০৭. ক্রিকেটে যেমন টেস্ট

ক্রিকেটে যেমন টেস্ট, ফুটবলে যেমন শিল্ড ফাইন্যাল, হোটেলে তেমনি ব্যাংকোয়েট। এই ব্যাংকোয়েট বস্তুটি আসলে যে কী, হোটেলের চাঁইদের কেউই তা জানেন না। জানবার সময়ও নেই কারুর।

ব্যাংকোয়েট সম্বন্ধে খোঁজখবর এলে সবচেয়ে যিনি খুশি হন, তিনি আমাদের ম্যানেজার। তিনি কাস্টমারকে সোজাসুজি বলে দেন, এত বড় পার্টিকে ম্যানেজ করা শাজাহান হোটেল ছাড়া আর কোথাও সম্ভব নয়। আমাদের চার্জ সামান্য একটু বেশি পড়ে, কিন্তু যারা পার্টিতে আসবেন তাদের আনন্দ; আর যারা পার্টি দিচ্ছেন তারাও নিশ্চিন্ত।

সপ্তাহে এক-আধটা ব্যাংকোয়েট শাজাহান হোটেলে লেগেই থাকে। আগে আরও হত। সত্যসুন্দরদা বললেন, আগে এমন সময় গিয়েছে, যখন পর পর পাঁচ দিন ব্যাংকোয়েট। দেড় মাস, দু মাস আগে থেকে ব্যবস্থা না-করলে হল্ পাওয়া যেত না।

সত্যসুন্দরদার কাছেই শুনলাম, এখন আর সেদিন নেই। তার কারণ যে কলকাতায় ফুর্তি করবার লোক কমে গিয়েছে, বা সামাজিক মেলামেশা কমে গিয়েছে তা নয়; আসলে কলকাতার ক্লাবগুলো জাঁকিয়ে বসেছে। সেখানে মদ সস্তা, খাবার সস্তা, লাভের তাড়নাটাও তেমন নেই। অথচ ইজ্জত কম নয়; বরং বেশি। ক্লাবের প্রাইভেসিতে পার্টি দিতে কলকাতার উঁচু মহলের নাগরিকরা পছন্দ করেন। ক্লাবের ম্যানেজমেন্টও খুশি হন। নতুন স্টাফ রাখতে হচ্ছে না, অথচ ক্লাবের তহবিলে কিছু আসছে। দেশের যা হালচাল, কিছুই বিশ্বাস নেই, কোনদিন সকালে খবরের কাগজে দেখা যাবে বোম্বাইয়ের মতো কলকাতারও বারোটা বেজে গিয়েছে। ভিজে কলকাতা রাতারাতি ড্রাই হয়ে গিয়েছে। মদের লাইসেন্সবিহীন ক্লাব অনেকটা পাতাবিহীন বাঁধাকপির মতো। বিধাতা করুন, সেই দুর্দিন যেন সুদূরপরাহত হয়। কিন্তু সত্যিই কখনও সবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বোম্বাই-এর শুকনো তেজস্ক্রিয় মেঘ যদি দিল্লি ঘুরে কলকাতায় এসে হাজির হয় তখন সেই দুর্দিনে ব্যাংকোয়েট ছাড়া ক্লাবের কিছুই থাকবে না। সেইজন্য এখন থেকেই তারা সতর্ক হয়েছেন।

কিন্তু ব্যাংকোয়েট কি আর অতই সহজ! বিশেষ করে সে ব্যাংকোয়েটে যদি সাড়ে-তিনশ চারশ অতিথি আসেন। শাজাহানে এমন সব লোক আছে, এসব কাজে যাদের তুলনা নেই। প্রয়োজন হলে সরকারি মহলেও তাদের ডাক পড়ে। আন্তর্জাতিক অতিথিদের কাছে ভারতবর্ষের ক্ষণভঙ্গুর মান-সম্ভ্রম তারাই রক্ষে করে আসে। আমাদের পরবাসীয়ার কথাই ধরা যাক না কেন। নাইনটিন টোয়েন্টিফোরে ব্রিটিশ এম্পায়ার এগজিবিশনে যে ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁ খোলা হয়েছিল, সেখানে কাজ করবার জন্য সে বিলেত গিয়েছিল। তারপর কতবার যে সে-লাট-বেলাটদের ব্যাংকোয়েটদায় উদ্ধার করেছে তার হিসেব নেই। ব্যাংকোয়েটের খবরে পরবাসীয়ারা খুশি হয়। দিন দুই যা একটু বেশি খাটতে হয়। পিঠে ব্যথা হয়, পাগুলো টনটন করতে আরম্ভ করে, কিন্তু তবু ভালো লাগে।

ব্যাংকোয়েটের ব্যবস্থা হলেই মার্কোপোলো খুব ঘোরাঘুরি আরম্ভ করেন। কিন্তু তার মেজাজটা হঠাৎ খুব নরম হয়ে যায়। বাড়ির রাশভারি কর্তা যেমন বিয়েবাড়ির কাজের চাপে অনেক সময় ছেলেপিলেদের সঙ্গে বন্ধুভাবে কথাবার্তা বলতে আরম্ভ করেন, মার্কোপোলোও তেমনি বলেন, জিমি, এটা খুবই ইম্পর্টান্ট ব্যাংকোয়েট, এই পুওর কান্ট্রির প্রেস্টিজ নির্ভর করছে এর সাফল্যের উপর।

জিমি বলে, এমন ব্যাংকোয়েটের ব্যবস্থা করব, যা কোনোদিন কলকাতায় হয়নি।

মার্কোপোলো জুনোর দিকে মুখ ফিরিয়ে প্রশ্ন করেন, তুমি কী বলো?

জুনো বলে, স্যর, নো-নো, দিজ আর সিম্পল পার্তিজ, নো ব্যাংকোয়েত! ব্যাংকোয়েট বলে লজ্জা দিচ্ছ কেন, এ-সব আসলে পার্টি। জুনোর ধারণা, ব্যাংকোয়েট কাকে বলে তা ক্যালকাটার লোকরা জানে না। জুনো বলে, এটা হাড়কঞ্জুস স্কচ সিটি। প্যারিসে কাজ শিখে, এই পিঁপড়ের পশ্চাৎ-টেপা শহরে এসে অর্ধেক রান্নাই ভুলে গেল। জুনো তো যে-সে লোকের পায়ের তলায় বসে রান্না শেখেনি। খোদ মঁসিয়ে হারবদু-দুনিয়ার যত হোটেলের যত সেফ আছে, তার নাম শুনে মাথা নত করে তাকে নিজে হাতে কুকিং শিখিয়েছেন। মঁসিয়ে হারবদু যাঁর শিষ্য, তিনি রান্নার জগতের বীঠোফেন। তাঁর নাম মঁসিয়ে একফিয়ারয়। একফিয়ারয় বলতেন, টু কু ইজ টু সার্চ গড়। হারবদুর কাছে জুনো কতবার শুনেছে, নয় কোর্সের কম ব্যাংকোয়েট ডিনার হয় না।

হোয়াট? মার্কোপোলো সায়েব চিৎকার করে উঠেছিলেন।

জুনো তার অ্যানে হাতটা ঘষতে ঘষতে বললে, হ্যাঁ, প্রথমে অডিভোর, তারপর স্যুপ, ফিশ, Entree, রিমুভস, রোস্ট এনট্রিমেন্ট, ডেসার্ট এবং শেষে কফি।

মার্কোপোলো এবার গম্ভীরভাবে বললেন, মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড, আমাদের এই ব্যাংকোয়েটটা ছেলেমানুষের ব্যাপার নয়। যতদূর শুনেছি, অভ্যাগতরা দেশের এবং পৃথিবীর অনেক গুরুতর সমস্যা সম্বন্ধে আলোচনা করবেন। ন্যাচারালি তাঁরা চান প্লেন অ্যান্ড সিম্পল ডিনার। অ্যাবাউট পনেরো টাকা পার হেড।

নয় কোর্সের ডিনার রান্নার সুযোগ হারিয়ে জুনো বললে, আপনার যা খুশি হুকুম করুন, আমি বেঁধে খালাস। আপনি বলুন, আমি শুধু কোল্ড মাটন এবং ব্রেড দিচ্ছি। তবে এটা আমি বলবই, প্যারিস ছাড়া আর কোথাও বেঁধে সুখ নেই। দুনিয়ার আর কোথাও রান্নার সমঝদার নেই। সেইজন্যেই কলকাতায় হালুইকর বাউন পাওয়া যাবে; কিন্তু কলকাতা কোনোদিন একটা মঁসিয়ে হারবদু বা একটা মঁসিয়ে একফিয়ারয়কে সৃষ্টি করতে পারবে না।

মার্কোপোলা উঠে পড়লেন। বললেন, তোমরা একটু বসো, আমি একটা টেলিফোন করে আসছি। মেনুটা ওঁদের সঙ্গে আলোচনা করে নিই।

বোসদা তখন জুনোকে বললেন, পুওর জুনো! তুমি দুঃখ করো না। আমার বিয়ের সময় তোমাকে মনের সুখে রান্নার সুযোগ দেব। তখন দেখব কি মেনু তোমার মাথায় আছে।

জুনো হেসে বললে, স্যাটা, তোমার বিয়েতে ফ্রেঞ্চ ইংলিশ, স্প্যানিশ, ইটালিয়ান, পোলিশ, আফ্রিকান, টার্কিস, চাইনিজ, ইন্ডিয়ান সব রকম এক-একটা ডিশ করব।

হে পরম করুণাময়, হে প্রভু, মঁসিয়ে জুনোকে তুমি দীর্ঘজীবী করো। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, ইউ-এন-ও থেকে একটি মনের মতো কনে আমার জন্যে পাঠিয়ে দিও। বোসদা হাঁটু গেড়ে, জোড়হাতে সকৌতুকে ভগবানের উদ্দেশে প্রার্থনা জানালেন।

জুনো খুশি হয়ে বললে, তোমার ফুলশয্যার রাত্রে যে স্যুপ করব, তার নাম La Soupe des Noces oy Tourin Aux Tomates!

বোসদা হাসতে হাসতে একটু সরে এসে বললেন, নামটা তো বেজায় লম্বা-চওড়া। আসল জিনিসটা কি, জুনোদা?

জুনো বললে, ছোট করে আমরা বলি মধুযামিনী স্যুপ। এই স্যুপ অনেকখানি তৈরি করতে হবে। তারপর আমাদের দেশে যা হয়, তাই করা হবে।

জিমি বললে, প্রেম করা আর খাওয়া ছাড়া আর কোনো চিন্তাই তো তোমাদের ফরাসি জাতের মাথায় আসে না।

জুনে রেগে গিয়ে জিমিকে বললে, বাজে বোকো না।

তারপর বোসদার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললে, তোমার ফুলশয্যার দিন আমরা বহু রাত পর্যন্ত খানাপিনা করব, হই-হই করব। তারপর গভীর রাত্রে দু পাত্র গরম মধুযামিনী স্যুপ নিয়ে তোমার বদ্ধঘরের দরজায় ধাক্কা দিতে আরম্ভ করব। যতক্ষণ না তোমরা দরজা খুলে দাও, ততক্ষণ আমরা বাজনা বাজাব, চিৎকার করব, ধাক্কা দেব। তারপর আমাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে যেমনি তুমি বা তোমার গিন্নি দরজা খুলবে, অমনি হই-হই করে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ব। জোর করে তোমাদের দুজনকে ওই স্যুপ খাওয়াব। ঠিক আমরা খাওয়াব না। মিসেস বোসকে খাওয়াবে তুমি, আর মিসেস বোস খাওয়াবেন তোমাকে। যতক্ষণ না তোমরা ওই স্যুপ শেষ করবে, ততক্ষণ আমরা ঘর থেকে বেরুব না।

বোসদা হেসে বললেন, তা না হয় নাই বেরুলে। কিন্তু স্যুপটা কিসের তৈরি শুনি। কলকাতায় সব জিনিস পাওয়া যাবে তো?

জরুর। আমার চাই বারোটা টমাটো, ছটা পেঁয়াজ, কিছু মরিচ, আর এক আউন্স মাখন!

অ্যাঁ! কেবল পিয়াজ আর টমাটো দিয়ে La Soupe des Noces oy Tourin Aux Tomates! আমি ওর মধ্যে নেই। আমি বিয়েই করব না। মুখ দিয়ে ভকভক করে পিঁয়াজের গন্ধ বেরুচ্ছে, এমন স্বামীকে কোনো মেয়েই সহ্য করবে না।

জুনো যে সত্যসুন্দরদাকে ভালোবাসে, তা তার কথাতেই বোঝা যায়। সে এবার আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু মার্কোপোলো ফিরে এলেন। বললেন, কথাবার্তা সব হয়ে গিয়েছে। আমি মেনুটা এখনই রোজিকে ডিক্টেট করে দিচ্ছি। শুধু কজন ভেজিটারিয়ান, আর কজন নন-ভেজিটারিয়ান তা জানা যাচ্ছে না।

জিমি বললে, সে তো কখনই জানা হয়ে ওঠে না। শতকরা দশটা নিরামিষ করে দিই।

জুনো রেগে বললে, হেল! প্যারিস যদি স্বর্গ হয়, ক্যালকাটা তাহলে রাঁধুনিদের নরক। পার্টিতে না এসে কলকাতার লোকেরা বাড়িতে বসে বসে ফল খায় না কেন? মঁসিয়ে হারবদু কি ভাবতে পারেন যে, একই ডিনার টেবিলে একদল ভেজিটারিয়ান, আর একদল নন-ভেজিটারিয়ান! একদল নিরামিষাশী হয়েও ডিম খায়। আর একদল নন-ভেজিটারিয়ান হয়েও বীফ খায় না। আর একদল গোরু খায়, কিন্তু শুয়োরের নাম শুনলে বমি করতে আরম্ভ করে।

বোসদা জুনোকে রাগাবার জন্যে বললেন, এখন বল মা তারা, দাঁড়াই কোথায়?

হোয়াট? জুনো প্রশ্ন করলেন।

এই জন্যেই তো আমাদের গ্রেট রামপ্রসাদঠাকুর বলেছন—টেল মাদার স্টার হোয়্যার ড়ু আই স্ট্যান্ড? বোসদা বললেন।

জুনোর মুখে হাসি ফুটে উঠল, স্যাটা, মিস্টার প্রসাদ কি একজন গ্রেট কুক ছিলেন?

ভেরি ভেরি গ্রেট রাঁধুনি। ওনলি গডের জন্যে তিনি কুক করতেন।

পরবাসীয়া আসরে বসেছিল। সে এবার ম্যানেজার সায়েবের কানে কানে কী যেন বললে। ম্যানেজার জিমিকে প্রশ্ন করলেন, ওয়েটারের কী হবে? মেন ডাইনিং হল-এ কজনকে দিয়ে তুমি চালিয়ে নিতে পারবে?

কুড়িজনের কমে অসম্ভব, স্টুয়ার্ড বললেন।

ব্যাংকোয়েটের সময় লোকের অভাব হয়। যেখানে যত লোক আছে, সবাইকে উর্দি পরিয়ে ওয়েটারের কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়। কোন হোটেলে একবার নাকি ঝাড়ুদারদেরও কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরবাসীয়া চুপি চুপি খবরটা আমাকে জানিয়েছিল। তাছাড়া পুরনো লোকদেরও খবর দেওয়া হয়। যারা অনেকদিন চাকরি থেকে অবসর নিয়েছে (অর্থাৎ জিমি যাদের অবসর নিতে বাধ্য করেছে), কলকাতার কাছাকাছি থাকলে তাদেরও ডাক পড়ে।

জিমি বললেন, পরবাসীয়া, তুমি এখনই বেরিয়ে পড়ো, আবদুল গফুর, মায়াধর, জয়া এদের সব খবর দিয়ে এসো। দুটাকা করেই দেওয়া হবে।

পরবাসীয়া উঠে পড়ল। আর মার্কোপোলো বললেন, যাবার আগে ন্যাটাহারিকে একটা খবর দিয়ে যাও।

চটি ফটর ফটর করতে করতে নিত্যহরিবাবু যখন আসরে হাজির হলেন, তখন আরও অনেকেই উঠে পড়েছেন। জুনো তার কিচেনে চলে গিয়েছে। জিমি কন্ট্রাক্টরের সঙ্গে মার্কেটের ব্যবস্থা করতে বেরিয়ে গেলেন। মার্কোপোলো বললেন, ন্যাটাহারি, ব্যাংকোয়েট।

ন্যাটাহারি তাতেই সব বুঝে গেলেন।কটা বাড়তি লোক নিয়ে আসছেন স্যর?

প্রায় কুড়িটা।

চল্লিশটা উর্দি, আর আশিটা দস্তানা আমি রেডি করে রেখে দেব। মাথার পাগড়িও দিয়ে দিই স্যর? রাজ্যের বড় বড় লোক আসছেন। লাটসায়েব আসছেন নাকি?

আসতে পারেন। কিছুই বলা যায় না। বোসদা বললেন।

নিত্যহরি বললেন, তা হলে তো বাজনদারদেরও সাজাতে হয়।

হ্যাঁ, তাদেরও জামা-কাপড়ের ব্যবস্থা যেন ঠিক থাকে।

তাদের জামা-কাপড় তো হবেই স্যার, ন্যাটাহারি যতক্ষণ রয়েছে। কিন্তু, আমি তাই বলে গোমেজের বাজনার জামা-কাপড়ের ব্যবস্থা করতে পারব না। ধাড়ি ধাড়ি পাঁচটা ছোড়া স্যর, একবার লাঞ্চের সময় কেঁকুঁ কেঁকুঁ করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল, আবার রাত্রে গিয়ে ঘণ্টাখানেক কেঁকু কেঁকু করলে। অন্য সময়ে ভোঁসভোঁস করে নাক ডেকে ঘুমোবে। যন্তর হচ্ছে নিজের সন্তানের মতো। তার জামা-কাপড় তার মায়েরা দেখবে, আমাকে দেখতে হবে কেন?

মার্কোপোলো, কেন জানি না, নিত্যহরিকে একটু প্রশ্রয় দেন। মুখ ফিরিয়ে একটু মৃদু হেসে বললেন, মিস্টার বোস সব ব্যবস্থা করবেন। তুমি এখন যাও। তারপর আমাকে আড়ালে ডেকে বললেন, আমাকে একটু বেরোতে হবে। বায়রন একটা স্লিপ পাঠিয়েছে। হয়তো সুশানের কোনো খবর জোগাড় করতে পেরেছে। বোসকে বলল, ব্যাংকোয়েটের সব ব্যবস্থা যেন ঠিক করে রাখে।

 

হোটেলে সারাদিন উত্তেজনার মধ্যে কেটে গেল। কারুর এক মুহূর্ত নিশ্বাস ফেলবার সময় নেই। বোসদা আজ রিসেপশনে উইলিয়মকে বসিয়ে রেখে, ব্যাংকোয়েটের কাজে আমাকে নিয়ে ছোটাছুটি করছেন। ওয়েটাররা প্যান্ট্রিতে বসে ফর্সা কাপড় দিয়ে ছুরি, কাঁটা, চামচ মুছে চকচক করছে। পরবাসীয়া তাদের বলছে, প্রত্যেকটি জিনিস আমি গুনে তুলব। হারালেই মাইনে থেকে দাম যাবে।

আর এমনি উদ্বেগের মধ্যে আমাদের শাজাহান হোটেল ক্রমশ সেই মোহনায় হাজির হল, দিনের নদী যেখানে রাত্রের পারাবারে এসে মেশে। সত্যসুন্দরদা ততক্ষণে ঘর সাজিয়ে ফেলেছেন। ন্যাটাহারিবাবুর কাপড়ে তৈরি সাড়ে তিনশ বুনো শুয়োরের মাথা তখন ব্যাংকোয়েট হল-এ অপেক্ষা করছে।

 

মানবপ্রেম সমিতি একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। আজ যাঁদের নৈশ ভোজসভা, তারা সম্প্রতি কলকাতায় এই আন্তর্জাতিক সমিতির একটি শাখা গড়ে তুলেছেন। অতিথিদের অভ্যর্থনার জন্য মিস্টার আগরওয়ালা, মিস্টার ল্যাংফোর্ড এবং খানবাহাদুর হক কাউন্টারের সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন। মিস্টার আগরওয়ালা পরেছেন জাতীয় পোশাক, গলাবন্ধ কোট ও চুস্ত। মিস্টার ল্যাংফোর্ড সান্ধ্য ইউরোপীয় পরিচ্ছদ। আর খানবাহাদুর তার মোগলাই ট্রাডিশনকে অবজ্ঞা করেননি। মানবসেবার জন্য এঁদের সকলেরই দুশ্চিন্তার অবধি নেই। এঁদের সকলেরই অনেক কাজ আছে; অনেক সমস্যা আছে; সুখ উপভোগ করবার অনেক জায়গা আছে। কিন্তু সে-সব ছেড়ে দিয়ে তারা যে সন্ধে থেকে হোটেলে এসে দাঁড়িয়ে আছেন তার একমাত্র কারণ সমাজের জন্য, দেশ ও জাতির বৃহত্তম স্বার্থের জন্য তারা ত্যাগ করতে চান।

একটু খাতির কোরো, আগরওয়ালাকে দেখিয়ে বোসদা ফিসফিস করে বললেন। ত্রিমুর্তির মধ্যে মধ্যবয়সী আগরওয়ালাকে খাতির করতে যাব কেন, প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তার আগেই বোসদা বললেন, দু নম্বর সুইটটা ওঁরাই সব সময়ের জন্যে ভাড়া করে রেখেছেন। ওঁদের কোম্পানিরই অতিথিশালা। করবীকে চেনো তো? ওঁদেরই হোল-টাইম হোস্টেস। মাইনে ছাড়াও করবী বোনাস পায়।

এতদিন খবরের কাগজে স্বদেশি সংগ্রাম, বিদেশি শোষণ, হিন্দু-মুসলমানের পার্থক্য ইত্যাদি সম্বন্ধে যা পড়েছি দেখলাম তার সবই মিথ্যে। মিস্টার আগরওয়ালা অতিথিদের লিস্ট হাতে ল্যাংফোর্ডের কানে কানে কী বললেন। ল্যাংফোর্ড খিল খিল করে হাসতে হাসতে আগরওয়ালার ঘাড়ে গড়িয়ে পড়লেন। সেই হাসির ঢেউ খানবাহাদুরের উপর পড়তে দেরি হল না। তিনটে সভ্যতা মিলে মিশে আমারই চোখের সামনে একাকার হয়ে গেল।

এবার অতিথিরা আসতে আরম্ভ করেছেন। মার্কোপোলো বাইরে থেকে ফিরে এসে একটা ধোপভাঙা সার্কস্কিনের স্যুট পরে হ-এর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ওঁকে খুবই উদ্বিগ্ন মনে হল। কিন্তু এত লোকের ভিড়ের মধ্যে কাছে গিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না।

আমরাও ধোপভাঙা স্যুট পরেছি। বোসদা একসময় আমার প্রজাপতি টাইটা একটু টেনে সোজা করে দিলেন। ফিসফিস করে বললেন, স্টাইলের মাথায় চলতে হবে। হাঁদাগঙ্গারাম হলেই বিপদ।

কলকাতার কলকাতাত্ব যাঁদের নিয়ে, তাঁদের সবাইকেই বোসদা বোধহয় চেনেন। একজনকে দেখিয়ে বললেন, উনি মিস্টার চোখানিয়া, কটন কিং। চোখানিয়া একলাই এসেছেন, মিসেসকে উনি কখনও আনেন না।

মানবপ্রেম সমিতির তিনজন সদস্যই চোখানিয়ার দিকে এগিয়ে গেলেন। চোখানিয়া এবার আগরওয়ালার পিঠে একটা মৃদু থাপ্পড় দিয়ে হ-এর দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন। মানুষের সেবার মহৎ উদ্দেশ্যে চোখানিয়া তার মূল্যবান সময় নষ্ট করতে দ্বিধা করেননি। তিনি শাজাহান হোটেলে ছুটে এসেছেন।

বোসদা বললেন, আমি মুখস্থ বলে দিতে পারি, কে কে আসবেন। কলকাতায় যত পার্টি হয়, তাতে সব কটা লোকই এক। কারণ সবাই এক লিস্ট দেখে ছাপানো কার্ড পাঠায়। একই লোকের কাছে রোজ নেমন্তন্ন যায়। রোজই তিনি জামা-কাপড় পরে সন্ধেবেলায় বেরিয়ে পড়েন। বিভিন্ন হোটেলে যান, না হয় বিভিন্ন ক্লাবে, না হয় আলিপুর কিংবা বর্ধমান রোডের বাড়িতে।

বোসদা ফিসফিস করে বললেন, কলকাতাকে এবং মানবপ্রেমিক নাগরিকদের নিজের চোখে দেখে নাও। কারণ কাল যখন খবরের কাগজে এই অধিবেশনের রিপোর্ট পড়বে, তখন আসল জিনিসের কিছুই থাকবে না। সেখানে শুধু বক্তৃতার রিপোর্ট থাকবে। কে কী বলবেন, তার সামারি কাগজের অফিসে চলে গিয়েছে। রাম না জন্মাতেই রামায়ণ লেখা হয়ে গিয়েছে!

রোগামতো এক ভদ্রমহিলা এবার ক্যামেরা হাতে একা ঢুকলেন। বোসদা বললেন, শম্পা সান্যাল, শীর্ণ ফরাসি সৌন্দর্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী! আগে ছিলেন ঘোষ, তারপর বোধহয় ভ্যালেংকার না কোন এক মারাঠিকে বিয়ে করেছিলেন। তারপর বোধহয় সাহা, তারপর মিত্তির! এবার আবার পুরনো কুমারী নামে ফিরে এসেছেন। মিস শম্পা সান্যাল। সোসাইটি রিপোর্টার।

সেটা কী জিনিস? আমি বোকার মতো প্রশ্ন করলাম।

সোসাইটি জার্নাল বেরোয় না? কে কোথায় পার্টি দিচ্ছেন, কে কোথায় সমাজসেবা করছেন, কী করে পশম বুনে বাচ্চাদের জামা করতে হয়, ঘর সাজাতে হয়, রাঁধতে হয়, এইসব যেখানে লেখা থাকে। ওঁর কাগজের হাজার হাজার বিক্রি। কলকাতার সব পার্টিতে ওঁকে পাবে। ইন ফ্যাক্ট, ওঁকে না হলে পার্টিই হয় না। কারণ পার্টি দিলে, অথচ সোসাইটি জার্নালে রিপোর্ট বেরুল না, তাহলে সব বৃথা।

শম্পা সান্যাল হাতের ক্যামেরাটা দোলাতে দোলাতে কাউন্টারে এলেন। বোসদা মাথা দুলিয়ে বললেন, গুড ইভনিং।

শম্পা বললেন, এবার আপনারই একটা ফটো ছাপিয়ে দেব। কলকাতায় যত সুন্দর পার্টি হয়, তার অর্ধেক শাজাহানেই হয়।

বোসদা বললেন, অসংখ্য ধন্যবাদ। শম্পা বললেন, আমার মোটেই ভেতরে যেতে ইচ্ছে করছে না। আমার কী ইচ্ছে করছে জানেন? ইচ্ছে করছে কোনো ঘরে বসে বসে আপনার সঙ্গে একলা গল্প করি।

বোসদার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। কিছু না বলে তিনি চুপ করে রইলেন। মিস সান্যাল বললেন, আপনার ঘর কোথায়? কোন তলায়?

বোসদা বোধহয় ভদ্রমহিলার প্রশ্নে বিপদের ইঙ্গিত পেলেন। তাঁর স্বভাবসিদ্ধ কায়দায় বেমালুম বললেন, ছাদের উপর। আমরা তিনজনে একটা ঘরে থাকি। আমি, শংকর, আর একজন। সে বেচারা আবার আমাশায় শয্যাশায়ী হয়ে সর্বদা ঘরেই রয়েছে।

মিস সান্যাল একটু স্রগ করলেন, পুওর বয়! একটা আলাদা ঘরও দেয় না।

সবই ভাগ্য, শম্পা দেবী। প্রাইভেসি বলে কোনো বস্তু ভগবান আমাদের মতো হোটেল কর্মচারীদের কপালে লেখেননি। বোসদা গভীর নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। তারপর মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, আর কোনো পার্টি ছিল নাকি?

হ্যাঁ, দুটো ককটেল সেরে আসছি। মিষ্টি ফাংশন। আরও মিষ্টি লাগত যদি আপনার মতো কোনো হ্যান্ডসাম ইয়ংম্যান আমার পাশে থাকত। সত্যি বলছি, বিলিভ মি।

উইলিয়ম ঘোষের দিকে বোসদা কি ইঙ্গিত করলেন। উইলিয়ম বললেন, মিস সানিয়েল, চলুন আমরা হ-এ যাই।

উইলিয়মের হাতে ক্যামেরাটা দিয়ে সোসাইটি রিপোর্টার মিস সান্যাল সামনে এগিয়ে চললেন।

বোসদা গম্ভীরভাবে বললেন, ক্রিমিনাল। বাঙালি মেয়েদের কেন যে ওরা হুইস্কি খেতে অ্যালাউ করে। ভদ্রমহিলার আজ মাথার ঠিক নেই।

আজকের পার্টিতে আছেন ব্যারিস্টার সেন, রেডিওথেরাপিস্ট মিত্র, গাইনোকলজিস্ট চ্যাটার্জি, ক্রীড়া-রাজনীতিক বসু, রাজনৈতিক ক্রীড়াবিদ পাল। আর আছেন রাজারা—পাটের রাজা, তেলের রাজা, ঘিয়ের রাজা। লোহা, অ্যালুমিনিয়াম, কাপড়ের রাজরাজড়ারাও বাদ যাননি। অতীতের স্পেসিমেন হিসেবে বিলীয়মান জমিদারদের দুএকজন প্রতিনিধিও আছেন।

এবার যে ভদ্রলোক শাজাহান হোটেলে ঢুকলেন তাকে দেখেই বোসদা ফিসফিস করে বললেন, চিনে রাখো। লক্ষ্মীর বরপুত্র, শিল্পজগতে আমাদের আশা-ভরসা মাধব পাকড়াশী। গরিবের ছেলে শ্রীমাধব অতি সামান্য অবস্থা থেকে সাফল্যের পর্বতশিখরে উঠেছেন।

ভদ্রলোক একেবারে সোজা আমাদের কাউন্টারে হাজির হলেন। তাঁর পাশের ভদ্রমহিলাকে দেখেই আমি চমকে উঠলাম, মিসেস পাকড়াশী! মোটাপাড় শান্তিপুরী সাদা খোলের শাড়ি পরেছেন। সিঁথিতে জ্বলজ্বল করছে সিঁদুর।

মাধব পাকড়াশী ইভনিং স্যুট পরেছেন। তাকে দেখেই বোসদা বললেন, নমস্কার স্যর। পাকড়াশী তার অমায়িক ব্যবহারের জন্যে বিখ্যাত। মিষ্টি করে বললেন, আমি ভালো। ওঁর শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছে না। প্রায়ই নানারকম অসুখে ভুগছেন।

লজ্জাবতী গৃহবধূর মতো মিসেস পাকড়াশী মাথা নাড়লেন। তোমার যেমন কথা। সারাদিন খেটে খেটে তুমিই শরীরটাকে নষ্ট করছ।

মাধব পাকড়াশী হেসে বললেন, গত তিন সপ্তাহে একটা দিন যায়নি যেদিন ডিনারের নেমন্তন্ন নেই। তাছাড়া বারোটা ককটেল, চোদ্দটা লাঞ্চ। তাও গোটা পনেরো রিফিউজ করেছি। কিন্তু সব সময় রিফিউজ করাও মুশকিল।

বোসদা মাথা নেড়ে বললেন, আপনারা হলেন স্যর ক্যালকাটা সোসাইটির ফাদার-মাদার। লোকে তো আপনাদের আশা করবেই।

মুশকিল তো আমার স্ত্রীকে নিয়ে। পুজোআচ্চা নিয়ে সারাদিন পড়ে থাকবেন। বাইরে বেরোতে চাইবেন না। অথচ এভরিহয়ার, এমনকি বোম্বাইতেও স্ত্রীরা স্বামীর পাবলিক রিলেসন্স অফিসারের কাজ করেন। আমাকে প্রত্যেক ফাংশনে উনি কেন এলেন না এক্সপ্লেন করতে হয়। আমার খোকার সঙ্গে কোনো শাই গার্ল অর্থাৎ কিনা লাজুক মেয়ের বিয়ে দেব না।

মিসেস পাকড়াশী তখন ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছেন। চলো, সভার কাজ বোধহয় আরম্ভ হয়ে যাবে।

মাধব পাকড়াশী বললেন, আঃ আমাকে একটু অর্ডিনারি লোকদের সঙ্গে থাকতে দাও। একটু ফ্রেশ অক্সিজেন মনের মধ্যে ঢুকিয়ে নিতে দাও। ওখানে আবার আগরওয়ালা রয়েছে, এখনই মাধব ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ার অ্যালটমেন্ট সম্বন্ধে কথা বলতে আরম্ভ করবে।

তা হলে আমি একটু এগিয়ে যাই। একে তো ইন্ডাস্ট্রি তোমাকে নাক উঁচু লোক বলে ভাবতে শুরু করেছে।

যাও, প্লিজ। এই তো প্রকৃত পি আর ওর কাজ। মাধব পাকড়াশী স্ত্রীকে উৎসাহ দিলেন।

মিসেস পাকড়াশী বোসদার দিকে একবার তাকিয়ে হ-এর দিকে চলে গেলেন। সেই চকিত দৃষ্টির মধ্যে বোসদা নিশ্চয়ই তার ইঙ্গিত খুঁজে পেলেন। আমারও মনে হল, এই কদিনে আমিও অনেক চালাক হয়ে উঠেছি। অনেক চকিত চাহনির গোপন সংকেত আমার কাছে সহজেই বোধগম্য হয়ে উঠছে। স্ত্রীর গমন-পথের দিকে তাকিয়ে মাধব পাকড়াশী বললেন, আমার স্ত্রী না হলে, এই সাম্রাজ্য আমি গড়ে তুলতে পারতাম না। রিয়েলি ওয়ান্ডারফুল ওয়াইফ।

পাকড়াশী কেবল ফ্রেশ অক্সিজেনের আশায় কাউন্টারে এসে দাঁড়াননি। আরও দরকার ছিল। এবার সেই প্রসঙ্গে এলেন, হ্যাঁ যা বলছিলাম, জার্মানি থেকে দুজন ভদ্রলোক বোধহয় সামনের সপ্তাহে কলকাতায় আসবেন। ওঁদের জন্য দুটো সুইট চাই। বেস্ট রুম। ক্লাবে রাখতে পারতাম, কিন্তু ওখানে বড্ড জানাজানি হয়ে যায়। ওঁরা যে কারণে আসছেন, সেটা আমি এখন কাউকে জানতে দিতে চাই না।

বোসদা আমাকে বললেন, রেজিস্টার খোললা।

রেজিস্টার খুললাম। সুইট নেই। সব অ্যাডভান্স বুকিং হয়ে রয়েছে। বললাম, মুশকিল হয়ে গিয়েছে। ফরেন কালচারাল মিশন আসছে, তারা দু-মাস আগে থেকে সুইটগুলো নিয়ে নিয়েছে।

তাহলে উপায়? মিস্টার পাকড়াশী জিজ্ঞাসা করলেন।

কী হয়েছে? কী হয়েছে? মিস্টার আগরওয়ালা হঠাৎ সেখানে এসে দাঁড়ালেন।

দুটো সুইট চাইছিলাম। কিন্তু ক্যালকাটার হোটেলগুলোর এমন অবস্থা যে মাসখানেকের নোটিশ না দিলে একটা খাটিয়াও পাওয়া যায় না। পাকড়াশী বললেন।

আমি থাকতে আপনি সুইট পাবেন না, সে হোয় না। মিস্টার আগরওয়ালা বললেন। আমাদের পার্মানেন্ট গেস্ট হাউস রয়েছে।-বাই ইস্পেশাল অ্যারেঞ্জমেন্ট উইথ শাজাহান। আমাদের হোস্টেসকে ডাকছি।

বোসদা আমাকে বললেন, তাড়াতাড়ি করবী দেবীকে দুনম্বর সুইট থেকে ডেকে নিয়ে এস। আমি সেদিকেই ছুটলাম।

 

করবী গুহ তখন ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বোধহয় প্রসাধন করছিলেন। যখন দরজা খুললেন, তখনও শ্রীমতী গুহর প্রসাধন শেষ হয়নি। খোঁপাতে একটা বেলফুলের মালা জড়াচ্ছিলেন। আমাকে দেখেই কাজলকালো চোখ দুটি বিকশিত করে তিনি মৃদু হাসলেন।

মেয়েদের দিকে তাকিয়ে তাঁদের বয়স নির্ধারণ করবার যে বিরল শক্তি ভগবান কাউকে কাউকে দিয়ে থাকেন, আমি তার থেকে বঞ্চিত। সাহিত্যের প্রয়োজনে, কম অথবা বেশি এই দুটি শব্দ দিয়েই আমি কাজ চালিয়ে নিই। ওইটুকুও বলতে না হলে আমি খুশি হতাম। পুরুষ চরিত্রের বয়স নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। অথচ মেয়েদের ক্ষেত্রে যুগযুগান্তর ধরে এটি একটি প্রয়োজনীয় তথ্য বলে সম্মানিত হয়ে এসেছে। করবী দেবীর বয়স বেশি নয়। এবং তার যুবতী শরীর যে বয়সকে গ্রাহ্য করে না, একথা জোর করে বলতে পারি! করবী দেবীর দেহের কোথাও কোথাও যেন ভাস্কর্যের ছাপ আঁকা। আয়ত চোখ, সুতীক্ষ্ণ নাক, মসৃণ গণ্ড। একটু হয়তো কমনীয়তার অভাব। করবী দেবীর গ্রীবাটি সুন্দর। আর সমান্তরাল কঁধ। বক্ষদেশ ঈষৎ স্কুল। কোমরটা তীক্ষ্ণ শাসনে ক্ষীণ রেখেছেন।

মৃদু হেসে করবী দেবী বললেন, আপনি না বোসের অ্যাসিস্ট্যান্ট?

বললাম, আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনাকে একবার তিনি ডাকছেন।

মিস্টার বোস ডাকছেন? ভদ্রমহিলা যেন একটু বিরক্ত হলেন।

বললাম, মিস্টার আগরওয়ালা এবং মিস্টার পাকড়াশীও ওখানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।

ও, তাই বলুন। করবী দেবী এবার যেন ব্যাপারটার গুরুত্ব উপলব্ধি করে শরীরের গাড়িতে স্টার্ট দিলেন। ঝকঝকে নতুন গাড়ির স্টার্ট নেওয়ার মধ্যে যেমন একটা প্রচেষ্টাহীন ছন্দ আছে, করবী দেবীর চেয়ার থেকে উঠে পড়ার মধ্যেও তেমন একটু চটুল ছন্দ ছিল।

কাউন্টারে এসে দেখলাম উইলিয়ম একা দাঁড়িয়ে রয়েছে। বললে, বোধহয় সভার কাজ আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। ওঁরা সবাই ওদিকে চলে গিয়েছেন।

আমরা দুজনও হন্তদন্ত হয়ে সেদিকে ছুটলাম। করবী দেবী বললেন, মিস্টার আগরওয়ালা নিজে ডাকলেন? বেলা তিনটের সময় তো ওঁর সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে, তখন কিছুই তো বললেন না।

মাধব পাকড়াশী, মিসেস পাকড়াশী এবং মিস্টার আগরওয়ালা তখন ব্যাংকোয়েট হ-এর একটা টেবিল দখল করে বসেছেন। বোসদা ঘরের কোণ থেকে মাইকটা টেনে এনে সভাপতির মুখের সামনে হাজির করলেন। মাননীয় সভাপতি শুধু মানবসেবার মহান উদ্দেশ্যে এরোপ্লেনযোগে কলকাতায় হাজির হয়েছেন। ন্যাশনাল ড্রেসে সজ্জিত সভাপতি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন। মাথার টুপিটা তিনি এবার ঠিক করে নিলেন।

তাঁর দিকে তাকিয়ে করবী দেবী ফিক করে হেসে ফেললেন। নিজের মনেই বললেন, ও-হরি! ইনি! তাই বলি, দুপুরে ওকে এত খাতির কেন?

করবী দেবীর কথা শোনবার আগেই সভাপতির বক্তৃতা আরম্ভ হয়ে গেল। কলকাতার বরেণ্য নাগরিকবৃন্দ, আপনাদের অমূল্য সময় ব্যয় করে এই সন্ধ্যায় এখানে সমবেত হবার যে কষ্ট আপনারা স্বীকার করেছেন, তার জন্য আমি আপনাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি। ভারতবর্ষে আমরা এতদিন কেবল জাতির কথাই চিন্তা করে এসেছি। কিন্তু এখন বৃহত্তর পরিধিতে মানুষের কথা ভাববার সময় এসেছে, বিশেষ করে এই ক্যালকাটারই একজন সন্তান যখন বলে গিয়েছেন, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।

সভাপতির বক্তৃতা একটা আলাদা টেবিলে বসে সাংবাদিকরা লিখে নিচ্ছিলেন। তারা হঠাৎ পেন্সিল থামিয়ে নিজেদের মুখের দিকে তাকাতে লাগলেন। সভাপতির পাশে প্রখ্যাত সাহিত্যিক নগেন পাল বসেছিলেন। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে সভাপতির কানে কানে কী যেন বললেন। সভাপতি একটু থেমে বললেন, ভারতীয় সাহিত্যের অন্যতম ভরসা মাননীয় নগেন পাল আমাকে মনে করিয়ে দিলেন, কবি চণ্ডীদাসের সঙ্গে ক্যালকাটার কোনো সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু আমি বলি, মিস্টার দাস তো এই বাংলা দেশেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং কলকাতাকে বাদ দিয়ে কে বেঙ্গলের কথা চিন্তা করতে পারে?

এবার মৃদু হাততালি পড়ল। এবং সভাপতি ঘোষণা করলেন, বিশ্বের প্রধান সমস্যা হল খাবার সমস্যা। বিশেষ করে অন্ন। পৃথিবীতে যে চাল উৎপন্ন হচ্ছে, তাতে প্রতিটি মানুষকে পেট ভরে খেতে দেওয়া সম্ভব নয়। এবার সভাপতি একটি কাগজের টুকরো থেকে জনসংখ্যা সম্বন্ধে বিভিন্ন স্ট্যাটিসটিকস মাইকের মধ্য দিয়ে সমাগত অতিথিদের ছুড়ে দিতে লাগলেন।

করবী দেবী তখনও দরজার গোড়ায় আমার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আমাকে বললেন, বেশ বিপদে ফেললেন। এমনভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি বলুন তো?

আমি বললাম, বক্তৃতা শেষ হলেই মিস্টার আগরওয়ালার কাছে চলে যেতে পারবেন। করবী দেবী মুখ ভেঙচিয়ে বললেন, এ বক্তৃতা কি আর এখন শেষ হবে!

আমি বললাম, এটা তো আর মনুমেন্টের তলা নয়। হোটেলের ব্যাংকোয়েট হল, বক্তৃতা এখনই শেষ হয়ে যাবে।

সভাপতি বললেন, স্বল্প সম্পদ সবার প্রয়োজনমতো বিতরণ করার মধ্যেই রয়েছে মানব-সভ্যতার সাফল্যের চাবিকাঠি। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের লোকদের এবং আমাদের নিজের দেশের ভাইবোনদের—যে দেশে বুদ্ধ, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধী জন্মেছেন—আত্মত্যাগ করতে হবে। মানবসেবা সমিতির কোনো ভোজসভায় আমরা চাল ব্যবহার করব না। তাছাড়া আরও কুড়িজন সদস্য আগামী কয়েক বছর বাড়িতেও চাল খাবেন না বলে ঘোযণা করেছেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন মিস্টার এ আগরওয়ালা, মিস্টার… সভাপতি নাম পড়ে যেতে লাগলেন। করবী দেবী আবার ফিক করে হেসে ফেললেন, দূর মশাই, আপনি কোথায় নিয়ে এলেন? এখানে সবারই কি ডায়াবিটিস?

মানে? আমি ফিসফিস করে প্রশ্ন করলাম।

আগরওয়ালা ভাত খাবেন কী? ওঁর তো ডায়াবিটিস। আমার ঘরেও তো সিরিঞ্জ আর ইনসুলিন ইঞ্জেকশন আছে। যেদিন এখানে রাত্রের জন্য একটু বিশ্রাম করতে আসেন, সেদিন নিজেই একমাত্রা নিয়ে নেন।

মেনুকার্ডগুলো প্রত্যেকটা টেবিলেই দুখানা করে দেওয়া আছে। সবাই একমনে সেটা দেখছিলেন। একজন বেশ টাইট গুণ্ডাধরনের বেঁটে ও মোটা ভদ্রলোক টেবিলে জনাতিনেক বন্ধু নিয়ে বসেছিলেন। ভদ্রলোক আমাকে ডাকলেন। আমি মাপা স্টেপে ওঁর সামনে এসে মাথা নিচু করে অভিবাদন করলাম। ডান হাতের মেমোবই ও মেনুকার্ডটা বাঁ হাতে চালান করে দিয়ে, ফিসফিস করে বললাম, ইয়েস স্যর।

ভদ্রলোক বললেন, এ কি নিরামিষ ডিনার নাকি?

বললাম, না, স্যার। আমিষ আইটেমও অনেক রয়েছে।

আঃ, তা বলছি না, ভদ্রলোক বিরক্ত কণ্ঠে বললেন। বলছি, দেশে–হয় চালের অভাব রয়েছে। তাতে না-হয় ধেনোটা খাওয়া উচিত হবে। কিন্তু অন্য মালের ব্যবস্থা হয়েছে কি?

আমি আমতা আমতা করতে লাগলাম। বোসদা একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মুহূর্তের মধ্যে কোথা থেকে আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। আমাকে সরিয়ে দিয়ে বললেন, এক্সকিউজ মি স্যর, আমি মিস্টার ল্যাংফোর্ড অথবা মিস্টার আগরওয়ালাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

একটা ঠ্যাং অন্য পায়ের উপর তুলতে তুলতে ভদ্রলোক বললেন, ল্যাংফোর্ডে আর কাম নেই, ওই আগরওয়ালাকেই পাঠিয়ে দিন।

এক কোণ দিয়ে মিস্টার আগরওয়ালার দিকে যেতে যেতে বোসদা বললেন, ডেঞ্জারাস লোক, ফোকলা চ্যাটার্জি। আসল নাম আর এন চ্যাটার্জি, নামকরা বক্সার ছিল। তখন ঘুষি মেরে কে ওঁর সামনের দুটো দাঁত ভেঙে দিয়েছিল। পাঁড়মাতাল। চোখগুলো সবসময় লাল জবা ফুলের মতো হয়ে আছে। ছোট করে ছাঁটা মাথার চুলগুলো বুরুশের মতো খাড়া হয়ে থাকে।

কলকাতার সব পার্টি আর ককটেলে ওঁর নেমন্তন্ন হয়। অন্তত চ্যাটার্জি নাকি খুব লাকি বয়। উনি এলে পার্টি জমতে বাধ্য। অন্তত অনেকের তাই বিশ্বাস। শুধু সিনেমার পার্টিতে এখন আর কেউ ওঁকে ডাকে না। অভিনেত্রী শ্রীলেখা দেবীর শাড়িতে সেবার এইখানেই উনি বমি করে দিয়েছিলেন। শ্রীলেখা দেবী সেই থেকে বলেছেন, ফোকলা চ্যাটার্জি যে পার্টিতে আসবে, সেখানে তিনি আর যাবেন না।

বোসদাকে আসতে দেখেই আগরওয়ালা উঠে পড়েছিলেন। ফিসফিস করে বোসদা বললেন, মিঃ চ্যাটার্জি ডাকছেন।

ও মাই লর্ড! বলে আগরওয়ালা ফোকলার টেবিলের দিকে চললেন।

ফোকলা চ্যাটার্জি বললেন, আগরওয়ালা, এ কেমন ধরনের রসিকতা? মানবসেবা করা হবে; অথচ এতগুলো কেষ্টর জীবনে কষ্ট দিচ্ছ। মেনুতে কোনো মালের নাম নেই।

সভাপতি তখন বক্তৃতা করে যাচ্ছেন। আগরওয়ালা বেশ বিপদে পড়ে গিয়েছে। ফোকলা চ্যাটার্জি আগরওয়ালার হাত চেপে ধরে বললেন, পালাচ্ছ কোথায়? এখনি আমি সীন ক্রিয়েট করতে পারি জানো? আমি সভাপতি-টতি কাউকে কেয়ার করি না। কথায় বলে, ফোকলার নেই ডেন্টিস্টের ভয়।

আগরওয়ালা বললেন, মাই ডিয়ার ফেলল, আমাদেরও ককটেল দেবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সভাপতি রাজি নন। উনি সোজা বলে দিয়েছেন, অ্যালকহলিক বীভারেজ সার্ভ করা হলে উনি বক্তৃতা করতে পারবেন না।

অশ্লীল গালাগাল দিয়ে ফোকলা বললেন, ব্যাটাছেলে কি ভাটপাড়ার বিধবা পিসিমা! ওঁর অমন গুড়ের নাগরির মতো চেহারা মাল না-টেনেই হয়েছে বলতে চাও?

আগরওয়ালা ফোকলাকে সামলাবার জন্য বললেন, পাবলিকলি ওঁদের পক্ষে ড্রিঙ্ক করা!

ফোকলা এবার উঠে পড়ে বললেন, তাই বলো। বেশ, প্রাইভেটলিই আমি ড্রিঙ্ক করব। আমি মমতাজ-এ চলে যাচ্ছি।

বোসদা বললেন, বার দশটা পর্যন্ত ভোলা আছে। ওখানে সবরকম ড্রিঙ্কস পাওয়া যাবে।

গোটাপঞ্চাশেক টাকা এখন ছাড়ো দেখি। মানিব্যাগ আনতে ভুলে গিয়েছি। আর না-হয় বলে দাও, আমার মালের টাকাটা তোমাদের এই বিলের সঙ্গে যেন ধরে নেয়।

আগরওয়ালা বললেন, বেশ তাই হবে। ফোকলা চ্যাটার্জি চেয়ার থেকে উঠে পড়ে বার-এর দিকে চললেন। যেতে যেতে বললেন, শ্লা, দু-দুটো ককটেল-এ নেমন্তন্ন ছিল। নিরিমিষ জানলে কোন ব্যাটাচ্ছেলে এই হরিসভার কেত্তন শুনতে আসত।

বোসদা আমাকে বললেন, বার-এ বলে দিয়ে এসো, ওঁর কাছে যেন। টাকা না চায়।

ফোকলা চ্যাটার্জিকে বার-এ বসিয়ে আবার যখন ফিরে এলাম, তখন সভাপতি পৃথিবীর সব মানুষকে ভালোবেসে, উপস্থিত ভদ্রমহোদয় এবং মহোদয়াগণ যে মহান আদর্শ স্থাপন করলেন, তার জন্য সাধুবাদ জানাচ্ছেন। প্রেম, প্রীতি ও ত্যাগ তিতিক্ষার এই পথেই যে দেশের মানুষরা সার্থকতার দিকে এগিয়ে যাবেন সে-সম্বন্ধে তার কোনো সন্দেহ রইল না।

এবার ডিনার। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আইনত সাপারও বলা যেতে পারে। চালের কোনো সংস্রব না থাকায়, আড়াই টাকা করে চার্জ বেশি নেওয়া হয়েছে। সাড়ে তিনশ লোকের মধ্যে তিরিশটা বেয়ারা এবং আমাদের পাঁচজন ছোকরা ঘুরে ঘুরে হিমশিম খেয়ে যাবার অবস্থা।

সভাপতি তার মধ্যেই চিৎকার করে আমাকে বলেছিলেন, কী হে ছোকরা, এতগুলো লোক তোমরা, অথচ এই কটা গেস্টকে তাড়াতাড়ি সার্ভ করতে পারছ না?

আমি চুপ করে দাড়িয়ে ছিলাম। সভাপতি বললেন, ইন-ইন্ডিয়া চারটে পাঁচটা ছোকরা চার পাঁচশ লোককে খাইয়ে দেয়।

মুরগির উপর অস্ত্রোপচার করতে করতে মাধব পাকড়াশী গম্ভীরভাবে বললেন, এর নাম ইংলিশ-সার্ভিস।

তাহলে এটা বোঝা যাচ্ছে যে, অনেক বিষয়ে ওয়েস্ট ক্রমশ আমাদের পিছনে পড়ে থাকছে।

নগেন পাল বললেন, আপনি স্যর একটা বই লিখুন—ডিক্লাইন অ্যান্ড ফল অফ দি ওয়েস্ট।

লিখলেই হয়। জওহরলালের ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া যারা পাবলিশ করেছে তারা বহুবার আমাকে রিকোয়েস্ট করেছে।

সভাপতির ছবি আমি অনেকবার কাগজে দেখেছি। ওঁর বক্তৃতা শ্রদ্ধার সঙ্গে বহুবার পড়েছি। তাই ওঁর বকুনিকে আমার বকুনি বলেই মনে হল না। শ্রদ্ধেয় সভাপতি প্রথমে বলেছিলেন তিনি ভেজিটারিয়ান কিন্তু ডিম খাবেন। হঠাৎ মুরগির ঘ্রাণে বোধহয় তার মত পরিবর্তন হল। পাকড়াশীকে প্রশ্ন করলেন, মাংসটা নরম?

বেশ নরম। ক্যালকাটার মাংসের তুলনা নেই। এত জায়গায় তো যাই, কিন্তু এত নরম, এত সুস্বাদু কোথাও নেই! পাকড়াশী মৃদু হেসে বললেন।

সভাপতি বললেন, ওহে ছোকরা, যাও তো, একটু চিকেন নিয়ে এসো তো আমার জন্যে।

একটা ট্রে নিয়ে ওঁর সামনে ধরলাম। কোনোরকম কথাবার্তা না বলে সমস্ত ট্রেটাই নিজের প্লেটে ঢেলে নিলেন তিনি। কাঁটা চামচ ফেলে দিয়ে সভাপতি ভারতীয় প্রথায় ডান হাত দিয়ে ধরে মাংসের হাড় মড় মড় করে চিবোতে লাগলেন। সেই হাড়ভাঙা শব্দে, তার পাশের বিদেশি কনসালদের কয়েকজন অবাক হয়ে ঘাড় ফেরালেন। নাকের সিকনিটা বাঁ হাতের রুমালে মুছতে মুছতে তিনি বললেন, গতবারে ফরেন ট্যুরে গিয়ে আমি এইটে আরম্ভ করি। ওদের তাজ্জব বানিয়ে দিয়েছিলুম। বম্বের ওই আধামেমসায়েব রাইটার মিস পোস্তওয়ালা আমার পাশে বসে বাধা দেবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আমি খাঁটি ভারতীয়, আমি কেন শুনতে যাব? আমি চেটেপুটে ঝোল পর্যন্ত খেয়েছিলাম।

ওদিকে তখন আইসক্রিম দেওয়া আরম্ভ হয়েছে। একসঙ্গে দুটো আইসক্রিম টেবিলের উপর তুলে নিয়ে, সভাপতি বললেন, এগুলো হজমিকারক। এসব পরে খাচ্ছি। তুমি ছোকরা চটপট আর একটু চিকেন নিয়ে এসে দেখি। ঠ্যাং আনবার চেষ্টা করবে, হাড় যেন কম থাকে।

পিছনে ফিরে চিকেনের খোঁজে যেতে যেতে শুনলাম, জাতীয়তাবাদী সভাপতি নগেন পালকে বলছেন, এটা বিদেশি কনসার্ন। এখানে কোনো মায়াদয়া করবেন না। ব্যাটারা গলায় গামছা দিয়ে দাম নেবে, লাভ করবে। লাভ বিদেশে পাঠাবে, আমাদের ফরেন একচেঞ্জ চলে যাবে। যতটা পারি উসুল করে নিই। কোনো ভয় নেই, আমার কাছে সব ব্যবস্থা আছে। জোয়ানের আরক পাবেন, সোডামিন্ট ট্যাবলেট পাবেন, কিচ্ছু ভয় নেই।

চিকেনের আর একটা প্লেট যখন ওঁর দিকে এগিয়ে দিলাম, তখন তিনি করুণ সুরে বললেন, চাট্টি ভাত না-হলে এসব জিনিস জমে না। কিন্তু কী করা যাবে, ইন্ডিয়ার জন্যে, ওয়ার্লডের জন্যে এটুকু স্যাক্রিফাইস আমাদের করতেই হবে।

একটা ঢেকুর তুলে আগরওয়ালা বললেন, তোবে যাই বলুন স্যর, আপনার স্পিচটা বহুত বড়িয়া হয়েছে।

সভাপতি তখন সশব্দে আরও বিকট একটা ঢেকুর তুলে বললেন, তা বটে। কিন্তু তার থেকে ঢের ভালো হয়েছে আজকের ডিনারের মেনু! বেটারা গলায় গামছা দিয়ে দাম নেয় বটে, কিন্তু জিনিস ভালো দেয়। ফরেন ফার্মগুলো ইন্ডিয়াতে এইজন্যেই এত এগিয়ে যাচ্ছে। . করবী দেবী ইতিমধ্যে কাজ শেষ করে ফেলেছেন। মাধব পাকড়াশীর

অতিথিদের জন্য আগরওয়ালার অতিথি সদনে পাকা ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু উনি ফিরে যেতে পারেননি। আগরওয়ালার অনুরোধে ডিনারে বসে গিয়েছিলেন। করবী দেবীর সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গেল। গোমেজের দল তখন বাজনা শুরু করে দিয়েছে। এই বাজনার একটা সুবিধে, একটা টেবিলের কথা আর একটা টেবিলে পৌছয় না। সবাই প্রাইভেসিতে নিরাপদ বোধ করেন। করবী দেবী চেয়ার থেকে উঠে পড়ে হ-এর দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসলেন। তারপর আমার সঙ্গে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন, আপনাদের সভাপতির ভড়ং দেখলে বাঁচিনে। সুইটটা ওঁর থাকবার জন্যে ঠিক করে রাখা হয়েছিল। আমার ছবি দেখতে চেয়েছিলেন। বললেন, ওখানে ওঠা তো ভালো দেখায় না। যেখানে প্রত্যেক বার উঠি, সেখানেই উঠব। তবে রাত্রে কয়েক ঘন্টা আপনাদের হোস্টেসের ঘরে বিশ্রাম করে নিতে আপত্তি নেই।

করবী দেবী এবার খিলখিল করে হেসে উঠলেন। এবং আমি কিছু বোঝবার আগেই দ্রুতগতিতে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন, যাই। সম্মানিত অতিথিকে স্বাগত জানাবার ব্যবস্থা করিগে যাই!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *