০৭. দেবভাষায় কটুকাটব্য

দেবভাষায় কটুকাটব্য

০১.

পারস্পরিক কলহ এবং সেই সূত্রে গালাগালি–এটি বোধহয় পৃথিবীর প্রাচীনতম মৌখিক ব্যায়াম। অল্প হোক বেশি হোক, ঝগড়া সবাই করে; যে বলে, করে না–তারও মনের কোণে এই বৃত্তিটি লুকিয়ে আছে। শুধুমাত্র প্রকাশ এবং লিপিকরের অভাবে পৃথিবীর প্রাচীনতম ঝগড়ার ভাষাটি আমাদের অজানা রয়ে গেল। প্রথমেই বলি–ঝগড়া দু-রকমের। ঘরে এবং বাইরে। চ্যারিটি’ যেমন ঘরে আরম্ভ হয়, ঝগড়াও তেমনি প্রথমে আপন গৃহে আশৈশব অভ্যস্ত হয়ে, আস্তে আস্তে বহির্জগতে সঞ্চারিত হয়। কাজেই ঘরে এবং বাইরে–এই দু’য়ের অন্তর্বর্তী সময়টুকু যে যত সুকৌশলে সুব্যবহার করতে পারবে, পরবর্তীকালে সে তত ভালো ঝগড়াটে হয়ে উঠতে পারবে।

ঝগড়া এবং গালাগালির প্রকারভেদ নিয়ে এ যাবৎ কোনও গবেষণা হয়েছে কিনা, আমার জানা নেই। তবে স্থান, কাল এবং পাত্র ভেদে ঝগড়া নানারকমের হয় এবং একই কারণে গালাগালিরও প্রকারভেদ আছে। যারা স্থান, কাল এবং পাত্র নির্বিশেষে ঝগড়া করতে পারেন, সেই সব অতি শক্তিমান মানুষেরা এই প্রবন্ধের আওতায় পড়বেন না; কেননা কবি যেমন প্রায় নির্বিষয়ক জিনিসের ওপরেও কবিতা লিখে ফেলতে পারেন, এঁরাও তেমনি তুচ্ছ কিংবা বিনা কারণেই অতি আকস্মিকভাবে ঝগড়ার সৃষ্টি করতে পারেন। তাদের এই অহৈতুকী শক্তি এবং তাদের গলার আরোহণ অবরোহণ সংযোগে যে বিচিত্র গালাগালি পরিবেশিত হয় তার একটি বর্ণনা আপাতত নিষ্প্রয়োজন, কেননা আমরা সভ্য-সমাজের কথা বলছি। কিন্তু এই সভ্য সমাজের অন্তঃকলহ, যদি নিকৃষ্ট ঝগড়ার রূপ নেয় কিংবা তাদের কথাবার্তার মধ্যে যদি এমন কোনও শব্দ চিত্র পাওয়া যায়, যার অর্থ শালীনতা অতিক্রম করে, তাহলে পাঠক যেন আমাকে ক্ষমা করবেন। অবশ্য সেই সঙ্গে এও মনে রাখবেন যে আপনিও সেই সভ্য সমাজের একজন।

যাই হোক, ঝগড়া এবং গালাগালির শত-সহস্র অবান্তর ভেদ থাকলেও আমার আলোচ্য পরিসর হবে খুব ছোটো এবং তীক্ষ্ণ বিষয়গুলি। আধুনিককালের কোনওরকম ঝগড়াঝাটির মধ্যে আমি যাব না; কেননা রাজনীতির কল্যাণে ঝগড়া জিনিসটা এখন সর্বত্রই ঢুকে পড়েছে। তাছাড়া কাল কলি, এবং কলি অর্থ কলহ। এক সাধু-মহারাজ আমাকে প্রায় বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, ভাগবত-পুরাণ অনুসারে কলহরূপী এই কলির স্থান নাকি চারটি– অক্ষক্রীড়া, পানশালা, স্ত্রীলোক এবং প্রাণীবধ। এরপর তিনি বললেন–”কলিকাতা মহানগরীকে ডাকবিভাগের সংক্ষিপ্ত ভাষ্যে লেখা হয় কলি’, তার মানে এই কলিকাতা শহরই হল কলির নিবাস-ভূমি।” কথাটা প্রথমে তেমন করে আমল দিইনি, কিন্তু পরে, যখন দেখলাম সমস্ত কলকাতায় ব্লক-কংগ্রেসের অফিস আর কমিউনিস্টদের লোকাল কমিটি ছড়িয়ে পড়ল, যখন দেখলাম প্রাইমারি স্কুল থেকে আরম্ভ করে সব কটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি একেবারে ছেয়ে গেল, তখন বুঝলাম সাধুজির অভিনব ব্যাখ্যাটি তো মন্দ নয়। সত্যিই তো, কলিকাতা শহর কলি-কলহের আদর্শতম জায়গা। এই শহরের সমস্ত অলিতে-গলিতে যত বিচিত্র রকমের কলহ প্রতিনিয়তই জন্ম নিচ্ছে, তার নিকেশ করা আমার কম্মো নয়। তার থেকে কলি-কলহের সঙ্গে আমি যে বিদ্যাশিক্ষার প্রসঙ্গটি টেনে আনলাম তার কৈফিয়ৎ দিই।

সকলেই যেমন জানেন যে, বিদ্যা কিংবা বাক্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন বাগদেবী, তেমনি অনেকেই বোধ করি জানেন না যে, ঝগড়াঝাটিরও একজন অধিষ্ঠাত্রী দেবী আছেন এবং তিনিও বাগদেবী। সরস্বতীর বরপুত্রদের কথাটা হয়তো তত পছন্দ হচ্ছে না কিন্তু দেবী ভাগবত পুরাণটি খুলে দেখবেন আমার কথা সত্যি। একসময় নাকি লক্ষ্মী, সরস্বতী এবং গঙ্গা–এঁরা তিনজন ভগবান শ্রীহরির স্ত্রী-রূপে বিরাজ করছিলেন। তিনজনই বড়ো ঘরের মেয়ে, কাজেই সমান প্রেমের অংশীদার। কিন্তু একদিন হল কি, (এটি নববসন্তের কারণে হতে পারে, “ছোট বউ সোনার দলা”–সে কারণে হতে পারে, কিংবা সতত উচ্ছল জলরাশির মতো তার আপন চঞ্চল স্বভাবের জন্যও হতে পারে) ছোটোবউ গঙ্গা একাধিকবার টেরিয়ে টেরিয়ে শ্রীবিষ্ণুর দয়িত মুখখানি দেখছিলেন। তাঁর ভাবটিও বেশ প্রকটভাবে সকাম ছিল। আর এইসব আকস্মিক এবং ক্ষণিকের ভাববিলাসে ভগবান বিষ্ণু আশৈশব অভ্যস্ত এবং নিপুণ হওয়ায়, তিনিও চোখে চোখেই গঙ্গা-কটাক্ষের উপযুক্ত উত্তর দিচ্ছিলেন। সবাই জানেন–বড়োবউ লক্ষ্মী অমৃত মন্থনের আগ পর্যন্ত সমুদ্রের মধ্যে বড়ো হওয়ায় বহির্জগতের কোনও শব্দ তার কানে যেত না। এইরকম একটা বদ অভ্যাসের ফলে পুজোর সময় কাঁসর-ঘণ্টার আওয়াজও তিনি সহ্য করতে পারেন না। আমাদের ধারণা, একই কারণে অনর্থক ঝগড়াঝাটি এড়ানোর জন্য গঙ্গাকে ক্ষমা করে দিলেন লক্ষ্মী। কিন্তু সরস্বতী ছাড়বার পাত্র নন। তিনি প্রথমেই ভগবান শ্রীহরিকে সংক্ষেপে বললেন-বোঝাই যাচ্ছে, গঙ্গার ওপর তোমার ভালোবাসা কতখানি? আর লক্ষ্মীর ওপরে ভালোবাসা প্রায় সমান। সমান ব্যবহারের জন্য যেসব মনীষীরা তোমাকে সত্ত্ব-স্বরূপ বলে জানেন, তারা আসলে মূর্খ।” আরও কী শুনতে হয় এবং আরও বৃহত্তর কোনও অনর্থ কিছু না ঘটে–এই আশঙ্কায় মনে মনে কী একটা ভেবে ভগবান সভার বাইরে চলে গেলেন–মনসা চ সমালোচ্য জগাম স বহিঃসভা। এইবার লক্ষ্মী আর গঙ্গাকে সরস্বতী পেলেন একা। ব্যস্ গঙ্গার চুলের মুঠি ধরে সরস্বতী কিছু একটা করতে যাবেন এমন সময় লক্ষ্মী সরস্বতীর কোমর ধরে ঝুলে পড়লেন। রাগের সময় এইরকম বাধা দিলে যা হয়, সরস্বতী লক্ষ্মীকেই এক সাংঘাতিক শাপ দিয়ে বসলেন।

আগেই বলেছি লক্ষ্মী হলেন অতি ভদ্র এবং স্নিগ্ধা মহিলা। শাপ শুনে তার কিঞ্চিৎ ক্রোধাবেশ হল বটে, তবু তিনি বীণাপাণির আপাতত বীণাবাদন-হীন হস্তখানি ছেড়ে দিলেন না। ওদিকে চুলের মুঠিতে টান পড়ায় এবং তারই কারণে লক্ষ্মীর হেনস্থা হওয়ায়, গঙ্গা এবার লক্ষ্মীকে বললেন–”ছেড়ে দাও বড়দি, এই ঝগড়াটে মেয়েছেলেটাকে–দুঃশীলা মুখরা নষ্টা নিত্যং বাঁচালরূপিণী। ও আমার করবেটা কী? ইনি বাক্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী তাই তো কলহপ্রিয়া–বাগধিষ্ঠাত্রী দেবীয়ং সততংকলহপ্রিয়া। দুর্মুখীর কত শক্তি আছে, আর আমার সঙ্গে কত ঝগড়া করতে পারে, আমি আজ তাই দেখব।” অতএব গঙ্গাও শাপাশাপি আরম্ভ করলেন। সাধারণ গৃহস্থ বাড়ির কর্তার মতো নারায়ণ অনেকক্ষণ বাইরে রইলেন বটে, তবে ভেতরে এসে দেখলেন পারস্পরিক শাপ-শাপান্তের পালা শেষ। তিনি প্রথমেই অভিমানিনী সরস্বতাঁকে টেনে নিলেন বুকে–বাসয়ামাস বক্ষসি। তারপরে অনেক দুঃখে নারায়ণ বললেন-যে বাড়িতে তিনটি বউ এবং সে বউয়ের চরিত্র যদি তিন রকমের হয় তাহলেই বিপদ। ব্যাধির জ্বালা বরং সহ্য হয়, বিষ খাওয়ার জ্বালা–সেও ভালো, কিন্তু–দুষ্টস্ত্ৰীণাং মুখজ্বালা মরণাদতিরিচ্যতে–ঝগড়াটে স্ত্রীলোকের মুখ-ঝামটা সহ্য করার থেকে মরণ ভালো।

সর্বদশী নারায়ণের এই করুণ অভিজ্ঞতার প্রতি আমরা সম্পূর্ণ সহানুভূতিশীল, তবে পুরাণ-পুরুষ তার অভিজ্ঞতা-বশে যে সিদ্ধান্ত করেছিলেন তার সঙ্গে আমরা সম্পূর্ণ একমত নই। তিনি বলেছিলেন–একভাৰ্য্যঃ সুখী” অর্থাৎ একটি বউ থাকলে স্বামীর সুখ, কিন্তু “নৈব বহুভাৰ্য্যঃ কদাচন” অর্থাৎ কিনা একাধিক বউ থাকলেই ঝগড়া লাগবে। কিন্তু হে পুরাণ-পুরুষ! তুমি অজ-জন্মরহিত, তুমি স্বয়ং জগৎপিতা হওয়ায়, তোমার পিতাও নেই। যদি পিতা থাকত, তাহলে তুমি বুঝতে–এখনকার দিনে গার্হস্থ্য ঝগড়ার জন্য নিজেরই তিনটে বউ থাকার দরকার নেই, পিতার স্ত্রী কিংবা ভ্রাতার স্ত্রী থাকলেই যথেষ্ট, আর যদি নিদেনপক্ষে পিতার কিংবা ভ্রাতার দিক থেকে উপযুক্ত সরবরাহ ব্যবস্থা না থাকে তাহলে স্বয়ং স্বামীই এই অভাব পূরণ করে যোগ্য প্রতিপক্ষের কাজ করতে পারেন। কারণ এই ঘোর কলিযুগে (সমস্ত পুরাণ মতেই) মেয়েরা সব পুরুষের মতো আর পুরুষেরা সব–স্ত্রীবশঃ পুমা৷ কাজেই মাতা এবং ভ্রাতৃবধূর অভাবে স্ত্রীর যদি স্বামীর ওপর ক্রোধাবেশ হয় তাহলে স্বামী কী বলবেন, সেটি আমি প্রসিদ্ধ আলংকারিক প্রথায় জানাচ্ছি। বলবেন–সুন্দরী! অধম দাসের ওপরে রাগ হলে প্রভু তাকে পাদপ্রহার করেন–এতে কোনও দুঃখ নেই। কিন্তু সেই প্রহারেও যে স্পর্শটুকু রয়েছে, তাতেই গায়ে দিয়েছিল কাটা-পুলকে রোমাঞ্চে। ভয় হয়, গায়ের সেই রোমাঞ্চ-কণ্টকে তোমার কুসুম-কোমল পাখানিতে ব্যথা লাগেনি তো–উদ্যৎ-কঠোর-পুলকাঙ্কুরকণ্টকাগ্রৈর্য ভিদ্যতে মৃদুপদং ননু সা ব্যথা মে।

অতি কঠিন এবং প্রতিকূল এক সময়ে এইরকম একটি আলংকারিক আত্মনিবেদন–এ বোধকরি সবার পক্ষে সম্ভব নয় এবং এইরকম একটি লীলায়িত প্রতিবাদে দুনিয়ার সমস্ত স্বামীরা শামিল হবেন কিনা, তাতেও আমাদের সন্দেহ আছে। সবচেয়ে বড়ো কথা সাধারণ মধ্যবিত্ত গৃহস্থ ঘরে, সে যত ভদ্র ঘরই হোক, স্বামী-স্ত্রী কেউই কম যান না। অধিকাংশ পুরুষ মানুষেরই অবশ্য মনে মনে ধারণা যে, তার স্ত্রীর মধ্যে পূর্বোক্ত পরমা-প্রকৃতি লক্ষ্মীর অংশ যতখানি তার থেকে নিত্য বাঁচালরূপিণী সরস্বতীর অংশটাই বেশি। এ ধারণা যে সর্বৈব ভুল, সে কথায় একটু পরেই আসছি, তবে সরস্বতীর এই দুর্নামের কথাটা খুব সোজা। সবাই জানেন কিনা জানি না, একশ্রেণির আলংকারিকের মতে, সমস্ত কবিত্ব কিংবা কাব্যের অলংকার মানেই বেশি কথা বলা–অতিশয়োক্তি, অর্থাৎ মুখখানি যে চাঁদের মতো সুন্দর–একথা না বললেও পৃথিবীর কোনও ক্ষতি-বৃদ্ধি হত না। তবু কাব্য আছে, অলংকারও আছে, অপি চ সমস্ত কাব্যালংকারের প্রাণ প্রতিষ্ঠা যদি বাস্বরূপা সরস্বতীর ওপর নির্ভর করে, তবে ঝগড়া কিংবা বাদানুবাদের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতীই বটে, কেননা ঝগড়া মানেও বাড়তি কথা বলা।

এখন সরস্বতী যেহেতু স্ত্রীলোক তাই পৃথিবীর তাবৎ স্ত্রীলোকের কিছু স্বাভাবিক বাক্-সিদ্ধি থাকলেও থাকতেও পারে, তবে এক্ষেত্রে সাধারণীকরণ একেবারেই ঠিক হবে না। বিশেষত সংস্কৃত সাহিত্যে এমনও প্রাচীন শ্লোক পাওয়া যায় যেখানে শুধুমাত্র রান্না না হওয়ার অপরাধে স্বামী দেবতা আপন স্ত্রীকে মহাপাপিনী’ বলে সম্বোধন করেছেন। স্ত্রীও কম নন, তিনি বললেন–”পাপী আমি নই, পাপী তোমার বাবা!” আর যায় কোথা, স্বামী। বললেন–ব মেয়েছেলে কোথাকার, খুব যে কথা বেরুচ্ছে মুখ দিয়ে? গিন্নি ততোধিক বেঁজে বললেন–ব মেয়েছেলে আমি? বদ্ হল তোমার মা-বোনেরাতবৈব জননী রণ্ডারণ্ডা ত্বদীয়া স্বসা। কর্তা বললেন–”বেরোও আমার বাড়ি থেকে।” গিন্নি বললেন–মজা নাকি, বাড়িটি কি তোমার, যে বললে, আর বেরিয়ে যাব। কর্তা এবার আর্তস্বরে ভগবানের কাছে। মরণ ভিক্ষা চাইলেন, এবং ভাবলেন বুঝিবা তার বাড়িতে উপপতির ভাগ্য খুলে গেছে–হ্যাঁ হা নথ মাদ্য দেহিমরণংজারস্য ভাগ্যোদয়ঃ।(মহাসুভাষিত সংগ্রহ)

এই যে ঝগড়া, এ সব সময়, সর্বত্র দেখা যায় না এবং যাও বা দেখা যায়, তাও খুব ভালো ঘরে নয়। তবে বড়ো মানুষের বড়ো ঘরেও যে এমন ঝগড়া চলে না, তা নয়, তবে তাতে থাকে আধুনিক পালিশ, শব্দ কিছু কম, কিন্তু যন্ত্রণা আরও বেশি।

আমি আগেই বলেছি, ঝগড়ার ক্ষেত্রে স্থান, কাল এবং পাত্র–এই তিনটিই বড়ো জরুরি। বিশেষত অন্তর-মহলে যে ঝগড়া চলে, বহির্জগতে তা চলে না। যে নিন্দাবাদ আত্মীয়-পরিজনের মধ্যে চলে, সেই নিন্দাবাদই নতুন চেহারা নেয়, যখন তা বৃহত্তর জগতে ব্যবহার করি। তবে ঝগড়া কিংবা গালাগালির কথা যেহেতু আমি অতি লঘুভাবে আরম্ভ করেছি, তখন লঘু কথাগুলি আগেই সেরে নিই। ঝগড়াঝাটির ব্যাপারে স্ত্রীলোকের অশিক্ষিত-পটুত্বের অভিযোগ থাকায় কালচার্ড অথবা বিদগ্ধা মহিলাদের সম্বন্ধেও দু-এক কথা আগেভাগেই জানানো প্রয়োজন। গাথাসপ্তশতীর কবি হাল বলেছেন যে, ভালো দরের মহিলারা নাকি ভৎর্সনা করেন হেসে, পীড়ন করেন অতি যত্ন করে আর কলহ করেন চোখের জল ফেলে। সুমহিলাদের সম্বন্ধে আমাদের মনেও এইরকম উচ্চ ধারণা আছে বটে, তবে কার্যক্ষেত্রে শুধুমাত্র চোখের জলে আমাদের দেশের পুরুষ-পুঙ্গবদের মন ভুলবে কিনা, বলা শক্ত। বিশেষত, পুরুষের ধারণা–পুরুষ-মানুষেরা একদম ঝগড়া করতে চায় না, ঝগড়া বাধায় মেয়েরা।

এখনকার কালের কথা বলতে পারব না, তবে সেদিনের মেয়েদের ওপর এই দোষ চাপালে আমার বিলক্ষণ আপত্তি আছে। কেননা এ-কালের নববধূ-প্রধান সমাজব্যবস্থার সঙ্গে সেকালের পুরুষ শাসিত সমাজের কোনও তুলনা হয় না। প্রথমত খাতায়-কলমে, মনুর নিয়মে সেকালের মেয়েদের ঝগড়া করার কোনও উপায় ছিল না এবং ঝগড়া করার শাস্তিও ছিল বড়োই কঠিন। কাজেই চোখের জল ফেলে ঝগড়া করার আদত যদি সুমহিলাদের জানা থাকে, তবে অন্যদেরও চোখের জল ফেলতে হত ঝগড়া করার অক্ষমতার জন্য। সেকালের শাস্ত্রমতে নারী-পুরুষ একবার সাত পাকে বাঁধা পড়লে আর খেয়ালখুশিমতো বিবাহবিচ্ছেদ করা চলত না। কিন্তু মজার কথা হল, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে যে পুনর্বিবাহের নিয়ম ছিল–তার মধ্যে অন্তত একটি হল, স্ত্রী যদি কলহকারিণী হয়, তবে তাকে উপেক্ষা করে–আবার মোরে পাগল করে দিবে কে’–এই নিয়মে দ্বিতীয় বিবাহ করা চলত। কিন্তু এ তো গেল নিয়মের কথা। আমরা জানি, বউ ঝগড়া করুন আর নাই করুন, নতুন মুখের আবেশ পুরুষ মানুষের গা-সওয়া ছিল, কাজেই সংস্কৃত সাহিত্যে প্রচুর শ্লোক বাঁধা হয়েছে যার সারমর্ম হল–কলহকারিণী ধর্মপত্নী থেকে মুক্তি চাই–পরং প্রচণ্ড কটুবাক্যবাদিনী, বিবাদশীলা পরগেহগামিনী। মৌখর্য-যুক্তা চ পতীষ্টনাশিনী, ত্যজেত ভার‍্যা দশপুত্ৰপুত্রিণী।

স্ত্রীলোক সম্বন্ধে এই যে সাধারণীকরণ–এ নির্ঘাৎ পুরুষ মানুষের সৃষ্টি। একজন তো সুন্দর কায়দা করে স্ত্রীলোকের তুলনা করেছেন চুলকানির সঙ্গে। তিনি বলেছেন–প্রথমে সে সযত্নে ধরেছিল আমার হাত, তারপর আমার জঘন এবং কটিদেশে তার উপস্থিতি টের পেলাম, আমারও ভালো লেগেছিল, তাই আমিও ব্যবহার করেছি আমার নখাগ্রভাগ– আপনারা ভাবছেন বুঝি বা ব্যাকুলা রমণী হবে কোন; কিন্তু না, এটি আসলে চুলকানি রোগ। সংসারের চক্রে, ঘাত-প্রতিঘাতে স্ত্রীলোকের রণরঙ্গিনী মূর্তি আমাদের অচেনা নয়, কিন্তু সমস্ত দোষ মেয়েদের ঘাড়ে চাপিয়ে তাকে ঝগড়াটে অপবাদ দেওয়া, এটা আমাদের প্রাচীন এবং পুরুষালি ট্র্যাডিশন। মনু মহারাজের আপন স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা কেমন ছিল জানি না, বিশেষত ফ্রয়েড সাহেবকে দিয়ে তার যে-কোনও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করাব, সে উপায়ও নেই; কিন্তু এও সত্যি স্ত্রীলোকের ব্যাপারে মনু একেবারে একচোখো এবং একলষেড়ে। তার মতে মেয়েরা নাকি স্বভাবতই পুংশ্চলী’, মানে পুরুষ মানুষ দেখলেই নাকি তাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। এক অর্থে, মনুর ভাগ্য খুবই ভালো, কেননা আমাদের আমলে মেয়েদের স্বভাব একেবারে পালটে গেছে। বরঞ্চ পাড়া এবং রাস্তার মোড়ে, এমনকী ট্রামে বাসে পর্যন্ত, পুরুষদেরই এখন স্ত্রীচল’ অবস্থায় দেখা যায়। মনুর ধারণা–স্বামীর ব্যাপারেও মেয়েরা এতটুকু নরম নয়, বরঞ্চ নিঃস্নেহতার জন্য স্বামীর বিরুদ্ধ আচরণ করে। তাছাড়া মেয়েরা নাকি ভীষণ ঘুমোয়, কেবল বসে থাকে, ভীষণ সাজগোজ করে, অতিরিক্ত ক্রোধী এবং সুযোগ পেলেই বাবা-মা এবং স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে।

শুধু মনু নয়, প্রাচীনপন্থী শাস্ত্রকারদের এবং আধুনিকপন্থী ভুক্তভোগীদের অনেকেরই এমন ধারণা হতে পারে। এমনকী কারও ওপর রাগে, অবহেলায় কিংবা অনাদরে আজকের দিনে যেমন যন্ত্র’ শব্দটি ব্যবহার করি (একখানি যন্ত্রর বটে!) ঠিক তেমনি করেই বলেছেন কবি ভর্তৃহরি-স্ত্রী-যন্ত্ৰং কেন সৃষ্ট–স্ত্রীলোক নামক যন্ত্রটিকে যে কে তৈরি করেছে। তবে হ্যাঁ, ভর্তৃহরির আত্মজ্ঞান ছিল এবং ছিল জগৎ সম্বন্ধেও কিছু বোধ, যার জন্যে সত্য স্বীকার করে বলেছেন–যন্ত্র বটে, তবে সেটি বিষম্ অমৃতময়–অর্থাৎ বিষামৃতে একত্রে মিলন’। আমরা বলি, এ তো সংসারের চিত্রই, ভালোবাসার রূপও তো প্রায় ওইরকম, অন্তত মধ্যযুগীয় কবি প্রেম বর্ণনার ক্ষেত্রেই তো ওই পদটি ব্যবহার করেছেন–”বিষামৃতে একত্রে মিলন’। তবে বিষের ভাগটা শুধু মেয়েদের দান করে অমৃতের ভাগটুকু মুখে পুরে অমৃতনিষ্যন্দী ভাষায় পুরুষ মানুষ মেয়েদের কীই না বলেছে!

