চুয়াডাঙ্গা থেকে এক ভদ্রমহিলা ফোন করলেন, হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আপনার লেখাটা নিয়মিত পড়ছি। তিনি এখন কেমন আছেন এ কথা। আপনি একবারও লিখছেন না। আমরা জানতে চাই তিনি কেমন আছেন।
আমি বিনীতভাবে বললাম, আমি তাঁর অসুস্থতার কথা লিখতে চাই না। আমার কলম সায় দেয় না। তবে তাঁর অসুস্থতার কথা, তিনি এখন কেমন আছেন এসব দুচার দিন পর পর সব কাগজেই লেখা হচ্ছে।
ভদ্রমহিলা একটু নাছোড় ধরনের। বললেন, আপনি কবে কীভাবে তাঁর অসুস্থতার কথা জানলেন?
আমার বলতে ভালো লাগছিল না। ব্যস্ততার ভান করে ফোন রেখে দিলাম। আজ এই লেখা লিখতে বসে মনে হচ্ছে, সেই ভদ্রমহিলার মতো হয়তো অনেক পাঠকের জানার আগ্রহ, আমি কীভাবে হুমায়ূন আহমেদের অসুস্থতার কথা জানলাম।
ঘটনাটা বলি।
আমার বহু বছরের পুরনো বন্ধু আলমগীর রহমান। বাংলাদেশের অত্যন্ত রুচিশীল ও বিখ্যাত প্ৰকাশন সংস্থা প্রতীক আর অবসরের স্বত্বাধিকারী। একসময় চমৎকার গল্প লিখতেন, সাংবাদিকতা করতেন। তারপর এলেন প্রকাশনায়। খুবই বন্ধুবৎসল মেজাজি মানুষ আলমগীর ভাই।
হঠাৎ একদিন তাঁর ফোন, মিলন, আপনি হুমায়ুনের সঙ্গে দেখা করেন।
আমি অবাক। হুমায়ূন ভাই সিঙ্গাপুর থেকে ফিরেছেন?
হ্যাঁ। শাশুড়ির পায়ের চিকিৎসার জন্য গিয়েছিল। নিজের চেকআপও করিয়ে আসছে। আপনি দেখা করেন। তিন দিন পর হুমায়ূন আমেরিকায় যাচ্ছে।
আমি ছিলাম গাড়িতে। অফিসে যাচ্ছিলাম। আলমগীর ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, জরুরি কিছু?
বলতে পারব না। আপনি দেখা করেন।
আমি একটু চিন্তিত হলাম। ব্যাপারটা কী?
ফোন করলাম মাজহারকে। কী খবর, মাজহার? আলমগীর ভাই ফোন করে বললেন…
হ্যাঁ। আপনি স্যারের সঙ্গে দেখা করেন।
ব্যাপারটা কী?
মাজহার বিষন্ন গলায় বললেন, খারাপ খবর আছে।
কী হয়েছে?
হুমায়ূন ভাইয়ের কোলন ক্যান্সার ধরা পড়েছে।
আমি যেন পরিষ্কার বুঝতে পারলাম না কথাটা। কী? কী ধরা পড়েছে?
কোলন ক্যান্সার।
প্ৰথমে দিশেহারা হলাম, তারপর স্তব্ধ। কথা বলতে পারছি না।
মাজহার বললেন, সিঙ্গাপুরে যাওয়ার পর ভাবি বললেন, আসছ যখন, তোমার চেকআপটিাও করিয়ে নাও। চেকআপ করাতে গিয়ে ধরা পড়েছে। ওখানে চিকিৎসা করাতে রাজি হন নি। পরশুর পরদিন নিউইয়র্কে যাচ্ছেন। আমিও যাচ্ছি। সঙ্গে। মেমোরিয়াল স্লোয়ান ক্যাটারিং ক্যান্সার হাসপাতালে চিকিৎসা হবে। এই হাসপাতালে সোনিয়া গান্ধীরও ক্যান্সারের চিকিৎসা হয়েছে। পৃথিবী-বিখ্যাত হাসপাতাল।
মাজহার বলে যাচ্ছেন। কিন্তু আমার কানে যেন ঢুকছে না কিছুই। মৃতের মতো অফিসে এলাম। কোনো কাজে মনই বসল না। প্ৰায় সারাটা দিন আমার রুমের সোফায় শুয়ে রইলাম। রাতের বেলা একটু আগেভাগেই অফিস থেকে বেরিয়ে গেলাম দখিন হাওয়ায়। গিয়ে দেখি, হুমায়ূন ভাই যে জায়গাটায় বসে লেখালেখি করেন, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেন, সেখানে তাঁর পাশে বসে আছেন জুয়েল আইচ। কিছুক্ষণ পর আলমগীর ভাই এলেন, মাজহার এলেন। আমাকে দেখে সব সময়কার মতো হুমায়ূন ভাই বললেন, আসো, মিলন। বসে।
আমি তাঁর পাশে বসলাম। তিনি শুরু করলেন তাঁর রসিকতা, শোনো মিলন, সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথে আমার আর আমার মায়ের বাইপাস হয়েছিল। একইরুমে পাশাপাশি বেড়ে রাখা হয়েছিল মা-ছেলেকে। এরকম ইতিহাস ওই হাসপাতালে নেই। মায়ের পাওয়া গিয়েছিল। ৯টি ব্লক, ছেলের ১১টি। এবার ওই হাসপাতালে চকআপে গেছি। ডাক্তার চেকআপ করে বললেন, অমুক রুমে যাও। গেলাম। আরেক ডাক্তার চেকআপ করে বললেন, আরে, তোমার তো ক্যান্সার। বললেন এমন ভঙ্গিতে, যেন ক্যান্সার কোনো রোগই না। সর্দি-কাশির মতো সামান্য কিছু।
আমার এমনিতেই সারা দিন ধরে মন খারাপ। হুমায়ূন ভাইয়ের রসিকতায় হাসার চেষ্টা করছি, হাসতে পারছি না। জুয়েল আইচের মুখে সব সময় হাসি লেগেই আছে। তিনি আমার দিকে তাকালেন, কিন্তু সবসময়কার মতো প্ৰাণ খুলে হাসতে পারলেন না। আমি মাথা নিচু করে হুমায়ূন ভাইয়ের পাশে বসে আছি। খানিক পর শাওন এসে বসল। পাশে। সে খুবই উচ্ছল, প্রাণবন্ত; একপলক তার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি, ভেতরের গভীর কষ্ট অতিকষ্টে চেপে সে উচ্ছল থাকার চেষ্টা করছে। আমার চোখ ভরে আসছিল কান্নায়, গোপনে চেপে রাখছিলাম চোখের পানি।
হুমায়ূন ভাই নানা রকম কথা বলে যাচ্ছিলেন, তাঁর চিরাচরিত রসিকতাও করছিলেন। আমি না থাকলে তো তোমার অনেক সুবিধা। তুমি তখন একচ্ছত্র রাজত্ব করবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
শাওন উচ্ছল গলায় বলল, না না, মিলন আংকেলকে একক রাজত্ব করতে দেওয়া যাবে না। হুমায়ূন আহমেদ কমপক্ষে আরও ২০ বছর আছে।
প্রিয় পাঠক, আপনাদের কারও কারও মনে হতে পারে শাওন আমাকে কেন মিলন ভাই না বলে মিলন অ্যাংকেল বলছে। আসলে আমাদের কয়েকজনের ক্ষেত্রে শাওন তার অভ্যাসটা বদলাতে পারে নি। যেমন—আসাদুজ্জামান নূর কিংবা আলমগীর রহমান কিংবা আমি। আমি শাওনকে চিনি ওর শিশু বয়স থেকে। বিটিভির নতুন কুড়ির সময় থেকে। শাওনের গুণের পরিচয় তখন থেকেই জানি। ওর অসাধারণ অভিনয়ের কথা, অসাধারণ গায়কি প্রতিভার কথা, এমনকি টিভি নাটক পরিচালনার কথা সবাই জানে। আমি তার আরেকটা বড় প্রতিভার কথাও জানি। শাওন খুবই উচ্চমানের একজন নৃত্যশিল্পী। এখন আলোকিত করছে হুমায়ূন আহমেদের জীবন, একসময় আলোকিত করেছিল নতুন কুঁড়ি প্ৰতিযোগিতা।
কথায় কথায় কত কথা যে আসে!
শাওনকে নিয়ে একটা ঘটনার কথা বলি।
নুহাশপল্লীতে হুমায়ূন ভাইয়ের নাটকের শুটিং ছিল। আমি আর ইফতেখার নামে হুমায়ূন ভাইয়ের এক বন্ধু গেছি তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিতে। নাটকের নায়িকা শাওন। পরদিন ইউনিভার্সিটিতে তার জরুরি ক্লাস। বিকেলবেলা ফিরতে হবে। আমি আর ইফতেখার ভাই যে মাইক্রোবাসে ফিরব, শাওনও সেই মাইক্রোবাসে আমাদের সঙ্গে রওনা দিল। রাস্তায় হঠাৎ আমি শাওনকে বললাম, শাওন একটু পুরনো দিনের হিন্দি গান শোনাও না। দু-চার লাইন যা পারো।
ধারণা ছিল, শাওন এই জেনারেশানের মেয়ে, ও কি আর পুরনো দিনের হিন্দি গান পুরোপুরি জানে কোনোটা? হয়তো দু-চার লাইন গাইতে পারবে।
শাওন আমার ধারণা তছনছ করে দিল। একটার পর একটা পুরনো দিনের হিন্দি গান গাইতে লাগল। সামসাদ বেগম, নূরজাহান, লতা মুঙ্গেশকর, গীতা দত্ত, এমনকি মোহাম্মদ রফি, মুকেশের গানও। এমন নিখুঁত সুরে, একটি শব্দও ভুল না করে একের পর এক গেয়ে গেল। শাওন একটা করে গান শুরু করে, আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে তার মুখের দিকে তাকাই।
নুহাশপল্লী থেকে ঢাকা, সারাটা পথ পুরনো দিনের হিন্দি গান গেয়ে শোনাল শাওন। ওর গান শুনতে শুনতে আমি চলে গেলাম। আমার ছেলেবেলায়, কৈশোরকালে। সেই সময়কার আমার পুরান ঢাকার জীবনে, যেখানে চায়ের দোকানে দিনরাত বাজত এসব গান। গ্রামোফোনে, রেডিওতে। বিয়েবাড়ির অনুষ্ঠানেও বাজত।
বাংলার হেমন্ত মুখোপাধ্যায় মুম্বাইতে (তখনকার বোম্বাই) গিয়ে হয়েছিলেন হেমন্তকুমার। হিন্দি গান গেয়ে নাগিন ছবির সুর করে ভারতবর্ষ মাত করে দিলেন। সেদিন শাওন শেষ গানটা গেয়েছিল হেমন্তকুমারের আয় আপনা দিল তো আওয়ারা।