বিলু,
তোর দুটি চিঠিই পেয়েছি। প্রথমটির জবাব সঙ্গে সঙ্গে লিখেছিলাম। রমজান ভাইকে পোস্ট করতে দিয়েছি। ওমা দুই দিন পরে দেখি তার বাজারের ব্যাগ থেকে চিঠি বেরুল। ভিজে ন্যাত। ন্যাতা! অথচ রমজান ভাই আমাকে বলেছে সে নিজ হাতে চিঠি ফেলেছে। দেখ অবস্থা। তারপর তোমার দুনম্বর চিঠিটি এল। ভাবলাম রাতে জবাব লিখব। রাত ছাড়া চিঠি লিখতে ভাল লাগে না। কিন্তু রাতে বাবার খুব জ্বর এল। মাথায় পানি ঢালতে হল, ডাক্তার আনতে হল। ডাক্তার বলছেন ম্যালেরিয়া। দেশে কী এখন ম্যালেরিয়া আছে নাকি যে ম্যালেরিয়া হবে। ডাক্তারটির বয়স খুব কম, আমার মনে হয় নতুন পাস করেছে। আমার মত পাস। বইটই ভালমতো পড়েনি। আমার সঙ্গে গম্ভীর হয়ে কথা বলছিল।
মিস নীলু, ভয়ের কিছু নেই। আমি আবার এসে দেখে যাব।
আমি হেসে বাঁচি না। মিস নীলু আবার কি! কলেজে ওঠার পর দেখি অনেকেই সম্মান-টম্মান করছে। বিশেষ করে আমাদের কলেজের একজন লজিকের স্যার–নাজিবর রহমান ভুইয়া। উনি সব সময় আপনি আপনি করছেন। ছাত্রীরা তার নাম দিয়েছে প্ৰেমকুমার। কারণ তিনি নাকি সব মেয়ের সঙ্গে প্ৰেম করবার চেষ্টা করেন। তাকে প্রতি বছর পাঁচ ছ’বছর হাফসোল খেতে হয়। হাফসোল কী জানিস তো? নাকি তোদের কলেজে এসব কথা বলে না?
যাই হোক নজিবর রহমান স্যার কী করল তোকে বলি। ক্লাসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ নজিবর রহমান স্যারের সঙ্গে দেখা। তিনি ভ্রূ কুচকে বললেন, তুমি ফাস্ট ইয়ারের না?
জি স্যার।
গত ক্লাসে আসিনি কেন?
বাবার জ্বর ছিল তাই আসিনি।
লজিকের কতগুলি ইম্পর্টেন্ট ডেফিনেশন পড়িয়েছি। মিস করলে পরেরগুলি ধরতে পারবে না।
আমি চুপ করে রইলাম। নজিবর রহমান স্যার গভীরভাবে কিছুক্ষণ মাথা দুলিয়ে বললেন, ঠিক আছে আমার কাছে প্রিপেয়ারড নোট আছে। একবার এসে নিয়ে যেও।
আমি অবশ্যি নোট নিতে যাইনি। গেলেই আমার নাম হয়ে যেত প্রেমকুমারী। হিহিহি। উঁচু ক্লাসের মেয়েদের কাছে শুনেছি তার কাছে ক্লাস নোটের দশ-বারোটা কপি তৈরি থাকে। যাদের সঙ্গে তাঁর প্রেম করার ইচ্ছে হয় তাদের তিনি ডেকে ডেকে দেন। ভদ্রলোক কিন্তু পড়ান খুব ভাল। আমাদের আরেকজন স্যার আছে খুব ভাল পড়ান। তাঁর নাম কি জানিস? তাঁর নাম মুরগির গু। কী জন্যে বেচারার এই নাম হল। অনেকদিন ধরে তাঁর এই নাম চলছে। ছোটখাটো মানুষ, খুব পান খান। ক্লাস শুরু করবার আগে ডাস্টার দিয়ে টেবিলে একটা প্রচণ্ড বাড়ি দিয়ে বলেন, নিস্তব্ধতা! ছাত্রীগণ নিস্তব্ধতা হিরন্ময়!। প্রথম দিন তো আমি বহু কষ্টে হাসি সামলালাম, কিন্তু পরে দেখি সাংঘাতিক ভাল পড়ান। তার একটা ভাল নাম হওয়া দরকার ছিল।
ক্লাসের অনেক কথা লিখলাম। আরো মজার মজার ব্যাপার আছে, পরে লিখব। একজন আপা আছেন তার নাম মিস চাটা। দারুণ অসভ্য অসভ্য সব গল্প তাকে নিয়ে। চিঠিতে লেখা যাবে না।
এবার অন্য খবর বলি। মুন্নির বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে পিডিবির ইঞ্জিনিয়ার। খুব নাকি বড়লোক। আমি অবশ্যি বিয়েতে যাইনি। কারণ আমাকে যেতে বলেনি। মুন্নি ক্লাসের প্রায় সব মেয়েকে বলেছে, আমাকে বলেনি। রকিব ভাই এসেছিলেন ঢাকা থেকে। আমার অবশ্যি ধারণা ছিল আসবেন। না। বিয়ের পরদিন আমাদের বাড়িতে এলেন। কখন এসেছেন আমি কিছুই জানি না। কি জন্যে যেন বসার ঘরে গিয়েছি, দেখি তিনি বসে বসে বাবার সঙ্গে গল্প করছেন। তাঁর গায়ে নীল রঙের স্ট্রাইপ দেয়া একটা শার্ট ছিল। এমন মানিয়েছিল তাকে কী বলব।
আমার গায়ে ছিল বোম্বে প্রিন্টের ঐ জংলি শাড়িটা। আমাকে নিশ্চয় ভূতের মত লাগছিল। কারণ ঐ দিন আমি চুলও বাঁধিনি, কিছুই করিনি। আকবরের মাকে বলেছিলাম চুল বেঁধে দিতে। সে দিতাছি আপা বলে সেই যে গিয়েছে গিয়েছেই। আর দেখা নেই। আমি গিয়ে দেখি দিব্যি। ঘুমাচ্ছে। তারপর আমিও ঘুমাতে গেলাম। এখন চিন্তা করে দেখ অবস্থা। চুল বাধা নেই। ঘুম ঘুম ফোলা মুখ, পরনে জংলি শাড়ি। কি ভাবলেন উনি কে জানে। আমি তো একদম হতভম্ব হয়ে গেছি। উনি বললেন, তুমি কে নীলু না বিলু?
আর বাবার যা কাণ্ড। বাবা বললেন, সালাম কর নীলু, সালাম কর। সালাম করব কি। আমি বললাম, আপনি বসুন, আমি হাত-মুখ ধুয়ে আসছি। উঁহু, আমি বেশিক্ষণ বসতে পারব না। উনি অবশ্যি অনেকক্ষণ বসলেন। চা-টা খেলেন। যাবার আগে আমাকে দুটো বই দিয়ে গেছেন। একটা হচ্ছে–ঘনাদার গল্প (দেখ না কাণ্ড, ঘনাদার গল্প পড়ার বয়স এখন আছে?) অন্যটি হচ্ছে একটি কবিতার বই, নাম–পালক। আজ আর লিখব না, ঘুম পাচ্ছে।
–নীলু
পুনশ্চঃ তোর সঙ্গে যে রকিব ভাইয়ের দেখা হয়েছিল ঢাকায় এই কথাটি তুই কোনো চিঠিতেই লিখিসনি।
প্রিয় আপা,
আমি তোমাকে চারটি চিঠি দিয়েছি, তুমি মাত্র দুটি চিঠির জবাব দিয়েছ। এরকম করলে আমি আড়ি নেব। তখন মজা টের পাবে। বাবার খুব অসুখ। ডাক্তার বলেছেন ম্যালেরিয়া। খুব দুর্বল হয়ে গেছেন। এখন আর বাইরে যান না। আর বাবা তার প্রেসটা বিক্রি করে দিয়েছেন। কিন্তু কাউকে সেটা বলেননি। নজমুল চাচা এটা শুনে খুব রাগ করেছেন।
আরেকটা খুব খারাপ খবর আছে। আমার গানের স্যারের ছোট ছেলেটা পানিতে ডুবে মরে গেছে। ছেলেটার বয়স সাত। তার নাম দীপন। তুমি তাকে দেখেছিলে। তোমার মনে আছে। তবলা বাজিয়েছিল। তুমি বললে ওমা এইটুকু ছেলে আবার তবলা বাজায়। তোমার কলেজ। কবে
ছুটি হবে?
–সেতারা
প্রিয় মা বিলু,
দোয়া নিও। তোমার বাবার অসুখের সংবাদ পাইয়াছ। এখন কিছুটা সুস্থ, তবে পুরোপুরি সারে নাই। চিন্তার কোনো কারণ নাই। ইতিমধ্যে তোমার লোকাল গার্জেন সফদর সাহেবের একখানি পত্র পাইয়াছি। তুমি নাকি তাকে বলেছি–তুমি ছুটির দিনে হোস্টেলেই থাকতে চাও। এটা ঠিক না। সফদর সাহেব অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি। তার কথা শুনিবে। এবং সেই মত চলিবে।
তোমার বাবার ব্যবসা কিঞ্চিৎ মন্দা যাইতেছে। তিনি খুব সম্ভবত প্রেস বিক্রি করিয়া দিয়াছেন। কাজটা ঠিক হয় নাই। চালু প্রেস বিক্রয় করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তুমি কোনরূপ চিন্তা করিও না। তোমাদের অন্য অংশটি ভাড়া দেওয়ার চেষ্টা করিতেছি। দুই একজনের সঙ্গে কথাবার্তা হইয়াছে। যে কোনো ভাড়াটেকে হুঁট করিয়া ঢুকানো ঠিক হইব না, তাই বিলম্ব হইতেছে।
ভাল থাকিও ঠিকমত পড়াশুনা করিও।
–তোমার চাচা
নজমুল ইসলাম
নীলু,
তোর চিঠি পেয়েছি আজ বিকেলে।
এখন রাত প্রায় এগারোটা। অনেক রাতে উত্তর লিখতে বসেছি, কারণ আমার রুমমেট কিছু লেখার সময় খুব বিরক্ত করে। ঘাড়ের কাছে মাথা এনে সে চিঠি পড়বে। আমি এতটুকুও পছন্দ করি না, তবু সে এটা করবেই। তার ধারণা আমি কোনো ছেলেকে চিঠি লিখছি। আমার তো আর খেয়ে-দোয়ে কাজ নেই।
বাবার অসুখের খবর পেয়ে খুব খারাপ লেগেছে। এতদিনে সেরেছে নিশ্চয়ই সব জানাবি। নজমুল চাচা লিখেছেন প্রেস বিক্রি হয়ে গেছে। শুনে যা ভয় লাগছে। এখন আমাদের চলবে কি করে? আজ সমস্ত দিন আমার এইসব ভেবে খুব খারাপ লেগেছে। তার ওপর আজ বায়োলজি ল্যাব ছিল। আমাদের ডেমনেসট্রেটর একটা ব্যাঙ এনে ক্লোরফরমন্ড করলেন। আমরা শুধু দূর থেকে দেখলাম। তারপর উনি সেটা কচ করে কেটে ফেললেন। ব্যাঙের হৃৎপিণ্ডটা তখনো লাফাচ্ছে। কি যে খারাপ লেগেছে।
বিকেলে হোস্টেলে ফিরে এসেও বমি বমি লাগছিল। রাতে ভাত খাইনি। আমার রুমমেট তখন ফ্রেঞ্চ টোস্ট করে খাওয়াল। ওর একটা কেরোসিন কুকার আছে। খাটের নিচে লুকিয়ে রাখে। কারণ হলে এই সব এলাউ করে না। কিন্তু বেচারীর খুব রান্নার সখ। কয়েক দিন আগে গাজরের হালুয়া বানোল। এটা বানানো যে এত সহজ তা জানতাম না। খেতেও খুব ভাল হয়েছিল। মেয়েটির নাম মালা। রাজশাহী থেকে এসেছে। অনেক রকম রান্না জানে। দারুণ স্মার্ট মেয়ে। হোস্টেল সুপারের পারমিশন না নিয়েই সে দু’দিন তার এক আত্মীয় বাড়ি থেকে এসেছে!
এখানে নিয়মের খুব কড়াকড়ি। তবে সিনিয়র মেয়েদের বেলায় এতটা নয়। সিনিয়র মেয়েরা দোতলায় থাকে। ওদের সঙ্গে আমাদের তেমন যোগ নেই। ওরা অনেক রকম কাণ্ড-কারখানা করে। গত শুক্রবারে কি হয়েছে জানিস! রাত একটায় হঠাৎ শুনি দারুণ হৈচৈ হচ্ছে। পরে শোনা গেল দোতলার কাটি মেয়ে প্ল্যানচেট করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মা নিয়ে এসেছে। সে আত্মা আবার কিছুতেই যেতে চাচ্ছে না। হোস্টেল সুপারটুপার এলেন। হুলুস্কুল কাণ্ড।
তুই লিখেছিস তোর রকিব ভাইয়ের সঙ্গে যে দেখা হয়েছিল সে সম্পর্কে কিছু লিখিনি। ইচ্ছে করেই লিখিনি। তুই আবার কি ভাবতে কি ভাববি। যাক এখন লিখছি। সেদিন কেমিস্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল খাতা কিনতে ন্যুমার্কেটে গিয়েছি। আমার সঙ্গে আছে আমার রুমমেট মালা। সে চুল বাঁধার রাবার ব্যান্ড আর টিপ কিনবে। কেনাকাটা শেষ হবার পর আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি, হঠাৎ মালা বলল-দ্যাখ ঐ ভদ্রলোক তখন থেকে আমাদের পিছে পিছে আসছে আর মিচকি মিচিকি হাসছে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি একজন দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক। আমাকে তাকাতে দেখেই সে বলল–তুমি নীলু না বিলু?
আমি তখনো চিনতে পারিনি। তখন ভদ্রলোক রাগী গলায় বললেন–চিঠির জবাব দাওনি কেন? তখন চিনলাম। খুব অবাক হয়েছিলাম। এ রকম দাড়িগোঁফ কল্পনাও করিনি। তারপর উনি আমাদের আইসক্রিম খাওয়াতে নিয়ে গেলেন। মালা কিছুতেই যাবে না। শেষপর্যন্ত অবশ্যি গেল। তিনি সারাক্ষণই তোর কথা জিজ্ঞেস করছিলেন। তার কি ধরণা জানিস? তার ধারণা–না বলব না।
শোন নীলু একটা কথা–তুই ঐ ভদ্রলোককে বলবি উনি যেন দাড়িগোঁফ কামিয়ে ফেলেন। যা জঘন্য লাগছিল। ওঁকে।
এই যা–একটা বেজে যাচ্ছে, শুয়ে পড়ি। কাল পরশু আবার চিঠি লিখব।
–বিলু
মা বিলু,
দোয়া নিও। নীলুর নিকট হইতে শুনিলাম তোমাদের দোতলার মেয়েরা প্ল্যানচেটে আত্মা আনিয়াছে। উহাদের সহিত কোনোরূপ সম্পর্ক রাখিবে না। সব কিছু নিয়া ছেলেখেলা ভাল না।
তোমাদের উপরের তলায় নতুন ভাড়াটে আসিয়াছে। অতি সজ্জন ভদ্রলোক। স্বামী-স্ত্রী ও একটি ছেলে। ছেলেটি ঈষৎ দুরন্ত।
তোমার বাবার অসুখ অল্প বাড়িয়াছে। তবে চিন্তার কারণ নাই। শরীরের ওপর অযত্ন ও অবহেলার এই ফল। কিছুদিন ভূগাইবে। আর সব সংবাদ ভালো। জনৈক লোক মারফত আমি মুক্তাগাছার কিছু মণ্ডা পাঠাইলাম। বন্ধু-বান্ধব নিয়া খাইও। আর তোমাদের হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্টের নিকট একটি পৃথক পত্র দিলাম। পত্রটি তাহাকে পৌছাইও এবং আমার সালাম দিও। ইতি।
তোমার চাচা
–নজমুল ইসলাম
হোস্টেল সুপার।
জনাবা,
সবিনয় নিবেদন এই যে, জানিতে পারিলাম। আপনার হোস্টেলের কতিপয় ছাত্রী প্ল্যানচেট না কি যেন করিতেছে। এই সব বিষয় নিয়া ঠাট্টা-তামাশা শুভ নয়। ছাত্রীর অভিভাবক হিসাবে আমি চিন্তাযুক্ত আছি। আপনি যথাবিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ করিয়া চিন্তামুক্ত করিবেন। আপনার নিকট এই আমার বিনীত প্রার্থনা। ইতি।
–নজমুল ইসলাম
আপা,
তুমি নীলু আপাকে এত লম্বা লিখেছ, আমাকে লেখোনি কেন? আমি খুব রাগ করেছি। আর কোনোদিন তোমাকে চিঠি লিখব না। আল্লাহর কসম।
বাবার অসুখ খুব বেড়েছে। আর আকবরের মার হাতের আঙুলের নিচে ঘা হয়েছে। নজমুল চাচা বলেছেন বেশি পানি ঘাঁটাঘাঁটির জন্যে এটা হয়েছে।
দোতলায় নতুন ভাড়াটে এসেছে করিম সাহেব ভদ্রলোক খুব মোটা। তাঁর ছেলেটি দারুণ দুষ্ট। এবং খুব ফাজিল। সে আমাদের কাচের জগটা ভেঙে ফেলেছে। ভেঙে আবার দাঁত বের করে হাসে। এমন ফাজিল।
–সেতারা
পুনশ্চঃ আপা তোমরা যে রবীন্দ্রনাথের আত্মা এনেছ সে কি করেছে? আমাদের ক্লাসের একটি মেয়ে বলেছে সেও নাকি প্ল্যানচেট করতে পারে। আমার বিশ্বাস হয় না, সে খুব গুল ছাড়ে। এই জন্যে আমরা তার নাম দিয়েছি গুল বাহার।
প্রিয় বিলু,
তোদের হোস্টেলের মেয়েরা ভূত এনেছে শুনে নজমুল চাচা খুব রাগ করেছেন। তিনি বলেছেন তিনি হোস্টেল সুপার এবং প্রিন্সিপ্যালকে চিঠি লিখবেন।
আমাদের দোতলায় নতুন ভাড়াটে এসেছেন। তাঁর স্ত্রীর নাম নীনা। ভদ্রমহিলা নাকি-স্বরে কথা বলেন। প্রথম দিন বাড়িতে এসে বললেন–বাড়িত খুব বড়। তবে চারদিকে খুব জঙ্গলা। আমি বহু কষ্টে হাসি সামলেছি। তবে ভদ্রমহিলা খুব ভাল। বাবার জন্যে সুপ করে পাঠান। এবং খুব খোঁজখবর করেন। তবে ভদ্রমহিলার শুচিবায়ু আছে। রোজ তিন চারবার ঘর ধোয়া মোছা করেন।
বিলু তোকে এখন একটা কথা বলি–আমি রকিব ভাইয়ের একটা খুব চমৎকার চিঠি পেয়েছি। এত সুন্দর চিঠি যে আমি খুব কাদলাম। কত লক্ষ বার যে পড়লাম। সেই চিঠি। আমার কি ইচ্ছে করে জানিস? ইচ্ছে করে একদিন হুঁট করে ভদ্রলোকের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে খুব চমকে দেই। তারপর তিনি যখন বলবেন—তুমি কে, নীলু না বিলু? আমি তখন বলব, আমি বিলু। এবং অনেকক্ষণ বিলু হিসেবে কথাবার্তা বলার পর হঠাৎ বলব, আমি কিন্তু নীলু ভদ্রলোকের মুখের অবস্থাটা কি হবে ভেবে দেখ।
বিলু, ঐ ভদ্রলোকের সঙ্গে কি করে আমার পরিচয় হল তোকে বলি। মুন্নিদের বাসায় বেড়াতে গিয়েছি। অপলারাও গিয়েছে। মুন্নি বলল, আমার এক ভাই এসেছেন ইউনিভার্সিটির টিচার। অংকের টিচার, যা গম্ভীর। আমরা আড়াল থেকে দেখলাম সত্যি গম্ভীর। মুন্নি তখন করল কি জানিস? আমাকে বলল–এই নীলু, তুই যদি আমার ঐ ভাইয়ের কাছ থেকে একটা সিগারেট নিয়ে খেতে পারিস তো বুঝব তোর সাহস। আমি বললাম–আমি শুধু শুধু তার কাছ থেকে সিগারেট নিয়ে খাব কেন?
তুই তো টেনেছিস সিগারেট। স্কুলের বাথরুমে। এখন দেখি তোর সাহস। যদি সিগারেট চাইতে পারিস তাহলে প্রমাণ হবে আমাদের ক্লাসে তোর চেয়ে সাহসী মেয়ে নেই।
আমি ইতস্তত করে ঢুকে পড়লাম ভদ্রলোকের ঘরে। কোনোমতে বললাম–মুন্নির সঙ্গে আমার একটা বাজি হয়েছে। সেই বাজিতে আমি জিতব, যদি আপনি আমাকে একটা সিগারেট দেন।
ভদ্রলোক কিছুই বুঝতে পারলেন না, একটা সিগারেট বের করে দিলেন। আমি বললাম, আপনি রাগ করবেন না। সিগারেটটা আমাকে ধরাতে হবে। ভদ্রলোক দিয়াশলাই বের করে দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। আমার দিকে। নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কি?
নীলু
ও নীলু তোমার কথা বলেছে আমাকে মুন্নি।
কি বলেছে?
বলেছে যে তুমি খুব তেজী মেয়ে।
আরো অনেক কিছু বলেছে নিশ্চয়ই।
ভদ্রলোক তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। আমি বললাম, আর কিছু বলেনি মুন্নি?
আর কি বলবে?
বলেনি আমার মা পালিয়ে গেছে? আমাদের সম্পর্কে যখন কেউ কিছু বলে সেটাই সবার আগে বলে।
ভদ্রলোক চুপ করে রইলেন। আমি বললাম, মুন্নি বলেনি সে সব?
বলেছে।
আমি দেখলাম জানালার আড়াল থেকে মুন্নি ও অপলা অবাক হয়ে দেখছে আমার হাতে জুলন্ত সিগারেট।
আমি বললাম, আজ উঠি। আপনি আমার ওপর রাগ করেননি তো।
রাগ করব কেন?
আপনার সামনে সিগারেট টানলাম যে।
না। রাগ করিনি। মাঝে মাঝে এই সব ছেলেমানুষি দেখতে ভালই লাগে।
আমি উঠে দাঁড়াতেই ভদ্রলোক বললেন–নীলু বস, তোমার সঙ্গে কথা বলতে বেশ ভাল লাগছে। প্লিজ বাস। আমি অবাক হয়েই বসলাম। আর আমার কি যে ভাল লাগল। এখনো মনে আছে সে রাতে অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমুতে পারিনি। শেষ রাতের দিকে ঘুম এল এবং আমি ভদ্রলোকেকে স্বপ্ন দেখলাম। যেন আমি চা বানাচ্ছি, তিনি এসে বললেন–নীলু আমার আজ ফিরতে দেরি হবে, তুমি খেয়ে নিও। অপেক্ষা করবার দরকার নেই। আমি রাগের ভঙ্গি করে বললাম।–না। আজ কোথাও যেতে পারবে না। আজ আমরা বাগানে হাঁটব।
অদ্ভুত মিষ্টি স্বপ্নের ভেতরই আমি কেঁদে বুক ভাসিয়েছি। কাউকে এই স্বপ্নের কথা বলতে পারিনি। তোকে বলার ইচ্ছে হয়েছে, কিন্তু সাহস হয়নি। যদি তুই হাসোহাসি করিস।
তোকে আমি অনেক কথা বলতে চাই বিলু। ছুটি হতে তো অনেক দেরি। একবার চালে আয় না। তাছাড়া এমনিতেও তোর আসা উচিত। বাবার শরীর খুব খারাপ, কেউ তোকে জানাচ্ছে না। কাল রাতে আমি ঘরে ঢুকতেই বাবা বললেন, কে রেনু? আমি বললাম–বাবা আমি নীলু বাবা কেমন চোখে তাকালেন আমার দিকে, তারপর বললেন–নীলু, তোর মা বোধ হয় এসেছে। বসতে-টসতে দে। পুরোনো কথা মনে রেখে লাভ নেই।
বিলু চলে আয়।
–তোর
নীলু