দরজা খোলার জন্য ওভারকোটের বিভিন্ন পকেটে হাত ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে চাবি খুঁজতে লাগলো সিদ্ধার্থ। অতীনের কাছেও চাবি থাকে, কিন্তু সে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে দেয়াল ঘেঁষে। যেন ধরা-পড়া চোরের মতন মুখচোখ, তার দাড়িতে লেগে আছে রাস্তার ধুলো।
প্যান্ট-সার্ট-জ্যাকেট ও ওভারকোট মিলিয়ে দশ বারোটা পকেট, সব কটা পকেট খুঁজে চাবিটা পাওয়া গেল শেষ পর্যন্ত। ভেতরে এসে, আলো জ্বেলে রাগে গরগর করতে করতে সিদ্ধার্থ বললো, এমন দামি নেশা, শালা চৌপাট হয়ে গেল একেবারে। ভেবেছিলুম রাত্তিরটা থানায় কাটাতে হবে!
ওভারকোটটা খুলে সে ছুঁড়ে ফেললো বিছানার ওপর। তারপর উগ্রমূর্তিতে অতীনের দিকে ফিরে বললো, এবার বল, কেন ঐ কাণ্ডটা করতে গেলি? গাড়িতে দুটো মেয়ে ছিল, নইলে তোকে তখনই এমন পেটাতে ইচ্ছে করছিল আমার!
অতীন যেন সঙ্কোচ-গ্লানিতে সরু হয়ে গেছে। সে ওভারকোট খুললো না। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থেকেই নীচু গলায় বললো, আমি এখনই চলে যাবো! জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে মিনিট দশেক লাগবে, সেইটুকু যদি সময় দিস
সিদ্ধার্থ বললো, চলে যাবি মানে? এত রাত্তিরে কোথায় যাবি?
অতীন বললো, সে আমার কোনো অসুবিধে হবে না। সাবওয়েতে রাত্তিরে শুয়ে থাকা যায়।
সিদ্ধার্থ তাকে একটা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল মাটিতে। জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে বললো, ব্লাডি ইডিয়েট, আমার সঙ্গে মাজাকি হচ্ছে? এক্সপ্লেইন ইয়োর বিহেভিয়ার ফাস্ট। কেউ কি তোর সঙ্গে একবারও খারাপ ব্যবহার করেছে? তবু তুই সবাইকে অপমান করবি কেন?
–সিদ্ধার্থ, আমি এখন একটু ব্র্যান্ডি খেতে পারি?
–ব্র্যান্ডি? তোকে আর কিছু দেবো না। আমার কাবার্ড গুলো চাবি দিয়ে রাখবো। সব কিছুরই একটা লিমিট আছে। ছি ছি ছি ছি, আজ তুই যা করলি!
–সিদ্ধার্থ, আমার মাথাটা দুর্বল লাগছে। ঘুম পাচ্ছে। যদি কাল সকালে
–মারতে মারতে তোর আমি ঘুম ঘুচিয়ে দেবো আজ। তুই আজ যা সর্বনাশ করতে যাচ্ছিলি আমাদের…
অতীন চেয়ারে বসে পড়ে ফ্যাকাসে গলায় বললো, কেন তুই আমাকে ঐ পার্টিতে নিয়ে গেলি। আমি যেতে চাইনি, তুই জোর করে…
সিদ্ধার্থ এগিয়ে এসে অতীনের চুল খামচে ধরে বললো, তোকে আমি শান্তাবৌদির বাড়িতে নিয়ে গিয়ে অন্যায় করেছি। তোকে ইংল্যান্ড থেকে এখানে ডেকে আনাটাও আমার অন্যায় হয়েছে? আমার অ্যাপার্টমেন্টে কে থাকতে দিয়েছি, সেটাও আমার অন্যায়? তুই যদি মরতেই চাস, দেশে থেকেই মরতে পারতি না? এখানে একা একা যেখানে খুশী গিয়ে মর না! মরার জায়গার অভাব আছে? আমাদের জড়াতে চেয়েছিলি কেন?
অতীন বললো, আমি চেষ্টা করলেও মরতে পারি না।
অতীনের চুল ধরে টানতে টানতে জানলার কাছে নিয়ে এসে, জানলাটা খুলে দিয়ে, সিদ্ধার্থ বললো, লাফা, এখন থেকে নীচে লাফিয়ে পড়। দেখি শালা, তুই মরিস কি না।
সিদ্ধার্থর হাতটা ধরে অতীন বললো, ছাড়, আমার লাগছে! সত্যি, তোদের ওরকম বিপদে ফেলা আমার অন্যায় হয়েছে। গাড়ির মধ্যে হঠাৎ যেন আমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল, সবাই আমাকে অপমান করছে, আমার বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না।
–কেউ তোকে অপমান করেনি। শান্তাবৌদি কত ভালো ব্যবহার করছিলেন, তুই-ই তাদের অপমান করেছিস।
–হয়তো আমারই ভুল। শান্তাবৌদির কাছে এখন টেলিফোন করে মাপ চাইবো? অতীনের চুল ছেড়ে দিয়ে সিদ্ধার্থ বললো, এত রাত্তিরে আর ন্যাকামি করতে হবে না! দ্যাখ অতীন, মানুষের ধৈর্যের একটা সীমা আছে। আমি আর তোকে ট্যাকল করতে পারছি না। আমি কি সব সময় তোকে পাহারা দিয়ে থাকবো? তুই এখানে আছিস বলে আমার কোনো বান্ধবীকে এই অ্যাপার্টমেন্টে ডাকি না, উইক এন্ডে ডেট করি না, আর কত স্যাক্রিফাইস করবো তোর জন্য?
অতীন একটা সিগারেট ধরিয়ে স্নান গলায় বললো, তুই আমাকে সাতদিনের নোটিস দিয়েছিস, তার আগেই আমি তোর অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে চলে যাবো।
–আমার অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে রেল স্টেশানে গিয়ে শুবি? হারামজাদা ছেলে, গাড়ির দরজা। খুলে, যখন ঝাঁপ দিলি, তখন তোর মা বাবার কথা একবারও মনে পড়লো না? আচ্ছা, মা বাবার কথাও না হয় বাদ দিলুম, ঐ শর্মিলা বলে মেয়েটির কথাও একবারও ভাবলি না!
–আমি এমন একটা ক্রাইসিসের মধ্যে পড়েছি, তাতে মা-বাবা, বন্ধু বান্ধব কেউ আমাকে কোনো হেল্প করতে পারবে না। আমি এমন একটা বিরাট অন্যায় করে ফেলেছি, যার থেকে মুক্তি পাবার কোনো উপায়ই নেই। সেইজন্যই ভাবি যে আমার এখন মরে যাওয়াই ভালো।
–অন্যায় আর অন্যায়! তোর এই একটা অবসেশান তুই মুছে ফেলতে পারছিস না? যুদ্ধ করতে গেলে মানুষ মারতে হয়। যুদ্ধ ব্যাপারটাই একটা অন্যায় হতে পারে, কিন্তু অ্যাকচুয়াল যুদ্ধে নেমে পড়লে মানুষ মারা অন্যায় নয়। নইলে নিজেকে মরতে হবে। তুইও একটা আদর্শের জন্য যুদ্ধে নেমেছিলি।
অতীনের চোখ দুটি জ্বলজ্বল করে উঠলো, শক্ত হয়ে গেল চিবুক, সে ঘাড় সোজা করে বললো, না, না, না, না, নর্থবেঙ্গলে আমি যে একজনকে মেরেছি, সেটা আমি মোটেই অন্যায় করিনি। বেশ করেছি মেরেছি! সেটা ছিল একটা সমাজবিরোধী, জোতদারের দালাল, ভাড়াটে গুণ্ডা, আমাদের দিকে আগে বোমা ছুঁড়েছিল, মানিকদা ইনজিওরড হয়েছিলেন, তারপরেও লোহার রড নিয়ে তেড়ে এসেছিল আমাদের দিকে। আমি তাকে গুলি না করলে সে-ই আমার মাথা ছাতু করে দিত। নট ওনলি ফর সেলফ-ডিফেন্স, তাকে শাস্তি দেবার মরাল রাইট ছিল আমার হান্ড্রেড পারসেন্ট! বেশ করেছি তাকে মেরেছি! ওরা আমার নামে মিথ্যে কেস সাজিয়েছিল, কিন্তু আমি জানি, আমি কোনো অন্যায় করিনি।
সিদ্ধার্থ বললো, তুই যদি নিজেকে এত স্টাউটলি ডিফেন্ড করতে পারিস, তা হলে আর লজ্জা পাবার কী আছে? চোর-চোর ভাব করে থাকিস কেন? লোকজনের সঙ্গে মিশতে পারিস না। দিনদিন তুই মরবিড় হয়ে যাচ্ছিস। কাল তুই ঘুমের মধ্যে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিলি!
অতীনের শরীরটা আবার শ্লথ হয়ে গেল, নুয়ে গেল মুখ। মেঝের দিকে তাকিয়ে সে বললো, পালিয়ে থাকার সময় আমি এমন একটা কাজ করে ফেলেছি… প্রচণ্ড জ্বরের ঘোরে… মাথার ঠিক ছিল না… তারপর থেকে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারি না! অন্য কারুকে সে কথা বলতেও পারি না, কী যে করবো এখন তা বুঝতেও পারি না।
–ইডিয়েট, তুই সে কথা আমাকেও বলতে পারিস না? আমি তোর বন্ধু নই? একা একা ব্রুড করে তুই দিন দিন যে একটা ওয়ার্থলেস হয়ে যাচ্ছিস, তাতে কোনো লাভ আছে?
–কোনো বন্ধুই আমাকে সাহায্য করতে পারবে না।
–আমি আজই সব শুনতে চাই। ইটস হাই টাইম…
সেই এক ঘোর বৃষ্টিময় বিকেলে অতীন একটা লোককে গুলি করার পর দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটেছিল। কোথায় যাবে সে? মানিকদার আস্তানায় যাওয়া যাবে না, ওরা মানিকদাকে চিনে ফেলেছে। কলকাতার বাড়িতেও ফেরা যায় না এখন, পুলিশ নির্ঘাৎ খোঁজ পেয়ে যাবে সে বাড়ির। কয়েক মিনিট আগেও অতীন জানতো না যে সে একটা লোককে খুন করবে। কিন্তু ওরাই আগে আক্রমণ করেছে, প্রায় বিনা কারণে, বিনা প্ররোচনায় পুলিশ ওদেরই তাঁবেদার পুলিশের হাতে ধরা পড়লে অত্যাচার করবে, বালির বস্তা দিয়ে পেটাবে, কানু সান্যাল–খোকন। মজুমদারের সন্ধান জানবার জন্য জেরা করবে… তারপর কি ওরা অতীনকে ফাঁসি দেবে? কিছুতেই ধরা দেবে না অতীন, বিপ্লবীরা কখনো ধরা দেয় না, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যায়!
প্রথম রাতটা অতীন কাটালো মাদারিহাটের কাছে একটা জঙ্গলে। সারা রাত তার চোখে একফোঁটা ঘুম আসেনি। মাত্র দু’এক মিনিটের একটা ঘটনায় তার জীবনটা বদলে গেছে। সে এখন অন্য মানুষ। সে আর মমতা-প্রতাপ মজুমদারের ছেলে নয়, তাঁদের কাছে অতীন কী করে। আর মুখ দেখাবে? অলির সঙ্গেও আর সম্পর্ক থাকবে না কিছু।-অলির বাবার চোখে সে এখন অস্পৃশ্য, একটা ক্রিমিন্যাল।
সেই রাতেই অতীন বুঝেছিল যে জঙ্গলে একা একা লুকিয়ে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। মানিকদা একবার বলেছিলেন বডার ক্রস করে নেপালে চলে যাবার কথা। কিন্তু নেপালে গিয়ে সে কোথায় থাকবে? তার কাছে টাকাকড়ি নেই, নেপালে কোনো কনট্যাক্ট নেই। যদি সঙ্গে আর একজন কেউ থাকতো, তাহলে দু’জনে মিলে বুদ্ধি করে একটা কিছু করা যেত। তপনটা কোথায় গেল? কাপুরুষের মতন পালিয়েছে আগেই…।
পরদিন সন্ধের অন্ধকারে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে অতীন মাদারিহাটে এসে রঞ্জিতকে খুঁজল। এই রঞ্জিত এখানে একটা ইস্কুলে পড়ায়, কয়েকবার এসেছে শিলিগুড়িতে মানিকদার বাড়িতে। সে তাদের মতবাদে, বিপ্লবের আদর্শে বিশ্বাসী।
রঞ্জিতরা খুবই গরিব, দু’খানা মাত্র টিনের ঘরে মা বাবা-ভাই-বোন মিলিয়ে সাতজন থাকে। সেখানে অতীনকে আশ্রয় দেবে কী করে? তা ছাড়া মাদারিহাটের মতন একটা ছোট জায়গায় একজন নতুন লোক দেখলেই জানাজানি হয়ে যাবে। ঘরের মধ্যে লুকিয়ে থাকবেই বা ক’দিন। রঞ্জিতদের বাড়ির গা ঘেঁষাঘেষি অনেকগুলো বাড়ি, সবই প্রাক্তন রিফিউজিদের, এক বাড়ি লোক অন্য বাড়িতে যখন তখন আসে।
খুনের কথা এর মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। রঞ্জিতের কাছ থেকেই অতীন খবর পেল যে মানিকদা ধরা পড়েননি। যে-ছেলেটি মারা গেছে, ফরোয়ার্ড ব্লকে তার নাম লেখানো থাকলেও সে ছেলেটি আসলে একটি গুণ্ডা। এর আগে সে বেশ কয়েকটা খুন করেছে। কিন্তু এখানে রটেছে যে সি পি এম-এর উগ্রপন্থীদের হাতে খুন হয়েছে ফরায়ার্ড ব্লকের একজন কর্মী। তাই নিয়ে একটা মিছিল বেরিয়ে গেছে কুচবিহারে।
রঞ্জিত পরামর্শ দিল অতীনকে বিহারে চলে যেতে, ওয়েস্ট বেঙ্গল পুলিশের আওতার বাইরে। খুনের আসামী হিসেবে অতীনের নাম এখনো জানাজানি হয়নি, সে কয়েকমাস বিহারে কাটিয়ে আসতে পারলে ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ে যাবে। কাটিহারে রঞ্জিতের এক মামাতো ভাই থাকে, সে যথাসাধ্য সাহায্য করবে অতীনকে।
রঞ্জিতের অত টানাটানির সংসার, তবু সে পঞ্চাশটা টাকা জোগাড় করে দিল অতীনকে। নিজের একটা জামা দিল এবং তার মামাতো ভাইয়ের নামে একটা চিঠি।
কিষানগঞ্জ দিয়ে অতীন ঢুকে পড়লো বিহারে। তারপর বাস ধরে পূর্ণিয়া, সেখান থেকে কাটিহার। বিহারে এসেই অতীন অনেকটা স্বাভাবিক বোধ করলো, যেন তার বিপদ কেটে গেছে, এখানে কেউ তাকে চেনে না।
এর মধ্যে কলকাতায় ফেরার কথা ছিল অতীনের। মাকে সে চিঠিটা যে কেন লিখতে গেল। ঠিক দিনে অতীন না পৌঁছেলে মা উতলা হয়ে উঠবেন। সোমবার দিন নিশ্চয়ই তার জন্য রান্না করে রেখেছিলেন মা। এখন অতীনের কাছ থেকে কোনো সাড়া শব্দ না পেলে মা বাবা কী করবেন? প্রথমে একটা টেলিগ্রাম পাঠাবেন শিলিগুড়িতে। কোনো উত্তর পাবেন না। তারপর? মা বাবাকে জোর করে পাঠাবেন শিলিগুড়িতে? কিংবা কৌশিকও আসতে পারে। কৌশিক পমপমেরা কি সব জেনে ফেলেছে? মানিকদা কোথায় গেলেন?
