সাত
চীন দেশের বাদশাহ সুলতানকে মূল্যবান কতকগুলো উপহার পাঠিয়েছেন। তার মধ্যে রয়েছে একশ ক্রীতদাস ও দাসী, পাঁচশ মখমল ও রেশমি-কাপড়ের টুকরা, জরির পোষাক এবং অস্ত্রশস্ত্র। এসব পাঠিয়ে কারাজিল (হিমালয়) পাহাড়ের নিকটস্থ একটি মন্দির পূণনির্মাণের অনুমতি চেয়েছেন তিনি সুলতানের কাছে। চীন দেশীয় তীর্থযাত্রীদের এ মন্দিরটি সমহল নামক স্থানে অবস্থিত। ভারতের মুসলমান সৈন্যরা এক সময়ে এ-মন্দিরটি আক্রমণ করে এবং ধ্বংস করে ফেলে। চীন সম্রাটের উপহার গ্রহণ করে সুলতান তাকে লিখে পাঠালেন, ইসলাম ধর্মের নিয়মানুসারে মন্দির নির্মাণের অনুমতি দেওয়া সম্ভব নয়। যারা মন্দির নির্মাণের জন্যে বিশেষ ধরণের কর দেয় মুসলিম সাম্রাজ্যে শুধু তাদেরই মন্দির নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়। তারপরে লিখলেন, “আপনিও যদি “জিজিয়া” কর দিতে সম্মত থাকেন তবে আপনাকে মন্দির নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হবে। যারা সত্য পথ অনুসরণ করে তাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক।” পত্রের সঙ্গে তিনি পাল্টা উপহারও পাঠালেন। সে উপহার সম্ভার চীন থেকে প্রাপ্ত উপহারের চেয়ে অনেক বেশী। তার ভেতরে প্রধান ছিল একশ ভাল জাতের ঘোড়া, একশ শ্বেতাঙ্গ ক্রীতদাস, একশ হিন্দু নর্তকী ও গায়িকা, বারশ বিভিন্ন শ্রেণীর বস্ত্রখণ্ড, সোনারূপার তৈজসপত্র, সোনালী কাজকরা পোষাক পরিচ্ছদ, তরবারী, মুক্তার কাজ করা দস্তানা এবং পনের জন খোজা ভৃত্য।
সুলতান আমার সহগামী-দূত হিসাবে নিযুক্ত করলেন জান্জানের খ্যাতনামা বিদ্বান আমীর জহিরউদ্দিনকে। উপহার দ্রব্যের হেফাজতের ভার দিলেন কাফুর নামক একজন খোঁজার উপর। আমাদের জাহাজে আরোহণের পূর্ব পর্যন্ত এগিয়ে দেবার জন্য এক হাজার সৈন্যসহ পাঠালেন আমীর মোহাম্মদকে।
আমাদের সঙ্গে ফিরে চললেন চীনের পনের জন দূত এবং তাদের ভৃত্যগণ, সব মিলে প্রায় শতেক লোক।
সুলতান আদেশ দিলেন, আমরা তাঁর রাজ্যের বাইরে গিয়ে-না-পৌঁছা অবধি সরকার থেকেই আমাদের খাদ্য সরবরাহ করা হবে। হিজরী ৭৪৩ সনের ১৭ই সফর মোতাবেক ১৩৪২ খৃষ্টাব্দের ২২ শে জুলাই আমাদের যাত্রা শুরু হল। যাত্রার জন্যে বিশেষ করে এ-দিনটি নির্দিষ্ট করার একটি কারণ ছিল। এখানকার লোকেরা প্রতিমাসের ২রা, ৭ই, ১২ই, ১৭ই, ২২শে এবং ২৭শে তারিখকে বিদেশযাত্রার জন্যে শুভদিন মনে। করে।
প্রথম দিন যাত্রা করে আমরা দিল্লীর সাত মাইল দূরে তিলবাতে উপস্থিত হলাম। সেখান থেকে রওয়ানা হয়ে বায়না শহরে কুল-এ (আলিগড়) পৌঁছে একটি মাঠের উপর তাবু ফেললাম।
কুলে পৌঁছে শুনতে পেলাম কতিপয় অবিশ্বাসী হিন্দু আল-জালালী শহরটি আক্রমণ করে ঘেরাও করে রেখেছে। এ শহরটি কুল থেকে সাত মাইল দূরে অবস্থিত। অগত্যা আমরা সে দিকেই রওয়ানা হলাম। ইত্যবসরে হিন্দু বিদ্রোহীরা শহরের অধিবাসীদের সঙ্গে যুদ্ধ আরম্ভ করেছে এবং তাদের প্রায় ধ্বংস করে এনেছে। আমরা সেখানে পৌঁছে তাদের পালটা আক্রমণ করার পূর্ব পর্যন্ত তারা আমাদের সম্বন্ধে কিছুই জানতে পারেনি। তাদের মধ্যে অশ্বারোহী ছিল এক হাজার, পদাতিক তিন হাজার। কিন্তু তাহলেও দলের শেষ লোকটি অবধি আমাদের হাতে প্রাণহারায় এবং তাদের বহু ঘোড়াও অস্ত্রশস্ত্র আমাদের হস্তগত হয়। অবশ্য আমাদের দলেরও কিছু সংখ্যক লোক নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে ছিল তেইশ জন অশ্বারোহী, পঞ্চান্ন জন পদাতিক, সেই সঙ্গে উপহার দ্রব্যের হেফাজতকারী কাফুর।
আমরা পত্রযোগে সুলতানকে কাফুরের মৃত্যু-সংবাদ জানিয়ে সুলতানের জবাবের প্রতীক্ষায় রইলাম। এ সময়ে আল-জালালীর নিকটবর্তী দুরধিগম্য এক পাহাড় থেকে দলে-দলে হিন্দুরা এসে শহরের আশে-পাশে আক্রমণ চালাত। আমাদের দলের লোকেরা প্রায় প্রতিদিন তাদের প্রতিরোধ করতে বেরিয়ে যেত।
এ-উপলক্ষে একবার আমি কতিপয় বন্ধুর সঙ্গে অশ্বারোহণ করে একবার বেরিয়ে এক বাগানে বসে বিশ্রাম করছিলাম, কারণ তখন গ্রীষ্মকাল। এমন সময় অদূরে বহু লোক-জনের চীৎকার শুনতে পেলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম বিদ্রোহী হিন্দুরা একটি গ্রাম আক্রমণ করেছে। আমরা তাদের পাল্টা আক্রমণ করতেই তারা ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে গেল। আমরাও তাদের পথ অনুসরণ করে ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে তাদের পিছু নিলাম।
এভাবে পশ্চাদ্ধাবন করতে গিয়ে একবার পাঁচ জন সঙ্গীসহ আমি দল থেকে অনেক দূরে গিয়ে পড়লাম। এ সময়ে এক ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে একদল অশ্বারোহী ও পদাতিক সহসা আমাদের আক্রমণ করল। তাদের সংখ্যাধিক্য দেখে আমরা পালাতে চেষ্টা করলাম। প্রথমে তাদের দশজন আমার পিছু ধাওয়া করেছিল, শেষ অবধি তিন জন আমার পিছনে-পিছনে লেগেই রইল। আমার সামনে তখন আর পালাবার পথ নেই। সেখানকার জমিও প্রস্তরময়। একবার আমার ঘোড়ার সামনের পা দু’খানা পাথরের ফাঁকে আটকা পড়ে গেল। অগত্যা আমি নেমে ঘোড়ার পা মুক্ত করতে বাধ্য হলাম। ভারতের রীতি-অনুযায়ী একজন লোক দু’খানা করে তরবারী সঙ্গে রাখে। ঘোড়ার জিনের সঙ্গে বাঁধা আমার একখানা তরবারী মাটিতে পড়ে গেল। তরবারীখানা ছিল সোনার কারুকার্য খচিত। কাজেই আবার ঘোড়া থেকে নেমে আমাকে তরবারীখানা। কুড়িয়ে নিতে হল। তখনও শত্রুপক্ষের তিনজন লোক আমার পশ্চাদ্ধাবন করছে। অবশেষে সামনেই গভীর একটি নালা দেখতে পেয়ে আমি নীচের দিকে নেমে গেলাম। তারপরে আর পশ্চাদ্ধাবনকারীদের সাক্ষাৎ পাইনি।
অত:পর আমি বনের পাশে একটি উপত্যকায় গিয়ে উঠলাম। সেখানে একটি রাস্তা পেয়ে আমি অনির্দিষ্ট ভাবে হাঁটতে লাগলাম। সে রাস্তা কোথায় গিয়ে পৌঁছে, তাও আমার জানা নেই। এমন সময় প্রায় চল্লিশ জন বিধর্মী তীর ধনুক নিয়ে আমাকে ঘেরাও করে ফেলল। আমার ভয় হল যে, পালাবার চেষ্টা করলেই তারা এক সঙ্গে আমাকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়তে আরম্ভ করবে। এদিকে আমি এখন একেবারে নিরস্ত্র বললেই চলে। কাজেই আমি নিরুপায় হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ে আত্মসমর্পন করলাম, কারণ আত্মসমর্পণকারী শত্রুকে তারা হত্যা করে না।
তারা আমাকে ধরে পরিধানের বস্ত্র ছাড়া আর সব কিছুই খুলে নিয়ে গেল। তারপরে আমাকে নিয়ে গেল জঙ্গলের ভেতর তাদের আস্তানায়। বৃক্ষাবৃত একটি পুকুরের কাছে তাদের আস্তানা। তাদের দেওয়া মটরশুটির তৈরী এক রকম রুটি খেয়ে পানি খেলাম। এদের দলে দেখলাম দুজন মুসলমান রয়েছে। তারা ফারসী ভাষায় আমার সঙ্গে কথার্বাতা বলল, আমার সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে চাইল। আমি যে। সুলতানের নিকট থেকেই এসেছি, এটুকু গোপন করে আংশিকভাবে তাদের কাছে নিজের কথা বললাম। তারপর তারা বলল, “এদের হাতে অথবা অন্য লোকদের হাতে নিশ্চয়ই তোমাকে প্রাণ দিতে হবে। ইনি এদের সরদার।” এই বলে তাদের মধ্যে
একজন লোককে দেখিয়ে দিল। কাজেই আমি তার সঙ্গে কথা বললাম। মুসলমান দুজন। দোভাষীর কাজ করতে লাগল।
অত:পর সরদার আমাকে তিনজন লোকের জিম্মা করে দিল। তাদের একজন ছিল বৃদ্ধ, দ্বিতীয় জন তার ছেলে। তৃতীয় ব্যক্তি কৃষ্ণকায় একজন দুষ্ট প্রকৃতির লোক। এ তিনজন লোকের সঙ্গে কথাবার্তায় জানতে পারলাম, আমাকে হত্যা করার ভার পড়েছে এদের উপর।
সেই দিনই বিকাল বেলা তারা আমাকে হাজির করল একটি গুহার কাছে। সেখানে কৃষ্ণকায় লোকটি আমার গায়ের উপর তার পা দিয়ে রাখল এবং বৃদ্ধ ও তার ছেলে ঘুমিয়ে পড়ল। ভোরে উঠে তারা নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলল এবং আমাকে পুকুরে যেতে ইশারা করল। আমার তখন আশঙ্কা হল, এবার আমাকে হত্যা করা হবে। কাজেই আমি বৃদ্ধলোকটির সঙ্গে কথা বলে তার দয়া ভিক্ষা করতে লাগলাম। আমার। উপর তার কিছুটা দয়া হল।
দুপুরে বেলা পুকুরের কাছে কিছু লোকজনের সোরগোল শুনা গেল। তারা মনে করল, তাদেরই দলের লোক। কাজেই তারা আমাকেও সেখানে যেতে বলল। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখা গেল এ-দলের লোক তারা নয়। নতুন দলটি আমার প্রহরীদের পরামর্শ দিল তাদের সঙ্গে যেতে। কিন্তু এরা তাতে রাজী না হয়ে বরং আমাকে তাদের সামনে রেখে বসে রইল। তাদের সামনে একগাছি শনের দড়ি। আমার মনে হল, আমাকে হত্যা করার সময় হয়তো এই দড়ি দিয়েই বাঁধবে আমাকে।
অনেকক্ষণ পরে শেষোক্ত দলের তিনজন লোক আমার কাছে এল। তাদের মধ্যে সুদর্শন এক যুবক আমাকে জিজ্ঞেস করল, তোমাকে আমি মুক্তি দিলে খুশি হবে?
আমি সম্মতি জানাতেই সে বলল, বেশ যাও।
বলতেই আমি আমার গায়ের জামাটি খুলে তাকে দিলাম। বিনিময়ে সেও তার গায়ের একটি জামা আমাকে দিল। অত:পর আমি চলে এলাম কিন্তু সারাক্ষণ ভয় হতে লাগল, হয়ত তাদের মনের অবস্থার কোন রকম পরিবর্তন হলে আবার আমাকে গ্রেফতার করতে পারে। তাই আমি তাড়াতাড়ি একটা নল-খাগড়ার বনে গিয়ে লুকিয়ে রইলাম এবং সূর্যাস্ত পর্যন্ত সেখানেই কাটালাম।
যুবক আমাকে যে রাস্তাটা দেখিয়ে দিয়েছিল, সূর্যাস্তের পরে সেই রাস্তা ধরেই চলতে লাগলাম। রাস্তাটা একটি ছোট খালে গিয়ে পড়েছে সেখানে গিয়ে আমি তৃষ্ণা নিবারণ করলাম। প্রায় দুপুর-রাত অবধি চলবার পর আমি একটা পাহাড়ের নিকট এসে সেখানেই রাত কাটালাম। ভোরে উঠে আবার আমার যাত্রা শুরু হল এবং দুপুর বেলা একটা উচ্চ পাহাড়ের কাছে গিয়ে পৌঁছলাম। এখানে কুল জাতীয় এক প্রকার ফল পেড়ে খেতে গিয়ে কাঁটার আঁচড় লেগেছিল আমার বাহুতে। বাহুর সে দাগ আজও মিলায়নি।
সপ্তম দিনে বিধর্মীদের এক গ্রামে গিয়ে পৌঁছলাম আমি। গ্রামে একটি কুপ আছে, শাক-সজীর ক্ষেতও আছে। আমি কিছু আহার্য চাইলাম কিন্তু গ্রামের লোকেরা আমাকে কিছুই খেতে দিতে রাজী হল না। একটি কুপের কাছে কিছু মূলো-শাক দেখতে পেয়ে অগত্যা আমি তাই খেলাম।
অষ্টম দিনে পিপাসায় আমি মৃতপ্রায় হলে গেলাম। একটি গ্রামে গেলাম, কিন্তু সেখানেও পানি পেলাম না।
রাস্তা দিয়ে চলতে-চলতে অবশেষে আমি একটি ভোলা কুপের কাছে গিয়ে হাজির হলাম। কুপের কাছে একটি দড়ি আছে কিন্তু পানি তুলবার কোন পাত্র সেখানে দেখতে পেলাম না। আমার মাথায় এক টুকরো কাপড় ছিল। দড়ির মাথায় কাপড়ের টুকরোটি বেঁধে তাই ভিজিয়ে পানি তুলে মুখে দিলাম। কিন্তু তাতে তৃষ্ণা নিবারণ হল না। অবশেষে আমি আমার এক পাটী জুতো দড়িতে বেঁধে তারই সাহায্যে পানি তুলে পান করলাম। কিন্তু তাতে পরিপূর্ণভাবে তৃপ্ত হতে পারলাম না। কাজেই দড়ি বাঁধা জুতোখানা দ্বিতীয়বার কুপে ফেললাম। দুর্ভাগ্যের বিষয় এবার দড়ি ছিঁড়ে জুতোখানা কুপের তলায় পড়ে গেল। অগত্যা দ্বিতীয় পাটী জুতোর সাহায্যে একই উপায়ে পানি তুলে আমাকে পান করতে হল।
তারপর সেই জুতোখানা কেটে তার উপরের অংশ আমার দুপায়ে বাধলাম দড়ি এবং ছেঁড়া কাপড়ের সাহায্যে।
আমি যখন পায়ে জুতোর চামড়া বাঁধছিলাম এবং এরপর কি করা যাবে তাই ভাবছিলাম তখন একটি লোক এসে আমার সামনে দাঁড়াল। আমি তার দিকে চোখ তুলে চেয়ে দেখলাম, লোকটি কৃষ্ণবর্ণ। তার হাতে একটি জগ ও একখানা লাঠী, কাঁধে একটি ঝোলা। সে মুসলমানী কায়দায় আমাকে অভিবাদন জানাল, ‘আচ্ছালামু আলাইকুম’ বলে। আমি অনুরূপভাবে তাকে প্রত্যাভিবাদন জানালাম। তখন লোকটি আমার পরিচয় জিজ্ঞেস করতে আমি বললাম, আমি একজন পথহারা ব্যক্তি। সে বলল, আমিও তাই।
তার সঙ্গে দড়ি ছিল। তার জগ ও দড়ির সাহায্যে পানি তুলে পান করতে উদ্যত হয়েছি এমন সময় সে বলে উঠল, সবুর কর। এই বলে সে তার ঝোলার ভেতর থেকে এক মুঠো কাল মটর ও চাউল ভাজা বের করে আমাকে খেতে দিল।
খাওয়ার পরে ওজু করে সে দু’রাকাত নামাজ পড়ল। আমিও তাই করলাম। অত:পর সে আমার নাম জিজ্ঞেস করায় আমি বললাম আমার নাম মোহাম্মদ। সে তার নিজের নাম বলল, ‘আনন্দিতআত্মা’। তার নাম একটা ভাল লক্ষণ বলে মনে হল এবং আমার মনে স্বস্তি ফিরে এল।
সে একটু পরে বলল, আল্লার ওয়াস্তে তুমি আমার সঙ্গে চল। আমি রাজী হলাম; কিন্তু এত দুর্বলতা বোধ করতে লাগলাম যে বেশীক্ষণ তার সঙ্গে চলতে পারলাম না। এক জায়গায় গিয়ে আমি বসে পড়লাম। তাকে বললাম যতদিন তোমার দেখা পাইনি ততদিন বেশ চলেছি কিন্তু তোমাকে পেয়ে যেনো আর চলতে পারছি না।
আমি হাঁটতে অক্ষম বলাতে আগন্তুক আমাকে নিজের কাঁধে তুলে নিলেন এবং স্মরণ করতে বললেন, “খোদা আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ রক্ষাকর্তা।” আমি বার বার এ-কথা স্মরণ করতে লাগলাম। কিন্তু আমার চোখ যেন আপনা হতেই বন্ধ হয়ে আসছিল। তারপর হঠাৎ যেন মাটীতে পড়ে যাচ্ছি মনে হওয়ায় আমার জ্ঞান ফিরে এল, আমি চোখ মেলে চাইলাম। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সে লোকটিকে ধারে কাছে আর কোথাও দেখতে পেলাম না। তাছাড়া আমি তখন একটি লোকালয়ে অবস্থান করছি।
গ্রামের ভেতর প্রবেশ করে দেখলাম, অধিকাংশ বাসিন্দা হিন্দু কিন্তু তাদের শাসনকর্তা একজন মুসলমান। প্রজাদের কাছে খবর পেয়ে তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। আমি তাকে সেই গ্রামের নাম জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, গ্রামটির নাম তাজবুরা। আমার দলের লোকেরা যেখানে আছে সেই কোয়েল এখান থেকে খুব দূরে নয়। গ্রামের শাসনকর্তা আমাকে তার বাড়ী নিয়ে যাবার জন্যে একটি ঘোড়া আনালেন। বাড়ীতে গেলে তিনি আমাকে গোসল করালেন এবং গরম খাদ্য খেতে। দিলেন। আমার আহারের পরে বললেন, আমার কাছে একটি জামা ও পাগড়ী আছে। একজন মিসরবাসী আরবের লোক এগুলো আমার জিম্মায় রেখে গেছে। কোয়েলে যে সেনাদল আছে, সে তারই একজন সৈনিক। আমি তখন সেগুলো আমাকে দিতে অনুরোধ জানালাম। সেগুলো আমার কাছে হাজির করা হলে দেখলাম, এগুলো আমার নিজেরই সম্পত্তি এবং আমিই কোয়েল থাকাকালে সেই আরবী লোকটিকে এগুলো দিয়েছিলাম। এব্যাপারে আমি বিস্মিত না হয়ে পারলাম না। সে লোকটি আমাকে কাঁধে। তুলে এখানে এনেছিলেন তখন তার কথাই আমি ভাবতে লাগলাম।
ভাবতে ভাবতে আমার মনে পড়ল, আবু আবদুল্লাহ্ আল-মুর্শিদী নামক একজন দরবেশের কথা। তিনি একবার আমাকে বলেছিলেন, তুমি হিন্দুস্থানে পৌঁছে আমার ভাই দিলশাদের দেখা পাবে। তুমি সেখানে একটি বিপদে পড়বে এবং আমার ভাই তোমাকে সেই বিপদ থেকে রক্ষা করবে।
আমি এখন বুঝতে পারলাম, ইনিই দরবেশ আবু আবদুল্লাহ আল-মুর্শিদীর ভাই। দুঃখের বিষয়, উল্লিখিত ঘটনার সময় ছাড়া আর কখনও এ লোকটির সঙ্গলাভের সৌভাগ্য আমার হয় নাই।
সে রাত্রেই কোয়েলায় পত্র লিখে আমার নিরাপত্তার কথা বন্ধুদের জানালাম। খবর পেয়ে তারা আমার জন্যে ঘোড়া ও পোষাক নিয়ে হাজির হলেন এবং আমাকে ফিরে পেয়ে বিশেষ সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন।
তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারলাম, কাফুরের মৃত্যুর পরে আমরা সুলতানকে যে চিঠি লিখেছিলাম তার জবাব এসে পৌঁচেছে। তিনি সমবুল নামক একজন খোঁজাকে কাফুরের স্থলাভিষিক্ত করে পাঠিয়েছেন এবং পুনরায় আমাদের যাত্রা শুরু করতে বলেছেন।
আমার বিপন্ন অবস্থার কথা লিখে সঙ্গীরা সুলতানকে আরও একখানা চিঠি লিখেছিল। সেই চিঠিতে তারা এ যাত্রাকে অশুভ যাত্রা মনে করে আর অধিক অগ্রসর হতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছিল। কিন্তু সুলতানের মনোভাব জানতে পেরে আমি তাদের মতে মত দিতে পারিনি। তারা তখন বলল, যাত্রার শুরুতেই কি রকম বিপদ-আপদ ক হয়েছে আপনি কি তা দেখতে পাচ্ছেন না। আপনার অনুরোধ অবশ্যই সুলতান রক্ষা করবেন। সুলতানের জবাবের জন্যে আমাদের এখানেই অপেক্ষা করা উচিত অথবা সুলতানের কাছে ফিরে যাওয়া উচিত।
আমি তাদের প্রস্তাবে অসম্মতি জানিয়ে বললাম, আমরা এখানে অপেক্ষা করতে পারি না। যেখানেই আমরা যাই না কেন, সুলতানের জবাব সেখানেই পাব।
তারপর আমরা পুনরায় যাত্রা করে তাবু ফেললাম বার্জবুরা বা বার্জপুর নামক স্থানে গিয়ে। এখানে একজন শেখের একটি দরগাহ আছে। সুশ্রী ও ধর্মপ্রাণ এই শেখ নাভি থেকে পা অবধি শুধু একখণ্ড বস্ত্র ব্যবহার করেন। এ জন্য সবাই তাকে নাঙ্গা মোহাম্মদ বলে থাকে। বার্জপুর থেকে রওয়ানা হয়ে আমরা প্রথমে পৌঁছলাম আব-ই-সিয়া (কালিন্দী) নদী অবধি এবং সেখান থেকে কনৌজ। কনৌজ একটি সুগঠিত ও সুরক্ষিত বড় শহর। শহরটি প্রকাণ্ড একটি দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। এ শহরে জিনিষপত্রের দাম বেশ সস্তা। আমরা এখানে তিনদিন কাটালাম। আমার সম্বন্ধে সুলতানকে যে পত্র দেওয়া হয়েছিল তার জবাব এখানে থাকতেই পেলাম। তিনি লিখেছেন, যদি ইব্নে বতুতার কোন খোঁজই না পাওয়া যায়, তবে তার জায়গায় তোমরা দৌলতাবাদের কাজী ওয়াজি উল-মুলককে নিয়ে যাত্রা শুরু করবো।
কনৌজ থেকে আমরা মাওরী নামক ছোট একটি শহর ছাড়িয়ে বড় শহর মার-এ গিয়ে পৌঁছলাম।৩ এ শহরের অধিকাংশ অধিবাসী বিধর্মী; কিন্তু শাসনকর্তা মুসলমান।
মালয়া নামক একটি হিন্দু সম্প্রদায়ের নাম থেকে এ-শহরটির নামকরণ হয়েছে। এরা সুশ্রী ও শক্তিশালী এবং মহিলারা খুবই সুন্দরী। মার ছাড়িয়ে আমরা গেলাম আলাবার বা আলাপুর। এ-ছোট শহরটির অধিবাসীরাও অধিকাংশ হিন্দু এবং শাসনকর্তা আবিসিনিয়ার একজন মুসলমান। এক সময়ে ইনি সুলতানের একজন ক্রীতদাস ছিলেন। অসীম সাহসিকতার জন্য ইনি সর্বত্র পরিচিত ছিলেন। বিধর্মীরা বরাবর একে ভয় করে চলত। কারণ ইনি অনবরত তাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে এবং তাদের বন্দী বা হত্যা করে ত্রাসের সঞ্চার করেছিলেন। ইনি যেমন শক্তিশালী তেমনি দীর্ঘকায় ছিলেন। শুনেছি একবার আহার করতে বসে ইনি একটি ভেড়ার গোত একাই খেয়ে ফেলতেন এবং খাওয়ার পরে প্রায় দেড় পাউণ্ড ঘি খেতেন। তাদের নিজের দেশের নিয়মও ছিল তাই। এই শাসনকর্তার একটি পুত্রও ঠিক তারই মত সাহসী ছিল। অবশেষে একটি গ্রাম আক্রমণ করতে গিয়ে ইনি হিন্দুদের হাতে নিহত হন।
অত:পর আমরা গোয়ালিয়রে এসে হাজির হলাম। এখানে উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত একটি দূর্গ আছে। এই দূর্গের প্রবেশদ্বারে মাহুতসহ পাথরের খোদাই একটি হাতী দেখলাম। এখানকার শাসনকর্তা একজন ধার্মিক ও সদ্ব্যক্তি। ইনি পূর্বে একবার আমাকে বিশেষ সম্মান করেছিলেন। একদিন আমি তার কাছে গিয়ে দেখলাম, তিনি একজন বিধর্মীকে তার কোন অপরাধের জন্য দু’টুকরা করে কাটতে উদ্যত হয়েছেন। দেখেই আমি তাকে বললাম, আল্লার নামে আমি অনুরোধ করছি, এ-কাজটি করবেন না। কারণ, আমি জীবনে কখনো চোখের সামনে নরহত্যা দেখিনি। তিনি আমার অনুরোধ রক্ষা করে লোকটিকে কারাগারে রাখবার হুকুম করলেন। কাজেই আমার হস্তক্ষেপে একটি লোকের জীবন রক্ষা হল।
গোয়ালিয়র থেকে আমরা গেলাম পারওয়ান।পারওয়ান মুসলমানদের শহর কিন্তু এ-শহরের অবস্থান বিধর্মীদের অধিকৃত জায়গায়। এ-জায়গাটির আশে-পাশে অনেক ব্যাঘ্রের বাস। স্থানীয় একজন লোকের মুখে শুনলাম, শহরের প্রবেশদ্বার বন্ধ থাকা সত্ত্বেও রাত্রে একটি বাঘ প্রায়ই শহরে প্রবেশ করে এবং মানুষ ধরে নিয়ে যায়। এভাবে। এ-শহরের বেশ কিছু লোককে হত্যা করেছে বলে শোনা যায়। অথচ বাঘটি কি ভাবে যে শহরে প্রবেশ করে তা কেউ বলতে পারে না।
অবশেষে একটা আশ্চর্যজনক গল্প শুনলাম। একজন লোক আমার কাছে গল্প করল, এ-বাঘটি আসলে একটি মানুষ। যাদুর বলে এ বাঘের আকৃতি ধারণ করতে পারে। এসব যাদুকরেরা যোগী নামে পরিচিত। আমি এ-গল্প বিশ্বাস করতে রাজী হলাম না; কিন্তু একাধিক লোকের কাছে এ-বিষয়ে আমি একই গল্প শুনেছি।
এই শ্রেণী যোগী বা যাদুগীররা অনেক অসম্ভব কাজ করতে পারে। তাদের কেউ মাসের পর মাস কাটাতে পারে পানাহার না করে। কেউ-কেউ মাটীর নীচে গর্ত করে তাতেই বাস করে। এ রকম একটি লোকের কথা শুনেছি, সে নাকি এক বছর ছিল এমনি একটি গর্তে। এখানকার লোকেরা বলে, যোগীরা এমন পিল তৈরী করতে পারে-যার একটি খেয়ে কয়েক দিন বা মাস কাটিয়ে দেওয়া যায়। এ সময়ের মধ্যে কোন রকম তাদের ক্ষুধা-তৃষ্ণা থাকে না। এ ছাড়া বহুদূরে কি ঘটছে তাও তারা অনায়াসে বলে দিতে পারে। সুলতান যোগীদের সম্মান করেন এবং তাদের সঙ্গ দান করে থাকেন। শুনলাম, যোগীদের মধ্যে অনেকে আছে শুধু শাক-সজী খেয়ে জীবন ধারণ করে এবং বেশীর ভাগ যোগীরাই মাছ-মাংস স্পর্শ করে না। দীর্ঘদিনের অভ্যাসের ফলে নিজেদের তারা এভাবে নিয়ন্ত্রিত করেছে যে বাহ্যিক প্রয়োজন তাদের অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে।
যোগীদের মধ্যে এমনও কিছু সংখ্যক লোক আছে যারা একটি লোকের দিকে চোখ তুলে চাইলেই সেই লোকটি সেখানেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়। সাধারণ লোকরা বলে, এ ভাবে মৃত্যু ঘটেছে এমন কোন লোকের বক্ষ বিদারণ করে দেখা গেছে তার হৃদপিণ্ড নেই। অর্থাৎ হৃদপিণ্ড খেয়ে ফেলা হয়েছে। এ ধরনের যাদুগীর বা যোগীদের মধ্যে নারীই বেশী। সে সব নারী যাদুগীর মানুষের হৃদপিণ্ড ভক্ষণ করে তাদের বলা হয় কাফতার। দিল্লীতে যখন দুর্ভিক্ষ চলছে তখন এমনি একজন স্ত্রীলোককে আমার নিকট এনে বলা হয়েছিল, সে নাকি একটি শিশুর হৃদপিণ্ড ভক্ষণ করেছে। আমি তাকে সুলতানের লেফটেন্যান্টের কাছে পাঠাতে বললাম। লেফটেন্যান্ট বললেন, স্ত্রীলোকটি সত্যই কাফতার কি না তিনি তা পরীক্ষা করে দেখবেন।
এই বলে হাতে পায়ে চারটি পানিভর্তি কলসী বেঁধে স্ত্রীলোকটিকে যমুনা নদীতে নিক্ষেপ করা হয়। স্ত্রীলোকটি কিন্তু ডুবে না গিয়ে পানির উপর ভেসে রইল। এর ফলে তাকে কাফতার বলে গণ্য করা হল। বলা বাহুল্য, যথারীতি স্ত্রীলোকটি ডুবে গেলে তাকে কাক্তার বলে ধরা হত না। পরে হুকুম হল তাকে আগুনে পুড়িয়ে মারতে। স্ত্রীলোকটির ভাবশেষ শহরের নারী-পুরুষ সবাই মিলে কুড়িয়ে নিয়ে গেল। তাদের ধারণা এ ভস্ম গায়ে মাখলে এ-বছরের জন্যে অপর কোন কাতার তাদের কোন রকম অনিষ্ট করতে পারবে না।
আমি যখন দিল্লীতে তখন একদিন সুলতান আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি গিয়ে তাকে একটি গোপন কক্ষে কয়েকজন অন্তরঙ্গ বন্ধু ও দু’জন, যোগীর সঙ্গে দেখতে পেলাম। দু’জন যোগীর একজন বসা অবস্থায় শূন্যে আমাদের মাথার উপর উঠে গেল। তখনও সে সেখানে শূন্যের উপর বসে আছে। এ অদ্ভুত দৃশ্য আমাকে এতটা ভীত ও বিস্মিত করেছিল যে, আমি তৎক্ষণাৎ জ্ঞান হারালাম। পরে ঔষধ খাওয়ানোর ফলে প্রকৃতিস্থ হয়ে উঠে বসলাম। তখনও পর্যন্ত যোগী শুন্যেই বসে আছে। অবশেষে তার সঙ্গী যোগী ঝোলার ভেতর থেকে একখানা খড়ম বের করে মাটীতে ছুঁড়ে মারল। খড়মখানা শূন্যে অবস্থিত যোগীর ঘাড়ে বারবার আঘাত করতে লাগল এবং যোগী ধীরে ধীরে মাটিতে নেমে এসে আমাদের পাশে পূর্ববৎ বসে পড়ল। তখন সুলতান আমাকে বললেন, তুমি ভয় পাবে আমি জানতাম। তা না হলে আরও আশ্চর্যজনক ব্যাপার তোমাকে দেখাতে পারতাম। আমি সেখান থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম; কিন্তু আমার হৃদকম্প তখনও রয়েই গেল এবং আমি অসুখে পড়লাম। পরে ঔষধ খেয়ে আমাকে সুস্থ হতে হয়েছে।
আমাদের আলোচ্য বিষয়ে ফিরে আসা যাক। পারওয়ান থেকে আমরা গিয়ে কাজাররা পৌঁছি। এখানে এক মাইল লম্বা একটি দিঘী আছে। দিঘীর পাড়ে দেবমূর্তিসহ দেবমন্দির। মূর্তিগুলো মুসলিমদের দ্বারা (অস্পষ্ট) করা হয়েছে। সেখান থেকে চান্দিরি হয়ে আমরা ধিহার ৬ (ধর) শহরে এলাম। এ জেলার সবচেয়ে বড় প্রদেশ মালওয়াল এটি প্রধান শহর। দিল্লী থেকে এখানে আসতে চব্বিশ দিন লাগে। পথের পাশে স্তম্ভের গায়ে মাইলের সংখ্যা খোদিত আছে। পথিকরা সেই সংখ্যা দেখেই বুঝতে পারে, কত মাইল তারা একদিনে এসেছে এবং আর কত মাইল এগিয়ে গেলে থাকবার জায়গা বা গন্তব্যস্থানে পৌঁছা যাবে। ধিহার থেকে গেলাম উজ্জয়ন (উজ্জয়ন)। চমৎকার একটি জনবহুল শহর উজ্জয়ন। উজ্জয়ন থেকে এলাম দৌলত আবাদ। এ বিস্তৃত শহরটির প্রয়োজনীয়তার দিক থেকে রাজধানী দিল্লীর সঙ্গে তুলনা চলে। তিনটি বিভিন্ন অংশে এ শহর বিভক্ত। প্রথমাংশ খাস দৌলতআবাদ সুলতান ও তার সেনাদের জন্য নির্দিষ্ট। দ্বিতীয় অংশ কাটাক নামে পরিচিত। তৃতীয়াংশে দুয়াইগির (দেওগিরি) নামে প্রসিদ্ধ দূর্গ।
দৌলতআবাদে সুলতানের শিক্ষক প্রসিদ্ধ খান কুলু খান বাস করেন। তিনি এ শহরের শাসনকর্তা এবং সাগার, তিলিং (তেলিঙানা) প্রভৃতি অঞ্চলের রাজপ্রতিনিধি। এ জনবহুল প্রদেশটি তিন মাসের পথ অবধি বিস্তৃত এবং এর সবটাই খান ও তাঁর সহকারীদের কর্তৃত্বাধীনে পরিচালিত। উপরোল্লিখিত দুয়াইগির দূর্গ সমতলভূমি বেষ্টিত একটি টিলা। টিলার খননকার্য চালিয়ে চূড়ান্ত এ দূর্গ নির্মান করা হয়েছে। চামড়া দিয়ে তৈরী মইয়ের সাহায্যে সেখানে পৌঁছতে হয়। রাত্রে এ মইটি সরিয়ে উপরে তুলে রাখা হয়। সাঘাতিক অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদীদের এখানকার কারাগারে বন্দী করা হয়। এ কারাগারে বিড়ালের চেয়েও বড় আকারের অনেক ইঁদুর আছে। বাস্তবিক পক্ষে সে ইঁদুর দেখে বিড়াল আত্মরক্ষার চেষ্টা না করে ভয়ে পালায়। শুধু ফাঁদ পেতে সে সব ইঁদুর ধরা যায়। আমি সে ইঁদুর দেখে সত্যিই বিস্মিত হয়েছি। দৌলত আবাদের অধিবাসীরা মারহাট্টাদের বংশধর। খোদা তাদের নারীদের বিশেষ করে নাসিকা ও ভুরুযুগল অত্যন্ত সুন্দর করে গঠন করেছেন। এ শহরের বিধর্মী অধিবাসীরা সবাই ব্যবসায়ী। তারা অত্যন্ত ধনবান এবং মনিমুভার ব্যবসায় করে। দৌলত আবাদে গায়ক ও গায়িকাদের অতি সুন্দর ও বিশাল একটি বাজার আছে। সেখানে বহু সংখ্যক দোকান। প্রত্যেক দোকানেই এমন একটি দরজা আছে যেখান দিয়ে এগিয়ে দোকানের মালীকের বাড়ী অবধি যাওয়া যায়। কার্পেট দিয়ে দোকানগুলো সুন্দর করে সাজানো, দোকানের মধ্যস্থলে বড় একটি দোলনার মতো বস্তু। সেখানে গায়িকা বসে বা শুয়ে থাকে। সব রকম অলঙ্কার দিয়ে তাকে সাজানো হয় এবং পরিচারকরা তার দোলনায় দোল দেয়। বাজারের মধ্যস্থলে কার্পেট মোড়া প্রকাণ্ড একটি সজ্জিত মঞ্চ। প্রতি বৃহস্পতিবার আসরের নামাজের পরে প্রধান বাদ্যকর এসে মঞ্চে বসেন। তার ভৃত্য ও ক্রীতদাসেরা বসে তার সামনে। তখন গায়িকারা একের পর আরেকজন এসে নাচ গান করতে থাকে। মগরেবের নামাজের সময় অবধি এমনি নাচ-গান চলে। তারপর তারা চলে যায়। সেই বাজারেই নামাজ পড়ার জন্য মসজিদও রয়েছে। ভারতের কোনো বিধর্মী শাসক এ বাজারের ভেতর দিয়ে গেলেই মঞ্চের কাছে নামতেন এবং গায়িকা বালিকারা এসে তার। সামনে নাচগান করতো। একজন মুসলমান সুলতানও তাই করতেন।
আমরা মাধুরবার (নাধুরবার) শহর অবধি চলে গেলাম। এ ছোট শহরটিতে মারহাট্টাদের বাস। তাদের অধিকাংশই দক্ষ শিল্পী। অনেকে চিকিৎসক অথবা জ্যোতিষী। মারহাট্টাদের মধ্যে যারা উচ্চবংশীয় তারা ব্রাহ্মণ ও কাটরী (ক্ষত্রিয়)। তাদের খাদ্য হলো চাউল, শাকসজি ও তিলের তৈল। জীবকে কষ্ট দেওয়া বা জীবহত্যা করা তারা পছন্দ করে না। তারা খাওয়ার আগে পুরোপুরি স্নান করে নেয়। অন্ততঃ ছয়। পুরুষ দূরের কোনো ভগ্নী সম্পৰ্কীয় ছাড়া কোনো আত্মীয়ের সঙ্গে এদের বিয়ে হতে পারে না। তারা কখনো মদ্যপান করে না। মদ্য পানকে সবচেয়ে বড় পাপ বলে মনে করে। ভারতের মুসলমানদেরও সেই মত। কোনো মুসলমান মদ্যপান করলে আশি চাবুক মেরে তাকে শাস্তি দেওয়া হয় এবং তিন মাসকাল তাকে এমন এক কারাগারে (Matamore) বন্দী করে রাখা হয় যার দরজা শুধু খাবার সময় হলে ভোলা হয়।
এ শহর থেকে আমরা শাখার (সগড়) এলাম। এ নামেরই (তাপ্তী) বড় একটি নদীর তীরে এ শহর। এখানকার বাসিন্দারা সৎ, ধার্মিক এবং বিশ্বস্ত।
তারপরে আমরা কিনবায়া (Cambay) শহরে এসে পৌঁছলাম। সমুদ্রের একটি অংশ নদীর মতো হয়ে এগিয়ে এসেছে। তার পরেই এ শহর। এখানে জাহাজ চলাচল করতে পারে এবং পানিতে জোয়ার ভাটা হয়। আমি নিজে দেখেছি, এখানে ভাটার সময় জাহাজ কাঁদায় ঠেকে থাকে এবং জোয়ারের সময় ভেসে যায়। এ শহরের গঠন প্রকৃতি এ মসজিদের ভাস্কর্যের জন্য এটি অন্যতম সুদৃশ্য শহর। এর কারণ, এখানকার অধিবাসীদের বেশীর ভাগই বিদেশী সওদাগর। তারা সর্বদাই চমৎকার এমারত ও সুন্দর মসজিদ তৈয়ার করে। এ কাজে তারা একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। এ শহর ত্যাগ করে আমরা কাওয়া এলাম। এ শহরটিও জোয়ার-ভাটা হয় এমন একটি উপসাগরের তীরে অবস্থিত। এটি জালানসি নামক বিধর্মী এক রাজার অধীনে। তার বিষয়ে পরে বলা হবে। তারপর আমরা উপসাগরের কুলে কান্দাহার নামক একটি বড় শহরে পৌঁছি। এ শহরের মালীক একজন বিধর্মী। কান্দাহারের বিধর্মী সুলতানের নামই জালানসি। তার রাজ্য মুসলিম রাজ্যেরই অন্তর্ভূক্ত বলে তিনি ভারতের বাদশাহকে প্রতি বছর উপঢৌকন১০ পাঠিয়ে থাকেন। আমরা কান্দাহার পৌঁছলে তিনি আমাদের প্রতি। সম্মান প্রদর্শন করেন এবং নিজে প্রাসাদ ছেড়ে দিয়ে আমাদের জায়গা করে দেন। খাজা বোহরার বংশধরেরা এবং তার দরবারের অন্যান্য গণমান্য মুসলমানরা আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন জাহাজের মালীক ইব্রাহিম। তার দু’খানা জাহাজ ছিল।
আমরা কান্দাহারে ইব্রাহিমের আল-জাগির নামক একটি জাহাজে আরোহণ করি। সুলতানের উপহারের সত্তরটি ঘোড়াও আমরা এ জাহাজে তুলি। আমাদের সঙ্গীদের ঘোড়ার সঙ্গে বাকি ঘোড়াগুলো তোলা হয় মানুর্ত’ নামে ইব্রাহিমের এক ভাইয়ের জাহাজে। জালানসি আমাদের একখানা জাহাজ দেন। সে জাহাজে জহিরউদ্দিন সানবুল ও তাদের দলের অন্যান্যের ঘোড় তোলা হয়। তিনি এ জাহাজে আমাদের জন্য পানি ও খাদ্য এবং পশুর জন্য খাদ্য দিয়ে যান। তিনি আল-উকারি নামক আরেকটি জাহাজে তার ছেলেকেও আমাদের সঙ্গে পাঠান। এ জাহাজখানা গ্যানি নামক ছোট পোতবিশেষ। শুধু সামান্য একটু বেশী চওড়া। এ জাহাজে দাঁড়ের সংখ্যা ষাটটি। যুদ্ধের সময় তীর বা পাথর যাতে না পড়তে পারে সেজন্য দাড়ীদের উপরে ছাদ বা ছৈ লাগানো আছে। আমি উঠেছিলাম আল-জাগির নামক জাহাজে। তাতে রয়েছে পঞ্চাশ জন দাড়ী এবং পঞ্চাশ জন অস্ত্রধারী হাসী। ভারত মহাসাগরের বুকে নিরাপত্তার জন্য হাবৃসীদের ব্যবস্থা। প্রতি জাহাজে এদের একজন থাকলেই ভারতীয় বোম্বেটে বা পৌত্তলিকদের কেউ ভয়ে কাছ ঘেসবে না। দুদিন পরে আমরা বইরাম১১ দ্বীপে পৌঁছলাম। তার পরের দিন গেলাম কুকা (কার্থিওয়ারের গগা) শহরে। এ শহরে কয়েকটি প্রসিদ্ধ বাজার আছে। তখন ভাটার সময় বলে আমাদের জাহাজ তীর থেকে চার মাইল দূরে নোঙ্গর করল। কিন্তু আমি কয়েকজন সঙ্গীসহ ছোট একটি নৌকায় তীরে। গিয়ে উঠলাম। কুকার সুলতান একজন পৌত্তলিক। তার নাম- ডানকুল। তিনি ভারতের বাদশার আনুগত্য বাহ্যত স্বীকার করলেও আসলে তিনি একজন বিদ্রোহী।এ শহর থেকে জাহাজে পাল খাঁটিয়ে তৃতীয় দিনে আমরা সান্দাবুর (গোয়া)১২ পৌঁছি। এখানে ত্রিশটি গ্রাম আছে। শহরটি একটি উপসাগর দ্বারা বেষ্টিত। ভাটার সময় এ উপসাগরের পানি মিষ্টি বলে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু জোয়ারের সময় লবনাক্ত ও তিক্ত। দ্বীপের মধ্যস্থলে দুটি শহর। তার একটির নির্মাতা বিধর্মীরা। মুসলিমরা এদেশ জয় করার পরে তারাই অপরটি নির্মাণ করে। আমরা এ দ্বীপের পাশ কাটিয়ে গিয়ে অপর একটি ক্ষুদ্র দ্বীপে নোঙ্গর করি। পরের দিন আমরা হিনাওর (হোনাভার, অনেরৈ) শহরে পৌঁছি। শহরটি বড় বড় জাহাজ চলাচলের যোগ্য একটি ক্ষুদ্র উপসাগরের তীরে অবস্থিত। পুষকাল’ বা বর্ষার সময় এ উপসাগরটি এমন ভয়াবহ আকার ধারণ করে যে চার মাস অবধি একমাত্র মৎস্য শিকারী ছাড়া অন্য কোন পোত যাতায়াত করতে পারে না। এ শহরের এবং উপকূলের সর্বত্র নারীরা শেলাই বিহীন কাপড় ছাড়া আর কিছুই ব্যবহার করে না। কাপড়ের এক প্রান্ত তারা কোমরে জড়ায় এবং অপর অংশ কাঁধের উপর দিয়ে মাথায় দেয়। তারা সুন্দরী এবং সতী। প্রত্যেকেই নিজ নিজ নাকে একটি আংটি ব্যবহার করে। তাদের একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, প্রত্যেকেই তারা কোরাণ কণ্ঠস্থ করে রেখেছে। শহরে আমি তেরটি বালিকা বিদ্যালয় ও তেইশটি বালকদের বিদ্যালয় দেখেছি। জিনিষ আর কোথাও দেখতে পাইনি। এখানকার অধিবাসীরা বিদেশের সঙ্গে জাহাজের সাহায্যে বাণিজ্য করে। চাষোপযোগী কোনো ভূমি এদের নেই। হিনাওরের শাসনকর্তা সুলতান জালালউদ্দিন একজন পরাক্রমশালী অতি উত্তম ব্যক্তি। তাঁর রাজ্য হারিয়াব নামক একজন বিধর্মী রাজার অধীনে। হারিয়ারের কথা আমরা পরে বলবো।
সুলতান জালালউদ্দিনের নৌ-শক্তির জন্য ভীত হয়ে মালাবারের অধিবাসীরা তাকে নির্দিষ্ট হারে বার্ষিক চাঁদা দেয়। ঘোড়সওয়ার ও পদাতিকসহ তার সৈন্যসংখ্যা প্রায় ছ’হাজার। আরেকবার আমি প্রায় এগার মাসকাল তার দরবারে কাটিয়েছিলাম আদৌ রুটী না-খেয়ে। কারণ, তাদের প্রধান খাদ্য ভাত। ভাত ছাড়া আর কিছুই না খেয়ে আমি আরও তিন বছর কাটিয়েছি মালদ্বীপে, সিংহলে, এবং করমণ্ডল ও মালাবার। উপকূলে। শেষ অবধি আমি পানির সঙ্গে ছাড়া ভাত গলাধকরণ করতে পারিনি। এবার আমরা সুলতানের সঙ্গে তিন দিন কাটালাম। তিনিই আমাদের আহার্য সরবরাহ করেছিলেন। তারপর আমরা তার কাছে বিদায় নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম।
তিনদিন পর আমরা মরিচের দেশ মালাবারে পৌঁছলাম। এ দেশটি সানদাবুর (Goa) থেকে কাউলাম (ত্রিভাঙ্কুরের কুইলন) অবধি উপকুলে বিস্তৃত দু’মাসের পথ। সারাটা পথই গাছের ছায়ায় ঢাকা। প্রত্যেক আধ-মাইল অন্তর একটি করে কাঠের নির্মিত ঘরে মুসলমান বা অমুসলমান নির্বিশেষে বসবার জন্য বেঞ্চ পাতা আছে। প্রত্যেক ঘরেই একটি করে পানির কুপ এবং একজন অমুসলমান পরিচারক রয়েছে। পথিক যদি অমুসলমান হয় তবে সে তাকে পাত্রে ঢেলে পানি দেয় কিন্তু মুসলমান পথিক। হলে তার অঞ্জলি ভরে পানি দেয়। যে পর্যন্ত তাকে থামতে না বলা হয় সে পর্যন্ত সে অঞ্জলিতে পানি ঢালতে থাকে। মালাবারের বিধর্মী বা অমুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত। রীতি এই যে, কোনো মুসলমান তাদের গৃহে প্রবেশ করতে পারবে না অথবা তাদের পাত্র হতে আহার করতে পারবে না। যদি কোনো মুসলমান তা করে তবে সে পাত্র তারা। ভেঙ্গে ফেলে অথবা সেই মুসলমানকে দিয়ে দেয়। যেখানে অন্য কোনো মুসলমান। অধিবাসী নেই সেখানে মুসলমানকে খেতে দেওয়া হয় কলার পাতায়। এ পথের প্রত্যেক বিরতি স্থানেই মুসলমানদের ঘরবাড়ী আছে। মুসলমান পথিক সেখানে নেমে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র কিনতে পারে। তাদের ঘরবাড়ী না থাকলে মুসলমানরা এ পথে সফর করতে পারতো না।
পদব্রজে যে পথ অতিক্রম করতে দু’মাস লাগে তার কোথাও এক ফুট জায়গা এখানে অনাবাদী পড়ে নেই। প্রত্যেক অধিবাসীরই নিজ-নিজ ফলের বাগান আছে। বাগানের মধ্যস্থলে কাঠের বেড়ায় ঘেরাও করা বাড়ী। বাগানের ভেতর দিয়ে পথ চলে গেছে। সে পথ বেড়ার কাছে এলেই একটি সিঁড়ি দিয়ে উঠে যেতে হয়, আরেকটি সিঁড়ি দিয়ে নেমে পরবর্তী বাগানে যেতে হয়। এখানে কেউই কোনো জানোয়ারের পিঠে আরোহণ করে না। শুধু সুলতানের নিজের ঘোড়া রয়েছে। এখানকার অধিবাসীদের প্রধান বাহন পাল্কী। ক্রীতদাস বা ভাড়া করা বাহকেরা পান্ধী কাঁধে বহন করে নিয়ে যায়। যারা পাল্কীতে উঠতে নারাজ তাদের জন্য পায়ে হাঁটা ছাড়া অন্য কোনো প্রকার বাহন নেই। মালপত্র ও পণ্যদ্রব্য ভাড়া করা লোকেরা বহন করে। একজন সওদাগর হয়তো তার মালপত্র অন্যত্র নিয়ে যেতে একশ’ বা ঐ রকম সংখ্যক লোককে ভাড়া করে। এ পথটির চেয়ে নিরাপদ পথ আমি আর কোথাও দেখিনি। কারণ, সামান্য একটি বাদাম চুরি করলেও এখানে চোরকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। গাছের একটি ফল পড়লে মালিক ব্যতীত তা অপর কেউ স্পর্শও করে না। বাস্তবিক পক্ষে আমরা সময়-সময় এ পথে চলতে অনেক বিধর্মীর দেখা পেয়েছি। তারা আমাদের পথ ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়িয়েছে। তাদের কাছে মুসলমানরা অত্যন্ত সম্মানের পাত্র। শুধুমাত্র, আগেই যা। বলেছি, তারা মুসলমানদের গৃহে ঢুকতে দেয় না অথবা নিজেদের পাত্রে তাদের খেতে দেয় না। মালাবার ভূমিতে বারজন বিধর্মী সুলতান আছেন। তাদের মধ্যে কারো কারো সৈন্যবল পঞ্চাশ হাজার। আবার অনেকের মাত্র তিন হাজার সৈন্যও আছে। কিন্তু তবু তাদের ভেতরে কোন রকম গরমিল নেই এবং সবল কখনো দুর্বলের রাজ্য গ্রাস করে না। প্রত্যেক শাসনকর্তার রাজ্যের সীমান্তে একটি করে কাষ্ঠ-নির্মিত প্রবেশদ্বার আছে। সেখান থেকে কার রাজত্ব আরম্ভ সে কথা খোদাই করে প্রবেশদ্বারে লেখা আছে। একে বলা হয় অমুক রাজার নিরাপত্তার দ্বার। যদি কোনো মুসলমান বা বিধর্মী অপরাধী এক। রাজার রাজ্য থেকে অপর কোনো রাজ্যে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে তবে তার জীবন তখন নিরাপদ। যে রাজ্য থেকে সে পালিয়ে এসেছে সে রাজ্যের রাজা যদি পরাক্রমশালীও হন তবু তিনি আর আসামীকে ধরে নিতে পারেন না। এখানকার শাসনকর্তাগণ নিজেদের রাজ্যতার সন্তানদের না দিয়ে ভগ্নীর সন্তানদের উপর দিয়ে থাকেন। এ রীতি আমি একমাত্র আচ্ছাদিত মস্তক (veiled) মাসুকাদের ব্যতীত আর কোথাও প্রচলিত দেখিনি,তাদের বিষয়ে পরে উল্লেখ আছে।
মালাবারের যে শহরে আমরা প্রথম প্রবেশ করি তার নাম আবুসারার (বার্সেলোর)-বড় একটি জলাশয়ের পাড়ে বহু নারিকেল গাছ পরিবেষ্টিত ক্ষুদ্র একটি জায়গা। সেখান থেকে দু’দিন চলে আমরা এলাম ফাঁকানুর (বাকানর, বর্তমানে বারকার)১৩ নামে জলাশয়ের পাড়ে আরেকটি বড় শহরে।এখানে অনেক ইক্ষু পাওয়া যায়। দেশের অপর কোথাও এ জিনিসের প্রাচুর্য নেই। ফাঁকানুরের মুসলমান সমাজের প্রধান ব্যক্তিকে বলা হয় বাসাডাও (Basadaw), তার প্রায় ত্রিশটি যুদ্ধ জাহাজ আছে। তার সবগুলোই লুলা নামক একজন মুসলমানের পরিচালনাধীনে। সে একজন বোম্বেটে, দুষ্কৃতিকারী ও ডাকাত। আমরা সেখানে গিয়ে নোঙ্গর করতেই সুলতান তার পুত্রকে প্রতিভূ হিসেবে আমাদের জাহাজে থাকতে পাঠালেন। আমরা তীরে নেমে তার কাছে গেলে তিনি অত্যন্ত সমাদরের সঙ্গে তিন রাত্রি অবধি আমাদের মেহমানদারী করেন। ভারতের বাদশার প্রতি সম্মানার্থে। তা ছাড়া আমাদের জাহাজের লোক-লস্করের সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্য করে কিছু লাভবান হবার ইচ্ছাও তাঁর ছিল। তাদের একটি রীতি এই যে, শহরের পাশ দিয়ে কোনো জাহাজ গেলেই সেখানে নোঙ্গর করতে হবে এবং শাসনকর্তাকে কিছু উপঢৌকন দিতে হবে। তারা একে ‘বন্দরের অধিকার’ বলে। যদি কেউ এ প্রথা অমান্য করে চলে যায় তাকে এরা তার পশ্চাদ্ধাবন করে বল প্রয়োগে তাকে ফিরিয়ে আনে এবং দ্বিগুণ কর ধার্য করে যতদিন খুশী তাকে সেখানে আটক রাখে। ফাঁকানুর ছেড়ে তিনদিন পর আমরা মাঞ্জারুর (Mangalore) পৌঁছি। আদ-দাম্ব নামক দেশের বৃহত্তম ঋড়ির পারে এ শহরটি অবস্থিত। ফার্স এবং ইয়েমেনের অধিকাংশ সওদাগর এ শহরে এসে অবতরণ করে। এখানে প্রচুর মরিচ ও আদা পাওয়া যায়। মাঞ্জারুরের শাসনকর্তা দেশের প্রসিদ্ধ শাসনকর্তাদের অন্যতম। তার নাম রামাডৌ। এখানে প্রায় চার হাজার মুসলমানের একটি উপনিবেশ আছে। শহরের একটি উপকণ্ঠে তারা বসবাস করে। অনেক সময় তাদের সঙ্গে শহরবাসীদের বিরোধ বাধে কিন্তু সুলতান তখন তাদের মধ্যে শান্তি-স্থাপন করেন, কারণ সওদাগরদের প্রয়োজনীয়তা তিনি অস্বীকার করতে পারেন না। পূর্ববর্তী সুলতানের মতো এ সুলতান তাঁর পুত্রকে জাহাজে না-পাঠালে আমরা তীরে অবতরণ করতে অস্বীকার করি। অতঃপর তার পুত্রকে তিনি জাহাজে পাঠালে আমরা তীরে যাই। তিনি আমাদের বিশেষ সমাদর করেন।
মাঞ্জারে তিন দিন কাটিয়ে আমরা আবার পাল তুলে দিলাম হিলি১৪ যাবার উদ্দেশ্যে। দু’দিন লাগলো হিলি পৌঁছতে। বড় বড় জাহাজ চলাচলের উপযোগী একটি প্রশস্ত খাড়ির পাড়ে এ শহরটি। চীন থেকে যে সব বন্দরে জাহাজ আসে তার ভেতর এ শহরটিই সবচেয়ে বেশী দূরে। চীনের জাহাজ শুধু এ বন্দরে, কাওলামে এবং কালিকটে আসে। এখানকার প্রধান মসজিদটির জন্য মুসলিম ও বিধর্মী সবাই এ শহরটিকে একটু শ্রদ্ধার চোখে দেখে এবং সমুদ্রগামীরা মসজিদের নামে বহু মানত করে। এ মসজিদে কিছু সংখ্যক ছাত্র বাস করে। তারা মসজিদের আয় থেকে বৃত্তি পেয়ে থাকে। এ ছাড়া মসজিদের একটি লঙ্গরখানা থেকে মুসাফের এবং গরীব মুসলমানদের আহার্য দেওয়া হয়। সেখান থেকে জারফাটান (Cannanore) দাহফাট্টান এবং বাদফাট্টান যাই। এ শহর ক’টির সুলতানকে কুওয়াল (Kuwal) বলা হয়। তিনি মালাবারের শক্তিশালী সুলতানদের অন্যতম। দাহ্ফাটানে কুওয়ালের পিতামহ কর্তৃক নির্মিত একটি bain ও একটি প্রসিদ্ধ মসজিদ আছে। কুয়ালের পিতামহ ইসলামে দীক্ষাগ্রহণ করে মুসলমান। হন। বাদফাটানের অধিবাসীদের অধিকাংশই ব্রাহ্মণ। বিধর্মীরা তাদের শ্রদ্ধা করে। ব্রাহ্মণরা মুসলমানদের ঘৃণা করে। সে কারণে এদের মধ্যে কোনো মুসলমান বসবাস করে না। বাদফাঠান থেকে জাহাজ ছেড়ে আমরা ফান্দারায়না (পারোনি) পৌঁছি। পারোনি বাজার ও ফলের বাগান সমৃদ্ধ একটি বড় শহর। এ শহরে তিন-চতুর্থাংশ মুসলমানরা দখল করেছে। প্রত্যেক অংশেই একটি করে মসজিদ আছে। এ বন্দরে এসেই চীন দেশী জাহাজ শীতকাল কাটায়। এখান থেকে আমরা মালাবারের অন্যতম। প্রসিদ্ধ বন্দর কালিকটে পৌঁছলাম। এখানকার পোতাশ্রয়টি পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ পোতাশ্রয়। সূদুর চীন, সুমাত্রা, সিংহল, মালদ্বীপ, ইয়েমেন ও ফার্স থেকে লোকজন এখানে যাতায়াত করে এবং নানা দিক থেকে সওদাগরেরা এখানে১৫ আসে।
কালিকটের সুলতান একজন বিধর্মী। তাকে বলা হয় “সামারী”। কোনো কোনো গ্রীকদের মতোই তিনি মুণ্ডিত একজন বৃদ্ধ। এ শহরেও মিদকাল নামক প্রসিদ্ধ একজন জাহাজের মালিক বাস করে। তার অনেক ধনরত্ন ও ভারত, চীন, ইয়েমেন ও ফার্সের সঙ্গে বাণিজ্য করবার জন্য অনেক জাহাজ রয়েছে। আমরা শহরে গিয়ে পৌঁছলে প্রধান প্রধান অধিবাসীরা ও সওদাগরেরা এবং সুলতানের প্রতিনিধিরা আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে এলেন। তাদের সঙ্গে ছিল জয়ঢাক, শিঙ্গা, বিউগল এবং জাহাজের মাথায় পতাকা। অপূর্ব জাকজমক সহকারে আমরা পোতাশ্রয়ে প্রবেশ করি। এ রকম জাঁকজমক এসব দেশের কোথাও দেখিনি। দুঃখ কষ্টের আগে এ জাঁকজমক আমাদের জন্য আনন্দদায়ক হয়েছে। আমরা কালিকট বন্দরে নোঙ্গর করে তীরে গেলাম। বন্দরে তখন তেরো খানা চীন দেশীয় জাহাজ নোঙ্গর করে আছে। আমাদের প্রত্যেককে একটি করে ঘর দেওয়া হলো থাকবার জন্য। চীন যাত্রার অনুকুল আবহাওয়ার অপেক্ষায়। আমরা সেখানে তিন মাস কাটালাম বিধর্মী সুলতানের মেহমান হিসাবে। চীন সমুদ্রে শুধু চীন দেশীয় জাহাজেই যাতায়াত সম্ভব। সে জন্য এখানে তাদের বর্ণনা দিচ্ছি।
চীনের জাহাজ তিন প্রকার। বড় জাহাজগুলোকে বলা হয় চঞ্চ, মাঝারী আকারের গুলো জাও (Dhows) আর ছোট গুলো কাকাম। বড় জাহাজে তিন থেকে বারোখানা অবধি পাল খাটান হয়। পাল তৈরী করা হয় বাঁশের চাটাই দিয়ে। সেগুলো কখনো নামিয়ে রাখা হয় না, বাতাসের গতি দেখে শুধু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। জাহাজ যখন নোঙ্গর করা থাকে তখনও পালগুলো খাটানো থাকে। একটি জাহাজে লোকলস্করের সংখ্যা থাকে হাজার। তাদের ছ’শ নাবিক আর বাকি সবাই সৈনিক। সৈনিকদের মধ্যে আছে তীরন্দাজ, ঢালধারী এবং তরল ধাতু নিক্ষেপকারী। প্রতিটি বড় জাহাজের সঙ্গে তিনটি ছোট জাহাজও থাকতো। তাদের একটি ‘অর্ধেকআরেকটি ‘এক-তৃতীয়াংশ অন্যটি এক-চতুর্থাংশ’১৬। এ সব জাহাজ তৈরী করা হতো শুধু জইতুন ও সিংকালান (ক্যান্টন) শহরে। জাহাজগুলো চারতলা বিশিষ্ট। তাতে রয়েছে কামরা, কেবিন, সওদাগরদের জন্য সেলুন। কেবিনেও খাস-কামরা, ও স্নানাগার রয়েছে। কেবিনের অধিকারী নিজের কেবিন তালাবদ্ধ করে রাখতে পারে। অনেক সময়। তারা ক্রীতদাসী অথবা নিজের স্ত্রী সঙ্গে রাখে। অনেক সময় এক-এক কেবিনের অধিবাসী হয়তো কোনো বন্দরে না পৌঁছা পর্যন্ত জাহাজের অপর যাত্রীদের কাছে অপরিচিতই থেকে যায়। নাবিকদের ছেলেমেয়েরা চৌবাচ্চায় তরি-তরকারী শাকশজী ফলায়। জাহাজে মালীকের প্রতিনিধির মর্যাদা একজন বড় আমীরের মতো। তিনি যখন তীরে যান, তার আগে-আগে যায় তীরন্দাজরা আর বর্শা, তলোয়ার, ঢাক, শিঙ্গা প্রভৃতিসহ আবিসিনিয়ার ভৃত্যেরা। তার গন্তব্য স্থানে যাবার পর সঙ্গীরা দরজার দু’পাশে বর্শা হাতে দাঁড়িয়ে থাকে। যতক্ষণ তিনি সেখানে অবস্থান করেন ততক্ষণ এরাও একই অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকে। চীনের কোনো-কোনো লোক একাই অনেকগুলো জাহাজের। মালীক। সে সব জাহাজ প্রতিনিধিদের দ্বারা বিদেশে পাঠানো হয়। চীনদের মতো ধনীলোক দুনিয়ার আর কোথাও নেই।
চীন যাত্রার অনুকুল মৌসুম যখন শুরু হলো, সুলতান সামারী কালিকট বন্দরের তেরখানা জাহাজের একটিকে আমাদের যাত্রার উপযোগী করে তুললেন। সে জাহাজ বা জাঙ্কে যিনি মালীকের প্রতিনিধি তার নাম সুলেমান। তিনি সিরিয়ার (প্যালেষ্টাইন) অন্তর্গত সাফাঁদের অধিবাসী। আমি আগে থেকেই তাকে চিনতাম। তাই তাকে বললাম আমি আমার ক্রীতদাসী বালিকাদের জন্য নিজে একটি কেবিন চাই, কারণ তাদের সঙ্গে না-নিয়ে আমি কখনো সফরে বের হই না।
তিনি বললেন, চীনের সওদাগররা সবগুলো কেবিন তাদের আসা ও যাবার জন্য ভাড়া করে রেখেছে। আমার জামাইয়ের একটি কেবিন আছে। সেটা আমি আপনাকে দিতে পারি কিন্তু সে কেবিনটির স্নানাগার নাই। সম্ভবত আপনি সেটা অন্য কোনো। কেবিনের সঙ্গে বদলী করে নিতে পারবেন।
আমি তখন আমার সঙ্গীদের মালপত্র জাহাজে উঠাতে বললাম। নারী পুরুষ। নির্বিশেষে ক্রীতদাসরাও জাহাজে গিয়ে উঠলো। সেটা ছিল বৃহস্পতিবার। কাজেই, আমি একদিন তীরেই রয়ে গেলাম পরের দিন জুমার নামাজে যোগ দেবে বলে। রাজা সাবুল ও জহিরউদ্দিন তাদের উপহার-সামগ্রীসহ জাহাজে উঠে বললো, যে কেবিন আমরা পেয়েছি সেটি ছোট এবং অনুপযোগী। আমি ক্যাপ্টেনের কাছে সে কথা বলায়, তিনি বললেন, এর কোনো প্রতিকারে, উপায় নেই। কিন্তু আপনি যদি কাকামে যেতে রাজী থাকেন তবে সেখানে আপনার পছন্দ মতো কেবিন পাওয়া যাবে। আমি তাতেই। রাজী হয়ে সঙ্গীদের মাল-পত্র ও ক্রীতদাস দাসীদের সহ কাকামে উঠতে বললাম। জুমার নামাজের আগেই আমাদের ওঠার কাজ শেষ হলো। এ সমুদ্রে একটা বিশেষ লক্ষণ হলো, প্রতিদিন বিকালেই ঝড় উঠবে। তখন কেউ জাহাজে উঠতে পারে না। জাঙ্কগুলো আগেই পাল তুলে রওয়ানা হয়েছে। শুধু দু’খানা জাঙ্ক তখনও রওয়ানা হয়নি। তার একখানায় ছিলো উপহার সামগ্রী আরেক বানার মালীক শীতকালটা ফান্দারায়নায় কাটাবে স্থির করেছে। এ ছাড়া ছিল কাকাম, যার কথা আগেই বলেছি। শুক্রবারের রাত। আমরা তীরেই কাটালাম। ঝড়ের জন্য আমরাও জাহাজে উঠতে পারিনি, জাহাজে যারা ছিলো তারাও নেমে এসে আমাদের সঙ্গে মিলতে পারেনি। একটি কার্পেট ছাড়া শুয়ে ঘুমাবার উপযোগী আর কিছুই আমার সঙ্গে ছিলো না। শনিবার ভোরে জাঙ্ক ও কাকাম। দু’টোই তীর থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। যে জাঙ্ক খানার ফান্দারায়না যাবার কথা। সেখানাও ডাঙ্গায় উঠে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। যারা জাঙ্কে ছিলো তাদের। অনেকে ডুবে মরেছে অনেকে অবশ্যি জীবন রক্ষা করেছে। সেই রাত্রেই সুলতানের উপহার দ্রব্যবাহী জাহাজ বানারও একই দুদর্শা ঘটলো এবং যারা আরোহী ছিলো তারা ডুবে মারা গেলো। পরের দিন ভোরে আমরা সানুবল ও জহিরউদ্দিনের লাশ পেলাম। যথারীতি জানাজা পড়ে আমরা তাদের সমাহিত করলাম। আমি কালিকটের বিধর্মী সুলতানের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি তখন প্রকাণ্ড একটা সাদা কাপড় কোমরে জড়িয়ে ছোট পাগড়ী মাথায় দিয়ে খালি পায়ে সমুদ্রের পাড়ে ছিলেন। একজন ক্রীতদাস তার। মাথায় ছাতা ধরে দাঁড়িয়ে ছিলো, তার সামনে আগুন জ্বেলে রাখা হয়েছে। সমুদ্র থেকে ঝড়ে যেসব জিনিষপত্র ডাঙ্গায় উঠেছে বহু লোকজন তা কুড়িয়ে নিচ্ছিল। সুলতানের পুলিশ তাদের মেরে তাড়াবার চেষ্টা করছিল। শুধু এখানে ছাড়া মালাবারের সর্বত্র ঝড়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত জাহাজের মালামাল সরকারী খাজাঞ্চীতে জমা হয়। কিন্তু কালিকটে মালীকেরাই মালামালের অধিকারি হয়। এ জন্যই কালিকট একটি সমৃদ্ধিশালী শহরে পরিণত হয়েছে এবং অনেক ব্যবসায়ীকে আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। জাঙ্কের কি। দুরবস্থা হয়েছে তা দেখতে পেয়ে কাকামে যারা ছিলো তারা পাল তুলে কাকাম নিয়ে রওয়ানা হয়ে চলে গেল। তার ফলে আমার জিনিষ পত্রসহ ক্রীতদাস দাসীও সেই সঙ্গে নিয়ে গেলো। শুধু একলা আমি সমুদ্রোপূকলে পড়ে রইলাম আজাদীপ্রাপ্ত আমার একজন ক্রীতদাসকে সঙ্গে নিয়ে। অবশেষে আমার এ অবস্থা দেখে সেও আমাকে ত্যাগ করে। গেলো। তখন আমার কাছে সম্বল মাত্র দশটি দীনার আর যে কার্পেটে ঘুমিয়ে ছিলাম সেটি।
আমি শুনেছিলাম, কাউলামে গিয়ে কাকাম ভিড়বে। কাজেই সেখানে যাবো বলে স্থির করলাম। সেখানে যেতে হেঁটে বা নদীপথে দশদিন লাগে। আমি নদীপথেই রওয়ানা হয়ে একজন মুসলমানকে ভার দিলাম আমার কার্পেটটি বয়ে নিতে। সেখানে নিয়ম হলো, বিকালে জাহাজ থেকে নেমে তীরবর্তী গ্রামে রাত কাটাতে হয়, ভোরে এসে আবার উঠতে হয় জাহাজে। আমরাও তাই করেছি। কার্পেট বহনের জন্য যে লোকটিকে আমি নিয়োগ করেছিলাম, সে ছাড়া জাহাজে আর কোনো মুসলমান নেই। আমরা যখন তীরে যেতাম তখন সে লোকটি বিধর্মীদের সঙ্গে মিশে মদ্যপান করতো এবং চেঁচামেচি করে আমাকে বিরক্ত করতো। তার ফলে আমার দুর্দশা চরমে উঠলো। আমাদের যাত্রার পঞ্চম দিনে আমরা একটি পাহাড়ের উপর কুঞ্জকারী নামক স্থানে পৌঁছলাম। এখানে য়িহুদিরা বাস করে। তাদের শাসনকর্তা নিজেদের মধ্যকার একজন যিহুদী। শুধু কাওলামের সুলতানকে তাদের কর দিতে হয়। এ নদীর তীরের সব গাছই দারুচিনির আর ব্রেজিল নামক রং তৈরীর গাছ। তারা সে সব গাছ জ্বালানী কাঠরূপে ব্যবহার করে। আমরাও রান্নার কাজে এ কাঠই ব্যবহার করেছি। দশম দিনে আমরা। এসে কাওলামে পৌঁছলাম। কালাম মালাবার১৮ অঞ্চলের একটি সুন্দর শহর। চমৎকার বাজার আছে এখানে। ব্যবসায়ীদের এখানে বলা হয় সুলি। তারা অত্যন্ত ধনবান। একজন ব্যবসায়ীই একটা জাহাজ মালপত্রসহ কিনে নিজের ঘরের মৌজুদ মাল দিয়ে বোঝাই করতে পারে। এখানে মুসলমান ব্যবসায়ীদের একটি উপনিবেশ আছে। খাজা মুহাজ্জাব নামক একজন ব্যবসায়ীর দ্বারা তৈরী প্রধান মসজিদটি অতি সুন্দর। মালাবারের এ শহরটি চীন থেকে সবচেয়ে নিকটবর্তী। এখানেই চীনের অধিকাংশ ব্যবসায়ীরা এসে হাজির হয়। এ শহরে মুসলমানদের যথেষ্ট সমাদর ও সম্মান আছে। কাওলামের সুলতান তিরাওয়ারী নামক একজন বিধর্মী। তিনি মুসলমানদের সম্মান করেন। চোর ও বদমায়েসদের বিরুদ্ধে তাঁর আইন খুব কঠোর। আমি কিছুদিন কালামের এক মুসাফেরখানায় কাটালাম, কিন্তু আমার কাকমের কোনো সন্ধান পেলাম না। আমি সেখানে থাকাকালেই চীনের রাজদূতেরাও আসেন। যে সব জাহাজ ধ্বংস হয়েছে তার একটিতে তারাও ছিলেন। চীনের ব্যবসায়ীরা তাদের জামা কাপড় দান করেন এবং তারা চীনে ফিরে যান। পরে চীনে এদের সঙ্গে আমার সাক্ষাত হয়।
প্রথমে আমি মনে করেছিলাম, কালাম থেকে সুলতানের কাছে ফিরে গিয়ে উপহার-সম্ভারের দুর্দশার কথা তাকে বলবো। কিন্তু পরে ভয় হলো, আমি যা করেছি তারজন্য তিনি আমাকেই দোষী করবেন বলে। তিনি হয়তো জিজ্ঞেস করবেন, আমি নিজে তার উপহার দ্রব্যের সঙ্গে রইনি কেননা। অবশেষে আমি স্থির করলাম, হিনাওরের সুলতান জামালউদ্দিনের কাছে যাবো এবং কাকামের খবর না পাওয়া অবধি সেখানেই কাটাবো। কাজেই আমি কালিকটে ফিরে এলাম এবং সেখানে এসে ভারত সুলতানের। একখানা জাহাজ পেয়ে তাতে চড়ে বসলাম। তখন সমুদ্রযাত্রার উপযোগী সময় শেষ হয়ে এসেছে। আমরা তখন দিনের প্রথমভাগ জাহাজ চালিয়ে পরের দিন অবধি নোঙ্গর করে কাটাতাম। পথে একে-একে চারটি যুদ্ধ জাহাজের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়। আমরা খুব ভয় পেয়েছিলাম কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা আমাদের কোনো অনিষ্ট করেনি। আমি হিনাওরে পৌঁছে সুলতানকে সালাম করলাম। তিনি আমাকে বাসস্থান দিলেন কিন্তু কোনো ভৃত্য সেখানে ছিলো না। তিনি আমাকে তার সঙ্গে নামাজ পড়তে বললেন। আমি অধিকাংশ সময় মসজিদে১৯ কাটাতাম প্রত্যহ কোরাণ শরিফ পাঠ করে। পরে দিনে দুবারও কোরাণ পাঠ করেছি।
সুলতান জামালউদ্দিন তখন সান্দাবুর গোয়া) অভিযানের জন্য বাহান্নখানা জাহাজ সজ্জিত করেছিলেন। সেখানকার সুলতান ও তাঁর পুত্রের মধ্যে বিবাদ আরম্ভ হয়। পুত্র সুলতান জামালউদ্দিনের পত্র লিখেন সান্দাবুর অভিযানের জন্য। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, সান্দাবুর অভিযান করলে তিনি ইসলাম গ্রহণ করবেন এবং জামালউদ্দিনের কন্যার পাণিগ্রহণ করবেন। জাহাজগুলো যখন যাত্রার জন্য তৈরী হয়েছে তখন আমারও এ জেহাদে যোগদানের ইচ্ছা হলো। কাজেই, কোনো দৈববাণী পাবার জন্য আমি কোরাণ খুলে প্রথমেই একটি পৃষ্ঠার মাথায় পেলাম, খোদার পথে যারা থাকে খোদা তাদের। সহায়তা করেন। এটি একটি উত্তম ভবিষ্যৎবাণী বলে আমার বিশ্বাস হলো। বিকালে সুলতান নামাজ পড়তে এলে বললাম, আমিও অভিযানে যোগ দিতে ইচ্ছা করি। তিনি বললেন, তাহলে তোমাকে তাদের অধিনায়ক করা হবে। আমি তখন আমার কোরাণের দৈববাণীর কথা তাঁকে খুলে বললাম। তিনি তাতে এতো খুশী হলেন যে, নিজেও অভিযানের সঙ্গে যেতে তৈরী হলেন, যদিও এর আগে তিনি যেতে নারাজ ছিলেন। এক শনিবার তিনি একটি জাহাজে গিয়ে উঠলেন। আমি তার সঙ্গেই রইলাম। সোমবার বিকালে আমরা সান্দাবুর পৌঁছি। সেখানকার অধিবাসীরা যুদ্ধের জন্য তৈরীই ছিলো। কাজেই, ভোরের দিকে আমাদের জাহাজ তাদের দিকে অগ্রসর হতেই তারা জাহাজ। লক্ষ্য করে কামানের সাহায্যে পাথর ছুঁড়তে লাগলো। জাহাজে যারা ছিলো তারা তখন। ঢাল ও তলোয়ার হাতে নিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো। আমিও তাদের সঙ্গেই ঝাঁপ দিলাম। খোদা মুসলমানদের বিজয়ী করলেন। আমরা তরবারী হস্তে শহরে প্রবেশ করলাম। অধিবাসীদের বেশীর ভাগ তখন তাদের সুলতানের প্রাসাদে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করলো। কিন্তু আমরা যখন প্রাসাদ লক্ষ্য করে অগ্নি নিক্ষেপ করলাম তখন তারা বেরিয়ে আসতে লাগলো। এসে আমাদের হাতে ধরা দিলো। অতঃপর সুলতান তাদের মুক্তি। দিলেন এবং তাদের স্ত্রীপুত্রদের তাদের সঙ্গে মিলতে দিলেন। তারা সংখ্যায় ছিলো প্রায় দশ হাজার। সুলতান শহরের একটি উপকণ্ঠে তাদের বাসস্থান করে দিলেন এবং নিজে গিয়ে প্রাসাদ দখল করলেন। তার সভাসদরা রইলেন প্রাসাদের চারদিক ঘিরে।
শহর অধিকারের পর তিন মাস সান্দাবুরে কাটিয়ে আমি পুনরায় আমার যাত্রা শুরু করবার অনুমতি চাইলাম সুলতানের কাছে। তিনি তখন পুনরায় তার কাছে যাবার জন্য। আমাকে ওয়াদা করালেন। কাজেই আমি প্রথমে হিনাওর এলাম। সেখানে থেকে মাঞ্জারুর ও আগের মতোই অন্যান্য শহর হয়ে কালিকটে পৌঁছলাম। কালিকট থেকে গেলাম সুদৃশ্য শহর আস-সালিয়াটে। এখানে আস-সালিয়াট নামে পরিচিত একরকম কাপড় তৈরী২০ হয়। বহুদিন এ শহরে কাটিয়ে আবার আমি কালিকটে ফিরে এলাম। তখন আমার দু’জন ক্রীতদাস ফিরে আসে। তারাও আমার কাকামে ছিলো। তাদের কাছে জানতে পারলাম, সুমাত্রার শাসনকর্তা আমার ক্রীতদাসী বালিকাদের নিয়ে গেছেন। জিনিষপত্রও নানাজনে আত্মসাৎ করেছে এবং সঙ্গীরা চীন, সুমাত্রা ও বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এ কথা শুনে আমি হিনাওর ও সান্দাবুরে ফিরে এলাম পাঁচ মাস বাইরে থেকে। সেখানে তিন মাস কাটালাম।
***
টিকা
পরিচ্ছেদ ৭
১। ইউল বলেছেন এটা রোহিলাখণ্ডের সামবাল-দিল্লী আশী মাইল খানিক পূর্বে অবস্থিত (ক্যাথে, ৪র্থ খণ্ড, ১৮)।
২। জালালী একটি ক্ষুদ্র স্থান-আলিগড়ের ১১ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে। দিল্লীর একশত মাইলের মধ্যে দেশের অবস্থা এতখানি অরাজক ছিল যাতে করে সুলতান মুহাম্মদের সাম্রাজ্যের চেহারাটা বেশ বোঝা যায়।
৩। মাওরি সম্ভবতঃ ভিরে নিকটবর্তী উমরী। মার জায়গাটা অজ্ঞাত। কিন্তু গোয়ালিয়রের পূর্বে অবস্থিত।
৪।গোয়ালিয়রের দক্ষিণ-পূর্বে কিছু মাইল দূরে আলাপুরের একটি গ্রাম রয়েছে। জাবিল সম্ভবতঃ ঢোলপুরের রাজা বিধর্মী সুলতান এবং চাষাল নদীর মতো একই নাম।
৫। পারওয়ান নিশ্চিতরূপেই গোয়ালিয়র রাজ্যের নারওয়ার (ইব্নে বতুতা অন্য জায়গার। ন্যায় এখানেও একটি অজানা নামকে অধিক পরিচিত নামে অভিহিত করছেন, যথা আফগানিস্তানের পারওয়ান)-ইণ্ডিয়ান গেজেট অনুসারে এটা এক কালে দিল্পী এবং দাক্ষিণ্যাতের মাঝখানে পথের উপর একটি বর্ধিষ্ণু শহর ছিল।” আধুনিক মানচিত্রে পারওয়াই নামে একটি স্থান দেখা যায়। স্থানটি নারওয়ার ২৫ মাইল উত্তর-পূর্বে, এবং গোয়ালিয়রের ৩০ মাইল দক্ষিণে।
কাজারা নিঃসন্দেহে খাজুরাহো, ছত্তরপুরের ২৭ মাইল পূর্বে এবং পান্নার ২৫ মাইল উত্তর– পশ্চিমে-এখানে পৌঁছাবার ঘুর পথ সত্ত্বেও। ইনে বতুতা স্থানটির অবস্থানের যে বিবরণ দিয়েছেন সেটা স্যার আলেকজাণ্ডার কানিংহামের রিপোর্টের সঙ্গে সম্পূর্ণ মিলে যায়। (আর্কিওলজিকাল সার্ভে অব্ ইণ্ডিয়া ১৮৬২-৫, দ্বিতীয় খণ্ড, ৪১২-৪৩৯ পৃঃ)।
৬। এটা যদি মালওয়ান ধার হয়, তাহলে এ উজ্জয়িনীর পরে আসবে।
৭। দেওগিরির দূর্গ সম্বন্ধে ইণ্ডিয়ান গেজেটিয়ারে নিম্নলিখিত বিবরণ দেওয়া হয়েছে, “একটি মোচাকৃতি শিলার উপরে দূর্গটি নির্মিত হয়েছে- ভিত্তি থেকে ১৫০ ফিট এর উঁচু-ঢাল। যে পাহাড়ের উপর এটা অবস্থিত সেটা সমতলভূমি থেকে খাড়াভাবে ৬০০ ফিট উঁচু। মুসলিমগণ এ স্থানটি ১২৯৪ খ্রীষ্টাব্দে প্রথম দখল করেন এবং সুলতান মুহাম্মদ ইব্নে তুগলক দক্ষিণ ভারত আক্রমণ চালাবার ঘাটিরূপে স্থানটির গুরুত্ব বিবেচনা করে এটাকে দৌলতাবাদ নাম দেন এবং এখানে রাজধানী স্থাপনের পরিকল্পনা করেন। তার মৃত্যুর পূর্বে একজন বিদ্রোহী শাসক এ স্থানটি অধিকার করেন এবং আকবরের রাজত্বকাল পর্যন্ত এটা দিল্লীর অধীনতামুক্ত ছিল।
৮। ক্যামূবে উপসাগরের মাথায় অবস্থিত ক্যাবে এ সময়ে ভারতের অন্যতম প্রধান সমুদ্র বন্দর ছিল। উপসাগরটি পানি পড়ে ভরে যাওয়ায় এবং বন্যার আক্রমণ প্রবল হওয়ায় বন্দরটির অবনতি ঘটে এবং বর্তমানে এটা কেবল ছোট জাহাজের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
৯। কাওয়া একটি ক্ষুদ্র স্থান। ক্যামবে থেকে উপসাগরের বিপরীত দিকে অবস্থিত।
১০। কান্দাহার নিশ্চয়ই গান্ধারের আরবী রূপান্তর। মধ্যযুগে জাহাজীদের নিকট গান্দার বলে পরিচিত ছিল। এটা অবস্থিত ছিল ছোটো নদী ধান্দারের মোহনার তীরে কাওয়া থেকে দক্ষিণে অল্প দূরে।
জালানসি নামটা সম্ভবতঃ রাজপুত ঝালাস উপজাতির প্রতিরূপ। কাথিয়াওয়ার অন্তর্গত ঝালাওয়ার কিম্বা গোহেলওয়ার নামে এটা এখনো রক্ষিত হয়ে আসছে।
১১। ক্যাবে উপসাগরের মুখের নিকট ক্ষুদ্র দ্বীপ-এ সময়ের কিছু পূর্বে পর্যন্ত এটা ছিল সমুদ্র-দস্যুদের ঘাঁটি যখন মুসলিমগণ এটা অধিকার করেন এবং ছেড়ে চলে যান।
১২। স্যাণ্ডাবুর কিম্বা সিণ্ডাবুর নামে দ্বীপটি এবং গোয়া উপসাগর প্রথম দিকে মুসলিম সওদাগরদের নিকট পরিচিত ছিল এবং ইউরোপীয় সওদাগরগণ এটা তাদের নিকট থেকে গ্রহণ করেছিল। মোল শতাব্দীর আগে পর্যন্ত পুরাতন নাম গোয়া প্রচলিত হয় নাই। প্রথম মুসলিমগণ এটা দখল করেন ১৩১২ খ্রীষ্টাব্দে এবং পরবর্তীকালে এটা একাধিকবার এবং পুনঃ অধিকার করেছেন।
১৩। এ সব মধ্যযুগীয় বন্দরের অনেকগুলি অস্তিত্বই এখন আর বর্তমান নেই। এ সম্বন্ধে ইউল তার ক্যাথে, ৪র্থ খণ্ড, ৭২-৭৯ পৃষ্ঠায় আলোচনা করেছেন।
১৪। এই ইলি বা এলি রাজত্ব মাউন্ট ডেলীতে তার চিহ্ন রেখে গিয়েছে। মধ্যযুগীয় বন্দরটি সম্ভবতঃ এখন নিলেশ্বর গ্রামের দ্বারা প্রদর্শিত হচ্ছে। শৈলাস্তরীণ থেকে এটা কিছু মাইল উত্তর।
১৫। কালিকুটনে ইব্নে বতুতা পৃথিবীর অন্যতম প্রধান সমুদ্র বন্দরের পর্যায়ভূক্ত করেছেন। ষোলো শতাব্দীতে পর্তুগীজ বাণিজ্য ঘাঁটি স্থাপিত হওয়ার পর বন্দরটির দ্রুত অবনতি ঘটে। এখানকার শাসকের পদবিকে ইব্নে বতুতা সামারি বলেছেন (এটা মুসলিম কর্ণে বিদেশী নামে যোগ্য রূপান্তর। সামারিটানদের কাল্পনিক পূর্ব পুরুষরূপে ধর্মতান্ত্রিকদের কাছে সামারি নামটি পরিচিত)। সামারি হচ্ছে মালয়ালাম শব্দ সাটিরি বা সামারি মানে “সমুদ্র রাজা”। ইউরোপীয় পাঠকদের কাছে এর পর্তুগীজ রূপান্তর জ্যামূরিণ অধিক পরিচিত।
১৬। এ সবের উদ্দেশ্য ছিল শান্ত আবহাওয়ায় গুন টেনে নৌকা চালানো। এ কথা ইনে বতুতা নিম্নে বর্ণনা করেছেন।
১৭। কালিকুট এবং কুইলনের মাঝখানের দুরত্বের যদিও কিছুটা অংশ আভ্যন্তরিক জলপথে ভেদ করা যায় তথাপি সমস্ত পথ জলপথে যাওয়া যায় বলে মনে হয় না। এখানে ইব্নে। বতুতা তার চীন ভ্রমণ বৃত্তান্তের ন্যায় স্থলপথের বিবরণ অবহেলা করেছেন।
১৮। কুইলনকে ইব্নে বতুতা কালিকুটের পর্যায়ভুক্ত করেছেন। এটা অনেক আগে থেকে চীন বাণিজ্যের মাল প্রেরণের বন্দর ছিল। নবম শতাব্দীর আরব এবং পার্শিয়ান জাহাজীগণ এটা কালাম-মালয় বলতো। এর প্রতিযোগী কালিকুটের ন্যায় এ বন্দরটিরও অবনতি ঘটে যোব শতাব্দীতে। ইউল বলছেন ইব্নে বতুতা বর্ণিত এর শাসকদের তিরাওয়ারী পদবী তামিল সংস্কৃতের মিশ্রন তিৰু-পাতি “পবিত্র দেবতা” হয়ে থাকবে। (ক্যাথে, চতুর্থ খণ্ড, ৪০)।
১৯। “ইব্নে বতুতা সব সময় বিড়ম্বিত হয়েছে-এটা তারই লক্ষণ।” (ইউল)।
২০। শালিয়াত হচ্ছে পর্তুগীজ চিলিয়েত বা চেলি, এখন ভেপুর কালিকুটের সাড়ে ছ’মাইল দক্ষিণে। এখানে সে সব বস্ত্র তৈরী হতো সেগুলি ছিল বিভিন্ন রকমের- এখনো নরম সৃতিবস্ত্রকে পালী বলা হয়। সেটা সম্ভব যে এই শহরের নাম এসেছে ফ্রেঞ্চ চেলী থেকে-এবং এর থেকে উদ্ভব হয়েছে আমাদের শাল শব্দটি।