আমি গামাল আবদুল নাসেরকে প্রথম দেখি কলকাতায়। বান্দুংএ অনুষ্ঠিত এশিয়া-আফ্রিকার দেশগুলির সম্মেলনের শেষে দেশে ফিরছিলেন। তখনও বোয়িং বা জাম্রো আবিষ্কার করা হয় নি। সুপার-কন্সস্টেলেশন ও ভাইকাউণ্ট বিমানই সর্বাধুনিক। এক লাফে পৃথিবীর এদিক থেকে, ওদিক উড়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না বলেই নেহুর, নাসের ও আফগানিস্তানের নিয়াম কলকাতায় যাত্রা বিরতি করেছিলেন এক রাত্রির জন্য। সেটা ১৯৫৫ সালের এপ্রিল মাসের কথা।
বেশ মনে আছে বিকেলের দিকে ওঁরা দমদম পৌঁছলেন। বিমান থেকে প্রথম বেরুলেন নেহরু, তারপরই নাসের ও নিয়াম। মধ্যপ্রাচ্যের মহানায়ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিরাট জিজ্ঞাসা নাসেরকে দেখেই রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। দীর্ঘকায় চেহারা, দোহারা গড়ন, মুখে হাসি। পরণে কর্নেলের পোক। সঁইত্রিশ বছরের এই অনন্য রাষ্ট্রনায়ককে নবজীবনের দূত মনে করত বিশ্বের অসংখ্য মানুষ। করবে না কেন? মাত্র চৌত্রিশ বছরের যে তরুণ ইংরেজের পোয্যপুত্র ব্যাভিচারী ফারুককে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলতে পারেন, তাকে নবযুগের স্রষ্টা মনে করাই স্বাভাবিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে পঞ্চাশের দশকে জন্ম নিল পৃথিবীর তৃতীয় শক্তি ( Third world ) এবং নেহরু, সোয়েকৰ্ণ, টিটো, বন্দরনায়ক, উ, নক্রমার মত এই তরুণ রাষ্ট্রনায়কও তৃতীয় বিশ্বের অন্যতম মহানায়ক। তাইতো সেদিন অস্তগামী সূর্যের আলোয় দমদম বিমানবন্দরে এই মহানায়ককে দেখে সত্যি রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম।
স্বৈরতন্ত্রী মিশরের এক দরিদ্র পোস্টমাস্টারের ছেলে নাসের পরের বছরই সারা পৃথিবীকে চমকে দিলেন সুয়েজ খাল রাষ্ট্রীয়করণ করে। তখন একদিকে সমস্ত পাশ্চাত্য দেশ ও অন্যদিকে সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে মিশরের সম্পর্ক বেশ তিক্ত। (কুশ্চেভ হঠাৎ নেহরুকে খবর দিলেন, আগামী দু একদিনের মধ্যে ইংরেজ ও ফরাসীরা মিশর আক্রমণ করবে। খবরটা নাসেরকে জানিয়ে দেবার জন্য ক্রশ্চভ নেহরুকে অনুরোধ করলেন এবং নেহরুও কালবিলম্ব না করে সোভিয়েট গোয়েন্দা দপ্তরের সংগৃহীত এই খবরটি নাসেরকে জানিয়ে দেন। সোভিয়েট ইউনিয়নের সঙ্গে তখন মিশরের সম্পর্ক কী রকম ছিল, তা এই ঘটনার দ্বারাই প্রমাণিত হয়।) তবু এই দুঃসাহসী তরুণ বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন নি একই সঙ্গে ইজরাইল-ইংরেজ-ফরাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। সারা পৃথিবীর ন্যায় বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ সেদিন নাসেরকে সমর্থন করেন।
যাই হোক বহু ইতিহাসের স্রষ্টা ও নবজাগ্রত এশিয়া-আফ্রিকার অন্যতম মহানায়ক নাঁসেরকে আবার দেখি ১৯৬২ সালের বেলগ্রেড গোষ্ঠী নিরপেক্ষ সম্মেলনে ও পরে দিল্লীতে। দৈবক্রমে একটু ঘনিষ্ঠ হবারও দুর্লভ সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রনায়কেরই কিছু না কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। অনেকে বিরল প্রতিভাসম্পন্ন হন। কোন কোন রাষ্ট্রনায়কের মধ্যে বিস্ময়কর দূরদর্শিতা থাকে কিন্তু অনেক রাষ্ট্রনায়কের মধ্যেই যা থাকে না, তা হচ্ছে উষ্ণ ব্যক্তিত্ব। ইংরেজিতে যাকে বলে warni personality. আমাদেব নেহরুর মধ্যে ছাড়াও এই বিরল গুণ দেখেছি নায়েব ও নক্ৰমার মধ্যে।
মনে পড়ে বেলগ্রেড গোষ্ঠী নিরপেক্ষ দেশগুলির শীর্ষ সম্মেলনে কটি দিনের কথা। এখনকার মত সরকারী খবচে কাল সাবাদিক নিয়ে নেহরু বিদেশ সফর করতেন না এবং করার প্রয়োজনও বোধ করতেন না। (পাশ্চাত্য দেশগুলিতে রেডিও টি. ভি-সংবাদপত্রের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা আছে বলে তারা জলের মত অর্থ ব্যয় করে রাষ্ট্রের কর্ণধারদের বিদেশ সফর কভার করে। কমিউনিষ্ট দেশগুলিতে এই প্রতিযোগিতা বিন্দুমাত্রও নেই কিন্তু তবু কমিউনিষ্ট নেতারা নিজেদের ব্যাপক প্রচারের জন্য বিদেশ সফরের সময় বিমান ভর্তি রেডিও-টি. ভি-সংবাদপত্ৰ-সংবাদ সংস্থার সাংবাদিকদের সঙ্গে আনেন। এখন এই রোগ গরীব দেশগুলির রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে মহামারীর মত ছড়িয়ে পড়েছে।) বেলগ্রেডে আমরা মাত্র তিন চারজন ভারতীয় সাংবাদিক ঐ ঐতিহাসিক সম্মেলনের খবর সংগ্রহের জন্য উপস্থিত ছিলাম এবং তার মধ্যে একজন ছিলেন অল ইণ্ডিয়া রেডিওর সংবাদদাতা মিঃ চোনা। একজন বৃদ্ধ সাংবাদিক সস্ত্রীক ইউরোপ পরিভ্রমণে বেরিয়ে এই সম্মেলনের সময় বেলগ্রেডে ছিলেন। একটি গুজরাতী দৈনিকের মালিকের পুত্র নিছক মজার জন্য সাংবাদিক হিসেবেও তখন এখানে ছিলেন। মোটকথা মিঃ চেনা ছাড়া আমরা দুজন সাংবাদিকই সংবাদ সংগ্রহ করে আমাদের সংবাদপত্রে পাঠাতাম। তাইতো আমাদের দুজনকে সর্বত্রই উপস্থিত থাকতে হতো।
বেলগ্রেডে আমার একটু বিশেষ সুযোগ সুবিধা ছিল। প্রধানমন্ত্রী নেহরু ভারতীয় প্রতিনিধি দলের নেতা ছিলেন। সদস্য ছিলেন কৃষ্ণ মেনন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারি জেনারেল মিঃ আর. কে. নেহরু, ভারতীয় রাষ্ট্রদূত জগন্নাথ খোসল ও আরো দুতিনজন। নেহরু, কৃষ্ণ মেনন ও আর. কে. নেহরু আমাকে স্নেহ করতেন বলে অনেক সময় ওদের সঙ্গেই নানা অনুষ্ঠানে যোগদান করতাম। এই রকম একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠানেই কৃষ্ণ মেনন আমাকে নাসেরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। দুএকটি সৌজন্যমূলক কথাবার্তার পরই উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, এখানে (বেলগ্রেড) আসার পথে কী কায়রো গিয়েছিলেন?
না। আমি বেইরুট-এথেন্স হয়ে এসেছি
ইউ মাস্ট কাম টু কায়রো অন ইওর ওয়ে ব্যাক হোম।
নিশ্চয়ই আসব। আমারও কায়রো যাবার খুব ইচ্ছা।
নামের আমার কাঁধের উপর একটা হাত রেখে একটু হেসে বললেন, মাই ডিয়ার ইয়ং ফ্রেণ্ড, আমার দেশের মানুষ নেহরু ও মেননকে আমার চাইতেও বোধহয় বেশি ভালবাসে। তাই বলছি, কায়রো না এলে খুব অন্যায় করবেন।
নাসের হয়তো একটু অতিশয়োক্তি করেছিলেন কিন্তু বুঝলাম, মিশরের মানুষ নেহরু ও মেননকে সত্যি প্রিয়জন মনে করেন। নেহরুর সঙ্গে কায়রো সফরের সৌভাগ্য আমার হয়নি কিন্তু একবার মেনন যখন কায়রোতে ছিলেন, তখন আমিও সেখানে। একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখার সময় মেনন আমাকে সঙ্গে নিলেন। অনুষ্ঠান শুরু হবার আগে দর্শকরা মেননকে দেখলে হৈ চৈ করবেন ও হলের সামনে অসম্ভব ভীড় জমবে বলে আমরা অনুষ্ঠান শুরু হবার বেশ কিছুক্ষণ পরেই হলে ঢুকলাম। ইন্টারভ্যালের সময় হঠাৎ কিছু দর্শক মেননকে দেখতে পেয়েই চিৎকার করে উঠলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তাদের কী উল্লাস! না দেখলে সত্যি বিশ্বাস করা যায় না। গর্বে আনন্দে মন ভরে গেল। অনুমান করতে কষ্ট হল না নেহরুর জনপ্রিয়তা। যাই হোক মাস দেড়েক ইউরোপ ঘুরে দিল্লী ফেরার পথে কদিন কায়রোয় কাটিয়ে সত্যি আনন্দ পেয়েছিলাম।
কয়েক বছর পর নাসের দিল্লী এলে আবার দেখা। ওঁর আলীগড় সফরও কভার করলাম। দিল্লীতে ফিরে আবার দেখা। মাঝে মাঝে টুকটাক কথাবার্তা হয়।
এই সময় নাসেরের নামে এক বিচিত্র ও মুখরোচক গুজব ছড়ায় দিল্লীতে। দুএকটি পত্রপত্রিকায় তা ছাপাও হয় কিন্তু কেউই সাহস করে গুজবের সত্য-মিথ্যা যাচাই করছিলেন না। সাংবাদিক সম্মেলনে আমিই ওঁকে প্রশ্ন করলাম। পাশেই বসেছিলেন নেহরু। উনি আমার প্রশ্ন শুনেই রেগে লাল কিন্তু নাসের হাসি মুখেই জবাব দিলেন। ঐ প্রশ্নোত্তরের জন্যই জানা গেল গুজবটি মিথ্যা ও তার চিরসমাধি ঘটল। রাষ্ট্রপতি ভবনের রিসেপসনে নাসের আমাকে বললেন, আপনি সাহস করে ঐ প্রশ্নটি করেছিলেন বলেই আমি বলতে পারলাম, গুজবটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ওর কোন ভিত্তি নেই। আপনি প্রশ্ন না করলে গুজবটি আরো বহুজনের মধ্যে ছড়িয়ে অযথা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করত।
আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বললাম, আমিও ঠিক এই উদ্দেশ্যেই প্রশ্ন করেছিলাম কিন্তু প্রাইম মিনিস্টার আমাকে ভুল বুঝলেন।
আমি আপনাকে যা বললাম, তা মিঃ নেহরুকেও বলেছি।
থ্যাঙ্ক ইউ ইওর একসেলেন্সী।
উনি আমার সঙ্গে করমর্দন করবার সময় বললেন, এবার কায়রো আসার আগে আমাকে জানাবেন।
নিশ্চয়ই জানাব।
***
ক্রশ্চভ-বুলগানিনের মতই অভূতপূর্ব সম্বর্ধনা পেয়েছিলেন প্রথম ভারত সফরকারী মার্কিন রাষ্ট্রপতি আইসেনহাওয়ার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম মহানায়ক ও নাৎসী ফৌজের বিভীষিকা আইসেনহাওয়ারকে নিয়ে দিল্লীর মানুষ উন্মাদ হয়ে উঠেছিল। সত্তর বছরের এই যুব নেহরুর সঙ্গে কয়েক ঘণ্টা গভীর আলাপ-আলোচনার পর রাষ্ট্রপতি ভবনের বাইরে এসেই অন্য মানুষ। স্কাউট ও গাইড কিশোরকিশোরীদের মধ্যে এসে তিনিও ওদেরই একজন হয়ে গেলেন। এই মানুষটিই ওয়েলেসলী রোডের ধারের গলফ ক্লাবের মাঠে নিছকই একজন পরম উৎসাহী খেলোয়াড়। প্রেস সেক্রেটারি জেমস্ হ্যাঁগাটি আমাদের বললেন, ছবি আঁকা, বই পড়া ও মাছ ধরার সময়ও উনি রাষ্ট্রপতি থাকেন না। তখন উনি অন্য জাতের মানুষ। সত্যি তাই। দিল্লীর উপকণ্ঠের এক গ্রামে গিয়ে আইসেনহাওয়ারও নিছক একজন গ্রামবাসীর মতই কথাবার্তা বলেন। গরু-বাছুর চাষ-বাসের ব্যাপারে ওঁর কথাবার্তা শুনে গ্রামের লোকজন অবাক।
প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ারকে তাজমহল দেখাতে নিয়ে গেলেন স্বয়ং নেহরু। সঙ্গে আইসেনহাওয়ারের পুত্রবধু বারবারা আইসেন হাওয়ার। সঙ্গী সাংবাদিকদের মধ্যে আমিও আছি। তাজমহলের চারপাশে ঘুরে-ফিরে দেখে ওরা উপরে আসেন। পাশেই আমরা দাঁড়িয়ে আছি। আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্টের অফিসারদের অসংখ্য প্রশ্ন করেন আইসেনহাওয়ার। বারবারাকে বুঝিয়ে দেন নেহরু। ভাবপ্রবণ নেহরু তাজমহল দেখে যেন একটু আনমনা হয়ে যান। আমি ছোট্ট একটা সরস মন্তব্য করি। সাংবাদিক বন্ধুরা হেসে ওঠেন কিন্তু আমার মন্তব্য বোধহয় নেহরু শুনতে পান না। কিছু বলেনও না।
তাজমহল দেখে বিদায় নিচ্ছেন রাষ্ট্রপতি আইসেনহাওয়ার। ঐ একই ভোলা মোটরে বসে নেহরু। আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্টের অফিসারদের ধন্যবাদ জানাবার পর হঠাৎ আইসেনহাওয়ার আমাকে ডেকে আমার সঙ্গে করমর্দন করেই হাসতে হাসতে বললেন, আমি তোমার মন্তব্য শুনে খুব উপভোগ করেছি।
ওঁর কথায় আশেপাশের সব সাংবাদিক বন্ধুরা হো হো করে হেসে ওঠেন। আর আমি অবাক হয়ে ভাবি, উনি তো আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্টের অফিসারদের সঙ্গে কথা ছিলেন। আমার মন্তব্য শুনলেন কী করে?
উনি যে আইসেনহাওয়ার! চতুর্দিকে এত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি না থাকলে কি বিশ্ববরেণ্য সেনাপতি হওয়া যায়?
সর্বনাশা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কটা বছর কাটতে না কাটতেই পৃথিবীর দুটি বিবাদমান শক্তির সাময়িক মোকাবিলা শুরু হলো এই এশিয়ারই এক দেশে–কোরিয়ায়। কবছর যুদ্ধ চলার পর চুক্তি হলে উত্তর কোরিয়া থেকে রাশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সৈন্য সরিয়ে নেবে। চুক্তি হলেই যে তা রক্ষা করতে হবে, এ কথা দুটি বিবাদমান শক্তি বিশ্বাস করে না এবং তাইতো উত্তর কোরিয়ার সৈন্যবাহিনী হানা দিল দক্ষিণ কোরিয়া। রাষ্ট্রপুঞ্জের সৈন্যবাহিনী প্রতিরোধ করল কিন্তু চীনের পিপলস্ ভলান্টিয়ার ফোর্স যুদ্ধ শুরু করল দক্ষিণ কোরিয়ায়। আরো কত কি ঘটল। শেষ পর্যন্ত কোরিয়ার রণাঙ্গনে যুদ্ধ থামল কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা নিয়ে নতুন করে লড়াই শুরু হলো ইন্দো-চীনে।
কোরিয়ায় শান্তি ফিরিয়ে আনার কাজে নেহরু ও কৃষ্ণ মেননের অবদান বিশ্ববাসী স্বীকার করলেও মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব জন ফস্টার ডালেস গোষ্ঠী নিরপেক্ষ ভারতের এই গুরুত্ব মেনে নিতে পারলেন না। তাইতো তারই একগুয়েমির জন্য ইন্দো-চীন সংক্রান্ত জেনেভা সম্মেলনে ভারতকে আমন্ত্রণ জানান হলো না। সেটা ১৯৭৪ সালের মে মাসের কথা।
সম্মেলন শুরু হতে না হতেই দেখা দিল দ্বন্দ্ব। সম্মেলন কক্ষ ত্যাগ করে ডালেসের প্রতিনিধি হুমকি দিলেন নতুন সর্বাত্মক লড়াইয়ের। বৃটিশ প্রতিনিধি স্যার এ্যান্তনি ইডেন এক সম্মেলনকে চালু রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করলেও কোন অগ্রগতি হচ্ছে না। সম্মেলন প্রায় ভেঙে যায় আর কি! এমন সঙ্কটময় মুহূর্তে রাষ্ট্রপুঞ্জে যাবার পথে টুরিস্ট হিসেবে নেহরুর দৃত কৃষ্ণ মেনন জেনেভায় হাজির।
জেনেভায় মেনন পৌঁছতে না পৌঁছতেই কয়েকটি পাশ্চাত্য দেশে শুরু হলো তার নিন্দা কিন্তু শেষ পর্যন্ত জেনেভা সম্মেলনে অনিমন্ত্রিত এই কৃষ্ণ মেননই অষ্ণতম কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠলেন এবং বৃটেনের এ্যান্তনি ইডেন, রাশিয়ার মলোটভ, চীনের চৌ এন লাই, ভিয়েতনামের কাম ভন ভোঙ ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানী, নরওয়ে, সুইডেন, কলম্বিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার প্রতিনিধিরা প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় মেননের সঙ্গে পরামর্শ করা শুরু করলেন। এই জেনেভা সম্মেলন শেষ পর্যন্ত সাফল্যমণ্ডিত হবার পিছনে মেননের অবদান পরবর্তী কালে সবাই স্বীকার করেন।
যাইহোক এই জেনেভা সম্মেলনের সময়ই চৌ এন লাইএর সঙ্গে মেননেব গভীর হৃদ্যত হয় এবং সেই সূত্র ধরেই দেশে ফেরার পথে দিল্লী হয়ে যাবার জন্য নেহরু চৌ এন লাইকে আমন্ত্রণ জানালেন। চৌ খুশি হয়েই সে আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে দিল্লী এলেন। চৌ এন লাই এর সেই প্রথম ভারত ভ্রমণ। পরের বছর বান্দুংএ চৌ এন লাইএর সঙ্গে নেহরু এ মেননের আবার দেখা হল এবং তারপরের বছর (১৯৫৬) চৌ এন লাই তার ঐতিহাসিক ভারত সফরে এলেন।
আমি তখন ফ্রীলান্স রিপোর্টার হলেও প্রধানতঃ কলকাতার এক বিখ্যাত দৈনিকের সঙ্গে যুক্ত। চীনের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সারা দেশ ঘোরা কথা তখন স্বপ্নেও ভাবতে পারি না কিন্তু এত বড় ঐতিহাসিক সফরে কোন এক অংশও কভার করব না, তাও মেনে নিতে পারি না। চিঠি লিখলাম চীনে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত আর. কে. নেহরুকে। উনি খবর পাঠালেন, চীনা প্রধানমন্ত্রীর সফর শুরু হবার কয়েক দিন আগে কলকাতা হয়েই দিল্লী পৌঁছব। তুমি হাকসারের বাড়িতে আমার সঙ্গে দেখা করো।
এখানে একটু অন্য প্রসঙ্গে আসা দরকার। ডক্টর কৈলাশনাথ কাটজু যখন পশ্চিম বাংলার রাজ্যপাল, তখন একদিন রাজভবনের এক অনুষ্ঠানেই ওঁর বড় মেয়ে শ্রীমতী সুভদ্রা হাকসারের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় এবং প্রথম দর্শনেই তাকে মাতৃজ্ঞানে শ্রদ্ধা-ভক্তি করতে শুরু করি। রামকৃষ্ণ-মার একনিষ্ঠ সাধিকা শ্ৰীমতী হাকার কয়েক দিনের মধ্যেই আমার মাতাজী হয়ে গেলেন এবং উনিও বিন্দুমাত্র বিধা না করে আমাকে সন্তানের স্নেহ করতে শুরু করলেন। মিঃ হাকসার তখন ডানলপের ডিরেক্টার ও ওঁরা তখন গুরুসদয় দত্ত রোডে থাকতেন এবং সেখানে আমার নিত্য যাতায়াত ছিল। মিঃ হাসারের বোনের সঙ্গেই মিঃ আর. কে. নেহরুর বিয়ে হয়েছিল। এই হাকসার পরিবারের দৌলতেই আর. কে. নেহরুর সঙ্গে আমার বিশেষ হৃদ্যতা গড়ে ওঠে এবং উনিও আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। আমার জীবনের চরম দুর্দিনে মাতাজীর স্নেহ-ভালবাসার কথা আমি জীবনেও ভুলব না।
যাইহোক হাকসার-গৃহে মিঃ নেহরুর সঙ্গে কথাবার্তা হবার পর উনি বললেন, তুমি চিত্তরঞ্জন-সিন্ধী ছাড়াও কলকাতায় প্রাইম মিনিস্টারের সফর কভার করো এবং আমি তার ব্যবস্থা করব। ফ্রীলান্স রিপোর্টার হিসেবে সরকারী প্রেস কার্ড ছিল এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রচার অধিকর্তা প্রকাশ স্বরূপ মাথুরের সৌজন্যে চীনা প্রধানমন্ত্রীর সফর কভার করার বিশেষ প্রেস কার্ডও পেয়ে গেলাম। যে সংবাদপত্রের জন্য প্রধানতঃ কাজ করতাম, তাদের কাছে চৌ এন লাইএর চিত্তরঞ্জন সিন্ধী সফর কভার করার প্রস্তাব করতেই ওঁরা সরাসরি প্রস্তাবটি বাতিল করে দিলেন। আনন্দবাজার-হিন্দুস্থান স্টাণ্ডার্ডের চীফ রিপোর্টার মণীন্দ্র ভট্টাচার্য বললেন, আমরা চিত্তরঞ্জনে কোন রিপোর্টার পাঠাচ্ছি না। হ্যাঁ, তুমি চিত্তরঞ্জন ট্যুর কভার করে এবং তার জন্য আমরা তোমাকে একশ টাকা দেব। ব্যস! আমাকে তখন কে দেখে!
যাইহোক কদিন ধরে চৌ এন লাইএর সঙ্গে ঘোরাঘুরি করে দেখলাম, উনি বড় সিরিয়াস প্রকৃতির মানুষ। সবকিছুই গভীরভাবে বিচার-বিবেচনা করা ওঁর সহজাত স্বভাব। সর্বোপরি উনি পরিপূর্ণ ভাবে রাজনীতিবিদ (a total political personality)। মনে পড়ে কলকাতা রাজভবনের কাউন্সিল চেম্বারে ওঁর সাংবাদিক সম্মেলনের কথা। চৌ এন লাই চেয়ারে বসতে না বসতেই একজন মার্কিন সাংবাদিক একটা প্রশ্ন করলেন। চৌ এন লাই সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আপনারা বড় বেশি উদ্ধত। সব সময় সব ক্ষেত্রে নিজেদের প্রাধান্য বিস্তার করতে ব্যস্ত। আমি ভারত সরকারের আমন্ত্রণে ভারত সফর করছি। সুতরাং আমি যে প্রথমে ভারতীয় সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাব দেব, এটুকু সৌজন্যজ্ঞান আপনার থাকা উচিত।
এই একটি ছোট্ট সাধারণ উত্তরের মধ্য দিয়েই চৌ এন লাই মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির তীব্র সমালোচনা করলেন এবং এ ধরনের কথা শুধু -ওঁর পক্ষেই বলা সম্ভব ছিল।
এই সফরের শেষে আমার এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তখন ভি-আই-পিদের সঙ্গে কলকাতার সাংবাদিকরা নিয়মিত ছবি তুলতেন। চৌ এন লাই ও মার্শাল হো লুঙ ১৯৫৬ সালের দশই ডিসেম্বর সকালে দমদম থেকে স্বদেশ রওনা হন। বিমানে ওঠার প্রাক্কালে কয়েকজন রিপোর্টার-ফটোগ্রাফার চৌ এন লাইকে তাঁর সঙ্গে ছবি তোলার আগ্রহ প্রকাশ করতেই উনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হলেন। আমি চীনা প্রধান মন্ত্রীর ঠিক পাশেই দাঁড়িয়েছিলাম। এবং উনি আমার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে ধরেই ছবি তুললেন। তখন আমি ফ্রীলান্স হলেও কলকাতার যে দৈনিকের জন্য আমি প্রধানতঃ কাজ করতাম, সেই অফিসে বিকেলবেলায় যেতেই অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন চীফ রিপোর্টার গর্জে উঠলেন–তুমি চৌ এন লাইএর হাত ধরে ছবি তুলেছ কেন? তোমার এই ফাজলামির জন্য পুলিশ ক্ষেপে লাল। এখন ঠেলা সামলাও।
কথাটা শুনেই আমি ঘাবড়ে গেলাম। তবু সাহস সঞ্চয় করে। জিজ্ঞেস করলাম, আপনাকে কে বলল?
উনি একটি ইংরেজি পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টারের নাম করে বললেন, ও পুলিশের একজন অফিসারের কাছে শুনেছে।
ঐ ভদ্রলোকের নাম শুনেই মনে হলো, উনি বোধহয় ঈর্ষায় আমার নামে মিথ্যা কথা বলছেন। তবু মনে মনে একটু শঙ্কিতই রইলাম।
পরের দিন সকালেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ডিরেক্টর অব পাবলিসিটি মিঃ মাথুরের কাছে গেলাম। উনি সব শুনেই বললেন, বাজে কথা। চাইনীজ প্রিমিয়ার যদি খুশি হয়ে তোমার হাত ধরে ছবি তোলেন, তাতে পুলিশের আপত্তি করার কী কারণ আছে? তাছাড়া আমাকে না জানিয়ে পুলিশ নিশ্চয়ই কিছু করবে না।
পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হবার জন্য চীফ সেক্রেটারি সত্যেন রায়ের কাছে গেলাম। উনি হেসে বললেন, ঐ রিপোর্টারটি নিছক ঈর্ষায় তোমার নামে মিথ্যে কথা বলেছে। তাছাড়া আমিও তো চাইনীজ প্রিমিয়ারে পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। যে ছবিতে আমি আছি, তার ব্যাপারে পুলিশ কী বলবে?
সন্ধ্যায় অফিসে গিয়েই চীফ রিপোর্টারকে সব জানালাম কিন্তু উনি কোন মন্তব্য করলেন না। বোধহয় আমাকে ভাল করে বকুনি দেবার সুযোগ না পেয়ে মনে মনে একটু আহত হলেন।
ইংরেজি দৈনিকের ঐ রিপোর্টারের বিষয়ে দুচার কথা বলা প্রয়োজন। ওঁর শ্বশুরমশায়ের প্রতিষ্ঠানে আমি এক কালে শিক্ষানবিশী সাংবাদিক ছিলাম বলে উনি মনে মনে আমাকেও ওঁর অধঃস্তন কর্মচারী ভাবতেন এবং আমাদের মত ছেলেদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা উনি সম্মানজনক মনে করতেন না। উনি অবশ্য শ্বশুরমশায়ের দৌলতেই সাংবাদিক হন। ওঁর শ্বশুরমশায়ের প্রতিষ্ঠানটি সরকারের পাওনা লক্ষ লক্ষ টাকা না দিয়েই লালবাতি জ্বালান। কোন কর্মচারী প্রফিডেন্ট ফাণ্ডের একটি পয়সাও পান না। শুনেছি, এই প্রতিষ্ঠানের একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক বহুদিনের মাইনে ও প্রফিডেন্ট ফাণ্ডের টাকাকড়ি না পাওয়ায় অভাবের তাড়নায় শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যাও করেন। তবু এরা সমাজে বিখ্যাত ও শ্রদ্ধেয়।
যাইহোক সব মিলিয়ে চৌ এন লাইএর এই সফর আমার সাংবাদিক জীবনের প্রথম অধ্যায়ের একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। পরে দিল্লীতে আবার চৌ এন লাইএর দেখা পেয়েছিলাম। ধীর, স্থির, বিচক্ষণ দেশনায়ক হিসেবে চৌ এন লাইকে আমি চিরকাল মনে রাখব।