সপ্তম পরিচ্ছেদ
এসব কথা বলার নয় কাউকে। মা-দাদা-বৌদির কাছে তো নয়ই– এতখানি অপরাধের কথা, লজ্জা ও কলঙ্কের কথা, অস্বাভাবিক অমানুষতার কথা কারও কাছেই বুঝি বলা যায় না। সুতরাং চুপ করেই থাকে সে। চোখ দিয়ে শুধু জল পড়ে যায় উত্তরের বদলে। এক এক সময় মা ক্ষেপে যান– সব কথা সে শুনতে পায় না বটে, কানের মধ্যে সর্বদা যেন একটা ঝম ঝম করে আওয়াজ হচ্ছে, দিনরাতই– আভাসে আন্দাজে তাঁর তিরস্কারের কঠিন ভাষা সে কিছু কিছু বুঝতে পারে– কিন্তু জবাব দিতে পারে কৈ? মা এক-এক দিন তেড়ে মারতেও আসেন, অথচ, কী করে বোঝাবে সে তাঁকে যে বলার মতো তার কিছুই নেই। বলবার কোন উপায় নেই। সে তিরস্কারে মাথাটাই শুধু আরও খানিকটা হেঁট হয়, চোখের ধারাটাই শুধু আরও প্রবল হয়।
বৌদি আড়ালে আবডালে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করে। হেঁকে বললে মা শুনতে পাবেন বলে সীতার ফেলে যাওয়া স্লেটটা খুঁজে বার করে লিখে জানায় যে, ‘তুমি আমার কাছে বলো, কেউ টের পাবে না। তেমন যদি কিছু কথা হয় তো আমি বলবও না কাউকে। আর যদি এমন হয় যে মার কাছে বলতে লজ্জা করছে তোমার তো তাও আমাকে বলা সুবিধে, আমি ওঁদের বলতে পারব। চক্ষুলজ্জা হয় তো আমি চলে যাচ্ছি সেলেটে লিখে রাখো। দূরে নিয়ে গিয়ে পড়ব।’
কিন্তু তাও পারে না কান্তি। হাত জোড় করে শুধু
এদিকে কানের রোগটা ওর বেড়েই যায় দিন দিন। আগে একটু চেঁচিয়ে বললেই শুনতে পেত– এখন কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে চিৎকার করলে তবে কিছুটা শুনতে পায়! তাও অর্ধেক কথা বুঝতে পারে না। কেমন একরকম করুণ অসহায় ভাবে চেয়ে ঘাড় নাড়ে, কানটা এক হাত দিয়ে খানিকটা চোঙের মতো করে বক্তার মুখের আরও কাছে নিয়ে আসে।
এবার হেমও চিন্তিত হয়ে পড়ে। এখানের হাসপাতাল থেকে সাফ জবাব দিয়ে দিয়েছে। তারা আর পারবে না কিছু করতে।
কনক ক্রমাগত খোঁচায়, ‘ওগো কি করছ? এর পর যে চিকিচ্ছের বাইরে চলে যাবে। দুটো একটা দিন আপিস কামাই করো। কলকাতার কলেজে নিয়ে যাও।
অগত্যা তাই করতে হয়। অফিস কামাই করে মেডিকেল কলেজের আউটডোরে নিয়ে যায়।’ই-এন-টি’তে ধর্ণা দিয়ে যখন ডাক আসে তখন কিন্তু আশার সঞ্চার হয় একটু হেমের মনে। কারণ ডাক্তার যিনি দেখছিলেন তিনি ওর কেস দেখে খুব কৌতূহলী হয়ে উঠলেন। ছাত্রদের ডেকে দেখালেন, ‘স্ট্রেঞ্জ! ড্রামে কিছুই হয় নি, কালা হওয়ার অন্য কোনও কারণ নেই– অথচ শুনতে পাচ্ছে না। এ একটা ইন্টারেস্টিং কেস কিন্তু।’
দু-দিন বড়মাসীর কাছেই রইল ওরা দু-জনে। ছোটমাসীর একখানা ঘর, তাতে ওদের ছোট ভাই খোকাকে নিয়ে তিনটি প্রাণী। সেখানে থাকা সম্ভব নয়। বাড়ি থেকে রোজ রোজ আসার খরচাও আছে, ঝঞ্ঝাটও আছে।
তিন দিন পর পর গেল কান্তি। শেষের দিনে বলে-কয়ে শরৎ মেসোমশাইকে সঙ্গে দিয়ে হেম অফিস গেল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হল না। এঁরাও বললেন, ‘দুর্বলতার জন্যেই এ রকম হয়েছে। ভাল পুষ্টিকর কিছু খেতে দিন। টনিক খাওয়ান একটা।’ টনিক লিখেও দিলেন। বিলিতি নার্ভ-টনিক। সাত-আট টাকা দাম।
হেমের মুখ শুকিয়ে উঠতে দেখে শরৎ মেসোমশাই আটটা টাকা বার করে দিলেন। বললেন, ‘তুমি লজ্জা করো না বাবা, এ লৌকিকতা-লজ্জার সময় নয়। আছে বলেই দিচ্ছি, নইলে কি আর দিতে পারতুম। তুমি ওষুধটা কিনে নিয়েই যাও। আর ওখানে গিয়ে একটা দুধের যোগানি ব্যবস্থা করো, অন্তত এক পো করে। সেটাও আমি দেব। শুধু টনিকে কিছু হবে না, তার সঙ্গে ভাল খাওয়াও চাই। মাছ মাংস খাওয়াতে তো পারবে না তেমন, তবু এক পো করে দুধ খেলেও কিছুটা হবে।’
নেবার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু নিতে হল। কারণ সত্যিই তারও এমন সঙ্গতি নেই যে দুম করে আট টাকার ওষুধ কিনে খাওয়ায় এখুনি। কিছু সে হাতে রাখে ঠিকই মাইনের টাকা থেকে– কিন্তু সেও হাতি-ঘোড়া কিছু নয়। তা থেকেও তো ডাক্তারের ওষুধে কত টাকা বেরিয়ে গেল গত দু মাসে। আরও কি আপদ বিপদ হয় ঠিক আছে!
শরৎ মেসোমশাইয়ের দিল আছে কিন্তু, নইলে ওঁরও কীই বা আয়। একটা ছোট ছাপাখানা ছিল– নিজে দেখতে পারেন না, লীজ দিয়েছেন,তারই কটা টাকা ভরসা। তারও অর্ধেক নাকি আদায় হয় না! গিয়ে তাগাদা দিয়ে দু টাকা এক টাকা করে আদায় করতে হয়। দুর্দান্ত হাঁপানি মেসোমশাইয়ের, রোজ যাওয়াও তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তবু মাসীমা এখনও টিউশ্যনি করে সংসার চালাচ্ছেন তাই রক্ষে, নইলে খেতেই পেতেন না।
বিচিত্র ভাগ্য ছোটমাসীর। ওষুধটা কিনতে কিনতে কথাটা মনে হল হেমের। জীবনে একদিনও স্বামীর সাহচর্য পেলেন না– ফুলশয্যার রাত্রেও না। স্বামী তাঁর কোন্ ডোমের মেয়ে-রক্ষিতা নিয়েই রইলেন সারাজীবন, অসচ্চরিত্র স্বামী স্পর্শ করলে স্ত্রীর অপমান হবে এই ভয়ে স্পর্শ পর্যন্ত করলেন না কোনদিন। মার কাজের সুসার হবে বলে শুধু নাকি বিয়ে করেছিলেন। তারপর শাশুড়ীর জ্বালা সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে এলেন মাসিমা। দিদিমা একা, সহায়সম্বলহীন। কোথাও দাঁড়াবার কোন আশ্রয় না পেয়ে সেদিন ছোটমাসী উপার্জনের এক অভিনব পন্থা বেছে নিয়েছিলেন, সামান্য লেখাপড়া সম্বল করে এক টাকা দু টাকার টিউশ্যনি ধরে ছিলেন গোটাকতক। তার পর থেকে সে-ই চলেছে আজও। একেবারে বুড়ো বয়সে বলতে গেলে, শরতের সেই রক্ষিতাটি গত হলে, শরৎ যখন অসহায় হয়ে পড়লেন– অন্ধকার স্যাঁৎসেঁতে মেসবাড়ির নিচের তলার ঘরে পড়ে পড়ে কাশছেন আর হাঁপাচ্ছেন দেখে হেমই এসে খবর দিয়েছিল ছোটমাসীকে। ছোটমাসী গিয়ে মেস থেকে উদ্ধার করে এনে কাছে রেখে সেবা করছেন এখন। কিন্তু নিজের কোট ছাড়েন নি তাই বলে, মেসোমশাইয়ের শত অনুরোধেও টিউশ্যনি ছাড়তে রাজি হন নি। বলেছেন, ‘জীবনের এতগুলো বছর যদি স্বামীর ভাত না খেয়ে চলে যেতে পেরে থাকে তো এখনও পারবে। মানুষের জীবন, বলা যায় না কিছু–তবে পারি তো শেষ দিন পর্যন্ত নিজের ভাতই খেয়ে যাব। দুদিন ভাত দিয়ে যে তুমি বিয়ের সময়কার করা প্রতিজ্ঞা সেরে নেবে– তা হবে না!’…
শরতের দেওয়া সে টনিক ফুরোবার আগেই খবর পেয়ে অভয়পদ আর এক শিশি কিনে পাঠিয়ে দিলে। একদিন একরাশ ফলও পাঠিয়ে দিয়েছিল। দুধের যোগানি টাকা হেম অবশ্য কারুর কাছ থেকে নেয় নি– নিজেই দিয়ে যাচ্ছে যেমন করে হোক। তবে মাছ মাংস খাওয়াবার কোন সুবিধে হয় নি। শনি-রবিবার হাতছিপে যা দু-একটা ধরা পড়ত, তারই বেশির ভাগটা কান্তিকে দিত কনক, এই পর্যন্ত।
এর জন্য কান্তির লজ্জার অবধি ছিল না। আরও মাথা নুয়ে পড়ত তার। অত দামি ওষুধ খাবার সময় প্রত্যেকবারই লজ্জায় তার কান-মুখ রাঙা হয়ে উঠত। উপায় নেই বলেই খেতে হত তবু। এতগুলো লোককে ব্যস্ত করছে এত টাকা খরচ করাচ্ছে– এখন তাড়াতাড়ি সেরে উঠে এদের অব্যাহতি দিতে পারলেই ভাল। বৃথা চক্ষুলজ্জা করে রোগ বাড়িয়ে আরও বিব্রত করা উচিত নয়।
কিন্তু দু শিশি টনিক খেয়েও কানের কোন উপকার হল না। বরং মনে হতে লাগল আরও কালা হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। কিছুই প্রায় শুনতে পায় না এখন, কানের কাছে গিয়ে প্রাণপণে চিৎকার করলে দুটো-একটা কথা ধরতে পারে শুধু। এবার তার নিজেরও চিন্তা হয়েছে খুব। কান না ভাল হলে ইস্কুলে যেতে পারবে না– মাস্টার মশাইয়ের পড়ানো তো কিছুই শুনতে পাবে না।
সেখানকার বই-খাতাগুলো সেই কাছারি বাড়িতেই পড়ে আছে। কে-ই বা আনতে যাবে। তারা যে গরজ করে পাঠাবে সে সম্ভাবনাও নেই। চিঠি লিখলেও কোন সুরাহা হবে বলে মনে হয় না। সুতরাং শুধু চুপ করে বসে থাকা ছাড়া কোন কাজ নেই। কখনও সাধ্যমতো টুকটাক বাগানের কাজ করে এক-আধটু, নইলে বেশির ভাগ সময়ই চুপ করে বসে থাকে আর ভাবে এই অসুখের কথা, নিজের জীবনের কথা, এই সর্বনাশা রোগের কথা। ভেবে ভেবে কূল-কিনারা পায় না কিছু –অসুস্থ শরীরে খানিকটা ভাববার পর মাথা ঝিমঝিম করে। লজ্জায় অনুতাপে চোখে জল এসে যায় বার বার।
দু শিশি টনিকেও কোন কাজ হয় নি– উন্নতি তো হয়ই নি উল্টে বরং কিছু অবনতিই ঘটছে শুনে গোবিন্দ ওকে আবার কলকাতাতে পাঠাতে বললে। কে একজন ই- এন-টির বড় ডাক্তার আছেন, ওর বন্ধু এবং মনিব ধরের আত্মীয় হন তিনি। ওর বন্ধুকে বলেই ব্যবস্থা করেছে গোবিন্দ, তিনি বিনা পয়সায় দেখতে রাজি হয়েছেন। যদি ছোটখাটো কোন অপারেশন করলে কাজ হয় তো তিনিই করবেন– তারও কোন খরচ লাগবে না। তিনিই হাসপাতালে ভর্তি করে নেবেন।
কিন্তু এবারও কোন লাভ হল না। দুদিন তিন দিন ধরে দেখলেন ডা. মল্লিক। কোন আশাও দিতে পারলেন না তিনি। বললেন, ‘আসলে ওর কানের নার্ভগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। ওর কোন চিকিৎসা বিলেতে হয় কিনা জানি না, এদেশে এখনও পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা হয় নি। বৃথা চেষ্টা। এর পর একেবারেই কিছু শুনতে পাবে না। কানের কাছে বাজ পড়লেও বুঝতে পারবে না। একেবারেই বরবাদ হয়ে গেল ছেলেটা।….. ঐ যে দুর্দান্ত ম্যালেরিয়া হয়েছিল বললেন, তাতেই এই কাণ্ডটি হল। সাধারণত ঐ টাইপের ম্যালেরিয়া শরীর একেবারে ঝাঁঝরা করে দিয়ে যায়। মনে হয় ওর বংশে ভি-ডি ছিল। তাতেই আরও অনিষ্ট হয়েছে। সরি, কী আর বলব।। feel pity for the boy.‘
অর্থাৎ এদিক দিয়ে আশা-ভরসা আর কিছু রইল না। একেবারেই নিশ্চিন্ত হল ওরা। এই খবরের পর শ্যামা আর একবার আছাড় খেয়ে পড়লেন। আর এক দফা– রতনকে উদ্দেশ্য করে– গালিগালাজ শাপ-শাপান্তর ঝড় উঠল। কান্তি কিছুই শুনতে পেল না তার, তবে বুঝতে পারল। বুঝতে পারল সে অনেক কিছুই। তাকে কেউ বলে দেয় নি যে আর কোন আশা নেই কোথাও তার কান সারাবার– কিন্তু দাদা বৌদির অন্ধকার হতাশ মুখ, বড়মাসীমার চোখের জল আর মার এই রণরঙ্গিণী মূর্তি ও আছড়ে পড়া দেখে কিছু আর বুঝতে বাকি রইল না। এবার পাথর হয়ে গেল সে। চোখে আর জল নেই তার। সব যেন শুকিয়ে গিয়েছে। এত বড় সর্বনাশের কথা যখন ভাবতেও পারে নি– তখন লজ্জায়, অনুশোচনায়, আত্মগ্লানিতে চোখ দিয়ে জল পড়ত; এখন আর কিছুই নেই, এ সবের অতীত হয়ে গিয়েছে সে। এখন শুধু সামনে দিক-দিশাহীন অন্ধকার, নিঃসীম শূন্যতা। ভয়েই পাথর হয়ে গেল সে।
অনেক চেঁচামেচি, অনেক কান্নাকাটির পর শ্যামাও এক সময় বোধ হয় শ্রান্ত হয়েই চুপ করলেন। কিন্তু মনের আক্রোশ মেটে নি তাঁর– এই কথাটা নিয়েই মনে মনে তোলপাড় করতে লাগলেন। একবার ভাবলেন সত্যি-সত্যিই যাবেন সেখানে সামনে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেতাই করে আসবেন, কৈফিয়ৎ তলব করবেন তাদের এই আচরণের। কোন্ অধিকারে ওদের না জানিয়ে ছেলেকে সেই মৃত্যুপুরীতে পাঠিয়েছিল তারা? কেন? কেন এ কাজ করতে গেল তারা, কিসের জন্যে?
আবার পরক্ষণেই মনে হল, ছিঃ! জামাইবাড়িতেই কোন দিন গেলেন না তিনি– তা আবার তাদের আত্মীয়বাড়ি। বিশেষ করে ঐ বাড়িতে– ঐ পাড়ায়। না, সে সম্ভব নয়; তা তিনি পারবেন না।
অনেক ভেবে-চিন্তে একটা কাজ করলেন। মহাশ্বেতার বড় ছেলেটা এসেছিল একদিন, তার শরণাপন্ন হলেন, ‘বুড়ো ভাই, একটা কাজ করবি? চুপি চুপি কোন রকমে তোর মেজকাকীর কাছ থেকে তোর রতনপিসীর ঠিকানাটা যোগাড় করে দিবি? এরা শুনলে হৈ-চৈ করে উঠবে– কিন্তু সেখানে কান্তির একরাশ কাপড়জামা পড়ে রয়েছে– মিছিমিছি নষ্ট হবে বৈ তো নয়। ঠিকানাটা পেলে আমি মনমন কাজে একটা চিঠি লিখে দেব, কাউকে দিয়ে তারা পাঠিয়ে দেবে।
বুড়ো কথাটা বুঝল। নিতান্তই স্বাভাবিক এটা তার দিদিমার পক্ষে। তবে সে পারবে না, অন্য ব্যবস্থা করবে। সেই কথাই বলল, ‘না দিদিমা, আমার কম্ম নয় ওসব। তবে কথাটা বার করে নেব। বুঁচি আছে মেজকাকীর পেয়ারের মন্ত্রী, তাকেই বলব। বরং তোমার নাম করেই বলব।’
তাই বলিস। আর ঠিকানাটা পেলে আমাকে দিয়ে যাস। লক্ষ্মী দাদা আমার, তবে দেখিস, এরা না কেউ টের পায়।’
‘ঠিক আছে, সে তুমি কিছু ভেবো নি।’আশ্বাস দিয়ে চলে যায় বুড়ো অর্থাৎ বিষ্ণুপদ।
অবশ্য বুড়োর বুদ্ধিতে কাজও হয়। দু দিন পরেই হাসতে হাসতে ঠিকানাটা এনে দিয়ে যায়।’মেজকাকীও জানত না ঠিক– মেজকাকার কাছ থেকে জেনে দিয়েছে। বাব্বা, ও কি আমাদের কাজ। বুঁচি বলেই পেরেছে!’
বুড়োকে দিয়েই একখানা দু-পয়সার খাম আনিয়ে নিলেন শ্যামা। তারপর অনেক দিন পরে সীতার খাতা থেকে এখখানা কাগজ যোগাড় করে চিঠি লিখতে বসলেন। সবাইকে বাঁচিয়ে আড়ালেই লিখতে হল– সেজন্যে দুদিন সময় লাগল তাঁর চিঠি শেষ করতে। বহুদিনের অনভ্যাস, কলমও সরতে চায় না। দেরি হওয়ার সে-ও একটা কারণ।
শ্যামা লিখলেন,
‘কল্যাণীয়াসু,
তোমার কল্যাণ কোন-ক্রমেই আমার কাম্য নয়, তবে অন্য পাঠ খুঁজিয়া না পাইয়াই এই পাঠ দিলাম। কল্যাণ কামনা তো দূরের কথা, তোমাকে নিত্য অভিসম্পাৎ না দিয়া আমি জল খাই না। তোমার অনিষ্টই এখন আমার একমাত্র কাম্য। কারণ বিশ্বাস করিয়া তোমার কাছে আমার গর্বের সেরা সন্তানটি গচ্ছিত রাখিয়াছিলাম, তুমি দয়া করিয়া একটু যদি মানুষ করিয়া দাও এই আশায়– তুমি চরম বিশ্বাস-ঘাতকতা করিয়া আমার সর্বনাশ করিয়াছ। এমন স্থানেই তাহাকে পাঠাইয়াছিলে যে কমাসেই বাছার আমার জীবনসংশয় ঘটিয়া গেল। দুর্দান্ত ম্যালেরিয়ায় মৃতপ্রায় হইয়া জীবনের আশায় জলাঞ্জলি দিয়া পড়িয়া ছিল, একজন অপরিচিত লোক দয়াপরবশ হইয়া পৌঁছাইয়া দিয়া গেলেন বলিয়া তবু প্রাণটা বাঁচিল। তাও অনেক কষ্টে, অনেক অর্থ ব্যয় করিয়া। বহু রাত জাগিয়া শুশ্রূষা করিতে হইয়াছিল, দশ- বারোদিন পর্যন্ত জীবনের কোন আশা ছিল না। প্রাণ যদি বা বাঁচিল চিরদিনের মতো পঙ্গু অক্ষম হইয়া গেল। শুনিয়া বোধ হয় সুখী হইবে– চিরদিনের মতো তাহার দুটি কান কালা হইয়া গিয়াছে। সাধারণ কালা নয়, বদ্ধ কালা। এখন কানের কাছে ঢাক বাজিলেও শুনিতে পায় না। আমরা ভিখারী, তবু ভিক্ষা দুঃখ করিয়াই বড় বড় ডাক্তার দেখাইয়াছি, চিকিৎসারও কোন ত্রুটি হয় নাই, কিন্তু ডাক্তাররা বলিতেছেন ও কান আর ভাল হইবে না। কোনদিনই না। সাংঘাতিক ম্যালেরিয়ার বিষেই উহার কানটি নষ্ট হইয়া গিয়াছে। এখন সে কী করিয়া খাইবে বলিতে পারো? পথের ধারে বসিয়া ভিক্ষা করা ছাড়া তো আর কোন উপায় রহিল না। মা, একটা কথা তোমাকে দুই হাত জোড় করিয়া জিজ্ঞাসা করিতেছি– আমরা তোমার কী অনিষ্ট করিয়াছিলাম যে তুমি বা তোমরা আমার এত বড় অনিষ্টটা করিলে? সাহায্য প্রার্থন করিয়াছিলাম– না পারিলে সোজাসুজি বলিয়া দিলে না কেন? সে নাকি বিগড়াইয়া গিয়াছিল– তোমরা বলিয়াছ, (সেও তো তোমার দায়িত্ব!) সেক্ষেত্রে আমাদের কাছেই পাঠাইয়া দিলে না কেন? আমাদের ছেলে আমরা বুঝিতাম। তাহাকে সাক্ষাৎ যমপুরীতে পাঠাইবার তোমার কী অধিকার ছিল? এই রহস্যটা যদি খোলসা করিয়া জানাও, এক্ষণে তবু মনকে একটা সান্ত্বনা দিতে পারি। আশা করি এ জবাব চাহিবার আমার সম্যক অধিকার আছে! পরিশেষে আবারও জানাই, সন্তোষজনক জবাব না পাওয়া পর্যন্ত নিত্য অভিশাপ দিব, তুমিও যেন এমনি করিয়া সকল ভালোর মাথা খাইয়া বসিয়া থাক। ইতি–
কান্তির মা।’
বহুকাল পরে লিখতে বসা। হাতের লেখা এককালে মুক্তোর মত ছিল– এখন এঁকেবেঁকে বিশ্রী হয়ে গেল। বিস্তর বানান ভুলও হল নিশ্চয়ই। তবু পড়ার কোনও অসুবিধা হবে মনে হল না। শ্যামা চিঠিখানা খামে এঁটে ঠিকানা লিখে দুপুরের দিকে নিজে সিদ্ধেশ্বরীতলার কাছে ডাকবাক্সে ফেলে দিয়ে এলেন।
জবাব পাবেন আশা করেন নি। প্রধানত গায়ের ঝাল মেটাতেই চিঠিটা লেখা। তবু দুদিন পর থেকেই একটু উৎসুক হয়ে দুপুরের দিকটায় বাইরের বাগানে ঘুরতে লাগলেন। ঐ সময় পিওন যায় প্রত্যহ এই পথ দিয়ে। যদিই চিঠি আসে, তার হাতেই পড়া বাঞ্ছনীয়। বৌমা কি কান্তির হাতে পড়লে অনেক ঝামেলা। কৈফিয়ৎ দিতে হবে বিস্তর। এখনকার ছেলেমেয়েদের আবার বড় বেশি ভদ্রতাজ্ঞান। যে আমার মন্দ করেছে তাকে দু-কথা শোনাব– এতেও ওঁদের ভদ্রতায় বাধে।
জবাব ডাকে এল না অবশ্য। তবে জবাব পেলেন শ্যামা।
অপ্রত্যাশিতভাবে। অচিন্তিত পথ দিয়ে এসে পৌঁছল।
চিরদিনের ভগ্নদূত মহাশ্বেতাই নিয়ে এল সে জবাব, প্রায় ছুটতে ছুটতে এসে খবরটা দিল সে।’আর শুনেছ ব্যাওরাটা। রতন গো রতন, আমার মামাতো ননদ, গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে পরশুদিন। কাল ইনি শুনে এসেছেন। পুলিশ-হাঙ্গামার কাণ্ড তো– সবাইকেই জানিয়েছে তাই, যে যেখানে আছে আপ্ত-স্বজন।’
‘গলায় দড়ি দিয়েছে! সে কি?’ আড়ষ্ট কণ্ঠে কোনমতে প্রশ্ন করেন শ্যামা।
‘হ্যাঁ গো। ঠিক দুপুর বেলা। নিজেরই শাড়ি কড়িকাঠের সঙ্গে বেঁধে এই কাণ্ড করে বসে আছে মেয়ে। কেউ জানে নি, কেউ টের পায় নি, এমন চুপিসারে কাজ সেরেছে। সন্ধ্যে হয়ে যায় তবু দোর খোলে না, ঘর থেকে বেরোয় না, এতেই সন্দ হতে দোর ভেঙ্গে ঘরে ঢুকে দেখে ঐ কাণ্ড। চিঠি লিখে গেছে নাকি– কারুর হাত নেই এতে, নিজের পাপের প্রাচিত্তির করতে আমি মরছি!… এমন ঘর-বাড়ি, এত পয়সা, সুখের জীবন, দ্যাখো দিকি বাপু! কী যে হল। তোমারই শাপমন্যি ফলল আর কি। যা গালটা দিলে কদিন ধরে ছড়া কাটিয়ে, এত কি সহ্য হয়! তোমার বাপু কথা বড্ড ফলেও যায়, কালমুখের বাণী।….. বলে কে যেন একখানা চিঠি দিয়েছিল দুদিন আগে, সেই চিঠি পেয়ে এস্তক মন ভার করে ছিল, খায় নি দায় নি কিছু করে নি দুদিন। সে চিঠিও পাওয়া যায় নি– তাহলে তবু একটা কিনারা হত যে কেন এ কাজ করলে। কে যে বাপু এমন শত্তুরতা করে চিঠি দিলে! কী লিখেছিল কে জানে, এমন কে চিঠি দিলে ওকে যে আপ্তঘাতী হতে হল!’
বকেই যায় মহাশ্বেতা আপনমনে, ওর অভ্যাসমতো।
কিন্তু শ্যামা যেন আর শুনতে পারেন না। তাঁর দু কান যেন পুড়িয়ে দেয় কে। বুকের মধ্যে নিঃশ্বাস যেন আটকে আসে।
অভিশাপ দিয়েছিলেন সত্য কথা– কিন্তু এ রকম তো তিনি চান নি। ঈশ্বর জানেন এমন শোচনীয় মৃত্যুর কথা তিনি কখনও চিন্তা করেন নি।
এমন হবে জানলে ও চিঠি কখনই দিতেন না তিনি। যদি মেজবৌয়ের মনে পড়ে, যদি সন্দেহ করে যে তাঁর চিঠিতেই এই কাজ করেছে রতন তো তিনি ওদের কাছে মুখ দেখাবেন কী করে?
আর তা ছাড়া– আজ যত বড় অনিষ্টই করে থাক সে– অনেক উপকারও করেছে, কান্তিকে যে যথার্থই ভালবাসত, তাতে তো কোন সন্দেহ নেই। তার এমন ভয়াবহ পরিণতি– কোন অন্ধ ক্রোধের বশেও কখনও কল্পনা করেন নি। ছি ছি, কী করল হতভাগী। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা দিয়ে গেল তাঁকেই!
শ্যামা নির্জনে বার বার নিজের ইষ্টের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগলেন। পরলোকে গিয়ে যেন হতভাগিনী শান্তি পায় একটু– সেখানে না আবার এই আত্মহত্যার শাস্তি বইতে হয় তাকে।
‘ঠাকুর তাকে মাপ করো, তাকে তোমার কাছে টেনে নাও।’
॥২॥
মহাশ্বেতার ইচ্ছে ছিল কান্তিকেও খবরটা দিয়ে যায়। বোধ করি পেট ফুলছিল তার তখনও। তাই শ্যামা যখন সেখান থেকে উঠে একরকম ছুটেই পিছন দিকের বাগানে চলে গেলেন নিজেকে সামলাতে– মহাশ্বেতা খুঁজে খুঁজে কান্তিকে বারও করেছিল।
‘ঐ, শুনছিস! তোর সেই তিনি রে– তোর রতনদি যে ঘোঙা উল্টেছেন। অক্কা পেয়েছে।… আ-মর চেয়ে আছে দ্যাকো কেমন করে– রতনদি তোর, রতন, আমার সেই ননদ মরে গেছে, বুঝলি? এই– গলায় দড়ি বেঁধে ঝুলছে। মা মানুষটি তো আমার সহজ নয়– মার গাল সহ্য করতে পারবে কেন? হাতে হাতে পলে গেল ওর শাপ! বাব্বা, মনে হলেও ভয় করে।’
যৎপরোনাস্তি চেঁচিয়েই বলেছিল মহাশ্বেতা, কিন্তু কান্তির কানে তাও পৌঁছবার, কথা নয়। সে তেমনি করুণ অসহায় ভাবে চেয়ে বললে, ‘কিচ্ছু বুঝতে পরছি না কী বলছ। কার কথা বলছ! কার কী হয়েছে? একটু লিখে দেবে?’
দূর হ কালার ডিম। এক জ্বালা হয়েছে কালাকে নিয়ে। আমি তোদের মতো লিখতে পড়তে পারি কি না, যে লিখে দেব। বলে কবে সেই দাগা বুলিয়েছিলুম দিনকতক, এখনও তা নাকি মনে আছে। আদ্দেক বানান জানি না।….. শোন যা বলছি, আমার মুখের দিকে তাকা। তবু চেয়ে থাকে দ্যাখো বোকার মতো–’
আরও ভাল করে জিনিসটা বুঝিয়ে দেবার হয়ত চেষ্টা করত কিন্তু ইতিমধ্যে হাঁকাহাঁকিতে আকৃষ্ট হয়ে কনক এসে পড়ল। সে ভেতরের কথা কিছুই জানতে পারে নি বটে, তবে এটা সে তার সহজ সহানুভূতি দিয়ে বেশ বুঝেছে যে, কান্তির এই দুর্গতির জন্য রতন যতই দায়ী হোক, কান্তির তার প্রতি এখনও যথেষ্ট টান আছে। কারণ এতদিনের এত কথার মধ্যেও ওর মুখ দিয়ে একটি দিনের জন্যেও রতনের বিরুদ্ধে কোন নালিশ উচ্চারিত হয় নি। হয়ত এককালে প্রচুর স্নেহ পেয়েছে তার কাছ থেকে বলেই– কৃতজ্ঞতাটা ভুলতে পারে নি, অথবা ওর এই অনিষ্টের মূলে রতনের সত্যিই তেমন কোন হাত ছিল না,- কারণ যা-ই হোক, কান্তি মনে মনে আজও রতনকে স্নেহ বা শ্রদ্ধা করে। সুতরাং হঠাৎ এত বড় খবরটা পেলে দুর্বল শরীর আরও ভেঙ্গে পড়বে।
সে ব্যস্ত হয়ে এসে মহাশ্বেতার হাত ধরে একরকম টেনেই বাইরে নিয়ে গেল।
‘ও কী করছিলেন ঠাকুরঝি, ওকে কি এখন এই খবর দেয়! এখনও ভাল করে সেরে উঠতে পারে নি, রোগা শরীর, –এখন এত বড় আঘাত সইতে পারবে কেন?’
‘নে বাপু, তোদের আদিখ্যেতা দেখলে আর প্রাণ বাঁচে না। এখনও কি তার ওপর এত টান এত ছেদ্দা-ভক্তি আছে ওর যে একেবারে বুক ফেটে যাবে! সে মাগী তো ওকে মেরে ফেলতেই বসেছিল! মা কি মন্যিটা দিত অমনি অমনি!’
‘তাই বলে কি এতদিনের ছেদ্দা-ভক্তি একদিনেই উবে যায়! এত বছর ধরে এত যত্ন করেছে, সে-সব একদিনেই ভুলে যাবে? অন্তরের টান থাকবে না একটা!’
‘জানি নে বাপু! তোদের কথার ধাঁচধরন বুঝতে পারি না। বলে– যে দিয়েছে মনে ব্যথা তার সঙ্গে আমার কিসের কথা, তবু যদি কই কথা ঘুচবে না মোর মনের ব্যথা!’
গজগজ করতে করতে মহাশ্বেতা চলে যায়।
কিন্তু ঐ ভাবে তাকে টেনে আনতে কান্তির মনে একটা খটকা লাগে। সে কনকের কাছে এসে বলে, ‘কী হয়েছে বৌদি, বড়দি কী বলছিল। কেউ মরেছে? কার কথা বলছিল? গলা দেখাচ্ছিল–!’
ঠোঁটের ভঙ্গি ক’রে কনক বুঝিয়ে দেয়, ‘ও কিছু না। ওর কে এক পাড়ার লোক মরেছে!’ কান্তি চুপ করে যায়– কিন্তু মনের খট্কাটা যে দূর হয় না সেটা তার মুখ দেখেই বুঝতে পারে কনক।
পরের দিন দুপুরে আবার এসে কনককে ধরে সে। এদিক-ওদিক চেয়ে চুপিচুপি বলে, ‘একটা কথা বলব বৌদি, কাউকে বলবে না?– লক্ষ্মীটি, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, না বলে আমি থাকতে পারছি না!’
কনকের মুখ শুকিয়ে ওঠে। তবুও বলতে হয়, ‘বলো না কী বলবে! কী এমন কথা?’
বলবার আগেই কান্তির মুখ লাল হয়ে উঠে। মাথা নিচু করে খুব চুপি-চুপি বলে, ‘এর মধ্যে– এর মধ্যে তোমরা রতনদির কোন খবর পাও নি?’ আটকে আটকে যাচ্ছিল কথাগুলো। বিশেষ করে রতনদির নামটা। কোনমতে যেন মরিয়া হয়েই শেষ পর্যন্ত উচ্চারণ করল।
যা আশঙ্কা করেছিল তাই। হয় ডাহা মিথ্যে বলতে হয়, নয় তো সত্যটা স্বীকার করতে হয়। তবু পাশ কাটাবার জন্যে পালটা প্রশ্ন করল কনক, ‘কেন বলো তো?’
আবারও মুখ নিচু করল কান্তি। রান্নাঘরের মাটির মেঝেতে নখ দিয়ে দাগ কাটতে কাটতে বলল, ‘কাল রাত্রে বড় বিশ্রী স্বপ্ন দেখেছি। যেন ছেঁড়া-ময়লা একটা কাপড় পরা, গলায় একটা কাটা দাগ– এসে আমার কাছে হাত জোড় করে কী চাইছে। কী যে চাইছে তা বুঝতে পারলুম না। সেই যে ঘুম ভেঙ্গে গেল, আর ঘুম এল না। রতনদির কিছু হয়েছে– হ্যাঁ বৌদি? লক্ষ্মীটি, আমার কাছে গোপন করো না, সে– বেঁচে আছে তো!’
একেবারে নির্জলা মিথ্যাটা মুখে আটকায় বৈ কি!
কনক মাথা নিচু করল এবার।
কান্তির গলাটা যেন একেবারে ভেঙ্গে এল। সে স্খলিত কণ্ঠে একেবারে ফিসফিস করে বলল, ‘তাই বুঝি কাল বড়দি বলতে এসেছিল? কেউ কেউ খুন করেছে বুঝি তাকে? গলা কেটে দিয়েছে?’
কনক ঘাড় নাড়ল। ইঙ্গিতে দেখাল যে গলায় দড়ি দিয়েছে রতন।
চুপ করে গেল কান্তি। শুধু আবার দুই চোখ দিয়ে তার এতদিন পরে অশ্রুর বন্যা নামল। এর পর দুটো দিন তার যে যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে কাটল তা কনক ছাড়া পুরোটা কেউ বুঝতে পারল না। ঠিক এইটেই আশঙ্কা করেছিল সে। যদি বেচারা প্রাণ খুলে কাঁদতেও পারত তো হয়ত আঘাতের তীব্রতা অতটা লাগত না। কিন্তু ভয়ে ভয়ে দাদা বা মার সামনে সে চোখের জলও ফেলতে পারত না। কে জানে অপরাধিনীর জন্যে চোখের জল ফেললে যদি এঁরা রাগ করেন? ঠিক সেই কারণেই তাকে প্রতিদিনের কাজগুলো স্বাভাবিক ভাবেই করে যেতে হ’ত– অন্তত চেষ্টা করতে হত। ভাতের সামনে গিয়েও বসতে হত, যদিও খেতে পারত না প্রায় একগালও! প্রথম দিন রাতে ইচ্ছে করেই হেমের সঙ্গে তাকে খেতে দেয় নি কনক, হেমের প্রশ্নের উত্তরে ‘আমার সঙ্গে খাবে’ বলে কাটিয়ে দিয়েছিল। মা’রও সেদিন একাদশী, ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়েছেন। তা নইলে বিস্তর বকুনি খেতে হ’ত ওকে। ভাত কমই দিয়েছিল কিন্তু তাও খেতে পারল না সে– দুএক গ্রাস নাড়াচাড়া করে কনকের চোখে চোখে পড়তেই কে’দে ফেলল। ইঙ্গিতে আশ্বস্ত ক’রে কনক তাকে চুপ করে বসে থাকতে বলল, তারপর নিজের খাওয়া হতে নিঃশব্দে ভাতসুদ্ধ থালাটা নিয়ে পুকুরে চলে গেল।
পরের দিন কিন্তু আর চেপে রাখা গেল না। তবে বিচিত্র কারণে শ্যামা খুব একটা বকাবকি করলেন না। শুধু কনককে প্রশ্ন করলেন একবার, ‘খবরটা ও শুনেছে বুঝি বৌমা? মহাই বুঝি এই উপকারটি করে গেলেন আমার?’
কিন্তু শ্যামা বকাবকি না করলেও দুদিনেই আবার কান্তির যা চেহারা হয়ে গেল, তা দেখে ভয় পাবারই কথা। কনক তো বটেই– শ্যামাও চিন্তিত হয়ে উঠলেন। শ্যামা যে এতটা সহানুভূতির চোখে ব্যাপারটা দেখবেন তা আশা করে নি কনক, সে ভরসা পেয়ে বলল, ‘কী হবে মা– আবার একটা কিছু ভারী অসুখ-বিসুখ হবে না তো গুমরে গুমরে!’
‘কী জানি মা, কিছুই তো বুঝতে পারছি না। একটা কিছু কাজের মধ্যে থাকলেও বা যা হয় হ’ত–শুধু শুধু চুপ করে বসে থাকা– এই যে হয়েছে আরও কাল!’
‘ওকে ওকে কোথাও দু-একদিনের জন্যে পাঠালে হ’ত না?’
কোথায় পাঠাব বলো। উমার কাছে একটা রাত্তিরও কাটাবার জায়গা নেই, পাঠাতে গেলে এক বড়দির কাছে। তা কালা-মানুষ কিছুই শোনে না– কলকাতায় গাড়ি-ঘোড়ার পথ, ছাড়তে ইচ্ছে করে না। আরও, কলকাতায় গেলে–ঐসব কথা বেশি ক’রে মনে পড়বে হয়ত!’
সুতরাং কোন মীমাংসাই হয় না। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে ওকে বাঁচিয়ে দেয় উমাই।
তৃতীয় দিনে ডাকে একটা চিঠি আসে কান্তিরই নামে। উমা ওকে বিস্তর সান্ত্বনা ও সাহস দিয়ে লিখেছে–
‘তুমি কোন কারণেই হতাশ হইও না–বা হাল ছাড়িয়া দিও না। মেয়েদের পড়ার বইতে অনেক অনেক জীবনী নিত্যই পড়িতেছি, তোমার অপেক্ষা গুরুতর রকমের অঙ্গহীন লোকও পৃথিবীতে বহু বড় বড় কাজ করিয়া কীর্তি রাখিয়া গিয়াছেন। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দাও যে হাত-পা বা ঐ ধরনের কোন অঙ্গ যায় নাই। আমি বলি কি, তুমি আবার পড়াশুনাতেই মন দাও। ফার্স্ট ক্লাস অবধি পড়িয়াছিলে মোটামুটি অনেকটা জানাই আছে। এখন বই দেখিয়া নিজেই পড়িতে পারিবে। এখন তো লিখিত পরীক্ষা–কানে শুনিবার কোন প্রয়োজন হয় না। তুমি বরং ওখানকার ইস্কুল হইতে, বা যেসব বই তুমি পড়িতে, মনে করিয়া পুস্তকের তালিকা করিয়া আমাকে দাদার মারফৎ বা ডাকে পাঠইয়া দাও, আমি আমার ছাত্রীদের বাড়ি হইতে যতটা পারি যোগাড় করিয়া দিব, বাকিগুলি তোমার মোসোমশায় কিনিয়া দিবেন। তুমি আর এক দিনও সময় নষ্ট না করিয়া কাজে লাগিয়া যাও।’
উমার এই চিঠিখানাই যেন দশ বোতল টনিকের কাজ করল। কান্তির মুখ-চোখের চেহারা ফিরে গেল দুদিনে। রতনের শোকটাও এই প্রবল উৎসাহের বন্যায় অনেকটা দূরে চলে গেল। এক আধবার–বিশেষত সন্ধ্যার সময়টা–একটু উন্মনা হয়ে উঠত, একটা দীর্ঘনিঃশ্বাসও হয়ত ফেলত কিংবা দূর শূন্যে চেয়ে চোখ দুটো উঠত ছলছল ক’রে–কিন্তু সেই গুম হয়ে বসে থাকা বা শুকিয়ে ওঠাটা একেবারে চলে গেল। সে সেইদিনই বসে বসে একটা বইয়ের ফর্দ করে দাদার হাতে দিয়ে দিলে ছোটমাসীকে দেবার জন্যে। তারপর খুঁজে খুঁজে সীতার দরুন বালির কাগজের খাতাটা বার ক’রে তারই দোয়াত কলম নিয়ে লিখতে বসল। যে ইংরেজি প্রবন্ধগুলো তার তৈরি করা ছিল, সেইগুলোই নতুন ক’রে লিখে মিলিয়ে নিতে লাগল। অর্থাৎ নতুন উৎসাহ এসেছে জীবনে–হতাশ ভাবটা অনেকখানি কেটে গেছে। এরাও নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচল এবার।
দিন পাঁচ-সাত পরেই ছোটমাসী একদফায় কতকগুলো বই পাঠিয়ে দিলেন। হেম ইতিমধ্যে ওর অফিস থেকে রেলের কখানা বাঁধানো খাতা এনে দিয়েছিল–অঙ্ক কষা ও অন্য সব লেখার জন্যে। এ তো আর ইস্কুলে দেখাতে হবে না–মিছিমিছি সাদা খাতা কিনে পয়সা নষ্ট করার প্রযোজন কি! তাতে অবশ্য কান্তিরও কোন আপত্তি নেই। সে এবার দ্বিগুণ উৎসাহের সঙ্গে নিয়মিত পড়াশুনো শুরু করল। অনেকটাই সহজ হয়ে এসেছে সে। শুধু ওর এই একেবারে কালা হয়ে যাওয়াটা এদের এখনও অভ্যাস হয় নি বলে এদেরই একটু অসুবিধা হচ্ছে। পেছন ফিরলে আর কোনমতেই ডাকার উপায় নেই। সামনে ফিরে থাকলে হাতপায়ের ভঙ্গি ক’রে ঠোঁট নেড়ে তবু কাজ চলে। অন্যদিকে ফিরে থাকলে গায়ে হাত দিয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। নয়ত ঘুরে গিয়ে চোখের সামনে দাঁড়াতে হয়–কি ঘাড় হেঁট করে থাকলে, একটা হাত ওর চোখের সামনে ঘুরিয়ে মাথা তোলবার ইঙ্গিত জানাতে হয়।
এইসব দেখে হেম মধ্যে মধ্যে হতাশ হয়ে পড়ে। মাকে বলে, ‘পড়ছে তো, প্রাইভেটে একজামিন দিয়ে পাসও হয়ত করতে পারবে কিন্তু কোন কাজ হবে কি তাতে? ও যে কোথাও চাকরি পাবে বলে তো মনে হয় না। কে দেবে ওকে কাজ? যে মাইনে দেবে সে এত দিকদারি সহ্য করবে কেন?…যা দেখছি ষাঁড়ের নাদ হয়েই ওকে জীবন কাটাতে হবে।’
শ্যামা চুপ ক’রে থাকেন। তিনি হেমের সঙ্গে একমত হ’তে পারেন না। মধ্যে মধ্যে তিনিও যে একটা হিম হতাশা বোধ করেন না তা নয়–কিন্তু ঠিক এতখানি অন্ধকার ভবিষ্যৎ মেনে নিতে তাঁর মন চায় না। এ ছেলের ওপর যে অনেকখানি ভরসা ছিল তাঁর। সে আশার প্রাসাদ একেবারে ধূলিসাৎ হলে তিনি দাঁড়ান কোথায়? তাই কতকটা নিজের গরজেই একটা ক্ষীণ আশা আঁকড়ে ধরে থাকেন। একটা কি কিছু উপায় হবে না, ভগবান কি এতটা অবিচার করবেন? তবে যে লোকে বলে ‘জীব দিয়েছেন যিনি, আহার দেবেন তিনি’–সে কি মিছে কথা? শুধুই কথার কথা? তাঁর জীবনে তিনি যেভাবে দাঁড়িয়েছেন সে কথা ভেবেও বল পান অনেকটা। আবার এমনও একটা ক্ষীণ আশা মনে মনে উঁকি দেয়–ভালও তো হয়ে যেতে পারে, যেমন হঠাৎ কালা হয়ে গেছে তেমনি হঠাৎই আবার হয়ত শুনতে আরম্ভ করবে। অনেক সময় দৈব ওষুধেও কাজ হয়। একবার তাই না হয় যাবেন মঙ্গলার কাছেই। তাঁর অনেক জানাশুনো আছে–যদি তেমন কোন ওষুধ-বিষুধের সন্ধান দিতে পারেন তিনি।
ছেলের মুখে চোখে নতুন উৎসাহের দীপ্তি জেগেছে, তার আলোও খানিকটা তাঁর মনে এসে পড়ে। হবেই একটা উপায়, যা হোক ক’রে। ভগবান কোন মতে একটা পথ দেখিয়ে দেবেনই।
।।৩।।
এর মধ্যে আর একটা প্রবল আঘাত এসে পড়ল কান্তির মনে। তার থিতিয়ে-আসা স্মৃতির সরোবরে নতুন ক’রে আলোড়ন জাগল। সে আঘাত বহন ক’রে নিয়ে এল একেবারেই অপ্রত্যাশিত একটি মানুষ–মোক্ষদা, রতনের ঝি।
তখন বেলা তিনটে হবে। কান্তি বাইরের ঘরে পড়াশুনো করছে, শ্যামা সেইখানেই বারান্দায় বসে পাতা চাঁচছেন। হঠাৎ বাগানের বেড়ার আগড় ঠেলে একটি অপরিচিত মধ্যবয়সী স্ত্রীলোককে ঢুকতে দেখে অবাক হয়ে গেলেন তিনি। যে এসেছে সে এখানকার কেউ নয়। এখানকার সম্ভ্রান্ত ভদ্রপরিবারেও বিধবা মেয়েরা সাধারণত ক্ষারে-কাঁচা কাপড় পরে। এর পরনে পরিষ্কার বাসিধোপ-করা নরুনপাড় ধুতি। অথচ চালচলন দেখলে ঝি বলেই মনে হয়–বা ঐ শ্রেণীর কেউ। কলকাতা শহরের কোন বড়মানুষের বাড়ির ঝি হবে হয়ত।
আর একটু কাছে আসতে শ্যামা তীক্ষ্ণ কণ্ঠেই প্রশ্ন করলেন, ‘কে গা বাছা–চিনতে পারছি না তো! কোথা থেকে আসছ?’
যে আসছিল সে তখনই জবাব দিল না। কাছে এসে সিঁড়ি দিয়ে দুটো ধাপ উঠে রকের প্রান্তে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম ক’রে বলল, ‘বলছি মা। একটু বসি আগে–দম নিই।’
তারপর অনিমন্ত্রিত ভাবেই রকের ওপর জেঁকে বসে বলল, ‘আপনি তো কান্তি দাদাবাবুর মা? এটাই তো তাঁদের বাড়ি?’
কান্তি দাদাবাবুর মা!
বিদ্যুৎবেগে মনে পড়ে যায় কথাটা। এক রতন বা তাদের বাড়ির কোন লোক ছাড়া এ পরিচয় ধরে কেউ খোঁজ করবে না। এ নিশ্চয় মোক্ষদা। এর কথা বহু গল্প করেছে কান্তি। মহাশ্বেতাও।
মোক্ষদা পাকা লোক! সে ওঁর মুখের রেখা দেখেই বুঝতে পারল যে তিনি ভাবছেন। ঘাড় নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ মা, আমি মোক্ষদা। অতন দিদিমণিদের বাড়ির ঝি
অপ্রসন্ন হয়ে উঠল শ্যামার মুখ। ওদের কথা তিনি সর্বতোভাবেই ভুলতে চাইছেন প্রাণপণে। আবার মনে করাতে এল কেন মিছিমিছি!
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আর একটা কথাও মনে হ’ল–যে রহস্যটা কিছুতেই এতকাল আবিষ্কার করা যা নি–কান্তিকে বার বার নানাভাবে জেরা করেও জানা যায় নি–সেইটেই হয়ত এবার পরিষ্কার হ’তে পারে।
তবু তিনি বিরস কণ্ঠেই বললেন, ‘তা তুমি আবার কী মনে ক’রে বাছা? তোমাদের দিয়ে তো আমার ঢের উপকার হয়েছে–আর কেন? আরও কী তোমাদের অভিরুচি আছে– তাই শুনি! অনেকটাই তো সেরে এনেছিলেন তোমার মনিবরা–বাকি তো শুধু চামড়া আর হাড় কখানা। তুমি বুঝি এবার সেটুকুও সেরে যেতে এসেছ? ঐ যে বলে–হাড় খাব মাংস খাব চামড়া নিয়ে ডুগডুগি বাজাব, তা সেই শেষের কাজটুকু সারতে এসেছ বুঝি!’
অকস্মাৎ মোক্ষদা ঠাঁই ঠাঁই করে দুহাতে নিজের দু-গালে চড়াতে লাগল।
‘এই! এই! আমার প্রাচিত্তির এই! নিত্যি নিজে হাতে নিজেকে প্রেহার করছি মা, দিন আত্তির। তাই তাতেই কি প্রাচিত্তির হবে? হবে না, নরকেও ঠাঁই হবে না আমার! মহাপাতক করেছি মা, নিজের হাতে গু গুলে খেয়েছি। তবে হ্যাঁ–তার সাজাও পেয়েছি হাতে হাতে। ঠাকুর আর আত পোয়াবার নেগে তুলে আকে নি–সদ্য সদ্য শোধ দে দিয়েছে। আমার মনিব সাক্ষাত রন্নপূর্ণো, তাকে আমিই তো বলতে গেলে মেরে ফেনুগা! য্যাদ্দিন বাঁচত কখনও কোন অভাব থাকত নি। যা চেয়েছি চেরকাল তাই দিয়েছে। একটি দিনের জন্যে না বলে নি কখনও। বলি মেয়ে-জামায়ের গুষ্টিসুদ্দু পালছিনু ঐ খুঁটির জোরেই তো গা! একেবারে ধনে- পরানে মেরে রেখে গেল! আর তার মূল হনু এই আমি–আক্কুশী শতেকক্ষোয়ারী!’
কৌতূহল অসম্বরণীয় হয়ে ওঠে। উত্তেজনাও বোধ করেন শ্যামা। সুগভীর রহস্যের বুঝি আজ তল মিলল। এতদিনের কৃষ্ণ যবনিকা বুঝি অপসারিত হ’ল চোখের সামনে থেকে। তবু যথাসাধ্য বাহ্যিক নিস্পৃহতা রক্ষা করে বসে থাকেন। ওকেই বলবার সুযোগ দেন আরও।
ঘরের মধ্যে থেকে কান্তিও দেখেছে মোক্ষদাকে। কাঠ হয়ে গেছে সে ওকে দেখে বাইরে এসে লাভ নেই, কিছুই শুনত পাবে না সে–তাছাড়া, তা ছাড়া কী জন্যে কী বলতে এসেছে ও–কে জানে! এতদিন এত যত্নে যে কলঙ্ক ঢেকে রেখেছিল, সেই কলঙ্কই বুঝি সকলের সামনে খুলে দিতে এসেছে ও। বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করতে থাকে তার। ইচ্ছা হয় ছুটে পালিয়ে যায় কোথাও।–চিরকালের মতো। রতনদিই চালাক, মরে বেঁচেছে। কান্তিরও যদি সে সাহস থাকত!
মোক্ষদা দম নেবার জন্যে একটু থেমেছিল; একটু পরে বলল, ‘তা হ্যাঁ মা, আপনি শোন নি আমাদের দিদিমণি গলায় দড়ি দেচে?’
অকারণেই কানের কাছটা কেমন গরম হয়ে ওঠে শ্যামার। তিনি ঘাড় নেড়ে শুধু জানান যে শুনেছেন।
‘তা কিসের জন্যে, কেন–সে বিত্তান্ত কিছু শোন নি আপনি? আমাদের কান্তি দাদাবাবু কিছু বলেনি আপনাকে?
‘বলবার কি হাল ছিল তার!’ ঝেঁঝে ওঠেন শ্যামা, ‘সে তো মরা এসে পৌঁছল বলতে গেলে। তাকে তো যমের মুখ থেকে ফিরিয়ে আনতে হয়েছে। সে কী বলবে? তার কিছু হুঁশপ ছিল। এখন তো কথাই নেই–দু কান কালা হয়ে বসে আছে–দুনিয়ায় এত শব্দ তা একটাও কানে যায় না তার। জবু-থবু জন্তু হয়ে গেছে একেবারে। তাকে জিগ্যেসই বা করবে কে? আমরা মানুষ তো–গণ্ডার তো আর নই। ঘেন্না-পিত্তির মাথা খেয়েও বসে নেই।’
মুখে সমবেদনাসূচক চুকচুক শব্দ ক’রে মোক্ষদা বলে, ‘আহা রে! কানে একেবারে শুনতে পায় না? তাহলে বদ্ধ কালা হয়ে গেছে বলো! ইস্! কী ছেলের কী হাল। রমন আজপুত্তুরের মতো ছেলে–কী বলছ মা!’
‘সত্যি বলছি কি মিথ্যে বলছি দেখে যাও না বাছা। চক্ষু-কর্ণের বিবাদভঞ্জন ক’রেই যাও না। এই ঘরেই তো আছে!’
‘না মা থাক। বাপরে, এ মুখ আর তাকে দেখাতে পারব নি। এ কালামুখীর পাপের কি শেষ আছে মা! যত শুনতিছি তত বুকের মধ্যেটা হিম হয়ে যাচ্ছে। বলি এসবই তো তোলা থাকতেছে গো। এর শেষ কি রমনি উঠবে!’
এবার শ্যামা আর থাকতে পারেন না, সোজাসুজি প্রশ্ন করেন, ‘তা কী হয়েছিল বাছা একটু শুনতে পাই না? কী এমন করেছিল ও, যে, এত বড় শাস্তিটা তোমরা দিলে?’
মোক্ষদা মাথা নামাল এবার। আঁচলের প্রান্তে বাঁধা গুলের কৌটোটা খুলে হাতে নিয়েছিল, সেটাও বাঁ-হাতে ধরা রইল। কৌটো খুলে গুলটুকু মুখে দেবারও যেন উৎসাহ রইল না তার। হেঁট মুখে কিছুক্ষণ একটা নারকেলপাতার ডগা নিয়ে নাড়াচাড়া করার পর বললে, ‘তা মা করেছিল। আমার দোষ কম নয়, ষোল আনার রোপর রাঠারো আনা তা আমি মানতিছি–তবে দাদাবাবুও কাজটা খুবই গরিত করেছিল, তাতে কোন সন্দ নি। তুমি ছেলেমানুষ, এখনও রিস্কুলে পড়তেছ–তায় গরিব বামুনের ছেলে, নেকাপড়া শিখে নিজের রুন্নতি করতে গেছ–তোমার কী দরকার নৈবিদ্যির কলাতে হাত বাড়াবার? রন্যায় অবিশ্যি দিদিমণিরই বেশি–সে আমি একশ বার বলব–লেহ্য কথা বলতে মুকী ভয় পায় না তা নিজের বেলায়ই বা কি রপরের বেলায়ই বা কি–আসল কথা ফুটফুটে রাজপুত্তুরের মতো চেহারা হয়ে উঠেছিল তো দাদাবাবুর, বয়েস যা তার চাইতে যেন বেশি ছাওয়ালো হয়ে উঠেছিল গড়নটা–আর লোভ সামলাতে পারলে নি, নষ্ট করে বসল। তা তাও বলি, সেও তো দগ্দাচ্ছে কম নয়–চেরকালই ঐ আক্কশ মেয়ে-খেকো মিনসে মাতাল দাঁতাল বাপের বয়িসী সব বুকচাপ মানুষগুলো এনে বসিয়ে দিচ্ছে বৈ তো নয়–সাধ-আহ্লাদ বলতে তো কোন দিন একটা মিটতে দেয় নি। কখনও কোথাও কি যেতে পেরেছে? গয়না গড়িয়ে দিয়েছে তো মাথা কিনেছে একেবারে, সে গয়না যদি কাউকে দেকাতেই না পারলে তো লাভ কি মা বলো! বলি এই কলকেতা শহরে যে এতটা কাল কাটিয়ে গেল তা এই শহরটাই কি কোনদিন ঘুরে দেখেছে, কেমন গমগমা শহরখানা! বাড়ির বাইরে পা দেবার তো হুকুম ছেল না গা। বাবুরো যত না হোক ঐ মেয়ে-খেকো মিসের শাসন যে আরও বেশি, সব্বদাই পেরানে ভয় যে মেয়ে পাছে হাতছাড়া হয়ে যায়। তাই তো দুঃখু করে বলত–মুকী, রেতকাল এখানে কাটল; জম্মকম্ম! সব এখেনে–তা একদিন চিড়িয়াখানা মরা-সোসাইটি পজ্জন্ত দেখা হ’ল না! জন্মের মধ্যে কম্ম, কাশী যাবে বলে বায়না ধরেছিল সে জামাইবাবুর কাছে–সে আজীও হয়েছিল, কিন্তু ওর বরাতে নি, পট্ করে মরে গেল। আর হ’ল নি কাশী যাওয়া। গেলে আমারও হ’ত–মুকী ছাড়া তো যেত নি সে। এ বাবু তো যমের দূত, দস্যি একেবারে–সদরের চৌকাট ডিঙ্গোবার হুকুম ছেল না এর আমলে।’
স্তম্ভিত হয়ে শুনছিলেন শ্যামা। ওর এই অনর্গল বাক্যস্রোতের মধ্যে থেকে সার যেটুকু সেটুকু নিতে পেরেছিলেন তিনি–আর তা-ই যথেষ্ট। বাকি কথার অর্ধেকও কানে যায় নি, তিনি চুপ ক’রে বসে ভাবছিলেন ঐ কথাটাই। তাঁর রাজপুত্রের মতো রূপবান ছেলে পেয়ে সে নষ্ট করেছিল! ডাইনী! ডাইনী চুষে খেয়েছে তাঁর ছেলেকে–তাই অমন ডাইনীচোষা কঙ্কালসার চেহারা হয়েছে ওর। গলায় দড়ি দিয়েছে, বেশ হয়েছে। গলায় দড়ি দেওয়াই উচিত। জন্মে জন্মে যেন গলায় দড়ি দেয়–তবে যদি এ অপরাধের স্খালন হয়। যে অনুতাপটুকু ছিল তাঁর এ কদিন ঐ চিঠিখানা দেবার জন্য, সেটুকু নিঃশেষে দূর হয়ে গেল। অনুতাপের জায়গায় প্রচণ্ড একটা আক্রোশ অনুভব করতে লাগলেন তিনি–নিষ্ফল অথচ সীমাহীন একটা রোষ। বিশ্বাস করে ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন তার কাছে–সেই বিশ্বাসের এই প্রতিদান। বলতে গেলে মার বয়সী তুই–তুই এই কাজ ক’রে বসলি! তাঁর দুধের ছেলে- বয়স হ’লে কি হবে, মনে মনে এখনও শিশু রয়ে গিছল যে। দুনিয়ার কোন মন্দ জিনিস, মন্দ কথা জানত না–নিৰ্মল ফুলের মতো অকলঙ্ক ছেলে তাঁর। সেই জন্যেই আরও সোজা হয়েছে কাজটা। কেমন ক’রে প্রবৃত্তিই বা এল তার। ছি ছি! ঐ জন্যেই বলে নষ্ট মেয়েমানুষের ছায়া মাড়াবে না। ঐ জন্যেই তিনি শুনে অত রাগ করেছিলেন। তিনি ঢের বেশি মানুষ চিনতেন।…
ছেলের ওপরও রাগ তাঁর কম হ’ল না। এই কাণ্ড ক’রে বসে আছেন বাবু। তাই মুখে রা নেই, তাই চুপচাপ। তাই কথা তুললেই কেবল চোখে জল। বলবেই বা কি! বলবে কোন্ মুখে। এই বয়সেই এই! গাছে না উঠতেই এক কাঁদি! ছেলের বাইরের শান্ত সরল চেহারা দেখে ভুলেছিলেন তিনি–ভুলে গিয়েছিলেন কোন্ বংশের ছেলে ও। বাপজেঠার নাম রাখবে না! যে ঝাড়ের বাঁশ সেই ঝাড়ের মতো না হ’লে চলবে কেন! সরকার-গিন্নী ঠিকই বলেন, ভাতার থেকে যার সুখ হ’ল না, তার সুখ আর এ জন্মে হবে না! ভেবেছিলেন এই ছেলে তাঁর মানুষের মতো মানুষ হয়ে মার মুখ উজ্জ্বল করবে। সেই বরাতই তাঁর বটে!…
বাইরে কথা বলার আওয়াজ পেয়ে কনক বেরিয়ে এসেছিল। অপরিচিত মানুষ দেখে সে ভেতরে চলে গেল বটে কিন্তু শ্যামার এবার চমক ভাঙ্গল। নির্জন নিস্তব্ধ দুপুরে গলার আওয়াজ বহুদূর যায়। ছেলেকে তিনি কোথায় পাঠিয়েছিলেন তা আর বিজ্ঞাপন ক’রে জানাবার দরকার নেই পাড়ার লোককে।
তিনি চাপা তিক্ত কণ্ঠে বললেন–অন্তরের বিষ কিছুতেই গোপন করতে পারলেন না– অনেক চেষ্টাতেও, ‘যাক গে বাছা, তুমি একটু গলা নামিয়ে কথা বলো দিকি, ব্যাগত্যা করি। এ সব তো আর ঢাক পিটিয়ে বলবার কথা নয়। ভদ্দরলোক বামুনের ঘরের মেয়ে হয়ে যে কাজ করত তোমার মনিব সেটা আর না-ই শোনালে পাঁচজনকে। আমরা পাঁচটা কুটুম নিয়ে ঘর করি–তা ছাড়া এ হ’ল কুটুম-বাড়িরই কেচ্ছা। কুটুমের কুটুম তো–মেয়ের ননদ!’
অপ্রতিভ হয়ে পড়ে মোক্ষদা। যথাসাধ্য গলা নামিয়েই বলে, ‘তা যা বলেছ মা, লেহ্য কথা। এ সব কি আর লোককে বলবার না জানাবার! আপনাদের এ হ’ল গে চোরের মার কান্না, মুখ বুজে সব সইতে হবে!’
শ্যামাও একটু নরম হয়ে আসেন। এখনও সবটা জানা যায় নি। রহস্যটা পুরো পরিষ্কার হয় নি এখনও। তিনিও অপেক্ষাকৃত শান্তকণ্ঠে বলেন, ‘তা নষ্টই যদি করেছিল– তুমি যা বলছ যদি সত্যিই হয়–ওকে চোখে লেগেছিল মনে ধরেছিল বলেই তো করেছে কাজটা–তা তবে ওর অমন সব্বনাশটা করলে কেন? এ আবার কেমন-ধারা ভালবাসা?’
‘সে কি করেছে? করেছে তো ঐ দস্যি, ঐ দত্যি-দানোটা!’ ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে মোক্ষদা, ‘আমি কি ছাই তখন বুঝেছি যে ওর ভাল-মানুষির মধ্যে রেত কাণ্ড আছে, ওর ভেতরে ভেতরে এত মলব ঘুরছে। আমি ভেবেছি রমন চোরের মার মেরে–আধমরা করেই তো ফেলেছিল বলতে গেলে–বুঝি মনে একটু দয়া হয়েছে। ছেলেটা যাতে আবার দাঁড়িয়ে যায়, ক’রে খেতে পারে, সেই জন্যে ক্ষ্যামা-ঘেন্না ক’রে একটা ভাল ব্যবস্থা ক’রে দিচ্ছে। সে যে অমন দেশ–এমন সাংঘাতিক ম্যালোয়ারী রোগ সেখেনে–তা কেমন ক’রে জানব মা! তা হ’লে কি আর আমি দাদাবাবুকে যেতে বলি সেখানেই–আমিই তো বারণ করতুম!’
‘মেরেছে! মেরেছে ওকে…আমার ছেলেকে!’ আড়ষ্ট বিহ্বল কণ্ঠে বলে ওঠেন শ্যামা। যেন বিশ্বাস হয় না কথাটা তাঁর।
‘সে কি একটু-আধটু মার মা। আমরা সব্বাই মিলে গিয়ে না পড়লে বোধহয় দুজনকেই খুন ক’রে ফেলত। শুধু কি দাদাবাবুকে–নিজের আঁড়কেও এহাই দেয় নি।’
‘এতবড় আস্পদা–বামুনের ছেলের গায়ে হাত তোলে! কী ভেবেছে, মাথার ওপর চন্দ সূয্যি নেই!’ শ্যামা তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলে ওঠেন, ‘কী জাতের লোক সে?’
তাঁর সেই আগুনের শিখার মতো মুখ-চোখের দিকে চেয়ে মোক্ষদা যেন গুটিয়ে যায়। বেশ একটু ভয়ে ভয়েই বলে, ‘তা জানি না মা, বলে তো দত্ত। তা দত্ত তো শুনেছি কায়েতও হয়, বেনেও হয়। কী দত্ত তা জানি নি!’
‘ফল পাবে। আমি যদি যথার্থ বামুনের মেয়ে হই– আর ও-ও যদি বামুনের ঘরে সতীর পেটে জন্মে থাকে তো এর ফল পাবে সে, দেখে নিও।
মোক্ষদার মুখ বিবর্ণ থেকে বিবর্ণতর হতে থাকে ক্রমশঃ। সে আস্তে আস্তে বলে, ‘পাবে কি মা, পেয়েছেই তো শুনছি। দিদিমণি গলায় দড়ি দেবার পর থেকেই নাকি পাগলের মতো হয়ে গেছে। খায় না দায় না, কারো সঙ্গে কথা বলে না–রাপিসেও নাকি যায় না, গুম্ খেয়ে এক জায়গায় বসে থাকে!’
‘হবে না!’ যেন বিজয়গর্বে বলে ওঠেন শ্যামা, ‘আমার ছেলের গায়ে হাততোলা, আমার ছেলের এমন সর্বনাশ করা–এর শোধ উঠবে না! এখনই হয়েছে কি, ওরও তোমাদের ঐ দত্তবাবুরও অপঘাত মৃত্যু হবে দেখে নিও!’
তারপরই কথাটা মনে পড়ে যায়, ‘তা সে টের পেলেই বা কী ক’রে। নিশ্চয় তোমাদের মধ্যেই কেউ চুলি খেয়েছে!’ বলতে বলতে তীক্ষ্ণ অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে চান মোক্ষদার মুখের দিকে। ওর সেই প্রথমকার অনুশোচনামূলক কথাগুলোর সঙ্গে এই ঘটনার একটা যোগসূত্র বুঝি খুঁজে পান এতক্ষণে।
আবার নিজের দুই গালে চড় মারতে থাকে মোক্ষদা, হাউ-মাউ ক’রে ওঠে একেবারে, ‘হেই মা, আমি তোমার রবোধ সন্তান মা, তুমি সাক্ষেত দেবতা, হেই মা, মন্যি দিও না, দোহাই তোমার। আমি নরকের কীট মা, এমনিই নিজের সব্বনাশ নিজে করেছি–তার রোপর শাপ-মন্যি দিও না মা, তোমার পায়ে ধরতিছি!’
চুপ চুপ, আবার চেঁচায়!’ প্রায় ধমক দিয়ে ওঠেন শ্যামা।
‘না মা চেঁচাই নি। চুপি চুপি বলতিছি! সে বেইমানী আমিই করেছি মা, স্বীকার পাচ্ছি। এদান্তে দিদিমণি বড় বাড়াবাড়ি শুরু করেছিল, দাদাবাবুকে নিয়ে রুন্মত্ত হয়ে উঠেছিল একেবারে। তাই দেখেই যে কী ইষ হলো মা, মাথায় যেন অক্ত চড়ে গেল ক্রেমশ। ইষ হ’লো যে, খেতে পেত না, ভিখিরীর ঘরের ছেলে এসে মনিবের মনিব সেজে বসল। আরও ভয় হল মা–মিছে কথা বলব নি, তুমি মা সাক্ষেত ভগবতী তা আমি বুঝে নিয়েছি, তোমার কাছে মিছে বলে পারও পাব নি–মনে মনে ছেল যে, দিদিমণির তো ছেলেপুলে হ’ল নি, পয়সায় দুক-দরদও নি, যা পাব দুয়ে নোব, দেশে বেশ গুছিয়ে দোব মেয়ে-জামাইকে–এখন ভয় হ’ল যে দাদাবাবুর রোপর যা টান কোন্ না ওকেই যথাসব্বস্ব দেবে–যা জামার রোপর জামা, কাপড়ের রোপর কাপড় দিচ্ছিল, জুতোই তো দাদাবাবুর জমেছিল কম করে ছ জোড়া–তা এত দিয়ে কি আর আমাদের কপালে কিছু বাকি থাকবে! তারপর তো ক্রেমশ দাদাবাবুরও চোখ খুলবে, কোন্ না পাওনাগণ্ডা বুঝে নিতে শিখবে সে। তখন আমাদের টাকা দেওয়াও বন্ধ করবে–যা বাঁচবে তা ওরই থাকবে, এই কথাটা যদি বোঝে অযথা খরচ কি আর করতে দেবে? আর দিদিমণির যা অবস্থা–সে তো তোমার ছেলের কথায় ত্যাখন উঠতেছে বসতেছে। দাদাবাবুর কথা তো বেদবাক্যি একেবারে। এই সব সাত-পাঁচ ভেবেই জামাইবাবুকে কথাটা আমি নাগিয়েছিলুম। ডান হাতে করে গু গুলে খেয়েছিলুম। হেই মা, আমাকে রেবারের মতো ঘাট করো মাপ করো মা–আমার যা সাজা তা আমিই ভোগ করতিছি। এর রোপর তুমি আর মন্যি দিও না। একটা মেয়ে নিয়ে আমি ঘর করি মা।’
মন্যি আমাকে দিতে হবে না মা, আর আমি কেনই বা দেব, আমারও অদেষ্ট, নাইলে এমন হবেই বা কেন–নষ্ট মেয়েমানুষের কাছে ছেলে কেউ কখনও পাঠায়–’ আস্তে আস্তে বলেন শ্যামা, ‘তবে বাছা বেইমানীর দেনা তোমার তোলা থাকল, সে আমি মন্যি দিই না দিই–সে দেনা তোমাকে শুধতেই হবে! এর সুদসুদ্ধ উশুল দিতে হবে একদিন!’
যেন শিউরে ওঠে মোক্ষদা। বলে, ‘আমি এতটা ভাবি নি মা সত্যি বলতিছি। তাও মুখে ঠিক বলি নি, একটু রিসারা দিয়েছিলুম মাত্তার। তাই থেকেই যে এত কাণ্ড হবে–তিল থেকে তাল–এমন সব্বনাশ হয়ে যাবে–কেমন করে জানব মা!’
চুপ করে থাকেন শ্যামা। সামনের এই প্রায় কুঁকড়ে-বসে-থাকা মানুষটা সম্বন্ধে যেমন একটা অপরিমিত ঘৃণা বোধ হ’তে থাকে, তেমনি একটা অনুকম্পাও অনুভব না করে পারেন না। কী তুচ্ছ ঈর্ষার বশে নিজেরই এতবড় অনিষ্টটা করে বসে রইল! অকারণ, অমূলক ঈর্ষা–যার কোন ভিত্তিই নেই–তাইতেই পাগল হয়ে নিজের সবচেয়ে বড় আশ্রয়টা নিজেই পুড়িয়ে দিলে। ওর চেয়ে হতভাগ্য আর কে আছে! নিজেরও অনিষ্ট করল আর সেই সঙ্গে তাঁরও অতিবড় সাধে এমন বাদ সাধল।
খানিক পরে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে শ্যামা যেন আবার কতকটা স্বাভাবিক হন। বলেন, ‘তা আজ কী মনে ক’রে এসেছ বাছা এখানে–সে কথাটা তো এখনও বললে না। এই সব সুখবর দিতে নিশ্চয়ই গাড়িভাড়া করে এত দূরে আসো নি। ব্যাপারটা কি খুলে বলে ফেল। আমার অনেক কাজ পড়ে আছে, এবার উঠতে হবে!
মোক্ষদাও এবার যেন একটু প্রকৃতিস্থ হয়। সামনে আর একটু এগিয়ে এসে আরও ফিসফিস ক’রে বলে, ‘হ্যাঁ গো মা–এসব কথা বলতে কি আর আসে মানুষ, কথায় কথায় বেরিয়ে গেল তাই! বলছিলুম কি দাদাবাবুর নেয্য পাওনা অত বড় সম্পত্তিটা রমনি রমনি ছেড়ে দেবে? একবার লড়ে দেখবে না? এদিকে তো বলতেছ ছেলে ঐ কাজের বার হয়ে গেল–ওজগার ক’রে খাবার ভরসা তো আর অইল না– তা একদিক দিয়ে ক্ষেতিটা পুষিয়ে নাও। সম্পত্তিটা তো বড় কম না–পেলে ঐতেই সারা জীবন কেটে যাবে ওর!’
সম্পত্তি!
ছিলে-কাটা ধনুকের মতোসোজা হয়ে বসেন শ্যামা, শব্দটা শোনবামাত্র।
তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন করেন, ‘সম্পত্তি? কিসের সম্পত্তি? ওর আবার সম্পত্তি এলো কোথা থেকে?’তাই বলতেই তো আমার আসা গো! একখানা সেই কী চিঠি গেল না–তাতেই দাদাবাবুর বিত্তান্ত সব জানতে পারলে তো–আমাকে বলে নি কিছু দিদিমণি, তবে আমি বুঝেছি মা, সে চিঠি আপনিই দিয়েছিলে, ও আমি ঠিক ধরতে পেরেছি। আর কে এমন কড়া চিঠি লিখবে বলো। পড়তে পড়তেই মুখ-চোখ লাল হয়ে গেল, দুচোখ দিয়ে দর-দর ক’রে জল ঝরতে লাগল। তারপর আমার দিকে ফিরে বললে, মুকী এত ক’রেও তোদের আশা মেটে নি, তোরা তাকে সেখানে মরতে পাঠিয়েছিলি!… তাতেই তো জাননু যে দাদাবাবুর খবর দিয়ে কে চিঠি নিকেছে। তা সে তুমি ছাড়া! আর কে নিকবে বলো গরজ করে।… সেই যা একবার একটা কথা মুখ দে বার করেছিল, তারপরই একেবারে যেন কাঠ হয়ে গেল। অত তো জানত না, জানে সেখেনে আছে, লেখাপড়া করতেছে–ভালই আছে, কেমন আছে কী বিত্তান্ত তা তো আর জিজ্ঞেসা করবার সাহস ছিল না, কাউকে দিয়ে যে খোঁজ করাবে সে জোও নি। বাপ তো ঐ চণ্ডাল। সরকারকে জিজ্ঞেস করবে–সে যদি আবার নাগায় বাবুর কাছে!… তা সে যাক গে, চিঠি পেয়ে গুম্ হয়ে অইল সারাদিন। বিকেলে উঠলে নি, গা ধুলে নি, মাথা বাঁধলে নি–কিচ্ছু না। আমি বলতে গেনু–তা বললে, ফের যদি আমার দিক করতে রাসিস তো আমি এক্ষুণি ঐ ফলকাটা ছুরিখানা গলায় বসিয়ে দোব!
আত্তিরে বাবু এল–তা ওপরের ঘরে গে একটা চাদর মুড়ি দে পড়ে অইল। সেই যে- ঘরে দাদাবাবু থাকত গো–সেই চৈকীর রোপরেই পড়ে অইল, সারাআত। বাবুকে বলে পাঠাল শরীর বেস্তর খারাপ, কেউ যেন না দিক্ করে। বাবু নিজে এল, মুখের রোপর থেকে চাদর না সরিয়েই বললে, আমার বাড়ি আমার ঘর–তোমার পয়সাতেও এ বাড়ি কেনা নয়–তা আমার শরীর খারাপ হ’লেও কি সেখানে আমি এক জায়গায় শান্তিতে পড়ে থাকতে পারব নি নাকি?… অমন কথা বাবু এর পূর্ব্বে আর কখনও শোনে নি, সে হকচকিয়ে ভয়ে ভয়ে চলে গেল। বোধ হচ্ছে যে কত্তা-বাবুকে গে নাগিয়ে থাকবে, কত্তাবাবু আসতেছিল, আমি বারণ কনু। বনু যে, একেবারে ক্ষেপে আছে এখন যেও নি, কারুর কথা মানবে নি, হিতে বেপরীত হবে। তা কত্তাবাবু বুঝল। চলে এল চুপি চুপি।…তা সেই পর আত ঝাঁঝাল, উঠল নি, খেলো নি, মুখে একটু জল দিল নি। পরের দিনও তাই। খুব করে বলতে, হাতে পায়ে ধরতে উঠে শুধু এক কাপ চা খেয়েছিল। তারপর দোপর বেলা হঠাৎ কী মনে করে উঠল, নিজের ঘরে কাগজ কলম টেনে নিয়ে খস খস ক’রে কি নিক্ল– একখানা চিঠি এমনি খামে আঁটল, আর একখানাতে সই করার পর আমাকে আর ঠাকুরকে বললে সই দিতে দুটো–তা আমি তো সই করতে জানি নি, টিপ দিনু। বনু এ কি সব নেকন গা, তা বললে, আমি যদি মরে যাই, এই বাড়ি আর আমার যা-কিছু আছে কান্তি পাবে, এ সব তারই অইল। আমার তেখুনি সন্দ হ’ল–বনু তা এখুনি মরার কথা কেন গা? বললে, মানুষের মরণ-বাঁচনের কথা কি কিছু বলা যায় মুকী! আগে ভাবতুম আমি মরে গেলে ওরা তাকে দেখবে–এখন তো দেখছি সবাই শত্তুর। সে মানুষটা কাজের বার হয়ে গেল, এরপর খাবে কি? য্যাদ্দিন বাঁচি না হয় কিছু কিছু পাঠালুম–আমি মলে ত্যাখন? তা আমিও তাই বুঝনু। তখন কি জানি ওর মনে এই মতলব আছে, তাহলে কি সঙ্গ ছাড়ি! আমাদের বিদেয় দিয়ে ঘরে গে খিল দিলে, বললে, সমস্ত আত ঘুম হয়নি কাল, এখন একটু ঘুমোব, সঞ্জের আগে যেন কেউ না ডাকে! ব্যস–তারপর সঞ্জে ছেড়ে আত হ’য়ে যায় দেখে ডাকতে গেনু তা সাড়াও নি শব্দও নি। ত্যাখন গিয়ে কত্তাবাবুকে ডাকি। তিনি এসে দারোয়ান ডাকে। দারোয়ান দোর ভেঙ্গে দ্যাখে ঐ কাণ্ড!’
রুদ্ধশ্বাসে শুনছিলেন শ্যামা। মোক্ষদা থামতে প্রায় অসহিষ্ণু ভাবেই বলে ওঠেন, ‘তারপর?’
‘বলছি গো মা দাঁড়াও, একটু দম নি।… ঐ ব্যাপার দেখে আমরা তো হাহাকার ক’রে উঠনু–ঐ পিশাচ ঐ মেয়ে-খেকোর কিন্তু কি শকুনের দিষ্টি–ওর নজরে ঠিক পড়েছে দুখানা খাম। আমরা কেউ দেখবার আগে কি হাত দেবার আগে যেন ছোঁ মেরে তুলে নিলে খাম দুখানা। তারপর দারোয়ানকে পুলিশ ডাকবার আর সরকারবাবুকে দত্তসাহেবের ওখানে খবর দেবার হুকুম দিয়েই এক ছুটে চলে গেল নিজের ঘরে।
‘তারপর?’ শ্যামা যেন পুরোপুরি অধৈর্য হয়ে উঠেছেন। তাঁর আর একটুও দেরি সইছে না।’তারপর পুলিশ যত কালে এসে পৌঁছল ততকালে সে চিঠি গাব হয়ে গেছে। একখানা খাম শুধু বার করে দিলে মিসে পুলিশের হাতে। তাতে শুধু নাকি ছিল যে আমি নিজের খুশিমতো মরতিছি, রপর কাউকে না কেউ দায়িক করে। যে চিঠিতে দাদাবাবুর বিষয়- আশয় পাবার কথা নেকা ছেল, সেই যে রুইল না কি বলে, তার নামগন্ধও অইল না।’
‘তা তোমরা কেউ কিছু বললে না?’ উত্তেজিতভাবে প্রশ্ন করেন শ্যামা
এ যা শুনছেন, এ যে অভাবনীয় অচিন্তিত। কলকাতার বাড়ি একখানা, বিশেষ যে বাড়ির বর্ণনা তিনি শুনেছেন, খুব কম করেও চল্লিশ পঞ্চাশ হাজার টাকা দাম! ও পাড়ায় ভাড়াও বেশি, ভাড়া দিলে এখুনি কোন্ না দেড়শ দুশ’ টাকা ভাড়া উঠবে। এত বড় সম্পত্তি–তাঁর কাছে কুবেরের ঐশ্বর্য বলতে গেলে–হাতের কাছ পর্যন্ত এসে বেরিয়ে গেল–তাঁরা একবার কথাটা জানলেন না পর্যন্ত!
‘বলেছিলুম বৈকি মা! পুলিশের কাছে পষ্ট পষ্ট বলেছিলুম। তা কত্তাবাবু যে এধারে ঠাকুর মিন্সেকে ভেতরে ভেতরে কড়কে একে দিয়েছে তা তো জানি নি–নিপেক্টার জিগ্যেস করতেই একেবারে ঝেড়ে জবাব দিলে, তার কিছু মনে নি। আমি বলে ফেলে বেকুব। নিপেক্টার উল্টে আমাকেই ধমক দিলে, বললে–রেমন ধারা মিছে কথা বললে তোমাকে বেঁধে নে যাব। বুঝব নিশ্চয় তোমার যোগসাজস আছে এ মরার সঙ্গে। তোমরা খুন করে ঝুলিয়ে রেখেছ কিনা তার ঠিক কি!… শুনে ভয়ে মরি, আর আ কাড়তে পারলুম নি। তারপর দারোয়ানের মুখে শুনি যে কত্তাবাবু গোছা করে নোট গুঁজে দেছে নিপেক্টারের হাতে। সে ত্যাখন ষোল আনা কত্তাবাবুর দিকে!’
‘তা ঠাকুর অমন মিছে কথা বললে কেন? সে তো শুনেছি তোমার হাতের লোক?’
বলে ফেলেই লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলেন শ্যামা। এসব নোংরা কথা পাড়া তাঁর ঠিক হয় নি।
কিন্তু মোক্ষদা খুব সহজভাবেই নিলে কথাটা, ‘হ’লে কি হবে মা, এর জন্যে ফৈজত কি কম ক’রেছি তারে। তা বলে যে কত্তাবাবু বললেন–এসব কথা যদি রুচ্চ-বাচ্য করো তো আমি পেরমাণ করে দেব, তোমরা সেই নষ্ট দুষ্টু ছোঁড়ার সঙ্গে যোগসাজস করে বাড়িখানা নিখিয়ে নিয়ে মেয়েটাকে আমার খুন করেছ! তোমাদের দুজনারই ফাঁসি হয়ে যাবে তাতে।… সেই ভয়েই সে আর ও কথা তোলে নি।’
তারপর আরও গলা নামিয়ে শ্যামার কানের কাছে মুখ এনে বললে, ‘কিন্তুক আমি শুনেছি মা, দু’জন সাক্ষী থাকলেই এসব মামলা জজে মেনে নেয়। ঠাকুরকে আমি বুঝিয়ে বলেছি, সে আদালতে গিয়ে যা সত্যি সব বলবে ঠিক-ঠিক।… তাতে বাড়িখানা রাদায় করতে পারবে না? হ্যাঁ মা?’
কোথায় সামান্য একটুখানি আশা যেন মাথা তুলেছিল শ্যামার মনের মধ্যে, এতক্ষণ ধরে বুঝি নিজের অগোচরেই তাকে জিইয়ে রাখার চেষ্টা করছিলেন তিনি, কিন্তু আর সেটা বাঁচানো সম্ভব হ’ল না। আশার সেই ক্ষীণ অঙ্কুরটি কিশলয়ের রূপ নেবারও আগে শুকিয়ে মরে গেল!
এই! এতক্ষণ ধরে এইটুকু শোনাবার জন্যেই এত ভনিতা! আইন-আদালত কিছু না বুঝলেও এটুকু সাংসারিক জ্ঞান তাঁর আছে যে, এই সামান্য অবলম্বন ভরসা করে মামলার দুস্তর সমুদ্রে পাড়ি দেওয়া যাবে না। তা ছাড়া তাঁর না আছে সহায়, না আছে সম্পদ। এতবড় বিষয় ও-পক্ষ সহজে ছাড়বে না। তাদের সঙ্গে তিনি লড়বেন কী দিয়ে আর কী নিয়ে! এ দু’জন সাক্ষী কতক্ষণ ধোপে টিকবে তারই বা ঠিক কি। ধমকে যা হয়েছে ঘুষ দিয়ে তা আরও সহজে হবে। এরাই হয়ত সাফ উড়িয়ে দেবে কথাটা।
মনের হতাশা বিরক্তিতে রূপান্তরিত হয়। সে বিরক্তি কণ্ঠস্বরে উপচে ওঠে যেন, ‘তা বাছা, তুমি এই বাজে কথাগুলো বলবার জন্যেই কি এত পয়সা খরচ করে এসেছ, না অন্য মতলব আছে?’
এতখানি আশার বাণী শোনাবার পর–অন্তত তার কাছে আশার বাণীই–এতটা তিক্ততা আশা করে নি মোক্ষদা। মনে মনে অনেক স্বপ্ন দেখেছে সে ইতিমধ্যে, এই বিষয়টা পাইয়ে দিলে মোটা কিছু আদায় করতে পারবে কান্তি-দাদাবাবুর কাছ থেকে, হয়ত আগেও কিছু পাবে–জরুরি সাক্ষী হাতে রাখার জন্যে। সে জায়গায় এই সম্ভাষণ। সে যেন থতমত খেয়ে চেয়ে রইল শুধু শ্যামার মুখের দিকে।
শ্যামার কণ্ঠ অধিকতর রুক্ষ হয়ে ওঠে, ‘বলি আমরা তো পাগলও নই আর ছন্নও নই যে তুমি এই কথা বলবে আর আমরা ধেই ধেই করে নেচে উঠব। দলিল নেই, পত্তর নেই–তোমরা এই দুজন ছাড়া কাকে-বকে কেউ জানে না, তাও পুলিশের কাছে একজন কবুল জবাব দিয়েছ যে কিছু জানে না–তোমার কথাও পুলিশে নিশ্চয় লিখে নেয় নি– এতবড় মামলাটা করতে যাব কিসের জোরে? লোকে যে আমাদের গায়ে ধূলো দেবে–কেউ কি বিশ্বাস করবে? তারপর তোমরা আজ এই বলছ, কাল হয়ত কত্তাবাবুর কাছ থেকে টাকা খেয়ে কি ধমক খেয়ে উলটো কথা বলবে–তখন মিথ্যে মামলার দায়ে জড়িয়ে পড়ব। না বাছা, আমরা বোকা লোক বটে, তাই বলে এত বোকা নই। তুমি এখন নিজের পথ দেখ– ওসব কথা আর তুলো না!’
অনেকক্ষণ অভিভূতের মতো বসে থাকার পর একটা নিঃশ্বাস ফেলে নড়ে-চড়ে বসল মোক্ষদা। গুলের কৌটোটা তখনও পর্যন্ত হাতে ধরাই রয়েছে, তা থেকে গুলটুকু বার করে মুখে দেবারও ফুরসৎ হয় নি। কিন্তু সে কথা তখন আর মনেও পড়ল না! বরং কৌটোটা আবার যথাস্থানে বেঁধে আঁচলের অপর প্রান্তে বাঁধা এক টুকরো কাগজ বার করে আল্তো শ্যামার সামনে রেখে দূর থেকে গড় হয়ে প্রমাণ করল। তারপর হাত জোড় করে বলল, ‘আমি পাপী তাপী মানুষ, আপনি বামুনের মেয়ে যা বলেছ তা শোবা পেয়েছে। তবু বলি, কথাটা একেবারে উড়িয়ে দিও নি। বড় ছেলে বাড়ি আসুক, তার সঙ্গে সলা-পরামর্শ কর। যদি মত হয়– এই আমার ঠিকানা অইল, এখন এইখেনেই আছি, আমার এক দেশের নোকের বাড়ি। ও বাড়ি ছেড়ে দিয়েছি সেই দিনই। ঠাকুর পোড়ারমুখো আর এক বাড়ি কাজ ধরেছে–তা তার ঠিকানাও আমি জানি। আমাকে এক নাইন নিখে দিলেই আমি ছুটে চলে আসব মা। কাকের মুখে বাত্তাটা শুধু পৌঁছে দিও।’
তারপর উঠে দাঁড়িয়ে একটু এদিক-ওদিক চেয়ে বললে, ‘বুকটা একেবারে শুকিয়ে উঠেছে মা, অব্যেস তো নেই, ওদ্দুরে রেতটা পথ হেঁটে এসেছি, পিপাসাটা বড্ড নেগেছে। এক ঘটি জল পাব মা?’
এবার শ্যামা রীতিমতো অপ্রতিভ হয়ে পড়েন। এটা তাঁরই আগে ভাবা উচিত ছিল। যা-ই করে থাক, কুটুমবাড়ির ঝি, তাঁর কাছে এসেছে, শত্রু হ’লেও আতিথেয়তার ত্রুটি ঘটতে দেওয়া ঠিক নয়। তিনি তাড়াতাড়ি বঁটিটা সরিয়ে উঠে এসে দোরের কাছ থেকে কনককে ডাকেন, ‘বৌমা, অ-বৌমা একঘটি খাবার জল দিয়ে যাও না মা। আর দ্যাখো দিকি কুণ্ডু বাড়ির সন্দেশ এক-আধটা পড়ে আছে কি না। নইলে আমার দরুন চালভাজার নাড়ু আছে, দুটো হাতে করে নিয়ে এসো মা।’ তারপর মোক্ষদার দিকে ফিরে কোমল কণ্ঠে বলেন, ‘বোস মা বোস। জলটা খেয়ে ওঠো। আহা, তেষ্টা তো পাবেই, এতটা পথ এই খর রোদে হেঁটে আসা।… আমারই মনে করা উচিত ছিল, তা আমার কি আর মাথার ঠিক আছে! একটু দেরি করো তো দুটো গরম ভাতও খেয়ে যেতে পারো–যা আছে বামুনবাড়ির ডাল-ভাত!’
সে তো আমার মহাভাগ্যি মা, আপনাদের পেসাদ পাব। তবে আজ আর থাকতে পারব নি মা, বলা-কওয়া নেই, তারা ভাববে।’
জল খেয়ে আর একবার প্রণাম করে মোক্ষদা চলে গেল।
‘কে মা?’ কনক প্রশ্ন করে।
মিথ্যা কথা বলতে পারেন না শ্যামা, কে জানে আড়াল থেকে শুনেছে কি না বৌ, একটু চুপ করে থেকে বলেন, ‘কান্তি যেখানে ছিল, সেই রতনের ঝি ‘
প্রসঙ্গটা অপ্রিয় বুঝে কনক চুপ করে যায়–আর কথা বাড়ায় না। …
আশা যে নেই তা শ্যামা ভালরকমই জানেন, তবু হেম বাড়ি আসতে তাকে আড়ালে ডেকে সব কথা বলেন। মোক্ষদার শেষ কথাটাও জানিয়ে ঠিকানা লেখা কাগজটা হাতে দেন। তারপর–হেম কী বলবে তা অনুমান করেও জিজ্ঞাসু উৎসুক নেত্রে ছেলের মুখের দিকে চেয়ে থাকেন।
হেম কাগজটা গুটি পাকিয়ে একেবারে উঠোনে ফেলে দিয়ে বলে, ‘যত্ত-সব পাগলের কাণ্ড। কালনেমির লঙ্কা ভাগ করছে বসে বসে। কোথায় কি যে সে বুড়োর সঙ্গে মামলা লড়তে যাব! রেজেস্টারি করা উইল হলেও না হয় কথা ছিল। টাকা দিলে নকল মিলত। এ দুটো লোকের মুখের কথা। তাও সত্যি বলছে কিনা তার ঠিক কি! হয়ত দুজনে যোগসাজস করে এসেছে, যদি বিষয়টা আদায় হয় তো মোটা বকরা মারবে আমাদের কাছ থেকে। এবার এলে সোজা ঐ আগড়ের কাছ থেকে হাঁকিয়ে দেবো, বদমাইশ মাগী!
এ সবই জানেন, জানতেন। তবু শ্যামার বুকের মধ্যে থেকে একটা ছোট্ট দীর্ঘ-নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে।
কে জানে সত্যি কিনা। এতগুলো টাকার বিষয় হাতের কাছ পর্যন্ত এগিয়ে এসেও হাতে এল না। তাঁর কপাল যে। নইলে এমন বোকামি সে করবে কেন! মেয়েটার মনে যদি এতই ছিল–উইলখানা খামে পুরে ডাকে পাঠিয়ে গলায় দড়ি দিতে পারল না!