ওসি সাহেব তাদের থানার লকআপে ঢুকিয়ে দিলেন। ছেলেরা এবং মেয়েরা আলাদা হয়ে গেল। এই ওসি সাহেবকে স্টেশনে দেখা যায় নি। তিনি স্টেশনে যাননি। ভদ্রলোকের বয়স বেশি না। ভদ্র চেহারা। পুলিশের ভদ্র চেহারা হলে অস্বস্তি লাগে। মনে হয় কিছু একটা ঝামেলা আছে। তা ছাড়া ভদ্রলোক পাঞ্জাবি, পরে আছেন। পুলিশের লোক থানার ভেতরে পাঞ্জাবি পরবেন কেন?
জেনানা ওয়ার্ডে এক অল্পবয়স্ক পাগলীকে রাখা হয়েছে। সে বমি করে পুরোটা ভাসিয়ে ফেলেছে। সে শুধু বমি করেই ক্ষান্ত হয়নি—মনের আনন্দে নিজের বমিতে গড়াগড়ি করছে। ভয়ংকর গন্ধ। কোনো স্বাভাবিক মানুষ এর মধ্যে থাকতে পারে না। প্রথমে নইমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। ফিসফিস করে বলল, এখানে এক ঘণ্টা থাকলে আমি মরে যাব। আমি সত্যি মরে যাব। কেন আমি তোদের সঙ্গে এলাম! কেন এলাম? কেন এলাম? নইমার হিষ্টিরিয়ার মতো হয়ে গেল।
আনুশকা বলল, ন্যাকামি করবি না। এখন ন্যাকামির সময় না।
আমি ন্যাকামি করছি? আমি করছি ন্যাকামিঃ আমি ন্যাকামি করছি?
চুপ কর। এক কথা বারবার বলবি না।
নইমা ওয়াক ওয়াক করতে লাগল। সে যেভাবে ওয়াক ওয়াক করেছে–মনে হয় কিছুক্ষণের মধ্যে তার পাকস্থলির পুরোটা বের হয়ে আসবে।
আনুশকা কঠিন গলায় বলল, তুই যদি ওয়াক ওয়াক বন্ধ না করিস তাহলে আই স্যোয়ার বাই দ্য নেম অব গড—এই বমির খানিকটা তোকে খাইয়ে দেব। নইমা ওয়াক ওয়াক বন্ধ করল। তবে সে বসে পড়ল। মনে হচ্ছে সে সত্যি সত্যি অজ্ঞান হয়ে যাবে। সে ক্ষীণ স্বরে বলল, আনুশকা আমি মরে যাচ্ছি। আমি সত্যি মরে যাচ্ছি। নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। তালাবদ্ধ ঘরে আমি থাকতে পারি না। আমার ক্লস্টোফোবিয়া আছে।
মুনা নইমাকে ধরে রেখেছে। তার হাতে একটা ম্যাগাজিন। সে ম্যাগাজিনটা পাখায় মতো করে ক্রমাগত মইমার মাথায় বাতাস করে যাচ্ছে।
নীরা মুখে শাড়ির আঁচল। চাপা দিয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে। সেও কাঁপছে থরথর করে। জয়ী একদৃষ্টিতে পাগলী মেয়েটাকে দেখছে। মেয়েটা কুৎসিত নোংরায় মাখামাথি হয়ে আছে। মাথার চুল ছেলেদের মতো ছোট ছোট করে কাটা। তার পরেও এই মেয়েটি যে রূপবতী তা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।
নইমা গোঙানির মতো শব্দ করতে লাগল। মুনা ভয় পেয়ে আনুশকাকে বলল, আপা, উনি কেমন জানি করছেন। আনুশকা গলা উঁচিয়ে ডাকতে লাগল—কে আছেন এখানে? কে আছেন? ওসি সাহেব! ওসি সাহেব!
ওসি সাহেব এগিয়ে এলেন। তাঁর মুখে জ্বলন্ত সিগারেট। মুখের ভঙ্গি অত্যন্ত শান্ত! যেন কিছুই হয় নি।
হৈচৈ করছেন কেন?
সঙ্গত কারণেই হৈচৈ করছি। কেন করছি সেটা আপনার না বুঝতে পারার কোনো কারণ নেই। আপনাকে দেখেই মনে হচ্ছে আপনি বুদ্ধিমান। তবে বুদ্ধিমান লোকরা মাঝে মাঝে খুব কাঁচা কাজ করে। আপনি আমাদের হাজতে ঢুকিয়ে যে কাঁচা কাজটি করেছেন তা ফলাফল সুদূরপ্রসারী হবার সম্ভাবনা।
ওসি সাহেব আগের চেয়েও শান্ত গলায় বললেন, মিস আনুশকা, কাচা কাজ আমাদের প্রায়ই করতে হয়। কাচা কাজ করতে যে আমরা ভালোবাসি কিংবা ইচ্ছা! করে করি তা না। উপরের নির্দেশ পেয়েই করি।
উপরের নির্দেশ পেয়েছেন বলে আমাদের একটা পাগলীর সঙ্গে খাঁচার ভেতর আটকে রাখতে হচ্ছে?
অবশ্যই। আপনাদের দেখেই বোঝা যাচ্ছে-আপনাদের ক্ষমতা আছে। আপনাদের যোগাযোগ ভালো। খোদ প্ৰাইম মিনিষ্টারের সঙ্গেও আপনাদের কারোর আত্মীয়তা থাকা মোটেই বিচিত্র না। আমি শখ করে আপনাদের এখানে ঢোকাব কেন?
আপনি আমাদের আটকে রাখবেন?
জি। আমার ওপর সেরকমই নির্দেশ। আপনাদের বিরুদ্ধে কিডন্যাপিংয়ের মামলা আছে। একজনের বিবাহিতা স্ত্রীকে আপনারা কিডন্যাপ করে নিয়ে এসেছেন। তার গায়ে চার লক্ষ টাকার গয়না আছে। কোর্ট থেকে আপনাদের গ্রেফতার করতে বলা হয়েছে। আমরা করেছি। কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে আপনাদের কোর্টে হাজির করব। তখন কোর্ট যদি আপনাদের জামিন দেয়আপনারা যেখানে যাচ্ছিলেন সেখানে চলে যাবেন। আমরা কাজ করছি According to the Book.
আমি কয়েকটা টেলিফোন করব।
আমাদের টেলিফোন নষ্ট।
অর্থাৎ আপনি আমাদের টেলিফোন করতেও দেবেন না?
বললাম তো, আমাদের টেলিফোন নষ্ট। ডায়াল টোন নেই।
কতক্ষণ আমাদের এভাবে আটকে রাখবেন?
মনিরুজ্জামান সাহেব ঢাকা থেকে রওনা হয়েছেন। উনি এসে পৌঁছার পরই ব্যবস্থা হবে?
উনি কখন এসে পৌঁছবেন?
সেটা নির্ভর করে উনি কিসে আসেন তার ওপর। ফার্স্ট ফ্লাইটে এলে বেলা নটার মধ্যে পৌঁছে যাবার কথা। যদি হেঁটে আসেন তাহলে দিন দশেক লাগার কথা।
আপনি কি আমাদের সঙ্গে রসিকতা করছেন ওসি সাহেব?
জি, করছি। শুধু আপনারাই রসিকতা করতে পারবেন। আর আমরা পুলিশের চাকরি করি বলে রসিকতা করতে পারব না।–তা তো হয় না।
আনুশকা হাল ছেড়ে দিল। ওসি সাহেব চলে যেতে চাইলেন, তখন জরী নরম গলায় ডাকল, ওসি সাহেব, আপনি কি আমার কিছু কথা শুনবেন?
জি শুনব। বাংলাদেশের পুলিশের বর্তমানে প্রধান কাজ হচ্ছে কথা শোনা। আমরা সবার কথা শুনি। বলুন কী বলবেন?
সমস্যাটা তো আমাকে নিয়ে? আমি তো আছিই। আমাকে যেখানে রাখবেন। আমি সেখানেই থাকব এবং মনিরুজ্জামান সাহেবের জন্যে অপেক্ষা করব। আপনি এদের ছেড়ে দিন। আর ছেড়ে দিতে না পারলে অফিসে নিয়ে বসান। প্লিজ। তাকিয়ে দেখুন–আমাদের একজন অসুস্থ হয়ে পড়েছে। নিঃশ্বাস নিতে পারছে না।
আপনাদের কষ্ট করতেই হবে। উপায় নেই।
আনুশকা বলল, খুব ভালো কথা। আমাদের ছাড়তে না পারেন-ঐ পাগলীটাকে ছাড়ুন। তাকে ধরে রেখেছেন কেন? সেও কি কাউকে কিডন্যাপ করে নিয়ে এসেছে?
না, সে কাউকে কিডন্যাপ করে আনে নি?
তাহলে তাকে হাজতে ভরে রেখেছেন কেন? হাতের কাছে সুন্দরী মেয়েছেলে না থাকলে ভাল লাগে না?
দেখুন। মিস আনুশকা, আপনি সকাল থেকেই অত্যন্তু আপত্তিকর কথা বলে যাচ্ছেন
যতক্ষণ আমাদের না ছাড়বেন ততক্ষণ বলব। তা ছাড়া আপনারা রূপবতী বিকৃতমস্তিষ্ক একটি মেয়েকে অকারণে ধরে রেখে দেবেন, আমরা কিছু বলতেও পারব না?
অকারণে ধরে রাখি নি। পাগল গ্রেফতার করার বিধান আছে। তাছাড়া মেয়েটি সুন্দরী। পাড়ার মাস্তানদের হাতে ঘন ঘন রেপ্ড হবার কপাল নিয়ে এসেছে। তাকে বাঁচানোর জন্যেই এখানে এনে রেখেছি।
যারা রেপ করছে তাদের কিছু বলছেন না, যে রেপ্ড হচ্ছে তাকে হাজতে ভরে রেখেছেন। আপনারা তো অত্যন্ত প্রশংসনীয় কাজ করছেন। শুনুন ওসি, আমি অত্যন্ত ভদ্র এবং বিনীত ভাষায় আপনার কাছে একটি অনুরোধ করছ– তাকিয়ে দেখুন, হাত জোড় করে বলছি। এই পাগলীটাকে ছাড়তে হবে না। একে হাজতেই রাখুন।–তবে দয়া করে একে ভালো করে সাবান দিয়ে একটি গোসল দিন। আমি টাকা দিচ্ছি–বাজার থেকে কিনে নতুন শাড়ি-ব্লাউজ-পেটিকেট নিয়ে আসার ব্যবস্থা করুন। ওর গায়ে যেসব কাপড় আছে সেগুলি হয় মাটির নিচে পুঁতে ফেলার ব্যবস্থা করুন, কিংবা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিন। আগুন জ্বালাবার খরচও আমি দেব; তারপর আপনি যা করবেন তা হচ্ছে-বড় দুবালতি পানি পাঠাবেন, একটা শলার ঝাড়ু পাঠাবেন এবং এক লিটারের একটা ফিনাইলের কৌটা পাঠাবেন। আমি নিজেই এই হাজতখানা ধোব। আমি নিজে যে ধোব, তার জন্যেও আপনাকে খরচপাতি দেব! এইখানেই শেষ না-পরবর্তী সময়ে আপনাকে পুরস্কৃত করব।
আমাকে পুরস্কৃত করবেন?
জি। আপনাকে এমন এক জায়গায় ট্রান্সফারের ব্যবস্থা করব যেখানে খুনের ছড়াছড়ি। প্রতি সপ্তাহে একটা করে মার্ডার হয়—তিনটি রেপ—গোটা দশেক ডাকাতি প্লাস চোরাচালানি। এমন সুবৰ্ণ সুযোগ হেলায় হারাবেন না। ওসি সাহেব। Chance of lite time.
মুনা খিলখিল করে হাসছে। এমন আনন্দিত ভঙ্গিতে সে অনেক দিন হাসে নি। তাকে হাসতে দেখে পাগলীটাও হাসছে। ওসি সাহেব কিছু বললেন না। যেরকম শান্ত ভঙ্গিতে এসেছিলেন সে রকম শান্ত ভঙ্গিতে চলে গেলেন।
তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এক বালতি পানি এবং ঝাটা নিয়ে জমাদার উপস্থিত হলো। দাঁত বের করে বলল, ওসি সাহেব বলছেন, শাড়ি তেল সাবান কী কী জানি। কিনবেন—টেকা দেন।
আনুশকা তার পার্স খুলে টাকা বের করল। জরীর দিকে তাকিয়ে বলল, জরী শোন, তুই কোনো ভয় পাচ্ছিস না তো? না, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এই ওসি মানুষটা খারাপ না। তোর কোনো বিপদ ওই ওসি হতে দেবে না।
এরকম মনে হবার কারণ কি?
কোনো কারণ নেই–ইনট্যুশন।