০৭. কার্বন-ডাই-অক্সাইড : পৃথিবীর ভিলেন?

০৭. কার্বন-ডাই-অক্সাইড : পৃথিবীর ভিলেন?

আমাদের বাতাসের শতকরা 99 ভাগ হচ্ছে নাইট্রোজেন এবং অক্সিজেন (যথাক্রমে 78% ও 21%)। বাকি এক শতাংশের বেশিরভাগই হচ্ছে আর্গন নামের একটা নিষ্ক্রিয় গ্যাস। এরপর অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিমাণ যে গ্যাসটির কথা বলা যায় সেটা হচ্ছে কার্বন-ডাই-অক্সাইড। কিন্তু বাতাসে তার পরিমাণ এত কম (মাত্র 0.038%) যে সেটাকে ধর্তব্যের মাঝেই আনার কথা ছিল না। কিন্তু মজার কথা হচ্ছে যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসটি শুধু যে ধর্তব্যের মাঝে আনা হয়েছে তা নয় আমাদের বর্তমান পৃথিবীতে এই গ্যাসটি হচ্ছে সবচেয়ে আলোচিত একটি গ্যাস।

কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসের নাম শুনেই বোঝা যায় যে এর মাঝে রয়েছে একটা কার্বনের এবং দুটো অক্সিজেনের পরমাণু। এটি বর্ণ এবং গন্ধহীন একটা গ্যাস। আমাদের নিশ্বাসের সাথে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বের হয়ে আসে। বাতাসে যে ক্ষুদ্র পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড রয়েছে সেটা আমাদের জন্যে বিষাক্ত নয় কিন্তু পরিমাণে বেশি হলে সেটা রীতিমতো বিষাক্ত হতে পারে। এটা বাতাস থেকে ভারী তাই অব্যবহৃত কুয়া বা গর্তের নিচে এটা জমা হয়, না বুঝে অনেক মানুষ এরকম কুয়ায় নেমে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা পড়ে।

শুধু যে কুয়াতে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে মানুষ মারা যায় তা নয়–কার্বন-ডাই-অক্সাইডের কারণে একসাথে শতশত মানুষের মারা যাওয়ারও উদাহরণ আছে। আফ্রিকায় তিনটি হ্রদ রয়েছে যেগুলোর গঠন একটু বিচিত্র। হ্রদের নিচে রয়েছে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ এবং সেই জ্বালামুখ দিয়ে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস বের হয়ে নিচে জমা হতে থাকে। প্রাকৃতিক কোনো কারণে হঠাৎ হঠাৎ হ্রদের নিচ থেকে বিপুল পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস বের হয়ে আসে। আগেই বলা হয়েছে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বাতাস থেকে ভারী–তাই পানি যেভাবে গড়িয়ে নিচু এলাকা প্লাবিত করে ফেলে, এই কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসও ঠিক সেভাবে কাছাকাছি নিচু জনপদকে প্লাবিত করে সব বাতাসকে সরিয়ে জায়গা দখল করে নেয়। এলাকার মানুষজন নিশ্বাস নিতে না পেরে দম বন্ধ হয়ে মারা যায়।

এরকম ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী ট্রাকে করে যাচ্ছিল, হঠাৎ করে দেখে ট্রাকের ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেছে। ট্রাকের ইঞ্জিন চলতেও অক্সিজেনের দরকার, কার্বন-ডাই-অক্সাইড এসে বাতাসকে অপসারিত করে ফেলার কারণে সেখানে ইঞ্জিনটাকে চালু রাখার জন্যে কোনো অক্সিজেন নেই। কেন ইঞ্জিনটা বন্ধ হয়েছে দেখার জন্যে ড্রাইভার নিচে নামতেই সে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে পড়ে গেল। ট্রাকের উপর যে দুজন বসে ছিল তারা ট্রাক থেকে নামে নি বলে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল। বন্যার পানি যেরকম একটা উচ্চতায় এসে থেমে যায়, কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসও সেরকম একটা উচ্চতায় এসে থেমে গিয়েছিল। যারা সেই উচ্চতার ভেতর ছিল তারা সবাই নিশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা গেছে, যারা উপরে ছিল তারা বেঁচে গেছে। কার্বন-ডাই অক্সাইডের প্লাবন”-এর সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটেছিল আফ্রিকার দে, 1984 সালে এরকম একটা দুর্ঘটনায় এক হাজার থেকে বেশি মানুষ এবং অসংখ্য গবাদিপশু, পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ মারা গিয়েছিল।

কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসকে তুলনামূলকভাবে বেশ সহজেই (-80°C তাপমাত্রায়) কঠিন কার্বন-ডাই-অক্সাইড করে ফেলা যায়, সেটাকে বলে ড্রাই আইস বা শুকনো বরফ। তার কারণ সাধারণত বরফ গলে প্রথমে তরলকে পাওয়া যায় কিন্তু ড্রাই আইস গলার পর সেটা তরল না হয়ে সরাসরি গ্যাসে পরিণত হয়ে যায়।

আমাদের পৃথিবীর জন্যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসের একটা খুব বড় গুরুত্ব রয়েছে। পৃথিবীর সবুজ গাছ তাদের খাবার তৈরি করার জন্যে বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মাটি থেকে পানি আর সূর্যের আলো থেকে শক্তি সংগ্রহ করে। পদ্ধতিটির নাম সালোক সংশ্লেষণ। এই সালোকসংশ্লেষণ করে শুধু যে গাছ তার খাবার তৈরি করে তা নয়, সেটি “বর্জ্য” হিসেবে আমাদের জন্যে মহামূল্যবান অক্সিজেন গ্যাস ফিরিয়ে দেয়। পৃথিবীর বনাঞ্চল বা গাছ সেজন্যে আমাদের কাছে এত প্রয়োজনীয়।

গোড়াতে বলা হয়েছে যে বাতাসে খুব অল্প পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড রয়েছে–মজার ব্যাপার হলো এই পরিমাণটুকু কিন্তু স্থির নয়–এটি বাড়ে এবং কমে। কার্বন-ডাই-অক্সাইড পানিতে অল্প পরিমাণ দ্রবীভূত হয়। বাতাসে এখন যে পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড আছে তার পঞ্চাশ গুণ পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড সমুদ্রের পানিতে দ্রবীভূত হয়ে আছে। পানিতে কী পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড দ্রবীভূত হতে পারবে সেটা নির্ভর করে পানির তাপমাত্রার উপর। বেশি তাপমাত্রায় কম পরিমাণ দ্রবীভূত হয়–আমরা সেটা কোমল পানীয়ের বেলায় দেখেছি। কোমল পানীয়ের মাঝে কার্বন-ডাই-অক্সাইড দ্রবীভূত করে রাখা হয়–সেটা যদি শীতল হয় তাহলে সেখানে বেশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড থাকে। তাপমাত্রা যদি বেড়ে যায় তাহলে কোমল পানীয় থেকে বুদ্বুদ হয়ে সেই কার্বন-ডাই-অক্সাইড বের হয়ে আসে। আমরা যদি পৃথিবীর মানচিত্রের দিকে তাকাই তাহলে দেখব তুলনামূলকভাবে উত্তর গোলার্ধে স্থলভাগ বেশি, কাজেই গাছের পরিমাণও বেশি। এই গাছগুলো বসন্তের শুরুতে বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিয়ে তার পরিমাণ খানিকটা কমিয়ে ফেলতে শুরু করে। শুধু তাই নয় পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধে জলভাগ বেশি, উত্তর গোলার্ধে যখন বসন্তের শুরু দক্ষিণ গোলার্ধে তখন হেমন্তের শুরু, পানি তুলনামূলক একটু বেশি শীতল কাজেই কার্বন-ডাই-অক্সাইড একটু বেশি দ্রবীভূত হয়ে থাকতে পারে। হেমন্তের শুরুতে গাছগুলো স্থবির, পাতাশূন্য হয়ে যায়–তখন কার্বন-ডাই-অক্সাইড নেয়া বন্ধ করে দেয় বলে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যায়। দক্ষিণ গোলার্ধের বিশাল সমুদ্ৰাঞ্চলে তখন বসন্তের শুরু হয়েছে, তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করেছে তাই কার্বন-ডাই-অক্সাইডও দ্রবীভূত হচ্ছে কম।

কার্বন-ডাই-অক্সাইড হচ্ছে গ্রীন হাউস গ্যাস। গ্রীন হাউসে যেরকম তাপ ধরে রাখার ব্যবস্থা থাকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসও সেরকম তাপ ধরে রাখতে পারে। আমাদের পৃথিবীর যে বায়ুমণ্ডল সেটা ভেদ করে সূর্যের আলো পৃথিবীতে পৌঁছায়। এই আলো পৃথিবীর বাতাসকে উত্তপ্ত করতে পারে না–এটা উত্তপ্ত করে পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশকে। পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশ আবার সেই উত্তাপের খানিকটা অংশ বিকীরণ করে ছেড়ে দেবার চেষ্টা করে। অন্যভাবে বলা যায় পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশ দৃশ্যমান আলো শোষণ করে কিন্তু বিকীরণ করে ইনফ্রায়েড আলো। কার্বন-ডাই অক্সাইড গ্যাস দৃশ্যমান আলোকে শোষণ করতে পারে না কিন্তু ইনফ্রায়েড আলোকে শোষণ করে ফেলে। তাই পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশের বিকীরণ করে ছেড়ে দেয়া তাপশক্তি বায়ুমণ্ডল ভেদ করে বাইরে চলে যেতে পারে না। এটা কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাঝে আটকা পড়ে বায়ুমণ্ডলকে উত্তপ্ত করে রাখে। এই পদ্ধতিটির জন্যে দিন এবং রাতে পৃথিবীর তাপমাত্রার মাঝে এক ধরনের সমতা আসে। তা না হলে দিনের বেলা পৃথিবীতে দুঃসহ গরম এবং রাতের বেলা কনকনে শীত নেমে আসত।

প্রকৃতি পৃথিবীকে বসবাসযোগ্য করার জন্যে এরকম নানা ধরনের প্রক্রিয়া করে রেখেছে এবং লক্ষ লক্ষ বছর ধরে সেটা এই পৃথিবীতে চলে আসছে। কিন্তু আমাদের খুব দুর্ভাগ্য পৃথিবীর অবিবেচক মানুষ বিংশ শতাব্দীতে হঠাৎ করে অনেক যত্ন করে গড়ে তোলা পৃথিবীর এই সমতাটুকু নষ্ট করে ফেলেছে। কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস যেহেতু গ্রীন হাউস গ্যাস তাই বাতাসে এর পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার অর্থ বাতাসের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া। বাতাসের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার অর্থ পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া। পৃথিবীর উত্তর মেরু আর দক্ষিণ মেরুতে রয়েছে বিপুল পরিমাণ বরফের আস্তরণ। পৃথিবীর তাপমাত্রা যদি একটুখানিও বেড়ে যায়, আর মেরু অঞ্চলের বরফ যদি একটুখানিও গলে যায় তাহলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাবে তখন পানির নিচে তলিয়ে যাবে পৃথিবীর নিম্নাঞ্চল। যে হারে পৃথিবীতে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস বেড়ে যাচ্ছে তাতে আশঙ্কা করা হয় বাংলাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জায়গা হয় পানির নিচে তলিয়ে যাবে না হয় লোনা পানির প্রভাবে কৃষিকাজের অযোগ্য হয়ে যাবে।

কার্বন-ডাই-অক্সাইডের কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিকে বলা হয় গ্লোবাল ওয়ার্মিং, বাংলায় বৈশ্বিক উষ্ণতা। বিজ্ঞানীরা অনেকদিন থেকেই এই বিষয়টা নিয়ে চেঁচামেচি করে আসছিলেন। প্রাকৃতিক উপায়ে বাতাসে অনেক কার্বন-ডাই-অক্সাইড আসে, সেটাকে ঠেকানোর কোনো উপায় নেই। ধারণা করা হয় পৃথিবীর বাতাসের শতকরা 40 অংশই আসে পৃথিবীর নানা আগ্নেয়গিরি থেকে। প্রকৃতি যেভাবে কার্বন-ডাই-অক্সাইড তৈরি করে ঠিক সেরকম সেটাকে শোষণ করারও ব্যবস্থা করে রেখেছে। সমুদ্র তার পানিতে বিশাল পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড দ্রবীভূত করে রাখে। কিন্তু পৃথিবীর অবিবেচক মানুষেরা কলকারখানা চালিয়ে, গাড়ি, জাহাজ, বিমান চালিয়ে প্রতিমুহূর্তে কার্বন-ডাই-অক্সাইড তৈরি করে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীদের কাছে এখন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ আছে যে পৃথিবীতে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ধীরে ধীরে বেড়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন এই পৃথিবী বৈশ্বিক উষ্ণতার কবলে পড়তে যাচ্ছে। প্রথম দিকে ব্যবসায়ীরা, কারখানা ফ্যাক্টরির মালিকেরা এটা মানতে চায় নি কিন্তু জাতিসংঘ থেকে শেষ পর্যন্ত একটা সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত পুরো পৃথিবী এটা মেনে নিয়েছে। সবাই স্বীকার করছে এই মুহূর্তে সতর্ক না হলে সামনে মহাবিপদ!

পৃথিবীর মানুষ অবিবেচক হয়ে প্রকৃতি এবং পরিবেশকে ধ্বংস করেছে–আবার সেই পৃথিবীর মানুষই প্রকৃতি এবং পরিবেশকে উদ্ধার করার কাজে লেগে গিয়েছে। সারা পৃথিবীজুড়ে এখন “সবুজ আন্দোলন শুরু হয়েছে, যার প্রধান একটা কাজ বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমানো। কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে সংক্ষেপে বলছে কার্বন, আর নূতন পৃথিবী এর পিছনে উঠেপড়ে লেগেছে!

কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছিল একটি নিরীহ প্রয়োজনীয় গ্যাস–কেমন করে জানি সে এখন হয়ে গেছে পৃথিবীর ভিলেন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *