রণজিৎবাবু বললেন, “খুব বেঁচে গিয়েছেন, চঞ্চলবাবু। আর একটু হলেই আপনার মাথার খুলিটা গিয়েছিল।”
চঞ্চল বললে, “মাথাটা যে আস্ত আছে এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না।” হাসবার চেষ্টা করলে বটে, কিন্তু বুকের ভেতর তার ধড়াস ধড়াস করছে, মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে।
মহিমবাবু অতি কষ্টে উচ্চারন করলেন, “একটু জল।”
রণজিৎবাবু বললেন, “বরং এক পেয়ালা চা খান, মহিমবাবু, সুস্থ বোধ করবেন।”
দু তিন ঢোঁক জল খেয়ে মহিমবাবু বললেন, “ উঃ, কী ভয়ানক! কী ভয়ানক! আপনাকে সুদ্ধু ফেলতে চায়! মস্ত একটা ক্রিমিন্যাল গ্যাঙ পিছনে লেগেছে, কী উপায় হবে, রণজিতবাবু?”
মহিমবাবু চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলেন।
রণজিৎবাবু একটু হেসে বললেন, “আপনার টেবিলের তলায় ঢোকাটা কিন্তু ভারি চমৎকার হয়েছিল আচ্ছা বিশ্রাম করুন, আমি ব্যাপারটার একটু তদন্ত করে আসি।”
ইন্সপেক্টরের মুখে এ রকম হালকা কথা শুনে চঞ্চলের শরীরটা যেন জ্বলে গেল। সে না বলে পারলে না, “একটু আগে, আপনার মুখের চেহারাও ঠিক বীরের মতো দেখা যাচ্ছিল না, ইন্সপেক্টরবাবু?”
“রণজিৎবাবু নির্লজ্জের মতো বললেন, “ওরে বাবা বন্দুকের গুলির সামনে বীরত্ব! চাচা, আপন বাঁচা।”
এ কথা বলেই তিনি কামরা থেকে বেরিয়ে গেলেন, চঞ্চল অত্যন্ত বিরক্ত মনে গুম হয়ে বসে রইল। মহিমবাবুও চোখ বুজে চুপ।
দিন দুপুরে কলেজ স্কোয়ারের উপরে এমন একটা কাণ্ড – রাস্তায় প্রকাণ্ড ভিড় জমে গেছে, তাদের চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে, তেতলার ঘরে বসেও। মহিমবাবু যেখানে বসেন তার ঠিক পিছেই একট মস্ত খোলা জানলা, জানলার উল্টোদিকে আর একটা তেতলা বাড়ি, মাঝখানে সরু গলি। সেই উল্টোদিকের বাড়ির একটা জানলা আর এ জানলা একেবারে মুখোমুখি। সে বাড়ি থেকেই কেউ যে এ কাণ্ড করেছে তাতে সন্দেহ নেই।
গুলির আওয়াজ হবার সঙ্গে সঙ্গেই নীচে রণজিৎবাবুর কনেস্টবলরা একটা কাজ করেছিল প্রাণপণে তাদের হুইসল বাজিয়ে দিয়েছিল, সঙ্গে সঙ্গে চারদিকের রাস্তা থেকে পুলিশ এসেছিল ছুটে, এখন ‘হরকরা’ আপিসের সামনে এক বিচিত্র দৃশ্য। পিছনের গলিও পুলিশে ভর্তি, দেখতে দেখতে সার্জেণ্ট এল চার পাঁচজন, আমহার্স্ট স্ট্রিট থানা থেকে দুজন দারোগা এল, কিন্তু গুলি ছুঁড়ল তার একেবারেই কোনো পাত্তা মিলল না।
প্রায় আধঘণ্টা পর রণজিৎবাবু ফিরে এলেন। মহিমবাবুর টেবিলের উপর বন্দুকের গুলিটি রেখে বললেন, “এটি পাওয়া গেছে আপনার টাইপিস্টের টেবিলের তলায়। এ ছাড়া আর কিছুই পাওয়া গেল না।”
চঞ্চল বেশ একটু ঝাঁঝাল সুরেই বললেন, “সে রকম আশাও আমরা করিনি।”
তার কথার কোনো জবাব না দিযে ইন্সপেক্টরবাবু বলতে লাগলেন, “উল্টোদিকের বাড়িটা দু মাস ধরে খালি পড়ে আছে। সদর দরজা তালা বন্ধ।”
“তাতে তো ডাকাতের আরও সুবিধে।”
“আমরা তালা ভেঙে ভিতরে ঢুকে তন্ন তন্ন করে খুঁজলুম, কোনো হদিশ মিলল না। এই জানলার মুখোমুখি ঘরটা অবশ্য খোলা ছিল, কিন্তু আশ্চর্য এই যে গলির দিকের জানলাটা ছিল বন্ধ।”
“তা পালাবার আগে জানলা বন্ধ করতে কতক্ষণ।”
“জানলার কাচে কি দেয়ালে কোথাও আঙুলের ছাপ নেই, ঘরে অনেকদিনের ধুলো জমে আছে, পায়ের ছাপ নেই।”
“ইন্সপেক্টরবাবু, যারা এত পারে তারা পায়ের আঙুলের ছাপ লুকোতেও জানে।”
“তাও বটে, তাও বটে,” বলে রণজিৎবাবু মাথা চুলকোতে লাগলেন। একটু পরে বললেন, “আচ্ছা চঞ্চলবাবু, আপনার মনে আছে, আমরা যখন এখানে বসে ছিলাম, ঐ জানালাটা খোলা ছিল না বন্ধ ছিল?”
