৭. এস্ট্রোনট হওয়ার প্রথম ধাপ
বল্টু একটা পেন্সিল-ব্যাটারি দেখিয়ে বলল, “এই যে ব্যাটারিটা দেখছিস,
এটার ভোল্টেজ হচ্ছে দেড়। দেড় ভোল্টে ইলেকট্রিক শক লাগে না।”
নান্টু বলল, “অ।”
বল্টু বলল, “উঁহু। এখন তোর জিজ্ঞেস করার কথা, তাহলে কত ভোল্টে ইলেকট্রিক শক লাগে।”
নান্টু বাধ্য ছেলের মতো জিজ্ঞেস করল, “তাহলে কত ভোল্টে ইলেকট্রিক শক লাগে?”
“পঞ্চাশ। পঞ্চাশ থেকে যত বেশি, ইলেকট্রিক শক তত বেশি।”
নান্টু একটু চিন্তা করে বলল, “অ”
“তাহলে বল দেখি, কাউকে যদি ইলেকট্রিক শক দিতে হয় তাহলে কী করতে হবে।”
নান্টু মাথা চুলকে বলল, “অনেকগুলো ব্যাটারি লাগবে?”
বল্টু চোখ বড় বড় করে বলল, “উঁহু। একটা ব্যাটারি দিয়েই হবে, শুধু ভভাল্টেজটা বাড়িয়ে ফেলতে হবে।”
নান্টু বলল, “অ”।
বল্টু একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “খালি অ বললে হবে না, তোকে জিজ্ঞেস করতে হবে কেমন করে ভোল্টেজ বাড়ায়।”
নান্টু জিজ্ঞেস করল, “কেমন করে ভোল্টেজ বাড়ায়?”
“ইনডাকশন কয়েল দিয়ে।”
নান্টু বলল, “অ”
বল্টু রেগে বলল, “তোকে দিয়ে কিছু হবে না। শুধু অ বলিস কেন। এখন জিজ্ঞেস কর, কেমন করে ইনডাকশন কয়েল বানায়।”
নান্টু আমতা আমতা করে বলল, “এ রকম কঠিন জিনিসের নাম তো বলতে পারি না। আমি যদি আঙুলটা এ রকম তিড়িংবিড়িং করে নাড়াই, তাহলে তুমি মনে করবে আমি প্রশ্নটা করেছি।”
পদ্ধতিটা বল্টুর পছন্দ হলো, বলল, “ঠিক আছে, আঙুল তিড়িংবিড়িং করে নাচা।”
নান্টু তখন আঙুলটা তিড়িংবিড়িং করে নাচাল, বল্টু তখন ইনডাকশন কয়েলে কেমন করে ভোল্টেজ বাড়ায় সেটা বুঝিয়ে দিল। প্রাইমারি কয়েলে দশ প্যাঁচ আর সেকেন্ডারিতে একশ প্যাঁচ থাকলে ভোল্টজ বাড়বে দশ গুণ। প্রাইমারি কয়েলে দশ প্যাঁচ আর সেকেন্ডারিতে এক হাজার প্যাঁচ থাকলে ভোল্টেজ বাড়বে একশ গুণ। সবকিছু শুনে নান্টু আবার তার আঙুল তিড়িংবিড়িং করে নাচাল। তার মানে সে আবার প্রশ্ন করেছে। প্রশ্নটা অনুমান করে বল্টু উত্তর দিল, “আমি চেষ্টা করছি হাজার ভোল্ট বানাতে।”
নান্টু আবার আঙুল নাচাল। বল্টু উত্তর দিল, “না, এই ভোল্টেজে শক খেলে কেউ মারা যাবে না। দেড় ভোল্টের ব্যাটারিতে কারেন্ট কম।”
নান্টু আবার আঙুল নাচাল। বল্টু উত্তর দিল, “বানানো প্রায় শেষ। সেকেন্ডারি কয়েলের তার খুব চিকন। ছিঁড়ে যায় একটু পর পর।”
নান্টু আবার আঙুল নাচাল। বল্টু আবার উত্তর দিল। নান্টু আবার নাচাল। বল্টু আবার উত্তর দিল। এভাবে চলতেই থাকল। উত্তরগুলো হলো
এ রকম :
“না, প্রাইমারির তার মোটা, ছেড়ে না।”
“না, তারগুলি এনামেলকোটেড, তাই শর্ট হয় না।”
“শর্ট মানে হচ্ছে একটার সাথে আরেকটা লেগে যাওয়া।”
“হ্যাঁ, এ জন্যে তারের ওপর প্লস্টিক থাকে যেন শর্ট না হয়।”
“না প্লাস্টিকের ভেতর দিয়ে ইলেকট্রিসিটি যায় না।”
“হ্যাঁ, গরম হলে প্লাস্টিক গলে যায়।”
“হ্যাঁ, প্লাস্টিক গলে গেলে পোড়া গন্ধ বের হয়।”
“হ্যাঁ, আমরা নাক দিয়ে গন্ধ শুঁকি।”
“না, আমরা কান দিয়ে গন্ধ শুঁকতে পারি না।”
“হ্যাঁ, আমরা কান দিয়ে শুনি।”
“না, আমরা কান দিয়ে দেখি না।”
“হ্যাঁ, আমরা চোখ দিয়ে দেখি।”
“না, আমরা অন্ধকারে দেখতে পারি না।”
“হ্যাঁ, অন্ধকারে গেলে আমরা ধাক্কা খেয়ে ধুরুম করে পড়ে যেতে পারি।”
নান্টু খুবই উৎসাহ পেয়েছে। সে এবার উত্তর শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছে না। একটানা আঙুলগুলো তিড়িংবিড়িং করে নাচিয়ে যাচ্ছে আর নাচিয়ে যাচ্ছে। বল্টু শেষ পর্যন্ত ধৈর্য হারিয়ে বলল, “তুই প্রশ্ন করা বন্ধ করবি?”
নান্টু তখন তার আঙুলগুলো থামিয়ে বলল, “বল্টু ভাইয়া, তুমিই না। বললে সব সময় প্রশ্ন করতে। সে জন্যেই তো করছি।”
“ব্যাস, অনেক হয়েছে। এখন থামা।”
“ঠিক আছে, বল্টু ভাইয়া।”
বল্টু তার ইনডাকশন কয়েলে তার প্যাঁচাতে শুরু করল। কাছেই নান্টু গালে হাত দিয়ে বসে থেকে গভীর মনোযোগ দিয়ে বল্টুর তার প্যাঁচানো দেখতে লাগল। তার প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বল্টু জিজ্ঞেস করল, “তুই বড় হয়ে কী হবি ঠিক করেছিস?”
নান্টু কোনো উত্তর না দিয়ে তার আঙুলগুলো তিড়িংবিড়িং করে নাচাল। বল্টু বলল, “আমি? আমি এমনিতে হব সায়েন্টিস্ট। আর যখন সায়েন্টিস্ট থাকব না, তখন হব অ্যাস্ট্রোনট।”
নান্টু বলল, “আমিও অ্যাস্ট্রোনট হব।”
বল্টু বলল, “ভেরি গুড।”
নান্টু একটু পরে বলল, “কিন্তু অ্যাস্ট্রোনট মানে কী? তারা কী করে?”
“অ্যাস্ট্রোনট হচ্ছে যারা রকেটে করে মহাকাশে যায়।”
“কিন্তু তুমি রকেট কোথায় পাবে?”
“বড় হলে আমি নিজেই বানাব।”
উত্তরটা নান্টুর পছন্দ হলো। বল্টু ইচ্ছা করলে একটা রকেট বানাতে পারবে সে ব্যাপারে নান্টুর কোনো সন্দেহ নাই।
বল্টু তার প্যাঁচাতে প্যাচাতে বলল, “সায়েন্টিস্ট হওয়া সোজা। অ্যাস্ট্রোনট হওয়া এত সোজা না।”
নান্টু তার আঙুল নাচাল।
বল্টু বলল, “অ্যাস্ট্রোনট হতে হলে অনেক রকম ট্রেনিং নিতে হয়। একটা টেনিং হচ্ছে কোনো রকম ওজন ছাড়া ভেসে থাকা।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ। দেখিস নাই, ডিসকভারি চ্যানেলে সব অ্যাস্ট্রোনট ভেসে বেড়াচ্ছে। এটা হচ্ছে সবচেয়ে কঠিন ট্রেনিং”।
নান্টুর বিষয়টা বুঝতে ঝামেলা হলো। তাই জিজ্ঞেস করল, “ওজন কেমন করে নাই করতে হয়?”
বল্টু তার প্যাচানো বন্ধ করে বলল, “খুব সোজা। ওপর থেকে লাফ দিতে হয়। যতক্ষণ তুই নিচে পড়তে থাকবি ততক্ষণ তোর মনে হবে কোনো ওজন নাই।”
“কিন্তু যখন নিচে এসে পড়বে?”
বল্টু শুকনো মুখ করে বলল, “তখন তুই একেবারে ভর্তা হয়ে যাবি। সেটাই সমস্যা। তা না হলে আমি কবে তিনতলা থেকে লাফ দিতাম।”
“বেশি উঁচু থেকে লাফ না দিয়ে টেবিলের ওপর থেকে লাফ দাও।”
“সেটা তো আমি কতবার দিয়েছি। কিন্তু কিছু বোঝার আগেই নিচে নেমে আসি। বুঝতেই পারি না।” কথা বলতে বলতে বল্টু তার ঘরের ছাদের দিকে তাকাল। সেখানে দুটি হুক। একটা থেকে সিলিং ফ্যান ঝুলছে, অন্যটা খালি। খালি হুকটা দেখে বল্টুর চোখ-মুখ হঠাৎ এক শ ওয়াট লাইটের মতো জ্বলে উঠল। বল্টু বলল, “এক কাজ করলে কেমন হয়?”
“কী কাজ?”
“ওই যে হুকটা দেখছিস, সেখান থেকে একটা দড়িতে বেঁধে ঝুলে পড়লে কেমন হয়?”
নান্টু তার মাথা চুলকাল। কেমন করে বলুকে পঁড়িতে বেঁধে হুক থেকে ঝোলানো হবে, কেমন করে নেমে আসবে–কিছুই বুঝতে পারছে না। বল্টু অবশ্য এত সহজে হাল ছেড়ে দিল না। নান্টুকে বোঝাতে শুরু করল। বলল, “প্রথমে একটা দড়ি দিয়ে আমার পেটে বাঁধব। তারপর দড়িটা ওই হুকটার ভেতর দিয়ে পাঠাব। তখন তুই এই দড়িটা ধরে টেনে আমাকে ওপরে তুলবি …
নান্টু ভয়ে ভয়ে বলল, “আ-আমি?”
“কেন? পারবি না?”
“মনে হয় পারব না।”
“তাহলে তোকে বেঁধে আমি টেনে তুলি। এর পর যখন ছেড়ে দেব, তুই ভাসতে ভাসতে নেমে আসবি।”
নান্টু শুকনো মুখে বলল, “আ-আমাকে টেনে তুলবে?”
“যা, তুইও তো বড় হয়ে অ্যাস্ট্রোনট হবি। তোর ট্রেনিং লাগবে না?”
“যদি পড়ে যাই?”
“পড়বি না, আমি ধরে রাখব।”
কাজেই কিছুক্ষণের মধ্যেই কাজ শুরু হয়ে গেল। নান্টুকে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখার জন্য মোটা দড়ি ছিল না, তাই বল্টু শুট করে রিতুর একটা শাড়ি নিয়ে এল। সেটা দিয়ে নান্টুর কোমরে শক্ত করে বাঁধা হলো। টেবিলের ওপর একটা চেয়ার, তার ওপর একটা মোড়া রেখে সেখানে দাঁড়িয়ে অনেক কষ্টে হুকের ভেতর দিয়ে শাড়িটা ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। এবার শুধু টেনে ওপরে তোলা বাকি।
বল্টু জিজ্ঞেস করল, “রেডি?”
নান্টু শুকনো মুখে বলল, “রেডি “
“মনে রাখিস, তোকে যখন টেনে ওপরে তুলব তখন তোর মনে হবে তোর ওজন বেড়ে যাচ্ছে। আর যখন নিচে নামবে তখন মনে হবে তোর ওজন কমে যাচ্ছে।”
“ঠিক আছে।”
“তুই আমাকে ঠিক ঠিক সবকিছু বলবি।”
“বলব।”
“রেডি … ওয়ান, টু, থ্রি!” বলে একটা হেঁচকা টান দিতেই নান্টু ছয় ইঞ্চির মতো ওপরে উঠে গেল। কোমরে দড়ি দিয়ে বাঁধা। ওই অবস্থায় সে ঘুরতে শুরু করে।
বল্টু হেঁচকা টান দিয়ে তাকে আরেকটু ওপরে তুলে জিজ্ঞেস করল, “কেমন লাগছে?”
নান্টু বলল, “কোমরে চিপা লাগছে।”
“ওজন কি বেশি মনে হচ্ছিল?”
“হ্যাঁ, অনেক বেশি মনে হচ্ছে।”
বল্টু তাকে মাটি থেকে পাঁচ-ছয় ফুট ওপরে তুলে ফেলল। সেভাবে ঝুলে থেকে নান্টু চরকিপাক খেতে থাকে। বল্টু জিজ্ঞেস করল, “এখন কেমন লাগছে?”
নান্টু বলল, “মাথা ঘুরছে।”
“ওজন কেমন লাগছে?”
“জানি না।” নান্টু কোঁকাতে কোকাতে বলল, “পেটে চিপা লাগছে। আর মাথা ঘুরছে। বমি হতে পারে।”
“বমি?”
“হ্যাঁ।”
“খবরদার! বমি করবি না, আর একটু …” বলে হেঁচকা টান দিয়ে নান্টুকে ছাদের কাছাকাছি তুলে নিয়ে আসে। সেখানে নান্টু প্রায় ফ্যানের মতোই ঘুরতে শুরু করেছে।
ঠিক এ সময় রিতু তার ঘর থেকে বের হয়েছে তার শাড়ির খোঁজে। এই মাত্র শাড়িটা বের করেছে। হঠাৎ করে সেটা উধাও হয়ে যাওয়ার অর্থ একটাই–বলু তার কোনো একটা গবেষণার জন্য সেটা সরিয়েছে। রিতু বল্টুর ঘরে এসে হকচকিয়ে গেল। নান্টু ছাদের কাছাকাছি ঝুলে চরকির মতো ঘুরছে। রিতুর শাড়িটা দিয়ে তাকে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
রিতু ছোটখাটো একটা চিৎকার দিয়ে দৌড়ে নান্টুকে ধরে ফেলল। তাকে যখন কোলে করে নামাচ্ছে, তখন বল্টু চিৎকার করে ঘর ফাটিয়ে দিচ্ছিল। গবেষণার পুরোটা শেষ হলে কী হতো সেটা কেউ ভালো করে জানে না।