মোসলেম উদ্দিনের দিন চারেক আগের আশঙ্কা আজ সকালে ফলে।
খুব সকালে দক্ষিণ থেকে ধীরে ধীরে বাতাস আসে। তখনও বোঝা যায়নি এই বাতাস মাত্র ঘণ্টা তিনেকের ভিতরে এমন রূপ ধারণ করবে। ধীরে আসা সেই বাতাসে নারকেল গাছের পাতা কাপে। নারকেলই সবচেয়ে উঁচু গাছ। তাছাড়া মেঘনিশ বা শিরীষ গাছের একেবারে উপরের দিকে জোরে হাওয়া লাগছে, যদিও গাছ কতটা কাঁপছে তা এমনিতে ঠিকঠাক বোঝা যায় না, শুধু নারকেল গাছ দেখেই ভালো বোঝা যায়। পাতায় পাতায় দোল, ঝুলে-পড়া পাতার ঘষা লাগে গাছের শরীরে সেই ঘর্ষণে শিরশির শব্দ হয়! বাতাস ধীরে ধীরে বাড়ে, ওই শব্দও বাড়ে। উপরের দিকে পাতা পরস্পরের গায়ে বাড়ি খায়।
সকালে তার মুনিগঞ্জের টিনের চালের বাসায় খুবই পাতলা যেন এক দুই ফোঁটা বৃষ্টির শব্দ টের পেয়েছে মোসলেম। তখনও ভাবেনি, রোদ একেবারেই উঠবে না। তা রোদ না উঠুক, এই বৃষ্টি যে বাড়বে তার এমন কোনও আলামত পাওয়া যায়নি। কিন্তু মনে মনে তার সেই আশঙ্কা তবু ছিল। হয়তো হাওয়া বাড়তেও পারে। কিন্তু ঘণ্টাখানেকের ভিতরে বাতাস বাড়ল, যদিও তখন আর বৃষ্টি নেই। মোসলেম উদ্দিন আলেকজানকে বলেছিল, আইজ মনে হয় আর কোনও উপায় নেই। এই জ্যৈষ্ঠের শেষ দিক এইভাবে দাবাড় আসতিচে!
আলেকজান বলেছে, দাবাড় কোতায় দেকতিচো, বৃষ্টি আসপো, বৃষ্টি আসার সময় হইয়ে গেইচে। দাবাড় যা আইল সেয়া বৈশাখ মাসে, এ মাসেও হইছে, কিন্তুক তাকাইয়ে বোঝে না, এই যে আসতিচে এহেবারে বৃষ্টি আইনে ছাড়বে।
মোসলেম জানে না, কী ভেবে কথাটা বলেছিল, কেন বলেছিল। ঝড়-বাদল বৃষ্টি দাবাড়ের হিসেব তার তো ভালোই জানা আছে। তবু তার কেন যেন মনে হয়েছিল, বৃষ্টি হয়তো এখনও আসার সময় হয়নি, আসবে দাবাড়! সে আলেকজানকে বলল, যাই কোর্টের দিকে। আইজকে বেলা বোঝা যাবে না। কিন্তু বেলা হইয়ে যাতিচে।
এই বলে মোসলেম উদ্দিন হাতঘড়ি পরতে পরতে তাতে দম দেয়। ঘড়িটার ডায়াল ছোটো ও পুরনো। ডায়ালের রঙ বেশ কালো হয়ে গেছে। এখনও ভালো সময় দেয়। কীভাবে একদিন তার হাতে এসেছিল এই ঘড়ি, তা এখনও সে মনে করতে পারে। ঘড়িটার দিকে চাইলে কখনও কখনও তার তা মনেও আসে। কিন্তু এখন আকাশের মুখ ভার, মোসলেম সেকথা মনে আসতে আসতে আর মনে এল না। অথবা, হতে পারে সেই কথার খানিকটা তার মনে এসেছিল, পর মুহূর্তেই ঘড়িটা হাতে পরতে পরতে সে সেখান থেকে সরে এল। তার মনে হয়েছিল, আলেকজানকে এখনও একটা কথা বলতে বাকি। সেকথাটা বলবে। তাই ঘরের দরজায় পা দিয়ে মোসলেম জানতে চাইল, পাউডারের মালপত্তর তো আছে? আপাতত আর মনে হয় আনা লাগবে না।
আলেকজান মোসলেম উদ্দিনের হাতে পান দিতে দরজায় দাঁড়িয়েছিল, কিছু বলল না। গাঢ় চোখে দেখল তাকে। দুই দিকে মাথা নাড়ল। অর্থাৎ, লাগবে না। তাছাড়া বহুদিনের অভিজ্ঞতায় আলেকজান জানে, এই আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে মানুষের জামা-কাপড় ময়লা হয় বেশি কিন্তু পাউডার চলে কম। মনে হয় এই সময় মোসলেম উদ্দিন তার আসরও তেমনি মিলাতে পারে না। বর্ষাকালে মানুষজনও ফাও কাজে কোর্টের ধারে কাছে তেমন আসে না।
সাধারণত এ সময় মোসলেম উদ্দিনের মুখোনা শুকিয়ে যায়। এখন তা ততটা হল না। তবু কিছুটা শুকনো মুখে সে আলেকজানের দিকে চেয়ে হাসল। একই সঙ্গে বিষয়টা অন্যদিকেও নিয়ে যেতে চাইল, আজগর আছে না? বান্দর খেলা দেখায়, আজগরের ভোমা জ্বর। ছেমড়াডার যে কী হল, মজমা না মিলতি পারলি ওরে এট্টু দেইহে আসপো।
ওর তো শুনি কয়দিন বাদে বাদে শরীর খারাপ হয়।
হয়। কোহানে থাহে, কোহানে খায়, কোথায় ঘুমোয়, কোহানে কী করে, তার কোনও ঠিক আছে। বান্দর নাচাতি নাচাতি নিজেও এট্টা বান্দর হইয়ে গেইচে।
মোসলেম ঘরের সামনে থেকে একটু এগিয়েছে। ফিরে সে আলেকজানকে একথা বলে, তারপর হাঁটতে শুরু করে। ছাতা নিয়ে বেরুতে পারলে হত। বোঁচকটা তার বাম বোগলে। সামনের রাস্তায় রিকশা পেলে হয়। ছাতার কথা ভাবল মোসলেম, কিন্তু জানে না ছাতাটা ব্যবহার উপযোগী আছে কি না। এবার একদিনও মাথায় দেয়নি। তাছাড়া একহাতে লাঠি আর অন্য হাতে ছাতা নিয়ে মোসলেমের হাঁটতে কষ্ট হয়। তাই প্রায়ই সময় তার ছাতার কথা মনে থাকে না।
মোসলেম কোর্ট পর্যন্ত আসতে আসতে বাতাস বাড়ে। মেইন রোড ধরে দক্ষিণে তাকালে রাস্তার দু-পাশে নারকেল ও মেঘনিশ গাছের পাতায় বাতাসের দাপট। একটা রিকশা পেয়ে মোসলেম রিকশাঅলাকে বলে লঞ্চঘাটে আসতে। রিকশা কোর্টের পাশ থেকে আসার সময় সে দেখে, চারপাশ অপেক্ষাকৃত ফাঁকা! বৃষ্টি না-ধরলে ফাঁকাই থাকবে।
