দুপুরের দিকে লালুর মনে হল, খানিক দূরে অন্য কেউ যেন গান গাইছে।
প্রথমে মনে হল মনের ভ্রম! এরকম হয়। কখনও বাতাসের সরসরানিকে মনে হয় মানুষের ফিসফিসানি। মাটিতে মানুষের পদশব্দেরও ভ্রম হয়।
গানটা ক্রমেই কাছে আসছে। তা হলে মনের ভুল নয়। কেউ যেন গান গাইতে গাইতে এগিয়ে আসছে এই দিকেই। গানের বাণী বোধগম্য হচ্ছে না। এখনও।
লালু বড় গাছটার আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। কে কোন্ উদ্দেশ্যে আসছে কে জানে।
ক্রমে আলো-আঁধারি থেকে বেরিয়ে এল একজন মানুষ।
মালকোঁচা মেরে ধুতি পরা, খালি গা, মুখ-ভরতি দাড়িগোঁফ, মাথায় একটা গামছা জড়ানো। এবার তার গান একটু একটু বোঝা যাচ্ছে।
মরলেম ভূতের বেগার খেটে
আমার কিছু সম্বল নাইকো গ্যাঁটে।
নিজে হই সরকারি মুটে মিছে মরি ব্যাগার খেটে
আমি দিন মজুরি নিত্য করি পঞ্চভূতে খায় গো বেঁটে…
লালু ভাবল, এ আবার কেমনতরো গান? কোনও যাত্রাপালায় কিংবা বাউল-ভিখিরির মুখে সে এমন গান শোনেনি।
লোকটির হাতে একটা লম্বা লাঠি, কোমরে দা বা কুড়ুলের মতন একটা কিছু গোঁজা।
তা দেখে একবার গা-টা ছমছম করে উঠল লালুর। কোনও হিংস্র মানুষ? কী উদ্দেশ্যে এসেছে এখানে?
লোকটা গান গাইতে গাইতে একটু একটু নাচছেও বটে। আর চুমো খাচ্ছে লাঠিটার ডগায়।
হিংস্র মানুষরা কি গান গেয়ে নাচে? ওর সঙ্গে আর কেউ আছে কি না তা দেখার জন্য নিঃসাড়ে অপেক্ষা করতে লাগল লালু। খানিক বাদে বোঝ গেল, আর কেউ আসেনি। এ লোকটির চেহারাও তেমন বড়সড় নয়। লালুর চেয়ে মাথায় বেশ ছোট। লালুকে মারতে এলে সুবিধে করতে পারবে না। লালুর হাতেও লাঠি আছে। আর বিনা কারণে মারবেই বা কেন? লালু কী। দোষ করেছে?
লোকটি গান থামিয়ে একবার হেঁকে বলল, আরেঃ গেল কোথায়? এইহানেই তো লুকে দ্যাখছিল তারে।
এবার লালু বেরিয়ে এল গাছের আড়াল থেকে।
লোকটি বলল, এই যে বাপধন। আছিলা কোথায়? ওরেঃব্বাইশ রে, হাতে দেখি একখান যমদণ্ড! মারবাটারবা না তো?
লোকটি মাথায় এক হাত দিয়ে পিছিয়ে গেল খানিকটা।
লালুর হাসি পেয়ে গেল। একটু আগে সে সশস্ত্র লোকটিকে দেখে ভয় পাচ্ছিল, এখন লোকটিই তার হাতে লাঠি দেখে ভয় পাচ্ছে।
লালু বলল, না, না।
লোকটি বলল, কওয়া তো যায় না কিছু। পাগল-ছাগলে কখন কী করে বিশ্বাস নাই। শোনো, তুমিও একখান পাগল, আমিও একখান পাগল। পাগলে পাগলে কাজিয়া করে না।
লালু বলল, আমি কেন পাগল হব? মোটেই না।
লোকটি বলল, গেরামের মানুষ যে কইল, জঙ্গলে একখান পাগল আইস্যা। গাছতলায় বইয়া রইছে! তাই দেখতে আইলাম। আমি কিন্তু সত্যিই পাগল। আমার নাম আগে আছিল সুলেমান মির্জা, পরে লোকে নাম দিল কালুয়া মির্জা। এখন সবলোকই কয় শুধু পাগল।
লালু তবু জোর দিয়ে বলল, তুমি পাগল হইতে পারো, আমি মোটেই পাগল না।
কালুয়া মির্জা ফিক করে হের্ষে বলল, সব পাগলই ভাবে, আমি পাগল না, খুব শেয়ানা। এই ভবের বাজারে কে যে পাগল না, তা বোঝাই শক্ত। তোমার নাম কী?
লালু তৎক্ষণাৎ তার নামটা বদলে ফেলল। সে এখন নতুন মানুষ, তার নতুন নাম দরকার। প্রায় কিছুই না-ভেবে সে বলল, লালন।
লোকটি বলল, হিন্দু না মোছলমান?
লালন বলল, সেটা জানা বুঝি খুব দরকার?
লোকটি বলল, তাই তো দেখি সবখানে। নতুন লোক দেখলেই মনে প্রশ্ন জাগে, মোছলমান না হিন্দু? মোছলমান হইলে এক রূপ ব্যবহার, আর হিন্দু হইলে অইন্য রকম।
লালন বলল, চেহারা দেখলেই কি জাতধর্ম বোঝা যায়?
কালুয়া বলল, তা কিছু কিছু বোঝা যায় তো বটে।
লালন বলল, এইটাই তো বুঝি না আমি। হিন্দুরা গলায় মালা দেয়। আর মোছলমানরা দেয় তছবি। ছুন্নত দিলে মোছলমান হয়, আর বামুনের গলায় থাকে পইতা। কিন্তু বামনিদের গলায় তো কিছু থাকে না আর মোছলমান মাইয়াদেরও ছুন্নত হয় না। তাইলে স্ত্রীলোকের কি জাতধর্ম নাই?
কালুয়া বলল, রাখো ওই সব কথা মাইয়া মানুষদের নাম শোনলেই বোঝা যায়। তবে, তোমার নাম লালন, তোমার নামটা যেন কেমন কেমন। মোছলমান বলেই মনে লয়। নবাব সেরাজউদুল্লার জবাইয়ের পর এই দ্যাশে মোছলমানের মধ্যে পাগলের সংখ্যা দিন দিন বাড়তেছে। জানো তো, দিল্লির বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফরও গোল্লায় গেছেন।
লালন বলল, দোস্ত, আমি অনেক কিছুই জানি না। আমি হিন্দু না মোছলমান তাও বুঝি না।
এবারে কালুয়া একেবারে কাছে এসে বলল, যখন আমারে দোস্ত কইলা, তখন হাতে হাত মিলাও। পাগলের আবার জাত-ধর্ম কী? সব সমান।
হাতের লাঠিটা তার এক হাঁটুর চাপ দিতেই সেটা দুটুকরো হয়ে গেল। এক টুকরো সে তুলে দিল লালনের হাতে।
এতক্ষণ লালন লক্ষ করেনি, যেটাকে সে লম্বা লাঠি ভাবছিল, সেটা আসলে একটা আখ।
তৎক্ষণাৎ লালনের একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল। মানুষের চোখকেও তা হলে বিশ্বাস করা যায় না। চক্ষু যা দেখে, তা বাস্তব সত্য নাও হতে পারে। যেটাকে মনে হচ্ছিল লাঠির মতন একটা অস্ত্র, সেটা আসলে ঠিক বিপরীত, একটা রসালো খাদ্য। এই রকমই তো মানুষ রঞ্জু দেখে সর্প ভ্রম করে।
আখের টুকরোটা হাতে নেওয়ামাত্রই লালনের পেটে দাউদাউ করে জ্বলে উঠল খিদে। সে আখটা প্রায় না-ছুলেই চিবোতে শুরু করল। সুমিষ্ট রস তার কণ্ঠনালি থেকে বয়ে এক পবিত্র ঝরনার মতন নামতে লাগল তার জঠরে।
কালুয়া বলল, শোনো, আমি পাগল বলে গ্রামের লোক আমারে যখন তখন খোঁচাখুঁচি করে। পোলাপানেরা আমার ভাতের পাত্র লাথি মাইরা ফেলাইয়া দেয়। কারুর ক্ষতি করি না, তবু এত জ্বালায়। তাই তোমার কথা শুনে ঠিক করলাম, জঙ্গলে এসে দুই পাগলে একসাথে থাকব। সেইডাই ভালো না, কী কও?
লালন বলল, তোমার কথা শুইন্যা তো তোমারে একটুও পাগল মনে হয়?
কালুয়া বলল, দ্যাখবা, দ্যাখ, আমি মাঝে মাঝে বদ্ধ পাগল হয়ে যাই। কিছুর হুঁশ থাকে না। আমি তখন বিশ্ব-সংসার ওলটপালট করি। তুমি সেই কালে আমারে সামলাইতে যাইও না, দূরে পলাইয়া থেকো! এক-দুদিন পর আবার ঠিক হয়ে যাই।
লালন বলল, কিন্তু আমরা জঙ্গলে থাকলে খাব কী? এইটুকখানি আখের রস খেয়েই আমার দারুণ ক্ষুধা বৃদ্ধি হয়েছে। আমি সত্যিই পাগল না। যার ক্ষুধা-তৃষ্ণা থাকে, সে কি পাগল হয়?
কালুয়া বলল, হবে না কেন? পাগলের ক্ষুধা-তৃষ্ণা থাকে, কামনা-বাসনা থাকে, পাগলেও গান গায়। খাওয়ার ব্যবস্থা আমিই করুম। তাগদ থাকলেই খাদ্য জুটে যায়।
কোমর থেকে একটা কুড়ুল বার করে সে জিজ্ঞেস করল, তুমি বাঁশ কাটতে জানো?
লালন বলল, বাঁশ? না, কাটি নাই কখনও।
কালুয়া বলল, ঠ্যালায় পড়লে শিখতে আর কতক্ষণ লাগে? এই জঙ্গলে অনেক বাঁশঝাড় আছে। গেরামের হাটে বাঁশ ভালো দামে বিকোয়। মাঝে মাঝে বাঁশ বেঁচে চাউল-ডাইল খরিদ করে আনব। তার আগে নিজেদের জন্য একটা ঘর বান্ধা দরকার। বৃষ্টির সময় মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই চাই না! পাগল হবার আগে আমি ছিলাম ঘরামি। খুব ভালো ঘর বান্ধতে জানি। তোমারে শিখায়ে দেব।
মাঝে মাঝে গেরামে গেলে ঘরামির কাজের অভাব হয় না। মানুষের যেমন অনবরত ঘর ভাঙে, তেমনই নতুন ঘর ব্যানাবার মোহ থাকে।
লালন বলল, তুমি তো বেশ কথা কও।
কালুয়া একগাল হেসে বলল, এতক্ষণ নিজের নাম মনে থাকে, ততক্ষণই। আর যখন খেপি, মাথায় ভূত চাপে, তখন বৃক্ষেরে ভাবি তৃণ, আর ঘাসের ডগায় এক বিন্দু পানি দেখলেও মনে হয় আসমানের তারা। মা কালীরে মনে হয় খোদা, আর খোদারে মনে হয় মা কালী। আরে ছি ছি ছি ছি, এইসব কথা শোনলে লোকে আমারে মারবে না? বেশ করবে মারবে।
লালন শঙ্কিতভাবে বলল, তুমি মোছলমান হয়েও কালী ভক্ত?
কালুয়া বলল, সেই পাপেই তো আমার মৃত্যু হবে। ভালো করেই জানি। তুমি কালী ঠাকুরের মূর্তি দেখেছ ভালো করে?
লালন বলল, ভালো করে, কাছ থেকে কখনও দেখি নাই। আমি যে-গেরামে আছিলাম, সেখানকার বেশির ভাগ মানুষই বৈষ্ণব। গৌর-নিতাইয়ের ভজনা করে। কালীপূজা হয় না।
কালুয়া বলল, ভালো করে দেখলে বুঝতে, ঐ মূর্তির মধ্যে কেমন যেন একটা টান আছে, মনটারে খাঁচার পক্ষীর মতন দোলায়, আমি চক্ষু ফিরাতে পারি না। সেজন্য বাড়িতেও অনেক মাইর খাইছি। শুনছি কী জান, ত্রিপুরা। নামে একটা রাজ্য আছে, সেখানে কিছু কিছু মোছলমানও কালীপূজা করে। আমাগো দেশে কেউ তা সহ্য করে না। হিন্দুরাও আমারে দেখলেই দূর দূর করে। কিন্তু মাঝে মাঝে আমার কী ইচ্ছে করে জান, একটা কালী ঠাকুরের মূর্তি চেটে চেটে একেবারে খেয়ে ফেলি। তাইলে হিন্দুরাও আমারে পিটায়ে শেষ করবে, আর মোছলমানরাও খুন করবে।
লালনের চক্ষু দুটি গোল গোল হয়ে গেল। এ ধরনের কথা সে কখনও শোনোনি। এবারে কি এই লোকটির পাগলামি শুরু হল নাকি?
কালুয়া এক হাত তুলে অভয় দিয়ে বলল, না, না, ঠিক আছি। চলো, বাঁশের ঝাড়ের খোঁজ করি।
কিন্তু তখনই যাওয়া গেল না, অকস্মাৎ শুরু হল ঝড়-বৃষ্টি। জঙ্গলের মধ্যে বৃষ্টি আর লোকালয়ের মধ্যে বৃষ্টি তো এক রকম নয়। বজ্র-গর্জনও অন্য প্রকার।
আখের রসটুকু ছাড়া সেদিন লালনের আর কোনও খাওয়া জুটল না। কিন্তু এখন সে ক্ষুধার তীব্র কষ্ট পেতে শুরু করেছে।
এত বৃষ্টির মধ্যে কিছুই করার থাকে না। দুজনে শুয়ে রইল পেটে কিল মেরে। মাঝে ঘুম, আবার জাগরণ, আবার ঘুম। গাছতলায় শুয়েও বৃষ্টির দাপট থেকে নিষ্কৃতির কোনও উপায় নেই।
পরদিন ঊষার আলো নিয়ে এল একটা নতুন ভোর। আর বৃষ্টি নেই। আকাশ একেবারে ঠাকুর দালানের মতন দেওয়া মোছা।
জেগে উঠে লালন দেখল, কালুয়া শেখ তখনও ঘুমন্ত, কিন্তু তার ঠোঁটে লেগে আছে হাসি। কিছু একটা সুখস্বপ্ন দেখছে বোধহয়।
লালন তাকে জাগাল না।
সে জোরে জোরে টাটকা বাতাসের নিশ্বাস নিল কিছুক্ষণ গলায় একটু একটু ব্যথা। এরকম বৃষ্টিতে ভিজলে সান্নিপাতিক হয়, তাতেও মানুষ মরে।
একসময় পাশের ডোবায় হাত-মুখ ধুয়ে এল। ততক্ষণে কালুয়া জেগে উঠেছে। ফাঁকা দৃষ্টিতে লালনের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কে?
এই রে, কাল রাতের কথা সব ভুলে গেছে নাকি!
লালন বলল, আমি একজন মানুষ!
এ কালুয়া বলল, মানুষ? সাচাই নাকি? তুমি পা দুইখান উপরে আর মাথা নীচে, এইভাবে হাঁটতে পারো?
লালন বলল, না। এইটা বুঝি মানুষের কাজ?
কালুয়া বলল, তুমি পারো না, দ্যাখো, আমি পারি।
একবার ডিগবাজি খেয়ে সে পা দুটো তুলে দিল শূন্যে, মাথাটা ঝুলে রইল নিচে, সেই অবস্থায় দুহাতে ভর দিয়ে চলে গেল খানিকটা।
আবার সোজাভাবে দাঁড়িয়ে সে বলল, তুমি যে কইলা, তুমি মানুষ, তুমি কী পারো?
লালন বলল, আমি একটা অকর্মার ধাড়ি। আমি কিছুই পারি না।
কালুয়া বলল, ও, মনে পড়ছে। তুমি তো একখান পাগল। এই জঙ্গলে থাকো। চলো, তোমারে কাজ শিখায়ে দেব।
তার মাথায় যে-গামছাটা জড়ানো ছিল, সেটাও জলে ভিজে চুপচুপে। তবু সেটা দিয়েই সে মুখ-মাথা মোছার চেষ্টা করতে লাগল।
এ-বনে সত্যিই বাঁশ ঝাড়ের অভাব নেই। এক এক স্থানে অন্য গাছ প্রায়। নেই বললেই চলে, শুধু বাঁশবন। শেয়ালেরা এর মধ্যেই গর্ত খুঁড়ে থাকে। দু-চারটে পালাল এদিক-ওদিক। একটু দূরে কোথাও কা কা করে ময়ূর ডাকছে।
কালুয়া অভিজ্ঞ হাতে এক-একটা বাঁশের গায়ে চাপড় মেরে দেখতে দেখতে এগোচ্ছে। বাঁশ চেনা সহজ নয়, কোন বাঁশের কত বয়স তা বুঝতে হয়। সেই জন্যই বোধহয় কথায় বলে, বাঁশবনে ডোম কানা।
বাঁশেরও যে অনেক জাত আছে, তা লালন জানত না। কালুয়া তাকে বোঝাচ্ছে, পারুয়া, রুপাই, মাকাল বাঁশ, এইরকম বিভিন্ন নাম। এইসবের মধ্যে মুলি বাঁশ বেশি ভালো।
একটা জায়গা পছন্দ করে কালুয়া তার কুড়ুলটা লালনের হাতে দিয়ে বলল, প্রথমটা তুমি কাটো! এই গোড়া থেকে কাটতে হবে। নজর ঠিক রাখো। প্রথমে উপর দিক থেকে এক কোপ মারবে, তারপর নীচের দিক থেকে।
দ্বিতীয় কোপেই লালনের হাত থেকে কুড়লটা ছিটকে পড়ে গেল।
কালুয়া হেসে বলল, অত সহজ না। তাগৎ লাগে। মায়ের দুধ খাও নাই? শিশু বয়সে মায়ের দুধ খেয়েছে কি না তা মনে নেই লালনের, কিন্তু কয়েকটা দিন যে সে সম্পূর্ণ অনাহারে রয়েছে, তা তো অন্য মানুষটি জানে। না। সে কথা সে বলল না, আবার শুরু করল নবোদ্যমে।
প্রথম বাঁশটি ভূমিসাৎ করার পর তার বুকটা আনন্দে ভরে গেল। এই প্রথম সে যেন সার্থক হল একটা কিছুতে। পরিশ্রমে তার দুর্বল শরীরটা কাঁপছে। বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটেছে সারা মুখে!
কালুয়া বলল, থামলে হবে না, আবার আর একখান।
লালন খেটে চলেছে, কালুয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে এদিক-ওদিক।
কোনও কোনও বাঁশের গায়ে জড়িয়ে আছে এক রকমের লতানে গাছ, বড় বড় পাতা। কালুয়া একটা পাতা ছিঁড়ে মুখে দিল। খানিকটা চিবিয়ে আপন মনে বলল, হু। মজা তো মন্দ না।
আর একটা পাতা ছিঁড়ে এনে সে লালনকে বলল, এইডা খাইয়া দ্যাখো তো মিঞা।
লালনের তেঁতুল পাতা খাওয়ার অভিজ্ঞতা ভালো নয়। সে ইতস্তত করতে লাগল।
কালুয়া ধমক দিয়ে বলল, খাও।
পাতাটা চিবোতে চিবোতে লালনের মনে হল স্বাদটা যেন চেনা চেনা। একটু একটু ঝাঁঝ, আবার মিষ্টত্বও আছে।
কালুয়া জিজ্ঞেস করল, এটা কীসের পাতা, বুঝলা কিছু?
লালন দুদিকে মাথা নাড়ল।
কালুয়া বলল, পান, পান, জংলি পান। সোয়াদ কিন্তু খারাপ না। তুমি আগে কখনও পান খাও নাই?
দীন-দুঃস্থ পরিবারে পান খাওয়া তো বিলাসিতা। বড় মানুষেরা খায়। লালন জীবনে একবারই একখিলি সাজা পান খেয়েছে। তার মামা বাড়িতে মাতামহের মৃত্যুর পর ধুমধাম করে শ্রাদ্ধ হয়েছিল, নেমন্তন্ন। খেয়েছিল গোটা পঞ্চাশজন। সেদিন লালনও পেট ভরে মণ্ডা-মেঠাই খেতে পেয়েছিল আর এক খিলি পানও জুটেছিল।
কালুয়া বলল, পানের দাম আছে। মেদিনীপুরের মানুষেরা পানের চাষ করে, তারে কয় পানের বরজ। জঙ্গলের মধ্যে বিনা পয়সার পান পাওয়া ভাগ্যের কথা। এখানেও তাইলে পানের চাষ করা যায়।
পট পট করে কয়েকটা পানপাতা মুখে দিতে দিতে সে আবার বলল, খাইয়া ল, খাইয়া ল, যে কয়টা পাবোস।
এবার লালন বেশ কৌতুক বোধ করল। সেই শ্রাদ্ধবাড়িতে লালন শুনেছিল যে, বেশি খাওয়া-দাওয়ার পর পান খেলে নাকি তাড়াতাড়ি সব হজম হয়। এখন তার পেটে এক দানা খাদ্যও নেই, এখন পান খেয়ে কী হজম করবে? নাড়ি-ভুঁড়ি হজম হয়ে যাবে নাকি?
কালুয়া জোরে গান গেয়ে উঠল, ওই যে পান বেঁচে খায় কৃষ্ণপান্তি তারেও দিলে জমিদারি…
লালন বলল, এ আবার কী গান? তুমি নিজে গান বানাও নাকি?
কালুয়া বলল, শোনো পাগলের কথা। আমার কি সে খ্যামতা আছে! মুখ্যুসুখ মানুষ। কোথায় যেন শুনছি, মনে গেঁথে যায়।
লালন বলল, তার পর কী?
কালুয়া বলল, সব মনে নাই। দুই চাইর ছত্তর…
প্যাদার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তার নামেতে
নিলাম জারি
ওই যে পান বেঁচে খায় কৃষ্ণপান্তি তারেও
দিলে জমিদারি
হুজুরে দরখাস্ত দিতে কোথা পাব টাকা কড়ি
আমারে ফিকিরে ফকির বানায়ে বসে আছ রাজকুমারী…
কোনও ফকিরের গান মনে হয়। মোটকথা, বুঝলি তো, পান বেঁচেও জমিদার হওন যায়।
পানের রসে লালনের গলার ব্যথার বেশ আরাম হল।
মোট বাঁশ কাটা হল দশখানা। আর বেশি কেটে লাভ নেই, বয়ে নিয়ে যেতে হবে তো।
অনেক আগেই লালনের হাত থেকে কুলখানা নিজে নিয়েছিল কালুয়া। তার হাত অনেক দ্রুত চলে। বাঁশগুলোর ডগা আর ডালপালা হেঁটে সে সমান মাপের করে নিল। তবু, দশখানা বাঁশ দুজনে বইবে কী করে?
মোটা মোটা কিছু লতা জোগাড় করে কালুয়া সব বাঁশগুলো গোছ করে বাঁধল। এবারে মাটিতে ফেলে দুজনে একসঙ্গে টানবে। বেশ কিছু পান। পাতাও সংগ্রহ করে নিল কালুয়া। ৩
গ্রামের হাটে পৌঁছোতে পৌঁছোতে বিকেল হয়ে গেল। তখন প্রায় ভাঙা হাট। তবু বাঁশগুলো বিক্রি হয়ে গেল অল্পক্ষণের মধ্যে। কালুয়া পানের গগাছের বদলে একসের ছোলা নিয়ে এল একটা মুদিখানা থেকে।
পাগলামির কোনও লক্ষণই নেই কালুয়ার। বেশ দরদামও করতে জানে।
এবার সে খরিদ করল কয়েকটা মাটির হাঁড়ি, মালসা ও কাঠের হাতা। সেগুলো সে চাপাল লালনের ঘাড়ে। নিজের গামছার দুদিকে বেঁধে নিল কয়েক সের চাল ও ডাল। দুখণ্ড চকমকি পাথরও যেন সে জোগাড় করল কোথা থেকে।
তারপর বলল, এইবার চলো। জঙ্গলে গিয়া আমরা জংলি থাকুম না, সংসার পাততে হবে।
ফিরতে হবে অনেকটা পথ। লালন যেন আর খিদে সহ্য করতে পারছে না সে মৃদু স্বরে বলল, আর একখান আউখ পাওয়া যায় না?
কালুয়া বলল, আর তো পয়সা-কড়ি নাই। তবু চলো, দেখি।
হাটের একপাশে এক ব্যাপারী বিক্রি করছে আখ, নারকোল, মানকচু এইসব। আলো পড়ে আসছে, সবাই ঘরে ফেরার পথ ধরেছে, আর খরিদ্দার। পাওয়া দুষ্কর।
ব্যাপারীর দিকে তাকিয়ে কালুয়া খুবই মোলায়েম গলায় বলতে লাগল, ভাইজান, একটা কথা কব? আইজ তো আর…
লালন তার হাত চেপে ধরে বলল, না। থাউক! চাই না। চলো—
তারদিকে কয়েক পলক অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকার পর কালুয়ার মুখ হাসিতে ভরে গেল। সে বলল, বুঝছি। ভিক্ষা করা যাবে না। প্রাণ যায় যাউক, তবু মান যেন থাকে। ঠিক। ঠিক ঠিক ঠিক। ঠিকের উপর ঠিক। একশোবার ঠিক। রসুল ছাড়া আর কাউর কাছে ভিক্ষা চাইতে নাই।
আশেপাশে পড়ে আছে মানুষের ফেলে যাওয়া কয়েকটা আখের টুকরো। আধ-খাওয়া একেবারে গোড়ার দিকটা শক্ত বলে অনেকে চিবোতে পারে না।
সেরকম দু-তিনটে টুকরো তুলে নিয়ে সে বলল, এগুলি খাওনে দোষ নাই। এ হইল পথের দান। আমরাও পথের মানুষ।
হাট থেকে বেরিয়ে যেতে গিয়েও একদিকে তাকিয়ে থেমে গিয়ে কালুয়া বলল, এই দুনিয়ায় আমাগো থেইক্যা আরও কত বড় পাগল আছে, দ্যাখবা? চলো দেখে যাই।
সেখানে দশ-বারোজনের ভিড় জমেছে, আর তাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন এক দীর্ঘকায় শ্বেতাঙ্গ পাদরি। তাঁর পরনে লম্বা সাদা জোব্বা, চুল-দাড়িও ধবধবে সাদা। হাতে একখানা কেতাব নিয়ে তিনি গদগদ স্বরে বলছেন, তোমা সব পাপী… নরকের দ্বার… প্রভু যিশু… পরম কল্যাণময়… আইস শরণ লও…
সাহেবের ধারণা, তিনি খুব শুদ্ধ বাংলা বলছেন, কিন্তু তাঁর উচ্চারণের জন্য এই শ্রোতারা প্রায় কিছুই বুঝতে পারছে না। তারা দাঁড়িয়ে আছে, এত কাছ থেকে শাসক জাতির একজন মানুষকে দেখার কৌতূহলে। মাঝে মাঝে ঘোড়ার পিঠে, চাবুক হাতে নীলকর সাহেবদের দেখা যায়। তাদের দেখলেই বুক কাঁপে। কিন্তু এই পাদরি সাহেবকে দেখলে বরং মায়া লাগে, ঘামে ভিজে তার গায়ের জামা লেপটে গেছে গায়ের সঙ্গে।
কালুয়া বলল, এমন পাগল দ্যাখছো আগে? সাত সমুদ্র পার হইয়া আইছে, আমরা নাকি সব পাপী, আমাগো উদ্ধার করবে? হাঃ হাঃ হাঃ! আরে বাপু, তোমার জাইত ভাইদের মতন, আমাগো চাবুক মারো, ঘরে আগুন দাও, গারদে ভরো, তার মানে বুঝি! জোর যার মুল্লুক তার। সোনাদানা যা আছে, নিয়া যাও! ধম্মের কথা আমারে কও ক্যান? তুমি যিশুর নাম জানো?
লালন বলল, হ জানি। সিরাজ সাঁই-এর কাছে শুনেছি।
কালুয়া অবাক হয়ে বলল, সিরাজ সাঁই? তুমি তারে চেনো নাকি!
লালন বলল, একবার দেখছি।
কালুয়া বলল, আরে ওই সিরাজ সাঁই-ই তো আমারে পাগল করিছে। একসময় কবো তোমারে তাঁর কথা। এখন চলো, আর দেরি করা যায় না। অন্ধকারে জঙ্গলের পথ…
হাটের এক ধারে গোরু, ছাগল, ঘোড়াও বিক্রি হয়। দুটো ঘোড়া বিক্রি হয়নি, তার ব্যাপারী ফিরে চলেছে।
ঘোড়া দুটির দিকে লালন সতৃষ্ণ নয়নে চাইল। ঘোড়া দেখলেই তার মনটা চনমন করে। কতদিন ঘোড়ায় চাপেনি। কবিরাজ মশাই বলেছিলেন, নিজে উপার্জন করে ঘোড়া কিনতে হয়। নইলে কপালে দুঃখ আছে। ঘোড়া কেনার সামর্থ্য তার কোনও দিনই হবে না। দুঃখ তার চিরসঙ্গী হয়ে থাকবে।
একটা ছোট নদীর ওপরে বাঁশের সাঁকো। সেটা পেরিয়ে ওপারে যেতেই দেখা গেল, পথের এক ধারে উপুড় হয়ে পড়ে আছে একজন উলঙ্গ মানুষ। জীবিত না মৃত বোঝা যায় না। সরু পায়ে চলা পথ দিয়ে এখন সঙ্গে অনেক হাট-ফেরতা মানুষ, কেউ তার দিকে ক্ষেপও করছে না।
লালন থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। কালুয়া বলল, আহা রে। একদিন আমায়ও এই দশা হবে আমি জানি। রাস্তার ধারে পইড়া থাকব। কুকুর-বিড়ালেও ছোঁবে না।
লালন হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে লোকটিকে উলটে দিল। চমকে গিয়ে দেখল, লোকটি মৃত তো নয়ই, অজ্ঞানও নয়। চোখ চেয়ে আছে, পলকও পড়ল। কালুয়া তাড়া দিয়ে বলল, চলো, চলো, নেশা-ভাঙ করছে বোধহয়। লোকটি খুব ক্ষীণস্বরে বলল, সুলেমান ভাই, আমারে বাঁচাও। কালুয়া বলল, এই দ্যাখো! এই ঘাটের মড়া আমার নাম জানল ক্যামনে?
লালন লোকটিকে ধরে ওঠাবার চেষ্টা করল, পারল না।
সে কালুয়াকে বলল, তুমিও হাত লাগাও। এরে খাড়া করাই।
কালুয়া বলল, এরে তুইল্যা কী হবে? এখনও শ্বাস আছে, কিন্তু বাঁচনের আশা নাই। দ্যাখো না, মুখখান কালিবর্ণ। এর শিয়রে শমন।
লালন এবার প্রায় ধমক দিয়ে বলল, যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ, তুমি জানো না? ধরো, হাত লাগাও।
দুজনে ধরাধরি করে তুলল বটে, কিন্তু লোকটির নিজের পায়ে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। প্রায় ফিসফিস করে বলল, সুলেমানভাই, আমারে চিনলা না? আমি কাশেম।
কালুয়া বলল, না, চিনি না। আমি তো এহন পাগল। পুরানো কোনও কথাই মনে নাই। তোর কী হইছে?
লোকটি বলল, আমারে মারছে।
কালুয়া জিজ্ঞেস করল, কে মারছে?
লোকটি বলল, অরা।
কালুয়া আবার জিজ্ঞেস করল, অরা মানে কারা? কেন মারছে?
লোকটি বলল, রোজ মারে। আমারে মেরে ফেলাবে।
কালুয়া অধৈর্য হয়ে বলল, কী জ্বালা! কে মারছে, কেন মারে কবি তো!
লোকটি আবার বলল, মারছে। খুব মারছে।
কালুয়া লালনকে বলল, দোস্ত, এভা পেরানে বাঁচলেও পাগল হবার দেরি নাই। আমরা এডারে নিয়া কী করব?
লোকটি বলল, এটু পানি। বুক ফাইট্যা যায়।
লোকটিকে ধরে রাখার ভার কালুয়াকে দিয়ে লালু সাঁকোর নীচ থেকে মাটির হাঁড়ি ভরতি জল নিয়ে এল।
লোকটি চোঁ চোঁ করে অর্ধেক হাঁড়ি জলই খেয়ে নিল। বাকিটা জল ঢেলে দিল নিজের মাথায়।
লালন বলল, তোমার বাড়ি কোন গেরামে? আমরা তোমারে দিয়া আসতে পারি।
লোকটি মাথা নেড়ে বলল, আমার গেরাম নাই। বাড়ি-ঘর সব গাছে। আমারে দ্যাখলেই অরা মারবে আবার। তাইলে আমি কোথায় যাই? তুমি ততা সবই জানো সুলেমান ভাই।
কালুয়া বলল, আমি কিছুই জানি না। আমি সুলেমান না, আমার নাম কালুয়া। তুই যদি গেরামে যাইতে না পারোস, জঙ্গলে গিয়া থাক। আমাগো মতন।
লালুকে সে জিজ্ঞেস করল, এরে আমাগো সাথে জঙ্গল নিয়া যাব নাকি? তুমি কী কও?
লালু বলল, আমারে জিগাও ক্যান। আমি কি জঙ্গলের মালিক? কে মালিক, তাও আমি জানি না। যার ইচ্ছা সেই জঙ্গলে গিয়া থাকতে পারে।
কালুয়া এবার লোকটিকে জিজ্ঞেস করল, কী রে, যাবি? হাঁটতে পারবি? ঘাড়ে কইরা তো নিতে পারব না। লোকটি বলল, আমি এখন যাব না। আর একজন… তোমরা আমারে ওই গাছতলায় বসাইয়া দ্যাও। পানি খাওয়াইলা, আল্লা তোমাদের মঙ্গল করবেন। আমি এখন ঠিক আছি।
ওকে বসিয়ে দেওয়া হল একটা বটগাছের তলায়।
কালুয়া বলল, শোন, যদি জঙ্গলে যাইতে ইচ্ছা হয়, এই রাস্তা দিয়া যাবি, জঙ্গলের মধ্যে যেইডা সব থিকা বড় আর উঁচা শিমুলগাছ, তার ধারে আমাগো দেখতে পাবি।
লোকটি বলল, কী জানি, দেখি কী হয়!
আর একটু পরে কালুয়া আর লালন রওনা দিল।
অন্ধকার হয়ে গেলেও ওরা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে নির্বিঘ্নেই পৌঁছে গেল নির্দিষ্ট স্থানে। তারপর দুজনেই কাজে লেগে গেল দ্রুত।
মাটিতে গর্ত খুঁড়ে, শুকনো পাতা আর কাঠ-কুটো জোগাড় করে এনে জড়ো করা হল সেখানে। চকমকি ঠুকে আগুন জ্বেলে ফেলল কালুয়া। কাছের ছোট জলাশয় থেকে এক হাঁড়ি জল নিয়ে এল লালন, তার মধ্যেই কালুয়া একটা উনুন বানিয়ে ফেলেছে কোনওরকমে।
অন্য হাঁড়িটায় চাল আর ডাল একসঙ্গে মিশিয়ে চাপিয়ে দেওয়া হল। দুজনে বসে রইল উনুনের দুপাশে। খিচুড়ি রান্নার জন্য খুব একটা রন্ধন বিদ্যা জানার দরকার হয় না। মশলাপাতি ব্যবহারের প্রশ্নই নেই, নুন ছাড়া আর আনা হয়নি কিছুই।
কিছুক্ষণ পরেই খিচুড়ির গন্ধ পাওয়া গেল।
এই রাত্তিরে আর কলাপাতা পাওয়া যাবে কোথায়। কাছাকাছি কলাগাছ নেই ওরা জানে। কাল দেখা যাবে। ওরা আর ধৈর্য ধরতে পারছে না। দুজনেই। হাঁড়ির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে খিচুড়ি খেতে লাগল গরম গরম।
একটু পরে থেমে গিয়ে কালুয়া বলল, ছয়। তুই কয়বার?
লালন বলল, গুনি নাই তো।
কালুয়া বলল, এইবার থিকা তুই একবার, আমি একবার। ইস, কয়েকখান কাঁচা মরিচ পাইলে কী ভালোই হইত রে!
তারপর সে গান ধরল, ডাইল রান্ধো রে, কাঁচা মরিচ দিয়া। গুরুর কাছে। লওয়া মন্তর বিরলে বসিয়া। ও মন ডাইল রান্ধো রে…
গান থামিয়ে সে বলল, আমার মা কইত, খাইতে খাইতে গান গাইলে বউ পাগল হয়! হায় রে কপাল, আমার বউ জুটল না, আমিই হইলাম পাগল।
নিজের রসিকতায় সে নিজেই হেসে উঠল।
প্রায় এক হাঁড়ি খিচুড়ি শেষ হতে দেরি হল না।
তৃপ্তির ভেঁকুর তুলে কালুয়া বলল, কী ক্ষুধাই পাইছিল, আর একটু হইলে বাপের নাম ভুইল্যা যাইতাম।
লালন বলল, আত্মার শান্তি হইল। এত ভালো খিচুড়ি আমি জন্মে খাই নাই।
আরও কাঠ এনে ঠেসে দেওয়া হল আগুনে। এই আগুন সারারাত জ্বললে জন্তু-জানোয়ার আসবে না।
সেই আগুনের দুপাশে শুয়ে দুজনে এক ঘুমে কাবার করে দিল রাত। সকাল থেকেই কাজ-কর্ম শুরু হয়ে গেল।
প্রথম কাজই হল, আরও বাঁশ কেটে বয়ে আনা। আগে ঘরের মতন ছাউনি বানাতে হবে। নইলে এই বর্ষার মধ্যে জঙ্গলে টেকা যাবে না।
কালুয়া না-থাকলে লালনের পক্ষে একা ঘর বানানো সম্ভব হত না বোধহয়। কালুয়া এ-কাজ সত্যিই ভালো জানে, সে পাকা ঘরামি। লালনের খালি আশঙ্কা, কালুয়া কখন পাগলামি শুরু করবে। এতক্ষণ পর্যন্ত সেরকম কোনও লক্ষণ দেখা যায়নি। শুধু মাঝে মাঝে বিচিত্র সব গান গেয়ে ওঠে।
তৃতীয় দিনে, তখনও ঘর তৈরির কাজ চলছে, বিকেলের দিকে দেখা গেল, একজন রমণীর কাঁধে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আসছে একজন পুরুষ।
ঘর্মাক্ত শরীরে, বিরক্ত হয়ে কালুয়া বলল, কী আপদ? এ আবার কারা আসে?
