দ্য র্যাট ট্র্যাপ
দুপুরে লাঞ্চ আওয়ারে মাঝে মাঝে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ কফি হাউসে যাই। আমার অফিসের কাছেই।
ডালহৌসির ব্যাঙ্ক অফ টোকিও থেকে মাঝে মাঝে হেঁটে আসে চন্দন দেবরায়। কাল চন্দন ওখানে আমাকে দুটো-একটা কথা যা বলল, তাতে এ যাবৎ পাওয়া আমার সব আক্কেল ওর এক গুলিতে গুড়ুম হয়ে গেল। ওকে সঙ্গে নিয়ে ক্লাইভ স্ট্রিটে গাড়োয়াল মণ্ডল বিকাশ নিগমের অফিস থেকে ৭ দিনের ট্যুরের তিনটে টিকিট কাটতে গেলাম। পি আর ও বললেন, যাত্রা হৃষীকেশ থেকে। টুর অনেক রকম আছে। তবে আপনারা এই দুনম্বর টুরে যান। চিলা ফরেস্ট আর পাউড়িতে একদিন করে থাকতে পারবেন। তবে কেদার-বদ্রী হয়ে ফেরার পথে বিটুয়িন ওখিমঠ অ্যান্ড রুদ্রপ্রয়াগ পানওয়ালি কান্থা বলে একটা নো ম্যানস ল্যান্ড পড়বে। ওখানে, মন্দাকিনীর তীরে, টেন্ট কলোনিতে আমরা একদিন ট্যুরিস্টদের রাখি। কেদারবদ্রী ভুলে যাবেন, কিন্তু এটা আপনার জীবনের সুইটেস্ট মেমারি হয়ে থাকবে।
পি আর ওর নাম হরেদও সিং তিওয়ারি। বৈদ্যনাথধাম থেকে ঠাকুর্দা গিয়ে হরিদ্বারে সেট করেন। ওখানে কম্বলের কারখানা আছে ওঁদের।
পানওয়ালিমে একরাত তেওয়ারিজি বললেন, হাম গাড়োয়ালিকে লিয়ে ভি আনফরিগটএবেল হ্যায়।
ঠিক হল, কাল আগে রেলের টিকিট কেটে, আমি নিগম-ট্যুরের টিকিট সেইমতো কাটতে আসব। মে মাসে খুব একটা যাত্রী নেই এখনও। চারা ফেকা গিয়া হ্যায় লেকিন,ওঁর ভাষায়, আভি তক মাছ মছলি নেহি লাগা। বাস ফাঁকা যাচ্ছে।
কখনও ট্র্যাপে পড়েছেন?
বিস্তৃত বিবরণ শুনব বলে সন্ধ্যাবেলা ওকে ডেকার্স লেনের পুলিস ক্লাবে আসতে বলেছিলাম। ওখানে রাম খুব সস্তা। চন্দন চিত্তদার দোকান থেকে ফিশ ফিঙ্গার আনাল।
লোডশেডিং। দরদর ধারায় ঘাম গড়িয়ে আসছে তার দুই রগ থেকে। রামে মাত্র দুটি চুমুক দিয়েই অমনি নাটকীয়ভাবে শুরু করেছিল চন্দন।
কঁল পেতেছেন কখনও? রুটির টুকরোর লোভে নেংটি ইঁদুরকে ঢুকতে দেখেছেন কলে? প্রথমে সতর্ক। ঢুকবে কি ঢুকবে না। যেন ভাবছে, ফিরে যাবে কি যাবে না। যেন-ফেন নয়, ওরা ভাবে। আমি দেখেছি। আমাদের ফ্ল্যাট দোতলায়। নিচে মানিকতলা বাজার। আমাকে প্রচুর ইঁদুর ধরতে হয়। এবং আমি ধরি। আমি প্রত্যেকটা ইঁদুরকে চিনি। তারা আমাকে চেনে। একটা ধাড়ি ইঁদুরকে এখনও ধরতে পারিনি। যেদিনই দেখা হয়, নর্দমায় ঢুকে যাবার আগে সেও আমাকে দেখে। দেখে রাখে।
হ্যাঁ। কিন্তু বদ্রীনাথের অভিজ্ঞতা তুমি যা বলতে চাইছিলে—
বদ্রীনাথের কথাই তো বলছি।চন্দন গ্লাস শেষ করে বলল, নো থ্যাঙ্কস। সিগারেট ছেড়ে দিয়েছি।
হ্যাঁ। তা বল।
তাঁরপর শেষ পর্যন্ত তার বুদ্ধিনাশ হয়। চন্দন বলল, সে কলে ঢুকে পড়ে। বদ্রীনাথে ঢুকে পড়ে আমাদের অবিকল সেই ইঁদুর-অভিজ্ঞতা হয়েছিল।হঠাৎ শুনলাম–ঘ্যাচাং। পিছনে কলের দরজা পড়ে গেল!
এ-ভাবে একবার ইদুর ও আরবার বদ্রীনাথের কোর্টে বল ফেলতে ফেলতে শেষ পর্যন্ত সে যে-ভাবে স্ম্যাশ করল, তা কিন্তু সত্যিই ভয়াবহ।
কেদারবদ্ৰীতে সবাই যায়। যায় তার চেয়েও বিপদসঙ্কুল দুর্গম জায়গায়। হাসতে হাসতে ফিরেও আসে। কিন্তু গোটা ব্যাপারটাই চন্দনের মতে, নিপুণ হাতে পাতা একটা ফাঁদ।
সে-হরি যাকে নেবে, তার আর রক্ষা বলে কিছু নেই।
ওরা গিয়েছিল ১৯৮৬-তে। মাত্র দুবছর আগে। তাও জুনের গরমে।
মোট শদুয়েকের বেশি যাত্রী সেদিন বদ্রী যায়নি। অপারেশন করানো সত্ত্বেও, জন্মত গন্নাকাটা বলে চন্দনের দু-একটা শব্দ এখনও আনুনাসিক হয়ে যায়। ঠিক কোনটা যে হবে, আগে থেকে বলা কঠিন। চন্দন বলল, গোবিন্দঘাট পর্যন্ত ফাসক্লাস গেলাম। বৃষ্টি পড়ছিল আগাগোড়াই। সেই কর্ণপ্রয়াগ থেকে। গোবিন্দঘাটের মিলিটারি ব্রিজ পেরুতে বরফ পড়া শুরু হল, বুঝলেন দাদা। চোখের সামনে দেখতে দেখতে সব সাদা হয়ে গেল। অথচ, এ তো ঠিক বৃষ্টি নয়, বরফ। পুরো আলো রয়েছে। কিছু আলো বরফের ভেতর থেকে আঁসছিল, বিশ্বাস করুন দাদা বলতে বলতে সে কেঁপে উঠে আমার হাত চেপে ধরল।
বাস তো হনুমান চটিতে কোনওমতে স্কিড করতে করতে পৌঁছল। তারপর বলল, আর যাবে না। হয় বদ্রীনাথ যাও, না হয় গোবিন্দঘাট ফিরে যাও। হয় সামনে যাও ৮-১০ কিলোমিটার। না হয় পিছনে যাও ২৩ কিলোমিটার। তখন বেলা বারোটা। এগারো হাজার ফুট খাদের ধারে হিমালয়ের পেটের মধ্যে আমরা তখন। বরফে হাঁটু ডুবে রয়েছে। সঙ্গে বৌ, শালী আর ভায়রাভাই ব্রজেন। আমাদের শাশুড়ি।
হাঃ-হাঃ-হাঃ-হাঃ। জাস্ট এনজয় দা ফান অফ ইট।
চন্দন বলে ভাল। কলকাতায় টকার হিসেবে, রেডিওর পরেই নাকি তার স্থান। তার মাথায় অ্যালোপেশিয়া, গ্লেসিয়ারের মতো সহসা ঝাঁ-চকচক করে উঠল মাথাভরা টাক, যখন। বার-এ হঠাৎ আলো এল।
দেখতে কুচ্ছিত হলেও শুনতে সে সত্যিই ভাল। কিন্তু, আসল কথায় আসবে কখন।
আমি সেকেন্ড রাউন্ড বলি।
তোমরা কোন দিকে গেলে?
বদ্রীনাথে, আবার কোথা! একটু বঁরফ হবে না?
তারপর… গ্লাসে বরফ না ঢালা পর্যন্ত সে একদম চুপ। স্পিকটি-নট।
চন্দন বলল, আমরা সবাই বললাম, ফিরে যাব। কিন্তু শাশুড়ি! দেহরক্ষা করবেন কিন্তু নারায়ণ-দর্শন না করে উনি ফিরবেন না। এজ কত বলুন তো। সেভেনটি ফাইভ।বর্ননাইনটিন ইলেভেন। এবার একটা য-ফলা লাগিয়ে সে হাসে, হ্যা-হ্যা-হ্যা-হ্যা।
আর এক রাউন্ড কি বলব? চন্দনের গল্প কি তাতেও শেষ হবে?
দাদা, আপনি খাচ্ছেন না?
আমার একটু তাড়া আছে।
না-না। ঘড়ি দেখে চন্দন বলল, সবে সাড়ে আটটা। বেঁয়ারা!
সে এক রাউন্ড বলল। ম্যানার্স-জ্ঞান থাকলে এটার দাম সে নিশ্চয়ই, অন্তত দিতে চাইবে।
তুমুল বৃষ্টির মধ্যে বাড়ি ফিরতে রাত বারোটা হয়ে গেল।ক্লাব থেকে চন্দন নিয়ে গিয়েছিল এলফিনে। থার্ড রাউন্ড থেকে সব খরচ সে করেছে।
এত আগ্রহ নিয়ে জীবনে বোধহয় কারুকে কিছু বলিনি, বলতে চাইনি, যেভাবে, ঝুঁকে, বেঁকে, টেবিলে মাথা রেখে, কখনও তুলে, দীপ্তিকে বলছিলাম, জানো, ওরা আটকে পড়েছিল। বদরীতে। সাতদিন বেরুতে পারেনি। ঘ্যচ্যাং! বরফ কলের দরজা পড়ে গিয়েছিল। বদ্রীনাথে আটকে পড়েছিল ওই ওরা।কারা আমি মনে করতে পারি না কিছুতে। তাই তিন আঙুল তুলে বলি, তিনশ ইদুর! ঘোড়াসুদ্ধ একটা মেয়ে, ওদের দলের, খাদে পড়ে। গেল…
টিকিট কেটেছ? গায়ে হাত দিও না।
টিকিট? কাল কাটব। ও হ্যাঁ, আমরা গাভোয়ালের বাসে যাচ্ছি। বুঝলে। বেস্ট ট্রাভেল এজেন্ট। বুঝলে। সব ব্যাবোস্তা করে এস্ছি।
মালে কত টাকা ওড়ালে আজ–ফের?
চোদ্দ টাকা। যাসস্…স্ট্যাক্সি ভাড়া! সগৌরবে এত বলে আমি বোধকরি ফের গায়ে হাত দিয়েছিলাম। গায়ে হাত দিয়েছিলাম বলতে, মূলত, কাছেই তো ডেকেছিলাম। তাই না? স্ত্রী পাঠকরা কী বলেন? মারতাম তো আর না। আদরই করতাম। ভালবাসতে গেলে, যারা ভালবাসার বাইরে, তারা একটু মদ খায়। তাদের খেতে হয়। নইলে তাদের খুন করতে হয় বৌকে। স্বামী মদ খায় না বলে যাঁরা নিশ্চিন্ত, তাদের জানাই, বৌ খুন তারাই বেশি করে। যারা টিটোটেলার। স্ট্যাটিসটিক্স তাই বলে। আস্ক লালবাজার বধূহত্যা স্কোয়াড। ওরা কনফার্ম করবে।
মর মুখপোড়া। ড্রিল মাস্টারের ছেলে!
দীপ্তি আমাকে একটা ধাক্কা দিয়ে শোবার ঘরে চলে গেল। সারারাত মেঝেয় পড়ে থাকলাম। তবে মিথ্যে কথা কেন বলব? পাখাটা ফুলফোর্সে চালিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। যে জন্যে সে রাতে প্রগাঢ় ঘুম হয়।
সকালে বাজার গেলাম। ওই একটা ছেলের কাছেই আমি মাছ কিনি। নাম সন্ন্যাসীচরণ ভক্ত। আজ ওর স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে দেখি, হেডমাস্টার বন্ধুবাবু খলবলে নর্দমার দিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছেন, ও সন্ন্যাসী, তোমার একটা শিঙ মাছ নর্দমায় পড়ল যে!
থাকুক স্যার কিছুক্ষণ ওখানে, হেসে সন্ন্যাসী উত্তর দেয়, নেকাপড়া শিখুক।
দীপ্তি অধ্যাপিকা। অনার্সে উচ্চ-দ্বিতীয় এবং এম-তে প্রথম শ্রেণী পেয়েছিল। আমার তখনও রাগ যায়নি। হ্যাঙওভার কাটেনি। মাছটা মাদি নাকি?