন না। দুর্যোধন বললেন, আচার্য, যুধিষ্ঠিরকে মারলে আমার বিজয়লাভ হবে না, অন্য পাণ্ডবরা আমাদের হত্যা করবে। তাদের যদি একজনও অবশিষ্ট থাকে তবে সে আমাদের নিঃশেষ করবে। কিন্তু যদি সত্যপ্রতিজ্ঞ যুধিষ্ঠিরকে ধরে আনা যায় তবে তাকে পুনর্বার দ্যূতক্রীড়ায় পরাস্ত করলে তাঁর অনুগত ভ্রাতারাও আবার বনে যাবে। এইপ্রকার জয়ই দীর্ঘকাল স্থায়ী হবে, সেজন্য ধর্মরাজকে বধ করতে ইচ্ছা করি না।

দুর্যোধনের কুটিল অভিপ্রায় জেনে বুদ্ধিমান দ্রোণ চিন্তা করে এই বর দিলেন-যুদ্ধকালে অর্জুন যদি যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা না করেন তবে ধরে নিও যে যুধিষ্ঠির আমাদের বশে এসেছেন। বৎস, অর্জুন সুরাসুরেরও অজেয়, তাঁর কাছ থেকে আমি যুধিষ্ঠিরকে হরণ করতে পারব না। অর্জুন আমার শিষ্য, কিন্তু যুবা, পুণ্যবান ও একাগ্রচিত্ত, তিনি ইন্দ্র ও রুদ্রের নিকট অনেক অস্ত্র লাভ করেছেন এবং তোমার প্রতি তার ক্রোধ আছে। তুমি যে উপায়ে পার অর্জুনকে অপসারিত করো, তা হলেই ধর্মরাজ বিজিত হবেন। অর্জুন বিনা যুধিষ্ঠির যদি মুহূর্তকালও যুদ্ধক্ষেত্রে আমার সম্মুখে থাকেন তবে তাকে নিশ্চয় তোমার বশে আনব।

দ্রোণের এই কথা শুনে নির্বোধ ধার্তরাষ্ট্রগণ মনে করলেন যে যুধিষ্ঠির ধরাই পড়েছেন। তারা জানতেন যে দ্রোণ পাণ্ডবদের পক্ষপাতী। তার প্রতিজ্ঞা দৃঢ় করবার জন্য দুর্যোধন দ্রোণের বরদানের সংবাদ সৈন্যগণের মধ্যে ঘোষণা করলেন।

৩। অর্জুনের জয় (একাদশ দিনের যুদ্ধ)

বিশ্বস্ত চরের নিকট সংবাদ পেয়ে যুধিষ্ঠির অর্জুনকে বললেন, তুমি দ্রোণের অভিপ্রায় শুনলে, যাতে তা সফল না হয় তার জন্য যত্ন কর। দ্রোণের প্রতিজ্ঞায় ছিদ্র আছে, আবার সেই ছিদ্র তিনি তোমার উপরেই রেখেছেন। অতএব আজ তুমি আমার কাছে থেকেই যুদ্ধ কর, যেন দুর্যোধনের অভীষ্ট সিদ্ধ না হয়।

অর্জুন বললেন, মহারাজ, দ্রোণকে বধ করা যেমন আমার অকর্তব্য, আপনাকে পরিত্যাগ করাও সেইরূপ। প্রাণ গেলেও আমি দ্রোণের আততায়ী হব না, আপনাকেও ত্যাগ করব না। আমি জীবিত থাকতে দ্রোণ আপনাকে নিগৃহীত করতে পারবেন না।

পাণ্ডব ও কৌরবগণের শিবিরে শঙ্খ ভেরী মৃদঙ্গ প্রভৃতি রণবাদ্য বেজে উঠল, দুই পক্ষের সৈন্যদল ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়ে পরস্পরের সম্মুখে এল। অনন্তর দ্রোণ ও ধৃষ্টদ্যুম্নের মধ্যে তুমুল সংগ্রাম আরম্ভ হল। স্বর্ণময় উজ্জ্বল রথে আরূঢ় হয়ে দ্রোণ তার সৈন্যদলের অগ্রভাগে বিচরণ করতে লাগলেন, তার শরক্ষেপণে পাণ্ডববাহিনী ত্রস্ত হল। যুধিষ্ঠিরপ্রমুখ যোদ্ধারা সকল দিক থেকে দ্রোণের প্রতি ধাবিত হলেন। সহদেব ও শকুনি, দ্রোণাচার্য ও দ্রুপদ, ভীমসেন ও বিবিংশতি, নকুল ও তাঁর মাতুল শল্য, ধৃষ্টকেতু ও কৃপ, সাত্যকি ও কৃতবর্মা, ধৃষ্টদ্যুম্ন ও সুশর্মা, বিরাট ও কর্ণ, শিখণ্ডী ও ভূরিশ্রবা, ঘটোৎকচ ও অলম্বুষ, অভিমন্যু ও বৃহদ্বল—এঁদের মধ্যে ঘোর যুদ্ধ হতে লাগল। অভিমন্যু বৃহলকে রথ থেকে নিপাতিত করে খড়্গ ও চর্ম নিয়ে পিতার মহাশত্রু জয়দ্রথের প্রতি ধাবিত হলেন। জয়দ্রথ পরাস্ত হলে শল্য অভিমন্যুকে আক্রমণ করলেন। শল্যের সারথি নিহত হল , তিনি গদাহস্তে রথ থেকে নামলেন, অভিমন্যুও প্রকাণ্ড গদা নিয়ে শল্যকে বললেন, আসুন আসুন। সেই সময়ে ভীমসেন এসে অভিমন্যুকে নিরস্ত করলেন এবং স্বয়ং শল্যের সঙ্গে গদাযুদ্ধ করতে লাগলেন। দুই গদার সংঘর্ষে অগ্নির উদ্ভব হল , বহুক্ষণ যুদ্ধের পর দুজনেই আহত হয়ে ভূপতিত হলেন। শল্য বিহ্বল হয়ে দ্রুত নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলেন, তখন কৃতবর্মা তাঁকে নিজের রথে তুলে নিয়ে রণভূমি থেকে চ’লে গেলেন। ভীম নিমেষমধ্যে গদাহস্তে উঠে দাঁড়ালেন।

কুরুসৈন্য পরাজিত হচ্ছে দেখে কর্ণপুত্র বৃষসেন রণস্থলে এসে নকুলপুত্র শতানীকের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। দ্রোপদীর অপর পুত্রগণ ভ্রাতা শতানীককে রক্ষা করতে এলেন। পাণ্ডবগণের সঙ্গে পাঞ্চাল কেকয় মৎস্য ও সৃঞ্জয় যোদ্ধগণ অস্ত্র উদ্যত করে উপস্থিত হলেন। কৌরবসৈন্য মর্দিত ও ভগ্ন হচ্ছে দেখে দ্রোণ বললেন, বীরগণ, তোমরা পালিও না। এই বলে তিনি যুধিষ্ঠিরের প্রতি ধাবিত হলেন। যুধিষ্ঠিরের সৈন্যরক্ষক পাঞ্চালবীর কুমার দ্রোণের বক্ষে শরাঘাত করলেন, দ্রোণও পাণ্ডবপক্ষীয় বীরগণের প্রতি শরক্ষেপণ করতে লাগলেন। পাঞ্চালবীর ব্যাঘ্রদত্ত ও সিংহসেন দ্রোণের হস্তে নিহত হলেন। দ্রোণকে যুধিষ্ঠিরের নিকটবর্তী দেখে কৌরবসৈন্যগণ বলতে লাগল, আজ রাজা দুর্যোধন কৃতার্থ হবেন, যুধিষ্ঠির ধরা পড়বেন। এই সময়ে অর্জুন দ্রুতবেগে দ্রোণসৈন্যের প্রতি ধাবিত হয়ে শরজালে সর্বদিক আচ্ছন্ন করলেন। দ্রোণ দুর্যোধন প্রভৃতি যুদ্ধ থেকে বিরত হলেন, শত্রুপক্ষকে এস্ত ও যুদ্ধে অনিচ্ছু দেখে অর্জুনও পাণ্ডবসৈন্যগণকে নিরস্ত করলেন।

॥ সংশপ্তকবধপর্বাধ্যায়॥

৪। সংশপ্তকগণের শপথ

দুই পক্ষের যোদ্ধারা নিজ নিজ শিবিরে ফিরে এলেন। দ্রোণ দুঃখিত ও লজ্জিত হয়ে দুর্যোধনকে বললেন, রাজা, আমি পূর্বেই বলেছি যে ধনঞ্জয় উপস্থিত থাকলে দেবতারাও যুধিষ্ঠিরকে ধরতে পারবেন না। কৃষ্ণার্জুন অজেয়, এ বিষয়ে তুমি সন্দেহ করো না। কোনও উপায়ে অর্জুনকে সরাতে পারলেই যুধিষ্ঠির তোমার বশে আসবেন। কেউ যদি তাৰ্জুনকে যুদ্ধে আহ্বান করে অন্যত্র নিয়ে যায় তবে অর্জুন জয়লাভ না করে কখনই ফিরবেন না, সেই অবকাশে আমি পাণ্ডবসৈন্য ভেদ করে ধৃষ্টদ্যুম্নের সমক্ষেই যুধিষ্ঠিরকে হরণ করব।

দ্রোণাচার্যের কথা শুনে ত্রিগর্তরাজ সুশর্মা ও তার ভ্রাতারা বললেন অকারণে আমাদের অপমান করেন সেজন্য ক্রোধে আমাদের নিদ্রা হয় না। রাজা, যে কার্য আপনার প্রিয় এবং আমাদের যশস্কর তা আমরা করব সরিয়ে নিয়ে গিয়ে বধ করব। আমরা সত্য প্রতিজ্ঞা করছি—পৃথিবী অর্জুনহীন অথবা ত্রিগর্তহীন হবে।

অযুত রথারোহী যোদ্ধার সহিত ত্রিগর্তরাজ সুশর্মা ও তার পাঁচ ভ্রাতা সত্যরথ সত্যবর্মা, সত্যব্রত, সত্যেষু ও সত্যকর্মা, তিন অযুত রথের সহিত মালব ও তুণ্ডিকেরগণ, অযুত রথের সহিত মাবেল্লক ললিথ ও মদ্রকগণ, এবং নানা জনপদ হতে আগত অযুত রথী শপথ গ্রহণে উদ্যোগী হলেন। তারা পৃথক পৃথক অগ্নিতে হোম করে কুশনির্মিত কৌপীন ও বিচিত্র কবচ পরিধান করলেন এবং ঘৃতাক্তদেহে মৌর্বী মেখলা ধারণ করে ব্রাহ্মণগণকে সুবর্ণ ধেনু ও বস্ত্র দান করলেন। তারপর অগ্নি প্রজ্বলিত করে উচ্চস্বরে এই প্রতিজ্ঞা করলেন-

যদি আমরা ধনঞ্জয়কে করে যুদ্ধ থেকে ফিরি, যদি যদি তার নিপীড়নে ভীত হয়ে যুদ্ধে পরাঙ্মুখ হই, তবে মিথ্যাবাদী ব্রহ্মঘাতী মদ্যপ গুরুদারগামী ও পরস্বহারকের যে নরক সেই নরকে আমার যাব; যারা রাজবৃত্তি হরণ করে, শরণাগতকে ত্যাগ করে, প্রার্থীকে হত্যা করে, গৃহদাহ করে, গোহত্যা করে, অন্যের অপকার করে, বেদের বিদ্বেষ করে, ঋতুকালে ভার্ষাকে প্রত্যাখ্যান করে, শ্রাদ্ধদিনে স্ত্রীগমন করে, ন্যস্ত ধন হরণ করে, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে, দুর্বলের সঙ্গে যুদ্ধ করে, এবং নাস্তিক, অগ্নিহোত্রবর্জিত, পিতৃমাতৃত্যাগী ও অন্যবিধ পাপকারিগণ যে নরকে যায়, সেই নরকে আমরা যাব। আর, যদি আমার যুদ্ধে দুষ্কর কর্ম সাধন করতে পারি তবে অবশ্যই অভীষ্ট স্বর্গলোক লাভ করব। (১)

সুশৰ্মা প্রভৃতি এইরূপ শপথ করে দক্ষিণ দিকে গিয়ে অর্জুনকে আহ্বান করতে লাগলেন। অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে বললেন, মহারাজ, আমাকে যুদ্ধে আহ্বান করলে আমি বিমুখ হই না, এই আমার ব্রত। সুশৰ্মা, তাঁর ভ্রাতারা ও অন্য সংশপ্তগণ আমাকে ডাকছেন, এই আহ্বান আমি সইতে পারছি না, আপনি আজ্ঞা দিন আমি ওঁদের বধ করতে যাই। যুধিষ্ঠির বললেন, বৎস, তুমি জান যে দ্রোণ আমাকে ধরতে চান, তাঁর এই অভিপ্রায় যাতে সিদ্ধ না হয় তাই কর। অর্জুন বললেন, এই পাঞ্চালবীর সত্যজিৎ আজ যুদ্ধে আপনাকে রক্ষা করবেন, ইনি জীবিত থাকতে দ্রোণের ইচ্ছা পূর্ণ হবে না। যদি সত্যজিৎ নিহত হন তবে সকলের সঙ্গে মিলিত হয়েও আপনি রণস্থলে থাকবেন না।

রাত্রি প্রভাত হলে যুধিষ্ঠির সস্নেহে অর্জুনকে আলিঙ্গন ও আশীর্বাদ করে যুদ্ধে যাবার অনুমতি দিলেন।

** (১) এই প্রকার শপথ ও মরম পণ করে যারা যুদ্ধে যায় তারাই সংশপ্তক।

৫। সংশপ্তকগণের যুদ্ধ-ভগদত্তবধ (দ্বাদশ দিনের যুদ্ধ)

বর্ষাকালে স্ফীতসলিলা গঙ্গা ও সরযূ যেমন বেগে মিলিত হয় সেইরূপ উভয় পক্ষের সেনা যুদ্ধে মিলিত হল। অর্জুনকে আসতে দেখে সংশপ্তকগণ হৃষ্ট হয়ে চিৎকার করতে লাগলেন। অর্জুন সহাস্যে কৃষ্ণকে বললেন, দেবকীনন্দন, ত্রিগতভ্রাতারা আজ যুদ্ধে মরতে আসছে, তারা রোদন না করে হর্ষপ্রকাশ করছে।

অর্জুন মহারবে দেবদত্ত শঙ্খ বাজালেন, তার শব্দে বিস্ত হয়ে সংশপ্তকবাহিনী কিছুক্ষণ পাষাণপ্রতিমার ন্যায় নিশ্চেষ্ট হয়ে রইল, তার পর দুই পক্ষ থেকে প্রবল শরবর্ষণ হতে লাগল। অর্জুনের শরাঘাতে নিপীড়িত হয়ে ত্রিগর্তসেনা ভগ্ন হল। সুশৰ্মা বললেন, বীরগণ, ভয় নেই, পালিও না, তোমরা সকলের সমক্ষে ঘোের শপথ করেছ, এখন দুর্যোধনের সৈন্যদের কাছে ফিরে গিয়ে কি বলবে? পশ্চাৎপদ হলে লোকে আমাদের উপহাস করবে, অতএব সকলে যথাশক্তি যুদ্ধ কর। তখন সংশপ্তকগণ এবং নারায়ণী সেনা (১) মৃত্যুপণ করে পুনর্বার যুদ্ধে প্রবৃত্ত হল।

অর্জুন বললেন, কৃষ্ণ, এই সংশপ্তকগণ জীবিত থাকতে রণভূমি ত্যাগ করবে , তুমি ওদের দিকে রথ নিয়ে চল। কিছুক্ষণ বাণবর্ষণের পর অর্জুন তাষ্ট্র (২) অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। তখন সহস্র সহস্র বিভিন্ন প্রতিমূর্তি আবির্ভূত হল বিপক্ষ সৈন্যগণ বিমূঢ় হয়ে এই অর্জুন, এই গোবিন্দ’ বলে পরস্পরকে হত্যা করতে লাগল। অর্জুন সহাস্যে ললিথ মালব মাবেল্লক ও ত্রিগর্ত যোদ্ধাদের নিপীড়িত করতে লাগলেন। বিপক্ষের শরজালে আচ্ছন্ন হয়ে অর্জুনের রথ অদৃশ্য হল তিনি নিহত হয়েছেন মনে করে শত্রুসৈন্যগণ সহর্ষে কোলাহল করে উঠল। অর্জুন বায়ব্যাস্ত্র মোচন করলেন, প্রবল বায়ুপ্রবাহে সংশপ্তকগণ এবং তাদের হস্তী রথ অশ্ব প্রভৃতি শুষ্কপত্রের ন্যায় বিক্ষিপ্ত হল। অর্জুন ক্ষিপ্রহস্তে তীক্ষ্ম শরের আঘাতে সহস্র সহস্র শত্রুসৈন্য বন্ধ করলেন। সংশপ্তকগণ বিনষ্ট হয়ে ইন্দ্রলোকে যেতে লাগল।

অর্জুন যখন প্রমত্ত হয়ে যুদ্ধ করছিলেন তখন দ্রোণ গরুড় ব্যূহ রচনা করে সসৈন্যে যুধিষ্ঠিরের প্রতি ধাবিত হলেন। এই ব্যূহের মুখে স্বয়ং দ্রোণ, মস্তকে দুর্যোধন ও তার ভ্রাতারা, নেত্রদ্বয়ে কৃতবর্মা ও কৃপাচার্য, গ্রীবার কলিঙ্গ সিংহল প্রাচ্য প্রভৃতি দেশের যোদ্ধারা, দক্ষিণ পার্শ্বে ভূরিশ্রবা শল্য প্রভৃতি, বাম পার্শ্বে অবন্তিদেশীয় বিন্দ অনুবিন্দ, কাম্বোজরাজ সুদক্ষিণ ও অশ্বত্থামা, পৃষ্ঠ-দেশে কলিঙ্গ অম্বষ্ঠ মাগধ পৌন্ড্র গান্ধার প্রভৃতি সৈন্যগণ, পশ্চাদ্ভাগে পুত্র জ্ঞাতি ও বান্ধব সহ কর্ণ, এবং বক্ষস্থলে জয়দ্রথ ভীমরথ নিষধরাজ প্রভৃতি রইলেন। রাজা ভগদত্ত এক সুসজ্জিত হস্তীর পৃষ্ঠে মাল্য ও শ্বেত ছত্রে শোভিত হয়ে ব্যূহমধ্যে অবস্থান করলেন।

অর্ধচন্দ্র ব্যূহ রচনা করে যুধিষ্ঠির ধৃষ্টদ্যুম্নকে বললেন, তুমি এমন ব্যবস্থা কর যাতে আমি দ্রোণের হাতে না পড়ি। ধৃষ্টদ্যুম্ন বললেন, আমি জীবিত থাকতে আপনি উদবিগ্ন হবেন না, দ্রোণকে আমি নিবারণ করব। ধৃষ্টদ্যুম্নকে সম্মুখে দেখে দ্রোণ বিশেষ হৃষ্ট হলেন না, তিনি প্রবল শরবর্যণে যুধিষ্ঠিরের সৈন্য বিনষ্ট ও বিচ্ছিন্ন করতে লাগলেন। ক্ষণকাল পরেই উভয় পক্ষ বিশৃঙ্খল হয়ে উন্মত্তের ন্যায় যুদ্ধে রত হল। যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করবার জন্য সত্যজিৎ দ্রোণের সহিত যুদ্ধ করতে লাগলেন, কিন্তু পরিশেষে নিহত হলেন। যুধিষ্ঠির ত্রস্ত হয়ে তখনই দ্রুতবেগে স’রে গেলেন। পাঞ্চাল কেকয় মৎস্য প্রভৃতি যোদ্ধারা দ্রোণকে আক্রমণ করলেন। প্রচণ্ড যুদ্ধের পর সাত্যকি চেকিতান ধৃষ্টদ্যুম্ন শিখণ্ডী প্রভৃতি দ্রোণের নিকট পরাস্ত হলেন, বিজয়ী কৌরবগণ পলায়মান পাণ্ডবসৈন্য বধ করতে লাগলেন।

দুর্যোধন সহাস্যে কর্ণকে বললেন, রাধেয়, দেখ, পাঞ্চালগণ দ্রোণের শরাঘাতে বিদীর্ণ হয়ে পালাচ্ছে, মহাক্ৰোধী দুর্মতি ভীম আমার সৈন্যে বেষ্টিত হয়ে জগৎ দ্রোণময় দেখছে, আজ সে জীবনরক্ষা ও রাজ্যলাভে নিরাশ হয়েছে। কর্ণ বললেন, এই মহাবীর ভীম জীবিত থাকতে রণস্থল ত্যাগ করবেন না, আমাদের সিংহনাদও সইবেন না। দ্রোণ যেখানে আছেন আমাদের শীঘ্র সেখানে যাওয়া উচিত, নতুবা কোক (নেকড়ে বাঘ) এর দল যেমন মহাহস্তীকে বধ করে সেইরূপ পাণ্ডবরা দ্রোণকে বধ করবে। এই কথা শুনে দুর্যোধন ও তার ভ্রাতারা দ্রোণকে রক্ষা করতে গেলেন।

দ্রোণের রথধ্বজের উপর কৃষ্ণসার মৃগের চর্ম ও স্বর্ণময় কমণ্ডলু, ভীমসেনের ধ্বজে মহাসিংহ, যুধিষ্ঠিরের ধ্বজে গ্রহগণান্বিত চন্দ্র ও শব্দায়মান দুই মৃদঙ্গ, নকুলের ধ্বজে একটি ভীষণ শরভ, এবং সহদেবের ধ্বজে রজতময় হংস ছিল। যে হস্তীতে চ’ড়ে ইন্দ্ৰ দৈত্যদানব জয় করেছিলেন, সেই হস্তীর বংশধরের পৃষ্ঠে চড়ে ভগদত্ত ভীমের প্রতি ধাবিত হলেন। পাঞ্চাল সৈন্য সহ যুধিষ্ঠির তাঁকে বাধা দিতে গেলেন। ভগদত্তের সঙ্গে যুদ্ধে দশার্ণরাজ নিহত হলেন, পাঞ্চালসৈন্য ভয়ে পালাতে লাগল।

হস্তীর গর্জন শুনে অর্জুন বললেন, কৃষ্ণ, এ নিশ্চয় ভগদত্তের বাহনের শব্দ,এই হস্তী অস্ত্রের আঘাত এবং অগ্নির স্পর্শও সইতে পারে, সে আজ সমস্ত পাণ্ডবসৈন্য বিনষ্ট করবে। তুমি সত্বর ভগদত্তের কাছে রথ নিয়ে চল, তাঁকে আজ আমি ইন্দ্রের অতিথি করে পাঠাব। অর্জুন যাত্রা করলে চোদ্দ হাজার সংশপ্তক মহারথ এবং দশ হাজার ত্রিগর্ত যোদ্ধা চার হাজার নারায়ণসৈন্য সহ তাঁর অনুসরণ করলেন। দুর্যোধন ও কর্ণের উদ্ভাবিত এই কৌশলে অর্জুন সংশয়াপন্ন হয়ে ভাবতে লাগলেন, সংশপ্তকদের সঙ্গে যুদ্ধ করব, না যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করতে যাব? তিনি সংশপ্তকগণকে বধ করাই উচিত মনে করলেন, এবং ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করে তাদের প্রায় নিঃশেষ করে ফেললেন। তার পর তিনি কৃষ্ণকে বললেন, ভগদত্তের কাছে চল।।

ত্রিগর্তরাজ সুশর্মা ও তার ভ্রাতারা অর্জুনের অনুসরণ করছিলেন। অর্জুন শরবর্ষণ করে সুশর্মাকে নিরস্ত এবং তাঁর ভ্রাতাদের বিনষ্ট করলেন। তারপর গজারোহী ভগদত্তের সঙ্গে রথারোহী অর্জুনের তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হল। কৃষ্ণার্জুনকে বধ করবার জন্য ভগদত্ত তাঁর হস্তীকে চালিত করলেন, কৃষ্ণ সত্বর দক্ষিণ পার্শ্বে রথ সরিয়ে নিলেন। যুদ্ধধর্ম স্মরণ করে অর্জুন বাহনসমেত ভগদত্তকে পিছন থেকে মারতে ইচ্ছা করলেন না।

অর্জুনের শাঘাতে ভগদত্তের হস্তীর বর্ম ছিন্ন হয়ে ভূপতিত হল। ভগদত্ত মন্ত্রপাঠ করে বৈষ্ণবাস্ত্র নিক্ষেপ করলেন, অর্জুনকে পশ্চাতে রেখে কৃষ্ণ সেই অস্ত্র নিজের বক্ষে গ্রহণ করলেন। বৈষ্ণবাস্ত্র বৈজয়ন্তী মালা হয়ে কৃষ্ণের বক্ষে লগ্ন হল। অর্জুন দুঃখিত হয়ে বললেন, কৃষ্ণ, তুমি বলেছিলে যে যুদ্ধ করবে না, কিন্তু সেই প্রতিজ্ঞা রাখলে না। আমি সতর্ক ও অস্ত্রনিবারণে সমর্থ থাকতে তোমার এমন করা উচিত হয়নি।

কৃষ্ণ বললেন, একটি গুহ্য কথা বলছি শোন।

-আমি চার মূর্তিতে বিভক্ত হয়ে লোকের হিতসাধন করি। আমার এক মূর্তি তপস্যা করে, দ্বিতীয় মূর্তি জগতের সাধু ও অসাধু কর্ম দেখে, তৃতীয় মূর্তি মনুষ্যলোকে কর্ম করে, এবং চতুর্থ মূর্তি সহস্র বৎসর শয়ন করে নিদ্রিত থাকে। সহস্র বৎসরের অন্তে আমার চতুর্থ মূর্তি গাত্রোত্থান করে যোগ্য ব্যক্তিদের বর দেয়। সেই সময়ে পৃথিবীর প্রার্থনায় তাঁর পুত্র নরককে আমি বৈষ্ণবাস্ত্র দিয়েছিলাম। প্রাগজ্যোতিষরাজ ভগদত্ত নরকাসুরের কাছ থেকে এই অস্ত্র পেয়েছিলেন। জগতে এই অস্ত্রের অবধ্য কেউ নেই, তোমার রক্ষার নিমিত্তই আমি বৈষ্ণবাস্ত্র গ্রহণ করে মাল্যে পরিবর্তিত করেছি। ভগদত্ত পরমাস্ত্রহীন হয়েছেন, এখন ওই মহাসুরকে বধ কর।

অর্জুন নারাচ নিক্ষেপ করলেন, তার আঘাতে ভগদত্তের মহাহস্তী আর্তনাদ করে নিহত হল। অর্জুন তখনই অর্ধচন্দ্র বাণে ভগদত্তের হৃদয় বিদীর্ণ করলেন, ভগদত্ত প্রাণহীন হয়ে পড়ে গেলেন। তারপর অর্জুন রণস্থলের দক্ষিণ দিকে গেলেন, শকুনির ভ্রাতা বৃষক ও অচল তাকে বাধা দিতে এলেন। অর্জুন একই শরে দু’জনকে বধ করলেন। বহুমায়াবিশারদ শকুনি মায়া দ্বারা কৃষ্ণার্জুনকে সম্মোহিত করবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু অর্জুনের শরবর্ষণে সকল মায়া দূরীভূত হল , শকুনি ভীত হয়ে পালিয়ে গেলেন।

দ্রোণের সঙ্গে ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতির অদ্ভুত যুদ্ধ হতে লাগল। অশ্বত্থামা নীল রাজার মস্তক ছেদন করলেন। পাণ্ডবপক্ষীয় মহারথগণ উদবিগ্ন হয়ে অর্জুনের অপেক্ষা করতে লাগলেন, যিনি তখন অবশিষ্ট সংশপ্তক ও নারায়ণসৈন্য বিনাশ করছিলেন। ভীমসেন প্রাণের মায়া ত্যাগ করে দ্রোণ কর্ণ দুর্যোধন ও অশ্বত্থামার সঙ্গে যুদ্ধ করছেন দেখে সাত্যকি নকুল সহদেব প্রভৃতি তাকে রক্ষা করতে এলেন। পাণ্ডববীরগণকে আরও ত্বরান্বিত করবার জন্য ধৃষ্টদ্যুম্ন বললেন, এই সময়। তখন সকলে তুমুল রবে দ্রোণের প্রতি ধাবিত হলেন। দ্রোণ শত শত বাণে চেদি পাঞ্চাল ও পাণ্ডবগণকে নিপীড়িত করতে লাগলেন। এমন সময় অর্জুন সংশপ্তকগণকে জয় করে দ্রোণের নিকট উপস্থিত হলেন। যুগান্তকালে উদিত ধূমকেতু যেমন সর্বভূত দহন করে, অর্জুনের অস্ত্রের তেজে সেইরূপ কুরুসৈন্য দগ্ধ হতে লাগল। তাদের হাহাকার শুনে কর্ণ আগ্নেয়াস্ত্র প্রয়োগ করলেন, অর্জুন তা শরাঘাতে নিবারিত করে কর্ণের তিন ভ্রাতাকে বধ করলেন। ভীম ও ধৃষ্টদ্যুম্নের খড়গাঘাতে কর্ণপক্ষের পনর জন যোদ্ধা, চন্দ্রবর্মা ও নিষধরাজ বৃহৎক্ষত্র নিহত হলেন।

তার পর সূর্য অস্তাচ’লে গেলেন, উভয় পক্ষ ক্লান্ত ও রুধিরাক্ত হয়ে পরস্পরকে দেখতে দেখতে শিবিরে প্রস্থান করলেন।

**

(১) কৃষ্ণ দুর্যোধনকে দিয়েছিলেন। উদযোগপর্ব ২-পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।

(২) ত্বষ্টা-বিশ্বকর্মা।

॥ অভিমন্যুবধপর্বাধ্যায়॥

৬। অভিমন্যুবধ (ত্রয়োদশ দিনের যুদ্ধ)

অভিমানী দুর্যোধন ক্ষুণ্ণ হয়ে দ্রোণকে বললেন, দ্বিজশ্রেষ্ঠ, আপনি নিশ্চয় মনে করেন যে আমরা বধের যোগ্য, তাই আজ যুধিষ্ঠিরকে পেয়েও ধরলেন না। আপনি প্রীত হয়ে আমাকে বর দিয়েছিলেন, কিন্তু শেষে তার অন্যথা করলেন। সাধু লোকে কখনও ভক্তের আশাভঙ্গ করেন না। দ্রোণ লজ্জিত হয়ে উত্তর দিলেন, আমি সর্বদাই তোমার প্রিয়সাধনের চেষ্টা করি কিন্তু তুমি তা বুঝতে পার না। বিশ্বস্রষ্টা গোবিন্দ যে পক্ষে আছেন এবং অর্জুন যার সেনানী সে পক্ষের বল মহাদেব ভিন্ন আর কে অতিক্রম করতে পারেন? সত্য বলছি, আজ আমি পাণ্ডবদের কোনও মহারথকে নিপাতিত করব। আমি এমন ব্যূহ রচনা করব যা দেবতারাও ভেদ করতে পারেন না। তুমি কোনও উপায়ে অর্জুনকে সরিয়ে রেখো।

পরদিন সংশপ্তকগণ দক্ষিণ দিকে গিয়ে পুনর্বার অর্জুনকে যুদ্ধে আহ্বান করলেন, অর্জুনও তাঁদের সঙ্গে ঘোর যুদ্ধে নিরত হলেন। দ্রোণ চক্রব্যূহ নির্মাণ করে তেজস্বী রাজপুত্রগণকে যথাস্থানে স্থাপিত করলেন। তারা সকলেই রক্তবসন, রক্তভূষণ ও রক্ত পতাকায় শোভিত হলেন এবং মাল্যধারণ করে অগুরু চন্দনে চর্চিত হয়ে। অভিমন্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে, চললেন। দুর্যোধনের পুত্র লক্ষ্মণ এই দশ সহস্র যোদ্ধার অগ্রবর্তী হলেন। কৌরবসেনার মধ্যদেশে দুর্যোধন কর্ণ কৃপ ও দুঃশাসন, এবং সম্মুখভাবে সেনাপতি দ্রোণ, সিন্ধুরাজ জয়দ্ৰথ, অশ্বত্থামা, ধৃতরাষ্ট্রের ত্রিশ জন পুত্র, শকুনি, শল্য ও ভূরিশ্রবা রইলেন।

দ্রোণকে আর কেউ বাধা দিতে পারবে না এই স্থির করে যুধিষ্ঠির অভিমন্যুর উপর অত্যন্ত গুরুভার অর্পণ করলেন। তিনি তাকে বললেন, বৎস, অর্জুন ফিরে এসে যাতে আমাদের নিন্দা না করেন এমন কার্য কর। আমরা চক্রব্যূহ ভেদের প্রণালী কিছুই জানি না, কেবল অর্জুন কৃষ্ণ প্রদ্যুম্ন আর তুমি—এই চার জন চক্রব্যূহ ভেদ করতে পার। তোমার পিতৃগণ মাতুলগণ এবং সমস্ত সৈন্য তোমার নিকট বর প্রার্থনা করছে, তুমি দ্রোণের চক্রব্যূহ ভেদ কর।

অভিমন্যু বললেন, পিতৃগণের জয়কামনায় আমি অবিলম্বে দ্রোণের ব্যূহমধ্যে প্রবেশ করব। কিন্তু পিতা আমাকে প্রবেশের কৌশলই শিখিয়েছেন, যদি কোনও বিপদ হয় তবে ব্যূহ থেকে বেরিয়ে আসতে আমি পারব না। যুধিষ্ঠির বললেন, বৎস, তুমি ব্যূহ ভেদ করে আমাদের জন্য দ্বার করে দাও, আমরা তোমার সঙ্গে সঙ্গে প্রবেশ করে তোমাকে রক্ষা করব। ভীম বললেন, বৎস, ধৃষ্টদ্যুম্ন সাত্যকি ও আমি তোমার অনুসরণ করব, পাঞ্চাল কেকয় মৎস্য প্রভৃতি যোদ্ধারাও যাবেন, তুমি একবার ব্যূহ ভেদ করলে আমরা বিপক্ষের প্রধান প্রধান যোদ্ধাদের বধ করে ব্যূহ বিধ্বস্ত করব। অভিমন্যু বললেন, পতঙ্গ যেমন জ্বলিত অগ্নিতে প্রবেশ করে, আমি সেইরূপ দুর্ধর্ষ দ্রোণসৈন্যের মধ্যে প্রবেশ করব। সকলেই দেখতে পাবে, বালক হলেও আমি সংগ্রামে দলে দলে শত্রুসৈন্য ধ্বংস করব।

যুধিষ্ঠির আশীর্বাদ করলেন। অভিমন্যু তাঁর সারথিকে বললেন, সুমিত্র, তুমি দ্রোণসৈন্যের দিকে শীঘ্র রথ নিয়ে চল। সারথি বললে, আয়ুষ্মন, পাণ্ডবগণ আপনার উপর গুরুভার দিয়েছেন, আপনি বিবেচনা করে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হবেন। দ্রোণাচার্য অস্ত্রবিশারদ পরিশ্রমী কৃতী যোদ্ধা, আর আপনি সুখে পালিত, যুদ্ধেও অনভিজ্ঞ। অভিমন্যু সহাস্যে বললেন, সারথি, দ্রোণ ও সমগ্র ক্ষত্রমণ্ডলকে আমি ভয় করি। , ঐরাবতে আরূঢ় ইন্দ্রের সঙ্গেও আমি যুদ্ধ করতে পারি। বিশ্বজয়ী মাতুল কৃষ্ণ বা পিতা অর্জুন যদি আমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে আসেন তথাপি আমি ভয় পাব না। তুমি বিলম্ব করো না, অগ্রসর হও। তখন সারথি সুমিত্র অপ্রসন্নমনে রথের অশ্বদের দ্রুতবেগে চালনা করলে, পাণ্ডবগণ পিছনে চললেন। সিংহশিশু যেমন হস্তিদলের প্রতি ধাবিত হয়, অভিমন্যু সেইরূপ দ্রোণ প্রভৃতি মহারথগণের প্রতি ধাবিত হলেন। তিনি অল্প দূর গেলেই দুই পক্ষের যুদ্ধ আরম্ভ হল।

দ্রোণের সমক্ষেই অভিমন্যু ব্যূহ ভেদ করে ভিতরে গেলেন এবং কুরুসৈন্য ধ্বংস করতে লাগলেন। দুর্যোধন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে অভিমন্যুকে বাধা দিতে এলেন। দ্রোণ অশ্বত্থামা কৃপ কর্ম শল্য প্রভৃতি শরবর্ষণ করে অভিমন্যুকে আচ্ছন্ন করলেন। অভিমন্যুর শরাঘাতে শল্য মূৰ্ছিত হয়ে রথের উপর বসে পড়লেন, কৌরবসৈন্য পালাতে লাগল। শল্যের ভ্রাতা অভিমন্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে এসে নিহত হলেন।

দ্রোণ হৃষ্ট হয়ে উৎফুল্লনয়নে কৃপকে বললেন, এই সুভদ্রানন্দন অভিমন্যু আজ যুধিষ্ঠিরাদিকে আনন্দিত করবে। এর তুল্য ধনুর্ধর আর কেউ আছে এমন মনে হয় না, এ ইচ্ছা করলেই আমাদের সেনা সংহার করতে পারে, কিন্তু কোনও কারণে তা করছে না। দ্রোণের এই কথায় দুর্যোধন বিস্মিত ও ক্রুদ্ধ হয়ে কর্ণ দুঃশাসন শল্য প্রভৃতিকে বললেন, সকল ক্ষত্রিয়ের আচার্য শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মজ্ঞ দ্রোণ অর্জুনের ওই মূঢ় পুত্রকে বধ করতে ইচ্ছা করেন না, শিষ্যের পুত্র বলে ওকে রক্ষা করতে চান। বীরগণ, আপনারা ওকে বধ করুন, বিলম্ব করবেন না। দুঃশাসন বললেন, আমিই ওকে মারব।

দুঃশাসনকে দেখে অভিমন্যু বললেন, ভাগ্যক্রমে আজ ধর্মত্যাগী নিষ্ঠুর কটুভাষী বীরকে যুদ্ধে দেখছি। মূর্খ, তুমি দূতসভায় জয়লাভে উন্মত্ত হয়ে কটুবাক্যে যুধিষ্ঠিরকে ক্রোধিত করেছিলে, তোমার পাপকর্মের ফলভোগের জন্য আমার কাছে এসে পড়েছ, আজ তোমাকে শাস্তি দিয়ে পাণ্ডবগণের ও দ্রৌপদীর নিকট ঋণমুক্ত হব। এই বলে অভিমন্যু দুঃশাসনকে শরাঘাত করলেন। দুঃশাসন মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে গেলেন, তাঁর সারথি তাঁকে সত্বর রণস্থল থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল। পাণ্ডবপক্ষীয় যোদ্ধারা অভিমনুকে দেখে সিংহনাদ করে দ্রোণের সৈন্যগণকে আক্রমণ করলেন।

তারপর কর্ণের সঙ্গে অভিমন্যুর যুদ্ধ হতে লাগল। অভিমন্যু কর্ণের এক ভ্রাতার শিরচ্ছেদন করলেন এবং কর্ণকেও শরাঘাতে নিপীড়িত করে রণভূমি থেকে দূর করলেন। অভিমন্যুর শরবর্ষণে বিশাল কৌরবসৈন্য ভগ্ন হল , যোদ্ধারা পালাতে লাগলেন, অবশেষে ধৃতরাষ্ট্রের জামাতা সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ ভিন্ন আর কেউ রইলেন না। দ্রৌপদী হরণের পর ভীমের হস্তে নিগৃহীত হয়ে জয়দ্রথ মহাদেবের আরাধনা করে এই বর পেয়েছিলেন যে অর্জুন ভিন্ন অন্য চারজন পাণ্ডবকে তিনি যুদ্ধে বাধা দিতে পারবেন।

জয়দ্রথ শরবর্ষণ করে সাত্যকি ধৃষ্টদ্যুম্ন বিরাট দ্রুপদ শিখণ্ডী এবং যুধিষ্ঠির ভীম প্রভৃতিকে নিপীড়িত করতে লাগলেন। অভিমন্যু ব্যূহ প্রবেশের যে পথ করেছিলেন জয়দ্রথ তা রুদ্ধ করে দিলেন। পাণ্ডবপক্ষীয় যোদ্ধারা দ্রোণসৈন্য ভেদ করবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু জয়দ্রথ তাদের বাধা দিলেন। কুরুসৈন্যে বেষ্টিত হয়ে অভিমন্যু একাকী দারুণ যুদ্ধ করতে লাগলেন। শল্যপুত্র রুক্ষ্মরথ ও দুর্যোধনপুত্র লক্ষ্মণ অভিমন্যুর হস্তে নিহত হলেন।

প্রিয় পুত্রের মৃত্যুতে ক্রুদ্ধ হয়ে দুর্যোধন স্বপক্ষের বীরগণকে উচ্চস্বরে বললেন, আপনারা অভিমন্যুকে বধ করুন। তখন দ্রোণ কৃপ কর্ণ অশ্বত্থামা বৃহদ্বল ও কৃতবর্মা এই ছয় রথী অভিমন্যুকে বেষ্টন করলেন। কোশলরাজ বৃহদ্বল এবং আরও অনেক যোদ্ধা অভিমন্যুর বাণে নিহত হলেন। দ্রোণ বললেন, কুমার অভিমন্যু তার পিতার ন্যায় সর্ব দিকে দ্রুত বিচরণ করে এত ক্ষিপ্রহস্তে শর সন্ধান ও মোচন করছে যে কেবল তার মণ্ডলাকার ধনুই দেখা যাচ্ছে। সুভদ্রানন্দনের শরক্ষেপণে আমার প্রাণসংশয় আর মোহ হলেও আমি অতিশয় আনন্দলাভ করছি, অর্জুনের সঙ্গে এর প্রভেদ দেখছি না।

কর্ণ শরাহত হয়ে দ্রোণকে বললেন, রণস্থলে থাকা আমার কর্তব্য, শুধু এই কারণে অভিমন্যু কর্তৃক নিপীড়িত হয়েও আমি এখানে রয়েছি। মৃদু হাস্য করে দ্রোণ বললেন, অভিমন্যুর কবচ অভেদ্য, আমিই ওর পিতাকে কবচধারণের প্রণালী শিখিয়েছিলাম। মহাধনুর্ধর কর্ণ, যদি পার তো ওর ধনু ছিন্ন কর, অশ্ব সারথি বিনষ্ট কর, তার পর পশ্চাৎ থেকে ওকে প্রহার কর। যদি বধ করতে চাও তবে ওকে রথহীন ও ধনুহীন কর।

দ্রোণের উপদেশে অনুসারে কর্ণ পিছন থেকে অভিমন্যুর ধনু ছিন্ন করলেন এবং অশ্ব ও সারথি বধ করলেন। তার পর দ্রোণ কৃপ কর্ণ অশ্বত্থামা দুর্যোধন ও শকুনি নিষ্করূণ হয়ে রথচ্যুত বালক অভিমন্যুর উপর শরাঘাত করতে লাগলেন। অভিমন্যু খড়্গ ও চর্ম নিয়ে রথ থেকে লাফিয়ে নামলেন। দ্রোণ ক্ষুরপ্র অস্ত্রে অভিমন্যুর খড়গের মুষ্টি কেটে ফেললেন। অভিমন্যু চক্র নিয়ে ধাবিত হলেন, বিপক্ষ বীরগণের শরাঘাতে তাও ছিন্ন হল। তখন তিনি গদা নিয়ে যুদ্ধ করতে লাগলেন। এই সময়ে দুঃশাসনের পুত্র অভিমন্যুর মস্তকে গদাঘাত করলেন, অভিমন্যু অচেতন হয়ে পড়ে গেলেন।

জগৎ তাপিত করে সূর্য যেমন অস্তে যান সেইরূপ কৌরবসেনা নিপীড়িত করে অভিমন্যু প্রাণশূন্যদেহে ভূপতিত হলেন। গগনচ্যুত চন্দ্রের ন্যায় তাঁকে নিপতিত দেখে গগনচারিগণ বিলাপ করতে লাগলেন। পলায়মান পাণ্ডব-সৈন্যগণকে যুধিষ্ঠির বললেন, বীর অভিমন্যু যুদ্ধে পরাঙ্মুখ হননি, তিনি স্বর্গে গেছেন। তোমরা স্থির হও, ভয় দূর কর, আমরা যুদ্ধে শত্রুদের জয় করব। কৃষ্ণার্জুনের তুল্য যোদ্ধা অভিমন্যু দশ সহস্র শত্রুসৈন্য ও মহাবল বৃহদ্বলকে বধ করে নিশ্চয় ইন্দ্রলোকে গেছেন, তার জন্য শোক করা উচিত নয়। তার পর সায়াহ্নকাল উপস্থিত হলে শোকমগ্ন পাণ্ডবগণ এবং রুধিরাক্ত কৌরবগণ যুদ্ধে বিরত হয়ে নিজ নিজ শিবিরে প্রস্থান করলেন।

ধৃতরাষ্ট্রকে অভিমন্যুবধের বৃত্তান্ত শুনিয়ে সঞ্জয় বললেন, মহারাজ, দ্রোণ কর্ণ প্রভৃতি ছ-জন মহারথ একজনকে নিপাতিত করলেন—এ আমরা ধর্মসংগত মনে করি না।

৭। যুধিষ্ঠির-সকাশে ব্যাস-মৃত্যুর উপাখ্যান

অভিমন্যুর শোকে যুধিষ্ঠির বিলাপ করতে লাগলেন-কেশরী যেমন গোমধ্যে প্রবেশ করেছিল। মহাধনুর্ধর দুর্ধর্ষ শত্রুগণকে পরাস্ত করে দ্রোণসৈন্য-সাগর উত্তীর্ণ হয়ে পরিশেষে সে দুঃশাসনপুত্রের হাতে নিহত হল। হা, হৃষীকেশ আর ধনঞ্জয়কে আমি কি বলব? নিজের প্রিয়সাধন ও জয়লাভের জন্য আমি সুভদ্রা অর্জুন ও কেশবের অপ্রিয় কার্য করেছি। বালকের স্থান ভোজনে গমনে শয়নে ও ভূষণে সর্বাগ্রে, কিন্তু তাকে আমার যুদ্ধেই অগ্রবর্তী করেছিলাম। অর্জুনপুত্রের এই মৃত্যুর পর জয়লাভ রাজ্যলাভ অমরত্ব বা দেবলোকে বাস কিছুই আমার প্রীতিকর হবে না।

এই সময়ে মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস যুধিষ্ঠিরের নিকটে এলেন। তিনি বললেন, মহাপ্রাজ্ঞ, তোমার তুল্য লোকের বিপদে মোহগ্রস্ত হওয়া উচিত নয়। পুরুষশ্রেষ্ঠ অভিমন্যু যা করেছেন তা বালকে পারে না, তিনি বহু শত্রু বধ করে স্বর্গে গেছেন। দেব দানব গন্ধর্ব সকলেই মৃত্যুর অধীন, এই বিধান অতিক্রম করা যায় না। যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, মৃত্যু কেন হয় তা বলুন। ব্যাসদেব বললেন, পুরাকালে অকম্পন রাজাকে নারদ যে ইতিহাস বলেছিলেন তা শোন।

সত্যযুগে অকম্পন নামে এক রাজা ছিলেন, হরি নামে তাঁর একটি অস্ত্রবিশারদ মেধাবী বলবান পুত্র ছিল। এই রাজপুত্র যুদ্ধে নিহত হলে কম্পন সর্বদা শোকাবিষ্ট হয়ে থাকতেন। তাঁকে সান্ত্বনা দেবার জন্য দেবর্ষি নারদ এই পুত্রশোকনাশক আখ্যান বলেছিলেন।-

প্রাণিসৃষ্টির পর ব্রহ্মা ভাবতে লাগলেন, এদের সংহার কোন্ উপায়ে হবে। তখন তার ক্রোধপ্রভাবে আকাশে অগ্নি উৎপন্ন হয়ে চরাচর সর্ব জগৎ দগ্ধ করতে লাগল। প্রজাগণের হিতকামনায় মহাদেব ব্রহ্মার শরণ নিলেন। ব্রহ্মা বললেন, পুত্র, তুমি আমার সংকল্পজাত, কি চাও বল। মহাদেব বললেন, প্রভু, আপনার সৃষ্ট প্রজাবর্গ আপনার ক্রোধেই দগ্ধ হচ্ছে, আপনি প্রসন্ন হন। ব্রহ্মা বললেন, আমি অকারণে ক্রুদ্ধ হইনি, দেবী পৃথিবী ভারে আর্ত হয়ে প্রাণিসংহারের নিমিত্ত আমাকে অনুরোধ করেছিলেন, কোনও উপায় খুঁজে না পাওয়ায় আমার ক্রোধ জন্মেছিল। মহাদেবের প্রার্থনার ব্রহ্মা তার ক্রোধজাত অগ্নি স্বদেহে ধারণ করলেন। তখন তার সকল ইন্দ্রিয়দ্বার থেকে এক পিঙ্গল-বর্ণা রক্তাননা রক্তনয়না স্বর্ণকুণ্ডলধারিণী নারী আবির্ভূত হলেন। ব্রহ্মা তাঁকে বললেন, মৃত্যু, তুমি আমার নিয়োগ অনুসারে সকল প্রাণী সংহার কর।

