রাত একটা।
আজিজ মিয়া ঘুমুচ্ছিল বাজারের ঘরে। ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখে তাঁর ঘুম ভাঙল। দুঃস্বপ্নটা এতই স্পষ্ট যে মনে হচ্ছিল। ঘটনাটা সত্যিই ঘটেছে। সে দেখল তার বাড়িতে একটা কফিন এসেছে। কফিন সে আগে কখনো দেখে নি। কিন্তু স্বপ্নে দেখামাত্র সে কফিনটা চিনতে পারল। বুঝতে পারল এই বাক্স করে মৃত ছেলে এসেছে। অথচ এই ভয়ঙ্কর ব্যাপার নিয়ে কারো মনেই কোনো টেনশান নেই। আজিজ মিয়ার স্ত্রী হাফিজা যথারীতি জর্দা দিয়ে পান খাচ্ছে। পানের পিক ফেলে কাকে যেন বলল, আমার মাথায় তেল দিয়ে দে। কে একজন তার মাথায় তেল দিতে বসল।
আজিজ মিয়া অবাক হয়ে দেখল। সবাই তাদের কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত। একজন আড়ং-এর ষাঁড়কে ভুষি দিচ্ছে। আরেকজন ষাড়ের গোসলের ব্যবস্থা করছে। হাইস্কুলের হেডমাস্টার সাহেব চাদার খাতা নিয়ে এসেছেন। স্কুলে চাঁদা দিতে হবে। হেডমাস্টার সাহেবকে বিসকিট দিয়ে চা দেয়া হয়েছে। তিনি চায়ে বিসকিট ড়ুবিয়ে খাচ্ছেন। অথচ উঠানে কফিনটা পড়ে আছে, কেউ কফিন খোলার কথা বলছে না।
আজিজ মিয়া নিজেই কফিন খুলতে এগিয়ে গেল। সেখানে দেখা গোল ইমাম সাহেবকে। স্বপ্নের মধ্যেই আজিজ মিয়া বুঝতে পারছে ইমাম সাহেব জীবিত না। তিনি তেতুল গাছে ফাঁস নিয়ে মারা গেছেন। আজিজ মিয়াকে দেখে ইমাম সাহেব বললেন, আপনি করেন কী! কফিন খুলতেছেন কেন? যে রকম আছে সে রকম থাকুক।
স্বপ্নের মধ্যেই আজিজ মিয়া রাগী গলায় বলল, আমার ছেলেকে আমি দেখব না?
ইমাম সাহেব বললেন, না দেখবেন না। দেখলে কষ্ট পাবেন। আপনার ছেলে ফাঁস নিয়ে মরেছে। লাশ বিকৃত হয়ে গেছে। এই লাশ কাউকে দেখানোর দরকার নাই। আসুন চুপিচুপি কবর দিয়ে ফেলি।
আজিজ মিয়া আর্তনাদ করে বলল, আমার ছেলের জানাজা হবে না?
ইমাম সাহেব বললেন, না। আমার যেমন জানাজা হয় নাই, আপনার ছেলেরও হবে না। ফাঁসের মরার জানাজা হয় না। আসুন কেউ কিছু টের পাওয়ার আগেই গর্ত খুঁড়ে কফিন মাটির নিচে ঢুকিয়ে ফেলি।
তারপরই স্বপ্নের পট পরিবর্তন হলো। দেখা গেল মসজিদের পাশে তেতুল গাছের নিচে আজিজ মিয়া এবং ইমাম সাহেব কোদাল দিয়ে গর্ত করা শুরু করেছেন। শুধুই তারা দুইজন। আশেপাশে কেউ নেই। কোনো শব্দ নেই। শুধু কোদাল দিয়ে মাটি কাটার ধুপ ধুপ শব্দ হচ্ছে।
আজিজ মিয়ার ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙার পরও সে কোদালের ধুপ ধুপ শব্দ শুনতে পাচ্ছে। এই শব্দ যে তার হৃৎপিণ্ডের লাফানোর শব্দ তা বুঝতেও তার সময় লাগল। বুকের মধ্যে শব্দ এত জোরে হচ্ছে মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি দূরে কোথাও কোদাল দিয়ে মাটি কাটা হচ্ছে–ধুপ ধুপ। ধুপ ধুপ।
চারদিক গাঢ় অন্ধকার। বাতাস। শীতল। কোনো শব্দ নেই। বিঝি পোকাও ডাকছে না। শুধু দূরে কোদাল দিয়ে মাটি কাটা হচ্ছে। আজিজ মিয়া হঠাৎ দৌড়াতে শুরু করল। তার মনেই রইল না, সে এখন একা চলা ফেরা করে না। তার পা খালি। জুতা-স্যান্ডল কিছুই নেই। এখন তার একটাই চিন্তা–কত তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌছানো যায়। সে দেখতে চায় তার বাড়ির উঠানে কোনো কফিন নেই।
অন্ধকার কিছুটা ফিকে হয়েছে। নক্ষত্রের আলোয় সব কিছুই আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে। বাজার থেকে আজিজ মিয়ার বাড়িতে যাবার দুটা রাস্তা আছে। একটা মসজিদের পাশ দিয়ে, অন্যটা ডিসট্রিক্ট বোর্ডের সড়ক দিয়ে। দ্রুত আসা যাবে মসজিদের পাশ দিয়েই। আজিজ মিয়া সেই পথ ধরল। যদিও এই পথে এখন লোক চলাচল করে না। ভয় পায়। আজিজ মিয়া এখন যাবতীয় ভয়ের উর্ধে। তাকে যে ভয় তাড়া করছে সে ভয়ের কাছে আর সব ভয় তুচ্ছ।
মসজিদ পার হয়েই আজিজ মিয়া থমকে দাঁড়াল। সড়কের ঠিক মাঝখানে কে যেন বসে আছে। ইমাম সাহেব না? হ্যাঁ ইমামই তো–ইয়াকুব মোল্লা। সে তো মারা গেছে। তার কবর হয়েছে। সে এখানে রাস্তার মাঝখানে বসে আছে। কেন? আজিজ মিয়া চিৎকার করে বলল, কে কে? কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনো স্বর বের হলো না। আজিজ মিয়া পেছনে ফিরল। পেছনেও একজন দাঁড়িয়ে আছে। কে সে? নক্ষত্রের অস্পষ্ট আলোয় কিছুই পরিষ্কার দেখা যায় না। কিন্তু পেছনে যে দাঁড়িয়ে আছে সেও যে ইমাম সাহেব তা বুঝা যাচ্ছে। পেছনের ইমাম সাহেবের হাতে লম্বা ছুরি। কোরবানির সময় ইমাম সাহেব এরকম একটা ছুরি নিয়েই গরু জবাই করতে বের হতেন। আজিজ মিয়ার শরীর কাঁপছে। মনে হচ্ছে রাস্তার মাঝখানেই সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। এটা করা যাবে না। তাকে পালাতে হবে। চিৎকার করে লাভ নেই, গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছে না। তাকে পালাতে হবে। কোন দিকে সে পালাবে?
আজিজ মিয়া রাস্তা থেকে নামতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়াতে শুরু করল। ইমাম সাহেবও তার পেছনে পেছনে দৌড়াচ্ছে। একজন ইমাম না, দু’জন। একজনের হাতে ছুরি, আরেকজনের হাতে কিছু নেই। আজিজ মিয়া জানত ঘটনা শেষ পর্যন্ত এরকম ঘটবে। কারণ সে ইমাম সাহেবকে কানে ধরে স্কুলের মাঠে চক্কর দিয়েছে। এর শাস্তি ইমাম সাহেব তাকে দেবেনই।
বুকে হাঁপ ধরে গেছে। আজিজ মিয়া ঠিকমতো দৌড়াতে পারছে না। আজিজ মিয়া দাঁড়িয়ে পড়ল। পেছন ফিরে দেখল। ইমাম সাহেবও দাঁড়িয়ে আছেন। এখন ইমাম একজন না। তিনজন। শুধু একজনের হাতে ছুরি। অন্য দু’জনের হাত খালি। আজিজ মিয়া আবার দৌড়াতে শুরু করল। সে কোন দিকে যাচ্ছে নিজেও জানে না। একবার মনে হলো সে একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে, একবার মনে হচ্ছে সে আসলে দৌড়াচ্ছে না, বাতাসে উড়ছে। সামনে এটা কী? পুকুর না? আজিজ মিয়া ঝাঁপ দিয়ে পুকুরে পড়ল। পুকুরের পানি বরফের মতো ঠাণ্ডা। হা–পা জমে যাচ্ছে। আজিজ মিয়া খুব ভালো সাঁতার জানে। কিন্তু সে সাঁতার দিতে পারছে না। পানিতে তলিয়ে যেতে শুরু করেছে। পুকুর পাড়ে তিন ইমাম দাঁড়িয়ে আছে। পুকুরের পানিতে তাদের ছায়া পড়েছে। ছায়া পড়ার কথা না। নক্ষত্রের আলোয় কোনো কিছুরই ছায়া পড়ে না। আজিজ মিয়া ক্ষীণ স্বরে ডাকিল, ও বকুলের মা! ও বকুলের মা।
বকুল আজিজ মিয়ার ছেলের নাম। বকুলের মা জবাব দিল না। তখন আজিজ মিয়া ডাকতে শুরু করল তার মা’কে। ও মাইজী। ও মাইজী।
নবনীর জ্বর খুব বেড়েছে। তার চোখ রক্তবর্ণ। ঘনঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। আনিস নবনীর মাথায় পানি ঢালছে। দরজার ওপাশ থেকে ভীত চোখে তাকিয়ে আছে সুজাত মিয়া। নবনীর এই অসুখের জন্য সে নিজেকে দায়ী করছে। সে তাকে অনেক ভালো বুদ্ধি গ্রামদেশে আছে। জিনের ফকিরকে আনলেই সে ব্যবস্থা করবে। এই কথা ডাক্তার সাহেবকে বলার সাহস তার নেই। সে জানে ডাক্তার সাহেবও কঠিন লোক। পীর ফকিরের যে ক্ষমতা আছে, এই লোকেরও সেই ক্ষমতা আছে। সাপের ওঝা সাপের বিষ নামাতে পারে। ডাক্তার সাহেব ওঝা না হয়েও সাপের বিষ নামায়। তার সাইকেল চুরি করেও চোর সুবিধা করতে পারে নি। সাইকেল ফেরত দিয়ে যেতে হয়েছে। ডাক্তার সাহেব এক ধরনের সাধনাও করেন। শ্মশানঘাটে একা বসে থাকেন। তার জিন সাধনা থাকাও বিচিত্র না। জিনের চেয়েও বড় সাধনা আছে। পরী সাধনা। সেই সাধনাও থাকতে পারে। তারপরেও সুজাত মিয়ার ভয় লাগছে। কারণ বিরাটনগরের অবস্থা ভালো না। ইমাম সাহেব বড় ত্যক্ত করছে। কোরান হাদিস জানা লোক যখন অপঘাতে মরে তখন তাদের অনেক ক্ষমতা হয়। তার নমুনা দেখা যাচ্ছে–আজিজ মিয়াকে পানিতে ড়ুবিয়ে মেরে ফেলল। তাকে যখন পানি থেকে তোলা হলো তখনও সামান্য জ্ঞান ছিল। কয়েকবার শুধু বলল, ইমাম সাব কই? ইমাম সাব? তারপরই সব শেষ। জীবন থাকতে থাকতে ডাক্তার সাবকে খবর দিয়ে নিলে ডাক্তার সােব তাকে বাঁচিয়ে ফেলতেন। খবরটা আসছে মৃত্যুর পরে। দুনিয়ার লোক ভিড় করেছে আজিজ মিয়ার বাড়িতে। সুজাতেরও যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। ভয়ের কারণে যায় নাই। ইমাম সাহেব আশেপাশেই আছে। কী দরকার।
আনিস সুজাতের দিকে তাকিয়ে বলল, জেগে থাকার দরকার নেই, তুমি শুয়ে পড়ে।
সুজাত দরজার আড়াল থেকে সরে গেল। কিন্তু শুয়ে পড়ল না। আজকের রাতটা ভালো না। ভয়ঙ্কর রাত। এই রাতে জেগে থাকা দরকার। আরো কত কী ঘটতে পারে। সুজাতের ধারণা চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতেও কোনো একটা ঘটনা ঘটছে। কারণ এক ঘণ্টার ওপর হয়েছে। বদি এসে বসে আছে। ডাক্তার সাহেবকে নিয়ে যেতে হবে চেয়ারম্যান সাহেব খবর পাঠিয়েছেন। সুজাতের ধারণা ডাক্তার সাহেব যাবেন না। চেয়ারম্যান সাহেবে পাইক বীরকন্দাজ পাঠালেও যাবেন না। কারণ ডাক্তার সাহেবের স্ত্রীর অবস্থাও ভালো না। এমন একটা ভয়ঙ্কর রাতে স্ত্রীকে একা ফেলে ডাক্তার সাহেব যাবে না।
নবনী ক্ষীণ স্বরে বলল, একটু পানি খাওয়াও তো।
আনিস গ্লাসে করে পানি দিল। নবনী পানিতে একটা চুমুক দিয়ে গ্লাস ফিরিয়ে দিল। পানি তিতা লাগছে। নবনী বলল, আমার জ্বর কি কিছু কমেছে?
আনিস বলল, না। তা হলে কি সামান্য বেড়েছে? হ্যাঁ একশ তিন ছিল। এখন হয়েছে একশ তিন পয়েন্ট পাঁচ। তবে মাথায় পানি ঢালছি। এনালজেসিক খাওয়ানো হয়েছে। জ্বর নেমে যাবে।
নবনী হালকা স্বরে বলল, তুমি অন্যদের চেয়ে আলাদা। আমি যখন বললাম জ্বর কি কমেছে তখনও অন্য যে-কোনো ডাক্তার হলে বলত হ্যাঁ সামান্য কমেছে। তুমি সত্যি কথাটা বললে। তবে আমার ধারণা মাঝে মাঝে মিথ্যা বলাটা অপরাধ না।
কথা না বলে ঘুমুবার চেষ্টা কর।
আমার কথা বলতে ভালো লাগছে।
তাহলে বল।
আমি স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের ব্যাপারটা নিয়ে খুব চিন্তিত।
এত চিন্তিত হবার কী আছে?
নবনী বলল, আমি ঘর পোড়া গরু তো এই জন্যেই চিন্তিত। আমি আবার বাবা-মা’কে দেখেছি।
আনিস বলল, তোমার কাছেই শুনেছি তাদের সম্পর্ক ভালো ছিল।
বাইরে বাইরে ছিল। ভেতরে ছিল না। তেলে জলে কখনো মিশ খায় নি। তুমি তো জান না আমার মা একগাদা ঘুমের ওষুধ খেয়ে মারা যান। ঘটনাটা আমরা চাপা দিয়ে রেখেছি। প্রায় কেউই এই ঘটনা জানে না। জ্বরের ঘোরে তোমাকে বললাম।
তোমার মা যখন মারা যান। তখন তোমার বয়স কত ছিল?
পনের বছর, আমি তখন এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি।
আমি যেমন দুঃস্বপ্ন দেখি আমার মাও সে রকম দুঃস্বপ্ন দেখতেন।
আনিস চুপ করে আছে। সে সামান্য চিন্তিত–জ্বর একেবারেই নামছে না। নবনী চাপা গলায় বলল, বাবা মাকে দেখে আমি কখনো বুঝতেই পারি নি তাদের সম্পর্কটা এতটা নষ্ট হয়েছে। কাজেই আমি ভয় পাই। আমি খুবই ভয় পাই। –
আনিস বলল, কিছু কিছু মানুষ আত্মহত্যার প্রবণতা নিয়ে জন্মায়। স্বামী এবং স্ত্রীর ভেতর খুব ভালো সম্পর্ক, তারপরেও দেখা যায়। এদের একজন কেউ কাণ্ডটা করে ফেলেছে। এটা এক ধরনের অসুস্থতা।
নবনী ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, যে অসুস্থতা আমার মায়ের মধ্যে আছে, সেই অসুখ তো আমার মধ্যেও থাকতে পারে। থাকতে পারে না? মা’র জিন কি আমার মধ্যে নেই? তোমাদের ডাক্তারি শাস্ত্র কী বলে?
আনিস জবাব দিল না। নবনী বলল, তোমার এখানে এসে আমার সামান্য মন খারাপ হয়েছে। কেন জান?
না, জানি না।
আমি দেখলাম আমি তোমাকে যে সব চিঠি লিখেছি তার সবই তুমি খুব যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছে–অথচ তোমার চিঠিগুলো আমার কাছে নেই। চিঠি পড়া হয়ে গেছে, আমি ভুলে গেছি। এতে কি প্রমাণিত হয় তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা কম?
এতে কিছুই প্রমাণিত হয় না।
হ্যাঁ প্রমাণিত হয়। আবার দেখ আমি জ্বরে ছটফট করছি–এই অবস্থায় আজিজ মিয়া নামে একজনের বাড়ি থেকে তোমাকে নিতে এল তুমি সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ফেলে চলে গেলে। এখন আবার আরেকজন কে এসেছে, তোমাকে কোথায় যেন নিতে চায়। আমার অবস্থা যত খারাপই হোক তুমি কিন্তু ঐ লোকের সঙ্গে যাবে। যাবে না?
হ্যাঁ যাব।
যে নিতে এসেছে তার নাম কী?
তার নাম বদি।
বাহ সুন্দর নাম তো। বন্দ থেকে বদি। ভালো থেকে ভালি। আচ্ছা ভালি নামে কেউ কি তোমাদের এই বিরাটনগরে আছে?
জানি না।
একটু খোঁজ নিয়ে দেখ তো।
আচ্ছা খোঁজ নেব। তুমি ঘুমুবার চেষ্টা কর।
আমাকে ঘুম পাড়াবার জন্যে তোমাকে ব্যস্ত হতে হবে না। তুমি বদির সঙ্গে যেখানে যেতে চাও–যেতে পার। এই যে তুমি আমাকে ফেলে ফেলে চলে যাচ্ছ এতে কিন্তু আমার খারাপ লাগছে না। বরং ভালো লাগছে। কেন ভালো লাগছে বলব?
বল।
নবনী আগ্রহের সঙ্গে বলল, আমার এই কারণে ভালো লাগছে যে তোমারও আমার প্রতি আগ্রহ কম। যদি সে-রকম আগ্রহ সেরকম মমতা থাকত–আমাকে ফেলে যেতে পারতে না। আমি নিজেও খুবই অসুস্থ। মাথায় আর পানি দিও না। ভালো লাগছে না। শুকনো তোয়ালে দিয়ে মাথাটা মুছিয়ে দাও।
আনিস মাথা মুছিয়ে দিল। নবনী বলল, এখন তুমি যেখানে যেতে চাও চলে যাও। কাল ভোরের ট্রেনে আমাকে তুলে দেবে। জ্বর কমুক বা না কমুক আমি চলে যাব।
আচ্ছা।
তুমি আমার সঙ্গে যাবে না। আমি যেমন একা এসেছি–একাই যাব।
আচ্ছা।
আমি দুঃস্বপ্ন দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমি আর দুঃস্বপ্ন দেখতে চাই না। বুঝতে পারছি আমি কী বলার চেষ্টা করছি?
তোমার শরীর ভালো না। তুমি কি বলছি নিজেও জান না।
আমি কী বলছি তা খুব ভালো করে জানি।
আনিস ক্লান্ত স্বরে বলল, তুমি যা চাইবে তাই হবে।
নবনী বলল, থ্যাংক য়ু। এখন যাও, বদি বলে যে এসেছে তার সঙ্গে যাও। আমার ঘুম পাচ্ছে। আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকব।
নবনী চোখ বন্ধ করল।
পুরো গ্রাম জুড়েই উত্তেজনা।
প্রতিটি বাড়িতেই বাতি জ্বলছে। আজিজ মিয়ার বাড়িতে লোকে লোকারণ্য। আশেপাশের গ্রাম থেকে লোকজন আসতে শুরু করেছে। মানুষের উত্তেজনা পশুপাখিদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। কুকুর ডাকছে। মাঝে মাঝে কাক ডাকছে। কুকুর এবং কাক মানুষের খুব কাছাকাছি বাস করে। এরা মানুষের সুখ-দুঃখের অংশীদার হতে চায়।
গ্রামের সব মানুষ জেগে থাকলেও রাস্তা ঘাট ফাঁকা। আনিস সাইকেল বের করেছে। অনেকদিন সাইকেলে চড়া হয় না। তার ইচ্ছা চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতে প্ৰথমেই যাবে। ঘটনা। কী জেনে ফেরার পথে ইমাম সাহেবের বাড়িতে যাবে। সকিনা মেয়েটি সেখানে একা বাস করছে। সে নিশ্চয়ই খুব ভয় পাচ্ছে। মেয়েটাকে বলবে তার বাড়িতে চলে আসতে। নবনী কাল চলে যাবে। সেও চলে যাক নবনীর সঙ্গে। তার এখানে একা থাকা ঠিক না। আনিসের শ্মশানঘাটে যেতেও খুব ইচ্ছা করছে। নবনীর আসার পর থেকে শ্মশানঘাটে যাওয়া হয় নি। অন্ধকার রাতে শ্বেতপাথরের মেঝেতে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকা। আকাশের তারা দেখা।
আনিসের ধারণা নবনী খুব ভুল চিন্তা করে নি। তাদের দু’জনের সম্পর্ক জমাট বাঁধে নি। সম্পর্কের রসায়নে খুব সূক্ষ্ম কোনো সমস্যা হয়েছে–সম্পর্ক জমাট বাঁধতে পারছে না। সম্পর্ক যে জমাট বাধে নি তার সবচে বড় প্রমাণ শ্মশানঘাটে নবনীকে তার নিয়ে যেতে ইচ্ছা করে নি। এই জায়গাটা যেন শুধুই তার একার। সেখানে অন্য কেউ যাবে না।
নবনীর সঙ্গে তার বিয়েটা প্রেমের বিয়ে এটা বলা যাবে না। দুজনের পরিচয় খুবই আকস্মিক। নীলক্ষেতে পুরনো বইয়ের দোকানে আনিস বই ঘাটছিল। এই দোকানগুলিতে হঠাৎ হঠাৎ কিছু ভালো বই পাওয়া যায়। Psychology of Dying Cancer Patients নামের অসাধারণ একটা বই মাত্র চল্লিশ টাকায় এখান থেকেই আনিস কিনেছিল। ধর্মগ্রন্থ মানুষ যেভাবে পাঠ করে, এই বই আনিস সেভাবেই পাঠ করে।
আনিস নিজের মনে বই ঘাঁটছে তখন একজন কে যেন আনিসের পাশে এসে বলল, আপা আপনাকে একটু ডাকে। আনিস তাকিয়ে দেখল–একটু দূরে গাড়ি পার্ক করা। গাড়িতে অতি রূপবতী এক তরুণী বসে আছে। আনিস তরুণীকে চিনতে পারল না। আনিস বলল, আপনার ভুল হয়েছে। আমাকে না, উনি হয়তো অন্য কাউকে ডাকছেন—।
লোকটি বলল, আপনাকেই ডাকেন। আপনার নাম আনিস না?
আনিস বলল, হ্যাঁ আমার নাম আনিস।
বই ঘাটা বন্ধ করে আনিস এগিয়ে গেল। তরুণী মেয়েটি বলল, আপনার নাম আনিস না?
আনিস বলল, হ্যাঁ।
আপনারা ছোটবেলায় কখনো কুমিল্লায় ছিলেন?
ছিলাম।
আপনার ছোটবোন মিনুর সঙ্গে আমি পড়তাম।
মিনু নামে আমার কোনো ছোটবোন নেই।
মিনু নানার বাড়িতে গিয়ে পুকুরে ড়ুবে মারা গিয়েছিল। আপনাদের নানার বাড়ি ময়মনসিংহে।
আনিস খুবই বিনয়ের সঙ্গে বলল, কোনো এক জায়গায় আপনার ভুল হচ্ছে। আমার নাম আনিস ঠিক আছে। কুমিল্লায় ছোটবেলায় ছিলাম তাও ঠিক আছে। আমাদের নানার বাড়ি যে ময়মনসিংহ তাও ঠিক–কিন্তু আমি সেই মানুষ না।
আপনার বাবা কানাডায় থাকতেন। মিনুর মৃত্যুর পর তিনি সবাইকে নিয়ে কানাডা চলে যান।
আনিস হতাশ গলায় বলল, আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না। আমি বরং একটা কাজ করি–আমার বাবা-মা কলাবাগানে থাকেন। আমি একটা কাগজে ঠিকানা লিখে দিচ্ছি। তাদের সঙ্গে কথা বললেই আপনার কনফিউসন দূর হবে।
তরুণী শক্ত গলায় বলল, ঠিকানা টেলিফোন নাম্বার সবই লিখে দিন। আমি আজই যাব। এখনি যাব। এক কাজ করুন–ঠিকানা লেখার দরকার নেই। আমি অপেক্ষা করছি। আপনি বই ঘাটছিলেন বই ঘাটা শেষ করে গাড়িতে উঠুন। আপনাকে নিয়েই আমি যাব।
আনিস বলল, আপনার কি সন্দেহ আমি আপনাকে ভুল ঠিকানা দেব?
এরকম সন্দেহ যে আমার হচ্ছে না, তা-না।
আনিসের বাড়িতে গিয়ে তরুণী মেয়েটির সন্দেহ দূর হয়েছিল। তারপরেও সে অনেকক্ষণ সে বাড়িতে রইল। খাটে পা তুলে নিতান্ত পরিচিতজনের মতো বসে গল্প করতে লাগল। আনিসের মা যখন বললেন, মা আজ দুপুরে তুমি আমাদের সঙ্গে খাও–নবনী তৎক্ষণাৎ বলল, আচ্ছা। এক পর্যায়ে আনিসের বাবা এসে ইশারায় তাকে ডেকে পাশের কামরায় নিয়ে গলা নিচু করে বললেন, মা তুমি ঐ মহিলাকে বল সে যেন এ রকম শব্দ করে না হাসে। আমার কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। জরুরি একটা কাজ করছি এর মধ্যে বাড়ি ঘর কাঁপিয়ে হেহেহে। মেয়েদের হাসির মধ্যে একটা সৌন্দর্য থাকবে, মাধুর্য থাকবে। তার কিছুই নেই। হাসি শুনলে মনে হবে কয়েকটা হায়না। ঝগড়া করছে। এ ওকে কামড়াচ্ছে।
নবনী বলল, আপনাদের মধ্যে কি ঝগড়া হয়েছে?
তিনি বললেন, হ্যাঁ। এক সপ্তাহ ধরে কথাবার্তা বন্ধ। আবার যে কথা বলা শুরু করব এটাও মনে হচ্ছে না। মা তুমি কি আরেকটা কাজ করতে পারবে, হায়নাটাকে বলবে যে আজ থেকে আমি তার খাবার মুখে দেব না। হোটেল থেকে খাবার এনে খাব। কথাটা বলতে পারবে? বলতে পারলে খুব ভালো হয়।
নবনী হাসতে হাসতে বলল, পারব।
দুপুরে খেতে বসে নবনী অবাক হয়ে দেখল আনিসের বাবা সত্যি সত্যি হোটেল থেকে বিরিয়ানী নিয়ে এসেছেন। একই টেবিলে বসে খুব আয়োজন করে খাচ্ছেন। নবনীর খুবই মজা লাগল।
আনিসের মা’র এই মেয়েটিকে এতই পছন্দ হলো যে দুপুরে খেতে বসেই তিনি ঠিক করলেন–যে করেই হোক এই মেয়েটির সঙ্গেই আনিসের বিয়ে দিতে হবে। তার আগ্রহেই শেষ পর্যন্ত বিয়েটা হয়। নবনীর দিক থেকেও হয়তো আগ্রহ ছিল। আনিসের আগ্রহ অনাগ্ৰহ কিছুই ছিল না।
যে মেয়ে মনে মনে অন্য একজনকে অনুসন্ধান করছে তার প্রতি আগ্ৰহ তৈরি হবার কথাও না। নবনী হয়তো ভেবেছিল এই আনিস তার কল্পনার আনিসের কাছাকাছি যাবে। সেটা সম্ভব হয় নি। নবনীর কল্পনার মানুষটা কেমন আনিস তা জানে না। কল্পনার মানুষের চরিত্রে অভিনয় সে করতে পারে নি। ইচ্ছাও হয় নি।
জহির খাঁর বাড়ির উঠোন ভর্তি মানুষ। সব ক’টা ঘরে হারিকেন জ্বলছে। পল্পী বিদ্যুতের কানেকশন থাকলেও আজ ইলেকট্রিসিটি নেই। দুটা হ্যাজাক বাতি জ্বলিয়ে অন্ধকার প্রায় দূরই করে দেয়া হয়েছে। একটা হ্যাজাক বাতি জ্বলছে মাঝলো ঘরের উঠোনে। আরেকটা মূল বসত বাড়ির বারান্দায়।
জহির খাঁ সাধারণত মাঝালা ঘরেই সময় কাটান। আজ তিনি শুয়ে আছেন। নিজের ঘরের পালংকে। সেখানে বাইরের লোকজনের প্রবেশ পুরোপুরি নিষিদ্ধ। কিন্তু আনিসকে সরাসরি সেখানেই নিয়ে যাওয়া হলো।
ঘরে বিশাল এক রেলিং দেয়া খাট। খাটে তিনটা বালিশ পেতে আধশোয়া হয়ে জহির খাঁ এলিয়ে পড়ে আছেন। তার গায়ে তসরের হলুদ রঙের চাদর। চাদরের নিচে একটু পরে পরেই তিনি কেঁপে কেঁপে উঠছেন। খাটের রেলিং ধরে হেনা চিন্তিত এবং ভীত চোখে দাঁড়িয়ে আছে। জহির খাঁর চোখ লাল তবে তিনি নেশাগ্ৰস্ত না। ঘরে এলকোহলের গন্ধ নেই। কর্পূরের গন্ধ আছে।
আনিস বলল, আপনার কি শরীর খারাপ করেছে?
জহির খাঁ বললেন, শরীর ভালো না খারাপ সেই আলাপ পরে হবে। তুমি ঐ চেয়ারটায় বস।
হেনা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, উনার শরীর খুবই খারাপ।
জহির খাঁ ধমক দিয়ে বললেন, তোমারে কে কথা বলতে বলছে? আমার শরীর ভালো না মন্দ সেইটা আমি বুঝব। ঘর থ্যাইকা যাও।
হেনা চোখ মুখ শক্ত করে রেলিং ধরে দাঁড়িয়েই রইল। জহির খাঁ প্ৰচণ্ড ধমক দিলেন–কঠিন গলায় বললেন, যাও ঘর থাইক্যা। হেনা বের হয়ে গেল। জহির খাঁ বললেন, ডাক্তার এখন তুমি আমারে পরীক্ষা-টরীক্ষা যা করার করা।
আনিস কাছে গেল। গায়ে জ্বর নেই। বরং গায়ের তাপ স্বাভাবিকের চেয়ে সামান্য কম। তবে নাড়ি খুব দ্রুত চলছে। প্রায় একশ’র কাছাকাছি। মাঝে মাঝে ড্রপবিট হচ্ছে।
জহির খাঁ বললেন, কি দেখলা? আনিস বলল, গায়ে জ্বর নেই। তবে নাড়ি দ্রুত চলছে। আপনি কোনো একটা বিষয় নিয়ে খুব উত্তেজিত।
বিষয়টা কি তুমি অনুমান করতে পার?
জ্বি না। আমার অনুমান শক্তি ভালো না।
জহির খাঁ বিছানায় উঠে বসলেন। লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোমারে আমি অত্যধিক স্নেহ করি বলেই বলতেছি। নয়তো বলতাম না। ডাক্তার শোন, আমি সব সময় নানান উত্তেজনার মধ্যে থাকি। উত্তেজনায় থাকা আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। এতে আমার শরীর খারাপ করে না। ঘটনা ভিন্ন। তুমি আমার ঘটনোটা আগে শোন–তারপরে চিকিৎসা করা। বুঝতে পারতেছি আমার চিকিৎসা দরকার। আমার শরীর অতিরিক্ত খারাপ। নিঃশ্বাস নিতে পারতেছিলাম না। তুমি বাড়ির কাছে আইসা সাইকেলের ঘন্টা দিলা তারপর থাইক্যা নিঃশ্বাস নিতে পারতেছি।
হেনা আবার এসে রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছে। জহির খাঁ প্ৰচণ্ড ধমক দিলেন–আবার কেন আসছ?
ধমকে হেনা কেঁপে উঠল, কিন্তু খাটের রেলিং ধরেই থাকল। আনিস বলল, আপনি এখন যান। উনার মেজাজ ঠিক হলে আসুন। চেয়ারম্যান সাহেবের হার্টের অবস্থা ভালো না। এই সময় তাঁকে আর উত্তেজিত করা ঠিক হবে না।
হেনা চলে গেল। তবে তার চোখ ভর্তি পানি। অস্বাভাবিক একটা দৃশ্য।
জহির খাঁ গলা নিচু করে বললেন, ডাক্তার শোন, আজ আমি ইমাম সাহেবরে দেখলাম। আচকান পাঞ্জাবি পরা। মাথায় টুপী।
আনিস কিছু বলল না।
জহির খাঁ বললেন, ঘটনাটা বলার আগে তোমার কাছে একটা বিষয় পরিষ্কার করা দরকার। এই যে আজিজ মিয়া পানিতে ড়ুইব্যা মারা গেছে–এই বিষয়ে তোমার অনুমান কী? কেন মরল?
আপনাকে আগেই বলেছি–আমার অনুমান শক্তি দুর্বল।
জহির খাঁ বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, অনেকেই মনে করবে কাজটা আমি করায়েছি। ভয় দেখায়ে তারে পানিতে নিয়া ফেলছি–ঘটনা সত্য না। আমি মানুষরে শাস্তি দেই। সেই শাস্তির মাপ আছে। কানে ধরে উঠবাস করাই, মাঠে চক্কর দেওনের ব্যবস্থা করি। আমার অবস্থায় থাকলে এইগুলা করতে হয়। বুঝতে পারতেছ?
আনিস জবাব দিল না। চুপ করে রইল। তার বাসায় ফেরা উচিত। সকিনার খবর নিয়ে অতি দ্রুত নবনীর কাছে যাওয়া উচিত। কে জানে নবনীর জ্বর হয়তো আরো বেড়েছে। বড় মানুষদের কনফেসন শোনা তার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। তবে এই কনফেসনটা প্ৰায় সময়ই ওষুধের মতো কাজ করে। সেই অর্থে জহির খাঁর কথা তার শোনা উচিত।
ডাক্তার।
জ্বি।
আমি পিশাচ না। আমি কথায় কথায় বলি–আমি দুষ্ট লোক। আমি চাই লোকে আমারে দুষ্ট লোক ভাবুক। এতে আমার কাজের সুবিধা হয়। আমি দুষ্ট লোক এইটা সত্য, তবে যতটা বলি ততটা না। আমার কথা কি তুমি মন দিয়া শুনতেছ?
জ্বি শুনছি।
এখন শোন–আমি কী দেখলাম। রাত বাজে একটা। আমার ঘুম আসতেছে না। প্রতিরাতে আমি মদ্যপান করি। এইটা করলাম না। আমার বাড়ির পিছনে একটা লিছু গাছ আছে তুমি দেখেছি কি-না জানি না। বিরাট গাছ। গাছের তলাটা আমি বঁধায়ে দিয়েছি। মন টন খারাপ থাকলে মাঝে মাঝে সেখানে বসি। বসে আছি–হঠাৎ দেখি ডিসট্রিক্ট বোর্ডের সড়ক দিয়ে কে যেন আসতেছে। ছোটখাট একজন মানুষ। হেলতে দুলতে আসতেছে। মাঝে মাঝে দাঁড়ায়। চারদিকে তাকায়। তারপর হাঁটা ধরে। আমি তাকায়ে আছি–তারপর দেখি যে দিক থেকে আসছিল। সে আবার সেই দিকে হাঁটা ধরেছে। কিছুক্ষণ পরে তারে আর দেখা গেল না। আমি ভাবলাম চোখের ধান্ধা। একটা সিগারেট ধরালাম। সিগারেটে দুটা টান দিয়েছি–দেখি সে আবার আসতেছে।
আমার বুক ধ্বক করে উঠল। কারণ আমি মানুষটারে ভালোমতো চিনেছি। আমাদের ইমাম সাহেব। আমার হাতে আছে একটা পাঁচ ব্যাটারির টর্চ। ডাক্তার আমি ভীতু লোক না। আবার খুব যে সাহসী তাও না। আমি টর্চ হাতে আগায়ে গেলাম। লোকটা কাছাকাছি আসলে তার মুখে টর্চ ফেলব।
আগে সে যেভাবে আসতেছিল এখনো সেভাবেই আসতেছে। মাঝে মাঝে দাঁড়ায়। এইদিক ঐ দিক চায় আবার হাঁটা শুরু করে। লোকটা আমার কাছাকাছি আসতেই আমি তার গায়ে টর্চ ফেললাম। যা ভেবেছিলাম–তাই। ইমাম ইয়াকুব। গাল ভর্তি দাড়ি। পরনে আচকান, পায়জামা, মাথায় টুপী। টর্চ ফেলতেই ইমাম উল্টা দিকে দৌড়াতে শুরু করল। আমি টর্চ ধরেই আছি। দেখলাম সে আসলে দৌড়াচ্ছে না–বাতাসের ওপর দিয়ে যাচ্ছে। এই হলো ঘটনা।
আপনি কি করলেন–বাড়িতে চলে এলেন?
না। আমি লিচু গাছের নিচে আবারো গিয়া বসলাম। বাড়ি থেকে দোনালা বন্দুক নিয়ে আসলাম। টোটা ভরলাম। ঠিক করলাম আবার যদি সে আসেগুলি করব।
এসেছিল?
আর আসে নাই। রাত তিনটার সময় খবর পাইলাম দুৰ্ঘটনা ঘটেছে। তারপর থাইক্যা নিঃশ্বাসের কষ্ট।
এখন একটু কম না?
হ্যাঁ এখন কম।
আপনি শুয়ে থাকুন। ঘুমাবার চেষ্টা করুন। আপনার ঘুম দরকার।
ডাক্তার তোমারে কথাগুলো বলতে পেরেছি। আমার হালকা লাগতেছে।
হেনা আবারো মাথা বের করেছে। জহির খাঁ ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, ডাক্তার তুমি এই মেয়ের গালে ঠাশ কইরা একটা চড় মার। বড় ত্যাক্ত করতাছে। হেনা সরে গেল না। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকল।
ইমাম সাহেবের চালা ঘরে বাতি জ্বলছে। আনিস সাইকেলের বেল টিপতেই সকিনা বের হয়ে এল। তার মাথা কালো চাদরে ঢাকা। চাদরের ফাঁক দিয়ে মুখ বের হয়ে আছে। সেই মুখ ভয়ে ছোট হয়ে আছে।
আনিস বলল, আপনি আমাকে চিনবেন না। আমার নাম…
মেয়েটি আনিসকে থামিয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বলল, আমি আপনেরে চিনি। বাপজান আপনার কথা আমাকে চিঠিতে লিখেছেন।
আপনি একা একা ভয় পাচ্ছেন কি-না দেখতে এসেছি।
সকিনা বলল, আমার ভয় কম। কিন্তু আমি ভয় পেয়েছি। আমি খুবই ভয় পেয়েছি। আমার ব্যাপজান মানুষ মারতেছে এটা কেমন কথা।
আনিস বলল, এটা খুবই ভুল কথা। এটা নিয়ে আপনি মোটেই দুঃশ্চিন্তা করবেন না। আপনি বরং এক কাজ করুন–আমার বাসায় চলুন। আমার স্ত্রী আছে। আপনার থাকতে সমস্যা হবে না। আমার স্ত্রী কাল সকালে ঢাকা চলে যাবে। আমার মনে হয় আপনারাও চলে যাওয়া ভালো।
বাপজানরে এইভাবে ফেলে রেখে চলে যাব? বাপজানের মৃত্যুর কোনো বিচার হবে না?
আনিস কী বলবে বুঝতে পারল না। সকিনা বলল, সবাই আপনাকে খুব ভালো পায়। আমার ব্যাপজান চিঠিতে লিখেছিলেন। আপনি ফিরিশতার মতো মানুষ। আপনি যদি আমাকে চলে যেতে বলেন আমি চলে যাব।
আনিস বলল, আমি আপনাকে চলে যেতেই বলছি। কারো ওপর কোনো রাগ না রেখে আপনি চলে যান।
সকিনা বলল, আচ্ছা আমি চলে যাব। তবে রাতটা এখানেই থাকব।
ভয় পাবেন না?
না, ভয় পাব না। জহির উদ্দিন খাঁ সাহেব আমার জন্যে পাহারার ব্যবস্থা করেছেন। তার হুকুম মতো আমার সঙ্গে একজন মহিলা থাকেন। মসজিদে একজন পুরুষ মানুষ থাকে।
তাই না-কি?
তিনি এই কাজটা প্রথম দিন থেকেই আমার জন্যে করেছেন। কেন করেছেন তা আমি জানি না। দুই বেলা আমার জন্যে তিনি ভাত তরকারি পাঠান। একটা কথা আছে না–গরু মেরে জুতা দান। আমার মনে হয় ব্যাপারটা সে রকম।
আনিস বলল, সে রকম তো নাও হতে পারে। হয়তো যে কাজটা উনি করেছেন তার জন্যে তিনি অনুতপ্ত। হয়তো আপনাকে দেখে তার মায়া লেগেছে। আমার ধারণা লোকে উনাকে যতটা খারাপ ভাবে তত খারাপ উনি না।
সকিনা কঠিন গলায় বলল, আমার বাবাই শুধু খারাপ। খারাপ কাজ করে সে শাস্তি পেয়েছে। মৃত্যুর পরেও খারাপ কাজ করছে। মানুষ মারছে। কিছু মনে করবেন না ডাক্তার সাহেব মনের দুঃখে কিছু কঠিন কথা বললাম।
আমি কিছু মনে করি নি।
সকিনা। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আমি হাসান নামের লোকটার সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলাম, কিন্তু কথা বলতে পারলাম না। জহির খাঁ সাহেব হাসানকে আর তার ছেলেকে দূরে কোথায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। তিনি চান না আমি তার সঙ্গে কথা বলি।
আনিস বলল, পুরনো প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলার দরকার কী?
সকিনা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, কেন, আপনি কি বিশ্বাস করেন ঘটনা সত্যি?
আনিস বলল, আমি কিছু বিশ্বাস করি না। আবার কোনো কিছু অবিশ্বাসও করি না। আমি শুধু একটা জিনিসই জানি–প্ৰাণী হিসেবে মানুষ খুবই অদ্ভুত।
কোনো প্রাণীই তার স্বজাতিকে হত্যা করে না। শুধু মানুষ করে।
মাটির হাঁড়ির মুখ কলাপাতা দিয়ে বাঁধা।
বাঁধন খুলতে খুলতে মরজিনার চোখ চকচক করতে লাগল। সে আদুরে গলায় বলল, আইজ আবার কী আনছেন?
মতি উদাস গলায় বলল, জানি না। কী আনছি। খুইল্যা দেখ।
জিনিসটা কী চিনতেছি না তো। মুখে দিয়া দেখ।
মরজিনা বলল, দেখতে জানি কেমন। ঘিন্না ঘিন্না লাগতেছে।
ঘিন্না লাগলে খাইও না। সবেরে সব জিনিস সয়না। ঘি খাইলে কুত্তার লোম পইড়া যায়। জিনিসটা হইল তেলিকান্দির সরভাজা।
তেলিকান্দির সরভাজা?
নাটোরের কাঁচাগুল্লা, পোড়াবাড়ির চমচম, কুমিল্লার রসমালাই যে রকম–তেলিকান্দির সরভাজাও একই রকম। রমেশ কারিগরের সাক্ষাত নাতি ওস্তাদ পরমেশ কারিগরের নিজের হাতে পাক দেওয়া জিনিস। ঢাকা শহরের রাইস আদমীরা নগদ টেকা দিয়া এই জিনিস নিয়া যায়। সাতদিন আগে অর্ডার দেওন লাগে। বহুত ঝামেলা কইরা তোমার জন্যে জোগাড় করছি। তুমি জিনিস চিনলা না, আমার আর করনের কী আছে! এইটা হইল আমার কপাল।
মরজিনা আঙ্গুলের ডগায় খানিকটা সরভাজা মুখে দিল। মতি বলল,
গন্ধ ভালো না, কিন্তু খাইতে ভালো।
খাওয়াটাই আসল, গন্ধ কিছু না। গু যদি খাইতে ভালো হইত–মানুষ নাকে চাপ দিয়া সমানে গু খাইত।
মরজিনা আগ্রহ করে খাচ্ছে। মতির এই দৃশ্য দেখতে বড় ভালো লাগছে। আহারে বেচারি! ভালো মন্দ খাইতে এত পছন্দ করে সেই ভালো মন্দ খাওয়ার ব্যবস্থাই তারে আল্লাহপাক দেয় নাই।
তেলিকান্দির সরভাজা যে আসলে ওস্তাদ পরমেশ কারিগর বানায় নি, মতি নিজে বানিয়েছে–এটা বলতে ইচ্ছা করছে। মতি চায়ের দোকান থেকে তিন কাপ দুধের সর কিনে নিয়ে সোয়াবিন তেলে ভেজে ফেলেছে। সঙ্গে চার চামচ চিনি দিয়েছে। তেজপাতা ছিল না বলে দেওয়া হয় নি। কড়াই থেকে কালো রং ওঠায় জিনিসটা দেখতে বিদঘুটে হয়েছে। তাতে ক্ষতি কী? খাওয়া হলো আসল। মতি বলল, মরজিনা মজা পাইছ?
মরজিনা বলল, আরেকবার আনন লাগব।
মতি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, চেষ্টা নিব। পারব কি-না বলতে পারি না। পরমেশ কাগিগররা আমার মতো দুই পয়সা দামের মানুষ ক্যামনে ধরে কও দেখি।
একবার যখন ধরতে পারছেন, আরেকবার পারবেন।
দেখি চেষ্টা নিব।
মরজিনা বলল, আমারে সোনার কিছু কিন্যা দিয়েন–মেয়েছেলের শইল্যে সোনার কোনো জিনিস না থাকলে দোষ লাগে। এমন সুন্দর সোনার একটা নাকছবি ছিল–কই যে পড়ছে!
মতি বলল, চিন্তা নিও না। দিব সোনার নাকছবি। স্বাধীন ব্যবসায় নামতেছি–টেকা পয়সার চিন্তা আর থাকব না।
কী ব্যবসা?
স্বপ্নে একটা বড়ি বানানির হিসটোরি পাইছি। এই বড়ি বেচব। বড়ির নাম–জ্বরমতি। এই বড়ি দুইটা খালি পেটে খাইলে যে-কোনো জ্বর দুই ঘণ্টার মধ্যে আরোগ্য হয়।
টেকা পয়সা হইলে কি আর আপনে আমারে পুছবেন? আমি কে?
আমি অবশ্যই তোমারে পুছব। ট্যাহা পয়সা হইলে তোমারে বিবাহও করতে পারি। অনেক দিন থাইক্যা সংসার করতে ইচ্ছা করে। টেকা পয়সার অভাবে সংসার করতে পারতেছি না।
আমার মতো একটা খারাপ মাইয়ারে আফনে সত্যই বিবাহ করবেন?
অবশ্যই করব। তুমি যেমন খারাপ আমিও তেমন খারাপ। খারাপে খারাপে কাটাকাটি।
আনন্দে মরজিনার চোখে পানি এসে গেল। মতি গভীর আবেগের সঙ্গে বলল–কানবা না। দুই দিনের দুনিয়োত আসছি আনন্দ ফুর্তি কইরা যাও। আমার মন খুবই খারাপ। তোমার চউক্ষের পানি দেখলে আরো খারাপ হইব।
মন খারাপ কী জন্যে?
ইমাম সাব আছে না। সে আইজ একটা লোক মাইরা ফেলছে।
কী কন আপনে?
খুবই খারাপ অবস্থা। আর গেরামে যাব না বলে ঠিক করেছি।
থাকবেন কই?
তোমার এইখানে থাকব। স্বামীরে তো তুমি ফেলতে পারব না। না-কি ফেলবা?
স্বামী আবার কখন হইলেন!
এখনো হই নাই—একদিন তো হইব। হইব না?
মরজিনা হাসছে। লাজুক হাসি। মতির দেখতে বড় ভালো লাগছে। না, সংসার ধর্মটা করা দরকার। শুধু যদি বড়িগুলা আস্ত থাকত। পাউডার হয়ে না। যেত। সংসার ধর্মের আগে বড়ি ঠিক করতে হবে। ডাক্তার সাহেবের স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করলে হয়। বড় বুদ্ধি এই মেয়ের। বুদ্ধিতে ঝকঝকি করতেছে। সেই তুলনায় মরজিনার বুদ্ধি–গরু ছাগলের চেয়ে সামান্য বেশি। তাও খুব বেশি না। দুই আঙ্গুল বেশি। অন্তরে মায়া মুহকবত নাই। ভালো ভালো খাওন যদি কেউ দেয়। তার জন্য মায়া মুহকবত আছে। খাওন নাই, মায়া মুহকবতও নাই। আজিব মেয়ে মানুষ। সব মেয়ে মানুষই আজিব—মরজিনা একটু বেশি আজিব। আল্লাপাকের দুনিয়াটাই আজিব।
মরজিনা বলল, কী চিন্তা করেন?
আল্লাপাকের আজিব দুনিয়া নিয়া চিন্তা করি।
মরজিনা বলল, একটা জিনিস খাইতে খুব মনে চায়–গরম বুন্দিয়া। লুচি দিয়া বুন্দিয়া। মতি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল–কী মেয়েছেলে, কোনো ভালো চিন্তা নাই। তার চিন্তা–গরম বুন্দিয়া। এমন মেয়েছেলে নিয়ে সংসার করা কঠিন হবে। খুবই কঠিন। ভাবের কথা বললে কিছুই বুঝবে না। মতির মাঝেমধ্যে ভাবের কথা বলতে ভালো লাগে। লুচি-বুন্দিয়া নিয়া কতক্ষণ আর কথা বলা যায়? মতি বড়ই উদাস বোধ করল।