দার্জিলিং থেকে ফেরার পথে অলিরা নিশ্চিত খোঁজ করবে অতীনের। আর কিছুদিন যাক, অলিকে সব কথা বুঝিয়ে একটা চিঠি লিখতে হবে।
কাটিহারে রঞ্জিতের মামাতো ভাইয়ের নাম পরাণ, একটা ছোট মনিহারি দোকান আছে তার। এরাও রিফিউজি কিন্তু ক্যাম্পে না থেকে কোনোক্রমে জীবনযাপনের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। শুকনো, চিড়ে-চ্যাপ্টা গোছের চেহারা এই পরাণের, বছর তিরিশেক বয়েস, সে রাজনীতির ধার ধারে না। কিন্তু রঞ্জিতের চিঠি পেয়ে সে কোনো প্রশ্ন করলো না, অতীনকে তার। দোকানের কাজে লাগিয়ে দিল।
দাড়ি কামানো বন্ধ করে দিয়েছিল অতীন, এবারে কে আরও কিছু ছদ্মবেশ নিতে হলো। প্যান্টের বললে ময়লা ধুতি ও খালি গায়ে সে দোকানে বসে, স্নান করে না, চুল আঁচড়ায় না। তার চেহারা থেকে শহুরে পালিশটা একেবারে মুছে ফেলা দরকার। পারতপক্ষে খদ্দেরদের সঙ্গে কথাও বলে না অতীন। পরাণ দরদাম করে, অতীন জিনিসপত্র বেঁধে দেয়। স্টেশানের কাছে, রেলেরই জমি জবরদখল করে, টিনের ছাউনির দোকান, রাত্তিরে অতীন সেই দোকানেই শোয়। রাণদের বাড়িতেই দু’বেলা খাওয়া, শুধু ডাল-ভাত আর একটা তরকারি, অধিকাংশ দিনই ঝিঙে বা ঢ্যাঁড়শের।
কাটিহারে পৌঁছোবার কয়েকদিন পরেই অতীন স্টেশানের খবরের কাগজে দেখলো যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার পতনের খবর। উত্তরবঙ্গে নকশালবাড়িকে কেন্দ্র করে ভূমি দখলের আন্দোলন একেবারে থিতিয়ে গেছে, কিন্তু কলকাতায় ছাত্রসমাজ সশস্ত্র কৃষক-বিপ্লবের সমর্থনে মিছিল বার করছে প্রায়ই।
টানা সাড়ে তিনমাস অতীন কাটিহারে রয়ে গেল সেই মনিহারি দোকানের বোকাসোকা কর্মচারীর ছদ্মবেশে। বাড়িতে সে চিঠি লেখেনি, অলিকেও সে চিঠি লেখেনি। এই অজ্ঞাতবাস তার বেশ পছন্দই হয়ে গিয়েছিল। ফেব্রুয়ারিতে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি হয়ে যাবার ফলে পুলিশ। এখন লাগামছাড়া। প্রতিদিন ডজন ডজন গ্রেফতারের খবর।
রঞ্জিত এর মধ্যে চিঠি লিখে জানিয়েছিল যে অতীন যেন অন্য কোথাও চলে না যায়। মানিকদার সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়েছে, মানিকদা অতীনকে আপাতত কাটিহারে থাকতেই নির্দেশ দিয়েছেন।
পুরো শীতকালটা তার কাটলো বিহারের ঐ ক্ষুদ্র শহরে।
তারপর চৈত্রমাসে এক ঝড় বৃষ্টির সন্ধ্যায় অতীন আর পরাণ যখন দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করতে যাচ্ছে, তখন হঠাৎ উপস্থিত হলো এক আগন্তুক। গায়ে বষতি, মাথায় টুপী, মুখে চাপ দাড়ি, সে প্রায় ঝাঁপটা তুলে জোর করে দোকানের মধ্যে ঢুকে পড়তেই অতীন একটা আড়াইসেরী বাটখারা তুলে নিয়েছিল হাতে। না লড়াই করে সে ধরা দেবে না।
ঐ বিচিত্র পোশাকের জন্য কৌশিককে চিনতে পারেনি অতীন। হঠাৎ এতদিন বাদে কৌশিককে দেখে তার কান্না পেয়ে গিয়েছিল। কৌশিক যেন তার সত্তার অপর একটি অংশ, কৌশিকের চেয়ে প্রিয় তার কেউ নেই।
পরাণকে প্রচুর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সেই রাতেই ওরা দু’জন রওনা হলো রাজমহলের দিকে। তারপর সেখান থেকে ধানবাদ, রাঁচী ঘুরে জামসেদপুর।
কৌশিকের কাছ থেকেই অতীন জানলো চারু মজুমদারের আদর্শে সশস্ত্র বিপ্লবের প্রস্তুতি মোটেই থেমে যায়নি, বরং সংগঠন গোপনে গোপনে অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। কানু সান্যাল–মানিকদারা আশা করেছিলেন যে সি পি এম পার্টি ক্যাডারদের মধ্যে একটা বিরাট ভাঙন ধরবে, তারা অবলম্বন করবে চারুবাবুর প্রদর্শিত পথ। তা হয়নি অবশ্য। সি পি এম দল। থেকে প্রায় হাজারজনকে বহিষ্কার করা হয়েছে, তারপর তাদের পার্টির মধ্যে আর কোনো প্রকাশ্য মতবিরোধ নেই। কিন্তু ছাত্রসমাজ থেকে প্রচুর সাড়া পাওয়া যাচ্ছে, এই আদর্শ ছড়িয়ে পড়েছে ভারতের নানা প্রান্তে, তৈরি হয়েছে একটা অল ইন্ডিয়া কো-অর্ডিনেশন কমিটি। একদিকে অন্ধ্র প্রদেশ অন্যদিকে পঞ্জাব, এর মধ্যে শুরু হয়েছে মাওপন্থীদের মধ্যে যোগাযোগ ও সমন্বয়, খুব শিগগিরই একটা আলাদা পাটি ফর্ম করা হবে। এখন অনেক কাজ!
কিন্তু অতীন এই সব কাজে এখন কোনো অংশ নিতে পারবে না। তপন ধরা পড়েছে, অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে পুলিশের কাছে সে অতীন ও মানিকদার নাম জানিয়ে দিয়েছে। ওয়ারেন্ট আছে এই দু’জনের নামে। এখন অন্তত এক বছর পশ্চিমবাংলায় অতীনের ঢোকা চলবে না। তারপর দিকে দিকে বিপ্লবের আগুন জ্বলে উঠলে পুলিশের ঐসব হুলিয়া-টুলিয়া তুচ্ছ হয়ে যাবে।
কৌশিক খানিকটা ভর্ৎসনার সুরে অতীনকে বলেছিল, এই সময়টায় আমাদের গোপনে গোপনে সংগঠন জোরদার করার কথা, এর মধ্যে তারা এমন একটা বেমক্কা কাজ করে ফেললি! এখন খুন জখমের মধ্যে যাবার কী দরকার ছিল?
অতীন উত্তর দিয়েছিল, আমরা কি প্ল্যান করে কিছু করেছি নাকি? হঠাৎ হয়ে গেল! মানিকদা চারুবাবুর কাছ থেকে একটা গোপন মেসেজ নিয়ে যাচ্ছিলেন খোকন মজুমদারের কাছে, মাঠের মধ্যে ওরা হঠাৎ আমাদের অ্যাটাক করলো…।
–মানিকদা বলেছেন, তুই মাথা গরম করে হঠাৎ গুলি চালিয়ে দিলি! ওকে একেবারে প্রাণে মেরে না ফেললে চলতো না?
–মানিকদা বলেছেন এই কথা? আমি না মারলে ওরা নির্ঘাৎ আমাদের মেরে ফেলতো। ওরা মারতেই এসেছিল। মানিকদার গায়ে বোমা ছুঁড়েছিল, তারপর লোহার রড নিয়ে তেড়ে এসেছিল! তুই জানতি, কৌশিক, মানিকদার সঙ্গে রিভলভার থাকে?
–সেই রিভলভারটা নিয়ে তুই কি ওদের ভয় দেখাতে পারতি না?
–ওরা কি ভয় পাবার মতন মানুষ? মানিকদার হাতে রিভলভার দেখেও ওরা বোমা ছুঁড়েছিল। খুন করতে ওদের হাত কাঁপে না। জানিস কৌশিক, দু’এক মুহূর্তের এদিক ওদিক, আমার গুলি যদি লোকটার গায়ে না লাগতো, ও আর একটা বোমা ছুঁড়লেই আমরা শেষ হয়ে যেতাম। হ্যাঁরে, তপন ধরা পড়ে সব বলে দিল? হারামজাদা বাঙালটা এত ভীতু?
–জেলের মধ্যে আমাদের অন্য ছেলেও আছে। তাকে দিয়ে তপনের ওপর ওয়াচ রেখেছি। তবে আমার মনে হয় ও রাজসাক্ষী হবে না। অনেকে সহ্য করতে পারে না, বুঝলি, প্রথমটায় ভেঙে পড়ে, তারপর আস্তে আস্তে শক্ত হয়ে ওঠে। মানিকদা এখনও তপনকে অবিশ্বাস করেন না।
–মানিকদা কোথায়?
–সেকথা তোকে বলা যাবে না। বাই চান্স তুই যদি ধরা পড়িস, তাতে টচারের মধ্যে তুই যাতে বলে না ফেলিস, সেই জন্য এই প্রিকশান। তুই না জানলে আর বলবি কি করে? আরে, না না, তোকে অবিশ্বাস করছি না। তুই তপনের মতন উইক সেকথাও বলছি না, তবে এই রকমই একটা সিস্টেম করা হয়েছে। আর মানিকদার সেফটির ওপর আমরা ম্যাক্সিমাম জোর দিয়েছি। মানিকদার শরীর খারাপ।
–আমার বাড়ির কোনো খবর জানিস?
–হ্যাঁ, সবাই ভালো আছেন। আমি মেসোমশাইয়ের সঙ্গে কোর্টে দেখা করে বলেছি, আপনারা চিন্তা করবেন না। বাবলু ভালো আছে। তুই কোথায় আছিস সে কথা জানাইনি অবশ্য।
–বাবা কী বললেন তোকে?
–অত্যন্ত স্ট্রেঞ্জ ব্যবহার করলেন। আমার কথাগুলো সব শুনলেন মন দিয়ে, কিন্তু কোনো মন্তব্য করলেন না, একটা কথাও বললেন না আমাকে। সব শোনার পর চুপ করে রইলেন, সিগারেট টানতে লাগলেন। এবার তার হাতের লেখা দু’ লাইন চিঠি নিয়ে গিয়ে তোর মাকে দেখাবো।
–আর অলি? তোর সঙ্গে অলির দেখা হয়েছিল এর মধ্যে?
–না, অলির সঙ্গে দেখা হয়নি। তবে খবর পেয়েছে নিশ্চয়ই। তুই কিন্তু পোস্টে কোনো চিঠি পাঠাসনি বাবলু! স্ট্রিকটলি নিষেধ!
জামসেদপুরে সতীশ মিশ্র নামে একজন ইঞ্জিনিয়ারের বাড়িতে তোলা হলো অতীনকে। ভদ্রলোক কিছুদিন আগে বিপত্নীক হয়েছেন, দুটি অল্পবয়েসী ছেলেমেয়ে আছে। অতীন তাদের গৃহশিক্ষক। সতীশ মিশ্র মুঙ্গেরের লোক হলেও যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনো করেছেন, মোটামুটি বাংলা জানেন। ভদ্রলোক কথা বলেন কম, কিন্তু বেশ সাহসী মানুষ। অতীনের পটভূমিকা তিনি জানেন, তিনি অতীনকে বলে দিয়েছেন, দিনের বেলা বিশেষ বেরুবেন না, তাহলে আর ভয়ের কিছু নেই।
জামসেদপুরে অতীনকে ঠিকঠাক ভাবে স্থিতি করিয়ে দিয়ে কৌশিক ফিরে গেল।
এই সতীশ মিশ্রের বাড়ির পাশেই থাকে একটি বাঙালী পরিবার। সেই পরিবারে দুটি মেয়ে এ বাড়ির মাতৃহীন ছেলেমেয়েদুটির জন্য মাঝে মাঝেই নানারকম খাবার ও খেলনা নিয়ে আসে। অতীনের মুখভর্তি দাড়ি গোঁফ থাকলেও বড় মেয়েটি তাকে দেখেই চিনতে পারলো। এই মেয়েটির নাম শর্মিলা, জলপাইগুড়ির এক চা বাগানে এর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল অতীন আর কৌশিকদের। শর্মিলার সব মনে আছে।
জামসেদপুরে ঐ বাড়িতে অতীনের কাটতে লাগলো মাসের পর মাস। এখানে অতীন। নিয়মিত ইংরিজি খবরের কাগজ পায়। সে জানতে পারলো, কানু সান্যাল ধরা পড়ে গেছেন। মানিকদার কোনো খবর নেই। রাষ্ট্রপতির শাসন তুলে দেবার দাবিতে জোরদার আন্দোলন। চলছে কলকাতায়। বামপন্থীরা অন্তর্বর্তী নির্বাচন চাইছে।
কৌশিক সেই যে গেল আর তার আসার নাম নেই। তবে তার কাছ থেকে খবর নিয়ে এর মধ্যে আরও দু’জন এসেছিল, তারা কেউই অতীনের চেনা নয়। তাদের একজনের হাতে অতীন। পেয়েছিল তার মায়ের চিঠি। অতীনও তাদের হাত দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিল দুখানা।
জামসেদপুরে বাঙালীর সংখ্যা অনেক, দুর্গাপুজো হয় বেশ কয়েকটা। সাকচিতেই প্রায় পাশাপাশি দুটো প্যান্ডেল। এই সময় সবকিছুই ঢিলেঢালা। তাই অতীন ঘোরাঘুরি করতে শুরু করলো দিনের বেলায়। পুজো প্যান্ডেলে যাওয়ার যে খুব আগ্রহ আছে তার তা নয়, কিন্তু সে স্বাধীনতা ভোগ করতে চাইছিল।
নবমী পুজোর দিন ভোরবেলা এক গাড়ি পুলিশ এসে বাড়ি ঘিরে ধরলো এবং অতীন গ্রেফতার হলো প্রায় ঘুমন্ত অবস্থায়। পাঁচদিন পর তাকে নিয়ে আসা হলো আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে।
পরে অবশ্য অতীন জেনেছিল যে তাকে ধরিয়ে দিয়েছেন অলির বাবা বিমানবিহারী।
এত গোপনীয়তার মধ্যেও কী করে যেন জানাজানি হয়ে গিয়েছিল অতীনের অজ্ঞাতবাসের ঠিকানা। প্রতাপ-মমতা জেনেছিলেন, অলি জেনেছিল। অলি কৌশিককে ধরে ছিল, সে একবার অতীনের সঙ্গে দেখা করতে জামসেদপুরে যাবে। সে উদ্যোগ নেবার আগেই বিমানবিহারী প্রতাপের কাছ থেকে জানতে পেরে গেলেন জামসেদপুরের কথা। সঙ্গে সঙ্গে তিনি পুলিশ কমিশনারের কাছে গিয়ে সব ঘটনা জানিয়ে এলেন।
বিমানবিহারী আসলে একটা সূক্ষ্ম বুদ্ধির চাল চেলেছিলেন।
মধ্যবর্তী নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। বামপন্থীদের নির্বাচনী শ্লোগানের মধ্যে আছে যে, ক্ষমতায় এলে তারা সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দেবেন। বিমানবিহারী হাওয়া দেখে বুঝেছিলেন যে বামপন্থীদের যুক্তফ্রন্টের আবার জয়ী হয়ে ফিরে আসার সম্ভাবনাই খুব বেশী। অতীন আত্মগোপন করে থাকলে তার নামে ওয়ারেন্ট রদ করা সহজ হবে না। বরং কিছুদিন রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে জেল খাটলেই নির্বাচনের পর তার মুক্তি পাওয়ার সুযোগ খুব উজ্জ্বল।
বিমানবিহারীর অনুমান প্রায় নির্ভুল। মধ্যবর্তী নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের জয় হলো, জ্যোতি বসু হলেন হোম মিনিস্টার এবং পূর্ব প্রতিশ্রুতি মতন রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দিলেন, তাঁদের ঘোষিত শত্ৰু কানু সান্যালরাও ছাড়া পেয়ে গেলেন। কিন্তু অতীনের কেসটা আটকে গেল। নথীপত্রে দেখা গেল অতীন রাজনৈতিক বন্দী নয়, তার নামে ক্রিমিন্যাল কেস, সে সাধারণ একটা খুনের আসামী।
এদিকে অতীনকে বিদেশে পাঠাবার ব্যবস্থা সব পাকা হয়ে গিয়েছিল। প্রতাপ ত্রিদিবকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেছিলেন ইংল্যান্ডে অতীনকে কিছুদিনের জন্য আশ্রয় দিতে। ত্রিদিব রাজি হয়েছিলেন সাগ্রহে। উঁচু মহলের বিভিন্ন ব্যক্তিকে ধরে অতীনের পাশপোর্ট এবং টিকিটেরও বন্দোবস্ত হয়ে গিয়েছিল, শেষ মুহূর্তে সব আটকে যাবার উপক্রম হলো।
কানু সান্যাল সমেত পরিচিত অন্যান্যরা সবাই ছাড়া পেয়ে গেলেও অতীন যখন মুক্তি পেল না, তখন সে খুবই ভেঙে পড়েছিল। বিমানবিহারী কিন্তু হাল ছাড়েননি। একটা প্রবল ঝুঁকি নিয়ে তিনি অতীনকে পাঁচ হাজার টাকার জামিনে খালাস করে আনলেন। তারপর জামিন ভঙ্গ করে তিনি অতীনকে তুলে দিলেন বিদেশের জাহাজে।
অতীন বিদেশে যেতে একেবারেই রাজি ছিল না। বাবা এবং বিমানকাকাকে সে অনেকবার বলেছে যে মুক্তি পেলেও সে লন্ডনে যাবে না। কিন্তু রাজনৈতিক বন্দীর মর্যাদা সে যখন পেল না, সাধারণ ক্রিমিন্যাল হিসেবে কয়েকদিনের জন্য মাত্র জামিনে ছাড়া পেয়ে তার দিশেহারা। অবস্থা। আবার তাকে জেলে যেতে হবে। বিচারে তার ফাঁসি না হলেও চোদ্দ বছর অন্তত জেল খাটতে হবে, কৌশিকই তখন বলেছিল, অলির বাবা ঠিক পথই বাতলেছেন। কিছুদিনের জন্য অন্তত বিলেতে থেকে আয়, এর মধ্যে তোর কেসটাকে পলিটিক্যাল অ্যাঙ্গেল দিতে হবে। বিমানবিহারী জ্যোতিবাবুকে বোঝাবেন, স্নেহাংশু আচার্যের সঙ্গে তাঁর বিশেষ ঘনিষ্ঠতা আছে
কলকাতার ময়দানে মে দিবসে কানু সান্যাল প্রকাশ্যে ঘোষণা করলেন নতুন এক রাজনৈতিক দলের জন্মের। দলটার নাম সি পি আই (এম এল) এবং এই দল পরিচালিত হবে। মাও সে তুং-এর চিন্তাধারায়। মাও সে-তুং-এর একটি রেড বুক আন্দোলিত করে তিনি বললেন, এই দলই ভারতে প্রথম সঠিক বিপ্লবী দল।
ঐ দিনই ময়দানের অন্য প্রান্তে আর এক বিশাল সভায় জ্যোতি বসু বললেন, তাঁর সরকার একদিনে নকশালদের দমন করতে পারে কিন্তু তিনি জনসাধারণের হাতেই সে ভার ছেড়ে দিতে চান। নকশালদের রাজনৈতিক বক্তব্য মোকাবিলা করা হবে রাজনৈতিক ভাবে, কিন্তু তাদের খুন-জখমের ক্রিয়াকর্মগুলো সাধারণ অপরাধীদের মতন বিচার করা হবে আইনের চোখে।
তার পরদিনই অতীন জাহাজে ভেসে পড়লো।…
সিদ্ধার্থ বললো, তোর বিলেতে থাকার অভিজ্ঞতাগুলো আমি শুনেছি। কিন্তু জামসেদপুরে কী হয়েছিল? এখন বোস্টনে যে শর্মিলা থাকে, তার সঙ্গে তোর আলাপ জামসেদপুরে? সেখানেই প্রেম হয়েছিল?
অতীন চুপ করে রইলো। সিগারেট ধরাতে গিয়ে তার হাত কাঁপছে। সে আর কথা বলতে পারছে না। শর্মিলার সঙ্গে কি তার প্রেম হয়েছিল? না বন্ধুত্ব? মাসের পর মাস সেই অজ্ঞাতবাসে শর্মিলাই ছিল তার কথা বলার একমাত্র সঙ্গী। সঙ্গিনী নয়, সঙ্গীই। অতীন প্রথম বেশ কিছুদিন শর্মিলাকে মেয়ে হিসাবে গ্রহণ করেনি, সহজ বন্ধুর মতন ছিল। অলি ছাড়া আর কোনো মেয়েকে ভালোবাসার কথা সে চিন্তাই করেনি।
কিন্তু পরপর কতকগুলো নির্জন দুপুর, অতীনের তখন প্রায়ই জ্বর হতো, শর্মিলা এসে সেবা করতো তাকে, এমন চমৎকার মেয়ে শর্মিলা, সরল, ভুলোমনা, পবিত্র। তার হাতের ছোঁয়ায় জাদু ছিল, প্রবল জ্বরের ঘোরে অতীনের একদিন মনে হলো শর্মিলাই অলি, সে তাকে জড়িয়ে ধরলো, বুকের কাছে টানলো, শর্মিলা জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে গেল নিজেকে।
একজন বিপ্লবীর সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়ায় রোমাঞ্চিত বোধ করতো শর্মিলা। অসুস্থ, অসহায় এই মানুষটিকে সেবা করে অদ্ভুত তৃপ্তি পেত, কিন্তু তার কোনো প্রেমের বোধ ছিল না। অতীন তো তাকে কোনোদিন ভালোবাসার কথা বলে নি। বিপ্লবীদের নিয়ম অনুযায়ী অতীন শর্মিলাকে তার পূর্ব পরিচয় কিছুই জানায় নি, অলির কথা, তার বাবা-মায়ের কথা, মানিকদার কথা একবারও উচ্চারণ করে নি সে।
কিন্তু মাসের পর মাস অনিশ্চিত অবস্থা, তার ওপর অসুখে ভুগে ভুগে দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। অতীন, তার মধ্যেই জেগে উঠেছিল এক প্রবল শারীরিক টান, এক এক সময় জ্বরের ঘোরে সে শর্মিলাকেই অলি মনে করে আদর করতে চাইতো। অলিকে সে ভালোবাসে, কিন্তু এখন অলি কেন তার কাছে নেই? এক অদ্ভুত, অযৌক্তিক অভিমান হচ্ছিল অলির ওপর। নারী-শরীরের স্পর্শের জন্য সে ছটফট করতো।
শর্মিলা কিন্তু অতীনকে কখনো প্রশ্রয় দেয় নি, প্রলুব্ধ করার তো প্রশ্নই ওঠে না। তখনও যেন শর্মিলার যৌন চেতনা জাগে নি। অসুস্থ একজন মানুষকে সে ধমক দিতে পারে না, কিন্তু অতীন বাড়াবাড়ি করতে গেলেই সে দূরে সরে যায়।
তিনদিন পর অতীন শর্মিলার জানু ধরে বললো, আমি তোমাকেই চাই!
শর্মিলাকে রাজি করাতে আরও সাতদিন লেগেছিল অতীনের। সেদিন একশো চার জ্বর, সে কিছুতেই ডাক্তার ডাকবে না, সে শুধু শর্মিলাকে চায়। শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ ভেঙে পড়লো শর্মিলার। সে অতীনের বুকে এলো। তারপর একটা প্রবল জোয়ার উঠলো, সে জোয়ারে ছেঁড়া চিঠির টুকরোর মতন অতীন ভাসিয়ে দিল অলিকে।