চঞ্চল একটু ভেবে বললে, “কী যেন, আমার ঠিক মনে পড়ছে না।”
মহিমবাবু বললেন, “বন্ধ থাকলেই বা কী! একটুখানি ঘুলঘুলি ফাঁক করে নিয়েও রিভলভার ছোঁড়া যায়।”
রণজিৎবাবু তৎক্ষণাৎ বললেন, “সে কথা ঠিক। তারপর একতলায় দোতলায় আপনার প্রেস ও আপিসও খোঁজা হল – যদি কোথাও লুকিয়ে থাকে -”
মহিমবাবু একটু হেসে বললেন, “তার চাইতে সটান আমার কাছে এসে ধরা দিতেও তো পারত।”
“পালাবার পথ না পেলে, ধরা তো দিতই। পালাল কেমন করে তাই ভাবছি।”
চঞ্চল বললে, “আপনার পদ্ধতিতে ভাবাটা বড্ড বেশি হচ্ছে, কাজ সে তুলনায় কম।”
“তাই তো, ভারি জব্দ হয়ে গেলাম লোকটার কাছে। দিনে দুপুরে এতগুলো পুলিশের নাকের তলা দিয়ে বেমালুম সরে পড়ল। আশ্চর্য!”
চঞ্চল বললে, “এটা বোঝ যাচ্ছে যে পরীক্ষিৎবাবুকে যারা সরিয়েছে, মহিমবাবুর উপরেও তাদের রাগ কম নয়।”
মহিমবাবু ফ্যাকাশে একটু হেসে বললেন, “হবেই বা না কেন! এ ব্যাপারটা নিয়ে ‘হরকরা’ যে রকম উঠে পড়ে লেগেছে, তেমন তো আর কেউ লাগেনি। পাবলিক ওপিনিয়ন ক্ষেপিয়ে তুলতে পারলে ব্যাপারটার একটা হদিশ হবেই।”
রণজিৎবাবু বললেন, “হ্যাঁ, আপনি একটু সাবধানেই থাকবেন, মহিমবাবু। লোক ওরা সুবিধের নয়।”
“আমার আর সাবধান আর অসাবধান। কাজ করে যাব – তারপরে যা হবার হবে।… দেখুন, আমার মনে হয় ঐ উপেন ধর লোকটাকে ধরতে পারলেই সমস্যার সমাধান হয় যায়।”
“চেষ্টা তো কারছি, কিন্তু …”
রণজিৎবাবুর কথা শেষ হল না – উসকোখুসকো চুল, চোখ ঘোলাটে বিজয়বাবু ঝড়ের মতো ঘরে এসে ঢুকলেন। একখানা খামে ভরা চিঠি মহিমবাবুর সামনে টেবিলের উপর ফেলে দিয়ে হাঁপাতে লাগলেন, ধপাস করে একটা চেয়ারে বসে পড়ে।
মহিমবাবু ব্যস্তভাবে বললেন, “কী, বিজয়? কী খবর?”
“খবর… এই চিঠি। এই যে রণজিৎবাবুও আছেন দেখছি। ভালোই হল।”
বিজয়বাবু মোটাসোটা নাদুসনুদুস চেহারার উপর দিয়ে যেন ঝড় বয়ে গেছে, চোখে পড়েছে কালি, মুখে পান নেই, তাঁর এমন রুক্ষ লক্ষ্মীছাড়া মূর্তি কেউ কখনও দ্যাখেনি।
মহিমবাবু বললেন, “একটা ডাব আনিয়ে দিই, বিজয়? না একটা কোল্ড ড্রিঙ্ক? বড্ড শুকনো দেখাচ্ছে তোমাকে।”
“না না – আমার কিচ্ছু লাগবে না। চিঠিটা দেখুন।”
খামটা খোলাই ছিল, মহিমবাবু ভিতর থেকে চিঠিটা বের করলেন। খুলে চোখের সামনে ধরেই বলে উঠলেন, “এ কী! এ যে দেখছি পরীক্ষিতের -”
সত্যিই তাই, পরীক্ষিৎবাবু লিখেছেন:
“বিজয়,
আমি এখন বন্দী। আছি ডায়মণ্ড হার্বারে, নদীর ধারে একটি বাংলোয়। বাড়িটা যেমন মস্ত, তেমনি পুরোনো। এর বেশি লিখতে পারব না। মহিমকে খবর দিও।
তোমার দাদা”
চিঠিটা হাতে হাতে অনেকবার ঘোরাঘুরি করল। পুরোনো ময়লা দুমড়োনো এক টুকরো কাগজে পেনসিলের অস্পষ্ট লেখা। সেরকমই আর একটা কাগজ জোড়া লাগিয়ে কোনোরকমে খাম তৈরি হয়েছে। বেয়ারিং চিঠি। ডাকঘরের ছাপ, ডায়মণ্ডহার্বারের বটে।
কয়েক মিনিট কেউ কোনো কথা বললে না।তারপর মহিমবাবু বললেন, “চিঠিটা যে জাল নয়, তার কী প্রমাণ?”
“হাতের লেখা দাদারই বটে,” বললেন বিজয়কৃষ্ণ।
“মনে তো হচ্ছে তাই, তবে…”
বিজয়বাবু অধীরভাবে বললেন, “তবে আবার কী? কত কষ্টে একটু কাগজ পেনসিল জোগাড় করে দাদা লিখেছেন। হাতের লেখা একটু আঁকা বাঁকা তো হবেই। মহিমবাবু, ইন্সপেক্টরবাবু, আপনারা … আপনারা দাদাকে উদ্ধার করুন,” বলতে বলতে বিজয়বাবুর গলা প্রায় ধরে এল।
“আহা, বিজয়, ও রকম কর না, একটু শান্ত হও।”
চিঠিটা রণজিৎবাবুর হাতে ধরা ছিল, তিনি সেটা পকেটে ভরে বললেন, আচ্ছা আমি এখন উঠি।”
বিজয়বাবু কাতরস্বরে বললেন, “তাহলে…”।
“আপনি ভাববেন না, যা ব্যবস্থা করবার সবই করা হবে।”
“এক্ষুণি বাড়িটাকে পুলিশ দিয়ে ঘেরাও করিয়ে ফেলুন। কে জানে, দেরি হলে ওরা যদি আবার সরিয়ে ফ্যালে।”
“হ্যাঁ, সেইরকমই কিছু একটা করতে হবে। …মহিমবাবু, আজ মোহনবাগানের খেলা দেখতে যাবেন না?”
মহিমবাবু অবাক হয়ে বললেন, “আপনি যাচ্ছে নাকি?”
“ভাবছি তো ধন্য মোহনবাগান! এত হেরে এত নাম জগতের আর কোনো টিম করেছে বলতে পারেন?”
চঞ্চল বলে উঠল, “আপনি দেখছি খেলা নিয়ে মেতে উঠলেন। এদিকে পরীক্ষিৎবাবু-”
“আর কয়েক ঘণ্টা সমুদ্রের হাওয়া খেলে পরীক্ষিৎবাবুর ক্ষতি হবে না। ব্যাপারটা তো বলতে গেলে চুকেই গেছে। আজ কালীঘাটের সঙ্গে খেলা। মোহনবাগান ক’গোলে হারবে তাই ভাবছি।”
চঞ্চল আরও তীব্রস্বরে কী একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু মহিমবাবু তার আগেই বললেন, “চঞ্চল, তুমি নীচের ঘরে গিয়ে বিকেলের এডিশনে এই চিঠিটার খবর দিযে এস। ডবল কলম নিউজ। চিঠিটার নকল আমি তক্ষুনি রেখেছিলাম – এই নাও। আর এই গুলি ছোঁড়ার ব্যাপারটাও দিতে হবে। শুনেছ তো, বিজয়, এদিককার কাণ্ড।”
“আপনার আপিসে ঢোকবার আগেই শুনেছি। আমাকে আর কিছু বললেন না, আমার আর সহ্য হচ্ছে না। উঃ!” বিজয়বাবু টেবিলের উপর দু হাতে মুখ ঢাকলেন।
চঞ্চল তার টেবিলে গিযে লিখতে বসল, রণজিৎবাবু বিদায় নিলেন। বিজয়বাবু মাথা তুলে বললেন, “এই ইন্সপেক্টরকে দিযে কোনো কাজ হবে বলে তো মনে হয় না। তিনি চললেন ফুটবল খেলা দেখতে।”
মহিমবাবু বিজয়ের পিঠে হাত রেখে বললেন, “তুমি ভেব না, বিজয়, এ ব্যাপারটার কুল কিনারা না করে আমি ছাড়ছিনে। আমাকে একটু বেরুতে হচ্ছে। তুমি বসবে।”
বিজয়কৃষ্ণ উদ্ভ্রান্তভাবে বললেন, “আমি বাড়ি ফিরে যাই।”
“বাড়িতে ভালো না লাগলে বরং আমার সঙ্গেই চল।”
“তাই চলুন।”