জামান বারান্দায় মোড়ার উপর শিরদাঁড়া বাঁকিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বসা। তার সামনে আরেকটা মোড়া। সেখানে টিফিন ক্যারিয়ারে সকালের নাশতা। ছোট লাল ফ্লাস্কে চা। সনজু ভীত ভঙ্গিতে একটু দূরে দাঁড়ানো। প্রতিবারই নাশতা নিয়ে তাকে দুলাভাইয়ের কঠিন কথা শুনতে হয়। আজ মনে হয় আরো বেশি শুনতে হবে। পরোটা, বুটের ডাল আর সবজি আনার কথা। সে এনেছে সবজি আর ডিমের ওমলেট। বুটের ডাল পায় নি।
জামান টিফিন ক্যারিয়ার খুলল। খাওয়া শুরু করল। বুটের ডাল নাই কেন এই নিয়ে হম্বিতম্বি শুরু করল না। মনে হয় বুটের ডালের কথা তার মনে নাই।
সনজু বলল, চা কাপে ঢেলে দিব দুলাভাই?
দাও। চিনি ছাড়া এনেছ তো?
জি।
চা কাপে ঢালতে গিয়ে সমস্যা হলো। কিছু চা মেঝেতে পড়ে গেল। সনজু নিশ্চিত দুলাভাই এখন গর্জে উঠে বলবেন, সামান্য কাজটাও ঠিকমতো করতে পারো না। সেরকম কিছু বলল না। বরং চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জামান তৃপ্তির শব্দ করল।
চা কোত্থেকে এনেছ? বিসমিল্লাহ হোটেল?
সনজু বলল, না। রাস্তার পাশে ছোট একটা দোকান আছে। চা ভালো বানায়।
এখন থেকে এই চা আনবে।
জি আচ্ছা।
তোমার বোনের সঙ্গে কথাবার্তা হয়?
জি না। এটা মিথ্যা। সনজুর সঙ্গে তার বোনের প্রতিদিনই কথা হয়।)
জামান বলল, যদি কোনোদিন ঐ মাগীর সঙ্গে কথা বলতে দেখি তাহলে টান দিয়ে জিহ্বা ছিঁড়ে ফেলব। এটা যেন মনে থাকে।
জি আচ্ছা।
আমার চোখের সামনে ঐ মেয়ে অন্য লোকের বাড়িতে উঠে গেল। বাজারের মেয়ের যতটুকু লজ্জা-শরম থাকে তার তো তাও নাই। ঠিক বলেছি কি-না বলো।
জি।
কি শাস্তি দেয়া যায় বলো। তুমিই বলো! তোমার স্ত্রী যদি এ রকম ঘটনা ঘটাত তুমি কি করতে?
জানি না দুলাভাই।
দুলাভাই দুলাভাই করবে না। আমি আর তোমার দুলাভাই না।
জি আচ্ছা।
বেশ্যা মেয়েটাকে এমন এক শাস্তি দিতে হবে যেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মনে থাকে। পাড়ার মাস্তান ছেলেগুলিকে দিয়ে রেপ করালে কেমন হয়? ছয়সাত জন মিলে রেপ করলে জন্মের শাস্তি হয়ে যাবে। ঠিক বলেছি?
সনজু জবাব দিল না। জামানের চায়ের কাপ শেষ হয়েছে। সনজু আবার কাপে চা ঢেলে দিল। ফ্লাঙ্কে তিন কাপ চা ধরে। জামান খায় দু কাপ। শেষ কাপটা সনজুর।
জামান সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, তুমি এক কাজ করো, মাগীটার কাছে যাও। তাকে বলো শেষ সুযোগ কানে ধরে আমার সামনে দশ বার উঠবোস করবে। চাটা দিয়ে আমার জুতার ময়লা খাবে। একবার চাটলেই হবে। আমি অতীত ভুলে যাব।
এখন বলব?
হ্যাঁ এখনই যাও। খালেক সাহেব হাসপাতাল থেকে ফিরেছেন?
জি।
উনার সামনে বা উনার মেয়ের সামনে কিছু বলবে না। আড়ালে ডেকে নিয়ে বলবে। সময় বেঁধে দিবে। যদি ফিরে আসতে চায় তাহলে সকাল দশটার মধ্যে আসতে হবে। আর একটা কথা বলবে, সেটা হলো—রাগের মাথায় তালাক কোনো তালাক না। সে যেন ভেবে না বসে যে তালাক হয়ে গেছে।
সনজু বের হয়ে গেল। জামান পুরোপুরি নিঃসন্দেহ শায়লা এক্ষুনি চলে আসবে। তার যাবার কোনো জায়গা নেই। খালেক সাহেব বাসা থেকে বের করে দিলে প্রথম কয়েক দিন থাকবে ফুটপাথে। তারপরে স্থান হবে চন্দ্রিমা উদ্যানে। নিজের ভাই হবে দালাল। কাস্টমার ধরে আনবে। দরদাম ঠিক করবে।
শায়লা বলল, এখন যেতে বলেছে?
সনজু বলল, সকাল দশটার মধ্যে যেতে বলেছে। তুমি যাবে?
হুঁ। অন্যের বাড়িতে কত দিন থাকব?
সনজু বলল, দশবার কানে ধরে উঠবোস করতে হবে। জুতা চাটতে হবে। তারপরেও যাবে?
শায়লা বলল, আমি নিরুপায়। তুই নিজেই বল আমরা দুইজনই নিরুপায় না?
সনজু কিছু বলল না। চোখ-মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল। বড় বোনের গালে চড় দিতে ইচ্ছা করছে। তা সম্ভব না। বড় বোন মায়ের অধিক।
শায়লা উঠে দাঁড়াল। সনজু বলল, তরুকে কিছু বলে যাবে না?
শায়লা বলল, না। ওকে বললে ও হয়তো যেতে দিবে না। নানান কথা বলবে। কি দরকার? তোর দুলাভাই কি বলেছে? কানে ধরে দশ বার উঠবোস আর জুতা চাটলেই হবে?
হুঁ।
জানালা দিয়ে দেখলাম বারান্দায় বসে নাশতা খাচ্ছে। এখন মেজজি কেমন?
ভালো।
শায়লা বলল, তুই আমার সঙ্গে আসবি না। একটু পরে আয়। তোর সামনে কানে ধরে উঠবোস করতে লজ্জা লাগবে।
সনজু বলল, তুমি একাই যাও। আমি দশ মিনিট পরে আসব।
সনজু বাড়ির ছাদে উঠে গেল। ওসমান সাহেবের কিছু লাগবে কি-না খোঁজ নেবে। প্রতিদিন সকালে সে এই কাজটা করে। মাসের শেষে ওসমান সাহেব পাঁচশ করে টাকা দেন। টাকাটা সে খরচ করে না, জমায়। সে তার তোষকে একটা ফুটো করেছে টাকা জমানোর জন্যে।
সিঁড়িঘরের সামনে সনজু থমকে দাঁড়াল। তরু চা খেতে খেতে ওসমান সাহেবের সঙ্গে গল্প করছে। ওসমান সাহেবের হাতেও চা। দুজনের মুখ হাসি হাসি। সনজুর হঠাৎ প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ করল। কোমর ভাঙা এই বুড়োর এত কি গল্প তরুর সঙ্গে? সনজু যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখান থেকে একটু সরে গেল। এখন আর তরু বা ওসমান সাহেব তাদের দেখতে পাবেন না। অথচ সে দরজার ফাঁক দিয়ে ঠিকই দেখবে।
ওসমান বললেন, আজ তোমাকে অন্যদিনের চেয়েও বেশি আনন্দিত মনে হচ্ছে। কারণ কি?
তরু বলল, কারণ আজ আমাকে দেখতে আসবে।
দেখতে আসবে মানে কি? বিয়ের কনে দেখা?
হুঁ।
ছেলে করে কি?
কাঠুরিয়া। কাঠ কাটে।
ওসমান বললেন, টিম্বার মার্চেন্ট?
তরু বলল, ভদ্র ভাষায় তাই। বাবার উনাকে খুবই পছন্দ। ছেলের নাম আনিস।
আনিস?
তরু বলল, হ্যাঁ আনিস। আমার খুবই অপছন্দের নাম। আমাদের ক্যান্টিনের বয়ের নাম আনিস। তার প্রধান চেষ্টা কোনো এক অপার গায়ের সঙ্গে হাত লাগিয়ে দেয়া যায় কি-না। ভাবটা এরকম যে ভুলে লেগে গেছে।
ওসমান বললেন, বয়কে দোষ দিয়ে লাভ নেই সমাজের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির এই স্বভাব আছে।
তরু হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে গলা নিচু করে বলল, আনিস সাহেব বিকেলে চা কোথায় খাবেন জানেন? আপনার এখানে। আপনার মতামত বাবার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই আপনি আনিস সাহেবকে ভালোমতো লক্ষ করবেন। তার আইকিউ-এর অবস্থা বুঝবেন।
তুমি বিয়ে করতে চাচ্ছ?
চাচ্ছি। ভালো ঔপন্যাসিকের বিয়ের অভিজ্ঞতা দরকার।
সত্যি সত্যি ঔপন্যাসিক হবার জন্যে বিয়ের অভিজ্ঞতা চাচ্ছ?
হুঁ। আমি কিছুদিন জেলেও থাকতে চাই। জেলের অভিজ্ঞতা লেখালেখিতে সাহায্য করে।
কে বলেছে?
স্যার বলেছেন। যে স্যার চর্যাপদ পড়ান—ড. আখলাক। তাঁর নিক নেম হলো ছোঁক ছোঁক স্যার। তিনি মেয়ে দেখলেই ছোঁক ছোঁক করেন। টিউটোরিয়েলে মেয়েরা সবসময় তার কাছে বেশি নাম্বার পায়।
মেয়েদের জন্যে তো ভালো।
হ্যাঁ ভালো। আপনাকে একটা মজার কথা বলব?
বলো।
সুতাকৃমি অর্থাৎ সনজু অনেকক্ষণ থেকে দরজার ফাঁক দিয়ে আমাদের দেখছে।
কতক্ষণ?
বেশ অনেকক্ষণ। আমি এখন কি করব জানেন? ওর দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটব।
ভেংচি কাটবে কেন?
ওর মধ্যে টেনশন তৈরি করার জন্যে। ভেংচি খেয়ে সে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাবে এবং সারাক্ষণ চিন্তা করবে ঘটনাটা কি। সাহস করে আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারবে না। সনজু প্রতিদিন চার-পাঁচ বার করে মারা যায়।
ওসমান বললেন, তোমার কথার অর্থ ধরতে পারলাম না। প্রতিদিন চারপাঁচবার করে মারা যায় মানে?
তরু বলল, আপনার কাছ থেকেই শুনেছি শেক্সপিয়ার সাহেব বলেন Cowards die many times before their death. সেই অর্থেই সনজু তিন-চার বার মারা যায়।
তরু সিঁড়িঘরের দরজার দিকে মুখ ফিরিয়ে বিকট ভেংচি কাটল।
ওসমান বললেন, তুমি বেশ ইন্টারেস্টিং মেয়ে। যে তোমাকে বিয়ে করবে সে কখনো বোরও হবে না। তবে তুমি যাকেই বিয়ে করবে তাকে নিয়েই বোরড হবে।
তরু হাতের কাপ নামিয়েই বলল, যাই।
ওসমান বললেন, চা তো শেষ হয়নি। চা শেষ করে যাও।
তরু বলল, আমি এখনই যাব। আমার ক্ষীণ সন্দেহ সুতাকৃমি চলে যায় নি। দরজার আড়ালে লুকিয়ে আছে, তাকে হাতেনাতে ধরব।
সনজু চলে যায় নি। দরজার আড়ালেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। তরুর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সে বলল, বড় আপা চলে গেছে।
তরু বলল, কোথায় গেছে? তোমার দুলাভাইয়ের কাছে?
হুঁ।
তালাক না হয়েছিল?
সনজু বলল, মুখের তালাক তো। রাগের মাথায় তালাকে কিছু হয় না। দুলাভাই বলেছেন তালাক হতে কোর্টের অর্ডার লাগে।
তরু বলল, সব ভালো যার শেষ ভালো। ঠিক আছে তুমি যাও। আড়াল থেকে উঁকি দিও না। আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে কিছু দেখার চেষ্টা করা খুব বাজে ব্যাপার।
সনজু বলল, আপনাকে একটা খবর দেবার জন্যে দাঁড়িয়ে আছি! আজ দুলাভাইকে শিক্ষা দেয়া হবে।
তুমি শিক্ষা দেবে?
আমার বন্ধুরা দিবে। মেরে তক্তা বানাবে। পেটে একটা ছুরিও ঢুকাবে। এমনভাবে ঢুকাবে যেন কোনো ক্ষতি না হয়। মারা যাবে না।
ঘটনা কখন ঘটবে?
আজ রাতে।
তরু বলল, ঘটনা যে ঘটাবে সে এনাটমি জানে তো? বেকায়দায় ছুরি ঢুকিয়ে মেরে না ফেলে।
সনজু বলল, সে এক্সপার্ট।
নাম কি?
হারুন। সবাই বলে ক্ষুর হারুন।
তরু বলল, ক্ষুরের কাজ ভালো জানে এই জন্যে ক্ষুর হারুন?
হুঁ। হারুন ভাই ভালো গান জানে।
তাই না-কি?
সনজু আগ্রহ নিয়ে বলল, তার আরেক নাম মুনসিগঞ্জের হেমন্ত। মুনসিগঞ্জে বাড়ি তো।
ভেরি গুড। গায়কের হাতে মৃত্যু।
মারা যাবে না। হারুন ভাই হাতের কাজে খুব সাবধান। ঘটনা ঘটামাত্র আপনাকে খবর দেব।
রাত নটা।
তরু বারান্দায় মোড়া পেতে বসে আছে। এখান থেকে বাড়ির গেট দেখা যায়। কে আসছে কে যাচ্ছে সেই খবরদারিও করা যায়। তরুর মেজাজ সামান্য খারাপ। সন্ধ্যাবেলা আনিস এসেছিল। একা না, তার চাচাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। তরুকে তাদের এতই পছন্দ হয়েছে যে চাচা মিয়া পাঞ্জাবির পকেট থেকে আংটি বের করে নিমিষেই তরুর হাতে পরিয়ে বলেছেন—সবাই হাত তোলেন। দোয়া হবে। নাটকীয় দোয়া ও দোয়ার মধ্যে গলা কাঁপানো বক্তৃতা আছে। অশ্রুজল আছে।
দোয়া শেষ হবার পর ওসমান বললেন, মেয়ে দেখী অনুষ্ঠানে আমরা সবসময় কিছু ভুল করি।
আনিসের চাচা (নাম কবিরুল ইসলাম চোখ সরু করে বললেন, কি ভুল করি?
ওসমান বললেন, পকেটে করে একটা আংটি নিয়ে যাই। মেয়ে পছন্দ হলে সঙ্গে সঙ্গে আংটি পরিয়ে দেয়া হয়। পছন্দ না হলে গোপনে আংটি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
কবিরুল ইসলাম বললেন, তাতে সমস্যা কি?
ওসমান বললেন, যে মেয়েটির বিয়ে হতে যাচ্ছে তার কিছুই বলার থাকে না। মেয়েটিরও তো পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার থাকতে পারে।
কবিরুল ইসলাম তখন শুরুর দিকে তাকিয়ে থিয়েটারে পাঠ গাইছেন ভঙ্গিতে বললেন, মা তরু। মা তুমিই বলো ছেলে কি পছন্দ হয়েছে? আলাপ খোলাখুলি হওয়া ভালো। আমি প্যাচের আলাপ পছন্দ করি না।
তরু সবাইকে চমকে দিয়ে স্পষ্ট গলায় বলল, বাবা যাকে পছন্দ করেছেন, আমি তাকে কখনো অপছন্দ করব না।
কবিরুল ইসলাম বললেন, মাশাল্লাহ্। মা তোমার কথা শুনে আনন্দ পেয়েছি। কথাবার্তা এরকমই হওয়া উচিত। পরিস্কার। সবাই আরেকবার হাত তুলেন্। দোয়া হবে।
তরুর হবু স্বামী এই পর্যায়ে বলল, চাচা দোয়া তো একবার হয়েছে। আবার কেন?
কবিরুল ইসলাম বললেন, দোয়া তো ভাত খাওয়া না। একবার ভাত খেয়েছি পেট ভরে গেছে আর খাওয়া যাবে না। দোয়া দশ বার করা যায়।
দ্বিতীয় দফার দোয়া আরো আবেগময় হলো। দোয়ার মধ্যে আনিসের বাবা মার কথা চলে এলো। এই শুভক্ষণে তার বড় ভাই অমীরুল ইসলাম জীবিত নাই। পরীর মতো ছেলের বৌ দেখে যেতে পারল না…।
আনিস নামের যুবকটিকে তরুর আসলেই পছন্দ হয়েছে। গম্ভীর ধরনের চেহারা। নির্বোধ তেলতেলে চেহারা না। জিনসের প্যান্টের উপর আকাশি রঙের পাঞ্জাবি পরেছে। দেখতে ভালো লাগছে।
তরু সবার জন্যে চা নিয়ে এসেছে। সবার চা ঠিকঠাক বানানো। শুধু আনিস নামের মানুষটার চায়ে শেষ মুহূর্তে এক টুকরা বরফ দিয়ে দিয়েছে। তার দেখার ইচ্ছা হিম শীতল চা খেয়ে মানুষটা কি করে। সে কি বলবে চাটা ঠাণ্ডা। না-কি এক চুমুক খেয়ে রেখে দেবে। না-কি কিছুই হয় নি এমন ভঙ্গিতে চা খেয়ে শেষ করবে।
আনিস চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়েই চমকে তরুর দিকে তাকিয়ে কাপ রেখে দিল। দ্বিতীয়বার চায়ের কাপে চুমুক দিল না।
আংটি পরানো অনুষ্ঠান এবং দ্বিতীয় দফা দোয়ার পর কবিরুল ইসলাম তরুর দিকে তাকিয়ে বললেন, মাগো! তোমরা দুজন যদি প্রাইভেট কোনো কথা বলতে চাও। ছাদে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলো। আমরা কাবিন নিয়ে প্রিলিমিনারি আলোচনা করি।
তারা দুজন ছাদে চলে এলো। আনিস সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে সিগারেট বের করে সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, বাঁচলাম।
তরু বলল, আপনি কি গরম এক কাপ চা খেতে চান?
না, থ্যাংক য়্যু।
তরু বলল, প্রাইভেট কোনো কথা থাকলে বলুন।
আনিস বলল, হুইল চেয়ারে বসা ভদ্রলোক কে?
বাবার বন্ধু।
আনিস বলল, ভদ্রলোক সারাক্ষণ তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। এর কারণটা কি?
তরু বলল, আপনি সারাক্ষণ ঐ ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে ছিলেন এর কারণটা আগে বলুন।
আমি সারাক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম তোমাকে কে বলল?
আপনি সারাক্ষণ তাকিয়ে না থাকলে কি করে বুঝবেন উনি সারাক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
আনিস বলল, মনে হচ্ছে তুমি কথার খেলা পছন্দ করো।
তরু বলল, হ্যাঁ করি।
আনিস বলল, আমি যে সিগারেট খাচ্ছি—সব ধোয়া যাচ্ছে তোমার দিকে, সমস্যা হচ্ছে না তো?
তরু সহজ গলায় বলল, আমি নন-স্মোকার হলে সমস্যা হতো। আমিও সিগারেট খাই।
বলো কি?
এমন চমকে উঠলেন কেন? যে জিনিস ছেলেরা খেতে পারে তা মেয়েরাও পারে। আমাকে একটা সিগারেট দিন।
আনিস বিস্মিত গলায় বলল, সত্যি সিগারেট খাবে?
হ্যাঁ খাব।
হঠাৎ ছাদে যদি কেউ আসে?
এলে দেখবে আমরা দুজন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছি।
আনিস সিগারেটের প্যাকেট বের করল। তরু সহজ ভঙ্গিতেই সিগারেট নিয়ে ব্রাল। লম্বা টান দিয়ে বলল, বাবার বন্ধু ঐ পঙ্গু মানুষটার নাম ওসমান। তিনি একা থাকেন। কালেভদ্রে তাঁর স্ত্রী তাকে দেখতে আসেন। আর্ট কলেজের এক তরুণী তাঁকে ছবি আঁকা শেখাত। তার বিয়ে হয়ে গেছে। সেও আসে না। জৈবিক কারণেই এখন এই বৃদ্ধ যে কোনো তরুণীর দিকে মুগ্ধ চোখে তাকাবে। তাই না?
আনিস বলল, তুমি এইসব কি বলছ!
তরু বলল, উনি কেন অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন সেটা ব্যাখ্যা করলাম। আমাকে আংটি পরিয়ে দেবার ব্যাপারটা উনার একেবারেই পছন্দ হয় নি। এখন বুঝতে পারছেন?
আনিস বলল, বুঝতে পারছি, তুমি অদ্ভুত মেয়ে।
আমি একজন ঔপন্যাসিক। ঔপন্যাসিকরা কিছুটা অন্য রকম হন। এটাই স্বাভাবিক।
ঔপন্যাসিক মানে? তুমি উপন্যাস লিখছ নাকি।
হুঁ। একটা ডিটেকটিভ উপন্যাস লিখছি।
ছাপা হয়েছে?
না। বিয়ের পর স্বামীর পয়সায় ছাপব। প্রকাশকরা নতুন লেখকের লেখা ছাপে না।
আনিস ইতস্তত করে বলল, কিছু মনে করো না। আমাকে কি তোমার পছন্দ হয়েছে?
তরু বলল, না।
না কেন?
আপনার সঙ্গে বিয়ে হলে আপনি আমাকে সিগারেট খেতে দেবেন না। কেউ আমার দিকে তাকালে ঈর্ষায় জ্বলে যাবেন। আপনার সঙ্গে জীবন-যাপন হবে যন্ত্রনার। আমাকে আরেকটা সিগারেট দিন। ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকবেন না। আমি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো চেইনস্মোকার। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে চেনেন তো? কবি এবং ঔপন্যাসিক।
আনিস বলল, এখন সিগারেট খাওয়াটা ঠিক হবে না। যে কোনো মুহূর্তে চাচা বের হয়ে আসবেন। সিগারেট হাতে তোমাকে দেখলে ধাক্কার মতো খাবেন।
আপনি ধাক্কা খাচ্ছেন না?
কিছুটা তো খাচ্ছিই।
তরু হাসি হাসি মুখে বলল, আংটি খুলে দেব? খুলে দেই? গোপনে। পকেটে করে নিয়ে চলে যান।
আনিস কিছু বলার আগেই তার চাচা বের হয়ে এলেন। আনন্দিত গলায় বললেন, মাগো! যাই? মোটামুটি সব ফাইন্যাল করে গেলাম। বাকি আল্লাহর ইচ্ছা।
তরু ঘড়ি দেখল। তার হাতে ঘড়ি নেই। মোবাইল ফোন। ফোন টিপে ঘড়ি দেখা। এখন বাজছে এগারোটা বিশ।
সনজুর দুলাভাইকে গেট খুলে বাসায় ফিরতে দেখা যাচ্ছে। তার এক হাতে দড়িতে বাধা কিছু সাগর কলা অন্য হাতে ব্রাউন পেপারের ব্যাগ। তার পেটে কেউ ছুরি বসায় নি।
দুলাভাইকে দেখে সনজু ছুটে এসে হাতের বাজার নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল। দুলাভাইকে সুস্থ অবস্থায় দেখে সে আনন্দিত না দুঃখিত তা এত দূর থেকে বুঝা যাচ্ছে না। তরু আরো কিছুক্ষণ বারান্দায় বসে থাকবে না-কি ঘরে ঢুকে উপন্যাসে হাত দেবে বুঝতে পারছে না। নতুন উপন্যাস শুরু করার চেয়ে ছোটগল্প লেখাটা মনে হয় সহজ। আশেপাশে যা ঘটছে তা নিয়ে ছোটগল্প। একটা গল্পের নাম কনে দেখা। সেখানে একটি মেয়েকে পছন্দ করে হাতে আংটি পরিয়ে দেয়া হবে। তারপর দেখা যাবে মেয়েটা ড্রাগ এডিক্ট। পাত্রপক্ষ পিছিয়ে যাবে শুধু পাত্র পিছাবে না। সে আধাপাগল হয়ে যাবে মেয়েটাকে বিয়ে করার জন্যে।
চিন্তা শেষ করার আগেই সুনজু উপস্থিত হলো। তরু বলল, ঘটনা তো ঘটে নাই।
সনজু বলল, আগামী বুধবার ঘটবে। আজ হারুন ভাইয়ের একটা জরুরি কাজ পড়ে গেছে। উনার বড় বোনের মেয়েটা খাট থেকে পড়ে মাথায় ব্যথা পেয়েছে। তাকে হাসপাতালে নিতে হয়েছে। বাচ্চাটার বয়স দেড় বছর। হারুন ভাই তাকে খুবই পছন্দ করেন।
তরু বলল, বুধবারে ঘটনা ঘটবে তো?
অবশ্যই। উনাকে কিছু খরচও দিয়েছি। এক হাজার টাকা দিয়েছি। অনোর কাছ থেকে উনি অনেক বেশি টাকা নেন। আমি বন্ধু বিধায় নামমাত্র টাকা নিয়েছেন। আপনার কোনো কাজ লাগলে বলবেন করায়ে দেব।
তরু হাই তুলতে তুলতে বলল, ক্ষুর চালাচালির কাজ লাগবে না তবে অন্য একটা কাজ করে দিলে ভালো হয়।
বলেন কি কাজ। কাল দিনের মধ্যে করে ফেলব।
একটা নকল ছবি বানিয়ে দিতে হবে। কম্পিউটারে খুব সহজেই কাজটা করা যায়। আমি আমার একটা ছবি দিব আর ওসমান চাচার একটা ছবি দেব। দুটা ছবি মিলিয়ে এমন করতে হবে যে নকল ছবিটাতে দেখা যাবে আমি ওসমান চাচার কোলে বসে আছি। পারবে না?
সনজু জবাব দিল না। তাকিয়ে রইল। তরু বলল, আমি অনেকগুলো ছবি দেব যেটা কাজে লাগে। সকালে এসে ছবি নিয়ে যেও।