সপ্তম পরিচ্ছেদ
কর্মে প্ৰাণযোগ্য–দৃঢ় ইচ্ছা
যে কাজই কর না, তাতে যদি কোন রকমে তোমার মন ঢেলে দিতে পারে, তাহলে আর কোন ভয় নাই। সংশয়কে মনে স্থান দিতে নাই। সংশয়ে মনের বল কমে যায়, এমন কি কার্যে সিদ্ধিলাভ হয় না।
কোন কাজ করতে ইচ্ছা করেছ। ভেবে নাও-বিশ্বাস কর—তুমি কৃতকার্য হবে-তারপর পরিশ্রম কর। তুমি নিশ্চয়ই কৃতকার্য হবে।
ফরাসী দেশে এক ব্যক্তি ঘরের ভিতর ঘুরে বেড়াতেন। আর বলতেনআমি একজন বড় যোদ্ধা হবো, তাই তিনি হয়েছিলেন।
একটি ছাত্রকে জানি-সে। কয়েক বছর আগেকার কথা। তিনি পড়তে বসেছিলেন, গায়ে তখন জ্বর। সামনে পরীক্ষা-না পড়লেই চলবে না। পরীক্ষায় পাশ না হলে হয়ত তাকে মরতে হবে। জ্বর এসেছে, সে কথা ভুলে গিয়ে তিনি পড়তে আরম্ভ করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর জ্বর চলে গেল।
এক ভদ্রলোকের অসুখ হয়েছিল—তিনি ইচ্ছা করলেন অবিলম্বে তাঁকে ভাল হতেই হবে-সত্যিই তিনি ভাল হলেন।
সম্রাট বাবরের কথা সবাই জানেন। পুত্রের ব্যাধি তিনি কেমন করে নিজের ভিতর টেনে নিলেন।
একবার এক সৈন্যাধ্যক্ষের অসুখ হয়। খুব সাংঘাতিক অসুখ। হঠাৎ একটা যুদ্ধ বেধে উঠলো। অসুখের কথা ভুলে একটা অমানুষিক শক্তির দ্বারা বলীয়ান হয়ে সেই শরীর নিয়েই ময়দানে নামলেন। যখন জয়লাভ হলো তখন তিনি প্ৰাণত্যাগ করলেন।
শুধু ইচ্ছা করলে কি হবে? দৃঢ়ভাবে ইচ্ছা করো এবং বিশ্বাস করো, তুমি কৃতকার্য হবে-সাধনা আপনা হতেই চলে আসবে। দুঃখে ভীত হবে না, অভাবে দমে যাবে না— অসীম বলে, নিরবচ্ছিন্ন সাধনায় নিজের পথ নিজে পরিষ্কার করে নিতে পারবেই।
বিশ্বাস ও দৃঢ় ইচ্ছার সম্মুখে অসম্ভব সম্ভব হয়ে পড়ে। তোমার সাধনায় যদি তুমি জয়ী হতে যাও, তবে সমস্ত মন তোমার কর্মে ঢেলে দাও-প্ৰাণ দিয়ে বিশ্বাস করো, তুমি কৃতকার্য হবে। সংশয় ও অবিশ্বাস মন থেকে দূর করে দাও। সংশয়ী যারা তারা কাপুরুষ, তাদের সাধনার কোন মূল্য নাই—তাদের পরাজয় হবে।
এক সাধু বলেছেন- যা আমরা হতে চাই, তাই হতে পারি। এই হতে চাওয়ার ইচ্ছা খুব দৃঢ় এবং কঠিন হওয়া চাই।
একদিন এক মিস্ত্রী একখানি চেয়ার তৈরী করে বললেন, চেয়ার তৈরী করি—বসতে পারি। না। প্ৰতিজ্ঞা করলাম, এই চেয়ারে আমি বসবো। বিস্ময়ের কথা! মিস্ত্রী কালে মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে সেই চেয়ারেই বসেছিলেন।
নিজেকে দুর্বল ও শক্তিহীন মনে করলে চলবে না; তুমি মানুষ-তোমার ভিতর এই শক্তি আছে-যে শক্তির সম্মুখে গিরি মাথা নত করে, বিশ্ব-সংসার কাঁপতে থাকে।
তুমি বিপদে পড়েছি? ভয় কি? বিপদকে উপহাস করে-দরিদ্র্যের বিষ্পেষণকে ঠেলে ফেলে দাঁড়াও, তুমি সফলতার উচ্চ শিখরে উঠতে পারবে।
এক ব্যক্তিকে জানি। তাকে এক নিষ্ঠুর ভদ্রলোক বলেছিলেন, এই শিলাখানি মাথায় করে রাস্তার ধারে নিয়ে যাও। তাহলে বুঝবো–তুমি শক্তিশালী পুরুষ, দশ টাকা বখশিশ, পাবে। লোকটি অর্থ অপেক্ষা গৌরব লোভে পাথরখানি মাথায় করে বেরোলো। সে খুবই উৎসাহের সঙ্গে শিলাখানি মাথায় নিয়েছিল। অর্ধপথ আসার পর তার মুখখানা শুকিয়ে গেল, যাতনায় বুক ঘন ঘন স্পন্দিত হতে লাগল, চোখ দুটি রক্তময় হয়ে গেল।
এক ভদ্রলোক কৌতুহল ও সহানুভূতিতে লোকটির পেছনে পেছনে যাচ্ছিলেন।
ভদ্রলোক সেই লোকটির অবস্থা একটু বুঝে তার কাছে যেয়ে দাঁড়াতেই লোকটি বললে–আর পারছি না-পাথর ফেলে দিই-কি বলেন?
ভদ্রলোক রুদ্র কণ্ঠে বললেন—বল কি? তোমার মতো শক্তিশালী লোকের কাছে পাথরখানা তো শোলার মতো হালকা, ফেলবে কেন? চল, নিয়ে চল। আমি তোমার সঙ্গে যাচ্ছি।
ক্লান্ত লোকটি উৎসাহ ও বিশ্বাসে পাথরখানি গন্তব্যস্থানে নিয়ে গেল।
জীবনের প্রথম থেকে ঠিক করে নাও, তুমি কোন কাজের জন্য উপযুক্ত। এটা একবার ওটা একবার করে যদি বেড়াও তাহলে তোমার জীবনের কোন উন্নতি হবে না। এইরূপ করে অনেক লোকের জীবন নষ্ট হয়ে গিয়েছে-তোমার যেন তা না হয়।
ঠিক করলে-ব্যবসায়ী হবে, সমস্ত প্ৰাণ ব্যবসাতে ঢেলে দাও। খেয়াল চেপেছে আর ব্যবসা করতে যেও না-দুদিন পরেই তোমার মন বিরক্ত হয়ে উঠবে। তোমার শক্তি বৃথা ক্ষয় মতলবে। যদি জোর না থাকে, তাহলে সাধনায় তোমার মন বসবে না। ইচ্ছা থাকলেই পথ আছে-এ প্রবাদটির চলতি সবার মধ্যেই আছে।
তোমার কোন কিছু করবার বা হবার দৃঢ় বাসনা আছে—তাহলে কোন বাধা তোমার গতিকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। শুধু চাই তোমার সঠিক ইচ্ছা এবং বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের সঙ্গে খোদার শক্তি তুমি পাবে।
ধর্মে—যে যা কঠিনভাবে পেতে ইচ্ছা করে, তা সে পায়।
নেপোলিয়ান বলেন— অসম্ভব বলে জগতে কিছু নাই। ডাক্তার লিভিংষ্টান যখন ছোট তখন তিনি এক কারখানায় মজুরি করতে গেলেন। প্রথম সপ্তাহে তিনি যে বেতন পেলেন তাই দিয়ে তিনি একখানা ল্যাটিন ভাষার গ্রামার কিনলেন। আমরা আজকাল ইংরেজী পড়ি, সেকালে ইংরেজরাও তেমনি ল্যাটিন ও গ্ৰীক পড়তেন। দিনে দিনের কাজ, রাতে দুপুর রাত পর্যন্ত জেগে জেগে বই পড়া।
এমন করে নিজে নিজে পড়ে লিভিংষ্টান ল্যাটিন ভাষার খুব বড় বড় বই পড়ে ফেললেন। বেশী করে তিনি বিজ্ঞানের বই পড়তেন।
এরপর তাঁর ইচ্ছা হলো মানুষের উপকার করে এবং তাদিগকে জ্ঞান দিয়ে তিনি জীবন শেষ করবেন। এই কাজে খুব দক্ষ হবার ইচ্ছায় তিনি চিকিৎসাশাস্ত্ৰ অধ্যয়ন করতে আরম্ভ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি গ্ৰীক ভাষাও আলোচনা করতে লাগলেন।
গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র যখন তিনি-তখন ছুটির সময় অর্থ জমাবার জন্য তিনি কারখানায় মজুররূপে কাজ করতেন।
ইচ্ছা ছিল তাই কোন রকম দুঃখ-কষ্টের ভিতর দিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি লাভ করতে সমর্থ হলেন।
জীবন তিনি পতিত মানুষের কল্যাণেই কাটিয়েছেন। যখন তিনি মিসরে তখন অনেক সময় তাকে গরু চরাতে দেখা যেতো। কখনও কখনও তিনি লাঙ্গল চষ্যতেন। পরের সেবা ও পরিশ্রমের উপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজে পরিশ্রম করতে গৌরব বোধ করতেন।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে জন হাওয়ার্ড নামক এক মহাপুরুষ বিলেতে কয়েদিদের প্রতি নিষ্ঠুর ব্যবহার অনেক পরিমাণে কমেছে। গভর্নমেন্ট এবং দেশের মনীষীবৃন্দ তাঁর চিস্তা ও ভাব গ্রহণ করেছিলেন। কোন দুঃখ কোন বাধা তাকে তাঁর সাধনা হতে ধরে রাখতে পারেনি। শক্তি ও বিশ্বাস তাকে জয়যুক্ত করেছিল। প্রতিভা কিংবা শুধু ভাষার পরীক্ষা তাকে জয়যুক্ত করে নাই।