সপ্তম পর্ব
অ্যালসিনোয়াসের প্রাসাদ
পথপার্শ্বস্ত সেই উদ্যানবাটিকার মধ্যে একটি নির্জন কুঞ্জবনে বসে ওডিসিয়াস যখন প্রার্থনা করছিলেন দেবী এথেনের কাছে, তখন নৌসিকার ঘোড়ার গাড়িটি উপনীত হলো প্রাসাদদ্বারে। সঙ্গে সঙ্গে তার ভাইরা গাড়ি থামিয়ে অশ্বগুলোকে গাড়ি থেকে বিযুক্ত করে পোশাকগুলো সব নামিয়ে নিল।
সোজা তার নিজের ঘরে চলে গেল নৌসিকা। তার খাস দাসী ইউরিমেদুসা তার ঘরের চুল্লীতে কাঠ দিয়ে ঘরটিকে গরম করে রেখেছিল তার জন্য। ইউরিমেদুসা যেমন বুদ্ধিমতী তেমনি বিচক্ষণ। দূর অ্যাপারিয়া থেকে তাকে জাহাজে করে রাজপ্রাসাদের দাসী হিসেবে রাখা হয়। নৌসিকার জন্মের পর থেকে তার দেখাশোনা করত ইউরিমেদুসা। নৌসিকা ঘরে ঢোকার পর তার নৈশভোজনের ব্যবস্থা করল ইউরিমেদুসা। ইতিমধ্যে প্রার্থনা শেষ করে নগরের মধ্যে হাঁটতে শুরু করে দিয়েছে ওডিসিয়াস। এমন সময় দেবী এথেন তাঁকে কুয়াশার দ্বারা আচ্ছন্ন করে এমনভাবে অপরিদৃশ্য করে তুললেন যাতে তাঁকে অপমান করতে না পারে পথে দেখা হলে। নগরদ্বারে প্রবেশের একটু আগে দেবী এথেন কলসী কাখে একটি বালিকার ছদ্মবেশে তাঁর সামনে আবির্ভূত হলেন।
তাঁকে দেখে ওডিসিয়াস বললেন, হে বৎসে, দয়া করে আমায় অ্যালসিনোয়াসের প্রাসাদটি দেখিয়ে দাও। দেখতে পাচ্ছ আমি একজন বিদেশী, দূর দেশ থেকে বহু কষ্ট ভোগ করে আসছি। এখানকার কোন মানুষ বা পথঘাট কিছুই চিনি না আমি।
বালিকাটি তখন বলল, মহাশয়, আমি আপনাকে সানন্দে তা দেখিয়ে দেব, কারণ সে প্রাসাদ আমার পিতার বাড়ির পাশেই অবস্থিত। কিন্তু আপনি যখন আমার পিছু পিছু আসবেন তখন কোনদিকে তাকাবেন না বা কাউকে কিছু প্রশ্ন করবেন না, কারণ ফ্যাকেসিয়াবাসীরা বিদেশীদের সম্মান করে না। তারা শুধু দূর সমুদ্রে জাহাজ ভাসিয়ে পাড়ি দিতে পারে। পসেডনের আশীর্বাদধন্য বলে নাবিক হিসেবে তারা খুবই সুদক্ষ এবং তাদের জাহাজগুলো বাতাস ও চিন্তার মত দ্রুতগতি।
এই বলে সেই বালিকাবেশিনী প্যালাস এথেন দ্রুতগতিতে আগে আগে চললেন আর ওডিসিয়াস তাকে অনুসরণ করতে লাগলেন। এথেনের কৃপায় ওডিসিয়াসের দেহটি এমন এক ইন্দ্রজালিক কুয়াশায় আচ্ছন্ন ছিল যাতে তিনি সুদক্ষ নাকি ফ্যাকসিয়াবাসীদের পাশ দিয়ে চলে গেলেও তারা দেখতে পেল না তাঁকে। যাবার পরে বড়বড় জাহাজে পরিপূর্ণ সুন্দর বন্দরগুলো দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন তিনি।
তাঁরা প্রাসাদে উপনীত হলে এথেন ওডিসিয়াসের দিকে ফিরে বললেন, যার কথা আপনি বলেছিলেন এটি হলো সেই প্রাসাদ। এখানে উচ্চবংশজাত রাজন্যবর্গ ভোজসভায় যোগদান করেন। কিন্তু আপনি কাউকে কোন কথা জিজ্ঞাসা না করে সোজা রাণীর কাছে চলে যাবেন। সাহসী বীরপুরুষেরা ঘরের বাইরে সমান সাহসের পরিচয় দেয়। রাণীর নাম হলো এ্যারিতে। তিনিও রাজা অ্যাসিনোয়াসের বংশ হতে উদ্ভূত এই বংশের প্রথম রাজা নৌসিথোয়াস পসেডনের ঔরসে ও সেকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরী পেরিবীয়ার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। পেরিবিয়া ছিলেন রাজা ইউরিমীডনের কনিষ্ঠা কন্যা।
ইউরিমীডন ছিলেন উদ্ধত দৈত্যকুলের অধিপতি এবং সমগ্র দৈত্যকুলসহ অকালে ধ্বংসপ্রাপ্ত হন। কালক্রমে পসেডন সুন্দরী পেরিবীয়াকে বিবাহ করেন এবং তাঁর গর্ভে বীর নৌসিথোয়াস নামে এক পুত্রের জন্ম দান করেন। এই নৌসিথোয়াসই ছিলেন ফ্যাকেসিয়া জাতির প্রথম রাজা। নৌসিথোয়াসের ছিল দুই পুত্র, একজির ও অ্যালসিনোয়াস। একজিনর দীর্ঘকাল বিবাহিত জীবনযাপন করে যেতে পারেন নি, কারণ অকালে অ্যাপোলোর শরে নিহত হতে হয় তাকে। তার কোন পুত্রসন্তান ছিল না, ছিল শুধু একটি কন্যা। সেই কন্যার নামই এ্যারিতে। অ্যালসিনোয়াস তাঁকে বিবাহ করেন। তিনি তাঁর স্ত্রীকে এমনভাবে শ্রদ্ধা করেন, যে শ্রদ্ধা আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে কোথাও কোন স্ত্রী তার স্বামীর কাছ থেকে পায় নি। সুদূর অতীত হতে আজ পর্যন্ত রাজা অ্যালসিনোয়াস ও তার সন্তানদের কাছ থেকে সমানে আন্তরিক ভক্তি ও শ্রদ্ধা লাভ করে আসছেন রাণী এ্যারিতে, তিনি যখন নগরপথ অতিক্রম করেন তখন রাজ্যের প্রজারা তাঁকে দেবীর মত জ্ঞান করে নিবিড় শ্রদ্ধার সঙ্গে মাথা নত করে। তিনি শুধু রাজ্যের রাণী নন, তিনি একজন বুদ্ধিমতী ও বিচক্ষণ মহিলাও বটে। অনেক সময় তিনি অনেক বিচারকার্যের সমাধান করেন। অনেক বিবাদ বিসম্বাদের মীমাংসা করে দেন। যদি তুমি একবার তাঁর সহানুভূতি আকর্ষণ করতে পার তাহলে সহজেই তুমি তোমার দেশে ফিরে যেতে পারবে।
তার কথা শেষ করে এথেন স্কেরি দেশ ত্যাগ করে সমুদ্র পার হয়ে ম্যারাথন ও এথেন্স নগরীতে চলে গেলেন। সেখানে গিয়ে তিনি রাজা এরেকথিয়াসের প্রাসাদে উপস্থিত হলেন।
ইতিমধ্যে অ্যালসিনোয়াসের সুরম্য প্রাসাদে গিয়ে উপস্থিত হলেন ওডিসিয়াস। অনেক দুশ্চিন্তা মনের মনে ভিড় করে আসছিল। ব্রোঞ্জ ধাতু দিয়ে বাঁধানো উঠোনে পা দিতে ইতস্তত করছিলেন তিনি। সূর্য বা চন্দ্রকিরণসন্নিভ এক আলোর উজ্জ্বলতা আলোকিত করে রেখেছিল প্রাসাদ মধ্যস্থিত সুপ্রশস্ত কক্ষগুলোকে। সমস্ত কক্ষগুলোর দেওয়াল ছিল ব্রোঞ্জনির্মিত আর তাদের ছাদে ছিল এনামেলের টালি। প্রত্যেকটি ঘরের দরজার কপাটগুলো ছিল স্বর্ণনির্মিত। ঘরের দুপাশে অমর অক্ষয় প্রহরীরূপে বিরাজ করছিল দেবশিল্পী হিফাস্টনির্মিত স্বর্ণ ও রৌপ্যনির্মিত কুকুর। সূচীশিল্প খচিত ঝালর দিয়ে ঢাকা অসংখ্য মোর পাতা ছিল প্রতিটি ঘরের চারদিকের দেওয়ালের ধারে ধারে। ফ্যাকেসিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের দলপতি ও পারিষদরা এই সব ঘরে ভোজসভায় যোগদান করতেন। এই সব ঘরের মাঝে মাঝে অবস্থিত স্তম্ভের উপর বলিষ্ঠ যুবকেরা সুবর্ণ নির্মিত প্রতিমূর্তি জ্বলন্ত মশাল হাতে রাত্রিকালে আলো দান করত।
প্রাসাদের মধ্যে সব সময় কর্মনিযুক্ত ছিল পঞ্চাশটি দাসী। কেউ কেউ শস্য চূর্ণ করত, কেউ কেউ চরকায় সুতো কাটতে ও সূচীশিল্পের কাজ করত। ফ্যাকেসিয়ার পুরুষরা যেমন নৌকার্যে সুদক্ষ ছিল তেমনি সেখানকার নারীরা তন্তু ও সূচীশিল্পের কাজে ছিল অতুলনীয়া। তাদের শিল্পকর্মে যেমন ছিল সূক্ষ্মতা ও সৌন্দর্যের ছাপ তেমনি ছিল বুদ্ধির পারিপাট্য। প্রাসাদ প্রাঙ্গণের বাইরে থেকে তোরণদ্বার পর্যন্ত বিস্তৃত এই বিস্তীর্ণ উদ্যান। চিরসবুজ সে উদ্যান ছিল আঙ্গুর, ডালিম, আপেল, ডুমুর ও অলিভ গাছে ভরা। কী শীত, কী গ্রীষ্ম কখনো ফল ঝরে না সেসব গাছ থেকে, সে উদ্যানে ফলের কখনো অভাব হয় না। পশ্চিমা বায়ুর অশেষ আনুকূল্য হতে কখনই বঞ্চিত হয় না এখানকার ফলের গাছগুলো। এই বাগানের প্রাপ্ত সংলগ্ন একটি আঙ্গুরের ক্ষেতে থোকা থোকা নীলচে আঙ্গুর ঝুলছিল। অনেক পাকা আঙ্গুর রোদে শুকনো হচ্ছিল। সবুজ শাকসজীও অনেক শোভা পাচ্ছিল। বাগানের দুদিক দিয়ে দুটি ঝর্না বয়ে গিয়ে প্রাসাদের ভিতর পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। দেবতাদের দ্বারা সজ্জিত অ্যালসিলোয়াসের প্রাসাদ ছিল এমনই মনোরম।
এই মনোরম প্রাসাদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ধরে এ দৃশ্য দেখলেন ওডিসিয়াস। সে দৃশ্যসৌন্দর্য কিছুক্ষণ উপভোগ করার পর প্রাসাদে প্রবেশ করে ওডিসিয়াস দেখলেন রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের দলপতিরা মদের অঞ্জলি দান করছে। কিন্তু কোথাও না দাঁড়িয়ে দরবার কক্ষ পার হয়ে ওডিসিয়াস চলে গেলেন রাজা ও রাণীর কাছে। এথেনের দ্বারা সৃষ্ট এক ঐন্দ্রজালিক কুয়াশার দ্বারা তাঁর দেহ আচ্ছন্ন ছিল বলে কেউ তাঁকে দেখতে পেল না। তিনি সরাসরি রাণীর কাছে গিয়ে তার পা দুটো জড়িয়ে ধরলেন। সঙ্গে সঙ্গে সেই ঐন্দ্রজালিক কুয়াশাটা অপসৃত হয়ে গেল তাঁর দেহ থেকে। তখন সেই ভোজসভায় উপস্থিত সকলে এই আগন্তুকের পানে তাকিয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এবার ওডিসিয়াস তার আবেদন জানাতে লাগলেন, হে একজিরকন্যা এ্যারিতে ভাগ্যবিড়ম্বিত অসহায় এক মানুষরূপে আজ আমি আপনাদের শরণাগত হয়েছি। আমি আপনার কাছে নতজানু হয়ে প্রার্থনা জানাচ্ছি। এইসব উপস্থিত
ভদ্রমহোদয়গণের কাছেও আবেদন জানাচ্ছি। ঈশ্বর যেন আপনাদের মঙ্গল করুন এবং আপনাদের সকল সম্পদ ও সম্মান আপনাদের সন্তান-সন্ততিদের জন্য জন্য রেখে যেতে পারেন। আমি শুধু আপনাদের কাছে এক জলযানের জন্য প্রার্থনা করছি যার সাহায্যে আমি দীর্ঘ নির্বাসনের পর আমার স্বদেশ ও স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করতে পারব।
তাঁর কথা বলা শেষ হলে সেই চুল্লীর পাশে ধুলোর উপরেই মাটিতে বসে পড়লেন ওডিসিয়াস। কিন্তু সেই বিরাট ভোজসভায় কোনদিক থেকে কেউ কোন কথা
বলল না। সভাগৃহের সেই নিস্তব্ধতা প্রথম ভঙ্গ করলেন লর্ড একেনেউস। ফ্যাকেসিয়াবাসীদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে বড় বাগ্মী এবং বিজ্ঞ ব্যক্তি। তিনি বললেন, অ্যালসিনোয়াস, একজন বিদেশী অতিথিকে এভাবে ধুলোর উপর বসতে দেওয়া আপনার মত রাজার পক্ষে অমর্যাদাকর ব্যাপার। ভোজসভায় আহুত অতিথিরা আপনার নিকট হতে উপযুক্ত সদ্ব্যবহারের প্রত্যাশা করছেন। আমি আপনাকে অনুরোধ করছি আপনি ওকে কোন রৌপ্যনির্মিত সিংহাসনে বসতে দিন এবং আপনার দাসীকে পানপাত্র আনতে বলুন যাতে আমরা দেবরাজ জিয়াসের উদ্দেশ্যে নতুন করে অঞ্জলি দান করতে পারি। জিয়াস উপর হতে আমাদের সব আচরণই প্রত্যক্ষ করেন। এই আগন্তুকের জন্য নৈশভোজনের ব্যবস্থা করুন।
নিজের কর্তব্যের কথা এভাবে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হলে রাজা অ্যালসিনোয়াস ওডিসিয়াসকে হাত ধরে তাকে উঠিয়ে পাশের একটি সিংহাসনে বসালেন। তার এক পুত্র লাওডামাস চেয়ারটি থেকে উঠে গিয়ে খালি করে দিলেন এই নতুন অতিথির জন্য। সোনার ঢাকনা দেওয়া একটি রূপোর গামলায় করে ওডিসিয়াসের হাত ধোয়ার জন্য জল নিয়ে এল একজন দাসী। তারপর তাঁর আসনের পাশে একটি কাঠের টেবিলের উপর কিছু রুটি আর প্রচুর উপাদেয় খাদ্য সাজিয়ে রাখল পরিবেশক এসে, যাতে তার থেকে ইচ্ছা মত প্রয়োজন মত নিতে পারেন ওডিসিয়াস। তার খাওয়া শেষ হলে অ্যালসিনোয়াস তাঁর এক কর্মচারিকে বললেন, পন্টোনোয়াস, যাতে আমরা বজ্ৰাধিপতি জিয়াসের উদ্দেশ্যে অঞ্জলি দান করতে পারি তার জন্য সমস্ত অতিথিদের পানপাত্রগুলো মদ দিয়ে ভরে দাও।
জিয়াসকে অঞ্জলি দান করে প্রাণভরে তৃপ্তির সঙ্গে সকলে মদ পান করলে রাজা অ্যালসিনোয়াস বললেন, হে ফ্যাকেসিয়ার পারিষদবর্গ, আমি কি এবার আপনাদের নিকট আমার মনের কথা ব্যক্ত করতে পারি? আজ এখন যেহেতু আপনাদের ভোজন কার্য শেষ সম্পন্ন হয়ে গেছে, রাত্রির মত আপনারা বাড়ি ফিরে যেতে পারেন। পরদিন সকালে আমাদের এই আগন্তুকের সম্মানার্থে দেবতাদের কাছে বলিদান করে আর এক ভোজসভার অনুষ্ঠান করা হবে। তারপর ঐ আগন্তুক যাতে নিরাপদে তাঁর গৃহে প্রত্যাবর্তন করতে পারেন তার ব্যবস্থা করব। পথে যাতে কোন বিপদে না পড়েন তার জন্য আমরা যোগ্য লোক সঙ্গে দেব। উনি বাড়ি না পৌঁছানো পর্যন্ত সে সঙ্গে থাকবে। এরপর অবশ্য নির্মম নিয়তি মাতৃগর্ভ হতে ওঁর ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরমুহূর্ত হতে ওঁর জীবনের প্রথম সুতোর সঙ্গে যে দুঃখকষ্ট গেঁথে দিয়েছ তা ওঁকে ভোগ করতেই হবে। কিন্তু উনি যদি স্বর্গ হতে আগত কোন দেবতা হন তাহলে বুঝতে হবে দেবতারা কোন চাতুরী খেলছেন আমাদের সঙ্গে। অতীতে দেখা গেছে যখনি আমরা কোন ভাল পশু দেবতাদের উদ্দেশ্যে বলি দিয়ে ভোজসভার আয়োজন করেছি তখনি দেবতারা বিনা আমন্ত্রণে ছদ্মবেশে আমাদের সামনে আবির্ভূত হয়ে সেই ভোজসভায় অংশগ্রহণ করেছেন আমাদের সঙ্গে। এমন কি, আমাদের দেশের কোন পথিকের সামনেও আপন স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করেছেন দেবতারা। কারণ সাইক্লোপরা যেমন দৈত্যদের নিকট আত্মীয় আমরা তেমনি মানুষ হলে দেবতাদের খুবই কাছাকাছি।
ওডিসিয়াস তখন তাড়াতাড়ি উত্তর করলেন, হে রাজন অ্যালসিনোয়াস, এ বিষয়ে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, আপনি বেশই দেখতে পাচ্ছেন দেবতাদের মত আমার চেহারা বা দৃষ্টিশক্তি কিছুই নেই, আমি একজন মানুষমাত্র। আপনাদের মধ্যে কেউ যদি সবচেয়ে তীব্র বিড়ম্বনা জীবনে ভোগ করে থাকেন তাহলে আমার বিড়ম্বনা ও দুঃখ তাঁর সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে। এমন কি আমি যদি আমার দুঃখের সব কাহিনী ব্যক্ত করি তাহলে তা দীর্ঘতায় তাকে ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু এখন আমি শুধু আমার নৈশ ভোজনের অনুমতি চাইছি আপনাদের নিকট। অভিশপ্ত ক্ষুধার মত অধৈর্য মানব জীবনে আর কিছুই নেই। কোন মানুষের অন্তর দুঃখে যতই ভারাক্রান্ত থাক না কেন, ক্ষুধা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে সব ফেলে সে ক্ষুধা তৃপ্ত করতেই হবে। আমার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছে। আমার অন্তরও এখন দুঃখে ভারাক্রান্ত; তথাপি আমার ক্ষুধার বশবর্তী হয়ে আমার খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করতেই হবে। এই ক্ষুধা আমাকে সব ভুলিয়ে দিয়ে উদর পূরণে বাধ্য করেছে আমায়। কিন্তু প্রাতঃকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার স্বদেশে যাওয়ার সব ব্যবস্থা আপনাদের করে দিতে হবে। আপনাদের এই হতভাগ্য অতিথি যাতে তার স্বদেশস্থ তার সেই বিশাল প্রাসাদে তার দাস-দাসীদের মাঝে ফিরে যেতে পারে, যাতে সে সেখানে গিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারে, তার ব্যবস্থা আপনারা করে দেবেন দয়া করে।
তাঁর বক্তব্য ঠিকমত বলতে পেরেছেন ওডিসিয়াস। সকলে হাততালি দিয়ে তাঁর আবেদনে সাড়া দিয়ে তাঁকে সমর্থন করল। তার যাওয়ার ব্যবস্থা অবশ্যই রা করে দেবে। অবশেষে ওডিসিয়াসের পানাহার ও অর্ঘ্যদানের কাজ শেষ হলে সভা ভঙ্গ হলো। অতিথিরা আপন আপন বাসভবনে চলে গেল। ওডিসিয়াস সেই প্রাসাদে রাজা রাণীর কাছেই রয়ে গেলেন। দাস-দাসীরা ভোজের টেবিলগুলো পরিষ্কার করতে লাগল, সকলেই নীরবে বসে ছিলেন। রাণী এ্যারিতেই প্রথমে সে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করলেন। তিনি এতক্ষণ ওডিসিয়াসের পোশাকগুলো লক্ষ্য করে বুঝলেন এ পোশাক তিনিই নিজের হাতে তৈরি করে তাঁর কন্যাকে দেন।
তাই তিনি প্রথমে বললেন, মহাশয়, আমি ভূমিকা না করেই কয়েকটি প্রশ্ন আপনাকে করব। কোথা থেকে আপনি আসছেন? আপনি কে? কে আপনাকে এই পোশাক দিয়েছে?কারণ আপনি একটু আগে বলেছেন নৌকাডুবি হয়ে তরঙ্গতাড়িত হয়ে এখানে এসে উঠেছেন। ওডিসিয়াস উত্তর করলেন, হে আমার শ্রদ্ধেয়া রাণীমা, আমি যদি প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত আনুপূর্বিক আমার সব কথা বিবৃত করি তাহলে আমাদের উভয়েরই পক্ষে সেটা ক্লান্তিকর ব্যাপার হবে। কারণ আমার এই দুর্ভাগ্য দীর্ঘদিনের। সুতরাং আমি শুধু আপনার প্রশ্নেরই যথার্থ উত্তর দান করব। দূর সমুদ্রে ওগিজিয়া নামক এক দ্বীপ আছে। সেখানে অ্যাটলাসকন্যা ক্যালিপসো বাস করেন। তিনি মানবী নন, সুন্দরী দেবী। তবু সকলে তাঁকে ভয় করে। দেবতা বা মানব কেউ তাঁর কাছে যায় না। তবু কোন এক অদৃশ্য শক্তির বশবর্তী হয়ে তার কাছে আমাকে যেতে হয়েছিল। এমনই আমার দুর্ভাগ্য। আমি ছিলাম একাকী, কারণ চোখ ধাঁধানো এক বজ্রের আঘাতে দেবরাজ জিয়াস আমাদের সুন্দর জাহাজটি ভেঙ্গে দেন। আমার নাবিকরা মারা যায়। সেই ভগ্ন জাহাজের একটি কাঠ ধরে নয় দিন ধরে সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে দশ দিনের দিন আমি ওগিজিয়া দ্বীপে এসে উঠি। এই দ্বীপেই অপরূপ কেশধন্যা ভীষণসুন্দরী দেবী ক্যালিপসো বাস করেন। তিনি ভালবাসার সঙ্গে যত্ন সহকারে আমাকে আশ্রয় দেন। তিনি আমাকে অমর অনন্ত যৌবনসম্পন্ন করে তোলার আশ্বাস দেন। কিন্তু তিনি মুহূর্তের জন্যও আমার হৃদয় জয় করতে পারেন নি। যে অক্ষয় বস্ত্র ক্যালিপসো আমায় দান করেছিলেন সে বস্ত্রের অঞ্চল আমি দীর্ঘ সাত বছর ধরে আমার অশ্রুজলে সিক্ত করে এসেছি।
অষ্টম বছরে তিনি আমাকে যাবার অনুমতি দেন। হয় তিনি জিয়াসের নিকট হতে কোন নির্দেশ পান অথবা তার নিজের মনেরই পরিবর্তন হয়। আমারই নিজের হাতে তৈরি একটি নৌকো তিনি খাদ্য ও পানীয় দিয়ে সাজিয়ে দেন। অনুকূল বাতাসেরও ব্যবস্থা করে দেন। সতের দিন ধরে আমি অবাধে এগিয়ে যাই। অষ্টাদশ দিন পরে আপনাদের দেশের ছায়াছন্ন সীমারেখা দেখে উৎফুল্ল হয়ে উঠি আনন্দে। কিন্তু সে আনন্দ ক্ষণিকের জন্য। পরক্ষণেই পডেসন আমার জন্য নিয়ে এলেন প্রচুর কষ্ট। সমুদ্রে হঠাৎ ঝড় তুলে ঢেউগুলোকে এমন প্রচণ্ডভাবে উত্তাল করে তুললেন যে আমার নৌকোটা সে ঢেউ কেটে এগিয়ে যেতে পারল না। আর একটা ঝড় এসে আমার নৌকোটাকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিল। যাই হোক, অতিকষ্টে কখনও সাঁতার কেটে, কখনও ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে অবশেষে আপনার এই উপকূলের কাছে এসে পড়ি। কিন্তু সেখানে খাড়াই পাহাড় থাকায় উঠতে না পেরে একটি নদীর মুখে ঢুকে পড়ি এবং তার তীরে এসে উঠি। অসাড় অবশ অঙ্গ নিয়ে কিছুক্ষণ সেখানে শুয়ে থাকি আমি। পরে কিছুটা শক্তি পাই দেহে। তখন রাত্রি নেমে আসে, আমি নদীতীর থেকে উঠে গিয়ে বনের মধ্যে কিছু পাতার উপর শুয়ে আর কিছু পাতা ঢাকা দিয়ে শুয়ে পড়ি এবং গভীরভাবে ঘুমিয়ে পড়ি। পরদিন দুপুর পর্যন্ত ঘুমোতে থাকি। ঘুম থেকে জেগেই দেখি নদীতীরে আপনার কন্যার দাসীরা খেলা করছে। তাদের মধ্যে আপনার কন্যাকে দেখে প্রথমে আমি দেবী বলে মনে করি। তাঁর কাছে আমি সাহায্যের আবেদন জানাই। যে সুমতি ও সদ্ব্যবহার যুবক যুবতীদের কাছ থেকে আশাই করতে পারা যায় না, তিনি আমার প্রতি তার যথেষ্ট পরিচয় দিলেন। তিনি শুধু আমাকে খাদ্য ও পানীয় দিলেন না, আমার স্নানের ব্যবস্থা করে আমাকে এই সব পোশাক পরিধান করতে দিলেন। এই হলো সত্য ঘটনা, যদিও এ ঘটনার কথা কাহিণীর মত বিবৃত করতে কষ্ট হচ্ছে আমার মনে।
এমন সময় অ্যালসিনোয়াস একটা কথা বললেন। তিনি বললেন, মহাশয়, একদিক দিয়ে কিন্তু আমার কন্যা ভুল করেছে। তার উচিত ছিল আমার কাছে সোজা আপনাকে নিয়ে আসা। যাই হোক, তাহলে তার কাছেই প্রথমে সাহায্যের আবেদন করেন?
বুদ্ধিমান ওডিসিয়াস উত্তর করলেন, হে রাজন, আপনার কন্যার কোন দোষ নেই, তাঁকে কোন তিরস্কার করবেন না। তিনি আমাকে আপনার নিকট আসার জন্যই বলেছিলেন। কিন্ত আপনি আমাকে এই অবস্থায় দেখে বিরক্ত হবেন বলে আমি এখানে তখন আসার সাহস পাই নি।
অ্যালসিনোয়াস বললেন, আমি কখনো তুচ্ছ কোন বিষয়ে রাগি বা বিরক্ত হই না। মানুষের সঙ্গে অবশ্যই আমাদের ভদ্র ব্যবহার করা উচিত। এখন দেখছি আমার মতো আপনি একই মনোভাবাপন্ন মানুষ। এমন অবস্থায় আমার মনে হয় আপনি যদি আমার কন্যাকে গ্রহণ করে আপনাকে প্রদত্ত এক বাড়িতে আমার জামাতারূপে রয়ে যান তাহলে তার থেকে ভাল আর কিছুই হতে পারে না। অবশ্য আপনি যদি এখানে থাকতে চান। কিন্তু আপনি যদি দেশে ফিরে যেতে চান তাহলে ফেসিয়ার কোন লোক বাধা দেবে না আপনাকে। ঈশ্বর করুন, যেন না যান। আপনার মনস্থির করার জন্য একটি দিন সময় দেওয়া হলো আপনাকে। আগামীকাল বলবেন আপনি কী চান।
আপনি যদি একান্তই যেতে চান তাহলে শান্ত সমুদ্রের উপর দিয়ে এমন সুন্দরভাবে জাহাজ চলবে যে আপনি সারা পথ ঘুমিয়ে কাটাবেন। অবশেষে অনায়াসে আপনার স্বদেশে বা আপনার ঈপ্সিত যেকোন গন্তব্যস্থলে উপনীত হবেন। আপনার দেশ যদি পৃথিবীর শেষ প্রান্তে অবস্থিত ইউবীয়া থেকেও দূরে হয় তাহলেও কোন ক্ষতি নেই। একবার আমাদের সুদক্ষ নাবিকরা এখান থেকে র্যাদামানথাসকে নিয়ে পৃথিবীর পুত্র টিটয়ের সঙ্গে দেখা করানোর জন্য একদিনের মধ্যে ইউবিয়া গিয়ে ফিরে এসেছিল। অথচ তাদের কোন ক্লান্তি হয় নি। কিন্তু আপনি নিজের চোখে দেখবেন আমাদের জাহাজগুলো কত ভাল এবং সমুদ্রে দাঁড় টানা বা জাহাজ চালানোর কাজে আমাদের দেশের যুবকরা কত সুদক্ষ।
শুনতে শুনতে এক অনির্বচনীয় আনন্দে অন্তরটা ভরে উঠল ওডিসিয়াসের। তিনি উচ্চকণ্ঠে প্রার্থনা করতে লাগলেন জিয়াসের উদ্দেশ্যে। তিনি বললেন, হে পরম পিতা জিয়াস, দেখো, অ্যালসিনোয়াস যেন তাঁর প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। তিনি যেন আমার পিতৃভূমিতে ফিরে যেতে পারি এবং পৃথিবীতে মানুষ যতদিন ভূমিকৰ্ষণ করবে ততদিন রাজা অ্যালসিনোয়াসের যশ যেন অক্ষয় হয়ে থাকে।
এবার রাণী এ্যারিতে ভৃত্যদের ওডিসিয়াসের শয্যা প্রস্তুত করার জন্য আদেশ দিলেন। গাড়ি-বারান্দার উপর একটি কাষ্ঠনির্মিত পালঙ্কে তার শয্যা প্রস্তুত করে কম্বল দিয়ে ওডিসিয়াসকে ডাকল ভৃত্যেরা। সে ডাকের সঙ্গে সঙ্গে নিবিড় নিদ্রাসুখের এক পূর্বাস্বাদন অনুভব করলেন ওডিসিয়াস।
ওডিসিয়াস তার বিছানায় শুয়ে পড়লে রাজা অ্যালসিনোয়াস তার স্ত্রীকে নিয়ে চলে গেলেন প্রাসাদের পশ্চাদভাগে তার শয়নকক্ষে।