2 of 3

০৭৭. লোকটা কী বলছে

লোকটা কী বলছে তা কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছিল না হেমকান্তর। কিন্তু ধীর স্থির মানুষ, বেশি কথা বলা বা তর্ক করা তার স্বভাব বিরুদ্ধ। তাই তিনি খানিকক্ষণ সামান্য বিস্ময়ের দৃষ্টিতে রামকান্তর দিকে চেয়ে থেকে বললেন, আমি তাকে চিনি?

চেনারই কথা।

চিনতে পেরেও বলছি না? এ কী করে সম্ভব? যে আমাকে খুন করতে চেষ্টা করেছে তাকে চিনতে পেরেও চুপ করে থাকব কেন?

আমাদেরও সেইটেই প্রশ্ন।

হেমকান্ত মাথা নেড়ে বললেন, আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

এমনও তো হতে পারে যে আততায়ি আপনার একজন প্রিয়পাত্ৰই হবে। সেক্ষেত্রে তার নাম বলতে না চাওয়াটা স্বাভাবিক।

হেমকান্ত চুপচাপ দারোগা সাহেবের মুখের দিকে বিস্মিত চোখে চেয়ে রইলেন। এরা তিলকে তাল করতে ওস্তাদ। সরলকে জটিল করায় এদের জুড়ি নেই।

হেমকান্ত মৃদু একটু হেসে বললেন, রহস্য না রেখে যদি তার নামটা বলেন তা হলে আমার উৎকণ্ঠা অনেক কমে যায়।

রামকান্ত রায় হাসলেন। খুবই উচ্চাঙ্গের হাসি। তাতে প্রচুর অহংকার এবং প্রত্যয় মিশে আছে। বললেন, ব্যস্ত হবেন না। এখনই তার নামটা করতে পারছি না।

হেমকান্ত ধৈর্য হারালেন না। শরীরটা দুর্বল। আচমকা আততায়ি গ্রেফতারের খবরটায় এবং রামকান্ত রায়ের এইসব হেঁয়ালি শুনে উদ্বেগে শরীরটা আরও দুর্বল লাগছে। তিনি চোখ দুটো একটু বুজলেন।

রামকান্ত রায় বললেন, আপনাকে আমার দু-একটি প্রশ্ন করার ছিল।

করুন।

স্বদেশি অর্থাৎ টেররিস্টদের প্রতি আপনার এই দুর্বলতা কেন?

কে বলল আমি টেররিস্টদের প্রতি দুর্বল?

আমরা সবই টের পাই, হেমকান্তবাবু।

হেমকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, আমি তো কিছুই করিনি যাতে আপনার ওরকম মনে হতে পারে!

আপনি করেননি? আপনার বাড়িতে শশীকে আশ্রয় দিয়েছিলেন সেকথা না হয় ছেড়েই দিচ্ছি। কিন্তু আপনার ছোট ছেলে কৃষ্ণকান্ত যে স্বদেশি হিসেবে তৈরি হচ্ছে সে খবর আপনার অজানা থাকার কথা নয়।

কৃষ্ণ!বলে হেমকান্ত চমকে উঠে বলতে চেষ্টা করলেন। বুকটা বড় বেশি ধক ধক করতে লাগল। রক্তস্রোত কি ভীষণ জোরে বইছে? হেমকান্ত খলিত কণ্ঠে বললেন, কী করেছে কৃষ্ণ?

কী করেনি বলুন? সে স্বদেশি করবে বলে ব্যায়াম করে, লাঠি খেলে, বন্দুক চালায়, ব্রহ্মচর্য করে। আমরা সব খবরই রাখি।

হেমকান্ত অবাক হয়ে বলে, শরীরচর্চা বন্দুক চালানো এসব তো আমরাও করতাম।

কিন্তু কৃষ্ণকান্ত এসব অকারণে করছে না। তার বন্ধুদের কাছে আমরা জানতে পেরেছি সে খুব বেশি মাত্রায় স্বদেশি মনোভাবাপন্ন।

হেমকান্ত মাথা নেড়ে বললেন, হতেই পারে না। আপনি ভুল জানেন।

আমাদের ইনফরমেশন কদাচিৎ ভুল হয়।

কৃষ্ণ আমার ছেলে, তার নাড়িনক্ষত্র আমি জানি।

সবটা জানেন না। আপনি স্নেহান্ধ বাবা, সবটা কী করে জানবেন? আর-একটা কথাও না জানিয়ে পারছি না।

বলুন।

আপনাদের পুরুতঠাকুরের মেয়ে রঙ্গময়ি সম্পর্কেও আমাদের কাছে কিছু ইনফরমেশন আছে।

হেমকান্ত ফের উত্তেজিত হয়ে উঠে বসার চেষ্টা করেন। কিন্তু পারেন না। মাথাটা একটু ঘুরে যায়। বলেন, সে আবাব কী করল?

ওঁর প্রতি আপনার সফটনেসের কথাও আমরা জানি। এক্ষেত্রেও আপনি আমাদের সঠিক তথ্য জানাবেন না বলেই ধরে নিচ্ছি। শুধু বলে দিচ্ছি, ওঁর বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিতে আমাদের বাধ্য করবেন না।

হেমকান্ত খুব বিস্বাদ অনুভব করলেন মনটায়। তার ও রঙ্গময়ির সম্পর্ক নিয়ে পুলিশও কথা বলছে! ভিতরটা উত্তপ্ত হয়ে উঠছিল তার। দারোগা সাহেব বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ তাকে ছোট ছেলের মতো ধমকাচ্ছেন। এবার একটু প্রতিবাদ করা উচিত।

হেমকান্ত মৃদু স্বরে বললেন, আপনি আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছেন কি?

ভয় দেখানো আমার কাজ নয়। আমার কাজ সতর্ক করা।

কিন্তু রঙ্গময়ি কী করেছে তা আপনি এখনও বলেননি। ক্রমাগত হেঁয়ালিতে কথা বললে তো হবে। আপনাকে পরিষ্কার করে বলতে হবে আমার ছেলে এবং রঙ্গময়ি সম্পর্কে আপনার অভিযোগ কী।

অভিযোগ এখনও করছি না। শুধু সন্দেহ প্রকাশ করছি। বিলিতি কাপড় পোড়ানোর ব্যাপারে রঙ্গময়ির ইনস্টিগেশন ছিল। আপনি ওঁকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবেন। সেই ঘটনায় ফায়ারিং-এ দুজন মারা গেছে। যে কজন অ্যারেস্টেড হয় তাদের একজনের কাছ থেকে আমরা। রঙ্গময়ির সম্পর্কে ইনফরমেশন পাই। অবশ্য সন্দেহ আমাদের আগে থেকেই ছিল। শশীকে উনি শেল্টার দেওয়ার খুব চেষ্টা করেছিলেন।

হেমকান্ত হতাশভাবে মাথা নেড়ে বললেন, আমি কিছুই জানি না। আর বিলিতি কাপড় পোড়ানো থেকে শুরু করে সবরকম আন্দোলন তো সারা দেশেই হচ্ছে। এর জন্য রঙ্গময়ির প্ররোচনার দরকার কী? আপনিই-বা এসব অনুমান করতে যাচ্ছেন কেন?

অনুমান নয়। আমরা শুধু অনুমানের ওপর নির্ভর করে কিছু বলি না।

রামকান্তবাবু, আপনি কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন তা ভুলে গেছেন। আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ বটে, কিন্তু কেউ আমাকে চোখ রাঙায় এটা আমি পছন্দ করি না।

রামকান্ত রায় একটু অবাক হলেন। লোকটিকে তিনি নিরীহ বলেই জানতেন। কিন্তু আজ হঠাৎ এঁর ভাবান্তর এবং কাঠিন্য দেখে তাকে থতমত খেতে হল। তবে তিনি সব পরিস্থিতিতেই মানিয়ে নিতে পারেন। তাছাড়া তিনি জানেন, এসব জমিদারদের কিছু রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকে, প্রভাব-প্রতিপত্তিও তো কম নয়। একজন দারোগাকে বদলি বা বরখাস্ত করা খুব কঠিন নাও হতে পারে। হেমকান্ত দাপুটে বা প্রভাবশালী লোক নন বটে, কিন্তু তার প্রভাবশালী শুভানুধ্যায়ির অভাব নেই।

রামকান্ত রায় গলার স্বর নরম করে ফেললেন। বললেন, আপনার ভালর জন্যই বলছি। আপনি যে নির্বিরোধী মানুষ একথা কে না জানে? তবু আপনার বাড়িতে কোনওরকম সিডিশাস অ্যাকশন হলে তো বিপদ আপনারই। আমি সরকারের চাকর মাত্র।

হেমকান্ত মাথা নেড়ে বললেন, শুধু সেটুকু হলে আমার বলার কিছু থাকত না। কিন্তু আমার মনে হয় আপনার এই পরিবারের প্রতি একটু আক্রোশও আছে।

না, কী যে বলেন।

হেমকান্ত একটু ক্ষীণ হেসে বললেন, প্রথম থেকেই আপনি ধরে নিয়েছেন যে, আমি স্বদেশিদের প্রতি সিমপ্যাথেটিক। ওরকম মনোভাব ভাল নয়। যখন আমাকে ছোরা মারা হল তখনও আপনি এটাকে অন্যভাবে দেখার চেষ্টা করছেন। আমার কাছে ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগছে।

রামকান্ত রায় গম্ভীর এবং অপ্রস্তুত অবস্থায় চুপ করে রইলেন। তারপর হঠাৎ বললেন, আচ্ছা, তা হলে চলি।

রামকান্ত রায় চলে যাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কনক এসে ঘরে ঢুকল। পিছনে জীমূতকান্তি।

কী হল, বাবা?

হেমকান্ত সহাস্যে বললেন, কিছু নয়। চিন্তা কোরো না।

কী বলতে এসেছিল?

একটা খবর দিয়ে গেল। লোকটা নাকি ধরা পড়েছে।

পড়েছে?

সত্যি-মিথ্যে জানি না। তবে লোকটা সুবিধের নয়।

কনককান্তি বলল, সুবিধের তো নয়ই। দারুণ বদনাম।

একটা অদ্ভুত কথা বলে গেল। যে আমাকে ছোরা মেরেছে তাকে নাকি আমি চিনি। কিন্তু বলছি না।

এররম অদ্ভুত কথার মানে কী? লোকটা কে?

তা তো কিছু বলল না। আবার কৃষ্ণ সম্পর্কেও নাকি ওদের সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

কৃষ্ণ!–কনক এবং জীমূত দুজনেই অবাক।

হেমকান্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখে বললেন, সেইটেই ভাবনার কথা। কৃষ্ণ একটু লাঠি-কাঠি খেলে। বন্দুক চালানো শেখে। এসব দেখেই ওদের ধারণা হয়েছে যে কৃষ্ণ স্বদেশি করে। ওরা এখন ছায়া দেখলেই চমকায়।

কৃষ্ণ স্বদেশি করবে কী! ও তো দুধের ছেলে!—জীমূতকান্তি অকপট বিস্ময়ে বলে।

হেমকান্ত মাথা নেড়ে বলেন, দুধের ছেলে বলে কথা নয়। দুধের ছেলেরা অনেকেই স্বদেশি করে। কংগ্রেসে কত ভলান্টিয়ার আছে ওর বয়সি। সেটা কথা নয়। কথা হল, কৃষ্ণ সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে আমাকে ঘাবড়ে দিতে চাইছে।

তা হলে এখন কী করা?

হেমকান্ত চিন্তিতভাবে বললেন, সেইটেই ভাবছি। রামকান্ত রায়কে আমিও একটু ভয় দেখিয়েছি। তাতে কাজও হয়েছে। কিন্তু আমার মনে হয় না লোক ও সহজে ছাড়বার পাত্র। কিছু লোক আছে যারা কাজ দেখাতে গিয়ে অনেক অনর্থ বাঁধায়। রামকান্ত সেই শ্রেণির লোক। গোডাউনে বিলিতি কাপড় পোড়ানোর ঘটনায় ফায়ারিং করা দরকার ছিল না। কাজেই কৃষ্ণ সম্পর্কে আমার দুর্ভাবনা হচ্ছে।

কনক বলল, তা হলে একটা কাজ করা যাক। কৃষ্ণকে এখান থেকে সরিয়ে নিলে কেমন হবে?

হেমকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, আমাকে একটু ভাবতে দাও। কৃষ্ণ আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে চায় না। এ জায়গার প্রতিও ওর টান আছে। আমি ওর সঙ্গে একটু কথা বলে দেখি।

কনক ও জীমূত দুজনের মুখেই দুশ্চিন্তা। হেমকান্ত সেটা লক্ষ করলেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় মুখে দুশ্চিন্তার কথা বললেও ভিতরে ভিতরে তিনি তেমন একটা ভয় পাচ্ছেন না। নিজের ভিতরে এই পরিবর্তন দেখে তিনি নিজেও কম বিস্মিত নন। আততায়ির ছোরা তার কিছু উপকার করেছে।

 

রামকান্ত রায়ের আগমন এবং নির্গমন দুই-ই ছাদ থেকে নিরীক্ষণ করেছে কৃষ্ণকান্ত। তার চোখে জ্বালা। তার ভিতরে এক অন্ধ রাগ। লোকটা যে তাদের শত্রু এ বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। শশিভূষণের ঘটনা থেকে লোকটার আক্রোশের শুরু। এ পর্যন্ত নানাভাবে হেমকান্তকে জব্দ করার চেষ্টা করেছে লোকটা। অকারণেই।

কৃষ্ণকান্ত বুঝতে পারছে, তাদের শত্রুর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। অথচ তারা তেমন কোনও অন্যায় করেনি। হেমকান্ত সবরকম ঘটনার ঊর্ধ্বে বিচরণ করেন। অথচ তাকেই লোকে ছোরা মারে। পুলিশ এসে তাকে জ্বালাতন করে, শহরবাসী তার নামে বদনাম রটায়।

কৃষ্ণকান্তর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য জায়গা রঙ্গময়ি। ছাদ থেকে নেমে সে রঙ্গময়িকে খুঁজতে গেল।

মন্দিরের চাতালে রঙ্গময়ি একা উদাস মুখে বসে আছে। তাকে দেখে খুশি হয়ে বলল, আয়।

দারোগা এসেছিল, দেখেছ?

দেখেছি। মস্ত ঘোড়া, নাল লাগানো বুট, কোমরে বেল্ট, চোখ রাক্ষসের মতো ধক ধক করছে। বলে রঙ্গময়ি বিষমুখে হাসল।

কী চায় বলো তো? রোজ আসে কেন?

কী জানি বাবা কেন আসে! সেই স্টাবিং নিয়েই বোধহয় কথা।

কেউ ধরা পড়েছে?

পড়েছে বোধহয়।

কী করে জানলে?

রঙ্গময়ি মাথা নেড়ে বলে, জানব কী করে? আন্দাজে বলা। তবে কানাঘুষো শুনছি কে যেন ধরা পড়েছে থানায়।

লোকটা কে জানো?

রঙ্গময়ি মাথা নেড়ে বলে, না।

কৃষ্ণকান্ত গম্ভীর মুখে চুপ করে থাকে। যে ধরা পড়েছে সে কি সত্যিই স্বদেশি? কথাটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না তার। স্বদেশিদের সে মনে-প্রাণে ভালবাসে।

রঙ্গময়ি খুব আলতো একটা হাত নরম করে তার পিঠে রেখে বলে, কী অত ভাবছিস? পুলিশের কথা অত বিশ্বাস করতে নেই। যে ধরা পড়েছে তার সঙ্গে হয়তো ঘটনার কোনও সম্পর্কই পাওয়া যাবে না।

কৃষ্ণকান্ত বলল, রামকান্ত রায় বাবাকে দেখতে পারে না কেন বলো তো?

ও ওইরকম। আমাকেও দেখতে পারে না। তোকেও না।

কৃষ্ণকান্ত চমকে উঠে বলে, কী করে বুঝলে?

আমার কাছে খবর আসে।

আমরা কী করেছি যে দেখতে পারে না?

রঙ্গময়ি একটু হাসে। বলে, কত কী করেছি। তোতে আমাতে মিলে ইংরেজ রাজত্বটার ভিতটাই নাড়িয়ে দিয়েছি বোধহয়। তাই ওর অত মাথাব্যথা।

সত্যি বলছ, পিসি?

সত্যিই বলছি। আমার মনে হয় তোর এখন কলকাতায় গিয়ে কিছুদিন থাকা দরকার।

কেন পুলিশ কি আমাকে ধরবে?

না ধরলেও জ্বালাতন করবে। নজর রাখবে।

তা হলে তুমি কী করবে?

আমার আর কী করার আছে?

তোমাকেও তো জ্বালাতন করবে।

রঙ্গময়ি মাথা নেড়ে বলে, করে করুক। আমি কোথাও যাব না।

কৃষ্ণকান্ত মাথা নেড়ে বলে, তা হলে আমিও যাব না।

রঙ্গময়ি একথাটার কোনও জবাব দেয় না। চুপচাপ বসে থাকে। তার স্নেহময় হাতখানা ধীরে ধীরে কৃষ্ণকান্তর মাথায় গভীর চুলের মধ্যে বিলি কেটে দেয়। অনেকক্ষণ বাদে সে বলে, দাদা বউদিরা সব এসেছে, তাদের সঙ্গে ঠিকমতো কথাটথা বলিস তো? না কি মুখচোরার মতো পালিয়ে বেড়াস!

কৃষ্ণকান্ত একটু লাজুক হেসে বলে, ওরা সব কেমন যেন! কেবল সংসারী কথাবার্তা বলে। আর কেবল এক কথা, কত বড় হয়েছিস! কী সুন্দর হয়েছিস! আমার ওসব ভাল লাগে না।

রঙ্গময়ি হাসে। বলে, সংসারী মানুষ সংসারের কথা বলবে না তো কী বলবে? একটু মিশিস ওদের সঙ্গে, নইলে নিলে হবে। দুঃখ পাবে ওরা।

কৃষ্ণকান্ত চুপ করে থাকে।

রঙ্গময়ি খুব নিচু স্বরে বলে, তোর ঘর থেকে একটা জিনিস আমি চুরি করেছি।

কৃষ্ণকান্ত একটু চমকে উঠে বলে, কী জিনিস?

যেটা তুই তোর বাবার চেস্ট অফ ড্রয়ার্স থেকে চুরি করেছিলি।

কৃষ্ণকান্ত রঙ্গময়ির মুখের দিকে চেয়ে বলে, পিস্তল?

রঙ্গময়ি একটু বিষঃ হেসে বলে, বোকা কোথাকার! ও দিয়ে তুই কী করবি বল তো!

কেন নিলে? আমার যে ওটা দরকার।

রঙ্গময়ি মাথা নেড়ে দৃঢ় গলায় বলে, না, ওটার তোমার কোনও দরকার নেই।

কেন নেই, পিসি?

এই বয়সে ওসব অস্ত্র কাছে রাখতে নেই। কখন পুলিশ বাড়ি সার্চ করে তারও ঠিক নেই।

কৃষ্ণকান্ত একটা শীতলতা অনুভব করে। পুলিশ আসা বিচিত্র কিছু নয়। আসতেই পারে। সে জিজ্ঞেস করে, কী করেছ ওটা নিয়ে?

ঢুকিয়ে রেখেছি। ভয় নেই।

ওটার গুলি ছিল না।

জানি। আমি খুলে দেখে নিয়েছি।

তুমি পিস্তল খুলতে পারো?

কেন পারব না?

কে তোমাকে শেখাল?

কেন? তোর বাবা!

বাবা!

তোর বাবাকে আমি কি কম জ্বালিয়েছি?

বাবা তো নিজেই বন্দুক-পিস্তল উঁত না!

কে বলল ছুঁত না! পছন্দ করত না ঠিকই। কিন্তু বন্দুক চালাতে পারত ভালই। তিন ভাই-ই পারত। চোর ডাকাতের ভয় আছে না জমিদারদের। তাই শিখে রাখতে হত।

কী করে শেখাল? তুমি বায়না ধরেছিলে?

রঙ্গময়ির চোখ চিকচিক করে উঠল সুখস্মৃতিতে। একটু চুপ করে থেকে বলল, আমি অন্য একটা বুদ্ধি খাটিয়েছিলাম। তোর বাবাকে কিছু বলিনি। ধরেছিলাম সুনয়নীকে।

মা! মাকে ধরলে কেন?

ওই তো মজা। আমি বললে যদি অন্য কিছু মনে করে! তাই তোর মাকে ধরে পড়লাম। বললাম, তোমার কর্তাকে বলো আমাদের বন্দুক চালানো শেখাতে। তোর মা তো শুনে ভিরমি খায় আর কী! মেয়েমানুষ আবার কবে বন্দুক-পিস্তল চালায়! কিছুতেই রাজি হয় না।

তারপর কী হল?

আমিও ছাড়িনি। বলে বলে মাথাটা খারাপ করলাম। তারপর সুনয়নী তোর বাবাকে গিয়ে একদিন ধরল, আমাদের বন্দুক চালানো শেখাও। শুনে তোর বাবার কী রাগ!

রাগল কেন?

ওই যে পুরুতের মেয়ে বুদ্ধি দিয়ে তার বউয়ের মাথাটা বিগড়েছে সেই জন্য। আমাকে ডেকে পাঠিয়ে খুব বকাঝকা করেছিল। কিন্তু সুনয়নী তো সোজা পাত্রী নয়। দারুণ জেদি। শেষে একদিন তোর বাবা আমাদের নিয়ে পিছনের বাগানটায় চাঁদমারি শুরু করল।

মা পেরেছিল?

রঙ্গময়ি খিলখিল করে হেসে বলে, একটুও না। বন্দুকের প্রথম শব্দটা শুনেই পালিয়ে যায়।

তোমার ভয় করেনি?

না। তবে লজ্জা করছিল।

কেন? লজ্জা কীসের?

সে তুই বুঝবি না। কিন্তু প্রথম দিনেই আমি দারুণ শিখে নিই। পরে সুনয়নীও শিখেছিল একটু। কানে তুলো দিয়ে, কাঁধে কাপড় জড়িয়ে অনেক কসরৎ করে শিখতে হয়েছিল তাকে।

শিখতে গেলে কেন বলো তোর!

সে কি আর এক কথায় বলা যায়! জালিয়ানওয়ালাবাগের সেই ঘটনার কথা খুব ভাবতাম। ক্ষুদিরামের ফাঁসি। এসব মনে করে করে কেন যেন একদিন বন্দুক চালানোর ইচ্ছে হয়েছিল। মনে হল, শিখে রাখি, পরে হয়তো কাজে লাগবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *