০৭. খুব ভোরে পাখির কিচকিচি শব্দে

খুব ভোরে পাখির কিচকিচি শব্দে লিলিযানের ঘুম ভেঙেছে। এত পাখিকে সে একসঙ্গে কখনো ডাকতে শুনে নি। তাহেরকে ডেকে তুলে পাখির গান শোনাতে ইচ্ছা করছে। ডেকে লাভ হবে না। এত ভোবে সে উঠবে না। ছুটিব দিনে নটা-দশটার আগে তার ঘুম ভাঙে না। এখন তো প্রতিদিনই ছুটি। লিলিয়ান বিছানা ছেড়ে বাগানে গেল। কাল বাতে যে বাগানটাকে ভয়াবহ জঙ্গল বলে মনে হচ্ছিল এখন তা মনে হচ্ছে না। ঝোপঝাড় ঠিকই আছে, ঝোপঝাড়েবা জন্যেই ভালো লাগছে। বাগানটা বেশ বড়, বেশির ভাগ গাছই তার অচেনা। তাহেরের কাছ থেকে গাছের নামগুলি জেনে নিতে হবে। একটা বড় গাছেব সামনে লিলিয়ান থমকে দাঁড়াল। এ গাছটা চেনা চেনা লাগছে। মনে হচ্ছে ওলিভ গাছ। এ দেশে কি ওলিভ গাছ হয়? একেক দেশে একেক রকম গাছ, সেই হিসেবে মানুষেবাও তো একেক রকম হওযা উচিত। এ বিষয়ে তাহেরের মতামত কী জিজ্ঞেস করতে হবে।

একটা গাছের নিচটা বাঁধানো। এখানে বসে, ব্রেকফার্স্ট খেলে কেমন হয়? তাহেরকে বললে সে হয়তো আবার মুখ বাকিয়ে বলবে–তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছি।

লিলিয়ানের ধারণা, সে মোটেই বাড়াবাড়ি করছে না। এই যে বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছে এটা কি বাড়াবাড়ি? নিশ্চয়ই বাড়াবাড়ি না। সে দেখছে মোট কত ধরনের গাছ। এখানে আছে।

ইস্কান্দর আলীর সঙ্গে বাগানেই লিলিয়ানের দেখা হলো। তিনি সকালের নাস্তা নিয়ে এদিকে আসছেন। এক হাতে টিফিন ক্যারিয়ার, অন্য হাতে ফ্লাস্ক। লিলিয়ানকে দেখে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। লিলিয়ান বলল, গুড মর্নিং!

তিনি হাসিমুখে মাথা নাড়লেন। লিলিয়ান বাংলায় থেমে থেমে বলল, আপনি কেমন আছেন?

ইস্কান্দর আলী থতমত খেয়ে বললেন, জ্বে ভালো। এইখানে কী করেন?

আমি বাগান দেখছি।

বাগানে দেখার কিছু নাই। সাপের আড্ডা। প্রতি বছর একটা-দুইটা গরু মরে। সাপ চিনেন তো?

জ্বি, আমি সাপ চিনি।

বড়ই ভয়ঙ্কর জিনিস। চলেন উপরে যাই। নাশতা নিয়া আসছি। খিচুড়ি আর ডিমের তরকারি। গৈ-গোরাম জায়গা। কিছু পাওয়া যায় না। সব জিনিস শহর থাইক্যা আনা লাগে। অনেক খরচ পড়ে।

লিলিয়ান সব কথা বুঝতে না পারলেও আন্দাজ করছে–এই মানুষটি বলছে, শহর থেকে জিনিস আনতে হয় বলে টাকা বেশি লাগে। লিলিয়ান বলল, আপনি তাহেরকে বলবেন, ও টাকা দেবে।

বলতেও শরম লাগে। কত টেকা সে আনছে কিছুই তো জানি না।

ও যথেষ্ট টাকা-পয়সা এনেছে। আমরা বাড়িঘর ঠিক করব, টাকা লাগবে।

বাড়িঘর ঠিক কইরা ফয়দা কী? কে থাকব?

আমলা থাকব। আচ্ছা, আপনি বলুন তো এই গাছটার কী নাম?

জলপাই গাছ।

আমি ঠিক করেছি আমি এবং তাহের এই গাছের নিচে বসে সকালের ব্রেকফার্স্ট করব। কাউকে দিয়ে কি পরিষ্কার করিয়ে দিতে পারবেন?

পারব। কিছু খরচ-বরচ লাগবে। টেকা ছাড়া কাউবে দিয়া কিছু করন যায় না। যে যুগের যে ভাও। দুনিয়া গেছে উল্টাইয়া।

লিলিয়ান ইস্কান্দর আলীকে নিয়ে বাগানে ঘুরছে। গাছের নাম জিজ্ঞেস করছে। অনেকগুলি নাম লিলিয়ান শিখে ফেলল–আমগাছ, তেঁতুলগাছ, বেলগাছ, কাঁঠালগাছ, জলপাইগাছ, গাবগাছ… ।

লিলিয়ানের খুব ভালো লাগছে। তাহেরের ঘুম না ভাঙা পর্যন্ত সে বাগানে বাগানে ঘুরল।

তাহের নাশতা খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। দুপুরেব খাবার খেয়েও ঘুমুতে গেল। তার ঘুম ভাঙল বিকেলে। সে হাসিমুখে বলল, ইচ্ছা করে ঘুম স্টক করে নিয়েছি। আজ রাত জাগাব। তোমাকে নিয়ে ছাদে বসে থাকব। কাল ছাদে যাওয়া হয় নি। আজ হবে। ছাদটা সুন্দর। ছাদ থেকে ব্ৰহ্মপুত্র পরিষ্কার দেখা যায়। ব্ৰহ্মপুত্র নদীতে নৌকাভ্রমণ করতে চাও?

চাই।

দেখি খোঁজ করে।

তাহের হাই তুলতে তুলতে বলল, বেশি ঘুমানোর প্রবলেম কী জানো? নেশা লেগে যায়। তখন শুধু ঘুমুতে ইচ্ছা করে।

তুমি কি আবার ঘুমুবে?

না।

বাগানে যাবে? চল বাগানে যাই। বিকেলের চাটা বাগানে বসে খাই।

ওরে সর্বনাশ! বিকেলে বাগানে যাওয়াই যাবে না। বিকেলে সাপরা খুব উত্তেজিত থাকে। বিকেলে দোতলা থেকে নিচে নামাটা হবে চরম বোকামি। বরং চল ছাদে বসে চা খাই।

বেশ চল।

তোমাকে আরেকটা কথা বলা দরকার। আজ রােতই কিন্তু এ বাড়িতে আমাদের শেষ রজনী। কাল ভোরে আমরা চলে যাব। তোমার যা দেখার দেখে নাও। ছবি তুলতে চাইলে ছবি তোল। ক্যামেরাটা বের কর তো?

লিলিয়ানের মন খারাপ হয়ে গেল। আজই শেষ রজনী? লিলিয়ান কিছু বলল না। ছবি তোলার ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহ দেখা গেল না।

 

বিকেলে ছাদে। চা খাওয়া হলো না। কারণ ছাদের দরজার চাবি নেই। ছালাম চাবি নিয়ে এলো অনেক রাতে। সেই চাবিতে তালা না খোলায় তালা ভাঙতে হলো। ছাদে পাটি পেতে বিছানা করতে করতে রাত দশটার মতো বেজে গেল। লিলিয়ানের খুব শখ ছিল শাড়ি পরবে। শাড়ি জোগাড় হয় নি। সে তার সবচে সুন্দর ড্রেসটি পরে ছাদে বসে আছে। তাহের ছালামকে বিদেয় করে ছাদে আসবে। সে আসতে খুব দেরি করছে। একা একা ছাদে পসে থাকতে লিলিয়ানের খুব খারাপ লাগছে না। বরং ভালোই লাগছে। তবে আজ গত রাতের মতো জোছনা হয় নি। আকাশে মেঘ। মরা জোছনা।

তাহের ছাদে এলো এগারটার দিকে। বিরক্তমুখে বলল, লিলিয়ান, ছাদের প্রোগ্রামটা–আধঘণ্টা পিছিয়ে দিতে হবে। আমার চাচা খবর পঠিয়েছেন। অত্যন্ত জরুরি কী কথা না-কি এই মুহুর্তে আমাকে বলা দরকার। তার হাঁপানীর টান উঠেছে। তিনি আসতে পারছেন না। তুমি শোবার ঘরে গিয়ে বসে। আমি ফিরে এসে তোমাকে নিয়ে ছাদে যাব।

তারা ছাদ থেকে নেমে এলো। লিলিয়ান বুঝতে পারছে তাকে একা ফেলে তাহেরের যেতে ইচ্ছা করছে না। লিলিয়ান বলল, আমিও যাই তোমার সঙ্গে?

তিনি বলে দিয়েছেন আমি যেন একা। যাই। তোমার ভয়ের কিছু নেই। তাঁর বড় ছেলেটা এখানে থাকবে।

আমি মোটেও ভয় পাচ্ছি না। তবে উনার ছেলে এখানে না থাকলে ভালো হয়। ছেলেটাকে আমার পছন্দ না। সারাক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তোকানোর ধরনটা ভালো না।

তাকানোর ধরন ঠিকই আছে। ওরা কখনো বিদেশী মেয়ে দেখে নি। তোমাকে অবাক হয়ে দেখছে। এতে যে তুমি অস্বস্তিবোধ করতে পার সেই জ্ঞান ওদের নেই। তাছাড়া সে থাকবে একতলায়, তুমি দোতলায়–অসুবিধা কী। পারবে না। আধঘণ্টা থাকতে?

পারব।

সিঁড়ির দরজাটা বন্ধ করে দিও।

আচ্ছা।

আমি মোটেও দেরি করব না। কথাটা শুনব আর চলে আসব। তাদের যদি ভালো

কোনো শাড়ি থাকে তোমার জন্যে নিয়ে আসব।

থ্যাংকস।

লিলিয়ান সিড়ির দরজা বন্ধ করে শোবার ঘরে চলে এলো। তার হাতে হারিকেন। তাকে একা এক আধঘণ্টা সময় কাটাতে হবে। আধঘণ্টা সময় কিছুই না। দেখতে দেখতে কেটে যাবে। হিথ্রো এয়াবপোর্ট থেকে তাহের ডাটি জোকস-এর একটা বই কিনেছে। নোংরা রসিকতা পড়তে ভালো লাগে না। তবু সময় কাটানোর জন্যে নিশ্চয়ই পড়া যায়।

লিলিয়ান শ্বেতপাথরের টেবিলে হারিকেন নামিয়ে রাখল। হারিকেনের সম্ভবত কোনো সমস্যা হয়েছে। শিখা দপদপ করছে। নিভে যাবে না তো? লিলিয়ান তাকিয়ে আছে হারিকেনের শিখার দিকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই কোনোরকম কারণ ছাড়া আচমকা তীব্ৰ ভয়ে লিলিয়ান আচ্ছন্ন হয়ে গেল। তার মনে হলো— ভয়ঙ্কর কোনো বিপদ ঘটতে যাচ্ছে। তাহের কিছুক্ষণের মধ্যেই ভয়াবহ কোনো বিপদে পড়বে। লিলিয়ান যন্ত্রের মতো পরপর তিনবার বললে, Oh God! Save him Please, Save him… পরম করুণাময় ঈশ্বর। তুমি আমার স্বামীকে রক্ষা কর।

লিলিয়ানের সামনে রাখা হারিকেন নিভে গেল। সে স্পষ্ট শুনল খুব হালকা পায়ে কে যেন আসছে তার ঘরের দিকে। যে আসছে তার পা ছোট ছোট, সে পা ফেলছে খুব সাবধানে। দরজার কাছে এসে সে থমকে দাঁড়িয়েছে, এক হাতে দরজা ধরেছে তা বুঝা যাচ্ছে। দরজায় ক্যাচর্ক্যাচ শব্দ হলো। এর উপস্থিতিই কি লিলিয়ান টের পাচ্ছিল? কে, এ কে? লিলিয়ান আতঙ্কে অস্থির হয়ে কাঁপা গলায় বলল, কে? কে? Who is there?

ছোট্ট করে কে যেন নিঃশ্বাস ফেলল। ছোট নিঃশ্বাস, কিন্তু লিলিয়ান স্পষ্ট শুনল। সে কি তার নিজের নিঃশ্বাসের শব্দই শুনেছে? ভয় পেলে মানুষের মস্তিষ্ক ঠিক কাজ করে না। তারও কি তাই হয়েছে? ডা. ভারমান নিশ্চয়ই এর চমৎকার ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। কিন্তু তার কাছে কোনো ব্যাখ্যা নেই।

 

তাহের সিগারেট ধরিয়েছে। বর্ষাকাল হলেও কয়েকদিন বৃষ্টি না হওয়ায় রাস্তাঘাট শুকনো। একজন যাচ্ছে সামনে সামনে। তার হাতে টর্চলাইট। সে টর্চের আলো ফেলছে। তাহেরের সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছে চারজন যুবক। একজনের নাম তাহের জানেছালাম। চাচার মেজো ছেলে। সে আসছে সবার পেছনে। বাকি তিনজন কে? এরা সঙ্গে যাচ্ছে কেন? কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হচ্ছে না। ওরাও কিছু বলছে না। চাচার এমন কী জরুরি কথা থাকতে পারে? জমিজমা সম্পর্কিত কিছু? তাহেরের পৈতৃক জমি নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। যা হবার হবে। এগুলি হাতছাড়া হয়ে একদিকে ভালো হয়েছে। বন্ধনমুক্ত হওয়া গেছে। জমির কারণে তার বাবাকে অপঘাতে মরতে হয়েছে। এই অভিশাপ থেকে তাহের মুক্তি চায়। তবে বাড়িটা সে রাখবে। সংস্কার করাবে। লিলিয়ানের যখন এত পছন্দ। তাদের ছেলেমেয়েরা বড় হলে এদের দেখাতে নিয়ে আসবে। কে জানে বৃদ্ধ বয়সে সে নিজেও হয়তো ফিরে আসবে। সে এবং লিলিয়ান জীবনের শেষ সময়টা কাটাবে নদীর ধারের এই বিশাল বাড়িতে। ততদিনে গ্রামে গ্রামে ইলেকট্রিসিটিও নিশ্চয়ই চলে আসবে।

দলটা নদীর পাড়ে এসে থমকে দাঁড়াল। তাহের বলল, এখানে কী? টর্চ হাতের ছেলেটা বলল, নদীর হেই পাড়ে যাওয়া লাগব।

তাহের বিস্মিত হয়ে বলল, নদীর ঐ পাড়ে কেন? ঐ পাড়ে কী? ছালাম তুমি এদিকে এসো। তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি।

ছালাম এলো না। সে দ্রুত সরে গেল। গেল নদীর দিকেই। সেখানে ঝাঁকড়া একটা পাকুর গাছ। পাকুর গাছের ডালের সঙ্গে নৌকা বাধা। চাঁদ উঠে নি। চারদিক অন্ধকার। নক্ষত্রের আলোয় কিছু দেখা যাচ্ছে না। অসংখ্য বিঝি পোকা ডাকছে। Something is very wrong, তাহের দ্রুত ভাবতে চেষ্টা করছে। চারজন যুবক তাকে ঘিরে আছে কেন? এরা নদীর পাড়ে তাকে নিয়ে এসেছে কেন? হত্যা করতে চায়? কোন চায়? টাকা-পয়সার জন্যে? মানুষ খুন করা এত সহজ।

টর্চ হাতের লোকটা বলল, আসেন নৌকায় আসেন।

তাহের কি দৌড়ে পালিয়ে যাবাব চেষ্টা করবে? পারবে পালাতে? এমনও তো হতে পাবে পুবো ব্যাপাধটা কিছুই না। সে ভয। পাচ্ছে বলেই আজেবাজে চিন্তা করছে। হয়তো তার চাচা নদীর ঐ পারে আরেকটা বাড়ি করেছেন। এই ছেলেগুলিকে রাখা হয়েছে বাড়ি পাহারার জন্যে।

খাড়াইযা আছেন ক্যান? আসেন। দেবি কইরা তো কিছু লাভ নাই।

তাহের যন্ত্রের মতো এগুলো। পাকুব গাছের কাছে চাদর গায়ে আর একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। এই গবমে। তার গায়ে চাদর কেন? লোকটা নৌকায় উঠে বসল। তাহের এগুলো যন্ত্রের মতো।

সবাই নৌকায় উঠল না। ছালাম এবং টর্চ হাতে ছেলেটা পাকুর গাছের নিচে দাঁড়িয়ে রইল। দুজন তাহেরের দুহাত ধরে নৌকায় প্রায় টেনে তুলল। চাদর গায়ের লোকটা ছাড়াও নৌকার একজন মাঝি আছে। মাঝি সঙ্গে সঙ্গে নৌকা ছেড়ে দিল। চাদর গায়ের লোকটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আইজ গরম বড় বেশি পড়ছে।

লোকটির গলার স্বরে বোঝা যাচ্ছে সে বৃদ্ধ। তাহেরেব বলার ইচ্ছা করছে— গরম বেশি কিন্তু আপনি চাদর গায়ে দিয়েছেন কেন? তাহের কিছুই বলল না। তাহেরের হাতে সিগারেট, প্যাকেট থেকে বের করে হাতে নিয়েছে। আগুন ধরাতে ভুলে গেছে। যদিও আগুন নেই। তবু তাহের অভ্যাস মতো সিগারেট মুখে দিচ্ছে এবং টানছে।

চাদর গায়ে বুড়ো লোকটি খুকধুক করে কেশে বলল, নৌকা মাঝগাংগে নিয়া চল। লোকটির মাথা থেকে চাদর সরে গেছে। তার মাথার সব চুল সাদা। থুতনির কাছে অল্প কিছু দাড়ি। দাড়ির রঙ কালো। তাহেরের মনে হলো তার বুকের উপর দিয়ে বরফ শীতল পানির একটা স্রোত বয়ে গেল। এরা তাকে খুন করার জন্যে এখানে নিয়ে এসেছে। গ্রামের সব খুনখারাপ হয় নদীর কাছে। নদী হত্যার চিহ্ন ধুয়ে মুছে ফেলে। জলধারার প্রবল স্রোত মৃতদেহ অনেক দূর নিয়ে যায়। জলজ প্রাণী অতি দ্রুত মৃতদেহ নষ্ট করে দেয়। চেনার উপায় থাকে না।

বুড়ো বলল, আপনের সিগারেট নিভা। সিগারেট ধরান। সিগারেট ধরাইয়া আরাম কইরা একটা টান দেন। আহ শালার গরম কী পড়ছে!

তাহেরের বা হাতটা একজন ধরেছিল। সে হাত ছাড়ল। তাহের পকেট থেকে দেয়াশলাই বের করল। তাকাল বুড়োর দিকে। মনে হচ্ছে এই বুড়েই হত্যাকারী। বুড়ো বন্দুক আনে নি। নিশ্চয়ই চাদরের নিচে ছোরা নিয়ে এসেছে। খোলা জায়গায় বন্দুকের আওয়াজ অনেক দূর পর্যন্ত যাবে। সেই তুলনায় ছোরা অনেক নিরাপদ।

বুড়ে বলল, ধরান সিগারেট ধরান।

তাহের সিগারেট ধরানোর চেষ্টা করছে। ধরাতে পারছে না। বাতাসের বেগ প্ৰবল। তাছাড়া তার হাত কাঁপছে। দেয়াশলাইয়ের চারটি কাঠি নষ্ট হবার পর, পঞ্চম কাঠিটি ধরল। তীব্র ঘামের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ঘামের গন্ধে তার বমি এসে যাচ্ছে।

তাহের দেখল। সবাই এক দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। কেউ মুহুর্তের জন্যেও দৃষ্টি ফিরিয়ে নিচ্ছে না। বুড়ো লোকটির মুখ হাসি হাসি। চাঁদের আলোয় হাসিমুখের এই বুড়োকে কী ভয়ঙ্করই না লাগছে।

 

লিলিয়ানের শোবার ঘর অন্ধকার। হারিকেন নিভে যাওয়ার পর সলতা থেকে বিশ্ৰী ধোঁয়া আসছে। লিলিয়ানের নাক জ্বালা করছে। ঘরে কি কার্বন মনোক্সাইড তৈরি হয়েছে? তার কি ঘর ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত? সিড়ির দরজায় ধাক্কার শব্দ হলো। ভারী গলায় কে বলল–দরজা খুলেন।

লিলিয়ান বলল, কে?

খবর আছে। দরজা খুলেন, Urgent খবর।

লিলিয়ান সিড়ির দরজার কাছে চলে এলো। দরজা খুলল না। তার মন বলছে–দরজার আড়ালে অপেক্ষা করছে ভয়ঙ্কর বিপদ।

খুলেন দরজা। খুলেন।

কে যেন প্ৰচণ্ড শব্দে ধাক্কা দিচ্ছে। লিলিয়ান বলল, Go away.

দরজায় হিংস্র পশুর থাবার মতো থাবা পড়ছে। একজন না, কয়েকজন। লিলিয়ানের মনে হলো–খুব কম করে হলেও তিনজন আছে। লিলিয়ান খিকখিক হাসব শব্দও শুনিল। তিনজনের কোনো-একজন আনন্দে হাসছে। এই আনন্দোবী উৎস কী?

ঐ সাদা চামড়া, দরজা না খুইল্যা কতক্ষণ থাকিবি? আপাসে দরজা খোল।

লিলিয়ান নড়ল না। দাঁড়িয়ে রইল। প্রাচীন ভারী দরজা চট করে ভাঙবে না। ভাঙতে সময় লাগবে। কতক্ষণ সময় লিলিয়ান জানে না। তাহের ফিরে আসা পর্যন্ত কি দরজা তাকে রক্ষা করবে? কিন্তু তাহের? ও কেমন আছে? তারও কি লিলিয়ানের মতোই বিপদ হয় নি? সে কি ফিরে আসতে পারবে? অনেক দিন পর লিলিয়ান তার মাকে ডাকল। ফিসফিস করে বলল, মা, আমি খুব বিপদে পড়েছি।

প্ৰচণ্ড শব্দ হচ্ছে দরজায়। এরা দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে। লিলিয়ান কাঁপা গলায় বলল, ঈশ্বর আমাকে রক্ষা কর। দরজার সামনে থেকে তার সরে যাওয়া উচিত। লিলিয়ান সরতে পারছে না। তার পা সিসের মতো ভারী হয়ে আছে–দরজার বাইরের মানুষগুলি পশুর মতো গর্জন করছে।

ভাঙ দরজা। ভাইঙা ধর সাদা চামড়ারে।

দরজা ভেঙে পড়ার কয়েক মিনিট আগে লিলিয়ান সংবিত ফিরে পেল। প্রথম দৌড়ে ঢুকল শোবার ঘরে। সেখান থেকে ছুটে গেল আয়নাঘরে। কোথাও লুকিয়ে থাকতে হবে। আয়নাঘরে লুকানোর জায়গা কোথায়? কাবার্ড কাবার্ড খুলে ভেতরে বসে থাকবে।

লিলিয়ান কাবার্ড খুলে ভেতরে ঢুকল, আর তখনই তিনজনের একটা দল দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে পড়ল। এই দলের একজন নিতান্ত চ্যাংড়া। তার হাতে পাঁচ ব্যাটারির একটা টর্চ। তার বয়স পনের-ষোলর বেশি না। সে খিকখিক করে হাসতে হাসতে বলল–মেম মাগি গেছে কই?

একজন বলল, পালাইছে। হয় খাটের নিচে নয়। আলমিরার ভিতরে।

লিলিয়ান এদের কথা শুনতে পারছে, কিন্তু গ্ৰাম্য টানা টানা কথার অর্থ ধরতে পারছে না। লিলিয়ানের মনে হচ্ছে কাবার্ডে ঢুকে সে বড় ধরনের বোকামি করেছে। এরা প্রথমেই কাবার্ডগুলি খুঁজবে। এক এক করে খুঁজবে। তার উচিত কাবার্ড থেকে বের হয়ে আসা। খোলামেলা জায়গায় থাকা যাতে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করতে পারে। কোণঠাসা হয়ে ধরা পড়ার কোনো মানে হয় না।

ওরা হারিকেন জ্বালিয়েছে। হারিকেন নিয়ে আয়নাঘরেই বোধহয় আসছে। লিলিয়ান কাবার্ড ছেড়ে পালাবার জন্যে কাবার্ডের দরজায় হাত রাখল, আর ঠিক তখন কাবার্ডের ভেতর কী যেন একটা নড়ে উঠল। ঝুনঝুন শব্দ হলো। একজন কেউ কোমল ভঙ্গিতে হাত রাখল তার পিঠে। লিলিয়ান ছোট্ট একটা নিঃশ্বাসের শব্দও যেন শুনল।

কী হচ্ছে লিলিয়ানের? সে কি পাগল হয়ে গেছে? তার কি হেলুসিনেশন হচ্ছে? সে এখন কী করবে? চিৎকার করে উঠবে? তাতে লাভ কী? পিঠে যে হাত রেখেছে সে হাত সরিয়ে নিচ্ছে না। যেন তাকে বলার চেষ্টা করছে–ভয় নেই। কোনো ভয় নেই। আয়নাঘরে তুমি নিশ্চিন্ত মনে অপেক্ষা কব। এরা তোমাকে কিছুতেই খুঁজে পাবে না। লিলিয়ান মনে মনে বলল, আপনি যেই হোন, আমার স্বামীকে রক্ষা করার চেষ্টা করুন। ও বিপদে পড়েছে। ওব বিপদ আমার চেয়েও ভয়ঙ্কর বিপদ। আমি বুঝতে পারছি। আমি খুব পবিষ্কার বুঝতে পারছি।

 

তাহেরের সিগারেট অনেক ছোট হয়ে এসেছে। সিগারেটের শেষ অংশ এখনই নদীর জলে ফেলে দিতে হবে। এরা সম্ভবত সিগারেট শেষ করার জন্যে অপেক্ষা করছে। তাহের বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি কী চান?

বৃদ্ধ খিকখিক করে খানিকক্ষণ হাসল। সে একাই হাসছে। অন্য কেউ হাসছে না। বৃদ্ধ হাসি থামিয়ে বলল, বিলাত দেশটা কেমন এন্টু কন তো হুনি।

বিলেতের খবর আমি জানি না। আমি থাকি আমেরিকায়।

আমার কাছে আমরিকা বিলাত এক জিনিস।

বৃদ্ধ চাদরের নিচে হাত ঢুকালো। তাহের জ্বলন্ত সিগারেট হাতে লাফিয়ে পড়ল নদীতে। পানির টান প্রবল। তাহেরকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এরা কি তাহেরকে ছেড়ে দেবে? মনে হয় না। নৌকা নিয়ে এরা তাকে খুঁজবে। তন্নতন্ন করে খুঁজবে। তাহের ভাবার চেষ্টা করছে তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কতটুকু। খুব বেশি নয়। সম্ভাবনা ক্ষীণ, কারণ তাহের সাঁতার জানে না।

 

লিলিয়ান আয়নাঘরের কাবার্ডে বসে আছে। কী গাঢ় অন্ধকার! এই অন্ধকার মাতৃগর্ভের অন্ধকার। কোনো মানুষের পক্ষে এই অন্ধকার সহ্য করা সম্ভব নয়।

হঠাৎ করে অন্ধকার কমে গেল। তিনজনের দলটা আয়নাঘরে ঢুকল। কাবার্ডে বসে থাকার অর্থ হয় না। লিলিয়ান ঠিক করল সে দরজা খুলে বের হবে। বলবে, কী চাও তোমরা?

লিলিয়ান দরজা খুলতে পারল না। যে লিলিয়ানের পিঠে হাত রেখেছিল। সে এবাব লিলিয়ানের হাত চেপে ধরল। নরম হাত। হাত ভর্তি চুড়ি। রিনারিন করে চুড়ি বেজে উঠল। এসব কি স্বপ্নে ঘটছে?

টর্চ হাতের ছেলেটি বলল, কুদ্দুস ভাই, আমার মনে হইতেছে মেম সাব এই ঘরে। ছেন্টের গন্ধ পাইতেছি। মেম সাব শইল্যে ছেন্ট দিছে। হি হি হি… ।

লিলিয়ান শক্ত হয়ে আছে। এই বোধহয় কাবার্ডের দরজা খুলল। ঠিক তখন রান্নাঘরে ঝন করে শব্দ হলো। টিনের একটা কিছু মেঝেতে গড়িয়ে যাচ্ছে। দলেব তিনজনই ছুটে গেল রান্নাঘরের দিকে। দৌড়ে যাবার জন্যে হারিকেনটা নিভে গেল।

যে লিলিয়ানের হাত ধরেছে সে-ই তাকে কাবার্ড থেকে বের করল। টেনে নিয়ে যাচ্ছে পাশের ঘরে। চারদিকে জমাটবাধা অন্ধকার। চাঁদের আলো কোথায়? আজ কি চাঁদ উঠে নি? কিছুই দেখা যাচ্ছে না। লিলিয়ান অন্ধের মতো অনুসরণ করছে। তার বোধ লুপ্ত। সে কী করছে নিজেও জানে না। তারা দুজন এখন দাঁড়িয়ে আছে একটা পর্দার আড়ালে। এটা কোন ঘর? লিলিয়ানের সব এলোমেলো হয়ে গেছে। যে তার হাত ধরে আছে সে কে? বা আসলেই কি কেউ তার হাত ধরে আছে?

তিনজনের দলটি এ ঘরে এসেছে। তারা এখন খানিকটা বিভ্রান্ত। একজন বলল, গেল কই? বসির ভাই, গোল কই?

এই ঘর দেখা হইছে?

একবার দেখলাম।

আবার দেখ। পর্দা টান দিয়া ফেলা।

একজন এসে পর্দা ধরল। আর তখন শোবার ঘর থেকে খিলখিল হাসির শব্দ শোনা গেল। কিশোরীর মিষ্টি রিনারিনে গলা। টর্চ হাতের ছেলেটা বলল–হাসে কেডা বসির ভাই, হাসে কেডা?

তিনজন এগুচ্ছে শোবার ঘরের দিকে। এবার আর আগের মতো ছুটে যাচ্ছে না। কিশোরীর হাসির শব্দ আরো বাড়ল। তারপর হঠাৎ করে থেমে গেল। লিলিয়ান মনে মনে বলল, যা ঘটছে সবই আমার কল্পনা। আমার উত্তেজিত মস্তিষ্ক আমাকে এসব দেখাচ্ছে, শোনাচ্ছে। আসলে কেউ আমার হাত ধরে নেই। কেউ আমাকে টেনে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে না। আমি নিজেই জায়গা বদল করছি, এবং কল্পনা কবছি। প্ৰচণ্ড ভয়ের কারণে আমার এ রকম হচ্ছে? ডা. ভারমান আমাকে তাই বলতেন।

তারপরেও লিলিয়ান ফিসফিস করে বলল, আপনি কে?

ছোট্ট নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা গেল। কোনো জবাব পাওয়া গেল না। লিলিয়ান বের হয়ে এলো পর্দার আড়াল থেকে। নিজের ইচ্ছায় নয়–যে তার হাত ধরে ছিল সেই তাকে টেনে বের করল। সে চরকির মতো ঘুরছে–এ-ঘর থেকে ঐ-ঘরে। যেন এক মজার খেলা। এক সময় লিলিয়ান লক্ষ করল সে লোহার প্যাচানো সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে। বাইরের অন্ধকাব্য গাঢ় নয়। অস্পষ্টভাবে সবকিছুই দেখা যাচ্ছে। এখন আর কেউ তার হাত ধরে নেই। এতক্ষণ যা ঘটেছিল সবই কল্পনা। মস্তিষ্ক তার নিজস্ব নিয়মে তৈরি করেছে বিভ্ৰম, এবং তাকে নিয়ে এসেছে। ঘরের বাইরে। অশরীরী বলে কিছু নেই, কিছু থাকতে পারে না।

লিলিয়ান খুব সাবধানে লোহার সিঁড়ি দিয়ে নামছে এতটুকু শব্দও যেন না হয়। তাকে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে হবে। অনেক দূর যেতে হবে, যেন কেউ তার নাগাল না পায়। সিঁড়ি এত দুলছে কেন? মনে হচ্ছে ভেঙে পড়ে যাবে। খুব হাওয়া। উড়িয়ে নিয়ে যাবার মতো হাওয়া। এই ব্যাপারগুলি তো স্বপ্নে ঘটেছিল। এখনো কি সে স্বপ্ন দেখছে? পুরোটাই কি স্বপ্ন? লিলিয়ানের শরীর অবসন্ন, অসম্ভব ক্লান্ত। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। ইচ্ছা করছে সিঁড়ির রেলিং জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে। মনে হচ্ছে সে জেগে আছে হাজার বছর ধরে।

সে একতলায় নেমে এসেছে। তার সামনেই এ বাড়ির ভাঙা প্রাচীর। ফিসফিস কথা শোনা যাচ্ছে। নিচেও কি কেউ অপেক্ষ ধরছে তার জন্যে? না-কি ওরাই নেমে এসেছে নিচে? দোতলা থেকে টর্চের আলো ফেলল। সিঁড়িতে। আলো এদিক-ওদিক যাচ্ছে। খুঁজে বেড়াচ্ছে লিলিয়ানকে। আর একটু হলেই সে অ্যালো পড়ত লিলিয়ানের মুখে। লিলিয়ান ক্লান্ত গলায় ফিসফিস করে বলল, আমাকে সাহায্য করুন। আমাকে সাহায্য করুন, Please help me.

কার কাছে সে সাহায্য চেয়েছে? উত্তেজিত বিভ্রান্ত মস্তিষ্কের কাছে, না-কি যে অশবীবী নারী তার হাত ধরেছিল তার কাছে। লিলিয়ান জানে না। সে জানতে ও চায় ন। প্রয়োজন হলে সে চোখ বন্ধ করে থাকবে। অশরীরী নারীমূর্তি তার হাত ধরে টেনে নিয়ে যাক। লিলিয়ান আবারও বলল, আপনি কোথায়? আপনি আমাকে সাহায্য করুন।

আর ঠিক তখন সে নারীমূর্তিকে দেখতে পেল। ভাঙা দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্ৰকাণ্ড শিরীষ গাছের আড়ালে সে দাঁড়িয়ে। সে হাত ইশারায় লিলিয়ানকে ডাকল। লিলিয়ান মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে গেল।

নারীমূর্তি সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আগে আগে যাচ্ছে। পেছনে পেছনে এগুচ্ছে লিলিয়ান। পাঁচিলের বাইরে এসেই নারীমূর্তি ছুটতে শুরু করল। সে লিলিয়ানকে কিছুই বলে নি। তবু লিলিয়ানের মনে হলো তাকে যেন এই অশরীরী মূর্তি বলছে–ভয় পেও না। তুমি আমার পেছনে পেছনে দৌড়াতে থাক।

আমরাগান ছাড়িয়ে, খোলা মাঠ, আবার খানিক ঝোপঝাড়, চাষা ক্ষেত। নারীমূর্তি দ্রুত ছুটছে। একবারও পেছন ফিরে তাকাচ্ছে না। লিলিয়ান কাতর গলায় বলল, পারছি না। আমি পারছি না–একটু থামুন, Please একটু থামুন। নারীমূর্তি থামছে না। ছুটছে, আরো দ্রুত ছুটছে।

তারা এক সময় চলে এলো নদীর তীরে। আর তখনই মেঘের আড়াল থেকে চাঁদ স্পষ্ট হলো। ঝলমল করে উঠল। নদী ও নদীর ওপাশের বনভূমি। নারীমূর্তি থমকে দাঁড়িয়েছে। হাত ইশারায় নদীর তীরে পড়ে থাকা কী একটা যেন দেখাচ্ছে। লিলিয়ান সেদিকে তাকাচ্ছে না। সে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে নারীমূর্তির দিকে।

কী সুন্দর। মায়াময় একটি মুখ। লম্বা বিনুনী করা চুল। শাড়ির আঁচল হাওয়ায় উড়ছে। লিলিয়ান বলল, আপনি কে? আপনি কি আমার কল্পনা না-কি সত্যি কিছু?

নারীমূর্তি হাসল। কী সুন্দর সে হাসি। লিলিয়ান হাসির শব্দও শুনল।

আপনি কি বলবেন না। আপনি কে?

ছায়ামূর্তি না-সূচক মাথা নাড়ল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে ছুটতে শুরু করল। লিলিয়ান চেঁচিয়ে বলল, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?

ছায়ামূর্তি ছুটতে ছুটতে কী যেন বলল, বাতাসের শব্দে তা শোনা গেল না।

লিলিয়ান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখ ফিরিয়ে নিতে পারছে না। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আশেপাশে তাকালেই দেখতে পেত নদীর তীরে চিৎ হয়ে যে মানুষটি শুয়ে আছে সে তাহের। এখনো তার দেহে প্ৰাণ আছে, সে বেঁচে যাবে, সে নিশ্চয়ই বেঁচে যাবে।

জ্যোৎস্না প্লাবিত জলরাশি, তার ধার ঘেসে ছুটে যাচ্ছে এক নারীমূর্তি। বাতাসে তার শাড়ির আঁচল উড়ছে। রিনারিন করে বাজছে হাতের চুড়ি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *