দেবী ও দানবী
পুরুষের কাছে নারী এক অনন্ত অস্বস্তি; নারী তার চোখে দুই বিপরীত মেরু- আলো ও অন্ধকার; সুখ ও ব্যাধি। পুরুষের চোখে নারী দেবী ও দানবী; প্রথমে দানবী, তারপর দেবী। নারী করালী দানবী পুরুষের কাছে, যে তাকে পাপিষ্ঠ ও স্বৰ্গচ্যুত করেছে; যে তাকে প্রলুব্ধ প্ররোচিত প্ৰতারিত ক’রে চলেছে। পুরুষ সারাক্ষণ ভয়ে থাকে যে ওই পাপীয়সী তার মতো দেবতাকে নামিয়ে দিতে পারে যে-কোনো রসাতলে। পুরুষ তাকে ভয় করে, তবে এড়িয়ে চলতে পারে না; কাম ও পার্থিব প্রয়োজনে সে নারীর সাথে জড়িয়ে আছে : তাকে আলিঙ্গনে বাঁধে, চুমো খায়, তার ঐন্দ্ৰজালিক মাংসকে নিয়তির মতো মানে, কিন্তু অবচেতন ও সচেতনভাবে নারীকে ভাবে দানবী। পুরুষের চোখে নারী দেবীও; তবে নারীর দেবীত্ব তাকে যতোটা সুখী করে, বরাভয় দেয়, তার চেয়ে অনেক বেশি তাকে সন্ত্রস্ত করে নারীর দানবীত্ব। ওই অপ্রতিরোধ্য দানবীর কাছে পুরুষ বোধ করে অসহায়। নারী যখন দেবী তখন পুরুষ তাকে ভয় পায় না, কেননা দেবীকে পুরুষ দাসীও ক’রে তুলতে পারে; কিন্তু তার ভয় দানবীকে। দেবীও পুরুষের কাছে সম্ভোগের অসম্ভব সামগ্ৰী। ‘দেবী, অনেক ভক্ত এসেছে তোমার চরণতলে/অনেক অর্ঘ্য আনি;/আমি অভাগ্য এনেছি বহিয়া নয়নজলে/ব্যৰ্থ সাধনখানি’, বা ‘আমি তব মালঞ্চের হব মালাকর’ বলে যে-পুরুষ, তার বাসনা হচ্ছে মন্দিরের বেদীতলে বা মালঞ্চের পুষ্পিত পরিবেশে দেবীৱ দেহখানি উপভোগ। পুরুষ কখনো নারী হ’তে চায় না, কিন্তু সব পুরুষই চায় পৃথিবীতে নারী থাকুক, নারীর জন্যে পুরুষ কৃতজ্ঞ প্রকৃতির কাছে। পুরুষের কাছে নারী এক সুখকর দুর্ঘটনা, যে-দুর্ঘটনা তাকে অমরত্বের আস্বাদ দিয়েছে; কিন্তু নারীকে নিয়ে তার মহাজাগতিক দুঃস্বপ্নের শেষ নেই। নারীকে ঘিরে পুরুষ সৃষ্টি করেছে নানা কিংবদন্তি বা পুরাণ, যাতে প্ৰকাশ পেয়েছে পুরুষের আশা ও ভয়। পুরুষের চোখে নারী মাংস, মাংসের অবর্ণনীয সুখ ও আতঙ্ক। পুরুষের কাছে নারী দেবী ও দানবী, খ্রিস্টানের কাছে সে পাপীয়সী হাওয়া ও পবিত্ৰ মেরিমাতা। দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ১৭৫) বলেছেন, ‘সে হচ্ছে মূর্তি, পরিচারিকা, জীবনের উৎস, অন্ধকারের শক্তি, সে হচ্ছে সত্যের মৌল নিঃশব্দতা, সে কৃত্রিম সামগ্ৰী, গুজব, এবং মিথ্যা; সে শুশ্রুষা ও অভিচারিণী; সে পুরুষের শিকার, তার পতন, পুরুষ যা নয় এবং যা কিছু কামনা করে। নারী তার সব কিছুঃ সে পুরুষের নঞর্থকতা।‘ পুরুষতান্ত্রিক পৃথিবীর প্রতিটি জাতি ও সভ্যতা নারীকে দেখেছে ভয়ের চোখে; আজো সে ভয় কাটে নি।
ছোটো বালিকা কোনো ভয় জাগায় না, কিন্তু যেই সে হয়ে ওঠে প্ৰজননপ্রস্তুত, নারী, সে হয় অশুচি। তার শরীর জুড়ে বিকশিত হয় পুরুষের আকর্ষণ ও আতঙ্ক। ওই শরীরের একটি বড়ো ঘটনার নাম ঋতুস্রাব। পুরুষতন্ত্র তার ঋতুস্রাবকে ঘিরে দিয়েছে একরাশ বিধিনিষেধ। অনেক সমাজ তাকে বিচ্ছিন্ন ক’রে দেয় অন্যদের থেকে, তাকে ঘোষণা করে অশুচি ব’লে। ঋতুক্ষরণকে প্রতিটি ধর্ম ও আদিম সমাজ দেখেছে দানবিক ব্যাপার রূপে। পিতৃতন্ত্রের সূচনা থেকেই নারীর স্রাবকে অশুভ ধারারূপে দেখা হচ্ছে; এবং একে এতো বিধিনিষেধে ঘিরে দেয়া হয়েছে যে আজো পুরুষেরা এর নামে শিউরে ওঠে। পশ্চিমে এক সময় বদ্ধমূল বিশ্বাস ছিলো যে ঋতুকালে নারীদের সংস্পর্শে শস্য নষ্ট হয়, বাগান ধ্বংস হয়, মৌমাছি মারা যায়; এ-সময়ে নারীর ছোঁয়ায় মদ হয় ভিনেগার, দুধ টক, এবং ঘটে আরো নানা অঘটন। উনিশ শতকের শেষভাগেও চিকিৎসাবিষয়ক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ‘এটা নিশ্চিত যে ঋতুমতী নারীর ছোয়ায় মাংস পচে।‘ এ-শতকের শুরুতেও ফ্রান্সে মদের কারখানায় ঢুকতে দেয়া হতো না ঋতুমতী নারীদের; বিশ্বাস ছিলো যে ওই অভিশপ্ত নারীদের, ঋতুস্রাবকে ইউরোপের অনেকাংশে ‘অভিশাপ’ই বলা হয়, প্রভাবে চিনি কালো হয়ে যায়। নারীর ক্ষরণ সম্পর্কে কুসংস্কারের মূলে রয়েছে অলৌকিক ভীতি। রক্ত পবিত্র, কিন্তু ঋতুকালে যে-রক্ত বেরিয়ে আসে তা অপবিত্র, কেননা এ-রক্তেই রয়েছে নারীর নারীত্ব। আদিম সমাজে রজঃস্রাবভীতি খুবই প্ৰবল; সেখানে ঋতুকালে নারীদের বিচ্ছিন্ন ক’রে ফেলা হয়, রাখা হয় পল্লীর প্রান্তে একলা কুটিরে। তাদের দুধ খেতে দেয়া হয় না, দুধের পাত্র ছুঁতে দেয়া হয় না, তারা স্বামীর কোনো কিছুই ছুঁতে পারে না। তারা মনে করে ঋতুমতী কোনো নারী যদি স্বামীর কোনো সামগ্ৰী স্পর্শ করে, তবে স্বামীটি অসুস্থ হয়ে পড়বে; আর সে যদি স্বামীর কোনো অস্ত্ৰ স্পর্শ করে তবে স্বামীটি নিহত হবে যুদ্ধে। কোনো কোনো সমাজে ঋতুকালে নারীদের চাঁদতারাসূর্যের দিকে তাকানোও নিষিদ্ধ।
বাইবেলে ও কোরানে ও সব ধর্মপুস্তকে ঋতুকে দেখা হয়েছে ভয়ের চোখে, এবং ঋতুমতী নারীদের নির্দেশ করা হয়েছে নিষিদ্ধ ও দূষিত প্রাণীরূপে। বাইবেলে বলা হয়েছে : ‘যে স্ত্রী রজঃস্বলা হয়, তাহার শরীরস্থ রক্ত ক্ষরিলে সাত দিবস তাহার অশৌচ থাকিবে, এবং যে কেহ তাহাকে স্পর্শ করে, সে সন্ধ্যা পর্যন্ত অশুচি থাকিবে’ এবং ‘অশৌচকালে যে পুরুষ তাহার সহিত শয়ন করে, ও তাহার রজঃ তাহার গাত্রে লাগে, সে সাত দিবস অশুচি থাকিবে’ [লেবীয় পুস্তক : ১৫]। কোরানে আছে : ‘লোকে তোমাকে রজঃক্ষরণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। তুমি বলো, তা অশুচি। তাই রজঃক্ষরণকালে স্ত্রীসঙ্গ বর্জন করবে, আর যতোদিন না তারা পবিত্র হয়, তাদের কাছে যেও না’ [২:২২২]। হিন্দুধর্মের ঋষিরা ঋতুক্ষরণের নামে শিউরে উঠে প্ৰণয়ন করেছেন শ্লোকের পর শ্লোক ও অজস্র বিধি। তাঁরা বিধান দিয়েছেন যে ঋতুকালে নারী অস্পৃশ্য থাকবে, তাকে কেউ স্পর্শ করবে না। নারী এমনভাবে থাকবে যাতে ভোজনরত কোনো ব্ৰাহ্মণের চোখে সে না পড়ে। ক্ষরণের প্রথম দিনে নারীকে গণ্য করতে হবে চণ্ডালী, দ্বিতীয় দিনে ব্ৰহ্মঘাতিনী, তৃতীয় দিনে রাজকী; এবং তাকে কোনো সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে, ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নিতে দেয়া হবে না [দ্র নরেন্দ্রনাথ (১৯৭৫, ৮৬)]। মনু, অঙ্গিরা, পরাশর ও আরো অনেকে নারী দানবীর ক্ষরণ নিয়ে মূল্যবান সময় ব্যয় ক’রে তৈরি করেছেন অনেক পবিত্র বিধি। মনু বলেছেন, ‘রজস্বলা নারীতে যে-পুরুষ সঙ্গত হয়, তার বুদ্ধি, তেজ, বল, আয়ু, ও চক্ষু ক্ষয় পায়’ [মনুসংহিতা, ৪:৪১]। এর সবটাই বাজেকথা, তবে হাজার হাজার বছর ধরে এ-শ্লোকটি ভয় দেখিয়ে আসছে পুরুষদের। বরাহপুরাণের একটি সম্পূর্ণ পরিচ্ছেদই রয়েছে দানবীর ভয়ংকর রক্তপাত ও বিধিনিষেধ সম্পর্কে। বিধান দেয়া হয়েছে রাজস্বলা নারীর সাথে কেউ কথা বলবে না, তার হাতের কোনো খাদ্য গ্ৰহণ করবে না; তার সামনে মন্ত্র উচ্চারণ করা যাবে না; আর বামন বলেছেন ওই নারীর সাথে সঙ্গম মহাপাপ। ঋতুমতী নারী যদি কাউকে স্পর্শ করে, তবে তাকে প্ৰায়শ্চিত্ত করতে হবে। ছাত্রদেরও নিষেধ করা হয়েছে ঋতুমতী নারীর কাছাকাছি না আসার। কোনো ঋতুমতী নারীকে দেখা ছাত্রদের নিষেধ; আর সমাবর্তনের পর কমপক্ষে তিন দিন তারা কোনো রাজস্বলা নারীকে দেখতে পারবে না। এই যে রক্ত তা যে অশুচি, এমন নয়; আসলে পুরুষের চোখে নারী এক দানবী, নারীর প্ৰতিমাসের রক্তধারা নারীর আপনি অশুচিতার চিহ্ন।
নারীর দেবী ও দানবী রূপ, নারীর প্রতি পুরুষের ভীতি ও কামনা প্ৰকাশ পায় কুমারীত্ব সম্পর্কে পুরুষের আগ্রহ ও আতঙ্কে। কুমারী, অক্ষতযোনি, পুরুষ কামনা করে, ভয়ও পায়। কুমারী পুরুষের চোখে এক চরম রহস্য। পুরুষের কাছে কুমারী, কুমারীর দেহ, তার রন্ধের অদৃশ্য আবরণঝিল্লি একই সাথে ভীতিকর, ও পরম কামনার বস্তু। পুরুষ যখন মনে করে নারীর শক্তি তাকে পরাভূত করবে, সে হেরে যাবে ওই রহস্যের কাছে, তখন সে ভয় পায়; যখন পুরুষ ভাবে ওই শক্তিকে সে জয় করবে, আধিপত্য বিস্তার করবে ওই রহস্যের ওপর, তখন সে দাবি করে অক্ষত কুমারী। আদিম সমাজে যেখানে নারীশক্তি প্ৰবল, সেখানে পুরুষ আতঙ্কে থাকে; তাই সেখানে বিয়ের আগের রাত্রেই কনের কুমারীত্ব মোচন করে শক্তিমান কেউ, পুরোহিত বা সমাজপতি। মার্কো পলো জানিয়েছে যে তিব্বতি পুরুষেরা কেউ কুমারী নারী বিয়ে করতে রাজি নয়। কুমারীর সতীচ্ছদ ছিন্ন করাকে মনে করা হয় এক অতীন্দ্রিয় ভীতির কাজ, যা সকলের পক্ষে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। অনেক সমাজে মনে করা হয় যে যোনিতে লুকিয়ে রয়েছে সাপ, যা পর্দা ছেড়ার সাথেসাথে দংশন করবে পুরুষাঙ্গে; কোনো কোনো সমাজে মনে করা হয় যে রক্তপাতের ফলে হানি ঘটবে পুরুষের বীর্যের। ধাতু বা বীৰ্যকে সব সমাজেই অত্যন্ত দামি মনে করা হয়। পুরুষ এতো যে ভয় পায় তা নারীকে দানবী রূপে দেখারই ফল। অনেক সমাজে সতীচ্ছদ ছেড়ারই প্রশ্ন ওঠে না; সেখানে মেয়েরা কুমারী থাকে শুধু শিশুকালে। শৈশব থেকেই তারা সঙ্গমের অনুমতি পায়, সঙ্গম সেখানে বাল্যক্রীড়া। কোনো কোনো সমাজে মা, বড়ো বোন, ধাত্রী মেয়েদের সতীচ্ছদ ছিন্ন করে। কোনো কোনো সমাজে পুরুষেরা জোর ক’রে মেয়েদের গ্রামের বাইরে নিয়ে গিয়ে স্বাভাবিক বা অন্য কোনো উপায়ে ছিন্ন করে কুমারীর আবরণ। কোনো কোনো সমাজে মেয়েদের তুলে দেয়া হয় অচেনা পুরুষদের হাতে, যারা মোচন করে তাদের কুমারীত্ব। ওই সমাজ বিশ্বাস করে অচেনা পুরুষদের এতে কোনো ক্ষতি হবে না, বা হ’লেও কোনো ক্ষতি নেই। কোনো কোনো সমাজে পুরোহিত বা সমাজপতি বা গ্ৰাম্য চিকিৎসক বিয়ের আগের রাতে মোচন করে কুমারীত্ব। মালাবার উপকূলে বিয়ের আগের রাতে কুমারীত্ব মোচনের দায়িত্ব পায় ব্ৰাহ্মণেরা; তারা এমনভাবে মোচন করে কুমারীর কুমারীত্ব যেনো একটি অসম্ভব কঠিন কাজ সম্পন্ন করছে। এ-কাজের জন্যে তারা মোটা পারিশ্রমিকও নিয়ে থাকে। সব সমাজেই পবিত্র কাজ অপবিত্রের করা নিষেধ: স্বামী পবিত্র নয়, শক্তিমান নয়; সমাজপতি বা পুরোহিত শক্তিমান বা পবিত্ৰ, তাই তাদের পক্ষেই ওই কাজ সম্ভব। সামোয়ায় রীতি হচ্ছে স্বামী তার স্ত্রীর সতীচ্ছদ স্বাভাবিক উপায়ে ছিন্ন করবে, তবে বীর্যপাত করতে পারবে না; কেননা তাতে যোনির রক্তে দূষিত হবে তার বীর্য। দানবীর নানা ভয়ে ভ’রে আছে পুরুষতন্ত্রের মন।
পুরুষ কুমারীকে ভয় পায়, তবে কামনাই করে বেশি। পুরুষ কুমারী কামনা করে, চায় কোমল কুমারী দেহলতা। কুমারীর তনু পুরুষের কাছে অনাবাদী জমি, ঘুমের দেশ, অনাঘ্রাত গোলাপ। ওই দেহে আছে গোপন ঝরনার জলের স্বাদ, ওই উদ্যানে পত্রপুটে ঢাকা অনাঘ্রাত দুটি পুজোর ফুল। পুরুষ তীব্র আকর্ষণ বোধ করে গোপন উদ্যান, মন্দির, ও নানা রকমের রুদ্ধ ও ছায়াসুনিবিড় এলাকার প্রতি: তার প্রতি পুরুষের আকর্ষণ, যার এখনো ঘুম ভঙে নি। পুরুষ রুদ্ধগৃহ খুলতে চায়, ঢুকতে চায় ওই গৃহে; পুরুষ তার ঘুম ভাঙাতে ও তাকে প্ৰাণ দিতে চায়; চায় তাকে অধিকার ও খনন করতে। পুরুষের রয়েছে ধ্বংসাত্মক প্রবণতা। সতীচ্ছদ ছিন্ন ক’রে পুরুষ নারীকে পায় অন্তরঙ্গতমভাবে; লোকশ্রুত পদটি ছিড়ে পুরুষ নারীর দেহটিকে পরিণত করে অক্রিয় বস্তুতে ও তার ওপর ওড়ায় নিজের পতাকা, স্থাপন করে সাম্রাজ্য। পুরুষ অবশ্য নারীর কুমারীত্বের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে যতোদিন নারীর যৌবন থাকে, তারপর কুমারীত্ব তার কাছে হয়ে ওঠে পীড়াদায়ক ভীতিকর। যে-নারীর শরীরে কোনো পুরুষ প্রবেশ করে নি, সে যখন আইবুড়ো হয় তখন পুরুষ তাকে মনে করে ডাইনি, অভিচারিণী। অনেকে বিশ্বাস করে আইবুড়ো অক্ষত মেয়েরা সহবাস করে শয়তানের সাথে। যেহেতু ওই নারী পুরুষের কাছে দেহ সমৰ্পণ করে নি, পুরুষের বশ্যতা স্বীকার করে নি, তাই পুরুষের চোখে সে শয়তানী। পুরুষের কাছে পোষ-না-মানা, বিদ্রোহী, নারীমাত্রই দানবী বা ডাইনি; কেননা সে পুরুষের সূত্র ও অনুশাসন মেনে নেয় নি। পুরুষ বিশ্বাস করে এ-দানবীরা এতো অশুভ যে ঘুমের মধ্যেও তারা পুরুষের শরীর নিয়ন্ত্রণ করে, যেমন স্বপদোষে। আমাদের দেশে এমন বিশ্বাস রয়েছে যে স্বপ্নে পুরুষকে প্রলুব্ধ করে ফোনো অভিচারিণী নারী, তাই ঘটে নৈশস্থলন; এবং হানি ঘটে স্বাস্থ্যের। ইহুদিপুরাণের লিলিথ এমন এক দানবী। রুডউইন লিলিথ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘লিলিথের করাল প্রভাব শুধু শিশুদের ওপরেই পড়ে না। সে আরো ভয়াবহ পুরুষের জন্যে, বিশেষ ক’রে তরুণদের জন্যে। লিলিথ পুরুষসম্মোহনকারিণী। লিলিথ হচ্ছে রূপসী ব্যভিচারিণী অবিবাহিতা বেশ্যার সেমেটীয় নাম, যে হাটেমাঠেঘাটে পুরুষদের সম্ভোগ করে’ [দ্র প্রাৎস (১৯৩৩, ২৮২);। ডাইনিদের বীভৎস ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে উপকথা রয়েছে সব জাতির ভাণ্ডারেই; এবং সব জাতির ডাইনিদেরই রয়েছে কতকগুলো সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ডাইনিদের মূল বৈশিষ্ট্য তারা কামার্ত পুরুষখেকো; তারা সম্ভোগের মধ্য দিয়ে পুরুষদে্র পরিণত করে নিজেদের খাদ্যে। তারা সঙ্গম করে শয়তানের সাথে, শয়তান পানিপাত্ৰ ভ’রে পান করে তাদের ক্ষরিত ৱক্ত। এদিকে ম্যালিনোস্কির ট্রোব্রিয়ান্ড দ্বীপপুঞ্জের বর্বরদের সাথে কোনো পার্থক্য নেই সভ্য ইউরোপীয় বা ভারতীয়দের। বর্বরদের কল্পনায় ডাইনিরা বেরোয় রাতে, নিজেদের রূপান্তরিত করে জোনাকি বা উড়ন্ত শেয়ালে, শব খায়, ও শয়তানের সাথে রমণ করে। ইউরোপে কয়েক শতক ধ’রে চলেছিলো ডাইনিশিকার; ওই হিংস্র শিকারীদের দুজন, জ্যাকব স্প্রেংগার ও হেনরি ক্র্যামার, একটি বই লিখেছিলেন ডাইনিদের হাতুড়ি নামে পনেরোশতকের শেষাংশে। তাঁরা লিখেছিলেন, ‘সব রকম ডাকিনীবিদ্যার মূলে রয়েছে কামক্ষুধা, নারীরা যাতে তৃপ্তিহীন। তিনটি জিনিশ রয়েছে যাদের ক্ষুধার শেষ নেই; না, আছে চতুর্থ একটি, যেটি কখনো বলে না, যথেষ্ট হয়েছে; সেটি হচ্ছে জরায়ুর মুখ। তাই নারীরা নিজেদের কামতৃপ্তির জন্যে এমনকি শয়তানের সাথেও সঙ্গমরত হয়’ [দ্র নেলসন (১৯৭৫, ৩৩৯)]। ডাইনি নাম দিয়ে ১৪০০ থেকে ১৭০০ অব্দের মধ্যে ইউরোপে পাঁচ লাখ নিরপরাধ নারীকে পুড়িয়ে মারে ঈশ্বরের পুরাহিতেরা। ওই নারীরা ডাইনি ছিলো না, তাদের অধিকাংশ নারী কেনো কোনো পুরুষের সাথেও সঙ্গমের সুযোগ পায় নি। তারা ছিলো কর্মজীবী নারী, যারা আর্থনীতিক কারণেই সমাজের প্রথাগত বিধি অমান্য করতে বাধ্য হয়েছিলো। তারা ছিলো অবিবাহিত; পুরুষ ও অর্থের অভাবে তারা বিয়ে করতে পারে নি, তারা নিয়েছিলো নানা পেশা জীবনধারণের জন্যে। অৰ্থাৎ তারা অমান্য করেছিলো সামাজিক ও ধর্মীয় বিধি: তারা ছিলো বিদ্রোহী, তাই তারা পুরুষের চোখে হয়েছিলো ডাইনি; এবং আগুনে ছাই হয়ে গিয়েছিলো। আজো যে-নারী সামাজিক বিধি অমান্য করে, পুরুষকে পাত্তা দেয় না, যাপন করে স্বায়ত্তশাসিত জীবন, তাকে মনে করা হয় আধুনিক ডাইনি বা দানবী। ডাইনির ভয়ে আধুনিক সভ্যতার হৃৎপিণ্ডও কম্পমান।
নারীকে অভিচারিণী বা ডাইনিরূপে দেখা হচ্ছে আবহমান কাল ধ’রে, আজো দেখা হয় সেভাবেই। যেনো তার কাজ ইন্দ্ৰজাল ছড়িয়ে পুরুষকে মেষ বানানো। নারী যাদুকর। যাদুকর ভয়ানক মানুষ, সে কাজ করে দেবতা ও রীতির বিরুদ্ধে, নিজের স্বার্থে। নারী সমাজের সাথে জড়িয়ে গেছে, কিন্তু পুরুষের মনে ভয় রয়ে গেছে যে নারী তাকে যে-কোনো সময় নিজের যাদুতে মজাবে। পাশের বাসার মেয়েটিকেও মনে হয় অভিচারিণী, যে চোখের পলকে সুবোধ ছেলেটিকে নির্বোধ মেষে পরিণত করতে পারে। তার চোখে ইন্দ্রজাল, ঠোঁটে যাদু, আঙুলে রহস্য, শরীরের বাঁকে বাঁকে ফাঁদ। পশ্চিমি পুরাণে পাওয়া যায় অনেক অভিচারিণী। যেমন সাইরেন। নারী হচ্ছে সাইরেন, যার গানে মুগ্ধ নাবিকেরা জাহাজসহ আছড়ে পড়ে পাথরের ওপর; নারী হচ্ছে কির্কি, যে তার প্রেমিকদের রূপান্তরিত করে পশুতে। পুরুষ তার যাদুপাশে জড়িয়ে হারায় নিজেকে, নিজের বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে। নারী পুরুষকে পান করায় বিস্মৃতির পানীয়। ফ্রয়েড ‘সভ্যতা ও তার অতৃপ্তি’তে এ-কুসংস্কারকেই বিজ্ঞানের মুখোশ পরিয়ে দেখিয়েছেন নারী শুধু পুরুষ নয়, সভ্যতারই শত্রু। এ-দানবীর কাজ সভ্যতাকে বিচলিত করা। খ্রিস্টান ধর্মে যৌনতাকে ভয়ের চোখে দেখা হয়, কারণ তারা নারীকে দেখে দানবীরূপে। ওই ধর্মে বিচ্ছিন্ন ক’রে নেয়া হয়েছে দেহ থেকে আত্মাকে; এবং শরীরকে করে তোলা হয়ছে আত্মার শত্ৰু। ওই বিশ্বাসে শরীরের সাথে সমস্ত সম্পর্কই পাপ ও অশুভ। খ্রিস্টানের কাছে দেহ আর মাংস পাপ; তবে পুরুষের দেহ পাপ নয়, নারীর দেহই পাপ। খ্রিস্টানের চোখে নারীর শরীর প্রলোভনের সোনার কলস, তার দেহ শয়তান। নারীই পাপের পথে নিয়ে গেছে আদমকে; তাই খ্রিস্টান সাহিত্য নারীঘৃণায় ও তিরষ্কারে মুখর। তারতুলিয়ানের চোখে নারী ‘পয়ঃপ্ৰণালির ওপর নির্মিত প্রাসাদ’ ; অগাষ্টিন বলেছেন, ‘আমাদের জন্ম হয়েছে মলমূত্র থেকে’ [ দ্র দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ২১৯-২২০)]। খ্রিস্টানের চোখে নারীর শরীর এতোই পাপীয়সী যে তারা ক্রাইস্টকে জন্ম দিয়েছে কুমারীর গর্ভ থেকে। ওই ধর্মের অনেক সন্তের মতে মেরি নারীদের মতো স্বাভাবিক রীতিতে জন্ম দেয় নি। ক্রাইস্টকে; অ্যামব্রোস, অগাস্টিনের মতে মেরির রুদ্ধ দেহ থেকেই জন্ম হয়েছিলো জেসাসের। খ্রিস্টানের কাছে নারীর দেহ কলঙ্ক, কাম হচ্ছে পাপ; তাই তারা দেহ ও কামের নিন্দায় মুখর থেকেছে, এবং উদ্ভাবন করেছে নিরন্তর নতুন নতুন শাস্তি। তারা পবিত্র মেরির দেহ থেকে নিঃশেষে বের ক’রে দিয়েছে অপবিত্ৰ কামকে তাকে পরিণত করেছে এক কামশূন্য বিদেহী নারীতে বা বিমূর্ত যন্ত্রে।
শুধু পুরোহিতেরা নন, বিজ্ঞানীরাও ঘেন্না করেছেন নারীর দেহের কথা ভাবতে। লিনাউস প্রকৃতিবিষয়ক সন্দর্ভে ঘেন্নায় নারীর যৌনাঙ্গ সম্পর্কে আলোচনা করেন নি। আজো অনেকেই নারীর দেহ, এমনকি নারী সম্পর্কে আলোচনাকেই মনে করে অশ্লীল। ফরাশি বিজ্ঞানী দ্য লরেঁ ঘেন্নায় প্রশ্ন করেছেন, ‘কী ক’রে এই স্বর্গীয় প্রাণী, যার রয়েছে যুক্তি ও বিচারবুদ্ধি, আকর্ষণ বোধ করে নারীর গোপন অঙ্গের প্রতি, যা ভরা থাকে রসে, আর যা লজ্জাজনকভাবে অবস্থিত শরীরের নিম্নতম স্থলে?’ [দ্র দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ২০০)]। খ্রিস্টানেরা তাই দানবীকে রূপান্তরিত করেছে দেবীতে; তারা পাপী প্রলোভনকারিণী হাওয়াকে ধুয়েমুছে তৈরি করেছে পাপহর মেরিকে। নারীকে তারা ক’রে তুলেছে গৃহগির্জার থাম। এ-প্রক্রিয়ায় নারীর শরীর থেকে ছেঁকে ফেলে দেয়া হয়েছে কাম। একজন লিখেছেন, ‘পুরুষের মাঝে যৌনকামনা সহজাত ও স্বতস্ফুর্ত, নারীর মধ্যে গুপ্ত, যদিও একেবারে অনুপস্থিত নয়।‘ অ্যাকটন ছিলেন উনিশ শতকের এক বিখ্যাত বিলেতি চিকিৎসক, বই লিখেছিলেন জননেন্দ্ৰিয়ের ভূমিকা ও রোগ নামে। ওই বইতে তিনি নারীর যৌনাঙ্গ সম্পর্কে কোনো আলোচনাই করেন নি; তাঁর মনোভাব হচ্ছে নারীর ওই সব প্রত্যঙ্গ নেই, থাকলেও সেগুলোর কোনো ভূমিকা নেই! তিনি ভিক্টোরীয় তরুণ স্বামীদের অভয়ও দিয়েছেন যে নারীরা তাদের গিলে খাবে না, কেননা ‘প্রেম, গৃহ, সন্তানই নারীর সব। সঙ্গম ঘটে খুবই কম’ (দ্র বাস্ক (১৯৭৪, ৮-৯)]। যে-সঙ্গম পুরুষের দিবারাত্রির স্বপ্ন, তাকেও ভয় করে পুরুষ। ওই দানবীর অঙ্গটিকে তার মনে হয় ক্ষত : নিজের ধাতুক্ষরণকে মনে হয় মৃত্যু। সব সমাজেই বিশ্বাস করা হয় সঙ্গমে পুরুষের বীর্য ক্ষয় হয়, শক্তি নষ্ট হয়; ফরাশিরা পুরুষের পুলককে বলে ‘ছোটো মৃত্যু’। নারীকে পুরুষ মনে করে ডাইনি, রক্তপায়ী ভ্যাম্পায়ার, যে তাকে পান করে, খায়। ফ্রয়েড পুরুষের এ-ভয়কে বৈজ্ঞানিক রূপ দিয়েছিলেন যে নারী সঙ্গমের সময় পুরুষকে খোজা করার সুখ পায়, অধিকার করে নেয় সম্রাট শিশ্নটি। পুরুষ নারীকে ততোটুকু ভালোবাসে ও দেবী মনে করে যতোটুকু নারী তার অধিকারে; আর ভয় কয়ে ও দানবী মনে করে যতোটুকু নারী তার অধিকারের বাইরে।
নারী দানবী, তাই তাকে বিশ্বাস করা যাবে না। পুরুষের সমস্ত শাস্ত্র রটনা করেছে নারীকে বিশ্বাস করলে ঘটবে পুরুষের পতন; তার শৌর্য নষ্ট হবে, রাজ্য ধ্বংস হবে, সমস্ত কীর্তি ধুলোয় লুটোবে। নারীকে বিশ্বাস ক’রে পুরুষের শোচনীয় পতনের কাহিনীতে ভ’রে আছে সমস্ত পুরাণ ও সাহিত্য। হাদিসে আছে : ‘যদি বিবি হাওয়া না হইত তবে কখনো কোনো নারী স্বামীর ক্ষতি করিত না’, এবং ‘পুরুষের জন্য নারী অপেক্ষা অধিক ক্ষতিকর বিপদের জিনিস আমি আমার পরে আর কিছু রাখিয়া যাইতেছি না’, এবং ‘তোমরা দুনিয়া সম্পর্কে সতর্ক হও এবং সতর্ক হও নারী জাতি সম্পর্কে। কেননা, বনি ইস্রাইলের প্রতি যে প্রথম বিপদ আসিয়াছিল তাহা নারীদের ভিতর দিয়াই আসিয়াছিল’, এবং ‘নারী হইল আওরত বা আবরণীয় জিনিস। যখন সে বাহির হয় শয়তান তাহাকে চোখ তুলিয়া দেখে’ [দ্র নূর মোহাম্মদ (১৯৮৭, ২৮১, ১৮৭, ১৮৮, ২০১); এবং ‘পুরুষ নারীর বাধ্য হলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়’ [দ্র রফিক (১৯৭৯, ১৮৩)]। নারীর বশীভূত হ’লে বীরের কী দুর্দশা ঘটে, বাইবেলের প্রণেতারা তা লিখেছেন স্যামসন ও ডেলাইলার উপাখ্যানে। স্যামসন শাস্তি পায় নারীর বশীভূত হওয়ার অপরাধে। মিল্টনের স্যামসন অ্যাগোনিসটিজ-এ স্যামসন বিশ্বাসই করে সে পেয়েছে উচিত শাস্তি; কেননা সে করেছে তুচ্ছ নারীর বশীভূত হওয়ার মতো গৰ্হিত অপরাধ। নারীর মতো সামান্যার বশীভূত হওয়ার থেকে অনেক ভালো যুদ্ধে মরা, ঘৃণ্য শত্ৰুর দাস হওয়া। স্যামসনের বিলাপে বাজে নারীর প্রতি পুরুষের চিরন্তন ধিক্কার :
ঘূণ্য কাপুরুষতা আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ক’রে
রেখেছিলো তার দাস; হে অসম্মান,
হে মর্যাদা, ধর্মের কলঙ্ক! ক্রীতদাস মন
পুরস্কৃত হয়েছে দাসের যোগ্য শাস্তিতে!
যে-রসাতলে এখন পড়েছি আমি,
এই ছিন্নবাস, এই ঘানিটানা, এও তুচ্ছ
আগের ঘূণ্য, অপৌরুষেয়, কলঙ্ককর, কুখ্যাত,
যথার্থ গোলামির কাছে। সেদিনের অন্ধদশা ছিলো অনেক নিকৃষ্ট,
যা দেখতে পায় নি আমার বশ্যতা ছিলো কতো শোচনীয়।
পুরুষতন্ত্র বিশ্বাস করে নারী হচ্ছে অনন্ত কাম ক্ষুধা, যা পুরুষকে শুষে নিঃশেষ করে। পুরুষের কাছে নারী হচ্ছে কাম। যে-নারী নিচে অসার পড়ে থেকে পুরুষকে সম্ভোগ করতে দেয়, পুরুষ তাকে সতী ভাবে; আর যে-নারী সাড়া দেয়, পুরুষকে মথিত করে, পুরুষের কাছে সে দানবী। জাঁ জাক রুশোর কথা ধরা যাক। রোম্যানটিকতার পুরোধা এ-দার্শনিক ঘোষণা করেছিলেন, ‘মানুষ জন্ম নেয় স্বাধীন, কিন্তু সর্বত্রই সে শৃঙ্খলিত।‘ তাঁর কাছে ‘মানুষ’ হচ্ছে ‘পুরুষ’। তিনি আসলে বলেছিলেন, ‘পুরুষ জন্ম নেয় স্বাধীন, কিন্তু সর্বত্রই সে শৃঙ্খলিত।‘ রুশোর বিশ্বাস ছিলো নারীরা বাঁচবে পুরুষের বিনোদের জন্যে; তবে পুরুষের অপেক্ষায় না থেকে কামেপ্রেমে নারীর উদ্যোগ নেয়ার প্রবল বিরোধী রুশো। যে-নারী উদ্যোগ নেয়, সে দানবী। রুশোর মতে, নারী থাকবে লাজুক লতা; সে নিজের দেহের সুখের কথা ভাববে না; যদি ভাবে তবে মানবজাতি ধ্বংস হয়ে যাবে সে-প্রক্রিয়ায় যে-প্রক্রিয়ায় তার টিকে থাকার কথা। অর্থাৎ পুরুষের কাম মানবজাতিকে টিকিয়ে রাখার জন্যে, আর নারীর কাম হচ্ছে মানবজাতির বিনাশ। পুরুষ তার আজগর কামক্ষুধায় ছুটতে পারে নারী থেকে নারীতে; নিজের ক্ষুধা তৃপ্ত করার জন্যে জাগিয়ে তোলে অলৌকিক ভীতি, কিন্তু নারীর ক্ষুধা তার কাছে আপত্তিকর। নারী হচ্ছে পুরুষের কাম ক্ষুধার খাদ্য; পুরুষ এটা শুধু বিশ্বাসই করে না, নারী যাতে অবলীলায় খাদ্য হয়, পুরুষ তার বিধানও তৈরি করে। আরব অঞ্চলে নারীকে মনে করা হয় ‘ফিৎনা’, যে নিজের কামে ঘটাতে পারে সামাজিক বিশৃঙ্খলা; কিন্তু সেখানে নারীকে অবরুদ্ধ ক’রে নানা ব্যবস্থা নেয়া হয় পুরুষের কামতৃপ্তির। একটি হাদিসে রয়েছে: ‘যখন কোনো রমণীকে তার স্বামী শয্যায় আহ্বান করে এবং সে অস্বীকাব করে এবং তার জন্য তার স্বামী ক্ষোভে রাত কাটায়–সেই রমণীকে প্রভাত পর্যন্ত ফেরেশতাগণ অভিশাপ দেয়’ [দ্র রফিক (১৯৭৯, ১৮১)]। নারী সম্পর্কে ডাইনিশিকারী স্প্রেংগার [দ্র ফিজেস (১৯৭০, ৬৪)] লিখেছেন :
নারী হচ্ছে অমৃতভাষিণী গোপন শত্র। সে শিকারীদের ফাঁদের থেকে বিপজ্জনক ফাঁদ, সে শয়তানের ফাঁদ। পুরুষ যখন নারীদের দেখে বা তাদেব কথা শোনে, তখন পুরুষ ধরা পড়ে তাদেব কামজালে ; যেমন সন্ত বার্নার্ড বলেন : তাদের মুখ প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখার মতো, তাদের স্বর সৰ্পের শোঁ শোঁ ধ্বনির মতো; তাছাড়াও তারা দুষ্ট সম্মোহন ছড়ায় অসংখ্য পুরুষ ও প্রাণীর ওপর। তাদেব মন বিদ্বেষের রাষ্ট্র। তাদের হাত হচ্ছে বেড়ি; তারা যখন কারো গায়ে হাত রাখে, তখন তারা শয়তানের সহযোগিতায় বাস্তবায়িত করে নিজেদের পরিকল্পনা।
ভারতীয় ত্রিকালদর্শীরা নারীর দানবীরূপ আঁকায় ও ছন্দোবদ্ধ ধিক্কার রচনায় পরিচয় দিয়েছেন লোকোত্তর প্রতিভার। ওই ঋষিরা লকলকে কামুক ও নারীবিদ্বেষী। নারী দেখলেই লক্ষ বছরেব ধ্যান আবর্জনার মতো ছুঁড়ে ফেলে তাঁরা অসুস্থের মতো উত্তেজিত হন, প্রকাশ্যে বা কুয়াশা ছড়িয়ে ধর্ষণ-রমণ করেন, যোনি না পেলে যেখানে সেখানে বীর্যপাত ক’রে শান্তি পান; এবং রচনা করেন শ্লোকের পর শ্লোক নারীনিন্দা। তাঁদের শ্ৰেষ্ঠ ধ্যান হচ্ছে কামধ্যান; আর তাঁরা প্ৰায় সবাই ছিলেন অকালস্খলনগ্ৰস্ত, যার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁদের সামান্য উত্তেজনায় রতিস্খলনের মধ্যে। তাঁদের চোখে নারী কামদানবী। নারীনিন্দায় বৌদ্ধহিন্দু সবাই সমান। জাতক, পঞ্চতন্ত্র, কথাসরিৎসাগর, রামায়ণ, মহাভারত, বিভিন্ন পুরাণ, মনুসংহিতা ও কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র ভরে আছে নারীর দানবীরূপে ও নারীবিদ্বেষে; মুক্তকণ্ঠ ঋষিদের রচিত অশ্লীল উপাখ্যান ও শ্লোকে। জাতকের গল্পে ফিরে ফিরে আসে কামচণ্ডালী নারীরা, যারা কাম ছাড়া কোনো নীতি জানে না। জাতকের একটি গল্পে আছে নারীরা বুড়ী জরতী হয়ে গেলেও থেকে যায় কামদাসী দানবী। বোধিসত্ত্বের মায়ের বয়স একশো বিশ, যাকে বোধিসত্ত্ব নিজে সেবাযত্ন করে। ওই মা’ও কামার্তে হয়ে ওঠে এক যুবকের জন্যে এবং উদ্যত হয় নিজের পুত্রকে হত্যা করতে। আরেকটি গল্পে রাজা শত্ৰু দমনের জন্যে রাজধানী ছেড়ে দূরে যায়; এবং যাওয়ার পথেপথে এক-এক ক’রে বত্ৰিশজন দূত পাঠায় রানীর কুশল জানার জন্যে। রানী বত্ৰিশজনের সাথেই লিপ্ত হয় কামে। যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে রাজা রানীর কুশল জানার জন্যে পাঠায় আবার বত্ৰিশজন দূত; রানী তাদের সাথেও কামে জড়িত হয়। এমনই দানবিক কাম ক্ষুধা নারীদের! নারীদের ক্ষুধার নানা উপাখ্যান রয়েছে পঞ্চতন্ত্র ও কথাসরিৎসাগর-এ। আর্য ঋষিদের চোখে নারী হচ্ছে সমস্ত অশুভ ও দোষের সমষ্টি। নারীকে দেখেছেন তাঁরা একটি বিশাল অতৃপ্ত যোনিরূপে; নারী হচ্ছে আপাদমস্তক যোনি, যে কাম ছাড়া আর কোনো সুখ বা নীতি জানে না। মনু [মনুসংহিতা, ৯:১৪; দ্র মুরারিমোহন (১৯৮৫)] বলেছেন :
নৈতা রূপং পরীক্ষন্তে নাসাং বয়সি সংস্থিতিঃ। সুরূপং বা বিরূপং বা পুমানিতেীব ভুঞ্জতে।
তারা রূপ বিচার করে না, বয়সও বিচার কবে না; সুরূপ বা কুরূপ যাই হোক, পুরুষ পেলেই তারা সম্ভোগের জন্যে অধীর হয়ে ওঠে।
পরের শ্লোকেই [৯:১৫) এ-মহর্ষি বলেছেন :
পুরুষ দেখামাত্রই তারা ভোগে মেতে ওঠে ব’লে তারা চঞ্চলচিত্ত ও স্নেহশূন্য; তাই সুরক্ষিত বাখ্যা হ’লেও তারা স্বামীর বিরুদ্ধে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়।
মহাভারত-এ [অনুশাসনপর্ব : ৩৮] বলা হয়েছে নারী জন্মদুশ্চরিত্র : ‘নারীরা শুধু পরপুরুষের অভাব ও পরিজনের ভয়ে ভর্তার বশীভূত হয়ে থাকে।‘ তার কামক্ষুধার কাছে তুচ্ছ হয়ে যায় আর সব কিছু। মহাভারতের [অনুশাসনপৰ্ব : ১৯]। ঋষি বলেছেন :
স্ত্রীলোক স্বভাবতই রতিপ্রিয়। পুরুষসংসর্গ তাদের যেমন প্রীতিকর, অগ্নি বরুণ প্রভৃতি দেবতারাও তাদের কাছে ততো প্রীতিকর নয় ; সমস্ত স্ত্রীলোকোব মাঝে পতিব্ৰতা চোখে পড়ে মাত্র এক-আধটি। যখন তাদের কামপ্রবৃত্তি প্রবুদ্ধ হয়, তখন তারা পিতা, মাতা, ভ্রাতা, কর্তা, পুত্র ও দেবরেব কিছুমাত্র অপেক্ষা করে না। নিজেব অভিলাষ পূর্ণ করতেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে থাকে।
বলা হয়েছে, ‘তারা অনায়াসে লজ্জা ছেড়ে পরপুরুষদের সাথে সংসর্গ করে। পুরুষ পরস্ত্রীসম্ভোগে অভিলাষী হয়ে তার কাছে গিয়ে অল্প চাটুবাক্য প্রয়োগ করলেই সে তখনি তার প্রতি অনুরক্ত হয়। [অনুশাসনপর্ব : ৩৮]। দেবীভাগবত-এ [ ৯:১৮] বলা হয়েছে :
স্ত্রীজাতি স্বভাবত নিরন্তর অভিলাষিণী-কামচারিণী, কামের আধার স্বরূপা ও মনোহারিণী হয়ে থাকে। তারা অন্তরের কামলালসা ছলক্রমে গোপন করে। নারী প্রকাশ্যে অতি লজ্জাশীলা কিন্তু গোপনে কান্তকে পেলে যেনো তাকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়। রমণী কোপশীলা, কলহের অঙ্কুর ও মৈথুনাভাবে সর্বদা মানিনী, বহু সম্ভোগে ভীতা ও অল্পসম্ভোগে অত্যন্ত দুঃখিত হয়। স্ত্রীজাতি সুমিষ্টান্ন ও সুশীতল জলেব চেয়েও সুন্দর সুরসিক গুণবান ও মনোহর যুবপুরুষকে সর্বদা মনেমনে কামনা করে। তারা রতিদাতা পুরুষকে নিজের পুত্রের থেকেও বেশি স্নেহ করে এবং সম্ভোগপারদররশী পুরুষই তাদের প্ৰাণাধিক প্ৰিয়তম।
এসব শ্লোক থেকে ধারণা করতে পারি। এ-শ্লোককারেরা কী ভয়াবহ কামদানবীরূপে দেখতেন ও কতোটা অবিশ্বাস করতেন নারীকে। তাই ঋষিগুরুরা কোথাও গেলে উদ্বিগ্ন থাকতেন ভাৰ্যাদের রন্ধ সম্পর্কে, প্রহরী হিসেবে রেখে যেতেন শিষ্যদের; এবং শিষ্যদের সম্পর্কেও নিশ্চিতবোধ করতেন না। তাই বিধান দেন যে পঞ্চমহাপাতকের একটি হচ্ছে গুরুপত্নীতে উপগমন। ঋষি [দেবীভাগবত, ৯:১] আরো বলেছেন :
কামিনীগণ জলৌকার মতো সতত পুরুষের রক্ত পান ক’রে থাকে, মূর্খেরা তা বুঝতে পারে না; কেননা তারা নারীদের হাবভাবে মোহিত হয়ে পড়ে। পুরুষ যাকে কান্ত মনে করে, সে-কান্তা সুখসম্ভোগ দিয়ে বীর্য, এবং কুটিল প্রেমালাপে মন ও ধন সবই হরণ করে। তাই নারীর মতো চোর আর কে আছে? রমণীরা কখনো সুখের নয়, তারা শুধু দুঃখেরই কারণ।
আরেকজন বলেছেন, ‘রমণীরা যে-পর্যন্ত কোনো নির্জন স্থান না পায় এবং কোনো পুরুষের সাথে বিশেষ আলাপ করতে না পারে, সে-পর্যন্ত স্ত্রীলোকের সতীত্ব থাকে‘ [শিবপুরাণ, ধর্মসংহিতা : ৪৪]। এ-ঋষিদের একজনের পুনর্জন্ম নেন বঙ্কিমচন্দ্ৰ চট্টোপাধ্যায় নামে; তিনি সৃষ্টি করেন একটি দানবী–রোহিণী। উপপ্রেমিকাতুর রোহিণীর মনস্তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন বঙ্কিম [কৃষ্ণকান্তের উইল : ৭] এভাবে :
রোহিণী দেখিয়াছিল যে, নিশাকর রূপবান–পটলচেরা চোখ।…ভাবিয়াছিল, নারী হইয়া জেয় পুরুষ দেখিলে কোন্ নারী না তাহাকে জয় করিতে কামনা করিবে? বাঘ গোরু মারে,–সকল গোরু খায় না। স্ত্রীলোক পুরুষকে জয় করে–কেবল জয়পতাকা উড়াইবার জন্য।
ঋষিরা পরিমাপও করেছেন দানবীর দুঃশীলতা; নির্দেশ করেছেন দুঃশীলতার ওজন। ঋষিদের পরিমাপে নারী [মহাভারত, অনুশাসনপর্ব : ৩৮] :
তুলাদণ্ডেব একদিকে যম, বায়ু, মৃত্যু, পাতাল, বাড়বানল, ক্ষুরধার, বিষ, সৰ্প, ও বহ্নি এবং অপরদিকে স্ত্রীজাতিকে সংস্থাপন করলে স্ত্রীজাতি কখনোই ভয়ানকত্বে ওগুলোব থেকে ন্যূন হবে না। বিধাতা যখন সৃষ্টিকার্যে প্রবৃত্ত হয়ে মহাভূত সমুদয় ও স্ত্রী-পুরুষের সৃষ্টি করেন, সে-সময়ই স্ত্রীদের দোষের সৃষ্টি করেছেন।
শুধু একবার ওজন করেন নি, করেছেন বারবার, দেখেছেন পরিমাপে তাঁরা নির্ভুল : ‘ইহলোকে স্ত্রীলোকের থেকে পাপশীল পদাৰ্থ আর কিছু নেই। প্ৰজ্বলিত অগ্নি, ময়দানবের মায়া, ক্ষুরধার, বিষ, সৰ্প ও মৃত্যু এর সবগুলোর সাথে তাদের তুলনা করা যায়'[ওই : ৪০; দ্র রবীন্দ্রনাথ (১২৯৪), অশোক (১৯৮৩, ৯১-১০৩), অনন্যা (১৩৯৪, ৩৬-৩৭)]। পদ্মপুরাণ-এ বলা হয়েছে :
ঘূতকুম্ভসম নারী তৃপ্তাঙ্গারসমাঃ পুমান।
তস্মাদ্ঘৃতঞ্চ বহ্নিঞ্চ নৈকস্থানে চ ধারয়েৎ।।
যথৈব মত্ত মাতঙ্গ সৃণিমুদগর যোগতঃ।
স্ববশং কুরুতে যন্তা তথা স্ত্রীণাং প্ররক্ষকঃ।।
নারী ঘৃতকুম্ভসম, পুরুষ তপ্ত অঙ্গারাসমান;
তাই ঘৃত ও অগ্নিকে একস্থানে রাখা উচিত নয়।
মাহুত যেমন মুগুর দিয়ে মত্ত হস্তীকে বশ করে,
তেমনি বশ করতে হবে নারীকে।
ব্ৰহ্মবৈবর্ত পুরাণ-এ আছে, ‘দুনিবাৰ্যশ্চ সৰ্বেষাং স্ত্রীস্বভাবশাচ চাপলঃ’, অর্থাৎ “স্ত্রীস্বভাব এতো চঞ্চল যে কারো পক্ষে সহজে নিবারণ করা অসম্ভব।’ এ-পুরাণপ্ৰণেতা আরো বলেছেন, ‘নারী মোক্ষদ্বারের করাট, হরিভক্তির বিরোধী। সংসারবন্ধনস্তম্ভের রজ্জ্ব, যা ছিন্ন করা যায় না। নারী বৈরাগ্যনাশের বীজ, সর্বদা অনুরাগবর্ধনকারিণী, সাহসের ভিত্তি ও দোষের গৃহ। নারী অবিশ্বাসের ক্ষেত্র, মূর্তিমতী কপটতা; অহঙ্কারের আশ্রয়, নারীর মুখে মধু ও অন্তরে বিষ।‘ পঞ্চতন্ত্র-এ বিষ্ণুশৰ্মা হিতোপদেশ দিয়েছেন : ‘নারীর মুখে মধু, অন্তরে শুধুই বিষ; তাই এদের মুখ পান করবে। কিন্তু হৃদয় মুষ্টাঘাতে আহত করবে।‘ এমন দানবী কি ঈশ্বর সৃষ্টি করতে পারেন? এক ঋষি প্রশ্ন করেছেন : ‘বিষ ও অমৃতযুক্ত স্ত্রীরূপ যন্ত্র ধর্মনাশের জন্যে কার দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে?’ আরেক ঋষি বিধান দিয়েছেন, ‘নাৰ্য শ্মশানঘটিকা ইব বর্জনীয়াঃ’ : ‘নারী শ্মশানের ঘটিকার মতো বর্জনীয়’ ( দ্র নারায়ণ (১৩৭৪, ৫৩-৫৪)]। নজরুল দোলন-চাঁপার ‘পূজারিণী’ কবিতায় চিৎকার করে বলেছেন, ‘নারী নাহি হতে চায় শুধু একা কারো, / এরা দেবী, এরা লোভী, যত পূজা পায় এরা চায় তত আরো। /ইহাদের অতিলোভী মন/একজনে তৃপ্ত নয়, এক পেয়ে সুখী নয়, যাচে বহু জন।‘ প্রাচীন ভারতীয় ঋষিদের গলা স্পষ্ট শোনা যায় এ-বিদ্বেষ ও হাহাকারে।
কিন্তু নারীকে পুরুষ বর্জন করতে পারে নি, দানবীকে সে প্রয়োজনে, কামে ও আবেগে কখনো কখনো দেবী ক’রে তুলেছে। বন্দনা করেছে তার দেবীরূপের-মাতা, স্ত্রী ও দয়িতার। তবে দেবীরূপে নারী পুরুষের অধীন, সামান্য ও অসহায়; তাই দেবী অনেক স্বস্তিকর, পুরুষের প্রিয় পুতুল। পুরুষ যখন নারীকে দেবীরূপেও কল্পনা করে, তখন তার ওপরে থাকে পুরুষ ও পুরুষ দেবতারা; দেবীকে ক’রে তোলে তারা বাহ্যিক শোভাময়, এবং অন্তঃসারশূন্য। হিন্দু পুরাণে চণ্ডী বা দুৰ্গা মহাশক্তি, কিন্তু তার শক্তিও তার নিজের নয়; পুরুষ দেবতাদের কৃপায় সে শক্তিময়ী : ‘শিবের তেজে দেবীর মুখ, যমের তেজে কেশ, বিষ্ণুর তেজে বাহুসমূহ, চন্দ্ৰতেজে স্তনদ্বয়, ইন্দ্রের তেজে মধ্যভাগ, বরুণের তেজে জংঘা ও উরু, পৃথিবীর তেজে নিতম্ব, ব্ৰহ্মার তেজে পদযুগল…। মহাদেব দিলেন শূল, কৃষ্ণ দিলেন চক্র, শঙ্খ দিলেন বরুণ, অগ্নি দিলেন শক্তি…’ [দ্র হংসনারায়ণ (১৯৮০, ১৭৫)]। আদমের বক্র হাড় থেকে যেমন সৃষ্টি করা হয়েছে হাওয়াকে, তেমনি পুরুষ দেবতাদের শক্তির সংকলন হচ্ছে এ-দেবী, যার নিজস্ব অস্তিত্বই নেই।
পুরুষতন্ত্র বহু শতাব্দী ধ’রে নারীকে ভূমি আর ভূমিকে নারীরূপে দেখে আসছে; পৃথিবীকে মাতৃদেবীরূপে পুজোও করছে; কিন্তু তার শক্তিকে করছে অস্বীকার। এস্কিলুস, আরিস্ততল, হিপপোক্রেতিস ঘোষণা করেছেন অলিম্পাস থেকে পৃথিবী পর্যন্ত সবখানে প্রধান পুরুষ; পুরুষই সৃষ্টিশীল, নারী নয়। নারী ভূমি, নারী উর্বর; তবে ওই উর্বরতা সৃষ্টিশীল নয়, তাকে সৃষ্টিশীল করে পুরুষের বীর্য। নারী মৃত্তিকা, পুরুষ বীজ; পুরুষ অগ্নি, নারী জল। মনু বলেছেন, ‘নারী জাতি ক্ষেত্রস্বরূপ এবং পুরুষ বীজস্বরূপ; ক্ষেত্র ও বীজের সংযোগেই সমস্ত প্রাণীর উদ্ভব হয়ে থাকে’ [৯:৩৩]; তিনি আরো বলেছেন, ঠিক সময়ে কৰ্ষিত ক্ষেত্রে যেমন বীজ বপন করা হয়, ক্ষেত্রে সে-বীজগুণসম্পন্ন অঙ্কুরই উদগত হয়ে থাকে’ [৯:৩৬]। কোরানে আছে : ‘তোমাদের স্ত্রী তোমাদের শস্যক্ষেত্র। তাই তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভারে ইচ্ছে যেতে পারো’ [২:২২৩]। পুরুষ নারীকে দরকারে দেবী করেছে, ধরণী করেছে; কিন্তু তাকে ক’রে রেখেছে অসার। প্রজননে নারীর ভূমিকাকে অস্বীকার করে তাকে পরিণত করেছে একটি অক্রিয় বীজধারণের পাত্রে। পিতৃতন্ত্র পুরুষের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার জন্যে বীজকেই দিয়েছে গুরুত্ব। হিন্দু পুরাণে দেখা যায় দেবতা ও ঋষিরা যেখানেসেখানে বীর্যপাত করছে, জন্ম দিচ্ছে অজস্র সন্তান; অর্থাৎ তারা নারীর জরায়ুকে প্রত্যাখ্যান ক’রে নারীকে তার একান্ত অধিকার থেকেও বহিষ্কার করেছে। পিতৃতন্ত্রের নারীর জরায়ুকে অস্বীকারের প্রায় রাজনীতিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় এস্কিলুসের অরেসতেইয়া নাটকে। অ্যাপোলো পেশ করে জন্মদানের পিতৃতান্ত্রিক ভাষ্য :
মা নয় শিশুর মাতা, যাকে তার বলা হয়।
সে সেবিকামাত্র, তার কাজ তার ভেতবে বপন করা
শিশুর প্রকৃত জন্মদাতা পুরুষের বীজ লালনপালন।
যদি দেবতার বরে বেঁচে থাকে শিশু,
সে তাকে পালন কবে, যেমন সখার জন্যে
কেউ দেখাশোনা কবে বেড়ে-ওঠা চারা…
মা ছাড়াও পিতা পারে জন্ম দিতে।
পুরুষের প্রাধান্য রাখার জন্যে পিতৃতন্ত্র সব পারে ; জন্মের স্বাভাবিক রীতিকেও উল্টে দিতে পারে। অ্যাপোলো এর উদাহরণও হাজির করেছে; নিয়ে এসেছে অ্যাথেনাকে, যে সম্পূর্ণ যুবতীরূপে জন্ম নিয়েছিলো পিতা জিউসের শির থেকে। সে এসেই ঘোষণা করে পিতৃতন্ত্রের জয় : ‘কোনো মাতা জন্ম দেয় নি আমাকে। তাই পিতার দাবি ও পুরুষাধিপত্যকে আমি শিরোধাৰ্য করি।‘ পুরুষতন্ত্রের একটি চমৎকার কৌশল হচ্ছে নারীর মুখে পুরুষের জয় ঘোষণা ও নারীনিন্দা করা। মহাভারত-এর নারীনিন্দার আধিকাংশ শ্লোক বলা হয়েছে নারীরই মুখে। পুরুষতন্ত্রে পুরুষই দেবতা; সে সব পারে, একলা নিজেই জন্ম দিতে পারে, দেবীকে পরিণত করতে পারে দাসীতে; মাকে শেখাতে পারে নীতিশাস্ত্র। বাঙলায় সাধারণ মানুষের মধ্যে এখনো বিশ্বাস রয়েছে যে নারী ঘট মাত্র; পুরুষের বীজেই ওই ঘট ভরে ওঠে। পুরুষ যখন নারীকে দেবী ব’লে, ভূমি ব’লে, মা ব’লে, তখনো তার মহিমা অস্বীকার করে।
নারীর দেবীরূপের একটি হচ্ছে বধু, যে পরম কাম্য শিকার পুরুষের। নববধূকে আলিঙ্গনে জড়িয়ে পুরুষ লাভ করে জীবন্র সমস্ত ধন। তার টাটকা শরীরের ছোঁয়ায় পুরুষের শরীরে ও মনে জাগে কবিতা, বাজে সঙ্গীতের সুর, সে ঢেকে যায় নিসর্গের বর্ণিল শোভায়। পুরুষের কাছে সে তখন কপোত ময়না কোকিল, গোলাপ পদ্ম রজনীগন্ধা, অমৃত, সন্ধ্যার মেঘমালা, হীরেচুনিপান্না, বসন্তের বাতাস, নীলিমা, সমুদ্র। কবিরা এ-দেবীর স্তব করেছেন উৎকৃষ্টতম শব্দের উৎকৃষ্টতম বিন্যাসে। বধু দেবী, কেননা সে পুরুষের রঙিন কামের রক্তিমতম পরিতৃপ্তি। কবি গেয়ে ওঠেন, ‘ওগো বধু সুন্দরী, তুমি মধুমঞ্জরী, পুলকিত চম্পার লহো অভিনন্দন–/পর্ণের পাত্রে ফাল্গুনরাত্রে মুকুলিত মল্লিকামাল্যের বন্ধন।/এনেছি বসন্তের অঞ্জলি গন্ধের; পলাশের কুঙ্কুম চাঁদিনির চন্দন–/পারুলের হিল্লোল, শিরীষের হিন্দোল, মঞ্জল বল্লীর বঙ্কিম কঙ্কণ’ [রবীন্দ্রনাথ]; আর এর সুরে ও ছবিতে প্রবলভাবে বয়ে চলে পুরুষের কামের প্রবাহ। দেবীকে ঘিরে আবর্তিত হয় পুরুষের থরোথরো কামনা। কামই ঘিরে থাকে দেবীকে বুদ্ধদেব বসু যখন বলেন, ‘যাও, মেয়ে জীবনের খাদ্য হও’; বা বিষ্ণু দে বলেন, ‘তুমি যেন এক পর্দায় ঢাকা বাড়ি, / আমি অঘ্রাণ-শিশিরে সিক্ত হাওয়া, /বিনিদ্র তাই দিনরাত ঘুরি ঘিরে’ ; বা ‘শলোমনের পরমগীত’-এর দয়িত বলে :
অয়ি মম প্ৰিয়ে! দেখ, তুমি সুন্দরী,
দেখ, তুমি সুন্দরী,
ঘোমটার মধ্যে তোমার নয়নযুগল কপোতের ন্যায়;
তোমার কেশপাশ এমন ছাগপালের ন্যায়,
যাহাবা গিলিয়দ-পৰ্ব্বতের পার্শ্বে শুইয়া থাকে।
তোমার দন্তশ্রেণী ছিন্নলোমা মেষীর পালবৎ,
যাহারা স্নান করিয়া উঠিয়া আসিয়াছে,…
তোমার ওষ্ঠাধর সিন্দুরবর্ণ সূত্রের ন্যায়,
তোমার গণ্ডদেশ দাড়িম্বখণ্ডের ন্যায়।…
তোমার কুচযুগল দুই হরিণ-শাবকের,
হরিণীব দুই যমজ বৎসের ন্যায়…
তোমার প্রেম দ্রাক্ষারস হইতে কত উৎকৃষ্ট!
তোমার তৈলের সৌরভ সমস্ত সুগন্ধি দ্রব্য অপেক্ষা কত উৎকৃষ্ট।
কান্তে! তোমার ওষ্ঠাধর হইতে ফোটা ফোটা মধু ক্ষরে,
তোমার জিহ্বার তলে মধু ও দুগ্ধ আছে;
মম ভগিনি, মম কান্তা অর্গলবদ্ধ উপবন,
অৰ্গলবদ্ধ জলাকর, মুদ্রাঙ্কিত উৎস।…
তোমার গোলাকার উরুদ্বয় স্বর্ণহারস্বরূপ।
নিপুণ শিল্পীর হস্তনির্মিত স্বর্ণহারস্বরূপ।
তোমার দেহ এমন গোল বাটির ন্যায়,
যাহাতে মিশ্ৰিত দ্রাক্ষারসের অভাব নাই।
তোমার কটিদেশ এমন গোধূমরাশির ন্যায়,
যাহা শোশন-পুষ্পশ্রেণীতে শোভিত।….
তোমার কুচযুগ দ্রাক্ষাগুচ্ছম্বরূপ।
বধুর এ-অসামান্য রূপ শুধু যৌবনের, যখন সে প্রেমিক; যখন সে গাৰ্হস্থ্য স্ত্রী হয়ে ওঠে নি। স্ত্রী হয়ে ওঠার পরও কখনো কখনো তাকে দেবী ক’রে তোলে পুরুষ, সন্তানের জননী গৃহলক্ষ্মীরূপে; কিন্তু সে নিজে তখন দেবতা। দেবতাই প্ৰভু, গৃহের দেবী তার পরিচারিকামাত্র।
কোনো কোনো ধর্মে নারীকে তার রক্তমাংস থেকে উত্তীর্ণ ক’রে অতীন্দ্ৰিয় ক’রে তোলা হয়। যেমন খ্রিস্টধর্মে, বা সুফিদের সাধনায়, কিছুটা হিন্দুধর্মে। ইসলামে নারীকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে সমস্ত অতীন্দ্ৰিয়তা ও রহস্য থেকে, মুসলমানের কোনো দেবী নেই; মুসলমানের কাছে নারী সম্ভোগের সামগ্ৰী:–পৃথিবীতে এবং ইন্দ্ৰিয়ভারাতুর বেহেশতে। খ্রিস্টানরা নারীকে মনে করে পরিবার ও গৃহের আত্মা। প্রায় সমস্ত ভাষায়ই দেশ, নগর, নদী প্রভৃতি নারী; নানা বিমূর্ত ভাবনাও নারী। সাহিত্যে নারীই বারবার ব্যবহৃত হয়েছে রূপকরূপে; কারণ নারী হচ্ছে ভাব ও আত্মা। খ্রিস্টানের কাছে নারী স্বর্গের সৌন্দর্য, যে তাকে ঈশ্বরের দিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়, যেমন ‘ডিভাইন কমেডি’তে দান্তেকে পথ দেখায় বিয়াত্রিসে। অনেক তত্ত্বে নারী হচ্ছে সুষমা, যুক্তি, সত্য। বিহারীলাল, হিন্দুধর্মের প্রভাবেই, বিশ্বসৌন্দর্যের সারসত্তাকে দেখেছেন নারীরূপে, সারদারূপে, এবং তাকে গৃহে দেখতে পেয়েছেন স্ত্রীরূপে। রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতাও অনেক সময় নারী। নারী যখন ভাব, রূপক, প্রতীক, তখন সে আর মাংস নয়; সে তখন অলৌকিক সত্তা। নারী তখন, যেমন জীবনানন্দের কাছে, অনন্ত নক্ষত্ৰবীথি অন্ধকারে জ্বলে যার পবিত্র শিখা। তখন সে কারো সম্পত্তি নয়, সম্ভোগসামগ্ৰী নয়, তখন সে আরাধ্য। তখন সে অতীন্দ্ৰিয়, বায়বীয়; তখন অশুভ রূপান্তরিত হয়। শুভ ও শুদ্ধতায়। তবে এ-নারী বাস্তব নারী নয়; তাকে নিয়ে বাস করে না পুরুষ; নারীর অতীন্দ্ৰিয় মূর্তি রচনা প্ৰকাশ করে পুরুষেরই প্রতিভা, তাতে নারীর অবস্থার কোনোই উন্নতি ঘটে না।