০৭. আজকাল বড় অস্থির লাগে

আজকাল বড় অস্থির লাগে।

সব যেন অগোছালো হয়ে গেছে। সুর কেটে গেছে। সফিকেব। সেই হাসি খুশি ভাব নেই। তার জ্বর কখনো থাকে কখনো থাকে না। মেডিকেল কলেজ থেকে এক্সরে করিয়ে এসেছে যক্ষ্মাপক্ষ্মা কিছু নেই। তার ব্যবসা খুব মন্দা যাচ্ছে। কিন্তু কেমন করে যেন প্রেসের পুরনো চাকরিটা আবার জোগাড় করেছে। আজকাল সে কৃপণের মত টাকা জমায়। তার খরচপাতি এমনিতেই অবশ্যি কমে গেছে। বোনকে টাকা পাঠাতে হয় না। আদর করে একটি পয়সাও খরচ করে না। মেডিকেল কলেজের ছোকড়া ডাক্তারটি বার বার বলেছিল, ভাল ভাল খাবার খাবেন। দুধ টুধ নিয়মিত খাবেন। আপনার এখন হাই প্রোটিন ডায়েট দরকার। ডাক্তারের কথা সে হেসে উড়িয়ে দিয়েছে।

হাই প্রোটিন ডায়েট খাব পয়সা কোথায়? পাস বুকের পাই পয়সাও খরচ করব না।

সেই একটি সাইন বোর্ড লিখিয়ে এনেছে—‘নীলগঞ্জ হোটেল এ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’

প্রকাণ্ড সাইন বোর্ড। খবরের কাগজে মুড়ে সেই সাইন বোর্ডটি রাখা হয়েছে চৌকির নিচে। মাঝে মাঝে রাত জেগে সে টাকা পয়সার হিসাব মিলায়। হাসি মুখে বলে, দেরি নাই আর। শুরু করে দিতে হবে।

তার চোখ জ্বল জুলি করে। গম্ভীর হয়ে বলে, ছোট থেকে শুরু হবে। প্রথমে থাকবে সাদামাটা চায়ের দোকান। তার পর বড় একটা হোটেল দেব। একটা হুঁলস্থূল কাণ্ড করব দেখবি।

সেই হুঁলস্থূল কাণ্ড করবার জন্যে সে প্রায়ই না খেয়ে থাকে।

একদিন বলল, চায়ের চিনি দেবার দবকার কী? চীনারা বিনা চিনিতে দিব্যি চা খাচ্ছে। না চিনিটা আমি উঠিয়েই দেব, অনেকগুলি টাকা বাঁচে বুঝলি?

পান্থ নিবাসের নাম ফলক রশীদ মিয়া সরিয়ে ফেলেছে। তিন তলায় নতুন নতুন ঘর উঠছে। জানালায় নতুন শিক বসানো হচ্ছে। চুনকাম হচ্ছে। একদিন দেখি রোকেয়া ভিলা নামে একটা সাইন বোর্ড শোভা পাচ্ছে। আমাদের কাছে নোটিশ দিয়েছে, দুই মাসের ভেতর বাড়ি খালি করে দিতে হবে। অন্যথায় আইনের আশ্রয় নেয়া হবে এই জাতীয় কথা লেখা।

করিম সাহেব এই নিয়ে খুব হৈচৈ কবছেন, উঠিয়ে দিবে বললেই হল? হাইকোর্টে কেইস করে শালার পাতলা পায়খানা বের করে দিব না? উঠিয়ে দেয়া খেলা কথা না। হুঁ হুঁ।

করিম সাহেব আজকাল প্ৰায় রাতেই মদটব্দ খেয়ে এসে বিশ্ৰী সব কাণ্ড কারখানা করেন। কেউ কিছু বললেই আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করেন, নিজের পয়সায় খাই। কারোর বাপের পয়সায় না। কারোর সাহস থাকে বলুক দেখি মুখের সামনে। জুতিয়ে দাঁত খুলে ফেলব না? ভদ্রলোক চিনা আছে আমার।

সত্য মিথ্যা জানি না, শুনছি। অফিসে কী একটা টাকা পয়সার গণ্ডগোলেব জন্য করিম সাহেবকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। তদন্ত-টদন্ত হচ্ছে। কথাটা সত্যি হতেও পারে। কয়েক দিন ধরে দেখছি অফিসে যান না। গতকাল আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী ব্যাপার করিম সাহেব অফিসে যান না। দেখি!

করিম সাহেব রেগে আগুন।

যাই না যাই সেটা আমার ব্যাপার। আপনে কোথাকার কে? আপনার খাই? না আপনার পরি? বি.এ. পরীক্ষার ফিস জমা দিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। নবী সাহেবের ঘরটিতে এখন একা একা থাকি। দিনরাত পড়তে চেষ্টা করি। নীরস পাঠ্য বইয়ের স্তুপ একেক সময় অসহ্য বোধ হয়। কোথায়ও হাফ ছাড়বার জন্যে যেতে ইচ্ছে হয়। যাওয়ার জায়গা নেই কোনো। আমার ছাত্রীটির বাসায় যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বিনা দরকারে শুধু শুধু যাওয়া। শেলীর বাবা-মা কেউ কিছু মনে করেন কী না তাই ভেবে যাওয়া হয় না।

 

মাকে দেখতে গিয়েছিলাম। এর মধ্যে। মা আগের মতই আছেন। এতদিন ধারণা ছিল বোধহয় খুব কষ্টে আছেন। কিন্তু দেখা গেল অবস্থা মোটেই সে রকম নয়। বাড়ির পেছনে সজী বাগান করেছেন। হাঁস-মুরগী পালছেন। ধান-চাল রাখার জন্য নতুন একটি ঘর তোলা হয়েছে। এমন অবাক লাগল দেখে! বাবার প্যারালিসিসও তেমন কিছু নয়। দেয়াল ধবে বেশ দাঁড়াতে পারেন।

অঞ্জু দেখলাম অনেক বড় হয়েছে। তাকে অতি কড়া শাসনে রাখা হয়। অঞ্জর কাছেই শুনলাম সে ঘুমিয়ে পড়লে মা তার বই খাতা তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখেন। যেন পারুলের মত কিছু আবার না ঘটে। অঞ্জু অনেক চালাক চতুর হয়েছে। অনেক কথা বলল সে। গল্প বলাও বেশ শিখেছে।

পারুল আপা ভালই করেছে দাদা। কী যে দিন গেছে আমাদের। কতদিন শুধু একবেলা রান্না হয়েছে। মার মেজাজ তো জানাই। সব সময় আগুনের মত তেঁতে থাকতেন। একদিন কী করেছেন শোন–বাবা দেরি করে ফিরেছেন। এগারোটার মত বাজে প্রায়। মা দরজা খুললেন না কিছুতেই।

খুললেন না কেন?

কে জানে কেন? কে যাবে জিজ্ঞেস করতে?

অঞ্জু এক ফাঁকে আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি নাকি দাদা বাড়ি বাড়ি কাপড় ফেরি করে বেড়াও? কত কাণ্ড হল এই নিয়ে। মামারা রেগে আগুন। বাবা বেচারা সরল মানুষ। ছোট মামাকে বলেছেন, তুমি নিজেও তো মানুষের বাড়ি গিয়ে রোগী দেখ। তাতে দোষ হয় না?

অঞ্জু হাসতে লাগল খিলখিল করে। বহু কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল, ছোট মামা তখন একেবারে হাউইয়ের মত নাচতে লাগলেন। মার সঙ্গে তুমুল ঝগড়া হল তখন। মায়ের সঙ্গে ঝগড়ায় কে পারবে বল? ছোট মামা হেরে ভূত।

মার সঙ্গে ঝগড়া কী নিয়ে?

জমি নিয়ে। নানার সম্পত্তির ওয়ারিশান চাইলেন মা। তাতেই লেগে গেল।

ওয়ারিশান পেয়েছেন?

পাবেন না মানে? মাকে তুমি এখনো চেন নাই দাদা।

অঞ্জুর কাছে শুনলাম মা আজকাল কারো সঙ্গে কথাবার্তা বিশেষ বলেন না। আমার সঙ্গেও বললেন না। অভাবে অনটনে এরকম হয় নাকি মানুষ? আবেগ শূন্য কথাবার্তা। সেই চরম অভাব এখন তো আর নেই। এখন এরকম হবে কেন? বাবার ধারণা মায়ের সঙ্গে জীন থাকে। আমাকে একবার একা পেয়ে ফিসফিস করে বললেন, সব জীনের কাণ্ড কারখানা।

কিসের কাণ্ড কারখানা?

জীনের। তোর মাকে জীন ধরেছে।

কী যে বলেন। আপনি!

বাবার পাগলামী মনে হল সেরে গেছে। সহজ স্বাভাবিক কথাবার্তা। তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবার কথা জিজ্ঞেস করলেন,

সফিক কেমন আছে? রেবাকে বিয়ে করেছে নাকি? আহা কেন করল না। নিশানাথ কই? সন্ন্যাসী হয়ে গেছে? আহারে বড় ভাল মানুষ ছিল! সন্ন্যাসী তো হবেই। ভালো মানুষ সংসারে থাকতে পারে?

অঞ্জকে জিজ্ঞেস করলাম, বাবার বেহালাব সখা মিটে গেছে নাকি রে?

অঞ্জু লাফিয়ে উঠল, সবচে দারুণ খবরটা তোমাকে দেয়া হয়নি দাদা। বাবা চমৎকার বেহালা বাজায়। যা চমৎকার! যা চমৎকার!

সে কী?

হ্যাঁ দাদা, তুমি বিশ্বাস করবে না। কী চমৎকার! মা পর্যন্ত হতভম্ভ হয়ে তাকিয়ে থাকেন।

বেহালা কিনেছেন নাকি বাবা?

না হারু-গায়েনকে খবর দিলেই সে বেহালা দিয়ে যায়। তুমি আজ বল বাবাকে বাজাতে। সন্ধ্যার পর সবাই গোল হয়ে বসব। বেশ হবে দাদা। বলবে তো?

বাবাকে বেহালা বাজানোর কথা বলতেই তিনি আঁৎকে উঠলেন, পূর্ণিমা আজকে। পূর্ণিমার সময় বেহালা বাজালে পরী নামে এটাও জানিস না, গাধা নাকি? পরীক্ষণেই গলার স্বর নামিয়ে বললেন, তুই তো বিশ্বাস করলি না। যখন বললাম তোর মার সঙ্গে জীন আছে। জীন আছে বলেই তো যখন বাজাই তখন এমন করে তাকায় আমার দিকে–ভয়ে আমার বুক কাঁপে। এই দেখ হাতের লোম খাড়া হয়ে গেছে।

ঢাকায় ফিরে আসার দিন মা আমাকে একশ টাকার একটি নোট দিয়ে বললেন, তুমি যে টাকা পাঠিয়েছিলে সেই টাকা; সাথে নিয়ে যাও; ফেরিওয়ালা হবার দরকার নেই। যখন টাকার দরকার হবে লিখবো।

আমার চোখে পানি এসে গেল। মা এরকম হয়ে গেলেন কী করে? দু’দিন ছিলাম। এর মধ্যে একবার মাত্র তিনি আগের মত সহজ স্বাভাবিক ভাবে কথা বললেন। আগের মত নরম স্বরের মিষ্টি কথা, তোর বাবার বেহালা শুনে যা। মানুষের মধ্যে যে কী গুণ আছে তা বোঝা বড় কষ্ট। এখন বড় আফসোস হয়। কে জানে তাঁর এই আফসোস কী জন্যে?

বাবার কাছে যখন বিদায় নিতে গেলাম। তিনি যেন কেমন কেমন ভঙ্গিতে তাকালেন। যেন আমাকে চিনতে পারছেন না। খানিকক্ষণ পর গম্ভীর হয়ে বললেন, চলে যাবেন যে চা, টা খেয়েছেন? চা না খেয়ে যাবেন না যেন। অঞ্জু খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলল, আপনি আপনি করছে কেন বাবা?

চিনতে পারছ না?

বাবা রাগী গলায় বললেন, হাসিস না। শুধু শুধু, চিনিব না কেন? না চেনার কী আছে?

বাবা ঘোর লাগা চোখে তাকালেন। আমার বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। সত্যি তাহলে আমাকে চিনতে পারছেন না। অঞ্জু বলল, তুমি মনে হয় ঘাবড়ে গেছ দাদা। মাঝে মাঝে বাবার এরকম হয়। কাউকে চিনতে পারেন না। আবার ঠিক হয়ে যায়।

ঢাকায় এসে দুটি চিঠি পেলাম। একটি পারুলোব। পারুলের চিঠিতে একটা দারুণ মজার খবর আছে। তার জমজ মেয়ে হয়েছে। পারুলের সব কাণ্ড কারখানাই অদ্ভুত। দ্বিতীয় চিঠিটি লিখেছে শেলী। তিন লাইনের চিঠি।

পরম শ্রদ্ধেয় স্যার,
আমার সালাম জানবেন। মা আপনাকে চিঠি লিখতে বললেন। আপনি তার সঙ্গে দেখা করবেন। আপনি আর আসেন না কেন?
বিনীতা
শেলী

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *