কলেরায় উজাড় কোনো গ্রামের মতো পড়ে আছে জলেশ্বরী। কুকুরগুলো পর্যন্ত পথে নেই। অন্ধকারে নিঃশব্দে সন্তৰ্পণে মোড়ের কাছে এসে দাঁড়ায় বিলকিস আর সিরাজ। কাপ বন্ধ একটা পানের দোকানের পেছনে গা ঢাকা দিয়ে বড় সড়কের দিকে দৃষ্টিপাত করে।
এখন চাঁদ উঠে গেছে। পেট উঁচু তার ঘোলাটে আলোয় সড়কটিকে অস্বাভাবিক স্থির এবং অন্য কোনো জনপদের বলে মনে হয়।
দূরে একটা শব্দ পাওয়া যায়।
ওরা এখনো আছে।
ফিসফিস করে ওঠে সিরাজ।
শব্দ পাওয়া যায়, কিন্তু শব্দের উৎস দেখা যায় না। ফলে সতর্ক থাকতে হয় আরো বেশি করে। কখন কোথা থেকে উদিত হয়, কে জানে!
পায়ের শব্দ মসিমস করে। নিস্তব্ধ রাতের ভেতরে সামান্য শব্দও তীব্ৰ আকার ধারণ করে। দিকভ্রম হয়ে শ্রোতার। বিলকিস আর সিরাজ অনবরত ডাইনে-বায়ে দেখে। এমনকি পেছনেও, যেখানে খাড়া দেয়াল উঠে গেছে পরিত্যক্ত কালী মন্দিরের।
মনে হচ্ছে, ভালো করেই টহল দিচ্ছে।
দেখতে পেলেও হতো।
দেখতে পেলে টুক করে পেরিয়ে যাওয়া যেত বড় সড়ক। এখন ঝুঁকি অনেক। যদি দেখে ফেলে, বন্দুক ছুঁড়তে ছুঁড়তে ওরা পেরিয়ে যাবে সত্যি, কিন্তু হুঁশিয়ার হয়ে যাবে। বেজায়গায় আটকে পড়তে হবে। তারচে অপেক্ষা করাই ভালো।
সিরাজ?
কী?
শব্দের দিকে কান রেখে ফিসফিস করে বিলকিস বলে, এখনো তুমি ফিরে যেতে পার। সিরাজ কিছু বলে না।
খোকা সত্যি নেই?
মকবুলদাও বললেন।
তুমি তো দেখে এলে, তখন লোক ছিল না।
তখন মনে হলো, কেউ নেই। এখন আবার শব্দ শুনছি।
মোক্তার সাহেব আর কী বললেন?
কীসের কথা?
খোকা।
আপনাকে বলা যাবে না।
যাবে। আমার কিছু হবে না।
সিরাজ চিন্তা করে খানিকক্ষণ। মটাস করে একটা শব্দ হয়।
ও কী?
কলা গাছের পচা পাতা খসে পড়ল।
কালী মন্দিরের ওপাশে কলা গাছের মাথাগুলো বাতাসে দোলায়।
খোকার কথা বল। কী বলেছেন মোক্তার সাহেব?
খোকার লাশের কাছে নিয়ে বলেছে, এই দ্যাখ কাদের মাস্টারের ছেলে। তারপর লাঠি দিয়ে মোক্তার সাহেবের তলপেটে বার বার খোঁচা দিয়েছে।
কেন?
ইতস্তত করে সিরাজ।
কেন খোঁচা দিয়েছে?
লাশের ওপর প্রস্রাব করতে বলে।
সিরাজ বলে, অনেকবার খুঁচিয়েছে। তারপর উনি অজ্ঞান হয়ে যান। ওরা হয়তো করেছে।
শিউরে ওঠে বিলকিস। নিঃশব্দ অস্থিরতায় সে মাথা এপাশ-ওপাশ করতে থাকে। তবু চোখের ওপর থেকে সরে যায় না। খোকার মুখ সে দেখতে পায়।
ও কী করেছিল। সিরাজ? ওদের এত রাগ কেন?
ঠোঁটের ওপর তর্জনী রাখে সিরাজ। কান খাড়া করে। এক পা এগিয়ে যায়। দোকানের আড়াল থেকেই গলা বাড়িয়ে দেখে। তার পর হাত নেড়ে ইশারা করে বিলকিসকে।
চলে আসুন। আমি আগে যাচ্ছি। ওপারে গিয়ে হাত দেখালে আসবেন।
প্রায় হামা দিয়ে সড়কটা পার হয়ে যায় সিরাজ। মিলিয়ে যায় ওপারের দুবাড়ির মাঝখানে আটকে পড়া অন্ধকারে। আবার তাকে দেখা যায়, খুব অস্পষ্টভাবে। সিরাজ গলা বাড়িয়ে আবার ডাইনে-বায়ে দ্যাখে। তারপর হাত তুলে সংক্ষিপ্ত ইশারা করে অন্ধকারে গলা টেনে নেয়।
ঘোলাটে চাঁদের আলোর ভেতরে সড়কটা পেরুতে গিয়ে মুহূর্তের জন্যে নিজেকে জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে স্তম্ভিত বলে বোধ হয় বিলকিসের। অন্ধকারের নিরাপত্তা উষ্ণ মনে হয়। সিরাজ তার হাত ধরে, কোনো কথা না বলে দু বাড়ির ফাঁক দিয়ে দ্রুততর করে টেনে নিয়ে যায়। অনেকটা দূরে গিয়ে একটা জলা জায়গা পড়ে। পাকের পচা গন্ধ নাকে এসে জ্বালা ধরায়।
দূরে একটা কুকুর ডেকে ওঠে।
সড়কে টহলদারের পায়ের মসমস শব্দ ছাড়া এই প্রথম জীবিত কারো সাড়া পাওয়া গেল। কান খাড়া করে রাখে তারা। কুকুরটা হয়তো এক্ষুনি ঘেউ ঘেউ করে উঠবে। সন্দিগ্ধ হয়ে উঠবে টহলদারেরা।
চাপা গলায় সিরাজ বলে, এইজন্যেই সোজা ছুটে এসেছি। এদিকে সরে না এলে ভয় ছিল।
একটা বিপদ পেরুবার উল্লাস লক্ষ করা যায় সিরাজের গলায়।
কুকুরটা ডাকে না।
যাক, এমনিতেই ডেকে ছিল।
আপা, এই জলার ধার ঘেঁষে যেতে হবে। মোটেই জায়গা নেই। ফসকালেই পাঁকে গিয়ে পড়বেন।
জলার ওপারে কবেকার সিংহ বাবুদের লাল একতলা দালান। বহু দিন আগেই কলকাতায় চলে গেছে। ওরা। বাড়িতে কালী মন্দিরের পুরোহিত থাকত। তার কোনো খোঁজ নেই। চাদের আলোয় দরোজা-জানালা ভাঙা দালানটিকে এক ধরনের নির্মাণ বলে বোধ হয়।
আমার হাত ধরুন।
প্রথমে খুব ধীরে পা ফেলে ওরা। তারপর সাহস বাড়ে কিংবা অভ্যোস হয়ে যায়, গতি কিছুটা দ্রুতি পায়।
জলা পেরিয়ে কাছারি পাড়ার পেছন দিয়ে অনেকটা যাওয়া যাবে। প্রায় অর্ধেক রাস্তা।
পাঁকের ভেতর হঠাৎ পা বসে যায় বিলকিসের। অস্ফুট ধ্বনি করে উঠতেই সিরাজ তাকে দুহাতে টান দেয়। কাদায় সংক্ষিপ্ত মন্থর শব্দ উঠে আবার সব নীরব হয়ে যায়। বিলকিসের দ্রুত শ্বাস নেবার শব্দ শোনা যায়।
দাঁড়াও, শাড়িটাকে ঠিক করে নিই।
এখন চলে আসুন, ওপারে গিয়ে করবেন। সাপ-খোপের জায়গা।
ওপারে এসে বিলকিস হাঁপাতে থাকে।
একটু দাঁড়িয়ে যাবেন?
না, না।
একটা জায়গায় জন্ম নিলেই কি তার প্রতিটি ধূলিকণা, গাছ, আকাশ, চাঁদ, বাড়ি চেনা হয়ে যায়? কাছারি পাড়ার পেছনে যে এত ঘন বন, আগে কখনো জানা ছিল না বিলকিসের। পাড়ার সড়ক দিয়ে যাতায়াত করছে। পেছন থেকে এখন পাড়াটিকে সম্পূর্ণ নতুন আর অচেনা মনে হয়।
ঠিক বন নয়। অসংখ্য আম, লিচু, জামের গাছ। বকশি বাবুদের বাগান বাড়ি ছিল।
বকশি বাবুদের বাগানে রাস্তা ভালো, আপা। শুধু খেয়াল রাখবেন, অনেক শুকনো পাতা তো, শব্দ না হয়। এখান থেকে সোজা শর্টকাট করে পোস্টাপিসের পেছনে গিয়ে পড়ব। তারপর বাজারের রাস্তা। আগে পোস্টাপিস পর্যন্ত যাই তো।
যে সিরাজ আলেফ মোক্তারের বাসায় ইতস্তত করছিল, আপত্তি করছিল, সেই সিরাজই এখন হাল হাতে নিয়েছে।
চাঁদের আলোয় বিচিত্র হয়ে উঠেছে বনের তলদেশ।
বিলকিস বলে, তুমি তো বললে না, ওদের এত রাগ কেন খোকার ওপর?
খোকা ভাইয়ের খুব ভালো গলা ছিল গানের।
রংপুর রেডিও থেকে দুদিন গান করেছিল। ঢাকায় আমার কাছে আসতে চেয়েছিল। ঢাকা রেডিও থেকে গান গাইবার খুব শখ ছিল। তুমি চিনতে খোকাকে?
চিনতাম। আলাপ ছিল না আপা।
কেন খোকার লাশের ওপর ওরা ওরকম করল?
বোধহয়, গান গাইত, খোকা ভাই এখানে সবাইকে আমার সোনার বাংলা শিখিয়েছিল। মার্চ মাসের মিছিলগুলোতে খোকা ভাই সবার আগে থাকত, একেকটা মোড়ে দাঁড়িয়ে সকলে আমার সোনার বাংলা গাইত। সবার চোখে পড়ে গিয়েছিল খোকা ভাই। কেন পালিয়ে যায় নি?
সকলে তো পারে না। আমিও পারি নি।
মা বুড়ো মানুষ। বোধহয় তাই যায় নি।
খোকা ভাই কিন্তু মোটেই পথে বেরুত না। কী করে যে ধরা পড়ল?
বাড়ি থেকে?
না। মকবুলদা বলল, ছেলেরা যখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে সরে যেতে বলে, খোকা ভাই তখন বাড়িতে ছিল না।
কোথায় গিয়েছিল তবে?
নীরবে দুজনে বাগানটা পেরোয়। প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ফাঁকে ফাঁকে এখনই দেখা যাচ্ছে পোস্টাপিসের হলুদ দালান। দালানের পাশ ঘিরে ছোট একটা বাঁশবন। পতাকাশূন্য দণ্ডের মতো খোলা আকাশে স্থির হয়ে আছে।