চুপ করে তক্তাপোশের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে থাকলাম। একটু বাদেই একটা খোট্টা পুলিশ মহা চেঁচামেচি লাগাল।
–আরে একঠো কো তো মিল গিয়া। কিন্তু বাকি সব কঁহা গিয়া কুছ পাত্তা ভি তো পাই না রে বাবা!
কাকে পেল দেখবার জন্য দরজার কাছে গেলাম, পুলিশটাও সঙ্গে গেল। দেখি কিনা কোত্থেকে রোগা চিমড়ে একটা লোককে, শার্টের কলার ধরে ঝোলাতে ঝোলাতে ওপরে নিয়ে এল। এ আবার কে রে বাবা!
লোকটাকে তক্তাপোশের ওপর ফেলে, হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, পিছু কা সিঁড়ি থেকে ভাগনে লাগা। ঔর হাম ভি বাঘকা মাফিক উসকো ঘাড়মে লাফায়া।
লোকটার দেখলাম চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে, এক পাটি চটি কোথায় খুলে পড়ে গেছে। তার ঠিকানা নেই, খোঁচা খোঁচা দাড়ি-গোঁফ, মুখ ভরতি উশকোখুশকো চুল।
ব্যস্ত হয়ে বললাম, আরে, এ আবার কিকো আনলি রে? ই তো ভুল আদমি হ্যায়।
তাই শুনে পুলিশ দুটোই রেগে বললে, হ্যাঁ, ভুল আদমি হ্যায় না তোমরা মুণ্ডু হ্যায়। নিশ্চয়ই তোমার দল কা আদমি হ্যায়। তুম গোপন করতা।
বললাম, নিজেই যখন ধরা পড়েছি, ওদের গোপন করে আর কী লাভ হবে?
কিছুতেই বুঝতে চায় না, শেষে বলে কিনা, দাড়ি গোঁফ লাগাকে ছদ্মবেশ পাকড়া কিনা, ওই আস্তে তুমি চিনতে নেই পারতা।
ভালো রে মজা।
এতক্ষণ লোকটার মুখে একটি কথা নেই। নিমেষের মধ্যে পুলিশ দুটো ওর ঠ্যাং-ট্যাং দড়ি দিয়ে তক্তাপোশের পায়ার সঙ্গে বেঁধে, বেচারাকে তক্তাপোশের একেবারে ধারে বসিয়ে, হাত দুটোকেও আবার পাছামোড়া করে কষে বেঁধে দিল। দেখলাম লোকটা বার বার কী যেন বলবার চেষ্টা করছে, তাতেই আবার ওর মুখের মধ্যে ওদের এক জনের পাগড়ি থেকে এক টুকরো ছিঁড়ে নিয়ে, ঠুসে দিল।
তারপর নিজেদের হাত-পা ঝেড়ে, কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল, আই বাপস্! কী দারুণ শুভা হ্যায়! কোই দাগি বদমাশ হোগা জরুর। উঃ আলজিবভি শুকিয়ে খটখটে হো গিয়া! বলে, বিড়ি খাবার জন্য বাইরে চলে গেল।
আমি তখন উঠে লোকটাকে ভালো করে দেখবার জন্য কাছে গেলাম। লিকপিকে হাত-পা, পঞ্চাশ-টঞ্চাশ বয়স হবে মনে হল, নিদেন চল্লিশ-টল্লিশ তো নিশ্চয়, কানে খুব লম্বা লম্বা চুল। বড় মায়া লাগল।
আমাকে কাছে আসতে দেখে হাত-পা নিয়ে কিলবিল করে সে বলল, এ-গ-গ-প-গ-প।
ভারি অসোয়াস্তি বোধ করতে লাগলাম। ততক্ষণে লোকটার মুখ-টুখ লাল হয়ে উঠেছে, সে আবার অনুনয়-বিনয় করে বলল, প-গ-গ-গ-গ-ব-গ-গ।
আমি তো অপ্রস্তুতের একশেষ! দরজার কাছে গেছি পুলিশ দুটোকে ডাকতে, যদি তারা কিছু করতে পারে। লোকটা কিন্তু তাই দেখে, মাটিতে পায়ের গোড়ালি ঘষে রেগে রেগে বলল, শশশশশ।
যাক গে, ঠিক সেই সময় পুলিশরা ফিরে আসতে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।
ওদিকে যারা খানাতল্লাশি করছিল, তাদের একটু-আধটু শব্দও আমার কানে আসছিল। বোধ হয় কেউ কেউ খুঁজতে খুঁজতে রান্না ঘরেও গিয়ে থাকবে। কিন্তু তারা তক্ষুনি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল শুনলাম, বুড়ির গলাও শুনলাম, মনে হল খুব খুশি হয়নি।
দুড়দাড় করে তিন-চার জন সিঁড়ি দিয়ে উঠে আমাদেরই ঘরে আশ্রয় খুঁজল, পেছন পেছন বুড়িও একটা গরম খুন্তি নিয়ে বকবক করতে করতে ছুটে এল।
ঘরে ঢুকে হাত-পা-বাঁধা আধাবয়সি লোকটাকে দেখে বুড়ি তো একেবারে থ! হাত থেকে খুন্তিটা ঝনঝন করে মাটিতে পড়ে গেল। আর অমনি পুলিশদের মধ্যে এক জন সেটাকে কুড়িয়ে নিয়ে জানলা দিয়ে গলিয়ে একতলায় ফেলে দিল। এইরকম উপস্থিতবুদ্ধি দিয়েই ওরা চোর ধরে।
বুড়ির হাত-পা কাঁপছে, মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। লোকটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে তো চেয়েই আছে! লোকটাও ঢোক গিলতে গিয়ে, খানিকটা পাগড়ি গিলে কেশে-টেশে একাকার।
পুলিশরা এগিয়ে এসে বুড়িকে সাবধান করে দিল, আরে, মাইজি, বেশি কাছে মত যাইয়ে, বড়া বদমাশ হ্যায়।
বুড়ি চোখ লাল করে, চাপা গলায় বললে, সে কি তোমাদের কাছে শিখতে হবে নাকি। এতকাল ঘর করছি আমি জানি না।
বলে কাছে গিয়ে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে, বললে, বেশ হয়েছে, ঠিক হয়েছে, উচিত সাজা হয়েছে! খুব খুশি হয়েছি।
লোকটা নরম সুরে ইনিয়ে-বিনিয়ে বললে, ল-ল-ল-ম-ম!
বুড়ি দাঁতে দাঁতে ঘষে, কোনো কথা না বলে আবার নীচে চলে গেল।
পুলিশরা হাঁ করে পরস্পরের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করে, বলাবলি করতে লাগল, আরে বাপ্পা! ই তো ভীষণ মাইজি হো!
তারপর বোকার মতো এ-ওর দিকে তাকাতে লাগল, লোকটাকে নিয়ে কী যে করা উচিত ভেবে পেল না।
এইসব ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত থাকাতে এতক্ষণ নিজের বিপদের কথা ভুলেই গেছলাম! এইবার ভাবনা-চিন্তায় মনটা আবার ভারী হয়ে উঠল। খিদেও পেয়েছিল দারুণ। বুড়ির হাতের গরম খুন্তিটা দেখে অবধি জিবে জল আসছিল! তবে খাবার-দাবার সম্বন্ধে আমি কাউকে বিশ্বাস করি, নিজের কাছে সর্বদা একটা স্টক রাখি। কালকের সব জামাটামা এতক্ষণে শুকিয়ে গেছে, তার পকেট থেকে একটু চুইংগাম বের করতে যাব, ওমা, পুলিশগুলো অমনি হাঁই হই করে ছুটে এসে বলে কি না, খবরদার! ছুরি-ছোরা বার করেগা তো ডান্ডা দেকে মুণ্ডু উড়ায়ে দেগা!
সাহস দেখে হাসি পেল! বুঝিয়ে বললাম, আরে বাবা, ছুরি-ছোরা সঙ্গে থাকলে কি আর এতক্ষণ এখানে বসে থাকি! ওটা আমার খাবার।
কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না। শেষপর্যন্ত সবাইকে একটু একটু দিয়ে তবে রেহাই পেলাম। পকেট তো প্রায় গড়ের মাঠ! ওরা দেখলাম কচ কচ করে চিবিয়ে, রবার-টবার সব গিলে ফেলে, বিরস বদন করে বসে থাকল!
এদিকে সময় আর কাটতে চায় না। বাইরে চনচনে রোদ, মনে হচ্ছে বেলা এগারোটাও হতে পারে, বারোটাও হতে পারে। স্কুলের দিনে এর কত আগে আমি খাই।
অথচ এখন অবধি অন্য লোকগুলোর কোনো সাড়াশব্দই নেই! বাড়ি ছেড়ে তারা যে জঙ্গলের মধ্যে তোলপাড় করছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
ভেবে অবাক হচ্ছি বিরিঞ্চিদারা তাহলে গেল কোথায়। শেষটা হুলিয়াতে খেয়ে নেয়নি তো!
এমনি সময় পুলিশের এক জন আমার কাছে এসে, পিঠে হাত-টাত বুলিয়ে হাসি হাসি মুখ করে বলতে লাগল, আরে ভাই, বোলো না ওলোককো কঁহা গুম কিয়া! তোমকো লজেঞ্চুষ দেগা, লাঠি দেগা, লাটু দেগা–
এত এত ঘুষ দেখাতে লাগল, এমনি খারাপ!
হঠাৎ ঝড়ের মতো দাড়িওয়ালা বুড়োটা এসে ঘরে ঢুকল। হাত-পা-বাঁধা লোকটাকে দেখে রেগেমেগে পুলিশদের বলল, স্টুপিড় কাঁহিকা; চোর ধরতে সব দেখছি সমান ওস্তাদ। আবার আমাদের কর্তাবাবুকে ধরে এনে বেঁধে রাখা হয়েছে। এরজন্যে এক-একটাকে যদি কুড়ি বছর করে জেলে যেতে না হয় তো কী বলেছি। আর কর্তামশাইকেই জেলে দিবি তো আমার বাকি মাইনেটা কি তোরা দিবি না কে দেবে শুনি!
পুলিশদের আর মুখে কথাটি নেই! বুড়োও কারো অপেক্ষা না রেখে, দড়ি-দড়া খুলতে লেগে গেল। দড়ি খোলা হয়ে গেলে বললাম, ওর মুখ থেকে পাগড়ি বের করে দাও, নইলে কথা বলবে কী করে?
কিন্তু লোকটাকে হাঁ করিয়ে দেখা গেল, মুখে পাগড়ি-টাগড়ি কিছু নেই, কখন সেটা চিবিয়ে গিলে-টিলে বসে আছে!
পাগড়ি গেলার কথা শুনে পুলিশরা বেজায় রেগে গেল। এক জন তো বার বার বলতে লাগল গিলে ফেলেছে আবার কী! ওতে নাকি তার ধাবির হিসসে লেখা ছিল, এখন কী হবে।
ততক্ষণে রোগা লোকটার মুখে কথা ফিরে এসেছে, সেও রেগে বলল, গিলেছি মানে আবার কী? গলা দিয়ে নেমে গেলে আমি আর কী করতে পারি বল? অবশ্যি খেতে যে খুব খারাপ লেগেছে তা বলছি না। বেশ টক-টক নোনতা-নোনতা।
এই বলে সে ঠোঁট চেটে, পাগড়ির যে দুটো-একটা সুতো লেগে ছিল সেগুলোকেও খেয়ে ফেলল।
তাই দেখে আমারও এমনি খিদে পেতে লাগল সে আর কী বলব।
দূরে সেজোদাদামশায়ের, বিরিঞ্চিদার পিসেমশাইয়ের গলার আওয়াজ শুনে বোঝা গেল ঠানদিদিদের কাউকে এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। সত্যি, গেল কোথায় সব, কে জানে হয়তো কিছুতে–
শুনলাম পুলিশ ইন্সপেক্টর বলছেন, দেখতে ছোটো হলে কী হবে, একেবারে কেউটে সাপের বাচ্চা। ও-ই যে এ-সমস্তর গোড়ায় তার কোনোই সন্দেহ নেই, নইলে ওদের এত বুদ্ধি আসে কোত্থেকে।
পিসেমশাইও তক্ষুনি সায় দিয়ে বললেন, হ্যাঁ, আমাদের বিরিঞ্চি তো আগে এমন ছিল না। ওই অতটুকু ছেলে দেখে, তাকে বিশ্বাস করে, দেখুন তো মশাই, শেষটা এই অঘোর জঙ্গলে প্রাণটা খোয়ালে।
তাই শুনে সেজোদাদামশাই বিরক্ত হয়ে বললেন, রেখে দিন, মশাই। আপনাদের বিরিঞ্চিটি কিছু কম যায় না। বউঠানের মাথায় হাত বুলিয়ে
পুলিশ ইন্সপেক্টর বললেন, দেখুন, আপনাদের এইসব পারিবারিক ব্যাপারগুলো অতি ছোটো জিনিস। ওই বিরিঞ্চি কি শ্যামাদাস মোলো কি না মোলো, তাই দিয়ে দেশের কীই-বা এসে যায় বলুন। আসল কথা হল জমিদারমশায়ের মুক্তোর মালাটা গেল কোথায়? বড়োসায়েব আর আমায় আস্ত রাখবে না। আর মালা খুঁজে দিতে না পারলে আমার প্রমোশনেরই-বা কী হবে, তাই বলুন?