সরোদনে কৃতাঞ্জলি হয়ে মৃত্যু বললেন, প্রভু, আমি নারীরূপে সৃষ্ট হয়ে কি করে এই ক্রুর কর্ম করব? আমি যাকে মারব তার আত্মীয়রা আমার অনিষ্ট-চিন্তা করবে, আমি তা ভয় করি। লোকে যখন বিলাপ করবে তখন আমি তাদের প্রিয় প্রাণ হরণ করতে পারব না; আপনি অধর্ম থেকে আমাকে রক্ষা করুন। ব্রহ্মা বললেন, তুমি বিচার করো না, আমার আদেশে সকল প্রাণী সংহার কর, তুমি জগতে অনিন্দিতা হবে।

মৃত্যুসম্মত হলেন না, ধেনুক ঋষির আশ্রমে গিয়ে কঠোর তপস্যা করতে লাগলেন। ব্রহ্মা তুষ্ট হয়ে বর দিতে এলে মৃত্যু বললেন, প্রভু, সুস্থ প্রাণীকে আমি হত্যা করতে চাই না, আমি আর্ত ভীত ও নিরপরাধ, আমাকে অভয় দিন। ব্রহ্মা বললেন, কল্যাণী, তোমার অধর্ম হবে না, তুমি সকল প্রাণী সংহার করতে থাক। সনাতন ধর্ম তোমাকে সর্বপ্রকারে পবিত্র রাখবেন, লোকপাল যম তোমার সহায় হবেন, ব্যাধি সকলও তোমকে সাহায্য করবে। আমার দেবগণের বরে তুমি নিস্পাপ হয়ে খ্যাতিলাভ করবে। মৃত্যু বললেন, আপনার আদেশ আমার শিরোধার্য, কিন্তু লোভ ক্রোধ অসূয়া দ্রোহ মোহ অলজ্জা ও পুরুষ আচরণ—এই সকল দোষে দেহ বিদ্ধ হলেই আমি সংহার করব। ব্রহ্মা বললেন, মৃত্যু, তাই হবে, তোমার অশ্রুবিন্দু আমার হাতে পড়েছিল, তাই ব্যাধি হয়ে প্রাণিদের বধ করবে, তোমার অধর্ম হবে না।

তারপর নারদ অকম্পনকে বললেন, মহারাজ, ব্রহ্মার আজ্ঞায় মৃত্যুদেবী অনাসক্তভাবে অন্তকালে প্রাণীদের প্রাণ হরণ করেন, অতএব তুমি নিষ্ফল শোক করো না। জীব পরলোকে গেলে ইন্দ্রিয়সকল সূক্ষ্মশরীরে অবস্থান করে, কর্মক্ষয় হলে আবার অন্য শরীর আশ্রয় করে মর্ত্যে আসে। প্রাণবায়ু দেহ ভেদ করে বহির্গত হলে আর ফিরে আসে না। তোমার পুত্র স্বর্গলাভ করে বীরলোকে আনন্দে আছে, মর্তের দুঃখ ত্যাগ করে স্বর্গে পুণ্যবানদের সঙ্গে মিলিত হয়েছে।।

৮। সুবর্ণষ্ঠীবীর উপাখ্যান

মৃত্যুর উপাখ্যান শোনার পর যুধিষ্ঠির বললেন, ভগবান, আপনি আমাকে পুণ্যকর্মা ইন্দ্রতুল্যবিক্রমশালী নিস্পাপ সত্যবাদী রাজর্ষিদের কথা বলুন। ব্যাসদেব এই উপাখ্যান বললেন।

একদিন দেবর্ষি নারদ ও পর্বত তাঁদের সখা শিত্যপুত্র রাজা সৃঞ্জয়ের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। তারা সুখে উপবিষ্ট হলে একটি শুচিস্মিতা বরবর্ণিনী কন্যা তাদের কাছে এলেন। পর্বত ঋষি জিজ্ঞাসা করলেন, এই চঞ্চল-নয়না সর্বলক্ষণযুক্তা কন্যাটি কার? এ কি সূর্যের দীপ্তি, না অগ্নির শিখা, না শ্রী হ্ৰী কীর্তি ধৃতি পুষ্টি সিদ্ধি, কিংবা চন্দ্রমার প্রভা? সৃঞ্জয় বললেন, এ আমারই কন্যা। নারদ বললেন, রাজা, যদি সুমহৎ শ্রেয় লাভ করতে চাও তবে এই কন্যাটিকে ভার্যারূপে আমাকে দাও। তখন পর্বত ঋষি ক্রুদ্ধ হয়ে নারদকে বললেন, আমি পূর্বে যাকে মনে মনে বরণ করেছি তাকেই তুমি চাচ্ছ! ব্রাহ্মণ, তুমি আর নিজের ইচ্ছানুসারে স্বর্গে যেতে পারবে না। নারদ বললেন, মন্ত্রপাঠাদির দ্বারা বিবাহ সম্পূর্ণ হয় না, সপ্তপদীগমনেই সম্পূর্ণ হয়। এই কন্যা আমার ভার্যা হবার পূর্বেই তুমি আমাকে শাপ দিলে, অতএব তুমিও আমার সঙ্গে ভিন্ন স্বর্গে যেতে পারবে না। পরস্পর অভিশাপের পর নারদ ও পর্বত সৃঞ্জয়ের নিকটেই বাস করতে লাগলেন।

রাজা সৃঞ্জয় তপস্যাপরায়ণ বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণগণকে সেবা দ্বারা তুষ্ট করে বর চাইলেন, যেন তার গুণবান যশস্বী কীর্তিমান তেজস্বী ও শত্রুনাশন পুত্র হয়। বর পেয়ে যথাকালে তার একটি পুত্র হল। এই পুত্রের মূল পুরীষ ক্লেদ ও স্বেদ সুবর্ণময়, সেজন্য তার নাম হল সুবর্ণষ্ঠীবী। রাজা ইচ্ছামত সকল বস্তু স্বর্ণে রূপান্তরিত করাতে লাগলেন, কালক্রমে তাঁর গৃহ প্রাকার দুর্গ ব্রাহ্মণবাস শয্যা আসন যান স্থালী প্রভৃতি সবই স্বর্ণময় হল। এক দল দস্যু লুব্ধ হয়ে স্বর্ণের আকরস্বরূপ রাজপুত্রকে হরণ করে বনে নিয়ে গেল। তারা সুবর্ণষ্ঠীবীকে কেটে খণ্ড খণ্ড করলে, কিন্তু তাদের কোনও অর্থলাভ হল না। রাজপুত্রের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে রাজার সমস্ত ধন লুপ্ত হল , মূর্খ। দস্যুরাও বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে পরস্পরকে বধ করে নরকে গেল।

সৃঞ্জয় রাজা পুত্রশোকে মৃতপ্রায় হয়ে বিলাপ করতে লাগলেন। নারদ তাকে বললেন, আমরা ব্রহ্মবাদী বিপ্রগণ তোমার গৃহে বাস করছি, আর তুমি কাম্য বিষয়ের ভোগে অতৃপ্ত থেকেই মরবে! যজ্ঞ বেদাধ্যয়ন দান আর তপস্যায় যারা তোমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ এমন বহু রাজার মৃত্যু হয়েছে, অতএব অযজ্ঞকারী অদাতা পুত্রের মৃত্যুর জন্য তোমার শোক করা উচিত….তার পর নারদ উদাহরণ স্বরূপ এই ষোল জন মহাত্মার কথা বললেন।

রাজর্ষি মরুত্ত, যাঁর ভবনে দেবতারা পরিবেশন করতেন। রাজা সুহোত্র, যাঁর জন্য পর্জন্যদেব হিরণ্য বর্ষণ করতেন। পুরুর পুত্র জনমেজয়, যিনি প্রতি বার যজ্ঞকালে দশ সহস্র স্বর্ণভূষিত হস্তী বহু সহস্র সালংকারা কন্যা এবং কোটি বৃষ দক্ষিণা দিতেন। উশীনরপুত্র শিবি, যাঁর যজ্ঞে দধিদুগ্ধের মহাহ্রদ এবং শুভ্র অন্নের পর্বত থাকত। দশরথপুত্র রাম, যিনি সুরাসুরের অবধ্য দেবব্রাহ্মণের কণ্টক রাবণকে বধ এবং এগার হাজার বৎসর রাজত্ব করে প্রজাদের নিয়ে স্বর্গে গিয়েছিলেন। ভগীরথ, যাঁকে সমুদ্রগামিনী গঙ্গা পিতা বলে স্বীকার করেছিলেন। দিলীপ, যিনি যজ্ঞে ব্রাহ্মণগণকে বসুধা দান করেছিলেন এবং যথার ভবনে বেদপাঠধ্বনি, জ্যানির্ঘোষ, এবং ‘পান-ভোজন কর’ এই শব্দ কখনও থামত না। যুবনাশ্বের পুত্র মান্ধাতা, যিনি আসমুদ্র পৃথিবী ব্রাহ্মণগণকে দান করে পুণ্যলোকে গিয়েছিলেন। নহুষের পুত্র যযাতি, যিনি বহুবিধ জ্ঞ করেছিলেন এবং দ্বিতীয় ইন্দ্রের ন্যায় ইচ্ছানুসারে স্বর্গোদ্যানে বিহার করতেন। নাভাগের পুত্র অম্বরীষ, যিনি যজ্ঞে ব্রাহ্মণগণকে দক্ষিণাস্বরূপ কোষ ও সৈন্য সহ শত সহস্র রাজ্য দান করেছিলেন। রাজা শশবিন্দু, যাঁর অশ্বমেধ যজ্ঞে এক ক্রোশ উচ্চ তেরটা খাদ্যের পর্বত প্রস্তুত হয়েছিল। অমূর্তরয়ার পুত্র গয়, যিনি অশ্বমেধ যজ্ঞে মণিকঙ্করে খচিত স্বর্ণময় পৃথিবী নির্মাণ করে ব্রাহ্মণগণকে দান করতেন। এবং অক্ষয় বট ও পবিত্র ব্রহ্মসরোবরের জন্য বিখ্যাত হয়েছেন। সংস্কৃতের পুত্র। রন্তিদেব, যাঁর দু লক্ষ পাচক ছিল, যাঁর কাছে পশুর দল স্বর্গলাভের জন্য নিজেরাই আসত, যাঁর গৃহে অতিথি এলে একুশ হাজার বৃষ হত্যা করা হত, কিন্তু তাতেও পর্যাপ্ত হত না, ভোজনের সময় পাচকরা বলত, আজ মাংস কম, আপনারা বেশী। করে সূপ (দাল) খান। দুষ্মন্তের পুত্র ভরত, যিনি অত্যন্ত বলবান ছিলেন এবং যমুনা সরস্বতী ও গঙ্গার তীরে বহু সহস্র যজ্ঞ করেছিলেন। বেণ রাজার পুত্র পৃথু যাঁর আজ্ঞায় পৃথিবীকে দোহন করে বৃক্ষ পর্বত দেবাসুর মনুষ্য প্রভৃতি অভীষ্ট বিষয় লাভ করেছিলেন। এই মহাত্মারা সকলেই মরেছেন। জমদগ্নিপুত্র পরশুরামও মরবেন, যিনি একুশ বার পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় করেছিলেন এবং কশ্যপকে সপ্তদ্বীপা বসুমতী দান করে মহেন্দ্র পর্বতে বাস করছেন।

নারদ সৃঞ্জয়কে বললেন, আমার কথা তুমি শুনলে কি? না শুদ্রার ব্রাহ্মণ পতি শ্রাদ্ধ করলে যেমন নিষ্ফল হয়, আমার বাক্যও সেইরূপ নিষ্ফল হল ? সৃঞ্জয় করজোড়ে বললেন, সূর্যের কিরণে যেমন অন্ধকার দূর হয় সেইরূপ আপনার আখ্যান শুনে আমার পুত্রশোক দূর হয়েছে। নারদ বললেন, তুমি অভীষ্ট বর চাও, আমাদের। কথা মিথ্যা হবে না। সৃঞ্জয় বললেন, ভগবান, আপনি প্রসন্ন হয়েছেন তাতেই আমি হৃষ্ট হয়েছি। নারদ বললেন, তোমার পুত্র দস্যুহস্তে বৃথা নিহত হয়েছে, তাকে কষ্টময় নরক থেকে উদ্ধার করে তোমাকে দান করছি। তখন নারদের বরে সুবর্ণষ্ঠীবী। পুনর্জীবিত হল।

উপাখ্যান শেষ করে ব্যাস যুধিষ্ঠিরকে বললেন, সৃঞ্জয়ের পুত্র বালক, সে ভয়ার্ত ও যুদ্ধে অক্ষম ছিল, কৃতকর্মা না হয়ে যজ্ঞ না করে নিঃসন্তান অবস্থায় মরেছিল, এজন্যই সে পুনর্জীবন পেয়েছিল। কিন্তু অভিমন্যু মহাবীর ও কৃতকর্মা, তিনি বহু সহস্র শত্রুকে সন্তপ্ত করে সম্মুখ সমরে নিহত হয়ে অক্ষয় স্বর্গলোকে গেছেন, সেখান থেকে কেউ মর্ত্যে আসতে চায় না। অতএব অর্জুনের পুত্রকে আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। তিনি অমৃতকিরণে উদ্ভাসিত হয়ে চন্দ্রের ন্যায় বিরাজ করছেন, তাঁর জন্য শোক করা উচিত নয়। মহারাজ, তুমি ধৈর্য ধারণ করে শত্রু জয় কর। এই বলে ব্যাস চ’লে গেলেন।

॥ প্রতিজ্ঞাপর্বাধ্যায়॥

৯। অর্জুনের প্রতিজ্ঞা

সেইদিন সায়াহ্নকালে দু পক্ষের সৈন্য যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত হলে অর্জুন সংশপ্তকগণকে বধ করে নিজ শিবিরে যাত্রা করলেন। তিনি যেতে যেতে সাশ্রুকণ্ঠে বললেন, কেশব, আমার হৃদয় ত্রস্ত হচ্ছে কেন? আমি কথা বলতে পারছি না, শরীর অবসন্ন হচ্ছে, বহু অশুভ লক্ষণ দেখছি। আমার ভ্রাতারা কুশলে আছেন তো? কৃষ্ণ বললেন, তুমি চিন্তিত হয়ো না, তারা ভালই আছেন, হয়তো সামান্য কিছু অনিষ্ট হয়ে থাকবে।

নিরানন্দ আলোকহীন শিবিরে উপস্থিত হয়ে অর্জুন দেখলেন, মালিক বাদ্য বাজছে না, শঙ্খধ্বনি হচ্ছে না, ভ্রাতারা যেন অচেতন হয়ে রয়েছেন। উদবিগ্ন হয়ে অর্জুন তাদের বললেন, আপনারা সকলে ম্লানমুখে রয়েছেন, অভিমন্যুকে দেখছি না। শুনেছি দ্রোণ চক্রব্যূহ রচনা করেছিলেন, অভিমন্যু ভিন্ন আপনাদের আর কেউ তা ভেদ করতে পারেন না। কিন্তু তাকে আমি প্রবেশ করতেই শিখিয়েছি, নির্গমের প্রণালী শেখাইনি। ব্যূহমধ্যে প্রবেশ করে অভিমন্যু কি নিহত হয়েছে? সুভদ্রার প্রিয় পুত্র, দ্রৌপদী কৃষ্ণ ও আমার স্নেহভাজন অভিমন্যুকে কে বধ করেছে? যার কেশপ্রান্ত কুঞ্চিত, চক্ষু হরিণ-শাবকের ন্যায়, দেহ নব শাল তরুর ন্যায়; যে সর্বদা স্মিতমুখে কথা বলে, গুরুজনের আজ্ঞা পালন করে, বালক হয়েও বয়স্থের ন্যায় কার্য করে; যে যুদ্ধে প্রথম প্রহার করে না, অধীরও হয় না, যে মহারথ বলে গণ্য, যার বিক্রম আমার চেয়ে অর্ধ গুণ অধিক, যে কৃষ্ণ প্রদ্যুম্ন ও আমার প্রিয় শিষ্য, সেই পুত্রকে যদি দেখতে না পাই তবে আমি যমসদনে যাব। হা পুত্র, আমি ভাগ্যহীন তাই তোমাকে সর্বদা দেখেও আমার তৃপ্তি হত না। যম তোমাকে সবলে নিয়ে গেছেন, তুমি দেবগণের প্রিয় অতিথি হয়েছ।

তারপর অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে বললেন, মহারাজ, অভিমন্যু শনিপীড়ন করে সম্মুখ যুদ্ধে স্বর্গারোহণ করেছে তো? কর্ণ দ্রোণ প্রভৃতির বাণে কাতর হয়ে সে নিশ্চয় বার বার বিলাপ করেছে—যদি পিতা এসে আমাকে রক্ষা করতেন! সেই অবস্থায় নৃশংসগণ তাকে নিপাতিত করেছে। অথবা, যে আমার পুত্র, কৃষ্ণের ভাগিনেয়, সুভদ্রার গর্ভজাত, সে এমন বিলাপ করতে পারে না। তাকে না দেখে সুভদ্রা আর দ্রৌপদী কি বলবেন, আমিই বা তাদের কি বলব? আমার হৃদয় নিশ্চয় বজ্রসারময়, শোকার্তা বধু উত্তরার রোদনেও তা বিদীর্ণ হবে না। আমি গর্বিত ধার্তরাষ্ট্রগণের সিংহনাদ শুনেছিলাম, কৃষ্ণও যুযুৎসুকে বলতে শুনেছেন—অধর্মজ্ঞ মহারথগণ, অর্জুনের পরিবর্তে একটি বালককে বধ করে চিৎকার করছ কেন?

পুত্রশোকার্ত অর্জুনকে ধরে কৃষ্ণ বললেন, অর্জুন, ক্ষান্ত হও, সকল ক্ষত্রিয়। বীরেরই এই পন্থা, অভিমন্যু পুণ্যার্জিতলোকে গেছেন তাতে সংশয় নেই। সকল বীরেরই এই আকাঙ্ক্ষা—যেন সম্মুখ যুদ্ধে আমার মৃত্যু হয়। ভরতশ্রেষ্ঠ, তোমাকে শোকাবিষ্ট দেখে তোমার ভ্রাতারা, এই রাজারা, এবং সুহৃদ্গণ সকলেই কাতর হয়েছেন। তুমি সান্ত্বনা দিয়ে এঁদের আশ্বস্ত কর। যা জ্ঞাতব্য তা তুমি জান, অতএব শোক করো না।

গদগদকণ্ঠে অর্জুন ভ্রাতাদের বললেন, অভিমন্যুর মৃত্যু কি করে হল শুনতে ইচ্ছা করি। আপনারা রথারোহী হয়ে শরবর্ষণ করছিলেন, শত্রুরা অন্যায় যুদ্ধে কি করে তাকে বধ করলে ? হা, আপনাদের পৌরুষ নেইষ পরাক্রমও নেই। আমারই দোষ, তাই দুর্বল ভীরু অদৃঢ়প্রতিজ্ঞ আপনাদের উপর ভর দিয়ে অন্যত্র গিয়েছিলাম। আপনাদের বর্ম আর অস্ত্রশস্ত্র অলংকারমাত্র, সভায় যে বীরত্ব প্রকাশ করতেন তাও কেবল মুখের কথা, তাই আমার পুত্রকে রক্ষা করতে পারলেন না। এই বলে অর্জুন অপূর্ণমুখে অসিকামুকহস্তে ক্রুদ্ধ কৃতান্তের ন্যায় দাঁড়িয়ে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলেন।

যুধিষ্ঠির বললেন, মহাবাহু, তুমি সংশপ্তকদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেলে দ্রোণ তার সৈন্য ব্যূহবদ্ধ করে আমাদের নিপীড়িত করতে লাগলেন। নিরূপায় হয়ে আমার অভিমন্যুকে বললাম, বৎস, তুমি দ্রোণের সৈন্য ভেদ কর। যে পথে সে ব্যূহমধ্যে প্রবেশ করবে সেই পথে আমরাও যাব এই ইচ্ছায় আমরা তার অনুসরণ করলাম, কিন্তু জয়দ্রথ মহাদেবের বরপ্রভাবে আমাদের সকলকেই নিবারিত করলেন। তার পর দ্রোণ কৃপ কর্ণ অশ্বত্থামা বৃহদ্বল ও কৃতবর্মা এই ছয় রথী অভিমন্যুকে বেষ্টন করলেন। বালক অভিমন্যু যথাশক্তি যুদ্ধ করতে লাগলেন, কিন্তু অবশেষে তার রথ নষ্ট হল , তখন দুঃশাসনের পুত্র তাকে হত্যা করলে। অভিমন্যু বহু সহস্র হস্তী অশ্ব রথ ধ্বংস করে এবং বহু বীর ও রাজা বৃহদ্বলকে স্বর্গে পাঠিয়ে স্বয়ং স্বর্গে গেছেন।

অর্জুন ‘হা পুত্র’ বলে ভূপতিত হলেন, তার পর সংজ্ঞা লাভ করে জ্বররোগীর ন্যায় কাঁপতে কাঁপতে হাতে হাত ঘষে বললেন, আমি প্রতিজ্ঞা করছি, জয়দ্রথ যদি ভয় পেয়ে দুর্যোধনাদিকে ত্যাগ করে না পালায় তবে কালই তাকে বধ করব। সে যদি আমার বা কৃষ্ণের বা মহারাজ যুধিষ্ঠিরের শরণাপন্ন না হয় তবে কালই তাকে বধ করব। যদি কাল তাকে নিহত করতে না পারি তবে যে নরকে মাতৃহন্তা ও পিতৃহন্তা যায়, গুরুপত্নীগামী, বিশ্বাসঘাতক, ভুক্তপূর্বা স্ত্রীর নিন্দাকারী, গোহন্তা, এবং ব্রাহ্মণহন্তা যায়, সেই নরকে আমি যাব। যে লোক পা দিয়ে ব্রাহ্মণ গো বা অগ্নি স্পর্শ করে, জলে মল মূত্র শ্লেষ্ম ত্যাগ করে, নগ্ন হয়ে স্নান করে, অতিথিকে আহার দেয় না, উৎকোচ নেয়, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়, স্ত্রী পুত্র ভৃত্য ও অতিথিকে ভাগ না দিয়ে মিষ্টান্ন খায়; যে ব্রাহ্মণ শীতভীত, যে ক্ষত্রিয় রণভীত, যে কৃতঘম, এবং ধর্মচ্যুত অন্যান্য লোক যে নরকে যায় সেই নরকে আমি যাব। আরও প্রতিজ্ঞা করছি শুনুন-পাপী জয়দ্রথ জীবিত থাকতে যদি কাল সূর্যাস্ত হয় তবে আমি জ্বলন্ত অগ্নিতে প্রবেশ করব। সুরাসুর ব্রহ্মর্ষি দেবর্ষি স্থাবর জঙ্গম কেউ তাকে রক্ষা করতে পারবে না, সে রসাতলে আকাশে দেবপুরে বা দানবপুরে যেখানেই যাক, আমি শরাঘাতে তার শিরচ্ছেদন করব।

অর্জুন বামে ও দক্ষিণে গাণ্ডীব ধনুর জ্যাকর্ষণ করলেন, সেই নির্ঘোষ তাঁর কণ্ঠধ্বনি অতিক্রম করে আকাশ স্পর্শ করলে। তার পর কৃষ্ম পাঞ্চজন্য এবং অর্জুন দেবদত্ত শঙ্খ বাজালেন, আকাশ পাতাল ও পৃথিবী কেঁপে উঠল, নানাবিধ বাদ্যধ্বনি হল পাণ্ডবগণ সিংহনাদ করলেন।

১০। জয়দ্রথের ভয়-সুভদ্রার বিলাপ

পাণ্ডবগণের সেই মহানিনাদ শুনে এবং চরমুখে অর্জুনের প্রতিজ্ঞার সংবাদ জেনে জয়দ্রথ উদবিগ্ন হয়ে দুর্যোধনাদিকে বললেন, পাণ্ডুর পত্নীর গর্ভে কামুক ইন্দ্রের ঔরসে যে পুত্র জন্মেছিল সেই দুর্বুদ্ধি অর্জুন আমাকে যমালয়ে পাঠাতে চায়। তোমাদের মঙ্গল হ’ক, আমি প্রাণরক্ষার জন্য নিজ ভবনে চ’লে যাব। অথবা তোমরা আমাকে রক্ষা কর, অভয় দাও। পাণ্ডবদের সিংহনাদ শুনে আমার অত্যন্ত ভয় হয়েছে, ন্যায় শরীর অবসন্ন হয়েছে। তোমরা অনুমতি দাও, আমি আত্মগোপন করি, যাতে পাণ্ডবরা আমাকে দেখতে না পায়। দুর্যোধন বললেন, নরব্যাঘ্র, ভয় পেয়ো না, তুমি ক্ষত্রিয় বীরগণের মধ্যে থাকলে কে তোমাকে আক্রমণ করবে? আমরা সসৈন্যে তোমাকে রক্ষা করব। তুমি স্বয়ং রথিশ্রেষ্ঠ মহাবীর, তবে পাণ্ডবদের ভয় করছ কেন?

রাত্রিকালে জয়দ্রথ দুর্যোধনের সঙ্গে দ্রোণের কাছে গিয়ে তাঁকে প্রণাম করে বললেন, আচার্য, অস্ত্রশিক্ষায় অর্জুন আর আমার প্রভেদ কি তা জানতে ইচ্ছা করি। দ্রোণ বললেন, বৎস, আমি তোমাদের সমভাবেই শিক্ষা দিয়েছি, কিন্তু যোগাভ্যাস ও কষ্টভোগ করে অর্জুন অধিকতর শক্তিমান হয়েছেন। তথাপি তুমি ভয় পেয়ে , আমি তোমাকে নিশ্চয় রক্ষা করব। আমি এমন ব্যূহ রচনা করব যা অর্জুন ভেদ করতে পারবেন না। তুমি স্বধর্ম অনুসারে যুদ্ধ কর। মনে রেখো, আমরা কেউ চিরকাল বাঁচব না, কালবশে সকলেই নিজ নিজ কর্মর্সহ পরলোকে যাব। দ্রোণের কথা শুনে জয়দ্রথ আশ্বস্ত হলেন এবং ভয় ত্যাগ করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন।

কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, তুমি আমার সঙ্গে মন্ত্রণা না করেই প্রতিজ্ঞা করেছ। যে কাল জয়দ্রথকে বধ করবে; এই দুঃসাহসের জন্য যেন আমার উপহাসাস্পদ না হই। আমি কৌরবশিবিরে যে চর পাঠিয়েছিলাম তাদের কাছে শুনেছি, কর্ণ ভূরিশ্রবা অশ্বত্থামা বৃষসেন কৃপ ও শল্য এই ছ জন জয়দ্রথের সঙ্গে থাকবেন। এঁদের জয় করলে জয়দ্রথকে পাবে না। অর্জুন বললেন, আমি মনে করি, এঁদের মিলিত শক্তি আমার অর্ধেকের তুল্য। মধুসূদন, তুমি দেখো, কাল আমি দ্রোণাদির সমক্ষেই জয়দ্রথের মুণ্ড ভূপাতিত করব। কাল সকলেই দেখবে, ক্ষীরান্নভোজী পাপাচারী জয়দ্রথ আমার বাণে বিদীর্ণ হয়ে রণভূমিতে পতিত হয়েছে। দিব্যধনু গাণ্ডীব, আমি যোদ্ধা, আর তুমি সারথি থাকলে কি না জয় করা যায় ? কৃষ্ণ, কাল প্রভাতেই যাতে আমার রথ সজ্জিত থাকে তা দেখো। এখন তুমি তোমার ভগিনী সুভদ্রা এবং আমার পুত্রবধূ উত্তরাকে সান্ত্বনা দাও, উত্তরার সহচরীদের শোক দূর কর।

কৃষ্ণ দুঃখিতমনে অর্জুনের গৃহে গিয়ে সুভদ্রাকে বললেন, বাফেয়ী (১), তুমি আর বধূ উত্তরা কুমার অভিমন্যুর জন্য শোক করো না, কালবশে সকল প্রাণীরই এই গতি হয়। মহৎ কুলে জাত ক্ষত্রিয় বীরের এরূপ মরণই উপযুক্ত। পিতার ন্যায় পরাক্রান্ত মহারথ অভিমন্যু বীরের অভিলষিত গতি লাভ করেছেন। তপস্যা ব্রহ্মচর্য বেদাধ্যয়ন ও প্রজ্ঞা দ্বারা সাধুজন যেখানে যেতে চান তোমার পুত্র সেখানে গেছেন। তুমি বীরপ্রসবিনী বীরপত্নী বীরবান্ধবা, শোক করো না, তোমার তনয় পরমা গতি পেয়েছেন। বালকহন্তা পাপী জয়দ্রথ তার কর্মের উপযুক্ত ফল পাবে, অমরাবতীতে আশ্রয় নিলেও সে অর্জুনের হাতে নিষ্কৃতি পাবে না। তুমি কালই শুনবে, জয়দ্রথের মুণ্ড ছিন্ন হয়ে সমস্তপঞ্চকের বাইরে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। রাজ্ঞী, তুমি পুত্রবধূকে আশ্বস্ত কর, কাল তুমি বিশেষ প্রিয় সংবাদ শুনবে, তোমার পতি যে প্রতিজ্ঞা করেছেন তার অন্যথা হবে না।

পুত্রশোকার্তা সুভদ্রা বিলাপ করতে লাগলেন, হা পুত্র, তুমি এই মন্দভাগিনীর ক্রোড়ে এসে পিতৃতুল্য পরাক্রান্ত হয়েও কেন নিহত হলে? তুমি সুখভোগে অভ্যস্ত ছিলে, উত্তম শয্যায় শুতে, আজ কেন বাণবিদ্ধ হয়ে ভূশয়ন করেছ? বরনারীগণ যে মহাবাহুর সেবা করত, আজ শৃগালরা কেন তার কাছে রয়েছে? ভীমার্জুন বৃষ্ণি পাঞ্চাল কেকয় মৎস্য প্রভৃতি বরগণকে ধিক, তারা তোমাকে রক্ষা করতে পারলেন না! হা বীর, তুমি স্বপ্নলব্ধ ধনের ন্যায় দেখা দিয়ে বিনষ্ট হলে! তোমার এই শোকবিহুলা তরুণী ভার্যাকে কি করে বাঁচিয়ে রাখব? হা পুত্র, তুমি ফলদানের সময় আমাকে ত্যাগ করে অকালে চ’লে গেলে! যজ্ঞকারী দানশীল ব্রহ্মচর্যপরায়ণ গুরুশুশ্রষাকারী ব্রাহ্মণদের যে গতি, যুদ্ধে অপরাঙ্মুখ শক্তহত্তা বীরগণের যে গতি, একভার্য পুরুষের যে গতি, সদাচার ও চতুরাশ্রমীর পুণ্য রক্ষাকারী রাজা এবং সর্বভূতের প্রতি প্রীতিযুক্ত অনিষ্ঠুর লোকের যে গতি, তুমি সেই গতি লাভ কর।

সুভদ্রা উত্তরার সঙ্গে এইরূপ বিলাপ করছিলেন এমন সময় দ্রৌপদী সেখানে এলেন এবং সকলে শোকাকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে উন্মত্তের ন্যায় সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে গেলেন। জলসেচনে তাদের সচেতন করে কৃষ্ণ বললেন, সুভদ্রা, শোক ত্যাগ কর; পাঞ্চালী, উত্তরাকে সান্ত্বনা দাও। অভিমন্যু ক্ষত্রিয়োচিত উত্তম গতি পেয়েছেন, আমাদের বংশের সকলেই যেন এই গতি পায়। তিনি যে মহৎ কর্ম করেছেন, আমরা ও আমাদের সুহৃগণও যেন সেইরূপ কর্ম করতে পারি।

১১। অর্জুনের স্বপ্ন

সুভদ্রা প্রভৃতির নিকট বিদায় নিয়ে কৃষ্ণ অর্জুনের জন্য কুশ দিয়ে একটি শয্যা রচনা করলেন এবং তার চতুর্দিক মাল্য গন্ধদ্রব্য লাজ ও অস্ত্রশস্ত্রে সাজিয়ে দিলেন। পরিচারকগণ সেই শয্যার নিকটে মহাদেবের নৈশপূজার উপকরণ রেখে দিলে। কৃষ্ণের উপদেশ অনুসারে অর্জুন পূজা করলেন, তারপর কৃষ্ণ নিজের শিবিরে ফিরে গেলেন।

সেই রাত্রিতে পাণ্ডবশিবিরে কারও নিদ্রা হল না, সকলেই উদবিগ্ন হয়ে অর্জুনের দুরূহ প্রতিজ্ঞার বিষয় ভাবতে লাগলেন। মধ্যরাত্রে কৃষ্ণ তার সারথি দারুককে বললেন, আমি কাল এমন কার্য করব যাতে সূর্যাস্তের পূর্বেই অর্জুন জয়দ্রথকে বধ করতে পারবেন। অর্জুনের চেয়ে প্রিয়তর আমার কেউ নেই, তার জন্য আমি কৌরবগণকে সংহার করব। রাত্রি প্রভাত হলেই তুমি আমার রথ প্রস্তুত করবে এবং তাতে আমার কৌমোদক গদা, দিব্য শক্তি, চক্র, ধনুর্বাণ, ছত্র প্রভৃতি রাখবে এবং চার অশ্ব যোজিত করবে। পাঞ্চজনের নির্ঘোষ শুনলেই তুমি সত্বর আমার কাছে আসবে। দারুক বললেন, পুরুষব্যাঘ্র, আপনি যাঁর সারথ্য স্বীকার করেছেন সেই অর্জুন নিশ্চয় জয়ী হবেন। আপনি যে আদেশ করলেন আমি তা পালন করব।

অর্জুন শিবমন্ত্র জপ করতে করতে নিদ্রিত হলেন। তিনি স্বপ্ন দেখলেন, কৃষ্ণ তার কাছে এসে বলছেন, তোমার বিষাদের কারণ কি তা বল। অর্জুন উত্তর দিলেন, আমি প্রতিজ্ঞা করেছি যে কাল সূর্যাস্তের পূর্বে জয়দ্রথকে বধ করব, কিন্তু কৌরবপক্ষের মহারথগণ এবং বিশাল সেনা তাঁকে বেষ্টন করে থাকবে। কি করে তাকে আমি দেখতে পাব? এখন সূর্যাস্তও শীঘ্র হয়। কেশব, আমার প্রতিজ্ঞারক্ষা হবে না, আমি জীবিত থাকতেও পারব না।

কৃষ্ণ বললেন, যদি পাশুপত অস্ত্র তোমার জানা থাকে তবে তুমি কাল জয়দ্রথকে বধ করতে পারবে। যদি জানা না থাকে তবে মনে মনে ভগবান বৃষভধ্বজের ধ্যান ও মন্ত্রজপ কর। অর্জুন আচমন করে ভূমিতে বসে একাগ্রমনে ধ্যান করতে লাগলেন। ব্রাহ্মমুহূর্তে তিনি দেখলেন, কৃষ্ণ তাঁর দক্ষিণ হস্ত ধরে আছেন, তারা আকাশমার্গে বায়ুবেগে গিয়ে হিমালয় অতিক্রম করে মহামন্দর পর্বতে উপস্থিত হয়েছেন। সেখানে শূলপাণি জটাধারী গৌরবর্ণ মহাদেব, পার্বতী ও প্রমথগণ রয়েছেন, গীত বাদ্য নৃত্য হচ্ছে, ব্রহ্মবাদী মুনিগণ স্তব করছেন। কৃষ্ণ ও অর্জুন ভূমিতে মস্তক স্পর্শ করে সনাতন ব্রহ্মস্বরূপ মহাদেবকে প্রণাম করলেন, মহাদেব সহাস্যে স্বাগত জানালে কৃষ্ণার্জুন কৃতাঞ্জলি হয়ে স্তব করলেন। অর্জুন দেখলেন, তিনি যে পূজা করেছিলেন তার উপহার মহাদেবের নিকট এসেছে। মহাদেবের কৃপায় অর্জুন পাশুপত অস্ত্রের প্রয়োগ শিক্ষা করলেন। তার পর কৃষ্ণার্জুন মহাদেবকে বন্দনা করে শিবিরে ফিরে এলেন।

রাত্রি প্রভাত হলে বৈতালিকদের স্তব ও গীতবাদ্যের ধ্বনিতে যুধিষ্ঠিরের নিদ্রাভঙ্গ হল। সুশিক্ষিত পরিচারকগণ কষায় দ্রব্যে গাত্রমার্জন করে মন্ত্রপূত চন্দনাদিযুক্ত জলে তাকে স্নান করিয়ে দিলে। জলশোষণের জন্য যুধিষ্ঠির একটি শিথিল উষ্ণীষ পরলেন এবং মাল্য ও কোমল বস্ত্র ধারণ করে যথাবিধি হোম করলেন। তার পর মহার্ঘ অলংকারে ভূষিত হয়ে কৃষ্ণ বিরাট দ্রুপদ সাত্যকি ধৃষ্টদ্যুম্ন ভীম প্রভৃতির সঙ্গে মিলিত হলেন। যুধিষ্ঠির বললেন, জনার্দন, তুমি সকল আপদ থেকে আমাদের রক্ষা কর, পাণ্ডবগণ অগাধ কুরুসাগরে নিমগ্ন হচ্ছে, তুমি তাদের ত্রাণ কর। শঙ্খচক্রগদাধর দেবেশ পুরুষোত্তম, অর্জুনের প্রতিজ্ঞা সত্য কর। কৃষ্ণ বললেন, মহারাজ, অর্জুনের তুল্য ধনুর্ধর ত্রিলোকে নেই, সমস্ত দেবতা যদি জয়দ্রথের রক্ষক হন তথাপি অর্জুন আজ তাকে বধ করবেন।

এমন সময়ে অর্জুন এসে বললেন, মহারাজ, কেশবের অনুগ্রহে আমি এক আশ্চর্য স্বপ্ন দেখেছি। অর্জুনের মহাদেবদর্শনের বৃত্তান্ত শুনে সকলে ভূতলে মস্তক রেখে প্রণত হয়ে সাধু বলতে লাগলেন। তারপর অর্জুন বললেন, সাত্যকি, শুভলক্ষণ দেখতে পাচ্ছি, আজ আমি নিশ্চয় জয়ী হব। আজ কৃষ্ণ আর আমি তোমাদের কাছে থাকব না, তুমি সর্বপ্রযত্নে রাজা যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা ক’রো।

॥ জয়দ্রথবধপর্বাধ্যায়॥

১২। জয়দ্রথের অভিমুখে কৃষ্ণার্জুন (চতুর্দশ দিনের যুদ্ধ)

প্রভাতকালে দ্রোণ জয়দ্রথকে বললেন, তুমি আমার পশ্চাতে ছ ক্রোশ দূরে সসৈন্যে থাকবে, ভূরিশ্রবা কর্ণ অশ্বত্থামা শল্য বৃষসেন ও কৃপ তোমাকে রক্ষা করবেন। দ্রোণ চক্ৰশকট ব্যূহ রচনা করলেন। এই ব্যূহের পশ্চাতে পদ্ম নামক এক গর্ভব্যূহ এবং তার মধ্যে এক সূচাব্যূহ নির্মিত হল। কৃতবর্মা সূচীব্যূহের সম্মুখে এবং বিশাল সৈন্যে পরিবেষ্টিত জয়দ্রথ এক পার্শ্বে রইলেন। দ্রোণাচার্য চক্ৰশকট ব্যূহের মুখে রইলেন।।

পাণ্ডবসৈন্য ব্যূহবদ্ধ হলে অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন, দুর্যোধন-ভ্রাতা দুর্মর্ষণ যেখানে রয়েছে সেখানে রথ নিয়ে চল, আমি এই গজসৈন্য ভেদ করে শত্ৰু-বাহিনীতে প্রবেশ করব। অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে দুর্মর্ষণ পরাজিত হচ্ছেন দেখে দুঃশাসন সসৈন্যে অর্জুনকে বেষ্টন করলেন, কিন্তু তাঁর শরবর্ষণে নিপীড়িত ও ত্রস্ত হয়ে শকটব্যূহের মধ্যে দ্রোণের নিকট আশ্রয় নিলেন। অর্জুন দুঃশাসনের সৈন্য ধ্বংস করে দ্রোণের কাছে এলেন এবং কৃষ্ণের অনুমতি নিয়ে কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, ভগবান, আমাকে আশীর্বাদ করুন, আপনার অনুগ্রহে আমি এই দুর্ভেদ্য বাহিনীতে প্রবেশ করতে ইচ্ছা করি। আপনি আমার পিতৃতুল্য, ধর্মরাজ ও কৃষ্ণের ন্যায় মাননীয়, অশ্বত্থামার তুল্যই আমি আপনার রক্ষণীয়। আপনি আমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করুন। ঈষৎ হাস্য করে দ্রোণ বললেন, অর্জুন, আমাকে জয় না করে জরদ্রথকে জয় করতে পারবে না।

দ্রোণের সঙ্গে অর্জুনের তুমুল যুদ্ধ হল। কিছু কাল পরে কৃষ্ণ বললেন, অর্জুন, বৃথা কালক্ষেপ করো না, এখন দ্রোণকে ছাড়! অর্জুন চ’লে যাচ্ছেন দেখে দ্রোণ সহাস্যে বললেন, পাণ্ডুপুত্র, কোথায় যাচ্ছ? শত্রুজয় না করে তুমি তো যুদ্ধে বিরত হও না। অর্জুন বললেন, আপনি আমার গুরু, শত্রু নন; আপনাকে পরাজিত করতে পারে এমন পুরুষও কেউ নেই।

অর্জুন জয়দ্রথের দিকে সত্বর চললেন, পাঞ্চালবীর যুধামন্যু ও উত্তমৌজা তাঁর রক্ষক হয়ে সঙ্গে সঙ্গে গেলেন। 

কৌরবসৈন্য ভগ্ন হচ্ছে দেখে দুর্যোধন দ্রোণকে বললেন, আচার্য, অর্জুন আপনার সৈন্য ভেদ করায় জয়দ্রথের রক্ষকগণ সংশয়াপন্ন হয়েছেন, তাঁদের বিশ্বাস ছিল যে জীবিত অবস্থায় অর্জুন আপনাকে অতিক্রম করতে পারবেন না। আমি জানি আপনি পাণ্ডবদের হিতেই রত আছেন। আমি আপনাকে উত্তম বৃত্তি দিয়ে থাকি, যথাশক্তি তুষ্ট রাখি, কিন্তু আপনি তা মনে রাখেন না। আমাদের আশ্রয়ে থেকেই আপনি আমাদের অপ্রিয় কর্ম করছেন, আপনি যে মধুলিপ্ত ক্ষুরের তুল্য তা আমি বুঝতে পারিনি। আমি বুদ্ধিহীন, তাই জয়দ্রথ যখন চ’লে যেতে চেয়েছিলেন তখন আপনার ভরসায় তাকে বারণ করেছিলাম। আমি আর্ত হয়ে প্রলাপ বকছি, ক্রুদ্ধ হবেন না জয়দ্রথকে রক্ষা করুন।

দ্রোণ বললেন, রাজা, তুমি আমার কাছে অশ্বত্থামার সমান। আমি সত্য বলছি। শোন। কৃষ্ণ সারথিশ্রেষ্ঠ, তাঁর অশ্বসকল শীঘ্রগামী, অল্প ফাক পেলেও তা দিয়ে অর্জুন শীঘ্র যেতে পারেন। তুমি কি দেখতে পাও না আমার বাণ অর্জুনের রথের এক ক্রোশ পিছনে পড়ে? আমার বয়স হয়েছে, শীঘ্র যেতে পারি না। আমি বলেছি যে যুধিষ্ঠিরকে ধরব, এখন তাকে ছেড়ে আমি অর্জুনের কাছে যেতে পারি না। অর্জুন আর তুমি একই বংশে জন্মেছ, তুমি বীর কৃতী ও দক্ষ, তুমিই শত্রুতার সৃষ্টি করেছ। ভয় পেয়ো না, তুমি নিজেই অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ কর।

দুর্যোধন বললেন, আচার্য, আপনাকে যে অতিক্রম করেছে সেই অর্জুনের সঙ্গে আমি কি করে যুদ্ধ করব? দ্রোণ বললেন, তোমার দেহে আমি এই কাঞ্চনময় কবচ বেঁধে দিচ্ছি, কৃষ্ণ অর্জুন বা অন্য কোনও যোদ্ধা এই কবচ ভেদ করতে পারবেন না। বৃত্রবধের পূর্বে মহাদেব এই কবচ ইন্দ্রকে দিয়েছিলেন। ইন্দ্রের কাছ থেকে যথাক্রমে অঙ্গিরা, তৎপুত্র বৃহস্পতি, অগ্নিবেশ্য ঋষি এবং পরিশেষে আমি এই কবচ পেয়েছি। কবচ ধারণ করে দুর্যোধন অর্জুনের অভিমুখে গেলেন। পাণ্ডবগণ তিন ভাগে বিভক্ত কৌরবসৈন্যের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন।

সূর্য যখন অস্তাচ’লের অভিমুখী হলেন কৃষ্ণার্জুন তখনও জয়দ্রথের দিকে যাচ্ছিলেন।অবন্তিদেশীয় বিন্দ ও অনুবিন্দ অর্জুনকে বাধা দিতে এসে নিহত হলেন। অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন, আমার অশ্বসকল বাণে আহত ও ক্লান্ত হয়েছে, জয়দ্রথও দূরে রয়েছে। তুমি অশ্বদের শুশ্রুষা কর, আমি শত্রুসৈন্য নিবারণ করব। এই বলে থেকে নামলেন এবং অস্ত্রাঘাতে ভূমি ভেদ করে জলাশয় সৃষ্টি করলেন। সহাস্যে সাধু সাধু বলে কৃষ্ণ অশ্বদের পরিচর্যা করে এবং জল খাইয়ে সুস্থ করলেন, তার পর পুনর্বার বেগে রথ চালালেন। অর্জুন কৌরবসৈন্য আলোড়ন করতে করতে অগ্রসর হলেন এবং কিছু দূর গিয়ে জয়দ্রথকে দেখতে পেলেন।

দ্রোণের সৈন্য অতিক্রম করে অর্জুন জয়দ্রথের অভিমুখে যাচ্ছেন দেখে দুর্যোধন সবেগে এসে অর্জুনের রথের সম্মুখে উপস্থিত হলেন। কৃষ্ণ বললেন, ধনঞ্জয়, ভাগ্যক্রমে দুর্যোধন তোমার বাণের পথে এসে পড়েছেন, এখন ওঁকে বধ কর। অর্জুন ও দুর্যোধন পরস্পরের প্রতি শরাঘাত করতে লাগলেন। অর্জুনের বাণ নিষ্ফল হচ্ছে দেখে কৃষ্ণ বললেন, জলে পাথর ভাসার ন্যায় অদৃষ্টপূর্ব ব্যাপার দেখছি, তোমার বাণে দুর্যোধনের কিছুই হচ্ছে না। তোমার গাণ্ডীবের শক্তি ও বাহুবল ঠিক আছে। তো? অর্জুন বললেন, আমার মনে হয় দুর্যোধনের দেহে দ্রোণ অভেদ্য কবচ বেঁধে দিয়েছেন, এর বন্ধনরীতি আমিও ইন্দ্রের কাছ থেকে শিখেছি। কিন্তু দুর্যোধন স্ত্রীলোকের ন্যায় এই কবচ বৃথা ধারণ করে আছে, কবচ থাকলেও ওকে আমি পরাজিত করব। অর্জুন শরাঘাতে দুর্যোধনের ধনু ও হস্তাবরণ ছিন্ন করলেন এবং অশ্ব ও সারথি বিনষ্ট করলেন। দুর্যোধনকে মহাবিপদে পতিত দেখে ভূরিশ্রবা কর্ণ কৃপ শল্য প্রভৃতি সসৈন্যে এসে অর্জুনকে বেষ্টন করলেন। পাণ্ডবগণকে ডাকবার জন্য অর্জুন বার বার তাঁর ধনুতে টংকার দিলেন, কৃষ্ণও পাঞ্চজন্য বাজালেন।

এই সময়ে দ্রোণের নিকটস্থ কৌরবযোদ্ধাদের সঙ্গে পাণ্ডবপক্ষীয় যোদ্ধাদের ঘোর যুদ্ধ হচ্ছিল। ঘটোৎকচ অলষুষ রাক্ষসকে বধ করলেন। পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণ দ্রোণের শরাঘাতে নিপীড়িত হতে লাগলেন। সহসা পাঞ্চজন্যের ধ্বনি ও কৌরবগণের সিংহনাদ শুনে যুধিষ্ঠির বললেন, নিশ্চয় অর্জুন বিপদে পড়েছেন। সাত্যকি, তোমার চেয়ে সুহৃত্তম কেউ নেই, তুমি সত্বর গিয়ে অর্জুনকে রক্ষা কর, শত্রুসৈন্য তাঁকে বেষ্টন করেছে।

সাত্যকি বললেন, মহারাজ, আপনার আদেশ পালনে আমি সর্বদা প্রস্তুত, কিন্তু অর্জুন আমার উপরে আপনার রক্ষার ভার দিয়ে গেছেন, আমি চ’লে গেলে দ্রোণ আপনাকে অনায়াসে বন্দী করবেন। যদি কৃষ্ণনন্দন প্রদ্যুম্ন এখানে থাকতেন তবে তাকে আপনার রক্ষার ভার দিয়ে আমি যেতে পারতাম। অর্জুনের জন্য আপনি ভয় পাবেন না, কর্ণ প্রভৃতি মহারথের বিক্রম অর্জুনের ষোল ভাগের এক ভাগও নয়। যুধিষ্ঠির বললেন, অর্জুনের কাছে তোমার যাওয়াই আমি উচিত মনে করি। ভীমসেন আমাকে রক্ষা করবেন, তা ছাড়া ঘটোৎকচ বিরাট দ্রুপদ শিখণ্ডী নকুল সহদেব এবং ধৃষ্টদ্যুম্নও এখানে আছেন।

যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে সাত্যকি ভীমকে বললেন, রাজা যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করো, এই তোমার প্রধান কর্তব্য। পাপী জয়দ্রথ নিহত হলে আমি ফিরে এসে ধর্মরাজকে। আলিঙ্গন করব। সাত্যকি কুরুসৈন্য বিদারণ করে অগ্রসর হলেন। দ্রোণ তাঁকে নিবারণ করবার চেষ্টা করে বললেন, তোমার গুরু অর্জুন কাপুরুষের ন্যায় যুদ্ধে বিরত হয়ে আমাকে প্রদক্ষিণ করে চ’লে গেছেন। তুমিও যদি সত্বর চ’লে না যাও তবে আমার কাছে নিস্তার পাবে না। সাত্যকি বললেন, ভগবান, আমি ধর্মরাজের আদেশে আমার গুরু অর্জুনের কাছে যাচ্ছি, আপনার মঙ্গল হ’ক, আমি আর বিলম্ব করব না। এই বলে সাত্যকি দ্রোণকে প্রদক্ষিণ করে বেগে অগ্রসর হলেন। তাকে বাধা দেবার জন্য দ্রোণ ও কৌরবপক্ষীয় অন্যান্য বীরগণ ঘোর যুদ্ধ করতে লাগলেন। সাত্যকির শরাঘাতে রাজা জলসন্ধ ও সুদর্শন নিহত হলেন। দ্রোণের সারথি নিপাতিত হল তাঁর অশ্বসকল উদ্ভ্রান্ত হয়ে রথ নিয়ে ঘুরতে লাগল। তখন কৌরববীরগণ সাত্যকিকে ত্যাগ করে দ্রোণকে রক্ষা করলেন, দ্রোণ বিক্ষতদেহে তার ব্যূহদ্বারে ফিরে গেলেন।

দুর্যোধনের যবন সৈন্য সাত্যকির সঙ্গে যুদ্ধ করতে এল। তাদের লৌহ ও কাংস্য-নির্মিত বর্ম এবং দেহ ভেদ করে সাত্যকির বাণসকল ভূমিতে প্রবেশ করতে লাগল। যবন কাম্বোজ কিরাত ও বর্বর সৈন্যের মৃতদেহে রণভূমি আচ্ছন্ন হল। পর্বতবাসী পাষাণযোদ্ধারা সাত্যকির উপর শিলাবর্ষণ করতে এল, কিন্তু শরাঘাতে ছিন্নবাহু হয়ে ভূমিতে পড়ে গেল।

সাত্যকির পরাক্রমে ভীত হয়ে অন্যান্য যোদ্ধাদের সঙ্গে দুঃশাসন দ্রোণের কাছে চ’লে এলেন। দ্রোণ বললেন, দুঃশাসন, তোমাদের রথসকল দ্রুতবেগে চ’লে আসছে কেন? জয়দ্রথ জীবিত আছেন তো? রাজপুত্র ও মহাবীর হয়ে তুমি রণস্থল ত্যাগ করলে কেন? তুমি দ্যতসভায় দ্রৌপদীকে বলেছিলেন যে পাণ্ডবগণ ষণ্ডতিল (১) তুল্য, তবে এখন পালিয়ে এলে কেন ? তোমার অভিমান দর্প আর বীরগর্জন কোথায় গেল ? দ্রোণের ভর্ৎসনা শুনে দুঃশাসন আবার সাত্যকির সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেলেন কিন্তু পরাজিত হয়ে প্রস্থান করলেন।

অপরাহ্নকালে পক্ককেশ শ্যামবর্ণ দ্রোণ আবার যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। তিনি পঁচাশি বৎসরের বৃদ্ধ হলেও ষোল বৎসরের যুবকের ন্যায় বিচরণ করতে লাগলেন। তার শরাঘাতে কেকয়রাজগণের জ্যেষ্ঠ বৃহৎক্ষত্র, শিশুপালপুত্র ধৃষ্টকেতু, এবং ধৃষ্টদ্যুম্নের পুত্র ক্ষত্রধর্মা নিহত হলেন।

** (১) যে তিলের অঙ্কুর হয় না, অর্থাৎ নপুংসক।

১৩। কর্ণের হস্তে ভীমের পরাজয়-ভূরিশ্রবা-বধ (চতুর্দশ দিনের আরও যুদ্ধ)

কৃষ্ণার্জুনকে দেখতে না পেয়ে এবং গাণ্ডীবের শব্দ শুনতে না পেয়ে যুধিষ্ঠির উদবিগ্ন হলেন। তিনি ভীমকে বললেন, তোমার কনিষ্ঠ ভ্রাতার কোনও চিহ্ন আমি দেখতে পাচ্ছি না, কৃষ্ণও পাঞ্চজন্য বাজাচ্ছেন। নিশ্চয় ধনঞ্জয় নিহত হয়েছেন এবং কৃষ্ণ স্বয়ং যুদ্ধ করছেন। তুমি সত্বর অর্জুন আর সাত্যকির কাছে যাও। ভীম বললেন, কৃষ্ণার্জুনের কোনও ভয় নেই, তথাপি আপনার আজ্ঞা শিরোধার্য করে আমি যাচ্ছি। যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করবার ভার ধৃষ্টদ্যুম্নকে দিয়ে ভীম অর্জুনের অভিমুখে যাত্রা করলেন, পাঞ্চল ও সোমক সৈন্যগণ তার সঙ্গে গেল।

ভীমের ললাটে লৌহবাণ দিয়ে আঘাত করে দ্রোণ সহাস্যে বললেন, কুন্তীপুত্র, আজ আমি তোমার শত্রু, আমাকে পরাস্ত না করে তুমি এই বাহিনী ভেদ করতে পারবে না। ভীম বললেন, ব্রহ্মবন্ধু (নীচ ব্রাহ্মণ), আপনার অনুমতি না পেয়েও অর্জুন এই বাহিনী ভেদ করে গেছেন। আমি আপনার শত্রু ভীমসেন, অর্জুনের মত দয়ালু নই, আপনাকে সম্মানও করি না। এই বলে ভীম গদাঘাতে দ্রোণের অশ্ব সারথি ও রথ বিনষ্ট করলেন। দ্রোণ অন্য রথে উঠে ব্যূহদ্বারে চ’লে গেলেন। ভীমের সঙ্গে যুদ্ধে দুর্যোধনের ভ্রাতা বিন্দ অনুবিন্দ সুবর্মা ও সুদর্শন নিহত হলেন। কৌরবগণকে পরাস্ত করে ভীম সত্বর অগ্রসর হলেন এবং কিছু দূর গিয়ে অর্জুনকে দেখতে পেয়ে সিংহনাদ করলেন। কৃষ্ণার্জুনও সিংহনাদ করে উত্তর দিলেন। এই গর্জন শুনে যুধিষ্ঠির আনন্দিত হলেন।

দুর্যোধন দ্রোণের কাছে এসে বললেন, আচার্য, অর্জুন সাত্যকি ও ভীম আপনাকে অতিক্রম করে জয়দ্রথের অভিমুখে গেছেন। আমাদের যোদ্ধারা বলছেন, ধনুর্বেদের পারগামী দ্রোণের এই পরাজয় বিশ্বাস করা যায় না। আমি মন্দভাগ্য, এই যুদ্ধে নিশ্চয় আমার নাশ হবে। আপনার অভিপ্রায় কি তা বলুন। দ্রোণ বললেন, পাণ্ডবপক্ষের তিন মহারথ আমাদের অতিক্রম করে গেছেন, আমাদের সেনা সম্মুখে ও পশ্চাতে আক্রান্ত হয়েছে। এখন জয়দ্রথকে রক্ষা করাই প্রধান কর্তব্য। বৎস, শকুনির বুদ্ধিতে যে ন্যূতক্রীড়া হয়েছিল তাতে জয়-পরাজয় কিছুই হয়নি, এই রণস্থলেই জয়-পরাজয় নির্ধারিত হবে। তোমরা জীবনের মমতা ত্যাগ করে জয়দ্রথকে রক্ষা কর। দ্রোণের উপদেশে দুর্যোধন তাঁর অনুচরদের নিয়ে সত্বর প্রস্থান করলেন।

কৃষ্ণার্জুনের অভিমুখে ভীমকে যেতে দেখে কর্ণ তাকে যুদ্ধে আহ্বান করে বললেন, ভীম, তোমার শত্রুরা যা স্বপ্নেও ভাবেনি তুমি সেই কাজ করছ, পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে চ’লে যাচ্ছ। ভীম ফিরে এসে কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন। কর্ণ মৃদুভাবে এবং ভীম পূর্বের শত্রুতা স্মরণ করে ক্রুদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করতে লাগলেন। দুর্যোধনের আদেশে তার নয় ভ্রাতা দুর্জয় দুর্মুখ চিত্ৰ উপচিত্র চিত্রাক্ষ চারুচিত্র শরাসন চিত্রায়ু ও চিত্রবর্মা কর্ণকে সাহায্য করতে এলেন, কিন্তু ভীম সকলকেই বধ করলেন। তারপর দুর্যোধনের আরও সাত ভ্রাতা শত্ৰুঞ্জয় শসহ চিত্র চিত্রায়ুধ দৃঢ় চিত্রসেন ও বিকর্ণ যুদ্ধ করতে এলেন এবং তারাও নিহত হলেন। এইরূপে ভীম একত্রিশ জন ধার্তরাষ্ট্রকে নিপাতিত করলেন।

কর্ণের শরাঘাতে ভীমের ধনু ছিন্ন এবং রথের অশ্বসকল নিহত হল। ভীম রথ থেকে নেমে খড়্গ ও চর্ম নিয়ে যুদ্ধ করতে লাগলেন। কর্ণ ভীমের চর্ম ছেদন করলেন, ক্রুদ্ধ ভীম তার খড়্গ নিক্ষেপ করে কর্ণের ধনু ছেদন করলেন। কর্ণ অন্য ধনু নিলেন, নিরস্ত্র ভীম হস্তীর মৃতদেহ ও ভগ্ন রথের স্তুপের মধ্যে আশ্রয় নিলেন এবং হস্তীর দেহ নিক্ষেপ করে যুদ্ধ করতে লাগলেন। কর্ণের শরাঘাতে ভীম মূৰ্ছিতপ্রায় হলেন। কুন্তীর বাক্য স্মরণ করে কর্ণ ভীমকে বধ করলেন না, কেবল ধনুর অগ্রভাগ দিয়ে স্পর্শ করে বার বার সহাস্যে বললেন, ওরে তুবরক (১) ঔদরিক সংগ্রামকাতর মূঢ়, তুমি অস্ত্রবিদ্যা জান না, আর যুদ্ধ করো না। যেখানে বহুবিধ খাদ্যপানীয় থাকে সেখানেই তোমার স্থান, তুমি রণভূমির অযোগ্য। বৎস বৃকোদর, তুমি বনে গিয়ে মুনি হয়ে ফলমূল খাও গে, কিংবা গৃহে গিয়ে পাচক আর ভূত্যদের তাড়না কর। আমার মত লোকের সঙ্গে যুদ্ধ করলে তোমাকে অনেক কষ্ট ভোগ করতে হবে। তুমি কৃষ্ণার্জুনের কাছে যাও, কিংবা গৃহে যাও। বালক, তোমার যুদ্ধের প্রয়োজন কি? ভীম বললেন, কেন মিথ্যা গর্ব করছ, আমি তোমাকে বহুবার পরাজিত করেছি। ইন্দ্রেরও জয়-পরাজয় হয়েছিল। নীচকুলজাত কর্ণ, তুমি আমার সঙ্গে মল্লযুদ্ধ কর, আমি তোমাকে কীচকের ন্যায় বিনষ্ট করব।

এই সময়ে অর্জুন কর্ণের প্রতি শরবর্ষণ করতে লাগলেন। ভীমকে ত্যাগ করে কর্ণ দুর্যোধনাদির কাছে গেলেন, ভীমও সাত্যকির রথে উঠে অর্জুনের অভিমুখে চললেন। ভূরিশ্রবা সাত্যকিকে বাধা দিতে এলেন এবং কিছু কাল ঘোর যুদ্ধের পর সাত্যকিকে ভূপাতিত করে তাকে পদাঘাত করলেন এবং মুণ্ডচ্ছেদের উদ্দেশ্যে তাঁর কেশগুচ্ছ ধরলেন। তখন কৃষ্ণের উপদেশে অর্জুন তীক্ষ্ম শরে ভূরিশ্রবার দক্ষিণ হস্ত কেটে ফেললেন। ভূরিশ্রবা বললেন, কৌন্তেয়, তুমি অতি নৃশংস কর্ম করলে, আমি অন্যের সঙ্গে যুদ্ধে রত ছিলাম, সেই সময়ে আমার বাহু ছেদন করলে! এরূপ অস্ত্রপ্রয়োগ কে তোমাকে শিখিয়েছেন, ইন্দ্র রুদ্র দ্রোণ না কৃপ? তুমি কৃষ্ণের উপদেশে সাত্যকিকে বাঁচাবার জন্য এরূপ করেছ। বৃষ্ণি ও অন্ধক বংশের লোকেরা ব্রাত্য, নিন্দাহ্ কর্ম করাই ওদের স্বভাব, সেই বংশে জাত কৃষ্ণের কথা তুমি শুনলে কেন? এই বলে মহাযশা ভূরিশ্রবা বাঁ হাতে ভূমিতে শর বিছিয়ে প্রয়োপবেশনে বসলেন এবং ব্রহ্মলোকে যাবার ইচ্ছায় যোগস্থ হয়ে মহোপনিষৎ ধ্যান করতে লাগলেন। অর্জুন তাকে বললেন, তুমি নিরস্ত্র সাত্যকিকে বধ করতে গিয়েছিলে, নিরস্ত্র বালক অভিমন্যুকে তোমরা হত্যা করেছ, কোন্ ধার্মিক লোক এমন কর্মের প্রশংসা করেন?

ভূরিশ্রবা ভূমিতে মস্তক স্পর্শ করলেন এবং ছিন্ন দক্ষিণ হস্ত বাম হস্তে ধরে অর্জুনের দিকে নিক্ষেপ করলেন। অর্জুন তাঁকে বললেন, আমার ভ্রাতাদের উপর যেমন প্রীতি, তোমার উপরেও সেইরূপ প্রীতি আছে। তুমি উশীনরপুত্র শিবি রাজার ন্যায় পুণ্যলোকে যাও। কৃষ্ণ বললেন, ভূরিশ্রবা, তুমি দেবগণের বাঞ্ছিত আমার লোকে যাও, গরুড়ে আরোহণ করে বিচরণ কর। এই সময়ে সাত্যকি চৈতন্যলাভ করে ভূমি থেকে উঠলেন এবং খড়্গ নিয়ে ভূরিশ্রবার শিরচ্ছেদ করতে উদ্যত হলেন। সমস্ত সৈন্য নিন্দা করতে লাগল, কৃষ্ণ অর্জুন ভীম কৃপ অশ্বত্থামা কর্ণ জয়দ্রথ প্রভৃতি উচ্চস্বরে বারণ করতে লাগলেন, তথাপি সাত্যকি যোগমগ্ন ভূরিশ্রবার মস্তক ছেদন করলেন।

সাত্যকি বললেন, ওহে অধার্মিকগণ, তোমরা আমাকে ‘মেরো না, মেরো না’ বলে নিষেধ করছিলে, কিন্তু সুভদ্রার বালক পুত্র যখন নিহত হয় তখন তোমাদের ধর্ম কোথায় ছিল? আমার এই প্রতিজ্ঞা আছে—যে আমাকে যুদ্ধে নিষ্পিষ্ট করে পদাঘাত করবে সে মুনির ন্যায় ব্রতপরায়ণ হলেও তাকে আমি বধ করব। আমি ভূরিশ্রবাকে বধ করে উচিত কার্য করেছি, অর্জুন এঁর বাহু কেটে আমাকে বঞ্চিত করেছেন।

যুদ্ধের বিবরণ শুনতে শুনতে ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে বললেন, বহুযুদ্ধজয়ী সাত্যকিকে ভূরিশ্রবা কি করে ভূপাতিত করতে পেরেছিলেন? সঞ্জয় বললেন, যযাতির জ্যেষ্ঠপুত্র যদুর বংশে দেবমীঢ় জন্মগ্রহণ করেন। তার পুত্রের নাম শূর, শূরের পুত্র মহাযশা বসুদেব। যদুর বংশে মহাবীর শিনিও জন্মেছিলেন। দেবকের কন্যা দেবকীর যখন স্বয়ংবর হয় তখন শিনি সেই কন্যাকে বসুদেবের জন্য সবলে হরণ করেন। কুরুবংশীয় সোমদত্ত তা সইলেন না, শিনির সঙ্গে বাহুযুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন। শিনি সোমদত্তকে ভূপাতিত করে পদাঘাত করলেন এবং অসি উদ্যত করে কেশ ধরলেন, কিন্তু পরিশেষে দয়া করে ছেড়ে দিলেন। তার পর সোমদত্ত মহাদেবকে আরাধনায় তুষ্ট করে বর চাইলেন-ভগবান, এমন পুত্র দিন যে শিনির বংশধরকে ভূমিতে ফেলে পদাঘাত করবে। মহাদেবের বরে সোমদত্ত ভূরিশ্রবাকে পুত্ররূপে পেলেন। এই কারণেই ভূরিশ্রবা শিনির পৌত্র সাত্যকিকে নিগৃহীত করতে পেরেছিলেন।

** (১) দাড়িগোঁফহীন, মাকুন্দ।

১৪। জয়দ্রথবধ (চতুর্দশ দিনের আরও যুদ্ধ)

অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন, সূর্যাস্তের আর বিলম্ব নেই, জয়দ্রথের কাছে রথ নিয়ে চল, আমি যেন প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারি। অর্জুনকে আসতে দেখে দুর্যোধন কর্ণ বৃষসেন শল্য অশ্বত্থামা কৃপ এবং স্বয়ং জয়দ্রথ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। দুর্যোধন কর্ণকে বললেন, দিনের অল্পই অবশিষ্ট আছে, জয়দ্রথকে যদি সূর্যাস্ত পর্যন্ত রক্ষা করা যায় তবে অর্জুনের প্রতিজ্ঞা মিথ্যা হবে, সে অগ্নিপ্রবেশ করবে। অর্জুন মরলে তার ভ্রাতারাও মরবে, তার পর আমরা নিঙ্কণ্টক হয়ে পৃথিবী ভোগ করব। কর্ণ, তোমরা সকলে আমার সঙ্গে মিলিত হয়ে বিশেষ যত্ন সহকারে যুদ্ধ কর। কর্ণ বললেন, ভীম আমার দেহ ক্ষতবিক্ষত করেছে, যুদ্ধে থাকা কর্তব্য সেজন্যই আমি এখানে আছি, কিন্তু আমার অঙ্গসকল অচল হয়ে আছে; তথাপি আমি যথাশক্তি , যুদ্ধ করব। মহারাজ, তোমার জন্য আমি পুরুষকার আশ্রয় করে অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করব, কিন্তু জয় দৈবের অধীন।

তীক্ষ্ম শরাঘাতে অর্জুন বিপক্ষের সৈন্য হস্তী ও অশ্ব সংহার করতে লাগলেন এবং ভীমসেন ও সাত্যকি কর্তৃক রক্ষিত হয়ে ক্রমশ জয়দ্রথের নিকটস্থ হলেন। দুর্যোধন কর্ণ কৃপ প্রভৃতি অর্জুনকে বেষ্টন করলেন কিন্তু অর্জুনের প্রচণ্ড বাণবর্ষণে তাঁরা আকুল হয়ে সরে গেলেন। অর্জুনের শরাঘাতে জয়দ্রথের সারথির মুণ্ড এবং রথের বরাহধ্বজ ভূপাতিত হল। সূর্য দ্রুতগতিতে অস্তাচ’লে যাচ্ছেন দেখে কৃষ্ণ বললেন, ভীত জয়দ্রথকে ছ জন মহারথ রক্ষা করছেন, এঁদের জয় না করে কিংবা ছলনা ভিন্ন তুমি জয়দ্রথকে বধ করতে পারবে না। আমি যোগবলে সূর্যকে আবৃত করব, তখন সূর্যাস্ত হয়ে গেছে ভেবে জয়দ্রথ আর আত্মগোপন করবেন না, সেই অবকাশে তুমি তাকে প্রহার করো।

যোগীশ্বর হরি যোগযুক্ত হয়ে সূর্যকে তমসাচ্ছন্ন করলেন। সূর্যাস্ত হয়েছে, এখন অর্জুন অগ্নিপ্রবেশ করবেন-এই ভেবে কৌরবযোদ্ধারা হৃষ্ট হলেন। জয়দ্রথ ঊর্ধ্বমুখ হয়ে সূর্য দেখতে পেলেন না। কৃষ্ণ বললেন, অর্জুন, জয়দ্রথ ভয়মুক্ত হয়ে সূর্য দেখছেন, দূরাত্মাকে বধ করবার এই সময়।

কৃপ কর্ণ শল্য দুর্যোধন প্রভৃতিকে শরাঘাতে বিতাড়িত করে অর্জুন জয়দ্রথের প্রতি ধাবিত হলেন। ধূলি ও অন্ধকারে চতুর্দিক আচ্ছন্ন হওয়ায় যোদ্ধারা কেউ কাকেও দেখতে পেলেন না, অশ্বারোহী গজারোহী ও পদাতি সৈন্য অর্জুনের বাণে বিদারিত হয়ে পালাতে লাগল। কৃষ্ণ পুনর্বার বললেন, অর্জুন, জয়দ্রথের শিরচ্ছেদ কর, সূর্য অস্তে যাচ্ছেন। যা করতে হবে শোন।

–বিখ্যাত রাজা বৃদ্ধক্ষত্র জয়দ্রথের পিতা। পুত্রের জন্মকালে তিনি এই দৈববাণী শুনেছিলেন যে রণস্থলে কোনও শত্রু এর শিরচ্ছেদন করবে। পুত্রবৎসল বৃদ্ধক্ষত্র এই অভিশাপ দিলেন-যে আমার পুত্রের মস্তক ভূমিতে ফেলবে তার মস্তক শতধা বিদীর্ণ হবে। তার পর যথাকালে জয়দ্রথকে রাজপদ দিয়ে বৃদ্ধক্ষত্র বনগমন করলেন, এখন তিনি সমস্তপঞ্চকের বাইরে দুষ্কর তপস্যা করছেন। অর্জুন, তুমি অদ্ভুতশক্তিসম্পন্ন কোনও দিব্য অস্ত্র দিয়ে জয়দ্রথের মুণ্ড কেটে বৃদ্ধক্ষত্রের ক্রোড়ে ফেল। যদি ভূমিতে ফেল তবে তোমার মস্তক বিদীর্ণ হবে।

ওষ্ঠপ্রান্ত লেহন করে অর্জুন এক মন্ত্রসিদ্ধ বজ্রতুল্য বাণ নিক্ষেপ করলেন। সেই বাণ শ্যেন পক্ষীর ন্যায় দ্রুতবেগে গিয়ে জয়দ্রথের মুণ্ড ছেদন করে আকাশে উঠল। অর্জুনের আরও কতকগুলি বাণ সেই মুণ্ড উর্ধ্বে বহন করে নিয়ে চলল, অর্জুন পুনর্বার ছয় মহারথের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। এই সময়ে ধৃতরাষ্ট্রের বৈবাহিক রাজা বৃদ্ধক্ষত্ৰ সন্ধ্যাবন্দনা করছিলেন। সহসা কৃষ্ণকেশ ও কুণ্ডলে শোভিত জয়দ্রথের মস্তক তাঁর ক্রোড়ে পতিত হল। বৃদ্ধক্ষত্র ত্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে উঠলেন, তখন তার পুত্রের মস্তক ভূমিতে পড়ল, তার নিজের মস্তকও শতধা বিদীর্ণ হল।

তারপর কৃষ্ণ অন্ধকার অপসারিত করলেন। কৌরবগণ বুঝলেন বাসুদেবের মায়াবলে এমন হয়েছে। দুর্যোধন ও তার ভ্রাতারা অমোচন করতে লাগলেন। কৃষ্ণ অর্জুন ভীম সাত্যকি প্রভৃতি শঙ্খধ্বনি করলেন, সেই নিনাদ শুনে যুধিষ্ঠির বুঝলেন যে জয়দ্রথ নিহত হয়েছেন।

১৫। দুর্যোধনের ক্ষোভ

দুর্যোধন বিষগ্নমনে দ্রোণকে বললেন, আচার্য, আমাদের কিরূপ ধ্বংস হচ্ছে দেখুন। পিতামহ ভীষ্ম, মহাবীর জলসন্ধ, কাম্বোজরাজ সুদক্ষিণ, রাক্ষসরাজ অলম্বুষ, মহাবল ভূরিশ্রবা, সিন্ধুরাজ জয়দ্ৰথ, এবং আমার অসংখ্য সৈন্য নিহত হয়েছে। আমি লোভী পাপী ধর্মনাশক, তাই আমার জয়াভিলাষী যোদ্ধারা যমালয়ে গেছেন। পাণ্ডব আর পাঞ্চালদের যুদ্ধে বধ করে আমি শান্তিলাভ করব কিংবা নিজে নিহত হয়ে বীরলোকে যাব। আমি সহায়হীন, সকলে পাণ্ডবদের হিতকামনা যেমন করেন তেমন আমার করেন না। ভীষ্ম নিজেই নিজের মৃত্যুর উপায় বলে দিলেন, অর্জুন আপনার শিষ্য তাই আপনিও যুদ্ধে উপেক্ষা করছেন। আমার আর জীবনে প্রয়োজন নেই। পাণ্ডবগণের আচার্য, আপনি আমাকে মরণের অনুমতি দিন।

দ্রোণ বললেন, তুমি আমাকে বাক্যবাণে পীড়িত করছ কেন? আমি সর্বদাই বলে থাকি যে সব্যসাচীকে জয় করা অসম্ভব। তোমরা জয়দ্রথকে রক্ষা করবার জন্য অর্জুনকে বেষ্টন করেছিলে; তুমি কর্ণ কৃপ শল্য ও অশ্বত্থামা জীবিত থাকতে জয়দ্রথ নিহত হলেন কেন? তিনি অর্জুনের হাতে নিস্তার পাননি, আমিও নিজের জীবন রক্ষার উপায় দেখছি না। আমি অত্যন্ত সন্তপ্ত হয়ে আছি, এর উপর তুমি তীক্ষ্ণ বাক্য বলছ কেন? যখন ভূরিশ্রবা আর সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ নিহত হয়েছেন তখন আর কে অবশিষ্ট থাকবে? দুর্যোধন, আমি সমস্ত পাণ্ডবসৈন্য ধ্বংস না করে বর্ম খুলব না। তুমি অশ্বত্থামাকে বলো সে জীবিত থাকতে যেন সোমকগণ রক্ষা না পায়। তোমার বাক্যে পীড়িত হয়ে আমি শত্রুবাহিনীর মধ্যে প্রবেশ করছি; যদি পার তবে কৌরবসৈন্য রক্ষা করো, আজ রাত্রিতেও যুদ্ধ হবে। এই বলে দ্রোণ পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়গণের প্রতি ধাবিত হলেন।

দুর্যোধন কর্ণকে বললেন, দ্রোণ যদি পথ ছেড়ে না দিতেন তবে অর্জুন কি ব্যহ ভেদ করতে পারত? সে চিরকালই দ্রোণের প্রিয় তাই যুদ্ধ না করেই দ্রোণ তাকে প্রবেশ করতে দিয়েছিলেন। প্রাণরক্ষার জন্য জয়দ্রথ গৃহে যেতে চেয়েছিলেন, দ্রোণ তাঁকে অভয় দিলেন, কিন্তু আমার নিগুণতা দেখে অর্জুনকে বৃহদ্বার ছেড়ে দিলেন। আমরা অনার্য দুরাত্মা, তাই আমাদের সমক্ষেই আমার চিত্রসেন প্রভৃতি ভ্রাতারা ভীমের হাতে বিনষ্ট হয়েছেন।

কর্ণ বললেন, তুমি আচার্যের নিন্দা করো না, এই ব্রাহ্মণ জীবনের আশা ত্যাগ করে যথাশক্তি যুদ্ধ করছেন। তিনি স্থবির, শীঘ্রগমনে অক্ষম, বাহুচালনাতেও অশক্ত হয়েছেন। অস্ত্রবিশারদ হলেও তিনি পাণ্ডবদের জয় করতে পারবেন না। দুর্যোধন, আমরাও যথাশক্তি যুদ্ধ করছিলাম তথাপি সিন্ধুরাজ নিহত হয়েছেন, এজন্য মনে করি দৈবই প্রবল। আমরা পাণ্ডবদের সঙ্গে শঠতা করেছি, বিষ দিয়েছি, জতুগৃহে অগ্নি দিয়েছি, দ্যুতে পরাজিত করেছি, রাজনীতি অনুসারে বনবাসে পাঠিয়েছি, কিন্তু দৈবের প্রভাবে সবই নিষ্ফল হয়েছে। তুমি ও পাণ্ডবরা মরণপণ করে সর্বপ্রযত্নে যুদ্ধ কর, দৈব তার নিজ মার্গেই চলবে। সৎ বা অসৎ সকল কার্যের পরিণামে দৈবই প্রবল, মানুষ নিদ্রিত থাকলেও অনন্য-কৰ্মা দৈব জেগে থাকে।

॥ ঘটোৎকচবধপর্বাধ্যায়॥

১৬। সোমদত্ত-বাহ্বীক-বধ-কৃপ-কর্ণ-অশ্বত্থামার কলহ (চতুর্দশ দিনের আরও যুদ্ধ)

সন্ধ্যাকালে ভীরুর ত্রাসজনক এবং বীরের হর্ষবর্ধক নিদারুণ রাত্রিযুদ্ধ আরম্ভ হল পাণ্ডব পাঞ্চাল ও সৃঞ্জয়গণ মিলিত হয়ে দ্রোণের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন।

ভূরিশ্রবার পিতা সোমদত্ত সাত্যকিকে বললেন, তুমি ক্ষত্রধর্ম ত্যাগ করে দস্যুর ধর্মে রত হলে কেন ? বৃষ্ণিবংশে দুজন মহারথ বলে খ্যাত, প্রদ্যুম্ন ও তুমি। দক্ষিণবাহুহীন প্রয়োপবেশনে উপবিষ্ট ভূরিশ্রবাকে তুমি কেন হত্যা করলে? আমি শপথ করছি, অর্জুন যদি রক্ষা না করেন তবে এই রাত্রি অতীত না হতেই তোমাকে বধ করব নতুবা ঘোর নরকে যাব। সাত্যকির সঙ্গে যুদ্ধে আহত হয়ে সোমদত্ত মূৰ্ছিত হলেন, তার সারথি তাঁকে সরিয়ে নিয়ে গেল।

অশ্বত্থামার সঙ্গে ঘটোৎকচের ভীষণ যুদ্ধ হতে লাগল। ঘটোৎকচপুত্র অঞ্জনপর্বা অশ্বত্থামা কর্তৃক নিহত হলেন। ঘটোৎকচ বললেন, দ্রোণপুত্র, তুমি আজ আমার হাতে রক্ষা পাবে না। অশ্বত্থামা বললেন, বৎস, আমি তোমার পিতার তুল্য, তোমার উপর আমার অধিক ক্রোধ নেই। ঘটোৎকচ, ক্রুদ্ধ হয়ে মায়াযুদ্ধ করতে লাগলেন। তার অনুচর এক অক্ষৌহিণী রাক্ষসকে অশ্বত্থামা বিনষ্ট করলেন। সোমদত্ত আবার যুদ্ধ করতে এসে ভীমের পরিঘ ও সাত্যকির বাণের আঘাতে নিহত হলেন। সোমদত্তের পিতা বাহ্লীকরাজ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ভীমকে আক্রমণ করলেন, গদাঘাতে ভীম তাঁকে বধ করলেন।

দুর্যোধন কর্ণকে বললেন, মিত্রবৎসল কর্ণ, পাণ্ডবপক্ষীয় মহারথগণ আমার যোদ্ধাদের বেষ্টন করেছেন, তুমি ওঁদের রক্ষা কর। কর্ণ বললেন, আমি জীবিত থাকতে তুমি বিষাদগ্রস্ত হয়ো না, সমস্ত পাণ্ডবদের আমি জয় করব। কৃপাচার্য ঈযৎ হাস্য করে বললেন, ভাল ভাল! কেবল কথাতেই যদি কার্যসিদ্ধি হত তবে তুমি দুর্যোধনের সেনা রক্ষা করতে পারতে। সূতপুত্র, তুমি সর্বত্রই পাণ্ডবদের হাতে পরাজিত হয়েছ, এখন বৃথা গর্জন না করে যুদ্ধ কর। কর্ণ ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, বীরগণ বর্ষার মেঘের ন্যায় গর্জন করেন, এবং যথাকালে রোপিত বীজের ন্যায় শীঘ্র ফলও দেন। তারা যদি যুদ্ধের ভার নিয়ে গর্ব প্রকাশ করেন তাতে আমি দোষ দেখি না। ব্রাহ্মণ, পাণ্ডব ও কৃষ্ণ প্রভৃতিকে মারবার সংকল্প করে যদি আমি গর্জন করি তবে আপনার তাতে কি ক্ষতি? আপনি আমার গর্জনের ফল দেখতে পাবেন, আমি শত্রুবধ করে দুর্যোধনকে নিষ্কণ্টক রাজ্য দেব। কৃপ বললেন, তুমি প্রলাপ বকছ, কৃষ্ণ ও অর্জুন যে পক্ষে আছেন সেই পক্ষে নিশ্চয় জয় হবে। কর্ণ সহাস্যে বললেন, ব্রাহ্মণ, আমার কাছে ইন্দ্রদত্ত অমোঘ শক্তি অস্ত্র আছে, তার দ্বারাই আমি অর্জুনকে বধ করব। আপনি বৃদ্ধ, যুদ্ধে অক্ষম, পাণ্ডবদের প্রতি স্নেহযুক্ত, সেজন্য মোহবশে আমাকে অবজ্ঞা করেন। দুর্মতি ব্রাহ্মণ, যদি পুনর্বার আমাকে অপ্রিয় বাক্য বলেন তবে খড়্গ দিয়ে আপনার জিহ্বা ছেদন করব। আপনি রণস্থলে কৌরবসেনাকে ভয় দেখিয়ে পাণ্ডবদের স্তুতি করতে চান!

মাতুল কৃপাচার্যকে কর্ণ ভর্ৎসনা করছেন দেখে অশ্বত্থামা খড়্গ উদ্যত করে বেগে উপস্থিত হলেন। তিনি দুর্যোধনের সমক্ষেই কর্ণকে বললেন, নরাধম, তুমি নিজের বীরত্বের দর্পে অন্য কোনও ধনুর্ধরকে গণনা কর না! অর্জুন যখন তোমাকে পরাস্ত করে জয়দ্রথকে বধ করেছিলেন তখন তোমার বীরত্ব আর অস্ত্র কোথায় ছিল? আমার মাতুল অর্জুন সম্বন্ধে যথার্থ বলেছেন তাই তুমি ভৎর্সনা করছ! দুর্মতি, আজ আমি তোমার শিরচ্ছেদ করব। এই বলে অশ্বত্থামা কর্ণের প্রতি ধাবিত হলেন, তখন দুর্যোধন ও কৃপ তাঁকে নিবারণ করলেন। দুর্যোধন বললেন, অশ্বত্থামা, প্রসন্ন হও, সূতপুত্রকে ক্ষমা কর। কর্ণ কৃপ দ্রোণ শল্য শকুনি আর তোমার উপর মহৎ কার্যের ভার রয়েছে। মহামনা শান্তস্বভাব কৃপাচার্য বললেন, দুর্মতি সূতপুত্র, আমরা তোমাকে ক্ষমা করলাম, কিন্তু অর্জুন তোমার দর্প চূর্ণ করবেন।

তার পর কর্ণ ও দুর্যোধন পাণ্ডবযোদ্ধাদের সঙ্গে ঘোর যুদ্ধে রত হলেন। অশ্বত্থামা দুর্যোধনকে বললেন, আমি জীবিত থাকতে তোমার যুদ্ধ করা উচিত নয়; তুমি ব্যস্ত হয়ো না, আমিই অর্জুনকে নিবারণ করব। দুর্যোধন বললেন, দ্বিজশ্রেষ্ঠ, দ্রোণাচার্য পুত্রের ন্যায় পাণ্ডবদের রক্ষা করেন, তুমিও তাদের উপেক্ষা করে থাক। অশ্বত্থামা, প্রসন্ন হও, আমার শত্রুদের নাশ কর। অশ্বত্থামা বললেন, তোমার কথা সত্য, পাণ্ডবরা আমার ও আমার পিতার প্রিয়। আমরাও তাদের প্রিয়, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে নয়। আমরা প্রাণের ভয় ত্যাগ করে যথাশক্তি যুদ্ধ করি। দুর্যোধনকে আশ্বস্ত করে অশ্বত্থামা রণস্থলে গেলেন এবং বিপক্ষ যোদ্ধৃগণকে নিপীড়িত করতে লাগলেন।

১৭। কৃষ্ণার্জুন ও ঘটোৎকচ (চতুর্দশ দিনের আরও যুদ্ধ)

গাঢ় অন্ধকারে বিমূঢ় হয়ে সৈন্যরা পরস্পরকে বধ করছে দেখে দুর্যোধন তার পদাতিদের বললেন, তোমরা অস্ত্র ত্যাগ করে হাতে জ্বলন্ত প্রদীপ নাও। পদাতিরা প্রদীপ ধরলে যুদ্ধভূমির অন্ধকার দূর হল। পাণ্ডবরাও পদাতি সৈন্যের হাতে প্রদীপ দিলেন। প্রত্যেক হস্তীর পৃষ্ঠে সাত, রথে দশ, অশ্বে দুই, এবং সেনার পার্শ্বে পশ্চাতে ও ধ্বজেও প্রদীপ দেওয়া হল।

সেই নিদারুণ রাত্রিযুদ্ধে এক বার পাণ্ডবপক্ষের অন্য বার কৌরবপক্ষের জয় হ’তে লাগল। স্বয়ংবরসভায় যেমন বিবাহার্থীদের নাম ঘোষিত হয় সেইরূপ রাজারা নিজ নিজ নাম ও পরিচয় শুনিয়ে বিপক্ষকে প্রহার করতে লাগলেন। অর্জুনের প্রবল শরবণে কৌরবসৈন্য ভয়ার্ত হয়ে পালাচ্ছে দেখে দুর্যোধন দ্রোণ ও কর্ণকে বললেন, অর্জুন জয়দ্রথকে বধ করেছে সেজন্য ক্রুদ্ধ হয়ে আপনারাই রাত্রিকালে এই যুদ্ধ আরম্ভ করেছেন। পাণ্ডবসৈন্য আমাদের সৈন্য সংহার করছে, আর আপনারা অক্ষমের ন্যায় তা দেখছেন। হে মাননীয় বীরদ্বয়, যদি আমাকে ত্যাগ করাই আপনাদের ইচ্ছা ছিল তবে আমাকে আশ্বাস দেওয়া আপনাদের উচিত হয়নি। আপনাদের অভিপ্রায় জানলে এই সৈন্যক্ষয়কর যুদ্ধ আরম্ভ করতাম না। যদি আমাকে ত্যাগ করতে না চান তবে যুদ্ধে আপনাদের বিক্রম প্রকাশ করুন। দুর্যোধনের বাক্যরূপ কশাঘাতে দ্রোণ ও কর্ণ পদাহত সর্পের ন্যায় উত্তেজিত হয়ে যুদ্ধ করতে গেলেন।

কর্ণের শরবর্ষণে আকুল হয়ে পাণ্ডবসৈন্য পালাচ্ছে দেখে যুধিষ্ঠির অর্জুনকে বললেন, আমাদের যোদ্ধারা অনাথের ন্যায় বন্ধুদের ডাকছে, কর্ণের শরসন্ধান আর শরত্যাগের মধ্যে কোনও অবকাশ দেখা যাচ্ছে না, নিশ্চয় আজ ইনি আমাদের সংহার করবেন। ধনঞ্জয়, কর্ণের বধের জন্য যা করা উচিত তা কর। অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন, আমাদের রথীরা পালাচ্ছেন আর কর্ণ নির্ভয়ে তাদের শরাঘাত করছেন, এ আমি সইতে পারছি না। মধুসূদন, শীঘ্র কর্ণের কাছে রথ নিয়ে চল, হয় আমি তাঁকে মারব না হয় তিনি আমাকে মারবেন।

কৃষ্ণ বললেন, তুমি অথবা রাক্ষস ঘটোৎকচ ভিন্ন আর কেউ কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারবে না। এখন তার সঙ্গে তোমার যুদ্ধ করা আমি উচিত মনে করি না, কারণ তাঁর কাছে ইন্দ্রদত্ত শক্তি অস্ত্র আছে, তোমাকে মারবার জন্য কর্ণ এই ভয়ংকর তাস্ত্র সর্বদা সঙ্গে রাখেন। অতএব ঘটোৎকচই তার সঙ্গে যুদ্ধ করুক। ভীমসেনের এই পুত্রের কাছে দৈব রাক্ষস ও আসুর সর্বপ্রকার অস্ত্রই রয়েছে, সে কর্ণকে জয় করবে তাতে আমার সংশয় নেই।

কৃষ্ণের আহ্বান শুনে দীপ্তকুণ্ডলধারী সশস্ত্র মেঘবর্ণ ঘটোৎকচ এসে অভিবাদন। করলেন। কৃষ্ণ সহাস্যে বললেন, পুত্র ঘটোৎকচ, এমন একমাত্র তোমারই বিক্রমপ্রকাশের সময় উপস্থিত হয়েছে। তোমার আত্মীয়গণ বিপৎসাগরে নিমগ্ন হয়েছেন, তুমি তাদের রক্ষা কর। কর্ণ পাণ্ডবসৈন্য নিপীড়িত করছেন, ক্ষত্রিয় বীরগণকে হনন করছেন, এই নিশীথকালে পাঞ্চালরা সিংহের ভয়ে মৃগের ন্যায় পালিয়ে যাচ্ছে। তোমার নানাবিধ অস্ত্র ও রাক্ষসী মায়া আছে, আর রাক্ষসগণ রাত্রিতেই অধিক বলবান হয়।

অর্জুন বললেন, ঘটোৎকচ, আমি মনে করি সর্বসৈন্যমধ্যে তুমি, সাত্যকি আর ভীমসেন এই তিন জনই শ্রেষ্ঠ। তুমি এই রাত্রিতে কর্ণের সঙ্গে দ্বৈরথ যুদ্ধ কর, সাত্যকি তোমার পাঠরক্ষক হবেন।

ঘটোৎকচ বললেন, নরশ্রেষ্ঠ, আমি একাকীই কর্ণ দ্রোণ এবং অন্য ক্ষত্রিয় বীরগণকে জয় করতে পারি। আমি এমন যুদ্ধ করব যে লোকে চিরকাল তার কথা বলবে। কোনও বীরকে আমি ছাড়ব না, ভয়ে কৃতাঞ্জলি হলেও নয়, রাক্ষস-ধর্ম অনুসারে সকলকেই বধ করব। এই বলে ঘটোৎকচ কর্ণের দিকে ধাবিত হলেন।

১৮। ঘটোৎকচবধ (চতুর্দশ দিনের আরও যুদ্ধ)

ঘটোৎকচের দেহ বিশাল, চক্ষু লোহিত, শ্মশ্রু পিঙ্গল, মুখ আকৰ্ণ-বিস্তৃত, দন্ত করাল, অঙ্গ নীলবর্ণ, মস্তক বৃহৎ, তার উপরে বিকট কেশচূড়া। তাঁর দেহে কাংস্যনির্মিত উজ্জ্বল বর্ম, মস্তকে শুভ্র কিরীট, কর্ণে অরুণবর্ণ কুণ্ডল। তার বৃহৎ রথ ভল্লুকচর্মে আচ্ছাদিত এবং শত অশ্বে বাহিত। সেই রথের আকাশস্পর্শী ধ্বজের উপর এক ভীষণ মাংসাশী গৃধ্র বসে আছে।

কর্ণ ও ঘটোৎকচ শরক্ষেপণ করতে করতে পরস্পরের দিকে ধাবিত হলেন। কিছুক্ষণ পরে ঘটোৎকচ মায়াযুদ্ধ আরম্ভ করলেন। ঘোরদর্শন রাক্ষস সৈন্য আবির্ভূত হয়ে শিলা লৌহচক্র তোমর শূল শতঘ্নী পট্টিশ প্রভৃতি বর্ষণ করতে লাগল, কৌরব যোদ্ধারা ভীত হয়ে পশ্চাৎপদ হলেন, কেবল কর্ণ অবিচলিত থেকে বাণবর্ষণ করতে লাগলেন। শরবিদ্ধ হয়ে ঘটোৎকচের দেহ শজারুর ন্যায় কণ্টকিত হল। একবার দৃশ্য হয়ে, আবার অদৃশ্য হয়ে, কখনও আকাশে উঠে, কখনও ভূমি বিদীর্ণ করে ঘটোৎকচ যুদ্ধ করতে লাগলেন। সহসা তিনি নিজেকে বহু রূপে বিভক্ত করলেন, সিংহ ব্যাঘ্র তরঙ্কু সর্প, তীক্ষ্মচঞ্চু পক্ষী, রাক্ষস পিশাচ কুকুরু বৃক প্রভৃতি আবির্ভূত হয়ে কর্ণকে ভক্ষণ করতে গেল। শরাঘাতে কর্ণ তাদের একে একে বধ করলেন।

অলায়ুধ নামে এক রাক্ষস দুর্যোধনের কাছে এসে বললে, মহারাজ, হিড়িম্ব বক ও কির্মীর আমার বন্ধু ছিলেন, ভীম তাদের বধ করেছে, কন্যা হিড়িম্বাকে ধর্ষণ করেছে। আমি আজ কৃষ্ণ ও পাণ্ডবগণকে সসৈন্যে হত্যা করে ভক্ষণ করব। দুর্যোধনের অনুমতি পেয়ে অলায়ুধ ভীমের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেল। ঘটোৎকচ তার মুণ্ড কেটে দুর্যোধনের দিকে নিক্ষেপ করলেন। তার মায়াসৃষ্ট রাক্ষসগণ অগণিত সৈন্য বধ করতে লাগল। কুরুবীরগণ রণে ভঙ্গ দিয়ে বললেন, কৌরবগণ, পালাও, ইন্দ্রাদি দেবতারা পাণ্ডবদের জন্য আমাদের বধ করছেন।

চক্ৰযুক্ত একটি শতঘ্নী নিক্ষেপ করে ঘটোৎকচ কর্ণের চার অশ্ব বধ করলেন। কৌরবগণ সকলে কর্ণকে বললেন, তুমি শীঘ্র শক্তি অস্ত্রে এই রাক্ষসকে বধ কর, নতুবা আমরা সসৈন্যে বিনষ্ট হব। কর্ণ দেখলেন, ঘটোৎকচ সৈন্যসংহার করছেন, কৌরবগণ ত্রস্ত হয়ে আর্তনাদ করছেন। তখন তিনি ইন্দ্রপ্রদত্ত বৈজয়ন্তী শক্তি নিলেন। অর্জুনকে বধ করবার জন্য কর্ণ বহু বৎসর এই অস্ত্র সযত্নে রেখেছিলেন। এখন তিনি কৃতান্তের জিহ্বার ন্যায় লেলিহান, উল্কার ন্যায় দীপ্যমান, মৃত্যুর ভগিনীর ন্যায় ভীষণ সেই শক্তি ঘটোৎকচের প্রতি নিক্ষেপ করলেন। ঘটোৎকচ ভীত হয়ে নিজের দেহ বিন্ধ্য পর্বতের ন্যায় বৃহৎ করে বেগে পিছনে সরে গেলেন। কর্ণের হস্তনিক্ষিপ্ত শক্তি ঘটোৎকচের সমস্ত মায়া ভস্ম করে এবং তার বক্ষ বিদীর্ণ করে আকাশে নক্ষত্রগণের মধ্যে চ’লে গেল। মরণকালে ঘটোৎকচ আর এক আশ্চর্য কার্য করলেন। তিনি পর্বত ও মেঘের ন্যায় বিশাল দেহ ধারণ করে আকাশ থেকে পতিত হলেন; তার প্রাণহীন দেহের ভারে কৌরববাহিনীর এক অংশ নিষ্পেষিত হল।।

কৌরবগণ হৃষ্ট হয়ে সিংহনাদ ও বাদ্যধ্বনি করতে লাগলেন, কর্ণ বৃহন্তা ইন্দ্রের ন্যায় পূজিত হলেন।

ঘটোৎকচের মৃত্যুতে পাণ্ডবগণ শোকে অশ্রুমোচন করতে লাগলেন, কিন্তু কৃষ্ণ হৃষ্ট হয়ে সিংহনাদ করে অর্জুনকে আলিঙ্গন করলেন। তিনি অশ্বের রশ্মি সংযত করে রথের উপর নৃত্য করতে লাগলেন এবং বার বার তাল ঠুকে গর্জন করলেন। অর্জুন অপ্রীত হয়ে বললেন, মধুসূদন, আমরা শোকগ্রস্ত হয়েছি, তুমি অসময়ে হর্যপ্রকাশ করছ। তোমার এই অধীরতার কারণ কি?

কৃষ্ণ বললেন, আজ কর্ণ ঘটোৎকচের উপর শক্তি নিক্ষেপ করেছেন, তার ফলে তিনি নিজেই যুদ্ধে নিহত হবেন। ভাগ্যক্রমে কর্ণের অক্ষয় কবচ আর কুন্ডল দূর হয়েছে, ভাগ্যক্রমে ইন্দ্রদত্ত অমোঘ শক্তিও ঘটোৎকচকে মেরে অপসৃত হয়েছে। অর্জুন, তোমার হিতের জন্যই আমি জরাসন্ধ শিশুপাল আর একলব্যকে একে একে নিহত করিয়েছি, হিড়িম্ব কির্মীর বক অলায়ুধ এবং উগ্রকর্মা ঘটোৎকচকেও নিপাতিত করিয়েছি। অর্জুন বললেন, আমার হিতের জন্য কেন? কৃষ্ণ উত্তর দিলেন, জরাসন্ধ শিশুপাল আর একলব্য না মরলে এখন ভয়ের কারণ হতেন, দুর্যোধন নিশ্চয় তাদের বরণ করতেন এবং তারাও এই যুদ্ধে কুরুপক্ষে যেতেন। নরশ্রেষ্ঠ, তোমার সহায়তায় দেবদ্বেষীদের বিনাশ এবং জগতের হিতসাধনের জন্য আমি জন্মেছি। হিড়িম্ব বক আর কির্মীরকে ভীমসেন মেরেছেন, ঘটোৎকচ অলায়ুধকে মেরেছে, কর্ণ ঘটোৎকচের উপর শক্তি নিক্ষেপ করেছেন। কর্ণ যদি বধ না করতেন তবে আমিই ঘটোৎকচকে বধ করতাম, কিন্তু তোমাদের প্রীতির জন্য তা করি নি। এই রাক্ষস ব্রাহ্মণদ্বেষী যজ্ঞদ্বেষী ধর্মনাশক পাপাত্মা, সেজন্যই কৌশলে তাকে নিপাতিত করিয়েছি, ইন্দ্রের শক্তিও ব্যয়িত করিয়েছি। আমিই কর্ণকে বিমোহিত করেছিলাম, তাই তিনি তোমার জন্য রক্ষিত শক্তি ঘটোৎকচের উপর নিক্ষেপ করেছেন।

ঘটোৎকচের মৃত্যুতে যুধিষ্ঠির কাতর হয়েছেন দেখে কৃষ্ণ বললেন, ভরতশ্রেষ্ঠ, আপনি শোক করবেন না, এরূপ বিহ্বলতা আপনার যোগ্য নয়। আপনি উঠুন, যুদ্ধ করুন, গুরুভার বহন করুন। আপনি শোকাকুল হলে আমাদের জয়লাভ সংশয়ের বিষয় হবে। যুধিষ্ঠির হাত দিয়ে চোখ মুছে বললেন, মহাবাহু, যে লোক উপকার মনে রাখে না তার ব্রহ্মহত্যার পাপ হয়। আমাদের বনবাসকালে ঘটোৎকচ বালক হলেও বহু সাহায্য করেছিল। অর্জুনের অনুপস্থিতিকালে সে কাম্যক বনে আমাদের কাছে ছিল, যখন আমরা গন্ধমাদন পর্বতে যাই তখন তার সাহায্যেই আমরা অনেক দুর্গম স্থান পার হতে পেরেছিলাম, পরিশ্রান্তা পাঞ্চালীকেও সে পৃষ্ঠে বহন করেছিল। এই যুদ্ধে সে আমার জন্য বহু দুঃসাধ্য কর্ম করেছে। সে আমার ভক্ত ও প্রিয় ছিল, তার জন্য আমি শোকার্ত হয়েছি। জনার্দন, তুমি ও আমরা জীবিত থাকতে এবং অর্জুনের সমক্ষে ঘটোৎকচ কেন কর্ণের হাতে নিহত হল? অর্জুন অল্প কারণে জয়দ্রথকে বধ করেছেন, তাতে আমি বিশেষ প্রীত হইনি। যদি শত্রুবধ করাই ন্যায্য হয় তবে আমি বিশেষ প্রীত হইনি। যদি শত্রুবধ করাই ন্যায্য হয় তবে আগে দ্রোণ ও কর্ণকেই বধ করা উচিত, এঁরাই আমাদের দুঃখের মূল। যেখানে দ্রোণ আর কর্ণকে মারা উচিত সেখানে অর্জুন জয়দ্রথকে মেরেছেন। মহাবাহু ভীমসেন এখন দ্রোণের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন, আমি নিজেই কর্ণকে বধ করতে যাব।

যুধিষ্ঠির বেগে কর্ণের দিকে যাচ্ছিলেন এমন সময় ব্যাসদেব এসে তাকে বললেন, যুধিষ্ঠির, ভাগ্যক্রমে অর্জুন কর্ণের সঙ্গে দ্বৈরথ যুদ্ধ করেননি তাই তিনি ইন্দ্রদত্ত শক্তির প্রহার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। ঘটোৎকচ নিহত হওয়ায় অর্জুন রক্ষা পেয়েছেন। বৎস, ঘটোৎকচের জন্য শোক করো না, তুমি ভ্রাতাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে যুদ্ধ কর। আর পাঁচদিন পরে তুমি পৃথিবীর অধিপতি হবে। তুমি সর্বদা ধর্মের চিন্তা কর, যেখানে ধর্ম সেখানেই জয় হয়। এই বলে ব্যাস অন্তর্হিত হলেন।

॥ দ্রোণবধপর্বাধ্যায়॥

১৯। দ্রুপদ-বিরাট-বধ-দুর্যোধনের বাল্যস্মৃতি (পঞ্চদশ দিনের যুদ্ধ)

সেই ভয়ংকর রাত্রির অধভাগ অতীত হলে সৈন্যরা পরিশ্রান্ত ও নিদ্রাতুর হয়ে পড়ল। অনেকে অস্ত্র ত্যাগ করে হস্তী ও অশ্বের পৃষ্ঠে নিদ্রিত হল , অনেকে নিদ্ৰান্ধ হয়ে শত্রু মনে করে স্বপক্ষকেই বধ করতে লাগল। তাদের এই অবস্থা দেখে অর্জুন সর্ব দিক নিনাদিত করে উচ্চস্বরে বললেন, সৈন্যগণ, রণভূমি ধূলি ও অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়েছে, তোমাদের বাহন এবং তোমরা শ্রান্ত ও নিদ্ৰান্ধ হয়েছ, যদি ইচ্ছা কর তবে এই রণভূমিতে কিছু কাল নিদ্রা যাও। চন্দ্রোদয় হলে কুরুপাণ্ডবগণ বিশ্রামের পর আবার যুদ্ধ করবে। অর্জুনের এই কথা শুনে কৌরবসৈন্যরা চিৎকার করে বললে, কর্ণ, কর্ণ রাজা দুর্যোধন, পাণ্ডবসেনা যুদ্ধে বিরত হয়েছে, আপনারাও বিরত হন। তখন দুই পক্ষই যুদ্ধে নিবৃত্ত হয়ে অর্জুনের প্রশংসা করতে লাগল। সমস্ত সৈন্য নিদ্রামগ্ন হওয়ায় বোধ হল যেন কোনও নিপুণ চিত্রকর পটের উপর তাদের চিত্রিত করেছে।

কিছু কাল পরে মহাদেবের বৃষভের ন্যায়, মদনের শরাসনের ন্যায়, নববধূর ঈষৎ হাস্যের ন্যায় শ্বেতবর্ণ মনোহর চন্দ্র ক্রমশ উদিত হলেন। তখন অন্ধকার দূর হল সৈন্যগণ নিদ্রা থেকে উঠে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হল।

দুর্যোধন দ্রোণকে বললেন, আমাদের শত্রুরা যখন শ্রান্ত ও অবসন্ন হয়ে বিশ্রাম করছিল তখন আমরা তাদের লক্ষ্য রূপে পেয়েছিলাম। তারা ক্ষমার যোগ্য না হলেও আপনার প্রিয়কামনায় তাদের ক্ষমা করেছি। পাণ্ডবরা এখন বিশ্রাম করে বলবান হয়েছে। আমাদের তেজ ও শক্তি ক্রমশই কমছে, কিন্তু আপনার প্রশ্রয় পেয়ে পাণ্ডবদের ক্রমশ বলবৃদ্ধি হচ্ছে। আপনি সর্বাস্ত্রবিৎ, দিব্য অস্ত্রে ত্রিভুন সংহার করতে পারেন, কিন্তু পাণ্ডবগণকে শিষ্য জ্ঞান করে অথবা আমার দুর্ভাগ্যক্রমে আপনি তাদের ক্ষমা করে আসছেন। দ্রোণ বললেন, আমি স্থবির হয়েও যথাশক্তি যুদ্ধ করছি, অতঃপর বিজয়লাভের জন্য হীন কার্যও করব, ভাল হ’ক মন্দ হ’ক তুমি যা চাও আমি করব। আমি শপথ করছি, যুদ্ধে সমস্ত পাঞ্চাল বধ না করে আমার বর্ম খুলব না।

রাত্রির তিন মুহূর্ত অবশিষ্ট থাকতে পুনর্বার যুদ্ধ আরম্ভ হল। দ্রোণ কৌরবসেনা দুই ভাগে বিভক্ত করলেন এবং এক ভাগ নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। ক্রমশ অরুণােদয়ে চন্দ্রের প্রভা ক্ষীণ হল। বিরাট ও দ্রুপদ সসৈন্যে দ্রোণকে আক্রমণ করলেন। দ্রোণের শরাঘাতে দ্রুপদের তিন পৌত্র নিহত হলেন।চেদি কেকয় সৃঞ্জয় ও মৎস্য সৈন্যগণ পরাভূত হল। কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর দ্রোণভল্লের-আঘাতে দ্রুপদ ও বিরাটকে বধ করলেন।

ভীমসেন উগ্রবাক্যে ধৃষ্টদ্যুম্নকে বললেন, কোন্ ক্ষত্রিয় দ্রুপদের বংশে জন্মগ্রহণ করে এবং সর্বাস্ত্রবিশারদ হয়ে শত্রুকে দেখেও উপেক্ষা করে? কোন্ পুরুষ রাজসভায় শপথ করে পিতা ও পুত্রগণের হত্যা দেখেও শত্রুকে পরিত্যাগ করে ? এই বলে ভীম শরক্ষেপণ করতে করতে দ্রোণসৈন্যের মধ্যে প্রবেশ করলেন। ধৃষ্টদ্যুম্নও তার অনুসরণ করলেন।

কিছুক্ষণ পরে সূর্যোদয় হল। যোদ্ধারা বর্মাবৃতদেহে সহস্রাংশু আদিত্যের উপাসনা করলেন, তারপর আবার যুদ্ধ করতে লাগলেন। সাত্যকিকে দেখে দুর্যোধন বললেন, সখা, ক্রোধ লোভ ক্ষত্রিয়াচার ও পৌরুষকে ধিক—আমরা পরস্পরের প্রতি শরসন্ধান করছি! বাল্যকালে আমরা পরস্পরের প্রাণ অপেক্ষা প্রিয় ছিলাম, এখন এই রণস্থলে সে সমস্তই জীর্ণ হয়ে গেছে। সাত্যকি, আমাদের সেই বাল্যকালের খেলা কোথায় গেল, এই যুদ্ধই বা কেন হল? যে ধনের লোভে আমরা যুদ্ধ করছি তা নিয়ে আমরা কি করব? সাত্যকি সহাস্যে উত্তর দিলেন, রাজপুত্র, আমরা যেখানে একসঙ্গে খেলতাম এ সেই সভামণ্ডপ নয়, আচার্যের গৃহও নয়। ক্ষত্রিয়দের স্বভাবই এই, তারা গুরুজনকেও বধ করে। যদি আমি তোমার প্রিয় হই তবে শীঘ্র আমাকে বধ কর, যাতে আমি পুণ্যলোকে যেতে পারি, মিত্রদের এই ঘোর বিপদ দেখতে আমি আর ইচ্ছা করি না। এই বলে সাত্যকি দুর্যোধনের প্রতি ধাবিত হলেন এবং সিংহ ও হস্তীর ন্যায় দুজনে যুদ্ধে রত হলেন।

২০। দ্রোণের ব্রহ্মলোকে প্রয়াণ (পঞ্চদশ দিনের আরও যুদ্ধ)

দ্রোণের শরবৃষ্টিতে পাণ্ডবসেনা নিরন্তর নিহত হচ্ছে দেখে কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, হাতে ধনুর্বাণ থাকলে দ্রোণ ইন্দ্রাদি দেবগণেরও অজেয়, কিন্তু যদি অস্ত্র ত্যাগ করেন তবে মানুষও ওঁকে বধ করতে পারে। তোমরা এখন ধর্মের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে জয়ের উপায় স্থির কর, নতুবা দ্রোণই তোমাদের সকলকে বধ করবেন। আমার মনে হয়, অশ্বত্থামার মৃত্যুসংবাদ পেলে উনি আর যুদ্ধ করবেন না, অতএব কেউ ওঁকে বলুক যে অশ্বত্থামার মৃত্যুসংবাদ পেলে উনি আর যুদ্ধ করবেন না, অতএব কেউ ওঁকে বলুক যে অশ্বত্থামা যুদ্ধে হত হয়েছেন।

কৃষ্ণের এই প্রস্তাব অর্জুনের রুচিকর হল না, কিন্তু আর সকলেই এতে মত দিলেন, যুধিষ্ঠিরও নিতান্ত অনিচ্ছায় সম্মত হলেন। মালবরাজ ইন্দ্রবর্মার অশ্বত্থামা নামে এক হস্তী ছিল। ভীম তাকে গদাঘাতে বধ করলেন এবং দ্রোণের কাছে গিয়ে লজ্জিতভাবে উচ্চস্বরে বললেন, অশ্বত্থামা হত হয়েছে। বালুকাময় তটভূমি যেমন জলে গলিত হয়, ভীমসেনের অপ্রিয় বাক্য শুনে সেইরূপ দ্রোণের অঙ্গ অবসন্ন হল। কিন্তু তিনি পুত্রের বীরত্ব জানতেন, সেজন্য ভীমের কথায় অধীর হলেন না, ধৃষ্টদ্যুম্নের উপর তীক্ষ্ম বাণ ক্ষেপণ করতে লাগলেন। ধৃষ্টদ্যুম্নের রথ ও সমস্ত অস্ত্র বিনষ্ট হল , তখন ভীম তাঁকে নিজের রথে তুলে নিয়ে বললেন, তুমি ভিন্ন আর কেউ আচার্যকে বধ করতে পারবে না, তোমার উপরেই এই ভার আছে, অতএব শীঘ্র ওঁকে মারবার চেষ্টা কর।

দ্রোণ ক্রুদ্ধ হয়ে ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করলেন। বিশ হাজার পাঞ্চাল রথী, পাঁচ শ মৎস্য সৈন্য, ছ হাজার সৃঞ্জয় সৈন্য, দশ হাজার হস্তী এবং দশ হাজার অশ্ব নিপাতিত হল। এই সময়ে বিশ্বামিত্র জমদগ্নি ভরদ্বাজ গৌতম বশিষ্ঠ প্রভৃতি মহর্ষিগণ অগ্নিদবেকে পুরোবর্তী করে সূক্ষ্মদেহে উপস্থিত হয়েছে। তুমি বেদবেদাঙ্গবিৎ সত্যধর্মে নিরত ব্রাহ্মণ, এরূপ ক্রুর কর্ম করা তোমার উচিত নয়। যারা ব্রহ্মাস্ত্রে অনভিজ্ঞ এমন লোককে তুমি ব্রহ্মাস্ত্র দিয়ে মারছ, এই পাপকর্ম আর করো না, শীঘ্র অস্ত্র ত্যাগ কর।

যুদ্ধে বিরত হয়ে দ্রোণ বিষগ্নমনে যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞাসা করলেন, অশ্বত্থামা হত হয়েছেন কিনা। দ্রোণের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে ত্রিলোকের ঐশ্বর্যের জন্যও যুধিষ্ঠির মিথ্যা বলবেন না। কৃষ্ণ উদবিগ্ন হয়ে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, দ্রোণ যদি আর অর্ধ দিন যুদ্ধ করেন তবে আপনার সমস্ত সৈন্য বিনষ্ট হবে। আমাদের রক্ষার জন্য এখন আপনি সত্য না বলে মিথ্যাই বলুন, জীবনরক্ষার জন্য মিথ্যা বললে পাপ হয় না। ভীম বললেন, মালবরাজ ইন্দ্রবর্মার অশ্বত্থামা নামে এক হস্তী ছিল, সে আমাদের সৈন্য মথিত করছিল সেজন্য তাকে আমি বধ করেছি। তার পর আমি দ্রোণকে বললাম, ভগবান, অশ্বত্থামা হত হয়েছেন, আপনি যুদ্ধ থেকে বিরত হন; কিন্তু উনি আমার কথা বিশ্বাস করলেন না। মহারাজ, আপনি গোবিন্দের কথা শুনুন, দ্রোণকে বলুন যে অশ্বত্থামা মরেছেন। আপনি বললে দ্রোণ আর যুদ্ধ করবেন না।

কৃষ্ণের প্ররোচনায়, ভীমের সমর্থনে, এবং দ্ৰোণবধের ভবিতব্যতা জেনে যুধিষ্ঠির সম্মত হলেন। তাঁর অসত্যভাষণের ভয় ছিল, জয়লাভেরও আগ্রহ ছিল। তিনি উচ্চস্বরে বললেন, ‘অশ্বত্থামা হতঃ’-অশ্বত্থামা হত হয়েছেন, তার পর অস্ফুটস্বরে বললেন, ‘ইতি কুঞ্জরঃ’—এই নামের হস্তী। যুধিষ্ঠিরের রথ পূর্বে ভূমি থেকে চার আঙুল উপরে থাকত, এখন মিথ্যা বলার পাপে তার বাহনসকল ভূমি স্পর্শ করলে।

মহর্ষিদের কথা শুনে দ্রোণের ধারণা জন্মেছিল যে তিনি পাণ্ডবদের নিকট অপরাধী হয়েছেন। এখন তিনি পুত্রের মৃত্যুসংবাদে শোকে অভিভূত এবং ধৃষ্টদ্যুম্নকে দেখে উদূবিগ্ন হলেন, আর যুদ্ধ করতে পারলেন না। এই সময়ে ধৃষ্টদ্যুম্ন-যাঁকে দ্রুপদ প্রজ্বলিত অগ্নি থেকে দ্রোণবধের নিমিত্ত লাভ করেছিলেন—একটি সুদৃঢ় দীর্ঘ ধনুতে আশীবিষতুল্য শর সন্ধান করলেন। দ্রোণ সেই শর নিবারণের চেষ্টা করলেন, কিন্তু তার উপযুক্ত অস্ত্র তার স্মরণ হল না। দ্রোণের কাছে গিয়ে ভীম ধীরে ধীরে বললেন, যে হীন ব্রাহ্মণগণ স্বকর্মে তুষ্ট না থেকে অস্ত্রশিক্ষা করেছে, তারা যদি যুদ্ধে প্রবৃত্ত হত তবে ক্ষত্রিয়কুল ক্ষয় পেত না। এই সৈন্যরা নিজের বৃত্তি অনুসারে যুদ্ধ করছে, কিন্তু আপনি অব্রাহ্মণের বৃত্তি নিয়ে এক পুত্রের জন্য বহু প্রাণী বধ করছেন, আপনার লজ্জা হচ্ছে না কেন? যার জন্য আপনি অস্ত্রধারণ করে আছেন, যাঁর অপেক্ষায় আপনি জীবিত আছেন, সেই পুত্র আজ রণভূমিতে শুয়ে আছে। ধর্মরাজের বাক্যে আপনি সন্দেহ করতে পারেন না।

 দ্রোণ শরাসন ত্যাগ করে বললেন, কর্ণ, কর্ণ, কৃপ, দুর্যোধন, তোমরা যথাশক্তি যুদ্ধ কর, পাণ্ডবদের আর তোমাদের মঙ্গল হ’ক, আমি অস্ত্র ত্যাগ করলাম। এই বলে তিনি উচ্চস্বরে অশ্বত্থামাকে ডাকলেন, তার পর সমস্ত অস্ত্র রথের মধ্যে রেখে যোগস্থ হয়ে সর্বপ্রাণীকে অভয় দিলেন। এই অবসর পেয়ে ধৃষ্টদ্যুম্ন তার রথ থেকে লাফিয়ে নামলেন এবং খড়্গ নিয়ে দ্রোণের প্রতি ধাবিত হলেন। দুই পক্ষের সৈন্যরা হাহাকার করে উঠল। দ্রোণ যোগমগ্ন হয়ে মুখ কিঞ্চিৎ উন্নত করে নিমীলিতনেত্রে পরমপুরুষ বিষ্ণুকে ধ্যান করতে লাগলেন এবং ব্রহ্মস্বরূপ একাক্ষর ও-মন্ত্র স্মরণ করতে করতে ব্রহ্মলোকে যাত্রা করলেন। মৃত্যুকালে তার দেহ থেকে দিব্য জ্যোতি নির্গত হয়ে উল্কার ন্যায় নিমেষমধ্যে অন্তর্হিত হল। দ্রোণের এই ব্রহ্মলোকযাত্রা কেবল পাঁচজন দেখতে পেলেন-কৃষ্ণ কৃপ যুধিষ্ঠির অর্জুন ও সঞ্জয়।

দ্রোণ রক্তাক্তদেহে নিরস্ত্র হয়ে রথে বসে আছেন দেখে ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁর প্রতি ধাবিত হলেন। দ্রুপদপুত্র, আচার্যকে জীবিত ধরে আন, বধ করো না’—উচ্চস্বরে এই বলে অর্জুন তাকে নিবারণ করতে গেলেন; তথাপি ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রাণহীন দ্রোণের কেশ গ্রহণ করে শিরচ্ছেদ করলেন এবং খড়্গ ঘূর্ণিত করে সিংহনাদ করতে লাগলেন। তার পর তিনি দ্রোণের মুণ্ড তুলে নিয়ে কৌরব-সৈন্যগণের সম্মুখে নিক্ষেপ করলেন।

দ্রোণের মৃত্যুর পর কৌরবসৈন্য ভগ্ন হল। কুরুপক্ষের রাজারা দ্রোণের দেহের জন্য রণস্থলে অন্বেষণ করলেন, কিন্তু বহু কবন্ধের মধ্যে তা দেখতে পেলেন না। ধৃষ্টদ্যুম্নকে আলিঙ্গন করে ভীম বললেন, সূতপুত্র কর্ণ আর পাপী দুর্যোধন নিহত হলে আবার তোমাকে আলিঙ্গন করব। এই বলে ভীম হৃষ্টচিত্তে তাল ঠুকে পৃথিবী কম্পিত করতে লাগলেন।

॥ নারায়ণাস্ত্রমোক্ষপর্বাধ্যায়॥

২১। অশ্বত্থামার সংকল্প-ধৃষ্টদ্যুম্ন-সাত্যকির কলহ

দ্রোণের মৃত্যুর পর কৌরবগণ ভীত হয়ে পালাতে লাগলেন। কর্ণ শল্য কৃপ দুর্যোধন দুঃশাসন প্রভৃতি রণস্থল থেকে চ’লে এলেন। অশ্বত্থামা তখনও শিখণ্ডী প্রভৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন। কৌরবসৈন্যের ভঙ্গ দেখে তিনি দুর্যোধনের কাছে এসে বললেন, রাজা, তোমার সৈন্য পালাচ্ছে কেন? তোমাকে এবং কর্ণ প্রভৃতিকে প্রকৃতিস্থ দেখছি না, কোন্ মহারথ নিহত হয়েছেন ? দুর্যোধন অশ্বত্থামার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেন না, তার চক্ষু অপূর্ণ হল। তখন কৃপাচার্য দ্রোণের মৃত্যুর বৃত্তান্ত জানালেন। অশ্বত্থামা বারবার চক্ষু মুছে ক্রোধে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমার পিতা অস্ত্র ত্যাগ করার পর নীচাশয় পাণ্ডবগণ যেভাবে তাকে বধ করেছে এবং ধর্মধ্বজী নৃশংস অনার্য যুধিষ্ঠির যে পাপকর্ম করেছে তা শুনলাম। ন্যায়যুদ্ধে নিহত হওয়া দুঃখজনক নয়, কিন্তু সকল সৈন্যের সমক্ষে পিতার কেশাকর্ষণ করা হয়েছে। এতেই আমি মর্মান্তিক কষ্ট পাচ্ছি। নৃশংস দুরাত্মা ধৃষ্টদ্যুম্ন শীঘ্রই এর দারুণ প্রতিফল পাবে। যে মিথ্যাবাদী পাণ্ডব আচার্যকে অস্ত্রত্যাগ করিয়েছে, আজ রণভূমি সেই যুধিষ্ঠিরের রক্ত পান করবে। আমি এমন কর্ম করব যাতে পরলোকগত পিতার নিকট ঋণমুক্ত হতে পারি। আমার কাছে যে অস্ত্র আছে তা পাণ্ডবগণ কৃষ্ণ ধৃষ্টদ্যুম্ন শিখণ্ডী বা সাত্যকি কেউ জানেন না। আমার পিতা নারায়ণের পূজা করে এই অস্ত্র পেয়েছিলেন। অস্ত্রদানকালে নারায়ণ বলেছিলেন, ব্রাহ্মণ, এই অস্ত্র সহসা প্রয়োগ করবে না। শত্ৰুসংহার না করে এই অস্ত্র নিবৃত্ত হয় না। এতে কে নিহত হবে তা পূর্বে জানা যায় না, যারা অবধ্য তারাও নিহত হতে পারে। কিন্তু রথ ও অস্ত্র ত্যাগ করে শরণাগত হলে এই মহাস্ত্র থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়। দুর্যোধন, আজ আমি সেই নারায়ণাস্ত্র দিয়ে পাণ্ডব পাঞ্চাল মৎস্য ও কেকয়গণকে বিদ্রাবিত করব। গুরুহত্যাকারী পাপিষ্ঠ ধৃষ্টদ্যুম্ন আজ রক্ষা পাবে না।

দ্রোণপুত্রের এই কথা শুনে কৌরবসৈন্য আশ্বস্ত হয়ে ফিরে এল, কৌরব-শিবিরে শঙ্খ ও রণবাদ্য বাজতে লাগল। অশ্বত্থামা জলস্পর্শ করে নারায়ণাস্ত্র প্রকাশিত করলেন। তখন সগর্জনে বায়ু বইতে লাগল, পৃথিবী কম্পিত ও মহাসাগর বিক্ষুব্ধ হল , নদীস্রোত বিপরীতগামী হল সূর্য মলিন হলেন।

কৌরবশিবিরে তুমুল শব্দ শুনে যুধিষ্ঠির অর্জুনকে বললেন, দ্রোণাচার্যের নিধনের পর কৌরবরা হতাশ হয়ে রণস্থল থেকে পালিয়েছিল, এখন আবার ওদের ফিরিয়ে আনলে কে? ওদের মধ্যে ওই লোমহর্ষকর নিনাদ হচ্ছে কেন? অর্জুন বললেন, অশ্বত্থামা গর্জন করছেন। তিনি ভূমিষ্ঠ হয়েই উচ্চৈঃশ্রবার ন্যায় হেরব করেছিলেন সেজন্য তাঁর নাম অশ্বত্থামা। ধৃষ্টদ্যুম্ন আমার গুরুর কেশাকর্ষণ করেছিলেন, অশ্বত্থামা তা ক্ষমা করবেন না। মহারাজ, আপনি ধর্মজ্ঞ হয়েও রাজ্যলাভের জন্য মিথ্যা বলে মহাপাপ করেছেন। বালিবধের জন্য রামের যেমন অকীর্তি হয়েছে সেইরূপ দ্রোণবধের জন্য আপনার চিরস্থায়ী অকীর্তি হবে। এই পাণ্ডুপুত্র সর্বধর্মসম্পন্ন, এ আমার শিষ্য, এ মিথ্যা বলবে না—আপনার উপর দ্রোণের এই বিশ্বাস ছিল। আপনি অস্ত্ৰত্যাগী গুরুকে অধর্ম অনুসারে হত্যা করিয়েছেন, এখন যদি পারেন তো সকলে মিলে ধৃষ্টদ্যুম্নকে রক্ষা করুন। যিনি সর্বভূতে প্রতিমান সেই অতিমানুষ অশ্বত্থামা পিতার কেশাকর্ষণ শুনে আজ আমাদের সংহার করবেন। আমাদের বয়সের অধিকাংশই অতীত হয়েছে, এখন যে অল্পকাল অবশিষ্ট আছে তা অধর্মাচরণের জন্য বিকারগ্রস্ত হল। যিনি স্নেহের জন্য এবং ধর্মত পিতার তুল্য ছিলেন, অল্প কাল রাজ্যভোগের লোভে তাকে আমরা হত্যা করিয়েছি। হা, আমরা মহৎ পাপ করেছি!

ভীমসেন ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, অর্জুন, তুমি অরণ্যবাসী ব্রতধারী মুনির ন্যায় ধর্মকথা বলছ। কৌরবগণ অধর্ম অনুসারে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের রাজ্য হরণ করেছে, দ্রৌপদীর কেশাকর্ষণ করেছে, আমাদের তের বৎসর নির্বাসিত করেছে; এখন আমরা সেইসকল দুষ্কার্যের প্রতিশোধ নিচ্ছি। তুমি ক্ষত্রধর্ম না বুঝে আমাদের ক্ষতস্থানে ক্ষার দিচ্ছ। তোমরা চার ভ্রাতা না হয় যুদ্ধ করো না, আমি একাই গদাহস্তে অশ্বত্থামাকে জয় করব।

ধৃষ্টদ্যুম্ন অর্জুনকে বললেন, ব্রাহ্মণদের কার্য যজন যাজন অধ্যয়ন অধ্যাপন দান ও প্রতিগ্রহ। দ্রোণ তার কি করেছেন? তিনি স্বধর্ম ত্যাগ করে ক্ষত্রিয়বৃত্তি নিয়ে অলৌকিক অস্ত্রে আমাদের ধ্বংস করছিলেন। সেই নীচ ব্রাহ্মণকে যদি আমরা কুটিল উপায়ে বধ করে থাকি তবে কি অন্যায় হয়েছে? দ্রোণকে মারবার জন্যই যজ্ঞাগ্নি থেকে দ্রুপদপুত্ররূপে আমার উৎপত্তি। সেই নৃশংসকে আমি নিপাতিত করেছি, তার জন্য আমাকে অভিনন্দন করছ না কেন? তুমি জয়দ্রথের মুণ্ড নিষাদের দেশে নিক্ষেপ করেছিলে, কিন্তু আমি দ্রোণের মুণ্ড সেরূপে নিক্ষেপ করিনি, এই আমার দুঃখ। ভীষ্মকে বধ করলে যদি অধর্ম না হয় তবে দ্রোণের বধে অধর্ম হবে কেন? অর্জুন, জ্যেষ্ঠপাণ্ডব মিথ্যাবাদী নন, আমিও অধার্মিক নই, আমরা শিষ্যদ্রোহী পাপীকেই মেরেছি।

ধৃষ্ঠদ্যুম্নের কথা শুনে অর্জুন বললেন, ধিক ধিক! যুধিষ্ঠিরাদি, কৃষ্ণ, এবং আর সকলে লজ্জিত হলেন। সাত্যকি বললেন, এখানে কি এমন কেউ নেই যে এই অকল্যাণভায়ী নরাধম ধৃষ্টদ্যুম্নকে বধ করে? ক্ষুদ্রমতি, তোমার জিহ্বা আর মস্তক বিদীর্ণ হচ্ছে না কেন? কুলাঙ্গার, গুরুহত্যা করে তোমার ঊর্ধ্বতন ও অধস্তন সাত পুরুষকে তুমি নরকস্থ করেছ। ভীষ্ম নিজেই নিজের মৃত্যুর উপায় বলে দিয়েছিলেন, এবং অেমার ভ্রাতা শিখণ্ডীই তাকে বধ করেছে। তুমি যদি আবার এপ্রকার কথা বল তবে গদাঘাতে তোমার মস্তক চূর্ণ করব।

সাত্যকির ভর্ৎসনা শুনে ধৃষ্টদ্যুম্ন হেসে বললেন, তেমার কথা শুনেছি শুনেছি, ক্ষমাও করেছি। সাত্যকি, তোমার কেশাগ্র থেকে নখাগ্র পর্যন্ত নিন্দনীয়, তথাপি আমার নিন্দা করছ! সকলে বারণ করলেও তুমি প্রয়োপবিষ্ট ছিন্নবাহু ভূরিশ্রবার শিরচ্ছেদ করেছিলে। তার চেয়ে পাপকর্ম আর কি হতে পারে ? ধৃষ্টদ্যুম্নের তিরস্কার শুনে সাত্যকি বললেন, আমি আর কিছু বলতে চাই না, তুমি বধের যোগ্য, তোমাকে বধ করব। এ সাত্যকি গদা নিয়ে ধৃষ্টদ্যুম্নের প্রতি ধাবিত হলেন, তখন কৃষ্ণের ইঙ্গিতে ভীমসেন সাত্যকিকে জড়িয়ে ধরে নিরস্ত করলেন। সহদেব মিষ্টবাক্যে বললেন, নরশ্রেষ্ঠ সাত্যকি, অন্ধক বৃষ্ণি ও পাঞ্চাল ভিন্ন আমাদের মিত্র নেই। আপনারা, আমরা এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন সকলেই পরস্পরের মিত্র, অতএব ক্ষমা করুন। ধৃষ্টদ্যুম্ন সহাস্যে বললেন, ভীম, শিনির পৌত্রটাকে ছেড়ে দাও, আমি তীক্ষ্ম শরের আঘাতে ওর ক্রোধ, যুদ্ধের ইচ্ছা আর জীবন শেষ করে দেব, ও মনে করেছে আমি ছিন্নবাহু ভূরিশ্রবা।

সাত্যকি ও ধৃষ্টদ্যুম্ন বৃষের ন্যায় গর্জন করতে লাগলেন, তখন কৃষ্ণ ও যুধিষ্ঠির অনেক চেষ্টায় তাদের শান্ত করলেন।

২২। অশ্বত্থামার নারায়ণাস্ত্র মোচন (পঞ্চদশ দিনের যুদ্ধান্ত)

প্রলয়কালে যমের ন্যায় অশ্বত্থামা পাণ্ডবসৈন্য সংহার করতে লাগলেন। তার নারায়ণাস্ত্র থেকে সহস্র সহস্র দীপ্তমুখ সর্পের ন্যায় বাণ এবং লৌহগোলক শতক্ষ্মী শূল গদা ও ক্ষুরধার চক্র নির্গত হল , পাণ্ডবসৈন্য তৃণরাশির ন্যায় দগ্ধ হতে লাগল। সৈন্যগণ জ্ঞানশূন্য হয়ে পালাচ্ছে এবং অর্জুন উদাসীন হয়ে আছেন দেখে যুধিষ্ঠির বললেন, ধৃষ্টদ্যুম্ন, তুমি পাঞ্চাল সৈন্য নিয়ে পালাও; সাত্যকি, তুমি বৃষ্ণি-অন্ধক সৈন্য নিয়ে গৃহে চ’লে যাও; ধর্মাত্মা বাসুদেব যা কর্তব্য মনে করেন করবেন। আমি সকল সৈন্যকে বলছি-যুদ্ধ করো না, আমি ভ্রাতাদের সঙ্গে অগ্নিপ্রবেশ করব। ভীষ্ম ও দ্রোণ রূপ দুস্তর সাগর পার হয়ে এখন আমরা অশ্বত্থামা রূপ গোস্পদে নিমজ্জিত হব। আমি শুভাকাঙ্ক্ষী আচার্যকে নিপাতিত করিয়েছি, অতএব অর্জুনের ইচ্ছা পূর্ণ হ’ক। এই দ্রোণ যুদ্ধে অপটু বালক অভিমন্যুকে হত্যা করিয়েছেন; দ্যূতসভায় নিগৃহীত দ্রৌপদীর প্রশ্ন শুনে নীরব ছিলেন; পরিশ্রান্ত অর্জুনকে মারবার জন্য দুর্যোধন যখন যুদ্ধে যান তখন ইনিই তার দেহে অক্ষয় কবচ বেঁধে দিয়েছিলেন; ব্রহ্মাস্ত্রে অনভিজ্ঞ পাঞ্চালগণকে ইনি ব্রহ্মাস্ত্র দিয়ে নিপাতিত করেছিলেন; কৌরবগণ যখন আমাদের নির্বাসিত করে তখন ইনি আমাদের যুদ্ধ করতে দেননি, আমাদের সঙ্গে বনেও যান নি। আমাদের সেই পরম সুহৃৎ দ্রোণাচার্য নিহত হয়েছেন, অতএব আমরাও সবান্ধবে প্রাণত্যাগ করব।

কৃষ্ণ সত্বর এসে দুই হাত তুলে সৈন্যগণকে বললেন, তোমরা শীঘ্র অস্ত্রত্যাগ কর, বাহন থেকে নেমে পড়, নারায়ণাস্ত্র নিবারণের এই উপায়। ভীম বললেন, কেউ অস্ত্রত্যাগ করো না, আমি শরাঘাতে অশ্বত্থামার অস্ত্র নিবারিত করব। এই বলে তিনি রথারোহণে অশ্বত্থামার দিকে ধাবিত হলেন। অশ্বত্থামাও হাস্যমুখে অভিভাষণ করে অনলোদ্গারী বাণে ভীমকে আচ্ছন্ন করলেন।

পাণ্ডবসৈন্য অস্ত্র পরিত্যাগ করে হস্তী অশ্ব ও রথ থেকে নেমে পড়ল, তখন অশ্বত্থামার নারায়ণাস্ত্র কেবল ভীমের দিকে যেতে লাগল। কৃষ্ণ ও অর্জুন সত্বর রথ থেকে নেমে ভীমের কাছে গেলেন। কৃষ্ণ বললেন, পাণ্ডুপুত্র, এ কি করছেন? বারণ করলেও যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত হচ্ছেন না কেন? যদি আজ জয়ী হওয়া সম্ভবপর হত তবে আমরা সকলেই যুদ্ধ করতাম। দেখুন, পাণ্ডবপক্ষের সকলেই রথ থেকে নেমেছেন। এই বলে কৃষ্ণ ও অর্জুন সবলে ভীমকে রথ থেকে নামালেন এবং তার অস্ত্র কেড়ে নিলেন। ভীম ক্রোধে রক্তনয়ন হয়ে সর্পের ন্যায় নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলেন, নারায়ণাস্ত্রও নিবৃত্ত হল।

হতাবশিষ্ট পাণ্ডবসৈন্য আবার যুদ্ধে উদ্যত হয়েছে দেখে দুর্যোধন বললেন, অশ্বত্থামা, আবার অস্ত্র প্রয়োগ কর। অশ্বত্থামা বিষণ্ণহয়ে বললেন, রাজা, এই নারায়ণাস্ত্র দ্বিতীয়বার প্রয়োগ করলে প্রয়োগকারীকেই বধ করে। নিশ্চয় কৃষ্ণ পাণ্ডবগণকে এই অস্ত্র নিবারণের উপায় বলেছেন, নতুবা আজ সমস্ত শত্রু ধ্বংস হত। তখন দুর্যোধনের অনুরোধে অশ্বত্থামা অন্য অস্ত্র নিয়ে আবার যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন ও সাত্যকিকে পরাস্ত করে মালবরাজ সুদর্শন, পুরুবংশীয় বৃদ্ধক্ষত্র ও চেদি দেশের যুবরাজকে বধ করলেন। তার পর তিনি অর্জুনের দিকে ভয়ংকর আগ্নেয়াস্ত্র নিক্ষেপ করলেন, অর্জুন ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করে অশ্বত্থামার অস্ত্র ব্যর্থ করে দিলেন।

এই সময়ে স্নিগ্ধজলদবর্ণ সর্ববেদের আধার সাক্ষাৎ ধর্ম সদৃশ মহর্ষি ব্যাস আবির্ভূত হলেন। অশ্বত্থামা কাতর হয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ভগবান, আমার অস্ত্র মিথ্যা হল কেন? কৃষ্ণার্জুনের মায়ায় না দৈব ঘটনা এমন হল ? কৃষ্ণ ও অর্জুন মানুষ হয়ে আমার অস্ত্র থেকে কি করে নিস্তার পেলেন?

ব্যাসদেব বললেন, স্বয়ং নারায়ণ মায়ার দ্বারা জগৎ মোহিত করে কৃষ্ণরূপে বিচরণ করছেন। তাঁর তপস্যার ফলে তাঁরই তুল্য নর-ঋষি জন্মেছিলেন, অর্জুন সেই নরের অবতার। অশ্বত্থামা, তুমিও রুদ্রের অংশে জন্মেছ। কৃষ্ণ অর্জুন ও তোমার অনেক জন্ম হয়ে গেছে, তোমরা বহু কর্ম যোগ ও তপস্যা করেছ, যুগে যুগে কৃষ্ণার্জুন শিবলিঙ্গের পূজা করেছেন, তুমি শিবপ্রতিমার পূজা করেছ। কৃষ্ণ রুদ্রের ভক্ত এবং রুদ্র হতেই তার উৎপত্তি।

ব্যাসের বাক্য শুনে অশ্বত্থামা রুদ্রকে নমস্কার করলেন এবং কেশবের প্রতি শ্রদ্ধাবান হলেন। তিনি রোমাঞ্চিতদেহে মহর্ষি ব্যাসকে অভিবাদন করে কৌরবগণের নিকট ফিরে গেলেন। সে দিনের যুদ্ধ শেষ হল।

২৩। মহাদেবের মাহাত্ম্য

ব্যাসদেবকে দেখে অর্জুন বললেন, মহামুনি, আমি যুদ্ধ করবার সময় দেখেছি এক অগ্নিপ্রভ পুরুষ প্রদীপ্ত শূল নিয়ে আমার আগে আগে যাচ্ছেন, এবং যে দিকে যাচ্ছেন সেই দিকেই শত্রুরা পরাভূত হচ্ছে। তাঁর চরণ ভূমিস্পর্শ করে না, তিনি শূলও নিক্ষেপ করেন না, অথচ তার শূল থেকে সহস্র সহস্র শূল নির্গত হয়। তার প্রভাবেই শত্রু পরাভূত হয়, কিন্তু লোকে মনে করে আমিই পরাভূত করেছি। এই শূলধারী সূর্যসন্নিভ পুরুষশ্রেষ্ঠ কে তা বলুন। ব্যাস বললেন, অর্জুন, তুমি মহাদেবকে দেখেছ। তিনি প্রজাপতিগণের প্রধান, সর্বলোকেশ্বর, ঈশান, শিব, শংকর, ত্রিলোচন, রুদ্র, হর, স্থাণু, শম্ভ, স্বয়ম্ভু, ভূতনাথ, বিশ্বেশ্বর, পশুপতি, সর্ব, ধূর্জটি, বৃষধ্বজ, মহেশ্বর, পিনাকী, ত্র্যম্বক। তার বহু পারিষদ আছেন, তাদের নানা রূপ-বামন, জটাধারী, মুণ্ডিত-মস্তক, মহোদর, মহাকায়, মহাকর্ণ, বিকৃতমুখ, বিকৃতচরণ, বিকৃতকেশ। তিনিই যুদ্ধে তোমার আগে আগে যান। তুমি তার শরণাপন্ন হও। পুরাকালে প্রজাপতি দক্ষ এক যজ্ঞ করেছিলেন, মহাদেবের ক্রোধে তা পণ্ড হয়। পরিশেষে দেবতারা তাকে প্রণিপাত করে তার শরণাপন্ন হলেন এবং তার জন্য বিশিষ্ট যজ্ঞভাগ নির্দিষ্ট করে দিলেন। তখন মহাদেব প্রসন্ন হলেন। পুরাকালে কমলাক্ষ তারকাক্ষ ও বিদ্যুম্নালী নামে তিন অসুর ব্রহ্মার নিকট বর পেয়ে নগরতুল্য বৃহৎ তিন বিমানে আকাশে ঘুরে বেড়াত। এই বিমানের একটি স্বর্ণময়, আর একটি রজতময়, আর একটি লৌহময়। এই ত্রিপুরাসুরের উপদ্রবে পীড়িত হয়ে দেবতারা মহাদেবের শরণাপন্ন হলেন। মহাদেব ত্রিশূলের আঘাতে সেই ত্রিপুর বিনষ্ট করলেন। সেই সময়ে ভগবতী উমা পঞ্চশিখাযুক্ত একটি বালককে কোলে নিয়ে দেবগণকে জিজ্ঞাসা করলেন, কে এই বালক? ইন্দ্র অসূয়াবশে বালকের উপর বজ্রপ্রহার করতে গেলেন, মহাদেব ইন্দ্রের বাহু স্তম্ভিত করে দিলেন। তার পর পিতামহ ব্রহ্মা মহেশ্বরকে শ্রেষ্ট জেনে বন্দনা করলেন, দেবতারাও রুদ্র ও উমাকে প্রসন্ন করলেন। তখন ইন্দ্রের বাহু পূর্ববৎ হল। পাণ্ডুনন্দন, আমি সহস্র বৎসরেও মহাদেবের সমস্ত গুণ বর্ণনা করতে পারি না। বেদে এঁর শতরুদ্রিয় স্তোত্র এবং অনন্তরুদ্র নামে উপাসনামন্ত্র আছে। জয়দ্ৰথবধের পূর্বে তুমি কৃষ্ণের প্রসাদে স্বপ্নযোগে এই মহাদেবকেই দেখেছিলে। কৌন্তেয়, যাও, যুদ্ধ কর, তোমার পরাজয় হবে না, মন্ত্রী ও রক্ষক রূপে স্বয়ং জনার্দন তোমার পার্শ্বে রয়েছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *