০৭. দর্শনের ইতিহাস বিচার

দর্শনের ইতিহাস বিচার

দর্শনের ইতিহাস বিচার করলে দেখতে পাওয়া যায়, সামাজিক মেহনতের সঙ্গে দর্শনের সম্পর্ক যখন ঘনিষ্ঠ তখন দর্শনে প্ৰগতির চিহ্ন : সুস্থ আর বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের দিকে ঝোঁক। কিন্তু এ সম্পর্ক যখনই শিথিল হয়েছে, তখনই দর্শনে ফুটে উঠেছে প্রতিক্রিয়ার প্রতিটি লক্ষণ : অধ্যাত্মবাদ। আর রহস্যবাদ, বৈজ্ঞানিক মেজাজের বদলে ধামিক মেজাজ, বস্তুবাদের বদলে ভাববাদ। এমনটা না হয়ে উপায়ও নেই। কেননা, একমাত্র মেহনতের মধ্যে-প্ৰয়োগজীবনের মধ্যে-হৃদয়ঙ্গম হয় বহির্বস্তুর অবধারিত যাথার্থ। কামারশালে লোহা পেটবার সময় কামার বোঝে-হাড়ে হাড়ে বোঝে—লোহা জিনিসটা স্বপ্ন নয়, মায়া নয়, মতিভ্রুমও নয়। তার বদলে এক ধরনের সত্যি জিনিস, যার বাস্তবতা দুর্ধর্ষ। তাই সমাজের সদর মহল থেকে মেহনতের সবটুকু ইজ্জত যদি মুছে যায়, তাহলে সেই মহলের চেতনায় বহির্জগতের এই যাথার্থ কীসের নির্ভরে টিকে থাকবে? মানুষের যে-হাত দুনিয়ার সঙ্গে সংগ্রামে প্ৰবৃত্ত সেই হাত যখন চোখের আড়ালে পড়ল, তখন যে-দুনিয়ার সঙ্গে সংগ্রাম সেই-দুনিয়ার কথাটাও ঝাপসা হয়ে আসবে না কি? বাকি থাকবে শুধু চেতনা–শুধু নিৰ্মল, নিরাবলম্ব, বিশুদ্ধ চেতনা। কেননা, মাথার ঘাম পায়ে ফেলবার তাগিদযখন নেই, তখন শুধুই মাথা-ঘামানো, তারই নাম হলো চেতনা। আর তাই, তখন মানুষের মনে এ-অভিমান জাগাই খুব স্বাভাবিক যে তার এই চেতনা বুঝি সর্বশক্তিমান, সর্বশক্তির আধার। এই অভিমানটাই হলো চেতনকারণবাদ বা অধ্যাত্মবাদ বা ভাববাদের আসল ভিত্তি।

য়ুরোপীয় দর্শনে যাঁরা আদি-দার্শনিক বলে স্বীকৃত, ইতিহাসে ধাদের নামকরণ হয়েছে আইওনীয় দার্শনিক, তঁদের বেলায় সামাজিক মেহনতের সঙ্গে দর্শনের সম্পর্কটা ঘনিষ্ঠ। তাই তাদের মেজাজ চোদে আনাই বৈজ্ঞানিকের মেজাজ, তঁদের দর্শনে সুস্থ বস্তুবাদের স্পষ্ট স্বাক্ষর,-ষদিও অবশ্য উপসংহারের দিক থেকে তঁদের বক্তব্যটুকু আজকের বৈজ্ঞানিক উপসংহারের তুলনায় অনেক স্থূল, অনেক প্ৰাকৃত।

আইওনীয়দের পর পিথাগোরাস, কিংবা আরো নিখুঁতভাবে বললে বলা উচিত পিথাগোর-পন্থীদের দল। কেননা এই দলের যিনি গুরুদেবঅর্থাৎ খোদ পিথাগোরাস-তিনি নিজে কোনো দার্শনিক গ্ৰন্থরচনা করেননি, এবং গ্রীক ঐতিহ্য অনুসারে এ দর্শনের উক্তিগুলি পিথাগোর-পন্থীদের উক্তি বলেই উল্লিখিত হয়েছে। যেমন ধরা যায়। এ্যারিস্টটুল-এর কথা। তার গ্রন্থে পূর্বদার্শনিকদের বর্ণনা করবার সময় তিনি কোনো কথাকেই পিথাগোরাসের একার কথা বলে উল্লেখ করেননি, বারবার উল্লেখ করছেন পিথাগোরপন্থীদের কথা হিসেবে। তবু পিথাগোরাসের ব্যক্তিগত প্ৰতিভা নিশ্চয়ই অসামান্য ছিল, দর্শনের ঐতিহাসিকেরা প্ৰায় একবাক্যে স্বীকার করেন, প্রাচীন ইতিহাসে এমনতর প্রতিভার নমুনা অত্যন্ত বিরল। অথচ, পিথাগোরাসের জীবনচরিত বলতে মাত্র দু’চারটে টুকরো কথা টিকে রয়েছে। সামস দ্বীপে তার জন্ম, কিন্তু ওখানে পলিক্রিটিসের শাসন অসহ জ্ঞান করায় তিনি ৫৩৫ খ্ৰীষ্টপূর্বাব্দে দক্ষিণ ইতালিতে গিয়ে আশ্রয় গ্ৰহণ করেন। অনুমান, তখন তার বয়েস বছর চল্লিশ। দক্ষিণ ইতালিতে ক্রোটন নামের জায়গায় তিনি তাঁর মঠ স্থাপন করেন, এবং ক্রমশ গড়ে ওঠে এ-মঠের নানান শাখা। মনে রাখতে হবে, পিথাগোর-পন্থীদের মঠ শুধুমাত্ৰ সাধন ভজন বা দার্শনিক ধ্যানধারণার কেন্দ্র ছিল না, ছিল ওঁদের বিশিষ্ট রাজনীতির ঘাঁটিও। ফলে, তাদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীও ছিল। এবং এই প্ৰতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে সংঘর্ষের দরুনই বৃদ্ধ পিথাগোরাস শেষ পর্যন্ত প্ৰাণ নিয়ে মেটপন্‌টিয়ন্‌-এ পলায়ন করেন; সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা তাঁর ওই মঠ এবং মঠের বহু শাখা ধ্বংস করেছিল, এমন-কী খুন করেছিল তাঁর বহু শিষ্যকেও। পিথাগোরাসের জীবন সম্বন্ধে ঐতিহাসিক তথ্য মোটের ওপর এইটুকুই। আরো কিছুটা আন্দাজ করা সম্ভব তাঁর দার্শনিক মতবাদের বিশ্লেষণ থেকে।

দর্শন হিসেবে, পিথাগোর-পন্থীদের দর্শনে প্ৰতিক্রিয়ার প্রায় প্রতিটি লক্ষণ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে; রহস্যবাদ। আর অধ্যাত্মবাদ, বস্তুবাদ ছেড়ে ভাববাদ, স্বাস্থ বিজ্ঞানের পথ ছেড়ে ধর্মমোহের পথ। তাই আইওনীয়দের তুলনায় এক আমূল পরিবর্তন। দর্শনের ইতিহাসকে বুঝতে হলে এই পরিবর্তনের একটা ব্যাখ্যা পাওয়া চাই। য়ুরোপীয় দর্শনের যে-সব সাবেকী ইতিহাস, সেই সব ইতিহাসে এই পরিবর্তনের প্রকৃত গুরুত্ব অনুভূত হয়েছে কি না, তা-ই সন্দেহের কথা। অথচ পরিবর্তনটা যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তা শুধু একটা ব্যাপার থেকেই আন্দাজ করা যায়। এখান থেকে গ্ৰীক চিন্তাধারায় যে সংকট দেখা দিল, তার পরিণামে গ্ৰীক যুগের যিনি সবচেয়ে দিকপাল দার্শনিক বলে সাধারণত স্বীকৃত হন-অর্থাৎ প্লেটো-তার দর্শনে প্ৰতিক্রিয়ার সবচেয়ে চরম চিহ্ন। দ্বিতীয়ত, দর্শনের সাবেকী ইতিহাসগুলিতে এই পরিবর্তনের যেটুকু বা ব্যাখ্যা, তাও মোটেই সন্তোষজনক নয়। ব্যাখ্যাটা মোটের উপর দুরকমের। এক রকমের ব্যাখ্যা হলো, নিছক মজি-রুচির দিক থেকে ব্যাখ্যা; পিথাগোরাসের মজি ও রুচি অন্য রকমের ছিল, তাই তাঁর দর্শনটাও অন্য রকমের। অথচ, এটা তো কোনো ব্যাখ্যাই নয়, মূল সমস্যার বর্ণনামাত্র। কেননা আসল সমস্যা হলো; একটা বিশেষ যুগে চিন্তাশীলেরমর্জি-রূচিতে আমন আমূল পরিবর্তন দেখা দেয় কেমন করে? দার্শনিককে নিছক খেয়ালখুশির কারবারি মনে করলেও তার খেয়ালখুশির রকম-ফেরকে কোনো একটা নিয়ম দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করতে হবে তো, তা নইলে যে পাগলা ঘোড়ার পাগলামির সঙ্গে দার্শনিক যুগপরিবর্তনের কোনো তফাত থাকে না।

দর্শনের সাবেক ইতিহাসগুলিতে আর একরকম ব্যাখ্যা হলো হেগেলপখীদের ব্যাখ্যা। এই ব্যাখ্যা অনুসারে, সব কিছুই লীলাময়ের লীলা, পরব্রহ্মের আত্মবিকাশ। সে আত্মবিকাশের অবশ্য একটা নিয়ম আছে, ক্ৰম আছে। দর্শনের ইতিহাসে যে ক্ৰমবিকাশ, তা এই নিয়মেরই প্ৰতিবিম্বমাত্র। হেগেলপন্থীরা বলেন, প্ৰথম স্তরে লীলাময় নিজেকে বিকশিত করেন স্থূল ও মূর্ত বহির্বস্তু হিসেবে, তার পর ক্রমশ সূক্ষ্মর দিকে, চিন্মেয়ের দিকে অগ্ৰগতি। তাই, দার্শনিক চেতনার আদিতেও স্থূল ও মূর্ত বহির্বস্তুকে পরমসত্য বলে চেনবার প্রয়াস : আইওনীয় দার্শনিকেরা কেউ বা জলকে, কেউ বা পদার্থের প্ৰাকৃত প্ৰলয়কে, কেউ আবার বায়ুকে পরম সত্যের সম্মান দিতে চাইলেন। কিন্তু জলই হোক আর বায়ুই হোক, মনে রাখতে হবে সব কিছুই স্থূল বহির্বস্তু, জড়। দ্বিতীয় যুগটায়, হেগেল-পন্থীদের মতে, মানুষের দার্শনিক চেতনা আর এক ধাপ এগিয়ে এল। বস্তুজগৎকে, জড়কে একেবারে বর্জন করা যদিও সম্ভব হলো না, তবুও বস্তুজগতের স্থূল ও মূর্ত রূপটাকেই একমাত্র সত্য বলে মেনে নেওয়াও নয়। তার বদলে, বস্তুজগতের সূক্ষ্ম, অমূর্ত গঠনের দিকটাকেতার গাণিতিক লক্ষণকে-পরম সত্য বলে চেনবার প্রয়াস। জড়কে ছেড়ে আসা, যদিও কিনা জড়ের উপরে খানিকটা নোঙর থেকে গিয়েছে। হেগেলীয়দের এই ব্যাখ্যাটা প্ৰথমে স্পষ্টভাবে বোঝবার চেষ্টা করা হোক, তারপর দেখা যাক ব্যাখ্যা হিসেবে এটা কতখানি টিঁকসই।

পিথাগোর-পন্থীরা বলতেন, সংখ্যাই পরম সত্তা। এমনিতে কথাটার তাৎপৰ্য বোঝা কঠিন। কিন্তু হেগেলীয়রা বলেন, “সংখ্যা” বলে ব্যাপারটা যে আসলে কী, তা মনে রাখলে এই কথার একটা মানে খুঁজে পাওয়া যাবে। কেননা, “সংখ্যা” হলো বস্তুর অমূর্ত আর গাণিতিক রূপমাত্ৰ : ইন্দ্ৰিয় দিয়ে তাকে জানা যায় না, বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে হয়। ইন্দ্ৰিয় দিয়ে যেটুকু জানা যায় সেটুকু বস্তুর নেহাত স্থূল, নেহাত জড়রূপ। যেমন ধরা যাক, পাঁচটা বলদের কথা। রক্তমাংসে গড়া বলদের শরীরগুলোকে আমরা চোখে দেখতে পাই, হাত দিয়ে স্পর্শ করতে পারি,-অর্থাৎ জানতে পারি। ইন্দ্ৰিয়র সাহায্যে। কিন্তু রক্তমাংসে গড় শরীরগুলো তো নেহাতই স্থূল, নেহাতই জড়জিনিস। এছাড়াও কিন্তু পাঁচটা বলদের ব্যাপারে। আর একটা দিক রয়েছে,-সেইটাই হলো। গাণিতিক দিক, যার নাম ওই “সংখ্যা”। ওই “পাচ” বলে ব্যাপারটা। পাঁচটা বলদ আমরা চোখে দেখতে পাই, কিন্তু “পাঁচ” বলে–নিছক “পাঁচ” বলে–কোনো কিছুকে আমরা ইন্দ্ৰিয় দিয়ে জানতে পারি না। সংখ্যা তাই বস্তুর অমূর্ত গাণিতিক রূপ; একে বুদ্ধি দিয়ে বোঝবার চেষ্টা করা যায়-এই রূপটা নিয়ে হিসেব করা যায়—ইন্দ্রিয় দিয়ে একে ধরাছোঁয়া সম্ভব নয়। পিথাগোর-পন্থীরা যখন এই “সংখ্যা”কে পরম সত্য বলে ঘোষণা করেন, তখন বুঝতে হবে তঁরা বস্তুর মূর্ত ও বাহরূপটাকে ছেড়ে তার অমূর্ত ও বুদ্ধিগ্রন্থ রূপটাকেই একমাত্র সত্য মনে করতে চেয়েছেন, অর্থাৎ চেয়েছেন চিন্ময়ের দিকে–চেতনকারণের দিকে–একধাপ এগিয়ে যেতে।

