০৭. এন্ড্রু জনাথন

এন্ড্রু জনাথন

বয়স : ৪৩।

উচ্চতা : ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি।

ওজন : এক শ পনের পাউন্ড।

চোখ; নীল বর্ণ।

চুল: পিঙ্গল।

জন্মস্থান : ক্যানসাস সিটি।

জনাথন লোকটি ছোটখাটো। ঈগলের মতো তীক্ষ চোখ ছাড়া তার চেহারায় অন্য কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। তাকে দেখলেই মনে হয় অ্যানিমিয়ায় ভুগছে। দুর্বল এবং অসুস্থ একটি ভাব আছে তার মধ্যে। ইদানীং সে ডান পা একটু টেনে-টেনে হাঁটছে। আর্থরাইটিসের প্রথম ইশারা হতে পারে। তাদের পরিবারের আর্থরাইটিসের ইতিহাস আছে।

লোকটি কথা বলে কম। কাজকর্ম বিশেষ কিছু করে না। থাকে ওয়াশিংটনের পশ্চিমের একটা হোটলে। মাসে এক বার সিটি ব্যাঙ্ক থেকে পাঁচ শ ত্রিশ ডলার নিয়ে এসে হোটেলের বিল মেটায়। মাসে দু বার যায় সিঙ্গেলস ক্লাবে,উদ্দেশ্য কোনো মেয়ের সঙ্গ পাওয়া যায় কি না। উদ্দেশ্য সফল হয় না কোনো সময়ই। মেয়েরা তেতাল্লিশ বছরের কোনো মানুষের ব্যাপারে তেমন উৎসাহ বোধ করে না। তার চেয়েও বড় কথা জনাথন নাচ জানে না। কাজেই কোনো মেয়েকে গিয়ে বলতে পারে নাতুমি কি আমার সঙ্গে খানিকক্ষণ নাচবে?

অবশ্যি তার সময় সেজন্যে যে খুব খারাপ কাটে তা নয়। সমুদ্রের পারে প্রতিদিনই সে বেশ কিছুটা সময় কাটায়। কয়েকটা বিয়ার খায়। কোনো কোনো দিন মুভি দেখে, তারপর ফিরে আসে নিজের ঘরে। প্রতি রাতেই তার ভালো ঘুম হয়। জীবন থেকে অবসর নেওয়া একজন মানুষ, যার জীবনে তেমন কোনো উত্তেজনা নেই। উত্তেজনার প্রয়োজন নেই।

এক দিন দুপুর আড়াইটার দিকে এই লোকটি হঠাৎ গা-ঝাড়া দিয়ে উঠল। তার সুটকেস গুছিয়ে নিয়ে হোটেলের বিল মিটিয়ে দিল। হোটেলের মালিক অবাক হয়ে বলল, অসময়ে চলে যাচ্ছেন।

জনাথন হাসল।

আবার আসবেন।

আসব। নিশ্চয় আসব।

জনাথনের গায়ে একটি সামার কোট। মাথায় ক্রিকেট খেলোয়াড়দের সাদা টুপি। হাতে রেক্সিনের একটি হ্যান্ডব্যাগ। সে হেঁটে-হেঁটে গেল গ্রে হাউন্ড বাস স্টেশনে। সুটকেস বুক বল নিউ অরলিংটনের ঠিকানায়।

ট্যাক্সি ভাড়া করে চলে গেল ফ্লাওয়ার শপে। ফুলের দোকানের ছোট্ট মেয়েটিকে বলল, টকটকে লাল রঙের তিন ডজন গোলাপ দিতে পার? সবচেয়ে বড় সাইজ। মেয়েটি হেসে বলল, বিশেষ কোনো উৎসব বুঝি?

হ্যাঁ, খুব বড় উৎসব।

তোড়া বানিয়ে দেব?

দাও।

দাম কিন্তু অনেক পড়বে। এগুলি এসেছে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে।

আমি ক্যাশ পেমেন্ট করব। দামের জন্যে অসুবিধা নেই।

তুমি নিজেই নিয়ে যাবে?

হ্যাঁ, আমি নিজেই নিয়ে যাব। জনাথন কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল, ফুলের সঙ্গে আর কী দেওয়া যায়, বল তো?

কাকে দিচ্ছ?

তা বলা যাবে না।

আমার মনে হয় ফুলগুলিই যথেষ্ট। চমৎকার ফুল! আমাকে কেউ কোনোদিন এতগুলি ফুল একসঙ্গে দেয় নি।

জনাথন চলে গেল ফলের দোকানে। এক ঝুড়ি আপেল কিনল। টকটকে লাল রঙের আপেল। বড় সুন্দর।

ফুল এবং ফলের ঝুড়ি হাতে সে বেলা চারটার দিকে সমুদ্রের পারে উপস্থিত হল। এই জায়গাটি তার খুব ভালো চেনা। গত ছ মাসে প্রতি দিন এক বার করে এসেছে। চষে বেড়িয়েছে চারদিক। এটা কি উদ্দেশ্যমূলক ছিল? হয়তো বা। জনাথনের চোখে-মুখে এখন আর আগের আলস্য নেই। চোখ ঝকঝক করছে। ঈগল পাখির দৃষ্টি। সে এগিয়ে গেল সাউথ পয়েন্ট টার্মিনালে। বেশ কয়েকটি শখের প্রমোদতরী ভিড় করে আছে। সুন্দর-সুন্দর নাম সুইট সিক্সটিন, দি ড্রিম, দি রেড রিবন। এরা সন্ধ্যার আগে-আগে ছেড়ে যাবে। রাত দশটা-এগারটার দিকে ফিরে আসবে।

জনাথন যে-প্ৰমোদতরীটির কাছে এসে দাঁড়াল, তার নাম দি ফার ইস্ট। চমৎকার দোতলা একটি ছিমছাম জলযান। ধবধবে সাদা রঙ। নীল জলের সঙ্গে এত চমৎকার মানিয়েছে।

এখানে কি পল ভিন্তানি আছেন?

কেন? আমার একটু প্রয়োজন ছিল।

কী প্রয়োজন?

আমি তাঁর জন্যে কিছু উপহার নিয়ে এসেছিলাম।

জনাথন তার উপহার দেখাল এবং বিনীত ভঙ্গিতে হাসল। মৃদুস্বরে বলল, একসময় তাঁর কাছ থেকে উপকার পেয়েছিলাম, সেই জন্যে আসা।

উপহার আমার কাছে দাও নিয়ে যাচ্ছি। নাম কী বল। পল ভিন্তানিকে বলব।

আমি একজন অভাজন ব্যক্তি। নাম বললে চিনতে পারবেন না। দেখলে হয়তো চিনতে পারতেন।

না, তুমি যেতে পারবে না। নিরাপত্তার একটা ব্যাপার আছে।

আপনি আমাকে ভালো করে তল্লাশি করে দেখুন।

দেখাদেখির দরকার নেই। দাও, উপহারগুলি দাও। কী নাম বলব?

নাম বলতে হবে না। বলবেন, এক জন দরিদ্র ভক্ত।

লোকটি ফুল এবং আপেল নিয়ে চলে গেল। জনাথন হতাশ মুখে দাঁড়িয়ে রইল নিচে। তার মনে ক্ষীণ আশা, এক্ষুনি তার ডাক পড়বে। এতগুলি চমৎকার ফুল কে দিয়েছে, কী জন্যে দিয়েছে, এটা জানার আগ্রহ সবারই হবে। পল ভিন্তানিরও হওয়া উচিত।

এবং তাই হল, জনাথনকে ভেতরে যেতে বলা হল।

পল ভিন্তানির বয়স ত্রিশের কম, কিন্তু দেখাচ্ছে চল্লিশের মত। তার কোমর জড়িয়ে যে-মেয়েটি বসে আছে, তার বয়স সতেরর বেশি হবে না। এমন একজন রূপসী মেয়েকে দেখতে পাওয়া ভাগ্যের কথা। পল ভিন্তানি প্রচুর মদ্যপানের কারণে চোখ খুলে রাখতে পারছে না। কথা বলল মেয়েটি, এত চমৎকার গোলাপগুলি তুমি পলকে দিয়ে?

জনাথন বিনয়ে মাথা নিচু করে ফেলল।

এত সুন্দর ফুল দিতে হয় প্রেমিকাকে। তোমার বোধহয় প্রেমিকা নেই।

মেয়েটি খিলখিল করে হাসতে লাগল। সেও মনে হয় নেশাগ্রস্ত।

ভিন্তানি থেমে-থেমে বলল, তোমাকে চিনতে পারছি না।

আমার নাম জনাথন।

জনাথন, ফুলের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। এখন যেতে পার। আর তোমার যদি কোনো আবদার থাকে, পরে এসে বলবে। কিছু-একটা তোমার মনে আছে। বিনা কারণে কেউ ফুল দেয় না। হা-হা-হা।

ভিন্তানি হাতের ইশারা করে জনাথনকে চলে যেতে বলল। জনাথন একটু পিছিয়ে গিয়ে কেবিনের দরজা ভেজিয়ে দিল।

ভিন্তানি, আমাকে তোমার চেনার কথা। আমার নাম এন্ড্রু জনাথন। জার্মানিতে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। আমাকে এত সহজে ভুলে যাওয়া ঠিক না।

ভিন্তানির নেশা কেটে যেতে শুরু করল। মেয়েটি তাকাচ্ছে অবাক হয়ে। সে উঠে দাঁড়াবে কি দাঁড়াবে না ঠিক করে উঠতে পারছে না। জনাথন মেয়েটির দিকে ঠাণ্ডা গলায় বলল, নড়াচড়া করবে না। কোনো রকম সাড়াশব্দও করবে না। আমার সঙ্গে একটি লুগার থারটি সিক্স পিস্তল আছে। পিস্তল চালনায় আমার দক্ষতা তোমার বন্ধু মিঃ ভিন্তানি ভালোই জানেন। তাই না মিঃ ভিন্তানি?

ভিন্তানি শুকনো গলায় বলল, তুমি কী চাও?

তেমন কিছু চাই না। আমি কিছু কোকেন এনেছি তোমার জন্য। এইটি তুমি আমার সামনে খাবে। আমি দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখব। এটা আমার অনেক দিনের শখ।

ভিন্তানির নেশা পুরোপুরি কেটে গেল। তার কপালে ঘাম জমতে শুরু করেছে। জনাথন তার সামার কোটের পকেট থেকে পিস্তলটি বের করল। ছোট্ট ছিমছাম একটি জিনিস।

ভিন্তানি টেনে-টেনে বলল, জনাথন, তুমি জীবিত অবস্থায় এখান থেকে বের হতে পারবে না।

তোমার মতো জীবনের প্রতি আমার মোহ নেই। বের হতে না-পারলেও ক্ষতি নেই। খেতে শুরু কর, পিস্তলের গুলি খেয়ে মরার চেয়ে কোকেন খেয়ে মরা ভালো। এতে কষ্ট কম হয় বলে আমার ধারণা।

জনাথন তাকিয়ে আছে হাসিমুখে, যেন কিছুই হয় নি। ভিন্তানি খেতে শুরু করল। তার চোখ ঠিকরে বের হয়ে আসছে। চাপা একটা গোঁ-গোঁ শব্দ আসছে মুখ থেকে।

মেয়েটি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে জনাথনের দিকে। অবিশ্বাস্য এই ঘটনাটি সে নিজের চোখের সামনেই দেখছে, তবু স্বীকার করতে পারছে না।

জনাথন বলল, তোমার মতো এমন রূপসী একটি মেয়ের তো খুব ভালো ছেলেবন্ধু পাওয়ার কথা। এর সঙ্গে লেপ্টে আছ কেন?

মেয়েটি জবাব দিল না। জনাথন বলল, কি নাম তোমার?

এলেনা।

এলেনা, তোমার বন্ধুর হয়ে গেছে, আমার ধারণা। তবু এক জন ডাক্তার দেখিয়ে নিশ্চিত হওয়া ভালো।

এলেনা জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটল। জনাথন বলল, শুভ সন্ধ্যা, এলেনা।

জনাথন নির্বিঘ্নে নিচে নেমে এল। কেউ তাকে কোনো প্রশ্ন করল না। সে মুখে একটি বিনীত হাসি ফুটিয়ে রাখল।

 

তার খোঁজ পড়ল পঁয়ত্রিশ মিনিট পর। ওয়েস্ট কোস্টের মাফিয়া বস এত্তের বড় ছেলে পল ভিন্তানি মারা গেছে। খবর ছড়িয়ে পড়ল দাবানলের মতো।

এন্ড্রু জনাথন মিলিয়ে গেছে হাওয়ার মতো। এত্তেনা ঠাণ্ডা গলায় বলল, বাহাত্তর ঘন্টার মধ্যে একে আমি চাই। সে এ-শহরেই আছে, এবং সে কোন যাদুমন্ত্র জানে

না।

এত্তেনা মাফিয়াদের ক্ষমতার একটা নমুনা দেখাবার ব্যবস্থা করল। তারা নিজেদের নিজস্ব পদ্ধতিতে শহর থেকে বের হবার সমস্ত পথ সিল করে দিল। মান-সম্মানের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাঘের গুহায় ঢুকে কেউ বাঘের বাচ্চা মেরে যেতে পারে না। বাহাত্তর ঘন্টা পার হয়ে গেল, এন্ড্রু জনাথন ধরা পড়ল না। শিকাগো-মাফিয়াদের একটি প্রধান শাখা থেকে বিপুল সাহায্য এসে উপস্থিত হল। শহরকে বন্ধ করা হবে। চিরুনির মত এলাকাটিতে আঁচড়ানো হবে। একটি মাছিও যেন গলে যেতে না পারে। জনাথন তো এক জন জলজ্যান্ত মানুষ।

শহরকে ঘিরে একটি কাল্পনিক বৃত্ত তৈরি করা হয়েছে। সেই বৃত্ত ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। কিন্তু জনাথনকে পাওয়া যাচ্ছে না।

পঞ্চম দিনে এত্তে একটি টেলিফোন কল পেল। জেনারেল সিমসন লং ডিসট্যান্স কল করেছেন। তাঁদের কথাবার্তা হল এরকম–

সিমসন : আমাকে চিনতে পারছেন তো?

এত্তেনা : পারছি। বয়স হয়েছে, স্মৃতি দুর্বল। কিন্তু আপনাকে চিনতে পারছি।

সিমসন : আপনার পারিবারিক দুঃসংবাদের খবরে খুবই দুঃখিত হলাম।

এত্তেনা : ধন্যবাদ। আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।

সিমসন : শুনলাম এন্ড্রু জনাথন এখনো ধরা পড়ে নি।

এত্তেনা : না। তবে ধরা পড়বে। সময় হয়ে এসেছে। আপনি শিকাগো শহরে একটি সুচ ফেলে রাখুন, আমি খুঁজে বের করে দেব। সেই ক্ষমতা আমার আছে। আশা করি স্বীকার করবেন।

সিমসন : আমি একটি বিশেষ কারণে আপনাকে টেলিফোন করেছি।

এত্তো : কারণ ছাড়া আপনাদের মতো মানুষ আমাদের খোঁজ করবেন না, তা জানি। কারণটি বলুন।

সিমসন : এন্ড্রু জনাথনকে আমাদের প্রয়োজন। অত্যন্ত প্রয়োজন।

এত্তেনা : (নীরব) সিমসন : আপনি আপনার দলের সবাইকে উঠিয়ে নেবেন।

এত্তেনা : (নীরব)

সিমসন : এন্ড্রু জনাথনকে জীবিত অবস্থায় আমাদের হাতে তুলে দিতে হবে। আপনার কাছ থেকে এই গ্যারান্টি চাই।

এত্তেনা : তা সম্ভব নয়। সিমসন আপনি বুদ্ধিমান মানুষ বলে জানতাম।

এত্তেনা : (নীরব)।

সিমসন আপনাকে দশ মিনিট সময় দিচ্ছি। দশ মিনিটের মধ্যেই আমাকে জানাবেন। হ্যাঁ কিংবা না।

জেনারেল সিমসন টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। এবং তার এক ঘন্টা পর ফকনারকে টেলিফোনে জানালেন এন্ড্রু জনাথনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। তাকে আগামী কাল ভোরে পৌঁছে দেওয়া হবে।

খুঁজে পেতে অসুবিধা হয় নি তো?

না, তেমন হয় নি।

বেন ওয়াটসন জুনিয়রকে কবে পাব?

বলতে পারছি না।

পাব তো?

সিমসন জবাব দিলেন না। টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *