০৭. অনি ঘুমুচ্ছে

অনি ঘুমুচ্ছে।

রাত মাত্ৰ নটা। অথচ মনে হচ্ছে নিশুতি। ঢাকার বাইরে গেলেই রিমির এমন হয়। নটা-দশটা বাজতেই মনে হয় মাঝরাত।

অনিকে একটা খাটে শোয়ানো হয়েছে। অন্য খাটটিতে রিমি এবং তৌহিদ শোবে। তৌহিদ বলল, দুজন এই খাটে ধরবে না। আমি নির্ধাৎ গড়িয়ে পড়ে যাব। এরচে বরং কার্পেটে শোয়া যাক। চাদর বিছিয়ে বিছানা কর।

রিমি হ্যাঁ-না কিছু বলল না। মনে হয় তার মত আছে। মত না থাকলে কঠিন গলায় না বলত। না শব্দটা এম্নিতেই খারাপ। সেই খারাপ শব্দটা কোমল গলায় বলা উচিত। রিমি তা বোঝে না।

দরজায় টোকা পড়ছে। রিমি দরজা খুলল, সার্কিট হাউসের এ্যাটেনডেন্ট। একদিনের পরিচয়েই সে হাসিমুখে ঘরের লোকের মতো জিজ্ঞেস করল, আপা কিছু লাগবে?

রিমি বলল, তোমাদের মশারি নেই? মশারি দেবে না?

মশা তো আপা নেই। তবু যদি বলেন; মশার ওষুধ স্প্রে করে দেব?

থাক দরকার নেই। উনার শ্বাসকষ্ট আছে। মশার ওষুধের গন্ধ সহ্য করতে পারবেন না।

চা দেব আপাং চা খাবেন?

উনাকে এক কাপ দাও। উনি শোবার আগে চা খান। আচ্ছা, আমাকেও দিও।

তৌহিদ হাসিমুখে বলল, তোমার চা খাওয়াটা ঠিক হবে না। রাতের ঘুম নষ্ট হবে।

হোক। চল বাইরে বসি। বাইরে বসার চেয়ার দিয়েছে।

দুজনেই বারান্দায় চলে এল। তৌহিদের ঘুম পাচ্ছে। শেষ চা-টা খাবার জন্যে জেগে আছে। রিমিকে দেখে মনে হচ্ছে তার ঘুম পাচ্ছে না। সমস্ত দিনের ক্লান্তির কিছুই তার চোখে নেই।  তৌহিদ চেয়ারে বসতে-বসতে বলল, এখান থেকে সমুদ্র দেখা যায় না। এরা সার্কিট হাউসটা উল্টো করে বানিয়েছে। আমরা বসেছি সমুদ্রের দিকে পিঠ দিয়ে।

রিমি কিছু বলল না। তাকে এখন কিছুটা বিষণ্ণ বলে মনে হচ্ছে।

তৌহিদ বলল, চুপচাপ বসে আছ কেন? কথা বল।

কথা বললেই তোমার সঙ্গে ঝগড়া হবে। কাজেই চুপচাপ বসে আছি।

ঝগড়া হবে কেন?

ঝগড়া হবে কারণ তুমি ফ্লাটা বাসে ফেলে এসেছ। ফ্লাটা সারাক্ষণ তোমার সঙ্গে ছিল। নামার সময় তুমি নামলে ফ্লাস্ক ছাড়া।

বাদ দাও।

রিমি হাসিমুখে বলল, বাদ দিলাম।

তৌহিদ একটা হাত রিমির কোলে রাখল এবং সঙ্গে-সঙ্গে সরিয়ে নিল। ছেলেটা চা নিয়ে আসছে।

চা-টা ঠাণ্ডা। পানসে ধরনের। তবু রিমি ছোট-ছোট চুমুক দিয়ে খাচ্ছে। তার খাওয়া দেখে মনে হয় তার বেশ ভালো লাগছে। রিমি বলল, আমাদের পাশের কামরায় যে ভদ্রলোক থাকেন তার সঙ্গে কি তোমার কথা হয়েছে?

না, কেন বল তো?

এম্নি জিজ্ঞেস করছি। আমার সঙ্গে কথা হয়েছে। আমি একা-একা সমুদ্রের পাশে বসেছিলাম, ভদ্রলোক আমাকে এগিয়ে দিলেন।

তৌহিদ সিগারেট ধরাতে-ধরাতে বলল, আমি আগ বাড়িয়ে কখনো কথা বলি না। কথা বললেই এক সময় বের হয়ে যাবে আমি একজন স্কুল মাস্টার। স্কুল মাস্টারদের সম্পর্কে লোকজনদের ধারণা ভালো না।

লোকজনদের কী ধারণা?

বেশিরভাগ মানুষেরই ধারণা, এরা কিছুই জানে না। এক দঙ্গল ছাত্র পড়ানোর বাইরে এদের কোনো জগৎ নেই। বদমেজাজি শুকনো রসকষহীন মানুষ।

ধারণা কি ভুল?

না ভুল না। ঠিকই আছে।

চা শেষ করার পরেও তারা অনেকক্ষণ বাইরে রইল। তৌহিদ একটা হাত রাখল রিমির কোলে। নরম গলায় বলল, বেশ লাগছে, তাই না?

হুঁ।

প্রতিবছর একবার করে আসতে পারলে চমৎকার হত।

তা হত।

এখন থেকে বেড়ানোর জন্যে আলাদা করে টাকা জমাব, কি বল রিমি?

জমিও। ম্যাট্রিক পরীক্ষার খাতা দেখার টাকাগুলো আলাদা করে রাখলেই কিন্তু হয়।

চল শুয়ে পড়ি।

তোমার ঘুম পাচ্ছে?

হুঁ।

আর একটু বস। ঘুমে আমার নিজের চোখ জড়িয়ে আসছিল। এখন কেন জানি ঘুমটা কেটে গেছে। খানিকক্ষণ বস। গল্প করি। আমরা এইভাবে বসে কখনো তো গল্প করি না। তুমি কথা বল—আমি শুনি।

কি কথা বলব?

যা ইচ্ছা বল। নিজের কথা বল। বাবা-মার কথা বল। বা তোমার ছেলেবেলার কথা। তোমার যা ভালো লাগে। নিজের কোনো কথাই তো তুমি আমাকে বল না।

বলার মত কিছু নেই।

নিজের কথা কিছু বলতে ইচ্ছা করে না। আমার শৈশব খুব কষ্টে কেটেছে। আমার চার বছর বয়সে মা মারা গেলেন। বাবা আবার বিয়ে করলেন। সেই সমার ছিল মাথা খারাপ। বিয়ের পর সেটা ধরা পড়ল। উদ্ভট সব পাগলামি করতেন। আমাদের আদর করতেন আবার মাছ কাটা বঁটি দিয়ে কেটে দুটুকরা করতে চাইতেন।

বল কী।

ভয়াবহ অবস্থা। মার হাতে একটা বঁটি আর আমরা বোনরা ভয়ে আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে ছুটাছুটি করছি এটা ছিল খুব কমন দৃশ্য। মা বঁটি দিয়ে আমার বড়ববানের পায়ে একটা কোপ বসিয়েও ছিলেন। এই যন্ত্ৰণা অবশ্যি আমাদের বেশি দিন সহ্য করতে হল না। বাচ্চা হতে গিয়ে মা মারা গেলেন। বাবা আবার বিয়ে করলেন।

বাদ দাও। আমার এসব গল্প করতে ইচ্ছা করছে না। চল যাই ঘুমুই। ঘুম পাচ্ছে।

চায়ের কাপ তো নিতে এল না।

ভেতরে নিয়ে রেখে দেব। সকালে নেবে।

বিছানা কার্পেটের ওপরই হল। কার্বাডে কম্বল ছিল। সেই কম্বল বিছিযে তার ওপর চাদর দিয়ে দেয়া হল। তৌহিদ শুতে-শুতে বলল, আরামে বিছানা হয়েছে। সে তার স্ত্রীর পায়ের উপর পা তুলে দিয়েছে। এটাই তার ঘুমানোর স্বাভাবিক ভঙ্গি।

কিছুক্ষণে মধ্যেই তার নিঃশ্বাস ভারি হয়ে এল। রিমির ঘুম এল আরো অনেক পরে। সেই ঘুমও খুব গাঢ় নয়। এলোমেলো সব স্বপ্নে ঘুম ঠাসা। সেই সব স্বপ্নেরও কোন আগা-মাথা নেই। তবে শেষরাতের স্বপ্নটা সে খুব পরিস্কার দেখল। এত পরিষ্কার যে মনে হয় এটা আসলেই ঘটছে।

সে দেখল তার শাশুড়ি জোবেদা খানম কক্সবাজার সার্কিট হাউসের এই ঘরে এসেছেন। তিনি অসম্ভব বিরক্ত। চোখ কুঁচকে আছে রাগে। তিনি ঝাঁঝাল গলায় বললেন, এসব কী হচ্ছে বৌমা?

কিসের কথা বলছেন মা?

মাটিতে শুয়ে আছ কেন? খাট থাকতে মাটিতে শুয়ে থাকা এটা আবার কোন ঢং?

মাটি কোথায় মা? কার্পেটের ওপর শুয়েছি। তার ওপর কম্বল আছে। এই দেখুন না।

আর মেয়েটাকে মশারি ছাড়া ফেলে রেখেছ। মশা তো খেয়ে ফেলছে। মেয়েটাকে।

সমুদ্রের পাড়ে মশা থাকে না মা। হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে যায়।

এইসব ঢং-এর গল্প আমার সঙ্গে করবে না তো মা। ঢং-এর গল্প আমার। ভালো লাগে না। উঠে দেখ মশা মেয়েটাকে ছিলে ফেলেছে।

রিমি উঠে বসল। এতক্ষণ সে স্বপ্ন দেখছিল এই ধারণা মনে আসতেও তার . অনেক সময় লাগল। স্বপ্ন এত স্পষ্ট হয়। এত গোছানো হয়।

মনে হচ্ছে সত্যি-সত্যি তার শাশুড়ি এসেছিলেন। রিমি মেয়ের খাটের কাছে গেল। সত্যি-সত্যি বেশ কয়েকটা মশা রিমিকে ছেকে ধরেছে। রক্ত খেয়ে এক-একটা ফুলে কোলবালিশ হয়ে আছে। আহারে বেচারাকালই মশারির ব্যবস্থা করতে হবে। এদের না। থাকে তো একটা কিনে ফেলতে হবে। এম্নিতেই একটা মশারি কেনা দরকার। ওদেরটায় অনেকগুলো ফুটো।

রিমি জানালা খুলে দিল। ঘরে আলো আসুক। আলো এলে মশা থাকবে না। তেমন আলো ঢুকল না। কারণ অন্ধকার পুরোপুরি কাটে নি। রিমি ঘরের বাতি জ্বলে দিল। নিজে মুখ ধুয়ে তৌহিদের ঘুম ভাঙাল। ভোরবেলা একসঙ্গে সমুদ্র দেখতে যাবে। অনির ঘুম ভাঙাল না। সে আরো খানিকক্ষণ ধুমুক। তৌহিদের বাথরুমে অনেক সময় লাগে।

রিমি দরজা খুলে বারান্দায় এসেই হকচকিয়ে গেল। ওরা গতরাতে যে চেয়ারে বসেছিল সেখানে বুড়ো এক ভদ্রলোক বসে আছেন। বুড়ো ভদ্রলোকের পরনে হাফপ্যান্ট। গায়ে চক্ৰাবা শার্ট। সমানে পাইপ টানছেন। রিমিকে দেখে নাটকীয় ভঙ্গিতে মাথা ঝুকিয়ে বললেন, গুড মর্নিং ম্যাডাম।

রিমি কী বলবে ভেবে পেল না। বুড়ো ভদ্রলোক মুখ থেকে পাইপ সরিয়ে নিয়ে বললেন, লেট মি ইট্রডিউস মাইসে। আমি রিটায়ার্ড জাজ সিরাজুল ইসলাম। তুমি কে? তুমি করে বলার অপরাধ আশা করি ক্ষমা করবে। বয়সের সুযোগ গ্রহণ করছি।

হা-হা-হা।

আমার নাম রিমি।

মিস না মিসেস?

মিসেস।

মিসেস রিমি, তুমি যে একজন অসাধারণ রূপবতী মহিলা এই কথাটা নিশ্চয়ই আগে অনেকবার শুনেছ। তবু এই বৃদ্ধের মুখ থেকে আরেকবার শোন।

রিমি লজ্জা পেয়ে গেল। রিটায়ার্ড ডিস্ট্রিক্ট জাজ সিরাজুল ইসলাম হড়বড় করে কথা বলতে লাগলেন।

সারা বারান্দায় কোথাও চেয়ার নেই। তোমাদের এখানে চেয়ার দেখে এসে বসলাম। আমি আমার নাতি-নাতনিদের জন্যে অপেক্ষা করছি। ওরা সমুদ্রে যাওয়ার জন্যে সাজসজ্জা করছে। কতক্ষণ লাগবে কে জানে। আটাত্তর বছর বয়সেও আমি সবকিছুতে ফার্স্ট আর ওরা লাস্ট। হা-হা-হা। তুমি কি বসবে? বস এই চেয়ারটায়।

রিমি সহজ গলায় বল, আমি বসব না। আপনি বসুন। জাজ সাহেবদের পাশে বসতে আমার ভয় করে।

ভদ্রলোক মনে হল এই কথায় খুব লজ্জা পেলেন। হা-হা করে খানিকক্ষণ হেসে রিমির হাত ধরে পাশের চেয়ারে বসালেন। রিমির মনে হয়, এই যে নিতান্ত অপরিচিত একটি মেয়েকে উনি হাত ধরে পাশে বসালেন, এ কাজটা ঢাকায় তিনি নিশ্চয়ই করতেন না। এরকম উদ্ভট সাজপোকও করতেন না। সমুদ্রের হাওয়া হয়ত মানুষের মধ্যে খানিকটা পাগলামি ঢুকিয়ে দেয়।

মিসেস রিমি?

জ্বি।

তোমার স্বামীটি কি এখনো ঘুমুচ্ছে?

জ্বি না; জেগেছেন। হাত-মুখ ধুচ্ছেন।

দ্যাটস নাইস। তাকে নিয়ে আমাদের সঙ্গে চল। একসঙ্গে সমুদ্র দেখব।

বেশ তো, চলুন।

আমি আবার বিরাট দলবল নিয়ে ঘুরতে পছন্দ করি। এখন দলের সদস্যসংখ্যা এগার। তোমরা দুজন এলে হবে তের। আনকি থারটিন।

আমার সঙ্গে আমার মেয়ে আছে।

বাঁচা গেল। আনলাকি থারটিন আর হতে হল না। এখন আমরা লাকি ফোর্টিন।

আগামীকাল আমরা যাব মহেশখালি। এখানকার ওয়াটার ডেভলপমেন্ট বোর্ডর। একটা সমুদ্রগামী জাহাজ আছে। ওরা ঐটি আমাদের একদিনের জন্যে ছেড়ে দিয়েছে। দুপুরের খাওয়াদাওয়া জাহাজেই হবে।

তোমার সঙ্গে তাহলে কাল সারাদিনের প্রোগ্রাম সেটেল করলাম। মনে থাকবে?

রিমি হাসিমুখে বলল, থাকবে।

ভেরি গুড। এই দেশে আসলে সত্যিকার অর্থে দেখার কিছু নেই। গত সামারে আমি আমার বড় ছেলের কাছে গিয়েছিলাম সিয়াটলে, অসাধারণ। যেমন প্রকৃতি তেমনি তার রক্ষণাবেক্ষণ। আমেরিকানদের কারবারই অন্যরকম। ইউরোপ দেখা হয়। নি। ইটালিতে আমার ছোট মেয়ে আছে। হাসবেত্ত আই স্পেশালিস্ট। আমাকে যেতে বলেছে। সামনের সামারে যাবার ইচ্ছা।

আপনার তো খুব মজা। ঘুরেঘুরে বেড়াচ্ছেন।

তা ঠিক। রিটায়াড় জীবন উপভোগ করার চেষ্টা করছি। অনেকে তা করে না। ভালো কথা, তোমার হাসবেন্ড কী করেন তাতো জানা হল না।

উনি মাস্টারি করেন। স্কুল টিচার।

স্কুল টিচার?

জাজ সাহেবের মুখ হঠাৎ একটু পানসে হয়ে গেল। মনে হল তিনি একটা ধাক্কা খেলেন। রিমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

একেবারে শেষপ্রান্তের ঘর থেকে পুতুলের মত একটি মেয়ে বের হয়ে বলল, গ্রান্ডপা, এস আমরা রেডি। জাজ সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, দেখি ওরা কদ্র কী করেছে।

বুড়োভদ্রলোক দলবল নিয়ে নিচে নামলেন। তৌহিদ তখন বারান্দায়। জাজ সাহেব তাঁর দল নিয়ে দোতলা থেকে একতলায় নামছেন। তিনি একবারও তৌহিদের দিকে ফিরে তাকালেন না।

তৌহিদ বলল, এই বুড়ো ভদ্রলোক কী অত পোশক পরেছেন দেখেছ? রিমি জবাব দিল না। তার কান্না পাচ্ছে। নিজেকে বড়ই তুচ্ছ ও ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে।

তৌহিদ বলল, অনিকে ডেকে তোল, চল যাই সমুদ্রে পা ভিজিয়ে আসি।

রিমি ক্লান্ত গলায় বলল, চল।

 

সমুদ্রের কাছে এসে রিমির মন বুড়িয়ে গেল। তার কাছে মনে হল ঐ জাজ সাহেব যত। বড়ই হোন তিনিও অতি ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ। সমুদ্র সব মানুষকে এক পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।

এখন জোয়ারের সময়।

সমুদ্র ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। আকাশে মেঘ জমেছে বলেই সমুদ্রকে যেন কালো দেখাচ্ছে। কালো জলের মাথায় হঠাৎ-হঠাৎ সাদা ফেনার ফুল ফুটেই আবার মিলিয়ে, যাচ্ছে। কী অসম্ভব সুন্দর।

অধিকাংশ মানুষই এই সৌন্দৰ্য উপেক্ষা করে ঝিনুক কুড়াচ্ছে। শিশুদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে বয়স্ক মানুষ। একটা জীবন্ত তারা মাছ বালির উপর ভেসে উঠেছে। তাকে ঘিরে একদল কৌতূহলী মানুষ। একটি বাচ্চা ছেলে মাকে জিজ্ঞেস করল, মা, তারা মাছ কি আমরা খাই?

মা ছেলেটির গালে ঠাস করে একটা চড় বৃসিয়ে দিয়ে বললেন, গাধা, সব জায়গায় গাধামি করে। স্টার ফিস তোক কখনো বেঁধে দিয়েছি যে জিজ্ঞেস করছিল?

লজ্জায়, অপমানে ছেলেটির চোখে পানি এসে গেল। সমুদ্র বোধহয় তা টের পেল। ছেলেটির মা সমুদ্রে নামামাত্র প্রবল একটা ঢেউ এসে মাকে উল্টে ফেলে দিল। তীরে দাঁড়ানো সবাই হেসে উঠল হো-হো করে।

ছোটে-ছোট জাল নিয়ে প্রচুর জেলে নেমেছে সমুদ্রে। তারা ধরছে চিংড়ি মাছের। পোনা। একেকটা পোনা তারা এক টাকা করে বিক্রি করবে। আজ জেলেদের ভাগ্য ভালো—প্রচুর পোনা ধরা পড়ছে।

স্নানের পোশাক পরা দুজন বিদেশিনী পানিতে নেমেছে। এদের অসম্ভব সাহস। এরা অনেক দূর চলে গেছে। হাত-পা ছড়িয়ে তারা নানা ভঙ্গিমায় পানির উপর নাচানাচি করছে। ওদের সঙ্গের পুরুষ দুজন পানিতে নামে নি। ভেজা বালুতে বসে বর্মী চুরুট টানছে এবং হাসাহাসি করছে। মেয়ে দুটি যে এত দূরে চলে গেছে তা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।

শুধু রিমির কেন জানি প্রচণ্ড ভয় করছে। মনে হচ্ছে-একটা বড় ঢেউ উঠে এসে মেয়ে দুটিকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।

একজন ভদ্রলোককে দেখা গেল গলা ফুলিয়ে পাশের এক ভদ্রলোকের সঙ্গে তর্ক করছেন, আরে ভাই আমি তো না জেনে বলছি না। জেনেশুনেই বলছি। ভদ্রলোকের নাম হিরাম কক্স। তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন ক্যাপটেন ছিলেন। তার নামানুসারে কক্সবাজারের নাম করা হয়।

আপনি কিছুই জানেন না। কসাহেব ছিলেন একজন ব্রিটিশ আইসিএস। তিনি এই জায়গা ঘুর করতে এসে নাম দেন কক্সবাজার, আগে এই জায়গার নাম ছিল বালু। বালু একটা বার্মিজ শব্দ, যার অর্থ নীল পানি।

দয়া করে এইসব আজগুবি কথা বলবেন না-তো।

আপনি দয়া করে ইতিহাস কপচাবেন না।

বাঙালি নিজের প্রেজেন্ট জানে না, পাস্ট নিয়ে চোঁচামেচি করে। আগে জানবেন প্রেজেন্ট, তারপর পাস্ট।

আপনি কিন্তু ভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন।

আর আপনি মূৰ্খামির সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন।

শাট আপ।

ইউ শাট আপ।

রিমি অবাক হয়ে ওদের ঝগড়া শুনছে। দুজন বয়স্ক মানুষ শিশুদের মধ্যে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়া করে? তাও সমুদ্রের কাছে এসে? এর কোন মানে হয়?

রিমির ঠিক গায়ের ওপর একটা পাজেরো জিপ হস করে থামল। ড্রাইভারের পাশে বসা মানুষটা নেমে এসে হাসি হাসি গলায় বলল, চিনতে পারছেন?

রিমি বলল, পারছি।

বলার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে না চিনতে পারছেন। বলেন তো কে?

কাল রাতে আপনার সঙ্গে কথা হয়েছে।

রাইট। রাতে আপনি এমন একটা ভঙ্গি করলেন যাতে মনে হল আপনি আমাকে খারাপ ধরনের ভিলেন ভেবে বসে আছেন। এইটা আপনার মেয়ে।

জ্বি। অনি, স্লামালিকুম দাও।

অনি বলল, আমি কাউকে স্লামালিকুম দিতে পারব না। ভদ্রলোক হাসিমুখে বললেন, আপনার স্বামী কোথায়?

ঐ যে।

যান আপনার স্বামীকে ডেকে নিয়ে আসুন আপনাদের হিমছড়ি দেখিয়ে আনি। সরকারি গাড়ি পাওয়া গেছে।

রিমি অস্বস্তির সঙ্গে বলল, দরকার নেই। আমরা সমুদ্রের কাছেই থাকব। অন্য কোথাও যাব না।

আপনাদের কোথাও যেতে হবে না। সমুদ্রের কাছেই থাকতে পারবেন। আমরা তীর ঘেঁষে-ঘেঁষে যাব।

না থাক।

আপনার অস্বস্তির কারণটা বুঝতে পারছি না। আপনি কি এখনো আমাকে ভিলেন ভাবছেন?

না।

আচ্ছা আমি আপনার স্বামীর সঙ্গে কথা বলছি। উনাকে দেখে মনে হচ্ছে উনি আপনার মতো এত কঠিন না। ভালো কথা, উনি কী করেন জানতে পারি? প্রফেশানটা আগে জানা থাকলে আলাপ জমাতে সুবিধা হয়।

উনি একজন স্কুল টিচার।

তাই নাকি? আমার বাবাও স্কুল টিচার ছিলেন। তাঁর ভয়ে আমরা থরথর করে কাঁপতাম। শুধু যে আমরা তাই আমার মা, খালা সবাই। আপনার স্বামী আশা করি তেমন ভয়ংকর না।

রিমি হেসে ফেলল। তার মনে একগাদা বালি জমে খচখচ করছিল। সমুদ্রের একটা বড় ঢেউ এসে সব ধুয়ে নিয়ে গেল।

 

জিপ দ্রুতগতিতে চলছে। মাঝেমাঝে ছুটছে হাতখানিক পানির ওপর দিয়ে। অনির বিস্ময়ের সীমা নেই। সে একটু পরপর বলছে, আমাদের এই গাড়ি জাহাজের মতে, তাই না বাবা? পানির ওপর দিয়ে যেতে পারে।

রিমির এই ভদ্রলোককে বেশ ভালো লাগল। তাঁর নাম জামাল হোসেন। বয়স পঞ্চাশের ওপর, দেখায় চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ। সিএসপি অফিসার। সরকারি কাজে এসেছেন। কাজ শেষ করেছেন। আগামীকাল ভোরে চলে যাবেন।

জামাল হোসেন বললেন, লোকজন হিমছড়িতে আসে খুব আগ্রহ নিয়ে। ভাবে বিশাল একটা জলপ্রপাত দেখবে। গিয়ে দেখে ছোট্ট একটা পানির ধারা। দেখে মনে হয় উঁচু পাহাড়ের মাথায় কেউ একটা পানির ট্যাপ খুলে দিয়েছে। তবু লোকজন আসে। হতাশ হওয়ার জন্যে আসে। অবশ্যি পুরাপুরি হতাশ হয় না।

হতাশ হয় না কেন?

হিমছড়িতে আসার পথে দীর্ঘ বেলাভূমি চোখে পড়ে। এই বেলাভূমির সৌন্দর্যের তো কোনো সীমা-পরিসীমা নেই, তাই না?

রিমি বলল, হ্যাঁ নাই। এত সুন্দর যে মন খারাপ হয়ে যায়।

আসলেই তাই। পৃথিবীর সব সুন্দর জিনিসের সামনে দাঁড়ালেই মন খারাপ হয়। এটা মানুষের বেলায়ও সত্যি। আমার প্রথম স্ত্রী খুব রূপবতী ছিল। সে এতই সুন্দর ছিল। যে তার দিকে তাকালেই মন খারাপ হয়ে যেত।

উনি কি মারা গেছেন?

হ্যাঁ। বিয়ের দুবছরের মাথায় চাইল্ড বার্থে। সেও বাঁচে নি। বাচ্চাটিও বাঁচে নি। আমার স্ত্রীর নাম ছিল আনুশকা। মৃত শিশুরও না-কি নাম প্রয়োজন হয়। কাজেই আমি আমার মৃত কন্যাটিরও নাম রেখেছিলাম। ওর নাম দিয়েছিলাম ছোট আনুশকা। ও তার মায়ের মতোই হয়েছিল। হয়তবা সে তার মায়ের চেয়েও সুন্দর হয়েছিল।

তৌহিদ মৃদুস্বরে বলল,এই অপ্রিয় প্রসঙ্গটা বাদ থাক ভাই সাহেব।

আচ্ছা বাদ থাক। চলুন আমরা আনন্দ করি। খুকী তোমার নাম কি?

আমার নাম বলতে ইচ্ছা করছে না।

তুমি কি গান জান খুকী?

আমার নাম অনি।

তুমি কি গান জান অনি?

জানি, কিন্তু গাইব না। আমার অবশ্যি একটা গান শোনার খুব ইচ্ছা করছিল।

অনি খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে যেন নিজের মনেই গাইছে এমন ভঙ্গিতে গান শুরু করল, আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে..

কচিকণ্ঠের গান। যে গানের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক করছে সমুদ্রের মতো বড় সুরকার, সেই গান তো অপূর্ব হবেই। সবার মন অন্যরকম হয়ে গেল। ড্রাইভার পর্যন্ত দুবার পেছনে ফিরে গায়িকাকে দেখল। তৌহিদ মুগ্ধ। তার মেয়ে এত সুন্দর গাইতে পারে তা সে কল্পনাও করে নি। কোত্থেকে সে গান শিখল?

 

জলপ্রপাত দেখে রিমি মুগ্ধ। সে ভেবেছিল দেখবে ছোট্ট জলের ধারা। দেখা গেল তা নয়, প্রবল বেগে পানি নেমে আসছে। জামাল হোসেন বললেন, বর্ষাকাল বলে এত পানি। আসলে এত পানি থাকে না।

অনি বলল, আমি আপনার কোলে উঠব।

অবশ্যই উঠবে। এস।

ভদ্রলোক অনিকে ঘাড়ে তুলে নিলেন। হাসিমুখে বললেন, শিশুদের অনেক অসাধারণ ক্ষমতার একটা হল সব কিছু নিজের করে নেয়া। যখন সে একটা গাড়িতে চড়বে তখন বলবে এটা আমাদের গাড়ি। যখন ট্রেনে চড়বে; বলবে আমাদের ট্রেন। এখন অনি আমার ঘাড়ে চড়ে মনে-মনে বলছে আমাদের মানুষ। হা-হা-হা। তৌহিদ সাহেব আপনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন কেন ছবি তুলুন।

তৌহিদ লজ্জিত মুখে বলল, আমাদের কোন ক্যামেরা নেই।

আগে জানলে আমারটা নিয়ে আসতাম। ওটা ফেলে এসেছি সার্কিট হাউসে আমার স্ত্রীর কাছে। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর আমি আবার বিয়ে করি। উচিত ছিল দেবদাস হয়ে যাওয়া, সেটা সম্ভব হয় নি।

রিমি জিজ্ঞেস করবে না করবে না করেও জিজ্ঞেস করে ফেলল, উনাকে নিয়ে আসেন না কেন?

ওর সমুদ্র ভালো লাগে না। ও প্রায়ই আসে কক্সবাজার। বেশিরভাগ সময় রেস্ট হউসে শুয়ে থাকে। বার্মিজ মার্কেটে শপিং করে। আপনাদের হয়তবা ধারণা হচ্ছে ও একটু অন্যরকম। আসলে তা না, ও চমৎকার একটি মেয়ে। আপনাদের সঙ্গে কথা হলেই বুঝবেন। আসুন জলপ্রপাতে স্নান করা যাক। অবশ্যি এটাকে জলপ্রপাত না বলে ঝরনা বলাই যুক্তিযুক্ত।

আমরা তো গোসলের কাপড় আনি নি।

ভেজা কাপড়ে ফিরব। কোনো অসুবিধা নেই। আসুন।

সবাই পানিতে নেমে গেল। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয় বর্ষণ। প্রচণ্ড বৰ্ষণ। বৃষ্টির পানি বরফের চেয়েও শীতল। সুচের মতো গায়ে ফুটছে। সবাই দৌড়ে গাড়িতে চলে এল।

সমুদ্র ফুঁসতে শুরু করেছে। বাতাসের সঙ্গে-সঙ্গে একেকটা ঢেউ লাফিয়ে উঠছে – অনেক দূর। জামাল সাহেব বললেন, অবস্থা খুব ভালো মনে হচ্ছে না। তাড়াতাড়ি রওনা হওয়া ভালো।

অনি খুব সহজ গলায় বলল, চাচা আজ কি আমরা সবাই মারা যাব?

তোমার কী মনে হয়?

আমার মনে হয় মারা যাব।

অনিকে আসন্ন মৃত্যুচিন্তায় মোটও চিন্তিত মনে হল না। তাকে বরং উল্লসিতই মনে হল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *