ঝগড়ু, বলল, আমাদের দুমকা একেবারে খরখরে শুকনো হলে হবে কী, আমাদের পাহাড়ে নদীর জলে যখন বান ডাকে তখন সব ভাসিয়ে নিয়ে চলে যায়। এই ভিন গাঁয়ে গেলাম দিব্যি সুন্দর পায়ে হেঁটে নদী পার হয়ে, আর ঘণ্টা তিন বাদে এসে দেখি লাল ঘোলা জলে-ভরতি বিরাট নদী, আর তার সে কী আওয়াজ, কান ঝালাপালা হয়ে যায়। আবার রাত পোয়ালে যে নদী সেই। পায়ে হেঁটে পার হয়ে গায়ে ফেরা যায়।
কোত্থেকে বানের জলে হাজার হাজার মাছ ভেসে আসে। নদীর জল দুই পাড় ছাপিয়ে ওঠে, তারপর যখন আবার নেমে যায়, যেখানে-সেখানে পাথরের ফোকরে ফাটলে জল আটকে থাকে, তার মধ্যে কতরকম মাছ কিলবিল করতে থাকে।
সে মাছ তোমরা ধর, ঝগড়ু?
ধরি বই কী। ক-দিন ধরে গাঁয়ের লোকে মনের সুখে মাছ খায়। দুমকার লোকরা বড়ো গরিব হয়, দিদি। তাদের বড়ো কষ্ট। শীত কালে টোপাকুল পাকলে, বিচিসুদ্ধ পাথর দিয়ে হেঁচে খায় লোকে। তাহলে অনেকক্ষণ পেট ভরে থাকে, ভাত খেতে ইচ্ছা হয় না।
তবে শুধু কি আর মাছ ধরে, তার চাইতেও আশ্চর্য সব জিনিস মাঝে মাঝে ধরা পড়ে।
কী জিনিস, ঝগড়ু?
একবার আমাদের গাঁয়ের নান্দু জল নেমে যাবার পর, সন্ধে বেলায় চাঁদের আলোয় গেছেনদীর ধারে, বর্শা দিয়ে মাছ গাঁথবে, তীরের কাছ থেকে। দেখে কিনা চাঁদের আলোয় কী একটা লম্বা জিনিস বালিতে বেধে গিয়ে, স্রোতের সঙ্গে একটু একটু দুলছে।
কাছে গিয়ে দেখে আগাগোড়া আশ্চর্যরকম কারিকুরি-করা সাদা রঙের একটা ছোটো নৌকো। হাতির দাঁতের কি হাড়ের তৈরি বুঝতে পারল না। নৌকোর সামনের দিকটার গড়ন একটি অপরূপ সুন্দরী মেয়ের মতো, কিন্তু তার পায়ের বদলে আঁশে-ঢাকা মাছের ল্যাজ।
হাত বাড়িয়ে নৌকোটাকে টেনে ডাঙায় তুলতেই, নান্দুর চক্ষু চড়কগাছ!
নৌকোর মধ্যে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে আশ্চর্য একটি মেয়ে। তার গায়ের রঙও হাতির দাঁতের মতো, হালকা পালকের মতো গড়নটি, চোখ খুলতেই নান্দু দেখল তার ঘোর নীল রং, পরনে একটা ঘন সবুজ রেশমি কাপড়। চমকে মেয়েটি উঠে বসল একবার চারিদিকে তাকিয়ে দেখল, তারপরে এক নিমিষে জলের মধ্যে ঝাঁপ দিল।
নান্দু তার আঁচলখানি চেপে ধরল, এক মুঠি সবুজ রেশম তার হাতে রয়ে গেল, মেয়েটি স্রোতের মধ্যে তলিয়ে গেল আর নৌকোটা বালির উপর পড়ে থাকল। ছোটোবেলায় ওই নৌকো আমিও দেখেছি।
ঝগড়ু থামলে বোগি রাগ করতে লাগল। তোমার সব গল্প হারানোর গল্প, ঝগড়ু, পাওনি কখনো কিছু?
তাহলে যাবে কাল দোলতলার মেলায়? সেখানে কিছু পাওয়া যেতে পারে। রমুদিদি, যাবেনাকি তোমার সেই একচোখা লোকের খোঁজে?
রমু বলল, যাব, যাব, ঝগড়ু। চিনির মঠ কিনে দেবে তো?
দিদিমাকে নিয়ে একটু গোল বাধল, ঝগড়ু, তোমার সঙ্গে না গিয়ে ওদের দাদুর সঙ্গে গেলেই ভালো হত-না?
না, দিদিমা, দাদু গাছতলায় বসে খালি বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে চায়, হাঁটতে চায় না।
শেষপর্যন্ত ঝগড়ুর সঙ্গেই যাওয়া হল। দিদিমা বললেন, সারাক্ষণ ঝগডুর সঙ্গে সঙ্গে থাকবে, তেলেভাজা খাবে না, অচেনা লোকের সঙ্গে কথা বলবে না।
মেলার মাঠের উপরে মেঘের মতো ধুলো উড়ছে, পা পোঁ করে বাজনা বাজছে। বোগি বলল, সার্কাস দেখাবে তো, ঝগড়ু? জান, বাঁদরে ছাগল-টানা গাড়ি চালায়, টেবিল-চেয়ারে বসে চা ঢেলে খায়! আছে তোমাদের দুমকাতে অমন বাঁদর?
ঝগড়ু বলল, হাসিয়ো না, বোগিদাদা, দুমকাতে ওসব ছেঁদো বাঁদরকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। পয়সা নষ্ট করে সার্কাস দেখে একবার দুমকার বনের মধ্যে যেয়ো দিকিনি!
সে কীরকম বন, ঝগড়ু?
ঝগড়ুর মুখটা অন্যরকম হয়ে গেল, মেলার মাঠের উপরে ধুলোর মেঘের দিকে তাকিয়ে, হোঁচট খেতে খেতে ঝগড়ু চলতে লাগল। সে গভীর বন, রমুদিদি, শাল গাছ, মহুয়া গাছ, সীতাহার গাছ, শিমুল গাছের ভিড় সেখানে। গাছের গা জড়িয়ে লতা ওঠে, শীতের আগে সেই লতায় ঝুরো ব্যুরো সাদা ফুল ফোটে। বুনো মুরগি দেখেছ, রমুদিদি? দুমকার বনে বুনো মুরগি চরে, কী তাদের রঙের বাহার। সমস্ত বন জুড়ে জন্তুজানোয়ারদের খুটখুট কিচিরমিচির, কিন্তু হঠাৎ চোখে কাউকে দেখতে পাবে না। নজর করে দেখো, দিদি, গাছের ডালের সঙ্গে রং মিলিয়ে ছাই রঙের পাখি বসে থাকে, চোখে পড়ে না। যেই-না একটু বাতাস বইল, লতাপাতা ডালপালা শিরশির দুলদুল করে উঠল, গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে এক ঝলক রোদ্দুর এসে পাখির গায়ে লাগল, অমনি সে ডানা মেলে আকাশে ওড়ে। বাইরেটাই শুধু ছাই রঙের, ডানার তলাটা শাঁখের মতো ঝকঝকে সাদা। গাছতলায়। ঝোঁপঝাঁপ থাকে, দিদি, তাতে ফুল ফোটে, কী তাদের সুবাস, ঝাকে ঝুঁকে প্রজাপতিরা সেখানে ঘোরাফেরা করে।
কিন্তু ঝোঁপের মধ্যে না যাওয়াই ভালো, বোগিদাদা, সেখানে সাপের বাস। হঠাৎ যখন চক্কর মেলে ওঠেন তারা, যেমনি তাঁদের রূপের ছটা, তেমনি তাদের বিষের জ্বালা। রূপের বড়া জুলুনি, দিদি।
তোমরা ঝোঁপের মধ্যে যাও না, ঝগড়ু?
আমরা যাব না কেন? দুমকার ছেলেরা সবাই সাপের মন্ত্র জানে।
কী মন্ত্র বলো।
ঝগড়ু জিব কেটে বলল, সে অন্য কাউকে বলা যায় না, বোগিদাদা, তবে ছোট্ট একটা তামার মাদুলিতে ভরে, তোমার হাতে বেঁধে দিলে, আর ওঁরা তোমায় কিছু বলবেন না।
বলো, দুমকার বনের কথা আরও বলো।
ওইখানে ছোটোবেলায় বাবুদের সঙ্গে পাখি শিকারে গিয়েছিলাম।
পাখি তো বিলের ধারে শিকার করতে হয়, আঃ, রমু, খালি খালি কাঁদ কেন?
সবুজ পায়রার গলায় বন্দুকের গুলি লাগলে রক্ত বেরোয় দেখেছি।
না, দিদি, না, সে সবুজ পায়রার সময় নয়। আমাদের বনে একরকম লালচে রঙেরল্যাজ-ঝোলা পাখি থাকে, মাথায় তাদের কালো ঝুঁটি, বাবুরা তাদের শিকার করে। সে পাখি বিলের ধারে থাকে না।
তারপর কী হল?
বাবুরা অন্য পাখি দেখে, ছোটো ছোটো জানোয়ার দেখে, কিন্তু সব ছেড়ে দেয়। এমনি সময় এক পাল বাঁদরের সামনে পড়ে গেল। বাঁদর মারতে ওরা যায়নি, শুধু শুধু মজা করে বন্দুক তুলতেই, বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, বাঁদরগুলো সব হাতজোড় করে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। তাই দেখে বাবুরা হেসে উঠল, কিন্তু একজনার হাতের বন্দুককী করে জানি ছুটে গিয়ে, একটা বাঁদরমরে গেল। অমনি এক নিমেষে সব বাঁদর হাওয়া! মরা বাঁদরটা পর্যন্ত রইল না।
তোমার দুঃখ হয়নি, ঝগড়ু?
দুঃখ বলে দুঃখু, রমুদিদি? কিন্তু কী করি, বাবুরাও কেমন যেন চুপ হয়ে গেল। আর কী আশ্চর্য কথা, বনটার চেহারাও যেন বদলে গেল। হঠাৎ একসময় সকলের খেয়াল হল, কোথাও একটা টু শব্দ নেই। গহন বনটা যেন নিঃশ্বাস বন্ধ করে আছে, কোথাও একটা পাখি নেই, কাঠবেড়ালি নেই, পাতার খসখস শব্দ নেই, ঝোঁপের মধ্যে চকচকে চোখ নেই।
তারপর, ঝগড়ু?