চিররঞ্জন এই পৃথিবীর একজন হেরে যাওয়া মানুষ। প্রথম যৌবনে যখন শরীর সোজা থাকে, স্নায়ু সবসময় সজাগ, আনন্দের উপকরণ আপনা থেকে চলে আসে কাছে, একা একা হেঁটে যাবার সময় গোপনে মনে হয় এই পৃথিবীটা আমার সেই সময়েই তিনি পর পর দুটি আঘাত পেয়েছিলেন, তাতে তার মন ভেঙে যায়। আর রুখে দাঁড়াতে পারেননি, বরং নিরাসক্ত হয়ে যান। পৃথিবীতে দাপটের সঙ্গে বেঁচে থাকার বদলে আরও কিছু দিন কাটিয়ে যাবার মনোভাব দেখা দেয়। কোনও জায়গায় চিররঞ্জন উপস্থিত থাকলেও তাঁর উপস্থিতি সহজে বোঝা যায় না।
যদিও প্রথম জীবনটা চিররঞ্জন ভালোই শুরু করেছিলেন। গ্রামের মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসতে পেরেছিলেন নিজের চেষ্টায়। তার বাবা সারদারঞ্জনের কাছে ম্যাট্রিক পরীক্ষাই ছিল শিক্ষার চূড়ান্ত মান। সদরের হাইস্কুলে প্রতি বছর ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেয় দশ বারোটি ছেলে, তার মধ্যে পাশ করে দুটি বা তিনটি, তারাই বংশের মুখ উজ্জ্বল করা সন্তান। অত খেটেখুটে পরীক্ষা পাশ করার পর ছেলেরা চাকরিবাকরি জোগাড় করবে গভর্নমেন্টের চাকরি হলে তো কথাই নেই। সারদারঞ্জনের ইচ্ছে তারপর ছেলেদের বিয়ে দিয়ে ঘরে বউ আনবেন, নাতি-নাতনিতে সংসার ভরে যাবে। সুখ তো এরই নাম। বড়ছেলে প্রিয়রঞ্জন একবারেই ম্যাট্রিক পাশ করে অল্প দিনের মধ্যেই চাকরিও পেয়ে গিয়েছিলেন, বিয়েও দেওয়া হয়েছিল যথারীতি। কিন্তু চিররঞ্জনের শখ হল কলেজে পড়ায়।
খরচ চালাবার জন্য নিজেরই চেষ্টায় চিররঞ্জন কলকাতার একটি বাড়িতে থাকা-খাওয়ার টিউশানি জোগাড় করে নিয়েছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে সেই পরিবারটি খুব ভালো, সকলের ব্যবহার বেশ আন্তরিক। আমহার্স্ট স্ট্রিটের রায়বাড়িতে চিররঞ্জন দুটি ছেলের গৃহশিক্ষক, একতলায় একটি ঘর পেয়েছেন–সকালবেলার জলখাবার আসে ওপরতলা থেকে, তবে দুপুর আর রাত্তিরের খাবারটা খেয়ে নিতে হয় বারোয়ারি রান্নাঘরে গিয়ে। রান্নার ঠাকুররা বাড়ির মাস্টারকে একটু অবজ্ঞা করে, মাছের টুকরো প্রায়ই অদৃশ্য হয়ে যায়, কিন্তু চিররঞ্জন তা নিয়ে কখনও অভিযোগ করেননি। ছাত্রদের বিধবা পিসিমা মলিনা তাকে খুব স্নেহ করেন, প্রায়ই খোঁজখবর নেন। বাড়িতে নারায়ণের পুজো হয় নিত্য তিরিশ দিন, যদি কোনও দিন পুরুতঠাকুর আসতে না পারেন, তখন চিররঞ্জনকেই নমো নমো করে ঘণ্টা নাড়তে হয়।
চিররঞ্জন আই-এ পাশ করার পর সারদারঞ্জন ছেলেকে আর একবার তাড়া দিলেন দেশে ফেরার জন্য। তিনি তখন ছেলের জন্য চারদিকে পাত্রী দেখে বেড়াচ্ছেন–তার এই ছেলে দুটো পাশ দিয়েছে, এখন তার বাজারদর অনেক বেশি। তা ছাড়া কলকাতা শহরে কত রকম ডাকিনী-যোগিনী ঘুরে বেড়ায় বয়েসকালের ছেলেকে কি সেখানে একা ফেলে রাখতে আছে! সিনেমা-থিয়েটারে যোগ দিয়েই বেশ্যাপল্লির মেয়েগুলো এক একজন দেবী হয়ে উঠছেন। ঘরের বউরাও ওই স্লেচ্ছ শহরে ফিটন চেপে বরের সঙ্গে গঙ্গার ধারে হাওয়া খেতে যায়!
কিন্তু চিররঞ্জন গ্র্যাজুয়েট না হয়ে ছাড়বেন না। তার আগে বিয়েও করবেন না। এদিকে মলিনার সঙ্গে তাঁর স্নেহ-মমতার সম্পর্ক আস্তে আস্তে প্লেটনিক প্রেমের দিকে মোড় নিচ্ছে।
বি.এ. পরীক্ষা দেবার পর চিররঞ্জন দেশে ফেরার জন্য তৈরি হলেন। তখনও রেজাল্ট বেরোয়নি। ততদিনে সারদারঞ্জন অনেক দেখাদেখি করে তিন জায়গায় ছেলের বিয়ের সম্পর্ক প্রায় ঠিক করে ফেলেছেন, এখন দর কষাকষি চলছে। সেই সময় পরীক্ষা দিয়েই ছাত্ররা এগজামিনারদের বাড়ি বাড়ি ঘুরত রেজাল্ট জানার জন্য। তখন ছাত্রসংখ্যা এত বিপুল ছিল না–এগজামিনারও ছিল বাঁধাধরা। তাদের বাড়ির সামনে লম্বা লাইন পড়ত সকাল থেকে–এগজামিনারের কোনও দয়ালু-হৃদয় আত্মীয় এক এক জনের রোল। নাম্বার দেখে নিয়ে নাম্বার বলে দিতেন।
চিররঞ্জন পরীক্ষা মোটামুটি ভালোই দিয়েছিলেন, মনে কোনও আশঙ্কা ছিল না–তবু হঠাৎ খবর পেলেন তিনি অঙ্কে ফেল করেছেন! নিজেই গরজ করে তিনি অর্থনীতির সঙ্গে অঙ্ক কম্বিনেশান নিয়েছিলেন। খবর শুনে চিররঞ্জনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল! পরের বাড়িতে আশ্রিত থেকে যারা লেখাপড়া করে, তাদের পক্ষে ফেল করা যে কতখানি গ্লানির ব্যাপার, তা অন্য কেউ বুঝবে না। এখন কী উপায়? এরপর আর আমহার্স্ট স্ট্রিটের রায়বাড়িতেও সম্মানের সঙ্গে থাকা যাবে না!
চিররঞ্জনের এক বন্ধু পরামর্শ দিলেন স্যার আশুতোষ নাকি গরিব ছাত্রদের অবস্থা শুনলে দু’-এক সাবজেক্টে ফেল হলেও পাশ করিয়ে দেন। বন্ধু ভবশঙ্করের সঙ্গে চিররঞ্জন একদিন গেলেন রসা রোডে স্যার আশুতোষের বাড়িতে। সকালবেলা লোকজনের ভিড়ে দেখা করাই যায় না। একটু দুপুর দুপুরে দুই বন্ধু সট করে ঢুকে পড়লেন ভেতরে। বাংলার বাঘ তখন স্নানের আগে তেল মাখছেন। মস্ত বড় গোঁফসমেত বিরাট মুখখানা তুলে জিজ্ঞেস করলেন, আবার কী হল? কী চাই তোদের, আঁ?
লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে চিররঞ্জন কী বললেন তা শোনাই গেল না। নগ্নগাত্র স্যার আশুতোষ হুংকার দিলেন, পেন্নাম করলিনে?
দুই যুবা তখনই বসে পড়ে ঝুপঝাঁপ করে প্রণাম করল পায়ে হাত দিয়ে। চাকরকে দিয়ে তেল মাখাতে মাখাতে স্যার আশুতোষ সব শুনলেন, খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন চিররঞ্জনের পরিবারের খবর, গ্রামের খবর। কিন্তু পাশ করিয়ে দিতে রাজি হলেন না। ধমকে বললেন, ফেল করেছ, আবার পড়ো ইউনিভার্সিটিতে; কি আমি দানছত্তর খুলেছি? খরচ চালাতে না পারো, কলেজের ফি মকুব করে দেবার ব্যবস্থা করব। তোমার থেকে আরও অনেক গরিব ছেলে ভালো রেজাল্ট করে।
চিররঞ্জন নিরাশ হয়ে ফিরে এলেন। দুঃখে-লজ্জায় আমহার্স্ট স্ট্রিটের রায়বাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন। ভেসে বেড়াচ্ছেন এখানে-সেখানে। এই সময় হঠাৎ তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল এক লগ্নছাড়া পাত্রীর সঙ্গে। এই পাত্রীপক্ষ ফেল করার খবর শুনে চিরঞ্জনকে একবার বাতিল করেছিল, পরে তারাই আবার সাধাসাধি করতে এল নিজেদের গরজে। নববধূ বেশ সুন্দরী, শ্বশুর বড়লোক–চিররঞ্জন কিছু দিন কাটালেন আমোদ আহ্লাদে। শ্বশুরবাড়িরই উদ্যোগে কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংয়ে (হোম) পুলিশ বিভাগে একটা চাকরিও জুটে গেল তার। পাকা চাকরি, কম কাজ, উপরি আছে। সরকারি চাকরি সে-আমলে ছিল স্বর্ণপ্রসূ হাঁসের মতন। কাজ না করলেও চাকরি যাবার সম্ভাবনা নেই। করপোরেশন অফিসে চেয়ারে কোট ঝুলিয়ে সরে পড়া কিংবা সরকারি অফিসে সাহেবের গতিবিধি অনুযায়ী টিফিন করা ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। ঘুষের সুযোগ প্রায় সব বিভাগেই। বিয়ের বাজারে সরকারি চাকুরে পাত্রকে প্রকাশ্যেই জিজ্ঞেস করা হত–মাইনে কত, আর উপরি কত? মাইনে খুব কম, উপরি তার তিন-চার গুণ। ব্রিটিশ শাসকরাই খুব সযত্নে এই ব্যবস্থাটি পাকা করে রেখেছিল। দেশের একটি মুষ্টিমেয় শ্রেণিকে কিছু বেশি সুবিধা দিলে বাকি লোকদের শোষণ করার অনেক সুবিধে হয়। দেশের মানুষ পরস্পরকে অবিশ্বাস করে, লাভ হয় বিদেশিদের। তবে দেশ স্বাধীন হবার পরও যে এই ব্যবস্থা টিকে থাকবে–তা বোধহয় ব্রিটিশরাও কল্পনা করতে পারেনি।
এমন ভালো চাকরি থেকেও চিররঞ্জন হঠাৎ একদিন বরখাস্ত হয়ে গেলেন। হোম পুলিশ বিভাগে কাজ করে যে ব্যক্তি, তারই ভাই খুন করেছে সাহেব পুলিশ কমিশনারকে, এ যে বাঘের ঘরে ঘোঘের বাসা! শুধু যে এই চাকরিটাই গেল, তা নয়, সমস্ত রকম সরকারি চাকরির দরজা চিরকালের মতন বন্ধ হয়ে গেল। এর পরেও নিস্তার নেই, চিররঞ্জন লক্ষ করলেন, তিনি যেখানেই যান সব সময় দু’জন লোক ছায়ার মতন তাঁর পেছনে পেছনে ঘোরে। নিদারুণ ত্রাসে চিররঞ্জনের সারাটা দিন কাটে। কোথাও চাকরি খুঁজতে যাওয়ারও উৎসাহ পান না। তার ছোটভাই ও রকম একটা কাণ্ড করে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল, এ জন্য শোক করারও অবকাশ নেই, নিজের চিন্তাই তখন প্রবল।
চাকরি পাবার পর স্ত্রী আর কন্যাকে নিয়ে সবেমাত্র সংসার পেতেছিলেন কলকাতায়, সে-সংসার ভেঙে দিতে হল। ততদিনে সারদারঞ্জন মারা গেছেন, দেশের বাড়িতে থাকাও নিরাপদ নয়। বড়ভাই প্রিয়রঞ্জন বরিশাল শহরে বাসা করেছেন, সেখানে থাকার জন্য আহ্বান জানালেন ওঁদের। কিন্তু দাদার সংসারে বোঝা বাড়ানোর বদলে অনেক ভেবেচিন্তে শ্বশুরবাড়িতে গিয়েই আশ্রয় নিলেন তাদের বিরাট বড় সংসার, এমন কিছু ক্ষতি বৃদ্ধি হবে না।
শুরু হয়ে গেল চিররঞ্জনের আশ্রিত জীবন। ছাত্র বয়সেও তিনি পরের বাড়িতে থেকেছেন, তারপর থেকে সারাটা জীবনই প্রায় তাঁকে পরের বাড়িতে কাটিয়ে যেতে হল। বাকি জীবনটা চিররঞ্জন আর বিশেষ সুবিধে করতে পারেননি, সেই উদম্যই হারিয়ে ফেলেছিলেন। মাঝে মাঝে আরও কয়েকটা চাকরি করেছেন, একবার ব্যবসা করতেও গিয়েছিলেন, কোনওটাই ঠিকমতন দানা বাঁধল না। চিররঞ্জনের শ্বশুর একজন নামকরা পণ্ডিত লোক, আবার সাংসারিক ব্যাপারেও খুব অভিজ্ঞ, এই জামাইটিকে তিনি জীবনে দাঁড় করিয়ে দেবার অনেক রকম চেষ্টা করছেন, কিন্তু যার নিজের পায়েই জোর নেই, সে দাঁড়াবে কী করে! শ্বশুরের সুপারিশে পাওয়া দিল্লিতে একটা ভালো চাকরিতেও চিরঞ্জনের মন বসল না।
শুভার্থীদের পরামর্শে কিছু দিন নিজের গ্রামে গিয়ে হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার সেজেও বসেছিলেন। গ্রামে তখনও ডাক্তারের অভাব। মেটিরিয়া মেডিকা একখানা কিনে আর কিছু ওষুধপত্তর নিয়েই হোমিওপ্যাথি শুরু করা যায়। কিন্তু যে-লোক সত্যিই ডাক্তারি বিদ্যে জানে না, তাকে ডাক্তার সাজতে হলে মিথ্যে কথা বলায় খুব ধুরন্ধর হতে হয়। চিররঞ্জনের সে গুণও ছিল না। তার ফলে, কেশো রুগি, চোর কিংবা মুখচোরা বারবণিতাদের যা অবস্থা হয়, চিররঞ্জনেরও তাই হল। কিছু অর্থদণ্ড দিয়ে ডাক্তারখানার ঝাঁপ ফেলে দিলেন।
স্ত্রী কন্যাকে শ্বশুরবাড়ি রেখে চিররঞ্জন মাঝে মাঝে চলে আসেন কলকাতায় কাজের খোঁজে। এই বিরাট শহরের ভিড়ে মিশে থাকতে তাঁর ভালো লাগে। চিররঞ্জনের। চেহারাটা খুব রোগা পাতলা, এখন অল্প বয়সেই তাঁকে খানিকটা বুড়োটে দেখায়। মাঝে মাঝে যান আমহার্স্ট স্ট্রিটের সেই রায়বাড়িতে। তাঁর ছাত্র দু’জনের মধ্যে একজন ব্যারিস্টারি পড়তে গেছে বিলেতে, একজন পৈতৃক ব্যবসা দেখছে–সে বেশ খাতির করে মাস্টারমশাইকে। প্রায়ই সে মাস্টারমশাইকে একটানা-একটা চাকরির প্রস্তাব দেয়, চিররঞ্জন প্রত্যেকটিই প্রত্যাখ্যান করেন হাসিমুখে। স্যার আশুতোষ মারা গেছেন। এবাড়িতে মলিনারও বয়স বেড়েছে বোঝা যায়, চুলে সাদা ছোপ ধরেছে একটু। নিয়মিত সন্ধ্যাবেলা এসে চিররঞ্জন মলিনার থেকে তিন-চার হাত দূরত্ব রেখে বসে গল্প করে যান ঘন্টার পর ঘণ্টা। কখনও কখনও দুজনের কেউই একটাও কথা বলেন না, দুই দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে বসে থাকেন চুপচাপ। হঠাৎ দেখলে মনে হয়, এঁদের দু’জনের মধ্যে কোনও একটা জায়গায় খুব মিল আছে।
চিররঞ্জন তখন কলকাতায় একটা কোঅপারেটিভ মেসের ম্যানেজার। চাকুরে বাবুদের মেস, একমাত্র চিররঞ্জনকেই নির্দিষ্ট হিসেবে অফিসে যেতে হয় না বলে তাকে ম্যানেজার করে দেওয়া হয়েছে এবং তাঁর চার্জ অর্ধেক। এই সময় টেলিগ্রাম পেলেন শ্বশুরবাড়িতে তার স্ত্রী আর একটি সন্তান প্রসব করেছেন, এবার পুত্র। খবরটা পেয়ে চিররঞ্জন প্রথম দু’দিন বিষণ্ণ হয়ে রইলেন। অনুভব করলেন, সংসার তাকে আরও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়াচ্ছে। যার স্ত্রীকে চিরকাল বাপেরবাড়ি ফেলে রাখতে হয়, তার পুত্র কন্যার সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে আনন্দিত হবার কথা নয়। টেলিগ্রাম পেয়েও চিররঞ্জন গেলেন না। কয়েক দিন পর চিঠিতে বিস্তারিত খবর এল। বর্ষাকাল, সেবার ঝড়বৃষ্টির প্রকোপ অত্যন্ত বেশি, আঁতুড়ঘরের চাল উড়ে গিয়েছিল, কয়েকটি দিন খুব সংকটজনক : অবস্থায় কেটেছে জননী ও নবজাতকের। ছেলের নাম রাখা হয়েছে বাদল।
এই চিঠি পেয়ে চিররঞ্জন হঠাৎ উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। যেন তার মনে হল এই ছেলেই তার সব দুঃখ-কষ্ট দূর করবে। নিজের জীবনে তিনি যা পারেননি, এই ছেলে সার্থক করবে সেই স্বপ্ন। পুন্নাম নরকের ভয় ছিল না চিররঞ্জনের, কিন্তু পুত্ৰই পিতাকে ভরসা দেয়। খেয়ালের মাথায় এক রাশ টাকা ধার করে তিনি স্ত্রীর জন্য শাড়ি এবং ছেলের জন্য বিলিতি খেলনা পাঠালেন পার্সেল করে।
বড়ভাই প্রিয়রঞ্জন বেশ গুছিয়ে নিয়েছিলেন বরিশালে। ফরিদপুরে নিজেদের বাড়িতে বিশ্বরঞ্জনের খোঁজে তখনও ঘন ঘন পুলিশ আসে, তাই দেশের বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক প্রায়। চুকিয়েই দিয়েছিলেন একরকম। ছোটভাই নিখিলরঞ্জন তাঁর কাছেই থাকে, পড়াশুনোয় মাথা নেই, ম্যাট্রিক পাশ করতে পারেনি শেষ পর্যন্ত। বি এম কলেজের উলটোদিকে প্রিয়রঞ্জন একটা কাগজ কলম-পেনসিলের দোকান খুলে ছোটভাইকে বসিয়ে দিলেন সেখানে। দোকানটা দেখতে দেখতে বেড়ে উঠল।
প্রিয়রঞ্জন একটু রগচটা ধরনের মানুষ। ছোটভাইয়ের সামান্য দোষ-ত্রুটি দেখলেই মারধর করতেন। নিখিলরঞ্জন যখন বড় রকমের একটা কেলেঙ্কারি করে ফেললেন, তখন প্রিয়রঞ্জন এমন মার দিতে লাগলেন, যে, পাড়াপ্রতিবেশীরা এসে না আটকালে একটা কিছু অঘটন ঘটে যেত। হাঁপাতে হাঁপাতে প্রিয়রঞ্জন বলেছিলেন, মারব না তো কী করব? নিজের ভাইকে তো পুলিশে দিতে পারি না? আহত নিখিলরঞ্জন ধুঁকতে ধুঁকতেই সে রাত্রে বাড়ি থেকে সরে পড়লেন। একমাস বাদে চিঠি এল আসাম থেকে, দাদা আমি ভালো আছি। আমার জন্য চিন্তা করিয়ো না। আমি ঠাকুরের পাদপদ্মে আশ্রয় পাইয়াছি। সেই থেকে নিখিলরঞ্জন রামকৃষ্ণ মিশনে–সাদা কাপড় থেকে আস্তে আস্তে গেরুয়া পেয়েছেন।
চাকরির থেকেও কাগজের দোকানের ব্যবসাতেই প্রিয়রঞ্জনের বেশি উন্নতি হতে লাগল। অমরনাথ যখন কলকাতায় এসে বাড়ি কিনলেন, তখন প্রিয়রঞ্জন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসে সেইসঙ্গে কলকাতার ব্যবসার বাজারটিও পর্যবেক্ষণ করলেন। তাঁর তীক্ষ্ণ চোখে বড় শহরের বিস্তৃত সুযোগটা ঠিক ধরা পড়ল। চাকরি ছেড়ে প্রিয়রঞ্জন কলকাতাতেই ব্যবসা করবেন ঠিক করে ফেললেন। অমরনাথের অত বড় বাড়ি, থাকারও কোনও অসুবিধে নেই। উদাসীন প্রকৃতির অমরনাথ এ-প্রস্তাবে এককথাতেই রাজি, এমনকী প্রিয়রঞ্জনের পীড়াপীড়িতে তিনি ওঁর কাগজের ব্যবসায় লগ্নিও করলেন কিছু টাকা। এক বছরের মধ্যে প্রিয়রঞ্জনের দোকানের দুটি শাখা স্থাপিত হল কলকাতায় তিনি চিররঞ্জনকে সপরিবারে টেনে আনলেন এ বাড়িতে এবং প্রায় জোর করেই ছোটভাইকে পার্টনার করে নিলেন ব্যবসায়। যদিও তিনি ঠিকই বুঝেছিলেন, এ ভাইটির কাছ থেকে বিশেষ কিছু কাজ পাওয়া যাবে না।
এ-বাড়িতে অমরনাথ কর্তা হলেও দেখাশুনোর সব ভার প্রিয়রঞ্জনের। বাড়ির চুনকাম থেকে বাথরুমের দরজা সারানোর তদারকি তিনিই করেন। কোথায় কলের মিস্ত্রি পাওয়া যায়, সিমেন্ট কোথায় সস্তা–এ সব তাঁর নখদর্পণে। প্রিয়রঞ্জনের স্ত্রী সুপ্রভাই বাড়ির গৃহিণী। সুপ্রভা একটু বেশি মুখরা–এ ছাড়া সংসার সামলাবার সব গুণই তাঁর আছে। ঝি অনুপস্থিত হলে বাড়ির তিনতলা থেকে একতলা তিনি নিজেই ধুয়ে মুছে ফেলতে পারেন। কার পাতে ক’টুকরো মাছ পড়বে সেদিকেও তাঁর সমান দৃষ্টি। ঝি-চাকরদের ওপর তিনি একটু বেশি অত্যাচার করেন বটে, কিন্তু চিররঞ্জনের স্ত্রী হিমানীকে কখনও ঘাঁটান না। হিমানী বড়লোকের মেয়ে–এজন্য তাঁর মনে একটু সমীহের ভাব আছে। যদিও সুপ্রভার স্বামীর অবস্থা এখন যথেষ্ট সচ্ছল–কিন্তু তিনি সাধারণ গরিব ঘরের মেয়ে–এই মানসিক বৈষম্য কখনও ঘোচেনি।
শ্বশুরবাড়ি থেকে স্ত্রী ও সন্তানদের নিজের কাছে এনে রেখেছেন বটে, তবু চিররঞ্জনের মনে সুখ নেই তেমন। এটাও তো পরেরই বাড়ি। তিনি পরবাসী হয়েই রইলেন। মাঝে মাঝে কাগজের দোকানে গিয়ে বসেন। কখনও সখনও আলাদা ভাবে তিনি নিজেও কিছু রোজগার করে ফেলেন কোনও উপায়ে–তখন বাড়ির সকলকে কিছু না কিছু উপহার কিনে দেন। মোটমাট তিনি সারা জীবন বেকার হয়েই রইলেন। আগেও কম কথা বলতেন, এখন প্রতাপশালী দাদার ছত্রছায়ায় আরও চুপচাপ হয়ে যেতে লাগলেন ক্রমশ। সাংসারিক কোনও ব্যাপারে তিনি মাথা ঘামান না।
যে-কোনও কারণেই তোক প্রিয়রঞ্জনের চেয়ে চিররঞ্জনকেই বেশি পছন্দ করে ফেললেন অমরনাথ। এই নিরাসক্ত মানুষটির প্রতি তাঁর কৌতূহল জাগ্রত হয়েছিল। প্রিয়রঞ্জনের সঙ্গে কাজের কথা, দরকারি কথা সেরে নিতেন চট করে, আর চিররঞ্জনের সঙ্গে প্রাণের কথা বলতেন। অমরনাথ একটু ভালো করেই বুঝতেন যে ব্যবহারিক সুবিধের জন্য প্রিয়রঞ্জন তাঁকে খাতির করলেও মনে মনে তাঁকে পছন্দ করেন না। অমরনাথ একসময় প্রিয়রঞ্জনের নিজের বোনকে কষ্ট দিয়েছিলেন, মুসলমান নর্তকীর সঙ্গে বসবাস করেছেন, এসব প্রিয়রঞ্জন কখনওই পুরো ক্ষমা করতে পারবেন না। নেহাত বাইরে বাইরে মানিয়ে চলছেন। চিররঞ্জন ওসব পুরনো ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামান না। অমরনাথ বুঝতে পেরেছিলেন, চিররঞ্জন চুপচাপ থাকলেও আশেপাশের সবকিছুই খুব সূক্ষ্মভাবে লক্ষ করার একটা প্রবণতা আছে তাঁর মধ্যে। এই এক ধরনের মানুষ, যারা ইচ্ছে করে ঠকে। অর্থাৎ যে ঠকাচ্ছে, তাকেও বুঝতে দেয় না যে সে তো বুঝেসুঝেই ঠকছে। অন্যদের মুখতা দেখে যে মনে মনে হাসে, অথচ নিজে কখনও তার ওপর টেক্কা দেবার জন্য বেশি চালাকের মতন ব্যবহার করে না। এই নেশায় যারা মজে যায়, তারা সুখী হয় কি না সেটা বিতর্কের বিষয়, কিন্তু তারা জীবনে উন্নতি করার চেষ্টায় মাতে না কখনও।
অমরনাথ ক্রমশ জানতে পেরেছিলেন, চিররঞ্জন কয়েকটি নিজস্ব ধারণা মিলিয়ে এক ধরনের দর্শন গড়ে তুলেছেন। সেই দর্শনের মধ্যে খানিকটা সিনিসিজম আছে, তবু শুনলে হঠাৎ চমকে উঠতে হয়।
প্রিয়রঞ্জন একদিন বাড়িতে ঢুকলেন চিৎকার করতে করতে। সদর দরজার সামনেই পাশের বস্তির ছেলেরা হেগে রেখে গেছে, প্রিয়রঞ্জন অন্যমনস্ক ভাবে তাতে পা দিয়ে ফেলেছেন। ঘেন্নায় ছটফট করছেন একেবারে। বালতি বালতি জল ঢেলে পা ধোওয়া। হল, তবু ঘেন্না যায় না। সুপ্রভা মাথায় গঙ্গার জল ছিটিয়ে দিলেন। প্রিয়রঞ্জন তবু ওপরে উঠতে পারছেন না, বালতি সুদ্ধ সাবানগোলা জলে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, এবং চিৎকার করে বলতে লাগলেন, এর একটা বিহিত করতেই হবে।
দোতলার বারান্দায় অমরনাথ আর চিররঞ্জন দাঁড়িয়ে ছিলেন পাশাপাশি। একটু পরে চিররঞ্জন আপন মনেই বললেন, সবই মন। একবার ধুলেও যা, দশবার ধুলেও তা। সবাই। জানে। তবু মনে থাকে না।
অমরনাথ শুনতে পেয়ে বললেন, তা তো বটেই, মনই তো সব। চিররঞ্জন বললেন, অপরের টুথব্রাশও ধুয়ে নিয়ে ব্যবহার করা যায় অনায়াসে, তবু আমরা করতে পারি না। কিন্তু জল খাবার গেলাস ধুয়ে নিয়ে ব্যবহার করতে পারি।
অমরনাথ এবার শুধু হাসলেন। চিররঞ্জন আবার বললেন, আমরা ভুলে যাই, আমাদের প্রত্যেকের শরীরের মধ্যে খানিকটা গু আছে। সারাদিন শরীরের মধ্যে গু নিয়ে ঘুরছি! অথচ নিজের শরীরটাকে অপবিত্র মনে হয় না।
অমরনাথ এবার বললেন, কিন্তু এটা তো ভুলে থাকাই ভালো। তাই না?
চিররঞ্জন সঙ্গে সঙ্গে মেনে নিয়ে বললেন, তা ঠিক!
কিন্তু একটা কথা চিররঞ্জনের মাথায় ঢুকলে আর সহজে ছাড়ে না। সারা দিন সেইটাই বোধহয় ভাবতে থাকেন। সেই দিনই সন্ধ্যাবেলা তিনি অমরনাথকে নিভৃতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা বড়বাবু, এমন কোনও সাবালক মেয়ে-পুরুষ আছে এ-পৃথিবীতে, যারা প্রতিদিন সকালে পায়খানা ঠিক মতন হল কি না এই নিয়ে ভাবে না?
বড়বাবু মৃদু হেসে উত্তর দিলেন, বলা শক্ত।
সন্ন্যাসীদের কি এইরকম হয়? মহাত্মা গান্ধীর ও হয়?
হঠাৎ এসব কথা মনে এল কেন?
মানুষের মনে বেশির ভাগ চিন্তাই তো হঠাৎ আসে। তার কোনও ঠিকঠিকানা আছে?
সন্ন্যাসীদের তো এই জন্যই জিতেন্দ্রিয় বলে। তাঁরা নিশ্চয়ই এসবের ঊর্ধ্বে। আমি কিছুদিন ওঁদের সঙ্গে মিশেছিলাম, তখন অবশ্য আমার মনে এ-প্রশ্ন আসেনি। তা হলে জেনে নিতুম।
জিতেন্দ্রিয় বলতে তো কামনা-বাসনা জয় করাই বোঝায়। নিছক যেগুলো শারীরিক প্রয়োজন, যেমন খাওয়া এবং অপ্রয়োজনীয় খাদ্য শরীর থেকে বার করে দেওয়া– এগুলো কি এড়ানো যায়?
কামনা বাসনাও শারীরিক প্রয়োজন। তুমি মানো কি না জানি না, আমি মানি। কামনা বাসনাকে যারা দূরে সরিয়ে রাখে, তাদের শরীর সেটা সহজে মেনে নেয় না, অনেকে শেষ পর্যন্ত পাগল হয়ে যায়। অধিকাংশ সাধু-সন্ন্যাসীই এক ধরনের উন্মাদ, আমি লক্ষ করেছি। ভাবোদও বলতে পারো। লোকে তাই বলে।
কিন্তু সব মানুষের সব ইন্দ্রিয় তো সমান শক্তিশালী নয়। কারওর স্পর্শে বেশি আনন্দ, কারওর দর্শনে। পরনারীকে স্পর্শ করা অন্যায়, দর্শনে তো কেউ দোষ দেয় না। অথচ এমন মানুষও তো আছে, যাদের রূপ দেখার চোখ আছে, যারা বিভিন্ন ফুলের রং চিনতে পারে–তারা কোনও নারীর রূপের দিকে কয়েক পলক চেয়ে থেকে যে আনন্দ পায়…
বড়বাবু টেবিলে টোকা মারতে মারতে বললেন, বুঝতে পারছি, তোমারও বয়স হয়ে যাচ্ছে। বুড়ো হয়ে গেলেই এইসব মনে পড়ে। অল্প বয়সে শুধু চোখে মন মানে না। ছুঁয়ে দেখতেই হয়!
বুড়ো হয়ে গেলেও আমার দুঃখ নেই। অভিজ্ঞতা না হলে উপভোগ গাঢ় হয় না। ছোকরা বয়সে তো ছটফট করেই সময় কেটে যায়!
অমরনাথ যে-দিন সূর্যকে খুব শাস্তি দিচ্ছিলেন, সেদিন চিররঞ্জন পেছন থেকে এসে আস্তে তাঁর কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন, কেন শুধু শুধু নিজেকে কষ্ট দিচ্ছেন?