০৭. ঘটাং ঘটাং শব্দে ঘুম ভাঙল

ঘটাং ঘটাং শব্দে ঘুম ভাঙল।

একেবারে কাকডাকা ভোর। এত ভোরে জিতু মিয়া পানি তোলা শুরু করেছে?

কাকদের ঘুমও তো ভালো করে ভাঙে নি। আমি বিস্মিত হয়ে বারান্দায় এসে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম— বাবা টিউবওলের পাম্প চালাচ্ছেন। তাঁকে বিরত করার চেষ্ট করছে নীতু এবং বড় আপা। মাও আছেন। তিনি দূরে দাঁড়িয়ে আছেন, কিছু বলছেন না। নীতু তীক্ষ্ণ গলায় বলল,বাবা তুমি কাউকে না ধরে দোতলায় উঠাতে পার না— আর তুমি পানি তুলছ? বাবা গম্ভীর গলায় বললেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা দরকার। না মানার জন্য মইনুদিনের অবস্থা তো দেখলি। ফট করে চলে গেল। সে বয়সে আমার এক বছরের ছোট।

বাবা প্লিজ, বন্ধ কর। প্লিজ।

নীতু বাবাকে এসে প্রায় জড়িয়ে ধরল। বড় আপা বাবার কানে কানে কীসব যেন বলছেন। বাবা তার উত্তরে শুধু মাথা নাড়াচ্ছেন।

মেজোভাইও ঘুম ভেঙে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর দৃষ্টি তীক্ষ্ম। মুখ কঠিন।

মেজোভাই আমার দিকে ফিরে বললেন, বড় আপা বাবাকে কী বলছে?

আমি বললাম, বুঝতে পারছি না।

বাড়ি নিয়ে কিছু বলছে বোধহয়।

মনে হয় না।

তাই বলছে। এরা দুজন ক্রমাগত বাবাকে জাপাচ্ছে— বাড়ি ছেড়ে দাও। বাড়ি ছেড়ে দাও। মেয়েদের বুদ্ধি। ইডিয়টস।

মেজোভাই থু করে থুতু ফেললেন। কদিন ধরেই দেখছি তার থুতু ফেলার রোগ হয়েছে। গৰ্ভবতী মেয়েদের মতো ক্রমাগত থুতু ফেলেন। থুতু ফেলার সময় তার মুখ ঘৃণায় কুঁচকে যায়। কার উপর এত ঘৃণা কে জানে?

রঞ্জু!

বল।

ওরা দুজন ক্রমাগত বাবাকে জপাচ্ছে। ক্রমাগত জপাচ্ছে।

না, উনার শরীর খারাপ, তাই সারক্ষণ পাশে পাশে থাকে।

আমরা সারা জীবন কষ্ট করেছি। এখন একটা সুযোগ পাওয়া গেছে–এরা সবাই সুযোগ নিতে দেবে না। ইনজিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার সময় সাতশ টাকা লাগে। সেই টাকা কীভাবে যোগাড় করেছিলাম জানিস?

না।

শোভাকে বলেছিলাম। সেই বেচারি তার কানের দুল বিক্রি করে টাকা দিয়েছিল। ওদের বাড়িতে জানাজানি হয়ে যেতে একটা বিশ্ৰী কাণ্ড হয়।

তুমি তার জন্মদিনে যাও নি কেন?

তোকে কে বলল?

আমি আমার এক ফ্রেন্ডের কাছে শুনেছি। অনেক রাত পর্যন্ত বেচারি তোমার জন্য অপেক্ষা করেছিল। কাজটা ভালো কর নি।

মনে ছিল না। খুব আপসেটিং লাগছিল–মানে এখনো লাগছে। আচ্ছা, ও কি এর মধ্যে এসেছিল?

আমি মিথ্যা করে বললাম, একদিন এসেছিলেন। গেট দিয়ে ঢুকে তারপর হঠাৎ দেখি বের হয়ে চলে যাচ্ছেন।

তাই নাকি?

মেজোভাইয়ের চোখ করুণ হয়ে গেল। আমি বললাম, তুমি আজ তাদের বাসা থেকে ঘুরে আস না কেন?

যাব। দু-একদিনের মধ্যেই যাব। যেতে ইচ্ছে করে না। মেজাজ এমন খারাপ হয়েছে! সবার সাথে শুধু ঝগড়া করতে ইচ্ছে করে। এখন মনে হচ্ছে বুনোভাই সুখে আছে। দিনরাত শুয়ে বসে. ছিঃ ছিঃ। যে ফ্যামিলির সবচে বড় ছেলের এই অবস্থা সেই ফ্যামিলি এমন একটা সুযোগ কি ছাড়তে পারে? পারা কি উচিত? তোর কী মনে হয়, উচিত?

উচিত না।

অফকোর্স উচিত না। এটা হচ্ছে আমাদের সারভাইভেলের প্রশ্ন। আজ যদি এমন হত যে বুনোভাই ভালো একটা চাকরি করছে।–আমি পাস করে জয়েন্ট করেছি, নীতুর বিয়ে হয়ে গেছে…

তুমি তো পাস করবেই, আর নীতুরও ভালো বিয়ে হবে। দেখতে সুন্দরী, বুদ্ধিমতী।

আমি পাস–টাস করব না। পড়াশোনাই করব না বলে ঠিক করেছি।

কেন?

দূর, বেতনের এই দুতিন হাজার টাকায় আমার কিছু হবে না। বিজনেস করব।

বিজনেস করবে? টাকা পাবে কোথায়?

টাকা তো আছে। আমাদের এই জায়গাটাই হবে। আমার ক্যাপিটেল। বাংলাদেশে কোটিপতি হওয়া এমন কিছু না। আমি সাত বছরের মধ্যে কোটিপতি হব। তুই কাগজে কলমে লিখে রাখতে পারিস। তখন দশটা পাস করা ইনঞ্জিনিয়ার আমার ফার্মে খাটাব। আমি আমার ফার্মের নামও ভেবে রেখেছি। The Master Builders.

যদি বাড়িটা বাবা দিয়ে দেন তাহলেও কি কোটিপতি হতে পারব?

না, তাহলে পারব না।

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, বাবা বাড়িটা দিয়ে দিতে পারেন। এই সম্ভাবনা কিন্তু আছে। মেজোভাই চমকে উঠে বললেন, সম্ভাবনা আছে মানে?

গতকাল একজন উকিল এসেছিল। বাবা খবর দিয়ে আনিয়েছিলেন বলে মনে হয়। দরজা বন্ধ করে কী-সব লেখালেখি হল।

মাই গড! কী বলছিস তুই?

মেজোভাই আবার থুতু ফেললেন। তাঁর শরীর উত্তেজনায় কাঁপছে। সেই প্ৰবল উত্তেজনা অনেক কষ্টে দমন করে বললেন, বাবা কোনো দলিলপত্র করলেও তা কোর্টে টিকবে না। কারণ তার মাথার ঠিক নেই। সাইকিয়াট্রিস্ট তার চিকিৎসা করছে। অপ্রকৃতিস্থ মানুষ কোনো দলিল করতে পারেন না। আমি খুব হালকা গলায় বললাম, ভাইয়া, বাড়ির দলিল কিন্তু মার নামে। বাবার নামে না।

মার নামে মানে? মার নামে কেন?

মইনুদিন চাচা মরবার আগে তাই বলে গিয়েছিলেন।

মাকে বাড়ি দিতে বলে গিয়েছিলেন?

হ্যাঁ।

তোকে কে বলল?

আমি জানি। বাবা বুনোভাইয়াকে বলেছেন। বুনোভাই আমাকে বলেছেন।

মাকে সে কেন বাড়ি দেবে?

আমিও তাই ভাবছি। জীবনের শুরুতে তিনি বেশ কিছুদিন আমাদের বাড়িতে ছিলেন, হয়তো তখন মার সেবাযত্নে খুশি হয়েছিলেন। সেটা মনে রেখেছেন।

তুই এসব কী বলছিস?

বন্ধু-পত্নীকে ছোটখাটো উপহার অনেকেই দেয়। এটা দোষের কিছু না। ইনি বড়লোক মানুষ, বড় উপহার দিয়েছেন।

মেজোভাইয়ের মুখ বিবৰ্ণ হয়ে গেল। হতভম্ব ভাবটা তার মধ্যে যেন আর নেই।

এখন অসম্ভব রাগে তাঁর চোখ জ্বলছে।

হারামজাদার এত বড় সাহস! হারামজাদা আমার মাকে অপমান করে?

আমি সহজ গলায় বললাম, অপমানের কী দেখলে ভাইয়া? একজন উপহার হিসেবে একটা জিনিস দিচ্ছে।

শুয়োরের বাচ্চা আমার মাকে বাড়ি উপহার দেবে কেন? শুয়োরের বাচ্চা ভেবেছে কি?

এত অস্থির হচ্ছে কেন ভাইয়া? তুমি যা ভাবছি হয়তো সেসব কিছু না। বিত্তবান মানুষের খেয়াল।

খেয়াল মোটেই না। মোটেই খেয়াল না। আমার মনে পড়ছে। মার যখন অ্যাপেন্ডিসাইটিসের পেইন হল সে মাকে নিয়ে ভর্তি করলেন সবচে বড় ক্লিনিকে। সারারাত আমাদের সাথে ক্লিনিকে বসে রইল।

এটাতো অন্যায় কিছু না।

অন্যায় না মানে? হারামজাদার এতবড় সাহস! এতবড় সাহস ঐ শুয়োরের বাচ্চার!

হইচই শুনে বুনোভাই বের হয়ে এলেন। মেজোভাই কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, বুনোভাই, রঞ্জু এসব কী বলছে?

বুনোভাই পরম মমতায় বললেন, আয়, তুই আমার ঘরে আয়।মেজোভাই হাইমাউ করে কেঁদে উঠলেন। তাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে হচ্ছে। মেজোভাই কিছুতেই যাবে না। হইচই শুনে মা এলেন। বিস্মিত স্বরে বললেন, কী হয়েছে রে?

বুনোভাই বললেন, কিছু হয় নি। মা, তুমি যাও তো।

মেজোভাই চোখ লাল করে বললেন, না, তুমি যেতে পারবে না, তুমি থাক। তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।

মা শান্ত গলায় বললেন, কী কথা?

বুনোভাই মেজোভাইকে কোনো কথা বলার সুযোগ দিলেন না। তার মুখ চেপে ধরলেন।

মা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেলেন। তাঁর মাথার চুল প্ৰায় সবই পাকা, তবু আজ হঠাৎ করে মনে হল যৌবনে আমার মা অসম্ভব রূপবতী ছিলেন। জীবনের শেষ প্রান্তেও তিনি সেই রূপের কিছুটা হলেও ধরে রেখেছেন।

নীতু বারান্দায় এসে বলল, মেজোভাইয়ের কী হয়েছে? মা বললেন, জানি না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *