০৭. আহসান এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড

৭. আহসান এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড

ইতিহাস ক্লাসে সুনির্মল দপ্তরী একটা ছোট চিরকুট নিয়ে এল। ইতিহাস স্যার চিরকুটটা পড়ে ভুরু কুঁচকে ক্লাসের দিকে তাকালেন, তারপর মেঘ স্বরে বললেন, মুনীর আর সলীল–

আমি আর সলীল উঠে দাঁড়ালাম।

তোমাদের দুজনকে হেডস্যার ডেকে পাঠিয়েছেন।

শুনে আমাদের একেবারে আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। হেডস্যার ডেকে পাঠানো এখন পর্যন্ত কারো জন্যে কোন সুসংবাদ বয়ে আনেনি। এক কথায় বলা যায়, এটা সাক্ষাৎ মৃত্যুর আলামত। কি জন্যে আমাদের উপর এই মহা বিপর্যয় নেমে আসছে। সেটাই প্রশ্ন। সেদিনের স্কুল পালানোটা কি হেডস্যার জেনে গেছেন? কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব? অন্য কেউ তো টের পায়নি। তাহলে কি বড়দের উপন্যাস পড়াটা? কিন্তু সেটাও তো খুব বেশি মানুষ জানে না। নাওয়াজ খানের চেম্বারে গিয়ে আমরা কি কিছু গোলমাল করে এসেছি? নাকি অন্য কিছু? গত কয়েক সপ্তাহে আমি যত অপকর্ম করে এসেছি সবগুলি একে একে মনে পড়তে লাগল।

ইতিহাস স্যারের কোন দয়া মায়া নেই বলে ধরে নেয়া হয়। ক্লাসে আবার সেটা প্রমাণ হল, স্যার মধুর ভঙ্গিতে হেসে বললেন, যাও বাবারা, একটু ধোলাই খেয়ে আস।

আমি আর সলীল ফ্যাকাসে মুখে সুনির্মল দপ্তরীর সাথে রওনা দিলাম। সলীল গলা নামিয়ে বলল, সুনির্মলদা, ব্যাপারটা কি?

সুনির্মলদা একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে উদাস গলায় বললেন, আর ব্যাপার!

শুনে আমরা আরো ঘাবড়ে গেলাম।

হেডস্যারের রুমে গিয়ে পর্দা সরিয়ে উঁকি মেরে দেখি, ভিতরে দুইজন মানুষ বসে আছে। দুজনেই মোটা এবং ফর্সা। বড়লোকদের এক রকম চেহারা হয়, তাদের চেহারা। সেরকম। একজনের মাথায় চুল পাতলা হয়ে এসেছে, অন্যজনের বড় বড় গোফ এবং চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। আমরা ভারি পর্দার ভিতর দিয়ে মাথা গলিয়ে দুর্বল গলায় বললাম, স্যার আমাদের ডেকেছেন?

হ্যাঁ, ডেকেছি। এসো। হেডস্যার কথা শেষ করে আমাদের দিকে হাসিমুখে তাকালেন। অবিশ্বাস্য ব্যাপার, আমি হেডস্যারকে কখনো হাসতে দেখেছি বলে মনে করতে পারলাম না। শুধু তাই নয়, স্যারের গলার স্বর মাখনের মত নরম, আমাদের নিজেদের কানকে বিশ্বাস হল না।

আমরা সাবধানে ভিতরে ঢুকলাম, এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত না ব্যাপারটা কোন রকম রসিকতা কিনা। হেডস্যার জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা সলীল আর মুনীর?

জী স্যার। আমি মুনীর।

সলীল বলল, আমি সলীল।

হেডস্যার লোক দুজনের দিকে তাকিয়ে বললেন, এই যে, যে দুজনকে আপনারা খুঁজছেন।

লোক দুজন আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল, খুব চেষ্টা করছে হাসি হাসি মুখ করে তাকাতে, কিন্তু কেন জানি আমার মনে হল লোক দুজন কোন কারণে আমাদের উপর। রেগে আছে। টাক মাথার মানুষটি মুখের হাসিটাকে আরো বড় করে গলায় মধু ঢেলে বলল, খোকারা, কেমন আছ?

ভাল।

বেশ। বেশ। বেশ। লোকটা পুতুলের মতো মাথা নেড়ে আবার বলল, বেশ। বেশ। বেশ।

দুই নম্বর মানুষটি, যার চোখে চশমা এবং নাকের নিচে বড় বড় গোঁফ, মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, আমার ঢাকা থেকে এসেছি, বিকেলের ট্রেনে চলে যাব।

আমি আর সলীল দুজনেই লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমাদের ডেকে . পাঠানোর সাথে বিকেলের ট্রেনে তাদের ঢাকা ফিরে যাবার কি সম্পর্ক এখনো ঠিক বুঝতে পারলাম না।

টাক মাথার লোকটি বলল, আমরা এখানে এসেছি একটা বিজনেসের ব্যাপারে।

চশমা চোখের লোকটি বলল, আমাদের অনেক রকম বিজনেস। গার্মেন্টস, শিপিং, প্লাস্টিক, আরো অনেক কিছু।

টাক মাথার লোকটা বলল, আহসান এন্টারপ্রাইজ বললে সবাই এক নামে চেনে। যাই হোক যেটা বলছিলাম, আমরা একটা জমি কিনব প্রফেসর জহুরুল চৌধুরীর কাছে। থেকে। অংকের প্রফেসর–

টাক মাথার মানুষটি হঠাৎ খুব জোরে জোরে হাসতে শুরু করল, যেন অংকের প্রফেসর হওয়া খুব একটা হাসির ব্যাপার। আমি আর সলীল একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম, তখনো রহস্যটার সমাধান হয়নি কিন্তু যোগাযোগটা কিভাবে হয়েছে মনে হয় একটু একটু আন্দাজ করেত পারছি।

চশমা চোখের মানুষটি বলল, প্রফেসর সাহেব খুব মজার মানুষ। খুব খেয়ালী মানুষ!

জ্ঞানী মানুষেরা সাধারণত খেয়ালী হয়। প্রফেসর জি. সি. দেব ছিলেন জ্ঞানী মানুষ। একবার নাকি ক্লাসে ভুল করে মশারী পরে চলে এসেছিলেন! পাকিস্তান আমী মেরে ফেলেছিল সেভেন্টি ওয়ানে। দেশের একটা বিগ লস। চশমা চোখের মানুষটা জিব দিয়ে চুকচুক করে শব্দ করল।

টাক মাথার মানুষটা পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে টেবিলে রাখতে রাখতে বলল, খোকারা, তোমরা বিশ্বাস করবে না, প্রফেসর জহুরুল চৌধুরী কি রকম মজার মানুষ শুনো। তার কাছ থেকে আমরা, আহসান এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড, একটা জমি কিনছি। আর প্রফেসর সাহেব কি করলেন জান?

কি?

বলেছেন একটা কাগজে তোমাদের দুজনের সিগনেচার নিয়ে আসতে! সেই কাগজে তোমরা লিখে দেবে এই জমি বিক্রি করিতে আমাদের কোন আপত্তি নাই।” টাক মাথার মানুষটি আবার দুলে দুলে হাসতে শুরু করল।

চশমা চোখের মানুষটি আঙুল দিয়ে তার বড় বড় গোফ টানতে টানতে বলল, তোমাদের মনে হয় খুব স্নেহ করেন। গাছের উপরে একটা ঘর তৈরি করছেন, সেখানে নাকি তোমরা গিয়েছ?

আমরা মাথা নাড়লাম।

চশমা চোখের মানুষটি হঠাৎ মুখটাকে একজন দার্শনিকের মত করে বলল, আসলে যারা বড় মানুষ তারা সব সময় বাচ্চাদের ভালবাসেন। বাচ্চাদের মাঝে এক ধরনের ইনোসেন্স থাকে যেটা আমরা টের পাই না! যারা সত্যিকারের বড় মানুষ তারা সেটা চট করে ধরতে পারে।

টাক মাথার মানুষটি আবার পুতুলের মত জোরে জোরে মাথা নাড়ল। চশমা চোখের মানুষটি টেবিলের উপরে রাখা কাগজটা আমাদের দিকে এগিয়ে বলল, আমি তোমাদের ঝামেলা কমানোর জন্যে কাগজে টাইপ করে এনেছি –”এই জমি বিক্রি করিতে আমাদের কোন আপত্তি নাই”। তোমরা নিচে তোমাদের নাম লিখে দাও। কিসে লিখবে? ইংরেজিতে, না বাংলায়?

সলীল একটু গলা পরিষ্কার করে বলল, কিন্তু আমাদের আপত্তি আছে।

অ্যাঁ? মনে হল মানুষটা ঠিক বুঝতে পারল না সলীল কি বলছে।

আমাদের আপত্তি আছে। ঐ জায়গাটা বিক্রি করায় আমাদের আপত্তি আছে।

তোমাদের আপত্তি আছে?

হ্যাঁ। আমি আর সলীল মাথা নাড়লাম।

জমিটা কি তোমাদের? তোমার ফ্যামিলির?

না।

তাহলে তোমার আপত্তি আছে মানে?

তবু আপত্তি আছে। জায়গাটা খুব সুন্দর, স্কুল ছুটি হলে আমরা সেখানে বেড়াতে যাই। আপনারা জায়গাটা কিনে সেখানে ইটের ভাটা বানাবেন। সব গাছ কেটে ফেলবেন। আমাদের সে জন্য আপত্তি আছে।

লোক দুজন আস্তে আস্তে রেগে উঠল। মানুষ রেগে গেলে তাদের খুব খারাপ দেখায়, এই দুজনকেও খুব খারাপ দেখাতে লাগল। মাথায় টাক মানুষটাকে কেমন যেন মোষের মত দেখাতে লাগল। সে ফোঁৎ করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, এটা মশকরা করার জায়গা না। নাও এখানে সাইন কর।

উঁহু। লোকটা এবারে হেডস্যারের দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার, একটু বলবেন সাইন করতে।

হেডস্যার এতক্ষণ খুব কৌতূহলী চোখে আমাদের দিকে তাকিয়েছিলেন। লোকটার কথা শুনে বললেন, আমার বলা তো ঠিক হবে না। আমি তো এর আগে পিছে কিছুই জানি না। প্রফেসর সাহেব যখন এদের অনুমতি চাইছেন, এর পিছনে নিশ্চয়ই কোন। কারণ আছে। আমি তাদের পড়াশোনা করতে বলতে পারি, হোমওয়ার্ক করতে বলতে পারি, কিন্তু এটা তো বলতে পারি না।

আমি আর সলীল কৃতজ্ঞ চোখে হেডস্যারের দিকে তাকালাম। কখনো বুঝতে পারিনি স্যার এরকম একটা কথা বলবেন। মনে করেছিলাম, কাগজটাতে সাইন করার জন্যে এমন একটা ধমক দেবেন যে, আমরা একেবারে কাপড় ভিজিয়ে ফেলে ছুটে গিয়ে সাইন করব।

চশমা চোখের লোকটি তার গোঁফে টান দিতে দিতে হেডস্যারের দিতে ঝুঁকে পড়ে বলল, কিন্তু স্যার, আপনি বুঝতে পারছেন না! অনেক বড় বিজনেস ডিল, একজন মানুষের পাগলামির জন্যে তো নষ্ট হতে পারে না।

পাগলামো?

অফকোর্স। প্রফেসর সাহেব বদ্ধ পাগল। জেলখানায় না হয় পাগলা গারদে আটকে রাখার কথা। বয়স্ক মানুষ, একটা গাছের উপর বসে থাকে, চিন্তা করতে পারেন?

মোটেও পাগল না। আমি গলা উঁচিয়ে বললাম, জারুল চৌধুরী মোটেই পাগল না। অনেক ভালমানুষ।

টাক মাথার মানুষটি হঠাৎ গলা উঁচিয়ে বলল, দেখি, আমি দুজনের সাথে একটু কথা বলে দেখি। আস খোকারা, আমার কাছে আস। কি যেন নাম জামাল আর কি —

সলীল আর মুনীর।

ও আচ্ছা। সলীল আর মুনীর। আস, কাছে আস।

আমরা এগিয়ে গেলাম।

বুঝেছ খোকারা, এটা অনেক বড় ব্যাপার। দেশের উন্নতির জন্যে কলকারখানা তৈরি করতে হয়, বাড়িঘর তৈরি করতে হয়। তার জন্যে ইট লাগে, সিমেন্ট লাগে। ইট তো আর গাছে ধরে না, ইট তৈরি করতে হয়। সে জন্যে ইটের ভাটা খুব জরুরি। আর তাই আমাদের এই জায়গাটা দরকার। এমনিতে পড়ে আছে, জংলা জায়গা, সাপখোপের আড্ডা। তোমাদের কি দেখে ভাল লাগল কে জানে। যাই হোক, ভাল যখন লেগেছে তোমরা এখানে যখন খুশি বেড়াতে আসবে। আমি বলে রাখব, যখন খুশি তোমরা আসতে পারবে।

ইটের ভাটায়?

মানুষটা না শোনার ভান করে বলল, তোমরা যদি এই কাগজটায় সাইন করে দাও তাহলে কি করব জান?

কি?

দুইজনকে দুইটা সাইকেল কিনে দেব। নতুন সাইকেল। একেবারে ব্ৰাণ্ড নিউ। কি বল, হ্যাঁ?

নতুন সাইকেল? আমার বুকের ভিতর একেবারে ছলাৎ করে উঠে। সলীল অবশ্যি গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ল, বলল, সাইকেল চাই না।

তাহলে কি চাও?

কিছু চাই না।

মানুষ দুজন চোখ দুটি দিয়ে আগুন বের করে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। আমরা চোখ সরালাম না, বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। খানিকক্ষণ এভাবে কেটে গেল, তখন হঠাৎ একজন উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলে একটা থাবা দিয়ে বলল, এই জন্যে সব সময়। বলি পাগল ছাগলের সাথে কখনো বিজনেস করতে হয় না।

অন্যজনও তখন উঠে দাঁড়াল, টেবিল থেকে কাগজটা নিয়ে কুটিকুটি করে ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলল, ছেলেপিলে ঠিক করে মানুষ হয় না আজকাল। আমাদের সময় শক্ত পিটুনি দেয়ার নিয়ম ছিল, বেয়াদব ছেলেরা একেবারে সিদে হয়ে যেতো।

হেডস্যার হাসি হাসি মুখে বললেন, আমি মাস্টার মানুষ, আমিও বেয়াদপি একেবারে সহ্য করি না। আমার ছেলেরা আর যাই করুক কোন বেয়াদবি করেনি।

মানষ দুইজন নাক দিয়ে এক ধরনের শব্দ করতে করতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। হেডস্যার সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মাথা নাড়লেন, তাঁকে দেখে মনে হতে লাগল যেন খুব মজার একটা জিনিস দেখেছেন।

আমি হেডস্যারের দিকে তাকিয়ে বললাম, যাব স্যার আমরা?

যাও।

আমরা বের হয়ে যাচ্ছিলাম, হেড স্যার আবার জিজ্ঞেস করলেন, দিনরাত শুধু বন জংগলে ঘোরাঘুরি কর, নাকি পড়াশোনাও কর?

পড়াশোনাও করি স্যার।

রোল নাম্বার কত?

তিন।

হেডস্যার আমার দিকে তাকালেন, আমি উদাস উদাস মুখ করে বললাম, তেইশ!

তেইশ? পড়াশোনা করলে রোল নাম্বার তেইশ হয় কেমন করে?

আমি কিছু বললাম না, বলার কিছু ছিলও না। হেডস্যার বললেন, যাও ক্লাসে যাও।

আমরা বের হয়ে যাচ্ছিলাম, হেডস্যার আবার আমাদের থামালেন, যে জায়গাটা নিয়ে এত হৈ চৈ সেটা কি আসলেই সুন্দর?

জ্বী স্যার। অপূর্ব সুন্দর জায়গা। সলীল হাত নেড়ে বলল, আপনি দেখলে মুগ্ধ হয়ে যাবেন।

একবার নিয়ে যেও তো আমাকে।

নিয়ে যাব স্যার। আপনি বললে আমরা নিয়ে যাব। আপানার যখন ইচ্ছে।

আর ঐ প্রফেসর সাহেব, সত্যিই কি গাছের উপর থাকেন?

সব সময় না স্যার, মাঝে মাঝে। গাছের উপর চমৎকার ঘর স্যার, থাকতে কোন অসুবিধে নেই।

ও, আচ্ছা। ঠিক আছে তোমরা যাও।

আমরা বাইরে যেতে যেতে দেখলাম, হেড স্যার জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন। বাইরে দুটি বড় বড় গাছ, স্যার সেই গাছের দিকে কেমন জানি একরকম মুখ করে তাকিয়ে আছেন। কে জানে স্যারের হয়তো ছেলেবেলার কথা মনে পড়েছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *