০৭. উচিত থেকেও উচিত শিক্ষা

০৭. উচিত থেকেও উচিত শিক্ষা

রাজ্জাক স্যারের মারের দাগটা লাল হয়ে ফুলে গিয়েছিল, নানির চোখ থেকে আড়াল রাখার জন্য রাশাকে কয়েকদিন খুব সাবধান থাকতে হলো। নানি অবশ্যি কোনো কিছুকেই খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখেন না, তাই তার চোখে পড়লেও ব্যাপারটা ধরতে পারতেন বলে মনে হয় না। রাশা তবু কোনো ঝুঁকি নিল না। নানি যদি জিজ্ঞেস করতেন তাহলে তাকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলতেই হতো–রাশা কিছুতেই সেটা করতে চাচ্ছিল না।

রাজ্জাক স্যারের মারের ঘটনার পর তার ক্লাসের সবাই তাকে একটু অন্যচোখে দেখে, কিন্তু একটা ছেলের ব্যবহারের মাঝে একটা বড় পরিবর্তন দেখা গেল। লাজুক ধরনের ছেলে, নাম রতন, প্রথম দিনেই তাকে জিজ্ঞেস করে নিয়েছে সে স্কুল ছেড়ে চলে যাবে কিনা। রাশা লক্ষ করল, রতন ছেলেটা সবসময়েই তার আশেপাশে থাকছে, মনে হয় তাকে কিছু বলার চেষ্টা করছে। রাশা একসময় তাকে জিজ্ঞেস করে ফেলল, “তুই কি আমাকে কিছু বলবি?”

রতন আশেপাশে তাকাল তারপর গলা নামিয়ে বলল, “হ্যাঁ।”

“কী বলবি? বল।”

“এখানে তো বলতে পারব না।”

“কেন?”

“অন্যেরা শুনে ফেলবে।” রাশা অবাক হয়ে বলল, “শুনে ফেললে কী হবে?” রতন মাথা নাড়ল, বলল, “না অন্যদের শোনানো যাবে না।”

“তাহলে কখন বলবি?”

“তুই যখন বাড়ি যাবি, তখন বলব। রাস্তায়।”

“ঠিক আছে।”

.

সেদিন বিকেলবেলা রাশ যখন জয়নব, জিতু আর মতি অন্যদের নিয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ি যাচ্ছে তখন একটা নিরিবিলি জায়গায় হঠাৎ করে কোথা থেকে জানি রতন এসে হাজির হলো। সে এদিক-সেদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে ডাকল, “এই রাশা শোন।”

রাশা দাঁড়িয়ে গেল, সাথে সাথে জয়নব, জিতু, মতি আর অন্যরাও। রতন রহস্যময় একটা ভঙ্গি করে বলল, “শুধু তুই। অন্যদের চলে যেতে বল।”

রাশা বলল, “চলে গেলে হবে কেমন করে? ওরা অপেক্ষা করুক।”

“ঠিক আছে। কিন্ত্র অনেক দূরে অপেক্ষা করতে হবে।” রাশা জয়নবকে বলল, “তোরা হেঁটে ঐ ব্রিজটার ওপর অপেক্ষা করো, আমি রতনের সাথে কথা বলে আসছি।”

জয়নব খুব সন্দেহের চোখে একবার রতনকে আরেকবার রাশাকে দেখল, তারপর হেঁটে হেঁটে সামনে এগিয়ে গেল।

রাশা রতনের দিকে তাকিয়ে বলল, “বল কী বলবি।”

“কাউকে বলবি না তো?”

“না শুনে কেমন করে বলি?” রাশা একটু অধৈর্য হয়ে বলল, “আগে বল! শুনি কথাটা কী!”

“আমার এক মামা লন্ডনে থাকে।”

রাশা অবাক হয়ে রতনের দিকে তাকাল, তার মামা লন্ডনে থাকে সেটা বলার জন্যে এত গোপনীয়তা কেন?

“সেই মামা বাড়ি এসেছে। মামার তিন-চারটা মোবাইল ফোন।”

রাশা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে কখন মামার গল্প শেষ হয়ে আসল গল্প শুরু হবে। রতন বলল, “আমি মামাকে বললাম, মামা আমাকে একটা মোবাইল ফোন দিবে? মামা বলল, তুই বাচ্চা ছেলে মোবাইল ফোন দিয়ে কী করবি। আগে বড় হ তখন তোরে একটা মোবাইল ফোন কিনে দিব।”

রতন এইটুকু বলে রাশার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকাল, রাশ ঠিক বুঝতে পারল না সে কী বলবে, রাশার সন্দেই হাতে থাকে রতনের মাথায় হয়তো একটু ছিট আছে, সে তাকে শেষ পর্যন্ত মোবাইল ফোনের গল্পই শোনাতে থাকবে। হলোও তাই, রতন বলল, “আমি তখন বললাম, মামা তোমার যে মোবাইল দিয়ে ছবি তোলা যায় সেইটা দিবা? কয়টা ছবি তুলি। মামী বলল, হারাবি না তো? অনেক দামি মোবাইল। আমি বললাম, না মামা হারাব না।”

রতন আবার থামল, রাশার দিকে তাকাল, মনে হলো সে আশা করছে বাশা এখন কিছু একটা বলবে। রাশা কিছু বলল না, অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল কখন গল্পটা শেষ হবে। রতনের গল্প শেষ করতে কোনো তাড়া নেই, সে বলল, “মামার মোবাইল অনেক দামি, ফটো তুলতে পারে, ভিডিও করতে পারে। আমি অনেক ফটো তুলেছি, ভিডিও তুলেছি।”

রাশা আর পারল না, বলল, “বেশ করেছিস! আরো ফটো তোল, আরো ভিডিও কর। এখন আমি যাই।”

“শোন না কী করেছি। একদিন আমি মামার মোবাইলটা স্কুলে নিয়ে আসছিলাম, কাউকে বলি নাই। পোলাপান যা বদ, নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করবে। বলবে আমার ছবি তোল, আমার ছবি তোল। শেষে হাত থেকে পড়ে ভেঙে যাবে। সেই জন্যে কাউকে দেখাই নাই।”

রাশা অধৈর্য হয়ে বলল, “রতন! আমার বাড়ি অনেক দূর। যেতে অনেকক্ষণ লাগবে। তোর মোবাইলের গল্প আজকে এইখানে শেষ কর, বাকিটা কালকে শুনব। এখন আমি যাব।”

রতনের মনে হলো একটু মন খারাপ হলো, বলল, “চলে যাবি?”

“হ্যাঁ।“

“আমি স্কুলে যে ভিডিও করেছি সেটা একটু দেখবি না?”

“কালকে দেখব।”

“একটু দেখ। বলে রতন তার পকেট থেকে একটা দামি মোবাইল বের করে টেপাটেপি করতে থাকে, হঠাৎ মোবাইলের ভেতর থেকে একজন মানুষের ক্রুদ্ধ গর্জন ভেসে আসে। রাশা কৌতূহলী হয়ে মোবাইলটার দিকে তাকায়, রাজ্জাক স্যার হাতে বেত নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন, একজনকে পেটাতে পেটাতে শুইয়ে ফেলেছেন। হঠাৎ করে রাশা তার তীক্ষ্ণ গলার চিৎকার শুনতে পেল, “স্যার!”

রাশা চোখ কপালে তুলে বলল, “তুই পুরোটা ভিডিও করেছিস?”

রতন গম্ভীর মুখে বলল, “পুরোটা। একেবারে ফার্স্ট ক্লাস ভিডিও। কেউ টের পায় নাই!”

“দেখি দেখি—”

রতন তার হাতে মোবাইলটা দেয়, সেখানে দেখা গেল রাজ্জাক স্যার হিংস্র মুখে এগিয়ে যাচ্ছেন, রাশার সাথে দুই-একটা কথা তারপর শপাং করে হাতের মাঝে বেত এসে পড়ল। রাশা দৃশ্যটি দেখতে পারে না; একধরনের আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে ফেলে। মোবাইলের ভেতর থেকে স্যারের হিংস্র গালিগালাজ বের হতে থাকে। রতন বলল, “মামা লন্ডন চলে যাবে।”

রাশা জিজ্ঞেস করল, “এই ফোনটা নিয়ে যাবে?”

“হ্যাঁ।“

“এই ভিডিওটার একটা কপি আমাদের রাখতে হবে। এইটা খুবই জরুরি।”

রতন বলল, “সেই জন্যে আমি তোর সাথে নিরিবিলি কথা বলতে চাচ্ছিলাম।”

রাশা বলল, “সেটা তো আগে বলবি। এর পরেরবার যখন কোনো জরুরি বিষয় নিয়ে কথা বলবি তখন ধানাই-পানাই না করে সোজাসুজি কাজের কথায় চলে আসবি। বুঝেছিস?”

রতন একটু আহত গলায় বলল, “আমি কখন ধানাই-পানাই করেছি? আমি তো সোজাসুজি কাজের কথাই বলেছি।”

“না বলিস নাই।”

“বলেছি।”

“থাক বাবা এখন এটা নিয়ে আর তর্ক করে লাভ নাই। এখন আমাকে বল এইটা কিভাবে কপি করা যায়।”

“মামাকে জিজ্ঞেস করব?”

“উঁহু। বড় মানুষদের জিজ্ঞেস করলেই ঝামেলা। বাজারে একটা ফোন-ফ্যাক্স-কম্পিউটারের দোকান আছে না?”

“হ্যাঁ আছে।”

“সেইখানে নিয়ে গিয়ে একটা সিডিতে কপি করতে হবে।”

“সিডি কী?”

“সেটা এখন আমি তোকে শিখাতে পারব না। কালকে মোবাইল ফোনটা নিয়ে আসিস। দুপুরবেলা কপি করাতে নিয়ে যাব।”

“ঠিক আছে।”

“কাউকে বলবি না।”

“বলব না।”

“গোপন রাখবি।” রতন মুখভঙ্গি করে বলল, “আমি তো গোপনই রাখতে চাচ্ছি, তুই-ই সবার সামনে কথা বলতে চাস!”

.

পরদিন দুপুরে মোবাইল টেলিফোন থেকে ভিডিওটা দুটো সিডিতে কপি করে নেয়া হলো। রাশা সিডি দুটি খুব যত্ন করে রেখে দিল, কোনো একদিন নিশ্চয়ই কাজে লাগবে। পরেরবার যখন জাহানারা ম্যাডামের সাথে কথা বলবে তখন তাকে জিজ্ঞেস করবে। তাকে এভাবে মেরেছেন শুনলে কষ্ট পাবেন কিন্তু কিছু তো আর করার নেই। স্কুলে ছেলেমেয়েদের পেটানো যাবে না দেশে নিশ্চয়ই এরকম আইন আছে, সেই আইনে রাজ্জাক স্যারের নিশ্চয়ই শাস্তি পাবার কথা। তার একটা উচিত শিক্ষা হওয়া উচিত, কিন্তু সেই শিক্ষাটা তাকে দেবে কে?

কিন্তু হঠাৎ করে সেই সুযোগটা চলে এলো–রাশা নিজেও বুঝতে পারেনি এত তাড়াতাড়ি এরকম চমকপ্রদ একটা সুযোগ আসবে। ঘটনাটা শুরু হলো এভাবে :

সকাল বেলা মাঠে অ্যাসেম্বলিতে সবাই দাঁড়িয়েছে তখন হেডমাস্টার সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “তোমাদের জন্যে একটা সুখবর আছে।”

স্যার-ম্যাডামরা যখন বলেন সুখবর আছে প্রায় সবসময়েই দেখা যায় খবরটা আসলে সুখবর না। কয়েকদিন আগে হেড স্যার বলেছিলেন, তোমাদের জন্য একটা সুখবর আছে, এমপি সাহেব আসছেন। সব ছাত্রছাত্রী এমপি সাহেবকে সংবর্ধনা দেয়ার জন্য ছোট ছোট পতাকা নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে। স্কুল থেকে সব ছেলেমেয়ে সকাল থেকে রাস্তার দুই পাশে ফ্ল্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে রইল। সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো, তার মাঝে গনগনে রোদ, ঘেমে একেকজন একাকার। শেষ পর্যন্ত এমপি সাহেব এলেন, তার গলায় ফুলের মালা, সামনে-পিছনে শুধু লোক আর লোক। কালো আর মোটা এমপি সাহেব হেঁটে হেঁটে চলে গেলেন, স্কুলের এত এত বাচ্চা যে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে তাদের দিকে একবার ঘুরেও তাকালেন না।

তাই হেডমাস্টার যখন বললেন, তোমাদের জন্যে সুখবর আছে তখন সবাই ভয়ে ভয়ে হেডমাস্টারের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সুখবরটা কী শোনার জন্য। হেডমাস্টার বললেন, “তোমরা কারা কারা কম্পিউটারের নাম শুনেছ?”

মোটামুটি সবাই হাত তুলল।

হেডমাস্টার জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কারা কারা কম্পিউটার দেখেছ?”

এবারে অনেক হাত নেমে গেল।

“তোমরা কারা কারা কম্পিউটার ব্যবহার করেছ?”

এবারে রাশা ছাড়া অন্য সবার হাত নেমে গেল। আর কারো হাত উঠে নাই বলে রাশাও তাড়াতাড়ি তার হাত নামিয়ে ফেলল। হেডমাস্টার বললেন, “উন্নত দেশে মানুষের ঘরে ঘরে কম্পিউটার। আমাদের খুবই কপাল খারাপ যে আমরা স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের পর্যন্ত কম্পিউটার দেখাতে পারি না। যাই হোক আমাদের সেই দুঃখের দিন শেষ হতে যাচ্ছে! তোমরা শুনে খুবই খুশি হবে যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে দেশের সব স্কুলে কম্পিউটার দেয়া হচ্ছে। সেই প্রোগ্রামের আওতায় আমরাও আমাদের স্কুলে একটা কম্পিউটার পেতে যাচ্ছি।”

হেড স্যারের কথা শেষ হওয়া মাত্র ছেলেমেয়েরা সবাই আনন্দের একটা শব্দ করল, এটা ভেজাল সুখবর না, এটা সত্যি সুখবর!

হেডমাস্টার সাহেব বললেন, “তবে একটা জিনিস সবার মনে রাখতে হবে, কম্পিউটার কিন্তু টেলিভিশনের মতো না, যে টিপ দিলেই প্রোগ্রাম শুরু হয়ে যাবে। নাচ-গান চলতে থাকবে। কম্পিউটার অত্যন্ত সূক্ষ্ম একটা যন্ত্র। এটা ঠিক করে চালাতে জানতে হয়। যারা জ্ঞানী-গুণী মানুষ তারা কম্পিউটার দিয়ে প্রোগ্রামিং করে। কম্পিউটার দিয়ে চিঠি লেখে, ছবি আঁকে, ই-মেইল করে। ইন্টারনেট করে। সবাই বুঝেছ?”

হেডস্টার সাহেব কী বলছেন সেটা বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই ঠিক বুঝতে পারল না কিন্তু সবাই মাথা নাড়ল। হেডমাস্টার সাহেব বললেন, “আমরাও চাই আমাদের আহাদ আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরাও একদিন কম্পিউটার চালাতে শিখবে।”

ছেলেমেয়েরা আবার আনন্দের শব্দ করল, হেডমাস্টার ছেলেমেয়েদের উচ্ছ্বাস দেখে খুশি হলেন। হাসি হাসি মুখে বললেন, আমাদের সায়েন্স টিচার রাজ্জাক সাহেব কম্পিউটারের ওপর ট্রেনিং নিতে আগামী সপ্তাহ ঢাকা যাবেন। তারপর ঢাকা থেকে লোকজন এসে আমাদের স্কুলে কম্পিউটার বসিয়ে দিয়ে যাবে। আমরাও তখন সাবইকে বলতে পারব আমাদের স্কুল তথ্যপ্রযুক্তিতে পিছেয়ে নাই।

হেটমাস্টার বক্তৃতার ভঙ্গিতে হাত উপরে তুলে একটা ঝাঁকুনি দিলেন, সব ছেলেমেয়ে তখন আবার তাল মিলিয়ে চিৎকার করে উঠল। শুধু রাখা চিৎকার না করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, কয়েকজন ছেলেমেয়ের জন্য কম্পিউটার আর সেই কম্পিউটারের দায়িত্বে থাকবেন রাজ্জাক স্যার। কোনো ছেলেমেয়ে আর সেই কম্পিউটার ব্যবহার করা দূরে থাকুক ছুঁয়েও দেখতে পারবে না। পুরো ব্যাপাটার মাঝে শুধু একটা ভারো দিক, কম্পিউটারের ট্রেনিং নেবার জন্যে রাজ্জাক স্যার এক সপ্তাহের জন্য ঢাকা থাকবেন, সেই একসপ্তাহ ছেলেমেয়েদের আনন্দ, সেই সপ্তাহে তার পিটুনি খেতে হবে না।

পরের সপ্তাহে স্কুলে একটু উত্তেজনা দেখা গেল। বালতিতে পানির মাঝে চুন গুলিয়ে সেই চুনের পানি দিয়ে দেয়াল হোয়াইট ওয়াশ করার চেষ্টা করা হলো। ফলাফল হলো ভয়ঙ্কর, স্কুলের জায়গায় জায়গায় ক্যাটক্যাটে সাদা রঙের কারণ স্কুলটাকে কেমন যে অপরিচিত দেখাতে থাকে। স্কুলের ছেলেমেয়েদের দিয়ে মাঠের আগাছা পরিষ্কার করানো হলো, ক্লাসঘর পরিষ্কার করানো হলো। ___

“তোমরা সবাই পরিষ্কার কাপড় পরে আসবে। খবরদার, কেউ খালি পায়ে আসবে না, জুতো না হয় স্যাভেল পরে আসবে। মাথায় তেল দিয়ে চুল আঁচড়ে আসবে। ঢাকা থেকে যারা আসবেন তারা যদি তোমাদের কিছু জিজ্ঞেস করেন তাহলে সুন্দর করে শুদ্ধ ভাষায় উত্তর দিবে। অনুষ্ঠান চলার সময় তোমরা কেউ গোলমাল করত্বে না, কথা বলবে না। যা যা বলা হবে সবকিছু মন দিয়ে শুনবে। মনে রেখো তোমরা যদি ঢাকার গেস্টদের মাঝে একটা ভালো ধারণা দিতে পারো তাহলে হয়তো ভবিষ্যতে আরো কম্পিউটার পাবে।”

পরের দিন স্কুলে যাবার সময় কী মনে হলো কে জানে রাশা রতনের ভিডিও থেকে তৈরি করা সিডিটা তার বইয়ের মাঝে করে স্কুলে নিয়ে এলো।

স্কুলে এসে দেখে সেখানে সাজ সাজ রব। সব ক্লাসঘর থেকে বেঞ্চগুলো বের করে মাঝখানে আনা হয়েছে। স্কুলের বারান্দায় চেয়ার টেবিল পেতে বসার জায়গা করা হয়েছে। চেয়ারগুলো টাওয়েল দিয়ে সাজানো! টেবিলে সাদা টেবিল ক্লথ। একপাশে মাইক্রোফোন, বারান্দায় দুটি বড় বড় স্পিকার। যে কম্পিউটারটা স্কুলে দেয়া হবে সেটাকে টেবিলে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কম্পিউটারের পাশে অনেকগুলো সিডি সাজানো। টেবিলের ওপর ফুলদানি, সেই ফুলদানিতে চকচকে প্লাস্টিকের ফুল।

বারান্দায় একটু ভেতরের দিকে একটা বড় সাদা স্ক্রিন। সামনে ছোট একটা টেবিলে একটা ভিডিও প্রজেক্টর। হেডমাস্টার গলায় একটা টাই লাগিয়ে খুব ব্যস্তভাবে হাঁটাহাঁটি করছেন। রাজ্জাক স্যার একটা চকচকে সাফারি স্যুট পরে এসেছেন। স্কুলের অন্য শিক্ষকরাও সেজেগুজে চলে এসেছেন।

ক্লাসঘর থেকে সব বেঞ্চ বাইরে নিয়ে আসা হয়েছে, ক্লাসে বসার জায়গা নেই তাই সব ছাত্রছাত্রী সেই বেঞ্চে চুপচাপ বসে অপেক্ষা করছে। কেউ একজন মাইকটা চালু করে সেটা পরীক্ষা করার জন্যে বলল, “হ্যালো মাইক্রোফোন টেস্টিং ওয়ান টু থ্রি ফোর। ওয়ান টু থ্রি ফোর।”

রাশা দেখতে পেল বেশ কয়েকটা ফুলের তোড়া এনে এক কোনায় রাখা হয়েছে। তখন হঠাৎ করে হেডমাস্টারের কী একটা মনে পড়ল, তিনি ব্যস্ত হয়ে ছাত্রছাত্রীদের দিকে ছুটে এলেন, বললেন, “সর্বনাশ! অতিথিদের ফুলের তোড়া কে দেবে ঠিক করা হয় নাই। ক্লাস নাইনের মেয়েরা কোথায়?”

দেখা গেল ক্লাস নাইনে দুজন মেয়ে কম পড়েছে। তখন ক্লাস এইট থেকে দুজন মেয়ে নেয়া হলো। একজন সানজিদা অন্যজন রাশা। রাশা তখন চোখ বন্ধ করে উপরের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “থ্যাংক ইউ আল্লাহ। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।”

অতিথিরা আসতে অনেক দেরি করলেন, সবাই একেবারে অধৈর্য হয়ে গিয়েছিল, শুধু রাশা অধৈর্য হলো না। সে শান্ত মুখে বসে রইল, কেউ টের পেল না তার বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা চলন্ত ট্রেনের মতো ধক ধক করে শব্দ করছে।

শেষ পর্যন্ত অতিথিরা এলেন, স্কুলের মাঠে দুইটা গাড়ি এসে থামল, পিছনে পুলিশের একটা গাড়ি। অতিথিরা গাড়ি থেকে নামার পর হেডমাস্টার একেবারে বিগলিত ভঙ্গিতে তাদেরকে স্টেজে নিয়ে এসে বসালেন। এই গরমের ভেতর একজন কোট-টাই পরে এসেছেন, তাকে দেখেই রাশার গরম লাগতে থাকে। একজন পুলিশের পোশাক পরা, তিনি স্টেজে বসতে চাচ্ছিলেন না, হেডমাস্টার জোর করে তাকেও স্টেজে তুলে দিলেন। অতিথিদের অনেক তাড়া, এখান থেকে অন্য একটা স্কুলে যাবেন, কাজেই খুব দ্রুত অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল।

অনুষ্ঠান পরিচালনা করছেন রাজ্জাক স্যার। তিনি গলা কাঁপিয়ে অতিথিদের সম্পর্কে অনেক ভালো ভালো কথা বললেন। এস.পি, এবং ভি.সি, সাহেব যে তাদের অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করে এরকম তুচ্ছ একটা স্কুলে চলে এসেছেন সে জন্যে কৃতজ্ঞতা জানতে জানাতে মুখে প্রায় ফেনা তুলে ফেললেন। তারপর তাদের ফুল দিয়ে বরণ করার জন্য মেয়েদের স্টেজে ডাকলেন। রাশা তার বইয়ের ভেতর থেকে সিডিটা নিয়ে রওনা দিল, হাতটা একটু পিছনে রাখল যেন কেউ সেটা লক্ষ না করে। মঞ্চের পাশে গিয়ে ফুলের তোড়াটা হাতে নেয়ার পর সে ফুলের তোড়ার পিছনে সিডিটা লুকিয়ে ফেলল। একজন একজন করে ফুলের তোড়া নিয়ে যাচ্ছে, সেও এগিয়ে গেল, টেবিলের পাশে দিয়ে যাবার সময় সে টুক করে সিভিটা অন্য সিডিগুলোর উপরে রেখে দিল। কোট-টাই পরা মানুষটা তার হাত থেকে ফুলের তোড়াটা নিয়ে কিছু একটা বললেন, উত্তেজনায় রাশার বুক এমন ধুকপুক করছিল যে কী বলেছেন সে ঠিক ভালো করে শুনতেও পেল না।

রাশা আবার তার জায়গায় এসে বসে চোখ বন্ধ করে উপরের দিকে তাকাল, বিড়বিড় করে বলল, “হে খোদা। আমার কলিই। আমি করেছি বাকিটা তোমার দায়িত্ব। তুমি বাকিটা করে দাও, প্লিজ।”

সবাইকে দিয়ে বক্তৃতা দেয়ানোর একটা ব্যাপার ছিল কিন্তু কোট-টাই পরা মানুষটি তার মাঝে যেতে চাইলেন না, সামনে বসে থাকা কমবয়সী একটা মানুষকে কী যেন ইঙ্গিত করলেন, সেই মানুষটা তখন তড়াক করে লাফ দিয়ে স্টেজে উঠে মাইক্রোফোনটা হাতে নিয়ে কথা বলতে শুরু করে। মানুষটা হাসি-খুশি আর কথা বলে সুন্দর করে, সবাই তাই বেশ আগ্রহ নিয়ে তার কথা শুনতে থাকে। মানুষটা বলল, “এইখানে বেশিরভাগ হচ্ছে বাচ্চা ছেলেমেয়ে! বাচ্চা ছেলেমেয়েরা বক্তৃতা দুই চোখে দেখতে পারে না, তাই আজকে কোনো বক্তৃতা হবে না। আমরা সরাসরি মজার জায়গায় চলে যাব। মজার জিনিসটা কী কে বলতে পারবে?”

সবাই একসাথে চিৎকার করে বলল, “কম্পিউটার!”

মানুষটা হাসিমুখে বলল, “ভেরি গুড! এবারে বলো দেখি কম্পিউটার দিয়ে কী কী করা যায়?”

ছাত্রছাত্রীরা চুপ করে বসে রইল। একজন ভয়ে ভয়ে বলল, “হিন্দি সিনেমা দেখা যায়!”

মানুষটা হেসে ফেলল, বলল, “যদি বলতে সিনেমা দেখা যায় তাহলেও একটা কথা ছিল, একেবারে হিন্দি সিনেমা! অবশ্যি তোমাকে দোষ দিই কেমন করে–তুমি নিশ্চয়ই কোনো দোকানে দেখেছ কম্পিউটারে হিন্দি সিনেমা দেখাচ্ছে! ঠিক আছে, এবারে বলে আর কী করা যায়?”

একজন বলল, “চিঠি লেখা যায়?”

মানুষটা বলল, “ভেরি গুড়! চিঠি লেখা যায়। আর কী করা যায়?”

আরেকজন বলল, “ছবি আঁকা যায়।”

“আর কী করা যায়?”

“গেম খেলা যায়।”

“আর কী করা যায়?”

রাশা ইচ্ছে করলেই কম্পিউটার দিয়ে কী করা যায় সেরকম কয়েক ডজন কাজের কথা বলতে পারত, কিন্তু সে কিছু বলল না।

মানুষটা অনেকগুলো কাজের কথা শুনে শেষ পর্যন্ত বলল, “তোমরা যে কয়টা কাজের কথা বলেছ কম্পিউটার দিয়ে তার সবগুলো করা যায়–শুধু যে সেগুলো করা যায় তা নয়, সেগুলো ছাড়াও আরো অনেক কাজ করা যায়! আমি সেগুলো নিয়ে বকবক না করে তোমাদের দেখাব। ঠিক আছে?”

সবাই চিৎকার করে বলল, “ঠিক আছে।”

মানুষটা কম্পিউটারের পাশে রাখা সিডিগুলো এবারে হাতে তুলে নেয়, সাথে সাথে রাশার বুকটা ধক করে উঠল। মানুষটা মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলল, আমি তোমাদের জন্যে অনেকগুলো সিডি নিয়ে এসেছি, এর মাঝে কোনোটা গেম, কোনোটা এনসাইক্লোপিডিয়া, কোনোটা বিজ্ঞানের এক্সপেরিমেন্ট, কোনোটা গান, কোনোটা ছবি আঁকার প্রোগ্রাম! আমি এখন সেগুলো তোমাদের একটু একটু করে দেখাব। বলো তোমরা কোনটা আগে দেখতে চাও?”

বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে চিৎকার করে উঠল, “গেম। গেম!”

মানুষটা সিডিগুলোর উপর চোখ বুলাতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেল, রাশার রেখে আসা সিঁড়িটা হাতে নিয়ে বলল, “কী ইন্টারেস্টিং, এখানে একটা নতুন সিডি! কেউ একজন রেখে গেছে, উপরে লেখা আমাদের স্কুল! তার মানে তোমাদের স্কুলের ওপরে কেউ একটা কিছু তৈরি করেছে। এটা দিয়েই শুরু করা যাক। কী বলো? দেখি তোমাদের স্কুল কী রকম!”

হেডমাস্টারকে এবারে খানিকটা বিভ্রান্ত দেখা গেল, গলা নামিয়ে রাজ্জাক স্যারকে বিষয়টা গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন। রাজ্জাক স্যার বললেন তিনি এটা সম্পর্কে কিছু জানেন না। তাদের দুজনকেই এবারে খানিকটা দুশ্চিন্তিত দেখাতে থাকে।

কম্পিউটারের মানুষটা তখন সিডিটা কম্পিউটারে ঢুকিয়ে দিয়ে মাইক্রোফোনে বলল, “কম্পিউটারের মনিটর হয় ছোট। শুধু একজন সেটা দেখতে পারে। আজকে আমরা যেন সবাই দেখতে পারি সে জন্যে একটা ভিডিও প্রজেক্টর এনেছি, একটা বড় স্ক্রিন এনেছি। এখন আমরা সবাই দেখতে পারব। একসাথে দেখতে পারব।”

রাশা নিশ্বাস বন্ধ করে ফেলল, উত্তেজনায় তার চোখ দুটি বন্ধ হয়ে যায়। ঠিক তক্ষুণি স্পিকার থেকে রাজ্জাক স্যারের বিকট গলায় চিৎকার শোনা গেল, “শুওরের বাচ্চা, হারামজাদা!”

স্টেজে বসে থাকা অতিথিরা, সামনে বসে থাকা সার-ম্যাডামরা আর বেঞ্চে বসে থাকা কয়েকশ ছেলেমেয়ে একসাথে চমকে উঠল। সবাই চোখ বড় বড় করে স্ক্রিনের দিকে তাকায়, সেখানে রাজ্জাক স্যারকে দেখা যায়, হাতে একটা বেত নিয়ে সঁত-মুখ খিঁচিয়ে বললেন, “খুন করে ফেলব আমি তোরে। বেতিয়ে শরীরের চামড়া তুলে ফেলব, পিটিয়ে লাশ করে ফেলব।” ১০৮

সবাই দেখল রাজ্জাক স্যার তার হাতের বেত নিয়ে একটা ছেলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন, তারপর অমানুষের মতো তাকে মারতে লাগলেন। নিজের চোখে না দেখলে কেউ এটা বিশ্বাস করবে না। স্টেজে বসে থাকা অতিথিরা, সামনে বসে থাকা স্যার, ম্যাডামেরা আর কয়েকশ ছেলেমেয়ে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে এই ভয়ঙ্কর দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে রইল।

রাশা রাজ্জাক স্যারের দিকে তাকিয়েছিল, সে দেখল স্যার লাফিয়ে উঠলেন, কম্পিউটারের দিকে ছুটে গিয়ে সেটা বন্ধ করার চেষ্টা করলেন। চিৎকার করে একবার বললেন, “কী হচ্ছে? কী হচ্ছে এখানে?”

কেউ তার কথা শুনল না, কম্পিউটারের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল। সবাই দেখল, রাজ্জাক স্যার ছেলেটাকে মারছেন, ছেলেটা হাত দিয়ে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করল, তাতে সার যেন আরো খেপে গেলেন, তখন চুলের মুঠি ধরে তাকে বেঞ্চের ওপর প্রায় শুইয়ে ফেলে মারতে লাগলেন। বেতের শপাং শপাং শব্দ তার সাথে ছেলেটার কাতর চিৎকার।

হঠাৎ ভিডিও স্ক্রিনে রাশার তীক্ষ্ণ চিৎকার শোনা গেল, “স্যার।”

সকল দর্শক চমকে উঠে চোখ বড় বড় করে তাকাল। স্ক্রিনে দেখা গেল রাজ্জাক স্যার ঘুরে তাকিয়েছেন। তাকে দেখতে অবিকল একটা জানোয়ারের মতো দেখাচ্ছে। হিংস্র গলায় বললেন, “কে?”

রাশাকে দেখা গেল না, শুধু তার কথা শোনা গেল, “আমি স্যার।”

“কী হয়েছে?”

“আপনি এভাবে ওকে মারতে পারেন না।”

সবাই চোখ বড় বড় করে দেখার চেষ্টা করছে কোন মেয়ের এত সাহস, কোন মেয়ে এভাবে কথা বলছে। স্ক্রিনে তাকে দেখা যাচ্ছে না, শুধু রাজ্জাক স্যারকে দেখা যাচ্ছে। রাজ্জাক স্যার যখন রাশার কাছে হাজির হলেন তখন স্ক্রিনে প্রথমবার রাশাকে দেখা গেল, একটু পিছন থেকে কিন্তু তাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

এরকম সময় রাজ্জাক স্যার স্টেজে ছুটে এসে আবার কম্পিউটারটা বন্ধু করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। কম্পিউটারের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা তাকে এত জোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল যে রাজ্জাক স্যার স্টেজ থেকে পড়তে পড়তে কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিলেন।

সবাই দেখল রাজ্জাক স্যরি কিভাবে শপাং শপাং করে বেত দিয়ে রাশার হাতটাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিলেন। সবাই দেখল কিভাবে সব ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে গেল, কিভাবে রাজ্জাক স্যার হঠাৎ করে থেমে গেলেন, কিভাবে ক্লাস থেকে বের হয়ে গেলেন, কিভাবে রাশা কান্নায় ভেঙে পড়ল, কিভাবে ক্লাসের সব ছেলেমেয়ে ছুটে এলো তার কাছে। এরকম জায়গায় ভিডিওটা শেষ হয়ে হঠাৎ করে স্ক্রিনটা অন্ধকার হয়ে গেল।

কেউ কোনো কথা বলল না, সবাই নিজের জায়গায় পাথরের মধ্যে বসে রইল। রাশা দেখল কোট-টাই পরে থাকা মানুষটা খুব সাবধানে তার টাইটা দিয়ে চোখ মুছলেন। হেডমাস্টার মাথা নিচু করে বসে রইলেন। শুধু রাজ্জাক স্যারকে দেখা গেল কিছু একটা বলতে চাইছেন কিন্তু বলতে পারছেন না, তার মুখ ফ্যাকাসে এবং বিবর্ণ, মনে হচ্ছে বিশাল একটা কুৎসিত পোকা।

কোট-টাই পরা মানুষটা কিছু একটা বললেন, কিন্তু সামনে মাইক্রোফোন নেই বলে তার কথাটা শোনা গেল না। কম্পিউটারের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা স্ট্যান্ড থেকে মাইক্রোফোনটা খুলে তার হাতে ধরিয়ে দিল। কোট-টাই পরা মানুষটা বললেন, “আমরা স্কুলে স্কুলে কম্পিউটার দিচ্ছি, বড় বড় কথা বলছি–কিন্তু কী লাভ? আমাদের ছেলেমেয়েদের আমরা রাক্ষসের হাতে ছেড়ে দিচ্ছি। সেই রাক্ষসেরা আমাদের ছেলেমেয়েদের মেরে ফেলছে, খুন করে ফেলছে, আমরা সেটা জানি না! কী লাভ তাহলে? কী লাভ?”

কোট-টাই পরা মানুষটা হেডমাস্টারের দিকে তাকিয়ে বলল, “হেডমাস্টার সাহেব। আপনার স্কুলে এই ভাবে ছেলেমেয়েদের মারা হয় আপনি সেটা জানেন না? আপনি কিসের হেডমাস্টার? আপনার হাতে আমরা কিভাবে ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব দিব? কিভাবে?”

হেডমাস্টার বিড়বিড় করে কিছু একটা বলে মাথা নিচু করে বসে রইলেন। কোট-টাই পরা মানুষটা পুলিশের পোশাক পরা মানুষটাকে বলল, “এস. পি. সাহেব, আপনি এই রাক্ষসটাকে ধরেন, বুক করেন। চৌদ্দ বছরের আগে যদি জেলখানা থেকে ছাড়া পায়–”

রাজ্জাক স্যার তখন পাগলের মতো ছুটে এসে হাউমাউ করে কোট-টাই পরা মানুষটার পা ধরার চেষ্টা করতে থাকেন। কোট-টাই পরা মানুষটা তখন রাজ্জাক স্যারকে এত জোরে একটা ধমক দিলেন যে সারা স্কুল কেঁপে উঠল, “খবরদার! আমাকে তুমি যদি স্পর্শ করো আমি তোমাকে খুন করে ফেলব।”

তারপর পিছন দিকে তাকিয়ে বললেন, “সরিয়ে নিয়ে যাও একে। সরিয়ে নাও। আমি কোনো নাটক দেখতে চাই না।”

তখন বেশ কয়েকজন মানুষ রাজ্জাক স্যারকে ধরে সরিয়ে নিল। কোট-টাই পরা মানুষটা এতক্ষণ বসে বসে কথা বলছিলেন, এবার মাইক্রোফোনটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, তারপর হেঁটে হেঁটে সামনে এসে থামলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন, তারপর বললেন, “পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানী মানুষ কারা জানো? সবচেয়ে সম্মানী মানুষ হচ্ছে শিক্ষক, বুঝেছ? একজন শিক্ষককে কোনোভাবে অসম্মান করতে হয় না। যদি সেই শিক্ষক নিজেকে নিজে অসম্মান করেন তখন আমরা কিছু করতে পারি না, আমরা খুব মনে কষ্ট পাই কিন্তু কিছু করতে পারি না। যাই হোক, আমার প্রিয় ছেলেমেয়েরা, আজকে আমি খুব মনে কষ্ট পেয়েছি। এ রকম যদি একটা ঘটনা ঘটে তাহলে দেশে আরো যে আশি হাজার স্কুল আছে, সেখানেও নিশ্চয়ই এরকম ঘটনা ঘটে। হয়তো এখন এই মুহূর্তে কোনো স্কুলে কোনো ছেলেকে কিংবা কোনো মেয়েকে কোনো একজন স্যার মারছেন! চিন্তা করতে পারো? আমরা দেশের শিক্ষার দায়িত্ব নিয়ে আছি। খোদা কি আমাদের মাফ করবেন? করবেন না। খোদ আমাদের মাপ করবেন না।”

মানুষটা একটা নিশ্বাস নিয়ে বললেন, “খুব মন খারাপ হয়েছে সত্যি কথা, তারপরেও কিন্তু একটা জিনিস দেখে আমার বুকটা ভরে গেছে। এইটুকুন একটা মেয়ে, কী তার সাহস, সে কী রকম তার বন্ধুকে রক্ষা করার জন্যে দাঁড়িয়ে গেল, কিভাবে মার খেল তবু সে পিছিয়ে গেল না। মাই গুডনেস্! তুমি এখানে আছ কি না আমি জানি না, তুমি যদি থাকো মা তোমাকে স্যালুট।” বলে কোট-টাই পরা মানুষটা হাত তুলে স্যালুট করার ভঙ্গি করলেন।

সব ছেলেমেয়ে হাততালি দিতে থাকে, কয়েকজন রাশাকে ঠেলে দাঁড়া করানোর চেষ্টা করে, রাশা উঠল না, মাথা নিচু করে বসে রইল।

কোট-প্যান্ট পরা মানুষটা বললেন, “তোমরা যখন বড় হবে, যখন এই দেশের দায়িত্ব নিবে তখন কোনো ছেলেমেয়ে আর ক্লাসরুমে কষ্ট পাবে না। দুঃখ পাবে না। ঠিক আছে?”

ছেলেমেয়ের মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক আছে।”

“কথা দাও।”

সবাই মাথা নেড়ে কথা দিল। এরকম সময় কম্পিউটারের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি এসে কোট-টাই পরা মানুষটার সাথে কথা বলল, কিছু একটা হিসাব করল, তারপর মাথা নাড়ল, আবার কথা বলল, তারপর আবার মাথা নাড়ল, তারপর মনে হলো দুজনে কোনো একটা বিষয়ে একমত হলো। কমবয়সী মজার মানুষটা তখন কোট-টাই পরা মানুষটার হাত থেকে মাইক্রোফোনটা নিয়ে বলল, “আমার ওপর দায়িত্ব ছিল তোমাদের কম্পিউটার দেখানো। কম্পিউটার দিয়ে কিভাবে তথ্যপ্রযুক্তি করতে হয় সেটা বোঝানো! আমি কী দেখলাম? আমি দেখলাম, তোমরা আমার থেকে কম্পিউটার অনেক ভালো বোঝো! তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে তোমরা বিশাল একটা অন্যায়কে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছ। কাজেই তোমাদের আমার শেখানোর কিছু নাই, উল্টো আমি তোমাদের কাছ থেকে আজকে অনেক কিছু শিখে গেলাম।”

ছেলেমেয়েরা খুশিতে হাততালি দিতে থাকে। মানুষটা বলল, “আমি স্যারের সাথে কথা বলেছি। স্যারকে বলেছি এই স্কুল যখন কম্পিউটারের এত সুন্দর ব্যবহার করে এদের মাত্র একটা কম্পিউটার দিলে কি হয়? এদের বেশি করে কম্পিউটার দিতে হবে। বলো তোমরা কয়টা কম্পিউটার চাও?”

সামনে বসে থাকা একজন চিৎকার করতে লাগল, “দশটা! দশটা!”

“মাত্র দশটা? আমরা তোমাদের তিরিশটা কম্পিউটার দিব! তিরিশটা!”

ছেলেমেয়েদের চিৎকারে মানুষটার কথা চাপা পড়ে গেল। তারা উঠে দাঁড়িয়ে লাফাতে থাকে। ছেলেমেয়েরা একটু শান্ত হলে মানুষটা বলল, “আমরা দেখতে পাচ্ছি তোমাদের স্কুলে এতগুলো কম্পিউটার রাখার জায়গা নাই, তাই স্যার বলেছেন, ওই কোনায় একটা ঘর তুলে দেবেন। সেটা হবে তোমাদের কম্পিউটার ল্যাবরেটরি।

ছেলেমেয়েগুলোর সাথে এবারে স্যার আর ম্যাডামরাও আনন্দে লাফাতে লাগলেন। শুধু রাশা চুপ করে বসে রইল। তার মনে হতে লাগল সে বুঝি আর বাচ্চা মেয়ে না। সে বুঝি অনেক বড় হয়ে গেছে। তার বুঝি আর লাফ-ঝাঁপ করা মানায় না।

শুধু তার মুখে একটা হাসি আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে।

1 Comment
Collapse Comments
অমিতা ভট্টাচার্য্য May 14, 2020 at 1:55 am

অসাধারণ একটি উপন্যাস।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *