আমার অবিশ্বাস
এ-বইয়ের পরিচ্ছেদগুলো লেখার সময় মনে পড়ছিলো ম্যাথিউ আরনল্ডকে, যিনি একশো তিরিশ বছর আগে, ১৮৬৭তে, দেখেছিলেন আলো নিভে আসছে ফরাশি উপকূলে, আর সমুদ্রের ভাটার টানে শুনেছিলেন বিষাদের সুর। সমুদ্রের ভাটার টানে তিনি পেয়েছিলেন একটি রূপক-ধর্মীয় বিশ্বাসের অবসানের রূপক; এবং লিখেছিলেন একটি মহান কবিতা : Dover Beach। বাঙলায় এমন কবিতা কেউ লেখেন নি- (বহু পরে সুধীন্দ্রনাথ বেদনাহীনভাবে ঘোষণা করেছিলেন ‘শূন্যগর্ভ পুরাণ-সংহিতা’); আমাদের কবিদের হয়তো সমুদ্রের স্বরের সাথে বিশেষ পরিচয় নেই, এবং এখনো হয়তো তাদের বিশ্বাসের সমুদ্রে চলছে প্রচণ্ড জোয়ার। বিশ্বাস অধিকাংশ মানুষের জন্যেই এক বড়ো আশ্ৰয়;—তা কোনো আশ্ৰয়ই দিতে পারে না, কিন্তু তারা মনে করে কোনো এক মহাশক্তিমান সব সময়ই তাদের সাথে রয়েছেন অভিভাবক হিশেবে। এক চমৎকার মতিভ্ৰম সুখী ক’রে রাখে তাদের। আমার এক ছাত্রীও একদিন বিচলিত হয়ে কেঁপে কেঁপে বলেছিলো, স্যার, বিশ্বাস না করলে আমরা বাঁচবো কী নিয়ে, আমরা কি নিঃস্ব হয়ে যাবো না, শূন্য মনে হবে না। নিজেকে? আমাদের কী থাকবে?? আমি জানি বিশ্বাস মানুষকে শান্তি দেয়, নির্বোধ সুখে রাখে; কিন্তু শান্তি আর সুখ গর্দভদেরই উপভোগ্য, মানুষের নয়। বিশ্বাসকে যারা করেছে জীবনের বড়ো আশ্রয়, তারা ওটি হারাতে ভয় পায়; কেননা বিশ্বাসে। তারা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তাদের সুখে রাখে অভ্যাস, তারা ভয় পায় অভ্যাস থেকে স’রে যেতে। একদিন মানুষ যখন মুক্ত হবে অলৌকিক বিশ্বাস থেকে, তারা ভয় পাবে না; কেননা অভ্যাস আর প্রথা তাদের পীড়ন করবে না। বিশ্বাস না থাকলেও জীবনে অনেক কিছু থাকে; সে-সবের জন্যেই জীবন যাপন করার উপযুক্ত। বিশ্বাসের থেকে বারান্দার চড়ুইটিও জীবনের জন্যে অনেক মূল্যবান; চড়ুইটি যা দিতে পারে বিশ্বাস তা দিতে পারে না। আমি বারবার বলেছি—‘জীবন তাৎপর্যহীন’; এটা ভীতিকর মনে হবে অনেকের: আবার কেউ কেউ বলতে পারেন- ‘তাৎপর্য? তাৎপর্য থাকতে হবে কেনো জীবনের? আমার জীবন আছে, একদিন থাকবে না। এই তো সব।’ আমাদের সমাজ আদিম; এখানে প্রশ্ন নেই, তাই যন্ত্রণাও নেই, রয়েছে বিভ্রান্ত বিশ্বাসের নিরন্তর নির্বোধ উত্তপ্ত উদ্দীপনা।
ম্যাথিউ আরনল্ড ভিন্ন সমাজের, তিনি কবি ও জ্ঞানী; তিনি দেখেছিলেন শেষ হয়ে আসছে বিশ্বাসের কাল; এবং তারই মনে হয়েছিলো যে একদিন কবিতাই নেবে ধর্মের স্থান। আমি অবশ্য কবিতাকে ধর্মের মতো নিরর্থক মনে করি না; কবিতা ধর্মের স্থান নেবে—এটাও এক সুন্দর বাজেকথা; কবিতা থাকবে কবিতা হয়েই, কবিতাকে অন্য কারো জায়গা জুড়ে বসতে হবে না। অন্যদের তুলনায় তিনি বেশ আগেই দেখেছিলেন সত্যটি যে বিশ্বাসের সমুদ্রে ভাটা চলছে; কয়েক বছরের মধ্যেই দেখা যায়। আরনল্ড যা বোধ করেছিলেন আবেগের ভেতর দিয়ে, রূপায়িত করেছিলেন যা রূপকে, একদল জ্ঞানী তা দেখছেন মগজ দিয়ে, এবং লিখছেন বিধ্বংসী বইপত্র। বেশ সংকটে তখন ইউরোপি সভ্যতার সব কিছু, তবে সবচেয়ে সংকটে ধর্ম। ডারউইন জীবন সৃষ্টির দায়িত্ব থেকে তখন মুক্তি দিয়েছেন বিধাতাকে, আর নিটশে ঘোষণা করেছেন বিধাতা মৃত’; তবে এগুলো নয়, ধর্মকে সবচেয়ে বেশি আহত করেন ধার্মিকেরাই। গবেষকেরা তখন বিকাশ ঘটাচ্ছিলেন এমন এক খ্রিষ্টধর্মীয় বিদ্যার, যার নাম উচ্চতর সমালোচনা’ (আহা, কবে যে এ-বিদ্যার বিকাশ ঘটবে নবীন ধর্মগুলো নিয়ে); আর এ-বিদ্যাই বাজিয়ে দেয় বিশ্বাসের মৃত্যুঘণ্টা। ১৮৬০-এ বেরোয় প্রবন্ধ ও সমালোচনা নামে যাজকদের লেখা একটি বই, যাতে তাঁরা দাবি করনে খ্রিস্টধর্মীয় বইগুলোকেও বিচার করতে হবে অন্যান্য বইয়ের মতোই। এতে শুরু হয় কোলাহল, এবং তাদের বিরুদ্ধে আনা হয় ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগ, ফরাসি দেশে বেরোয় আর্নেস্ত রেনাঁর জেসাসের জীবন, জর্মনিতে বেরোয় স্ট্রাউসের একই বিষয়ের বই। ওয়েলহাউসেন ইসরায়েলের ইতিহাস নামক বইতে দেখান যে পুরোনো বাইবেলের কিছু অংশ লেখা হয়েছিলো মোজেসের অন্তত এক হাজার বছর পর। এটা এক বড়ো আঘাতের মতো দেখা দেয়, কেননা এতোদিন বিশ্বাস করা হতো বাইবেল হচ্ছে বিধাতার নিজের বাণী: তাই কোনো সন্দেহ নেই। এ-বইয়ে। ১৮৭২ সালে জর্জ স্মিথ দেখান যে নুহের প্লাবনের উপাখ্যান আসলে এসেছে ব্যাবিলনের এক উপাখ্যান থেকে। এটা আরেক বড়ো আঘাত দেয় বিশ্বাসীদের মনে। দেখানো হয় যে বাইবেলের অনেক কিছুরই মিল রয়েছে ব্যাবিলন ও অন্যান্য প্রাচীন জাতির উপাখ্যানের সাথে, যাদের সংস্পর্শে আসতে হয়েছিলো ইহুদিদের। এর ফলে ধ’সে পড়তে থাকে ইহুদি ও খ্রিস্টধর্মীয় বিশ্বাস। আরনল্ড শুনেছিলেন বিষাদের সুর; এ-বইগুলো কোনো সুর ধ্বনিত করে না, চারদিকে ছড়িয়ে দেয় ভেঙে পড়ার প্রচণ্ড শব্দ।
বিশ্বাসের অবসানের কাল এসে গেছে, ভাটায় গড়াচ্ছে তার সমুদ্ৰ—আরনল্ড এটা অনুভব করেছিলেন অনেকেরই আগে। বেদনা বোধ করেছিলেন তিনি, তবে হাহাকার করেন নি। ওই বেদনা থেকে জন্মেছিলো তার মহান কবিতা ‘ডোভার সৈকত’। তাঁর কবিতাটিকে শুধু ধর্মীয় বিশ্বাসের ভাটার কবিতা মনে হয় না। আমার; সমস্ত বিশ্বাসের ভাটার কবিতাই মনে হয়। এটিকে। কবিতাটি পড়তে ইচ্ছে করছে আমার। কবিতাটি অনুবাদ করতে চাই আমি।
ডোভার সৈকত
ম্যাথিউ আরনল্ড
সমুদ্র প্রশান্ত আজ রাতে।
ভরা জোয়ার এখন, ভাসে রূপবতী চাঁদ
প্ৰণালির জলের ওপরে;—ফরাশিদেশের উপকূলে
আলো মৃদু হয়ে নেভে গেলো এইমাত্র; বিলেতের উপকূলশৈলগুলো,
মৃদু আলোকিত ও বিস্তৃত, দাড়িয়ে রয়েছে শান্ত উপসাগরের থেকে মাথা তুলে।
জানালার ধারে এসো, কী মধুর রাতের বাতাস!
শুধু, পত্রালির দীর্ঘ সারি থেকে
যেখানে সমুদ্র মেশে চাঁদের আলোয় শাদা তটদেশে,
শোনো! তুমি শোনো ঢেউয়ের টানে স’রে-যাওয়া নুড়িদের
ঘর্ষণের শব্দ, এবং অবশেষে,
যখন ফিরে আসে উচ্চ বালুময় তটে,
শুরু হয়, আর থামে, তারপর শুরু হয় পুনরায়,
কোলাহলপূর্ণ ধীর লয়ে, এবং বয়ে আনে
মনে বিষাদের চিরন্তন সুর।
সোফোক্লিজ বহুকাল আগে
শুনেছিলেন এ-সুর অ্যাজিআনে, আর এটা তাঁর মনে
বয়ে এনেছিলো মানুষের দুর্দশার
ঘোলাটে জোয়ার-ভাটা; আমরাও
এই শব্দে পাই একটি ভাবনা,
সেই সুর শুনে এই দূর উত্তর সাগরের তীরে।
বিশ্বাসের সমুদ্রও
একদিন ছিলো ভরপুর, এবং পৃথিবীর তটদেশ ঘিরে
ছিলো উজ্বল মেখলার মতো ভাঁজেভাঁজে।
কিন্তু এখন আমি শুধু শুনি
তার বিষণ্ণ, সুদীর্ঘ, স’রে-যাওয়ার শব্দ,
স’রে যাচ্ছে, রাত্রির বাতাসের শ্বাস, বিশাল বিষণ্ণ সমুদ্রতীর,
আর বিশ্বের নগ্ন পাথরখণ্ডরাশি থেকে।
আহা, প্ৰিয়তমা, এসো আমরা
সৎ হই একে অপরের প্রতি! কেননা এই বিশ্ব, যা আমাদের সামনে
স্বপ্নের দেশের মতো ছড়িয়ে রয়েছে বলে মনে হয়,
যা এতো বৈচিত্ৰপূৰ্ণ, এতোই সুন্দর, এমন নতুন,
তার সত্যিই নেই কোনো আনন্দ, কোনো প্রেম, কোনো আলো,
নেই কোনো নিশ্চয়তা, নেই শান্তি, নেই বেদনার শুশ্রূষা;
আর আমরা এখানে আছি যেনো এক অন্ধকার এলাকায়,
ভেসে যাচ্ছি যুদ্ধ ও পালানোর বিভ্রান্ত ভীতিকর সংকেতে,
যেখানে মূর্খ সৈন্যবাহিনী রাত্রির অন্ধকারে যুদ্ধে ওঠে মেতে।
আরনল্ড শেষে আর অলৌকিক বিশ্বাসে সীমাবদ্ধ থাকেন নি, মুখোমুখি হয়েছেন লৌকিক বিশ্বাসেরও, প্রেম ও দুর্দশাগ্রস্ত পৃথিবীর,–Where ignorant armies clash by night : যেখানে মূর্খ সৈন্যবাহিনী রাত্রির অন্ধকারে যুদ্ধে ওঠে মেতে। আমরা এখন তার থেকেও অন্ধকার সময়ে রয়েছি।
সারাক্ষণ আমি ভাবি না বিশ্বাস-অবিশ্বাস নিয়ে; বিশ্বাসের ব্যাপারটি ভুলেই থাকতে পারি, ভুলেই থাকি; তার থেকে অজস্র আকর্ষণীয়তায় ভারে আছে পৃথিবী ও জীবন। এই রোদ অজস্র বিশ্বাসের থেকে চিরন্তন, এই বৃষ্টি মূল্যবান লাখ লাখ বিশ্বাসের থেকে, কর্কশ। কাকের ডাককেও মনে হয়। পাচ কোটি বিশ্বাসের থেকে সুখকর; আর রয়েছে মানুষের মুখ, মানুষের শরীর, এবং রয়েছে বই। বারট্র্যান্ড রাসেল যখনই উল্লেখ করেছেন ধর্মগুলোর নাম, তখনই নাম করেছেন চারটি ধর্মের : ইহুদি, খ্রিস্টান, ইসলাম, ও সাম্যবাদ। সাম্যবাদ ও ধর্ম তার কাছে, শুনে অনেকেই বিস্মিত হবে এতে প্রথম; কিন্তু তার ব্যাখ্যার পর আর সন্দেহ থাকে না যে ওটিও একধরনের ধর্ম। সব ধর্মই নিয়ন্ত্রণবাদী, সাম্যবাদ ও তাই; তবে এর সীমাবদ্ধতা হচ্ছে এর কোনো বিধাতা নেই। ধর্মগুলো সাধারণত টিকে থাকে রাষ্ট্র নির্ভর ক’রে, কিন্তু রাষ্ট্রের ওপরও থাকতে হয় একজন বিধাতা : রাষ্ট্র ও বিধাতা মিলেই টিকিয়ে রাখে ধর্মগুলোকে। ধর্মের প্রবক্তারা জানেন বিধাতা সরাসরি কাজ করেন না, বাণী দিয়েই শেষ হয় তার কাজ; তাই দখল করতে হবে রাষ্ট্রযন্ত্র; রাষ্ট্রযন্ত্রই তখন কাজ করবে বিধাতার। কয়েক শতাব্দী ধ’রে উৎপীড়িত হয়ে খ্রিস্টানরা যেদিন দখল করে রোমীয় সামাজ্য, তখন থেকে তাদের বিধাতার আর কোনো কাজ থাকে না; তারাই তখন পীড়ন করতে থাকে অন্যদের। ইসলাম ব্যাপারটি বুঝেছিলো শুরুতেই, তাই শুরুতেই দখল করেছিলো রাষ্ট্রযন্ত্র; যা নানা বাক নিয়ে ধারাবাহিকভাবে চলছে এখনো। জয়ীর মতো সফল আর কেউ নয়; কিন্তু জয় উ ৎকর্ষ বোঝায় না, পৃথিবী ভীরে বারবার জয়ী হয়েছে নিকৃষ্ট, পরাভূত হয়েছে উ ৎকৃষ্ট। তবে জয়ী টিকে থাকে।
আমি আর দ্বিতীয়বার জীবন যাপন করতে চাই না: পুনর্জন্ম আর পরলোকে উত্থান আমার কাছে হাস্যকর, এমনকি কেউ যদি আমাকে আবার বাল্যকালে পৌঁছে দিতে পারে, যাপন করতে দেয় আমার ফেলে-আসা বাল্যজীবন, আমি তাতে রাজি হবো না, যদিও বাল্যকাল আমার অত্যন্ত প্রিয়; এবং তা আমাকে দিন দিন আরো ব্যাকুল করছে। বাল্যকালে আমার একটি বড়ো সুখ ছিলো যে বিশ্বাস করতে হতো না। ধর্ম রাড়িখালে গুরুত্বহীন হয়ে উঠেছিলো আমার বাল্যকালেই; ও নিয়ে কেউ মাতামাতি করতো না-কিন্তু এখন মাতামাতি শুরু হয়েছে। আমাদের গ্রামের অধিকাংশ মানুষ নিজেদের মতো ক’রে তাদের বিধাতাকে বিশ্বাস করতেন; বিধাতা বলতে তাঁরা কী বুঝতেন, তা কেউ জানে না। তাদের আমি বেশি মাছিদে, মসজিদকে তারা মছিদ’ বলতেন—শব্দটিকে তারা বাঙলা ক’রে নিয়েছিলেন, যেতে দেখি নি; নামাজ পড়তেও দেখেছি খুবই কম। তাদের সময়ই ছিলো না; সেই সকালে তারা ক্ষেতে যেতেন, চাষ করতেন, বা ধান বুনতেন, বা গরু চরাতেন, তাদের ঘরে ফেরার ঠিক ছিলো না। ধর্মকর্ম ছিলো বিশেষভাবে নারীদের কাজ: তারাও তা যে ঠিকমতো করতেন, তা নয়। মাকে একবার আমি একটি সুরা বলতে বলেছিলাম, মা প্রথম রাজি হয় নি, পরে যখন বলে, দেখতে পাই তা অনেকখানিই ভুল। রাড়িখালের অধিকাংশই ধর্মের পদগুলো ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারতেন না, আজো পারেন না; কিন্তু তাতে তাদের কিছু যায় আসে নি। এখন অবশ্য রাড়িখালে আমি অদ্ভুত শাদা লম্বা পোশাক পরা লোকদের ঘুরতে দেখি, যখনই গ্রামে যাই, তারা রাড়িখালের নয়, তাদের ভাড়া ক’রে আনা হয়েছে; আর তারা যখন ওই অদ্ভুত পোশাক প’রে পথ দিয়ে হাটে রাড়িখালের চাষীরা নরকের ভয়ে হয়তো কেপে ওঠে। রাড়িখালে এখন মাইক্রোফোনে ধৰ্মচর্চা হয়, যেমন ডিশ অ্যান্টেনায় চর্চা হয় সংস্কৃতির। কিন্তু পাতার ফাঁক দিয়ে ভোরে কারো মধুর কণ্ঠ ভেসে আসে না, ভেসে আসে মাইক্রোফোনের ঘড়ঘড় শব্দ। কয়েক দিন আগে ভোরের আগে আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো; হঠাৎ আমি চারদিক থেকে ছুটে আসা অজস্র মাইক্রোফোনের প্রচণ্ড ও অস্পষ্ট শব্দে কেঁপে উঠি। কোনোটির কথাই বুঝতে পারছিলাম না। আমি, যদিও আমি বোঝার খুবই চেষ্টা করছিলাম; আমি শুনতে পাচ্ছিলাম। শুধু নিরন্তর গোলমাল। আমি শুনেছি। একদিন না কি পবিত্র বইগুলোর অক্ষর রাশি মুছে যাবে, পবিত্র শ্লোকগুলো অর্থের বদলে প্রচার করবে: গোলমাল। সে-সময় কি এসে গেছে। এরই মাঝে?
ইস্কুলে যতোই ওপরের ক্লাশে উঠতে থাকি আমি. ততোই আমার সুখ কমতে থাকে; দেখতে পাই বইগুলো বিশ্বাস করতে বলছে, অনেকের স্তব করতে বলছে। ইতিহাস বই পড়তে গিয়ে মুগ্ধ না হয়ে আমি হয়ে উঠি সন্দেহপরায়ণ; ওই বইগুলোতে দেখি রাজাদের সম্পর্কে উচ্ছাস, যা আমার ভালো লাগে নি। বাঙলা বইগুলোতে যাদের লেখা থাকতো, শেষ দিকে থাকতো তাদের জীবনীও ওই জীবনীতে খুবই প্রশংসা করা হতো তাদের, কিন্তু আমি বুঝে উঠতে থাকি যে ওই লেখকেরা অতো প্রশংসা পেতে পারেন না। মোঃ বরকতউল্লাহর দু-তিনটি লেখা পড়তে হয়েছিলো ওপরের শ্রেণীতে; লেখকপরিচিতিতে বলা হয়েছিলো তিনি দার্শনিক, ওই বয়সে দার্শনিক কী, তা ঠিক বুঝে উঠতে পারি নি, কিন্তু বুঝতে পারি যে তাঁর লেখায় কোনো প্রশ্ন নেই, নানা ভক্তি আছে, কতকগুলো পুরোনো কথা আছে। একটি লেখায় শেখ সাদিকে তিনি এক অলৌকিক মানুষে পরিণত করেন; আমরাও খুব অনুরক্ত হই। সন্দির; কিন্তু প্রতিশ্রুতিমতো বন্ধুর মৃত্যুর দিনে বন্ধুর বাড়িতে তাঁর আসা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় নি আমার, যদিও আমার বন্ধুরা ওই অলৌকিক ঘটনায় অত্যন্ত মুগ্ধ হয়। ওপরের শ্রেণীতে দুটি ঘটনা আমাকে নাড়া দেয়। প্রথমটি হচ্ছে দ্বিতীয় মওলানাসাব এক স্যারকে লাঠি দিয়ে মারতে যান, কেননা স্যার বলেছিলেন ধর্মের বইগুলো গল্পের বই; আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে আমাদের নির্দেশ দেয়া হয় পাকিস্থানের প্রধানমন্ত্রী সোরাওয়ার্দির একটি ভাষণ মুখস্থ করতে। প্রথম ঘটনাটি ইস্কুলে সাড়া জাগিয়েছিলো; দ্বিতীয়টি ঘটেছিলো নীরবে। সবাই ওই বক্তৃতা মুখস্থ করেছিলো, আমি করি নি; আমার মনে হয়েছিলো ওই নিকৃষ্ট বক্তৃতাটি আমি কেনো মুখস্থ করবো? তিনি শক্তিমান ব’লে? আমি কামিনী রায়ের কবিতা মুখস্থ করতে পারি, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ মুখস্থ করতে পারি না।
দিন দিন আমার ভেতরে অবিশ্বাস জমে উঠতে থাকে; মনে হ’তে থাকে যা কিছু চলছে, যা কিছুকে খুবই মহৎ মনে করা হয়, তা অতো মহৎ নয়; যা কিছুকে সত্য মনে করা হয়, তার সবই সত্য নয়; যা কিছুকে মান্য করতে বলা হয়, তার সবই মাননীয় নয়।-কিন্তু আসলেই কিসে অবিশ্বাস আমার? দেখতে পাই আমার অবিশ্বাস শক্তিতে;—যা কিছু শক্তিমান, দর্পশালী, যা কিছু পীড়ন করে মানুষকে, তাতেই ক্রমশ আমার অবিশ্বাস গভীর হতে থাকে। বিনা প্রশ্নে কিছু মেনে নিতে আমার ইচ্ছে করে না; আর যা-কিছু সম্পর্কে কারো কোনো সন্দেহ নেই, যা-কিছুর স্তুতি ক’রে অন্যরা সুখ পায়, সেগুলোতেই আমার বেশি সন্দেহ হতে থাকে। এখানে এখন সবাই শক্তির পূজারী; তারা বিধাতায় বিশ্বাস নাও করতে পারেন, কেননা কল্পিত বিধাতা সরাসরি নিজের শক্তি প্রয়োগ করেন না; কিন্তু তারা বিশ্বাস করেন নেতায়, নায়কে, একনায়কে, পিতায়, রাষ্ট্রপিতায়, প্রথায়, ও আরো অজস্র বস্তুতে; কেননা এগুলো শক্তিমান। আমি শক্তিতে বিশ্বাস করি না, আমি অবিশ্বাস করি শক্তিতে, ক্ষমতায়, দৰ্পে। আমার সমস্ত অবিশ্বাস জন্মেছে শক্তিতে অবিশ্বাস থেকে। শক্তি অমানবিক, শক্তি নিজেকে ছাড়া আর কাউকে মূল্য দেয় না; শক্তি সব ধরনের যুক্তি ও মানবিকতাকে পর্যাদস্ত করতে চায়। নিটশে বিশ্বাস করতেন, এবং ২ নিটশেকে গালি দিয়েও সবাই হিটলারের মতোই বিশ্বাস করে, যে ‘জীবন শক্তিলাভের বাসনা ছাড়া আর কিছু নয়। আমি মেনে নিই। নিটশেকে যে সবাই প্রচণ্ড শক্তি চায়, যারা যতো আদিম তারা ততো বেশি শক্তি চায়;-শক্তি : সীমাহীন, অযৌক্তিক, প্রচণ্ড, অমানবিক; কিন্তু আমি ওই শক্তির প্রতিপক্ষ, আমি তার মুখোমুখি দাঁড়াতে চাই। কামিনী রায় বা জসীমউদদীন আমার শ্রদ্ধেয় পৃথিবীর সমস্ত রাষ্ট্রপতি আর প্রধানমন্ত্রী আর আলেকজান্ডারের থেকে। শক্তিমানেরা তুচ্ছ, তারা ইতিহাসের পরিহাস; তাদের শ্রদ্ধা করার কিছু নেই। আমার ছেলেবেলায় চারপাশে খুবই প্রশংসা শুনতাম হিটলার আর নেপোলিয়নের; আমাদের বইতে তাদের সম্পর্কে লেখাও ছিলো; কিন্তু আমি বুঝে উঠতে পারতাম কেনো তাদের মহাপুরুষ ভাববো। তাদের আমি কখনো মহাপুরুষ ভাবি নি। শক্তি সব সময়ই দূষিত ও ক্ষতিকর, শক্তি রোগের মতো। আমি ঘৃণা করি শক্তি ও শক্তিমানদের, অবজ্ঞা করি শক্তি ও শক্তিমানদের; তারা রোগ; তারা দূষিত করে মানুষকে, নষ্ট করে মানুষের মস্তিষ্ক আর হৃদয়।
ভক্ত কখনো আমি হ’তে পারি নি, যদিও আমি অনেকেরই অনুরাগী। আমি দেখেছি অনেক প্রতিভাবান মানুষও বেঁচে থাকেন কারো উপগ্ৰহরূপে; ওভাবে বেঁচে থাকাতেই গৌরব বোধ করেন তারা, ধন্য হয় তাদের জীবন; এটা আমার কাছে মর্মান্তিক। ভক্ত হ’লে নানা বাস্তব স্বাৰ্থ চরিতার্থ হয়; তবে ভক্ত হওয়ার মূলে থাকে বিশেষ মনস্তাত্ত্বিক কারণ। ভক্তরা মহিমা অর্জন করে দেবতাদের সংস্পর্শে। ভক্তরা জানে, বা তাদের অবচেতন মনে একটি বোধ কাজ করে যে তারা দেবতা হয়ে উঠবে না, কিন্তু দেবতার মহিমা তাদের ভেতরে সঞ্চারিত হোক, এটা তারা চায়; তাই দেবতার পায়ে আত্মোৎসর্গ ক’রে তারা অর্জন করে মহিমা। কোনো কোনো দার্শনিক প্রচার করেন যে মানুষের থাকা উচিত বিশ্বাস করার বাসনা-উইল টু বিলিভ’: আমি এটাকে খুবই বাজে দৰ্শন বলে মনে করি; আমি, অনেকটা রাসেলের মতোই, মনে করি মানুষের থাকা উচিত সন্দেহ করার, এমনকি অবিশ্বাস করার বাসনা। বিশ্বাস খুবই ক্ষতিকর। ধর্মের বইগুলো নির্দেশ দেয় বিশ্বাস করতে, বলে ওগুলোতে প্ৰকাশ পেয়েছে চিরন্তন সত্য; তবে নির্দেশ মাত্ৰই অবিবেচিত শক্তির প্রকাশ। ওগুলোতে যদি সত্যিই চিরন্তন সত্য প্রকাশ পেয়ে থাকে, তাহলে তার চেয়ে ভালো আর কিছুই হ’তে পারে না; কিন্তু আমরা কি একটু বিচার ক’রে দেখতে পারি না কাকে বলে চিরন্তন সত্য? চিরন্তন সত্য হচ্ছে, ওই বইগুলোর মতে, একরাশ নির্দেশ যা মানতে হবে বিনাপ্রশ্নে। ধর্মের বইগুলোর রীতি ঢুকে গেছে আমাদের সব কিছুতে। রবীন্দ্রনাথ এখন বেশ বড়ো রকমের এক দেবতা হয়ে উঠেছেন বাঙালির; আমি তার প্রতিভার অনুরাগী, কিন্তু আমি মনে করি না যে তিনি বিচারের ওপরে।
মানুষ অজস্র ব্যাপার মেনে চলে, বা মেনে চলতে বাধ্য হয়, যেগুলোকে তারা ধ্রুব মনে করে, বিশ্বাস করে বা বিশ্বাস করতে বাধ্য হয় যে, ওগুলোর মধ্যে রয়েছে। মহত্ত্ব। তবে ওগুলোতে নেই কোনো মহত্ত্ব বা ধ্রুবতা, সব বিশ্বাসই অচিরজীবী ও অসার; ওগুলোর বড়ো অংশই আদিম পুরোনো কিছু মানুষের খামখেয়াল বা স্বার্থ বা বিশ্বাসের বাস্তবায়ন। কিছু মানুষ সব সময়ই হয় আত্মগবী উন্মাদ, যারা চায় অন্যদের জীবনকে নিজের চিন্তার মাপে কাটতে ও শেলাই করতে; তাই অধিকাংশ মানুষ নিজেদের জীবন যাপন করতে পারে না, করে পরের জীবন যাপন, কিছু প্রাচীন মানুষের পরিকল্পিত উদ্ভট জীবন। জীবনযাপনে মানুষ প্রাচীন উদ্ভট পরিকল্পনার বন্দী: পুরোনো কালের কিছু মানুষ হাত-পা বেঁধে সাতার কাটার জন্যে ছেড়ে দিয়েছে আধুনিক কালের মানুষদের। তাই মানুষ ভালো নেই, মানুষের অবস্থা খুবই খারাপ; মানুষ যাপন করছে পোকার জীবন। মানুষের সবচেয়ে বড়ো রোগ অবশ্যই দারিদ্র্য, ওই দারিদ্র্যও সৃষ্টি করেছে মানুষ; তবে দারিদ্র্য পেরিয়ে গিয়ে পরিবার, সমাজ, সংস্কৃতি, রাষ্ট্র, সভ্যতায় মানুষ যে-জীবন যাপন করে, তা মানুষকে অসুস্থ অসুখী ছাড়া আর কিছু করতে পারে না। সমাজ, পরিবার, রাষ্ট্র, সভ্যতা একরাশ হাস্যকর বিধিবিধানের সমষ্টি, জমকালো কুচকাওয়াজের মতোই হাস্যকর, তাতে প্রচুর রয়েছে উচ্চরোল, অভিবাদন, দৃঢ় পদক্ষেপ; কিন্তু সবটাই অসার। বিধিবিধান মানুষের স্বভাববিরোধী, কিন্তু বিস্ময়কর হচ্ছে মানুষই তৈরি করেছে বিধিবিধান, আর কোনো প্ৰাণী করে নি। তবে মানুষ কখনোই আন্তরিকভাবে মেনে নেয় নি বিধিবিধান; সাধারণত যারা বিধান তৈরি করে, সেই শক্তিমানদের প্রথম কাজই হয় বিধান ভাঙা, কিন্তু তারা বিধান দিয়ে বেঁধে ফেলে অধিকাংশ মানুষকে। মানুষ ভালো নেই; মানুষের মুখের দিকে তাকালে কারো মুখে আমি ভালো থাকার ছাপ দেখি না;-আরিস্ততলের মুখে দেখতে পাই ভালো না থাকার দাগ, যাজ্ঞবল্কের মুখেও দেখি, সম্রাট ও দসু্যদের মুখে দেখি ওই দাগ, রবীন্দ্রনাথের মুখেও দেখি; ফেরিঅলার মুখেও দেখতে পাই একই দাগ-মানুষ ভালো নেই। আমার মুখেও দেখি একই দাগ।
জীবনে মানুষ জীবন যাপন করে না; যাপন করে অন্য কিছু জীবনযাপনের নামে মানুষ ক’রে চলছে প্রথাযাপন। প্রথা জীবনের শত্ৰু, প্রথা জীবনকে নিরক্ত ক’রে তোলে, তার ভেতর থেকে শুষে নেয় প্রাণ; কিন্তু প্রথায় অভ্যস্ত হয়ে গেলে প্রথাকেই মনে হয় জীবন। অধিকাংশ মানুষ প্রথা যাপন ক’রে গৌরব বোধ করে যে তারা জীবন যাপন করছে। প্রথার হাত এমন তুষারশীতল যে তার ছোয়ায় একান্ত মানবিক উষ্ণ ব্যাপারগুলোও তুষারিত হয়ে যেতে পারে, তাতে আর থাকে না। কোনো মানবিক তাপ। যে-সমাজে প্রথার পরিমাণ যতো বেশি, তার মানুষ ততো মৃত, নিরক্ত, অসুস্থ, বিকৃত, ততো প্রতিভাহীন; সেখানে দিকে দিকে দেখতে পাওয়া যায় লাশ, দেখা যায় বিকৃত অসুস্থ মানুষ। প্রথার বাইরে গেলে মানুষ সুস্থ ও সৎ হয়ে ওঠে, কমে তার কপটতা; তখন সে মানুষ হয়ে ওঠে। প্রথা হচ্ছে সে-সমস্ত বিধান, যেগুলোর কোনো অন্তঃসার নেই, কিন্তু মেনে চলতে বাধ্য হয় মানুষ। প্রথা জীবনের মৃতরূপ, জীর্ণ লোকাচার, স্রোতহীনতা, শৈবালোচ্ছন্নতা। প্রথাগুলো, সাধারণত, মানুষ পায় ধর্ম থেকে; জীবনকে প্রথায়, নিরর্থক রীতিতে, পরিণত করাই ধর্মের কাজ। ধর্মের কোনো উপকারিতা নেই, বস্তুগতভাবে কখনোই প্রমাণ করা যাবে না যে এর রয়েছে উপকারিতা; তবে এর অপকারিত রয়েছে প্রচুর, বস্তুগতভাবে সব সময়ই তা প্রমাণ করা যায়; কিন্তু ধর্ম যেহেতু শক্তিশালী, সব সময় মানুষকে রাখে সামাজিক ও মহাজাগতিক ভয়ের মধ্যে, তাই ধর্মের অপকারিতার কথা কেউ বলে না। মহাজাগতিক ভয়ের থেকে অবশ্য সামাজিক রাষ্ট্রিক ভয়ের পরিমাণ বেশি; কেননা অধিকাংশ সমাজ ও রাষ্ট্র কাজ করে ধর্মের রক্ষীবাহিনীরূপে, তার তৎপরতার কোনো শেষ নেই। ধর্ম ও ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে এক বড়ো সম্পর্ক ধর্মের বিধাতাদের কল্পনা করা হয় সর্বশক্তিধর রূপে, আর ধর্মও ক্ষমতা ছাড়া চলতে পারে না।
বাল্যকাল, এখন, আক্রান্ত তিনটি আদিম শক্তি-রাজনীতি, ধর্ম ও কাম— দিয়ে, যেগুলোর পীড়নে বাল্যকাল থেকে ঝরে যাচ্ছে সমস্ত স্বপ্ন সমস্ত সুখ; আমার বাল্যকাল আক্রান্ত ছিলো একটি আদিম শক্তি-রাজনীতি দিয়ে। গ্রামে গিয়ে পৌছোতো একের পর এক দীর্ঘ দূরবতী নাম : কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ, কায়েদে মিল্লাত লিয়াকত আলি খান, ফিল্ডমার্শাল মােহাম্মদ আইউব খান—এসব গিয়ে পৌছোতো, আমরা এসব নামকে দেবতাদের নাম, যদিও মুসলমানের দেবতা নেই, মনে ক’রে মুখস্থ করতাম; নামগুলো পুরোপুরি বলতাম। যাতে প্রকাশ না পায় অবিনয়। মুসলমানরা নামের ব্যাপারে খুবই স্পর্শকাতর, তারা নামের ডানে বাঁয়ে নানা বস্তু লাগিয়ে থাকে, যা মনে করিয়ে দেয় প্রাচীন আরবের একটি বিশ্বাস যে নামের সাথে রয়েছে যাদুর সম্পর্ক। আরবরা আসল নাম গোপন ক’রে রাখতো, ব্যবহার করতো আবু লাহাব বা আবু হুরায়রার মতো অভিধা, যাতে কেউ যাদু করতে না পারে:-যাদু করার জন্যে দরকার আসল নাম! বাঙালি মুসলমান কেমন পাগল ছিলো ওসব পাকিস্থানি নামে, তা কি আমি দেখি নি? দীর্ঘ দেহের ওই সব ক্ষুদ্র মানুষদের দ্বারা কেমন বিহ্বল ছিলো বাঙালি মুসলমান, তা কি আমি ভুলে গেছি? মুসলমানের কাছে তাদের অতীতের সব নাম ও সৱ কিছু পবিত্র, তাই তাদের সম্পর্কে কোনো কথা বলা যায় না। আমি একবার মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ বলেছিলাম, এক স্যার তাতে অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন, আমাকে দিয়ে কায়েদ আজম বলিয়েছিলেন। তিনি কায়েদে আজম, জাতির পিতা, তিনি ছাড়া মুসলমানরা থাকতো হিন্দুদের চাকর, এসব বলেছিলেন স্যার। তখন থেকেই এসব নামে আমার বিরাগ দেখা দিতে থাকে, ঘেন্না লাগতে থাকে রাজনীতিক দেবতাদের। ছাত্রজীবন থেকে আজ পর্যন্ত নানা রাজনীতিক বিধাতা সম্পর্কে কবিতা লেখার চাপ পড়েছে আমার ওপর;–আমি তা অবহেলা ক’রে গেছি; আমার খুব ভালো লাগে যে আমার বন্ধুরা অবলীলায় রাজনীতিক বিধাতার পর বিধাতা নিয়ে কবিতা লিখে ফেলেন, বিহ্বল হয়ে ঘোষণা করেন যে ওই বিধাতারা না থাকলে থাকতেন না তারা, কিন্তু আমি কখনো ওই রকম আবেগ বোধ করি নি। রাজনীতিকদের আমার কখনো মনে হয় নি মহান, আমি তাদের মধ্যে দেখেছি শক্তি ও অন্তঃসারশূন্যতার যৌগ। রাজনীতির লক্ষ্যই হচ্ছে শক্তি, আর যাঁরা জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত, সারাটি জীবন ব্যয় করেন শক্তির জন্যে, তাঁদের আমার বেশ দানবিক মনে হয়।
কিন্তু আমার মতো সবার মনে হয় না; তারা শ্রদ্ধাভক্তি ক’রে সুখী হন। বাঙলা ভাষা এক সময় সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিলো জিন্নাহ বা কায়েদে আজমকে আশ্রয় ক’রে;–কবি, প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকাররা পাগল হয়ে গিয়েছিলেন ওই ব্যক্তির অলৌকিক মহিমায়। তারা ওই ভদ্রলোকের এতো স্তুতি রচনা করেছিলেন, যা অনেক আর্য দেবতারও ভাগ্যে জোটে নি। আবুল ফজল, পরে যিনি জাতির বিবেক ব’লে গণ্য হন এবং আরো পরে যিনি বিবেকচুৰ্য্যত হয়ে এখন কাটাচ্ছেন নির্বাসনের কাল, একটি নাটক লিখেছিলেন মোহাম্মদীতে। পুরোনো ওই পত্রিকাটি আমি পেয়েছিলাম। আমাদের বাসার পুরোনো বইপত্রের মধ্যে; কায়েদে আজমকে নিয়ে লেখা নাটকটি পড়ে চঞ্চল হয়ে উঠেছিলাম আমি। কী শোচনীয় সামান্য মানুষদের স্তব ক’রে। স্তবের মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের মধ্যে অনুভব করেন তাদের দেবতাদের মহিমা, অর্থাৎ শক্তি। আমার সামনে এখন একটি লেখা প’ড়ে আছে ‘আধুনিক জগতের অন্যতম বিস্ময় : কায়েদে আজম’ নামে, লেখক ইব্রাহিম খাঁ। এভাবেই বিস্মিত হন আমাদের লেখকেরা, স্তুতি করেন রাজনীতিক বীরদের। লেখকদের কতোটা পতন ঘটতে পারে তা পাকিস্থানপর্বের বাঙালি মুসলমান লেখকদের লেখা পড়লে চমৎকার বোঝা যায়। সুফিয়া কামাল ঈদ আর কায়েদে আজম নিয়ে হয়তো শতাধিক পদ্য লিখেছিলেন; তাঁর পদ্যের নাম ‘হে মহান নেতা’, ‘হে সিপাহসালার’, ‘হে মশালধারী’, ‘হে অমর প্রাণী’, ‘নির্ভীক মহাপ্ৰাণ’ ইত্যাদি। তিনি লিখেছিলেন এ-ধরনের চরণমালা :
তসলীম লহ, হে অমর প্রাণ! কায়েদে আজম! জাতির পিতা!
মুকুটবিহীন সম্রাট ওগো! সকল মানব-মনের মিতা।
তোমার মুখের কালাম শুনিল; আজাদ। আমরা আজাদ জাতি!
নিমিষে দাঁড়াল ঝাণ্ডা উড়ায়ে; সম্মুখে আঁধার গহীন রাতি। [‘হে আমার প্রাণ’]
কায়েদে আজম! আমরা তোমার দান,
শির পাতি নিয়া বক্ষঃরক্তে রাখিয়াছি সম্মান। [‘হে সিপাহসালার’]
কী শোচনীয় অর্থবিরহিত শূন্যগর্ভ স্তবস্তুতি। এখানে এসে পড়ে বিশ্বাসের ব্যাপারটি, এবং জানিয়ে দেয় বিশ্বাস কতো স্বল্পায়ু, কতো হাস্যকর। মহিলাকবি ওপরের ছ-পংক্তিতে যা লিখেছেন, তা কবিতা হয়ে ওঠে নি, কতকগুলো পুরোনো মরচেপড়া আবেগ সাজিয়েছেন তিনি এগুলোতে, কিন্তু বুঝতে পারি তাঁর আবেগ উঠে এসেছে তার বিশ্বাস থেকেই। তিনি নিশ্চয়ই মিথ্যে কথা বলেন নি, নিশ্চয়ই তিনি বিশ্বাস করতেন যে ওই ভদ্রলোক ‘জাতির পিতা’, বিশ্বাস করতেন, ‘কায়েদে আজম! আমরা তোমার দান’। কিন্তু বিশ্বাস খুবই করুণ ব্যাপার; তিনি নিশ্চয়ই এখন আর এ-বিশ্বাস পোষণ করেন না। তবে এখনো তিনি বিশ্বাস করেন জাতির পিতায়, শুধু ব্যক্তিটি ভিন্ন, ঠিক যেমন ঘটেছে মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের বেলা:-যখন তারা এক দেবতা ছেড়ে বিশ্বাস। এনেছে আরেক দেবতায়।
আমি রাজনীতিক দেবতায় বা বিধাতায় বা মহানায়কে বা নেতায় বিশ্বাস করি না। অতিজাগতিক বিধাতাদের মতো রাজনীতিক বিধাতাদের কাজও মানুষকে বন্দী ক’রে ফেলা, তাদের নিজেদের বন্দনাকারীতে পরিণত করা। রাজনীতিক বিধাতারা তুচ্ছ মানুষ আমার কাছে; আমি জানি তাঁরা শক্তিমান, কিন্তু শক্তির স্তব করার মতো শোচনীয়তা আর নেই। আমি যাদের স্তব করি, স্তব নয়—যাদের প্রতি অনুরাগ বোধ করি, তারা কেউ রাজনীতিক দেবতাদের মতো বাহ্যিক শক্তিধর নন। রাজনৈতিক নেতারা আন্তর প্রতিভাসম্পন্ন নন, তাঁদের সবটাই বাইরের, ভেতরে কিছু নেই; বিশেষ পরিস্থিতিতে তাঁরা হঠাৎ বিশাল আকারে দেখা দেন; ভিন্ন পরিস্তিতিতে তাঁরা অনেকেই চোখের আড়ালে থেকে যেতেন। পৃথিবী চিরকাল চতুর্থপঞ্চম শ্রেণীর মানুষদের দিয়ে শাসিত হয়েছে, যদিও তাদের কেউ কেউ রাজ্য স্থাপন করেছেন, জয় করেছেন মহারাজ্য, এমনকি এনে দিয়েছেন স্বাধীনতা। কিন্তু স্বাধীনতা কি কখনো একজন রাজনীতিক এনে দিতে পারেন? পৃথিবী জুড়েই দেখা যাচ্ছে যে অধিকাংশ রাজনীতিকই দুৰ্বত্ত; ক্ষমতা দখল করার পর আর তারা ক্ষমতা ছাড়তে চান না, মানুষকে অশেষ দুৰ্দশায় তলিয়ে দিয়ে তারা উপভোগ করেন। মধ্যযুগীয় সম্রাটের জীবন, তাদের অবৈধ ধন ও নারীর কোনো হিশেবে নেই; কিন্তু তারা করেন অতিমানবিক আচরণ, সাধারণ মানুষের কাছে তারা দাবি করেন। বিধাতার মর্যাদা। অধিকাংশ রাজনীতিক, যাদের মৃত্যুতে সাত দিন ধ’রে শোক পালন করা হয়, ঝুলিয়ে রাখা হয় পতাকা, পরে স্মৃতিসৌধ তোলা হয়, তাদের মৃত্যুতে সামান্য ও শূন্যতা সৃষ্টি হয় না সমাজে। তারা সাধারণত বিশেষ কোনো কাজের যোগ্য নন। বাজারের চর্মকারটি মারা গেলে বাজারে একটা শূন্যতা দেখা দেয়, বহু লোক জুতো শেলাই করাতে এসে ফিরে যায়, তাদের জীবনে কিছু সময়ের জন্যে হ’লেও বিপর্যয় দেখা দেয়; কিন্তু একজন নেতার মৃত্যুতে তেমন কোনো শূন্যতা দেখা দেয় না। ওই নেতা জুতোও শেলাই করতে পারতেন না, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বর্ণমালা বা সরল অংক শেখানোর যোগ্যতাও তার ছিলো না, তিনি আসলে সমাজের কোনো প্রকৃত কাজেই লাগেন নি। কিন্তু তিনি ছিলেন খুবই শক্তিধর; এবং তাঁর মৃত্যুর পর আমরা সাত দিন শোক পালন করি, যদিও শোক পালন করা উচিত বাজারের চর্মকারটির মৃত্যুতে। রাজনীতিকদের মতো আন্তর গুণহীন লোক সমাজে আর নেই। মানুষের দুর্ভাগ্য আন্তর গুণহীন মানুষেরাই শাসন করে মানুষকে।
খুব ক্ষতিকর একটি বিশ্বাস দু-হাজার বছর ধ’রে প্রশংসিত ও জনপ্রিয় যে মানুষের জীবনের থাকা উচিত একটা আদর্শ, মানুষকে জীবন যাপন করা উচিত আদর্শ অনুসারে: তার জীবনের লক্ষ্যই হওয়া উচিত ওই আদর্শের বাস্তবায়ন। কিন্তু প্রতিটি আদর্শই কারাগার; কোনো আদর্শকে পরম মনে করা হচ্ছে কারাগারকে পরম মনে করা। আদর্শের শেষ নেই পৃথিবীতে, অজস্র আদর্শ ছড়ানো পথেঘাটে, পৃথিবী জুড়ে দশকে দশকে মাতারা জন্ম দিচ্ছেন বিচিত্র আদর্শের জনকদের; তাদের সবারই উদ্দেশ্য নিজেদের কারাগারে সবাইকে চিরকালের জন্যে আটকে ফেলা। অন্যদের আটকে ফেলে, নিজেদের কারাগারে রেখে পীড়ন ক’রে, সুখ পায় একদল মানুষ। আদর্শগুলোর মুখে অবশ্য চমৎকার কারুকাজকরা মুখোশ থাকে, মুখোশের আড়ালের হিংস্র কুৎসিত মুখটিকে দেখা যায় না, মনে হয় মুখোশের আড়ালে আছে অপার্থিব সুন্দর মুখ; কিন্তু মুখোশ সরিয়ে নিলেই কুৎসিত মুখ দেখে কেঁপে উঠতে হয়। ধর্মগুলো জীবনযাপনের আদর্শের কারাগাররূপে বন্দী ক’রে ফেলতে পেরেছে। মানুষকে; মানুষ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে সব ধরনের কারাগারের মধ্যে নিকৃষ্টতম কারাগারগুলো। এটা ঘটেছে এজন্যে যে ধর্মগুলোই সবচেয়ে দক্ষতার সাথে সবচেয়ে উচু এবং সবচেয়ে প্রশস্ত দেয়ালের কারাগার তৈরি করতে পেরেছে। কারাগারে বাস করার মধ্যে যেমন নেই কোনো মহত্ত্ব, তেমনি আদর্শের মধ্যে থাকাও সম্পূর্ণ মহত্ত্বহীন। কিন্তু মানুষকে দীক্ষিত করতে পারলে তারা কারাগারের স্তুতিতেও মুখর হয়ে উঠতে পারে, বিশ্বাস করতে পারে যে কারাগারই স্বৰ্গ, দাবি করতে পারে যে আমাদের কারাগারই সত্য ও শ্রেষ্ঠ; তাই সবাইকে ঢুকতে হবে আমাদের কারাগারে। মানুষ জীবন যাপন করার জন্যে জন্মেছে, তার জীবনের কোনো লক্ষ্য নেই।-কোনো থাকবে?-জীবন যাপনই তার লক্ষ্য, বিশেষ আদর্শযাপন জীবনের লক্ষ্য নয়। জীবন হচ্ছে বিস্তৃত, দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছড়ানো প্রান্তর, তাতে আছে অপরিমিত আলো বাতাস জল রোদ বৃষ্টি ছায়া মাটি মাধুর্য; আদর্শ হচ্ছে ছিদ্ৰহীন দেয়ালের পরাক্রান্ত বেষ্টনি। আদর্শের ভেতরে যারা আছে, তারা অসুস্থ; হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, ইহুদি, বৌদ্ধ, শিখ, বাহাই, কাদিয়ানি, ফ্যাশিবাদী, মৌলবাদী, কঠোর সাম্যবাদী অসুস্থ। ক্যালিগুলার একটা আদর্শ ছিলো, যেমন ছিলো মুসোলিনি, হিটলার, স্তালিন, ও আরো অনেকের, যেমন আছে একনায়কদের; আমরা জানি সেগুলো মানুষের জন্যে কতো মর্মান্তিক। জীবনকে যে কয়েকটি সরল সূত্রে পরিণত করেছে, জীবনে যে শুধু দেখতে চায় ওই সূত্রগুলোর কাজ, সে সুস্থ নয়; আর যারা ওই সূত্রানুসারে বেঁচে থাকে, তারাও সুস্থ নয়। তারা মানুষ নয়, তারা খচ্চর।
আদর্শগুলো বিধিবিধান বা প্রথা ছাড়া আর কিছু নয়; ওগুলোর কাজ বিশেষ ধরনের সমাজ টিকিয়ে রাখা। ওগুলো মানুষকে খুঁজতে দেয় না নিজের পথ, বের করতে দেয় না তার নিজের নিরর্থক জীবনের তাৎপর্য। মানুষ তাই বলি হয়ে গেছে বিশেষ ধরনের সমাজ, রাষ্ট্র, সংস্কৃতি, ও পরিবারের; মানুষের একান্ত মানবিক ব্যাপারগুলোও হয়ে উঠেছে ক্লান্তিকর। তাই সব কিছু ব্যর্থ হয়ে গেছে মানুষের : তার কাম, বিয়ে, পরিবার, সন্তান সবই পর্যবসিত হয়েছে ব্যর্থতায়। সমাজ, রাষ্ট্র, সভ্যতা আরো পরের ব্যাপার ব্যক্তির জীবনে, সেগুলো সম্মিলিত ক্রিয়াকাণ্ড; সেগুলোর ব্যর্থতা তো আরো শোচনীয়, কিন্তু মর্মান্তিক হচ্ছে প্রতিটি নারীনরের কাম, বিয়ে, পরিবার, সন্তান নিয়ে ব্যর্থতা। প্রতিটি মানুষের-নারী ও নরের—মুখের দিকে তাকালে চোখে পড়ে ব্যর্থ তার কাম, ব্যর্থ তার বিয়ে, ব্যর্থ তার পরিবার, ব্যৰ্থ তার সন্তান। মানুষ যে-সব মহৎ ব্যাপার গ’ড়ে তুলেছে বিবাহ, পরিবার, সন্তান নামে, সেগুলো গ’ড়ে উঠতো না, যদিও না থাকতো তার সুন্দর ভয়াবহ অশ্লীল কাম; বিয়ে, পরিবার, সন্তান তার কামের সৃষ্টি। তবে কাম ও সন্তান জৈবিক, বিয়ে ও পরিবার জৈবিক নয়, সামাজিক; কাম থেকে জন্মে তার সন্তান, সমাজ থেকে জন্মে বিয়ে ও পরিবার। কাম ও সন্তান অকৃত্রিম, বিয়ে ও পরিবার কৃত্রিম। কামের রূপ সর্বত্র অভিন্ন, কিন্তু বিয়ে ও পরিবারের রূপ বিভিন্ন। বিবর্তনের ফলে যেদিন উদ্ভব হয়েছিলো কামের, সেদিন থেকেই শুরু হয়েছে মানুষের যন্ত্রণা; ধর্মীয় বিশ্বাসে ঘটে একই ব্যাপার-কামই হচ্ছে নরনারীর জন্যে নিষিদ্ধ। গন্ধম। বিজ্ঞানীদের ধারণা দু-বিলিঅন বছর আগে আবিষ্কৃত হয়েছিলো কাম। তার আগে বিভিন্ন জৈববস্তু এলোমেলো পরিব্যক্তি অর্থাৎ জিনগুলোর প্রকৃতিবাদলের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি করতো অবিকল নতুন জৈববস্তু; কিন্তু কাম বিকাশের পর সব কিছু বদলে যায়। আধুনিক বিশ্বের সব কিছু–সন্তান, কবিতা, নভোযান, কম্পিউটার–জন্মেছে কাম থেকে; সব কিছুই শক্তিমান সুন্দর অশ্লীল কামের আত্মজ।
বোকাচ্চিওর দেকামেরন-এর একটি গল্প, কীভাবে শয়তানকে নরকে পুরতে হয়’, মনে পড়ছে। অসাধারণ তাৎপর্যপূর্ণ মজার গল্প এটি। এক তরুণ সন্ন্যাসী সাধনা ক’রে চলছিলেন গুহায়, সেখানে এসে উপস্থিত হয় এক সরল রূপসী নিষ্পাপ তরুণী, যে নিজেকে সমর্পণ করতে চায় ক্রাইস্টের পায়ে। স্বৰ্গে আদমের যে-অবস্থা হয়েছিলো, তাই হয় তরুণ সন্ন্যাসীর; কয়েক দিনের মধ্যে জেগে ওঠে। শয়তান—তার কাম। কামে সন্ন্যাসী থারথার কাঁপতে থাকেন। নিষ্পাপ তরুণী জানতে চায়—কী হয়েছে, সন্ন্যাসী, আপনি কাপছেন কেনো? সন্ন্যাসী বলেন-আমার ভেতর শয়তান জেগে উঠেছে, তাই কাপছি আমি। তরুণী জানতে চায়-কোথায় শয়তান, সন্ন্যাসী? সন্ন্যাসী তরুণীকে দেখিয়ে দেয় উত্তেজিত পাপিষ্ঠ শয়তানকে। তরুণী জানতে চায়-প্ৰভু, আমি কী করতে পারি, আমাকে বলুন। সন্ন্যাসী বলেনশয়তানকে নরকে পুরতে হবে, তাহলেই শান্তি পাবো। আমি, সুখী হবেন ক্রাইস্ট। তরুণী বলে-নরক কোথায় পাবো, সন্ন্যাসী? সন্ন্যাসী তরুণীকে দেখিয়ে দেয় যে নরক রয়েছে তার নাভিমূলের নিচে। তরুণী বলে—তাহলে আপনি শয়তানকে নরকে পুরুন } সন্ন্যাসী ও তরুণী কয়েক দিন ধ’রে দিনরাত শয়তানকে নরকে পুরে শাস্তি দিতে থাকে, দাউদাউ জুলতে থাকে নরক পুরতে থাকে শয়তান। অবিরাম নরকে জুলে নিস্তেজ হয়ে পড়ে শয়তান, সে আর যন্ত্রণা দিতে পারে না; কিন্তু তরুণী আবেদন জানাতে থাকে-সন্ন্যাসী, শয়তানকে নরকে পুরুন, আমার নরক জুলছে। আর না পেরে গুহা ছেড়ে পালাতে থাকেন তরুণ সন্ত; তার পেছনে পেছনে দৌড়োতে থাকে তরুণী, এবং চিৎকার করতে থাকে-হে সন্ন্যাসী, আপনার শয়তান তো শাস্তি পেয়ে শান্ত হয়েছে, কিন্তু আমার নরক যে জুলছে। ওই তরুণ হয়তো পরে হয়ে উঠেছিলেন কামবিদ্বেষী কোনো সন্ত: কোনো সন্ত পল, বা কোনো সন্ত টমাস।
কাম নিয়ে শুরুতে মানুষের বিশেষ উদ্বেগ ছিলো না; কামকে তারা তখন নৈতিকতার মানদণ্ডে পরিণত করে নি, পুরুষ ও নারী উভয়েই এটা উপভোগ করেছে অপরাধবোধে না ভুগে। কিন্তু যেই দেখা দিতে থাকে সম্পত্তি ও সম্পত্তির অধিকার, পুরুষ ক্ৰমশ হয়ে উঠতে থাকে প্ৰভু, বুঝতে পারে সন্তান উৎপাদনে তার ভূমিকা, তৈরি করে কতকগুলো কৃত্রিম সংস্থা-বিয়ে, পরিবার, সমাজ, তখনই কাম হয়ে উঠতে থাকে মানুষের বড়ো উদ্বেগ, স্বৰ্গচ্যুতি ঘটে মানুষের। এর আগে নারী কাম উপভোগ করেছে দেহপ্রাণভরে; কিন্তু পুরুষ বিয়ে, পরিবার, সমাজ তৈরি ক’রে ছিনিয়ে নেয় নারীর কামসুখ, তাকে ভেঙেচুরে বিন্যস্ত করে নিজের নিচে, কিন্তু খোলা রাখে নিজের কামসুখের সমস্ত দরোজা ও সারণী। পুরুষ নিজের জন্যে রাখে বহুপত্নী, অজস্র উপপত্নী, এবং অসংখ্য পতিতা। পুরুষ থেকে যায় বহুগামী, কিন্তু ভুলতে পারে না যে নারীও ছিলো বহুগামী, এবং তার বহুগামিতার শক্তি পুরুষের থেকে অনেক বেশি। তাই পুরুষ মেতে ওঠে নারীনিন্দায়; বলে নারী হচ্ছে জরায়ুর মুখ, যে নিজের তৃপ্তির জন্যে মিলিত হয় শয়তানের সাথেও; বলে নারী হচ্ছে অভিচারিণী, ডাইনি, কির্কি, সাইরেন; বলে স্ত্রীলোক স্বভাবতই রতিপ্রিয়, পুরুষসংসর্গ তাদের যেমন প্রীতিকর দেবতারাও তাদের কাছে তেমন প্রীতিকর নয়; বলে নারী নরকের দরোজা; বলে নারী আর আগুনের ক্ষুধাই শুধু কখনো মেটে না। এটা ঠিক যে নারীর উপভোগশক্তি পুরুষের থেকে অনেক বেশি; কিন্তু পুরুষের সভ্যতা নারীকে বিকল ক’রে অবারিত ক’রে রাখে পুরুষের ভোগের পথ। পুরুষ নিজের সুবিধা ও সুখের জন্যে সৃষ্টি করে একনিষ্ঠতা, সতীত্ব নামে নানা নৈতিক ধারণা; তবে পুরুষ কখনোই একনিষ্ঠ আর সৎ থাকে নি, কিন্তু নারীকে বাধ্য করেছে একনিষ্ঠ ও সতী থাকতে, এবং সব সময়ই সন্দেহ করেছে নারীর সতীত্ সম্পর্কে। পুরুষ হচ্ছে সব ধরনের নৈতিক ধারণার স্বাপ্লিক ও প্রণেতা, আর নারী তার দণ্ডভোগী। উনিশশতকে ভিক্টোরীয়রা নিজেদের সুবিধার জন্যে নারীর ভাবমূর্তি বদলে দিয়ে রটাতে থাকে যে নারী স্বভাবতই একনিষ্ঠ, তার কামও কম; কিন্তু মানুষ, নারী ও পুরুষ, কখনোই একনিষ্ঠ নয়। আমি কয়েকজন নারীর সাথে কথা ব’লে দেখেছি;—তারা হেসেই উড়িয়ে দেন নারীর একনিষ্ঠতার ধারণা, জানান যে বাধ্য হয়েই তারা একনিষ্ঠ, যদিও তাদের স্বামীরা বহুগামী। এক তরুণী, যার প্রথম বিয়ে ভেঙে যায় কয়েক মাসেই, এবং দু-মাসের মধ্যেই আরেকটি বিয়ে করে, তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম দুটি পুরুষের সাথে সংসর্গে তার মনে কোনো অপরাধবোধ জেগেছে কি না। তরুণী হেসে উঠে বলে- কী যে বলেন, স্যার, এতেই তো মজা। সম্প্রতি পত্রিকায় একটি সংবাদ বেরিয়েছে বাঙলাদেশেরই পল্লীর এক তরুণী সম্পর্কে, যে একই সাথে দুটি বিয়ে ক’রে কিছু দিন থাকছিলো এক স্বামীর সাথে এবং কিছু দিন অন্যজনের সাথে। একনিষ্ঠতা তার কাছে কোনো ব্যাপারই নয়; বুঝতে পারি দ্বিনিষ্ঠ হয়েই সে পাচ্ছিলো তার কাম্য সুখ। কিন্তু সমাজ এটা মেনে নিতে পারে না; তবে তার ভাগ্য ভালো সমাজ তাকে বেশি শান্তি দেয় নি।
পুরুষ কামের দাস, কাম চরিতাৰ্থ করার জন্যে সে সব সময় ব্যগ্ৰ; কিন্তু তার মনে কাম জাগায় পাপবোধ: কাম তার কাছে পাপ। এ-পাপবোধকে তীব্ৰ ক’রে তুলেছিলেন খ্রিস্টান সন্তরা; কাম তাদের কাছে চরম পাপ।। সন্তরা নিজেরা অবশ্য চিরকৌমাৰ্যব্রত পালন করেন নি; যৌবনে প্রচুর কামে ক্লান্ত হয়ে ঘেন্না ধ’রে যায় তাদের, তারপর যুদ্ধ ঘোষণা করেন। কামের বিরুদ্ধে; এবং এক সময় গির্জা তাদের অভিষিক্ত করে সন্ত হিশেবে। সন্ত পলের মতে সব ধরনের যৌনসংসর্গ, বিবাহিতই হোক আর অবিবাহিতই হোক, পাপ। এর প্রভাব পড়েছিলো ব্ৰাহ্মদের, এমনকি তলস্তয় আর গান্ধির ওপরও। উনিশ শতকে কিছু ব্ৰাহ্ম স্বামী-স্ত্রী ঠিক করেছিলো তারা জীবনে আর কখনো সঙ্গম করবে না, থাকবে ভাইবোনের মতো। তলস্তয়, যিনি যৌবনে মনে করতেন রূপসী তরুণী উপভোগ পাপ নয়, স্বাস্থ্যের লক্ষণ, আর গান্ধি, দু-তিনটি তরুণী ডাক্তারের সঙ্গ ছাড়া যিনি সুস্থ থাকতেন না, বুড়ো বয়সে সিদ্ধান্তে পৌঁছেন সঙ্গম খুবই খারাপ কাজ। ক্লান্ত বুড়োদের মগজে দেখা দেয় কতোই না বিকৃতি। সন্ত পালের মতে কৌমার্য স্বৰ্গীয়। রাসেল বলেছেন সন্তরা স্বৰ্গীয় কৌমার্য টিকিয়ে রাখার জন্যে গিয়ে আশ্রয় নিতেন মরুভূমিতে, যুদ্ধে লিপ্ত থাকতেন। শয়তানের সাথে, যে তাদের কল্প লোক ভ’রে দিতো বিচিত্র ধরনের কামোদ্দীপক দুঃস্বপ্নে। সন্ত জেরোম জানিয়েছেন কেমন কামযন্ত্রণায় কাটতো তার সময় চলসিসের মরুভূমিতে, কামযন্ত্রণায় দেখতে পেতেন তার সামনে নাচছে দলে দলে তরুণী। টমাসের মতে মানুষের প্রধান কাজ বিধাতাকে ভালোবাসা, দ্বিতীয় কাজ প্রতিবেশীদের অল্পসল্প ভালোবাসা। তিনি অবিবাহিত সঙ্গম নিষিদ্ধ করেন, কেননা সন্তানদের পিতামাতার সাথে থাকা দরকার। প্রকৃতিবিরুদ্ধ ব’লে তিনি নিষিদ্ধ করেন জন্মনিয়ন্ত্রণ: তবে তিনি চিরকৌমার্য নিষিদ্ধ করেন নি। তিনি নির্দেশ দেন একবিবাহের; কেননা পুরুষের বহুবিবাহ নারীদের প্রতি অন্যায়, আর নারীদের বহুবিবাহ সৃষ্টি করে পিতৃত্ব সম্বন্ধে অনিশ্চিত। তিনি ভাইবোনের অজাচার নিষিদ্ধ করেন এ-যুক্তিতে যে এতে স্বামীস্ত্রী ও ভাইবোনের ভালোবাসা মিলে এমন আবেগ সৃষ্টি করবে। যে তারা সারাক্ষণ লিপ্ত থাকবে সঙ্গমে। সংসর্গ পাপ, কিন্তু পাপ যে কোথায় শুরু হয় খ্রিস্টান গির্জা তা ঠিকমতো শনাক্ত করতে পারে নি। খ্রিস্টান গির্জা চুম্বন, আলিঙ্গন, মর্দনকে বিশেষ সীমা পর্যন্ত নিষিদ্ধ মনে করে না। এক ক্যাথলিক ধর্মযাজক বিধান দিয়েছিলেন যে স্বীকারোক্তির সময় পুরুষ ধর্মযাজিকার স্তনযুগল মর্দন করতে পারে, যদি তার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য না থাকে। খ্রিস্টান সন্তরা মুখর ছিলেন সঙ্গমের নিন্দায় : অগাস্টিনের মতে সঙ্গম মূলতই ঘেন্নার ব্যাপার; আরনোবিউসের মতে এটা নোংরা ও হীন কাজ; তার তুলিয়ানের মতে সঙ্গম লজাজনক। সন্তরা বিস্মিত হয়ে ভাবতেন সন্তান জন্মানোর এমন নোংরা। উপায়ের বদলে বিধাতা কেনো বের করলেন না কোনো উৎকৃষ্টতর উপায়। বিধাতা কি করতে পারেন এমন নোংবা কাজ? না, এর জন্যে বিধাতার কোনো দোষ নেই; সন্তারা ভেবে বের করেন যে সব দোষ আদম ও হাওয়ার।
পুরোনো ভারত ও গ্রিস পত্নী, উপপত্নী, ও পতিতা সম্বন্ধে যে-সিদ্ধান্তে পৌঁচেছিলো তার সারকথা বলেছিলেন দেমোসথেনেস : ‘পুরুষের কামসুখের জন্যে আছে গণিকারা; প্রতিদিনের ব্যবহারের জন্যে আছে উপপত্নীরা, আর তার সন্তান লালন ও সতী গৃহিণীর দায়িত্ব পালনের জন্যে আছে পত্নীরা।’ এ-তিন ধরনের নারীর মধ্যে পত্নীরাই পেয়েছে সবচেয়ে কম মূল্য, তারা পেয়েছে শুধু পত্নী ও সন্তানের জননী হওয়ার গৌরব। গ্রিসের পুরুষেরা শুধু উপপত্নী ও গণিকায়ই তৃপ্ত ছিলো না; তাদের কাছে প্রমোদের শ্রেষ্ঠ বস্তু ছিলো বালক। সক্রেতিসের ছিলো আলকিবিয়াদেশ নামে এক বালক প্রেমিক, যার জ্বালায় অস্থির হয়ে পড়েছিলেন দার্শনিক। উপপত্নী সব পুরুষ রাখতে পারে না, তাদের জন্যে ছিলো, এবং এখনো রয়েছে, সারিসারি পতিতা। পতিতাকে এখন পতিত মনে করা হয়, শুরুতে এমন মনে করা হতো না, তাদের স্থান ছিলো অত্যন্ত উচ্চে: পতিতারা শুরুতে ছিলো উচ্চিতা: তারা জড়িত ছিলো পবিত্র ধর্ম ও ঐশ্বর্যের সাথে। প্লাউতুস বলেছিলেন, পতিতা সমৃদ্ধ মহানগরীর মতো, অজস্র মানুষ ছাড়া যার চলে না।’ আদিপুস্তক-এ (৩৮ পরিচ্ছেদ) একটি অসাধারণ গল্প রয়েছে শ্বশুর জিহুদা আর পুত্রবধু তামর সম্পর্কে। তামারের বিয়ে হয়েছিলো জিহুদার প্রথম পুত্র এরের সাথে; এর ‘সদাপ্রভুর চোখে দুষ্ট’ বিবেচিত হওয়ায় সদাপ্ৰভু তাকে মেরে ফেলেন। এর কেনো দুষ্ট’ বিবেচিত হয় সদাপ্রভুর চোখে, তা অবশ্য বলা হয় নি বাইবেলে; তবে সম্ভবত সে ছিলো সমকামী, যে স্ত্রীর সাথে প্রথা সিদ্ধ সঙ্গম করতে চায় নি। সমকাম সদাপ্রভুর চোখে প্রচণ্ড ঘৃণা ও বিভীষিকার কাজ, তাই তাকে মেরে ফেলা হয়। এরের কনিষ্ঠ ভাই ওনন; জিহুদা ওননকে বলে, ‘তুমি আপন ভ্রাতার স্ত্রীর কাছে গমন কর, ও তাহার প্রতি দেবরের কৰ্ত্তব্য সাধন করিয়া নিজ ভ্রাতার জন্য বংশ উৎপন্ন কর।’ ওনন জানতো ভাবীর গর্ভে সে উৎপাদন করবে। যে-সন্তান, তা তার হবে না, হবে ভাইয়ের; তাই সে ‘‘ভূমিতে রেতঃপাত করিলা’। এতেও ক্ষিপ্ত হন সদাপ্রভু-তিনি খুবই ক্ষিপ্ত ব্যক্তিত্ব, খেপে উঠতে তাঁর সময় লাগে না, এবং বধ করেন। ওননকে। ওনন যা করে, তাকে আজকাল বলা হয় coitus interruptus, মুসলমানরা বলে ‘আজল’, যা ইসলামে সিদ্ধ। জিহুদার শেল নামের আরেক পুত্র ছিলো, কিন্তু সে অপ্রাপ্তবয়স্ক; তাই সে সাবালক না হওয়া পর্যন্ত জিহুদা তামরকে পিতার গৃহে গিয়ে বাস করতে বলে।
বহু দিন চ’লে যায়, পরলোকগত হয়। জিহুদার স্ত্রী; এবং জিহুদা মেষের লোম কাটার জন্যে যায় তিস্নায়। শ্বশুর আসছে জেনে তামার বিধবার পোশাক ছেড়ে মুখ আবরণে ঢেকে পথের পাশে ব’সে থাকে। জিহুদা তাকে দেখে বেশ্য মনে করে, পুত্রবধুকে চিনতে না পেরে গিয়ে বলে, ‘আইস, আমি তোমার কাছে গমন করি।’ তোমর রাজি হয় তাতে; তবে জানতে চায় মিলনের জন্যে কি পারিশ্রমিক দেবে। জিহুদা। জিহুদা পাল থেকে একটা ছাগবৎস পাঠাতে রাজি হয়, এবং কাজ সেরে বন্ধক হিশেবে তামারের কাছে নিজের ‘মোহর ও সূত্র ও হস্তের যষ্টি’ রেখে চ’লে যায়। তোমর মুখের আবরণ ফেলে আবার বিধবার পোশাক পরে। কিছু দিন পর জিহুদা বন্ধক ফেরত পাওয়ার জন্যে ছাগবৎস পাঠায়, কিন্তু কিছতেই পথের পাশের বেশ্যাটিকে আর পাওয়া যায় না। তিন মাস পর জিহুদাকে কেউ এসে বলে যে তার পুত্রবধু বেশ্যা হয়েছে, বেশ্যাবৃত্তির ফলে তার গর্ভ হয়েছে। জিহুদা সৎ মানুষের ক্ৰোধে জ্বলে উঠে বলে, ‘তাঁহাকে বাহিরে আনিয়া পোড়াইয়া দাও।’ তামারকে ধ’রে আনা হয় জিহুদার কাছে, এবং সূত্রপাত হয় এক বাইবেলীয় নাটকীয় ঘটনার। তোমর বলে, ‘যাহার এই সকল বস্ত, সেই পুরুষ হইতে আমার গর্ভ হইয়াছে।’ সে সাথে সাথে বের ক’রে দেখায় তার শ্বশুরের ‘মোহর ও সূত্র ও হস্তের যষ্টি’। জিহুদাকে স্বীকার করতে হয় যে, ওগুলো তারই। জিহুদা নিজেকে বাচানোর জন্যে বের করে এক খোড়া যুক্তি যে ‘সে আমা হইতেও অধিক ধাৰ্ম্মিকা, কেননা আমি তাহাকে আপন পুত্ৰ শেলাকে দিই নাই।’ পুরুষ চিরকাল কামকে রেখেছে নৈতিকতার ওপরে, অন্তত নিজের বেলা; এতে পৌরাণিক ও আধুনিকের মধ্যে পার্থক্য নেই; তবে পুরোনোদের নীতিবোধ ছিলো আরো শিথিল।
গ্রিক পতিতা থাইসকে মনে পড়ছে, যার তরুণ প্রেমিক ইউথিদেমুসকে নানা যুক্তি দিয়ে ভাগিয়ে নিয়েছিলেন এক দার্শনিক। দর্শন অসাধারণ জিনিশ, কাম খুবই খারাপ. এ-যুক্তি দিয়ে ওই তরুণ প্রেমিককে ভাগিয়েছিলেন কোনো এক প্লাতো বা আরিস্তাতল (মনে রাখতে পারি প্রাতো আর আরিস্ততলের ছিলো একাধিক রক্ষিতা: বিশশতকে যে-দুই দার্শনিকের, সাত্র ও বোভোয়ার, প্রেম কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে তারাও একনিষ্ঠ ছিলেন না; সার্তের মৃত্যুর পর জানা যায় তাঁর ছিলো বেশ কয়েকটি রক্ষিতা, আর বোভোয়ারও মাঝেমাঝে ঘুমোতেন অন্যদের সাথে)। তাতে দুঃখে ভেঙে পড়েছিলো পতিতা থাইস; এবং লিখেছিলো। এ-পত্রটি :
যখন থেকে তুমি দর্শন পড়া শুরু করেছে। সে থেকেই তুমি অবজ্ঞা করছে! আমাদের মন্দিরকে। সে থেকে তুমি বেশ গর্বে এবং হাতে বই নিয়ে যাচ্ছে অ্যাকাডেমিতে, হেঁটে যাচ্ছে আমার বাড়ির পাশ দিয়ে যেনো তুমি কখনো চোখ ফেলো নি। এ-বাড়ির ওপর। তুমি পাগল হয়ে গেছে, ইউথিদেমুস: তুমি কি জানো না। ওই দার্শনিকটি, যে আমন গম্ভীর মুখে তোমার উদ্দেশে বর্ষণ করে ওইসব বিস্ময়কর বক্তৃতা, সে কী ধরনের মানুষ? তুমি কি জানো ওই লোক আমার সাথে সাক্ষাতের জন্যে চেষ্টা ক’রে আসছে কতোখানি? আর সে কতোখানি পাগল মেগারার পরিচারিকা হারপিলিসের জন্যে? তবে আগে তাকে আমি গ্ৰহণ করতাম না, ওই দার্শনিকের সোনার বদলে তোমাকে বাহুতে জড়িয়ে ধ’রেই ঘুমোতে পছন্দ করতাম আমি। তবে সে যখন আমার ভালোবাসা থেকে তোমাকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, আমি এখন তাকে আসতে দেবো; এবং যদি তুমি চাও তাহলে আমি তোমাকে দেখতে দেবো যে তোমার নারীবিদ্বেষী বিদ্যালয়শিক্ষক শুধু রাতের স্বাভাবিক প্রমোদেই সন্তুষ্ট নয়। তুমি কি মনে করো যে দার্শনিক গণিকার থেকে উত্তম? যখন কেউ গণিকার সাথে থাকে সে কখনো স্বৈরাচারীর ক্ষমতা চায় না, বা দ্ৰোহ সৃষ্টি করে না রাজ্যে।…বিধাতা আমাদের বেশি আয়ু দেন নি: ঘুম থেকে জেগে তুমি দেখো না যে তুমি নিজেকে অপচয় ক’রে ফেলেছো ধাঁধা এবং বাজেকথায়। বিদায়।
পুরুষ হচ্ছে রাজ্য; আর পুরুষদের রাজা হচ্ছে রাজারা। রাজারা যেভাবে কাম উপভোগ করেছে, তার মধ্যেই মিলে পুরুষদের কাম ক্ষুধার পরিচয়, পারলে প্রতিটি পুরুষই রাজাদের মতো মেটাতো নিজের ক্ষুধা। রাজারা চিরকালই বহু বিয়ে করেছে, রেখেছে অজস্র উপপত্নী, সেবা নিয়েছে অসংখ্য পতিতার। বহুবিবাহ কেমন রাজকীয় রূপ নিতে পারে, তার পরিচয় পাওয়া যায় হাজার বছর আগের চীনের রাজপ্রাসাদে। সেখানে নিয়ম ছিলো রাজার থাকবে ১টি রানী, ৩টি পত্নী ৯টি দ্বিতীয় শ্রেণীর পত্নী, ২৭টি তৃতীয় শ্রেণীর পত্নী, এবং ৮১টি উপপত্নী। রাজার এমন বিশাল প্ৰমোদবিভাগ চালানোর জন্যে থাকতো কয়েকজন নারী ‘কাম সচিব’। এদের দায়িত্ব ছিলো রাজা যাতে ঠিক নারীটির সাথে ঠিক দিন ঠিক সময় পর পর ঠিক মতো মিলিত হয়, তা পরিচালনা করা। ত্যাং রাজত্বকালে রাজার নারীদের সংখ্যা বেড়ে হাজারে পৌঁছে, এবং কাম সচিবদের কাজ অত্যন্ত বেড়ে যায়। হিন্দু আর মুসলমান রাজারা যখন যার সাথে ইচ্ছে হতো তারই সাথে মিলতো, চীনা রাজাদের সে-স্বাধীনতা ছিলো না, মিলতে হতো সচিবদের নিপুণ হিশেবে অনুসারে। সবচেয়ে বেশি পরিমাণে নারী সংগ্রহ ও উপভোগের জন্যে বিখ্যাত হয়ে আছে বাগদাদের বাদশারা, এবং পরে তুরস্কের অটোমান রাজারা, যাদের মহাকীর্তির নাম হারেম। অটোমান রাজাদের হারেমে থাকতো ৩০০ থেকে ১২০০র মতো রক্ষিতা, এবং তাদের দেখাশোনার জন্যে থাকতো একপাল প্রহরী, সহচর, খোজা, বস্ত্ররক্ষয়িত্রী, দাসী। সৌদি আরবের স্থপতি আবদুল আজিজেরও ছিলো ১৭টি স্ত্রী; আর জন্মেছিলো। ৫৪টি পুত্র ও ২১৫টি কন্যা।
পুরুষ কখনো একনিষ্ঠ নয়, কামে সৎ পুরুষ উপকথামাত্র। ধর্মগুলোর মধ্যে শুধু ইসলামই পুরুষের বহুকামিতা স্বীকার করে, এবং রেখেছে। পুরুষের চারটি বিয়ের বিধান, তবে নারীর জন্যে বিধান করেছে কঠোর একবিবাহ। ইসলামপূর্ব আরব নারী অবশ্য উপভোগ করতো একই সাথে একাধিক স্বামীর সংসৰ্গ, তার সে-সুখের অবসান হয় ইসলামের আবির্ভাবে। আরব ছিলো অনেকটা মাতৃতান্ত্রিক, ইসলামপূর্ব আরবে পিতৃপরিচয় গৌণ ব্যাপার ছিলো, সন্তানেরা পরিচিত হতো মায়ের পরিচয়েই। ষষ্ঠ শতকের শেষ দিকে আরবসমাজের বদল শুরু হয়েছিলো, ব্যবসাবাণিজ্যের ফলে প্রচুর ধন জন্মছিলো পুরুষদের হাতে, দেখা দিচ্ছিলো পিতৃতন্ত্র; পুরুষেরা চাচ্ছিলো তাদের ধনের উত্তরাধিকারী হবে তাদের ঔরসজাত সন্তানেরা, অন্য পুরুষের সন্তানেরা নয়। ইসলাম ওই সময়ে আরবসমাজে প্রতিষ্ঠা করে পিতৃতন্ত্র; মাতা হয়ে ওঠে গৌণ। ধর্মেও ঘটে একই ব্যাপার: অবসান ঘটে মক্কার লাত, মানত, উজ্জা নামের দেবীদের। ইসলামপূর্ব আরবে পুরুষ বিয়ে ক’রে যেতো স্ত্রীর গোত্রে, স্ত্রী থেকে যেতো নিজের গোত্রেই; এবং নারী একই সাথে কয়েকটি বিয়ে করতে পারতো, পুরুষ ও অবশ্য পারতো। ইসলাম পুরুষের বহুবিবাহ সীমাবদ্ধ করে চারটিতে, এবং নারীর বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করে সম্পূর্ণরূপে। নারীর বহুস্বামী নিষিদ্ধ করায় শুরুতে এর বিরুদ্ধে আন্দোলনও হয়েছিলো, কিন্তু শক্তিমান ইসলাম নারীদের স্তব্ধ ক’রে দিতে দ্বিধা করে নি।
একই সাথে পুরুষের একাধিক স্ত্রী রাখা এখন অত্যন্ত নিন্দিত; এবং নারীর একই সাথে একাধিক স্বামী রাখার কথা সভ্যরা কেউ কল্পনাও করতে পারে না, যদিও তিব্বতে এটা এখনো প্রচলিত। এ-কামনির্ভর একনিষ্ঠ নৈতিকতার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে খ্রিস্টধর্ম থেকে; একেই এখন মনে করা হয় নৈতিকতার পরাকাষ্ঠী। এক সাথে চার স্ত্রী রাখার বিধানের জন্যে ইসলাম আজকাল খুবই বিব্রত, তাই অনেক মুসলমান রাষ্ট্রে এটা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে নানা শর্ত জুড়ে। পৃথিবী জুড়ে সবাই এখন নির্বিচারে বিশ্বাস করে যে এককালে এক স্বামী-এক স্ত্রীই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ নৈতিকতা। নৈতিকতার মানদণ্ডে কোনো কিছু বিচার করাই অনৈতিক—যুগে যুগে নৈতিক বিচার ভুল ব’লে প্রমাণিত হয়েছে, এবং তথাকথিত আধুনিক মানুষের এ-বিশ্বাস মূলত ঘোর অনৈতিক ও শিহরণজাগানো কপটতায় পরিপূর্ণ। এক স্বামী-এক স্ত্রী সংস্থার মধ্যে যেমন নেই কোনো নৈতিকতা, তেমনি কোনো অনৈতিকতা নেই এক স্বামী-একাধিক স্ত্রী, এবং এক স্ত্রী-একাধিক স্বামীর মধ্যে। আমাদের নৈতিকতাবোধ দূষিত, কেননা এর ভিত্তি কাম বা যৌনসংসর্গ। তবে কাম বা যৌনসংসর্গ পেরিয়ে গভীরে ঢুকলে দেখি যে বর্তমান নৈতিকতার ভিত্তি মালিকানা বা অধিকার। আমরা নিজেদের সম্পত্তির ওপর অন্যের সামান্যতম অধিকার যেমন স্বীকার করি না, তেমনি নারী ও পুরুষের শরীর ও কামকে মনে করি একান্তভাবে পরস্পরের সম্পত্তি; পুরুষটি ও তার দেহ ও তার কাম নারীর সম্পত্তি, আর নারীটি ও তার দেহ ও তার কাম পুরুষটির সম্পত্তি। কাম ও অধিকারভিত্তিক নৈতিকতা কোনো নৈতিকতাই নয়, তা অনৈতিকতা।
এর ভেতরে রয়েছে এক বড়ো কপটতাও। পৃথিবী জুড়ে পুরুষ প্রকাশ্যেই বহু নারী ভোগ করছে, আর নারীরাও গোপনে, যদিও পরিমাণে অনেক কম, ভোগ করছে বহু পুরুষ। ইউরোপ-আমেরিকায় নারীপুরুষ উভয়েরই বহুবিবাহ নিষিদ্ধ, কিন্তু বহুকাম নিষিদ্ধ নয়; সেখানে পুরুষ ও নারী উভয়েই একই সময়ে ও সারা জীবনে উপভোগ করছে বহু নারী ও পুরুষ। তাই একনিষ্ঠতা এক হাস্যকর কপট ধারণায় পরিণত হয়েছে; পরিণত হয়েছে বলা ঠিক হচ্ছে না, একনিষ্ঠতা কখনোই ছিলো না। কাম ও অধিকারকে নৈতিকতার ভিত্তি ক’রে মানুষ কোন অনৈতিক পাতালে নেমেছে, তার পরিচয় পাই টেস্টটিউবে শিশুপ্রজননে। এ—অসাধারণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মূলে রয়েছে করুণ কামভিত্তিক নৈতিকতা। মনে করা যাক স্ত্রীটি উর্বর, কিন্তু স্বামীটি অনুর্বর; এ-ক্ষেত্রে বর্তমান আবিষ্কার কোনো অজ্ঞাত পুরুষের বীর্যে ও নারীটির ডিমে টিউবে উন্মেষ ঘটাচ্ছে একটি মানুষের: তারপর সেটি ঢুকিয়ে দিচ্ছে নারীটির জরায়ুতে। আবিষ্কারটি অসাধারণ, ব্যাপারটি খুবই চমৎকার; কিন্তু সবটাই গভীরভাবে অনৈতিক। আমরা যদি উন্নত নৈতিকতার অধিকারী হতাম, কামকে ভিত্তি না করতাম নৈতিকতার, তাহলে একটি উর্বর পুরুষ দিয়ে সহজেই গর্ভবতী করতে পারতাম নারীটিকে। কিন্তু নারীর সতীত্ আমাদের টিকিয়ে রাখতেই হবে, তার ভেতর অন্য কোনো পুরুষকে আমরা ঢুকতে দিতে পারি না: স্ত্রীটি একটু সুখ পাক, তাও আমরা চাই না, কিন্তু সন্তান চাই; এবং সাথে সাথে বুেশ বড়ো একটা ব্যবসাও ক’রে নিতে চাই। এর চেয়ে শোচনীয় অনৈতিকতা আর হতে পারে না। প্রাচীন ভারত ছিলো আমাদের থেকে অনেক উন্নত নৈতিকতাসম্পন্ন: সেখানে ব্যবস্থা ছিলো ক্ষেত্ৰজ সন্তান জন্মদানের। মহাভারত-এ বিচিত্রবীর্যের ছিলো দুই স্ত্রী : অম্বালিকা ও অম্বিকা। সন্তান জন্মদানের আগেই ক্ষয়রোগে বিচিত্রবীর্যের মৃত্যু হ’লে সত্যবতী ব্যাসকে দিয়ে অম্বালিকার গর্ভে উৎপাদন করে পাণ্ডুকে, আর অম্বিকার গর্ভে ধৃতরাষ্ট্রকে। অন্য পুরুষের দ্বারা নারীর সন্তান জন্মানোই ছিলো ক্ষেত্ৰজ রীতি, ওই সন্তান পরিচিত হতো। পিতার নামেই বীৰ্যদাতা পুরুষটির পরিচয়ে নয়। তারা কামকে বড়ো ক’রে তোলে নি ব’লে তারা ছিলো উন্নত নৈতিকতাসম্পন্ন। আমাদের নৈতিকতা অনৈতিক ও কপট। বিবাহ ও পরিবার যে পরিণত হয়েছে ব্যর্থ সংস্থায়, তার মূলে এই অনৈতিক ও কপট নৈতিকতা; বর্তমান বিবাহরীতিতে নারীপুরুষ উভয়েই অসুখী। এখন পৃথিবী জুড়ে চলছে অবিশ্বাস ও অপ্রেমের সংসার। ইউরোপ আমেরিকা এখন মেনে নিচ্ছে সমকাম ও সমলৈঙ্গিক বিয়ে, চলছে স্বামীস্ত্রী বিনিময়, এবং সেখানে গোপনে চলছে সম্মিলিত বিয়ে বা কাম, ও আরো অজস্র রীতি। যদি কোনো পুরুষ একাধিক নারীর সাথে বিবাহিত বা অবিবাহিত জীবন যাপন করতে চায়, তারা সবাই যদি তাতে সুখী হয়, তাতে কারো আপত্তি থাকা উচিত নয়; এবং কোনো নারী যদি একাধিক পুরুষের সাথে বিবাহিত বা অবিবাহিত জীবন যাপন করতে চায়, তারা সবাই যদি তাতে সুখী হয়, তাতেও কারো আপত্তি থাকা উচিত নয়। তাদের ওই জীবনযাপন অন্য কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না, সুখী করে তাদের; তাই তা অনৈতিক নয়। মানুষ ক্রমশ সেদিকেই এগোচ্ছে, বর্তমানের অনৈতিক নৈতিকতা বেশি দিন তাদের বাধা দিয়ে আটকে রাখতে পারবে না। একদিন সমাজ থেকে উঠে যাবে কাম ও অধিকারভিত্তিক বিবাহ, পরিবার, ও নৈতিকতা।
নৈতিকতার সীমা হওয়া উচিত সংকীর্ণ; আমার কোনো কাজ যেনো অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত না ক’রে—এটুকু; কিন্তু ব্যাধিগ্রস্ত নীতিপ্রণেতারা এর সীমা বাড়িয়ে মানুষের জীবনের সব কিছুকে ঘিরে ফেলেছে, বন্দী ক’রে ফেলেছে, তার বাস্তব ও স্বপ্নকে বিপর্যস্ত ক’রে ফেলেছে; তবে আমার কোনো কাজ যেনো অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত না ক’রে’— এ-শর্তটিকেও পূরণ করতে পারে নি। প্রথাগত নৈতিকতার লক্ষ্য স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া; তা যতো বেশি স্বাধীনতা কাড়তে পারে ততো বেশি নৈতিক মনে করে নিজেকে। এ-সমাজ কি নারীকে মুখ খোলা রেখে বাইরে বেরোতে দেয়? না, দেয় না; তাই এ-সমাজ অত্যন্ত নৈতিক ও ধাৰ্মিক। এ-সমাজে কি পুরুষ অন্য কোনো নারীর সাথে বেড়াতে যেতে পারে? না, পারে না; তাই এ-সমাজ খুবই নৈতিক ও ধাৰ্মিক। নৈতিকতা এমনই পীড়াদায়ক ও হাস্যকর। কিন্তু ব্যক্তির স্বাধীনতা হরণকে বিবেচনা করা উচিত অত্যন্ত অনৈতিক ব’লে, মানুষ স্বাধীনতা দেয়াই হওয়া উচিত নৈতিকতার ভিত্তি। নৈতিক মানদণ্ড খুবই নিকৃষ্ট মানদণ্ড, কেননা তা বস্তুনিষ্ঠ নয়; তা কিছু অসুস্থ মানুষের তৈরি মানদণ্ড। এখন সমাজগুলো চলছে নানা ধর্মীয় নৈতিকতার মানদণ্ডে, অর্থাৎ কয়েক হাজার বছর আগের কিছু মানুষের ভালোলাগা/মন্দলাগা ও বিশ্বাসের ওপর। খুব সরল উদাহরণ হিশেবে খাদ্যের ওপর বিধিনিষেধের ব্যাপারটি বিবেচনা করতে পারি। বিভিন্ন ধর্মে বেশ কিছু খাদ্য নিষিদ্ধ; হিন্দুর গোমাংস খাওয়া নিষিদ্ধ বা অনৈতিক, মুসলমানের শুয়োরমাংস খাওয়া ও মদ্যপান নিষিদ্ধ বা অনৈতিক। মুসলমান ও, হিন্দু ছাড়া, সবাই গোমাংস খায়, তাদের ধর্ম ও নৈতিকতা ক্ষুন্ন হয় না, কোনো ক্ষতিও হয় না; মুসলমান ছাড়া সবাই তৃপ্তির সাথে শুয়োরমাংস খায় ও মদ্যপান করে, তাদের ধর্ম ও নৈতিকতা নষ্ট হয় না, কোনো ক্ষতিও হয় না। যা অধিকাংশের জন্যে নৈতিক, তা অল্প কিছু মানুষের জন্যে অনৈতিক: তাই বুঝতে পারি। এখানে যে-নৈতিকতা কাজ করে, তা নিতান্ত স্বেচ্ছাচারী; তাই একে নৈতিকতা বলা যায় না। হিন্দু গরু খেলে কারো কোনো ক্ষতি হয় না, মুসলমান শুয়োরমাংস খেলে বা মদ্যপান করলে কারো কোনো ক্ষতি হয় না; তাই একে অনৈতিক মনে করতে পারি না। কিন্তু এ-নিষেধগুলো কেনো? এ-নিষেধগুলোর পেছনে নৈতিকতা নেই, বিজ্ঞান নেই;-আজকাল ছদ্মবিজ্ঞানীরা আদিম মানুষের অজস্র কুসংস্কারকে বিজ্ঞানসম্মত ব’লে প্রমাণ ক’রে প্রচুর ধন উপার্জন করছে; এগুলোর পেছনে আছে বিধানপ্রণেতারাদের কুসংস্কার ও স্বেচ্ছাচার।
মুসলমানের চোখে শুয়োর জঘন্যতম ঘেন্নার বস্তু; এর নামে মুসলমান যতোটা শিউরে ওঠে নরকের নামেও ততোটা ওঠে না। বন্দুকের টোটয় শুয়োরের চর্বির গুজব শুনে তারা মহাবিদ্রোহই ঘটিয়েছিলো ১৮৫৭ সালে। একটি ঘটনা মনে পড়ছে। বিলেতে ব্রিটিশ কাউন্সিলের আপ্যায়নে আমরা ছিলাম কিছু দিন। প্রান্তরাশে একটি সুস্বাদু মাংসাটুকরো প্রতিদিনই থাকতো, যার নাম ‘বেকন’। কয়েক দিন পর আমার এক ধাৰ্মিক বাঙলাদেশীয় বন্ধু ও আমি একই টেবিলে বসি। তিনি বেকন কেটে কেটে খেতে খেতে বলেন- ‘এই বেকন জিনিশটা যে কী বুঝতে পারছি না, কিন্তু এর থেকে সুস্বাদু জিনিশ আর আমি খাই নি।’ তিনি জানতে চান—’বেকন কী?’ আমি বলি—‘এটা শুয়োর মাংস।’ বন্ধুটি সাথে সাথে দাড়িয়ে যান, দু-হাতে মুখ চেপে ধরেন, প্রাতরাশ না ক’রেই দৌড়ে বেরিয়ে যান। ঘৃণা ও সংস্কার কতোটা প্রবল হ’তে পারে মানুষের সেদিন আমি চোখের সামনে দেখতে পাই। শুয়োর একটি নিরীহ প্ৰাণী, সেটি কোনো নৈতিকতা ও ধর্মের কথা জানে না; জানে না তাকে কারা ঘৃণা করে, কারা করে না। ঘৃণার ব্যাপারটিই আপত্তিকর, ঘৃণাকারীরা অসুস্থ। বলা হয়েছে যে শুয়োরমাংস হচ্ছে ‘রিজস’, অর্থাৎ ‘abomination’, ‘unclean’, বা ‘ঘৃণা’ ও ভীতির বস্তু’ বা ‘অপবিত্র’। অধিকাংশ মুসলমান, যদি জিজ্ঞেস করা হয় সে কেনো শুয়োর খায় না, বলে যে এটা নিষিদ্ধ। তবে একদল শিক্ষিত মেলে যারা গর্বের সাথে বলে, তারা এটা খায় না, কেননা এটা খেলে রোগ হয়। মজা হচ্ছে যে আরবে শুয়োর ছিলো অপরিচিত; তবে এটা কেনো নিষিদ্ধ হলো? এটা ঠিক যে শুয়োরমাংস খেলে Trichinosis নামে একটি মৃদু রোগ হ’তে পারে, তবে এটা উনিশশতকের আগে কেউ জানতো না। গরু, ছাগল, মেষ প্রভৃতি পশুর মাংস থেকেও মানুষের শরীরে রোগ ছড়াতে পারে, সেগুলো তো খাই আমরা। শুয়োর নিষিদ্ধ হলো কেনো? আমি তা ব্যাখ্যা করবো না। অবশ্য শুয়োর মুসলমানের জন্যে নিষিদ্ধ হওয়ায় শুয়োররা যে খুব দুঃখিত, তা নয়; তারা এসে কেন্দেকেটে বলে না যে দয়া ক’রে আমাদের খাও: লাভই হয়েছে তাদের এতে, তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে গেছে।
মদ্যপানও নিষিদ্ধ মুসলমানের জন্যে; তবে মদকে শুয়োরমাংসের মতো ঘেন্না করে না তারা, বরং ধনী মুসলমান খুবই ভালোবাসে অ্যালকোহল, গরিবরাও অপছন্দ করে না। মদের বিরুদ্ধে মুসলমান জগতে একটা বড়ো অপপ্রচার চলে ব’লে এই চমৎকার বস্তুটির ভাবমূর্তি বেশ নষ্ট হয়ে গেছে; এবং মুসলমান পরিবারে খামোখা গোলমাল লেগে থাকে। স্বৰ্গে মদ থাকবে, মর্তেও এটা খারাপ নয়। মদ সম্বন্ধে মুসলমানের কপটতা ভালোভাবে ধরা পড়ে বর্তমানে উৎপাদিত ‘ইসলামি বিয়ার’ ও এ-ধরনের পানীয়তে। বিয়ার হচ্ছে বিয়ার, তাতে অ্যালকোহল থাকবে; কিন্তু ধাৰ্মিক মুসলমান অ্যালকোহল খাবে না, মদের নাম খাবে। কী শোচনীয় এই নৈতিকতা। মদ মুসলমানের কল্পনাকে বেশ ভ’রে রাখে-মুসলমান মদের প্রতি বিকর্ষণ বা আকর্ষণ বোধ করে, কিন্তু কখনো ভুলে থাকতে পারে না। মদ মুসলমানের কল্পনাকে কতোখানি ভ’রে রাখে তার পরিচয় পাই বিপুল পরিমাণ আরবি ও ফারসি কবিতায়; এবং নজরুলের এ-পবিত্ৰ পংক্তিটিতে : ‘খোদার প্রেমের শারাব পিয়ে বেহুশ হয়ে রই পড়ে।’ আরবি কবিতা ও আরব্য রজনী মদের গন্ধে ভরপুর। ইসলামি পাকিস্থানে মদ্যপান সম্পর্কে খুশবন্ত সিং জানিয়েছেন যে মদ সেখানে রাভি নদীর মতো প্রবল বেগে প্রবাহিত হয় না, তবে সব ধনীর বাড়িতেই চুইয়ে চুইয়ে পড়ে। চার্লস গ্রাস (টাইমস্ লিটেরেরি সাপ্লিমেন্ট, ২২ এপ্রিল ১৯৯৪) সৌদি আরবে মদ্যপানের কপটতা সম্পর্কে লিখেছেন :
অ্যালকোহল রাখা নিষিদ্ধ, কিন্তু আমি যেখানেই গেছি, রাজপুত্র, মন্ত্রী, দূতদের ভবনে আমাকে আপ্যায়ন করা হয়েছে হুইস্কি দিয়ে (জনপ্রিয় হচ্ছে জনি ওয়াকার ব্ল্যাক লেবেল)। আমি জানতে পারি যে এক সন্ধ্যায় যে-রাজপুত্রের সাথে আমি হুইস্কি পান করছিলাম, তিনি পরদিন ভোরে এক ব্যক্তিকে মদ্যপানের অপরাধে কারাদণ্ডিত করবেন।
পৃথিবী জুড়েই মুসলমান মদ্যপান করে; আর আরবরা পান করে না, মাছের মতো গিলে। মদ্যপান মুসলমানের জন্যে একদিনে নিষিদ্ধ হয় নি, হয়েছে ক্রমশ, এক বিখ্যাত ব্যক্তির মত্ততার জন্যে এটা নিষিদ্ধ হয়ে যায় চিরকালের জন্যে; এর জন্যে ব্যবস্থা হয় আশিটি চাবুকের, এমনকি মৃত্যুদণ্ডের। তবে আরবরা নতুন ধর্মের আগেও মদ খেয়েছে, পরেও খেয়েছে ও খাচ্ছে, এবং মদ খাওয়া নিয়ে লিখেছে প্রচুর কবিতা, যেগুলো পরিচিত ‘খামরিয়া’ বা মদের কবিতা’ নামে। দ্বিতীয় খলিফার কালে বারবার মদের প্রশংসা ক’রে কবিতা লিখে কারাগারে গেছেন, ও নির্বাসিত হয়েছেন কবি আবু মিহজান; তার একটি কবিতার অংশ এমন :
দাও, বন্ধু, একটুকু মদ আমি পান করি; আমি
ভালোভাবে জানি মদ সম্পর্কে কী নির্দেশ দিয়েছে বিধাতা।
আমাকে দাও খাটি মদ যাতে আমার পাপ হয় বৃহৎ
কেননা অমিশ্র মন্দ পান করলেই পরিপূর্ণ হয় পাপ।
এ-কবিতার প্রতিবাদটুকু চোখে পড়ে সকলেরই। মদের শ্রেষ্ঠ কবি আবু নুয়াস (৭৬২-৮১৪), যাকে বারবার দেখা যায় আরব্য রজনীতে হারুন আলরশিদের সাথে। মদের প্রশংসা ক’রে মৃত্যুদণ্ড তিনি এড়াতে পারেন নি; হায়, নির্বোধ কবি, কেনো প্রশংসা করো; প্রকাশ্যে উচ্চকণ্ঠে নিন্দে করো, এবং গোপনে মাছের মতো খাও। শুধু কবিরাই নন, বীরেরাও মদ খেতেন, তারাই খেতেন বেশি; খালিদ ইবনে ওয়ালিদের জীবনীকার গর্বের সাথে জানিয়েছেন। খালিদ যৌবনে নিয়মিত নামতেন। মদ্যপানের প্রতিযোগিতায়, এবং প্রথম হতেন।
মদ্য একদিনে নিষিদ্ধ হয় নি, প্রথমে এটি প্রশংসিতই ছিলো, পরে নিষিদ্ধ হয়। কয়েক পর্যায়ে। আদিমুসলমানদের কেউ কেউ পান ক’রে খুবই অস্বাভাবিক আচরণ করেছিলেন, যার জন্যে এটা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এ-সম্পর্কে যে-কাহিনী প্রচলিত, তা সত্যিই স্তম্ভিত করে আমাদের। কোনো সচিব সচিবালয়ে গিয়ে বা কোনো অধ্যাপক ক্লাশে গিয়ে মাতলামো করেছে, এমন কখনো ঘটে নি; কিন্তু ওই বিখ্যাত ব্যক্তি খুবই অশোভন আচরণ করেছিলেন উপাসনালয়ে। ১৬.৬৭তে আছে : ‘And among fruits you have the palm and the vine, from which you get wine and healthful nutriment: in this, truly, are signs for those who reflect’ (রোডওয়েল)। এতে রয়েছে একটি শব্দ ‘সংকর’। এর অর্থ নিয়েই অনুবাদকদের মধ্যে বিরোধ : দাউদ অনুবাদ করেছেন ‘intoxicants’, পিকথল করেছেন। ‘strong drink’, ইউসুফ আলি করেছেন ‘wholesome drink’; ইসলামিক ফাউন্ডেশন করেছে ‘মাদক’। মদ্যপান একেবারেই খারাপ নয়; আমি খাই, শামসুর রাহমান খান, এবং খায় লাখ লাখ বাঙালি ও মুসলমান, এবং খেয়েছেন গ্যালিলিও, নিউটন, শেক্সপিয়র, তলস্তয়, রবীন্দ্রনাথ, আইনস্টাইন: খান অজস্র সচিব, সম্পাদক, অধ্যাপক, মন্ত্রী, সেনাপতি, রাষ্ট্রপতি, উপাচার্য, বিচারপতি, দূত, পুলিশ। নিষেধ মানসিক রোগ সৃষ্টি করে; মুসলমান যখন মদ খায়, তার মনে অপরাধবোধ জন্মে, কেননা পরিবার ও সমাজ তাকে মনে করে মাতাল, দেখে খারাপ চোখে। অনেককে জানি আমি যারা মদ খেয়ে বাসায় ফেরার আগে খান প্রচুর পানশুপুরিজর্দা, কেউ কেউ চিবোন পেয়ারাপাতা; অনেকে অপরাধবোধে ভুগে ভুগে পুরোপুরি মাতাল হয়ে পড়েন, কাঁদতে থাকেন, বাসায় আর ফিরতে পারেন না। এ-অসুস্থতা থেকে উঠে আসতে হবে মুসলমানকে মদকে মনে করতে হবে একটি পানীয়, যা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ পান করে।
বহু দিন মার্ক্স এঙ্গেলস, সাম্যবাদ, শ্রেণীসংগ্রাম, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ, বিপ্লব শব্দগুলো শুনি না। কেউ বললে বা দেয়ালে এ-শব্দগুলো দেখলে কেঁপে উঠি, তারপর শান্ত হই। আমি কখনো শ্লোগানে মুখর হই নি, যারা মুখর হতেন এখন তাদের পুঁজির শ্লোগানে মেতে থাকতে দেখি। পৃথিবী কি তার শেষ সামাজিক পরিণতিতে পৌঁছে গেছে, সব অসুখ কি সেরে গেছে পৃথিবীর? পৃথিবীতে কি আর গরিব নেই? পৃথিবী কি এখন ভাসছে ডলারের স্রোতে? এ-শব্দগুলো এখন নিষিদ্ধ শব্দের মতো, এবং এগুলো আজ সম্পূর্ণ নিস্ক্রিয়। মার্ক্স যে বলেছিলেন দার্শনিকেরা এতো দিন শুধু নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন বিশ্বকে, এখন দরকার তাকে বদলে দেয়া; আমরা কি ফিরে যাবো আবার মার্ক্সের আগে, শুধু ভাষ্যের পর ভাষ্য লিখবো পৃথিবীর? শুধু স্থগিত রাখবো তাকে বদলে দেয়া? গরিব আরো গরিব হ’তে থাকবে ধনী আরো ধনী; আর গরিবেরা শুধু ব্যবহৃত হবে ধনীদের ক্ষমতা দখলের শ্লোগানে? মার্ক্স ধর্মকে বলেছিলেন ‘গরিবদের আফিম’; অনেকটা প্ৰশংসার্থেই তিনি প্রয়োগ করেছিলেন রূপকটি, কিন্তু এর আধুনিকত্বে মর্মাহত হয়েছেন ধাৰ্মিকেরা। ধার্মিকেরা বলে থাকেন যে বিধাতাই শেষ আশ্রয়, যার আর কিছু নেই তার আছে বিধাতা, মার্ক্স এ-অর্থেই ব্যবহার করেছিলেন রূপকটি; তবে তিনি এর মূল্য বদলে দিয়েছিলেন। সব কিছু নিরর্থক হয়ে যাওয়ার পরই এক সময় মানুষ খেতো আফিম, যেমন আজকাল গ্রহণ করে মাদক; আফিমের মাদকতায় তারা সুখ পেতো, কিন্তু শেষে অসার হয়ে পড়তো; বিধাতায়ও তাই হয়, সুখ পেতে পেতে শেষে মানুষ আসার হয়ে পড়ে। গরিবদের সাথে বিধাতার গভীর সম্পর্ক রয়েছে, তাকে পাওয়ার জন্যে টাকা পয়সা লাগে না। ভাওয়ালে পর্তুগিজ পাদ্রি আসসুম্পসাউও বুঝেছিলেন ‘ঈশ্বর থাকেন গরিবদের আঙিনায়’, তাই যেতে হবে সেখানেই। মানুষ শিক্ষিত হয়ে জন্ম নেয় না, জন্ম নিয়েই সে বিচার করতে পারে না। সব কিছু একটি মানুষকে তৈরি করতে দু-দশক সময় কেটে যায়। গরিবের সন্তানকে প্রস্তুত করে দারিদ্র্য: তার কিছু নেই, তাই তার ওপর সহজেই চাপিয়ে দেয়া যায় বিধাতাকে। বাঙলাদেশে এখন তাই হচ্ছে, প্রতিক্রিয়াশীলতা যে তীব্র বেগে বাড়ছে, তার কারণ দারিদ্র্য। ধনীরা ধর্মকে পাত্তা দেয় না, কিন্তু ধর্ম দিয়ে যেহেতু তারা প্রতারণা করতে পারে, তাই নানা খেলা খেলে তারা ধর্মের সাথে: এবং সবচেয়ে করুণ খেলাটি খেলে গরিবদের সাথে।
দারিদ্র্য কোনো বিধাতার উপহার নয়, কোনো ঐতিহাসিক নিয়তিও নয়; এটা রাজনীতিক, ও প্রচণ্ড সন্ত্রাসের ফল; দারিদ্র্য সম্পদের অভাবের জন্যে ঘটে না, ঘটে তার অপব্যবহারের জন্যে; একথাই জানিয়েছিলেন মার্ক্স। কিন্তু চারপাশে তাকালে কী দেখতে পাই? দেখতে পাই দারিদ্র্য করুণাময়ের দান, তিনি যাকে করুণা করেন তাঁকে পাঁচখানা পাজেরো দান করেন, আর যাকে ইচ্ছে করেন তাকে রেললাইনের পাশে টায়ার পুড়ে রান্না ক’রে খেয়ে মরতে বাধ্য করেন। গরিবদের অনেকের সাথে আমি কথা ব’লে শিউরে উঠেছি, দেখেছি সত্যিই তারা বিশ্বাস করে তাদের দারিদ্র্য বিধাতারই দান। ধর্ম এমন ব্যাপার যা শূদ্র হওয়াকে, দরিদ্র হওয়াকে ধর্মীয় বিশ্বাসে পরিণত করে; শূদ্র ও দরিদ্র বিশ্বাস করে এভাবেই সে স্বর্গে যেতে পারবে। এ-বিশ্বাস অবশ্য তার নিজের নয়, হাজার হাজার বছর ধ’রে এটা তাকে শেখানো হচ্ছে, প্রতিদিন ধাৰ্মিকেরা তাদের এটা শেখান; তাই তাদের মনে এ-বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে উঠেছে। ধর্ম দিয়ে তাদের এখন আরো মাতিয়ে রাখা সম্ভব। কিছু টাকা ছেড়ে দিলে ধর্ম ও অর্থের মিশ্রণে তাদের মধ্যে উৎপন্ন হয় এমন উত্তেজক মাদক, যা বিপ্লবের সব সম্ভাবনাকে দীর্ঘকালের জন্যে স্থগিত ক’রে দেয়। আমরা অবশ্য অনেক বিপ্লব ও তার ব্যর্থতা দেখেছি। বিশশতক তো যুদ্ধ ও বিপ্লবেরই শতাব্দী। উনিশশতক ছিলো জাতীয়তাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ প্রভৃতির শতাব্দী, যা বিপন্ন ক’রে তুলেছিলো পৃথিবীকে; আর বিশশতকে ঘটেছে এতো প্রচণ্ড বিপর্যয় যে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মানুষকে মুক্ত করা দুরাশায় পরিণত হয়েছে। যুদ্ধ আর বিপ্লব এক নয়, যদিও দুটিতেই ঘটে সন্ত্ৰাস; বিপ্লব আধুনিক ব্যাপার, বিপ্লবের সাথে থাকে মুক্তির চেতনা। হান্না আরেভূটু দেখিয়েছেন আধুনিক বিপ্লবের ধারণার সূচনা হয় আঠারোশতকের আমেরিকা ও ফরাশিদেশে। যুদ্ধের ফলে নানা বদল ঘটে, কিন্তু বিপ্লব শুধু বদল ঘটায় না। বিপ্লবের সাথে জড়িত থাকে এ-চেতনা যে সমাজের চলতি অবস্থা অবধারিত নয়, আবশ্যকও নয়। প্রাকৃতিক সূত্রে কোনো ধনীগরিব নেই। বিপ্লবের সম্ভাবনা দেখা দেয় তখনি যখন মানুষ বোধ করে যে দারিদ্র্য অবধারিত নয়, এটা মানুষের সৃষ্টি; মনে করতে থাকে যে একদল মানুষ, পরিস্থিতির সুযোগে, বা শক্তিপ্রয়োগ, বা জোচ্চোরি ক’রে ধন আয়ত্ত করেছে, এবং আরেক দল, যারা তা পারে নি, হয়ে আছে দরিদ্র; তাই ধনীগরিবের পার্থক্য অবধারিত নয়, শাশ্বতও নয়। কোনো বিপ্লব আজো সফল হয় নি; পৃথিবীর দুটি বড়ো বিপ্লব—ফরাশি বিপ্লব ও রাশিয়ার সাম্যবাদী বিপ্লব ব্যর্থ হয়ে গেছে। দু-এক দশকে আর বিপ্লবের মুখ দেখবো ব’লে আশা করতে পারছি না; কেননা প্রতিক্রিয়াশীলতা এখন ব্যাপক, আর গরিবেরা বিশ্বাস করছে যে বিধাতাই তাদের গরিব করেছে, আর ধনী হ’তে চাইলে তাদের সুযোগ নিতে হবে পরিস্থিতির, বা জোচ্চোরির-এটাই বিধাতার বিধান।
চারদিকে চলছে। জীবনের উৎসব, প্ৰাণের রঙিন কার্নিভাল, আবেগে গাল লাল হয়ে উঠছে সবুজ হয়ে উঠছে পাতা; এ-কার্নিভালে কুৎসিত মুখোশ প’রে কে নাচছে তুমুল নাচ?—মৃত্যু। মানুষের চিন্তায় মৃত্যু বিমূর্ত ধারণা নয়, মানুষের মনে মৃত্যু এক সজীব অস্তিত্ব, যার কাজ তার রঙিন উৎসবকে অন্ধকার ক’রে তোলা। সে চলছিলো, একদিন থেমে যাচ্ছে, কোনো দিন জানবে না সে ছিলো। অন্যরা হয়তো জানবে, যদি সে জানার মতো হয়, তবে একদিন ভুলে যাবে। আমি বড়ো হয়েছি মৃত্যুর মধ্যে, মৃত্যুপরিবৃত হয়ে; ছেলেবেলায় মাঝেমাঝেই শুনতাম কোনো বাড়ি থেকে উঠছে করুণ কান্নার রোল, বুঝতাম। কেউ মারা গেছে, কেঁপে উঠতাম। আমার চারদিক অন্ধকারে ঢেকে যেতো, কোনো রাতও আমন অন্ধকার নয়। তারা সাধারণত হতো শিশু-বালকবালিকা, আমার মতোই, কখনো আমার থেকে ছোটো, কখনো বড়ো। বুড়োরাও মরতো, তবে আমন করুণ কান্না উঠতো না তাদের মৃত্যুতে। ভাবতাম আমার জন্যেও মৃত্যু অপেক্ষা ক’রে আছে; আমি ম’রে যাবো, আর কুয়াশায় হাঁটবো না, রোদে দাঁড়াবো না, ঝাঁপিয়ে পড়বো না পুকুরে, উঠবো না গাছে, যাবো না ইস্কুলে। বুক সব সময়ই ভারী হয়ে থাকতো; আমার সারাটি বছরই ছিলো মৃত্যু দিয়ে ঘেরা, প্রতিটা মাসই ছিলো মৃত্যুর মাস; চারদিকে দেখতাম মৃত্যুর মুখ, কিন্তু তার মুখ দেখতে পেতাম না। কলেরা আসবে কার্তিকে, রহস্যময় শাদা শাড়ি পরে এক নারী চুল উড়িয়ে হেঁটে যাবে আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে, তার শাদা আঁচল লাগবে আমাদের বাঁশের বেড়ায়, রাতে আমি বমি ক’রে ফেলবো, আমি ম’রে যাবো; বসন্ত আসবে চোত বা বোশেখে, আমাদের বাড়ির ওপর দিয়ে এক দমকা বাতাস বয়ে যাবে, আমার জুর আসবে, আমি ম’রে যাবো। সারা বাল্যকাল ভরে আমি মৃত্যুকে পথে পথে, বেড়ার পাশে, পুকুরের জলে, ধানের গুচ্ছে, শিশিরে, গাছের ডালে, আর কুয়াশারোদের ভেতরে দেখতে পেয়েছি। যারা আমাদের গ্রামে ম’রে যেতো, যদি তারা আমারই বয়সের হতো, আমি ম’রে যেতাম তাদের সাথে; তাদের সাথে কাফন প’রে আমি নেমে যেতম কবরে, আমার ওপর মাটি ঝ’রে পড়তো, আমার চারদিকে উঠতে থাকতো অবোধ্য শ্লোকের ভীতিকর শব্দ, আগরবাতির দমবন্ধ করা গন্ধ। আমার ঘুম আসতো না। কতোবার যে আমি ম’রে গেছি আমার বাল্যকালে।
মৃত্যু খুবই কাছে থেকে দেখেছি আমি, বাল্যকালে; যৌবনের পর আর মৃত্যু কাছে থেকে দেখি নি। মৃত্যু বাল্যকালের পর আমার কাছে মূল্য বা মর্যাদা হারিয়ে ফেলে; আমি ভুলেই যাই যে মৃত্যু আছে, বা থাকলেও আমার তাতে কিছু যায় আসে না, তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। পঞ্চম/ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি তখন, আমাদের পাশের বাড়ির এক বুড়ো, যাকে আমি দাদা বলতাম এবং তিনিও আমাকে দাদা বলতেন, তিনি মারা যাবেন, তাঁর পাশে কেউ নেই, শুধু আমি ছিলাম। তিনি মারা গেলেন, আমি সবাইকে ডেকে জানালাম যে দাদা মারা গেছেন। আমার কোনো কষ্ট লাগে নি; এমনকি আমি তার কবরও অনেকটা খুঁড়েছিলাম। কয়েক বছর পর যখন আমার ছোটো এক ভাই ম’রে গেলো, রাতে অসুখ হয়ে চ’লে গেলো ভোরেবেলাতেই, কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেলো, আমি তাঁর কবর খুঁড়তে পারি নি, আমি তার কবরে ঝাঁপিয়ে পড়তে চেয়েছিলাম। এখনকার শিশুদের, অন্তত আমার শ্রেণীটি যাদের জন্ম দিচ্ছে ও লালনপালন করছে, তারা মৃত্যু চেনে না, মৃত্যু তারা দেখে নি; আমার কাছে মৃত্যুর যেমন জীবন্ত অস্তিত্ব ছিলো, তাদের কাছে মৃত্যুর তেমন অস্তিত্ব নেই। তারা দূর থেকে শোনে মৃত্যু আছে, কিন্তু তা তাদের নাড়া দেয় না, একবার শুনে তারা অন্য দিকে মন দেয়, ক্রিকেট খেলতে যায়; তারা কান্নার করুণ সুর শুনতে পায় না। তারা সব। কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন, মৃত্যুর ভয় ও বেদনা থেকেও বিচ্ছিন্ন। তারা হয়তো অনেক কুসংস্কার থেকে মুক্ত; এবং মুক্ত অনেক ভয় থেকে। ইউরোপ আমেরিকায় মৃত্যু আরো বিমূর্ত, আরো নিরবয়ব হয়ে উঠেছে; সেখানে অনেকে আছে, যারা কখনো কারো মৃত্যু দেখে নি, কোনো লাশ দেখে নি। সেখানে শিশুদের পিতামাতারা সাধারণত মারা যায় না, আর সাধারণত শিশুরা মারা যায় না; যারা মারা যায়, তারা জীবন থেকে অনেক আগেই অনেক দূরে স’রে গেছে। হাসপাতাল তাদের মানবিকভাবে লোকান্তরিত হওয়ার ব্যবস্থা করে, সমাহিত্যকারী প্রতিষ্ঠানগুলো মানবিকভাবে তাদের সমাহিত করে; চারপাশে কোথাও মৃত্যুর দাগ লাগতে দেয় না। সেখানে কেউ মরে না, একদিন অনুপস্থিত হয়ে যায়।
শুধু মানুষ নয়, সব প্রাণীর মৃত্যুর কথাই আমার মনে পড়ে। হিংস্র বাঘ, বিশাল হাতী, হরিণ, বা সাপ, বা পিপড়ে কীভাবে মারা যায়। আমি জানি না; তারা কতোটা কষ্ট পায়, তা আমি জানি না। কীভাবে মরে টিয়ে, চড়ুই, কবুতর, কাক, তাও আমার জানা নেই। আমি জানি না তারা মৃত্যুকে মানুষের মতোই ভয় করে কি না। তারা কি জানে মৃত্যুর কথা? আমি দু-একটি পাখি ও বেড়ালকে ধীরেধীরে মরতে দেখেছি; কী তীব্র কষ্টে তারা বিবশ হচ্ছে, মুমূর্ষ হচ্ছে, চোখে চরম হতাশা জমা বাঁধছে, তাও দেখেছি; কিন্তু তারা কি জানতো তারা মারা যাচ্ছে? সম্ভবত অন্য কোনো প্রাণীরই মৃত্যু সম্বন্ধে ধারণা নেই; না কি আছে?
খুব কষ্ট পাই আমি তাদের জন্যে, যারা হঠাৎ ম’রে যায়, আর যারা মরে যায় নামপরিচয়হীন। পরিস্থিতি একটু ভিন্ন হ’লেই তারা মরতো না, থাকতো জীবনের উৎসবে; কিন্তু পরিস্থিতি সামান্য ভিন্ন হওয়ায় তারা স’রে গেছে। তাদের কথা ভাবলে খুব তীব্র নিরর্থকতার বোধে আক্রান্ত হই আমি, যেমন তীব্র নিরর্থকতার বোধ হয় হিরোশিমা আর নাগাসাকির কথা ভাবলে। ওই দুই নগরের মানুষ যুদ্ধের মধ্যেও ভালো ছিলো; হঠাৎ তাদের ওপর লাফিয়ে পড়লো বিস্তৃত নরক। যারা ম’রে গেলো তারা জানলোও না কীভাবে কোথায় থেকে হঠাৎ এলো এমন মৃত্যু। চরম নিরর্থকতার ও আকস্মিকতার বোধ নিয়ে স’রে গেছে। ওই দুই নগরের মানুষ। মৃত্যু কী রূপে দেখা দিয়েছিলো আউসহ্বিট্জে, হিটলারের মানুষনিধনকুণ্ডে? ধাৰ্মিকেরা বলেন বিধাতা করুণাময়, এটা কেমন করুণা তারা? দুটি নগরের অসংখ্য মানুষ ধ্বংস করা হলো আণবিক বোমায়, আউসহ্বিট্জে পোড়ানো হলো লাখ লাখ মানুষ তারই করুণায়? নিশ্চয়ই সমস্ত প্ৰশংসা তার। তিনি কি দয়াময় নন? না কি তিনি মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলেন ওই সময়? হোৱাইনবার্গ এমন নির্বিকার বিধাতার কাছে প্রার্থনা করাকে মনে করেন। চরম অভদ্রতার কাজ। এলাই হ্বিসেল বলেছেন আউসহ্বিট্জে শুধু মানুষের মৃত্যু হয় নি, মৃত্যু হয়েছে মানুষ ধারণাটিরও; আউসহ্বিট্জে বিশ্ব পোড়ায় তার আপনি হৃদয়। আউসহ্বিট্জে একা হিটলারের কাজ নয়, ওই কাজে অংশ নিয়েছিলো নানা পেশার মানুষ; লেখক ও শিক্ষকেরা প্রস্তুত করেছিলো ঘেন্নার উর্বর জমি, যেখানে হিটলার বুনেছিলো তার ইহুদিবিদ্বেষের বীজ, ছাত্র ও পাঠকেরা তুলেছিলো তার ফসল: আইনজীবীরা আইন তৈরি ক’রে বিচ্ছিন্ন করেছিলো ইহুদিদের এবং প্রস্তুত করেছিলো বধ্যভূমি, চিকিৎসকেরা নারীপুরুষশিশুর ওপর গ্যাস প্রয়োগ ক’রে চালিয়েছিলো পরীক্ষা; বিজ্ঞানের নামে বিজ্ঞানসাধকেরা সম্পন্ন করেছিলো বন্দীদের ওপর তাদের নৃশংস নিরীক্ষা। ব্যবসা-ব্যবস্থাপকেরা ব্যবহার করেছিলো তাদের শাস্তা শ্রমিকরূপে। কোনো আদিম সমাজে ঘটে নি আউসহ্বিট্জ; ঘটেছিল বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, দর্শন, শিল্পকলায় উন্নত এক সমাজে। এ-সমাজের কাছে কি চাইবো না আমরা মানবিকতা বা মনুষ্যত্ব? তার বদলে যা দেখতে পাই, তা হচ্ছে সব কিছুই সম্ভব মানবসমাজে; মানুষের এক গোত্র সম্পূর্ণ নিৰ্মল করতে পারে আরেক গোত্রকে। একাত্তরে কি তা-ই দেখি নি আমরা? সম্ভব হ’লে কি পাকিস্থানি ঘাতকেরা সম্পূর্ণ নির্মূল করতো না বাঙালিদের?
আউসহ্বিট্জে বিধাতার ভূমিকা কী? এ-প্রশ্ন শুনে আমি হো হো ক’রে হেসে উঠবো; ন্যায়পরায়ণ ধাৰ্মিকেরা চুপ ক’রে থাকবেন, স্থূল ধাৰ্মিক হয়তো একে গণ্য করবে ইহুদিদের ওপর বিধাতার অভিশাপ ব’লে। কিন্তু বাঙলাদেশে গণহত্যায় কি ভূমিকা বিধাতার? রাজনীতিক কারণে হয়তো সবাই চুপ থাকবে। বাঙলাদেশে গণহত্যা বা আউসহ্বিট্জে বিধাতার ভূমিকা কি দর্শনের বিষয় হ’তে পারে? হ্যা, হতে পারে; যেমন আউসহ্বিট্জে বিধাতার ভূমিকাকে দর্শনের বিষয়ে পরিণত করেছেন এলাই হ্বিসেল। হ্বিসেল নিজে বন্দী ছিলেন আউসহ্বিট্জের মৃত্যুশিবিরে; কিন্তু বেঁচে গিয়েছিলেন, তবে ওই বাঁচা বদলে দিয়েছিলো তাঁর সব কিছু। তিনি বলেছেন লেখক হওয়ার কথা তার ছিলো না; কিন্তু তিনি লেখেন, কেননা তিনি তাৎপর্য দিতে চান তার বেঁচে থাকাকে; নইলে তিনি পাগল হয়ে যাবেন। যে-ইহুদিনিধনকুণ্ড জ্বলিয়েছিলো হিটলার, তার মূলে রয়েছে সামাজিক রাজনীতিক আর্থনীতিক কারণ ও তার ব্যক্তিগত বিকার; তবে হ্বিসেল এর সাথে যুক্ত করেন বিধাতাকেও। তার মতে বিধাতাকে বাদ দিয়ে এ-মহানরক ব্যাখ্যা করা যায় না। কীভাবে বিধাতাকে জড়ানো যায় এমন অশুভ ব্যাপারে? তাহলে কি বিধাতা আর শয়তানের মধ্যে পাতাতে হবে আবার বন্ধুত্ব, মিটমাট ক’রে ফেলতে হবে তাদের পুরোনো কলহ? বিধাতাকে কি দাঁড় করাতে হবে কাঠগড়ায়? ধার্মিকেরা সব সময় বিধাতাকে শুভ দেখতে চান, আর অশুভ সব কিছু চাপিয়ে দেন। শয়তানের বা মানুষের ওপর। হ্বিসেল এটা মেনে নেন না; তার মতে বিধাতাকে অতি শুভ মনে করাতেই বৈধতা পায় অশুভ। এ নিয়ে তিনি লিখেছেন এক অসাধারণ নাটক : বিধাতার বিচার।
মৃত্যু কাকে বলে? মৃত্যু হচ্ছে জীবনপ্রক্রিয়ার উল্টোনো অসম্ভব পরিসমাপ্তি; আর ফেরা নেই, আর অগ্ৰগতি নেই; চিরকালের জন্যে থেমে যাওয়া। যে ছিলো সে আর নেই; আর সে নিশ্বাস নেয় না, তার শিরা আর কাপে না, আলো তাকে আর চকিত করে না, আঘাত তাকে আর ব্যথা দেয়া না। তাপহীন হয়ে ওঠে তার শরীর, কিছুক্ষণ পর শক্ত হয়, আরো কিছুক্ষণ পর পচন ধরে। জীবনের কিছু আর তার জন্যে নয়-একদিন স্বপ্ন ছিলো, সোনা ছিলো, তা আজ নিরুত্তর শান্তি পায়, যেনো কোন মায়াবীর প্রয়োজনে লাগে; তার জন্যে অপেক্ষমান এখন মাটি ও আগুন। বিজ্ঞান এখন নানা উপায় বের করেছে নিশ্চিতভাবে জানতে যে সত্যিই লোকটি মরেছে কি না? কেনো এতো উপায়? মানুষ মরতে চায় না ব’লেই—গলিত স্থবির ব্যাং আরো দুই মুহুর্তের ভিক্ষা মাগে? অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে? মৃত্যুর ভয়ে চিরকালই জামে গেছে মানুষ; আধুনিকদের থেকে সম্ভবত পুরোনোরাই ভয় পেয়েছে বেশি; তাই মৃত্যু নিয়ে তাদের ভাবনাকল্পনার শেষ নেই। তারা কল্পনা করেছিলো আত্মা; আর আত্মাকে বিস্মৃতির নদী পার করিয়েছে, বাস করিয়েছে বিস্মৃতিলোকে তাকে ত্ৰাণ করার উপায় কল্পনা করেছে, ছায়ামূর্তিরূপে রেখেছে মৃতদের দেশে, প্রেতলোকে, শেষে বিচার করিয়েছে, এবং পাপপুণ্য অনুসারে রেখেছে স্বর্গে বা নরকে। মৃত্যুভয়েই দেখা দিয়েছিলো এসব উন্মত্ত কল্পনা; সত্যের মুখােমুখি না হয়ে তারা তৈরি করেছিলো সুখকর সুন্দর মিথ্যে। অনেক পাগল ভেবেছে মৃত্যু হচ্ছে জীবনেরই আরেক রূপ, তার জীবন ছুটে চলেছে এক অবস্থা থেকে আরেক অবস্থায়, এক বিমানবন্দর থেকে আরেক বিমানবন্দরে। হিন্দুরা ভয়ে কল্পনা করেছে। বারবার জীবন, বৌদ্ধরা নিস্ক্রান্ত্র হয়ে যেতে চেয়েছে জীবন থেকে। আমি যেমন ছেলেবেলায় চারপাশে মৃত্যু দেখতাম পুরোনোরাও দেখতেন, তাই তাঁরা অনেক কিছুর মুখে দেখতে পেতেন মৃত্যু। তাঁরা মৃত্যু ও নারীকে দেখতেন অভিন্নরূপে। হোমারে পাই পাখিনারী সাইরেনদের, যারা মৃত্যুর প্রতিমূর্তি। কঙ্কালও এক সময় ছিলো মৃত্যুর প্রতীক। রোম্যান্টিক কবিরা অবশ্য শিশুর মতোই কল্পনা করেছেন মৃত্যুকে; রবীন্দ্রনাথের কাছে কখনো তা রাধার কাছে কৃষ্ণের মতো, কখনো মায়ের এক স্তন থেকে আরেক স্তনে স্থানান্তর-প্রচুর মাতৃদুগ্ধ পানের ব্যবস্থা রয়েছে মৃত্যুর পর; ডান যদিও বোধ করেছিলেন যার জন্যেই ঘণ্টা বাজুক তা বাজে তাঁর জন্যেই, কিন্তু কবিতা লিখতে গিয়ে বলেছেন, ‘মৃত্যু তুমি গর্বিত হয়ো না’, চিৎকার ক’রে বলেছেন, ‘মৃত্যু তুমি নেই। মৃত্যুর থেকে গর্ব করার অধিকার আর কার আছে? হাহাকারের মতো শোনায় ডানের এই চিৎকার। তবে মৃত্যু সাম্যবাদী, সবাইকে নামিয়ে আনে একই সমতলে—একই আবর্জনাস্তুপে: সব সোনার ছেলেরা অবশেষে চিমনিঝাড়ুদার বালকদের মতো ধুলোয় মেশে, এবং রাজা ও সম্রাটের হাড় পড়ে থাকে। পাশাপাশি। আসলেই কি থাকে-মর্মর প্রাসাদ ওঠে। ভিখিরির কবরে? কবরে না কি গরিবও কোটিপতিকে, মৃত্যুদণ্ডিত কবি পিটার পেট্রিক্স-এর ভাষায়, বলতে পারে : We’re equal now, I’ll not an inch resign;/This is my dunghill, as the next is thine। স্বৰ্গনরক নেই, আমরা কেউ স্বৰ্গে বা নরকে যাবো না, কিছু দিন শুয়ে থাকবো নিজ নিজ গোবরগাদায়।
আমি জানি, ভালো ক’রেই জানি, কিছু অপেক্ষা ক’রে নেই আমার জন্যে; কোনো বিস্মৃতির বিষণ্ণ জলধারা, কোনো প্রেতলোক, কোনো পুনরুত্থান, কোনো বিচারক, কোনো স্বৰ্গ, কোনো নরক; আমি আছি, একদিন থাকবো না, মিশে যাবো, অপরিচিত হয়ে যাবো, জানবো না। আমি ছিলাম। নিরর্থক সব পুণ্যশ্লোক, তাৎপর্যহীন সমস্ত প্রার্থনা, হাস্যকর উদ্ধত সমাধি; মৃত্যুর পর যে-কোনো জায়গায়ই আমি পড়ে থাকতে পারি,-জঙ্গলে, জলাভূমিতে, পথের পাশে, পাহাড়ের চূড়োয়, নদীতে, মরুভূমিতে, তুষারাস্তুপে। কিছুই অপবিত্র নয়, যেমন কিছুই পবিত্র নয়; কিন্তু সব কিছুই সুন্দর, সবচেয়ে সুন্দর এই তাৎপর্যহীন জীবন। আমরতা চাই না আমি, বেঁচে থাকতে চাই না একশো বছর; আমি প্রস্তুত, তবে আজ নয়। চ’লে যাওয়ার পর কিছু চাই না। আমি; দেহ বা দ্রাক্ষা, ওষ্ঠ বা অমৃত, বা অমরতা; তবে এখনি যেতে চাই না; তাৎপর্যহীন জীবনকে আমার ইন্দ্ৰিয়গুলো দিয়ে আমি আরো কিছুকাল তাৎপর্যপূর্ণ ক’রে যেতে চাই। আরো কিছুকাল আমি নক্ষত্র দেখতে চাই, নারী দেখতে চাই, শিশির ছুতে চাই, ঘাসের গন্ধ পেতে চাই, পানীয়র স্বাদ পেতে চাই, বর্ণমালা আর ধ্বনিপুঞ্জের সাথে জড়িয়ে থাকতে চাই, মগজে আলোড়ন বোধ করতে চাই। আরো কিছু দিন আমি হেসে যেতে চাই। একদিন নামবে অন্ধকারমহাজগতের থেকে বিপুল, মহাকালের থেকে অনন্ত; কিন্তু ঘুমিয়ে পড়ার আগে আমি আরো কিছু দূর যেতে চাই।