লঞ্চঘাটের কাছে নেমে মোসলেম ভাবে, আলতাফকে জিজ্ঞাসা করবে আজগর এখন কোথায় থাকে। কিন্তু আলতাফকে হোটেলের সামনে দেখে না। হয়তো বাজারে গেছে। এসময় কোত্থেকে সুকুমার এসে উদয় হয়। সুকুমার মোসলেমকে দেখেই বুঝেছে, সে আজগরকে দেখতে এসেছে।
একটু এগিয়ে, তারপর নদীর পাড় ধরে আজগরের ঝুপড়ি পর্যন্ত আসতে কতটুকুই-বা সময়। এর ভিতরে সুকুমারের কাছে মোসলেম জানতে চেয়েছে আজগরের অবস্থা কী? কোনও ওষুধ-পথ্য কি পেটে পড়েছে ছোঁকরার? সুকুমার যদিও সবকিছু জানে না। কাল সারাটা বিকেল ও সন্ধ্যা তার কেটেছে ঝিলিকের চিন্তায়। তবে আজগরকে কোনও ডাক্তারের কাছে নেওয়া হয়নি, তা সে জানে। মনে হয় রাত এক প্রহরের পর সামনের কোনও এক ফার্মেসিঅলার কাছে থেকে কী-একটা বড়ি এনে খাইয়েছিল, তাতে নাকি ভোর রাত্রের দিকে জ্বর খানিকটা ছেড়েছে, কিন্তু হুঁশ সেভাবে আসেনি। জরিনা বলেছে, সারাটা রাত্তির নাকি বিড়বিড় করে কী সমস্ত বলেছে।
সুকুমারের কাছে এসব শুনে আজগরের ঝুপড়ি পর্যন্ত আসতে আসতে মোসলেমের মেজাজ খিচে যায়। জরিনা ছেমড়ির দেখি কোনও বোধ-ভাষ্য নেই। খালি আছে কথায় যোগ্যতা। এমনিতেই আজগরের শরীরের ওই দশা। মাসের ভিতরে কয়দিনই তো কাশতে কাশতে প্রায় কাৎ হয়ে থাকে। তারপর এই প্রায় দিন তিনেকের জ্বর। আজ বেলা তো এতক্ষণে কম হয়নি, আজগররে নিয়ে তো হাসপাতালের দিকে যেতে পারত। সদর হাসপাতাল না-হয় দূরে, সেই মুনিগঞ্জ, পুরানো হাসপাতালে গেলেও তো সরকারি ডাক্তার দুটো ওষুধ লিখে দিত। মোসলেম সুকুমারেরও মুখের দিকে চায়। সুকুমার তো একটা বুঝমান মানুষ, সে এতক্ষণে তাহলে করেছে কী?
আজগরকে দেখে মোসলেম বোঝে, সুকুমারের মুখে শুনে অবস্থা যা ভেবেছিল, আজগরের অবস্থা তার চেয়ে খারাপ। গায়ে শক্তি আর অবশিষ্ট নেই। চোখ বসে প্রায় গর্ত হয়ে গেছে। গালের হা-এর পাশে কেমন যেন ফেনার দাগ। এখনি হাসপাতালে অথবা ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। এই দিকে কোনও ডাক্তার বসে না। যারা বসে সবই হোমিওপ্যাথি। এই সকালে এমবিবিএস ডাক্তাররা সবাই হাসপাতালে। একজন আছে রেল রোডে। সেই ডাক্তার এখনও চেম্বারে এসেছে কি না ঠিক নেই। তার চেয়ে পুরানো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ভালো। যদিও মোসলেম ইচ্ছে করেই জানতে চায়নি জরিনা কোনও ডাক্তারের কাছে যায়নি কেন? জরিনার মুখোনা দেখেই বুঝেছে, এদের কাছে পয়সাপাতি কিছু নেই। তবু, নীচু গলায় মোসলেম যখন বলেছে, জরিনা ছেমড়ি, আরও আগে আজগররে হাসপাতালে নেয়া লাগত, তয় আর এইরাম কাহিল হত না। তখন ঝিলিক একবার বলেছে, সেও তাই বলেছিল, কিন্তু জরিনার পাংশুটে মুখোনা দেখে মোসলেম যা বোঝার বুঝে যায়।
মোসলেমের তৎপরতায় সুকুমার একখানা ভ্যান ডেকে আনে। ভ্যানখানা আজগরের ঝুপড়ির সামনে পর্যন্ত আসতে আসতে দক্ষিণ থেকে তাদের উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার বাতাস আসে। তাতে ভ্যানঅলার ভ্যানখানা আজগরের ঝুপড়ি পর্যন্ত আনতে কোনও সমস্যা হয় না। শুধু ঝুপড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মোসলেম দেখে, এমন বাতাসে এই প্রায় দোমড়ানো ভেঙে পড়া ঘরখানার দক্ষিণের বেড়ার দিক থেকে কুলকুলিয়ে বাতাস ঢুকছে, সেই বাতাসে ওই দিকের পাতলা বেড়ার অনেকখানিক ফাঁকা হয়ে গেল।
সুকুমার পাঁজাকোলা করে আজগরকে নিয়ে ভ্যানে তুলল। মোসলেম উঠল ভ্যানের পিছনের দিকে, সুকুমার সামনে বসে আজগরকে শুইয়ে মাথাটা রাখল তার কোলে। মোসলেম বলল, জরি, ঘরদুয়ার এট্টু ঠিকঠাক কর, যা বাতাস আসতিছে! ভ্যান ছাড়তে ছাড়তে মোসলেম আর একবার আজগরের ঘরের দিকে তাকিয়ে ভাবল, এই আজগর বান্দরঅলার ঘরদুয়ার। এই কইরে আজগর এট্টা জীবন কাটাইয়ে দেল।
জরিনা মোসলেমের কাছে জানতে চেয়েছিল, সে যাবে না? মোসলেম বলেছে, তারা যাবে আর আসবে। কিন্তু সঙ্গে মোসলেম যে তাকে এই ঘরদোর গোছাতে বলেছে, এতে যেন তার আপত্তি। জরিনা কখনও আজগরের ঘরকে নিজের ঘর ভাবেনি। কেন ভাবেনি তার কোনও ব্যাখ্যা তার কাছে নেই। মোসলেম বলে যাওয়ার পরও তার ইচ্ছে করল না। যদিও ঝিলিক তাকে বলেছে, ও জরিনাদি, চলো, এপাশ ওপাশ এট্টু ঠিক করি। আইজকে বাতাস ঢালবে। পুরোন হাসপাতার যদি ধারে হয়, তালি ডাক্তার দেখাইয়ে আনতি আর কোতোক্ষণ?
জরিনা কোনও কথা বলে না। সকাল থেকেই মন ভালো নেই। আজগরের শরীরে অবস্থা খারাপ এই জন্যে শুধু না, তার হাত একটা পয়সাও নেই। কাল মোসলেম ওষুধ কিনে দিয়ে গেছে। সুকুমার সন্ধ্যার পর রুটি কিনে এনেছে এই দিয়ে চলেছে। সকালবেলা আজগর কিছুই খায়নি, কিন্তু তাদের তিনজনের খাবার এনেছে সুকুমার। তখন দেখেছে ঝিলিক শাড়ির খোট থেকে টাকা দিয়েছে। জরিনা তো জানে, এখানে সবে এসে সুকুমার, তারপর পরশু আজগরের ওপর রাগ করে মজমা মিলায়নি, কাল কোর্টের এলাকায় মানুষজন বলতে গেলে ছিলই না। ইব্রাহিম শেখের মতন মানুষ সেও অল্প সময়ে আসর গুটিয়েছে। ট্রেনের ব্যাপারটা না মিটলে উকিলদের অনেকেই কোর্টে আসবে না। সরকারের সঙ্গে টক্কর!
এসব জরিনার শোনা কথা। তারপর ঝিলিক গেল বাপের বাড়ির দেশে। সেখানে পাঠানোর লঞ্চভাড়া নিশ্চয়ই সুকুমার দিয়েছে। সুকুমারের কাছে আর কিছুই হয়তো নেই। এখন হাসপাতালের ডাক্তার যদি ওষুধ লেখে, জরিনা জানে না, কী হবে!
এদিকে ঝিলিক আজগরের ঝুপড়ির ভিতরে ঢুকে এটা সেটা গোছাতে শুরু করেছে। কিন্তু গোছানোরই-বা এমন কী আছে। ঘর বলতে যা, এই ঘরকে তা বলা যায় না। প্রায় ভেঙেপড়া তক্তপোশ বা খাটও নেই। দক্ষিণের বেড়ার ওই অবস্থা। ঝড়-বাদলে বানর দুটোকেও এর ভিতরে ঢুকিয়ে নেয়। এখন ওই অবলা প্রাণী দুটো আগাম ঝড় আর বৃষ্টির আশঙ্কায় ঝুপড়ির বেড়ার পাশে গুটিসুটি মেরে আছে। ঝিলিক শুনেছে এইসব বনের প্রাণী আগেই বুঝতে পারে ঝড়-বাদল।
ঝিলিক হঠাৎ দেখে ঝুপড়ির সামনে জরিনা নেই। আজব মানুষ। সুকুমার তাকে বলেছে, চোদ্দ ঘাটে জল খাওয়া পদ। কোথাও দাঁড়ায় নাকি। এখন কী মনে করে আজগরের সাথে আছে তা ভগবান জানে। যদিও ঝিলিকের তা মনে হয়নি। সে বলেছিল, তা না, মানুষটা ভালো আছে। সুকুমারের যা স্বভাব, তাই বলেছিল, মাইজে বউ, আমি কি কইচি খারাপ! কইছি মানুষটার ধরন ওইরাম, ঘরের চালের তলে মাথা দেয়া পদ না।
তখন ঝিলিক তো চাইলে সুকুমারকেও দুই কথা শোনাতে পারত। শুনিয়েছিল। কিন্তু আগায়নি। যখন সুকুমারের ওই কথার উত্তরে বলেছিল, নিজে তো গিরস্ত বাড়ির ছওয়াল, দেলা তুমি কোনওদিন চালের তলে মাথা? এর উত্তরে সুকুমার বলেছিল, আমি বেটা মানুষ। মাথা দেয়ায় কী আর না দেয়ায় কী? এর অবশ্য উত্তর যা হয় তা আর বলেনি ঝিলিক। শুধু বলেছিল, মানুষের ভাইগ্য। বোঝলা, মানুষের ভাইগ্য। ভাইগ্য মানুষরে কোথায় নিয়ে যায়। আইজ আমি এইহেনে
এরপরও ঝিলিকের কথা ছিল। বলেনি কিছুই। বলতে পারত। সুকুমারও এই কথায় কেমন উদাস হয়ে উলটো দিকে তাকিয়ে ছিল। সুকুমারের ওই ভঙ্গিটা বড়ো ভালো লাগে ঝিলিকের উদাসী হয়ে কেমন যেন কোন দিকে তাকিয়ে থাকে। এত দূরে তাকায় মানুষটা, বড়ো গোল চোখ জোড়া তখন একটু যেন কুঁচকে থাকে। তার ভিতরে বহু বহু দূরে কী দেখে। আর আশেপাশে কোথায় আছে, কার কাছে আছে, কী দেখছে–কোনও দিকেই খেয়াল থাকে না তার। সেই রূপসার কুলে এমন একদিন দেখেছিল, পরশু আবার দেখেছে। কিন্তু রূপসার কূলে সুকুমারের চোখে মুখে কোথাও বিষাদ ছিল না, দুঃখ ছিল না, কিন্তু পরশু ঝিলিক দেখেছে সুকুমারের চোখের ভিতরে কোথায় যেন দুঃখ!
যাক, ঝিলিক এখন জরিনার আচরণ বুঝল না। ভাই তুই এই মানুষটার সাথে দিনেমানে প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা থাকিস্, খাই ঘুমোস্ একসাথে, আর এই মানুষটার ঘরখান একটু ঝাড়পোচ দিয়ে রাখবি না? যেই সে কথা বলল ঝিলিক, অমনি কোথায় গেল!
ঝুপড়ির ভিতর থেকে কতগুলো কাগজের ঠোঙা, চানাচুরের প্যাকেট কলার পুরনো খোসা এইসমস্ত বাইরে ছুঁড়ে দিয়ে ঝিলিক বিড়বিড় করে। তারপর মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে, জরিনা দরজার কাছে দাঁড়ানো। হাতে বড়োসড়ো একটা ছালার চট। ঝিলিককে বলে, ওদি, এইখেন ওই দিক দিয়ে দেও। যে বাতাস চালাতিচে। ফুটো বেড়ায় এইখেন থাকলি তবু কিছু বাতাস মানাবে।
পালা কোথায়?
ওই আলতাফের হোটেলের ভিতরদে নিয়ে আইচি। মনে হয় কোনও ব্যাপারি থুইয়ে গেইচে।
এমনি দেল?
হয়, আলতাফ দেবে এমনি? চাইর কথা শুনোল, ফাও কথা কল। চেঁচাইয়ে উঠিচে।
সেইয়ে। এমনি দেয়ার মানুষ আছে?
এই জন্যি কম দিন কথা শোনানো নানে। শুনোক। আমি কইচি, মানুষটার ওই দশা। বাদলের ছিট আসে, যাগো তা থুইয়ে গেইচে, তাগে কইয়ে একখান চোরে নিয়ে গেইচে।
এর কিছুক্ষণের ভিতর সুকুমার আজগরকে নিয়ে ফেরে। এখন আজগরের অবস্থা যেন কিছুটা ভালো। রিকশায় বসে এসেছে। মোসলেম উদ্দিন আসেনি। সুকুমার রিকশা থেকে নেমে আজগরকে ধরে নামায়। ঝিলিক আর জরিনাকে বলে তাকে শুইয়ে দিতে। জ্বর নাকি আজই কমে আসবে। তবে কয়েকদিন গায়ে বেশ ব্যাথা থাকবে। ডাক্তার একটা ইনজেকশন দিয়ে দিয়েছে। কয়েকটা ওষুধও লিখেছে। ওষুধগুলো একটু বাদে নিয়ে আসবে সে।
জরিনা আর ঝিলিক আজগরকে ভিতরে নিয়ে শুইয়ে দেয়। তবে আজগরকে দেখে বানর দুটো পথের পাশ থেকে দড়ি টানটান করে দরজার কাছে এসেছিল। তাদের মালিকের নিশ্চিত কিছু হয়েছে। চোখ বড়ো করে বানর দুটো আজগর ঝুপড়িতে ঢোকার আগ পর্যন্ত তাকিয়ে থাকে। এই দৃশ্য দেখে সুকুমারের মনে হয়, এই অবুঝ প্রাণীরা জানে না, তাদের মালিক কালকে না-থাকলে, তখন তাদের দেখার কেউ থাকবে না এই ধরাধামে, তখন কোথায় গিয়ে পড়বে কে জানে।
কিন্তু ওষুধ যে নিয়ে আসবে সুকুমার, এই কথা জানিয়ে সে চলে এল, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছে জরিনা আর ঝিলিকের শুকনো মুখ, যদিও ওই কথা বলার সময় তার জানা ছিল না, এখনও জানে না ওষুধের টাকা কোথায় পাবে। ওষুধের দাম কত? কত দামের ওষুধ লিখেছে ডাক্তার। লঞ্চঘাটের গলি ধরে মেইন রোডের দিকে আসতে আসতে সুকুমার ভাবে, আলতাফের কাছে টাকা চাবে। আবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হয়, কাল রাত্রে সে ঝিলিককে নিয়ে দোতলায় শুয়েছিল, সেই পয়সা এখনও দেয়নি, তার ওপর এখন আবার টাকা চাইলে আলতাফ নাও দিতে পারে।
ধীর পায়ে এইসব ভেবে সুকুমার আলতাফের হোটেল পর্যন্ত আসে। তখনই তার মনে হয়, এর আগে একটা ফার্মেসিতে ঢুকে জেনে নিলেই পারে ওষুধগুলোর দাম কত। আজ আর কাল এই দুই দিনের ওষুধ নিলে কেমন দাম পড়বে। সুকুমার তাই করে। রাস্তা উলটো দিকে দি জনতা ফার্মেসিতে ঢুকে জানতে চায় ওষুধের দাম। সুকুমার ভেবে রেখেছিল, আজগরকে দেখে ডাক্তার বুঝেছে গরিব মানুষ, তাই সস্তা ওষুধ লেখার কথা। ডাক্তার লিখেছেও তাই। ফার্মেসির লোকটা আজ আর কালকের ওষুধ নিলে দাম কত লাগবে তা জানায়।
এবার সুকুমার চলে আসে। রাস্তা পার হয়। আলতাফের কাছে টাকা চায়। আলতাফ হোটেল ভাড়ার টাকা নিয়ে কিছুই বলে না। শুধু জানতে চায়, কাল রাতে তাদের কোনও অসুবিধা হয়েছিল কি না। একথা জানতে চাওয়ার অর্থ আজও কি তারা থাকবে। এর অবশ্য কারণ আছে। এই হোটেলের দোতলা প্রায় ফাঁকাই থাকে। এক পাশে খোপের মতো কয়েকটা রুম। সেখানে প্রায়শ কেউ থাকে না। একমাত্র রাতের লঞ্চ ফেল-করা যাত্রীদের কেউ কেউ কখনও রাত কাটায়। তাও তারাই, যাদের প্রকৃত আবাসিক হোটেলে থাকার টাকা নেই। আলতাফ তাদের জানায়, রাতে তার হোটেলে ভাত খাওয়া বাবদ তারা থাকছে। ফলে, দরও তেমন বেশি নেয় না। কেউ কেউ তারপরও দরদাম করে। আলতাফ তখন যাত্রীর মান অনুযায়ী খেকায়। সেখানে সুকুমার খেলাঅলা বউ নিয়ে যদি তার এখানে থাকে তো থাকতে পারে। ঝিলিক যে সুকুমারের বউ এটা অবশ্য আলতাফের নিজের হিসেব। হতে পারে জরিনা তাকে তাই বলেছে। কিন্তু শাঁখা-সিন্দুর হাতে নেই কেন, এই কথা জানতে চায়নি। যদিও জরিনা একদিন কথায় কথায় ঝিলিককে বলেছিল, দেওর হোক আর যাই হোক, শাখা তো হাতে দিতি পারো, তালি মানষি আর কোনও কিছু নিয়ে সন্দেহ করত না।
সন্দেহ করা নিয়ে আলতাফ অবশ্য কিছু বলেনি। সুকুমার আর ঝিলিক যদি তার বাধা কাস্টমার হয় হোক। এমনিতে আলতাফ জরিনার সঙ্গে যত রঙ্গ করে কথা বলুক, ঝিলিক যখন তার কাস্টমার তখন তার সঙ্গে একটু হলেও দূরত্ব সে রক্ষা করে।
এখন সুকুমার আলতাফের কাছে টাকা চাওয়াটা তার জন্যে একটা সুযোগ। সে বরং উলটো ঠেলা দিল, পাঁচ টাকা লাগবে?
সুকুমার বলে, হু–
সুকুমারের জন্যে এটা সংকোচ। আকাশের এই অবস্থা। পুরো কোর্ট চত্বরে মানুষজন কী আসবে তার ভরসা নেই। সেখানে পাতার টিপ। মানুষজন নেই, চত্বরে পাতা, বৃষ্টিতে ভিজে, এর ভিতরে সুকুমার খেলা দেখাতে পারবে না। ফলে, পাঁচ টাকাই তার জন্যে এখন অনেক। এই টাকা কীভাবে শোধ দেবে সে জানে না। আজগর কয়দিনে খাড়া হবে তার ঠিক নেই। একমাত্র ইব্রাহিম শেখ এই চত্বরে পারবে মজমা মিলাতে। দিলদারেরও একটা সুযোগ আজকে বাতের যন্ত্র নিয়ে বসার। বারিক বুড়োর তার বইয়ের দোকান খুলবে কি না কে জানে।
আলতাফ বলে, আরও লাগলি নেও।
হয়, আরও লাগলি নিই। তারপর শোধ দেয়া লাগবে না?
দিয়ানে। একদিন ঠিকঠাক খেলা দেহাতি পারলি তোমার কত আয়। আমাগো মতন নাকি, এই জায়গায় দাঁড়াইয়ে চেঁচাও, আসেন লঞ্চ ছাড়ার দেরি আছে, ভাত খাইয়ে যান, বাইলে-টেংরা, রুই-কাতল, ভেটকি-পাঙ্গাশ, খাশি আর মুরগি। এইয়ে কইয়ে দিন পার করো। কোনওদিন খদ্দের জোটে, কোনওদিন জোটে না।
আলতাফ এক নিশ্বাসে বলে। সুকুমার চিন্তিত মুখে তাকিয়ে আছে। আলতাফ বলে চলছে তার কথা। এই কয়দিনে তার বোঝা হয়ে গেছে, ভাতের হোটেলের ক্যাশ কাউন্টারে বসতে বসতে লোকটা এক ভাঙা রেকর্ডই বাজায়। মানুষের চোখ মুখের পরিস্থিতি খেয়াল করে না। হয়তো মানুষের পেটের খিদে নিয়ে কারবার। জানে খিদে যদি লাগে মানুষ খেতে বসবেই। আর একবার পাতে ভাত দিয়ে কয়টা খাওয়াতে পারলেই হল, তারপর তুমি যাবা কোথায়, এটা খাও ওটা খাও, সেই সাধাসাধির ধরনও জানা আছে সুকুমারের। শুধু এখানে কেন, এমন ভাতের হোটেলে জীবনে তো কম খায়নি, কত লঞ্চঘাটে কত রেল স্টেশনে ফেরি ঘাটে ফেরির উপরে মাঝি ঘাটে এমনতর ভাতের হোটেল মাপতে মাপতে আজ এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে।
আলতাফ কী বুঝল কে জানে। গলার স্বরের ধরন হঠাৎ বদলে গেলে তার। নীচু স্বরে সে সুকুমারের কাছে জানতে চাইল, কী ও দা, মন খারাপ? কোনও সমস্যা?
উহুঁ–
তালি কথা কতিচো না যে?
কী কব?
কলাম টাকা আরও লাগলি নাও—
না, টাকা নিলিই হল, সেয়া শোধ দিতি হবে না?
লাগবে কী জানি?
এতক্ষণে এত কথার তোড়ে আলতাফের সুকুমারের হাতে ধরা ছোট্টো কাগজখানায় চোখ পড়েছে। এটা যে প্রেসক্রিপশন তা আলতাফের না-বোঝার কোনও কারণ নেই। আর আজগরকে ভ্যানে নিয়ে যাওয়া আবার হাসপাতাল থেকে রিকশায় করে আনা দুবারই আলতাফ দেখেছে। তাই হয়তো, লাগবে কী জন্যি? বলেই সঙ্গে আরও জানতে চাইল, আচ্ছা, আজগরের কথা কী কল ডাক্তার?
আছে, ভালো হইয়ে যাবে। খাওয়া দাওয়ায় অনিয়ম, লাগাইতে ঠান্ডা, নদীর কূলে রাতে বইসে থাহে, জরিনাও একজন। ডাক্তার কল জ্বর সাইরে যাবে, তয় গায় বল পাবে নানে কয়দিন, এট্টু ভালো মন্দ খাতি হবে।
আর খাইচে। রাত্তির হলি ওই বান্দর নাচানো টাহা নিয়ে যায় কামারপট্টির পিছনে সাইজে মেয়ার দোকানে! কোনওদিন গলা পর্যন্ত টাইনে আসে, কোনওদিন নিয়ে আসে সালসার বোতলে ভইরে।
হয় শুনিচি, জরিনা কইছে।
ও এট্টা আপদ। সাথে জুটিছে ওই জরিনা, করবে না বালডাও। কতদিন কইচি হোটেলে থাল ধুইয়ে দিয়ে যা। তাতে ওনার প্রেস্ট্রিজ যায়। এইরাম নটী মাগি আমি জীবনে দেহিনি
সুকুমারের অবশ্য এ কথায় সায় দেয়া হল না। আবার আলতাফের এমন কথায় উলটো কিছুও বলতে পারছে না। এখনও আলতাফের কাছ থেকে টাকা নেয়নি। এসব কথা বললে কথা আরও বাড়বে। খেলাঅলা সুকুমার, জানে কখন কোন সময়ে স্থির থাকতে হয়। সে বলে, টাকা দেন, দশ টাকাই। আজগর ভাইরে ওষুধ কয়ডা কিনে দিয়ে আসি। তারপর আইসে শোনবানি বাকি কথা।
আলতাফ বলে চলেছে, তারপর আছে বানর দুটো।
তা তো আছে।
আলতাফের কাছে থেকে টাকা নিয়ে আবার জনতা ফার্মেসির দিকে যেতে যেতে সুকুমার ভাবল, আলতাফের সাথে এই কথায় অন্তত একটা কাজ হল, লোকটার সঙ্গে সম্পর্ক কিছুটা হলেও বাড়ল। এখন আর ঝিলিককে সহসা উলটো পালটা কিছু বলতে পারবে না।
সুকুমার ওষুধ নিয়ে আজগরের ঝুপড়ির সামনে আসতে দেখে, ঝিলিক দাঁড়িয়ে। সুকুমারকে দেখেই সে বলল, এতক্ষণে আসলা? গেছেলা কোথায়?
ওষুধ আনতি।
ওষুধ আনতে?
হয়, আজগর ভাইর জন্যি ওষুধ আনতি।
ওষুধ আনলা, তুমি পয়সা পালা কোতায়?
আলতাফের কাছে দে ধার করিচি—
ঝিলিক চোখ বড়ো করে সুকুমারের দিকে তাকিয়ে থাকে। গলা নামায়, তুমি পারোও।
এর মদ্যি পারাপারির কী আছে?
ঝিলিকের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে জরিনা। সেই সোজা ঝুপড়ির ভিতরে আজগরের মাথা দেখা যাচ্ছে। শরীরেরও খানিকটা। ফলে, এখন ঝিলিকের কথার অর্থটা সুকুমার যদি বুঝেও থাকে তার কোনও প্রকাশ তার চোখে নেই। সে জানে, ঝিলিক কী বলেছে। এই আজগরের সঙ্গে সেদিন মজমা মিলনো নিয়ে তার এক চোট হল। তারপর হাতে তার পয়সাপাতি নেই একেবারে। কাল ঝিলিক মোড়েলগঞ্জ থেকে ফিরল। সেখানে কোনও কিছুরই ফয়সালা হয়নি। ঝিলিককে আবারও যেতে হবে।
পিছনে জরিনা দাঁড়িয়ে থাকায় সুকুমার ঝিলিককে চোখ টেপে। ঝিলিকের কথার লজটা জরিনা কিছুটা হলেও তো বুঝেছে। কিন্তু সে সব প্রায় মুহূর্তে ভেঙে দিয়ে সুকুমার জরিনার দিকে এগোল, এই যে জরিনাদি, ওষুধ।
জরিনাও এমন ভঙ্গি করল যেন একথার কিছুই শোনেনি, সুকুমার ভাই, ওষুধ আনিছো। আমি ভাবলাম তোমার ধারে জিগোই ডাক্তার কী কইচে? এর মদ্যি দেখি তুই নেই।
কবে আর কী? জ্বর এমনি বাধিছে। তয় ডাক্তার কইচে শরীরে কিছু নেই। শরীরের দিকে এট্টু খেয়াল দিতি হবে। ভালো মন্দ খাতি কইছে।
কারে কী কও? ওই আজগর দেবে শরীরের দিকে খেয়াল, তালি তো হইল।
তবু। এইয়ে করলি কিন্তু বেশিদিন টেকপে নানে
জানি। ওর আর টেকা না টেকা। জরিনা ঝুপড়ির ভিতরে শুয়ে থাকা আজগরের দিকে তাকাল। সে এখনও বেখোরে ঘুমাচ্ছে। তারপরই কথা অন্যদিকে নিল, ওষুধ আনার টাহা পালা কোতায়?
পাইচি। ওই নিয়ে এহোন ভাবদি হবে না।
কও আমারে।
আলতাফের ধারদে আনিচি।
শুনে জরিনার মুখে কোনও পরিবর্তন যে হবে না, সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু ভিতরে একটা বিষয় খেলে গেল, এবার তাহলে আলতাফ একটা সুযোগ পাবে, এই টাকা নিয়ে জরিনাকে দুই কথা শোনানোর। কিন্তু যতই ভাতের হোটেলের ভাগের মালিক হোক আলতাফ, জরিনা তাকে পছন্দ করে না। ভিতরে কোনও অজ্ঞাত কারণ আছে হয়তো, সে কারণ কোনওভাবেই জরিনা প্রকাশ করবে না, অন্তত সুকুমারের সামনে তো না-ই।
জরিনা জানতে চাইল, কবে শোধ দিতি হবে কিছু কইচে নিকি।
তুমি এত ভাবদিচো কী জন্যি, টাকা তো আনিছি আমি, শোধ দেয়া না দেয়ার মনস্থ আমার। আর ওষুধ আনিচি আইজকে আর কাইলকের, পরশু দিনের ওষুধ কাইল রাত্তিরে কেনবানে।
জরিনা সুকুমারের কাছে উলটো অন্য আর এক আলতাফের পরিচয় দিল, ও যে কীরাম মানুষ তা কয়দিন মিশলি বুঝতি পারবা। দাড়ি মোচ কামানো সুন্দর মানুষ দেখলি হবে কী? গুর মদ্যি টাহা দেখলিও সেইডে তুইলে আনতি পারে।
ঝিলিক পাশ থেকে থেকে বলল, এহোন এইয়ে বাদ দেও। কেননা, একথা এখন ঝিলিকের শুনে কোনও লাভ নেই। রাতে তাদের মাথা গোঁজার আশ্রয় আলতাফ।
হয়। দেলাম বাদ। তোমরা এহোনও ওই আলতাফের ধারে থাহো। দুইজনের এট্টা কিছু না হলি, তার আগে এইসমস্ত কথা কইয়ে কোনও ফ্যাকরা বাদানোর দরকার কী? নদীর কূলের কথা, এট্টু বাদে দেখা গেল আলতাফের কানে চইলে গেল।
সুকুমার বলল, আমি এট্টু বাজারের দিক যাই।
ঝিলিক বলল, কী জন্যি?
এট্টু সাগুদানা কিনে নিয়ে আসি। আজগর উঠলি জরিনাদি খাওয়াইয়ে দেবেনে।
জরিনা বলল, আকাশের যে অবস্থা! দাবাড় কিন্তু চালাল বুইলে।
তার আগে চইলে আসপ।
ঝিলিক জানতে চায়, আইজকে কোর্টের দিকে যাবানা?
