শেষ রাতে আমি একবার উঠেছিলাম। ঐ পাশের বাথরুমে গেছিলাম।
ছুটির ঘর থেকে সাড়াশব্দ পেলাম না। অসাড়ে ঘুমোচ্ছে শেষ রাতে। আবার গিয়ে যে শুলাম, সে ঘুম ভাঙল ছটার সময়।
বালিশের নীচ থেকে হাতঘড়িটা বের করে সময় দেখলাম, তারপর বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম।
এখনো বেশ ঠাণ্ডা। পুবের আকাশ পরিষ্কার হয়েছে, কিন্তু রোদ ওঠেনি। চতুর্দিক শিশিরে সাদা হয়ে রয়েছে।
বাবুর্চিখানার দিকে দরজা খুলতেই লালি আর হাসান সেলাম জানাল। একটু গরম জল চেয়ে নিয়ে খাওয়ার ঘরের বেসিনেই দাঁত মেজে নিলাম, মুখ ধুলাম।
ততক্ষণে হানিফ এসে গেছে। মেটে ও মাংস নিয়ে।
বাইরে রোদে চা দিতে বলে, ছুটিকে ডাকলাম।
একবার ডাকতেই ছুটি সাড়া দিল।
বললাম, কি? তুমি জেগে জেগে শুয়ে কার স্বপ্ন দেখছ?
ও বলল, আপনাকে তা বলব কেন?
বললাম, তোমার চা পাঠিয়ে দেব ঘরে লালিকে দিয়ে? না, উঠে চা খাবে?
ছুটি বলল, মুখ ধুয়ে চা খাব।
বললাম, তোমার বাথরুমের পেছনের দরজাটা খুলে দাও, লালি গরম জল এনে দিচ্ছে। এই ঠাণ্ডা জল মুখে লাগিও না, তাহলে সুন্দর মুখটার চেহারা ম্যাকলাস্কিগঞ্জের রিলিফ ম্যাপের মত হয়ে যাবে।
লালিকে জল দিতে বলে, আমি বাইরে গিয়ে প্রথম রোদে পাইচারী করতে লাগলাম।
রাস্তা ছেড়ে এখনো বাগানে নামা যায় না ভিজে সপসপ করছে। গোলাপগুলোর পাপড়িতে শিশির পড়ে ঠাণ্ডায় জমে গিয়ে হীরের মত দেখাচ্ছে। চতুর্দিক থেকে পাখি ডাকছে। তিতিরের গলা সবচেয়ে জোর শোনা যাচ্ছে।
একটু পরে, নাইটি ছেড়ে কাল রাতের শাড়ি পরেই ছুটি এল।
দরজা দিয়ে বাইরে পা দিয়েই চোখ বড় বড় করে বলল, সুকুদা–কী-ই ভালো জায়গা–দারুণ সুন্দর। ঈস্ ক-ত্ব গাছ! সত্যি বলছি, আমার এখানে থেকে যেতে ইচ্ছে করছে সারা জীবন।
আমি হেসে বললাম, থাকো না, কে তোমাকে মানা করছে। বল, পছন্দ হয়ত এ রকম একটা বাড়ি তোমাকে কিনেই দিই। এ রকম বাড়ি তোমাকে আমি কিনে দিতে পারব। এখানে বাড়ির দাম খুব সস্তা।
ছুটি চা ঢালতে ঢালতে বললো, ও সবে আমার দরকার নেই। এই সব পার্থিব জিনিস আমার ভালো লাগে না।
কি ভালো লাগে তাহলে?
চেয়ার টেনে ওর সামনে বসতে বসতে বললাম আমি।
ও বলল, আপনি আমাকে যা দিয়েছেন, যতটুকু দিয়েছেন; তা যেন আমার চিরদিন থাকে। এ ছাড়া আর বেশি কিছু চাইবার নেই আমার।
আমি মুখ তুলে ছুটির মুখের দিকে চাইলাম।
ছুটি মুখ নামিয়ে চায়ের পেয়ালা এগিয়ে দিল আমার দিকে।
আমি বললাম, এ সব কথা থাক। কেমন ঘুম হল বল?
দারুণ। এক ঘুমে রাত পোয়ালো। তারপরই বলল, এখন আমরা কি করব?
এখন, মানে একটু পরে, আরেক কাপ চা খেয়ে চান সেরে নাও। তারপর পেয়ারাতলায় বসে ব্রেকফাস্ট খাও। নাস্তার পরে তোমাকে বেড়াতে নিয়ে যাব। চলো, পাকদণ্ডীর পথে তোমাকে স্টেশানে নিয়ে যাব। এখানের স্টেশান দেখবে, কি সুন্দর।
ওমা, এখানে রেল স্টেশানও আছে নাকি?
নিশ্চয়ই। স্টেশান নেই?
কোলকাতা থেকে সোজা আসা যায়?
হ্যাঁ, আসা যায় বইকি?
কি মজা। দেখি যদি স্টেশানটা পছন্দ হয়, তবে যখন কোলকাতায় যাব পরের মাসে, তখন কোলকাতা থেকে সোজা আপনার এখানে চলে আসব।
আমি বললাম, তা এস, কিন্তু বাড়িতে হেঁটে আসতে হবে। কোনোরকম ট্রান্সপোর্ট নেই।
একজোড়া ঘুঘু ফলসাগাছ থেকে উড়ে এসে ভিজে মাঠে বসল। কি যেন খুঁটে খুঁটে খেল, তারপর উড়ে গেল।
ছুটি পাশের শাল সেগুনের জঙ্গলের দিকে চেয়ে, চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আনমনে ভাবল। অনেকক্ষণ, নিজের মনে নীচের ঠোঁটটা অনবধানে কামড়ে ধরল, তারপর বলল, তাহলে আমি চান করেই নিই। আপনি কি অন্য বাথরুমে যাবেন, না আমার চান হয়ে গেলে, এ বাথরুমে?
আমার এত সকালে চান করা ঠিক হবে না। তুমি চান করে নাও, তারপর ঐ বাথরুমেই চান করে নেব। আমার সাজসরঞ্জাম সব ও বাথরুমেই আছে।
ছুটি যখন চান করতে গেল, আমি তখন লালিকে দিয়ে বাইরের ঘরের বেতের টেবলটা পেয়ারাতলায় বের করিয়ে ব্রেকফাস্ট টেবল হিসাবে পাতলাম। একটা সবুজ সাদা চেক-চেক টেবল ক্লথ পাতলাম। এ জায়গাটা দুদিন আগে গোবর দিয়ে নিকোনো হয়েছে–পরিষ্কার দেখাচ্ছে জায়গাটা। পেয়ারা গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে সাদা বেতের টেবল-চেয়ারে রোদ এসে পড়েছে। রোদে পিঠ দিয়ে বসতে ভারী আরাম লাগে।
এখানে রোজ ব্রেকফাস্টের সময়ে রোদে পিঠ দিয়ে বসে মনে হয় পৃথিবীর যত শান্তি সব বুঝি এইখানে এসে বাসা বাঁধছে। গাড়িঘোড়ার আওয়াজ নেই, টেলিফোন নেই, ইচ্ছা করলেই যে কেউ শান্তি নষ্ট করবে, তারও কোনো উপায় নেই। যে শান্তি ভঙ্গ করতে আসবে, তাকেও বহুদূর থেকে পায়ে হেঁটেই আসতে হবে।
একটু পরেই ছুটি চান করে বাইরে এল।
একটা সাদা খোলের লাল ও কালোপাড়ের পাছা-পেড়ে তাঁতের শাড়ি পরেছে-লাল টিপ পরেছে বড় করে। মাথার চুল খুলে এসেছে রোদে শুকোবে বলে। কী ভালো যে লাগছে ছুটিকে, কি বলব।
ছুটি বলল, সুকুদা, খুব আরাম করে চান করলাম।
ছুটি এসে আমার সামনে বসল। ওর চুল, ওর চোখ, ওর নাক, ওর কান, ওর দাঁত, ওর হাতের আঙুল, ওর পায়ের পাতা সব কিছুর মধ্যে এমন একটা পরিচ্ছন্ন দীপ্তি যে, ও যখনি চান করে ওঠে তখনি ওর দিকে অপলকে আমার চেয়ে থাকতে ইচ্ছা করে।
হঠাৎ চোখ তুলে ছুটি বলল, কি দেখছেন?
তোমাকে।
এতদিনেও কি দেখা শেষ হয়নি আপনার? বোঝা শেষ হয়নি? এখনো কি কোনো সন্দেহ আছে? দ্বিধা আছে কোনো?
জানি না।
তবে এমন করে দেখছেন কেন?
আমি বললাম, কথা বলো না। জানো, এই সকালের পাখি-ডাকা, শিশির-ভেজা নরম প্রকৃতির পটভূমিতে তোমার এই সবে-চান-করে ওঠা নরম শরীর কেমন অদ্ভুত মানিয়ে গেছে। মনে হচ্ছে তুমিও বুঝি এই পরিবেশেরই একটি আঙ্গিক। একটুও নড়ো না কিন্তু– তোমাকে দেখতে দাও আমাকে ভালো করে।
কতক্ষণ যে ওখানে বসেছিলাম জানি না।
এক সময় ছুটি বলল, এখন রোদ বেশ গরম হয়েছে, এবারে আপনি চান করতে পারেন। গরম জল দিতে বলব আমি?
তুমি এখানে চুপ করে বসো ত দশ মিনিট। আমি চান করে দাড়ি কামিয়ে আসছি।
আপনি কখন দাড়ি কামান?
সকালে। কেন বলো ত? হঠাৎ এ প্রশ্ন?
আমার…এখনো জ্বালা করছে।
বলেই, ছুটি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে দুষ্টুমির হাসি হাসল।
আমি লজ্জা পেলাম। বললাম, ঠিক আছে, আজ সকাল, দুপুর, রাত্তির তিন বেলা দাড়ি কামাব।
ছুটি বাচ্চা মেয়ের মত চেঁচিয়ে উঠল। বলল, এ–ম্মা। আমি কি তাই বলেছি! আপনি ভীষণ খারাপ।
বাথরুমে আমি দাড়ি কামাচ্ছিলাম, এমন সময় লালি পেছনের দরজা ধাক্কা দিল গরম জল দেবার জন্য। গরম জলের বালতিটা দিয়ে লালি বলল, মেমসাহেবকা কোই কাপড়া হায় অন্দর? ধূপমে দেনেকা লিয়ে? ওকে বললাম, নেই। পরক্ষণেই আমার চোখ পড়ল, বাথরুমের র্যাকে। একটি ভিজে ব্রা, লেস-লাগানো ফিকে নীল নাইলনের প্যান্টি এবং সরু কোমরের একটি সায়া ঝুলছে র্যাকে।
লালিকে বললাম, নিয়ে যাও এসে।
সমস্ত বাথরুমটা ছুটির শরীরের সুগন্ধে ভরে আছে। আসলে গন্ধটা ওর সাবানের। সমস্ত বাথরুমটা গন্ধে ম ম করছে। সেই সুগন্ধি দরজা জানালা বন্ধ-করা ঘরে গরম জলে চান করতে করতে ছুটির শরীরের কথা ভেবে আমার সমস্ত শীত চলে গেল। আমার সমস্ত শরীর এই দারুণ হিমেল সকালে এক আশ্চর্য উষ্ণতায় ভরে গেল।
যে শরীরকে আমি ভালোবাসি, যে নূপুরের মত নাভিকে আমি কল্পনায় দেখেছি বহুবার, যে মসৃণ রোমশ রেশমী কাঠবিড়ালিতে আমার স্বপ্নের মধ্যে আমি বহুবার হাত ছুঁইয়েছি, যে-সমর্পণী বুকে আমি বহুবার আমার মাথা এলিয়ে এই দ্বিধা-বিভক্ত জীবনের সব ক্লান্তি অপনোদন করেছি, কল্পনার সেইসব এই সকালে যেন সত্যি হয়ে উঠল। আমার আর একটুও শীত রইল না।
ছুটি ঠিকই বলে, ডাক্তাররা শুধু শরীরের চিকিৎসা করে, তারা মনের চিকিৎসা জানে না।
ব্রেকফাস্টের পর ছুটিকে নিয়ে বাড়ির পেছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
বললাম, ওই শাড়ি পরে এমন সুঁড়ি পথে যেতে পারবে?
ছুটি লাল আর কালো ফুল-তোলা কার্ডিগানটার বোতাম বন্ধ করতে করতে বলল, একজন রোগী মানুষ যদি পারে, তাহলে একজন সুস্থ মানুষী নিশ্চয়ই পারবে।
গেটের পেছনেই নালাটা। জল যাচ্ছে তিরতির করে। পাথরের মাঝে মাঝে এখানে ওখানে গাড়হাতে জল জমে আছে। ক্ষুদে ক্ষুদে গাছগুলো তিড়িংবিড়িং করছে। চতুর্দিকে সেই হলুদ জংলী ফুলগুলো ফুটেছে। ওদের ফিনফিনে পাপড়িতে সকালের রোদ লেগেছে।
উপরে এখন এক-আকাশ ঝকঝকে রোদ্দুর। পাখিদের চিকন গলায় রোদ পিছলে যাচ্ছে।
ঘন পিটিসের ঝোপের মধ্যে দিয়ে খোয়াই-এর লাল পথ উঠে গেছে পেছনের মালভূমির মত টাঁড়ে। পিটিসের ফুলগুলো কমলারঙা, কতগুলো লালও আছে। কেমন একটা ঝাঁঝালো গন্ধ ওদের ফুলে।
চড়াইটা উঠেই ছুটি এক দৌড়ে মালভূমিতে পৌঁছে গেল–পৌঁছে গিয়েই মাথা উঁচু করে নিশ্বাস নিল–বলল, আঃ।
আমি গিয়ে পৌঁছতেই আমার হাতে হাত জড়িয়ে বলল, আপনি যদি আমাকে মেরে তাড়িয়েও দেন, আমি এখান থেকে যাবো না।
বলে, সামনের টাঁড়ের দিকে চেয়ে রইল।
সুদূরবিস্তৃত মাঠ–মাঝে মাঝে পিটিস ঝোপ, কুঁচফুলের গাছ, হলুদরঙা গোল গোল ফলের ঝোপ (আমি এদের নাম দিয়েছি জাফরানী), মাঝে মাঝে মহুয়াগাছ। বাঁ দিকে নাকটা পাহাড়, কঙ্কা বস্তীর রাস্তা–সামনে দূরে কয়েক ঘর ওরাঁও-এর গ্রাম–আর যতদূর চোখ যায় শুধু হলুদ আর হলুদ। সর্ষে আর সরগুজা লাগিয়েছে ওরা। উপরে ঝকঝকে নীল আকাশ, নীচে সবুজের আঁচলঘেরা এই হলুদ স্বপ্নভূমি।
ছুটি কথা না বলে তেমনি করে দাঁড়িয়েই রইল।
আমি বললাম, কী? এগোবে না?
ও তবুও কথা বলল না।
আমি ডাকলাম, ছুটি, ও ছুটি।
ছুটি আমার দিকে মুখ ফেরাল, দেখলাম ওর দুচোখে দুফোঁটা জল টলটল করছে।
আমি আকাশকে সাক্ষী রেখে ওর দুচোখের পাতায় চুমু খেলাম।
ছুটি বলল, সুকুদা, বহুদিন পরে আজ আনন্দে আমার চোখে জল এল। সেই যে-বার হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় স্কলারশিপ পেয়েছিলাম সেদিন আনন্দে কেঁদেছিলাম–মনে আছে, বাবা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন–আমাকে শূন্যে তুলে বলতে লাগলেন, আই এ্যাম সো প্রাউড, আই এ্যাম সো প্রাউড অব উ্য। আমি কেঁদে ফেলেছিলাম।
ছুটির চোখে আবার জল দেখলাম।
বললাম, একি, এ আবার কি? আবার কেন?
জল-ভরা চোখে ছুটি হেসে ফেলল, মিষ্টি হাসি। বলল, বাবার কথা মনে পড়ে গেল, তাই। তারপর বলল, জানেন সুকুদা, আপনি যখন আমাকে আদর করেন, তখন কেন যেন আমার বাবার কথা মনে পড়ে যায়। বাবা চলে যাওয়ার পর, আপনার মত করে কেউ আমাকে ভালোবাসেনি।
আমি ওর কোমরে হাত রেখে বললাম, ছুটি, চলো আমরা এগোই–এরপর ফিরে আসতে কষ্ট হবে, রোদ দেখতে দেখতে কড়া হয়ে যাবে।
ছুটি বলল, এক সেকেন্ড দাঁড়ান, প্লিজ, আমি একটু কুঁচফল তুলে নিয়ে আসি, বলেই দৌড়ে গেল। দৌড়ে গিয়ে তোড়া শুদ্ধুই শুকনো কুঁচফল তুলে আনল। বলল, কী দারুণ–না?
তারপর লাল কালো কুঁচফলগুলোকে তোড়া শুদ্ধুই নিজের হাতব্যাগে পুরে ফেলল। আমরা যখন সর্ষে ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে মাঠ পেরুচ্ছি, তখন হঠাৎ ছুটি বলে উঠল, সুখ নেইকো মনে, নাকছাবিটি হারিয়ে গেছে হলুদ বনে বনে।
মনে আছে?
আমি বললাম, আছে।
তারপরই আমাকে আঙুল দিয়ে খোঁচা মেরে বলল, কি হল, আপনি একেবারে চুপ করে আছেন যে?
বললাম, খুব ভালো লাগছে, তাই।
কেন? ভালো লাগছে কেন?
টেনে টেনে আন্তরিকতার সঙ্গে ছুটি শুধোল।
আমি মুখ ঘুরিয়ে বললাম, কেন ভালো লাগছে, তুমি জান না? কতদিন স্বপ্ন দেখেছি, বিশ্বাস করো, কতদিন স্বপ্ন দেখেছি অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় শুয়ে শুয়ে যে, একটু ভালো হয়ে উঠলে তোমার সঙ্গে এই হলুদ মাঠ পেরোব–ভেবেছি তুমি সঙ্গে থাকলে, তুমি কাছে থাকলে, তোমার হাত ধরে একবারের জন্যে এই আকাশভরা আলোয় এই হলুদ মাঠ পেরোতে পারলে আমি চিরদিনের মত ভালো হয়ে যাব। আর কখনো কোনো অসুস্থতা আমাকে পীড়িত করবে না।
ছুটি সামনে সামনে যাচ্ছিল, থেমে পড়ে আমার পাশে এল; বলল, দেখবেন সত্যিই আপনি একেবারে ভালো হয়ে যাবেন। আপনি দেখবেন।
দেখতে দেখতে আমরা সেই সাদা পোড়ো বাড়িটার কাছে এলাম। জর্জ ওর ছেলেকে নিয়ে পথের পাশে মহুয়া গাছতলায় দাঁড়িয়ে ছিল।
জর্জ আমাকে উইশ করল।
আমি শুধোলাম, কি জর্জ? ভূতের উপদ্রব কমেছে, না রাতে এখন এখানেই শুচ্ছ!
ও বলল, না। রাতের বেলা স্ত্রী ও বাচ্চাকে নিয়ে প্যাট গ্লাসকিনের কাছে গিয়ে শুই।
একটু এগিয়ে যেতেই ছুটি শুধোলা, কি বলছিলেন, ভূত ভূত?
আমি বললাম, এরা বলে এ বাড়িতে রাতেরবেলা নানারকম আওয়াজ শোনা যায়। এই যে ছেলেটি দেখছ এর নাম জর্জ–-জর্জ ব্যানার্জি। এ কাজ করত এখানেরই একটা কোলিয়ারিতে–তারপর সেখানের এক রেজা কুলিকে বিয়ে করে। বাচ্চাটি জর্জের ছেলে।
কেন এরকম করল? ছুটি শুধোল।
ভালো লেগে গেছিল। কাউকে যদি কারো ভালো লেগে যায় ত কি করবে বল? তবে এই বিয়ের জন্যে বেচারাকে যা মূল্য দিতে হয়েছে তা ওই জানে। রেজাকে বিয়ে করার সঙ্গে সঙ্গে নাকি চাকরি গেছিল। তারপর শুধু চাকরি যাওয়াতে সব শেষ হয়নি; সমাজ আরো যতরকম প্রতিশোধ নিতে পারে ওর উপর নিয়েছিল।
জর্জ এখন যে-কোনো কাজ করে। টাকা পেলেই হল। কিছুদিন আগে এখানের একটা বাড়ির সেপটি ট্যাঙ্ক খারাপ হয়ে যায়, এখানের একমাত্র জমাদার অনেক টাকা চেয়েছিল–যেহেতু সে একমাত্র জমাদার। জর্জ মাত্র ত্রিশ টাকার বিনিময়ে নীচে নেমে বাতি করে সেই ময়লার ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করেছিল।
ঈস কি দুর্দশা! ছুটি বলল।
বললাম, দুর্দশা বল আর যাই-ই বল, এ কথা জানার পর ছেলেটার উপর আমার ভক্তি হল। দোষের কি বল? ভিক্ষাও চায় না, কারো কাছে মাথাও নোওয়ায় না, যা করেছে ভুল বা ঠিক তা করেছেই। সমাজের ভয়ে, সুখে থাকার বিনিময়ে, নিজের সিদ্ধান্তকে পরমুহূর্তে বাতিল করেনি। তুমি জানো না গরমের দিনে অনেক সময় জর্জ শুধু পাকা মহুয়া খেয়ে থেকেছে। জানো ত, সিনিয়র কেমব্রিজ অবধি পড়েছে ও।
মহুয়া খেয়ে থেকেনে কিছু করেন না?
করি, আমি বললাম; আমার সাধ্যমত। আমি এসেই ওকে টুকটাক কাজ দিয়েছি–খেতে বলি আমার সঙ্গে। এতে কতখানি উপকার হয় জানি না, তবে একটা মস্ত উপকার হয় এই যে, ও বুঝতে পারে ওকে সকলেই খরচার খাতায় লেখেনি। সমাজে হয়ত কিছু লোক এখনও আছে যারা ওর এই সৎসাহসের প্রশংসা করে। কিছু লোকের মনে এখনো ওর জন্যে সহানুভূতি আছে।
ওর স্ত্রী কেমন দেখতে? খুব সুন্দরী বুঝি?
সুন্দরী কিছু নয়, সাধারণ রেজা মেয়েরা যেমন হয়। একদিন আমার কাছে নিয়ে এসেছিল। তবে খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।
আরা জানো, জর্জ একদিন দুঃখ করে আমাকে বলেছিল, একমাত্র পাদ্রীসাহেব ছাড়া আর কেউ তোমার মত আমাকে সাপোর্ট করেনি। এমনি দুঃখ-কষ্ট যা পাবার সে ত আমাকেই পেতে হয়েছে, মানে আমাদের; কিন্তু ওকে ছেড়ে দেওয়ার সহজ পন্থা যে সকলে বাতলেছেন তা সহজ হলেও যে সৎ নয়, এ কথা কেউই বলেনি। ও বলছিল, পাদ্রীসাহেব একদিন ওকে বলেছিলেন যে, ইফ উ্য আর এ গুড ক্রিশ্চিয়ান, উ শ্যাল নেভার ফোরসেক হার। জর্জ বলেছিল, এন্ড উ্য সী, আই অলওয়েজ ওয়ান্টেড টু বী আ গুড ক্রিশ্চিয়ান।
ছুটি বলল, বাঃ। এত কষ্ট পাচ্ছে, তবু মেয়েটাকে ছাড়েনি, না? তারপর বলল, এখানে দেখছি দারুণ দারুণ সব ক্যারেকটার আছে। খুব ইন্টারেস্টিং। আপনি যদি এ জায়গা নিয়ে লেখেন তবে চরিত্রের অভাব হবে না, কি বলেন?
আমি হাসলাম। বললাম, সে কথা কিন্তু সত্যি। এমন পরিবেশ এবং এমন বিচিত্র লোকজন, এঁদের নিয়ে লিখলে লেখা হয়ত কখনো ফুরাবে না।
দেখতে দেখতে আমরা নালা পেরিয়ে চড়াইটা উঠে দীপচাঁদের দোকানের পাশ দিয়ে গিয়ে স্টেশানের রাস্তায় পড়লাম।
পোস্টাফিসের গা ঘেঁষে, মুঙ্গারামের দোকানের পাশ দিয়ে গিয়ে স্টেশনে পৌঁছে গেলাম।
ছোট্ট স্টেশান। প্লাটফর্ম উঁচু নয়। মাটিতেই প্লাটফর্ম। ওপারে ঘন শালবন। আউটার সিগন্যাল জঙ্গলের মধ্যেই। দু-একজন পেয়ারাওয়ালা, আতাওয়ালা বসে আছে। সওদা নিয়ে, পানিপাঁড়ে ট্রেন আসার অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছে। স্টেশানের একপাশে কার্নি মেমসাহেবের চা-এর দোকান।
স্টেশন মাস্টারমশাইয়ের ঘরে জোর আড্ডা বসেছে। মাস্টারমশাই, এ. এস. এম. গাঙ্গুলীবাবু, সাহাবাবু, পোদ্দারবাবু, শৈলেন ঘোষ সকলের গলা শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ফোনে কথা হচ্ছে অন্য স্টেশানের সঙ্গে–গুমিয়া, হ্যালো গুমিয়া, ম্যাকলাস্কি বলছি, বড়বাবু; হ্যালো গুমিয়া, গুমিয়া।
টক্কা-টরে টরে-টক্কা, টক্কা-টরে মেসেজ আসছে, মেসেজ যাচ্ছে।
একবার মাস্টারমশাই বাইরে এলেন, এসে আমাকে দেখেই নমস্কার করলেন, আমিও প্রতিনমস্কার করলাম।
বললেন, কি? কাউরে নিতা আইছেন নাকি? তা অইলেই খাইছে–আজও দ্যাড় ঘন্টা লেট।
আমি হাসলাম, বললাম, না নিতে আসিনি কাউকে, এমনি বেড়াতে এসেছি।
ছুটি বেড়াতে বেড়াতে মিসেস কার্নির দোকানের সামনে চলে গেছিল। আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকল।
আমি যেতেই চোখ বড় বড় করে বলল, কী দারুণ আলুর চপ ভাজছে দেখুন। খাবেন?
আমি বললাম, তুমি খাও।
না। আপনি একটা না খেলে খাব না আমি।
আমি বললাম, আমার এখন আজেবাজে জিনিস খাওয়া বারণ।
ও হাত উল্টে বলল, তাহলে আর কি হবে? আমার খাওয়ার ইচ্ছা ছিল খুব।
আমি হেসে বললাম, তুমি ভীষণ মতলববাজ হয়েছ।
ও-ও হাসল, বলল, হইনি, বরাবরই ছিলাম; আগে লক্ষ্য করেননি।
ইতিমধ্যে মিসেস কার্নি ভিতর থেকে বেরিয়ে এসেই হাসিমুখে এগিয়ে এলেন, বললেন, হ্যালো ডিয়ার, তুমি ত আর আন্টির খোঁজও নাও না।
আমি ওর সঙ্গে ছুটির আলাপ করিয়ে দিলাম। মিসেস কার্নিকে আমি ডাকি ইয়াং লেডি বলে। সাতষট্টি বছর বয়সে, এখনো ফুল ফুল টুপি মাথায় দিয়ে লেডিজ সাইকেল চালিয়ে ক্রমাগত লাপরা-কঙ্কা-হেসালঙ করেন।
আলুর চপ খাওয়াতে খাওয়াতে ছুটিকে বলছিলেন উনি, ম্যাকলাস্কিগঞ্জের পুরোনো কথা।
মিসেস কার্নি এক বিস্ময়। এঁকে যতই দেখি, ততই অবাক হতে হয়। এক সময় ওর স্বামী এখানের কলোনাইজেশান সোসাইটির সেক্রেটারি ছিলেন। গাড়ি ছাড়া চড়তেন না, প্রভাব-প্রতিপত্তি সবই ছিল। এখন শুধু স্মৃতি আছে, আর আছে আত্নসম্মান। যে আত্মসম্মানের বশে ছোটখাট্টো মানুষটি তাঁর ছোট ছোট নরম হাতে এই কঠোর পৃথিবীর সঙ্গে সকাল পাঁচটা থেকে রাত এগারোটা অবধি একা লড়াই করে যাচ্ছেন।
আলুর চপ শেষ করে মাটির ভাঁড়ে চা খেলাম আমরা দুজনে।
ছুটি ভারী খুশি। বার বার বলতে লাগল, আমি কিন্তু কোলকাতা থেকে সোজা একবার ট্রেনে করে আসব-আপনি বেশ আমাকে নিতে আসবেন স্টেশানে, তারপর দুজনে গল্প করতে করতে পাকদণ্ডীর পথ দিয়ে হলুদ ক্ষেত পেরিয়ে আপনার বাড়ি পৌঁছব।
আমি বললাম, কিন্তু হলুদ ক্ষেত ত চিরদিন হলুদ থাকবে না।
ও মুখ ফিরিয়ে বলল, কোনো হলুদ ক্ষেতই চিরদিন থাকে না। কিন্তু আমার মনের মধ্যে ত থাকবে। সব থাকবে। এই সকাল, আপনার সঙ্গে ফুল মাড়িয়ে এই বেড়াতে আসার স্মৃতি। এ সব চিরদিনই থাকবে।
আমি চুপ করে রইলাম।
মিসেস কার্নিকে বললাম, একদিন বিকেলে আসব স্টেশানে, তারপর আপনার বাড়ি যাব গল্প করতে।
ইয়াং লেডী খুব খুশি হলেন। বললেন, নিশ্চয়ই এসো, খুবই আনন্দিত হব।
আরো কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক ঘুরে, ছুটি বলল, সুকুদা, এবার চলুন ফিরি। ফিরে গিয়ে আপনাকে একটা জিনিস রান্না করে খাওয়াব।
স্টেশানের গেটের কাছাকাছি যখন এসেছি, তখন শৈলেনের সঙ্গে দেখা।
ও বলল, এই যে দাদা, আমরা এবার থিয়েটার করছি, আপনি থাকবেন ত সে সময়?
আমি বললাম, আমি ত এখানেই মৌরসী-পাট্টা গেড়ে বসেছি। এখন নড়বার নাম পর্যন্ত করব না। কিন্তু কি থিয়েটার?
পলাতক। মনোজ বসুর লেখা। সেই যে সিনেমা হয়েছিল না! আমি হিরোর রোল করব। কি দাদা? মানাবে না!
বললাম, নিশ্চয়ই মানাবে। কিন্তু তুমি গান গাইতে পারো ত?
পারি না? গাইব এখুনি?
ওর কথার ধরনে ছুটি মুখ লুকিয়ে হাসল।
আমি বললাম, এখন দরকার নেই। আমি তোমাদের রিহার্সালে আসব একদিন।
তা ত আসবেনই–আর খালি আসলেই হবে না, চাঁদাও দিতে হবে কিন্তু।
আমি হেসে বললাম, নিশ্চয়ই! চাঁদাও দেব।
স্টেশান ছেড়ে হেঁটে আসতে আসতে ছুটিকে বললাম, এই শৈলেন ছেলেটা ভারী প্রাণবন্ত। সব সময় ও হাসিখুশি, প্রাণে ভরপুর। ও সেদিন কি বলছিল জানো, বলছিল দাদা, তারাশঙ্করের কবি পড়েছেন? ভালো লাগে না? আহা কি সব গান? ভালোবেসে সুখ মিটিল না হায়, এ-জীবন এত ছোট কেনে? সত্যি দাদা, আমাদের জীবনটা এত ছোট কেন বলতে পারেন? আমার ইচ্ছা করে হাজার বছর বাঁচি।
সব শুনে ছুটি বলল, ছেলেটা কেমন পাগল পাগল। এসব ছেলেদের মন খুব ভালো হয়।
আমি বললাম, শৈলেন একটা দারুণ কনট্রাস্ট চরিত্র। ওকে ফুলপ্যান্টের উপর পাঞ্জাবি পরে তার উপর র্যাপার মুড়ে বসে আড্ডা মারতে দেখলে ওর সম্বন্ধে এক ধারণা হয়, আর ও যখন রেলের উর্দি পরে গম্ভীর মুখ করে স্টেশানের গেটে দাঁড়িয়ে টিকিট চেক করে তখন ও অন্য লোক। তখন দেখে বোঝারই উপায় থাকে না যে মানুষটা এমন গান গায় বা পাগলামি করে বেড়ায়, তখন দেখে মনে হয় সৃষ্টির আদি থেকে ও বুঝি এমনি টিকিট চেক করেই আসছে।
ছুটি বলল, শুধু শৈলেন কেন? হয়ত আমরা সকলেই এরকম। আপনি যখন চেম্বারে বসে কাজ করেন, আমি যখন অফিসে কাজ করি, তখন কেউ কি স্বপ্নেও ভাবতে পারে যে, আমরা এমন পাগলের মত ভালোবাসতে পারি?
তারপরই বলল, সরি সরি, বলা উচিত–আমি। আমরা বলাটা অন্যায় হল।
আমি জবাব দিলাম না কথার, ওর দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকালাম।
তারপর ছুটি বলল, ও একেবারে বাচ্চা ছেলে ত?
বাচ্চাই ত? কতই বা বয়স হবে?
তারপর অনেকক্ষণ আমরা চুপচাপ এলাম।
ছুটি শুধোলো, আপনার কষ্ট হচ্ছে সুকুদা? রোদ্দুরে? ছায়ায় দাঁড়ালেই শীত করছে। আর রোদে গেলেই গা পুড়ে যায়, তাই না?
বললাম, তুমি আমার পাশে থাকলে কখনোই আমার কষ্ট হয় না। আসলে তোমারই কষ্ট হচ্ছে।
অনেক কষ্ট আমার সহ্য করতে হয়। এসব একটু-আধটু সুখের কষ্টকে আজকাল আর কষ্ট বলে মনেই হয় না।
দূর থেকে সেই হলুদ ফুলের মাঠ দেখা যেতে লাগল। একদল তিতির উড়ে গেল মহুয়াতলা দিয়ে। আশেপাশে কাদের গরু চরছিল নীচের খাদে। গরুর গলার ঘণ্টার টুং-টাং ভেসে আসছিল হাওয়ায়।
আমার সামনে সামনে সেই হলুদ ক্ষেতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল ছুটি। আর আমি চলেছিলাম ওর পায়ে পায়ে, চুপ করে। একটা অলস হলুদ সুগন্ধি ছায়া আমার সমস্ত বোধকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।
আমি স্বপ্নের মধ্যে হেঁটে চলছিলাম।
.
০৭.
হাসানকে কাল রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর ছুটি দিয়ে দিয়েছিলাম।
আজ খুব ভোরে লালি উঠে রান্নাঘরে গিয়ে গরম জল করেছে।
এখানে সাতটার আগে এখন রোদ ওঠে না এবং চামার রাস্তা দিয়ে বাসটা সাতটা অথবা সাতটার আগেই পাস করে যায়। তাই যাদের রাঁচী যাবার, তারা সকলেই একটু আগেই গিয়ে বড় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। কারণ, বাসে, এই একমাত্র বাসে, যেতে না পারলে সকাল সকাল রাঁচী পৌঁছনোর আশা নেই।
অন্যভাবে যাওয়া যে যায় না তা নয়, খিলাড়িতে গিয়ে অথবা টোড়ি স্টেশনে ট্রেনে গিয়ে সেখান থেকে বাস ধরে যাওয়া যায়। খিলাড়ি থেকে রওয়ানা হওয়া কোনো কয়লার ট্রাক ধরতে পারলে তাতেও যাওয়া যায়। কিন্তু সে সবই অনিশ্চিত এবং ঝামেলার। তাই যখন গঙ্গা বাস দয়া করে চলে, তখন লোকে গঙ্গা বাসকেই ভরসা করে থাকে।
তবে গঙ্গা বাসের দয়া বছরের বেশির ভাগ সময়েই নাকি ইদানীং হয় না।
ম্যাকলাস্কি থেকে চামা অবধি এই সাত-আট মাইল রাস্তাটুকুকে রোড ট্রান্সপোর্ট ডিপার্টমেন্টের টার্মিনোলজীতে ফেয়ার ওয়েদার রোড বলে। সেই জন্যে বছরের মধ্যে যেকদিন বাসের মালিক পক্ষর মতে আবহাওয়া এবং রাস্তা যথেষ্ট ভালো মনে না হয়, ততদিন এ-বাস অন্যান্য লাভজনক রুটে চলে। এ-রুটে বাস প্রায়ই থাকে না।
কিন্তু ম্যাকলাস্কিগঞ্জের কয়েকজন বয়স্ক, বৃদ্ধ, অবসরপ্রাপ্ত লোক এবং আমাদের মত কিছু প্রভাবহীন যাওয়া-আসা করা লোকের সুবিধা-অসুবিধার কথা কে ভাবে? বধির কানে নিষ্ফল প্রতিবাদ তুলে সমস্ত রকম অসুবিধাই সহ্য করতে হয়।
এ-বছর বারো মাসের মধ্যে আট মাস বাস চলেনি এ-রাস্তায়, অথচ প্রাইভেট গাড়ি, ট্রাক, জীপ, সবই সারা বছর, এমনকি ঘোরতর বর্ষাতেও যাতায়াত করে এবং করেছে।
এখন শীতের সময়টা বাস চলছে।
চোখ-মুখ ধুয়ে জামা-কাপড় পরে ভিতরের ড্রইং রুমে বসে চা ঢালছিল ছুটি।
আজ সকালে ও একটা কালো শাড়ি পরেছে, সাদা ব্লাউজ, গায়ে সেই ফুলতোলা সাদা শাল।
এখনো ভুরুতে আইব্রো-পেন্সিল ছোঁয়ায়নি! ওর ভুরুদুটি কেমন ফ্যাকাশে ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে।
আমি বললাম, আমি চা বানাচ্ছি, তুমি যাও ত, তোমার ভুরু ঠিক করে এসো।
ও প্রথমে লজ্জা পেল, তারপর বলল, আমি না-সেজে থাকলে বুঝি আমাকে ভালো লাগাতে আপনার কষ্ট হয়?
আমি বললাম, না তা নয়। তোমাকে আমি সব সময় তোমার সবচেয়ে সুন্দর চেহারায় দেখতে ভালোবাসি।
চা-টা ঢালতে ঢালতে ছুটি বলল, অতএব বোঝা যাচ্ছে, আদৌ আপনি আমাকে ভালোবাসেন না। আমার ত মনে হয়, যদি কারো কাউকে ভাল লাগে ত যে-কোনো চেহারায়, যে-কোনো অবস্থায়ই ভালো লাগে। মানে ভালো লাগা উচিত।
আমি জবাব দিলাম না।
ছুটি উঠে পড়ে বলল, ধরুন, আপনার চা। আমি এখুনি আসছি।
ঘরের মধ্যে তখনো অন্ধকার। আমরা আলো জ্বালিয়ে বসেছিলাম।
বাবুর্চিখানায় টুং-টাং শব্দ হচ্ছিল।
ছুটি বলেছিল, কিছুই না-খেয়ে যাবে, তারপর পীড়াপীড়িতে রাজি হয়েছে, শুধু দুখানা টোস্ট আর স্ক্র্যাম্বলড এগস ও আরেক কাপ চা খেয়ে ও রওয়ানা হবে বলে।
বাসের এখনো মিনিট পনেরো দেরি।
বাইরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। চতুর্দিক সাদা হয়ে রয়েছে বরফপাতের মত রাতের শিশিরে। পাখিগুলোও সব এখনো স্তব্ধ হয়ে আছে।
ছুটির ঘরে আলো জ্বলছিল। আয়নার সামনে ও বসে কি করছিল জানি না। হয়ত এই সাত-সকালে ওকে সাজতে বলায় ও আমাকে ভুল বুঝেছে।
মনে মনে আমি নিজেকেও কম বকিনি, এখনও বকছি।
আসলে, এই জড় ও স্থূল সংসারের মধ্যে বাস করে এমন বাড়াবাড়ি সৌন্দর্যজ্ঞান থাকার কোনো মানে হয় না। এই সৌন্দর্য-প্রীতির জন্যে মূল্যও যে কম দিতে হয়েছে তা নয়, কিন্তু ছুটিকে কোনোদিনও অসুন্দর দেখিনি এক মুহূর্তের জন্যও। তবু অসুস্থ না থাকলে, ও কখনও এক মুহূর্তের জন্যে আমার সামনে আসেনি না সেজে। অবশ্য না সেজে থাকলেও ওকে আমি সব সময়ই সুন্দর দেখি। ও জানে, ওর জানা উচিত, আমি কি বলতে চেয়েছিলাম।
এমন সময় ছুটি ডাকল, সুকুদা, একবার আসুন। দেখে যান একটা জিনিস।
আমি বললাম, তোমার চা ঠাণ্ডা হয়ে গেল।
হবে না, এখুনি যাচ্ছি। আপনি আসুন না, এক সেকেন্ড।
আমি ওর ঘরে গিয়ে দেখি ও নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সাজিয়েছে।
ও আয়নার দিকে মুখ ফিরিয়ে আয়নায় আমার ছায়ায় চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল, সুখী? বলুন, আপনি সুখী ত?
আমি নীচু হয়ে ওর ডান কানের লতিতে আলতো করে একটা চুমু খেলাম।
ছুটি মুখ নীচু করে ফেলল।
পরমুহূর্তেই যেই মুখ তুলল ছুটি, দেখলাম ওর কাজল-মাখা চোখ কি যেন বলবে বলে অধীর।
ছুটি আমার দু হাঁটুতে মুখ গুঁজে অস্পষ্ট অরুদ্ধ গলায় বলল, আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। আমাকে এখানে থাকতে দিন, আপনার সঙ্গে, আপনার কাছে থাকতে দিন। আমি বড় একা সুকুদা। আপনি ছাড়া আমার কাছের কেউ নেই। আপনাকে ফেলে আমার যেতে ইচ্ছা করছে না।
আমি ওকে দুহাতে তুলে নিলাম, ও অনেকক্ষণ আমার বুকে মুখ রেখে দাঁড়িয়ে রইল।
আমি বললাম, ছুটি–ও ছুটি–পাগলামি কোরো না। চলো চা খাবে চলো।
ছুটি আমার সঙ্গে সঙ্গে ও-ঘরে এলো।
চা একদম ঠাণ্ডা হয়ে গেছিল। লালিকে পট নিয়ে গিয়ে আবার চা আনতে বললাম।
ছুটি আমার সামনে বসেছিল, চতুর্দিকের আলোহীন শীতার্ত পরিবেশের মধ্যে আলোকিত উষ্ণ ঘরে।
ছুটি আমার দিকে এবং আমি ওর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে আমাদের দুজনের চোখ, দুজনের মন, কী এক আশ্চর্য অপ্রকাশ্য সুস্থ রোমাঞ্চকর উষ্ণতায় ভরে গেল। তারপর সেই উষ্ণতা সেই শীত-সকালে আমাদের মন ভরে দিয়ে উপছে গেল দিকে দিকে; রঙিন রোদ গড়িয়ে গেল শিশির-ভেজা ঢালে ঢালে, পাখি ডেকে উঠলো ডালে ডালে, চতুর্দিকে সঞ্চারিত সদ্যোজাত প্রাণের আভাস পরিস্ফুট হয়ে উঠলো।
ছুটির জল-ভেজা চোখে এক দারুণ খুশি ঝিলিক দিয়ে উঠল, তারপর দেখতে দেখতে ওর মুখের সব বিষাদ এক পরিতৃপ্তির দীপ্তিতে দীপ্তিমান হয়ে উঠল।
ছুটি আমার দিকে চেয়ে হাসছিল, আমিও ওর চোখে চেয়ে হাসছিলাম।
আমি গিয়ে বাইরের দরজা খুললাম।
ছুটি চায়ের পেয়ালা নিয়ে আমার গা-ঘেঁষে এসে দাঁড়াল।
আমরা দুজনে সবিস্ময়ে দেখলাম, সমস্ত পৃথিবীতে এই প্রথম ভোরের আশ্চর্যতায় আলো আর শব্দের এক কোমল নরম যুগলবন্দী বাজছে।
একটু পরে লালি চায়ের সঙ্গে খাবারটুকুও নিয়ে এল।
ছুটি অনিচ্ছার সঙ্গে খেল।
তারপর মালু ছুটির সুটকেসটি হাতে নিয়ে এগিয়ে গেল, যদি বাস এসে পড়ে তবে তাকে দু-এক মিনিট রুখবে বলে।
আমি আর ছুটিও বেরোলাম।
ও মুখ নীচু করে হাঁটছিল। কথা বলছিল না কিছু।
একবার বলল, রাঁচীতে কখন পৌঁছব?
বললাম, দশটা নাগাদ পৌঁছে যাবে।
তারপর বললাম, আবার কবে আসবে?
ও বলল, জানি না, দেখি আবার কবে ছুটি পাই। এমনি করে শুধু রবিবারের জন্যে, এক দিনের জন্যে আসব না। এতে শুধু কষ্ট। এবারে এলে তিন-চার দিন ছুটি নিয়ে আসব।
আমি বললাম, কুঁচফলগুলো নিয়েছ?
ও হাসল, বলল, হ্যাঁ, ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখব, এখানের কথা মনে পড়বে।
তারপর আর কোনো কথা হলো না।
চারিদিকের নানারকম প্রভাতী পাখির কলকাকলীর মধ্যে আমরা বাসের জন্যে দাঁড়িয়ে রইলাম।
দূর থেকে বাসটা আসার শব্দ শোনা গেল।
ছুটি ফিসফিস করে বলল, চিঠি দেবেন কিন্তু। রোজ একটা করে চিঠি লিখবেন আমাকে। বলুন লিখবেন? বলে আমার দিকে তাকাল।
আমি বললাম, রোজ চিঠি পেলে, চিঠি পেতে আর তোমার ভালো লাগবে না। তুমি দেখো, লেখার মত কিছু থাকলে, লিখতে যখনি ইচ্ছা করবে, তখনি লিখব, তুমি দেখো।
আর ইচ্ছা না করলে লিখবেন না?
ইচ্ছা করবে, সব সময়ই হয়ত ইচ্ছা করবে, তবুও রোজ লিখব না। তুমি জানো, কেন রোজ লিখব না!
না। আমি জানি না। আমি কিছু জানতে চাই না। আমি রোজ চিঠি চাই।
বাসটা এসে গেল।
গিরধারী ড্রাইভার স্টিয়ারিং-এ বাঁ হাত রেখে ডান হাত তুলে নমস্কার করল।
ছুটি আমার দিকে ফিরে বলল, আসি। ভালো হয়ে থাকবেন।
বাস ভর্তি লোক ছিল, আর কোনো কথা বলার সুযোগ হল না, ওর হাতে হাত রাখার সুযোগ হলো না। বললাম, এসো। তুমি আমাকে চিঠি লিখো।
ও মাথা হেলালো, বাসে উঠে সামনের দিকে জানালার পাশে বসল।
বাসটা ছেড়ে দিল।
অনেকক্ষণ, অনেক অনেকক্ষণ পাখির ডাক ফুলের গন্ধ শিশিরের নরম হালকা সুবাস সব ছাপিয়ে আমার ছুটিকে ছিনিয়ে নিয়ে-যাওয়া কর্তব্যের বাসটার পোড়া পেট্রলের গন্ধে আকাশটা ভরে রইল। আবহাওয়া তার গিয়ারের গোঙানিতে গাঢ় হয়ে রইল।
ছুটির সঙ্গে আমার অনেকখানি অশরীরী–আমি, অনবধানে গঙ্গা বাসে মনে মনে ছুটির পাশে বসে উধাও হয়ে গেল।
.
০৮.
শুক্রবারের হাটে গেছিলাম।
এসব হাটে বাণিজ্য হয়, বিকিকিনি হয়, কিন্তু ব্যবসাদারী গন্ধটা শহরের বাজারের মত তীব্র নয়। হাটের দিনে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের দেখে মনে হয়, এরা যেন সবাই একটা খেলায় মেতেছে।
বড় রাস্তা দিয়ে গেলে অনেক ঘুর পড়ে। তাই বাড়ির পেছনের তিতিরকন্নার হলুদ মাঠ পেরিয়ে, মহুয়াগাছগুলোর তলায় তলায় ঝাঁটি জঙ্গলের মাঝে মাঝে যে পায়ে-চলা পথ চলে গেছে টিলা-নালা পেরিয়ে, সে পথ দিয়ে চললাম।
শর্টকাটে এলে গির্জার সামনে উঠতে হয়। তারপর ছোট্ট একটা বস্তি। বস্তি পেরোলেই লেভেল-ক্রসিং। লেভেল ক্রসিং-এ দাঁড়িয়ে ডাইনে বাঁয়ে তাকালে চোখে পড়ে লাইনটা ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ডাইনে সোজা চলে গেছে খিলাড়ি পত্রাতু হয়ে বাড়কাকানার দিকে–আর বাঁদিকে গেছে হেহেগাড়া, রিচুঘুটা, কুমাণ্ডি চীপাদোহর হয়ে ডালটনগঞ্জে।
লেভেল ক্রসিং পেরুলেই মিস বনারের বিরাট পাকা বাড়ি। এই অবিবাহিতা একাকী বৃদ্ধা সারাদিন হাঁস-মুরগীর দেখাশোনা করেন। শীতের দুপুরে দাঁড়িয়ে নিজের মনে রাজহাঁসীদের সঙ্গে কথা বলেন।
তাঁর বাড়ি পেরুনোর পর বাঁয়ে আরো অনেক বাড়ি–হেসালঙের পথের পাশে।
পথটা সোজা চলে গেছে। মাঝপথে একটা মোড়। ডাইনে ঘুরলে হেলঙের হাটের রাস্তা। মোড় ছেড়ে সোজা একটু গেলেই শুঁড়িখানা। ইতস্তত শালপাতার দোনা ছড়ানো ছিটানো। মত্ত অবস্থায় যুবক-যুবতীরা, আর মুখে-খেউড় চোখে-কেতুর ভস্মপ্রায় বৃদ্ধরা।
হাট পেরিয়ে পথটা সোজা চলে গেছে খিলাড়ির দিকে, এ সি সি কোম্পানির সিমেন্ট ফ্যাকটরিতে।
মালু আগে আগে চলেছিল, মাথায় পাগড়ি বেঁধে লাঠির ডগায় থলিয়া ঝুলিয়ে গায়ে নতুন খাকি-রঙা কোট পরে।
মোড়ের মাথায় এসে মালুকে মনে করিয়ে দিলাম যে হাটে গিয়ে ও যেন ইচ্ছে করে হারিয়ে না যায়।
ও গতবার ইচ্ছে করে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গিয়ে সোজা শুঁড়িখানায় চলে গেছিল। তারপর মত্ত অবস্থায় রাতে ফিরে এসে আমাকে হাত নাড়িয়ে বলেছিল, যাও তুমকো হাম বরখাস্ত কর দিয়া, তুমহারা মাফিক নোকর হামকো নেহি চাইয়ে।
মালু কথা দিল যে, সে এবার আর হারাবে না।
হাট বেশ জমে গেছে।
দেঁহাতীরা এসেছে টাটকা শাক-সজি নিয়ে। একপাশে মোরগ-মুরগীর ভিড়। তারই পাশে বাঁশের গায়ে ঠ্যাং-উপরে মাথা-নীচে করে ঝোলানো আছে চামড়া-ছাড়ানো নগ্ন খাসী। খাসীগুলোর মৃত্যুর পরও নিস্তার নেই। সমস্ত অপমান থেকে ছুটি পাবার পরও এক নগ্ন নির্লজ্জতায় ওদের মুক্তি।
এদিকে রাবারের চটি, ওদিকে কাচের চুড়ি, প্লাস্টিকের খেলনা, রুপোর গয়না, পাকৌড়ার দোকান, চায়ের দোকান। আর মধ্যে দূর দূর গ্রাম থেকে আসা চুলে কাঠের কাঁকই-গোঁজা তেলমাখা, টানটান করে চুল-বাঁধা আঁটসাঁট বনজ মেয়েরা।
রুপোর গয়নার দোকানে ভিড় করেছিল একদল শহুরে সুন্দরী মেয়ে–এখানের কোনো বাসিন্দার বাড়ির ক্ষণকালের অতিথিরা। তাদের রঙিন বেল-বটম ও বহুমূল্য শাড়ি, তাদের চুল-বাঁধার কায়দা ও রকমারি সানগ্লাস ম্লান করে তাদেরই পাশে আছে এখানের মেয়েরা। গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে বা বসে এ ওর মাথার উকুন বাছছে। কেউ বা হেসে হেসে ঝরনার মত এ ওর গায়ে ঢলে পড়ছে। তাদের উত্তোলিত হাতের ফাঁকে ফাঁকে দু-এক ঝলক চোখে পড়ছে তাদের নিবিড় স্তন, তাদের মেদহীন পরিশ্রমী পুরন্ত দেহ, তাদের সরল নিরাভরণ নিরাবরণ তরঙ্গময় সৌন্দর্য। আর ওদেরই পাশে আসলের অভাব মেকিতে-ভরানো বিত্তবতী সভ্য যুবতীরা তাদের সমস্ত প্রাপ্তি সত্ত্বেও ওদের আড়চোখে দেখে শারীরিক হিংসায় জ্বলে যাচ্ছে।
আমার বন্ধু পানওয়ালার দোকান থেকে দুটো পান খেলাম জর্দা দিয়ে। চায়ের দোকানে সকলের সঙ্গে বসে চা খেলাম।
ধীরেসুস্থে হাট শেষ হল।
হু হু করে উত্তুরে হাওয়া বইছিল। হৈ হৈ করে যাচ্ছিল শালপাতার সঙ্গে খড়কুটো; গরু, ঘোড়া, ছাগল, মুরগী আর তেলেভাজা পাকৌড়ির গন্ধমাখা ধুলো।
সমস্ত হাট থেকে একটা গুঞ্জরণ বাজছিল উচ্চ গ্রামে।
হেসালঙের হাটে এলে আমার মন প্রতিবারেই ভীষণ চমৎকৃত হয়।
এখানে কোনো দৌড়াদৌড়ি নেই। লোকাল ট্রেন বা লাস্ট বাস মিস্ করার চিন্তা নেই। সময়মত উপস্থিত না হবার জন্যে অফিসের বড়সাহেব বা কোর্টের জজসাহেবের ভ্রূকুটির ভয় নেই। ঘড়ি আবিষ্কার হবার পর যদিও বহু সহস্র বছর পার হয়ে গেছে, কিন্তু মানুষ এখানে আজও ঘড়ির উপর কর্তৃত্ব করছে, ঘড়ি মানুষের উপর নয়।
এই হাট-করা ছেলেমেয়েদের কাউকে যদি শুধোন যায়, তোমার কত বছর বয়স, সে প্রথমে জবাব দেবে না। হেসে বলবে, জানি না। তারপর পীড়াপীড়ি করলে ভ্রূ কুঁচকে অনেক ভেবে বলবে, যে-বছর পাহাড়তলির আমলকী বনে একটিও আমলকী ধরেনি, যে বছর আমলকী তলায় চিতল হরিণের ঝাঁক খেলা করেনি ও সে-বছর জন্মেছিল।
ওরা ওদের জন্ম, ওদের মৃত্যু, ওদের জীবন, কোনো কিছু নিয়েই কখনো মাথা ঘামায়নি–অথচ ওদের স্বল্পবিত্ততা ছাড়া ওদের আর কোনো অভাব নেই। কারণ ওরা আমাদের মতো প্রতিমুহূর্তের তীব্র ও বহুবিধ অভাববোধে নিজেদের কণ্টকিত জর্জরিত করেনি। ওদের মত হতে পারলে কি ভালোই না হত। কিন্তু ওদের জগৎ আর আমাদের জগৎ যে এক নয়। আমরা যে সেই অভাববোধহীন দিনগুলিকে বহুদিন আগে পিছনে ফেলে রেখে এই সাইক্লোনিক বুভুক্ষু মানসিক জগতে প্রবেশ করে ফেলেছি। এ জগৎ, এ মানসিকতা থেকে বেরোবার পথ ত আমাদের হাতে নেই।
মুরগী কিনতে গিয়ে হঠাৎ দত্তবাবুর সঙ্গে দেখা। ছোটখাটো ভালো স্বাস্থ্যের ভদ্রলোক। বয়স ষাটে পৌঁছেছে–কিন্তু শক্ত আঁটসাঁট শরীর। এখনো অবলীলাক্রমে পাঁচ-দশ মাইল হেঁটে বেড়ান। বেড়ানোর জন্যে নয়, এখানে প্রয়োজনেই প্রত্যেককে দিনে দু-তিন মাইল কমপক্ষে হাঁটতে হয়। দত্তবাবুর ছেলেরা সকলেই মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেছে। তবুও উনি এখন একটা চাকরি নিয়েছেন। সময় কাটাবার জন্যে, ডালটনগঞ্জের কাঠ ও বাঁশের নামকরা এক ঠিকাদার কোম্পানিতে। উইকএন্ডে এখানে আসেন যান।
দত্তবাবুর পরেই দেখা হল রায়বাবুর সঙ্গে। উনি এখানের অন্যতম পুরোনো বাসিন্দা। বয়স পঁচাত্তর হয়েছে কিন্তু চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই। হেসালঙ ও খিলাড়ির হাটে এখনো নিজে যান, এখনো রোজগার করেন নানা কিছু করে। মাইলের পর মাইল হেঁটে এর বাড়ি তার বাড়ি গিয়ে খাল-খরিয়াত্ শুধোন।
আজ থেকে অনেক বছর আগে যখন এ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা এখানের দশ হাজার একর পাহাড় ও জঙ্গল সরকারের কাছ থেকে নিয়ে কলোনাইজেশান সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ার পত্তন করে এখানে কলোনি করেন, তখন থেকেই উনি এখানে আছেন।
তখন এ জায়গাটার চেহারা নাকি অন্যরকম ছিল। রাস্তাঘাট সব চমৎকার ছিল। অনেকের বাড়িতেই নাকি গাড়ি ছিল। প্রত্যেক বাড়িতে যাবার মত মোটরের রাস্তা ছিল। সকাল-বিকেলে ফুটফুটে মেয়েদের দেখা যেত গান গাইতে গাইতে গরুর-গাড়ি চালিয়ে ক্ষেত-খামার থেকে আসতে যেতে। তখনই বুথ সাহেবের ফার্মেরও পত্তন হয়। বিরাট জায়গা নিয়ে ফল ও ফসলের চাষ। এখনও সে ফার্ম আছে, তবে এক মাড়োয়ারী ভদ্রলোক এখন কিনে নিয়েছেন সে ফার্ম।
রায়বাবুর মদের দোকান ছিল এখানে সেই সময়ে। ফরেন-লিকার শপ। বলছিলেন, পুরো বিহারে তখন তাঁর দোকানের বিক্রি ছিল সবচেয়ে বেশি।
এ জায়গাটার চেহারা কি ছিল এখন দেখে বোঝার উপায় নেই।
তারপর দেশ স্বাধীন হবার পরই এ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা একে একে এখান থেকে সরে পড়তে লাগলেন, কেউ ইংল্যান্ড, কেউ কানাড়া, বেশির ভাগই অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দিলেন। বাড়িগুলো সব একে একে বিক্রি হয়ে গেল। তাদের বদলে জঙ্গল-পাহাড় ভালোবাসেন এমন ভিনদেশী লোক এসে এখানে জমতে লাগলেন। এখন জায়গাটা দেশী, বিদেশী ও স্বল্পসংখ্যক এ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের আন্তজাতিক জায়গা হয়ে গেছে।
চ্যাটার্জি সাহেবদেরও দেখলাম। আলাপ নেই ওঁদের সঙ্গে। মিলিটারিতে ছিলেন চ্যাটার্জি সাহেব। এখন রিটায়ার করে, এখানে আছেন। জোত-জমি করেন।
ওঁর মেয়েটিকে দেখলেই আমার মন বড় খারাপ লাগে। ভারী সুন্দরী, বিয়ের অল্প কিছুদিন পরই স্বামী প্লেন ক্র্যাশে মারা যান। তার ছোট ছেলেটিকে নিয়ে সে মা-বাবার সঙ্গে এখানেই থাকে। ম্যাকলাস্কিগঞ্জের এই বন-পাহাড়ে ও নিশ্চয়ই কিছু পেয়েছে যা দিয়ে ওর একাকীত্বও ভরিয়ে রাখে।
সাদা পোশাক পরা এই সুন্দরী মেয়েটিকে যখনি দেখি, তখনই মন এক পবিত্রতায় ভরে যায়। বিষাদেরও বোধহয় কোনো নিজস্ব পবিত্রতা আছে। ওর প্রতি এক নীরব সমবেদনায় মন হু-হু করে ওঠে।
হাট শেষ করে বাড়ি ফিরব, এমন সময় মিসেস কার্নির সঙ্গে দেখা, মিসেস মেরেডিথের ভাগ্নীর সঙ্গে ইয়াং-লেডি হাটে এসেছেন। আমাকে বললেন, পালাবে না, আজ আমার সঙ্গে বাড়ি চল, আমার ওখানে খেয়ে যাবে।
বললাম, বেশ। তাই-ই হবে।
মালুকে বললাম বাড়ি ফিরে যেতে। তারপর বাড়ির পথেই যায় না শুঁড়িখানার মোড়ে হঠাৎ ডানদিকে ঘুরে যায়, তা লক্ষ্য করার পর নিশ্চিত হলাম যে ও বাড়ির দিকেই যাচ্ছে।
বেলা পড়ে এসেছিল। হাট শেষ করে সবাই একে একে বাড়ির দিকে ফিরছিল। যাদের সওদা কেনা হয়ে গেছে, যাদের বেচাও শেষ; তারা সবাই-ই।
এক সময় মিসেস কার্নির সঙ্গে হাট থেকে বেরিয়ে পড়লাম।
ছোট মেয়ের মত ফুটফুটে বৃদ্ধা হাই-হিল জুতোর খুট-খাট আওয়াজ করে পাশে পাশে হাঁটছিলেন।
বয়স হয়ে গেলে সব মানুষই বেশি কথা বলেন, তাঁদের বোধহয় মনে হয় তাঁদের এত কথা বলার ছিল, অথচ বলা হল না; বোধহয় মনে হয়, এখন না বলে ফেললে পরে আর বলা যাবে না। কিংবা হয়ত তাঁদের কথা শোনার মত লোক জোটে না, যুবক-যুবতীরা তাঁদের এড়িয়ে চলে। তাই যদি কেউ মনোযোগ সহকারে তাঁদের কথা শোনেন তাঁদের কিছু বাকি না রেখেই তাঁরা সব কথা শোনাতে চান।
মিসেস কার্নির বাড়িতে যখন এসে পৌঁছলাম তখন আলো চলে গেছে। কিন্তু পশ্চিমের আকাশে তখনো লালচে আভা। এক ঝাঁক মেঠো বক তাদের লম্বা লম্বা পা ঝুলিয়ে নিস্তরঙ্গ সন্ধ্যার আকাশে দুলতে দুলতে টাঁড় পেরিয়ে নাকটা পাহাড়ের নীচে ফিরে চলেছে।
চওড়া বারান্দা–এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত রেলিং দেওয়া। পর পর অনেকগুলো ঘর। প্রত্যেক ঘরের সঙ্গে এ্যাটাচ বাথরুম। উপরে টালির ছাদ।
এক পাশের দুটি ঘর ভাড়া দেওয়া আছে বুথ ফার্মের একজন কর্মচারীকে। এ্যাংলো ইন্ডিয়ান। সপরিবারে তিনি থাকেন সেখানে।
বাকি তিনটি ঘর মিসেস কার্নি আগন্তুকদের ভাড়া দেন। বাইরে বড় করে হলুদের উপর সাদায় লেখা আছে রেস্ট হাউস। আট টাকায় থাকা-খাওয়া।
আগে আগে বেড়াতে এসে এখানে একাধিকবার ছিলাম। থাকা তেমন আরামপ্রদ না হলেও খাওয়া এবং মিসেস কার্নির যত্ন-আত্তির তুলনা নেই।
বারান্দার অন্য প্রান্তে একটু আড়াল করে মিসেস কার্নির ড্রইংরুম! তারই পাশে ছোট্ট লেখা-কাম-খাওয়ার টেবল। বারান্দার সামনে থেকে লতানো গোলাপ লতিয়ে উঠেছে টবের মানিপ্ল্যান্ট।
মিসেস কার্নি বললেন, বোসো, বোসো, আমি একটু কাজ সেরে আসছি। চা খাবে ত?
বললাম, খাব।
একটু পর ওঁর আয়া এসে চা দিয়ে গেল।
টেবলের ওপর ওর যৌবনের একটা ফোটো ছিল। রাইডিং-ব্রিচেস পরা ফুটন্ত একটি দপদপানো দামাল মেয়ে। সেই ফোটোর দিকে চেয়ে আজকের সাতষট্টি বছরের বৃদ্ধাকে চিনতেও কষ্ট হয়।
একদৃষ্টে ঐ ফোটোটার দিকে চেয়েছিলাম। তিনি বললেন, কি দেখছ?
আমি জবাব দিলাম না, হাসলাম।
মিসেস কার্নিও হাসলেন, বললেন, আমার ছবি নয়, বলো আমার অতীতকে দেখছ। আমার পুরোনো আমিকে দেখছ।
তাকিয়েই ছিলাম–সুন্দরী স্বাস্থ্যবতী একটি হাসিখুশি মেয়ে কাঁধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে কোঁকড়া চুল-হাসিমুখে চেয়ে আছে সে সামনের দিকে।
বললাম, আপনার কষ্ট হয় বুঝি এই ছবি দেখলে?
তিনি বললেন, নট এ্যাট অল। আমি এখনও খুশি। এজ আ ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট–আই হ্যাভ ভেরী মাচ এনজয়েড দিস লাইফ এন্ড আই এনজয় ইট ইভিন টু-ডে।
তারপর বললেন, শুধু বড় একা একা লাগে মাঝে মাঝে। এ ছাড়া আমি খুব খুশি। লাইফ ইজ আ ওয়ান্ডারফুল থিং, বুঝলে। আমি আবার প্রথম থেকে শুরু করতাম, আমার পাঁচ বছর বয়স থেকে, যদি আমাকে ভগবান সে সুযোগ দিতেন।
এ অবধি বলেই উনি চুপ করে গেলেন, তারপর বললেন, দাঁড়াও তোমাকে আমার ও মিস্টার কার্নির সব ছোটবেলার ছবি দেখাচ্ছি–হোয়াট আ ওয়ান্ডারফুল টাইম উই হ্যাড। আই রিয়্যালি ডু মিস মাই ম্যান।
শোবার ঘর থেকে মিসেস কার্নি অনেকগুলো ছবি নিয়ে এলেন, দু-তিনটি এ্যালবাম ভর্তি ছবি। ওঁর বাবা-মার ছবি–ওঁর শ্বশুরবাড়ির অনেকের ছবি। ওঁদের হানিমুনের ছবি।
মিসেস কার্নি বলছিলেন, জানো, শেষ বয়সে মিস্টার কার্নি অন্ধ হয়ে গেছিলেন।
যে-লোকটা ভীষণ চটপটে ছিল, কাজের লোক ছিল, যে আমাকে সারা জীবন সব। রকম আরামে, আনন্দে রেখেছিল সে লোটার শেষ বয়সে যে কী দুর্দশা হয়েছিল তা কি বলব।
এই আমি, এই অবলা নারী; এই মিসেস উইনিফ্রেড কার্নিই তখন তার সবকিছু ছিল।
আমার হাত ধরে তাকে চলতে হত–আমার রোজগারে তার খেতে হত–তার পক্ষে সেই শেষের দিনগুলো বড় লজ্জার ছিল।
কোন আত্মসম্মানজ্ঞানী পুরুষমানুষ স্ত্রীর উপরে নির্ভর করে, তার দয়ায় বেঁচে থাকতে চায়, বলো? অবশ্য পুরুষদের এটা অন্যায়। তারা যদি আমাদের ভালোবাসে, তবে তাদের মনে কোনো দৈন্য থাকা উচিত নয় এ বাবদে। একে দৈন্য বলা যায় কি না জানি না, তবে সত্যি কথা বলতে কি, আমরা মেয়েরা পুরুষদের এই সম্মানজ্ঞান বা দম্ভ যাই-ই বল, কিন্তু পছন্দ করি। কি জানি, মনে হয়, যে-পুরুষের এই সম্মানজ্ঞান নেই, যে এমন অবস্থায় নিজেকে অসহায় ও কর্তব্যচ্যুত বলে মনে করে না; তাকে কোনো মেয়ের পক্ষেই ভালোবাসা সম্ভব নয়।
তারপর অনেকক্ষণ আমরা দুজনে চুপচাপ বসেছিলাম। ওঁর কথার উত্তরে আমার কিছু বলার ছিলো না।
অনেকক্ষণ পর মিসেস কার্নি বললেন, জানো মিস্টার বোস, উনি মারা যাবার আগে হাতড়ে হাতড়ে আমার হাত খুঁজে নিয়ে নিজের হাতে নিতেন, আর ধীরে ধীরে বলতেন, আমার হাতে হাত রাখো, আমার বড় শীত করে।
বলতেন, ও মাই গার্লি, তুমি তোমার এই ছোট ছোট গোলাপ ফুলের পাপড়ির মত হাত দুটি দিয়ে কী কষ্টই না করছ, কত কষ্ট দিলাম তোমাকে আমি। তোমার এই সুন্দর হাত দুটি দিয়ে এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর বিরুদ্ধে তুমি একা-একা লড়াই করে গেলে, তোমার জন্যে আমার সারা জীবনে আমি যা না করলাম, তুমি আমার জন্যে এই শেষ জীবনে তার অনেক গুণ বেশি করলে। বলতেন, সুইটি গার্লি, আবার যদি তোমার সঙ্গে কখনো দেখা হয়, অন্য কোনো জন্মে, কখনো যদি আবার যৌবনাবস্থায় দুচোখ খুলে তোমাকে দেখতে পাই, ত দেখবে, আমি কি করে তোমার ঋণ শোধ করি।
বলতে বলতে মিসেস কার্নির দুচোখ বেয়ে জল গড়াতে লাগল।
বাইরে ঝিঁঝির শব্দ জোর হল।
ভারী একটানা ভোঁতা আওয়াজ তুলে ডিজেলে-টানা মেরুনরঙা মালগাড়ি চলে গেল অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বাড়কাকানার দিকে।
আমি চুপ করে বসে রইলাম। এখন কিছু বলা উচিত নয়, বলার নেই।
একটু পরে খাবার এল। খাবার বলতে কিছুই নয় তেমন। আণ্ডা কারী ও পাঁউরুটি, সঙ্গে পেয়ারার জ্যাম।
মিসেস কার্নি তাঁর গেস্টহাউসের অতিথিদের যেমন ষোড়শোপচারে খাওয়ান, নিজে তেমন খান না।
খাওয়া-দাওয়া শেষ হতে হতে রাত আটটা। রাত আটটা এখানে শীতের রাতে অনেক রাত।
যাবার সময় উনি একটা টর্চলাইট ধার দিলেন আমাকে। বললেন, কাল মালুকে দিয়ে পাঠিয়ে দিও।
উনি রেলিং ধরে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন–আমি পেছনে শর্টকাট দিয়ে বেরিয়ে এসে দীপচাঁদের দোকানের সামনের মাঠে পড়লাম। অন্ধকার হলেও আকাশে একফালি চাঁদ ছিল, আর ছিল নক্ষত্রমণ্ডলী। কোমরে তলোয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কালপুরুষ এক প্রাগৈতিহাসিক স্থবিরের মত সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড পাহারা দিচ্ছিলেন। অগণিত তারারা এই হিমের রাতে তাদের নীলাভ সবুজ চোখ মেলে তাকিয়েছিল।
প্রথমে বেশ ঠাণ্ডা লাগছিল। তারপর একটু হাঁটতেই গা গরম হয়ে গেল। দেখতে-দেখতে মাঠ পেরিয়ে এলাম।
ঝর্ণা পেরিয়ে সেই ভূতের বাড়ির পাশ দিয়ে এবং একা সায়ান্ধকার শিশির-ভেজা পথে যেতে যেতে মিসেস কার্নির কথাগুলো কানে বাজছিল, লাইফ ইজ আ ওয়ান্ডারফুল থিং।
কিন্তু আমার কেন এ কথা একবারও মনে হয় না?
আমার এই ভরা-যৌবনে–আমার এই সমস্ত রকম আপাতপ্রাপ্তির মধ্যেও কেন মন আমার সব সময় এমন অশান্ত থাকে? কেন এমন পাগলের মত ছটফট করে? না কি, আমি একাই নই, সবাই-ই এরকম, প্রত্যেক মানুষ ও মানুষীর মনের ভিতরেই বুঝি এমনি একটা মন থাকে, যে মনটা প্রতিটি মুহূর্তে বিদ্রোহীর মত মাথা তুলে দাঁড়াতে চায়, যা পেল, তাকে ধুলোয় ফেলে, অন্য কিছুর দিকে হাত বাড়ায়?
মাঝে মাঝে আমার নিজেকে লাথি মারতে ইচ্ছা করে। কেন সুখী হতে পারলাম না সহজ পথে-সকলে যেমন করে সুখী হয়? কেন সর্বক্ষণ একটা কাঁকড়া-বিছে আমাকে এমন করে কামড়ায়? কেন?