লালন বলল, এই মানুষটারেই তো দেখেছিলাম পথের পাশে শুয়ে থাকতে।
কালুয়া বলল, এখানে কে আসতে কইছে? আর মরার জায়গা পাইল না?
লালন বলল, বাঃ, তুমিই তো আসতে কইছিলা!
কালুয়া বলল, তাই নাকি? কিছুই মনে থাকে না। আমরা দুই পাগলেই তো বেশ শান্তিতে ছিলাম। অগো খেদামু? ভয় দেখামু?
লালন বলল, কেন, খেদাবে কেন? যার ইচ্ছা আসতে পারে। আমাগো চাইল-ডাইলে ভাগ না-বসাইলেই হইল।
কাছে আসার পর পুরুষটি বলল, সুলেমানভাই, আমি কাশেম। আইস্যা পড়লাম।
কালুয়া গম্ভীরভাবে বলল, বেশ করছো। রাত্তিরে কী খাবা? সে খেয়াল আছে? চাইল ডাইল আনছ? এহানে যার যার খাদ্য নিজের নিজের। আমাগো কোনও দায়িত্ব নাই।
রমণীটি বলল, নিজের নিজের কেন হবে? সঙ্কলডি একসাথে খাইতে পারি না? চাইল-ডাইল যথেষ্ট আনছি, চিড়া-মুড়ি-গুড়ও আছে।
কাশেম বলল, সুলেমানভাই, আপনে তো অরে চেনেন!
কালুয়া ধমক দিয়ে বলল, না চিনি না। আমি কারুকে চিনি না। আমি কারুর ভাই-টাইও না। আমি কোনও ব্রাহ্মণ কন্যার হাতে কিছু খাই না। তাতে আমার জাত যাবে।
লালন হেসে বলল, তুমি কইলা, তুমি চেনো না। তবে জানলে কী করে যে, ব্রাহ্মণ কন্যা?
রমণীটিও মুচকি হেসে বলল, আমারে চেনেন। আমার বাবা, ছোট। খুড়ারেও চেনেন।
ওদের সঙ্গে রয়েছে বেশ কয়েকটা পোঁটলাপুটলি। সেগুলি মাটিতে নামানোর পর রমণীটি লালনকে বলল, আপনেরও কি আমার হাতের কিছু। খাইলে জাত যাবে নাকি?
লালন বলল, হাতের বুঝি জাত থাকে? জাতের হাত থেকে বাঁচার জন্যই তো জঙ্গলে পলায়ে এসেছি।
সে আবার বলল, আমি কিন্তু পতিত।
কালুয়া চিৎকার করে বলল, আঃ, অত কথার কী আছে? এখন কাজের সময়। যাও দোস্ত হাত লাগাও। রাইতে আবার বৃষ্টি আসতে পারে।
ঘর বানাবার খুঁটি পোঁতা হয়ে গেছে। কাশ ছুলে ছুলে, লতার বাঁধন দিয়ে কালুয়া কোনওমতে একটা ছাউনি বানিয়ে ফেলেছে। সেটাই ধরাধরি করে চাপিয়ে দেওয়া হল ওপরে। একটা ঘর হল বটে, কিন্তু তার কোনও দেয়াল নেই, দরজা নেই। তবু বৃষ্টির সময় মাথা বাঁচানো যাবে।
রমণীটির নাম কমলি। তার বেশ ব্যক্তিত্ব আছে, শরীরও বেশ মজবুত। মাথায় চুল নেই, কদমছাট দেওয়া, তাতেই বোঝা যায়, সে হিন্দু ব্রাহ্মণ ঘরের বিধবা। চক্ষু দুটি টানা টানা। নাকও বেশ চোখা। বয়েস হবে বিশ বাইশ।
কাশেমের কোনও কাজ করার ক্ষমতা নেই। সে শুয়েই রইল। লালন আর কালুয়া যখন ঘর বাঁধায় ব্যস্ত, কমলি তখন পোঁটলাপুটলি খুলে সাজিয়ে ফেলল সব জিনিসপত্র। তারপর উনুনে রান্না চাপিয়ে দিল সে।
যেন এটা তার সংসার। অন্ধকার হয়ে যাবার পর সে সংসারের কর্ত্রীর মতনই অন্যদের ডাক দিয়ে বলল, সকলে খাইতে আসেন। বইস্যা পড়েন।
রান্না তো হয়েছে দুটো হাঁড়িতে, কিন্তু থালাবাসন তো নেই। আজও কলাপাতা জোগাড় করা হয়নি। খাওয়া হবে কীসে?
ডাল আর ভাত আলাদা রান্না হয়েছে। তার সঙ্গে আখের গুড়।
লালন বলল, ভাত আর ডাইল পৃথক রেখে কী হবে, এক হাঁড়িতেই ঢালল। পেটে গেলে তো সব একই হয়ে যাবে। এইজন্যই খিচুড়িতে সুবিধা। এই হাঁড়ির মধ্যে সকলে হাত ডুবায়ে ডুবায়েই খেতে হবে, তা ছাড়া তো উপায় নাই। কাইল অন্য ব্যবস্থা দেখা যাবে।
কমলি অবিশ্বাসের সুরে বলল, সকলে একসাথে খাবে?
লালন নিজেই ভাতের হাঁড়ির মধ্যে সব ডাল ঢেলে দিয়ে ঘেঁটে দিল। তারপর বলল, একসাথেই খাওয়া হবে, কেউ বেশি খাবে না, কমও না।
কালুয়া বলল, এই আমি শুরু করলাম।
কমলি হাত গুটিয়ে বসে রইল।
লালন তাকে বলল, নাও, শুরু করো।
কমলি জিভ কেটে বলল, মেয়েমানুষদের আগে খাইতে নাই। আগে পুরুষরা খাবে—
কালুয়া হুংকার দিয়ে বলল, চোপ। মেয়েমানুষ আবার কী! এখানে কেউ মেয়ে নাই, পুরুষ নাই। কেউ যেন এইসব কথা না-কয়।
লালন বলল, তুমি না-হাত দিলে আমরাও খাব না। হাত লাগাও!
এবারে চারটে হাত ঢুকল হাঁড়ির মধ্যে। অথচ কাড়াকাড়ি নেই।
কালুয়া একটু পরে বলল, ধুত্তোর! সোয়াদ নাই। রাঁধতে জানে না। মরিচ সম্ভার না-দিলে কি ডাইল হয়।
কমলি বলল, হাট থেকে মরিচ, হলদি আরও মশল্লা এনে দিয়ে। তখন দ্যাখবা, এই হাতের রান্নার কেমন সোয়াদ হয়।
লালন বলল, কালুয়া, তুমি কেন কইলা, ওর হাতে খেলে তোমার জাত যাবে?
কালুয়া বলল, মোছলমানের ছোঁওয়া খেলে হিন্দুর যদি জাত যায়, তবে হিন্দুর ছোঁওয়া খেলে মোছলমানের কেন জাত যাবে না।
কমলি বলল, ওঃ, ভারী তো মোছলমান! এবাদত জানে না।
লালন বলল, তুমিই তো আগে কইছিলা, পাগলের জাত থাকে না।
কালুয়া ভাবল, তাই তো আমি ভাবি, কখন বেশি পাগল হব। এই যে। এখন ঠিকঠাক আছি, এইটাই ভালো লাগে না!
এরপর বৃষ্টি নামল। তবে জোরে নয়, ইলশেগুঁড়ি। ছাউনির মধ্যে আশ্রয় নিল চারজনে।
আজ বড় বেশি শিয়াল ডাকছে। কুক কুক করছে একটা রাত পাখি। জলাশয়ের কাছটায় বড় কোনও জানোয়ারের দাপাদাপি শোনা গেল। কিন্তু চন্দ্রলুপ্ত রাত, মিশমিশে অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না।
দরজাহীন ঘরে যদি কোনও হিংস্র জানোয়ার ঢুকে পড়ে বেশি রাতে? ছাউনি তৈরির জন্য বাঁশ কাটার সময় দুখানা লাঠি বানাবার সরু বাঁশও কাটা হয়েছে।
লালন তার একখানা রাখল মাথার কাছে।
মাটির ওপরে পাশাপাশি শুয়ে রইল চারজন। একটুক্ষণ কারও মুখে কোনও কথা নেই। তারপর কালুয়া একটা গান গেয়ে উঠল।
রহমান রহিম আল্লা তুমি ওগো মকরউল্লা
তুমি মক্করেতে ধরো কায়া, কোন আকারে কী রূপছায়া
কোন নাম ধরে দিলেন দেখা, কোন নূরে দূরেতে জেল্লা
নামটি তোমার নিরঞ্জন
রেখেছিল কে কখন…
হঠাৎ গান থামিয়ে সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
লালন উদবিগ্ন হয়ে মাথা তুলে বলল, কী হইল দোস্ত? কী হইল?
কান্না না থামিয়ে কালুয়া বলল, কিছু না। কিছু হয় নাই!
কাশেম বলল, এইটাই তো ওনার অসুখ! একবার কান্না শুরু হইলে আর থামে না।
লালন এই কদিনের মধ্যে এমন দেখেনি। হাসি-ঠাট্টাতেই তো ওর ঝোঁক বেশি। আজ একেবারে শিশুর মতন কাঁদছে।
লালন আবার জিজ্ঞেস করল, কষ্ট হইতাছে কিছু?
কালুয়া বলল, না, না, না, না।
তবু কান্না থামল না।
কাশেম বলল, কমলি, তুই একখান গান গা। তাতে যদি থামে।
কমলি একটু গুনগুন করে গাইতে শুরু করল। তার গলাখানি বেশ।
মা মা বলে আর ডাকব না
ও মা দিয়েছ দিতেছ কতই যন্ত্রণা।
বারে বারে ডাকি মা মা বলিয়ে
মা বুঝি রয়েছে চক্ষুকর্ণ খেয়ে
মাতা বর্তমানে এ দুঃখ সন্তানে
মা বেঁচে তার কী ফল বলল না…
এ-গান শুনেও কান্না থামল না কালুয়ার। একজন মানুষ এমনভাবে কেঁদে চললে কি পাশের মানুষদের ঘুম আসে?
একটু পরে লালনও একটা গান গেয়ে উঠল আপন মনে:
ঘরের মধ্যে ঘর বেঁধেছেন
মন মতো মনোহরা।
ঘরের আট কুঠুরি নয় দরোজা
আঠার মোকান চোদ্দো পোয়া
দুই খুঁটিতে পাড়া সুসারা।
ঘরের বায়ান্ন বাজার তেরপান্ন গলি
ওই বাজারে বেচাকেনা
করে মন চোরা…
কমলি বলল, সাঁই, এটা কোন ফকিরের গান? আগে তো শুনি নাই।
কাশেম বলল, আমিও শুনি নাই। আপনিই রচেছেন বুঝি?
লালন বলল, সাঁই? আমি সাঁই টাই কিছু না। মুখ সুখ মানুষ। কোনওদিন সাধনাও করি নাই। এ-গান কার রচনা তাও জানি না। মাঝে মাঝে আমার কী যেন হয়, মনের ভিতর থেকে গান বাইরাইয়ে আসে। কার গান, কবে শিখেছি, কিছুই বুঝি না। মনে লয় যেন আমার মনের মধ্যে আর একটা মানুষ লুকায়ে আছে। সে যে কে, তাও জানি না। সেই গান বেধে আমারে দিয়া গাওয়ায়। ইচ্ছা করলেও সবসময় গাইতে পারি না। তার যখন ইচ্ছা হবে, সে আমার গলা দিয়া গাওয়াবে। তোমাগো এমন হয়?
কাশেম বলল, কী যে কন! আমরা তো চোখ থাকিতেও অন্ধ। মনের খবরও জানি না। যে মনের মানুষের কথা ট্যার পায়, তারেই তো সাঁই কয়। আহা কী গান শুনাইলেন!
লালনের গানের মাঝখানেই কালুয়ার কান্না থেমে গেছে।
সে এবার বলল, চুপ কর তো৷ ভ্যাজর ভ্যাজর করিস না। এ-গানের মর্ম বুঝিছিস কিছু? ঘরের আট কুঠুরি নয় দরোজা, এ কেমনতরো ঘর? তোরা বুঝবি না। এ অতি গুহ্য কথা।
লালন বলল, আহা, অমন ধমক দেও ক্যান। আমিও তো বুঝি না।
কালুয়া বলল, তোমার বুঝার দরকার নাই। তোমারে ভূতে পাইছে। সেই ভূতই তোমারে দিয়া গাওয়াবে। সেই ভূতের নাম নিরঞ্জন। এইবার সবাই ঘুমাও।
লালন বলল, তুমি এত কাঁদছিলা কেন? কীসের কষ্ট হতেছিল?
কালুয়া বলল, আমার কথা ছাড়ান দাও! আমারেও ভূতে ধরে, তবে সে আমার চোদ্দো পুরুষের ভূত। সে ভূতরে না তাড়াইলে আমি শান্তি পাব
এবার সবাই চুপ করে গেল। দূরে কোথাও রাত পাখিটা ডেকেই চলেছে। থেমে গেছে বৃষ্টি, তবু গাছের পাতা থেকে টুপটাপ ঝরে পড়ছে জলের ফোঁটা।