আইসে নি। আকাশের গতি ভালো থাকলি যাবানে। আর নয় দুপুরের পরে যাব রেল লাইনের ধারে।
সুকুমার বাজারের দিকে যাওয়ার কথা বলে যায়। কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ফিরে আসে। হাতে চারটে কলা। ঝিলিক ভেবেছিল, হঠাৎ কলা নিয়ে ফিরল কেন? তার আর জরিনার জন্যে এনেছে নাকি? তারপর মুহূর্তেই মনে হল, এগুলো বানর দুটোর জন্যে। কলাগুলো একটু দাগি আর বেশি পেকে যাওয়া। ঝিলিকের হাতে দিয়েই দ্রুত মেইন রোডের দিকে হাঁটে সুকুমার।
বাজারের কথা বললেই সুকুমার মেইন রোডে বা-দিকে না যেয়ে গেল ডান দিকে। কী মনে করে একটু কোর্ট চত্বরের দিকে যাওয়ার কথা ভাবে। হতে পারে, বানর দুটোর জন্যে কলা কিনতে কিনতে সুকুমারের মনে হয়েছে, এই বানরের খেলা দেখিয়ে পেট চালায় আজগর। আজ জ্বরে বিছানপড়তা, সেও হাতগুটিয়ে বসে আছে, খেলাঅলা সুকুমার কোর্ট চত্বরে খেলা দেখাতে পারছে না, আলতাফের কাছে ধার, মোসলেম তাদের সঙ্গে রিকশা উঠে কোর্টের কাছে এসে নেমেছে, তারপর থেকে টিপটিপ বৃষ্টির কমতি নেই, তবু এর ভিতরে একবার তো কোর্ট চত্বর দেখে আসা যেতে পারে। যদি কোর্ট চত্বরে খেলা দেখানোর উপায় না থাকে, তাহলে সে রেল স্টেশনের দিকে। যাবে। স্টেশন বিল্ডিংয়ের পিছনে কাটা লেকের পাড়ে অনেকখানিক জায়গা কংক্রিটের, বৃষ্টি না থাকলে সেখানে বিকালের দিকে খেলা দেখাতে পারবে সে। লোকজন কী হবে কে জানে। তবে যাই হোক, কুড়ি-পঁচিশ টাকাও যদি জোটে, তাহলেও কিছু তো হল। তাদের রাতের খাওয়া হবে। বেশি হলে আলতাফের ধার শোধ করা যাবে। হোটেল ভাড়া নয় সপ্তাহের শেষে দেবে।
এসব ভেবে, কোর্ট চত্বরে এসে দেখে, কোথায় কী? মোসলেম উদ্দিন নেই। বারিক বুড়ো বটতলায় পলিথিন টাঙিয়েছে, কিন্তু নীচে পলিথিন লেছে বই সাজায়নি। বই পাশে পলিথিনে বাঁধা। সেখানে উপরে বাঁশের স্থায়ী ঢাকনা। তার পাশে দিলদার তার বাত নিরাময় যন্ত্র নিয়ে বসে আছে। বৃষ্টি ঝেপে এলে এক দৌড়ে টাইপিস্টদের শেডে চলে যেতে পারবে।
বারিকের কাছাকাছি যায়নি, তার আগে যে ছোট্ট একটা ঘর, এখানে মহুরিরা হয়তো বসে,সুকুমার জানে না, ওই জায়গায় কান পরিষ্কার করা গোলাপ মিয়া দাঁড়িয়ে। সুকুমার একবার ভাবে গোলাপের কাছে যায়, আবার চারদিকে তাকায়। ঝড়ের আভাস, বৃষ্টি ফাঁকে ফাঁকে হচ্ছে, কিন্তু সেই জন্যে কোর্ট চত্বর এমন ফাঁকা!
বরং, গোলাপ এগিয়ে আসে তার কাছে, কী, ও দাদা, চাইয়ে চাইয়ে দেকতিচে কী?
এমন অবস্থা তো কত হয়। মাঝে মধ্যে কতদিন কত কারণে খেলা দেখানোর সুযোগ থাকে না, কিন্তু তখন তো টাকারও প্রয়োজন থাকে না, কিন্তু যখন হাতে চলার মতো পয়সা দরকার সেই সময়ে এই অবস্থা! এতে সুকুমারের মুখ খানিকটা অসহায়। যদিও রসিক গোলাপ মিয়ার কথার ধরন বদলায় না। কোর্টে মানুষ না আসলে সে কানের ময়লা কি খইল বের করবে এমন মানুষই-বা পাবে কোথায়। শহরের রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে ওই কাজের জন্যে মানুষ জোটানেনা কী কষ্টের তার জানা আছে। তাছাড়া, টাউনে মানুষ তারে ততটা পাত্তাই-বা দেয় কই? কেউ হয়তো বলে, কী গোলাপ, তোমারে দিয়ে কান চাওয়ালি কানের কিছু থাকপেনে? গোলাপ হয়তো বলে, দাদা, যে কী কন? এতদিন ধইরে এই কাজ করতিচি, কোনওদিন কোনও কমপিলেন পাইচেন? আসলে এসব গোলাপের সঙ্গে একপ্রকার রসিকতা। ওই যে গোলাপ কমপিলেন কথাটা বলল, ওটা শোনার জন্যে বলা। আবার কেউ হয়তো এরপরে তাকে প্রায় ধূলিসাই করে দেয়। বলে, সেদিন কোর্টে কাজে আমাগো গ্রামদে একজন মানুষ আইল। সে কল, কোর্টের কানের খইল বাইর করা মানুষ নাকি তার কানের পর্দা ছিঁড়ে আইনে দেখাইচে। তুই আইজকাল এইয়ে এইয়ে করতিচিস? গোলাপের বিব্রত হওয়ার দশা। সে তো জানে, শহরের এই মানুষগুলোর সাথে কোনওভাবে পারা যাবে না। কথায় তারা ঠকাবেই। আসলে তার পেটে লাথি মারছে। কিন্তু গোলাপের বলারই-বা কী আছে। এদের কত ক্ষমতা। এসব কথা বলে তার কাজকে উপহাস করে। সে জানে, তারপরও তাদের কেউ কেউ তারে ভালোবাসে। চাইলে দুটো একটা টাকাও দেয় প্রয়োজনে। অথবা বলে, মুখ দেইখে মনে হতিচে আইজকে তোর রোজগারপাতি নেই এহেবারে, তা এট্টা পান খাবি নাই (নাকি)? না চা খাবি?” তখন গোলাপ যদি বলে, চাহা খাতি পারি। তারা যে তার চা-কে চাহা বলা শোনার জন্যে কথাটা বলেছে, তাও সে বুঝতে পারে। সেই গোলাপ সুকুমারকে এই বললে, সুকুমার আর গোলাপ মিয়াকে কতটুকু চেনে? ওদিকে তারা দুজনই এই চত্বরের সওদাগর। যার যার ব্যবসাপাতি নিয়ে এখানে এসেছে। তাদের চোখেমুখের বিহ্বল ভাষা আজকে তো প্রায় একই। তা গোলাপ যা-ই জানতে চাক, এখানে এখন সুকুমার চেয়ে চেয়ে আর দেখবেটা কী? গোলাপ যা দেখে, সুকুমারও তো তাই দেখে। কিন্তু গোলাপের কথাটা দারুণ সুরেলা। শুনে, সুকুমার না হেসে পারল না। এতে যেন উভয়ের ফ্যাকাশে মুখোনা একটুক্ষণের জন্যেও উজ্জ্বল হল। যদিও সুকুমার যেই বলল, ও ভাই, দেকপো আর কী? তুমি যা দেকতিচো, আমিও সেইয়ে দেকতিচি। ধরা খাইয়ে বইসে রইচি।
হয়। দাবাড় চালাল বইলে। তালি আরও ধরা খাওয়া।
দাবাড় তো সকালে একবার চালাইল, সেই জন্যে এহোন একদম মানুষজন থাকপে না?
সুকুমারের কথা শেষ করতে দিল না গোলাপ, উকিলরা মনে হয়, কোর্টেই ওটপে নানে, টেরেন নিয়ে তাগো নামে কেস কাণ্ড হইচে–
সেই জন্যি মানুষজন এহেবারে আসপে না? আমি নয় খেলা দেহাতি পারব না বিষ্টি দাবাড় স্যাক না দিলি, কিন্তু মানুষ আসলি তো তোমার তবু দুই পয়সা হত
গোলাপ শুকনো হাসি হাসল। টাউনো মানুষ দিয়ে আমার কোনও লাভ নেই। কেসের জন্যি যদি গেরাম দিয়ে মানুষ আসে তালি দুই চাইর পয়সা হতি পারে।
আইজকে লঞ্চই আসে না আসে। বলেই সুকুমারের মনে হয়, ঝিলিক কাল চলে এসে ভালোই করেছে, আজ দক্ষিণে না-জানি কী অবস্থা! ওই দিকের নদীতে আজ নিশ্চয়ই তুফান! তারপর সুকুমার গোলাপের মুখ থেকে চোখ সরিয়ে একবার দক্ষিণের আকাশে তাকায়।
গোলাপ বলে, দেহহা কী? আইজকে কামাই নেই। আসতিচে। তারপর থেমে জানতে চায়, আচ্ছা, ওদা, আজগর ভাই অবস্থা কী? আছে কীরাম?
সহালে পুরনো হাসপাতালে লইয়ে গেইলাম। জ্বর কয়দিন থাকপে। তয় শরীরে নাকি কিছু নেই। এহেবারে কাহিল। ডাক্তার কইচে, ভালোমন্দ খাওয়াতি। এহেন ঘুমোতিচে। কী একটা ইনজেকশন দিচে।
আমাগো আর ভালোমন্দ খাওয়া। কও নেই ডাক্তাররে যে ও বাল বান্দর নাচায়। নিজে খাবে কী আর বান্দর গো খাওয়াবে কী? সাতে আছে এক নটী।
সুকুমারের গোলাপের কথার শেষটুকু ভালো লাগল না। যদিও গোলাপের বলার যা ধরন তাতে সে খেপতেও পারবে না। জরিনাকে নটী বলেছে, কিন্তু এমন হেসে বলেছে যে, তাতে আজগর তার বানর আর জরিনা সব একই। আজগরের আয়ে তাদের অভুক্তই থাকার কথা।
এইয়ে ডাক্তাররে কইয়ে কী হবে?
গোলাপ এ সময় বারিকের বসে থাকা বটগাছের নীচে হাত উঁচু করে সেখানে বসা দিলদারকে দেখায়, ওই দেহে, এক নাটাই সের নাতিপের বাকসো নিয়ে বইসে রইচে। ভাবখানা দেখে যেন আইজকে এই টাউনের সবাইর বাত নামাইয়ে বাড়ি যাবে!
সুকুমার হাসল। দেহিচি। তা আইজকে ওইভাবে বইসে রইচে কী জন্যি, পাবে কেউরে?
কেন বইসে রইচে তা দিলদারই ভালো কতি পারবে। তয় মানষি কয়, ওইসব ওয়ার ভান। আসলে করে সরকারে গোয়েন্দাগিরি।
কী কও?।
কী কও না, সত্যি। ওর চিন্তা কী জমি আছে কিছু। বান্দা লাগায়। হাউসে ওই যন্তর নিয়ে বসে। আর এই কোর্টের সব খবর পুলিশরে পাস করে।
সুকুমার বিস্ময়ে গোলাপের দিকে চেয়ে থাকে। সত্যি মিথ্যা কিছু যাচাই করতে গেল না। দরকার কী। অথবা তার কোনও উপায় আর সুযোগ তার নেই। গোলাপের কথা সে উড়িয়ে দিতে পারে না। আবার এখানে, তাদের ভিতরে বাত নামানো যন্ত্র নিয়ে বসা দিলদার পুলিশের গোয়েন্দা তাই-বা মেনে নেয় কী করে। কিন্তু সুকুমারের জানা আছে, এইসব বিচিত্র খবর হঠাৎ হঠাৎই উড়ে আসে। যেমন এখনই গোলাপ আরও বলল, ও শালার কাগজপত্র সব ঠিকঠাক। সৌদি চইলে যাবে।
তাই নাকি?
তুমি আবার যাইয়ে জিগাইয়ে না। কবে নানে কিন্তু কিছু। এমন ভাব করবে ওই নাপতালি দিয়ে কোনওমতে দিন চালায়।
সুকুমার চোখ বড়ো করে গোলাপের মুখ দেখে। এই কথা শুনে তার আর কাজ নেই। এখানে। থাকলে গোলাপ আরও বলবে। হয়তো চা খেতে নিয়ে যাবে। যদি চা-খাওয়ার পরে সেটার দাম গোলাপ দেয় তো পানের দাম সুকুমার দিতে হবে। সুকুমারে সেই সঙ্গতি নেই। পকেটে অবশিষ্ট যে পাঁচটি টাকা, তাই দিয়ে আজগরের জন্যে সাবুদানা কিনতে হবে। তারপর তা জলে ফোঁটানোর জন্যে জরিনাকে যেতে হবে হাফেজের বউ লালির কাছে। সেখানেও এই কাজের জন্যে টাকা চাইতে পারে। আবার নাও চাইতে পারে, আজগর তাদের বাধা খদ্দের। তবে যাই হোক, এখন সুকুমারের বাজারের দিকে যাওয়া দরকার। বৃষ্টি পড়ছে না। হয়তো টিপটিপ করে এখনই পড়বে। অথবা ও যে কোনও সময় দাবাড় চালাবে। তার আগে বাজার হয়ে আজগরের ঝুপড়ি পর্যন্ত আসতে হবে। তারপর, এখনই ভাবল সে, যদি সম্ভব হয়, সারাটা দুপুর আলতাফের হোটেলের দোতলায় ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেবে। ঝিলিক ডেকে না উঠালে উঠবে না। খাবেও না কিছু। খাবে যে সে-পয়সা কই?