অন্বেষণের মধ্যাহ্ন
১৯৩৮ সালের ডিসেম্বর। বম্বে। অনুত্তম গেছে রাষ্ট্রপতি সুভাষচন্দ্রের সন্দেশ নিয়ে সরদার বল্লভভাই সকাশে। সুভাষের সঙ্গে নাকি কংগ্রেস হাইকম্যাণ্ডের বনিবনা হচ্ছে না, মিটমাটের চেষ্টায় চরকির মতো বনবন করছে অনুত্তম। চরকা গেছে চুলোয়। ওই যে খদ্দরের ঝোলাটা ওর জায়গা নিয়েছে চামড়ার ব্রিফকেস। তাতে আছে রাজনৈতিক কাগজপত্র। একান্ত গোপনীয়। নীল চশমাটা তেমনি আছে। তবে তার ফ্রেমটা সোনা হয়ে গেছে। যে পরশপাথরের ছোঁয়া লেগেছে চশমার ফ্রেমে তারই ছোঁয়া লেগেছে সারা অঙ্গে। কটিবস্ত্র হয়েছে কোঁচানো ধুতি, তুলে না ধরলে ধুলোয় লুটোত। খালি পা ঢাকা পড়েছে সাদা লপেটায়, মাটির সঙ্গে তার সংযোগ ছিন্ন। খাটো কুর্তি এখন পুরো পাঞ্জাবি, তার উপর হাতকাটা জহরকোট।
চেহারাটা কিন্তু খারাপের দিকে। রোদের তাতে পুড়ে বৃষ্টির জলে ভিজে ঝড়ের ঝাপটা সয়ে উইয়ের কামড় খেয়ে শুকনো ডালের যে দশা হয় অনুত্তমেরও তাই। ভাঙাচোরা কাঠখোট্টা হাড় বার-করা চুল-পাতলা। সন্ত্রাসবাদী বলে সন্দেহবশত বাংলার সরকার তাকে প্রথমে কয়েদ করে, তারপরে অন্তরিন করে। পাঁচ-ছ বছর কেটে যায় বকসায়, দেউলিতে, অজ পাড়াগাঁয়। পরে হাসপাতালে। অথচ সন্ত্রাসবাদী সে কোনো কালেই ছিল না। শুধু রওশনের জন্যে এ দুর্ভোগ। যাক, তার ফলে সুভাষের সুনজরে পড়েছে। ‘আমি অনুত্তম, সুভাষদার কাছ থেকে আসছি,’ যেখানে যায় সেখানে এই তার পরিচয়পত্র। ছাড়পত্রও বটে, কংগ্রেসশাসিত প্রদেশের পুলিশ একথা শুনলে ‘নমস্তে’ বলে হটে যায়। কেবল বাংলাদেশের ওরা আঠার মতো লেগে থাকে। সেই জন্যই তো হাইকম্যাণ্ডের উপর তার অভিমান।
অনুত্তম মেরিন ড্রাইভ থেকে চৌপাটি হয়ে মালাবার পাহাড়ে যাচ্ছিল, একজন মন্ত্রীর সঙ্গে মন্ত্রণা করতে। উলটো দিক থেকে আসছিল আর একখানা মোটর। মুখোমুখি হতেই ও মোটরটা গেল থেমে। ড্রাইভারের সিট ছেড়ে বেরিয়ে এল এক মিলিটারি সাহেব। হাত বাড়িয়ে দিয়ে অনুত্তমের ড্রাইভারকে ইশারা করল গাড়ি থামাতে। অনুত্তম তো রেগে বেগনি। কংগ্রেসশাসিত প্রদেশে এই অনাচার। মন্ত্রীরা তা হলে করছে কী! দেখে নেব মুনশিকে। গাড়ি থেকে নেমে পড়ে রাগতভাবে বলল, ‘আমি অনুত্তম, রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে আসছি।’
‘আর আমি তন্ময়, পুনা থেকে আসছি।’ বলে হো-হো করে হেসে উঠল সাহেব।
ঝাঁকানি ও কোলাকুলির পর দুই বন্ধুর খেয়াল হল যে রাস্তার মাঝখানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখায় ট্রাফিক বন্ধ হতে বসেছে। তখন তন্ময় টেনে নিয়ে গেল অনুত্তমকে নিজের মোটরে, অপরটাকে বলল ঘুরিয়ে নিয়ে অনুসরণ করতে। ব্যালার্ড পিয়ার।
‘খবর পেয়েছিস কি না জানিনে, সুজন আসছে কলম্বো থেকে যে জাহাজে সেই জাহাজেই কান্তি রওনা হচ্ছে ইউরোপ। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধান। ভাবছিলুম তিন জনের দেখা হবে, চার জনের হবে না। অনু ভাই যদি থাকত। ভাবতে-না-ভাবতে তোর সঙ্গে মুখোমুখি। অদ্ভুত! অদ্ভুত! জীবনটাই অদ্ভুত! আমি আজকাল অদৃষ্টবাদী হয়েছি। আর তুই?’
‘আমি? আমার কথা থাক। হ্যাঁ রে, তুই নাকি বিয়ে করেছিস? পেয়েছিস তা হলে তাকে? তোর রূপমতীকে?’
দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে তন্ময় বলল, ‘বিয়ে করেছি। এক বার নয়, দু-বার। পেয়েছি, পেয়ে হারিয়েছি। হেরে গেছি। দেখে বুঝতে পারছিস নে, আমি পরাজিত?’
অনুত্তম লক্ষ করল তন্ময়ের মাথার চুল কাঁচা-পাকা। ষন্ডা ষন্ডা বলীবর্দের মতো আকার, কিন্তু অসহায়ের মতো মুখভাব। দু-চোখে কতকালের জমাট কান্না। তার হাসি যেন কান্নার রূপান্তর। মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে তার জীবনের সব শেষ হয়ে গেছে। তবু সে বেঁচে আছে, আবার বিয়ে করেছে, চাকরিতে ভালোই করেছে বলে মনে হয়। ছেলে-মেয়ে?
‘ছেলে-মেয়ে দুটি। কিন্তু রূপমতীর নয়। সে আমার সন্তানের মা হল না। আমি তার শুভকামনা করি। শুভকামনা করি আর একজনেরও। আমার কপালে যে সুখ সইল না তার কপালে যেন সয়। কিন্তু সইবে কী! আমার সমবেদনা তার প্রতি।’
অনুত্তম হাঁ করে শুনছিল। স্টিয়ারিং হুইলে ছিল তন্ময়ের হাত, নইলে তাকে ধাক্কা মেরে বলত, ‘এসব কী, তনু ভাই। এ যে সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য! হ্যাঁ রে, তুই কি পাগল হলি!’
তন্ময় ভারী গলায় বলে চলল, ‘কোনটা ভালো? পেয়ে হারানো? না আদৌ না পাওয়া? এক এক সময়ে মনে হয় আমি ভাগ্যবান যে আমি তাকে চোখে দেখেছি, বুকে ধরেছি, ঘরে ভরেছি, কোলে রেখেছি। এক এক সময় মনে হয় আমি পরম হতভাগ্য। আমি অসীম কৃপার পাত্র। আমার বউ চলে গেছে আমাকে ফেলে অন্যের অন্তঃপুরে।’
অনুত্তম আর সহ্য করতে পারছিল না। ঝুনো নারকেলের মতো মানুষটা কাঁদো-কাঁদো সুরে বলছিল, ‘ওঃ! ওঃ! ওঃ!’
তন্ময় ক্ষণকাল উদাস থেকে তারপর কখন একসময় আবার বলতে লাগল, ‘ইচ্ছা ছিল ওকে অনুসরণ করব। অনুসরণই তো অন্বেষণ। কে জানে হয়তো ওর মন ফিরবে। তখন ঘরের বউ ঘরে ফিরবে। কিন্তু ডিভোর্সের যুক্তিসংগত কারণ নেই দেখে ওর উকিল ওকে কুপরামর্শ দেয়। আর্জিতে লেখায় আমি নাকি সহবাসে অসমর্থ। তামাশা মন্দ নয়, প্রমাণের দায় চাপিয়ে দেওয়া হল প্রতিবাদীর উপরে। লজ্জায়, ঘৃণায় আমি গরহাজির থাকলুম। একতরফা ডিক্রি পেয়ে সে মামলায় জিতল।’
অনুত্তম ততক্ষণে রাগে গরগর করছে। বলল, ‘তুই ভুল দেখেছিস। ও রূপমতী নয়। রূপমতী হলে এমন কাজ করত না।’
তন্ময় হেসে বলল, ‘ওইখানে তোর সঙ্গে আমার মতভেদ। পদ্মাবতীর পরিচয়—করা না করায়। রূপমতীর পরিচয়—হওয়া না হওয়ায়। ও যে রূপমতী হয়েছে এটা জাগ্রত সত্য। কাজটা যদিও নিন্দনীয়। চরিত্রের ত্রুটি তো রূপের অপূর্ণতা নয়। তা সত্ত্বেও আমি ওকে ফিরে পেতে রাজি ছিলুম। ইচ্ছা ছিল না আর একটা বিয়ে করতে। কিন্তু যেখানে যাই সেখানে আমাকে দেখে কৌতুকের বিদ্যুৎ খেলে যায়। আমি যেন একটা সং। টেনিসের ছোকরাগুলো পর্যন্ত ফিসফিস করে বলে, এ সাহেব মর্দানা নয়!’
‘ওদের দোষ কী! আমি তোর বন্ধু না হলে ও ছাড়া আর কী বলতুম!’
‘ক্লাব ছেড়ে দিলুম। মেসে যাইনে। কিন্তু টেনিস? টেনিস যে আমার প্রাণ। তা বলে রোজ রোজ ওকথা বরদাস্ত হয় কখনো? স্থির করলুম বিয়েই করব আরেকবার। বিধাতা বিমুখ না হলে প্রমাণও করব যে আমি অশক্ত নই। তারপর জীবনে দ্বিতীয় সুযোগ এল। রূপবতী নয়, সাধ্বী সতী।’
অনুত্তম খুশি হয়ে বলল, ‘সেই ভালো। সেই ভালো। কিন্তু এখন থাক। পরে শুনব সব বৃত্তান্ত। ওই তো ব্যালার্ড পিয়ার দেখা যাচ্ছে। সুজনের সঙ্গে কান্তির সাক্ষাৎ হবে। আঃ! কী আনন্দ! কত কাল পরে, বল দেখি। চো-দ্দো ব-ছ-র। রামের বনবাস। ওঃ!’
ব্যালার্ড পিয়ারে জাহাজ ভিড়তে যাচ্ছে এমন সময় এরা পৌঁছোয়। সুজনের মতো কে যেন ডেকের উপর দাঁড়িয়ে। হাত নাড়ল এরা। হাত নাড়ল সেও। তারপর জাহাজ যতই কাছে অসতে লাগল ততই পরিষ্কার মালুম হতে থাকল সে সুজনই বটে। মাথায় চকচকে টাক। ভুঁড়িটি তুলোভরা তাকিয়ার মতো। কেবল মুখখানা তেমনি স্বপ্নবিভোর, তেমনি কোমল মধুর।
জাহাজ ভিড়তেই এরা দু-বন্ধু সোজা উঠে গেল গ্যাংওয়ে বেয়ে। জড়িয়ে ধরল ওকে।
‘তন্ময় ভাই! অনুত্তম ভাই!’
‘সুজন ভাই! সুজন ভাই!’
‘তোরা কে কেমন আছিস, ভাই?’
‘তুই কেমন আছিস, ভাই?’
‘হবে, হবে সব কথা। কিন্তু কান্তি ভাই কোথায়? তার খবর?’
‘কান্তি এইখানেই আছে। এই জাহাজেই রওনা হচ্ছে কন্টিনেন্টে।’
‘চমৎকার! তা হলে চল নামা যাক।’
ভারতের মাটিতে পা ঠেকানোর জন্যে সুজন অধীর হয়ে উঠেছিল। আর সকলের কাছে মাটি, তার কাছে মৃন্ময়ী মা। গুন গুন করে গান ধরল, ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা।’ এবং সত্যি সত্যি মাটিতে পা ঠেকানোর সঙ্গে সঙ্গে এক বার হাত ছুঁইয়ে মাথায় ঠেকাল। তার চোখে জল এসে গেল।
‘তেমনি সেন্টিমেন্টাল আছিস, দেখছি।’ তন্ময় বলল স্নেহভরে।
‘দেশের জন্যে দরদ কত!’ অনুত্তম বলল খোঁচা দিয়ে। ‘দমননীতির যুগটা বিদেশে গা-ঢাকা দিয়ে কাটালি। তারপর সিংহলে গেলি কোন দুঃখে!’
‘কেন? তোর কি মনে নেই যে আমি একজনের অন্বেষণের ভার নিয়েছিলুম?’
‘ওঃ! কলাবতীর অন্বেষণে লঙ্কায়! রাক্ষসের দেশে! হ্যাঁ, রূপকথায় সেইরকমই লেখে বটে। রাক্ষস-রাক্ষসীদের মেরে রাজকন্যাকে উদ্ধার করেছিস, না প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছিস, তাই বল।’
‘আরে না, সেসব কিছুই নয়। বকুল আছে ওখানে, ওর সঙ্গে আট ন-বছর দেখা হয়নি। কবে আবার হবে এই ভেবে কলম্বো দিয়ে ফিরি। কথা ছিল সোজা মাদ্রাজ হয়ে কলকাতা যাব, কিন্তু যা দেখলুম তারপরে তন্ময়ের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছাই প্রবল হল। চলে এলুম মুম্বাই। জলপথই ভালো লাগে আমার।’
তন্ময় কৌতূহলী হয়েছিল। অনুত্তমও গম্ভীরভাবে কৌতূহল গোপন করছিল।
‘বল, বল, কী দেখলি কী শুনলি।’
সুজন তার হাতে হাত রেখে কানে কানে বলল, ‘তোর রূপমতীকে দেখলুম।’
তন্ময়ের মুখ সাদা হয়ে গেল। সে বোবার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকাল। প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে দিতে অনুত্তম বলল, ‘কান্তির জন্যে কি ব্যালার্ড পিয়ারেই অপেক্ষা করা যাবে?’
তন্ময় বলল, ‘না, চল আমার ক্লাবে তোদের নিয়ে যাই। কান্তিকে টেলিফোন করলে সেও ওইখানে জুটবে। সুজন, তুই আমার সঙ্গে পুনা যাবি, দু-চার দিন থাকবি। আর অনুত্তম, তোর অবশ্য জরুরি কাজ আছে। তোকে পুনায় টানব না। কিন্তু ক্লাবে টানব।’
‘ক্লাব!’ অনুত্তম বলল রঙ্গ করে, ‘ক্লাবে যাচ্ছি জানলে একটা বোমা কি রিভলবার জোগাড় করতুম। ষাঁড়ের কাছে যেমন লাল ন্যাকড়া সন্ত্রাসবাদীদের কাছে তেমনি ক্লাব।’
তন্ময়ের ক্লাবের নাম ক্রিকেট ক্লাব অব ইন্ডিয়া। সেখানে তার দারুণ খাতির। তার মাথায় কিন্তু তখনও ঘুরছিল সুজন কী দেখেছে কী শুনেছে। কথায় কথায় আবার ওই প্রসঙ্গ উঠল।
‘আমি কি জানতুম যে ওই তোর রূপমতী? চোখ ঝলসানো রূপ দেখে ভাবছি কে এই অপ্সরা। শুনলুম রামায়ণের ফিলম হচ্ছে। তার শুটিং-এর জন্যে মুম্বই থেকে এঁরা এসেছেন। বকুলের স্বামী প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কর্তা। সুযোগসুবিধার জন্যে তাঁর সঙ্গে এঁদের সাক্ষাৎকার। তাঁর বাড়ি কলকাতায় শুনে রূপমতী আফশোস করলেন। তাঁরও তো স্বামীর বাড়ি কলকাতায়, কিন্তু স্বামীর সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। স্বামীর নাম তন্ময়।’
সুজন আরও বলল, ‘তোর ঠিকানা দিলেন তিনিই।’
অনুত্তম বলল, ‘আর ও প্রসঙ্গ কেন? তন্ময় এখন অন্যের স্বামী, তিনিও এখন অন্যের স্ত্রী। পরপুরুষ আর পরস্ত্রীর আলোচনা কি নীতির দিক থেকে বাঞ্ছনীয়?’
কথাটা অনুত্তম সুজনকে কটাক্ষ করে বলেনি। কিন্তু সুজন ওটা গায়ে পেতে নিল। বলল, ‘নীতির দিক থেকে বাঞ্ছনীয় কি না নীতিনিপুণরাই বুঝবেন। আমার তো মনে হয় সত্যের দিক থেকে বাঞ্ছনীয়। নইলে আমার নিজের কাহিনি অকথিত থেকে যায়।’
‘ওঃ তাই নাকি?’ চমকে উঠল অনুত্তম। ‘তোর নিজের কাহিনি—’
‘ওই নীল চশমাটা হল নীতির চশমা। ওর ভিতর দিয়ে দুনিয়ার দিকে তাকালে ভালো-মন্দ এই দুটো জিনিসই চোখে পড়ে। যা ভালো-মন্দের অতীত তার জন্যে চাই মুক্ত দৃষ্টি। সেটা নীতিনিপুণদের নীল চশমার সাধ্য নয়।’
অনুত্তম আহত হয়ে বলল, ‘তোর নিজের কাহিনি যদি অবাঞ্ছনীয় হয়ে থাকে তা হলেও আমি শুনব, ভাই সুজন। তা বলে আমাকে তুই দুঃখ দিস নে। এমনিতেই আমি দুঃখী।’
পুরাতন বন্ধুদের পুনর্মিলনে নিছক আনন্দ নেই, বেদনাও আছে। বেদনাটা এইজন্যে যে তাদের একজনের মত বা মতবাদ আরেকজনের থেকে এত বেশি ভিন্ন যে যতক্ষণ নীরব থাকা যায় ততক্ষণই শান্তি, অন্যথা অশান্তি। কবিগুরু, গ্যয়টে পুরাতন বন্ধু বা প্রেমিকদের পুনদর্শন পছন্দ করতেন না। সুজনের ওকথা মনে পড়ে গেল।
তিন বন্ধুরই বাক্যালাপ আপনি বন্ধ হয়ে এসেছে, সিগারেট খাওয়া ছাড়া আর কিছুই যেন করবার নেই, এমন সময় হইহই করে ঘরে ঢুকল কান্তি। উল্লাসে আহ্লাদে প্রাণের উচ্ছলতায় অকৃপণ। এই একটা ‘শো’ দিচ্ছে তো এই একবার মহড়া দিচ্ছে। এই একজনের বাড়ি খেতে যাচ্ছে তো এই একজনের বাড়ি শুতে যাচ্ছে। এখানে ওর মাসিমা, ওখানে ওর পিসিমা, বাঙালি গুজরাতি সিন্ধি। রকমারি ভাষা শিখেছে কান্তি, কখনো উর্দু আওড়াচ্ছে, কখনো তামিল, কখনো ভাঙা ভাঙা ফ্রেঞ্চ। পারসি ও ভাটিয়া বন্ধুরা চাঁদা করে পাথেয় দিচ্ছে, তাই নিয়ে প্যারিস যাচ্ছে সদলবলে।
‘তোরা তিন জনে প্যাঁচার মতো বসে আছিস কেন রে? ওঠ। ফোটো তোলাতে হবে। নাজুকে বলে এসেছি তৈরি থাকতে। চল’। এই বলে কান্তি অনুত্তমের টুপিতে টান দিল, সুজনের টাকে চিমটি কাটল, তন্ময়ের পিঠে থাপ্পড় মারল।
ঘরের জমাট আবহাওয়া তরল হল তার তারুণ্যের কিরণ লেগে। বয়সের চিহ্ন নেই তার শরীরে। তবে গভীরতার আভাস পাওয়া যায়।
‘সুজনকে তো দেখছি। সুজনিকা কোথায়? বড়ো আশা করেছিলুম রে। নিরাশ হলুম। আর তন্ময়, তোর সঙ্গে এক বার দেখা হয়েছিল পুনায়, তোর তন্ময়িনীর সঙ্গেও। মনের মতো বউ পেয়েছিস, আর ভাবনা কীসের! অতীতের জন্যে হা-হুতাশ করে জীবন অপচয় করিসনে। এই অনুত্তম, তোর দেশের কাজ কি কোনোদিন ফুরোবে না? ঘরসংসার করবিনে? বলিস তো একটি পাত্রী দেখি তোর জন্যে। একটি অনুত্তমা।’
‘তোর নিজের কথা বল, আমার কথা পরে হবে।’ অনুত্তম তার কাছে সরে এল।
‘আমার কথা খুব সংক্ষিপ্ত নয়, কিন্তু আমার সময় সংক্ষিপ্ত। জাহাজ ধরতে হবে। তা তুইও চল না আমার সঙ্গে এক জাহাজে? তোরাই তো গভর্নমেন্ট। পাসপোর্ট পেতে আধ ঘণ্টাও লাগবে না। প্যাসেজ আমি দেব।’
অনুত্তম মুচকি হাসল। কান্তি কী করে জানবে কার চিঠি রয়েছে তার ব্রিফকেসে। মহামান্য আগা খাঁর। দরকার হলে সে প্যারিসে উড়ে যেতে পারে তাঁর চিঠির জবাব দিয়ে আসতে।
‘কান্তি, তোর বোধ হয় মনে পড়ছে না যে পুরীতে আমরা স্থির করেছিলুম আবার যখন চার জনে মিলিত হব তখন যে-যার অন্বেষণের কাহিনি শোনাব। আমার কাহিনি তো সকলে তোরা জানিস, সময় থাকলে সমস্তটা শোনাতুম। এখন তোদের তিনজনের কাহিনি শোনা যাক। ফোটোর জন্যে আমিই ব্যবস্থা করছি। জাহাজঘাটেই ভালো হবে।’ বলল তন্ময়।
‘সুজন দেশে ফিরেছে, অনুত্তমও আর জেলে যাচ্ছে না, তন্ময় তো তার অন্বেষণ পর্ব শেষ করে দিয়েছে। আমি ইউরোপ থেকে ঘুরে আসি, তার পরে একটা দিন ফেলে আমরা চারজনে একত্র হব কোনো এক জায়গায়। তখন প্রাণখুলে গল্প করার মতো অবসর জুটবে। আজকের এই মিলনটা বিদায়ের ছায়ায় মলিন। ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে থেকে কি জীবনের রাগিণী বিস্তার করা যায়? এ যেন রেডিয়োতে গান গাওয়া। কাহিনি থাক, শুধু বলা যাক, কে কোথায় পৌঁছেছে।’
কান্তির এ প্রস্তাব সমর্থন করল সুজন। ‘কে কোথায় পৌঁছেছে। তন্ময়, তুই শুরু কর।’
তন্ময় বলল, ‘আমি একেবারে পৌঁছে গেছি। বুড়ি ছুঁয়েছি। আমার অন্বেষণের আর কোনো পর্যায় বাকি নেই। রূপমতীকে দেখেছি, চিনেছি, পেয়েছি, হারিয়েছি, হারানো সত্ত্বেও চিরকালের মতো পেয়েছি। মাত্র কয়েকটা বছরে যা অনুভব করেছি সারাজীবনেও তা হয় না। ওই কয়েকটা বছরই আমার সারাজীবন। বাকিটা তার সম্প্রসারণ।’
‘আমি’, অনুত্তম বলল, ‘এখনও পৌঁছোইনি। আমার মনে হচ্ছে সামনে আর একটা সংঘাত আসছে। ইংরেজ তার আগে নড়বে না। তার জন্যে দেশকে তৈরি করা আমার কাজ। দেশ যখন তৈরি হবে তখন সেই ঘনঘটার মধ্যে আবার পদ্মাবতীর সঙ্গে আমার শুভদৃষ্টি ঘটবে। তুই ইউরোপ থেকে ফিরে দিন ফেলতে চাস, কান্তি। দিনটা বোধ হয় পাঁচ বছরের আগে নয়। তার আগে আমি কোথাও পৌঁছোব না।’
সুজন বলল, ‘আমার অবস্থা তন্ময় ও অনুত্তম এ দু-জনের মাঝামাঝি। আমার কাহিনি এখনও সমাপ্ত হয়নি, কিন্তু তার সমাপ্তির জন্যে পাঁচ বছর অপেক্ষা করা নিষ্প্রয়োজন। আমার জীবনটা যে এত দীর্ঘ হবে তা কি আমি ভেবেছি? ধরে নিয়েছি কাহিনিটা শেষ হবার আগে জীবনটা শেষ হয়ে যাবে। তা যখন হল না তখন কাহিনিটাই সংক্ষেপ করে আনব। আমার কলাবতীকে আমি কোনোদিনই পাব না, এক-শো বছর বাঁচলেও পাব না। এ জন্মে নয়। এ বিশ্বাস দৃঢ় হল এবার কলম্বো গিয়ে।’
বলতে বলতে সুজনের কন্ঠস্বরে কারুণ্য এল। ‘আমার সাধ্যের সীমা কতদূর তার একটা আভাস পেয়েছি। সাধ্যের অতিরিক্ত করতে গেলে সাধনায় সিদ্ধিলাভ হয় না, শুধু জীবন বৃথা যায়। তার চেয়ে পরাজয় বরণ করা শ্রেয়। আমি পরাজিত, একথা বলতে একদিন আমার আত্মাভিমানে বাধত। এখনও বাধছে। কিন্তু এমন দিন আসবে যেদিন আমি অসংকোচে হার মানব।’
‘যেমন আমি মেনেছি হার!’ তন্ময় ক্ষীণ স্বরে বলল।
এবার কান্তির পালা। একটু আগে যে হইচই করছিল, খই ফুটছিল যার মুখে, সে একেবারে চুপ। নিথর নিঃস্পন্দ হয়ে বসেছিল ধ্যানীবুদ্ধের মতো। জাহাজ ধরতে হবে, তার জন্যে তাড়া নেই। বলবে না মনে করেছিল, কিন্তু না বলে উপায় নেই। কী বলবে? কতটুকু বলবে?
‘অনুত্তম, সুজন, তন্ময়’, ধীরে ধীরে বলতে লাগল কান্তি, ‘তোদের অন্বেষণ আর আমার অন্বেষণ একজাতের নয়। আমার কান্তিমতী সবঠাঁই রয়েছে। তাকে খুঁজে পাবার জন্যে কোথাও যেতে হবে না। তাই পৌঁছোনোর প্রশ্ন ওঠে না। আমি গোড়া থেকেই পৌঁছে রয়েছি।’
‘তা হলে’, কান্তিই আবার বলল, ‘কীসের অন্বেষণে আমি ঘুরছি? কবে সাঙ্গ হবে অন্বেষণ? আমিও নিজেকে এসব কথা জিজ্ঞাসা করি। উত্তর পাই, কোথাও বাঁধা থাকব না, কারও সঙ্গে নীড় বাঁধব না, আকাশে আকাশে পাশাপাশি উড়ব। কিন্তু আরেকজন রাজি হলে তো! সে যদি বলে, আকাশে আকাশে পাশাপাশি নয়, বাঁধা নীড়ে পাশাপাশি, তাও এক বসন্তে নয়, প্রতি বসন্তে, সারাজীবনের সব ক-টা ঋতুতে। সে যদি বলে, সংসারী হও, সন্তানের ভার নাও, সমাজের সঙ্গে বোঝাপড়া করে শান্তিতে থাক, তার পরে যদি সুযোগ হয় তবেই সৃষ্টি করবে, নয় তো নয়!’
বন্ধুরা সমব্যথী। কেউ কোনো মন্তব্য করে না। তখন কান্তি শুধু এইটুকু বলে শেষ করে দেয়, ‘আমি অপরাজিত। অপরাজিতই থাকব।’
ঘরের আবহাওয়া আবার জমাট হয়ে আসছে দেখে তন্ময় হেসে বলল, ‘যদি না মেলে অপরাজিতা।’ বলে সুজনের সঙ্গে চোখাচোখি করল। কিন্তু সুজনের চোখে হাসি কোথায়! সে যেন আসন্ন পরাজয়ের অবশ্যম্ভাবী সম্ভাবনায় Stoic-এর মতো কঠোর। এ কোন নতুন সুজন!
অনুত্তম উঠে বলল, ‘আমাকে মাফ করিস, ভাই কান্তি। তোকে জাহাজে তুলে দিয়ে আসতে চেষ্টা করব। কিন্তু আপাতত বিদায় নিতে বাধ্য হচ্ছি। রাজনীতি অতি নিষ্ঠুরা স্বামিনী। গিয়ে হয়তো শুনব আমারই দোষে মিটমাটের সুতো ছিঁড়ে গেছে।’