০৭. কার্ফু তোলা হলো

কার্ফু তোলা হলো সকাল নটায়।

চারদিকে কেমন ছমছমে ভাব। যেন কিছু একটা হবে। কী হবে কেউ ভাল কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। যুবকদের চেহারা একই সঙ্গে রাগী ও বিষণ্ণ।

এয়ারপোর্টে আমিন সাহেব মেয়েকে কোলে নিয়ে অপেক্ষা করছেন। ডাক্তার ভদ্রলোক বললেন, বাসায় না গিয়ে মেয়েকে সরাসরি কোনো হাসপাতালে নিয়ে যান। বডি ডিহাইড্রেটেড হয়ে গেছে। রাহেলা অস্থির হয়ে পড়েছেন, এতক্ষণেও নেওয়ার কোনো গাড়ি আসছে না কেন? তিনি বললেন, গাড়ি লাগবে না, চলো একটা বেবিট্যাক্সি নিয়ে চলে যাই।

এত মালপত্র কী করব?

পড়ে থাকুক।

বেবিট্যাক্সি, রিকশার সংখ্যা খুব কম। বহু কষ্টে একটি জোগাড় করা গেল। রাস্তায় যানবাহন তেমন নেই। কিন্তু প্রচুর মানুষ। ছোট ছোট দল বানিয়ে জটলা পাকাচ্ছে। রাস্তার প্রতিটি মোড়ে ইপিআর-এর বড় বড় ভ্যান। ভ্যানের মাথায় মেশিনগান বসিয়ে সৈন্যরা অপেক্ষা করছে। আমিন সাহেব বললেন, দেখে মনে হচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্র। রাহেলা, অবস্থা দেখো।

তুমি দেখো। আমার দেখার শখ নেই।

এত সৈন্য নামিয়েছে শহরে, আশ্চর্য!

প্রিসিলা বলল, বাবা, আমি সৈন্য দেখব। রাহেলা ধমক দিলেন, সৈন্য দেখতে হবে। শুয়ে থাকো। আমিন সাহেব বললেন, ওকে দেখতে দাও। দেখে অভ্যস্ত হোক। এ দেশের অবস্থা জানতে হবে না তাকে।

না, জানার দরকার নেই। আমি এখানে থাকব না।

কোথায় যাবে?

আমেরিকা। যেখান থেকে এসেছি সেখানে যাব।

আমিন সাহেব কিছু বললেন না। রাহেলা বললেন, এরকম দেশে মানুষ থাকতে পারে।

কেন, মানুষ থাকছে না? ওরা থাকতে পারলে আমরাও পারব। তাছাড়া অবস্থা এরকম থাকবে না।

কী করে তুমি জানো থাকবে না?

এটা জানা যায়। সব খারাপ সময়ের পর আসে সুসময়।

সুসময় আসুক আর যাই আসুক, আমি এখানে থাকব না। তুমি যেতে না চাও থাকবে। আমি প্রিসিলাকে নিয়ে চলে যাব।

আমিন সাহেব কিছু বললেন না।

ফার্মগেটের সামনে এসে দেখা গেল প্রতিটি গাড়িকে থামানো হচ্ছে। দুজন মিলিটারি এসে উঁকি দিচ্ছে প্রতিটি গাড়িতে। কাউকে কাউকে জিজ্ঞাসাবাদও করছে। আমিন সাহেবকে অবশ্যি কিছু বলল না। হাত দিয়ে ইশারা করে চলে যেতে বলল। প্রিসিলা বলল, ওরা মিলিটারি, বাবা?

হুঁ।

কী দেখছে?

কী জানি কী? তোমার শরীর কেমন লাগছে এখন?

ভালো।

আবার বমি বমি লাগছে?

নাহ্।

বাড়িতে গেলেই দেখবে শরীর পুরোপুরি সেরে গেছে। বাড়িতে পৌঁছেই ডাক্তার আনাব। ঠিক আছে?

প্রিসিলা বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ল। বাড়ি পৌঁছতে অবশ্যি দেরি হলো অনেক। নীলক্ষেতের সামনে সমস্ত গাড়ি আটকে রাখা হয়েছে। যেতে দেওয়া হচ্ছে না। কেন দেওয়া হচ্ছে না তাও কেউ বলছে না। রাহেলা অসহিষ্ণু গলায় বললেন, কী হচ্ছে?

বুঝতে পারছি না তো।

আমি অসুস্থ মেয়ে নিয়ে রাস্তায় পড়ে থাকব নাকি?

কিছু তো করার নেই। অপেক্ষা করা যাক। বোধহয় মিছিল-টিছিল আসছে।

আমি থাকব না এদেশে। আমি আগামী সপ্তাহেই চলে যাব।

রাহেলা কেঁদে ফেললেন।

.

খোকন বাড়ির সামনের গেটের কাছে একা একা দাঁড়িয়ে ছিল। তার খুব ইচ্ছা, সে ভয়াল-ছয়ের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কিন্তু বড়চাচা বলে দিয়েছেন, কেউ যেন বাড়ি ছেড়ে কোথাও না যায়। দারোয়ন গেটে তালা লাগিয়ে দিয়েছে। বড়চাচার হুকুম, ছাড়া তালা খোলার অনুমতি নেই। খোকন আশা করে আছে সাজ্জাদ বা বল্টু এদের কেউ তার খোঁজে আসবে। কিন্তু এখনো কেউ আসছে না। আসবে জানা কথা, কিন্তু এত দেরি। করছে কেন?

ছোটচাচা যখন বেবিট্যাক্সি থেকে নামলেন তখনো খোকন গেটের কাছে দাঁড়িয়ে। তবু সে বুঝতে পারল না যে ছোটচাচা এসে পড়েছেন। তিনি ডাকলেন, এটা কে, খোকন না? খোকনের চোখ বড় বড় হয়ে গেল।

আমরা যে গতকাল আসছি সে টেলিগ্রাম পাসনি?

না তো।

যা, ভেতরে গিয়ে খবর দে।

খোকনের হুঁশ ফিরে এল, সে বিদ্যুৎগতিতে ছুটে গেল বাড়ির ভেতরে। আর তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির প্রতিটি মানুষ বেরিয়ে এল। বহুদিন এ বাড়িতে এরকম আনন্দের ব্যাপার হয়নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *