৭
তরিকুল ইসলামের ঘুম ভাঙে ফজরের ওয়াক্তে। তিনি হিমশীতল ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করে নামাজ আদায় করেন। এরপর তাঁর আর অনেকক্ষণ কিছুই করার থাকে না। বাড়ির সবাই ঘুমে। তাদের ঘুম এত সহজে ভাঙে না। তরিকুল ইসলাম ঝাড়ু হাতে নেন। উঠান ঝাঁট দেয়া শুরু করেন। এতে দু’টা কাজ হয়—উঠান হয় ঝকঝকে পরিষ্কার এবং তাঁর শীত কমে। কিছু এক্সারসাইজও হয়। এই বয়সেও এক্সারসাইজ করে শরীর ঠিক রাখা অত্যন্ত জরুরি।
একটা বিষয় চিন্তা করে তরিকুল ইসলাম বেশ মজা পান। বিষয়টা হচ্ছে বাড়ির কেউই উঠান ঝাঁট দেয়ার ব্যাপারটা জানে না। তারা ধরেই নিয়েছে ঘুম থেকে উঠে দেখবে চারদিক ঝকঝক করছে। কারো মনে কোনো প্রশ্নই নেই।
তরিকুল ইসলাম উঠান ঝাঁট দিচ্ছেন। অর্ধেকের মতো ঝাঁট দেয়া হয়েছে। হঠাৎ পেছন থেকে এসে কে যেন তাঁর হাত জাপটে ধরল এবং ঝাড়ু দূরে ছুড়ে ফেলে দিল। তিনি চমকে পেছনে ফিরে আনন্দে অভিভূত হয়ে গেলেন। জামাই ফারুক এসেছে। তরিকুল ইসলাম বললেন, বাবা! কেমন আছ?
ফারুক কদমবুসি করতে করতে বলল, আপনি ঝাঁট দিচ্ছেন কেন? বাড়িতে মানুষ নাই?
তরিকুল ইসলাম বললেন, ঝাড়ু দেয়া মানে একই সঙ্গে হাতের, পায়ের এবং কোমরের এক্সারসাইজ। এই জন্য ঝাড়ু দেই।
ফারুক বলল, এক্সারসাইজের জন্য ঝাড়ু দিতে হবে না। আপনি ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করবেন। বাবা এখন বলুন আমার স্যারের অবস্থা কী? উনি হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন শুনে কী যে ভয় পেয়েছিলাম।
তোমার স্যার ভালো আছেন। ডাক্তার দেখে গেছে, বলেছে কোনো ভয় নাই। উনার সুস্বাস্থ্য কামনা করে মসজিদে একটা মিলাদও দিয়েছি। কবিরাজ রোহিনী বাবু এসেছিলেন তিনি চবন প্রাস বানিয়ে দিয়েছেন। সকাল-বিকাল এক চামচ করে খেলে ঘোড়ার মতো তেজি শরীর হবে।
স্যার কি ঘুমাচ্ছেন?
সবাই ঘুমাচ্ছে। কখন যে উঠবে আল্লাহপাক জানে। দাঁড়াও ডেকে তুলি।
ফারুক বলল, ডেকে তুলতে হবে না। তারা তাদের রুটিনমতো উঠুক। বাবা চা খাবেন?
কে চা বানাবে?
আমি বানাব। আপনার জন্য ইলিশ মিষ্টি নিয়ে এসেছি।
ইলিশ মিষ্টিটা কী?
সন্দেশ। ইলিশের পেটির মতো করে বানানো।
তরিকুল ইসলাম আগ্রহের সঙ্গে বললেন, বের কর একটা খেয়ে দেখি। ভালো মিষ্টি দেশ থেকে উঠেই যাচ্ছে। নাটোরের কাঁচাগোল্লা এখন স্মৃতি ছাড়া কিছুই না। মেট্রিক পরীক্ষার আগের দিন নাটোরের কাঁচাগোল্লা খেয়েছিলাম সেই স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। হাতে লেগে আছে মিষ্টির গন্ধ। তোমরা এই জমানার ছেলেপুলে আসল মিষ্টির স্বাদ কিছুই জানলে না। আপশোস, বিরাট আপশোস।
.
উঠানে বেতের মোড়ায় শ্বশুর-জামাই চা খাচ্ছেন। তরিকুল ইসলাম আনন্দে অভিভূত। জামাইকে তিনি অত্যন্ত পছন্দ করেন। তরিকুল ইসলাম বললেন, দুপুরে কী মাছ খেতে চাও বল?
ফারুক বলল, বিলের ফ্রেশ ছোট মাছ খাব।
পাঁচমিশালি গুঁড়ামাছ জোগাড় করব। কোনো সমস্যা নাই।
কালি বোয়াল কি পাওয়া যায় বাবা?
এই তো বিপদে ফেললে এইসব জিনিস কি আর দেশে আছে? দেখি চেষ্টা করে।
খলিশা মাছ?
আরেক ঝামেলায় ফেলেছ। খলিশা তো প্রায় extinct মাছ। এখুনি বের হচ্ছি। সকাল সকাল না গেলে পাওয়া যাবে না।
ফারুক বলল, বাবা আপনার জন্য একটা চাদর এনেছিলাম। বের করে দেই? চাদরটা গায়ে দেন। দেব?
দাও।
তরিকুল ইসলাম গায়ে চাদর জড়াতে জড়াতে বললেন, আরেক কাপ চা বানাও। চা খেয়ে বের হই। আরেকটা কথা বাবা তোমাকে বলি মন দিয়ে শোন। আমি শিক্ষক মানুষ তো সব মানুষকে আমার কাছে মনে হয় পরীক্ষার খাতা। সবাইকে নম্বর দেই। তুমি আমার কাছে নম্বর পেয়েছ একশতে একানব্বই। স্টার মার্কের চেয়েও বেশি। আর আমার জার্মান প্রবাসী গাধা পুত্র পেয়েছে চব্বিশ। গ্রেস মার্ক দিয়েও তাকে পাস করানোর বুদ্ধি নেই।
ফারুক বলল, আয়না। আয়না কত পেয়েছে?
তরিকুল ইসলাম চিন্তিত গলায় বললেন, ওর খাতাটা আমি বুঝি না। নাম্বারও এই জন্য দিতে পারি না।
.
আয়না দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি উঠোনের দিকে। শ্বশুর-জামাই চা খেতে খেতে গল্প করছে দেখতে ভালো লাগছিল। এখন ফারুক একা। মাথা নিচু করে উঠোনে হাঁটছে। একবারও দোতলার দিকে তাকাচ্ছে না। তাকালেই আয়নার হাসিমুখ দেখত।
আয়না দোতলা থেকে নামল। তার কেন জানি হঠাৎ ইচ্ছা করছে ফারুককে চমকে দিতে। নিঃশব্দে তার পেছনে দাঁড়িয়ে ‘হাউ’ করে চিৎকার দিলে কেমন হয়? আয়না খানিকটা অবাক হচ্ছে। এরকম ইচ্ছা তো তার আগে কখনো হয় নি।
‘হাউ’ চিৎকার শুনে ফারুক চমকে তাকাল। আয়না গম্ভীর গলায় বলল, কেমন আছ?
ভালো আছি। তুমি কেমন আছ?
আমিও ভালো আছি। তোমার শিক্ষকও ভালো আছেন। তবে তাঁর মাথা খানিকটা
এলোমেলো।
ফারুক বলল, আমার স্যার এমন একজন মানুষ যার মাথা কখনো এলোমেলো হয় না।
তাই বুঝি?
ফারুক বলল, হ্যাঁ তাই—যদিও আমার গুরু শুঁড়ি বাড়ি যায়
তবুও আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।
আয়না বলল, শুঁড়ি বাড়ি যায় মানে?
ফারুক বলল, কাথার কথা বললাম, আমার গুরু কোথাও যান না।
আয়না বলল, দোতলা থেকে দেখলাম তুমি বাবার জন্য চা বানিয়ে এনেছ। আমার জন্য চা বানিয়ে আন।
এখুনি আনছি। ইলিশ সন্দেশ এনেছি। খাবে?
তুমি বললে খাব। সকালে আমি মিষ্টি খাই না। খেতে বোলো না।
আচ্ছা বলব না।
আমি চা খাব আর তুমি আমার সামনে বসে বলবে কেন তুমি মিসির আলি নামের মানুষটাকে এত পছন্দ কর?
ফারুক বলল, আচ্ছা যাও বলব।
আয়না বলল, আমিও পছন্দ করি তবে আমার পছন্দের কারণ আর তোমার পছন্দের কারণ এক না।
তোমার পছন্দের কারণ কী?
আয়না হাসতে হাসতে বলল, বলব না।
.
ফারুক চা বানিয়ে এনেছে। আয়না আগ্রহ করে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। ফারুক বলল, মিসির আলি স্যারকে এত পছন্দ করি কেন বলছি। মন দিয়ে শোন।
মন দিয়ে শুনছি।
তাঁর চিন্তা করার ধারা বা বুদ্ধিবৃত্তির বিন্যাস বাদ থাকুক মানুষ মিসির আলির একটা গল্প শোন। মন দিয়ে শোন।
বারবার মন দিয়ে শোন বলছ কেন? আমি যা শুনি মন দিয়ে শুনি।
একদিন ক্লাসে তিনি বললেন, আমি মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে তার চিন্তা করার ক্ষমতার ভেতর একটা সম্পর্ক বের করার চেষ্টা করছি। তোমরা হচ্ছ আমার প্রথম সাবজেক্ট। তোমরা সবাই তোমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা বর্ণনা করবে এবং বোর্ডে লেখা পাঁচটা প্রশ্নের উত্তর দেবে।
১. রাতে বাতি নিভিয়ে ঘুমুতে যাও না বাতি জ্বালিয়ে ঘুমুতে যাও?
২. উচ্চতাভীতি কি আছে?
৩. দিঘির পানির কাছে গেলে কি পানিতে নামতে ইচ্ছা করে?
৪. আগুন ভয় পাও?
৫. অপরিচিত কোনো ফুল হাতে পেলে গন্ধ শুঁকে দেখ?
আমরা সবাই আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা লিখলাম এবং আগ্রহ নিয়ে প্রশ্নগুলোর জবাব দিলাম। কাজটা স্যার কেন করলেন জান? আমাদের মধ্যে হতদরিদ্র যারা তাদের খুঁজে বের করার জন্য।
আয়না বলল, মজার তো।
ফারুক বলল, স্যার তিনজন হতদরিদ্র খুঁজে বের করলেন যাদের ইউনিভার্সিটির খরচ তিনি দিতেন। আমি ছিলাম তিনজনের একজন।
বাহ্।
আরেকটা গল্প বলব?
বল।
স্যারের একবার পুরিসি হল। খুবই খারাপ অবস্থা। তিনি এমন একটা ক্লিনিক বের করলেন যার খোঁজ কেউ জানে না। তিনি সেখানে ভর্তি হলেন। কেন জান?
কেন?
যাতে ছাত্ররা তাঁকে খুঁজে না পায়। তাঁকে সেবার জন্য ব্যস্ত না হয়। তিনি কারোর সেবা নেন না। মিসির আলি স্যার এমনই একজন পুণ্যবান ব্যক্তি যার কাছাকাছি বসে থাকলেও পুণ্য হয়।
আয়না বলল, তোমার চোখে পানি এসে গেছে। পানি মোছ
ফারুক চোখ মুছল।
.
মিসির আলির সঙ্গে ফারুকের দেখা হল সকালে নাশতার টেবিলে। ফারুক বলল, স্যার আমাকে চিনেছেন?
মিসির আলি বললেন, তোমার নাম দেখে তোমাকে চিনতে পারি নি। এখন চিনেছি। খুব ভালোমতো চিনেছি। তুমি অনার্স এবং এমএ দুটোতেই ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট হয়েছিলে। ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার হবার কথা ছিল। কী সব পলিটিক্সের কারণে হয় নি।
ফারুক বলল, আমার বিষয়ে আর কিছু কি মনে আছে স্যার?
মনে আছে। আমার একবার পুরিসি হয়েছিল। মরতে বসেছিলাম। ভর্তি হয়েছিলাম এমন এক ক্লিনিকে যার খোঁজ কেউ জানে না। তুমি কীভাবে কীভাবে সেখানে উপস্থিত হলে। কেমন আছ ফারুক?
স্যার ভালো আছি। আপনি সুস্থ আছেন এবং ভালো আছেন দেখে ভালো লাগছে।
মিসির আলি বললেন, তুমি যে সমস্যার সমাধানের জন্য আমাকে ডেকেছ সেই সমাধান আমি করতে পারি নি। পারব সে রকম মনে হচ্ছে না।
ফারুক বলল, সব সমস্যার সমাধান থাকে না স্যার। যেসব সমস্যার সমাধানই নেই আপনি তাঁর কী সমাধান করবেন? এইসব নিয়ে আমরা রাতে কথা বলব।
সব গল্পই পড়া।তবুও আবার পড়ছি।