সপ্তম অধ্যায় – আকবরের ধর্ম ভাবনা, উলেমাদের সঙ্গে সম্পর্ক এবং সামাজিক সংস্কার
আকবরের ধর্মীয় নীতির দুটো দিক ছিল–একদিকে রাষ্ট্রের জন্য নেওয়া তার ধর্মীয় নীতিসমূহ আর অন্যদিকে ছিল তাঁর ধর্ম নিয়ে নিজস্ব কিছু ব্যক্তিগত ভাবনাচিন্তা। যদিও এই দুই দিকের মধ্যে কোনো নিচ্ছিদ্র পার্থক্য ছিল না তবুও এটা মনে রাখা দরকার ব্যক্তিগত ভাবনা ও বিশ্বাস সবসময় রাষ্ট্রনীতির মধ্যে প্রতিফলিত হবে এমন কোনো কথা নেই।
বৃহত্তর ক্ষেত্রে আকবরের ধর্মীয় নীতি পরিচালিত হয়েছিল তুর্ক-মুঘল ঐতিহ্য মেনে। ভক্তি সাধক ও উদারনৈতিক সুফি-সন্তদের দ্বারা প্রচারিত হিন্দু-মুসলিম মিলনের আবহ আকবরের ধর্মনীতিকে প্রভাবিত করেছিল। আর তার কৌতূহলী মনেও সুফিবাদের প্রতি অবাধ অনুরাগ তো ছিলই।
চেঙ্গিস খানের জীবনীকার জুয়াইনির মতে, তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামির থেকে দূরে থাকতেন এবং একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষ ভুলে বিশ্বাস করার ওপর জোর দিতেন। তৈমুরও এই নীতি মেনে চলতেন, ফলে তার ও তার উত্তরসূরিদের সাম্রাজ্যে শিয়াদের ওপর কোনোরকম উৎপীড়ন ঘটেনি, এমনকি তাঁর প্রশাসন ও সশস্ত্র বাহিনীতে খ্রিস্টান ও ইহুদিদেরও দেখা গিয়েছিল। এই উদার ও সহিষ্ণুতার নীতির সার্থক প্রতিফলন আমরা বাবর ও হুমায়ুনের নীতির মধ্যেও দেখতে পাই এবং সে নিয়ে আমরা আগেই আলোচনা করেছি। হুমায়ুনের ভাই কামরান, যিনি ছিলেন একজন গোঁড়া সুন্নি মুসলমান, হুমায়ুনের এই উদারনীতিকে রীতিমতো ঠাট্টা করতেন। বাবরকেও সমরখন্দে যখন শিয়াদের কুলা (টুপি) পরতে বলা হয়েছিল তখন তিনি তা পরতে বিন্দুমাত্র ইতস্তত করেননি। হুমায়ুন শাহ তাহমাসপের দরবারে আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলেন এবং সেখানে বহু শিয়া অভিজাত ছিলেন যাদের সাহচর্য লাভ করেছিলেন তিনি। এই বৃহত্তর উদারনৈতিক আদর্শের কারণেই হুমায়ুন তাঁর পুত্র আকবরের গৃহশিক্ষক হিসাবে নির্বাচন করেছিলেন আবদুল লতিফকে যিনি ইরানে পরিচিত ছিলেন সুন্নি হিসাবে আর ভারতে ছিলেন শিয়া।
আমরা দেখেছি কীভাবে পঞ্চদশ শতক জুড়ে ভারতের সাংস্কৃতিক তথা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলিম সমন্বয় বা একে অপরের কাছে আসার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। কবীর, নানক ও অন্যান্য ভক্তিবাদী সাধু-সন্তরা এ-সময় এক ও অদ্বিতীয় সত্য তথা ঈশ্বরের কথা বলতে শুরু করেছিলেন, যে ঈশ্বরকে মন থেকে বারংবার প্রার্থনা করলে অবলীলায় তিনি অন্তরে এসে বাস করবেন বলে তাদের দাবি ছিল। এই সকল সাধকেরা তাদের দ্বার সকল প্রকার মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন, তারা ভিন্ন ভিন্ন আধ্যাত্মিক প্রভু বা ঐতিহ্য পরিত্যাগ করে সব বিশ্বাসের মানুষকে আপন করে নিয়েছিলেন। এ সময় বেশ কয়েকটি সুফি সিলসিলা বিশেষ করে গাঙ্গেয় । দোয়াব অঞ্চলের চিশতী ও বিহারের কুবরাইয়া সম্প্রদায়ের সুফিরা জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য তাদের খানকার দরজা খুলে রেখেছিলেন, তারা ভিন্ন ভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের মধ্যে কোনো প্রভেদ করতেন না। সুফি সাধক আবদুল কোদুস গাঙ্গেহির লেখনীতে দেখা মিলেছিল ‘গোপী’, ‘মুরলী, কৃষ্ণ প্রভৃতি শব্দের রূপক ব্যবহার, আবার হিন্দি ভক্তিগীতিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল বেশ কয়েকজন সুফি সাধকের গাওয়া সামা (সমবেত সুফি সঙ্গীত)।
রাজনৈতিক ভাবে গুজরাট, মালব ও কাশ্মীরের মতো বহু প্রদেশে প্রশাসনিক স্তরে স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নানা পদে অনেক হিন্দুদের নিয়োগ করা হয়েছিল। লোদি আমলে কয়েকজন হিন্দু রাজার পদোন্নতি ঘটেছিল এবং তারা আমির পদ লাভ করেছিলেন। এই প্রক্রিয়ার অন্যতম প্রতিফলন দেখা যায় ইসলাম শাহের মৃত্যুর পর গুরুত্বপূর্ণ পদে। হেমুর উত্থানের মধ্যে। তবে সে সময়ে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও মন্দির ধ্বংস করার ঘটনা যে ঘটেনি তা কিন্তু নয়। । এই পরিবেশ ও সংস্কৃতি আকবর উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছিলেন এবং নিঃসন্দেহে এগুলি তার ভাবনা ও রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল।
প্রথম পর্যায় (১৫৫৬-৭৩)
তিন রাজকার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করে আকবর তার বড় মনের পরিচয় দিয়েছিলেন ১৫৬৩ সালে মথুরা ও অন্যান্য তীর্থক্ষেত্রে হিন্দুদের কাছ থেকে আদায় করা কোটি কোটি টাকার তীর্থ কর প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়ে। এর আগে তিনি বিদ্রোহী গ্রামগুলো থেকে আকবরের ধর্ম ভাবনা, উলেমাদের সঙ্গে সম্পর্ক এবং সামাজিক সংস্কার মহিলা ও শিশুদের ধরে এনে দাসবৃত্তি করানোর ধারা নিষিদ্ধ করেছিলেন। তিনি রাজপুত রাজকুমারীদের ইসলামে ধর্মান্তরিত না করে বিবাহ করেছিলেন, এমনকি অনেক পত্নীকে রাজপ্রাসাদে নিজ ধর্ম পালনেরও অনুমতি দিয়েছিলেন। এইভাবে আকবরের রাজ্যাভিষেকের পরে রাজসভায় আসা বীরবল ক্রমে আকবরের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন এবং তাকেও তার হিন্দু দেব-দেবী উপাসনা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। যদিও সেই সময় আকবরের ওপর গোঁড়া উলেমাদের প্রভাব ছিল তবুও সে-সময় তার রাষ্ট্রনীতি শুধু যে তার পূর্বসূরিদের উদারনৈতিক ঐতিহ্য মেনে পরিচালিত হয়েছিল তাই নয়, রাষ্ট্র প্রশাসনে রীতিমতো হিন্দুদের অগ্রাধিকার দেওয়াও শুরু হয়ে গিয়েছিল।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৫৬৪ সালে আকবর জিজিয়া কর রদ করার জন্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। আবুল ফজল স্পষ্ট বলেছিলেন যে এই পদক্ষেপ নিতে গিয়ে ‘আকবর অজ্ঞদের পক্ষের প্রচারক (অর্থাৎ উলেমাদের) খুব একটা পাত্তাই দেননি। তিনি এই ভেবে নিজের এই উদ্যোগকে যথার্থতা প্রদান করেছিলেন যে হিন্দুরাও সমান ভাবে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতি অনুগত, তারাও ‘ত্যাগ ও পরিষেবা দানের জন্য কোমর বেঁধে নেমে পড়তে ও এ সাম্রাজ্যের উন্নতির জন্য কাজ করতে প্রস্তুত। আবুল ফজল স্পষ্ট করে এটাও জানিয়েছিলেন যে উলেমাদের কেবল মুনাফার উদ্দেশ্যে জিজিয়া কর আদায় করা হত না, সেই সঙ্গে বিরোধী অর্থাৎ হিন্দুদের ধ্বংস করার জন্যে ও তাদের অপমান করার জন্যেও এই কর নেওয়া হত।
সাম্প্রতিক কালের কিছু গবেষণায় বলা হয়েছে যে আকবরের উদারনীতিবাদকে বড়ো করে দেখানার জন্যে আবুল ফজল ইচ্ছাকৃত ভাবে জিজিয়া কর রদের সময় কালকে পিছিয়ে ১৫৬৭ সাল বলে বর্ণনা করেছিলেন, কিন্তু বায়ুনি সেখানে এই সময় কালকে ১৫৭৯ বলে উল্লেখ করেছিলেন। বায়ুনি বলেছিলেন যে ১৫৭৫-৭৬ সালে আকবর শেখ আবদুন নবি ও মাখদুম-উল-মুলককে জিজিয়া কর সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে খোঁজখবর করা ও হিন্দুদের থেকে এই কর বাবদ ঠিক কত পরিমাণে অর্থ আদায় করা হবে তার হিসাব করতে আদেশ দিয়েছিলেন। সেই হিসাবে তারা সাম্রাজ্যের সর্বত্র ফরমান জারি করে দিয়েও ছিলেন; কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে সেই ফরমানের আদেশ জলের ঢেউয়ের মতো মিলিয়ে গিয়েছিল। ফলে আকবর ১৫৬৪ সালে জিজিয়া কর রদের নির্দেশ ফিরিয়ে নেওয়ায় কর আদায়ের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল।
ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে এই সময় আকবর অনেকটা গোঁড়া মুসলিমের মতো আচরণ করতেন বলে জানা যায়। তিনি ধর্মভীরুর মতো প্রাত্যহিক নামাজ পড়তেন ও নিজ হাতে মসজিদের দালান পরিষ্কার করতেন। তিনি হজে দূত পাঠিয়েছিলেন এবং হিজাজে গরিব দুঃখীদের দান করার জন্য একবার তিনি ছয় লক্ষ টাকাও পাঠিয়েছিলেন। এই পর্বে আকবর আবদুল্লা সুলতানপুরী ও শেখ আবদুন নবির একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন। আবদুল্লা সুলতানপুরী একজন কট্টরপন্থী মুসলিম ছিলেন এবং শের শাহের কাছ থেকে শেখ-উল-ইসলাম উপাধি লাভ করেছিলেন। ইসলাম শাহের নেতৃত্বে মাহদাবিশদের নিগ্রহ করা এবং তাদের নেতাদের নির্মম ভাবে হত্যা করার ঘটনায় আবদুল্লা সুলতানপুরীর হাত ছিল বলে সন্দেহ করা হয়। বৈরাম খাঁর পতনের পরে তিনি নতুন করে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন এবং মুকাদ্দম-উল-মুলক উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। আবদুন নবি একজন সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন এবং পণ্ডিত হিসাবে তার যথেষ্ট সম্মান ছিল, যদিও পরবর্তীকালে দেখা গিয়েছিল তার জ্ঞান ছিল ভাসা-ভাসা। উজির মুজফফর খানের সুপারিশে আকবর তাঁকে সদর পদে নিয়োগ করেছিলেন। আকবর প্রায়শই হাদিস (পয়গম্বরের ঐতিহ্যসমূহ)-এর ওপর তার বক্তৃতা শুনতে আসতেন এবং দু-এক বার তার জুতোও নিজে হাতে এগিয়ে দিয়েছিলেন বলে শোনা যায়। আবদুল নবি এতটাই গোঁড়া ছিলেন যে সামা গাওয়ার জন্য তিনি নিজের পিতার বিরোধিতা করেছিলেন। আংটি, রেশমের কাপড় বা গোলাপি কিংবা গাঢ় পীতবর্ণের পোশাক পরেছিলেন বলে আকবরকে তিনি ভর্ৎসনা করেছিলেন, এমনকি লাঠি দিয়ে প্রায় আঘাতও করে দিয়েছিলেন!
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে আকবর বৃহত্তর উদারনৈতিক ধর্মীয় রাষ্ট্রনীতি নিয়ে এগোতে চাইলেও সেইসময় রাজদরবারের দাঁড়টা ছিল রীতিমতো কয়েকজন গোঁড়া উলেমার হাতে। আবদুন নবিকে মুক্ত হস্তে তার প্রিয়জনদের নিষ্কর জমি প্রদানের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল। বায়ুনির মতে, আবদুন নবি যে হারে এ সময় জমি দান করেছিলেন তার দশ ভাগের এক ভাগও দান করেননি অন্য কোনো সদর। বিধর্মীদের ওপর অত্যাচার চালানোর জন্যেও আবদুন নবি তার উচ্চপদের ক্ষমতার অপব্যবহার করেছিলেন। তাঁর অঙ্গুলিহেলনে ১৫৬৯ সালে কাশ্মীরে আকবরের দূত মির্জা ইসফাহানি ও মুঘল দরবারে কাশ্মীরি দূত মির ইয়াকুব কাশ্মীরিকে শি-ইতে ধর্মমতে বিশ্বাস করা ও শ্রীনগরে সুন্নি-বিরোধী কার্যকলাপে অংশ দেবার দায়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। দিল্লিতে আমির খসরুর সমাধির পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে মুরতাজা সিরাজির সমাধিস্থ দেহাবশেষ খুঁড়ে বের করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল যে একজন বিধর্মী অর্থাৎ শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের সমাধি নিকটে থাকায় আমির খসরুর মতো একজন স্বনামধন্য সুন্নি সাধকের সমাধির গরিমা নষ্ট হচ্ছিল। মাহদাবিদাদে বিশ্বাসীদেরও চরম অপমান করা হয়েছিল। আবুল ফজলের পিতাও যথেষ্ট জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি শেখ মুবারকে তার ঘোষিত মাহদাবি বিশ্বাসের জন্যে সম্মান দেওয়া হত, কিন্তু আকবর হস্তক্ষেপ করে তা বন্ধ করে নিয়েছিলেন।
দ্বিতীয় পর্যায় (১৫৭৩-৮০)
এই পর্বে গভীর আলোচনা ও অন্তঃনিরীক্ষণের পর আকবরের ধর্মীয় মনোভাবে এসেছিল এক চরম পরিবর্তন এবং তা পরবর্তী ও চূড়ান্ত পর্যায়ে (১৫৮১-১৬০৫) তাঁর রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করার ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল। উজবেক অভিজাতদের বিরুদ্ধে তাঁর একের-পর-এক সাফল্য এবং তার সঙ্গে মালব, রাজস্থান ও গুজরাটে জয় লাভ করে আকবরের এই বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়েছিল যে তিনি হলেন পরেমশ্বরের মনোনীত সেই সৌভাগ্যবান মাধ্যম যার সাহায্যে এক শাসনের অধীনে সমস্ত ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করা যাবে। বায়ুনি লিখেছেন, সাম্রাজ্য দিনের-পর-দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল; সব কিছুই বেশ ভালো হচ্ছিল এবং সারা জগতেই আর কোনো প্রতিপক্ষ রইল না। তাই সম্রাট মুইনিয়াহ সম্প্রদায়ের গুরু ও শিষ্যদের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসার অবকাশ পেয়ে গিয়েছিলেন এবং তাদের সঙ্গে বেশিরভাগ সময় ঈশ্বরের বাণী (কোরান) ও পয়গম্বরের বাণী (হাদিস বা ঐতিহ্য) নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। আর সেখানেই সুফিবাদ, দর্শন ও আইনে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান প্রসঙ্গে নানা প্রশ্ন নিত্যদিনের ক্রম পর্যায়ে উঠে আসত।
গভীর ভাবে জানার মানসিকতা ছাড়াও আকবর ছোটোবেলা থেকে মৌলানা রুম ও হাফিজের মতো উদারনৈতিক সুফি চিন্তাবিদদের মসনভি-তে আসার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন। শাসক হিসাবে তিনি কেবল খাজা মইনুদ্দিন চিশতীর দরগাতে গিয়েই ক্ষান্ত হননি, সেই সঙ্গে অন্যান্য বহু বিখ্যাত সুফি সাধকের সমাধিও পরিদর্শন করেছিলেন।
ইবাদত খানা বিতর্ক
এই পরিপ্রেক্ষিতে আকবর ১৫৭৫ সালে ফতেপুর সিক্রিতে নির্মাণ করলেন ইবাদত খানা। এটা ছিল একটি বিশাল আয়তাকার গৃহ যা মূলত গুজরাট থেকে আগত সুফি সাধক শেখ আবদুল্লাহ নিয়াজীর বাসস্থানকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল। এই গৃহের সবদিকে ছিল প্রশস্ত দালান। আকবরের রাজপ্রাসাদের থেকে অনতিদূরে এই গৃহ নির্মাণ করা হয়েছিল যাতে সম্রাট সহজেই এখানে আসতে পারেন এবং যতক্ষণ ইচ্ছা সময় কাটাতে পারেন। পরের দিকে বানানো অনুপ তালাবও এর খুব কাছে অবস্থিত ছিল।
ধর্মীয় বিতর্কের জন্য ইবাদত খানা গড়ে তোলা নিঃসন্দেহে ছিল এক অভিনব পদক্ষেপ। এখানে মুসলিম ছাড়াও ইহুদি, খ্রিস্টান ও হিন্দুরা পারস্পরিক যুক্তিতর্কে অংশগ্রহণ করতেন, প্রত্যেকে নিজ নিজ বৌদ্ধিক জিজ্ঞাসার উত্তর খোঁজার এবং সেই সঙ্গে নিজ নিজ বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতেন। এই রকম বিতর্ক চলত উমাইয়াদ ও আব্বাসিদদের আমলে এবং তা সবে ইসলাম গ্রহণ করা ইলখানিদ মোঙ্গলদের আমলেও অব্যাহত ছিল। তৈমুরীয় শাসনে এই ঐতিহ্য বিলুপ্ত হয়ে যায়নি এবং হেরাটের তৈমুরীয় শাসক হুসেন বৈকারাও এ ধরনের বিতর্কসভার আয়োজন করতেন। আকবর খবর পেয়েছিলেন যে বাংলার তৎকালীন শাসক সুলেমান করোনি প্রত্যেক রাতে প্রায় ১৫০ জন শেখ ও উলেমাদের দলের সঙ্গে নামাজ পড়তেন এবং তাদের উপাসনাস্থলে সকাল পর্যন্ত থাকতেন এবং গান বাজনা ও বক্তৃতা শুনতেন।
প্রথম দিকে ইবাদত খানা কেবলমাত্র মুসলিমদের জন্য খোলা হয়েছিল। শোনা যায় যে রাজকার্য শেষ করে প্রত্যেক বৃহস্পতিবার রাতে আকবর ইবাদত খানায় আসতেন। যখন একে-একে এখানে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে তখন অনুপ তালাবের চারপাশে সকলকে বসতে দেওয়া হত। বিশেষ আলোচনার জন্যে অনেক সময় এখান থেকে বিদ্বজ্জনদের সম্রাটের শয়ন কক্ষে নিয়ে যাওয়া হত এবং সেখানে সম্রাট আরও মনোযোগী হয়ে তাদের বিতর্ক ও ভাবনাচিন্তাগুলো শুনতেন।
প্রথম দিকে সুফি শেখ, উলেমা, জ্ঞানীগুণী মানুষ ও সম্রাটের কয়েকজন প্রিয় সঙ্গীসাথী ইবাদত খানায় আসতেন। তাদের চারটি গোষ্ঠীতে ভাগ করা হত এবং আকরর এক-এক করে সব গোষ্ঠীর কাছে যেতেন। তবে সবথেকে প্রাণবন্ত আলোচনা হত ধর্মতত্ত্ববিদদের গোষ্ঠীতে। এখানে আলোচনায় একটা প্রশ্ন উঠে এসেছিল যে একজন সম্রাটের আইনত ঠিক কতজন পত্নী থাকতে পারে। এই প্রশ্নের একাধিক ব্যাখ্যা আলোচিত হয়েছিল যা শুনে বেশ হতাশ হয়েছিলেন আকবর। যদিও তিনি সভায় ঘোষণা করেছিলেন যে তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য হল সত্য ও বাস্তব সত্তার প্রকৃত স্বরূপ খুঁজে বার করা’, কিন্তু দেখা গিয়েছিল যে উলেমাদের উদ্দেশ্য সেখানে ছিল অন্য। তারা চাইছিলেন অন্যদের ওপর তাদের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে এবং প্রতিপক্ষকে ধমক দিয়ে পরাজয় স্বীকার করাতে তারা যেন উঠে-পড়ে লেগেছিলেন। আর এসব করতে গিয়ে তারা মাঝেমধ্যে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উপস্থিতিতেই প্রতিপক্ষের দিকে মারমুখী ভঙ্গিতে তেড়ে যেতেন।
ইবাদত খানার আলোচনায় এসব ঘটনা নতুন বা অভিনব ছিল না। তবে ১৫৭৮ সালে এক রহস্যময় অভিজ্ঞতার পর আকবর ইবাদত খানায় বিতর্কের দরজা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অর্থাৎ হিন্দু, জৈন, খ্রিস্টান ও জরাথুস্ত্রীয়দের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। এটা আবার অন্য বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। কোরানের বাণীর চূড়ান্তকরণ, মহম্মদের পয়গম্বর সত্তা, তার পুনরাবির্ভাব, এক ঈশ্বরের ভাবনা ইত্যাদি একাধিক প্রশ্নে মুসলিম গোষ্ঠীগুলো একদিকে হয়ে গিয়ে রীতিমতো আলোচনাকে ভেস্তে দিতে শুরু করে এবং কট্টরপন্থীদের দাপট চলতে থাকে। তাই আধুনিক ঐতিহাসিক আর পি. ত্রিপাঠী বলেন, ‘প্রশংসনীয় হবার পরিবর্তে ইবাদত খানা ক্রমশ হতাশায় পরিণত হয়েছিল’। আকবর নিজেও এইসব বিতর্কের নিষ্ফল পরিণতির কথা স্বীকার করে নিয়েছিলেন এবং আংশিক ভাবে ১৫৮১ সালে চূড়ান্ত ভাবে ১৫৮২ সালে ইবাদত খানা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
ইবাদত খানার বিতর্কসভা থেকে আকবর ঠিক কী, পেতে চেয়েছিলেন সেটা আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। যদি তিনি এটা চেয়ে থাকেন যে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতাদের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস জাগরিত করে এক বিভিন্ন সত্যে পৌঁছোতে, তাহলে সে ধরনের কোনো আশা ইবাদত খানার বিতর্ক থেকে পূরণ হয়নি, কারণ সেখানে কোনো গোষ্ঠীই বিচ্ছিন্নতা ও বিরোধিতার স্বার্থ পরিত্যাগ করেনি। তাঁরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ভাবনার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় গোঁ ধরে বসেছিলেন এবং বিতর্কে অংশ নিয়েছিলেন অন্যদের পরাজিত করে সম্রাটের সমর্থন আদায়ের সংকীর্ণ অভিসন্ধি চরিতার্থ করতে। কেউ একটা সর্বজনগ্রাহ্য বোঝাপড়ায় আসতে প্রস্তুতই ছিলেন না।
যদি আকবর নিজে ব্যক্তিগত ভাবে সকল ধর্মের মধ্য থেকে মূল সত্যটা বোঝার জন্যে এই উদ্যোগ নিয়ে থাকেন তাহলে তার ইবাদত খানায় এত ঘটা করে বিতর্কসভা করার কোনো দরকার ছিল না, তিনি খুব সহজেই নিজ ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় সে ব্যাপারে জ্ঞান সঞ্চয় করতে পারতেন, আর এমনটা তিনি কয়েক বার ইবাদত খানায়। বিতর্কসভা চলাকালীন করেও ছিলেন। যেমন তিনি পুরুষোত্তম ও দেবীর সঙ্গে শয়ন কক্ষে দেখা করেছিলেন। এছাড়া শেখ তাজুদ্দিন ও মোল্লা মহম্মদকেও আলাপ আলোচনার জন্যে আকবর তার নিজস্ব কক্ষে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। এই সব আলোচনা ইবাদত খানা বন্ধ হয়ে যাবার পরেও চলত। হয়তো আকবর ইবাদত খানার বিতর্কসভা থেকে ঠিক কী পেতে চেয়েছিলেন সে ব্যাপারে নিজে খুব একটা পরিষ্কার ছিলেন না। কিন্তু এই বিতর্কের ধারণা চালু করার ফলে আকবর যখন কোনো বিষয়ে জানতে ও বুঝতে চাইতেন তখন তিনি এ ধরনের আলোচনাসভার আয়োজন করে ফেলতেন। তাই তিনি বলেছিলেন, আশা করি আমি আর কোনো প্রথাগত বিষয়ের পণ্ডিতদের মধ্য মতবিরোধ শুনতে পাব না, কোরানের বাণী ও পয়গম্বরের ঐতিহ্য নিয়ে নানা ব্যাখ্যার বিভ্রান্তিও আমায় শুনতে হবে না।
তবে ইবাদত খানার বিতর্ককে কেবল অর্থহীন ও ক্ষতিকারক জমায়েত বলে উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। এর দুটো খুব গুরুত্বপূর্ণ ফল ছিল। এক, এরা আকবরকে এই ব্যাপারে নিশ্চিত করতে পেয়েছিলেন যে সব ধর্মের মধ্যেই সত্য আছে এবং সকলেই এক পরম সত্তার আলোয় আলোকিত। এই সময়টা আকবরের নিজস্ব ধর্মীয়। ভাবনার বিবর্তনের একটা গুরুত্বপূর্ণ পর্ব ছিল এবং পরবর্তীকালে তিনি যে। সুলহ-ই-কুল বা সব ধর্মের মধ্যে শান্তি ও সহাবস্থান গড়ে তোলার ধারণা বিকশিত করেছিলেন তার আদর্শ নির্মাণের ক্ষেত্রে ইবাদত খানার আলোচনা খুব কাজে লেগেছিল। দুই, এই বিতর্কসভা জনসমক্ষে দরবারি উলেমাদের সংকীর্ণতা, গোঁড়ামি ও ঔদ্ধত্য ফাঁস করে দিয়েছিল যা আকবরের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের ফাটল ধরার ক্ষেত্রে অনেকটা অনুঘটকের কাজ করেছিল। বলা বাহুল্য, এ সময় আকবরের মতালম্বী আবুল ফজল ও অন্যান্যরা উলেমাদের সরিয়ে নিজেদের স্থান পাকা করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন আর এই সম্পর্কের ফাটল তাঁদের কাছে একটা বড়ো অস্ত্র হিসাবে ধরা হয়েছিল।
এই ভাবে ইবাদত খানার বিতর্ক একটি নতুন উদারনৈতিক ও সহিষ্ণু রাষ্ট্রের উত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
মহজর এবং নতুন রাষ্ট্রনীতির সূচনা
মাহজার হল ১৫৭৮ সালে জারি হওয়া একটি বিবৃতি যাতে স্বাক্ষর করেছিলেন প্রথম সারির সাত উলেমা যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন শেখ আবদুন নবি, আবদুল্লাহ সুলতানপুরি এবং আবুল ফজলের পিতা শেখ মুবারক। তাদের স্বাক্ষর করা এই বিবৃতি নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি ঐতিহাসিক মহলে। ভিনসেন্ট স্মিথের মতে, পোপের মতো করে আকবর এর মাধ্যমে নিজেই নিজেকে ‘অভ্রান্ত প্রতিপন্ন’ করতে উঠে পড়ে লেগেছিলেন। অন্যেরা মনে করেন যে, আকবর এই মহজর জারি করার মাধ্যমে অটোমান খলিফা ও ইরানের শিয়া শাসকদের আনুগত্য ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। পাকিস্তানের কয়েকজন ঐতিহাসিক আবার একে ‘একটি অসৎ দলিল’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন, কারণ এর মাধ্যমে নাকি আকবর শিক্ষিত না হয়েও আইনের ব্যাখ্যাকারী সেজে বসেছিলেন। সত্যিটা আসলে কী তা জানতে হলে আমাদের এই বিবৃতি-পত্রটি ভালো করে খতিয়ে দেখতে হবে।
মাহজারের প্রথম ভাগে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করা আছে যে আকবর হলেন। ইসলামের সুলতান, মানবজাতির আশ্রয়, ধর্ম বিশ্বাসীদের নেতা, জগতের ওপর বিরাজমান আল্লাহর ছায়া। এই ধরনের অভিধা সে সময় খলিফার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হত। আকবর যদি নিজেকে খলিফা হিসাবে ঘোষণা করে থাকেন তাহলে বিরোধিতার কোনো জায়গা ছিল না, কারণ তৈমুরীয় শাসকরা কখনোই খলিফার মতো কোনো বাইরের কর্তৃপক্ষকে মেনে নেননি। আর এর মাধ্যমে আকবর অটোমান বা ইরানীয়দের খলিফা হবার দাবির বিরোধিতা করেছিলেন এমনটা মনে হয় না কারণ ভারতে কোনোদিন কেউ এই ধরনের দাবি করেননি (এক দক্ষিণে ইরানের শাহ ছাড়া)।
দ্বিতীয় ভাগে, কোরান ও হাদিসের কিছু অংশ হয়তো কিছুটা ভুল ভাবে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছিল যে একজন সদ্য ক্ষমতাসীন ও বিচক্ষণ সম্রাট হিসাবে সকলের আনুগত্য দাবি করার অধিকার আকবরের আছে, আর পরমেশ্বরের চোখে তার অবস্থান কিন্তু একজন মুজতাহিদ(পবিত্র আইনের ব্যাখ্যাকর্তা)-এর থেকেও বেশি। তৃতীয় ভাগে বলা আছে যদি ভবিষ্যতে ধর্মীয় কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হয় এবং সে ব্যাপারে মুজতাহিতদের মধ্যে মতানৈক্য না হয় তাহলে সম্রাট মানবজাতির কল্যাণের জন্য এবং জগতের প্রশাসনিক কাজকর্মকে যথাযথভাবে পরিচালনা করার। জন্য নিজের মতো ব্যবস্থা নিতে পারেন।
পরিশেষে এই যুক্তি দেওয়া হয় যে, আকবর কিন্তু স্বয়ং নস অর্থাৎ কোরানের ঘোষিত অধ্যাদেশ বিরোধী নয় এমন যে-কোনো আদেশনামা জারি করতেই পারেন। এবং ‘তা বৃহৎ পরিসরে মানবতার উপকারের জন্যই পরিকল্পিত।’ তাই সম্রাটের জারি করা কোনো অধ্যাদেশের বিরোধিতা করার অর্থ হল ইহলোক ও পরলোকের জন্য পাপ সঞ্চয় করা।
এই ঘোষণাপত্রটি ছিল নিঃসন্দেহে অভিনব। বলবন, আলাউদ্দিন খলজির মতো ভারতের পূর্বতন শাসকরা শরিয়ত অনুমোদন থাকুক বা না থাকুক, প্রয়োজনমতো ও ইচ্ছানুসারে এই ধরনের আদেশ জারি করতে চাইতেন সব সময়, কিন্তু তা পারেননি। ইবাদত খানার বিতর্কসভা থেকে আকবর এটা বুঝে গিয়েছিলেন যে কোনো বিষয়ে। সকল ধর্মের নেতাদের মধ্যে মতৈক্য তৈরি করা সম্ভব নয়। তাই যা করার তাকেই করতে হবে। এরপর মথুরার এক প্রথম সারির ব্রাহ্মণের ওপর এক কাজির মসজিদ নির্মাণের জন্য জোগাড় করা জিনিস হাতিয়ে মন্দির তৈরির চেষ্টা, পয়গম্বর মহম্মদকে অবমাননা করা এবং ইসলামের বিরুদ্ধাচরণের অভিযোগ এনে তাকে চরম শাস্তি দেবার বিধান দেওয়াকে কেন্দ্র করে আকবরের সঙ্গে উলেমাদের সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়।
আসলে ঘটনাটি ছিল এই রকম–আবুল ফজল ও বীরবলকে নিয়ে গড়া তদন্ত আয়োগের অনুসন্ধানে ওই ব্রাহ্মণটি দোষী প্রমাণিত হন। উলেমাদের একটা অংশ ব্রাহ্মণের মৃত্যুদণ্ড চায়, অন্য অংশ চায় যেহেতু উনি একজন জিম্মি বা হেফাজতে রয়েছেন, সেহেতু ওনাকে একটা মোটা অঙ্কের জরিমানা ও পায়ে ভুসোকালি মাখিয়ে চরম অপমান করে ছেড়ে দেওয়া হোক। আকবর কিন্তু লঘু শাস্তির পক্ষে থাকলেও বিষয়টি আবদুন নবির ওপর ছেড়ে দেন। তিনি ওই ব্রাহ্মণকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দেন। এই ঘটনায় আকবর আবদুন নবির ওপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন। এর আগেও আবদুন নবি একই ধরনের অভিযোগে একজন আফগান ও এক শিয়া মুসলমানকে মেরে ফেলার বিধান দিয়েছিলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে বিচক্ষণ পণ্ডিত শেখ মুবারক একবার আকবরকে বলেছিলেন, ‘সম্রাট আপনি যখন এই জগতের ইমাম ও মুজতাহিদ, তাহলে ধর্মীয় বা ধর্ম বহির্ভূত যে-কোনো বিষয়ে আপনার আদেশ জারি করার জন্য। এই উলেমাদের সাহায্য নেওয়ার প্রয়োজন আছে কি?
সুতরাং মনে হয় এর পর আকবর এই বিষয়ে অনেক ধর্মতত্ত্ববিদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করেছিলেন আর যার ফল ছিল মহজর ঘোষণা। বায়ুনি জানান যে কেউ কেউ স্বেচ্ছায় আবার আবদুন নবি বা আবদুল্লাহ সুলতানপুরির মতো কেউ কেউ অনিচ্ছা সত্ত্বেও মহজুরে স্বাক্ষর করেছিলেন। একটা বিষয় বলে রাখা ভালো যে এই আদেশনামায় কোথাও কিন্তু আকবর নিজেকে মুজতাহিদবলে দাবি করেননি (যদিও আবুল ফজল একবার তা বলেছিলেন), কিন্তু একজন শাসক হিসাবে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা ও প্রশাসনিক প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে তিনি বিভিন্ন ব্যাখ্যার মধ্যে থেকে একটিকে বেছে নেবার এবং পূর্বর্তন আইনপ্রণেতাদের বিধানকে পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। যদিও ঘোষণাপত্রে স্পষ্ট করে বলা হয়েছিল যে সম্রাট যে সিদ্ধান্ত নেবেন সবই জনকল্যাণ ও সাম্রাজ্যের ভালোর জন্য। কিন্তু এখানেই বিতর্কের বীজ লুকিয়ে ছিল। দুই পাকিস্তানি ঐতিহাসিক এস. এম. ইকরম ও এস. এ. রশিদ তাই যথার্থ বলেছেন যে, …নিরপেক্ষ ও নিখুঁতভাবে দেখলে বোঝা যায় যে এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে ইসলামীয় আইনের সম্পূর্ণরূপে বিরোধিতা করার জন্য ও একটি ধর্মবিরুদ্ধ রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য একেবারে আটঘাট বেঁধে নামা হয়েছিল। এখানেই শেষ নয়, তারা আরও বলেন যে, কিন্তু আকবর ১৫৭৯ সালের ঘোষণাপত্রের সীমাবদ্ধতাগুলোকে উপলব্ধি করতে পারেননি এবং বাস্তবে এটা রীতিমতো একটি অনিয়ন্ত্রিত স্বৈরতন্ত্রের অজুহাতে পরিণত হয়েছিল। এবার আমরা এই বিষয়ে আলোচনা করব।
মহজার-এর প্রকৃত গুরুত্ব বোধ হয় এইখানে যে তিনি (আকবরের) ধীরে ধীরে অথচ দৃঢ়ভাবে যে নীতির (সুলহ-ই-কুল) প্রয়োগ ঘটাতে চাইছিলেন, এটা ছিল তার প্রথম কার্যকরী বহিঃপ্রকাশ’ (এস. এ. এ. রিজভি)। আর এর ফলেই আকবরের সঙ্গে গোঁড়া উলেমাদের সম্পর্কের ফাটল চরম আকার নিয়েছিল।
এই ঘোষণাপত্রটির আন্তর্জাতিক তাৎপর্যও ছিল। বাংলা সহ সমগ্র উত্তর ভারতকে নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে আকবর এবার খুব সহজেই তুর্কির অটোমান বা ইরানের সাফাভিদদের মতো পশ্চিম এশিয়ার শক্তিশালী অধীশ্বরদের সমকক্ষ হবার দাবি। জানানোর জায়গায় চলে গিয়েছিলেন। আর তাই তিনি ভারতের মাটিকে পবিত্র শান্তির ভূমি বলে ঘোষণা করতে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন যা ছিল অটোমান ও সাফাভিদের চ্যালেঞ্জ করার শামিল। ঘোষণাপত্র শুরু হয়েছিল এই বলে—’হিন্দুস্থান। এবার নিরাপত্তা ও শান্তির কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে এবং পরিণত হয়েছে আদল (সুবিচার) ও পরহিতকারীর পীঠস্থানে…’, আর তাই দলে দলে অগণিত মানুষ যাদের মধ্যে ছিলেন জ্ঞানের পথপ্রদর্শক তথা মুক্তি লাভের দিশারী বিজ্ঞ সব উলেমা ও আইন প্রণেতাগণ, তাঁরা আরব ও আজমের দেশ (ইরাক ও ইরান) ছেড়ে এই পীঠস্থানের পানে ছুটে আসছেন এবং নিজের গৃহ ভেবে বসবাস করছেন।..
এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে আকবর কেবল সুবিচারের কথা (যা ছিল তার সুলহ–ই-কুল নীতির একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ) বলে ক্ষান্ত হননি, তিনি রীতিমতো উলেমা-দের এটা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্র কাজ করবে শুধুমাত্র জনগণের কল্যাণের জন্য।
গোঁড়া উলেমাদের সঙ্গে বিচ্ছেদ
আকবর যখন তার নিজের মতো করে কাজ করার নকশা বানিয়ে ফেলেছিলেন তখন উলেমা–দের সঙ্গে তার বিচ্ছেদ ঘটা নিছক সময়ের অপেক্ষা। তবে এটা ভাবা ঠিক হবে না যে মহজর বানানো হয়েছিল উলেমা–দের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে। উলেমা-রা এমনিতেই আবদুল্লাহ সুলতানপুরি ও শেখ আবদুন নবির নেতৃত্বাধীন দুই শিবিরে আগে থেকে বিভক্ত ছিল। ফলে তাদের গোঁড়ামির রমরমা নিজেই নিজের মরণ-খাদ খুলে রেখেছিল। আকবর উলেমা-দের ভণ্ডামি, শঠতা ও গোঁড়ামির নমুনা দেখতে দেখতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। একটি তদন্তে দেখা গিয়েছিল যে জাকাত কর ফাঁকি দেবার জন্য আবদুল্লাহ সুলতানপুরি সেই বছর তাঁর সব সম্পত্তি তার পত্নীর নামে করে দিয়েছিলেন এবং বছর ঘুরতেই তা আবার নিজের নামে ফিরিয়ে এনেছিলেন। এই কাণ্ড যে শুধু তিনি ঘটাতেন তা নয়, সে সময় অন্যদের মধ্যেও এই কারচুপির প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল। তদন্তে এটাও উঠে এসেছিল যে আবদুন নবির ওয়াকিল নিষ্কর জমি প্রদানের জন্য প্রচুর পরিমাণে ঘুস নিয়েছিলেন।
১৫৭৯ সালে আকবর আবদুল্লাহ সুলতানপুরি ও আবদুন নবিকে হজ যাত্রীদের একটি দলের নেতা হিসাবে নিয়োগ করে মক্কায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন এবং অনুমতি ছাড়া সেখান থেকে ফিরে না আসার আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু এই দুজনকে বহিষ্কার করলেও উলেমা–দের কাণ্ডকারখানা দেখে তাদের প্রতি আকবরের অসন্তোষ বিন্দুমাত্র কমেনি। ১৫৮০ সালে যখন কড়া ভাবে দাগ ব্যবস্থার প্রয়োগের বিরোধিতা করে। বাংলা ও বিহারের একদল অভিজাত বিদ্রোহ শুরু করেছিল তখন উলেমারা তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। জৌনপুরের কাজি মোল্লা মহম্মদ ইজদি ফতোয়া জারি করে জানিয়েছিলেন যে আকবরের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ আইনসম্মত, আবার বাংলার কাজি উলেমা–দের মদদ-ই–মাস ভাতা বরাদ্দ বন্ধ করে দেওয়ায় স্বর্গীয় প্রতিশোধ হিসাবে এই বিদ্রোহকে ব্যাখ্যা করেছিলেন। আকবর এঁদের ছেড়ে কথা বলেননি। বাংলা ও বিহারের বিদ্রোহ দমন করার পরেই এই দুই কাজিকে দরবারে ডেকে পাঠানো হয় আর তারপর যমুনা পার করে ফেরার পথে তাদের জলে ডুবিয়ে মেরে ফেলার আদেশ দেওয়া হয়। বিদ্রোহী আরও অনেককেই হয় কারাদণ্ড দেওয়া হয় নাহলে খতম করে দেওয়া হয়। আধুনিক ঐতিহাসিক এস. এ. এ. রিজভি বলেন, ‘উলেমা ও সুফিদের বিরুদ্ধে এই কঠোর পদক্ষেপগুলো প্রশাসনিক প্রয়োজনে নেওয়া হয়েছিল, ইসলাম বা গোঁড়া মুসলিমদের প্রতি বৈরিতার কারণে নয়। আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সংবাদ পেয়ে মক্কায় আকবরের নামে কুৎসার জাল বুনে আবদুল্লাহ সুলতানপুরি ও আবদুন নবি ১৫৮২ সালে ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন, কিন্তু এসে দেখেন বিদ্রোহ দমন করে ফেলেছেন আকবর। ফলে পালাবার আর কোনো রাস্তা ছিল না। সত্তর বছরের বৃদ্ধ আবদুল্লাহ সুলতানপুরি এরপর আহমেদাবাদে মারা যান। তার পারিবারিক কবরস্থান থেকে কয়েক বাক্স সোনার মোহর বাজেয়াপ্ত কড়া হয়। আবদুন নবিকে পাকড়াও করে ফতেপুরে নিয়ে আসা হয়। মক্কায় হজযাত্রীদের খরচের জন্য দেওয়া অর্থ তিনি আত্মসাৎ করেছেন কিনা তা খতিয়ে দেখার জন্য তাকে টোডর মলের হাতে তুলে দেওয়া হয়। কিছুদিন পর কারাগারে একদল দুষ্কৃতীর হামলায় প্রাণ হারান আবদুন নবি।
মদদ-ই-মাস ভাতার পুনর্বিন্যাস
ভারত কিংবা বিদেশি রাষ্ট্রের অন্যতম একটি ঐতিহ্য ছিল জ্ঞানীগুণী, আধ্যাত্মিক কাজকর্মে যুক্ত ব্যক্তি, দরিদ্র, বিধবা কিংবা বেকার অথচ সম্মানীয় ব্যক্তিদের নানা ভাবে সাহায্য করা। ভারতে এই উদ্দেশ্যে যে জমি দান করা হত তাঁকে বলা হত শাসন। ভারতের মুসলিম রাজ্যগুলোতে এ ধরনের জমি দানকে বলা হত মিলক, মদদ–ই–মাস বা সায়ুরঘল এবং এই কাজের দায়িত্ব সাধারণভাবে থাকত সদর-এর ওপর। অমুসলিমদের প্রয়োজন অনেক হলেও পূরণ করতেন তখনও বেশ কিছু অঞ্চলে রাজত্ব করা হিন্দু রাজারা।
দায়িত্বভার গ্রহণ করে আকবর এই মদদ–ই–মাস ভাতা বণ্টনের দায়িত্ব সদর-এর। হাতে অর্পণ করেছিলেন। লোদি ও শূরদের আমলে এই ধরনের প্রচুর জমি আফগান ও তাদের সমর্থক ভারতীয় শেখজাদাদের মধ্যে বিলি করা হয়েছিল। বৈরাম খাঁর অন্তর্বর্তী শাসনকালে শেখ গদাই এই সম্পত্তিগুলো হস্তান্তর করার উদ্যোগ। নিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু খুব একটা সফল হতে পারেননি। ১৫৬৫ সালে শেখ আবদুন। নবি সদর পদে বসেন। তাঁর সময়ে দুটো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। এক, আফগানরা যে মদদ–ই–মাস জমি ভোগ করেছিল সেগুলোকে রাষ্ট্রের খাস জমিতে পরিণত করা শুরু হয় এবং আবদুন নবির পছন্দের লোকজনদের মধ্যে তা বিলি করা হয়। এর ফলে প্রচুর পরিমাণে অসন্তোষ ও ঝুট-ঝামেলার সৃষ্টি হয়েছিল ঠিকই, যার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় বায়ুনির লেখায়। কিন্তু এই পদক্ষেপের কারণে রাষ্ট্রের খাস জমির আয় বেড়েছিল। দুই, যারা ভাতা হিসাবে একাধিক জায়গায় জমি পেয়েছিলেন তাদের সেই সব জমির পরিমাণ যোগ করে সেই হিসাবে জমি তাদের। পছন্দমতো একটি জায়গায় দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এতে যেমন তাদের দুর্ভোগ। কম হত, তেমনি রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও সুবিধা হত।
এই সময় ভাতা দানের ক্ষেত্রে আবদুন নবির কাজে কোনোভাবেই হস্তক্ষেপ করেননি আকবর। বায়ুনির মতে, যে পরিমাণে ‘প্রচুর জমি তিনি মদদ–ই–মাস, অবসর ভাতা ও ধর্মীয় অনুদান হিসাবে মানুষকে বিতরণ করে আগের সমস্ত দানকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন তাতে এটা বলতেই হবে যে ‘শেখ আবদুন নবির মতো এত প্রভাবশালী রাজপুরুষ, সদর-উস-সুদুর সে সময় কেউ ছিলেন না। আবদুন নবির বিরুদ্ধে অভিযোগ আসতে থাকায় তদন্ত হয় এবং তারপর পাঁচশো বিঘার বেশি জমি থাকা লোকজনদের দেওয়া নিষ্কর দানগুলির ব্যাপারে আকবর ব্যক্তিগতভাবে তদন্ত করে দেখার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি মূলত এইরকম দানের পরিমাণ কমিয়ে, দান। গ্রহীতাদের উৎপাদনশীল ব্যবসা ও পেশায় নিযুক্ত হয়ে আয় বাড়ানোর দিকে উৎসাহ দিতে চেয়েছিলেন।
১৫৮০ সালে যখন সুবা গঠন করে প্রত্যেক সুবায় একজন করে সদরনিযুক্ত করা হয়েছিল তখন তাদের আরও কিছু ক্ষমতা কমিয়ে দেওয়া হয়। এই সদর-দের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে সাম্রাজ্যকে ছয়টি ভাগে ভাগ করা হয় এবং প্রত্যেক ভাগে একজন করে তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করা হয়। ১৫৮৯ সালে নতুন আদেশ জারি করে সকল নিষ্কর জমিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়, যেখানে অর্ধেক জমি খেতাবি জমি হিসাবে বিবেচিত হত আর বাকি অর্ধেক জমিকে কৃষিকাজের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হত। যদি সমস্তটাই খেতাবি জমি হত তাহলে তার এক-চতুর্থাংশ নিয়ে নেওয়া হত কৃষিকার্যের জন্যে। এইভাবে নিষ্কর জমি-গ্রহীতাদেরও কৃষির সম্প্রসারণের ভাগীদার করে নেওয়া হয়েছিল।
প্রথমদিকে নিষ্কর জমি মূলত প্রদান করা হত মুসলিমদের। যদিও কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই ছিল, না হলে সে সময় বৃন্দাবনের মন্দিরগুলিকে ও জাখবারের যোগীদের জমি দান করার কথা জানা যেত না। ১৫৭৫ সালের পরে আকবর ‘নিচুতলার লোজন, বিদ্রোহী এমনকি হিন্দুদেরও জমি দান করেছিলেন (বদায়ুনি)। ১৫৮০ সালের পর অ-মুসলিমদের জমিদানের পরিমাণ আচমকা বেড়ে যায় এবং নিষ্কর জমি হিন্দু, জৈন, পারসি এমনকি ইহুদিদের উপাসনা কেন্দ্র নির্মাণের জন্য দেওয়া শুরু হয়। ভবঘুরে সন্ত ও যোগী, যাদের পার্থিব কোনো কামনা ছিল না তাদেরকেও দেওয়া আর্থিক অনুদানের সংখ্যা এ সময় বেড়ে গিয়েছিল। আকবর ফতেপুর সিক্রির বাইরে দুঃস্থ হিন্দু ও মুসলিমদের ক্ষুধা নিবারণের জন্য দুটি কেন্দ্র নির্মাণ করেছিলেন। একটি ছিল হিন্দুদের জন্য যাকে বলা হত ধর্মপুর আর অন্যটি ছিল মুসলমানদের জন্য যা খাইরপুর নামে পরিচিত ছিল। যখন যোগীরাও দলে দলে আসতে শুরু করেছিল তখন তাদের জন্য তৃতীয় একটি কেন্দ্র খোলা হয়েছিল যাকে বলা হত যোগীপুর।
এই ভাবে গোঁড়া উলেমা-দের প্রভাব স্তিমিত করে সব ধর্মবিশ্বাসের মানুষদের মধ্যে সমান ভাবে রাষ্ট্রের পরিষেবা ছড়িয়ে দেবার রাস্তা খুলে দেওয়া হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় “অনুদান প্রদানের নিয়মেও বেশ কড়াকড়ি আনা হয়েছিল ১০০ বিঘার ওপরে জমি দান করার ক্ষেত্রে অবশ্যই ভালো করে পরীক্ষা করে দেখে নেওয়া হত এবং বেশিরভাগ সময়েই তা কমিয়ে দেওয়া হত। এছাড়া সময়ে সময়ে অনুদান প্রদান প্রক্রিয়ার ওপর নজরদারি চালানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল যাতে সেখানে কোনো অনিয়ম না হয়।
আকবরের ধর্মীয় বিশ্বাসের তৃতীয় তথা চূড়ান্ত পর্যায় এবং তাঁর রাষ্ট্রনীতি (১৫৮১-১৬০৫)
আকবরের নিজস্ব ধর্মীয় ভাবনা ও বিশ্বাস এই শেষ পর্যায়ে এসে ধীরে ধীরে সংঘবদ্ধ হয়েছিল। তবে এই ব্যাপারে অনেক বিতর্ক রয়েছে। আমরা আলোচনার স্বার্থে সে বিতর্কে যাব না, তার ব্যক্তিগত বিশ্বাসের গভীরেও খুব বেশি ঢুকব না, তবে তার বিশ্বাসের যতটুকু তার নেওয়া জননীতিতে প্রতিফলিত হয়েছিল আমরা কেবল সেই দিকগুলির ওপরেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখব। আকবরের ধর্মীয় বিশ্বাসের মূল কথা ছিল। একেশ্বরবাদের ওপর আপসহীন অনুরাগ বা তৌহিক–ই–ইলাহিযা মূলত ইসলামীয় দার্শনিক ইবন-ই-আরাবির ভাবনার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। অনেক সুফি সাধকের মতো আকবরও বিশ্বাস করতেন যে সকল মানুষকে ধ্যানের মাধ্যমে পরমেশ্বরের পদতলে আনতে পারলেই হয়তো এক ঈশ্বরের চেতনা জাগরিত হবে। কেবল কোনো প্রথাগত রীতি দাসোচিত ভাবে অনুকরণ করলে (তাকলিদ) এই চেতনা জাগবে না।
আকবরের আল্লার ওপর গভীর বিশ্বাস ছিল এবং তিনি মনে করতেন যে মানুষের সকল কাজের পিছনে একটাই শক্তির হাত আর তা হল আল্লার শক্তি। সেই সঙ্গে তিনি নৈসর্গিক আলো বা নূর-কে খুব মেনে চলতেন কারণ তা একদিকে যেমন ছিল আধ্যাত্মিকতার চরম প্রকাশ তেমনি অন্যদিকে তা ছিল সূর্য ও অগ্নি থেকে উৎসারিত শক্তির প্রতীক।
আকবর কতটা হিন্দু, জৈন, জরাথুস্ট্রীয় বা খ্রিস্টান ধর্ম বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন তা নিয়ে যথেষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে। একদিকে যেমন বায়ুনি আকবরের সূর্য ও অগ্নি পূজো করা, সংস্কৃতে হাজার এক বার সূর্য নাম জপ করা, মাথায় টিকা পরা, রাখী উৎসব পালন করার অভিযোগ এনেছেন, তেমনি অন্যরা আবার বলেছেন তিনি জরাথুস্ট্রীয় প্রথা মেনে অগ্নি উপাসনা করতেন। কিছু বিশেষ দিনে তার পশুবলি রদ করার পদক্ষেপকে অনেকে জৈন প্রভাব বলে উল্লেখ করেন। তিনি পুনর্জন্মবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু হিন্দুদের মতানুসারে আত্মার এক দেহ থেকে আর-এক দেহে স্থানান্তরের ধারণা মেনে নিতে পারেননি।
তিনি কোন ভাবনার দ্বারা কতটা প্রভাবিত হয়েছিলেন তা খুঁজে বের করার চেষ্টা বৃথা–কারণ ভাবনার কোনো সীমা নেই। তাই আমাদের অনুমান করে নিতে হয়। যেমন তিনি যেভাবে আলোর প্রতি অনুরক্ত ছিলেন তাতে মনে হয় তিনি একাদশ শতকের দার্শনিক তথা সুফি সাধক আল-ঘিজালি এবং ইসরাকি ও নাকতাওইসের মতো কিছু মুসলিম সম্প্রদায়ের ভাবনার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। আমাদের বুঝতে হবে কীভাবে কোন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আকবরের মধ্যে পুরোনো ভাবনা ও ধারণাগুলো উজ্জীবিত হয়ে তার চেতনাকে একটা নতুন অর্থ বা তাৎপর্য প্রদান করেছিল, যেখানে তাঁর এই উপলব্ধি হয়েছিল যে সব ধর্মের মধ্যেই রয়েছে সত্যের উপাদান, কিন্তু তা অন্ধ বিশ্বাস, অন্ধ ভক্তি, দাসত্মাচিত অনুকরণ ও আচার সর্বস্বতার গ্রাসে তমসাবৃত। এই বিশ্বাস থেকেই তিনি নিজেকে আর কোনো ধর্মীয় গোঁড়ামি ও আচার সর্বস্বতায় জড়িয়ে ফেলেননি, আবার একই সঙ্গে সব ধর্মের প্রতি তার শ্রদ্ধারও কোনো খামতি ছিল না। এভাবেই তিনি গো-হত্যা রদ করেছিলেন এবং দশেরা বা মধ্য এশীয় প্রাচীন ঐতিহ্যের অঙ্গ নওরোজ উৎসব, এমনকি পারসিদেরও জন্যও একটি বিশেষ দিন ভক্তিভরে পালন করতেন। আবুল ফজল আইন-এ লিখেছেন যে আকবরের বিশ্বাসের স্বরূপ ছিল এইরকম : সবার সঙ্গে ভালোভাবে বোঝাপড়া গড়ে তোলা হল আমার কর্তব্য। যদি তারা আল্লার দেখানো পথে চলে তাহলে সেখানে আমার হস্তক্ষেপ করাটা আপনা থেকেই নিন্দনীয় একটা কাজ হবে; আর যদি তারা সে পথে না চলে, উপেক্ষার সুরের আবেশে ভেসে যায়, তাহলে সেখানে সাহায্য করতে এগিয়ে আসতে হবে আমাকেই।
আকবরের এই সব ধর্মের সার গ্রহণের ধারণাকে গোঁড়া মোল্লারা বিরোধিতা করে বলেছিলেন বিদত(বা ইসলাম ধর্ম বিমুখতা)। তাই বায়ুনি অভিযোগের সুরে বলেন যে, আকবর ‘পয়গম্বরের ও সন্তদের প্রেরণা, আশীর্বাদ, অলৌকিকতা ত্যাগ করেছিলেন, এমনকি সমগ্র আইনকেও (শরিয়া) ত্যাগ করতে ছাড়েননি, তাই একটা সময়ের পর তার হৃদয়ে ইসলামের সামান্য ফোঁটাও অবশিষ্ট থাকেনি। ফাদার মনসেরেটের নেতৃত্বে খ্রিস্টান মিশনারিগুলোও একই অভিযোগ এনেছিল। মনসেরেট বলেছিলেন ..কেউ জানে না তিনি কি (ধর্ম) মেনে চলেন…তবে তার কাজকর্ম দেখে মনে হয় না তিনি মুসলমান।
আকবর ইসলাম ত্যাগ করেছিলেন এই অভিযোগকে আধুনিক ঐতিহাসিকরা খুব একটা গুরুত্ব দিতে নারাজ। ইহুদিরা নিশ্চিত ছিলেন যে তারা আকবরকে খ্রিস্টান ধর্মে রূপান্তরিত করে ফেলতে পারবেন। তারা ইবাদত খানার বিতর্ক যথাযথ ভাবে না। শুনেই ইসলামের বিরোধিতা করেছিলেন এবং আকবরের উদারতাকে ভুল বুঝে সেলিমকে পালটানোর জন্য তাদের ধর্মের আচার-আচরণ পালনের প্রস্তাব দিয়ে বসেছিলেন। তাই প্রথম সারির পাকিস্তানি ঐতিহাসিক আই. এইচ. কুরেশি বলেন, ‘যেভাবে কয়েকজন ঐতিহাসিক বলেন যে তিনি (আকবর) তার অনুগামীদের ইসলাম ত্যাগ করতে বলেছিলেন তা কিন্তু সত্যি নয়, বরং তিনি তাদের সেই ধর্ম থেকে গোঁড়ামিকে ত্যাগ করতে বলেছিলেন। তবে একে কুরেশি ইসলামের পক্ষে খুব ক্ষতিকারক বলে উল্লেখ করে আকবরের রাজত্বকালকে বলেছেন ভারতে ইসলামের অন্ধকারতম সময়’, কারণ এর ফলে বাইরে থেকে অবাঞ্ছিত জিনিস এ সময় প্রবেশ করায় ইসলামীয় পরিচিতি বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। আসলে মৌলবাদের মূল সমস্যা সব সময় এটাই।
আকবর চাইতেন এমন ইসলাম যা এতটাই নমনীয় হবে যে তা দিয়ে অনায়াসে রাজনৈতিক সংকট দূর করা যাবে এবং যা মানুষের যুক্তিকে নাড়া দিয়ে যাবে’ (আবুল ফজল)। যে-কোনো সময় বিশ্বাসকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তিকে খুঁজতে যাওয়ার কাজটা খুব কঠিন। আর তার ওপর যদি বাকি সব বিশ্বাসের ওপর প্রভুত্ব কায়েম করে বসে থাকেন কোনো বিশেষ একটি ধর্মের নেতারা তাহলে সেখানে যুক্তি খোঁজার কাজটা আরও বেশি কঠিন হয়ে যায়। বায়ুনি তাই অকপটে স্বীকার করেন যে, যদি সব জায়গাতেই সত্য জ্ঞান খুঁজে পাওয়া যায় তাহলে সত্যকে কেবল একটা ধর্ম বা ইসলামের মতো অপেক্ষাকৃত নতুন সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখার কি প্রয়োজন…।’ কিন্তু এই পরিস্থিতিতে ইসলামের গুরুত্ব হারিয়ে যাবার ভয় থেকেই কোনো কোনো গোষ্ঠী এই স্লোগান দিতে চেয়েছিলেন যে ইসলাম বিপদগ্রস্ত। ইসলামের পরিচিতিকে রক্ষা করার নামে তারা সব রকম সামাজিক সংস্কারের বিরোধিতা করেছিলেন এবং এমন কিছু রীতিনীতিকে তারা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন যা হয়তো পরে গিয়ে একটা পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সমঝোতার জায়গা তৈরি করতে পারত। বস্তুত তাদের প্রতিবাদ ইসলামের পরিচিতি হারিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে ছিল না বরং ইসলামের প্রভুত্ব কমে যাওয়া এবং রাষ্ট্রে তাদের প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধেই তারা মরিয়া ভাবে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন।
দিন-ই-ইলাহি
আকবর ইসলাম ত্যাগ করেছিলেন এই অভিযোগকে প্রমাণ করার জন্যে আকবরের দরবারে থাকা ইহুদি ফাদার ও বদায়ুনি এই যুক্তি দিয়েছিলেন যে আকবর দিন-ই-ইলাহি নামে একটি নতুন ধর্ম প্রবর্তন করেছেন যা আসলে হিন্দু, খ্রিস্টান, জরাথুস্ট্রীয় প্রভৃতি একাধিক ধর্মের সমাহার এবং আকবর সেই ধর্মের প্রধান হয়ে বসতে চেয়েছেন। মনসেরেটের মতে, ‘তিনি ঈশ্বরকে উপেক্ষা করতেন ও নিজেকে ঈশ্বর বা মহান ‘পয়গম্বর’ হিসাবে দেখতে চাইতেন, এবং তিনি মানুষের মধ্যে এই বিশ্বাস জাগাতে চাইতেন যে তিনি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী, তাই তিনি নিজের পা ধোয়া জল দিয়ে মানুষের রোগ সারাতেন।’
আধুনিক গবেষকরা কিন্তু এটা মানেন না যে আকবর কোনো নতুন ধর্ম প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন। আসলে এটা সত্যি যে দিন-ই-ইলাহি’র মধ্যে কোনো যাজকতন্ত্র ছিল না, কোনো আচার-বিচার, বিশ্বাস বা কোনো ধর্মগ্রন্থও ছিল না। এমনকি আমরা জানি না যে ঠিক কবে এর প্রবর্তন করা হয়েছিল।
কদাপি ভারত ভ্রমণে না আসা এক যাজক বারততালির মতে, আকবর ১৫৮২ সালে তাঁর নতুন ধর্ম ঘোষণা করার জন্য একটি সাধারণ সভার আহ্বান করেছিলেন এবং সেখানে একজন বড় মাপের শেখকে পাঠিয়ে এই নির্দেশ দিয়েছিলেন যে খুব দ্রুত যেন একটি (ধর্মীয়) আইন তৈরি করে তা রাজদরবার থেকে সাম্রাজ্যের সর্বত্র প্রচার করা হয়। কিন্তু এই ধরনের কোনো নির্দেশনামা আজ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায় না।
নতুন ধর্ম ও তার দশ রকম আদর্শের কথার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। শাহজাহানের আমলের শেষের দিকে মুহসিন ফানির লেখা দাবিস্তান–ই–মাজাহিদ গ্রন্থে। যে আদর্শগুলোর কথা সেখানে উল্লেখিত আছে সেগুলি খুবই সাধারণ। যেমন উদারতা ও দয়া, পাপের প্রতি ঘৃণা, জাগতিক কামনা ত্যাগ, ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে আত্মার শুদ্ধিকরণ ইত্যাদি।
আবুল ফজল দিন–ই–ইলাহি কথাটি ব্যবহার করেননি, পরিবর্তে তিনি ব্যবহার করেছেন তৌহিদ–ই–ইলাহি কথাটি, যার অর্থ হল ঐশ্বরিক একেশ্বরবাদ। বদায়ুনি আবার দুটো কথাই ব্যবহার করেছেন। আবুল ফজল একে আকবরের জনগণের আধ্যাত্মিক পথনির্দেশক হবার ধারণার সঙ্গে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন। দিন–ই ইলাহি-র কথা তিনি আইন-এর একটি অধ্যায়ে আলোচনা করেছিলেন যাকে ব্লকম্যান। ভুলভাবে অনুবাদ করে বলেছিলেন ঐশ্বরিক বিশ্বাসের অধ্যাদেশসমূহ। আবুল ফজল বলেছেন মানুষের মধ্যে দুই ধরনের প্রবণতা কাজ করে, এক শ্রেণির মানুষ ধর্মের (দিন) পথে পা বাড়ায় আর এক দল মানুষ জাগতিক বিশ্বাসে (দুনিয়া) আসক্ত হয়ে পড়ে। তাই এই দুই প্রবণতার মাঝে এমন একটা রাস্তা বার করা দরকার যেখানে সবাই ঈশ্বরের আশিস লাভ করতে পারে। যদিও কিছু ধর্মোন্মাদ যারা মানুষের মতো দেখতে হলেও আসলে রক্তের পিপাসু তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যে কেউ যাতে প্রকাশ্যে তার জ্ঞানের ছটা ছড়িয়ে দিতে পারে সেই সাহস জাগিয়ে তুলতে হবে, হয়তো তা প্রথমে ধর্মবিরুদ্ধ ও নাস্তিক ভাবনা বলে মনে হবে, এমনকি কেউ কেউ তাকে হত্যা করার উদ্দেশ্য নিয়েও ছুটে আসতে পারে, কিন্তু তাতে ভয় পেলে চলবে না। তিনি বলেন যে এই পরিস্থিতিতে মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই তাদের রাজার সহায় হবে এই ভেবে যে রাজার অনেক উচ্চ ক্ষমতা রয়েছে এবং রাজা তাদের এই আধ্যাত্মিকতার পথে সঠিক ভাবে চলার জন্যে আলো দেখাবেন। আবুল ফজল বলেন। যে আকবর নাকি ঠিক এই কাজ করার জন্যেই জন্মেছিলেন, কিন্তু সেই কাজে হাত দেবার আগে কিছু সময়ের জন্যে তিনি ছিলেন পর্দার আড়ালে। কিন্তু প্রশ্ন হল আকবরের এই আধ্যাত্মিক নেতৃত্বের চরিত্রটা কেমন ছিল? সাধারণ ছিল না কি বিশেষ কোনো চরিত্র ছিল তার? এর উত্তরে আবুল ফজল আকবরের যে দুটো উক্তি উদ্ধৃত করেছেন তা তুলে দেওয়া হল: ‘নেতৃত্ব দানের অর্থ হল পথ দেখানো, শিষ্য জড়ো করা নয়…।’শিষ্য তৈরি করতে গেলে তাদের পরমেশ্বরের সেবায় নিয়োজিত হবার নির্দেশ দিতে হয়, ব্যক্তিগত চাকরে পরিণত করতে হয় না।
মনে হয় এই দুই উক্তির মধ্য দিয়ে আকবরের আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব দানের দাবির প্রকৃত যথার্থতা প্রকাশ পেয়েছিল। সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের যে চারটি ধাপ সে সময় প্রচলিত ছিল সেগুলিকেও দিন–ই–ইলাহি-র সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়েছিল, আর তার সর্বপ্রথম দৃষ্টান্ত মেলে ১৫৮০ সালে বায়ুনির রচনায়। এই চারটি ধাপ ছিল সম্রাটের সম্পত্তি, জীবন, সম্মান ও ধর্ম রক্ষার জন্যে নিজেকে উৎসর্গ করে দেওয়া। যিনি এই চার ধাপে নিজেকে সম্রাটের জন্যে উৎসর্গ করে দিতেন তিনি চারটি পদের অধিকারী হতেন আর যিনি এর মধ্যে যে-কোনো একটি ধাপে নিজেকে সম্রাটের প্রতি উৎসর্গ করতেন তিনি একটি পদ লাভ করতেন।
এই চার ধাপের আনুগত্যের মধ্যে কোনো অভিনবত্ব ছিল না। অনেক সুফি গুরুই তাদের শিষ্যদের এই চার প্রকার আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য বলতেন। এখানে চারটি ধাপের মধ্যে একটি ধর্মের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার অর্থ ছিল সকল প্রকার প্রথাগত ও অনুকরণীয় ধর্মীয় আচার বিচার ত্যাগ করা যা সুলহ-ই-কুল নীতির সঙ্গে একেবারে খাপ খেয়ে যায়। মনে হয় আকবর এই চার ধাপে অনুগতদের নির্বাচন করার ক্ষেত্রে বেশ সাবধানী ছিলেন, আইন-কে ইংরাজিতে অনুবাদকারী ব্লকম্যান উল্লেখ করেছেন যে ১৮ জন ব্যক্তি এই ধর্ম গ্রহণের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন যার মধ্যে একমাত্র হিন্দু ছিলেন বীরবল। বলা হয়ে থাকে যে ১৫৮২ সালে নতুন ধর্মকে প্রবর্তন করার জন্য একটি সভার আয়োজন করা হয়েছিল এবং সেখানে আকবর মান সিংহকে নাকি অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। মান সিংহ নাকি আমন্ত্রণের প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন যদি আনুগত্যের অর্থ একজনের জীবনকে কারো জন্য উৎসর্গ করে দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ হয় তাহলে তিনি ইতিমধ্যেই তার জীবন আকবরের হাতে তুলে দিয়েছেন। কিন্তু এই ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য আমাদের আরও প্রমাণের প্রয়োজন। কারণ বলা হয় যে মান সিংহ নাকি আরও বলেছিলেন ‘যদি এর আর-এক অর্থ এই হয় যে নিজের বিশ্বাসকেও আনুগত্যের নামে জলাঞ্জলি দিতে হবে তাহলে। যেহেতু আমি একজন হিন্দু তাই আমায় আনুগত্য প্রদর্শন করতে বললে আমাকে মুসলিম হয়ে যেতে হবে। আর আমি জানি এই দুই রাস্তা ছাড়া আর কোনো রাস্তা (ধর্ম) খোলা নেই আমার কাছে। শোনা যায় এর পর নাকি ব্যাপারটা এখানেই থেকে যায় এবং আকবর মান সিংহকে আর কোনো প্রশ্ন করেন নি।
মান সিংহের এই উত্তর বুঝিয়ে দেয় যে মানুষের মনে এই আনুগত্যের চার ধাপের। মধ্যে ধর্মীয় একটা ভয় কোথাও-না-কোথাও কাজ করেছিল। কিন্তু আকবর এই ভেবে আনুগত্যের কথা বলতে চাননি, তিনি এই চার ধাপে আনুগত্যের মধ্য দিয়ে উচ্চ মর্যাদা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন।
আসলে সেই সময় সাম্রাজ্য ও প্রশাসনের প্রসারের সঙ্গে রাজনৈতিক ও সামরিক প্রয়োজনগুলোকে ঠিকঠাক ভাবে সামলানোর জন্য দক্ষ, সৎ ও ন্যায়পরায়ণ উচ্চপদস্থ আধিকারিকের অভাব ব্যাপক ভাবে অনুভূত হচ্ছিল। আধুনিক ঐতিহাসিক এস. এ. এ. রিজভির মতে, ‘আনুগত্যের চার ধাপ মুঘল রাজমুকুটের ছত্রছায়ায় নতুন মুঘল অভিজাত শ্রেণিকে একত্রিত করার ক্ষেত্রে আদর্শগত শক্তি হিসাবে কাজ করেছিল।
মনে হয় সকল সভাসদ ও হাজার হাজার বিশ্বস্ত আধিকারিক ‘আনুগত্যের শৃঙ্খল’কে মনে করত পরিতৃপ্তির ফঁস। শোনা যায় যে প্রত্যেক মাসের রবিবার দিনটা এই আনুগত্য আদায়ের সূচনার জন্য নির্ধারিত থাকত এবং অনুগতদের বারো জন করে দলে নথিভুক্ত করা হত। অনুগত তার পাগড়ি হাতে নিয়ে সম্রাটের পদতলে মাথা ঠেকাতেন যা আসলে ছিল তার অহংকার ও স্বার্থপরতাকে সম্রাটের পায়ের নিচে পরিত্যাগ করার প্রতীক। সম্রাট তাকে ধরে তুলতেন এবং একটি শর্ত দিতেন যাতে আল্লার নাম ও আকবরের প্রিয় আদর্শবাণী: ‘আল্লা-হো-আকবর’ (অর্থাৎ আল্লা মহান) লেখা থাকত। সবাই একে অপরকে ‘আল্লা-ও-আকবর’ ও ‘জল জালালু’ বলে সম্বোধন করতেন, তাদের জন্ম মাসে তারা যতটা পারত মাংস ভক্ষণ থেকে নিজেদের বিরত রাখতেন এবং জন্মদিনে সুস্বাদু ভোজের আয়োজন করতেন ও ভিক্ষা দান করতেন।
এটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ যে আকবর ঠিক সেই সময়ে (১৫৮০ সাল নাগাদ) পর্দা সরিয়ে বেরিয়ে এসে অনুগতদের অভিবাদন গ্রহণ করতে শুরু করেছিলেন যে সময়টায় তিনি একের-পর-এক বিদ্রোহ ও গোঁড়া উলেমা–দের কার্যকলাপের ফলে বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর ভাই মির্জা হাকিমও এই সময় পাঞ্জাবের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। এছাড়া এটা ছিল সেই সময় যখন মধ্য এশিয়ায় উজবেক শক্তি ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল। এই পরিস্থিতিতে আকবর ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক দিকে থেকে কোনোরকম বিবাদ চাননি এবং অভিজাতদের কাছ থেকে পূর্ণ আনুগত্য ও বিশ্বাস আশা করেছিলেন।
আধুনিক গবেষক জে. এফ. রিচার্ড বলেছেন, বহুধাবিভক্ত অভিজাততন্ত্রকে এক জায়গায় নিয়ে এসে তাদের সাম্রাজ্যের পদতলে বেঁধে রাখার চরম কার্যকরী পন্থা ছিল এই আনুগত্য প্রদর্শনের প্রথা। রাজপুরুষ ও দরবারের উচ্চ মর্যাদাপূর্ণ সভাসদরা সকলেই সম্রাটের মুরিদ (শিষ্য) হিসাবে বিবেচিত হতেন, এমনকি আকবরের উত্তরসূরিদের আমলেও এই প্রথা অব্যাহত ছিল এবং তারা সম্রাটের পবিত্র হৃদয়ের মধ্য থেকে নির্গত অভিভাবকত্বের ছায়ায় নিজেদের উৎসর্গ করে দিতে সদা প্রস্তুত থাকতেন।
ভিনসেন্ট স্মিথ যেভাবে তৌহিদ-ই-ইলাহিকে ‘আকবরের মূর্খামির কীর্তিস্তম্ভ’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন তা আসলে ঠিক নয়। যদিও বহু তোষামোদকারী ও সুযোগসন্ধানী লোক নিজের আখের গোছাতে এই আনুগত্যের পরাকাষ্ঠা পরেছিলেন ঠিকই, কিন্তু এটা সত্যি যে আকবর মুঘল সিংহাসনের প্রতি নিবেদিত কিছু মানুষকে গড়ে নেবার যে ঐতিহ্য স্থাপন করেছিলেন তা তাঁর অবর্তমানে তাঁর উত্তরসূরিদের আমলে রীতিমতো একটা ধারায় পরিণত হয়েছিল।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে তৌহিদ-ই-ইলাহি মূলত ছিল একটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ। আকবর তার মতো করে একটি নতুন রাষ্ট্রের শৈলী তৈরি করতে চেষ্টা করেছিলেন যার মর্মার্থ অনুধাবন করা কোনো খ্রিস্টান ফাদার কিংবা বদায়ুনির মতো সংকীর্ণমনা গোঁড়া মোল্লার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই তারা তৌহিদ-ই-ইলাহিকে একটি ধর্মীয় উদ্যোগ হিসাবে দেখেছেন এবং আকবরকে স্বধর্ম ত্যাগী রূপে তুলে ধরে উদারনীতি, সুবিচার ও সকল বিশ্বাসের প্রতি সমান আচরণের ওপর নির্ভরশীল একটি নতুন রাষ্ট্রনীতির যন্ত্রণাদায়ক উত্থানকে উপেক্ষা করে গিয়েছেন।
প্রশ্ন জাগে–কেন আকবরকে তাঁর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য এই ধর্মীয়-আধ্যাত্মিক রূপ ও পদক্ষেপের সাহায্য নিতে হয়েছিল? এসব করে তিনি যে কেবল জটিলতা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তাই নয়, এমন একটি নজির গড়েছিলেন যা পরবর্তীকালে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রনীতি পরিগ্রহ করার ক্ষেত্রে রীতিমতো ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছিল। তাই হয়তো জাহাঙ্গিরের আমলে কয়েকজন অভিজাত নিজেদের সম্রাটের কাছে আনুগত্য প্রদর্শন করে মুরিদ বা বান্দা (দাস) হয়ে থাকাকে অত্যন্ত সম্মানের বলে মনে করলেও সম্রাটের তরফ থেকে শস্ত বা আনুগত্যের স্বীকৃতিপত্র প্রদানের প্রথাকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছিল।
এই প্রক্রিয়ায় উদ্যোগটা যদিও ছিল মূলত যতটা পারা যায় প্রজাদের মধ্য থেকে আনুগত্য ও বিশ্বাস আদায় করা, তবুও আকবর সাধারণ মানুষের ভালোবাসাকে কখনো অশ্রদ্ধা করেননি। তাই আবুল ফজল লিখেছেন যে আকবর প্রত্যেক দিন সাধারণ মানুষের আনা জলের পেয়ালায় ফুঁ দিতেন। এই ভাবে বহু আশা ছেড়ে দেওয়া অসুস্থ মানুষের মনে এই বিশ্বাস জাগত যে সর্বশক্তিমান চিকিৎসক যখন জলে ফুঁ দিয়ে বলে দিয়েছেন রোগ সেরে যাবে, তখন শরীর ভালো হয়ে যাবেই।
যদিও আকবর অলৌকিকতার বিরোধী ছিলেন এবং এগুলোকে এক প্রকার মানসিক উচ্ছ্বাসের বহিঃপ্রকাশ’ বলে মনে করতেন, তবু যখন প্রয়োজন হত তিনি সেগুলো মানুষের বিশ্বাস আদায়ের জন্য ব্যবহার করতে ছাড়তেন না।
সামাজিক সংস্কার ও সমন্বয়ের পথে যাত্রা
সার্বজনীন শান্তি ও সূবিচারের ওপর ভিত্তি করে একটি রাষ্ট্র গড়ে তোলার ডাক দেওয়ার পাশাপাশি আকবর প্রজাদের বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে যথাযথ বোঝাপড়া গড়ে তোলার দিকেও বিশেষ নজর দিয়েছিলেন। তাই তিনি একটি পৃথক অনুবাদ দফতর প্রতিষ্ঠা করে সংস্কৃত, আরবি, গ্রিক প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থের ফারসি ভাষায় অনুবাদ করার ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই উদ্দেশ্যে দক্ষ পণ্ডিতদের একটি গোষ্ঠী নিয়োগ করা হয়েছিল। ধর্মগ্রন্থ ছাড়াও বিভিন্ন ভাষার গল্প, উপাখ্যান, নীতিকথাও অনুবাদ করা হয়েছিল যার মধ্যে ছিল সিংহাসন বত্তিশি-র মতো উপাখ্যান, নল দমন (নল দময়ন্তী)-র মতো কাব্যনাট্য, পঞ্চতন্ত্র-র মতো নীতিকথামালা এবং ধর্মীয় গ্রন্থের মধ্যে ছিল অথর্ব বেদ, মহাভারত, রামায়ণ ও গীতা। এই সমস্ত গ্রন্থকে ফারসি ভাষায়। অনুবাদ করার পশ্চাতে আকবরের দ্বিতীয় যে উদ্দেশ্যটা ছিল তা বলতে গিয়ে আবুল ফজল তার লেখা মহাভারত-এর অনুবাদের মুখবন্ধে বলেছেন, আসলে এর মাধ্যমে অন্ধ অনুসরণের প্রাচীর ভেঙে ধর্মীয় বিষয়ে নতুন করে অনুসন্ধান ও গবেষণার ক্ষেত্র গড়ে তোলার একটা চেষ্টা করা হয়েছিল। এই ভাবে আকবরের হাত ধরে সপ্তদশ শতক জুড়ে একটা ঐতিহ্য বিকশিত হয়েছিল। তবে আবুল ফজল লক্ষ করেছিলেন মূলত হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে অন্য ধর্মের গ্রন্থ নিয়ে কাজ করার ব্যাপারে বেশ অনীহা ছিল। শুধু গোঁড়া মুসলিম উলেমারাই নন, বহু হিন্দু ধর্মগুরুর মধ্যে তিনি উপেক্ষা, বৈষম্য এবং নিজ ধর্মের প্রতি অন্ধ ভক্তির লক্ষণ দেখেছিলেন। যার ফলে ধর্মীয় সমন্বয়ের পথ অনুসন্ধানের উদ্যোগ ব্যাহত হয়েছিল। কিছুটা।
হিন্দুদের ধর্মীয় গ্রন্থ ছাড়াও খ্রিস্টান বাণীগুলোকে ফারসি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল। এই প্রথম বোধ হয় এই ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।
এসব ছাড়া ইতিহাস, জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিতশাস্ত্রের ওপর লেখা নানা গ্রন্থও অনুবাদ করার কাজ শুরু করা হয়েছিল। আর এই সূত্র ধরে কলহনের কাশ্মীরের ইতিহাস রাজতরঙ্গিনী ও ভাস্করাচার্যের গণিতশাস্ত্রের ওপর লেখা গ্রন্থ লীলাবতী ফারসি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল।
আকবরের একাধিক উদ্যোগ যেগুলিকে বায়ুনি নতুন অথচ উদ্ভট’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন, সেগুলি আসলে নৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত ব্যবস্থায় যথেষ্ট সংস্কারমূলক পদক্ষেপ বলা যেতেই পারে। যেমন মদ্যপানকে তখনই স্বীকৃতি দেওয়া হত যখন তা চিকিৎসকের অনুমোদন সাপেক্ষে কেবল শারীরিক ক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাজে লাগত, বেশ্যাবৃত্তিকে কড়া ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হত এবং অনৈতিক ভাবে নারী ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আকবর একটি অধ্যাদেশ জারি করে ঘোষণা করেছিলেন। যে কেউ যেন একটার বেশি বিবাহ না করে, তবে যদি প্রথম স্ত্রীর কোনো সন্তান না হয় তাহলে একাদিক বিবাহ করা যেতে পারে। বিধবা বিবাহকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল এবং বিবাহের জন্য পুরুষদের বয়স ধার্য করা হয়েছিল ন্যূনতম ষোলো বছর ও মহিলাদের ন্যূনতম চোদ্দো বছর। মাসতুতো, পিসতুতো, মামাতো ও দূর সম্পর্কের ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। কেবল পিতামাতার সম্মতির ভিত্তিতেই বিবাহ সম্পন্ন করার আদেশ দেওয়া হয়েছিল। বিবাহ নথিভুক্তি করার জন্য আকবর একটি দফতরও নাকি চালু করেছিলেন। তাছাড়া হিন্দু মহিলাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সতী হওয়াকে রাষ্ট্র সে সময় মান্যতা দিত না বলে জানা যায়।
এই সমস্ত উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ছিল প্রগতিশীল, কিন্তু সেগুলি কতটা বাস্তবে রূপায়িত হত সে সম্পর্কে কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। আকবরের নেওয়া আর-একটি ভালো উদ্যোগ ছিল দাস কেনাবেচা রদ করা। তিনি দাসবৃত্তিও নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন, তবে তা মুঘল রাজপ্রাসাদ ও অভিজাতদের গৃহস্থালিতে কতটা কার্যকর হয়েছিল সে নিয়ে সন্দেহ আছে।
আকবর যেসব আদেশনামা জারি করেছিলেন তার বেশিরভাগই দাঁড়িয়ে ছিল তার সর্বধর্ম বিশ্বাসের স্বাধীনতা ও যুক্তি-নির্ভর নয় এমন অন্ধ ধর্মীয় ধারণার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার প্রেরণার ওপর। তাই যদি কোনো হিন্দুকে জোর করে ইসলামে ধর্মান্তরিত করার পর তিনি নিজ ধর্মে ফিরে যেতে চাইতেন, তাহলে তা মঞ্জুর করা হত। হিন্দু মন্দির, খ্রিস্টান গির্জা বা ইহুদিদের ধর্মস্থান নির্মাণে কোনোরকম বাধা দেওয়া হত না। এই দেখে বদায়ুনি অভিযোগ করে বলেছিলেন আকবর নাকি মসজিদ ও প্রার্থনা কক্ষগুলোকে গুদাম ঘরে পরিণত করেছিলেন, শুক্রবার ছাড়া অন্য দিন আজান (প্রার্থনা) নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন এবং হজ যাত্রাও রদ করে দিয়েছিলেন। এসব। আসলে একজন ঐতিহাসিকের আকবরের প্রতি অতি বৈরিতার কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। বায়ুনি আরও বলেছেন, ‘পাশা খেলা ও তাতে উৎসাহ দেখানো থেকে শুরু করে সব কিছু করা হয়েছিল যা একেবারে ইসলাম বিরোধী।’ গোঁড়া মোল্লা বায়ুনি আকবরের আর যা যা কাজের বিরোধিতা করেছিলেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল আকবরের দাড়ি কাটা ও রঙ্গালয়ে যাওয়া। যদিও আকবর বারো বছরের কমবয়সি ছেলেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে খৎনা করা, এমনকি সমাধির সময় কোনদিকে শবদেহ রাখা হবে সেই নিয়ে হাজারো নিয়ম পালন নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন, তবুও বলতেই হবে এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা এক প্রকার বিড়ম্বনার সৃষ্টি করেছিল এবং তা কার্যকর করা কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
আকবর শিক্ষাক্ষেত্রে পাঠক্রমের আমূল পরিবর্তন এনে অনেক বেশি নৈতিক শিক্ষা প্রদানের ওপর জোর দিয়েছিলেন এবং গণিত, কৃষিবিদ্যা, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিদ্যা, রাষ্ট্র শাসনের নিয়ম, যুক্তিবিদ্যা, ইতিহাস প্রভৃতি ধর্মনিরপেক্ষ বিষয় পাঠক্রমে যুক্ত করেছিলেন। বলা বাহুল্য যে, বায়ুনি ছাড়া আর কেই-বা এই উদ্যোগকে আরবি শিক্ষার বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক পদক্ষেপ এবং কোরান, হাদিস প্রভৃতির মতো ধর্মীয় শিক্ষা বিরোধী কর্মসূচি বলে কটাক্ষ করবেন!
এছাড়া আকবর শিল্পী, কবি, চিত্রকর, সঙ্গীতজ্ঞ প্রমুখদের যথেষ্ট উৎসাহ দিতেন, আর এভাবেই তিনি তাঁর রাজসভাকে শিল্প ও সংস্কৃতির উৎকৃষ্ট পীঠস্থানে পরিণত করেছিলেন।
মুঘল রাষ্ট্র যেখানে আকবরের নেতৃত্বে ধর্মীয় ও রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষ ও উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রেখে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের পরিবেশ গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়েছিল সেখানে সমাজ কিন্তু তখনও ছিল নানান সম্প্রদায়ে বিভক্ত এবং গোঁড়া ঐতিহ্যের বেড়াজালে গভীরভাবে আবিষ্ট। তাই আকররের উত্তরসূরিদের এই দুই প্রবণতার মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে গিয়ে কালঘাম ছুটে গিয়েছিল।