জগৎ দু’রকমের।
বস্তুজগৎ। যে জগতে পদার্থবিদ্যার সূত্রগুলি কার্যকর। যেখানে আলোর গতি নির্দিষ্ট। কখনো এর বেশি হতে পারবে না।
আরেকটি হলো মনের জগৎ (আসলে মস্তিষ্কের জগৎ, মন বাস করে মস্তিষ্কে)। এই জগতে সম্ভবত পদার্থবিদ্যার নিয়মকানুন কার্যকর না। আমি ঢাকায় বসে তৎক্ষণাৎ কল্পনায় নিউইয়র্কে চলে যেতে পারি। আলো যে গতিতে চলে। তারচে অনেক দ্রুত গতিতে যাই। আমরা সময়ের বাধাকে অগ্রাহ্য করতে পারি। টাইম মেশিনের গল্পের মতো অতীতেও যেতে পারি। মধ্যবয়সেও ফিরে যেতে পারি শৈশবে।
তবে দু’টি জগতই পদার্থবিদ্যার Cause and Effect মেনে চলে। প্রথমে Cause তারপর Effect. শুধুমাত্র এই একটি ক্ষেত্রে দুটি জগতের মিল আছে।
ছোটনের মনের জগতের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করার জন্যে Cause সৃষ্টি করে আমি বসে রইলাম। যথাসময়ে Effect দেখব এই বিষয়ে মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম। এখানে Cause-টা ছিল তার ভেতর তীব্র ভালোবাসাবোধ তৈরি করা, আর Effect ছিল তীব্র শূন্যতাবোধ তৈরি করা।
মানুষের মস্তিষ্ক শূন্যতা নিতে পারে না। সে যখন তীব্র শূন্যতাবোধে আক্রান্ত হয় তখনই মুক্তির পথ দেখে। আত্মহনন হলো অনেকগুলি পথের একটি পথ। মোটামুটিভাবে ঝামেলামুক্ত পথ। দড়িতে কষ্ট করে ঝুলে পড়ে সব কষ্টের শেষ ঘটানো। দড়ি যোগাড় করে সিলিং ফ্যানে ঝুলানোটাই একমাত্র ঝামেলা।
সব ঝামেলা মিটিয়ে আত্মহননের ব্যাপারটা কেউ খুব গুছিয়ে করে, আবার কেউ এলোমেলোভাবে করে।
ছোটন কাজটা খুব গুছিয়ে করেছিল। অনেকেই তাড়াহুড়া করে আমি আত্মহত্যা করছি’ এই জাতীয় চিঠিপত্র লেখে না। তখন পুলিশ খুব ঝামেলা করে। ছোটন তা করে নি। সে তার বোনকে সুন্দর চিঠি লিখে গেল। সেই চিঠিতে একবারও আত্মহননের মূল কারণ উল্লেখ করল না। সে লিখল—
রূপা আপু,
তুমি আবার রাগ করো না। আমার বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করছে না। হয়তো আমি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছি। অসুখটা এত জটিল যে এর চিকিৎসা সম্ভব না।
আপু শোন, আমার মৃত্যুতে তুমি তীব্র কষ্ট পাবে তা আমি জানি। দুলাভাইও কষ্ট পাবেন। তোমার কাছে আমার অনুরোধ কষ্ট ভোলার ব্যাপারে তুমি দুলাভাইকে সাহায্য করবে।
তোমাদের দুজনের জীবন যেন অসম্ভব সুন্দর হয়, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যেন আনন্দময় হয়–এই তোমাদের প্রতি আমার আন্তরিক শুভকামনা।
ছোটন
বুধবার, অক্টোবর বার।
(সময় বিকাল পাঁচটা)
চিঠিটা সে লিখল বিকাল পাঁচটায়, তখন আমি রূপাকে নিয়ে ডেনটিস্টের কাছে গিয়েছি। তার দাঁতে ব্যথা।
সন্ধ্যা ছ’টায় ছোটন ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ল। এই সময়ে ডেনটিস্ট রূপার দাঁত ড্রিলিং মেশিন দিয়ে ড্রিল করছে। রূপা ভয়ে এবং যন্ত্রণায় চিৎকার করছে। রোমান পলনস্কি এই ঘটনা নিয়ে ছবি বানালে দৃশ্যগুলি হয়তো এরকম করে সাজাতেন—
দৃশ্য এক। ডেনটিস্ট রূপাকে চেয়ারে বসাল।
কাট। দৃশ্য দুই। ছোটন রেলিংয়ের উপর উঠে দাঁড়াল।
কাট। দৃশ্য তিন। ডেনটিস্ট রূপার দাঁত ড্রিল করছে।
কাট। দৃশ্য চার। ছোটন রেলিংয়ের উপর দাড়িয়ে। সামান্য দুলছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে ড্রিলিং মেশিনের শব্দ।
কাট। দৃশ্য পাঁচ। রূপা ব্যথায় চিৎকার করে উঠল।
কাট। দৃশ্য ছয়। ছোটন লাফ দিল।
ভালো কথা, আপনি রোমান পলনস্কির ছবি দেখেছেন? ‘রিপালশান’ ছবিটা দেখতে পারেন। এই প্রতিভাবান মানুষটা যে তের বছর বয়েসী এক বালিকাকে রেপ করেছিল এটা জানেন? রেপিস্ট মাত্রই মানসিক রোগী। তবে প্রতিভাবানরা না। তাই না?
আপনি কি কখনো সাগরে স্নান করেছেন? প্রথম একটা বড় ঢেউ আপনার উপর দিয়ে গেল। আপনি ভয়ে এবং আতঙ্কে অস্থির হলেন। দ্বিতীয় বড় ঢেউটা যখন গেল তখন ভয় অনেক কম। আতঙ্কও কম। অস্থিরতা নেই বললেই হয়। বরং কিছুটা আনন্দ লাগছে।
পরপর দুটি বিপর্যয়কে সমুদ্রের বড় দু’টা ঢেউয়ের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। প্রথম বিপর্যয় মনের উপর যে চাপ তৈরি করে দ্বিতীয় বিপর্যয়ে তা আসে না। বরং প্রথম বিপর্যয়ের প্রবল মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে।
ছোটনের মৃত্যু রূপা খুব সহজভাবে গ্রহণ করল।
ছোটন ছ’টা সাড়ে ছ’টার দিকে মারা যায় আমি তার মৃত্যুর দু’থেকে আড়াই ঘণ্টা পরের সিনারিও বলি। ঘড়িতে বাজছে আটটা পঁচিশ। আমি বারান্দার চেয়ারে বসে আছি। বাড়িতে পুলিশের ওসি সাহেব এসেছেন। আমার লোকজনও চলে এসেছে (রহমত মিয়া, ইফতেখার মামা, জলিল সাহেব)। গেটের বাইরেও অনেক লোকজন। তারা হৈচৈ করছে। পুলিশ তাদের সরিয়ে দিচ্ছে, তারা আবারো ফিরে আসছে। আমি ঝিম ধরা ভাবে বসে আছি। এমন সময় রূপা আমার কাছে এসে বলল, তুমি এত আপসেট হয়ো না। স্বাভাবিক হও। চা খাবে? চা বানিয়ে দেই?
যে মেয়েটির অতি আদরের ছোটবোন দু’ঘণ্টা আগে মারা গেছে সে কি এত স্বাভাবিক আচরণ করতে পারে? অবশ্যই পারে না। রূপা পারছে কারণ সে তার সমস্ত অস্বাভাবিকতা বড় বোনের মৃত্যুতে দেখিয়ে ফেলেছে। ছোট বোনের মৃত্যু তাকে স্বাভাবিক হতে সাহায্য করছে।
তবে এই স্বাভাবিকতা সাময়িক। খুবই সাময়িক। প্রবল শোকের ব্যাপারটা সে এখনো বুঝতে পারছে না, মস্তিষ্ক তাকে বুঝতে দিচ্ছে না। কারণ মস্তিষ্ক মনে করছে রূপা যখনই প্রবল শোকের ব্যাপারটা পুরোপুরি বুঝবে তখনই মস্তিষ্ক নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মস্তিষ্ক চেষ্টা করছে নিজেকে রক্ষা করতে।
রূপা আবারো বলল, তুমি কি চা খাবে? চা বানিয়ে আনব?
তোমাকে চা বানিয়ে আনতে হবে না। তুমি বসো তো আমার পাশে।
রূপা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, তুমি এমন অসহায়ের মতো মুখ করে বসে আছ, আমার খুব খারাপ লাগছে।
আমি বললাম, রূপা, তুমি একটা কাজ কর–ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে থাক। তোমার ঘুম দরকার।
রূপা বলল, আমি তোমার পাশে বসে থাকব, তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না। তুমি হাতটা দাও তো, আমি তোমার হাতটা একটু ধরি।
আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম। রূপা আমার হাত ধরে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল, তুমি এখন আর আমাকে আগের মতো দস্তা-কন্যা বলে ডাক না কেন?
এখন থেকে অবশ্যই দস্তা-কন্যা ডাকবে।
আমি বললাম, আচ্ছা।
রূপা বলল, আমি ছোটনের গোপন একটা ব্যাপার জানি। গোপন ব্যাপারটা শুনলে তুমি খুবই অবাক হবে।
গোপন ব্যাপারটা কী?
ছোটন তোমার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম। একবার ভেবেছিলাম তোমার সঙ্গে আলাপ করব। তোমার পরামর্শ নেব।
আলাপ কর নি কেন?
তুমি যদি আমার বোনটাকে খারাপ ভাব–এই জন্যে আলাপ করি নি। আমি চাই না কেউ আমার বোনকে খারাপ ভাবুক।
তাহলে ঠিক আছে।
আমি যে তোমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসি তা কি তুমি জানো?
জানি।
কেন ভালোবাসি সেটা জানো?
জানি।
তাহলে আমাকে একটু বুঝিয়ে বলো তো কেন ভালোবাসি। আমি নিজে জানি না। আমার জানতে ইচ্ছা করে।
আরেক দিন বলি। আজ বাড়িতে এত বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটল। এই সময়ে ভালোবাসা বাসি নিয়ে কথা বলা ঠিক না।
তুমি ঠিকই বলেছ। আচ্ছা শোন, আমার খুব কাঁদতে ইচ্ছা করছে। আমি কাঁদতে পারছি না। কেন বলো তো?
বলতে পারছি না।
কান্না দেখতে তোমার ভালো লাগে না। এই জন্যে আমি কাঁদছি না। আমি ঠিক করেছি তোমার ভালো লাগে না এমন কোনো কাজ আমি কখনো করব না। ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছি না?
হ্যাঁ, খুব ভালো সিদ্ধান্ত।
এতক্ষণ ধরে আমরা কথা বলছি, তুমি কিন্তু এখনো একবারও আমাকে দস্তাকন্যা বলে ডাক নি।
কেমন আছ দস্তা-কন্যা?
রূপা গাঢ় স্বরে বলল, ভালো আছি। আমি খুব ভালো আছি।
অনেক রাতে আমি ছাদে গেলাম। ডাক্তার সাহেব পেথিড্রিন ইনজেকশান দিয়ে রূপাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছেন। সহজে তার ঘুম ভাঙবে না। আমি দীর্ঘ সময় আকাশ দেখতে পারব। টেলিস্কোপ দিয়ে শখের এনোমারের আকাশ দেখা না, খালি চোখে আকাশ দেখা। আকাশে কোনো কোনো নক্ষত্র উজ্জ্বল, কোনো কোনোটি অনুজ্জ্বল। দীর্ঘ সময় এদের দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখ সবগুলি নক্ষত্রকে সমান ঔজ্জ্বল্যে দেখতে চেষ্টা করে, তখন মস্তিষ্কে কিছু রি-এরেঞ্জমেন্ট হয়। তার ফল খুব ইন্টারেস্টিং। তখন মনে হয় সব নক্ষত্র হঠাৎ নিচে নেমে আসছে কিংবা যে তাকিয়ে আছে সে ভেসে ভেসে নক্ষত্রের দিকে যাচ্ছে।
যখন আকাশের তারাগুলি আমার চোখের দিকে নামতে শুরু করল তখন অবিকল ছোটনের গলায় কেউ একজন বলল, কী দেখছ?
আমি বললাম, তারা দেখছি। কাঁসা-কন্যা, কেমন আছ?
ভালো আছি। আমি সবসময় ভালো থাকি।
তুমি কোথায়?
আমি তোমার মাথার পাশে, পা ছড়িয়ে বসে আছি।
আমি যদি উঠে বসি তাহলে কি তোমাকে দেখতে পাব?
অবশ্যই দেখতে পাবে। তোমার রোগ অনেক বেড়েছে, কাজেই বেশিরভাগ সময়ই তুমি আমাকে দেখতে পাবে। তুমি যদি আমাকে বলো তোমার পাশে শুয়ে তারা দেখতে, তা হলে আমি তাই করব। তুমি তখন আমার গায়ে হাত রেখেও তারা দেখতে পারবে। কিংবা আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার চোখের দিকেও তাকিয়ে থাকতে পার। চোখের মণিতে তারার প্রতিফলন দেখাটাও ইন্টারেস্টিং হবার কথা।
আমার কাছে তো পুরো ব্যাপারটাই ইন্টারেস্টিং লাগছে। কল্পনার মানুষের বাস্তব উপস্থিতি।
কাঁসা-কন্যা হাসল।
আমি বললাম, হাসছ কেন?
কাঁসা-কন্যা বলল, আমি হাসছি, কারণ, তোমার যে অসুখটা হয়েছে সেটা আসলেই মজার অসুখ। এই অসুখে বাস্তব-অবাস্তব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। কখনো তোমার কাছে মনে হবে, আমি বাস্তব, রূপা কল্পনা।
আচ্ছা তুমি এখন কার মতো? রূপার মতো না-কি ছোটনের মতো।
তুমি আমাকে যার মতো ভাববে, আমি হব তার মতো।
কাঁসা-কন্যা, আমার পাশে এসে শুয়ে থাক। আস আমরা এক সঙ্গে তারা দেখি।
সে বাধ্য মেয়ের মতো আমার পাশে এসে শুয়ে পড়ল। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ঐটাই কি সপ্তর্ষিমণ্ডল?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
সপ্তঋষির নামগুলি জানো?
অবশ্যই জানি–অন্ডু, পুলহ, পুলস্ত্য, অত্রি, অষ্টিরা, বশিষ্ট, মরীচ।
অরুন্ধতি নামের একটা তারা আছে না? অরুন্ধতি কোনটা? বশিষ্টের পাশের তারাটি অরুন্ধতি। দেখতে পাচ্ছ?
না।
চোখ খারাপ হলে অরুন্ধতি দেখা যায় না। আমার মনে হয় তোমার চশমা নিতে হবে।
আমাকে চোখের ডাক্তারের কাছে কবে নিয়ে যাবে বলো তো। আমি অরুন্ধতি তারাটা খালি চোখে দেখতে চাই।
নিয়ে যাব। খুব শিগগিরই নিয়ে যাব।
আমি কাঁসা-কন্যার চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। তারাগুলি সত্যি সত্যি তার চোখে দেখা যাচ্ছে। বাহ মজা তো!
কাঁসা-কন্যা লজ্জা লজ্জা গলায় বলল, চোখ বড় বড় করে কী দেখছ?
আমি বললাম, তারা দেখছি। তারাগুলি কি সুন্দর তোমার চোখের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে।
সে আদুরে গলায় বলল, উদ্ভট কথা বলবে না তো।
আমি বললাম, তুমি যে ধরনের কথা শুনতে চাও আমি ঠিক সেই ধরনের কথা বলব। ভালোবাসার কথা শুনতে চাও?
না।
না কেন?
আমার লজ্জা করবে।
তাহলে কি জ্ঞানের কথা শুনতে চাও? বিজ্ঞানের কথা। সৃষ্টি-তথ্য।
বলো শুনি।
এক্সপানডিং ইউনিভার্সের তথ্য জানো? আদিতে এই মহাজগৎ বিন্দুতে সীমাবদ্ধ ছিল। হঠাৎ কী যেন হলো। প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। বিন্দু পরিণত হলো মহাজগতে এবং সেই জগত থেমে রইল না, চারদিকে ছড়িয়ে যেতে লাগল।
বাহ অদ্ভুত তো!
যে নক্ষত্ররাজি যতদূরে সে তত বেশি গতিতে বাইরের দিকে ছুটছে।
কোথায় যাচ্ছে?
কোথায় যাচ্ছে আমরা জানি না। তবে একটা জিনিস জানি–সবচে’ দূরবর্তী নক্ষত্ররাজি ছুটছে আলোর গতিতে। তাতে একটা বড় সমস্যা তৈরি হচ্ছে।
কী সমস্যা?
যে বস্তু আলোর গতিতে ছুটে তার কাছে সময় বলে কিছু নেই। ঐসব বস্তু বাস করছে সময় শূন্য জগতে। কাজেই ঐসব বস্তু সম্পর্কে আমরা কোনোদিনই কোনো কিছু জানতে পারব না।
আমি গল্প করছি। বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে গল্প শুনছে কাঁসা-কন্যা। আহারে, কী আনন্দময় সময়!