এই হলো হেগেল-পন্থীদের ব্যাখ্যা। কিন্তু তলিয়ে দেখলে বুঝতে পারা যায়, এ-ব্যাখ্যা আসলে কোনো ব্যাখ্যাই নয়; ব্যাখ্যার বদলে একটি বিশিষ্ট দার্শনিক মতবাদের উল্লেখমাত্র। পরব্রহ্মের লীলাখেলা নিয়ে এক বিশিষ্ট দার্শনিক মতবাদ এবং সেই মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করবার আশায় দর্শনের ইতিহাসকে বিশেষ একরকমভাবে মোচড় দেবার প্রচেষ্টা। অবশ্যই হেগেলের প্রতিভা ছিল অসামান্য, মানব ইতিহাসের প্রায় সমস্ত অভিব্যক্তিকেই লীলাময়ের অধ্যাত্মারস দিয়ে জীৰ্ণ করে নেবার দুর্লভ মেধা। কিন্তু এ-মেধা যতই অসামান্য হোক না কেন, হেগেল বা হেগেলা-পন্থীদের রচনা থেকে এই দার্শনিক হাওয়াবদলের কোন প্রকৃত ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না; পাওয়া যায়। তার বদলে নিজেদের বিশিষ্ট দার্শনিক মতবাদ প্ৰতিষ্ঠা করবার পরিচয়।

আইওনীয় বস্তুবাদের পর পিথাগোরীয় অধ্যাত্মবাদ–দর্শনের এই দিকবদলাটুকুর বাস্তব ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া সম্ভব একমাত্র সামাজিক মেহনতের পটভূমিটা মনে রাখলে।

গ্ৰীক সমাজ ছিল দাস-সমাজ। তার মানে মেহনতের দায়টা ক্রীতদাসের উপর। কিন্তু দাস-সমাজেরও একটা ইতিহাস আছে। সে-ইতিহাসকে দুটি মোটা পৰ্যায়ে ভাগ করা চলে। প্রথম পর্যায়ে ক্রীতদাসুরা প্রধানতই গৃহস্থালির কাজে নিযুক্ত, কিন্তু সামাজিকভাবে মেহনতের পুরো দায়টা তখনো শুধু ক্রীতদাসের ঘাড়ে দেওয়া হয়নি। সামাজিকভাবে মেহনতের দায় বলতে বোঝায় পশুপালন, কারুশিল্প আর বিশেষ করে সওদাগরির জন্যে প্রয়োজনীয় মেহনত; কেননা গ্রীস দেশ রুক্ষ অনুর্বর দেশ, তাই চাষবাসের বদলে এইঃগুলির উপরই অনেক বেশি নির্ভরতা। তার মানে, দাস-সমাজের প্রথম পৰ্যায়ে ঘরকান্নার কাজকর্মের জন্যে যে-মেহনত দরকার, বিশেষ করে সেই মেহনতের দায়টা ক্রীতদাসের ঘাড়ে চাপিয়ে দেবার ব্যবস্থা। কিন্তু পশুপালন, কারুশিল্প আর বিশেষ করে সওদাগরির জন্যে যে-মেহনতের দরকার, তার পুরো দায়টা ক্রীতদাসের উপর নয়, সেখানে স্বাধীন গ্রীকদের নিজেদের মেহনতও। তাই এই যুগটায় গ্ৰীকসভ্যতার সদর মহল সামাজিক মেহনতের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েনি। ফলে দর্শন আর দার্শনিকের সঙ্গে তখনো সামাজিক মেহনতের যোগাযোগ। গ্ৰীক সওদাগরদের তখন সবচেয়ে বড়ঘাট হলো মিলেটাস শহর; কর্মমুখর এই শহরেই জন্ম হলো গ্ৰীকদর্শনের, আর গ্রীক দর্শনে যিনি আদিদার্শনিক তিনি কর্মজীবনের সাফল্যেই প্ৰাচীন যুগে সপ্তজ্ঞানীর এক জ্ঞানী বলে স্বীকৃত। কিন্তু দাস-সমাজের দ্বিতীয় পৰ্যায়ে মোটেই তা নয়; তখন থেকে যতখানি মেহনতের উপর পুরো সমাজটার নির্ভর, তার সবটুকুর দায়ই ক্রীতদাসের উপর। ফলে মেহনত পড়ল চোখের আড়ালে-কিংবা যা একই কথা, সমাজের সদর মহলের সঙ্গে মেহনতের সম্পর্ক হলো শিথিল। আর দর্শন বলে ব্যাপারটা যে-হেতু সমাজের সদরমহলেরই কীর্তি, সেইহেতু দাস-সমাজের দ্বিতীয় পৰ্যায়ে দর্শনের সঙ্গে সামাজিক মেহনতের আর সম্পর্ক রইল না।

পিথাগোরপন্থীদের দর্শন যখন পূর্ণ বিকাশ লাভ করেছে, তখন দাস সমাজের এই দ্বিতীয় পৰ্যায়। মেহনতকারী বলতে শুধুই ক্রীতদাস, অর্থাৎ একধরনের ইতর জীব। তাই মেহনত বলে ব্যাপারটাই ইতরের ধর্ম। পিথাগোর-পন্থীদের দর্শনে এই মনোভাবের স্পষ্ট পরিচয়। ওঁরা বলেন, অলিম্পিক খেলার মাঠে যে-সব আগন্তুকদের জমায়েত, তাদের দিকে একবার চেয়ে দেখুন, দেখবেন। মোটের ওপর তিন ধরনের মানুষ; কেউ বা এসেছে খেলার মাঠে কেনা-বেচা করতে, কেউ বা এসেছে প্ৰতিযোগিতায় যোগ দিতে, আর কেউ বা নিছক দ্রষ্টা, এসেছে শুধু দেখতে-কিন্তু দেখা ছাড়া কোনোরকম গতির খাটানোর মধ্যে তারা নেই। এদের মধ্যে যারা এসেছে কেনা-বেচার উদ্দেশে তারাই হলো সবচেয়ে অধম, সবচেয়ে নীচু স্তরের মানুষ। তারপর তারা, যারা প্ৰতিযোগিতায় যোগ দিতে চায়। আর যারা দ্রষ্টা, নিছক দ্রষ্টা–শুধু দেখবে, কিন্তু কোনোরকম মেহনতোরই ধারকাছ ঘেঁষবে না।–তারাই হলো সবচেয়ে সেরা ধরনের মানুষ। পিথাগোয়-পন্থীরা বলেন, এই উপমাটা মাথায় রেখে সাধারণভাবে মানবসমাজকেও বোঝবার চেষ্টা করতে হবে। তার মানে, সাধারণ মানুষকেও তিনভাগে ভাগ করা দরকার; সবচেয়ে সেরা ধরনের মানুষ হলো তারাই, যারা শুধু দ্রষ্টা, যারা ভালোবাসে শুধু নির্মল নির্লিপ্ত জ্ঞান, লাভ-লোকসানের দিকে তাদের নজর নেই, তারা নয়। যশপ্ৰাৰ্থী, তারা তাই কোনোরকম মেহনতেরই ধার ধারে না। তারপর তারা যারা গতির খাটায় যশোর আশায়, অলিম্পিক জমায়েতে খেলোয়াড়দের মতো। আর সবচেয়ে নিচু স্তরের মানুষ-সব চেয়ে হীন-সবচেয়ে অধ্যম-হলো মেহনতকারী, অর্থাৎ যারা গতির খাটায় নগদ বিদায়ের মুখ চেয়ে, অলিম্পিক খেলার মাঠে পসারীদের মতো। এইখানে মনে রাখতে হবে, বেচা-কেনায় উৎসাহী ব্যবসাদার বলতে আমরা আজকাল যে-ধরনের মানে বুঝি, গ্ৰীক সমাজে ঠিক সেই ধরনের নয়। ও-সমাজের একটা প্ৰধান নির্ভর ছিল ব্যবসাদারি। আর সওদাগরি, তাই বেচা-কেনা বলে ব্যাপারটা সামাজিক মেহনতের মস্ত বড় দিকই।

মানুষের দলকে এই যে তিন ভাগে ভাগ করবার চেষ্টা, এর থেকেই বুঝতে পারা যায় পিথাগোর-পন্থীদের কাছে মেহনতের মূল্য কতখানি তুচ্ছ-কতটা হীন-হয়ে দাঁড়িয়েছে, আর তারই পাশে নিছক নির্লিপ্ত জ্ঞানচর্চার গৌরবটা কী অসামান্য গৌরবে পরিণত হয়েছে। দাস-সমাজের প্রথম পৰ্যায়ে এমনটা হয়নি, এমনটা হবার কথা ময়। কেননা, তখন পৰ্যন্ত সমাজের যারা মাথা, তারা শুধুই মাথা খাটান না, মাথার ঘাম পায়ে ফেলতেও জানেন। কারুশিল্পে, ব্যবসায়, বাণিজ্যে নানান দিকে। কিন্তু দাস-সমাজের দ্বিতীয় পৰ্যায়ে আর তা নয়; তখন থেকে মেহনতের চিহ্নই ইতর মানুষের চিহ্ন।

ফলে, পিথাগোর-পন্থীদের পক্ষে মেহনতজীবনের ছোয়াচ বঁচিয়ে নির্জনে নির্লিপ্ত জ্ঞানের চর্চাকেই পরম পুরুষাৰ্থ মনে করা স্বাভাবিকু। তাই মঠ প্ৰতিষ্ঠা, দার্শনিকদের মঠ। স্বতন্ত্র দার্শনিক গোষ্ঠী গড়বার চেষ্টা আইওনীয়দের মধ্যে ছিল না, পিথাগোরদেরই প্ৰথম। এ-চেষ্টাকে তাদের খাপছাড়া খামখেয়ালের পরিচয় মনে করলেও ভুল করা হবে। এটা আসলে মেহনতকারী জনতা সম্বন্ধে তাদের বিতৃষ্ণ মেজাজেরই পরিণামমাত্র। নিকৃষ্ট মানুষের প্রবেশ নেই এই মঠে, এখানে শুধু নিৰ্বাচিত কয়েকজন নির্মল জ্ঞানচর্চায় বিভোর হয়ে দিন কাটাবেন। অবশ্যই বিশ্বের চরম রহস্য নিয়ে তাঁরা কী কিনারা করলেন-না করলেন, তা সাধারণ মানুষকে বুঝিয়ে বলবার তাগিদ থাকবার কথা নয়; পিথাগোর-পন্থীদের মধ্যে তা ছিল ও না। বরং তাগিদটা উলটো ধরনেরই; জনগণের কাছ থেকে জ্ঞানের কথাটা গোপন করা, লুকিয়ে রাখা। তাই তাদের ভাষাটাও দুৰ্বোধ্য, সংকেতময়, রহস্যঘন। তারা ওইরকম অদ্ভুত দুৰ্বোধ্য ভাষায় নিজেদের চিন্তাধারাটুকু নিছক নিজেদের গোষ্ঠীর মধ্যে আবদ্ধ রাখতে চেয়েছিলেন বলেই আধুনিক ঐতিহাসিক অনেক চেষ্টা করেও পিথাগোরপন্থীদের বক্তব্যটার পুরো অর্থ উদ্ধার করতে পারেন না, এবং শেষপর্যন্ত যেন হাল ছেড়ে বললেন : “এখানে শুধু দার্শনিক চিত্তাকর্ষণ নয়, এমন-কী ঐতিহাসিক চিত্তাকর্ষণও যেন উপে যায়” (সোয়োগলার)। যেমন ধরুন, ওদের মধ্যে কেউ বা বলছেন “ন্যায়= ৪”, কেউ বা বলছেন “ন্যায় = ৯”;–কিন্তু ৪-ই হোক আর ৯-ই হোক, এ-সব কথার যে কী মানে, আজকের দিনে তা আমাদের পক্ষে উদ্ধার করা সম্ভবই নয়। পাটীগণিতের মুখোশ পরানো এই রহস্যবাদের অর্থ আমরা কীসের ভিত্তিতে আন্দাজ করতে পারি?

দুৰ্বোধ্য সাংকেতিক ভাষায় নির্জনে চিন্তার জাল বোনা। কিন্তু মঠগুলো শুধুমাত্র দার্শনিক চিন্তার কেন্দ্র নয়। রাজনীতির ঘাটিও। পিথাগোরাসের একটা রাজনৈতিক মতবাদও ছিল, খুব সম্ভব সংগঠনও ছিল। মঠগুলো তারও কেন্দ্র। অবশ্য এই রাজনৈতিক মতবাদটা ঠিক কেমনতর, তার সুনিশ্চিত নির্দেশ পাবার উপায় নেই, আধুনিক পণ্ডিতেরা নানান রকম অনুমানের ভিত্তিতে পিথাগোর-পন্থীদের রাজনৈতিক মতবাদটা আন্দাজ করতে চান। এবং এ নিয়ে আধুনিক পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। কেউ বা মনে করেন, এই মতবাদটা ছিল সন্ত্রান্ত-তন্ত্র; মুষ্টিমেয় সম্রান্তের শাসনই সবচেয়ে ভালো। আবার কেউবা দেখাতে চেয়েছেন, পিথাগোর-পন্থীদের রাজনীতিটা ছিল গণতন্ত্র, সন্ত্রান্ত জমিদার-শ্রেণীর বিরুদ্ধে তাদের রাজনৈতিক সংগ্ৰাম।

অবশ্যই উভয় পক্ষের সিদ্ধান্তই ক্ষীণ ও ভঙ্গুর প্রমাণকে আশ্রয় করতে চায়; ধারা বলতেন পিথাগোর-পন্থীরা সম্রাপ্ত-পন্থী। আর যারা বলেন পিথাগোর-পন্থীরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, তাদের উভয়েরই সপক্ষে ঐতিহাসিক সাক্ষ্য অত্যন্ত দুর্বল। তবু, পিথাগোর-পন্থীদের রাজনীতিতে প্ৰগতির চিহ্ন খোঁজবার চেষ্টাটা মোটের উপর বিজ্ঞান-বিরুদ্ধ বলেই মনে হয়। যাদের চিন্তাধারায় এবং জীবনাদর্শে প্ৰতিক্রিয়ার প্রতিটি চিহ্ন এমন প্ৰকট, তাদের রাজনৈতিক মতবাদে প্রগতির পরিচয় থাকবার কথা নয়। তাছাড়া, যদিই বা টুকরোটাকরা কিছু কিছু সূত্র থেকে অনুমান করা যায় পিথাগোর-পন্থীদের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের দিকে ঝোঁক, তবুও মনে রাখতে হবে, এ-গণতন্ত্র সমন্ত মানুষ সম্বন্ধে প্ৰযোজ্য হতেই পারে না। সমাজের ভিত্তিতে দাস-প্ৰথা, চুড়ায় সম্রান্ত তন্ত্র আর গণতন্ত্রের দ্বন্দ্ব। তাই গণতন্ত্রই হোক আর সামন্ততন্ত্রই হোক, শাসন-কাজে ইতর মানুষের, ক্রীতদাসের কোনো অধিকার নেই। তাই, সামাজিক মেহনতের সঙ্গে পিথাগোরপন্থীদের ঠিক কেমনতর সম্পর্ক ছিল-এ-প্রশ্নের আলোচনায় তাঁদের রাজনৈতিক মতবাদটা নিছক রাজনীতির পরিভাষায় সন্ত্রান্ততান্ত্রিক না। গণতান্ত্রিক, তার হদিশ খুব বেশি আলোকপাত করতে পারবে না। পুরো সমাজের গড়নটা তখন কী-রকম, তারই মীমাংসা এই মূল প্রশ্নের উত্তর নির্ণয় করবে। মনে রাখতে হবে, পুরো সমাজের জন্যে যতখানি মেহনত দরকার তার সবটুকুর দায়ই তখন শুধু ক্রীতদাসের ঘাড়ে, তাই সামাজিক মেহনতের চিহ্নটা ইতরের চিহ্ন, মেহনতকারীরা ইতর মানুষমাত্র। পিথাগোরীয় দর্শনে এই মনোভাবের স্পষ্টতম পরিচয়।

 

সামাজিক মেহনত থেকে পিথাগোর-পন্থীরা কী-ভাবে যে হিটে গিয়েছিলেন, তার আরো একটা জরুরি প্রমাণ এখানে উল্লেখ করা যায়। তঁদের আগে পৰ্যন্ত-অর্থাৎ আইওনীয় দার্শনিকদের বেলায়-দার্শনিক উপমা, এমন-কী দার্শনিক চিন্তাধারার মূল কাঠামোটুকুও সংগ্ৰহ করা হতো। দৈনন্দিন কর্মজীবনের দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ রেখে। অধ্যাপক ফ্যারিংটন দেখিয়েছেন, কেমনভাবে কুমোরের চাকা বা কামারের হাপর বা ওইরকম আরো পাঁচ রকম জিনিস থেকে গ্ৰীক যুগের আদি দার্শনিকেরা সংগ্ৰহ করতেন। চিন্তাধারার কয়েকটি মূল কাঠামো, এবং তাদের বেলায় এই ধারণাগুলি দিয়েই বিশ্বের পুরো রূপটাকে চেনবার চেষ্টা। কিন্তু পিথাগোয়-পন্থীদের বেলায় একেবারেই তা নয়। কর্মজীবনে হাতিয়ারগুলির কাছ থেকে চিন্তার কাঠামো সংগ্ৰহ করা নয়, তার বদলে সংগীতের কাছ থেকে। সংগীতের দিকে পিথাগোর-পন্থীদের নানামুখী ঝোঁক। তারা মনে করতেন সংগীতের সাহায্যে আত্মাকে সংস্কৃত আর ক্লেদমুক্ত করা সম্ভব। তখনকার কালে কোরিবাস্তিক পুরোহিতেরা সংগীতের সাহায্যে-বাশি শুনিয়ে-মনোবিকারের চিকিৎসা করার চেষ্টা করতেন : এই চেষ্টা থেকেই হয়তো পিথাগোর-পন্থীদের মাথায় আসে। সংগীতের আত্মাকে পরিশোধিত করার কল্পনা। এবং একথায় কোনো সন্দেহই নেই যে, প্লেটোর “রিপাবলিক”-এর প্রথমাংশে আদর্শ শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করবার সময় সংগীতের উপর অতখানি বোক দেবার যে-চেষ্টা, তার মূলে রয়েছে পিথাগোর-পন্থীদের প্রেরণাই।

আত্মার জন্যে চাই সংগীত, যেমন দেহের জন্যে ব্যায়াম-প্লেটোর গ্রন্থে (“রিপাবলিক”)। সক্রেটিস বলেছেন অত্যন্ত জোর গলায়! শুধু তাই নয়। প্লেটোর অপর গ্রন্থে (“ফিডো”) সক্রেটিস বলেছেন, “দর্শন হলো চূড়ান্ত সংগীত”। আধুনিক ঐতিহাসিকেরা সুনিশ্চিতভাবে বলতে চান, এ-উক্তি আসলে পিথাগোর-পন্থীদের উক্তিই। অর্থাৎ, প্লেটোর রচনায় পিথাগোরীয় চিন্তাধারার নানামুখী প্রভাবের মধ্যে এও একটা প্ৰভাব। এবং সংগীতের মূল্যাটা . পিথাগোর-পন্থীদের কাছে অমন বিরাট বলেই য়ুরোপীয় ইতিহাসে ওরাই প্ৰথম সংগীত-বিজ্ঞান রচনায়মান দেন। সংগীত সম্বন্ধের্তারা যে মতবাদ দাঁড় করিয়েছিলেন, তাঁর মূল্য নিশ্চয়ই কম নয়। কিন্তু সে-মূল্য যতখানির হোক না কেন, কর্মজীবনের হাতিয়ারের বদলে নিছক সংগীতের কাছ থেকে দার্শনিক চিন্তাধারার কাঠামো সংগ্ৰহ করবার চেষ্টাকে প্ৰতিক্রিয়ার চিহ্ন বলেই স্বীকার করতে হবে। কেননা, মনে রাখতে হবে, আদিম সাম্যজীবন শেষ হবার পর থেকেই সংগীতের সঙ্গে মুছে গিয়েছে সমবেত আবেগ-উদ্দীপনার সম্পর্ক। সংগীত-বিশেষ করে গ্ৰীক সমাজের সদর মহলে যে যন্ত্রসংগীতের সমাদর সেই সংগীত (কেননা গণ-সংগীতের কথাটা আলাদা, সমাজের নিচু স্তরটায় গণ-সংগীতের সঙ্গে আজো মেহনত-জীবনের সম্পর্ক)-পরিণত হয়েছে বিলাসী শ্রেণীর অবসর-বিনোদনে। তাই, সংগীতের কাছ থেকে দার্শনিক চিন্তাধারার কাঠামো জোগাড় করবার চেষ্টাটা মেহনত-জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হবার পরিচয়ই।

প্ৰবাদ আছে, পিথাগোরাস একবার এক কামারশালের পাশ দিয়ে -চলেছিলেন। কামারশালে হাতুড়ি পেটার শব্দ : নানান কামার নানান ওজনের হাতুড়ি পিটছে, তাই শব্দও নানান রকমের,–যেন যন্ত্রের নানান পর্দায় নানান স্বর।। থমকে দাড়ালেন পিথাগোরাস, ভাবলেন, কপালে যে এমন সুযোগ জুটে গেল তা করুণাময়ের অশেষ করুণা ছাড়া আর কী? কিন্তু সুযোগটা ঠিক কীসের? ওই নানান ওজনের হাতুড়িতে যে নানান পর্দার সুর, তাই নিয়ে পরীক্ষা করবার সুযোগ। বীণা বাজাবার সময় বিভিন্ন তারে যে বিভিন্ন পর্দার সুর, তাও কি তাহলে তারগুলোর ওজনের ওপর নির্ভর করে? এই নিয়ে গবেষণায় আত্মনিয়োগ করলেন পিথাগোরাস। প্ৰবাদটা সত্যি না মিথ্যে, তা নিয়ে আলোচনা তুলে লাভ নেই। কিন্তু এই প্রবাদটার মধ্যে পিথাগোর-পন্থীদের মেজাজটা খুঁজে পাওয়া যায়। কামারশালের পাশ দিয়ে চলেছেন দার্শনিক, কিন্তু নজরটা মেহনতের উপর নয়, কামারদের উপর নয়। এর মধ্যে যতটুকু শৌখিনতার দিক, বিলাসের দিক-শব্দের ওই ঠুং-ঠাং-টুকু –দার্শনিকের নজর শুধু তারই উপর। আইওনীয় দার্শনিকদের বেলায় মেহমন্তজীবন থেকে, মেহনতের হাতিরার থেকে-দার্শনিক চিন্তাধারার মূল কাঠামো সংগ্ৰহ করবার চেষ্টা। তাই সুস্থ বস্তুবাদের দিকে ঝোঁক; পিথাগোর-পন্থীদের মতো। রহস্যবাদ। আর অধ্যাত্মবাদের দিকে ঝোক নয়। কিন্তু বিজ্ঞান? গণিতশাস্ত্র?-এইখানে পূর্বপক্ষ একটা দারুণ আপত্তি তুলবেন। পিথাগোরপন্থীদের দার্শনিক প্ৰচেষ্টায় পিছনে গণিতশাস্ত্রের যে বিরাট প্রভাব, তাকে তো উড়িয়ে দেওয়া চলে না। পিথাগোরাস নিজে গণিতশাস্ত্রে একজন দিকপাল পণ্ডিত ছিলেন, জ্যামিতিতে তার অবদান আজও আমাদের পাঠ্যপুস্তকে পড়তে হয় (“পিথাগোরাসের থিয়োরেম”)। শুধু তাই নয়। “সংখ্যা”-কে পরম সত্য মনে করাটা থেকেই বুঝতে হবে, গণিতবিজ্ঞানের প্রেরণাই পিথাগোর পন্থীদের দার্শনিক প্রেরণার মূল উৎস। গণিতবিজ্ঞানকে তো বিজ্ঞানের মৰ্যাদা দিতেই হবে। তাই এই বৈজ্ঞানিক প্রেরণাকে উপেক্ষা না করে পিথাগোর-পন্থীদের দর্শনে শুধুমাত্র প্রতিক্রিয়ার চিহ্ন খোঁজা সম্ভব নয়।

উত্তরে বলব, গণিত-বিজ্ঞানকে তুচ্ছ করবার তাগিদটা নিশ্চয়ই ভ্ৰান্ত। কিন্তু সেইসঙ্গে এ-কথাও মনে রাখা একান্ত দরকার যে, যুগে যুগে গণিতবিজ্ঞান দর্শনশাস্ত্রের পক্ষে এক মরীচিকার সৃষ্টি করেছে। এ-কথা কাণ্ট প্রমাণ করেছেন অত্যন্ত স্পষ্টভাবে। কথাটাকে ভালো করে না বুঝলে পিথাগোর-পন্থীদের দর্শনকে ঠিকমতে যাচাই করা যাবে না।

আসলে, গণিত-বিজ্ঞানের স্বরূপ হৃদয়ঙ্গম করবার ব্যাপারে একটা মস্ত।বড় ফাকির সম্ভাবনা। কেননা, আপাত-দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এ-বিজ্ঞান যা নিয়ে আলোচনা করে তা বাস্তবজগতের বা মূর্তজগতের ধরাছোয়ার বাইরে, মনে হতে পারে অতীন্দ্ৰিয় বিশুদ্ধ চেতনা-গ্ৰাহ সংকেতময় সত্তাই গণিতশাস্ত্রের প্ৰকৃত আলোচ্য। যেমন ধরুন, পাটীগণিতের সংখ্যা বা জ্যামিতির গড়নগুলো। পাটীগণিত বলছে, ৫ + ৭ = ১২। কিন্তু ৫ বলে কিছু, ৭ বলে কিছু, কিংবা ১২ বলে কিছু মূর্ত জগতের কোথাও নেই; মূর্ত জগতে আছে এটা গোরু, ৫টা ভেড়া কিংবা ওই ধরনের নানান রকম জিনিস। গোরু আছে, ভেড়া আছে বাস্তব পৃথিবীতে; কিন্তু বিশুদ্ধ ৫ বা বিশুদ্ধ ৭ নেই কোথাও। অথচ পাটীগণিতের আলোচনাটা তো গোরু ভেড়া নিয়ে আলোচনা নয়; আসল আলোচনা হলো ওই বিশুদ্ধ সংখ্যাগুলি নিয়ে। এই সংখ্যাগুলির কথা আমরা বড় জোর ভাবতে পারি, এগুলি নিয়ে চিন্তা করতে পারি; কিন্তু বাস্তব জগতের কোথাও এগুলির সন্ধান ‘মেলে না। কিংবা ধরা যাক জ্যামিতিতে আলোচ্য বিষয়গুলি। বিন্দু কিংবা সরল রেখা কিংবা ত্রিভুজ। বিন্দুর শুধু অবস্থান আছে, কিন্তু দৈর্ঘ্য-প্ৰস্থ বলে কিছু নেই। এমনতর জিনিস নিয়ে মাথা ঘামানো যায়, কিন্তু এমনতর জিনিস বাস্তব দুনিয়ার কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। কিংবা ধরা যাক, সরল রেখা। তার শুধু দৈর্ঘ্য আছে, কিন্তু প্ৰন্থ বলে কিছু নেই। অথচ, বাস্তব পৃথিবীতে যত সূক্ষ্ম রেখাই আপনি আঁকুন না কেন, তার কিছু না কিছু প্ৰস্থ তো থাকতে বাধ্য। প্ৰস্থ বাদ দিয়ে শুধু দৈর্ঘ-সম্পন্ন জিনিসের কথা কল্পনা করা যায়, কিন্তু পৃথিবীর কোথাও তার চিহ্ন পাওয়া অসম্ভব। তাই জন্যেই তো জ্যামিতিতে বলে : “ধরা যাক ABC হলো একটা ত্রিভুজ”, কিংবা “ধরা যাক AB একটা সরল রেখা”। তার মানে, কাগজের ওপর আমরা যে সরল রেখাটা কিংবা যে ত্রিভুজটা আঁকছি, আসলে সেটা সরল রেখা নয় কিংবা ত্রিভুজ নয়। তাই, “ধরা যাক” বলে বলি। যেমন, একটা পেনসিল দেখিয়ে যদি বলা যায়, “ধরা যাক এটা একটা টেস্ট-টিউব”। তার মানে, পেনসিলটা টেস্ট-টিউব নয়, তবু আপাতত কাজ চালাবার আশায় ওটাকেই টেস্ট-টিউব বলে কল্পনা করবার চেষ্টা। তবু টেস্ট-টিউব বাস্তব দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া যায়, পাওয়া যায় না জ্যামিতির বিষয়গুলি, সেগুলি তাই একান্তভাবে বুদ্ধিগ্রাহ, বাস্তব দুনিয়ার কোনো কিছু নয়।

গণিতের স্বরূপ উপলব্ধি করতে গেলে আপাতত এই রকমের একটা কথাই মনে হতে পারে, মনে হতে পারে-এ-বিজ্ঞানের আলোচ্য যে-বিষয় নিয়ে, তা বাস্তব জগতের জিনিস মোটেই নয়, বিশুদ্ধ চিন্তাজগতের জিনিস। আর তাই, দর্শন যদি গণিতশাস্ত্রের কাছ থেকে প্রেরণা পেতে চায় তাহলে দর্শনও বিশুদ্ধ চিন্ময়ের সন্ধান ছাড়া আর কী হতে পারে? আসলে কিন্তু এই মনেহওয়াটা একেবারে ভুল মনো-হওয়া। কেননা, কাণ্ট যেরকম দেখিয়েছিলেন, গণিত নিয়ে আলোচনা করতে গেলে মূর্ত জগতের অভিজ্ঞতার দ্বারস্থ না হয়ে উপায়ই নেই। কাণ্ট বলেছেন, ৫ আর ৭ যোগ দিলে যে ১২ হয়, এ-কথা শুধুমাত্র মাথা-ঘামিয়ে জানতে পারা সম্ভবই নয়। ৫-এর ধারণা আর ৭-এর ধারণা আর যোগ-চিহ্নের ধারণা-এ-সব নিয়ে আপনি যতই মাথা ঘামান না কেন, এই ধারণাগুলিকে যে-ভাবেই বিশ্লেষণ করুন না কেন, এর মধ্যে ১২-র ধারণা আবিষ্কার করা একেবারেই অসম্ভব। ১২-র ধারণা পেতে গেলে মূর্ত অভিজ্ঞতার দ্বারস্থ না হয়ে উপায় নেই; হয়তো পাঁচটা ঘুটি আর সাতটা ঘুটির যে মূর্ত অভিজ্ঞতা তার দ্বারস্থ হতে হবে। কিন্তু যেভাবেই হােক না। কেন, অভিজ্ঞতার নির্ভর একেবারে বাদ দিয়ে বিশুদ্ধ বুদ্ধির দৌলতে কখনোই জানা যায় না ৫+৭=১২। জ্যামিতির বেলাতেও তাই; জ্যামিতির গড়নগুলি নিয়ে আলোচনা করবার সময়ও মুর্ত অভিজ্ঞতার দ্বারস্থ না হয়ে কোনো উপায় নেই। তাই আঁকজোঁক করতে হয়, ছবি আঁকতে হয়।

এই হলো কাণ্টের সমালোচনা। অবশ্যই, কাণ্টের সমালোচনায় প্রধান বোকাটা হলো ইন্দ্ৰিয়-অভিজ্ঞতার দিকে; গণিত-বিজ্ঞান বিশুদ্ধ চেতনার বা শুধুমাত্ৰ বুদ্ধির উপর, মাথা ঘামানোর উপর নির্ভর করে না; তা একান্তভাবেই নির্ভর করতে বাধ্য ইন্দ্ৰিয়-অভিজ্ঞতার উপরও। কিন্তু এ সমালোচনার উপর নিভর করে আর এক-পা এগিয়ে গেলেই বুঝতে পারা যাবে, গণিতবিজ্ঞান কেন একান্তভাবেই মূর্ত আর বাস্তব পৃথিবীর মুখাপেক্ষী হতে বাধ্য। আসলে, ইন্দ্ৰিয়-অভিজ্ঞতা শূন্য থেকে স্বাক্ট হয় না; তার অনিবাৰ্য উৎস হলো বস্তু-জগৎ, মূর্ত পৃথিবী। তাই অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করা মানেই মূর্ত বস্তুজগতের উপর নির্ভর করা। তাছাড়া, গণিত-বিজ্ঞানের জন্ম-ইতিহাসের কথাটাও মনে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, বাস্তব পৃথিবীর সঙ্গে সংগ্রামের মধ্যেই এ-বিজ্ঞানের জন্ম। তাই মূর্ত্য-জগতের সঙ্গে, বস্তুজগতের সঙ্গে এ-বিজ্ঞানের ঘনিষ্ঠতা নানান দিক থেকে।

অথচ, আপাতদৃষ্টিতে তা মনে হয় না। খেয়াল থাকে না, গণিতবিজ্ঞান বাস্তব জগতের সঙ্গে কী ঘনিষ্ঠ সূত্রে আবদ্ধ। মনে হয়, বিশুদ্ধ চিন্ময় নিয়েই বুঝি তার আলোচনা। আর তাই, গণিতের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়ে দর্শন রচনা করবার সময় দেখতে পাওয়া যায়, দার্শনিকেরা যুগে যুগে এক চরম ভ্ৰান্তির মধ্যে গিয়ে পড়েছেন। তঁরা মনে করছেন, গণিতবিজ্ঞানে যেহেতু বিশুদ্ধ চিন্ময় বিষয় নিয়ে আলোচনা এবং যেহেতু দর্শনকেও ঢালতে হবে। গণিতবিজ্ঞানের ছাচে, সেইহেতু দর্শনের বেলাতেও মূর্ত জগতটা সম্বন্ধে, বাস্তব দুনিয়া সম্বন্ধে হুশি থাকবার কথা নয়। এই জন্যেই কাণ্ট বলেছেন, গণিতবিজ্ঞান অনেক সময় দর্শনকে পথ ভুলিয়েছে, মায়া-মরীচিকা যেরকম পথ ভুলোয় পথিককে।

এ-কথায় কোনো সন্দেহ নেই যে, পিথাগোর-পন্থীদের বেলায় এইরকম একটা মন্তব্য অত্যন্ত স্পষ্টভাবে প্ৰযোজ্য। গণিতবিজ্ঞানের কাছ থেকে তাঁরা প্রেরণা পেয়েছেন, কিন্তু প্রেরণাটা বৈজ্ঞানিক প্রেরণা নয়। তাই। এই তথাকথিত প্রেরণা তাদের বিজ্ঞানের পথ থেকে সরিয়ে বিজানবিরোধী অধ্যাত্মবাদের পথে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। এ-কথার আরো স্পষ্ট প্রমাণ হলো বিজ্ঞানের আদর্শ নিয়ে তঁদের মতবাদ। প্ৰকৃতির সঙ্গে, বাস্তব দুনিয়ার সঙ্গে সংগ্রামের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো বিজ্ঞান; কিন্তু পিথাগোর-পন্থীদের চেতনা থেকে সে-কথা মুছে গিয়েছিল। তাদের কাছে বিজ্ঞানের একমাত্র আদর্শ হলো আত্মাকে শুদ্ধ করবার আদর্শ। সংগীতের মতো গণিতবিজ্ঞানও চিত্তশুদ্ধির উপায় মাত্র। এমন-কী, তলিয়ে দেখতে গেলে চিকিৎসা-বিজ্ঞানের উন্ধেশ্বটাও তাই। কেননা, পিথাগোর-পন্থীদের কাছে যদিও আপাতত মনে হয় চিকিৎসা বিজ্ঞান দেহকে নীরোগ করবার উপায়, তবুও দেহকে নীরোগ করবার সবচেয়ে বড় তাগিদ হলো আত্মার জন্যে উপযুক্ত আর পরিচ্ছন্ন বাসস্থান নির্ণয় করা।

সমস্ত কিছু উদ্দেশ্যর কেন্দ্ৰ তাই আত্মা।

আত্মা নিয়ে এমনতর মাথা ঘামানো আইয়োনীয় দার্শনিকদের বেলায় মোটেই নয়। বহির্জগতের সঙ্গে মানুষের যে সংগ্রাম, অর্থাৎ মেহনত, সেই সংগ্রামে অংশীদার ছিলেন আইওনীয় দার্শনিকেরা। ফলে, তাদের সমস্যাটা বহির্জগৎকে নিয়েই। বস্তুজগতের প্রকৃত রূপ বুঝতে চেয়েছিলেন তারা। কিন্তু পিথাগোর-পন্থীদের সমস্ত উদ্দেশ্যটাই অন্তমুখী। তার কারণ, মেহনতের সঙ্গে সম্পর্ক গেছে ঘুচে, তাই সমস্যাটা বাইরের জগৎ নিয়ে নয়, মনের জগৎ নিয়ে। অর্থাৎ আত্মা নিয়ে। তার মানেই কিন্তু বিজ্ঞান ছেড়ে ধর্মের আশ্রয়ে এসে পড়ার চেষ্টা। কেননা, ধর্মের যেটা সবচেয়ে মূল কথা, সে-কথা হলো বাইরের জগৎকে বদলাবার বদলে মানস জগৎকে বদল করবার কথা।

ধর্মমোহকে পিছনে ফেলে এগিয়ে আসতে পেরেছিল বলেই আইওনীয় দর্শনের অতখানি গৌরব। সেই ধর্মমোহের কাছে ফিরে যেতে চাইল পিথাগোরাসের দর্শন। আধুনিক ঐতিহাসিকেরা তর্ক করেন, ঠিক কোন দেশের ধর্মবিশ্বাস পিথাগোর-পন্থীদের দর্শনে প্রভাব বিস্তার করছিল তাই নিয়ে। কেউ বলেন, ধর্মবিশ্বাসটার আমদানি হলো মিশর থেকে, কেউ বলেন। ভারতবর্ষ থেকে, আবার কেউ বা বলেন তা নয়, এ-ধর্ম-বিশ্বাস গ্ৰীক জমিতেই জন্মেছে, হোমার-এর চেয়ে প্রাচীন কবি আফিউস এ-ধর্মের আদিম প্ৰতিষ্ঠাতা, তাই এর নাম অফিক-ধর্মবিশ্বাস। অবশ্যই, ঠিক কোথা থেকে যে এই ধর্মবিশ্বাসের আমদানি হলো সেটা মোটেই বড় প্রশ্ন নয়। বড় কথা হলো, দর্শনের আঙিনায় এল ধর্মবিশ্বাস; বড় কথা হলো এই প্ৰতিক্রিয়ার কথাটাই।

পিথাগোর-পন্থীদের দর্শনে জন্মান্তরবাদ; এ দেহটা অমর আত্মার একটা অস্থায়ী ডেরা-মাত্র। আত্মা দুদিন পরেই এ-ডেরা ছেড়ে যাবে, আশ্রয় নেবে অন্য দেহে, অন্য ডেরায়।

পিথাগোর-পন্থীদের দর্শনে পাপ-পুণ্য নিয়ে পুরোদমে আলোচনা। পাপের সম্ভাবনা থেকে মুক্তি পাবার আশায় এবং অর্জিত পাপ স্বালন করবার আশায় হরেকরকম বিধি-নিষেধের বর্ণনা।

পিথাগোর-পন্থীরা মনে করতেন, মানুদের দল ভেড়ার পালের মতো; এই পালের চরম মালিক হলেন ভগবান। তাই মানুষের উদ্দেশ্য হলো, জীবনকে পবিত্র করে তোলা, যাতে সেই মালিকের মনস্তুষ্টি হয়।

–এই সব কথাই শেষ পর্যন্ত পিথাগোরপন্থীদের দর্শনের মূল কথা। অথচ এগুলি সবই ধর্মমোহের সনাতন অঙ্গমাত্র।

তাই পিথাগোর-পন্থীদের সময় থেকেই ইওরোপীয় দর্শনের আঙিনায় ধর্মের নিশান উড়ল।

 

গ্ৰীক দর্শনের আদি যুগটার কথা কিন্তু অন্যরকম।

প্ৰাচীন ভারতীয় দর্শনের আদি যুগেও বস্তুবাদের কথা, আর সেই বস্তুবাদের তীব্র সংগ্ৰাম ধর্মের বিরুদ্ধে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *