ঢাকা থিকা জিহাদিরা আইসছেন
এক বডিগার্ড দরোজায় টোকা দিয়ে বলে, ‘হুজুর, ঢাকা থিকা জিহাদিরা আইসছেন।’
আমি বলি, ‘জিহাদিদের বসতে বলো, কোক ফান্টা সেভেন আপ দাও।’
আমি ওজু করে, পাজামাপাঞ্জাবি পারে বাইরে বেরোই, দেখি একদল জিহাদি ব’সে আছে, তিরিশজনের মতো।
জিহাদিদের আমি যতোই দেখি ততোই বিস্মিত হই।
আমাকেও পুরোপুরি ওদের মতো হ’তে হবে, সাম্যবাদ ও সর্বহার করেও আমি ওদের মতো হয়ে উঠতে পারি নি, কিন্তু পারতে হবে; খুন করার সময় ওরা ছুরির থেকেও ধারালো আর নিষ্ঠুর, ছহবতের সময় ওরা লোহার মতো শক্ত, শক্ত হতেও সময় নেয় না, ক্ষরণেও সময় নেয় না, আবার শক্ত হয়, বিছমিল্লা বলে আবার শুরু করে; এবং বিনয়ের সময় ওরা পা ধ’রে ছালাম করতেও দ্বিধা করে না, পায়ে পড়ে যায় অবলীলায়, পচা ময়লার মতো প’ড়ে থাকে।
এটা খুবই দরকার, দীক্ষিত করতে হ’লে এমনই দীক্ষা দরকার।
ওরা সবাই মাদ্ৰাছার তালেবেলেম, ওরাও পরীক্ষা দেয়, পরীক্ষায় নকল করার সময় ওরা আশমানি কেতাবের পাতা জুতোর ভেতর ঢুকিয়ে নেয়, একটুও ভয় পায় না, যদিও সাম্যবাদ করার পরও এটা আমি কোনো দিনই করতে পারবো না, আবার খুনের সময় ওরা দশগুণ শিমার ও মুহম্মদি বেগ, ছুরি হাতে পথে পথে ছুটতে পারে।
আমার এক দোস্ত, হারামজাদা এক সময় সাম্যবাদ করতো, পরে বিসিএস দিয়ে আমলা হয়ে গেছে, তবে ওর বাড়িটা এক সময় ছিলো আমার বড়ো আশ্ৰয়, কিছু হ’লেই গিয়ে ওর বাসায় উঠতাম। একদিন গিয়ে দেখি হারামজাদা বাসায় নেই, হারামজাদার না কি অনেক মিটিং।
ভাবি বলেন, ‘কি হে মহামতি কার্লমার্ক্স, কমরেড লেনিন, কমরেড স্ট্যালিন, কমরেড চে গুয়েভারা, খতমি হক সাহেব? বিপদ হয়েছে না কি?’
ভাবিটি বাঙলার ছাত্রী ছিলেন, পরিহাস করতে পারেন যখন তখন; তাঁর পরিহাস আমার ভালোই লাগে, আর বুকে একটু কষ্ট লাগে।
আমি বলি, ‘না, ক্ষুধা লেগেছে; আর ওই ট্রেইটরটা কই?’
ভাবি বলেন, ‘ট্রেইটরটা তার উপজেলায় মাদ্ৰাছার হিশেবে করতে গেছে, আর ফাজিল দাখিল কামিল কাহিল কুহিল পরীক্ষার সেন্টার দেখতে গেছে।’
আমি বলি, ‘ট্রেইটরটা এখন মাদ্ৰাছা নিয়েই আছে?’
ভাবি বলেন, ‘ক্ষুধা কেমন লেগেছে?’
আমি বলি, ‘দুই চারটি হাতি খেতে পারি।’
ভাবি বলেন, ‘তাহলে খেয়ে ঘুম দিন, সন্ধ্যায় ট্রেইটরের সঙ্গে দেখা হবে।’
অনেক দিন পর পেট ভ’রে ভাত খাই। মুরগির গোস্ত, লাউডগা দিয়ে কই মাছ, গোলশা, চিংড়ির ভর্তা দিয়ে কয়েক থাল ভাত খেয়ে একটি লম্বা ঘুম দিই, সন্ধ্যার পর উঠে দেখি ট্রেইটরটা এসেছে। দেখি ট্রেইটরটার সব কিছুই আগের থেকে ভালো, বউটা ভালো—ভাবিকে আমি আগে থেকেই চিনি, তাঁর জন্যেই তো সাম্যবাদীটা ট্রেইটর হয়ে গেলো,–চেহারাটা আরো ভালো হয়েছে, জিপটাও ভালো, একটা মেয়ে হয়েছে, সেটিও ভালো।
সাম্যবাদ। আমাকে ভালো কিছু দেয় নি।
আমি বলি, ‘আই ট্রেইটর, তুই না কি এখন মাদ্ৰাছায় মাদ্ৰাছায় ঘুরিস?’
ট্রেইটর বলে, ‘এই ইছলামেরর পাণ্ডাগুলো আমাকে পাগল ক’রে দিচ্ছে, ইচ্ছে হয় আবার সর্বহারা হয়ে যাই।’
আমি বলি, ‘কী হয়েছে?’
ট্রেইটর বলে, ‘সাত দিন ধ’রে আমার কাজ পড়েছে আমার উপজেলায় আসলে কটি সরকারি মাদ্ৰাছা আছে, কজন হুজুর আছে, তার হিশেবে বের করা। তারপর আবার এখন ফাজিল কামিল দাখিল কাহিল কুহিল পরীক্ষা চলছে, ওই সব পরীক্ষার হলে গিয়ে নকল ধরতে হচ্ছে।’
আমি বলি, ‘কী দেখছিস?’
ট্রেইটর বলে, ‘সন্ধ্যার পরই তুই তা দেখতে পাবি।’
সমাজের সঙ্গে তো আমার কোনো সম্পর্ক ছিলো না, সমাজ কীভাবে কাজ করে তা আমি জানি নি; আমি জানতাম সমাজ হচ্ছে শ্রেণীদ্বন্দ্বের ব্যাপার, আর আমাদের কাজ হচ্ছে শোষণকারীদের শোধন ও নিধন করা। এর জন্যে দরকার অস্ত্ৰ, কাটা রাইফেল, চাইনিজ রাইফেল, স্টেনগান, গ্রেনেড, বোমা, মাইন প্রভৃতি, এবং নিউজপ্রিন্টের অজস্র ইশতেহার। সন্ধ্যা হতে হয় না, বিকেলেই দেখি টুপি দাড়ি নিয়ে একদল ঢুকছে ট্রেইটরের ড্রয়ি রুমে।
সবাইকে সে ঢুকতে দেয় না, অধিকাংশই দাড়িয়ে থাকে বাড়ির বাইরে গাছতলায়; কেউ কেউ গাছতলায় গামছা পেতে নামাজ পড়তে থাকে।
ট্রেইটর ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই জনদশেক বুড়ো মওলানা মৌলভি তার পায়ে পড়ে যায়, তার পায়ে চুমো খায়, সেজদা দেয়ার মতো পড়ে থাকে। আমি সর্বহারা হ’লেও এতে একটু কেঁপে উঠি; কিন্তু আমার ট্রেইটরটা এরই মাঝে সমাজকে বুঝে ফেলেছে, সে কাঁপে না, সে তাদের পা থেকে উঠতে বলে না, যেনো তার পা দুটি ওদের পড়ে থাকার জন্যেই সরকার বাহাদুর দিয়েছেন; ট্রেইটর একবার আমার দিকে তাকায়, যেনো বলছে, ‘দ্যাখো।‘
ট্রেইটর, যদিও জানে এরা কারা, তবু বলে, ‘আপনারা কারা?’
তারা এবার মাথা নিচু ক’রে দাঁড়ায়, দাঁড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে বলে, ‘ছার, হুজুর, আমরা আপনের অধীনের মাদ্ৰাছার হুজুর।’
ট্রেইটর বলে, ‘আপনারা কেনো এসেছেন?’
হজুররা বলে, ‘ছার, আমরা শুনছি আপনে আমাগো মাদ্ৰাছা ভিজিটে গেছিলেন, আমরা সেই সোম এবাদত বন্দেগি করতেছিলাম, তাইতে আপনে আমাগো পান নাই, ছার আপনে আমাগো বাচান।’
ট্রেইটর বলে, ‘তখন তো এবাদতের সময় ছিলো না।’
হুজুররা বলে, ‘ছার, আমরা সব সোমই আল্লার এবাদত বন্দেগি করি, এবাদত বন্দেগি সব সোমাই করন যায়।’
ট্রেইটর বলে, ‘কিন্তু আপনাদের তো বেতন দেয়া হয় পড়ানোর জন্যে, সব সময় এবাদতের জন্যে নয়।’
হজুররা বলে, ‘ছার, আল্লা রছুলের পরই আপনে আমাগো মালিক, এইবার আমাগো মাফ কইর্যা দ্যান, আল্লায় আপনেরে ভেস্ত দিবো।’
ট্রেইটর বলে, ‘আমার উপজেলায় কাগজেকলমে ১৫০টি মাদ্ৰাছা আছে, আমি ভিজিটে গিয়ে দেখেছি আছে পাঁচটি; অন্য কোনোটির নাম হিজল গাছের ডালে, কোনোটির নাম আমগাছের ডালে, কোনোটির নাম মুদিদোকানের চালে, ওই সব মাদ্রাছা আমি দেখতে পাই নি।‘
হজুররা বলে, ‘হুজুর, আমরা গুনাহর কাম করছি, আমাগো মাফ কইর্যা দেন, নাইলে পোলাপান লইয়া মরুম।’
ট্রেইটর বলে, ‘কিন্তু বেহেশতে তো ভালো থাকবেন, হুর আর গেলমান পাবেন বলে শুনেছি।’
গেলমান শব্দটি আমি ওই প্ৰথম শুনি, বুঝতে পারি ট্রেইটর বিসিএস হওয়ার জন্যে অনেক কিছু শিখেছে গাইড বই প’ড়ে।
হজুররা বলে, ‘কে ভেস্ত পাইব আর না পাইব, তা কি কওন যায়, ছার? তয় দুনিয়ায় ভাতকাপড় না আইলে বাচন যায় না। দুনিয়ায় বউ পোলাপান ভাত না পাইলে হুরে গোলমানে কি হইব?’
ট্রেইটর বলে, ‘১৫০টি মাদ্ৰাছায় আপনারা কতোজন হুজুর আছেন?’
হজুররা বলে, ‘গড়ে পাঁচজন কইর্যা ধরলেও ৭৫০জন আছি, হুজুর।’
ট্রেইটর বলে, ‘আপনাদের বেতন কতো?’
ট্রেইটর বলে, ‘চার হাজার ক’রে ধরলে ৭৫০জনের বেতন কতো হয়?’
তারা হিশেবে করতে শুরু করে, হিশেবে করে উঠতে পারে না; কিন্তু আশ্চৰ্য, তারা কোটি কোটি ছোয়াব সহজে হিশেব করতে পারে।
হজুররা বলে, ‘হিছাব করতে পারতেছি না, হুজুর।’
ট্রেইটর বলে, মাসে তিরিশ লক্ষ টাকা, আর ওই টাকাটা আপনারা ফাঁকি দিয়ে নিচ্ছেন; দেশকে ফাঁকি দিচ্ছেন, আল্লাকে ফাঁকি দিচ্ছেন।’
হজুররা চিৎকার করে কেঁদে ওঠে, নাউজুবিল্লা।’
ট্রেইটর বলে, ‘আমি রিপোর্ট দিচ্ছি যে পাঁচটি মাদ্ৰাছা রেখে অন্যগুলো বন্ধ করে দিতে, কারণ ওগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই।’
হুজুররা আবার ট্রেইটরের পায়ে পড়ে হুহু ক’রে কেঁদে ওঠে।
ট্রেইটরটা বয়সে আমার সমান, ওর পায়ে পড়ছে এতোগুলো হুজুর, যারা ওর পিতার সমান, এটা দেখে ট্রেইটরটাকে আমি শ্ৰদ্ধা করতে শুরু করি। আমি অবশ্য ট্রেইটর হতে পারবো না, রাইফেল হাতে নিয়ে শ্রেণীশক্ৰ খতম করতে গিয়ে আমি নিজেকে অনেক আগেই খতম করেছি।
হজুররা বলে, ‘ছার, পোলাপান লইয়া আমরা মারা যামু, আপনে আমাগো বাচান, আপনে আমাগো বাপের মতন।’
ট্রেইটর বলে, ‘আমার তো কিছু করার নেই, সরকার জানতে চেয়েছে, আমার কাজ হচ্ছে সত্য রিপোর্ট দেয়া, মিথ্যে বললে তো আমি দোজগে যাবো। আপনারা কি চান আমি দোজগে পুড়ি?’
আবার হুজুররা তার পায়ে পড়ে, হুহু ক’রে কেঁদে ওঠে।
হজুররা বলে, ‘না, না, হুজুর, আপনে দোজগে যাইবেন না, আমরা বালবাচ্চা লইয়া মইর্যা যামু, আমগো বাচান। ‘
আমি দেখি ট্রেইটর খুব পাকা হয়ে উঠেছে, বুড়ো হুজুরগুলো ওর পায়ে পড়ছে, হুহু ক’রে কাঁদছে, কিন্তু সে অটল থাকছে সততায়। ট্রেইটর বিস্ময়কররূপে সৎ হয়ে উঠেছে, সততায় সে অটল।
ট্রেইটর বলে, ‘কী ক’রে বাঁচাবো, বলুন, আপনারা তো ইসলামের বিরুদ্ধে কাজ করছেন, আল্লার বিরুদ্ধে কাজ করছেন, আমাদের পাক আল কোরানে তো মানুষকে সৎ থাকতে বলা হয়েছে।’
হজুররা বলে, ‘হুজুর, আমরা মমিন মুছলমান থাকতে পারি নাই, আল্লাপাকের কোছে গুনাহ্ করছি, তয় আপনে আমাগো বাচাইতে পারেন, আল্লা রজুলের পরই আমাগো কাছে আপনে৷’
ট্রেইটর বলে, ‘কী করে বাঁচাবো?’
হুজুররা নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে আলোচনা করে। একটি ব্যাপার আমাকে বেশ বিস্মিত করে, আমরা দুজন সোফায় বসে আছি, কিন্তু ট্রেইটর ওই বুড়োগুলোকে একবারও বসতে বলে নি। হুজুররা একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছে মনে হয়, আমরা দুজন তখন চা খাচ্ছি।
এক হজুর বলে, ‘ছার, হুজুর, আমাগো একটা আরজি আছে আপনের কাছে, আপনে মাফ করলে আরজিটা আপনারে কইতে পারি।‘
ট্রেইটর বলে, বলুন।’
হজুর বলে, ‘আপনের শ্ৰদ্ধেয় বন্ধুর সামনেই বলুম?’
ট্রেইটর বলে, ‘বলুন।’
হুজুর বলে, ‘আমাগো তিরিশ লোকের থিকা পনর লাক আপনে রাইকা দেন, বাকিটা আমাগো দেন, তাতেই আমরা বালবাচ্চা লইয়া বাচতে পারুম।‘
ট্রেইটর বলে, ‘রিপোর্ট আমি দু-একদিনের মধ্যে দেবো, তার আগেই আপনারা সব ব্যবস্থা করবেন।’
‘জি হুজুর’ বলে হুজুররা ট্রেইটরের পায়ে চুমো খেয়ে, বারবার পদধুলো নিয়ে, অনেকে আমার পায়েও চুমো খেয়ে, খুশিতে ‘আলহামদুলিল্লা’ বলতে বলতে বেরিয়ে যায়।
আমি একদল জীর্ণ মেরুদণ্ডহীন ভাঙা গাধাকে বেরিয়ে যেতে দেখি।
ট্রেইটর আমাকে বলে, ‘এরা দরকার হ’লে পায়ে চুমো খেতে পারে, দরকার হ’লে খুনও করতে পারে, তবে ওরা আমাকে খুন করবে না; ওরা সেজদা দিতে দিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।’
আমি ট্রেইটরের দক্ষতা দেখে মুগ্ধ হই, সম্ভবত শিক্ষা নিই।
আমি সাম্যবাদ করেছি, সর্বহারা করেছি, খুন করেছি, শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছি, কিন্তু এতোটা দক্ষতা কখনো দেখাতে পারি নি, আমলারা দক্ষতায় পবিত্ৰ শয়তানের থেকেও নিপুণ; কিন্তু আমার মধ্যে দক্ষতা দেখানোর একটি স্বপ্ন জেগে ওঠে। কিন্তু কী করে আমি এটা পারবো? আমার নেতারা একের পর শ্রেণীসংগ্ৰাম ছেড়ে একনায়কদের বুটের নিচে পড়ছে, আমি বুটের কাছাকাছিও যেতে পারছি না; কিন্তু আমি ব্যর্থ হতে দিতে পারি না। আমাকে। আমি তো খারাপ ছাত্র ছিলাম না, স্টার ছিলো মাধ্যমিকে উচ্চমাধ্যমিকে, আর আমার এই প্রিয় ট্রেইটর আমার থেকে খুব বেশি ভালো ছাত্র ছিলো না; মনোয়ারা নামে একটি তরুণী তাকে তুলে আনে সাম্যবাদ, সর্বহারা থেকে, নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় দেয়; তখন মনোয়ারা বাঙলায় অনার্স পড়তো, গ্রিনরোডে তাদের বাসা ছিলো; ট্রেইটরটি ওই বাড়িতে ঢুকে আর বেরোয় নি। মনোয়ারা তাকে শ্রেণীসংগ্রামের থেকে বেশি দিয়েছে; আমাকে কোনো মনোয়ারা উদ্ধার করে নি, পৃথিবীতে আমার জন্যে কোনো মনোয়ারা আনোয়ারা সালেহা জন্মে নি; একটি আগুন আমার বুকে জ্বলছিলেই; আমাকে একদিন নিয়ন্ত্রক হ’তে হবে।
কিছুক্ষণ পরে দেখি মঞ্চে অন্য মঞ্চনাটক, আমলারা নিপুণ অভিনেতা।
পিয়ন সংবাদ দিতেই আমার প্রিয় ট্রেইটর দৌড়ে গিয়ে আঙিনা থেকে এক বয়স্ক ভদ্রলোককে নিয়ে আসে। এবারও আমি অবাক হই, একদল বুড়ো হুজুরকে যে পদতলের বেশি দেয় নি, সে-ই একজন ভদ্রলোককে দৌড়ে বাইরে গিয়ে ‘স্যার, স্যার’ ব’লে নিয়ে আসে! ট্রেইটর তাঁকে বারবার ‘স্যার, স্যার’ বলছে দেখে আমিও উঠে সালাম দিই।
তাঁকে সালাম দিতে আমার কোনো দ্বিধা হয় না; বেশ শুভ্ৰ সুন্দর মার্জিত মানুষ, কথা বলছেন চমৎকার বাঙলায়, মুখে সুন্দর শাদা দাড়ি।
তাঁকে দেখেই আমার মনে দাড়ি রাখার স্বপ্ন জাগে, তাঁর মতো দাড়ি; যখন বুড়ো হবো তখন আমাকে হয়তো তাঁর মতো দেখাবে। ভদ্রলোক কে, আমি জানি না; কিন্তু আমার ট্রেইটর তাঁকে বিনয়ের সঙ্গে ‘স্যার, স্যার’ করছে দেখে বুঝি তিনি শক্তিমান কেউ। কিন্তু তাঁর কথায় কোনো শক্তির আভাস পাচ্ছিলাম না, পাচ্ছিলাম একটু মহত্ত্বকে, যা আমি কোনো দিন পাই নি। ভদ্রলোকের সঙ্গে আরো কয়েকজন এসেছে, তাদেরও আমার বেশ ভদ্ৰ মনে হয়।
ট্রেইটর ভদ্রলোককে পরিচয় করিয়ে দেয় আমার সঙ্গে।
বলে, ‘স্যার, আমার উপজেলার সবচেয়ে মান্যগণ্য ব্যক্তি, স্যারকে আমি শ্রদ্ধা করি’, আর আমার সম্পর্কে বলে, ‘আমার প্রিয় বন্ধু।’
ট্রেইটর বলে, ‘স্যার, আমাকে ডাকলেই আমিই যেতাম আপনার কাছে, আপনি কেনো এতো কষ্ট করে এলেন?’
ভদ্রলোক বলেন, ‘আপনাকে ডাকা অনুচিত হতো, আপনাকে ডাকার মতো পাওয়ারেও আমি নেই, আমি এসেছি আমার একটি দরকারে।’
ট্রেইটর বলে, ‘কী দরকার, স্যার?’
ভদ্রলোক বলেন, ‘আমাদের এলাকায় পাঁচটি মাদ্ৰাছা আছে, আজ ওদের পরীক্ষা ছিলো। আপনি না কি পরিদর্শনে গিয়ে সব ছেলেকে বহিষ্কার করেছেন?’
ট্রেইটর বলে, ‘জি, স্যার, বহিষ্কার করেছি; কেন্দ্ৰ বন্ধ করে দিয়েছি।’
ভদ্রলোক বলেন, ‘এবারের মতো ওদের একটু মাফ করে দিন।’
ট্রেইটর বলে, ‘জি, স্যার, মাফ ক’রে দেবো, যদি আপনি বলেন; কিন্তু তারা যে-অপরাধ করেছে, তা একটু আপনাকে শুনতে হবে।’
ভদ্ৰলোক বলেন, ‘কী অপরাধ করেছে?’
ট্রেইটর বলে, ‘স্যার, গিয়ে দেখি ওরা সবাই জুতোর ভেতরে কোরান হাদিসের পাতা ঢুকিয়ে নিয়ে এসেছে; আমি ওদের জুতো খুলে রেখেছি, জুতোয় ওদের নাম লিখে রেখেছি। চলুন স্যার, জুতোগুলো আপনাকে দেখাবো।’
ভদ্রলোক ‘নাউজুবিল্লা’, ‘আস্তাগাফেরুল্লা’ বলে চিৎকার ক’রে দাঁড়িয়ে যান, বলেন, ‘ওইগুলি কাফেরের থেকে কাফের, পাক কিতাবের পাতা ওরা জুতার ভিতর ঢুকিয়ে এনেছে? ওইগুলোকে আপনি শাস্তি দিন, আমার কিছু বলার নেই, আমি নিজেই ওইগুলোকে জুতা দিয়ে পিটাবো।’
শান্ত স্নিগ্ধ ভদ্রলোক আগুনের মতো দাউদাউ ক’রে ওঠেন।
তার কিছু দিন পরই আমি জামাঈ জেহাদে যোগ দিই। আমি বুঝতে পারি ওখানে গেলে আমি নেতা হতে পারবো।
আমি ঢাকা থেকে আসা জিহাদিদের সঙ্গে কথা বলি, টাকার বান্ডিলটি নিয়ে ভেতরে রাখি, ভৈরব দিবসে কী করতে হবে, সব বুঝিয়ে দিই: ওরা সহজেই বোঝে, বুঝতে বুঝতেই ওরা এসেছে। ওরা ওদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসেছে, আর ওরা নিজেরাই অস্ত্ৰ। ওদের জন্যে খাওয়ার, থাকার ব্যবস্থা ঠিক করা আছে; ভালো খাবারের ব্যবস্থা করেছি, মাদ্রাছার দশজন তালেবানকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ওদের খাওয়ানোর, দেখাশোনা করার। মাদ্ৰাছার পশ্চিমে মসজিদে ওরা থাকবে, যেনো মুসাফির; ওরা প্ৰথমে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে।
ওদের ব্যবস্থা ক’রে ঘরে ঢুকে গিয়ে দেখি কণাকলতা জেগে উঠেছে। অল্প ঘুমে ওর মুখটি দ্বিগুণ কণকলতা হয়ে উঠেছে।
আমি আমার পাক পবিত্র কিতাবরাশির পেছন থেকে একটি বোতল বের করি; সিভাস রিগ্যালই আমার একটু বেশি পছন্দ। আহা, যখন সাম্যবাদী সর্বহার লেনিন স্ট্যালিন ট্রটস্কি গুয়েভারা ছিলাম, তখন একঢোক ধেনোও পেতাম না, মেথরপট্টিতে যেতাম, পেলে মনে হতো স্বর্গীয় শারাব পেয়েছি, এখন ব্ল্যাক লেভেল আমার কাছে ট্যাপের পানির মতো। পরম করুণাময় গফুরুর রাহিম কখন কাকে কী দেবেন, তা কে বলতে পারে?
কণকলতা বলে, ‘বতলটি তো খুব সোন্দর, হুজুর, এমুন বতল ত আগে কহনও দেহি নাই।‘
আমি বলি, ‘তোমার দেহখানির মতো সুন্দর নয়, তোমার দেহটি হচ্ছে স্বর্গের বোতল, আর ওই বোতলভরা অমৃত।‘
আমি গ্লাশে রিগ্যাল ঢালি, একটু পানি মেশাই, রঙটা সোনার মতো হয়ে ওঠে; কণকলতার মতো হয়ে ওঠে, তবে কণাকলতা আরো সোনালি।
আমি প্রথমে কণকলতার মুখের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলি, ‘একটু খেয়ে দ্যাখো, ভালো লাগবে।’
কণকলতা বিছমিল্লা’ বলে চুমুক দিয়েই বলে, ‘কী যে ঝাঁজ, তয় অনেক মজার, কী কোক এইটা, হুজুর? এইটা কি আমরিকার কোক?’
আমি বলি, ‘কতোটা মজার?’
কণকলতা বলে, ‘হুজুরের ছ্যাপের মতই মজার।’
কণকলতা আর আমি নগ্ন শুয়ে একটু একটু পান করতে থাকি, কণকলতার দেহটি পান করবো না সিভাস রিগ্যাল পান করবো বুঝতে পারি না; এক সঙ্গে দুই রকমের সিভাস রিগ্যাল পেলে কোনটি বেশি উৎকৃষ্ট, তা ঠিক করতে আমার মতো জ্ঞানীরও কষ্ট হয়। আমি কণকলতা থেকে সিভাস রিগ্যালে, সিভাস রিগ্যাল থেকে কণকলতায় যেতে থাকি। কণকলতাকেই আমার বেশি অ্যালকোহলময় মনে হয়, ১০০% ভলিউম।
কণকলতা বলে, ‘হুজুর, আপনে আমার সোয়ামি।’
আমি বলি, ‘তোমাকে একদিন আমি মুছলমান বানাবো।’
কণকলতা বলে, ‘সোয়ামি, আপনের ওই বান্ডিলটায় কী?’
আমি বলি, ‘সোনা।’
কণকলতা বলে, ‘আমি দেখুম?’
আমি বাণ্ডিলটা এনে ওকে খুলে দেখাই, লাখ লাখ টাকার নতুন নোট দেখে ও কাঁপতে থাকে, বলে, ‘হুজুর, আপনের এতো ট্যাকা?’
আমি পঞ্চাশ হাজারের একটা বান্ডিল তুলে বলি, ‘কণকলতা, এই বাণ্ডিলটা কি আমি তোমার সোনার খনিতে ঢুকাবো?’
কণকলতা বলে, ‘তাইলে আমি মইর্যা যামু, হুজুর, বাণ্ডিলটা আমার হুজুরের হুজুরজির থিকাও মোডা, আর আমার খনিডা ত ট্যাকার খনি না, এইডা তো সোনালি ব্যাংক না, অগ্রণী ব্যাংক না, ইছলামি আরব-দুবাই ব্যাংক না, দক্ষিণ আফ্রিকার জোহান্সবাৰ্গও না, এইডা হইল হুজুরের মধুর খনি, হুজুর ছাড়া আর কিছু ঢুকবো না।’
তবু আমি একটা বান্ডিল ঢুকোতে চেষ্টা করি। কণকলতা চিৎকার করে ওঠে; সব কিছু সব জায়গায় ঢোকে না, যা ঢোকার তা ঢোকে। না ঢুকবে না, কিন্তু আমি এটা ওকে দিতে চাই।
কণকলতা বলে, ‘বান্ডিলডা। আমার দুধের মাঝখানে থোন।’
আমি নিজে খনিতে ঢুকতে থাকি; কণকলতা বলে, ‘বিছমিল্লা শয়তানের রাজিম কইলেন না, হুজুর?’
আমি বলি, ‘বান্ডিলটা তোমার, যাওয়ার সময় নিয়ে যেও; এটা তোমার তিন নম্বর ব্রেস্ট, তবে আসল দুটো আমার।‘
কণকলতা বলে, ‘আলহামদুলিল্লা, এমুন ব্রেস্ট মাঝেমইদ্যে দিয়েন, হুজুর, আমি পুরা আলকোরান মোখস্থ কইর্যা ফেলুম, মুছলমান হইয়া যামু। কিন্তু হুজরি, এত ট্যাক দিয়া আমি কি করুম?’
আমি বলি, ‘টাকা হাতে এলেই দেখবে করার কাজের অভাব নেই, তখন দেখবে কতো কিছু করার আগে, কিন্তু হাতে টাকা নেই।’
কণকলতা বলে, ‘তাই না কি, হুজুর? বাবায় আমারে দুই মাস আগে এক শ ট্যাকা দিছিল, অহনও অইডা বালিশের নিচে পইর্যা আছে।‘
কণকলতা সুখের খনি, আমার দিলকে সুখে ভরে দিয়েছে; তাকে শুধু পঞ্চাশ হাজার দিয়ে আমি সুখ পাই না। ড্রয়ার থেকে আমি সবচেয়ে দামি সোনার হারটি বের করি, ওটি কণকলতার মতোই কণকলতা।
কণকলতা ওটির দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে।
আমি বলি, ‘কণকলতা, এটিও তোমার জন্যে।’
কণকলতা বলে, ‘হুজুর, আমার গলায় পরাই দ্যান, বিবি। অইয়া যাই।’
আমি বলি, ‘গলার থেকেও সুন্দর জায়গায় এটি পরাবো, সোনার খনিতে থাকবে এই সোনার হার।’
কণকলতা বলে, ‘সেইটা আবার কি?’
আমি বলি, ‘তুমি কণকলতার মতো ঘুমিয়ে পরো।’
কণকলতা চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে; আমি সোনার হারটি কণকলতার সোনার খনিতে ধীরেধীরে বিলুপ্ত করি, কণকলতা সুখে কেঁপে কেঁপে ওঠে। সোনার হারও কি তাহলে এক ধরনের শিশ্ন?
আমি বলি, ‘কণকলতা, তোমার খনিতে সোনা আছে, তুমি খনন করে সোনা বের করে নাও, এই সোনা তোমার।’
কণকলতা সেটি বের করে চমকে ওঠে, চোখ ভরে তার সোনা জ্বলতে থাকে, বলে, ‘হুজুর, এইটা আমার গলায় পরাই দ্যান।’
আমি পরিয়ে দিই; কণকলতা আমাকে নমস্কার করে বলে, ‘হুজুর, আইজ থিকা আমি আপনের বিবি হইলাম; আর কেও এই দ্যাহ পাইব না।’
আমি বলি, ‘এর আগে কে পেয়েছে?’
কণকলতা বলে, ‘কতজনে পাইতে চাইছে, কেরেও দেই নাই; কুত্তাগো লগে গাইট বান্ধনের কতা মনে আইলেই আমার ঘিন্না লাগছে।’
আমি বলি, ‘আমিও তো কুত্তা।’
কণকলতা বলে, ‘কি যে কন, হুজুর, আপনে আমার দিল, আমার সোয়ামি, আমরা বাগদাদের বাদশাহ হারুনর রশিদ, দিল্লির সম্রাট শাজাহান। হুজুর, আমি মইর্যা গেলে আপনে আমারে কবর দিয়েন, কবরডার নাম দিয়েন কণকমহল।’
কণকলতা ও বকুলমালা দুই জিনিশ, দুই ফুল, দুই রকম তাদের গন্ধ, দুই রকম তাদের স্বাদ। কণকলতার দেহে আর কথায় কথায় মধুর রস, এই রসটা আমি পছন্দ করি, তার রস অমৃতসমান, নিজেকে আমার পুণ্যবান মনে হয়।
হরিপদ আচ্ছালতু খায়রুম মিনাননাউমের আগেই এসেছে, হয়তো সারারাত মাদ্ৰাছার পাশে নদীর পারেই ব’সে ছিলো। হরিপদটা আহম্মক, ব্যবসা বোঝে, কিন্তু বকুলমালা ও কণকলতাকে বোঝে না।