আমি মনুর কথা কিংবা ভর্তৃহরির কথা উল্লেখ করলাম এই জন্য যে, এঁরা কেউ কিন্তু অন্দরমহলে ঝগড়া করছেন না, অথচ অকপটে এবং বিনা দ্বিধায় সমস্ত জগৎবাসী স্ত্রীলোককে ধরে গালাগালি দিয়েছেন। এগুলোও কি ঝগড়া নয়? তাছাড়া আমি একটুও সায় দিতে পারি না মনুর কথায়, যে, মেয়েরাই শুধু ঝগড়াটে, পুরুষেরা নয়। পাঠক! দশরথের কথা স্মরণ করুন। তিনি নিজেই একসময় প্রেমে গলে গিয়ে বর দিতে চেয়েছিলেন কৈকেয়ীকে। তারপর যেই কৈকেয়ী বর চাইলেন অমনি যদি কৈকেয়ীর বংশ তুলে দশরথ বলেন–এমন কথা বলতে তোের দাঁত খসে খসে পড়ছে না–ন নাম তে কেন মুখাৎ পতন্ত্যধো, বিশীৰ্য্যমাণা দশনাঃ সহস্রধা–তাহলে কি বলব দশরথ ঝগড়াটে নন? তার ওপরে দেখুন, ভদ্দরলোকের’ ঘরে স্ত্রীলোককে গালাগালি দেওয়ার ভাষাও যে খুব পরিশীলিত ছিল তাও নয়। মাগী-মিনশে’র উতোর চাপান ছেড়েই দিলাম, পুরুষ মানুষ কিঞ্চিৎ কুপিত হলেই ‘দাসীত্র-পুত্তীত্র’ মানে দাসীপুত্রী কিংবা গর্ভদাসী–এ ছিল বাঁধা গৎ।

অনেকেই জানেন, কিংবা জানেন না যে, সেকালে স্ত্রী ঋতুমতী হলে, সেই তিন-চার দিনের জন্যও পুরুষ মানুষের একটি দাসীর প্রয়োজন হত এবং প্রয়োজন যখন হত তখন পুত্রও জন্মাত–স্বয়ং মহাত্মা বিদুরই এই জাতের ছেলে, ধৃতরাষ্ট্রেরও বৈশ্যা-রমণীর গর্ভে একটি পুত্র ছিল, যুযুৎসু। সে যাই হোক, দাসীদের দেখা হত প্রায় গণিকার প্রতিনিধি হিসেবে, কাজেই দাসীপুত্রী কিংবা গর্ভদাসী–ভদ্রলোকের গালাগালি নয়, তবু ভদ্রলোকেরাই এই শব্দগুলি ব্যবহার করতেন। কিংবা ধরুন, কোনও পুরুষ মানুষ যদি কোনও স্ত্রীলোককে বলেন ভ্রমরটেন্টে’ অথবা ‘টেন্টাকরালে’ তাহলে প্রথমত শব্দমাধুর্যেই সেই স্ত্রীলোকের পিত্তি চটে যাবে, তার পরে সে যদি বোঝে ভ্রমরটেন্টা’ মানে প্রায় গণিকা, আর ‘টেন্টাকরালে’ মানে জুয়োচোর, তাহলে কোন স্ত্রীলোক ঝগড়া না করে থাকবে? অথচ রাজশেখরের কর্পূরমঞ্জরীতে ঠিক এই ভাষায়ই রাজার পরিচারক বিদূষক গালাগালি করেছে রানির পরিচারিকা বিচক্ষণাকে। প্রত্যুত্তরে বিচক্ষণা কটু কথা ব্যবহার করেননি। যদি বলেন বিদূষক হাই সোসাইটির কোনও প্রতিনিধি নয় এবং তার কথাই অমনিধারা; তাহলে পৌরবকুলের শ্রেষ্ঠ পুরুষ দুষ্যন্তের ভাষণটি দিতে হয়।

মনে রাখবেন, ইনি কালিদাসের দুষ্যন্ত নন, ইনি মহাভারতকার ব্যাসের দুষ্যন্ত। এখানে দুর্বাসার শাপ-টাপের বালাই নেই। বরঞ্চ শকুন্তলা দুষ্যন্তের শ্রম লাঘব করে ছেলেকে বেশ খানিকটা বড়ো করে নিয়ে এসেছেন কমুনির আশ্রম থেকেই। দুষ্যন্ত দেখেই চিনতে পেরেছেন তার স্ত্রীকে, কিন্তু সভাসদ পরিজনবর্গের সামনে পূর্বকামুকতা প্রকাশের ভয়ে শকুন্তলাকে ভেঁটে বললেন–কে হে তুমি দুষ্টতাপসী? শকুন্তলা সরল মনে আত্ম-পরিচয় দিলেন।মা মেনকা, বাবা বিশ্বামিত্রের পরিচয়ও দিলেন। রাজা বললেন–দেখ, ওসব ছেলে-টেলের খবর আমি জানি না, মেয়েরা ভীষণ মিথ্যে কথা বলে–অসত্যবচনা নাৰ্য্যঃ। আর তোমার মার কথা কথা বোল না, সে তো একটা কুলটা-বেশ্যা-বন্ধকী জননী তব। তোমাকে পূজার নির্মাল্যের মতো ছুঁড়ে ফেলেছিল হিমালয়ের কোলে। বাপও তোমার কামলুব্ধ। পুংশ্চলীর মতো কথা বোল না, কোথা থেকে একটা শালস্তম্ভের মতো বিরাট ছেলে ধরে নিয়ে বলে কিনা, আমার ছেলে। সাধুবেশে আমাকে ভঁড়ানোর চেষ্টা কোর না, তুমি এখন এসো।

তাহলে পুরুষ মানুষও ঝগড়া করতে জানে। তবে এর উত্তরে শকুন্তলা যে ঝগড়া করেননি তা মোটেই নয়, সুমহিলাদের মত চোখের জল ফেলে ঝগড়া করার কায়দা তিনি রপ্ত করতে পারেননি। বিশেষত এই ব্যাপারে ঝগড়া করার সম্পূর্ণ অধিকার তার কাছে। তবে স্ত্রীলোকের কলহ-স্থানগুলি উল্লেখ করে আমি এই প্রবন্ধকে দাম্পত্য কলহের রূপ দিতে চাই না। বরঞ্চ পুরুষ মানুষের ঝগড়ার বিবরণ দিতে পারি শতখানেক, যদিও তাতে আমার উদ্দেশ্য সাধিত হবে না। তার চেয়ে গাথাসপ্তশতীর নিপুণ কবির সঙ্গে গলা মিলিয়ে আমরা সেই বিদগ্ধা মহিলার প্রতি সমব্যথী হই, যিনি বলেছিলেন–ঠাকুর তোমার পায়ে নমো নমঃ, আমার দয়িত স্বামীটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দাও অন্য কোনও মহিলার। কেননা যেসব পুরুষ মানুষ একজনেরই রস পায়, তারা কোনটা দোষ কোনটা গুণ, কোনটা মন্দ, কোনটা ভালো–সে বিচার জানে না।

.

০২.

এতক্ষণ যা বলেছি তাতে এ কথা পরিষ্কার বোঝা যাবে যে, আমি এখনও অন্দরমহলের চত্বর থেকে বেরিয়ে বৃহত্তর জগতে প্রবেশ করতে পারিনি। তবে অন্দরমহলের যে চিত্রটুকু আমি দিয়েছি, তাতে পাঠককুল অন্তত এটুকু বুঝেছেন যে, ভদ্রলোকেরাও যথেষ্ট সুন্দর ঝগড়া করতে পারে এবং অতিনিচু মানের গালাগালিও অপরকে দিতে পারে অবলীলাক্রমে। কথাটা যদি বেশ একটু মনোবিজ্ঞানীর কায়দায় বলতে পারতাম, তাহলে ভালো হত। কিন্তু আমার অনধিকার চর্চার সীমা অতদূর যায়নি। আমি বরঞ্চ সাধারণভাবে বলতে পারি–ঝগড়া কিংবা গালাগালির প্রক্রিয়া শুরু হয় এক ধরনের অহংবোধ থেকে কিংবা অভিমান থেকে। এই কারণে এক সুন্দরী আরেক সুন্দরীকে সহ্য করতে পারে না, এক নামী সার্থকনামা পুরুষ আরেক নামী পুরুষকে, এক ধনী অন্যতর ধনীকে সহ্য করতে পারে না। কবি, সাহিত্যিক এবং পণ্ডিত মানুষেরাও এর গণ্ডি থেকে বাইরে যেতে পারেননি। পাঠকের মনে পড়বে–অতিধীর রামচন্দ্র বিমাতা কৈকেয়ীর কাছে বনে যাবার প্রস্তাব শুনে সীতাদেবীকে সব জানিয়ে বলেছিলেন–আমাকে বনে যেতে হচ্ছে, কাজেই তোমাকে যদি ভরতের কাছে থাকতে হয়, তবে তার অনুকূল ব্যবহার করেই থাকতে হবে, কেননা তোমাকে ভরণপোষণ করা ভরতের অবশ্য-কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। বিশেষত তুমি যে ভরতের সামনে আমার গুণ গেয়ে গেয়ে বিলাপ করবে, তাতে কোনও সুবিধে হবে না, কেননা সমৃদ্ধ পুরুষেরা অপর গুণীজনের প্রশংসা সহ্য করতে পারেন না–ঋদ্ধিযুক্তা হি পুরুষা না সহন্তে পরস্তবম্।

অতএব পাঠক! ঝগড়া এবং গালাগালি–পণ্ডিত, মনীষী, সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল এবং তার নমুনা শুনবেন। অমন যে শঙ্করাচার্য যিনি সারা বেদান্তভাষ্য আর উপনিষদ্ ভাষ্য জুড়ে ‘অহং-মম’ ত্যাগ করার উপদেশ দিয়েছেন, তিনি নৈয়ায়িকদের গালাগালি দিয়ে বলেছেন–নৈয়ায়িকরা হল ‘শিং আর ল্যাজ ছাড়া বলদ। রামানুজই বা কম কিসে, তিনি একই কথা ফিরিয়ে দিয়েছেন অদ্বৈতবাদী শঙ্করকে, বলেছেন–অলাঙ্গুলশৃঙ্গা বলীবদাঃ। দার্শনিক দৃষ্টিতে রামানুজ, মধ্বাচার্য–এঁরা হলেন দ্বৈতবাদী, আর শঙ্কর হলেন অদ্বৈতবাদী। বহুকাল পরে, বহু যুগ টপকে নিজের মনের মতো আপনজন একটিই পেতে পারতেন শঙ্কর, তিনি হলেন মধুসূদন সরস্বতী। মধ্বাচার্যকে তিনি বলেছেন–বোকা, ছেলেমানুষ এবং নীতিভ্রষ্ট। আরও বলেছেন তত্ত্ববাদী মাধ্বপন্থীরা যদি প্রলাপ বকে, তার উত্তর কি বিদ্বান মানুষ দেবে? গাঁয়ের কুকুর যদি ঘেউ ঘেউ করে চেঁচায়, তার উত্তরে কি আমাদের মতো অদ্বৈতবাদী সিংহেরা প্রতিবচন দিয়ে ডাক ছাড়বেন হি রুতমনুরৌতি গ্রামসিংহস্য সিংহঃ।

মধ্বাচার্যের মতো দার্শনিক মধুসূদনের হাতে পড়ে ‘গ্রাম সিংহ’ মানে কুকুর হয়ে গেছেন। নৈয়ায়িকেরা মধুসূদনের হাত থেকে রক্ষা পাননি। এক নৈয়ায়িক, তার নামও শঙ্কর–তিনি কাজের মধ্যে ভেদরত্ন বলে একখানা বই লিখেছিলেন। ব্যস, আর যায় কোথা, মধুসূদন তাকে ভেঙিয়ে ভেঙিয়ে শোলোক লিখেছেন এবং সে ভেঙানো এমনই যে, শঙ্করের শব্দগুলিই এদিক-ওদিক করে বসানো, যদিও তার মানেটা মধুসূদনের পক্ষে যাবে। গ্রন্থশেষে নৈয়ায়িক শঙ্করকে একেবারে কাঠগড়ায় তুলেছেন মধুসূদন। প্রায় নাটক করে শঙ্করকে আসামীর ভূমিকায় দাঁড় করিয়েছেন, এবং তাকে দিয়েই বলিয়েছেন–”যদিও আপনারা দয়া করে অদ্বৈতবাদ নিরূপণ করেছেন অতি সুষ্ঠুভাবে, তবুও আমার হৃদয় যেন মানছে না, কি করি?” মধুসূদন নাটকেই উত্তর দিয়েছেন–তুমি হলে বুড়ো ষাঁড়, আর তোমার হৃদয়টা হয়ে গেছে পাথর। কাজেই শৈলসার হৃদয়ে কিছুই ঢুকবে না। শঙ্কর বললেন–আমাকে বুড়ো ষাঁড় বলছেন কেন? মধুসূদন তার কারণ দেখিয়ে বলেছেন তুমি নিতান্ত মূর্খ, তাই বুড়ো ষাঁড় বলেছি। আমরা তো আর তোমার মতো নয়, বৎস। শঙ্কর আবার বলেছেন–আমাকে বস’ বলে সম্বোধন করছেন কেন, আমি বুড়ো মানুষ। মধুসূদন মেজাজ দেখিয়ে বলেছেন–চুল পাকলেই কি বুড়ো হয়, পড়াশুনো করে যাঁরা কৃতবিদ্য হয়েছেন, তাঁরাই আসলে বুড়ো, তোমার তো সে সবের বালাই নেই কাজেই…ভাবখানা এই যে, বৎস’ বলে সম্বোধন করেছি, বেশ করেছি।

নিজের কল্পিত নাটকের শেষে, মধুসূদনের থেকে বহু অংশে প্রাচীন এই নৈয়ায়িককে শেষ পর্যন্ত করজোড়ে মধুসূদনের উপদেশ মেনে নিতে হয়েছে, কেননা ধরাধাম ত্যাগ করে বহু আগেই তিনি ন্যায়শাস্ত্রের মায়া কাটিয়েছেন। মহা-মহা-পণ্ডিতদের মধ্যে অপরকে লক্ষ্য করে কুকুর, ষাঁড়, বলদ’ ইত্যাদি গালাগালি দেবার প্রবৃত্তি যত হীনই হোক, তবু দেওয়া হয়েছে। পণ্ডিত, সমালোচকদের মধ্যে আরেক ধরনের ঝগড়া সাধারণ্যে প্রকাশ করা আমার পক্ষে কষ্টকর তবু একটু নমুনা দিই। যেমন ধরুন–নৈয়ায়িকেরা পাঁচটি বহিরিন্দ্রিয় মানেন–চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা এবং ত্বক। সাংখ্য দর্শনের পণ্ডিতেরা আবার অতিরিক্ত আরও পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয় মানেন–বাক্, পানি, পাদ, পায়ু, উপস্থ। অর্থাৎ সাংখ্যদের ধারণা জগতে যত বস্তু আছে তার সবগুলিই শুধুমাত্র চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা এবং ত্বক–এই পাঁচটির দ্বারা গ্রহণ কিংবা অনুভব করা সম্ভব নয়। অতএব আরও পাঁচটি ইন্দ্রিয় স্বীকার করলেই আর কোনও ঝামেলা থাকে না।

এইবার নৈয়ায়িক জয়ন্তভট্টের পালা। মোটামুটি দশম শতাব্দীর পূর্বের এই নৈয়ায়িক বিষয় ধরে গালাগালি দেওয়ার ব্যাপারে একেবারে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। সাংখ্য-দার্শনিকের গুষ্ঠির তুষ্টি করে তিনি এক জায়গায় বললেন–হ্যায়, পৃথিবীর যত মূর্খতা–তা সবই সাংখ্যদের হৃদয়ে এসে বাসা বেঁধেছে। আবার অন্য জায়গায় সাংখ্যদের এই অতিরিক্ত ইন্দ্রিয়বাদ সহ্য করতে না পেরে জয়ন্ত বললেন–এতই যখন বলছ, তা অতিরিক্ত শুধু ওই পাঁচটা কেন, কর্মেন্দ্রিয় তো আরও আছে। এই ধরো কণ্ঠনালী, সেও তো অন্ন গ্রহণের কাজ করে, অতএব এটি একটি কর্মেন্দ্রিয়। আবার ধরো বক্ষ–সেও স্তন কলশাদির আলিঙ্গন-সুখ অনুভব করে, অতএব বক্ষও একটি কর্মেন্দ্রিয়। কাঁধ-দুটি ভার বহন করে, ও দুটিও কর্মেন্দ্রিয়। ওহে সাংখ্য-পণ্ডিত, যদি বলো এই কাজগুলি তোমাদের বলা ওই অতিরিক্ত পাঁচটি ইন্দ্রিয় অর্থাৎ বাক, পানি, পাদ–ইত্যাদির দ্বারাই সম্ভব, তাহলে জিজ্ঞাসা করি–তোমাদের ভাত-খাওয়া, জলপান–এসব কর্ম কি হাত দিয়ে চলে না পা দিয়ে; না কি মলদ্বার দিয়ে চলে–কিংনু ভবান্ অন্ন-পানং পানিপাদেন নিগিরতি, পায়ুনা বা। অতএব দেখা যাচ্ছে কণ্ঠনালী, বক্ষ কি কাধ–এগুলোর যথেষ্ট কাজ থাকা সত্ত্বেও, যদি এগুলোকে ইন্দ্রিয় বলে স্বীকার না করো, তাহলে ওই বাক, পানি, পাদ–এই অতিরিক্ত পাঁচটাও স্বীকার করার প্রয়োজন নেই। চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা–এইগুলিই যথেষ্ট, নইলে, যা বলেছি–অগুনতি ইন্দ্রিয় স্বীকার করতে হবে।

দার্শনিকদের বুদ্ধি ছিল ক্ষুরধার। কাজেই বিষয় ধরে প্রতিপক্ষের পক্ষশাতন করা এবং সেই সূত্রে কিঞ্চিৎ কটু রসোদার করা–এ তাদের বিলক্ষণ অভ্যাস ছিল। এই কটুত্বের তীব্রতা কখনও ব্যক্তিবিশেষকে রসাতলে পাঠিয়ে দিত, কখনও বা সম্পূর্ণ সম্প্রদায় অন্যপক্ষের দূষণ-চিহ্নে কলঙ্কিত হতেন। সম্প্রদায় হিসেবে বৌদ্ধরাই বোধহয় সবচেয়ে গালাগালি খেয়েছেন অন্য পক্ষের দার্শনিকদের কাছে। অবশ্য বৌদ্ধরাও ছাড়েননি। কিন্তু পারস্পরিকভাবে এই প্রচণ্ড বাদানুবাদ এবং প্রখর গালাগালির মধ্যেও দার্শনিকদের মধ্যে এমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল, যাতে দু’পক্ষই লাভবান হয়েছেন। অবশ্য আপাতত আমি যেহেতু মাছির মতো দূষণ-ক্ষতের চিহ্ন খুঁজে বেড়াচ্ছি, তাই গালাগালির কথাতেই আসি।

এসব দশম শতাব্দীর পূর্বের কথা। নৈয়ায়িক শঙ্কর মিশ্রকে বৌদ্ধাচার্য জ্ঞানশ্রীমিশ্র কোনও এক সময় বলেছিলেন ‘বাঁচাল’–শঙ্করোহপি বাঁচাটতয়া কিমপি নাটয়তি। অবশ্য নৈয়ায়িক শঙ্কর বোয়াতুলসী পাতা নন, তিনিও পূর্বতন বৌদ্ধাচার্য ধর্মকীৰ্ত্তিকে ধূলিসাৎ করেছিলেন। কিন্তু সেই অপরাধের ফলে স্বয়ং জ্ঞানশ্রীমিশ্র শঙ্করকে যে শাস্তি দিয়েছেন, তার থেকে অনেক বেশি কড়া কথা শুনতে হয়েছে জ্ঞানশ্রী-শিষ্য রত্নকীৰ্ত্তির কাছে। তিনি বলেছেন–আমাদের গুরুকে অপমান করা। বেটা পশুর পশু, ঠকবাজ, তুমি আমাদের কৃপার পাত্র–অতএবাত্র প্রস্তাবে ভগবতঃ কীৰ্ত্তিপাদান (ধর্মকীৰ্ত্তি) অবমন্যমানঃ শঙ্করঃ পশশারপি পশুরিতি কৃপাপাত্রম্ এবৈষ জাল্মঃ।(রত্নকীৰ্ত্তি, স্থিরসিদ্ধিদূষণ)। নৈয়ায়িকেরাও ছাড়েননি। তারা একেবারে সম্পূর্ণ বৌদ্ধ-সম্প্রদায়ের গায়ে কাদা ছিটিয়ে দিয়ে বলেছেন-বেটারা এদিকে বলে সব শূন্য আর ওদিকে শিষ্যদের বোঝাচ্ছে–বুদ্ধায় দেয়ং, ধর্মায় দেয়ং, সংঘায় দেয়ং–বুদ্ধকে দাও, ধর্মকে দাও, সংঘকে দাও এইভাবে লোকের সঙ্গে প্রতারণা করে নিজেরা শিষ্য এবং অনুগামীদের দেওয়া অন্নপানে পেট-মোটা করছে–যতসব ধূর্ত এসে জুটেছে। (ভাসর্বজ্ঞ, ন্যায়ভূষণ)।

এ তো গেল সমস্ত সম্প্রদায়ের নামে কলঙ্ক-রোপণ। কিন্তু জ্ঞানশ্রী এবং রত্নকীৰ্ত্তি, গুরু-শিষ্য মিলে যে ব্যক্তিগত আক্রমণ হেনেছিলেন নৈয়ায়িক শঙ্করের বিরুদ্ধে, তার বদলা নিলেন উদয়নাচার্য, যিনি একাদশ শতাব্দীতে প্রাচীন এবং নব্যন্যায়ের সন্ধিযুগে বৌদ্ধদের জর্জরিত করেছিলেন। একে তো মাঝে মাঝেই বৌদ্ধদের তর্ক ধূলিসাৎকরে উদয়ন বলেছেন–এই আমি এবার বৌদ্ধদের মাথায় ডাঙস্ মারলাম–বৌদ্ধস্য শিরশি এষ প্রহারঃ, এরপর উদয়ন একজায়গায় জ্ঞানশ্রী আর রত্নকীর্তিকে একেবারে ধরাশায়ী করে দিয়েছেন। অবশ্য শিষ্য রত্নকীৰ্ত্তির থেকে গুরু জ্ঞানশ্রীর ওপরেই তার রাগটা বেশি এবং উদয়নের ধারণা, জ্ঞানশ্রীর জন্যই রত্নকীৰ্ত্তির এত বাড় বেড়েছে। উদয়ন যুক্তিতর্ক দিয়ে গুরুর উদ্দেশ্যে বললেন–তোমাদের এক কথার সঙ্গে আরেক কথা মেলে না, উদ্ভট তোমাদের কথাবার্তা। আর শিষ্যও করেছ যেমন, একেবারে জড়বুদ্ধি। কোনও চেতন মানুষকে তোমাদের যুক্তিতর্ক বোঝানো যাবে না, যেমনটি তুমি তোমার শিষ্য রত্নকীৰ্ত্তিকে বুঝিয়েছ, এখন আমার ঠেলা সামলাও–ত্বয়ৈব গ্রাহিতঃ শিষ্যঃ। ন চৈবং চেতনঃ গ্রাহয়িতুং শক্যতে, স্ববাগবিরোধস্য উদ্ভটত্বাৎ।

জ্ঞানশ্রী রত্নকীৰ্ত্তির তুলনায় এ গালাগাল অতি ভদ্র। বিশেষত তখনকার দিনে শিষ্যের যুক্তি যদি শিথিল হত তাহলেই তার গুরুকে কিঞ্চিৎ গালাগাল দেবার রেওয়াজ ছিল। যেমন ধরুন চৈতন্য মহাপ্রভুর আগের যুগে পুণ্ডরীকাক্ষ বিদ্যাসাগরের কথা। কলাপ ব্যাকরণের টীকা লিখতে বসে তিনি কেবলই তার পূর্বতন শ্রীপত্তিদত্তকে নিন্দা করেছেন এবং কোনও এক সময় শ্রীপতির ওপর এতই চটে গেছেন যে পুণ্ডরীকাক্ষ বলেই ফেললেন–বাজে গুরুর কাছে শিক্ষে নিলেই মাথার মধ্যে এইরকম দুর্বুদ্ধির সম্পদ গজায়–ত অসত্ উপাধ্যান-সেবা-বিম্ভিত-দুর্বুদ্ধি-বৈভবাদেব।

দার্শনিক যুক্তিতর্ক প্রচার করতে গিয়ে মতের অমিল ঘটলে প্রতিপক্ষীর সঙ্গে তার গুরুকেও এক হাত নেওয়া–এ অতি ভদ্র ব্যবহার। আমার দৃঢ় বিশ্বাস কোনও যুক্তিবাদী দার্শনিক যদি শিথিল যুক্তি নিয়ে পূর্বোক্ত জয়ন্ত ভট্টের যুক্তিজালে আবদ্ধ হন তবে তাকে কোনও না কোনও সময় এমন কথা শুনতে হবে, যা আমাদেরও শুনতে লাগবে চমৎকার। যেমন ধরুন মীমাংসাশাস্ত্রের অদ্বিতীয় পণ্ডিত কুমারিল ভট্ট বললেন–জগতে সাদা রঙ একটাই; পাঁচটি সাদা ফুল থাকলে, পাঁচটি সাদা রঙ স্বীকার করা যায় না। কিন্তু নৈয়ায়িকের চুলচেরা বিচারে পাঁচটি সাদা ফুলে পাঁচরকমের সাদা রঙ আছে; সাদা রঙগুলি সদৃশ হতে পারে কিন্তু ভিন্ন বটে। অতএব নৈয়ায়িক জয়ন্ত, কুমারিল ভট্টের উদ্দেশে চরম রসিকতা করে বললেন–অহো রসমারূঢ়ো ভট্টঃ- ভট্ট মশাইয়ের ভারি রস হয়েছে–এবার বলো, জগতে কর্মও একটা, বুধও একটি, গুণও একটিই আছে এবং তা হল সাদা। এসব কথা কীরকম জান? “স্ত্রী-গৃহে কামুকোক্তয়ঃ”-প্রেমিকার ঘরে বসে কামুক লোকেরা যেমন হালকা চালে হাজারো ভাব-ভালোবাসার কথা বলে, সেইরকম লঘু আলাপনের রস চেগিয়ে উঠেছে ভট্ট কুমারিলের।(জয়ন্তভট্ট, ন্যায়মঞ্জরী)

এইরকম করে প্রতিপক্ষকে জব্দ করার চাতুর্য সবার হয় না। জয়ন্ত ভট্ট যখন মেজাজে থাকেন তখন রসিকতার সঙ্গে ঝাঁঝ মেশে। কিন্তু তার মেজাজ ভালো না থাকলে রসিকতা যায় হারিয়ে, পরপক্ষের জন্য টিকে থাকে শুধু ঝাঁঝটুকুই। যখন প্রভাকর মিশ্রের অনুগামী মীমাংসক পণ্ডিতদের কিছুতেই নিজের যুক্তিতর্কগুলি বোঝাতে পারছেন না, তখন জয়ন্তের বিরক্তি চরমে ওঠে, ধিক্কার দিয়ে বলে ওঠেন–আঃ কুণ্ডশেখর-কুণ্ড মানে হাঁড়ি, ঘট অর্থাৎ মাথাটা তোমার একেবারে নিরেট হাঁড়ির মতো, ঘটে কিছুই নেই, এতবার করে বলছি তাও মাথায় ঢুকছে না–আঃ কুণ্ডশেখর! কথম্ অসকৃ অভিহিতমপি ন বুধ্যসে।”

আমি জানি, পণ্ডিত এবং মনীষীদের এই প্রবন্ধের মধ্যে টেনে এনে আমি ঘোর অন্যায় করেছি। একে তাদের যুক্তি-বুদ্ধি মানুষকে বোঝানো দুষ্কর, তার ওপরে এ হল আরেক প্রান্ত, যা আমাদের পূর্বকথিত অন্দরমহল থেকে অনেক দূরে। সভ্যতার দুই বিরুদ্ধে কোটির এক কোটিতে যদি সাধারণ মানুষ থাকেন তবে অন্য কোটিতে আছেন পণ্ডিতেরা; অথচ সময়মতো এঁদের ভাষার কি মিল! অন্তত আর একটি উদাহরণ না দিলে আমি পাঠকের কাছে ঋণী থাকব, তাই বলেই ফেলি। ইনি পণ্ডিতরাজ জগন্নাথ। মূলত ইনি প্রবন্ধকার, আলংকারিক, তবে কবিও বটে। অল্প-বয়সেই পণ্ডিত হয়ে যাওয়ায় জগন্নাথের কাঁচা বয়েসটি কেটেছে সম্রাট শাজাহানের সভাপতি হিসেবে–দিল্লীবল্লভপাণিপল্লবতলে নীতং নবীনং বয়ঃ। জগন্নাথের ধারণা ছিল–নিম্নমানের কবিরা বড়ো কবির কবিতা থেকে পদ চুরি করেন, ভাব চুরি করেন এবং একটু এদিক-ওদিক করে কবিতা বানিয়ে ফেলেন। তাই জগন্নাথ নিজে যে কবিতা রচনা করতেন, তা একেবারে নতুন, অন্য কবিদের থেকে বিলক্ষণ। কবিদের চুরির ব্যাপারটা তার মনের মধ্যে গেঁথে যাওয়ায়, তিনি লিখলেন–”যতসব দুশ্চরিত্র, বেজম্মা–অন্যেরা চুরি করবে ভয়েই আমি আমার একান্ত আপন পদ্যরত্নগুলি একটি পেটিকায় ভরে রেখেছি–দুবৃর্তা জারজন্মানো হরিষ্যস্তীতি শঙ্কয়া। মদীয় পদ্মরত্নানাং মঞ্জুষৈবা কৃতা ময়া।” জগন্নাথের কীর্তি আছে অনেক। তার কাছে সোজাসুজি অপরাধ না করলেও কোনও পণ্ডিত যদি এমন কথা বলেন, যা তার রুচিমতো নয়, তাহলেই পণ্ডিতরাজ জগন্নাথের হাতে তাকে মার খেতে হবে। ঠিক এইরকমই ঘটেছিল যখন মহা বৈয়াকরণ ভট্টোজি দীক্ষিত ‘প্রৌঢ়মনোরমা’ বলে একখানি গ্রন্থ লিখেছিলেন। জগন্নাথ আর কিছু করেননি, কটুক্তি নয়, গালাগালি নয়, শুধু নিজে আরেকখানা বই লিখে ফেললেন এবং তার নাম দিলেন ‘মনোরমা-কুচ-মর্দিনী।

মহাপণ্ডিতের কলম থেকে যে কুকথাগুলি বেরোল তার কারণ আছে। পণ্ডিতে-পণ্ডিতে বিবাদ হওয়ারও নীতিগত, আদর্শগত এবং সম্প্রদায়গত কারণ থাকে। কিন্তু গালাগালি দেওয়ার ব্যাপারে ঘরে এবং বাইরে সর্বত্রই এক ধরনের সঙ্গতি আছে। আমার ধারণা–সভ্যতা, ভব্যতা এইসব গালভরা শব্দের সঙ্গে এই গালাগালির কোনও সম্বন্ধই নেই; দরকার হলে, সময় বুঝে মানুষ দেখে এইসব আপনার তাগিদে স্বতঃই উৎসারিত হয়। কখনও বা এই উৎসারণ এতই সহজ যে, গালাগালি দেওয়ার কারণও ভালো করে থাকে না, তবু চলে লঘু পাপে গুরু দণ্ড। এই জিনিসের সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ জাত তুলে, কিংবা দেশ তুলে গালাগালি। আপাতত সমাজবিজ্ঞানীরা এইসব গালাগালি নিয়ে দেশ এবং কাল সম্বন্ধে নানা তথ্য বার করার চেষ্টা করছেন। আমার বুদ্ধি কম, আমি শুধু এইটুকু বলি, দুনিয়ায় এমন জাত নেই, যে অন্যের কাছে গালাগালি খায়নি। সে শুধু বামুন-কায়স্থ নয়, গুরু থেকে আরম্ভ করে স্যাকরা তাদের আপন কর্মদোষে অন্যের মুখঝামটা খেয়েছেন। আজকের যুগে বাংলা প্রবাদমালার কল্যাণে, বাংলা ভাষায় এসব গালাগালি অনেক জানি তবে এর শুরু যে কবে থেকে, সেই কথাটাই জানতে চাই।

আজকের দিন থেকে পূর্বতন দিনে সভ্যতার বোধ উন্নততর ছিল কিনা জানি না, তবে এখন কেউ বরিশালের লোককে তার দেশ নিয়ে কড়া কথা বললে, কিংবা অশান্তিপুরের মানুষকে শান্তিপুরের ভদ্রতার কথা জানালে মনে দুঃখ দেওয়া ছাড়া অন্য কোনও অন্যায় হয় না; কিন্তু তখনকার দিনে কড়া শাস্তি হত। মুশকিল হয়েছে, এখনকার বুদ্ধিজীবী থেকে কমিউনিস্ট সবাই মনু মহারাজের ওপর বড়ো খাপ্পা, কিন্তু মনু-যাজ্ঞবল্ক্য না হলে তখনকার সমাজ জানব কি করে? মনু যদিও বড়ো বেশি ব্রাহ্মণ ভক্ত, তবুও তিনি সকলের জন্য আইন জারি করে বলেছেন–কেউ যদি কারও দেশ, জাতি কিংবা কর্ম নিয়ে নিন্দা করে, তার দুশো পণ দণ্ড হবে। আইন যে কিছু ছিল, তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ অভিজ্ঞানশকুন্তলের ষষ্ঠ অঙ্কে। মৎস্যজীবী ধীবর যখন মাছের পেট থেকে রাজার নাম লেখা আংটি বার করেছে তখন রাজার শালা দুটি পুলিশ নিয়ে সেই ঘটনা পরখ করতে এসেছেন। শালা বলছেন–তুই করিস কি? মানুষটি বলল–আমি শক্রাবতারে থাকি, আমি জেলে, মাছ মেরে কুটুম্বভরণ করি। রাজার শালা টিপ্পনী কেটে বলল–দারুণ শুদ্ধ তোর জীবিকা। জেলে হলে কী হবে, অতি শক্তিমান রাজকর্মচারীর সামনে একটুও লজ্জা না পেয়ে এই এই ব্যঙ্গোক্তির প্রতিবাদ করে জেলে বলল-ওরকম কথা বলবেন না মশায়। যা আমার জাত ব্যবসা, তাই করি। রাজার শালা, প্রচণ্ড রাজপুরুষও এতে লজ্জা পেলেন।

তাই বলি, মনুর আইন একেবারে মিথ্যে নয়। তবে মনুর অর্থদণ্ডের পরিমাণ থেকে অনুমান করতে পারি যে, এই ধরনের গালাগালি বেশ চালু ছিল, যদিও ইন প্রিসিল্প সবাই জানত, যেমন এখনও সবাই জানে, যে এই ধরনের গালাগালি দেওয়া বড়োই গর্হিত। মনুর ভাষ্যকার মেধাতিথি মনুর আইনটিকে একটু ক্ল্যারিফাই করার চেষ্টা করেছেন। যেমন ধরুন, কেউ হয়তো ব্রহ্মাবর্তের বামুন, তাকে বলা হল–বেটা একেবারে বাহ্যক অর্থাৎ বাহীক-জাঠ। এরকম যদি কেউ আবার ক্ষত্রিয়কে বামুন বলে গালাগালি দেয়, তাহলে সেটাও কিন্তু গালাগালি এবং সেটা জাত তুলে। কেউ বলতে পারেন, বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণের নামে ক্ষত্রিয়কে সম্বোধন করলে ক্ষতি কি? আমরা বলব, সমস্ত জাতের লোকেরই জাতিগত কিছু দোষ থাকে এবং জাত তুলে গালাগালি দেবার সময় মানুষ এই দোষগুলিকেই উদ্দেশ্য করে। স্বয়ং ধর্মপ্রাণ যুধিষ্ঠিরকে আপন স্ত্রীর কাছে শুনতে হয়েছিল–অত শান্তি শান্তি কোর না, শান্তবৃত্তি বামুনকেই মানায়, রাজাদের নয়–শমেন সিদ্ধিং মুনয়ো, ন ভুভৃতঃ। তোমার যদি অত ইচ্ছে থাকে, তাহলে বনে চলে যাও, আর মাথায় জটা রেখে মুনিদের মতো আগুনে আহুতি দাওগে যাও–জটাধরঃ সন্ জুহুধীহ পাবক। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, কোনো বীর্যসম্পন্ন ক্ষত্রিয়কে বামুন বললে, সে ভাবে–হয়তো কেউ ব্রাহ্মণের মতো চাল-কলা-ছাঁদা-বাঁধা, অতি ব্ৰত-পার্বণশীল নির্বীর্য মানুষটিকে উদ্দেশ করছে। অতএব এটি গালাগালি।

মনু-যাজ্ঞবল্ক্য খেয়াল করেননি, বামুনকে ক্ষত্রিয় কিংবা ক্ষত্রিয়কে বামুন–এরকম একের বৃত্তি অন্যতরের ঘাড়ে চাপিয়ে গালাগালি দেওয়ার প্রয়োজন নেই; কোনও মানুষকে তার আপন জাতি, আপন দেশ আপন কর্ম ধরেই গালাগালি দেওয়া যায়। কেননা জাতি-দোষ, দেশদোষ কিংবা বৃত্তিদোষই এক্ষেত্রে গালাগালির জন্য যথেষ্ট এবং সভ্য মানুষেরা সেইগুলিকেই উদ্দেশ্য করেন। অনেকেই মনে করেন, ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্যান্য জাতের সম্বন্ধে যে অপভাষাগুলি ব্যবহার করা হয়েছে, তা বামুনদেরই তৈরি। আমি এ কথা মানি না, কেননা, জাতি বিষয়ক অপভাষাগুলি একেবারে লোকস্তরে নেমে এসেছে এবং বামুনদের নিয়েও ছড়ার কমতি নেই–তবু সে কথা পরে।

প্রাচীন সাহিত্যে জাতি বিষয়ক যত গালাগালি আছে, তাতে কায়স্থেরা বোধহয় সবার প্রথমে যাবে। কায়স্থের বুদ্ধিমত্তা অন্য মানুষের চোখে ধূর্ততা এবং কুচুটেমি ছাড়া কিছু নয়। একটি প্রাচীন শ্লোকে বলা হয়েছে–কায়স্থেরা মায়ের পেটে থাকা সত্ত্বেও যে মায়ের মাংস খেয়ে ফেলে না, তার কারণ এই নয় যে, কায়স্থেরা বড়ো করুণ-হৃদয়। আসলে গর্ভস্থ অবস্থায় তাদের দাঁত থাকে না বলেই মায়েরা বেঁচে যায়–

কায়স্থোপি কায়স্থো মাতুর্মাংসং ন খাদতি।
ন তত্র করুণাহেতুস্তত্র হেতুরদস্ততা৷৷

এই ধরনের প্রবাদ বাংলাতেও আছে, তবে হলফ করে বলতে পারি, সেটি এই প্রাচীন শ্লোকের অনুবাদমাত্র, লোকস্তরে সহজ পরম্পরায় আসা কোনো প্রবাদ নয়। ছড়াটি হল–”দাঁত থাকে না বলে কায়েত মায়ের পেটের মাংস খায় না।” সহজে আসা ছড়া যদি এমন হয় যে কাক ধূৰ্ত্ত আর কায়েত ধূর্ত তাহলে বলব কাকের সঙ্গে যুক্ত করে এক কবি কায়স্থদের প্রশংসা করছেন, আরেকজন করেছেন নিন্দা। মহাসুভাষিত সংগ্রহে একটি শ্লোকে বলা হয়েছে–কাক–কুকুট-কায় স্থাঃ সজাতি-পরিপোষকাঃ। মানে, কাক, মুরগি এবং কায়স্থ–এরা আপন জাতের লোককে পোষণ করে। অন্যদিকে, সজাতি-পরিহন্তারঃ সিংহাঃ শানো দ্বিজা গজাঃ। এক সাম্রাজ্যে দুই সিংহ থাকে না, এক পাড়ার কুকুর সহ্য করে না অন্য পাড়াতুতো কুকুরকে, এক পুরোহিত পছন্দ করেন না। তাঁর যজমানের বাড়িতে অন্য পুরোহিত প্রবেশ করুক, এক দলের হাতির সঙ্গে বনিবনা হয় না অন্য কোনও হস্তি-যুথপের।

কায়স্থের সঙ্গে কাকের তুলনায় অন্যজন কিন্তু বড়োই রূঢ়। তার মতে কাকের কাছ থেকে লোভ-কাকাল্লোল্যং, যমের কাছ থেকে ক্রুরতা আর স্থপতির কাছ থেকে স্থির পদার্থের ওপর আঘাত হানার শক্তি নিয়েই কায়স্থের জন্ম হয়েছে। সমাজ বিজ্ঞানীরা এসব শ্লোকের ওপর নজর দিয়েছেন কিনা জানি না, তবে এটা মনে রাখা দরকার, কায়স্থেরা ছিলেন লিপি-বিশারদ এবং হিসেব লিখিয়ে। সেই কারণে রাজা-জমিদারের মন ভোলানোর জন্য অপকর্মও কিছু করতে হত। সপ্তম শতাব্দীর নাটক মুদ্রারাক্ষসে চাণক্যের প্রতিদ্বন্দ্বী মহামন্ত্রী রাক্ষসের বন্ধু ছিলেন শকট দাস। প্রতিপক্ষের অনেকের মধ্যে তার নাম যখন চাণক্যের কানে উঠল, তখন তাকে উল্লেখ করা হয়েছিল কায়স্থ শকট দাস’ বলে। অনেক কায়স্থের থেকেও কুটিলমতি কৌটিল্য অবশ্য উড়িয়ে দিয়েছিলেন শকট দাসের জাতি-মাহাত্ম, বললেন–কায়স্থ ইতি লদ্বী মাত্রা–অর্থাৎ কায়স্থ! এ তো নগণ্য ব্যাপার, ও তাহলে বুদ্ধিতে আমার থেকে অনেক লঘু।

কিন্তু লঘু হোক আর গুরু হোক, রাজকর্মের সুবাদে, বিশেষত সে কর্ম যদি হিসাব লেখার মতো গুরুতর ব্যাপার হয়, তাহলে সাধারণের কোপ গিয়ে পড়ে তার ওপরেই। তাছাড়া মুষ্টিমেয়ের দোষও কখনও সমগ্র জাতির কলঙ্ক তৈরি করে। কাশ্মীরের কবি (১১শ শতাব্দী) ক্ষেমেন্দ্রের চোখে কায়স্থদের রূপ হল সেক্রেটারি’ বা ‘চিক্ ক্লার্কের’ মতো,যাকে তিনি বলেছেন ‘দিবির। ক্ষেমেন্দ্র কায়স্থদের দু’চোখে দেখতে পারেননি এবং তার ধারণা-মোহ’ নামে যে জিনিসটা মানুষের বুদ্ধি হরণ করে, তা আরও গুঢ় আকারে বাস করে কায়স্থদের মুখে এবং লেখায়। চন্দ্রকলার মতো ক্রম-বিবর্তিত যে শস্য-সম্পদ–সেও যদি কায়স্থের চোখে পড়ে, তবে তা একমুহূর্তে উবে যাবে। এরা যেন কালপুরুষ, সমস্ত লোকের উপর চাপিয়ে দিয়েছে অর্থদণ্ড। যে জিনিসের হিসেব করা উচিত নয়, সেটির হিসেব করে এবং যেটির করা উচিত, সেটির হিসেব না করে এই পিশাচেরা কাগজ উঁচিয়ে বেড়ায় এবং সমাজকে যেন দেখায়–সব লেখা আছে–গণনাগণন-পিশাচাশ্চরন্তি ভুর্জধ্বজা লোকে। নেহাৎ যমের পাশ গলায় বাঁধা না থাকলে, কেউ কি এই যম-মহিষের বাঁকানো শিঙের মতো কুটিল কায়স্থকে বিশ্বাস করবে? ক্ষেমেন্দ্রের মতে–কায়স্থদের কলমের মুখ দিয়ে নির্গত হয় যে মসীবিন্দু, সে যেন রাজলক্ষ্মীর কাজলকালো চোখের জল। কায়স্থ-লুণ্ঠিতা রাজলক্ষ্মী এইভাবেই কাঁদেন।

পরিষ্কার বোঝা যায়, মুষ্টিমেয় রাজকর্মচারীর স্বভাবদোষ সরলমতি মানুষের মনে ক্ষোভ জাগাত এবং তা সম্পূর্ণ জাতির গায়ে মাখিয়ে দিত নিন্দাপঙ্ক। তাদের গুণও হয়ে যেত দোষ। তাদের বিচিত্র, বঙ্কিম, অপূর্ব অক্ষর-চিত্রগুলিও তাই তুলিত হয়েছে কালসর্পের সর্পিল ভঙ্গির সঙ্গে। আর হিসাব লেখায় বিষম অঙ্ক-সংখ্যার বিন্যাস–সে যেন মায়াবনিতার আলুলায়িত চূর্ণকুন্তলের মতো বাঁকা। কে আছে জগতে যে এই আঙ্কিক রেখাবলীর দ্বারা প্রতারিত হয়নি।

আমার কায়স্থ পাঠককুল যেন একটুও বিব্রত বোধ না করেন, মনে রাখবেন, গালাগালি সব জাতের ওপর সমানভাবে বর্ষিত। কোনো জাতই আরেক জাতের প্রশংসা অর্জন করতে পারেনি। তবে কর্ম-গুণে কিংবা কর্মদোষে নিন্দার অনুপাত হয়েছে কম আর বেশি। শতমারী ভবে বৈদ্যঃ–একশোটা রুগি মরলে তবে বৈদ্য হওয়া যায়-এর মধ্যে কোনো নিন্দাই নেই। অসুখ করলে ডাক্তারের প্রয়োজন যেমন বেশি, বৈদ্যদের সম্বন্ধে নিন্দাও তেমনি ভয়-মাখানো, ঠাট্টা-মেশানো দুরুক্তি। প্রাচীনের মতে, রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির কাছ থেকে বিত্ত হরণ করা—আতুরাদ বিত্ত-হরণ–আর রোগী মরলেই পালানো-মৃতাচ্চ প্রপলায়ন–এই হল বৈদ্যের বৈদ্যত্ব। সবাই জানে বৈদ্য ভগবান নয়, তবে ডাক্তার বাড়িতে যাবে, পয়সা নেবে না; আবার রোগী মারা গেলে আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে বসে বসে কাঁদবে–এই বা কেমন আবদার! তবু এটা কোনো গালাগালিই নয়, বরঞ্চ আমাদের পুরাতন সহায় ক্ষেমেন্দ্র কথঞ্চিৎ কঠিন শব্দ ব্যবহার করে অন্যদের সঙ্গে বৈদ্যদের সমতা রেখেছেন। ক্ষেমেন্দ্র বললেন–এই অসহ্য ভিষক-বৈদ্যগুলো মরেও না। গ্রীষ্মকালে মানুষ যে অনুপাতে উগ্র এবং তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়ে, ঠিক সেই অনুপাতে এরা জলের পরিবর্তে ধন শোষণ করে। একের পর এক ওষুধ পালটে, নানা যৌগে অনুপানের ব্যবস্থা দিয়ে, নানা জিজ্ঞাসায় হাজারটা রুগি মেরে–পশ্চাদ্ বৈদ্যো ভবেৎ সিদ্ধ।

এরপর আসেন বৈশ্য অর্থাৎ বণিক এবং ব্যবসাদারেরা। প্রাচীন কথকঠাকুর ব্যঙ্গ করে বলেছেন–চোরের আবার ধর্ম, দুর্জনের আবার ক্ষমা, বৈশ্যের আবার স্নেহ। তা, এখন যদি ব্যবসাদারেরা সস্নেহে ব্যবসাপাতি আরম্ভ করেন তাহলে অর্থনীতি মাথায় উঠবে। ব্যবসা করব, লাভ-লোকসানের কথা চিন্তা করব না, তা তো হয় না। কবি বললেন, “করুন চিন্তা, কিন্তু আমার বক্তব্যটা আপনার ব্যবসা নিয়ে নয়, আপনার ‘অ্যাটিচুড়’ নিয়ে। যে বণিক দোকানে আরামসে বসে আছে, তাকে যদি ক্রেতা এসে দাম শুধোয়, তাতে সে যদি কড়াকিয়া, গন্ডাকিয়ার হিসেব করে পাঁচ-টাকা, কি একশো টাকা দাম বলে, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই; কিন্তু যখন উত্তাল ঘূর্ণিঝড়ে আপাতাল ঘূর্ণিত হচ্ছে, হাওয়ার বেগে ডুবে যাচ্ছে নৌকো, তখনও যে ক্রয়মূল্য আর বিক্রয়মূল্যের হিসেব কষে যায়–বুঝতে হবে সেই বণিক-মজ্জ্যামপি নাবি মুঞ্চতি ন যস্তামেব মূল্যস্থিতি।”

ব্যবসায়ীদের নিয়ে এক বিদ্রূপ নির্মল হাস্যরসাশ্রিত। সমালোচক কবির চোখে, ব্যবসায়ীরা হল কামুক পুরুষের পুরুষাঙ্গের মতো–প্রথমে নম্র, তারপর স্তব্ধ (স্বয়ং স্টার্ক-এর অনুবাদ করেছেন স্টার্ন ইন্ অ্যাপোচ্‌), কাজের সময় এরা একেবারে নিষ্ঠুর, আবার কাজ শেষ হয়ে গেলে পুনরায় ন–আদৌ নম্ৰস্ততঃ স্তব্ধঃ কার্যকালে চ নিষ্ঠুরঃ। কৃতে কার্যে পুন নম্রঃ শিশ্নতুল্যা বণিজনঃ।

এই ধরনের রসিকতা আর বাড়তে দিতে চাই না। বরঞ্চ অনেকেরই ধারণা যে, কটুক্তির ব্যাপারে বামুনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সেই প্রসঙ্গে আসি। কেউ যদি নারায়ণ ভট্টের বেণীসংহার নাটকটি খোলেন, তাহলে দেখবেন সেখানে কর্ণ আর দুর্যোধন দ্রোণাচার্যের রহস্যময় মৃত্যু নিয়ে কিছু বাক্য বিনিময় করছেন। কর্ণের ধারণা, প্রিয়পুত্রের মিথ্যা মৃত্যুসংবাদ শুনেও দ্রোণাচার্যের অস্ত্রত্যাগ করা উচিত হয়নি। দুর্যোধন রীতিমতো ব্যঙ্গ করে বললেন,”স্বভাব যায় না মলে–প্রকৃর্তিদুস্ত্যজেতি–তিনি শোকের তাড়নায় ক্ষত্রিয়ের প্রতিবাদী বৃত্তি ত্যাগ করে বামুনের স্বভাবসুলভ দীনতার আশ্রয় নিয়েছেন।” কথায় কথায় এই মন্তব্যগুলি কিঞ্চিৎ পরিশীলিত হয়ে দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামার কানেও উঠল। তিনি প্রথমেই বংশ তুলে গালাগালি দেওয়া আরম্ভ করলেন কর্ণকে, কেননা সূতপুত্রের ওইখানেই ছিল দুর্বলতা। কর্ণও ছেড়ে কথা বললেন না, তিনি বললেন-বেটা বাঁচাল বামুন, বৃথাই তোদের অস্ত্র, কাজের সময় কাজে লাগে না। কথাটা যেহেতু অশ্বত্থামার বাবার গায়েও লাগে, তাই তিনি রাধাগৰ্ভারভূত’ কর্ণকে সমুচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য বাঁ পাখানি মাটিতে ঠুকে বললেন–এই পা-টা তোর মাথায় রাখলুম, পারিস তো সরা। কর্ণ বললেন-বেটা জাতিতে বামুন, তাই অবধ্য। নইলে তোর পা-টা এতক্ষণ ধড় থেকে আলাদা হয়ে মাটিতে লুটাত। অশ্বত্থামা বললেন, তবে রে হতভাগা, আমি জাতিতে বামুন বলে আমার বীরত্বের অপমান করছিস, এই নে আমি জাতি ত্যাগ করলুম। এই বলে অশ্বত্থামা পৈতেখানাই ছিঁড়ে ফেললেন।

তাহলে দেখুন বামুনকে বামুন বললেও সে রেগে যায়। আসল কথা হল বৃত্তি। একই বৃত্তি বংশানুক্রমে পালন করতে থাকলে, তার কতকগুলো দোষ গজায়। একসময় শিষ্য-যজমানের বাড়ি থেকে দান প্রতিগ্রহ করা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অঙ্গীভূত ছিল এবং দরিদ্র থাকাটাও ব্রাহ্মণের কাছে অমর্যাদাকর ছিল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই দারিদ্র্য এবং প্রতিগ্রহই ব্রাহ্মণকে অভাবে এবং স্বভাবে লোভী করে তুলল। বিভূতিভূষণের ইছামতীতে নালু পালের ঘরে লুচি-সন্দেশ খাওয়া বামুনের কীর্তি, পাঠকের স্মরণ আছে কি না জানি না; কিন্তু ভারতবর্ষের সমাজ বহুকাল আগে থেকেই যে এই ব্রাহ্মণদের ব্যঙ্গ করেছে তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ, হাজারো নাটকে বিদূষকের চরিত্রটি। প্রাচীন নাটকের বিদূষক প্রায়ই ব্রাহ্মণ এবং ব্রাহ্মণ শাসিত সমাজে ব্রাহ্মণকেই বিদূষক সাজানো-এ বড়ো কম রসিকতা ছিল না। বিদূষককে সবসময়ই দেখানো হয়েছে ঔদরিক ব্রাহ্মণ হিসেবে, যে সবসময়ই খেতে চায়। এমনকী কোনও মনিকা কিংবা চুতলতিকা যদি তাকে কবিতার-কলি দ্বীপদীখণ্ডের তালিম দিতে চায়, তবে সে খণ্ড মানে চিনি কিংবা মিছরিই বোঝে এবং লোভাতুর হয়ে বলে–তা, এই খণ্ড দিয়ে কি মোয়া হয়, লাড্ড হয়–কিম্ এদিনা খণ্ডেন মোঅআ করীয়ন্তি, লডুআ বা?

পাঠক কিংবা সমালোচক বলতে পারেন, সংস্কৃত নাটকের বিদূষক চরিত্র দিয়ে সমস্ত ব্রাহ্মণের বিচার করা ঠিক হবে না। আমি বলব, ব্রাহ্মণ যেদিন থেকে অযাচক-বৃত্তি ছেড়েছে, ত্যাগ এবং শুচিতার মূল্য যেদিন ব্রাহ্মণের কাছে অনর্থক হয়েছে, সেদিন থেকেই ব্রাহ্মণ অন্যান্য জাতির কাছে হেয় হয়ে গেছে। বিদ্যা শিক্ষা–এসব আর সমাজের চোখে তেমন করে বড়ো হয়ে ওঠেনি, বেশি করে চোখে পড়েছে এইটুকুই যে, ব্রাহ্মণ অন্য জাতির দান প্রতিগ্রহ করে, অতএব সে লোভী। সবাই জানেন বৌদ্ধেরা ব্রাহ্মণদের ভালো চোখে দেখতেন না, যে কারণে ধর্মকীৰ্ত্তির মতো বৌদ্ধ দার্শনিক ব্রাহ্মণদের খোঁচা দিয়ে বলেছেন–আরে এ যে দেখছি ফলারে বামুনের মতো ভোজন-দক্ষিণা চাচ্ছে? কিং পর্বব্রাহ্মণবৎ অয়ং মূল্যং মৃগয়তে?

পর্ব-ব্রাহ্মণ কোনও বিশেষ পর্বদিনে গৃহস্থের ঘরে বসে আচ্ছাসে খেয়ে আবার কেমন করে দক্ষিণা নেন–এই জিনিসটি একটু বিশদ করে দেখাবার লোভ সামলাতে পারেননি টীকাকার অর্চট। তিনি বললেন–পর্বব্রাহ্মণের কায়দাটা কেমন জানেন–এই এক একটা করে লুচি খাব, আর এক একবার করে দক্ষিণা দিতে হবে–ঘৃতপুরং ঘৃতপুরং মে দক্ষিণা প্রদাতব্যা। ধর্মকীৰ্ত্তির হেতুবিন্দু গ্রন্থের টীকাকার অৰ্চটের (হেতুবিন্দু টীকা) এসব কথা নবম/দশম শতাব্দীর। ব্রাহ্মণের উদর নিয়ে বাংলার প্রবাদ আছে বিস্তর, বিশেষ করে কমলাকান্ত শর্মা যেদিন থেকে ব্রাহ্মণভোজনের নিমন্ত্রণ গ্রহণকে পেশা হিসেবে নিয়েছে, সেদিন থেকেই জানি এই ঔদরিক ব্রাহ্মণের মূল অনেক গভীরে এবং সে কাল যদি খ্রিস্টের জন্ম-সময়ের আশে-পাশে হয় তাতেও আশ্চর্য কিছু নেই।

শোনা যায় মৃচ্ছকটিক নাটকের ভিত্তি নাকি ভাসের চারুদত্ত, তা ভাস খ্রিস্টের প্রায় সম-সাময়িকই বটে। নাটকের আরম্ভেই সূত্ৰধার নাটক নামাতে গিয়ে বাড়ির গিন্নিকে ডাকছে প্রাতঃরাশের আশায়। গিন্নি বললেন–আজ আমার উপপিস, তুমি আমাদেরই মতো একটা গরিব বামুন ধরে আনো নেমন্তন্ন করে, সেই সঙ্গে তোমারও খাবার জুটবে। সূত্রধার বেরোলেন এবং চারুদত্তের বন্ধু ব্রাহ্মণ মৈত্রেয়কে ধরে বললেন–মৈত্রেয়মশাই, আপনার নেমন্তন্ন। খাবার একেবারে রেডি-ঘি, গুড়, দই সবই আছে। তাছাড়া দক্ষিণাও মিলবে কয়েক টাকা। মৈত্রেয়মশায়ের খাবার খুব পছন্দ, অথচ ওপরে একটা ভারিক্তি দেখিয়ে বললেন–যান, যান মশাই, অন্য কাউকে ধরুন, আমি এনগেজড়। সূত্ৰধার আবারও রসিয়ে রসিয়ে বললেন–দেখুন মশাই বেশ গরম গরম ঝোল, তরকারি, চাটনি। ঘি, গুড়, দই দিয়ে ভাত। আপনাকে পরিবেশনও করা হবে পরম আদরে। খেতে পারবেন যথেষ্ট।

নাটকের কারণে নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে মৈত্রেয়মশাই বড়োই পীড়িত এবং তিনি স্বগতোক্তি করে বলেছেন–ইস্ আমাকে বারবার লোভ দেখিয়ে দেখিয়ে বলল, তবু আমি প্রত্যাখ্যান করলাম। আবার বলছে, কয়েক টাকা দক্ষিণাও দেবে। যদিও মুখে এসব প্রত্যাখ্যান করেছি, তবুও হৃদয় আমার এর পেছনেই ঘুরঘুর করছে–এষ বাঁচা প্রত্যাখ্যাত হৃদয়ে নানুবধ্যমানো গম্যতে। দরিদ্র ব্রাহ্মণের এই করুণ অবস্থাই চাণক্যনীতিতে প্রবাদ তৈরি করেছে–আমন্ত্রণোৎসবা বিপ্রাঃ। নৃত্যন্তি ভোজনে বিপ্রাঃ। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ নেমন্তন্ন-বাড়িতে কোন খাবারটি বেশ ভালো এবং বেশি খাওয়া উচিত এবং কোনটি হেয় এবং না খাওয়া উচিত–সেই সম্বন্ধে ছেলেকে উপদেশ দিতেন। আর সেই বৃদ্ধের নিজের অবস্থাটি ভারি করুণ করে বর্ণনা করেছেন ভাসের মৈত্রেয়মশাই। তিনি বললেন–আমার পেটও আমার অবস্থার ভালোমন্দ বোঝে। অল্প একটু কিছু পেটে দিয়ে দাও তাতেও সন্তুষ্ট; আবার প্রচুর পরিমাণে খাবার এই পেটে ভরাতে থাক, দেখবে স্বচ্ছন্দে জায়গা করে নিয়েছে–অল্পেনাপি তুষ্যতি, বহুকম্ অপি ওদনভরং ভরিষ্যতি দীয়মান। আমার পেট না দিলে চায় না, দিলে ফেলে দেয় না। (ভাস, চারুদত্ত)।

দিনের পর দিন খাওয়া এবং না-খাওয়ার অভ্যাসে যাঁরা পেটকে এই পরিমাণ ইলস্টিক করে ফেলতে পারেন তাদের লোকে বলবেই–বামুন খাবার পেলেই নাচে। মজার ব্যাপার হল, আজকের দিনের মহা মহা সমাজবিজ্ঞানীদের ধারণা যে ব্রাহ্মণ-মাত্রেই ছিল সুবিধাভোগীর জাত। মুষ্টিমেয় ব্রাহ্মণ যাঁরা বিত্তশালী পরিবারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাদের কিছু সুবিধে নিশ্চয়ই ছিল, কিন্তু পরের দান-প্রতিগ্রহ করে যাদের জীবন কাটত এবং সে প্রতিগ্রহও যেহেতু নিম্নবর্ণের বাড়ি থেকে করা যেত না, সেখানে সাধারণ উদরপূর্তির জন্যই এঁদের যথেষ্ট চিন্তা করতে হত। এ-ব্যাপারে অন্তত আমি নিঃসন্দেহ। ঠিক এইজন্যই সূত্রধরের গৃহিণী সমব্যথী হয়ে এমন একজন ব্রাহ্মণকে নেমন্তন্ন করতে বলেছেন, যে তাদের মতোই গরিব। সে ধরেছে তাই গরিব চারুদত্তের গরিব বন্ধু মৈত্রেয়মশাইকে। গুড়, দই আর ভাত–বারবার বামুনঠাকুরকে লোভাতুর করে তুলেছে, আর তারই জন্যে নবীন তপস্বিনীতে এককালের ব্রহ্মজ্ঞানী ব্রাহ্মণকে শুনতে হয়েছে ব্রাহ্মণের উদর, ছিটেবেড়ার ঘর। এমনকী তারা যে হৃষ্টচিত্তে বেদমন্ত্র উচ্চারণ করতে পেরেছে তাও যে ওই খাবার গুণেই নয়, তাই বা হলফ করে বলি কি করে! শূদ্রক রচিত মৃচ্ছকটিকের বিদূষক যখন বসন্তসেনার আট মহলা বাড়িতে ঢুকেছে, তখন সপ্তম মহলে সে দেখল খাঁচার শুকপাখিও বেদমন্ত্র উচ্চারণ করছে। বিদূষক ব্যঙ্গ করে বলল, আরে! এ যে দেখছি দই-ভাতে পেটমোটা বামুনটির মতো বেদমন্ত্র পাঠ করছে।

সভ্যতার প্রথম যুগ থেকে দুইভাত আর পায়সান্ন সহযোগে জনগণের গালাগালি খেতে খেতে একসময় ব্রাহ্মণেরা হারিয়ে গেলেন, আর ঔদরিকের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রেখে গেলেন কতকগুলি পুরুতমশাইকে, যিনি পূজার সময় কলা-মুলো নিয়ে, শ্রাদ্ধের সময় কাপড় আর ছাতা নিয়ে যজমানের সঙ্গে ঝগড়া করেন। মানুষ বলে–পুরুতগুলো হতচ্ছাড়া। মন্ত্র পড়ে ঠিক ভূতের মতো, আর চাল-কলা নিয়ে ঝগড়া করে। আমি বলি–পূজা, শ্রাদ্ধ, এসবের দরকার কি। যদি বলেন সংস্কার, তাহলে বলি, পূজা-শ্রাদ্ধ যে-সংস্কারে বিশ্বাস করতে হয়, পুরুতকেও সেই সংস্কারে বিশ্বাস করতে হয়। আর মন্ত্র! এক সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতের বিয়ে হচ্ছিল, সে পুরুতের মন্ত্র উচ্চরণ শুনে নববধূর সামনে নিজের এলেম দেখিয়ে বলল–এই কি মন্ত্র! না ভূতের তন্ত্র। এ বিয়েই তো অসিদ্ধ। পুরুত ফোকলা দাঁতে হেসে বললেন এই মন্ত্র পড়েই তোর বাপেরও বিয়ে দিয়েছি, তাহলে তোর বাপের বিয়েও অসিদ্ধ এবং ফলগতভাবে তুইও অসিদ্ধ।

তবু পুরুতমশাইদের ওপর বিরক্তি আমাদের কমেনি এবং তাদের সম্বন্ধে আমরা যা বলি তার চতুগুণ বলেছেন প্রাচীন মানুষেরাই। তাদের নিয়ে যে নির্মম শ্লোক বাঁধা হয়েছে তাতে অনেকেই ক্ষোভ মেটাতে পারবেন। শ্লোকটি বলে–পুরীষস্য চ রোষস্য হিংসায়াস্তস্করস্য চ। আদ্যাক্ষরাণ্যেতেষাং পুরোহিত ইতি মৃতঃ। অর্থাৎ পুরীষ (মানে মল)। রোষ, হিংসা এবং তস্কর–এই চারটি শব্দের আদ্যক্ষরগুলি নিয়েই পুরোহিত। শ্লোককর্তা যে শব্দগুলির কথা বলেছেন তার গুণগুলিও পুরোহিতের মধ্যে আছে বলেই না এমন একটি শ্লোক তৈরি হয়েছে, অন্তত শ্লোক-রচয়িতার তত তাই ধারণা।

সবার সম্বন্ধেই বললাম শুধু শূদ্রের কথা বললাম না। বললাম না এইজন্য যে, তারা গালাগালির ওপরই ছিলেন চিরকাল। আজকে একবিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় বসে, তাদের সম্বন্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যবহৃত অপভাষাগুলির পুনরক্তি করে কী ধরনের প্রায়শ্চিত্ত করব? বরঞ্চ কঠিন কথার পরে কিঞ্চিৎ এমন প্রসঙ্গ টানা উচিত, যাতে কারও গায়েই লাগে না। যেমন ধরা যাক গুরু। আমাদের বিদ্যাও গুরুমুখী ধর্মও গুরুমুখী, কাজেই সমাজে গুরুর প্রতিপত্তির সঙ্গে সঙ্গে গুরুনিন্দাও তৈরি হচ্ছিল। একজন বললেন– হাজারো গুরু আছে, যারা শুধু শিষ্যের টাকা ঝেড়েই খালাস; এমন গুরু দেখলাম না যে শিষ্যের সন্তাপ হরণ করতে পারে গুরবো বহবঃ সন্তি শিষ্যবিত্তাপহারকাঃ। তং তু গুরুং ন পশ্যামি শিষ্য-সন্তাপহার৷৷ বেশিরভাগ গুরুর সম্বন্ধে এই আক্ষেপ ভালোই খেটে যায়, তবু যাঁরা অতিরিক্ত গুরুভক্ত তারা যেন আমার পরের কথাগুলি মনে না রাখেন। কাশ্মীরের কবি ক্ষেমেন্দ্রসুন্দর গুরুর মুখ দেখেননি নিশ্চয়, গুরুদের মুখগুলি তাই তার কাছে–কৃষ্ণাশ্ব-শকৃর্তা–কালো ঘোড়ার পাছার মতো। ব্যাঙের নাড়িভুঁড়ি মাখা মানুষও কেমন করে অপ্সরাদের প্রেমাস্পদ হয়ে পড়বে–এই স্বপ্ন দেখান গুরুরা। অল্পপরিচয়েই দীক্ষা দেন। আর মুগ্ধচিত্ত পুরুষের টাকা পয়সা আত্মসাৎ করেন। কোনও কোনও গুরু আবার হাত দেখে ভাগ্যও বলেন- তোমার হাতের ধনরেখাঁটি তো বেশ বড়ো, তবে তোমার স্বামীর মন যেন একটু চঞ্চল–এই ধরনের কথা বলে, বেটা ধূর্তগুরু, কুলবধূদের কুসুমকোমল হাতগুলি বসে বসে টেপে–মৃতি কুলবধূনাং কমল-কোমলং পাণিম্।

ক্ষেমেন্দ্র পর্যায়ক্রমে অনেকেরই শ্রাদ্ধ করে ছেড়েছেন এবং হাত দেখার কথায় মনে পড়ল, জ্যোতিষীদের সম্বন্ধেও ক্ষেমেন্দ্রর ধারণাটি চমৎকার। তিনি বলেন–হতভাগা জ্যোতিষীগুলো, বসে বসে কখন গগনের চাঁদ বিশাখা নক্ষত্রের সঙ্গে সমাগম করছে, তার খবর রাখে; কিন্তু বেটা জানে না, যে তার নিজের বউই কতকগুলি রসিক-কামুকের সঙ্গে উপগত হল–গণয়তি গগনে গণকশ্চন্দ্রেণ সমাগমং বিশাখায়াঃ। বিবিধ ভুজঙ্গ-ক্রীড়াসক্তাং গৃহিণীং ন জানাতি।

রসিকতার কথা থাক। রসিকতা-মাখানো গালাগালির পর্যায়ে, ছেলে থেকে আরম্ভ করে শ্বশুরগৃহের দুগ্ধলুব্ধ বেড়ালের মতো জামাই সবাই আছে। তার থেকে যেকথা বলা হয়নি, তাই বলি। আমার পূর্ব প্রতিজ্ঞামতো একটা কথাই বলা হয়নি, তা হল দেশ ধরে গালাগালির কথা। একটি দেশ কিংবা প্রদেশ আরেকটি দেশ কিংবা প্রদেশ সম্বন্ধে কোনওকালে ভালো ধারণা পোষণ করেনি। এক্ষেত্রে যে মানুষ যে দেশের লোক, সেই দেশের যদি সর্বজনবিদিত কোনও দোষ থাকে, তবে অন্যজনে তা গালাগালি হিসেবে ব্যবহার করে। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কর্ণের সারথি হিসেবে শল্য একটি নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছিলেন। অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ থেকে কর্ণকে বিরত করতে চাইছিলেন শল্য। অনেক উতোর-চাপানের পরেও শল্য যখন থামলেন না, কর্ণ তখন শল্যের মাতৃভূমি মদ্রদেশের দফা রফা করে ছাড়লেন। কর্ণ বললেন–মদ্রদেশের লোক তুমি, তোমার আর কত বোধ থাকবে? বহু দেশ ঘুরে এসে এক বামুন ঠাকুর আমাকে জানিয়েছেন–কুরু, পাঞ্চাল, মৎস্য কোশল এসব দেশের লোকেরা সব ভালো মানুষ। আর বাহীক, মদ্রক, কিংবা পঞ্চনদীর দেশটি হল একেবারে বাজে লোকের আচ্ছা।

মনে রাখবেন শল্যের জন্মভূমি সম্বন্ধে কর্ণ যা খবর পেয়েছেন, তা তীর্থ পর্যটক ব্রাহ্মণের কাছে। আরেক ব্রাহ্মণও কর্ণকে সাবধান করেছেন–আরট্ট, বাহীক, মাহিষক, কলিঙ্গ কেরল–এসব দেশ সম্বন্ধেও। পরিষ্কার বোঝা যায়, দেশ সম্বন্ধে নিন্দা ছড়ায় তখনই, যখন কোনও পর্যটক ব্যক্তিগত কারণে খারাপ ব্যবহার পায়। কিন্তু শোনা কথাতেই কর্ণ শল্যকে শুনিয়ে বলেছেন–ওরে মূর্খ। মদ্রদেশের লোকেরা সব ভীষণ ঝগড়াটে, মানুষেরা অধম আর মিথ্যেবাদী। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যত দুষ্কর্ম করা যায়, মদ্রকেরা সব করে। আর মদ্রদেশের মেয়েরা স্বেচ্ছায় পুরুষের সঙ্গে রতিবিলাস করে। শুধু তাই নয়, মদ খেয়ে আবার স্ট্রিপটিজুনাচে-বাসাংসি উৎসৃজ্য নৃত্যন্তি, স্ত্রিয়ো যা মদ্যমোহিতাঃ। তার ওপর যাদের দেশের মেয়েরা উট আর গাধার মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পেচ্ছাপ করে-ষাতিষ্ঠষ্যঃ প্রমেহন্তি–শল্য! তুমি হলে তাদের ছেলে। তোমাদের দেশের মেয়েদের কাছে যদি সুবীরক, মানে, টক আমানি (এক ধরনের টকসে মদ) চাওয়া যায়, তবে তার পাছায় চাটি মেরে বলে–স্বামী-পুত্তর দিয়ে দিতে পারি, টক-আমানি দেব না।

মহামতি কর্ণ কিংবা তার কানে মন্ত্র দেওয়া ব্রাহ্মণটি এই স্ত্রীলোকদের কাছে টক আমানি চাখতে চেয়েছিলেন কি না জানি না, তবে এটুকু বেশ বোঝা যায় যে, তথাকথিত ভদ্রসমাজের বহু মানুষই অন্যের মুখে ঝাল খেয়ে কারও মাতৃভূমি সম্বন্ধে এমন কথা বলেন। আমরা আরও কষ্ট পাই, কেন না খোদ বাংলাদেশের সম্বন্ধেও আমরা কম শুনিনি। খ্রিস্ট জন্মাবার আগে সশিষ্য মহাবীর জৈন নাকি বাংলায় এসেছিলেন। তার মতে রাঢ়দেশের লোকেরা একেবারে আচার-বিচারহীন আর বঙ্গদেশের লোকেরা অখাদ্য-কুখাদ্য–সব খায়। একেই তো মহাবীর জৈনের এমন ধারণা, তার মধ্যে আবার বাঙালিরা নাকি তার পেছনে ছু-ছু শব্দ করে কুকুর লেলিয়ে দিয়েছিল (আচারাঙ্গ সূত্র), আমরা আর জৈন সন্ন্যাসীদের মন ফিরে পাইনি।

আপাতত বেশি বিস্তারে যাব না, শুধু এইটুকু বলব, ভিপ্রদেশের লোকেরা আমাদের কেউ ভালো চোখে দেখেননি। বাঙালিরা বেদের ক্রিয়াকলাপ জানে না, কি বেদ উচ্চারণ জানে না–এসব কঠিন কথা তো অনেক শুনেছি এবং তা গা-সওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু দেখুন, ভাষা, যা মানুষের জীবনের এবং জন্মের অধিকার, সেটি নিয়ে রঙ্গ করলে বড়ো দুঃখ লাগে। অথচ রাজশেখর আমাদের অর্ধমাগধী প্রাকৃত শুনে ব্রহ্মার মুখসম্ভবা সরস্বতাঁকে পাঠিয়েছেন জগৎপিতা ব্রহ্মার কাছে এবং তার আর্জি হল–পিতা! আমার দ্বারা গৌড়দেশের ভাষা চালানো সম্ভব নয়, তার চেয়ে, গৌড়ের লোকের জন্য পৃথক একটি সরস্বতীর অর্ডার দিন অথবা গৌড়ীয়রা নিজেদের ভাষা ত্যাগ করুক–গৌড়স্তজতু বা গাথাম্ অন্যা বা অস্ত্র সরস্বতী। মনে রাখা দরকার, দেশ-বিদেশের সংস্কৃতি এবং ভূগোল সম্বন্ধে রাজশেখরের জ্ঞান ছিল টনটনে; কাজেই গৌড়দেশের উচ্চারণ বলতে যে একেবারে বাঙাল দেশের উচ্চারণ বোঝাব, তার উপায় নেই, যদিও বাংলাদেশের খানিকটা অবশ্য তখন গৌড়দেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

রাজশেখরের কথার সূত্র ধরে বলতে পারি, বাংলাদেশের লোকেরা চিরকালই তাদের ভাষার জন্য কথা শুনেছে; সিনেমা-বায়োস্কোপে বাঙাল-ভাষাভাষী একটি চাকরের ভূমিকা নতুন হাস্যরসের জোগান দিত। বাস্তবিক পক্ষে বাঙালদের সম্বন্ধে যদিও বা প্রাচীন শ্লোক আমার নজরে আসেনি। যদিও বা থাকে, তা আমার জানা নেই। ধরেই নেওয়া যায়, বাঙালদের সম্বন্ধে যে শ্লোকগুলি বানানো হয়েছে তা ঘটিদেরই বানানো। যেমন ধরুন–কখনও আশীর্বাদ নিও না পূর্ববঙ্গীয় মানুষের কাছ থেকে, কেননা তারা যদি বলেন শতায়ু হও, তাহলে শোনাবে যেন হতায়ু হও’–আশীর্বাদং ন গৃহীয়াৎ পূর্ব-বঙ্গ-নিবাসিনা। শতায়ুরিতি বক্তব্যে হতায়ুরিতি বাদিনা৷ এ তো গেল সাধারণ রসিকতা। আমার এক শিক্ষকের কল্যাণে নবদ্বীপ-নিবাসী এক মহাপণ্ডিতের হাতে লেখা পুঁথি দেখতে পাই, যে পুঁথিখানি অন্তত ১৬/১৭শ শতাব্দীর। ন্যায়শাস্ত্রের বিষয় নিয়ে লেখা, সেই পুথির একটি পত্রে একই হাতের লেখা একটি শ্লোক ছিল। শ্লোকটির মানে হল–বাঙালরা নাকি জায়গাবিশেষে সিংহের মতো পরাক্রমশালী কিন্তু যুদ্ধ করতে গেলে একেবারে হরিণের মতো–স্থানে সিংহসমাঃ রণে মৃগসমাঃ। পালানোর ব্যাপারে বাঙালরা একেবারে শেয়াল। চেহারাটা একেবারে বাঁদরের মতো। তার ওপরে মুখের গড়ন–একেবারেই বিড়ালবদন-রূপে মর্কটবৎ বিড়ালবদনাঃ; স্বভাবে কুর, খল এবং নির্দয়; বাঙালরা খাবার জোগাড় করবে বকের মতো ধ্যান দিয়ে, তবে খেতে পেলে, যাই খেতে দাও, কাকের মতো খাবে, আর খাওয়ার ভঙ্গিটা ঠিক যেন শুয়োরের মতো। স্ত্রী-পুরুষের মৈথুন কর্মে বাঙালরা ঠিক যেন ছাগল–আহারে বক-কাক-শূকর-সমাঃ ছাগোপমা মৈথুনে। কবির শেষ আক্ষেপ হল–হ্যায় এইরকম বাঙালরাও যদি মানুষ হয় তবে প্রেতাত্মা ভূতগুলো সব কেমন হবে-বাঙ্গালা যদি মানুষ হরে হরে প্রেতাস্তদা কীদৃশাঃ।

বাঙালদের সম্বন্ধে এই নির্মম পরিহাসোক্তি শুনেও আমার ত দুঃখ হয় না, কিন্তু স্বয়ং মহাপ্রভু, যাঁর পাঁচশো বছর পুরে গেল এই সেদিন, তিনিও যখন বাঙালদের নিন্দায় মুখর হয়ে ওঠেন, তখন বুঝি–গালাগালির প্রবৃত্তি বড়োই সার্বজনীন। অনেকেই জানেন চৈতন্যদেব পূর্ববঙ্গে গিয়েছিলেন অর্থের খোঁজে এবং অর্থও তিনি ভালোই পেয়েছিলেন। ফিরে এসে সমস্ত কিছু মায়ের চরণে নিবেদন করে, তিনি যখন আত্মীয়বন্ধুদের সঙ্গে মিলিত হলেন, তখন তার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হল বাঙালদের নকল করে ভেঙিয়ে ভেঙিয়ে কথা বলা–”বঙ্গদেশি বাক্য অনুকরণ করিয়া। বাঙালেরে কদৰ্থেন হাসিয়া হাসিয়া৷” বাঙাল ভাষার রকমারি টান শুনে পশ্চিমবঙ্গীয় মানুষের প্রাথমিক এই প্রতিক্রিয়া হয়তো অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এর পরে যখন মহাপ্রভুর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা আরম্ভ হয়েছে, গুরু হিসেবে বিদ্যাদানও চলছে, তখন বাঙাল দেখলে, বিশেষত শ্রীহট্টের নোক দেখলে, মহাপ্রভুর মুখ সুড়সুড় করে উঠত–”বিশেষ চালেন প্রভু দেখি শ্রীহট্টিয়া। কদৰ্থেন সেইমত বচন বলিয়া।” ভেঙিয়ে ভেঙিয়ে এমন অত্যুক্তি করা শুধু পরিহাসেই শেষ হত না, অপর পক্ষের ধৈর্যের সীমা লঙ্ঘন করত। কদাচিৎ তারাও মহাপ্রভুকে বোঝোনোর চেষ্টা করতেন, কেননা মহাপ্রভুর বাপ-পিতামহ শ্রীহট্টেরই লোক ছিলেন। তাই শ্রীহট্টিয়ার প্রতি প্রভুর বিদ্রূপ শুনে–

ক্রোধে শ্রীহট্টিয়া-গণ বোলে ‘অয় অয়’ (হয়, হয়)।
তুমি কোন দেশী তাহা কহততা নিশ্চয়।
 পিতামাতা আদি করি যতেক তোমার।
 বোল দেখি শ্রীহট্টে না হয় জন্ম কার ৷৷
আপনে হইয়া শ্রীহট্টিয়ার তনয়।
তবে ঢোল কর কোন যুক্তি ইথে হয়৷

 শ্রীহট্টিয়ার পক্ষে, দলে টানার এই চেষ্টা সফল হয়নি। সমস্ত লোকের চৈতন্য সম্পাদনকারী শ্ৰীকৃষ্ণচৈতন্যের একটুও মায়া হয় না। “যত যত বোলে প্রভু প্রবোধ না মানে। নানা মত কদৰ্থেন সে-দেশী বচনে ৷ তাবৎ চালেন শ্রীহট্টিয়ারে ঠাকুর। যাবত তাহার ক্রোধ না হয় প্রচুর।”

চৈতন্য লীলার ব্যাস বৃন্দাবন দাস এসব ঘটনাকে প্রভুর ‘চাপল্য’ বলে উল্লেখ করেছেন। সত্যি কথা এইরকম ভাষা নকল করে অন্যকে ততক্ষণই বলে যেতে থাকুন, যতক্ষণ সে না রেগে যায় এবং শেষে আমরা বলব শুধু ‘আপনি বড়ো চপল। চপলই বটে, তবে একের চপলতা অন্যের মনে যদি আঘাত দেয়, তবে সেটি বোঝে সেই মানুষটি, যার মাতৃভাষা অন্যের মুখে বিকৃত হয়, ধর্ষিত হয়। তবু এ সবই সভ্যতার অঙ্গ; সভ্য মানুষ বলেই সভ্যেতর অপশব্দ প্রয়োগ করার অধিকার নেই–এমন তো নয়। একজনের জাতি, একজনের বৃত্তি, কিংবা তার দেশ অথবা তার ধর্ম–সে যত সমৃদ্ধ অথবা হীনই হোক, তবু অন্য মানুষ তাকে করুণা করেনি। সভ্যতা এবং ভব্যতার পরিসর কত বড়ো জানি না এবং সম্ভবত তার পরিসর অন্য কোথাও হবে; আমি শুধু এইটুকুই জানি এবং এই জানাটাই আমার সান্ত্বনা, যে সভ্য মানুষের এই গালাগালির পরিসর থেকে কোনও সভ্য মানুষই বাদ যায়নি। [ এই প্রবন্ধে এমন কিছু শ্লোক ব্যবহৃত হয়েছে যার রচয়িতার নাম জানা যায় না। কিছু শ্লোক পাওয়া যায় এল স্টার্নবাক্ সম্পাদিত মহাসুভাষিতসংগ্রহ গ্রন্থে। অন্য শ্লোকগুলি অতি প্রাচীন বৃদ্ধদের পরম্পরাক্রমে পণ্ডিতদের মুখে প্রচলিত।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *