ডাঙাটা এদিকে আধ ক্রোশ আর ওদিকে আধ ক্রোশেরও বেশি হবে। মাঝে মাঝে বুড়ো বয়সের এক-একটা বট, তা ছাড়া ডাঙার বাকি সব ঠাঁই জুড়ে ফণী-মনসা, বাঘভেরেণ্ডা আর ময়নাকাটার ঝোপ। এই ডাঙাটা জলে ডোবে নি। পাকুড়তলার কাছ থেকে হাঁটা দিলে এই ডাঙায় পোঁছতে এক ঘণ্টার বেশি সময়ও লাগে না। পৌঁছতেও খুব বেশি অসুবিধা নেই। পাকুড়তলা থেকে ডাঙার পশ্চিমের গড়ানি পর্যন্ত এক হাঁটুর কম জল ছপছপ করে।
পাঁচ বছর আগে এই ডাঙার ঝোপের আড়ালে বসে ঢোলক পিটিয়ে একটা ছাগলা হরিণকে ভয় পাইয়ে দিয়ে ঝোপের ভিতর থেকে বের করেছিল দাশু। কাড়বাঁশ চালাতে হয় নি। একটা পাথর ছুঁড়ে ছাগলা হরিণটাকে ঘায়েল করেছিল। সুরেন মান্ঝিও ফাঁদ পেতে এই ডাঙার ঝোপঝাড়ের ভিতরে কত খরগোশ আর ছাগলা হরিণ কতবার ধরেছে।
ডাঙার বাকি তিন দিকে জল; সে জলে ঢালুর আর খাতের সব ঝোপঝাপ ড়ুবে রয়েছে। শুধু পূর্ব দিকের জলে টান ধরেছে। পাথরের চটানের ধাপে ধাপে প্রপাতের মত জল গড়িয়ে পড়ছে। টানের জোর কম নয়; জলের শব্দেরও বেশ রাগ আছে।
ধনুক আর তিনটে তীর এক হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরে ডাঙার ঝোপঝাপের ভিতর দিয়ে পা টিপে টিপে ঘুরতে থাকে দাশু। ভোরের দিকে অন্ধকার মুছে গিয়েছে অনেকক্ষণ। সকাল বেলার লালচে রোদ ঝলক দিয়ে ডাঙার বুকে লুটিয়ে পড়েছে। সেই বুড়ো বটও আছে। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে গিয়েছে দাশু। পাঁচ বছর আগে শত শত পাখিতে ছেয়ে থাকত যে বট, সেই বটের কাছে দাঁড়িয়ে একটা পাখির ডাকও শোনা গেল না।
রোদের তাত বাড়ে। দাশু ঘরামির আদুড় শরীর ঘামে ভিজে গিয়ে চকচক করে। বুড়ো বটের মাথার দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় দাশু, একটা হরিয়াল ঘুঘুর ছায়াও কোথাও উশখুশ করে না।
ঝোপঝাপও কত ফাঁকা হয়ে গিয়েছে! এক কণা ধুলোও নেই। শুধু কাঁকর আর কাকর, আর ভোতা ভোতা কালো পাথরের ধড়। মাঝে মাঝে ঘেসো সবুজের ছোট ছোট ছিটা দেখা যায়। শাওনের জলে ধোয়া হয়ে পরিষ্কার কাকরগুলি ঝকঝক করে; দাশুর পায়ের চাপে করকর করে বাজে।
ফণী-মনসার চেহারাও কত ফ্যাকাসে; উইঢিবির সঙ্গে জড়াজড়ি করে পড়ে আছে এক একটা ঝোপ। বাঘভেরেণ্ডার পাতায় মাকড়সার ভেঁড়া জাল সাদা জটার মত গুটলি পাকিয়ে পড়ে আছে। ময়না কাটার শুধু কাঁটা আছে, পাতা প্রায় নেই। এই শাওনের জলেও সবুজ হয়ে ওঠে নি ঝোপগুলি। ছাগলা-হরিণ ধরবার আশা ছেড়ে দেয় দাশু। এখানে ছাগলা-হরিণ থাকতে পারে না।
কিন্তু খরগোশও কি নেই? ঝোপঝাপে এত গর্ত; এই সবই যে খরগোশের গর্ত। কিন্তু কই? এতক্ষণ ধরে তাক করে পাথরের আড়ালে বসে আছে দাশু, তবু গর্তের মুখ থেকে একটাও খরগোশের মুখ উঁকি দিয়ে তাকাল না কেন? সবই কি হুড়পা বানের শব্দ শুনে ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়েছে? কিংবা, এই রুক্ষ আর শুকনো ডাঙাটাকে ঘেন্না করে চলে গিয়েছে?
শক্ত করে ধনুকটাকে এক হাতের মুঠোয় আঁকড়ে ধরে, আর এক হাতে একটা তীর দোলাতে দোলাতে আবার ঝোপঝাপের যত ছায়া আর যত রন্ধ্রের দিকে অপলক চোখের জ্বালাময় পিপাসা ছুঁড়ে দিয়ে ঘুরতে থাকে দাশু। একটা গর্তের কাছে এসে থমকে দাঁড়ায়। এক গাদা শুকনো পাতা জড়ো করে গর্তের মুখে ফেলে দিয়ে আগুন ধরায়। পোড়া পাতার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে; চাপ-চাপ ধোঁয়া হেলেদুলে ভাঙে আর ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু বৃথা।
গর্তের মুখ থেকে কোন আতঙ্কিত খরগোশের মূর্তি হুট করে বের হয়ে আসে না। ধোয়ার জ্বালা লেগে দাশুরই চোখ দুটো জ্বলতে থাকে।
বেলা বাড়ে। দাশুর চোখ দুটো ঠিক দিনের বেলার নেকড়ের মত হিংসুটে ক্ষুধার জ্বালায় কুঁচকে শীর্ণ হয়ে চারদিকের যত ঝোপঝাপের ছায়ার দিকে তাকায়। দাশুর ছায়াটাও যেন লোভী জানোয়ারের মত ঝোপঝাপের গন্ধ শুঁকে শুঁকে ঘুরতে থাকে। এত বড় ডাঙার মধ্যে কি একটাও মাংসল প্রাণ কোথাও লুকিয়ে নেই? না থাকলে চলবে কি করে? দাশুর জীবনের স্বপ্ন যে উপোসের জ্বালায় চুপসে মরে যেতে বসেছে।
ডাঙার এদিকে ওদিকে পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে নীরব ঝোপগুলিকে জখম করে ছুটতে থাকে দাশু। তারপর ক্লান্ত হয়ে একটা উইঢিবির কাছে বসে পড়ে ধুকতে থাকে।
কিন্তু বসে থাকতে পারে না। উইটিবির ধুলো গায়ের ঘামের সঙ্গে জড়িয়ে কাদা হয়ে যায়। দাশুর চেহারাও একটা আহত জানোয়ারের মত দেখায়। আবার ডাঙার ঝোপঝাপের
সব ছায়া আর সব গর্তের দিকে চোখ রেখে এদিক থেকে ওদিকে ছুটতে থাকে দাশু।
হঠাৎ চমকে ওঠে, থমকে দাঁড়ায় দাশু। দাশুর ঘামে-ভেজা মুখের উপর যেন এতক্ষণে সফল স্বপ্নের আশীর্বাদ ঝরে পড়েছে। সাদা দাঁতের দুই পাটি ঘষা খেয়ে আস্তে একটা শব্দ করে ওঠে, যেন সাদা হাসির উল্লাস ঠিকরে পড়ে।
একটা খরগোশ। বেশ বুড়ো হয়েছে খরগোশটা। মাথার রোঁয়া অনেকখানি ঝরে পড়ে গিয়েছে। একটা পা খোঁড়া। চোখের কোণে পিচুটি। বুড়ো খরগোশটা ফণী-মনসার ছায়ার কাছে মরা ঘাসের মূল খুঁড়ে খুঁড়ে বের করছে, আর সামনে দু পায়ের ছোট দুটি থাবা দিয়ে তুলে ধরে খাচ্ছে। এত বড় ডাঙার ঝোপঝাড়ের মধ্যে বোধ হয় এই বুড়ো খরগোশটাই একলা পড়ে আছে; ডরানির বানের শব্দ শুনেও পালিয়ে যেতে পারে নি।
ধুলোতে হাত ঘষে নিয়ে হাতের ঘাম মুছে, ধামনকাঠের ধনুকে একটা টোকা দিয়ে আর তীর জুড়ে দিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়ায় দাশু। কিন্তু বৃথা, সেই মুহূর্তে এক লাফ দিয়ে ফণী-মনসার ঝোপের ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেল খরগোশটা।
কিন্তু যাবে কোথায়? হেসে ওঠে দাশু। বুড়ো খরগোশের পেটও ক্ষিদেয় জ্বলছে যে, নইলে মরা ঘাসের মূল খাবে কেন? বের হয়ে আসতেই হবে, আর কতক্ষণই বা কোন্ গর্তে লুকিয়ে থাকতে পারবে?
ধনুকে তীর জুড়ে আর নিথর হয়ে একঠায় দাঁড়িয়ে থাকে দাশু। দাশুর চোখের চাহনিটাও যেন লালায় ভরে গিয়ে চকচক করে। জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট দুটোকে চেটে চেটে ভিজিয়ে তোলে দাও।
বেলা বাড়ে। দাশুর চোখের আশাও ক্লান্ত হয়ে যেন নেতিয়ে পড়ে। আবার সরে গিয়ে অন্য দিকে তাকায় দাশু। মরিয়া হয়ে ছুটতে থাকে। হ্যাঁ, সেই বুড়ো খরগোশটাই এতক্ষণ বাঘভেরেণ্ডার ছায়ার কাছে সবুজ ঘাসের একটা ছিটার কাছে বসে ছিল; দাশুর ছায়া দেখতে পেয়েই দৌড় দিয়েছে।
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ছুটছে বুড়ো খরগোশ। তীর চালায় দাও। কিন্তু খরগোশটার খাড়া কান দুটো কী ভয়ানক চতুর। কান দুটো দিয়ে মাথা ঢেকে আর মাথাটাকে চকিতে নামিয়ে দিয়ে একটা ঝোপের ভিতরে লাফ দিয়ে পড়ল খরগোশটা। ডাঙার পাথরের উপর মিছা আছাড় খেয়ে পড়ে তীরটা দু টুকরো হয়ে ভেঙে গেল।
কিন্তু সেই ঝোপের কাছে একটা লাফ দিয়ে এগিয়ে যায় দাশু। আবার ধনুকে তীর জুড়ে দিয়ে ছটফট করে লাফাতে আর হাঁপাতে থাকে। কিন্তু কই? ঝোপের ভিতরে কোন ভীরু খরগোশ মুখ গুঁজে পড়ে নেই। পালিয়েছে ধূর্ত ঠগটা। দাশু ঘরামির ক্ষুধার লালা আর জ্বালার সঙ্গে যেন ঠাট্টার খেলা খেলে বেড়াচ্ছে খরগোশটা।
আবার সরে যায় দাও। চলতে চলতে একটা গর্তের কাছে থমকে দাঁড়ায়। গর্তের মুখের কাছে যেন এইমাত্র হালকা ধুলো উড়েছে; তারই রেশ এখনও রয়েছে। দাওর সারা মুখ জুড়ে আবার একটা আশাময় সন্দেহের হাসি থমথম করে। বাঘভেরেণ্ডার আগডালের কচি পাতা ছিঁড়ে নিয়ে এসে গর্তের মুখের কাছে ফেলে দিয়ে একটু আড়ালে সরে দাঁড়ায় দাও। ধনুকে তীর জুড়ে দিয়ে আস্তে আস্তে হাঁপাতে থাকে।
বিকালের আলো লাল হয়ে এসেছে। আকাশের দিকে চোখ পড়তেই দুরু দুরু করে কেঁপে ওঠে দাশুর কাদাটে ঘামে পিছল হয়ে যাওয়া বুকটা। ওই খরগোশটাকে বিধে নিয়ে ঘরে ফিরতে হবে; কিন্তু সময় যে আর বেশি নেই। কখন্ বের হবে খরগোশটা?
আশায় রঙীন হয়ে চমকে ওঠে দাশুর চোখ। গর্তের ভিতর থেকে মুখ বের করে কচি পাতার উপর ছোট থাবা এগিয়ে দিয়েছে খরগোশটা। তীর ছাড়ে দাও। কিন্তু বৃথা। খরগোশটা মাথা কাত করে একটা লাফ দিয়ে গর্তের মুখ থেকে বের হয়েই দৌড় দেয়। দাশুর তীর গর্তের মুখের কাছে আছাড় খেয়ে পড়ে এক মুঠো ধুলো উড়িয়ে আর নিখান হয়ে ভেঙ্গে যায়।
বুড়ো খরগোশের তিন পায়েও এত জোর ছিল। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ছুটলেও কত জোরে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে যাচ্ছে। দাশুও যেন ওর প্রাণ মন ও শরীর এক উদ্দাম লোভের নেশায় মাতিয়ে নিয়ে খরগোশটার পিছু পিছু ধাওয়া করে ছুটতে থাকে।
একটা পরিস্কার পাথরের উপর বসেছে খরগোশটা। খোঁড়া পায়ের বুলো চাটছে। জিরোচ্ছে; হ্যাঁ, জিরোতে থাকুক। দাশুও একটা পাথরের আড়ালে হাঁটু পেতে বসে, আর খরগোশটার দিকে অপলক চোখের নজর রেখে হাঁপধরা বুকের ধড়ফড়ানি একটু জুড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে। এইবার খুব সামলে, খুব সাবধানে, শেষ তীরের মরণবিঁধ ছুঁড়তে হবে।
খরগোশটা বুড়ো হলেও খুব ডাগর। কিন্তু মুড়োটা ফেলে দিতেই হবে, ঘা আছে মাথায়। পিছনের টেংরি দুটো পল্টনী দিদিকে দিলে দু সের হাঁড়িয়া পাওয়া যাবে নিশ্চয়। পল্টনী দিদির ঘরে আগে তো সব সময় হাঁড়িয়া জমা থাকত। এখনও কি নাই? আছে নিশ্চয়।
খরগোশের মাংস তেঁতুল-ঝাল দিয়ে শাকপাতার সঙ্গে রাঁধলে স্বাদ ধরে ভাল। যদি বেলা থাকে, তবে কোনারের কচি পাতা যোগাড় করতে পারা যাবে। একটু দূরে যেতে হবে; ওই ওদিকে, হোই পশ্চিমের টাড়ের দিকে, যেখানে অনেকগুলি কোনার গাছ সেদিনও দেখতে পেয়েছে দাশু। এক হাঁড়ি গরম গরম শাকমাংস আর পাঁচ চুমুক হাঁড়িয়া। খুশি হবে না কি মুরলী? হেসে ফেলবে না কি মুরলী?
দু কান খাড়া করে আকাশপানে তাকিয়েছে খরগোশটা। মরা বিকালের ছায়া-ছায়া আলো আর লালচে আভা মেখে টুকটুক করছে খরগোশটার লাল চোখ। দাঁতে দাঁতে চেপে তীর ছাড়ে দাশু।
বিধেছে। তীরটা যেন একটা গোঁ ধরে ছুটে গিয়ে খরগোশটার পেটে লেগেছে। তীর-গাঁথা হয়ে বুড়ো খরগোশের ধড় একটা ডিগবাজি খেয়ে পাথরের উপর থেকে ছিটকে পড়ে গিয়েছে। ধামনকাঠের বাক হাতে তুলে লাফাতে লাফাতে ছুটে আসে দাশু। পাথরটার উপর উঠে দাঁড়ায়।
সেই মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে পাথরটারই মত প্রাণহীন একটা নিরেট কালো চেহারা নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে, যেন একটা নির্মম শূন্যতার দিকে তাকিয়ে থাকে দাশু। নেই, কিছু নেই। পাথরের ওপারের কাদার ওপরে শুধু কয়েক ছিটে রক্তের দাগ। খরগোশের ধড়টা খাতের জলের ভিতর পড়েছে আর স্রোতের টানে উধাও হয়ে গিয়েছে।
বানভাসির জল ফিরতি টানে হুড়মুড় করে খাত ধরে গড়িয়ে চলে যাচ্ছে। দাশু ঘরামির মাগ ছেইলা ঘর জমি আর গুলঞ্চের বেড়া, সব গুঁড়ো হয়ে আর হুড়মুড় করে ভেসে গড়িয়ে উধাও হয়ে যাচ্ছে। জলের শব্দ যেন একটা হিংস্র ঠাট্টার গান। চুপ করে দাঁড়িয়ে শুনতে থাকে দাশু।
কাঁপতে থাকে দাশু। গায়ের সব ঘাম শুকিয়ে যায়। ঠোঁট দুটো মরা গাছের পাতার মত শুকিয়ে কুঁকড়ে যায়। মধুকুপির আকাশে সন্ধ্যার কালো ছায়াও সিরসির করে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
ধামনকাঠের বাঁকের উপর ভর দিয়ে চলতে থাকে দাশু। ঘরে ফিরতে গিয়ে দাশুর অন্তরাত্মা যেন আহত জানোয়ারের মত জখম হয়ে টলছে। পাকুড়তলা পার হবার সময় পথের মাটির উপর ধপ করে একবার বসেও পড়ে; অনেকক্ষণ বসেই থাকে দাও। দাও ঘরামির হাতের শেষ তীরটা যেন দাশুর ভাগ্যটাকে বিধে রক্তাক্ত করে দিয়ে বানভাসির জলের ফিরতি টানে ভাসিয়ে দিয়েছে।
পুরনো জামকাঠের দরজার কাছে ডাকতে গিয়েই ফুঁপিয়ে ওঠে দাশু : জলদি আমাকে এক ঘটি ঠাণ্ডা জল দে, মুরলী।
দরজা খোলে মুরলী। এক ঘটি জল এনে দাশুর হাতে তুলে দেয়; আর রেড়ির তেলের মেটে বাতির পলতে উসকে দিয়ে দাশুর মুখের দিকে একবার তাকায়।
মুরলীর মুখের দিকে তাকাতে বুক কাঁপে দাশুর। দু হাঁটুর উপর মাথা পেতে খেজুর পাতার চাটাইয়ের উপর নিঝুম হয়ে বসে থাকে।
জানে না দাও, অনুভব করবারও শক্তি বোধহয় নেই, কত রাত হয়েছে। হঠাৎ মনে হয়, ঘরটাই টলমল করে নড়ে উঠেছে। কিন্তু পরমুহূর্তে বুঝতে পারে, দাশুর মাথাটাকে একটা ঠেলা দিয়ে তুলে ধরেছে মুরলী। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায় দাশু ও কি?
মুরলী বলে-আমাকে আবার কি শুধাতে চাও? তুমি বল।
দাশু–কি বলবো বল?
মুরলী—তুমি কি ভেবেছো? নিজে মরবে, আমাকে মরাবে আর আমার ছেইলাটাকেও মরাবে?
–না মুরলী, না। কখনো না। এমন কথা বলিস না। মুরলীর একটা হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে দাশু।
হাত ছাড়িয়ে নেয় মুরলী। মুরলীর শুকনো মুখের উপর কি-ভয়ানক ঘৃণার জ্বালা ছটফট করছে। কালো চোখের তারা দুটো ধিকধিক করছে। চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী-আমার ছেইলাকে বাঁচাতে পারবে না যে, সে আমার মরদ কেন হবে?
চুপ করে মুরলীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে দাশু। একটা বোবার মুখ, একটা বধিরের চোখ।
আবার চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী-মধুকুপির কিষাণের আর সে জোর নাই।
ও কি? কিসের শব্দ? জামকাঠের দরজায় কে যেন হাত বুলিয়ে আস্তে আস্তে শব্দ করছে। আস্তে আস্তে ডাকছে সরদার ভাই আছ কি হে?
চমকে ওঠে দাশু। আশ্চর্য হয়ে দরজার দিকে ভ্রূকুটি করে তাকিয়ে থাকে মুরলী।
আবার ডাক; শান্ত স্নিগ্ধ ও মায়ানিবিড় একটা আহ্বানের স্বর—আছ কি হে সরদার?
দাশু ঘরামির মুমূর্ষ অস্তিত্ব যেন নতুন প্রাণ পেয়ে জেগে ওঠে। লাফ দিয়ে উঠে, ঘরের দরজা খুলে বাইরের দাওয়ার উপর এসে দাঁড়ায় দাশু।
দাওয়ার উপর দাঁড়িয়ে আছে যে আগন্তুক, তার এক হাতে একটা বড় লাঠি, আর এক হাতে একটা হাঁড়ি, আর কাঁধের উপর ছোট একটা কম্বল।
শব্দ না করে গুঁড়ো গুঁড়ো নরম বৃষ্টি ঝরে পড়ছে। আকাশে আবার শাওনে মেঘ জমেছে। বিদ্যুতের ঝিলিক খেলছে আকাশে। আগন্তুকের মুখটা দেখতে পেয়েছে দাশু।
এগিয়ে এসে আগন্তুকের হাত ধরে চেঁচিয়ে ওঠে দাশু–ভঁইসাল, তুমি কোথা থেকে এলে ভাই?
ভঁইসাল হাসে যেথা থেকেই আসি না কেন, তোমার কাছেই তো এলাম!
দাশু–কেন?
ভঁইসাল এইবার গলার স্বর নরম করে নামিয়ে নিয়ে ফিসফিস স্বরে যেন আবেদন করে? টাকা নিবে সরদার?
ভঁইসালের হাত ধরে ছটফট করে দাশু : হ্যাঁ ভাই, টাকা চাই। কিন্তু বেশি চাই না।
ভঁইসাল-হাঁ হাঁ, সে তো ঠিক কথা। জমি কিনবে, নতুন ঘর বানাবে, মাগ-ছেইলাকে খাওয়াবে, পূজা-পরব করবে, করম নাচবে, এই তো?
দাশু–হ্যাঁ ভাই।
ভঁইসাল-তবে এসো।
দাশু–কোথায় যেতে বলছো হে?
ভঁইসাল—আমার সাথে এসো।
দাশু–টাকা?
ভইসাল-টাকা আজই পাইয়ে দিব, এসো।
মেঘে ভরাট আকাশ আর বিজলী হানে না; শুধু গরগর করে। কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া ছুটে বেড়ায়। গুঁড়ো বৃষ্টির ঝরানি বাতাসের এক-একটা আচমকা ঝাপটায় এলোমেলো হয়ে যায়। জমাট অন্ধকার কিন্তু একটুও কাঁপে না।
আকাশ বাতাস আর মাটি একসঙ্গে তাল পাকিয়ে কালো হয়ে গিয়েছে। পথের কাদা যেন পচা-পচা কালো মাংস; পথের জল ঠাণ্ডাঠাণ্ডা কালো রক্ত। পথ চলতে চলতে দাশুর কানের পাশে ফিসফিস করে হাসে গুপী লোহার : আঃ, বড় মিঠা রাত সরদার!
দাশু বলে–একটুক জিরাতে হয় ভঁইসাল।
–জিরাবে? আশ্চর্য হয় গুপী।
–হ্যাঁ। হাঁপ ছাড়ে দাশু।
–পিয়াস লেগেছে? প্রশ্ন করে গুপী।
–হ্যাঁ। একটা গাছের তলায় থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে দাশু, আর হাঁপাতে থাকে।
দাশুর হাতের কাছে হাঁড়িটাকে এগিয়ে দিয়ে হেসে ফেলে গুপী : নাও সরদার, দম তক পিয়াস মিটিয়ে নাও।
এক চুমুকে হাঁড়ির প্রায় অর্ধেক খালি করে দিয়ে আবার হাঁপ ছাড়ে আর হেসে ওঠে দাশু : বাঃ, বড় ডাল মাল। আবগারী জল বটে কি?
গুপী-আবগারী জলে কি এত তেজ আর ফুরতি থাকে রে ভাই? এটা ঘরের চোলাই বটে; আধা মেওয়া আর আধা মহুয়া।
দাশু–মজাদার বাস পেলাম যেন।
গুপী-হ্যাঁ রে ভাই; মৌরির রস দিয়ে মজালে মালের বাস এমনটি মিঠা হয়ে থাকে।
দাশু কোথা থেকে পেলে?
গুপী হাসে : জামুনগড়ায় আমার একটা ভক্ত আছে; সে বেটা দিলে।
দাশুর বুকে আর হাঁপ ধরে না। আর এক মুহূর্তও জিরিয়ে নেবার দরকার হয় না। গুপীর নিঃশ্বাসের শব্দের সঙ্গে নিজেরও বুকের উতলা বাতাসের শব্দ মিশিয়ে দিয়ে আর প্রায় ছুটে ছুটে চলতে থাকে।
সড়ক ছেড়ে দিয়ে বাঁ দিকের ডাঙার উপর নামে গুপী। এইবার গুপী একটা হাঁফ ছাড়ে আর হাঁড়িটাকে মুখের কাছে তুলে নিয়ে চুমুক দেয়। তার পরেই হেসে ওঠে : একটা কথা শুধাই সরদার?
দাশু–কি কথা?
গুপী-সরদারিন তোমাকে এত ডাঁটে কেন?
দাশু–কে বললে?
গুপী হাসে : দরজার কান পেতে সব শুনেছি।
দাশু–তবে আর শুধাও কেন?
–কদিন খাও নাই?
–দুই দিন।
–সরদারিনও কি খায় নাই?
–না।
–সরদারিনের পেটে ছেইলা আছে কি?
–হ্যাঁ। ধমকের সুরে আক্ষেপ করে গুপী-ছি ছি, তুই বড় দুখী বটিস সরদার।
উত্তর না দিয়ে চুপ করে শুধু শুনতে থাকে দাশু। তারপর ব্যস্ত হয়ে বলে-চল ভাই।
গুপী লোহার যেন দাশুর এই যন্ত্রণাক্ত ব্যস্ততার তাড়া তুচ্ছ করে আর আনমনা হয়ে একটা স্বপ্নালু আরামের আবেশে গা ঢেলে দিয়ে ডাঙার ঘাসের উপর বসে পড়ে আর নিঝুম হয়ে যায়। তারপর হাঁড়িতে চুমুক দিয়ে নিয়ে সেঁকুর তোলে-তোমার ঘরটি বড় ভাল ঘর, সরদার। ফিসফিক্স করে গুপী।
দাশুও চুপ করে বসে দু চোখের মিঠা-মিঠা নেশার জ্বালা নিয়ে ডাঙার অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকে।
গুপী-তোমার ঘরণীও বড় ভাল। চোখ দুটা বড় মিঠা।
আবার যেন নিঝুম হয়ে যায় গুপী। আবার মুখে হাঁড়ি ঠেকিয়ে আর একচুমুক মাদকতার আরাম টেনে বুক ভরে নিয়ে আবার বিড় বিড় করে-তোমার ছেইলাটাও বড় সুন্দর ছেইলা হবে হে।
দাশু বলে—আর কত জিরোবে?
গুপী তবু যেন আনমনার মত বিড়বিড় করে একটা নেশালস তন্দ্রার সঙ্গে কথা বলতে থাকে : বড় ভাল হবে। তোমার খুব সুখ হবে। নিজের মাগ, নিজের ছেইলা, নিজের ঘর, নিজের জমি। তুমি বড় চালাক বট সরদার।
বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে ওঠে দাশু–উঠ ভাই।
–কেন?
–আমাকে টাকা পাইয়ে দিবে না?
হেসে ফেলে গুপী : দিব। হাতির দাঁতও ভাঙে সরদার; কিন্তু গুপী লোহারের বাত ভাঙ্গে না।
ব্যস্তভাবে উঠে দাঁড়ায় গুপী লোহার। কম্বলের ভঁজের ভিতর থেকে দুটো হেঁসে বের করে-এই নাও, ধর।
দাশুর হাতের কাছে একটা হেঁসো এগিয়ে দেয় গুপী লোহার। আর দাশুও যেন অদ্ভুত এক জ্বালাময় ভক্তির নেশায় লুব্ধ হয়ে গুপী লোহারের সেই হিংস্র দীক্ষার শাণিত হাতিয়ার শক্ত করে আঁকড়ে ধরে।
–চল। হাঁক দেয় গুপী লোহার। গুপী লোহারের সঙ্গে প্রায় ছুটে ছুটে হাঁটতে থাকে দাও।
এক ক্রোশ শেষ হবার আগেই ডাঙা শেষ হয়। মাটির উপর পা ঘষে আর একটু আশ্চর্য হয়ে দাও বলে—এটা কেমন ডহয় বটে?
–এটা রেল-লাইন। চল।
আবার চলতে থাকে গুপী লোহার। পিছু পিছু দাও। দু পাশে সরকারী শালবন, মাঝখান দিয়ে নতুন রেল-লাইন। জঙ্গল ভেদ করে কে জানে কোন্ দিকে চলে গিয়েছে নতুন রেল লাইন? এদিক ওদিক তাকিয়ে আকাশের অন্ধকারের দিকে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারে দাও, বড়কালুর হরতকীর জঙ্গল আর পাথরের চটান খুব কাছেই রয়েছে। বড়কালুর গা বেয়ে বর্ষাজলের হাজার ঝরণা ঝরে পড়ছে তারও শব্দ শোনা যায়।
চলতে চলতে আবার আশ্চর্য হয় দাশু। একটু দূরে, এই সরকারী শালবনের মাথার উপর যেন একটা আভা থমকে রয়েছে। বৃষ্টিতে ভেজা জঙ্গলটাও কি আগুনে পুড়ছে?
তারপর আর বেশিক্ষণ নয়; আর খুব বেশি দূর এগিয়ে যেতেও হয় না; দাও যেন একটা নতুন জাদূর বিস্ময় সহ্য করতে গিয়ে ভয় পেয়ে গুপী লোহারের একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরে, আর থমকে দাঁড়ায়? কোথায় এলাম?
গুণী লোহার বলে-চুপ থাক।
বড় বড় গুটির উপর বড় বড় আলো। সারি সারি টিনের শেড। থাক দিয়ে সাজানো বড় বড় কাঠের ভূপ। এখানে ইঁটের আর ওখানে কাটা পাথরের এক একটা গাদা। হাতির মত এক-একটা বয়লট এখানে ওখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। শত রকমের সরঞ্জাম আর কলকজা বড় বড় ঠাঁই জুড়ে পড়ে আছে। তিরপাল ঢাকা দিয়ে গুঁড়ো বৃষ্টির ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে এক একটা কল এখানে-ওখানে যেন ঘুমিয়ে রয়েছে।
আস্তে আস্তে, শালের ছায়ার আড়াল দিয়ে পা টিপে পিটে হাঁটতে থাকে গুপী লোহার। পা টেনে টেনে চলতে থাকে দাশু। লাইনের পাশে একটা খাতের অন্ধকারের মধ্যে নামে গুপী লোহার, পিছু পিছু দাও। উঁকি দিয়ে শুধু চোখ দুটোকে ভাসিয়ে দিয়ে দুরের একটা টিনের একচালার দিকে তাকিয়ে থাকে গুপী লোহার।
–কি দেখছো ভঁইসাল? দাশু চাপাস্বরে কথা বলে।
গুপী লোহার বলে—আছে।
–কে?
–হেই যে লাল কম্বল।
দেখতে পায় দাশু, টিনের একচালার ভিতরে শান বাঁধানো মেজের উপর ছড়িয়ে রয়েছে শত শত কাঠের বাক্স; কে জানে কোন মালে ভরে আছে বাক্সগুলি। সেই সব বাক্সের সারির ফাঁকে ফাঁকে শুয়ে আছে মানুষ; একটা দুটো নয়,অনেক। হাত-পা গুটিয়ে ছোট ছোট মড়ার মত অসাড় হয়ে পড়ে আছে ঘুমন্ত মানুষগুলো; কুলি-মজুর বলে মনে হয়। হ্যাঁ, লাল কম্বলে ঢাকা হয়ে একটা মানুষও ঘুমিয়ে পড়ে আছে।
দাশু–লাল কম্বলটা কে বটে?
গুপী-ঠিকাদার বটে। কুলিদিগকে কাল সকালে হপ্তা দিবে শালা। শালার মাথার কাছে টাকার থলি আছে।
–ভঁইসাল ভাই। ডাকতে গিয়ে কেঁপে ওঠে দাশুর গলার স্বর।
–কি বটে? রুক্ষ স্বরে ফিসফিস করে গুপী লোহার।
–টাকা চাই না। ফুঁপিয়ে ওঠে দাশু।
—কি? গলার স্বর চেপে আস্তে একটা ধমক হানে গুপী লোহার।
ধপ করে বসে পড়ে দাও। গুপী লোহারের পায়ে হাত রেখে আর গলার স্বর ঠকঠকিয়ে অসহায়ের মত যেন আবেদন করে টাকা চাই না।
দাশুর পিঠে হাত বুলিয়ে যেন স্নেহা স্বরে কথা বলে গুপী লোহার-কেন মিছা গোলমাল করছো?
–মাপ কর ভাই।
–আমি নিজেকেই মাপ করি না, তোমাকে মাপ করবো কেমন করে? উঠ, যাও, চুপচাপ এগিয়ে যাও; আস্তে কম্বলটা ঠেলে দিবে, মুখটাকে চেপে ধরবে, আর হাঁসুয়া দিয়ে টুটির উপর তিনটা ঘষা মেরে, টুটির নলীটা ছিঁড়ে দিয়ে…।
–না না, কভি না। কাঁপতে থাকে দাশুর গলার স্বর।
দাশুর মাথায় হাত বুলিয়ে গুপী লোহার বলে কথা শুন, সরদার; ওর মাথার কাছে হাত চালালেই টাকার থলিটা পেয়ে যাবে। এত বড় থলি সরদার।
–আমাকে আর এসব কথা বলো না।
–কেউ জেগে নাই সরদার। কেউ দেখতে পাবে না। সব শালা চৌকিদারের বাচ্চা ঘুমে বেহুশ হয়ে আছে।
-আমি ঘরে ফিরে যাই।
-আমি তোমার নিকট খাড়া থাকবো সরদার। কোন শালা তোমার পানে এসেছে কি আমি ওর খবর নিয়ে ছেড়েছি।
–না।
–কেন?
–মানুষ মারতে বলল না।
–মানুষ? মারতে বলছে কে তোমাকে? ওটা যে ঠিকাদার বটে!
–ওর প্রাণ তো মানুষেরই প্রাণ বটে?
সাপের প্রাণ বটে। সাপ সাপ! সাপের যেমন বিষ থাকে, ওর তেমন টাকা আছে। দাশু করুণভাবে হাসে? তবে আর বিষ ছিনতে বল কেন?
গুপী লোহারও হাসে? ওর বিষ বটে, কিন্তু তোমার যে ওষুধ বটে গো। সাপের বিষ ছিনে নিয়ে ওষুধ করতে হয়। দেখ নাই ওঝারা কি করে?
দাশু উঠে দাঁড়ায়? না ভাই।
হাতের হেঁসোর-চুঁচালো মুখটাকে দাশুর বুকের উপর চেপে ধরে, রুষ্ট নিঃশ্বাসের ঝাজ দাশুর মুখের উপর ছড়িয়ে দিয়ে গুপী লোহর বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক। তুমি না পার, আমি টাকা আনছি।
–না, আমি টাকা নিব না।
–নিতে হবে। তুই শালা তোর মাগ-ছেইলাকে মারবি কেন রে? তুই নিজে ভুখা গরুর মত হেঁপে মরবি কেন রে?
গুপী লোহারের গলার স্বর কাঁপতে কাঁপতে ফুঁপিয়ে ওঠে। যেন গুপী লোহারের একটা স্বপ্নের আহ্লাদ পুড়ে গিয়ে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে। উন্মত্তের মত হাত-পা ছুঁড়ে দাশুর পিঠে বুকে ও পেটের উপর ঘুষি চড় আর লাথি ছুঁড়তে থাকে গুপী। খাতের ভেজা মাটির উপর গড়িয়ে পড়ে যায় দাশু।
গুঁড়ো ঝরানি নয়, বেশ জোরে শব্দ করে আর ঝরঝর করে ঝরে পড়ছে বৃষ্টি। হাঁপাতে থাকে গুপী লোহার।
আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায় দাশু। পাথরের পাটার মত বুক, শক্ত আর দূরন্ত পেশী দিয়ে তৈরী সেই দাশু, সেই মজবুত কিষাণ। দাশু কিষাণের ওই দুই হাত ইচ্ছে করলে এই মুহূর্তে ক্ষিপ্ত হয়ে গুপী লোহারের মাথাটাকে থেঁতলে দিয়ে জিভটাকেও একটানে উপড়ে ফেলে দিতে পারে। একটা লাফ দিয়ে গুপীর সামনে এগিয়ে আসে দাও।
দু হাত দিয়ে গুপী লোহারের হাত দুটোকে যেন অদ্ভুত এক আদরের আবেগে কাছে টেনে নিয়ে দাশু বলে-তোমার হাতে মার খেতে আমার লাজ নাই। তোমাকে দুখ দিলাম, তুমি মারবে না কেন? দশবার মারবে।
গুপী লোহারের দু’চোখে একটা হিংস্র বিস্ময় করুণ হয়ে ছলছল করে। দাশুর মুখের কাছে চোখ নিয়ে দেখতে থাকে। তার পরেই হাতের হেঁসোর উপর ফুঁ দিয়ে হেঁসোটাকে শক্ত করে চেপে ধরে দোলাতে দোলাতে ছটফট করে গুপী : কিন্তু টাকা তোমাকে নিতেই হবে সরদার। টাকা দিয়ে ছাড়বো আমি।
–না; দয়া কর ভাই।
–না, কোন দয়া নাই। তুমি থাক, আমি এখনই আসছি।
ছুটে চলে যায় গুপী লোহার। গুপী লোহারের ছুটন্ত ছায়ার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়েই চোখ বন্ধ করে দাও। আর, চোখ মেলতেই দেখতে পায়, টিনের একচালার মেঝের উপর সেই লাল কম্বলের কাছে পৌঁছে গিয়েছে গুপী লোহার।
কেঁপে ওঠে দাশুর বুক। খাতের ভিতর থেকে একটা লাফ দিয়ে বের হয়ে শালবনের অন্ধকারের দিকে তাকায়। ছটফট করে পা দুটো। এই জল, এই কাদা, আর বৃষ্টির এই ঝরানি যেন একটা গলাকাটা যন্ত্রণার রক্তে লাল হয়ে দাশুর হাড়মাস গুলে ফেলছে। হাঁটু দুটো টলমল করছে। টান হয়ে দাঁড়াতে গিয়ে টলতে থাকে দাশু। পালিয়ে যাবার জন্য দৌড়তে চায় দাশু, কিন্তু দৌড়তে পারছে না।
চমকে ওঠে দাশু। একটা ছায়া ছুটে এসে দাশুর পাশে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে কাশে : ঢল সরদার।
-কি করলে ভঁইসাল? কাঁপতে কাঁপতে যেন কান্না চেপে প্রশ্ন করে দাশু।
টাকার থলিটাকে দাশুর পিঠের উপর আছাড় মেরে একবার বাজিয়ে দিয়ে গুপী লোহার আবার কাশে। গুপী লোহারের গলায় যেন রক্তমাখা একটা হাসির শ্লেষ্ম ঘরঘর করে : সাপের বিষ ছিনে নিয়ে এলাম।
দাশু–সাপটার কি করলে?
গুপী লোহার-বাপের বাড়ি রওনা করিয়ে দিলাম।
–কি বললে? দাশুর নেশার বুক খুব আস্তে আর্তনাদ করে ওঠে।
হেসে ফেলে গুপী লোহার : একদিন তুমিও যাবে আর আমিও যাব সরদার, চিন্তা কর কেন?
রক্তমাখা হেঁসোটাকে দুরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দাশুর পিঠে একটা ধাক্কা দেয় গুপী লোহার : চল।
আর নতুন রেল-লাইন ধরে নেয়; শালবনের ভিড়ের ভিতর দিয়ে, সরু সরু খাত ধরে, জলকাদা মাড়িয়ে আর বৃষ্টির অঝোর ধারায় যেন একটা ছুটন্তু স্নানের ভয়ানক পুণ্যে গা ভিজিয়ে, হন্ হন্ করে হেঁটে যেতে থাকে গুপী লোহার আর দাশু।
বৃষ্টির ঝরানি থেমে যায়। আবার বৃষ্টির গুঁড়ো উড়তে থাকে। আকাশের দিকে চোখ তুলে গুপী বলে-রাত আর বেশি নাই।
কথা বলে না দাশু। গুপী লোহার বলে—ডহর ভুল করো না সরদার।
না, ডহর ভুল করে না দাও। হরতকীর জঙ্গলটা যখন ধরতে পারা গিয়েছে তখন সেই শুকনো ডাঙার কিনারায় গিয়ে পৌঁছতে কোন ভুল হবে না। পোঁছতে কতক্ষণই বা লাগবে?
হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় গুপী লোহার : তোমার হিস্যা তুমি এখনই নিয়ে নাও সরদার।
সেই মুহূর্তে যেন এক ঝলক ঠাণ্ডা আগুনের আভা গুপী লোহার আর দাশুর মুখের উপর এসে আছড়ে পড়ে। চোখ ধাঁধানো কটকটে আভা। ক্ষণিকের মত অন্ধ হয়ে আর স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে গুপী লোহার আর দাশু।
দাশুর কানের কাছে ছোট্ট একটা চিকার আছড়ে দিয়ে ছটফট করে ওঠে গুপী লোহার : পালাও, জলদি পালাও।
সঙ্গে সঙ্গে বুনো অন্ধকারের বুকটা যেন প্রচণ্ড আর্তনাদ করে ফেটে গেল। বন্দুকের শব্দ। গুলিটা ছুটে এসে ঠিক দাশুর পায়ের কাছে মাটিতে বিধেছে। কেঁপে উঠল মাটি।
চোখ মেলতে চেষ্টা করে দাশু, কিন্তু পারে না। সেই চোখ ধাঁধানো আলোটা যেন দাশুর চোখের উপর কামড় দিয়ে ঝুলে রয়েছে।
–ভঁইসাল! বিড়বিড় করে ডাকে দাও। কিন্তু কোন সাড়া শুনতে পায় না। গাছের গায়ে হেলান দিয়ে মরা গাছের মত পড়ে থাকে। আর, সেই বুনো অন্ধকারের ভিতর থেকে একটা বন্দুকের নল আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে ঠিক দাশুর বুকের কাছে থামে।
-অ্যাঁ? দাশু সরদার! বন্দুকের নলের মুখটা যেন চমকে উঠে, আশ্চর্য হয়ে, আর দুলতে দুলতে চেঁচিয়ে উঠেছে।
চোখ মেলে তাকাতে চেষ্টা করে দাশু, আর পলুস হালদারও তার হাতের টর্চ কাত করে দাশুর চোখের সামনে শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। যেন একটা হিংস্র জয়ের আমোদে হো-হো করে হেসে ওঠে পলুস হালদার-তোমাকে দাগী বলেছিলাম বলে সরদারিন বড় রাগ করেছিল।
বাঘিন কানারানীকে এক গুলিতে সাবড়ে দেবার আশায় জঙ্গলে এই একান্তে গেছে মাচানের উপর রাতজাগা চোখ নিয়ে বসেছিল যে শিকারী, তারই আশার কাছে কানারানীর চেয়েও চমৎকার একটা জানোয়ার ধরা পড়েছে। টর্চ ঘুরিয়ে দাশুর পা থেকে মাথা পর্যন্ত আর একবার দেখে নিয়ে পলুস হালদার প্রশ্ন করে সাথীটা ভেগেছে বুঝি?
দাশু মাথা নাড়ে : হ্যাঁ।
পলুস বলে-সাথীটা কে বটে? গুপী লোহার?
–হ্যাঁ।–খুনিয়া ডাকাতি করে এলে?
–আমি করি নাই।
–গুপী লোহার করেছে?
–সে ত বললে, করেছে।
–কত টাকা পেলে?
–পাই নাই।
–গুণী লোহার সব নিয়ে ভেগেছে?
–হ্যাঁ, কিন্তু…।
–কি?
–আমাকেও হিস্যা দিবে বলেছিল।
–তুমি হিস্যা চেয়েছিলে?
–না।
দাঁতে দাঁত ঘষে হাসতে থাকে পলুস হালদার : মধুকুপির দাশু সরদার বড় সাচ্চা, বড় ভালমানুষ বটে। হিস্যা নেয় না, কিন্তু খুনিয়া ডাকাতি করে। কি বল সরদার? ঠিক বলি নাই?
উত্তর দেয় না দাও। পলুস হালদার বন্দুকটাকে কাঁধের উপর তুলে নিয়ে, একটু দূরে গাছের মাথার উপর টর্চের আলো ফেলে মাচানটার দিকে একবার তাকায়, তারপরেই আক্ষেপ করে : নাঃ, বড় ঠকে গেলাম সরদার। তোমার লাস নিয়ে থানাতে জমা দিলে পাঁচ টাকাও পাওয়া যাবে না।…যাও, ঘরে যাও।
তবুও স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দাশু। পলুস হালদার ধমক দিয়ে বলে-যাও; সরদারিনকে বলবে, পলুস হালদার চোর নয়।
-কি বলছো? দাশু ঘরামির অসাড় চোখ দুটো যেন হঠাৎ দপ করে জ্বলে উঠে।
পলুস ভ্রূকুটি করে চোখ বড় করে তাকাও কেন সরদার? তোমাকে মায়া করে ছেড়ে দিলাম।
দাশু—কেন মায়া করলে?
পলুস বলে-তোমার সরদারিনকে মায়া করি, তাই।