০৭. খবির হোসেন ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে

খবির হোসেন ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন।

ভিড়টা ছেলে-ছোকদের। একটি মানুষ সাপের কামড়ে মরতে বসেছে, অথচ বয়স্ক লোকজন কেউ নেই, এর কারণ কি? রহস্য কিছু-একটা নিশ্চয়ই আছে। জিজ্ঞেস করবার লোক নেই। জোহরের নামাজের সময় হয়ে যাচ্ছে। অজু করে আজান দিতে হবে। কিন্তু তাঁর উঠতে ইচ্ছা করছেন। এখানে যে-সব কাণ্ডকারখানা হচ্ছে সেসব দেখাও ঠিক হচ্ছে কি না তা বুঝতে পারছেন না। আল্লা-খোদর নাম নেওয়া হচ্ছে না, এটা কী ব্যাপার? একটা লোক ক্রমাগত হিন্দু দেব-দেবীর নাম বলে যাচ্ছে, এ কেমন কথা! ওঝাদের সাপের বিষ নামাতে তিনি আগেও দেখেছেন। সেখানে দেবদেবীদের নিয়ে এতটা বাড়াবাড়ি করা হয় না। ওঝারা নানান রকম ছড়াটড়া বলে।

এই ওঝা সেরকম নয়। খবির হোসেনের মনে হল, এর দম ফুরিয়ে আসছে। মন্ত্রতন্ত্র বেশিক্ষণ চালাতে পারবে না। গত আধা ঘন্টায় সে তিন বার পানি খেয়েছে এবং খানিকটা পানি নিজের মাথায় ঢেলেছে। এই মুহূর্তে সে ফতুয়ার পকেট থেকে একটি বিড়ি বের করে উদাস ভঙ্গিতে টানছে, যেন সে সমস্ত উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। এখন হাত-মুখ ধুয়ে বাড়ি চলে যেতে চায়। কিংবা চারটা ডাল-ভাত খেয়ে কাঁঠালগাছের নিচে আরাম করে বসতে চায়।

খবির হোসেন বললেন, ভাই, আপনার নাম কি?

নিবারণ শব্দ করে থুথু ফেলে বিরস মুখে বলল, নিবারণ। আমার নাম নিবারণ। দশ গায়ের লোকে আমারে চিনে।

নিবারণের কণ্ঠে স্পষ্ট বিরক্তি। সে অপমানিত বোধ করছে।

কি রকম দেখছেন?

কিছু বুঝছি না।

বিষ নামছে?

উঁহুঁ। তেজ বেশি। মঙ্গলবার কৃষ্ণপক্ষের রাইতে কারবার হইছে। মুশকিলটা বুঝছেন? বেজায় মুশকিল।

না, বুঝছি না। কী মুশকিল?

নিবারণ অত্যন্ত বিরক্ত হল। কড়া-কড়া কিছু কথা বলতে গিয়েও বলল না।

খবির হোসেন মনিরউদ্দিনের দিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁর ইচ্ছা হচ্ছে তিন বার সুরা এখলাস পড়ে একটা ফুঁ দেবেন। আল্লাহ্‌র পাক কালাম হচ্ছে সবার উপরে।

কেমন আছ মনির?

মনিরউদ্দিন চোখ তুলে তাকাল। তার চোখ লাল। সে কোনো জবাব দিল না।

ব্যথা আছে?

জ্বি।

দমে-দমে আল্লাহর নাম নেও। আল্লাহপাক হচ্ছেন রহম নেওয়ালা। আমাদের এক পয়গম্বর ছিলেন মাছের পেটে। দমদমে আল্লাহর নাম নিচ্ছিলেন। সেই কারণে……

একটু পানি দেন মৌলানা সাব।

আনতেছি, পানি আনতেছি।

খবির হোসেন অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে বাড়ির দিকে গেলেন। মেয়েছেলেতে বাড়ি ভর্তি। পাখির মত কিচিরমিচির করছে।

মনিরউদ্দিনরে পানি খাওয়ান লাগে।

ভেতর থেকে একজন কে চিকন গলায় বলল, ওঝা পানি দিতে নিষেধ করছে।

তিয়াষি মানুষ পানি চাইলে দেওয়া লাগে। পানি খাইলে কিছু ক্ষতি নাই। পানির উপরে আল্লাহতালার খাস রহমত আছে।

বড় একটা ঘটিতে এক ঘটি পানি এনে দিল শরিফা। এই মেয়েটিকেই তিনি রাতে ছুটে যেতে দেখেছেন। নিতান্তই বাচ্চা মেয়ে। কেঁদে-কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে।

মা, চিন্তা কইরো না। এক দিলে আল্লারে ডাক।

মেয়েটি স্পষ্ট চোখে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে, যেন সে আরো কিছু শুনতে চায়।

খবির হোসেন নরম গলায় বললেন, বাদ আছর আমি মসজিদে মিলাদ পড়ায়ে দিব। কোনো চিন্তা করবা না। ফি আমানুল্লাহ্। আল্লাহ্পাক আসান দেনেওয়ালা।

শরিফা ক্ষীণ স্বরে বলল, রইদে ফালাইয়া থুইছে, কষ্ট হইতাছে। ইনারে এট্টু ছায়াতে নিয়া যান মৌলানা সাব।

ঠিক, ঠিক। ছায়ার মইধ্যে নেওয়া দরকার। করছি, আমি ব্যবস্থা করছি।

মনিরউদ্দিন ঢকটক করে সবটা পানি খেয়ে ফেলল। এত তৃষ্ণা ছিল তার, কে জানত?

খবির হোসেন বললেন, এরে ছায়ার মধ্যে নিয়া বসাই, কোন বাধা আছে?

নিবারণ হ্যাঁ-না কিছুই বলল না। নিজেই উঠে গিয়ে কাঁঠালগাছের ছায়ার বসল। অসহ্য গরম পড়েছে। মাটি থেকে ভাপ বেরুচ্ছে গরমে।

খবির হোসেন অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, নিবারণ মাথা নিচু করে বমি করছে। লোকটি অসুস্থ। খবির হোসেন এগিয়ে গেলেন। লোটার কষ্ট হচ্ছে।

কি হইছে আপনার?

শইল খারাপ। বয়স হইছে।

আসেন, মাথায় পানি ঢালি। তারপর শুয়ে থাকেন।

নিবারণ কোনো কথা বলল না। মৌলানা সাহেব অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, লোকটি কাঁদছে।

আপনার শরীর কি বেশি খারাপ?

নিবারণ তারও জবাব দিল না। খবির হোসেনের খুব মন খারাপ হয়ে গেল।

পেটে খিদা আছে? কিছু খাইবেন?

নিবারণ হ্যাঁ-না কিছুই বলল না। আবার বমি করল। যে-ভিড় মনিরউদ্দিনকে ঘিরে ছিল তা এখন নিবারণের চারদিকে। নিবারণ তার লাল চোখে চারদিক দেখল, তারপর ধমক দিয়ে বলল, কী দেখ? এইটা কি রঙ্গ-তামাশা?

তার বলার মধ্যে কিছু একটা ছিল। কয়েকজন ছেলেপুলে একসঙ্গে হেসে উঠল। দুঃখে ও কষ্টে নিবারণের চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল।

খবির হোসেন এক বদনা পানি জোগাড় করে নিবারণ ওঝার মাথায় ঢালতে লাগলেন। নিবারণ নড়াচড়া করছে না। বাধ্য ছেলের মতো মাথা পেতে বসে আছে। এক বদনা পানি শেষ হতেই সে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, আর এট্টু পানি দেন।

আরাম লাগছে?

হ।

খবির হোসেন পানির খোঁজে গেলেন। বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। মসজিদের ইমামতির কাজ-কঠিন দায়িত্বের কাজ। দুনিয়া একদিকে চলে গেলেও ঠিক সময়ে উপস্থিত থাকতে হবে। কিন্তু তাঁর যেতে ইচ্ছা করছে না। বড় মায়া লাগছে। আল্লাপাকের লীলা বোঝা দায়। একদিকে মায়া দেন, অন্যদিকে মায়া টেনে নেন। কী আজব কারবার!

 

যা ভাবা গিয়েছিল, তাই। মসজিদ খাঁ-খাঁ করছে। একটা মানুষ নেই। পানির ড্রামটিও শূন্য। যাদের পানি তুলে রাখার কথা, তারা মনিরউদ্দিনের বাড়িতে বসে আছে বোধহয়।

খবির হোসেনের অজুর পানির দরকার নেই—তাঁর অজু আছে। কিন্তু যদি কেউ আসে? এই দুপুরের রোদে সে নিশ্চয়ই অজুর পানির জন্যে আবার হটবে না? কষ্ট কেউ করতে চায় না। একটু রোদ, একটু গরম—এতেই সবাই কাহিল। অথচ রসুলুল্লাহ্র দেশে আগুনের মতো গরম মরুভূমি। সেই গরমের দেশেও লোকজন নামাজের জন্যে মসজিদে আসে। নিশ্চয়ই বহু দূর থেকে হেঁটে-হেঁটে আসে।

একা-একাই খবির হোসেন নামাজে দাঁড়ালেন। সুরা ফাতেহা শেষ হওয়ামাত্র চট করে তাঁর মনে হল—সাপের কামড়ের কোনো দোয়া কি আছে? বোধহয় নেই। মরুভূমির দেশে নিশ্চয়ই সাপ নেই। থাকলে হাদিসটাদিসে উল্লেখ থাকত। কোনো একটা চিন্তা মাথায় ঢুকে গেলে খুব মুশকিল। সেটা মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। শয়তানের কাজ। ইবলিশ শয়তানের কাজ। নামাজের সময় মানুষের মনকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেয়। শয়তানের ধোঁকার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারছেন না, এই দুঃখে খবির হোসেনের মন ভার হয়ে গেল।

তিনি কথা দিয়ে এসেছেন, বাদ জোহর একটা মিলাদ পড়াবেন। হায় রে! একাএকা মিলাদ হয় নাকি? কিন্তু কথা দিয়ে এসেছেন, কথা রাখতেই হবে। কথা দিয়ে যে কথা রাখে না, তার জন্যে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা আছে। কঠিন আজাব।

খবির হোসেন একাই মিলাদ পড়লেন। মসজিদঘরের এক পাশে কাসাসুল আম্বিয়া বইটি যত্ন করে রাখা। সেই বইটি হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ পাতা ওল্টালেন। এর প্রতিটি পাতা তাঁর অসংখ্যবার পড়া। কোথায় কি আছে, চোখ বন্ধ করে বলতে পারেন। তবু নতুন করে পড়া যায়। এই সমস্ত বই কখনো পুরোনো হয় না। কিন্তু আজ কিছুতেই মন। বসছে না। মনিরউদ্দিনের জন্যে মন টানছে।

খোদার তৈরি জীব মানুষ, আবার সাপও সেই খোদাতালারই সৃষ্টি। তবু কেন এই সাপ মানুষকে কামড়ায়? সাপের নিজের ইচ্ছাতে কিছু করার উপায় নেই, কারণ আল্লাহপাক পরিষ্কার বলেছেন—তাঁর হুকুম ছাড়া কিছুই হবে না। আজ যদি মনিরউদ্দিন মরে যায়, তাহলে সেটা ঘটবে আল্লাহ্‌র হুকুমে। কিন্তু কেন? খবির হোসেন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। তিনি অনেক কিছুই বুঝতে পারেন না। তাঁর বুঝতে ইচ্ছা করে। তাঁর জ্ঞান-বুদ্ধি সেরকম নেই। থাকলে ভালো হত। কিন্তু কী আর করা যাবে, আল্লাহ্ সবাইকে সব জিনিস দেন না। কেউ পায়—কেউ পায় না। কেন এরকম হবে? বাবা-মা তাদের সব শিশুকে সমান আদর করেন। তাদের সামান্য অসুখেবিসুখে অস্থির হন। কিন্তু……।

চিন্তাটা উল্টো দিকে যাচ্ছে। খবির হোসেন নিজেকে সামলে নিয়ে দোয়া করতে বসলেন। মনিরউদ্দিনের কথা আল্লাহ্কে গুছিয়ে বলতে গিয়ে তাঁর চোখ ভিজে উঠল।

অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার, মনিরউদ্দিন ছোকরা তাঁকে দেখতে পারে না। রাস্তায় দেখা হলে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে থাকে। একদিন তিনি বলেই ফেললেন, রাস্তায় দেখা-সাক্ষাৎ হয়, তুমি আমারে সালাম দেও না, বিষয় কি কও দেখি?

মনিরউদ্দিন মুখ শক্ত করে থাকে। উত্তর দেয় না।

সালাম দেওয়া হজরতের সুন্নত। সুন্নত পালন না করলে কঠিন আজাব। পুলছিরাত পার হওন দায়। জিনিসটা খিয়াল রাখবা। আরেকটা কথা, নামাজে সামিল হও না কেন?

কাজকাম নিয়া থাকি।

তা তো থাকবাই। কৃষিকাজ হইল গিয়া তোমার ফরজে কিফা। কিন্তু পাঁচ ওয়াক্ত আল্লাহপাকের সামনে খাড়া হওয়াও বড় ফরজ। খিয়াল রাখবা। দুই কান্দে দুই ফিরিশতা। বিনা কালির কলমে তারা লিখছে। মহাবিপদ সামনে।

তাতে কোনো লাভ হয় নি। এর পরও মনিরউদ্দিনের সঙ্গে দেখা হয়েছে। সে মুখ শক্ত করে রেছেছে। তিনি নিজেই আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছ মনির?

জ্বি ভালো।

ভালো থাকলেই ভালো। তোমার বৌটা ভালো?

হুঁ।

আইচ্ছা আইচ্ছা, খুশির কথা। যার একদিন তোমার বাড়িতে।

মনির কিছু বলে না। এইসব ক্ষেত্রে ভদ্রতা করে হলেও আসবার কথা বলতে হয়। তার সে বালাইও নেই। নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। কারণ ছাড়া মানুষ কিছু করে না। কারণটা জানতে ইচ্ছা করে।

খবির হোসেন দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসেছিলেন, সেই অবস্থায় এক সময় ঘুমিয়ে পড়লেন, এবং ঘুমের মধ্যে ভয়াবহ একটি দুঃস্বপ্ন দেখলেন। ঘামে তাঁর গা ভিজে গেল। তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যাওয়ার মতো হল। কী ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন। কী ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *