আজকাল ছোটো মাস্টারও রোজ আসেন। ডাক্তারবাবু বাবাকে বলেছেন যে আমাকে নানারকম ভালো হাতের কাজ শেখালে মনটন ভালো থাকবে, তাহলে ঠ্যাং দুটোও তাড়াতাড়ি সারবে। নাকি রোগটা ঠ্যাঙের নয়, মনের। মনের জোর হলেই পায়ের জোর হবে। কিছু বললাম না, কারণ হাতের কাজ শিখতে আমার কোনো আপত্তি নেই।
আপত্তি তো নেই-ই, বরং আগ্রহ আছে বলা যায়। বড়ো মাস্টার বাবাকে বললেন, তলাপাত্র যন্ত্রপাতি গাড়ি ইত্যাদির ছোটো ছোটো মডেল তৈরি করতে ওস্তাদ। আমাদের নাইট স্কুলের বড়ো ছেলেদের দিয়ে রেলগাড়ি আর এঞ্জিনের যে খাসা মডেল করিয়েছে, দেখলে অবাক হয়ে যাবেন।
বাবাকে দেখাবার জন্যে মডেলটা আনলেনও বড়ো মাস্টার। দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। অবিকল একটা রেলগাড়ি। দরজা, জানলা, স্প্রিং, চাকা, আলো, পাখা, জলের ট্যাঙ্ক, লাইন, ব্রেক, অ্যালার্ম সিগনেল, ইলেকট্রিক ইঞ্জিনের যাবতীয় কিছু একেবারে হুবহু সত্যিকার গাড়িতে যেমন থাকে। রং টং দিয়ে তৈরি। আমার ঘরের মেঝেতে লাইন বসিয়ে, প্লাগ লাগিয়ে সেই গাড়ি চালানো হল। তার বাঁশিটি পর্যন্ত অবিকল। কী বলব, গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল।
সেদিন রাতে মা-বাবার মুখে ছোটো মাস্টারের প্রশংসা আর ধরেনা। এতদিন চোর চোর চেহারা, সোজা তাকায় না কেন,ইত্যাদি কী না বলেছেন সবাই। আজ একেবারে উলটো কথা। তখনই ঠিক হয়ে গেল ছোটো মাস্টার রোজ বিকেলে নাইট স্কুলে যাবার আগে, আমাকে ঘণ্টা দুই হাতের কাজ শেখাবেন। ভালোই হল; ওই সময়টাই আমার ভালো কাটত না। আগে ওই সময়টা খেলার মাঠে কাটত। রোজ চারটে থেকে ছ-টা যদি মডেল তৈরি করা যায়, বিশেষত ছোটো মাস্টারের সঙ্গে, তাহলে মন্দ কী। তা ছাড়া আমার আরেকটা মতলবও আছে।
প্রথম দিন ছোটো মাস্টার এসে কিছু বলবার আগেই আমি বললাম, স্পেসশিপের মডেল করা যায়না?
ছোটো মাস্টার একটু হকচকিয়ে গেলেন। একেবারে স্পেসশিপ দিয়েই শুরু করবে নাকি? আগে ছোটোখাটো দুটো-একটা জিনিস করলে হয় না?
আমি বললাম, বেশ তো, আগে ছোটোখাটো জিনিস দিয়েই নাহয় শুরু করা যাবে। ওই যে সেদিন পাক-খাওয়ার মেশিনের কথা বলছিলেন, তাই দিয়েই আরম্ভ করা যাক। ওই বইটাতে তার ছবিও আছে।
অন্য কেউ হলে হয়তো বকাবকি করত। কিন্তু ছোটো মাস্টার বললেন, আচ্ছা, তাই হবে। তাহলে বইটা থেকে ওই যন্ত্রটার পার্টগুলোর ছবি আগে এঁকে নিতে হবে। কাগজ পেনসিল রবার সবই তো আছে। মাপ নেবার জন্য কম্পাস ইত্যাদিও লাগবে। ওই মাপেই এঁকো।
তারপর এক বার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, সত্যি সত্যি যাবার ইচ্ছা আছে দেখছি। কাগজে দেখলাম অ্যামেরিকানরা সম্ভবত এ বছরই চাঁদে মানুষ নামাবে।
আমি আরেকটু হলে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েই উঠছিলাম। পিছনটাকে চেয়ার থেকে খানিকটা বোধ হয় তুলেই ফেলেছিলাম। কিন্তু সে কথা মনে হতেই ধপ করে আবার চেয়ারের উপর পড়ে গেলাম। ছোটো মাস্টার সব দেখলেন। বললেন, লাগেনি তো? চাঁদে যাবে বলে যে সবার আগে যেতে হবে তার কোনো মানে নেই। তা ছাড়া নিজেদের স্পেসশিপে করে যেতে হলে একটু দেরি তো হবেই। বৈজ্ঞানিকরা আগে গিয়ে দেখেই আসুক না সেখানকার অবস্থাটা কীরকম। কী বলো? সেই বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে। মাটির নীচে উপনিবেশ করতে সময় নেবে।
আমি বললাম, বাবা বলছিলেন, এর মধ্যে রাশিয়ানদের একটা জিন্ডপাঁচ চাঁদের চারদিকে ঘুরে ফিরে এসেছে। এর আগে চাঁদে রকেট নেমেছে বটে, কিন্তু এক বার নেমে, আবার উঠে ফিরে আসেনি। বোধ হয় মানুষ না গেলে, সেটা খুব শক্ত হবে। ইস, পা-দুটোর উপর এমনি রাগ হয়! এই বলে পা-দুটোকে শক্ত করবার চেষ্টা করলাম। কেমন যেন ঝিঁঝি ধরার মতো মনে হল।
ঠিক সেই সময় একটা ছোটো বান্ডিল হাতে নিয়ে গুপি এসে উপস্থিত। স্কুলের জন্মদিন বলে সেদিন নাকি একটায় ছুটি হয়ে গেছে। পুঁটলিতে কী?
গুপি একটু লজ্জা পেল। খিদিরপুর ডকের কাছে নাকি সস্তায় খুব দরকারি সব পুরোনো জিনিস বিক্রি হচ্ছিল। তারই কিছু কিনে এনেছে। খুলে দেখলাম নাইলনের হাওয়া-বালিশ, হাওয়া না থাকলে রুমালের মতো ছোটো করে ভাজ করে ফেলা যায়। নাইলনের জলের বোতল আর খাবার রাখার থলি। হাঁ করে ছোটো মাস্টার গুপির দিকে চেয়ে রইলেন। গুপি বলল, হ্যাঁ স্যার, আগে থাকতেই বন্দোবস্ত করা ভালো। বেশিদিন তো আর নেই। নিজেদের খাবার-দাবার নিজেরা নিলেই ভালো। শুনলাম পাঁচ দিনের ওয়াস্তা; পাঁচ দিন! মানে, খালি রকেট সাত দিনে গিয়ে ফিরতে পারে বটে, কিন্তু লোকজন জিনিসপত্র থাকলে নিশ্চয় কিছু বেশি সময় লাগবে। হয়তো যেতে-আসতে পাঁচ-পাঁচ মোট দশ দিন।
আমি বললাম, চোঙা মতো ওটা কী? গুপি হেসে বলল, এটাই তো আসল জিনিস। চঁদ দেখার টেলিস্কোপ। কোনো জাহাজের খ্যাপা ক্যাপ্টেন নাকি ওটাকে বন্ধক দিয়ে টাকা নিয়েছিল, আর ছাড়াতে আসেনি।
–টেলিস্কোপ? টেলিস্কোপ দিয়ে কী হবে?
ছোটো মাস্টার লাফিয়ে উঠলেন, আকাশ দেখার টেলিস্কোপ নাকি? সে তো অন্যরকম দেখতে হয়। তারপর টেলিস্কোপটা বের করে বললেন, না, আকাশ দেখার নয়। কিন্তু খুব পাওয়ারফুল। সমুদ্রে দূরে দেখার জন্য ব্যবহার হয়। আকাশে এরোপ্লেন ইত্যাদিও দেখা যায়। দেখবে নাকি, পানু?
ছোটো মাস্টার টেলিস্কোপের লেন্স পরিষ্কার করে দিয়ে, ফোকাস ঠিক করে, আমার হাতে দিলেন। আমি জানলা দিয়ে চারিদিকে দেখতে লাগলাম। সব অন্যরকম লাগল। ঠান্ডা ঘরটাকে ভালো করে দেখলাম। মনে হল ছাদে কীসব পাইচারি করছে, ছোটোমতো, সাদা কালো। আলো কম বলে ভালো করে বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ একটা সন্দেহ হল, গুপি, নিশ্চয় পে– উঃ!
গুপি আমার হাঁটুর উপরে খুব জোরে চিমটি কাটল। আমি টেলিস্কোপ নামাতেই, ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে কিছু বলতে মানা করল। মুখে বলল, চাঁদ উঠেছে, দ্যাখ ভালো করে।
চাঁদের দিকে টেলিস্কোপ ফেরালাম। অদ্ভুত লাগল। অবিশ্যি পাহাড়-পর্বত এটা দিয়ে দেখা গেল না। কিন্তু আরেকটা জিনিস দেখে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। স্পষ্ট দেখলাম, জিনিসপত্রে বোঝাই ডানাওয়ালা একটা নৌকোর মতো কী যেন, চাঁদের মুখের উপর দিয়ে আস্তে আস্তে ভেসে গেল। কয়েক সেকেন্ডের জন্যে তার কুচকুচে কালো আকৃতি পূর্ণিমার চাঁদের সোনালি গায়ের উপর পরিষ্কার ফুটে উঠল। তারপরেই চাঁদ পেরিয়ে এক টুকরো কালচে মেঘের পিছনে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আমার মুখ দেখে ওরা দু-জন চাঁচাতে লাগল। কী হল? কী হল? শরীর খারাপ হল নাকি? আমি বললাম, না। চাঁদে যাবার প্রথম নৌকোটাকে বোধ হয় দেখলাম। লটবহর নিয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা, গুপি, ছোটোমামা কি–
গুপি বলল, চোপ।
ছোটো মাস্টার তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেন, আচ্ছা, আমি তাহলে আসি। আমি থাকলে তোমাদের কথাবার্তার অসুবিধা হয়। তা ছাড়া, নাইট ক্লাসের আর বেশি দেরিও নেই। বলেই, বোধ হয় একটু রেগে হনহন করে চলে গেলেন।
খুব খারাপ লাগল। কিন্তু গুপি খুশি হয়ে বলল, যাক, বাঁচা গেল, লোকটা ঠিক ছিনেজোঁক, কিছুতেই তোকে ছাড়তে চায় না।
আমি বললাম, না রে গুপি। উনি রবিবার ছাড়া রোজ আমাকে দু-ঘণ্টা করে হাতের কাজ শেখাবেন। প্রথমে আমরা স্পেসশিপের মডেল বানাব। তারপর সেটাকে বড় করে বানাতে কতক্ষণ!
শুনে গুপিরও কী উৎসাহ!
আমি বললাম, আচ্ছা, ছোটোমামাকে তো আর একদিনও দেখতে পেলাম না, গুপি। চাকরি গেল নাকি?
গুপি বলল, আরে, না, না, তাই যায় কখনো! ছোটোমামা ভয়ংকর চালাক, প্রেসের ভিতরে আজকাল ওর দিনের বেলায় ডিউটি। বড়ো সাহেবকে পটিয়েছে। ক্যান্টিন দেখে। তারজন্যে পয়সা নেয় না, কিন্তু দু-বেলা খাবার পায়। বড় সাহেবরা যা খায়, ও-ও তাই খায়। চপ, কাটলেট, মুরগি ভিন্দালু, পুডিং।
দু-জনেই খানিকক্ষণ চুপ করে সেসব কথা ভাবতে লাগলাম। তারপর গুপি বলল, কিন্তু বড়ো মাস্টারের কী রাগ! ওকে চেনেন না, জানেন না, তবু কেবলই ছোটো সাহেবের কান ভাঙাতে চেষ্টা করবেন। স্রেফ হিংসে। ছোটোমামা খাবে ক্যান্টিনে, আর বুড়ো খাবে তেওয়ারির দোকানে, এই আর কী! সমস্তক্ষণ ছোঁকছোঁক করে ছোটোমামার পিছনে ঘোরেন, প্রুফ দেখেন না হাতি! একটু যে তদন্ত করবে, ছোটোমামা সে জো নেই!
আমি বললাম, কেন, রাতে তদন্ত করলেই হয়।
শুনে গুপির কী হাসি, তাহলেই হয়েছে! ছোটোমামার যা ভূতের ভয়! ও রাতে গলি দিয়ে নামল আর কী!
আমি অবাক হয়ে গেলাম। তবে-না নাইট ওয়াচম্যানের বদলির কাজ নিয়েছিল বলেছিলি?
গুপি বলল, তাতে কী হয়েছে! সব নাইট ওয়াচম্যানরা ভূতের নামে জুজু। ছোটোমামা সিঁড়ির মাথা থেকেই চৌকিদারি করত। আগের ওয়াচম্যানই তাই বলে দিয়েছিল। সে-ও তাই করত। এখানকার রাতের পাহারাওয়ালারাই তাই করে। আর যারা ভূতে বিশ্বাস করে না, তারা দেয়ালে ঠেস দিয়ে ঘুমোয়। মোট কথা ঠান্ডা ঘরে কীরকম স্পেসশিপ তৈরি হচ্ছে, আর কারাই-বা তৈরি করছে, এ বিষয়ে এতটুকু তদন্ত করার সময় পাচ্ছে না ছোটোমামা। তা ছাড়া ওই সরকারি ছাপাখানাটা কি কম পুরোনো ভেবেছিস নাকি। কোম্পানির আমলে ওটা এদিককার সবচেয়ে বড়ো গুদামঘর ছিল। মোটে আশি বছর হল ছাপাখানা হয়েছে। ভূতফুত থাকলে ওইখানেই থাকা কিছু বিচিত্র নয়। ছোটোমামা রাতে শুয়ে শুয়ে হাঁচড়পাঁচড় উঁয়া-ঊয়া শব্দ শোনে। কোনদিন আবার ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যায়।
আমি ব্যস্ত হয়ে উঠলাম, মানা কর, গুপি, বাড়িতে পা দিয়েছে কি কাঁক করে সামন্ত ওকে ধরবে। ওর ঘরে-না চোরাই গাড়ির নম্বরপ্লেট পাওয়া গেছে।
গুপি বলল, আরে দূর! দূর! সে-বিষয়ে ছোটোমামাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। বলল নাকি বড়ো রাস্তার ওদিকে পুরোনো লোহার উঁই আছে, সেখান থেকে কুড়িয়ে এনেছে। গাড়ির নম্বরপ্লেট খুলবে ও! আমাকে দিয়ে নিজের পেনসিল কাটায়, ব্লেড দেখলে ওর গা শিরশির করে! নেংটি ইঁদুর ভয় পায়।
তারপর হঠাৎ থেমে গুপি বলল, ছোটো মাস্টারকে কি চোরাই কারবারি মনে হয়?
ভয়ানক রাগ হল। বললাম, আমাদের বাড়িতে যারা আসে যায়, তাদের তোর সন্দেহবাতিক। থেকে বাদ দে। সামন্তর তো ধারণা যে তোর ছোটোমামাই চোরাই কারবারের চাঁই।
গুপি তার জিনিসপত্র গুটিয়ে তুলে চলে গেল। দরজার কাছ থেকে বলে গেল, আশা করি এর পরেও ছোটোমামার স্পেসশিপে জায়গা আশা কর না।
আমিও চটেমটে বললাম, যারা স্পেসশিপ বানায়, তারা পুরোনো লোহার ছ্যাকড়া ঘুড়ি চড়ে না।
গুপি চলে গেলে মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল। স্কুলের সব খবর ওর কাছেই পাই। বলতে গেলে ও-ই আমার একমাত্র বন্ধু। ছোটো মাস্টারের হাতে-লেখা চাঁদ বিষয়ক নোট বইটা খুলে বসলাম। তাতে এই সব লেখা:
(১) চাঁদ পৃথিবী থেকে গড়পড়তা দুই লক্ষ চল্লিশ হাজার মাইল দূরে।
(২) তার মধ্যে দুই লক্ষ যোলো হাজার মাইল পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির এলাকার মধ্যে। বাকি চব্বিশ হাজার মাইল চাঁদের মাধ্যাকর্ষণের এলাকায়।
(৩) চাঁদে নামতে হলে প্রথমে মনে রাখতে হবে সেখানে বাতাস নেই। শব্দতরঙ্গ ওঠে না, অর্থাৎ কানে কিছু শোনা যায় না। নিশ্বাস নেবার অক্সিজেন নেই, কাজেই অক্সিজেনের ব্যবস্থা করে নিতে হবে। বায়ু নেই বলে সূর্যের আলোর বেজায় তাপ। আর রাতে বেজায় ঠান্ডা।
(৪) চাঁদের একেকটা দিন আর রাত আমাদের চোদ্দো দিনের সমান লম্বা। এক দিন আর এক রাতেই চাঁদের এক মাস কাবার হয়।
(৫) চাঁদ সর্বদা পৃথিবীর দিকে তার একটা পিঠই ফিরিয়ে রাখে। পৃথিবী থেকে অন্য পিঠটা দেখা যায় না, তবে রকেট থেকে তার ছবি তুলে দেখা গেছে যে সে-দিকে পাহাড়-পর্বত কম। নামতে হলে ওদিকেই সুবিধা।
(৬) প্রথম বৈজ্ঞানিকরা চাঁদে গিয়ে, মাটির নীচে উপনিবেশ তৈরি করবে। তাহলে রাতের বড় বেশি ঠান্ডা আর দিনের বড়ো বেশি গরম থেকে বাঁচা যাবে। উপনিবেশটা হবে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত।
(৭) নিশ্বাস নেবার অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে আর নিশ্বাস ফেলার সঙ্গে যে কার্বন ডাই-অক্সাইড বেরুবে তাকে দূর করতে, ক্লরেলা বলে একরকম শ্যাওলার চাষ করা হবে, মাটির নীচের সেই উপনিবেশে ক্লরেলার অন্য নাম ডাকউইড।
এইসব পড়ে আমি তো অবাক হয়ে গেলাম। কিন্তু তাহলে আমাদের বাতাসের ব্যাবসাটা তুলে দিতে হয়। তা হোক। ক্লরেলার চাষ করব। তাহলে জমি কিনতে হবে মাটির নীচে।
ভেবে দেখলাম চাঁদের মাটির তলার উপনিবেশে কী কী লাগতে পারে। জোনাকি পোকা সরবরাহ করা যায়। লক্ষ লক্ষ জোনাকি ছাড়লে মাটির তলার গুহাঘর নিশ্চয় আলো হয়ে থাকবে। তবে হয়তো বিজলিবাতির ব্যবস্থা হবে। তাহলে জোনাকি লাগবে না। এক যদিনা বিজলি বাঁচাবার জন্যে স্নানের ঘরেটরে ব্যবহার করা যায়। জোনাকি দিয়ে বোধ হয় রান্নার উনুন জ্বালানো যাবে না। একবার ধরেছিলাম মুঠো করে পাঁচ সাতটা। একটুও গরম মনে হয়নি।
পরদিন রবিবার। যখন বড়ো মাস্টার এলেন, চাঁদের সম্বন্ধে না বলে পারলাম না। মিটমিট করে হাসতে লাগলেন। বললেন, তার চেয়েও অনেক বেশি চিত্তাকর্ষক কথা হল যে আমাদের এই ভারতের দক্ষিণ দিকের তীরভূমির কাছাকাছি সমুদ্রের তলা থেকে রাজার ঐশ্বর্য তোলা যায়।
আমি বললাম, মুক্তো?
বড়ো মাস্টার হাসতে লাগলেন, মুক্তো হবে কেন? মুক্তো আর এমন কী, আজকাল মুক্তোর চাষ হয়, মুক্তোর দিন গেছে।
–তবে?
বড়ো মাস্টার বললেন, জাহাজডুবির কথা শুনেছিস?
ইংরেজরা এদেশের নাম শোনার অনেক আগে পোর্তুগিজরা ব্যাবসা করতে আসত। আবার জলদস্যু বোম্বেটেরাও ছিল। সমুদ্রে লড়াই হত, ঝড় হত, ডুবন্ত পাহাড়ে জাহাজের তলা ফেঁসে যেত, জাহাজডুবি হত। তার অনেক জাহাজ এখনও সমুদ্রের তলায় পড়ে আছে। সোনারুপোর গয়না, হিরে মণি মাণিক, এত বড়ো বড়ো মোহর সমুদ্রের নীচেকার বালির উপর ছড়িয়ে পড়ে আছে। কত লোকে নিজের চোখে দেখে এসেছে। আমিও।
আমি অবাক হয়ে বড়ো মাস্টারের মুখের দিকে তাকালাম। চেয়ারের হাতলে দু-হাত চাপড়ে কেঠো পা মাটিতে ঠুকে তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমিও। এবং এই কাঠের পা নিয়েই, আমাকে কি ওই ফেরারি ছোটোমামাটির চেয়ে কম ঠাউরেছিস নাকি?
চমকে উঠেছিলাম। তবে কি গুপি ভুল বলল, ছোটোমামাকে বড়ো মাস্টারমশাই চিনে ফেলেছেন। তাহলে সামন্তের কানে কথাটা তুলতেই-বা কতক্ষণ!হয়ে গেল চাঁদে যাওয়া। সঙ্গেসঙ্গে মনে পড়ে গেল ছোটো মাস্টারের কথা। বড়ো মাস্টার বললেন, হাসছিস যে বড়ো? আমার কথাটা বিশ্বাস হল না বুঝি?
–না, না, সেজন্যে নয়, ডুবো জাহাজের কথা খুব বিশ্বাস করেছি। কিন্তু কাল টেলিস্কোপ দিয়ে দেখলাম, জিনিসপত্রে বোঝাই আকাশি নৌকো চাদে যাচ্ছে।
–সে কী! চাঁদে জনমানুষ নেই, জিনিসপত্র যাচ্ছে আবার কী? কেনই-বা যাচ্ছে?
আমি বললাম, বাঃ, মাটির তলায় উপনিবেশ হবে যে। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত উপনিবেশ তৈরি করতে হলে যন্ত্রপাতি, তার, তক্তা, স্ক্রু ইত্যাদি লাগবে না?
বড়ো মাস্টার চোখ থেকে চশমা জোড়া খুলে আমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন! তারপর বললেন, বুড়োধরার কথা বলেছিলাম কি?
০৭.
আমি বললাম, বুড়োধরা আবার কী? সেরকম আছে বলে তো শুনিনি।
বড়ো মাস্টার বললেন, তা যদি না থাকত তো এতদিনে এই পৃথিবী বুড়োতে ছেয়ে যেত। তোদের আর দাঁড়াবার জায়গা থাকত না।
আমি লজ্জা পেয়ে বললাম, আপনাকে ধরেছিল বুঝি?
বড়ো মাস্টার রেগে গেলেন। চেয়ার ছেড়ে উঠে বললেন, আমাকে আবার বুড়ো দেখলি কোথায়? বুড়োরা দিনের মধ্যে দশ বার কেঠো পা নিয়ে পাঁচ তলা অবধি ওঠা-নামা করতে পারে?
হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে বলে ফেললাম, গুপির ছোটোমামা বলেন আপনি ছাপাখানার লিফটে চড়ে চার তলায় ওঠেন, তারপর সেখান থেকে সিঁড়ি দিয়ে পাঁচ তলায় ওঠেন। সেটুকু সব বুড়োরাই পারে।
মাস্টারমশায়ের মুখটা প্রথমে লাল হয়ে তারপর বেগনি হয়ে গেল। আমি তো ভয়েই মরি, এক্ষুনি-না ফেটে যান।
অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে মাস্টারমশাই বললেন, গুপির ছোটোমামা মানে সেই কুখ্যাত ফেরারি আসামি চাঁদু তো? সে আমাকে কোথায় দেখল?
আমি তো মহা মুশকিলে পড়ে গেলাম। এর আগেই গুপি আমাকে বলেছিল যে ছোটোমামার প্রাণ আমার হাতে। আমি আমতা আমতা করে বললাম, ওঁর ভালো নাম নৃপেন্দ্রনারায়ণ।
–তা হতে পারে, কিন্তু সে আমাকে দেখল কোথায়? এই বলে বড়ো মাস্টার আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে রইলেন।
আমি বললাম, না, তা নয়, দেখেননি হয়তো। কিন্তু উনি বলেছিলেন যে সরকারি ছাপাখানার লিট তো চার তলায় শেষ। তারপর বোধ হয় তোদের মাস্টারমশাইকে হাঁটতে হয়।
–কাকে বলছিলেন? তোকে?
না, না, আমাকে তো ভলো করে চেনেন না, তাই গুপিকেই বলেছিলেন। গল্পটা বলবেন না? বড়ো মাস্টার ফোঁস করে নিশ্বাস ছেড়ে বললেন, ওঃ, আমার জন্যে ভেবে ভেবেচঁদুর বুঝি ঘুম হয় না? গুপিকে বলিস ওকে বলে দিতে ও কী! অমন চমকে উঠলি কেন?
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বুঝেছি। বলবে কী করে? সে এতক্ষণে জলঢাকায় কি সোফিয়ায় কি নাথুলায় কি কোথায় তাই-বা কে জানে!
আমি বললাম, তা ছাড়া গুপির সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়ে গেছে, সে এখন আমাদের বাড়িতে আসবে না।
সঙ্গেসঙ্গে গুপি ঘরে ঢুকে বলল, না স্যার, ওর কোনো কথা বিশ্বাস করবেন না, স্যার। ওর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে বলে আসব নাই-বা কেন, আপনার গল্প শুনব নাই-বা কেন, খাব নাই-বা কেন?
এই বলে রামকানাইয়ের হাত থেকে ছোটো ছোটো মাংসের বড়া আর আলুমটর সিদ্ধর থালাটা নামিয়ে নিয়ে, তিনটে প্লেটে ভাগ করতে লাগল। মাস্টারমশাই এক বার ওর দিকে, এক বার আমার দিকে তাকাতে তাকাতে চামচ দিয়ে খেতে লাগলেন। তখন গুপি পকেট থেকে দুটো মলাট-আলগা বই বের করে বলল, তা ছাড়া, ওর এসব পড়া দরকার। নইলে চাঁদে যাবার মতো যথেষ্ট জ্ঞান হবে কী করে?
চোখ বুলিয়ে দেখলাম। একটার নাম, চাঁদ উপনিবেশ অন্যটার নাম, চাঁদের আবহাওয়া। ভেবেছিলাম ওর সঙ্গে কথা বলে কাজ নেই। বই দেখে বললাম, কোথায় পেলি রে?
গুপি বলল, ছোটো স্যারের কাছ থেকে নিয়েছিলাম।
মাস্টারমশাই বিরক্ত হয়ে বললেন, তোমাদের মাথা খেতে আর বড়ো বেশি বাকি রাখেনি তলাপাত্র। ওটা কীসের মডেল?
আমি খুব খুশি হলাম। বললাম, ওটা স্পেসশিপের পার্ট। ওর ভিতরে মানুষরা বসে থাকবে, মহাকাশযান পাক খেলেও মানুষগুলো স্থির হয়ে বসে থাকবে।
বড়ো মাস্টার একটুক্ষণ সেদিকে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, পুনালুর গেছিস কখনো?
আমরা তো অবাক।
পুনালুর আবার কোথায়? কোনো গ্রহের উপগ্রহ-ট্রহ নয় তো?
মাস্টারমশাই হেসে বললেন, ওই যা বলি, চাঁদ চাঁদ করে তোরা খেপে গেলি, অথচ এই পৃথিবীটার কিছুই দেখলি না। পুনালুর শুধু এই পৃথিবীতে নয়, আমাদের নিজেদের দেশে। মাদ্রাজ থেকে ত্রিবান্দ্রাম যেতে হলে প্রায় একটা গোটা দিন লেগে যায়। পথে খাওয়ার খুব ভালো ব্যবস্থা না থাকলেও, যেইনা পশ্চিমঘাট ফুঁড়ে বেরিয়ে এসে আমাদের ট্রেন পুনালুরে থামল, প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ছোট্ট একটা স্টেশন, তারপরেই সমুদ্রের গন্ধ পেলাম। তারপরেই কুইলন বলে একটা জায়গায় নেমে পড়লাম। সঙ্গে সামান্য জিনিসপত্র। কিছু কাপড়-চোপড়, একটা শতরঞ্চি আর হাঁসের সাজ!
আমি বললাম, হাঁসের সাজ আবার কী মাস্টারমশাই?
বড়ো মাস্টার অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। হাঁসের সাজ কী তাও জানিস না? এই বিদ্যে নিয়ে চাদে যেতে চাস? হাঁসের সাজ না পরলে সমুদ্রের তলায় সরেজমিন তদন্ত করব কী করে শুনি? কেঠো পায়ের উপর আড়াইমনি ডুবুরির পোশাক চাপালেই হয়েছে আর কী!
গুপি গলা খাঁকরে বলল, অবিশ্যি জলের নীচে আড়াই মন আর কিছু আড়াই মন থাকে না! বয়েন্সি অর্থাৎ প্লবতা জলের একটা গুণ!
বড়ো মাস্টার বিরক্ত হয়ে বললেন, থাক, আর বিদ্যে জাহির করতে হবে না। এও নিশ্চয় তলাপত্রর কাছে শেখা? বেশ, আড়াই মন নাহয় দেড় মনই হয়ে যাবে, তবুও আমার শরীরের আড়াই মন তার সঙ্গে জুড়তে হবে। কাঠের ঠ্যাং হয়তো ত্রিশ বছর সেই জাহাজের রান্নাঘরের টেবিল ঠেকিয়েছে। তারপর আমার কাছেই আছে ধর এই পঁয়ত্রিশ বছর। আর কত সইবে?
গুপি বলল, আচ্ছা, এবার বলুন হাঁসের সাজের কথা।
বড়ো মাস্টার বললেন, আর কিছুনয়, দু-পায়ে প্লাস্টিকের তৈরি বড়ো বড়ো হাঁসের পা লাগিয়ে, মুখে মুখোশ, চোখে বড়ো বড়ো গগলস্ এঁটে, পিঠে অক্সিজেনের থলি বেঁধে, মুখোশের ভিতরে নাকে তার নল গুঁজে, হাতে হাপুন নিয়ে তৈরি হয়ে নিতে কতক্ষণ লাগে! অতিরিক্ত বেশি পয়সাকড়ির বালাই নেই, সঙ্গে রিটার্ন টিকিট আর যৎসামান্য খাইখরচা। তা ছাড়া ছোট্ট বিছানা আর কাপড়-চোপড়। বাদাম গাছের মগডালে সেগুলো ঝুলিয়ে রেখে, কুইলনের সমুদ্রের ধারে গিয়ে জেলেদের একটা নৌকো ভাড়া করলাম। তীর থেকে সিকি মাইলটাক গিয়ে নৌকোতে বসে বসেই যেই না হাঁসের সাজ পরেছি, ভয়ের চোটে নৌকোর মাঝি মাঝদরিয়ায় নৌকো থেকে নেমে যায় আর কী! অনেক করে তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নৌকো থেকে টুপ করে জলে নেমে পড়লাম। নেমেই টের পেলাম ব্যাটা ঊর্ধ্বশ্বাসে ডাঙার দিকে পাড়ি দিল। যাক গে, এসব সামান্য জিনিসে আমি ভয় খাইনা। মিছিমিছি তো আর বর্মার শ্রেষ্ঠ সাঁতারুর সম্মান পাইনি। মানপত্র, সুবর্ণ পদক, টাকার থলি– যাক গে, নিজের বিষয়ে বেশি বলা আমি পছন্দ করি না।
আস্তে আস্তে ডুব দিলাম। একেবারে সমুদ্রের তলাকার বালির উপর নামলাম। বুঝতেই পারছিস সমুদ্র সেখানে বেশি গভীর নয়, বিশেষ করে এই গরমের সময়ে। গভীর না হলেও অদ্ভুত। কানে কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম না, কিন্তু সবুজ আলোতে সব দেখতে পাচ্ছিলাম। অদ্ভুত আকারের মাছ, সমুদ্রের কচ্ছপ আর কতরকম পলা আর আগাছা।
তলাপাত্র তোদের যে এতরকম জ্ঞান দেয়, আশা করি একথা বলতে ভোলেনি যে পৃথিবীর তিন ভাগ যখন জল আর মাত্র এক ভাগ মাটি, তখন মাটিতে যত-না ফসল হয়, জলে হতে পারে তার তিন গুণ। দেখলাম সেসব ফসলের কিছু কিছু একেবারে গিজগিজ করছে, শুড় নাড়ছে, দাঁত দেখাচ্ছে, চোখ পাকাচ্ছে। ডাঙায় তুলে বেঁধে খেলেই হল। হাজার বছরের খাদ্য মজুত আছে সমুদ্রের নীচে!চাদে জমি কেনার কথা বলিস তোরা, সমুদ্রের তলাকার জমি কিনতে পারলে আর কথা নেই।
এক জায়গায় দেখলাম একেবারে জ্যান্ত ঝিনুক ছেয়ে আছে। প্রত্যেকটির মধ্যে একটি করে বড় মুক্তো না থাকে তো কী বলেছি!
গুপি বলল, তুললেন না কেন দু-চারটে?
বড়ো মাস্টার ভুরু কুঁচকে বললেন, সামান্য মুক্তো তুলে সময় নষ্ট করব নাকি? আমার সামনে ছিল তার চেয়ে অনেক বড়ো উদ্দেশ্য। যার জন্যে এই অভিযান। তা ছাড়া দুটো চারটে যে তুলিনি তাই-বা কী করে জানিস! দেখিস গিয়ে তোদের বউঠানের কানে। চোখ টেরা হয়ে যাবে।
বড়ো মাস্টার পানের ডিবে খুলে রামকানাইয়ের দিকে তাকালেন। রামকানাই রেডি ছিল। পকেট থেকে ভিজে ন্যাকড়ায়-জড়ানো গোটা ছয় বড়ো পান বের করে ডিবে ভরে দিল। আজকাল দেখছি পারলে রামকানাই বড়ো মাস্টারের গল্প শুনতে ছাড়ে না। পরে অবিশ্যি নানারকম মন্তব্য করে। ভারি ইয়ে হয়েছে ওর। যাই হোক, মুখে দুটো পান পুরে, দাঁতে চুনের টিপ মুছে, মাস্টারমশাই বলতে লাগলেন।
–একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উপরে না উঠলে অক্সিজেনের থলি খালি হবার ভয় থাকে। তাতে অবিশ্যি ডাঙায় ফেরার অসুবিধে হয় না। উপরে উঠে সাঁতরে ফিরলেই হল। কিন্তু তদন্ত করতে হলে, তাড়াতাড়ি কাজ করলে হয় কখনো?
আর একাজ সারতে হবে খুব গোপনে। কেউ টের পেলেই হয়ে গেল। হাঁসের সাজ পরে দলে দলে ঝাঁপিয়ে পড়বে! পাকা খবর না নিয়ে যাইনি। খুব গূঢ় খবর। ওইখানে একটা পুরোনো পোতুর্গিজ জলদস্যুদের সমুদ্রের জাহাজ বমাল সমেত ডুবে পড়ে আছে। তিন-শো বছরের বেশি হয়ে গেছে।
বর্মায় থাকতেই একজন নাবিক আমার বাবার কাছে একটা চিঠি আর এক সমুদ্রের তলার ভেঁড়া ম্যাপ এক টাকা দিয়ে বিক্রি করেছিল।
গুপি অবাক হয়ে গিয়ে বলল, মোটে এক টাকা দিয়ে?
বড়ো মাস্টার বললেন, কেন, এক টাকা কি কম নাকি? আমার ঠাকুরদার বাবা এক টাকা দিয়ে এক-শো মন ধান কিনতেন। এক টাকা রোজগার করতে পারিস? গল্প শুনবি, না কি?
গুপি বললে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তারপর?
–তারপর হঠাৎ পায়ে কী একটা ফুটল। তুলে দেখি একটি মোহর, খাড়া হয়ে বালিতে বিধে আছে। চেয়ে দেখি চারদিকে বালিতে ছড়ানো হাজার হাজার মোহর। সামনে একটা পুরোনো লোহার সিন্দুক ভেঙে পড়ে আছে। জং ধরে সবুজ হয়ে গেছে। তার গায়ে কত খুদে খুদে সামুদ্রিক প্রাণী বাসা বেঁধেছে।
চোখ তুলে দেখি আরেকটু দূরে মস্ত মরা তিমি মাছের মতো একটা পুরোনো জাহাজ উপুড় হয়ে পড়ে আছে। খোলটা উপর দিকে, তাতে অসংখ্য ছোটো-বড়ো ছাদা। তার ভিতর দিয়ে শত শত ছোটো, বড়ো, লাল, কালো, হলদে মাছ আসছে, যাচ্ছে। চেয়ে চেয়ে আর কূল পাই না। তবে বেশিক্ষণ চাইতে হল না। চারদিক থেকে নিঃশব্দে পনেরো-কুড়িটা ছায়া নেমে এল। দেখলাম পনেরো-কুড়িটা সাহেব। সকলের হাঁসের সাজ, সঙ্গে শুধু হান নয়, বন্দুকও। প্ল্যাস্টিকের থলিতে ভরা, যাতে ভিজে না যায়।
তারপর আর কী, দেখতে দেখতে আমাকে ধরে ফেলে তারা ভাঙা নৌকোর কানা তুলে তার ভিতরে পুরে দিল। বলিনি এই ঘটনার বিষয়বস্তু হল বুড়ো ধরা? এবং সত্যিই আমিই সেই হতভাগ্য বুড়ো। তারপর যত পারল সোনাদানা চেঁচেপুঁছে নিয়ে চলে গেল।
আমি প্রথমটা জাহাজের খোলের ভিতরকার গাঢ় অন্ধকার দেখে, হকচকিয়ে গেলাম। তারপর আস্তে আস্তে যখন চোখ সয়ে গেল, তখন চেয়ে দেখলাম কত কঙ্কাল চারদিকে ছড়িয়ে আছে। তা ছাড়া কত যে গয়নাগাটি ছড়ানো, সে আর কী বলব।
গুপি বলল, আনলেন না স্যার, তাহলে এখন কত সুবিধে হত! স্পেসশিপের অনেক খরচ।
বড়ো মাস্টার বললেন, তখন আমি বেরুবার পথ খুঁজতে ব্যস্ত, গয়না তোলার কথা মনেও হয়নি। তা ছাড়া কঙ্কালগুলো জলের মধ্যে কেমন নড়ছিল চড়ছিল। শেষপর্যন্ত হাৰ্পন দিয়ে একটা ছাদাকে আরেকটু বড়ো করে নিয়ে, বেরিয়ে পড়লাম। এদিকে অক্সিজেন প্রায় শেষ, কোনো মতে জলের উপরে উঠলাম। ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে এসেছে। সারাদিন পেটে কিছু পড়েনি। কোনোরকমে সাঁতরে ডাঙায় উঠলাম। তারপর বাদাম গাছের নীচে গিয়ে দেখি সর্বনাশ, বাঁদররা সব জিনিসপত্র তছনছ করে, চারদিকে ছড়িয়েছে। অন্য জিনিস প্রায় সবই পেলাম। শুধু সেই চিঠিটা আরম্যাপটা ছাড়া মাঝে মাঝে কাগজে যখনই দেখি ডুবো জাহাজের সন্ধান পাওয়া গেছে ভারতের উপকূলের কাছে, ভাবি এই আমার সেই জাহাজ।
গুপি বলল, তবে জাহাজটা তো আর সত্যি করে আপনার নয়। অন্যরাই-বা নেবে না কেন?
বড়ো মাস্টার বললেন, আমার নয় মানে? দস্তুরমতো এক টাকা দিয়ে ওর কাগজপত্র কেনা হয়নি বলতে চাস?
তারপর বললেন, বোধ হয় আমার ওই নৌকোর মাঝি সাহেবদের গুপ্তচর ছিল। আমাকে নামিয়েই শহরে গিয়ে খবর দিয়ে এসেছিল। এইরকম করেই সাহেবদের অত টাকা হয়েছিল।
নইলে এমনি সময় আমাদের গলিতে সে কী দুপদাপ কাঁও ম্যাও! জানলা দিয়ে দেখি স্রোতের মতো বেড়ালের পাল ছুটে বেরিয়ে আসছে। বড়ো মাস্টার লাফিয়ে উঠে খটখট করতে করতে দৌড় দিলেন। দেখলাম তাঁর মুখটা অস্বাভাবিক রকমের সাদা। সঙ্গে সঙ্গে গুপিও ছুটল।
০৮.
আমি তো হাঁ করে বসেই রইলাম। রামকানাই এসে খাবারদাবারগুলো তুলে নেবার তালে ছিল। বারণ করলাম। বললাম, থাক, ওদের পুষ্টিকর খাবার দরকার হতে পারে। অস্বাভাবিকরকম দৌড়োচ্ছে। রামকানাই ফোঁস শব্দ করে চলে গেল। আরও অনেকক্ষণ পরে গুপি ফিরে এসে কোনো কথা না বলে খেতে আরম্ভ করে দিল।
তারপর খানিকটা জল খেয়ে বলল, উঃফ, ভাবা যায় না।
আমি বললাম, নেপোকে দেখলে?
গুপি মাথা নাড়ল। কই, না তো। তবে ওই শত শত বেড়ালের মধ্যে চোখে নাও পড়তে পারে।
আমি চটে গেলাম। নেপোকে চোখে নাও পড়তে পারে মানে? সাধারণ বেড়ালের দেড়া সাইজ ওর, গোপগুলো পাঁচ ইঞ্চি লম্বা, বেঁড়ে ল্যাজ। চোখে পড়তে বাধ্য।
গুপি বলল, তবে ছিল না।
এমনসময় বড়ো মাস্টারও হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এলেন। ময়লা রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, সারাজীবন ধরে কোথায় না গেলাম, কী না দেখলাম। কিন্তু এর সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনা হয় না। দশ ফুট চওড়া বেড়ালের নদীর কথা কেউ কখনো শুনেছে? তার উপর বেড়ালের ঢেউ।
আমি তো অবাক! বেড়ালের ঢেউ আবার কী?
গুপি বলল, তাও বুঝলি না? পেছনের বেড়াল যদি বেশি জোরে দৌড়ায়, তাহলে সামনের বেড়ালের পিঠের উপর উঠে পড়বে। অমনি সেখানে ঢেউ উঠবে।
বড়ো মাস্টার চেয়ারে বসে কেবলই মাথা নাড়তে লাগলেন। আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম, বলুন-না গঙ্গার ধারে কী হল?
গুপি আর চুপ করে থাকতে না পেরে বলল, বেড়ালের নদীর মাথায় তিনটে লোক দৌড়োচ্ছিল। তাদের চুল খাড়া, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছিল। বেড়ালরা একবার ধরে ফেললেই তো হয়ে গেল।
বড়ো মাস্টার বললেন, দু-জনের মাথায় দুটো মাছের চুপড়ি, এক জনের মুখে দাড়ি। প্রাণের ভয়ে চুপড়ি ফেলে প্রথম দু-জন দে দৌড়। বেড়ালের স্রোত এতটুকু থামল না।
গুপি বলল, সামনের বেড়ালরা হয়তো থেমেছিল, কিন্তু তাদের মাথার উপর দিয়ে পেছনের বেড়ালরা সমান বেগে ছুটে চলাতে কিছু টের পাওয়া গেল না। ফেরার সময় দেখলাম চুপড়িগুলোর দুটো-একটা বাঁশের কুচি পড়ে আছে। আর কিছু নেই।
আমি উত্তেজনার চোটে চেয়ার থেকে ছয়-সাত ইঞ্চি উঠেই পড়েছিলাম। আর বেড়ালরা? নেপোকে তো খোঁজা দরকার।
মাস্টারমশাই বললেন, তাকে আর পেয়েছ! নদীর ধারে পৌঁছে লোক তিনটে আর কোনো উপায় না দেখে, ঝপাঝপ দুটো খালি যাত্রীর নৌকোয় লাফিয়ে পড়ল। সঙ্গেসঙ্গে রাশি রাশি বেড়াল। তাই দেখে ঘাবড়ে গিয়ে যেখানে যত মাঝি ছিল যে-যার নৌকো নিয়ে পাড়ি দিল। আর বেড়ালরাও ঝুপ ঝাঁপ করে সেসব নৌকোয় চেপে বসল। পাঁচ মিনিটে গঙ্গার ধার ভেঁ ভা। শুধু যারা হাওয়া খেতে গেছিল তারা হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল আর দূর থেকে কানে এল একটা ম্যাও-ম্যাও শব্দ। এ-রকম যে সত্যি হতে পারে কে ভেবেছিল। আমিও না। অথচ একদিন এই আমি ব্রেজিলের সত্যিকার কাকড়ামতী নদী থেকে, প্রাণ হাতে নিয়ে বেঁচে এসেছিলাম। সে এক
আমি চেঁচিয়ে বললাম, না, না, শুনব না। এত বেড়ালের মধ্যে নিশ্চয়ই নেপো ছিল। কেন তাকে ধরে আনলেন না?
খুব কান্না পাচ্ছিল। তার মধ্যে গুপি কর্কশ গলায় বলল, যদি থেকেও থাকে, তার বাড়ি ফেরার কোনো মতলব নেই।
মাস্টারমশাইয়ের কী যেন মনে পড়াতে উঠে বললেন, যাই, আমার কাজ আছে। দ্যাখ, পানু, আমাদের বড়ো সাহেব তোর জন্যে সায়ামিজ ক্যাটের বাচ্চা দেবে বলেছে। তোর বেড়াল হারানোর দুঃখের কথা শুনে তার বড়ো কষ্ট হয়েছে! আচ্ছা চলি।
বড়ো মাস্টার চলে গেলে গুপি আমার কাছে চেয়ার টেনে বসে বলল, ব্যাপারটা কিন্তু খুব ঘোরালো। যতদূর দেখলাম বেড়ালগুলো বেজায় মোটা। আর প্রত্যেকের গলায় ছোট্ট একটা করে সাদা টিকিট বাঁধা। সাধারণ বেড়াল নয় ওরা।
আমি নাক টানতে লাগলাম। কান্না পেলে আমার সর্দি লাগে। গুপি আবার বলল, বেড়াল তাড়া করা দাড়িওয়ালা লোকটা ছোটোমামা।
এমনি চমকে গেলাম, যে সত্যি সত্যি চেয়ায়-গাড়ি থেকে পড়ে গেলাম। রামকানাই ছুটে এল। দুজনে মিলে আমাকে টেনে তুলল। পায়ের গোড়ালিতে খুব ব্যথা লাগল। কানে এল ঠান্ডাঘর থেকে ঠক ঠক ঠক–।
গুপি বলল, শুনতে পাচ্ছিস না? স্পেসশিপ তৈরি হচ্ছে। তবু ব্যাপারটা বুঝতে পাচ্ছিস না? ওই বেড়ালরা কে তা টের পাচ্ছিস না?
আমি হাঁ করে চেয়ে রইলাম।
গুপি বলল, ওরাই হল প্রথম ভারতীয় চন্দ্রযাত্রী। ট্রেনিং নিচ্ছে। আমি তখুনি সব বুঝতে পেরেছি কিন্তু মাস্টারমশাইয়ের সামনে কিছু বলিনি। ভারতীয় মানুষ যাবার আগে ওরাইচঁদে যাবে। নেমে যদি আমাদের আগে চাঁদে যায়, তাতে তোর গর্ব হওয়া উচিত, নাক টানা উচিত নয়। ভেবে দ্যাখ, আমরা পৌঁছোলে তার কী আনন্দটাই হবে।
আমি বললাম, কিন্তু পালিয়ে গেছে যে। চাঁদে যাবে কী করে?
গুপি বলল, মোটই পালায়নি। যাদের নেয়নি, তারাই পালিয়েছে। হয়তো গলার টিকিটে লেখাই ছিল, অমনোনীত, পড়তে তো আর পারিনি।
আমি বললাম, তা হলে কী করা উচিত?
গুপি বলল, এখন মোটে সাতটা। আটটা অবধি বসি। ছোটোমামা ঠিক সাঁতরে ফিরে আসবে। দারুণ সাঁতার কাটে জানিসই তো। সেবার সেই যে সোনার মেডেল পেল। বেড়ালরা কিছু জলে নেমে ওর পেছন পেছন সাঁতার দেবে না।
সঙ্গেসঙ্গে চুপ্পড় ভিজে ছোটোমামার প্রবেশ। দাড়িগুলো ভিজে গালের সঙ্গে লেপটে রয়েছে।
আমাকে বললেন, পানু, প্যান্ট দে, গেঞ্জি দে, গামছা দে। আমার আলনাতেই সব ঝোলানো থাকে। পাশেই স্নানের ঘর। দশ মিনিটের মধ্যে গা মুছে, কাপড় বদলে ছোটোমামা চেয়ারে বসে
ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। নাকি গলায় দাড়ি জড়িয়ে গিয়ে সাঁতারের খুব কষ্ট হয়েছে। তা ছাড়া ইলিশ মাছে পায়ের আঙুলে ঠুকরে দিয়েছে। আইডিন দেওয়া দরকার। তাই দেওয়া হল।
রামকানাই একবার উঁকি মেরে বলল, ওই আরেক খদ্দের এলেন।
আমি বললাম, গরম চা জলখাবার কী আছে এনে দাও।
রামকানাই গরম চা আর ডিম দিয়ে পাঁউরুটি ভেজে এনে বলল, থাকে কখনো ঘরে কিছু? এয়ারা যা সব রাকস।
ছোটোমামার খাওয়া শেষ হওয়া অবধি আমরা চুপ করে ছিলাম।
তারপর হাত ধুয়েই বড়ো বড়ো চোখ করে বললেন, বুড়ো চিনেছে নাকি আমাকে? তা হলেই তো বাবার কাছে লাগাবে, অমনি সামন্তর পেয়াদারা এসে ধরে নিয়ে যাবে। তাহলে রহস্য উদঘাটন কে করবে?
এই সময় ছোটো মাস্টার টুক করে ঘরে ঢুকে একটা মোড়ায় বসে লজ্জিতভাবে বললেন, চুল কাটাচ্ছিলাম পাড়ার সেলুনে। সেখানে বেড়ালের কথা শুনে ছুটে এলাম। ভাবলাম তাহলে হয়তো নেপোকে পাওয়া গেছে। কিন্তু তোমাদের মুখ দেখেই ভুল ভেঙেছে, আর বলতে হবে না।
ঠক ঠক ঠক ধড়াস্।
ছোটোমাস্টার চমকে উঠলেন। দিনরাত ঠান্ডাঘরে কাজ হয়, তবুবাড়ি তৈরি শেষ হয় না কেন?
ছোটোমামা আঙুল দিয়ে দাড়ি শুকোতে শুকোতে বললেন, অন্য কাজ হয়। বাড়ি তৈরির কাজ নয়। ঠান্ডাঘর যদি হবে তো তার বিজলির ব্যবস্থা কই? সুযোগ পেলেই ছোঁকছোঁক করে বেড়াই। এটুকু বুঝেছি যে ওখানে ঠান্ডা করার কোনো ব্যবস্থাই হয় না।
আমরা বললাম, তবে কি স্পেসশিপের কথাই ঠিক? ঠান্ডাঘরটা ছদ্মবেশ?
ছোটো মাস্টার বললেন, তা স্পেসশিপ বানাবে, তারজন্যে অত গোপনীয়তার কী আছে? আমাদের দেশের লোকে মহাকাশযান তৈরি করছে, এ তো ঢাক পিটিয়ে বলে বেড়াবার কথা। লুকিয়ে করবে কেন?
ছোটোমামা বললেন, প্রকাশ্যে করলেই হয়েছে! অমনি প্ল্যান চুরি যাবে, পার্টস্ চুরি যাবে, সরকারি তলব আসবে, স্পেসশিপ বানাচ্ছ তার পারমিট কোথায়, ছবি-সহ দরখাস্ত করো। আমি জানি না? ফালতু জিনিস দিয়ে ঘরে বসে রেডিয়ো বানিয়েই আমার যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে! করতে হলে লুকিয়েই করতে হবে। আপনি যেন আবার এসব কথা ফাঁস করে দেবেন না।
ছোটো মাস্টার জিব কেটে বললেন, না, না, কী যে বলেন! কিন্তু হাজার হাজার বেড়াল এল। কোত্থেকে! স্পেসশিপ করতে কি বেড়াল লাগে? মানে লোম-টোমে ইলেকট্রিসিটি–
নেপোর জন্য বড় ভাবনা হল।
গুপি বলল, তাও বুঝলেন না? একেবারে ঝপ করে তো আর চাঁদে মানুষ পাঠানো যায় না। প্রথমে এদের পাঠানো হবে।
কিন্তু এতগুলো কেন? দুটো-একটা পাঠালেই তো হয়। তাই তো সব দেশ থেকেই পাঠায়। গুপি বলল, মানুষের ওজন সইবে কিনা সেটাও তো দেখা দরকার। একটা আড়াইমনি মানুষের সমান ওজন নিতে হলে, ক-টি দেড়-সেরি বেড়াল লাগবে বলুন তো? একেবারে এক-শো দেড়-শো মানুষ নিরাপদে যাওয়া-আসা করতে পারবে কি না, তাও তো দেখা দরকার।
ছোটো মাস্টার তখন জানতে চাইলেন, কোথায় রাখা হয়েছিল এত বেড়াল? আমরা ছোটোমামার দিকে চাইলাম।
গুপি বলল, ছোটো করে বল, ছোটোমামা!
ছোটোমামা বললেন, আজ অনেকদিন যাবৎ এই গুরু তদন্তের দায়িত্ব একলা
গুপি বলল, ছোটোমামা, ফের!
ছোটোমামা বললেন, ওই নকল ঠান্ডাঘরের ওদিকের দেয়ালে, ঠিক গঙ্গার উপরেই দেখলাম একটা বড়ো চোঙার মুখ। কাঠ দিয়ে এঁটে বন্ধ করা। সামান্য কাঠে আমি ভড়কাই না। দুটো মাছওয়ালা রোজ গলি দিয়ে যায়, তাদের কিছু পয়সা দিয়ে রাজি করিয়ে, হাতুড়ি দিয়ে কাঠটি ভাঙালাম। কাঠ ভেঙে যেই না ওরা মাছের চুবড়ি মাথায় তুলেছে, অমনি চোঙার মধ্যে থেকে সে কী খচমচা খামচি!
০৯.
ছোটোমামা বলতে লাগলেন, সে যে কীসের খ্যাঁচম্যাচ সেটা বুঝতে আর বেশি দেরি লাগল না। ঝরনার মতো ঝুপ ঝাঁপ ধুপ ধাপ করে কেবলই বেড়াল পড়তে লাগল। মাছওয়ালারা একবার তাকিয়েই চুবড়ি তুলে দে দৌড়। আর যাবে কোথায়! সঙ্গে সঙ্গে বেড়ালের নদীও ছুটল! আমিও কি আর সেখানে থাকি! পাইপই লাগালাম। মাছের গন্ধেই বেড়াল বেরিয়েছে। আমি ছোটোবেলা থেকে কড লিভার অয়েল খেয়ে মানুষ, আমাতে আর মাছেতে কতটুকু তফাত তোরাই বল্। ছুটতে ছুটতে ছুটতে ছুটতে কোনোমতে একটা নৌকাতে যদি-বা উঠলাম, সঙ্গেসঙ্গে এই কেঁদে কেঁদো গোটা পঁচিশ বেড়াল। জলে নেমে সাঁতরে কোনোরকমে প্রাণটা হাতে করে ফিরেছি। পানু, আরও পান দে। আর সেই খোঁচা গোঁপ ভদ্রলোক কোথায় উঠে গেলেন? কে উনি?
তাকিয়ে দেখি, তাই তো ছোটো মাস্টার কখন হাওয়া হয়ে গেছেন। গুপি বলল, ওর নাম তলাপাত্র, এম.এ পাস, বড়ো মাস্টারের শাকরেদ।
ছোটোমামা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বললেন, কী সর্বনাশ! তবে তো নির্ঘাত ওঁর স্পাই! আর আমি কিনা ওঁর সামনে সব কথা ফাঁস করে দিয়েছি! ই–ই– স্!
গুপি বলল, না, না, ছোটোমামা তোমার সবতাতেই ইয়ে। উনি তোমার বিষয়ে কিছু জানেন না। তা ছাড়া জানলেও কেউ তোমাকে এখন চিনতে পারবে না।
ছোটোমামা খুশি হয়ে দাড়ি চুমরোতে চুমরোতে বললেন, চিনতে পারবেনা, না? বাব্বা, ক্যায়সা ছদ্মবেশটা ধরেছি তাই বল! ছোটো মাস্টার ছেড়ে দে, সে তো আমাকে আগে কখনো দেখেইনি, আমার নিজের বাবাই চিনতে পারবে না দেখিস। ভাবছি লোহালক্কড়গুলো কিছু কিছু নিয়ে এসে কাছে রাখি। পানু, তোর খাটের তলায় কিছু রাখলে তোর আপত্তি আছে?
আমি তো মহা মুশকিলে পড়লাম। সেই যে নিতাই সামন্ত চোরের কথা বলে গেছিল, সেই ইস্তক রোজ রাতে মা একটা বেঁটে লাঠি দিয়ে আমার খাটের তলা খুঁচিয়ে দেখেন। অথচ ছোটোমামা যদি ভাবেন আমি ওঁকে সাহায্য করতে চাইনা, তা হলে চাই কী হয়তো চাঁদের দল থেকে আমার নামটাই ছাঁটাই করে দেবেন। তাই বললাম, ইয়ে কী বলব, মানে, ইয়ে–
গুপি বলল, না, না এখানে নিতাই সামন্তর বড়ো বেশি আনাগোনা। কে ওদের এক টিকটিকি এসেছে দিল্লি থেকে, সে শুঁকে শুঁকে ফেরারি আসামি বের করে দেয়।
ছোটোমামা চটে গেলেন, আমি ফেরারি হতে পারি, কিন্তু মোটেই আসামি নই। একটু তাড়াতাড়ি চাইছিলাম কারণ অ্যামেরিকানরা এর মধ্যে তিনটে লোক পাঠিয়ে চাদে বেড় দিয়ে এসেছে, এবার নাকি লোক নামাবে। এর পরে আর ওখানে জমিটমি পাওয়াই যাবে না।
গুপি বলল, আমাদের হেডস্যার বলেছেন যে রাশিয়ানরা হয়তো এর আগেই ওখানে ঘাঁটি গেড়ে ফেলেছে।
আমি লাফিয়ে উঠে বললাম, হ্যাঁ, আমি তোর দূরবিন দিয়ে স্পষ্ট দেখেছি, জিনিস বোঝাই নৌকো চাঁদে যাচ্ছে।
গুপি বলল, না রে না, দূরবিনের কাচে কে একটা ছোট্ট খেলনা আটকে দিয়েছে, তাতে খুদে একটা নৌকো জলের মতো জিনিসে ভাসে, মনে হয় বুঝি সত্যি! কিন্তু অ্যামেরিকানরা চাদে নেমে যদি দেখে রাশিয়ানরা আগেই সেখানে ঘরবাড়ি করে ফেলেছে, তাহলে বেশ মজা হয়।
এমনি সময় ছোটো মাস্টার আবার ফিরে এসে মোড়ায় বসেই বললেন, চোঙা লোহার ঢাকনি দিয়ে কে বন্ধ করে দিয়েছে। ওই দিক দিয়ে ঢোকা যাবে না।
ছোটোমামা চমকে উঠে বললেন, কেন ঢোকা যাবে না? কিন্তু ঢুকবে কে?
ছোটো মাস্টার ছোটোমামার দিকে তাকিয়ে বললেন, কেন, রোগাপানা সাহসী কেউ ঢুকবে।
ছোটোমামা বললেন, খুব বেশি রোগা হওয়া চাই নাকি?
ছোটো মাস্টার কাষ্ঠহাসি হেসে বললেন, আমার চেয়ে রোগা কেউ। দাড়ি থাকলে ক্ষতি নেই। বরং চোঙার ভেতরে নরম লাইনিং-এর কাজ করবে।
ছোটোমামা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, বাবা দাড়ি রাখা পছন্দ করেন না, ওটা চেঁচে ফেলব ভাবছি।
ছোটো মাস্টার বললেন, বাবা তো শুনেছি পড়াশুনো ফেলে, লোহালক্কড়ের সন্ধানে ঘোরাও পছন্দ করেন না। তবে সাহস না থাকলে কেই-বা চোঙার মধ্যে ঢুকবে বলুন? কোথায় কী আছে কে জানে।
ছোটোমামা উঠে পড়েছিলেন, আবার বসে পড়ে বললেন, কী আবার থাকবে? স্পেসশিপের গুপ্ত কারখানা আছে। বাইরের লোক ঢুকলে মাথায় হয়তো স্প্যানার মারবে।
ছোটো মাস্টার বললেন, কিন্তু বেড়ালরাও ছিল মনে রাখবেন। একাজে বেড়ালের চেয়ে মানুষ পেলে অনেক ভালো হয় না কি?
ভালো করে ওদের কথার মানে বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু দেখলাম ছোটোমামার চোখ দুটো হঠাৎ দপ করে জ্বলে উঠল। কীরকম চাপা গলায় বললেন, মানুষ। চাদে নামার প্রথম মানুষ! ই-স্! একটুক্ষণ চুপ করে থেকে মাথা বাঁকিয়ে বললেন, কিন্তু লোহার ঢাকনি আঁটা বললেন যে?
ছোটো মাস্টার বললেন, আহা, বাইরে থেকে রিভেট করা। ওস্তাদ লোকের পক্ষে সে আর এমন কী। তা ছাড়া আমার মনে হয়–
ছোটোমামা বললেন, কী মনে হয়?
–আজ রাতে রিভেট ভোলা থাকতেও পারে। যা ঘুরঘুট্টি অন্ধকার।
ছোটোমামা বললেন, চলি। এবেলা ডিউটি আছে।
কেমন যেন ওঁকে দেখতে অনেক লম্বা অনেক ষণ্ডা অনেক লোমশ মনে হচ্ছিল। আমার শার্ট প্যান্ট পরেই চলে গেলেন। উৎসাহের চোটে আমার পায়ে বেজায় ঝিঁঝিধরে গেল। অথচ দশ দিন আগেও পায়ে কিছু টেরই পেতাম না। শেষটা হয়তো চাদে গিয়ে কোনো অসুবিধাই হবে না। এই সময় ছোটোমামা ফিরে এসে বললেন, একটা কথা বলতে ভুলে গেছিলাম। গুপি, শোবার সময় জানলা একটু খুলে রাখিস। তেমন তেমন হলে, পায়রা গিয়ে খবর দেবে। বলেই সুড়ৎ করে চলে গেলেন। আমরা অবাক হয়ে গুপির দিকে চাইলাম।
গুপি বলল, আমরা কয়েকটা পায়রা পুষে আমাদের বাড়ি আর দাদুদের বাড়ির মধ্যে খবর দেওয়া-নেওয়া করি। ছোট্ট ছোট্ট পাহাড়ি পায়রা, দিব্যি পকেটে পুরে রাখা যায়। একটা পায়রা ছোটোমামাকে এনে দিয়েছি। সেটার কথাই বলছেন।
ছোটো মাস্টার এমন কথা কখনো শোনেননি। বললেন, উনি থাকেন কোথায়?
গুপি আমার দিকে চেয়ে একটু মাথা নাড়ল। ছোটো মাস্টার লজ্জা পেয়ে বললেন, জানি অবিশ্যি আপাতত ছাপাখানায় চাকরি নিয়ে সেখানেই বসবাস করেন। ভালো খানদান, কিন্তু সবসময় এত ঘোরাঘুরি করেন যে গায়ে মাংস লাগে না। শুনেছি এক তলা থেকে পাঁচ তলা অবধি দিনের মধ্যে পঁচিশ বার ওঠা-নামা করেন। বড়ো স্যার বারি চটা ওঁর উপর। তবে উনিই যে গুপির ফেরারি ছোটোমামা এটা জানা ছিল না। সাহসী বটে।
ছোটো মাস্টার উঠে দাঁড়াতেই, গুপি ব্যস্ত হয়ে বলল, বড়ো মাস্টারকে ছোটোমামার কথাটা বলবেন না কিন্তু স্যার, তাহলে সব ভেস্তে যাবে। শেষটা হয়তো আমাদেরও চাদে যাওয়া হবে না!
ছোটো মাস্টার বললেন, না, না, কোন কথাটা আমি তাকে বলেছি? তবেচাদুকে তাড়াতাড়ি চাদে যেতে বল। কারণ সত্যিই এ-বছরেই অ্যামেরিকানরা গিয়ে হয়তো সেখানে ব্যাবসা কঁদবে। তারপর পারমিট পাওয়াই এক মহা সমস্যা হবে।
ছোটো মাস্টার সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলে, গুপি বলল, নারে পানু, কাজটা খুব ভালো হল না। ছোটোমামা চোঙায় ঢুকতে গিয়ে না আবার কোনো ফ্যাসাদে পড়ে। সাহসী হলে কী হবে। মাকড়সা, টিকটিকি, এমনকী ব্যাং দেখলেও ওর হাঁটু বেঁকে যায়। শেষটা চোঙায় ঢুকে না আটকে থাকে। তা ছাড়া ছোটো মাস্টার কী করে ছোটোমামার ডাকনাম জানল? নিশ্চয় তোদের কাছে শুনেছে। তোরা বড় কথা বলিস। এসব ব্যাপারে ছোটো মাস্টারের এত কীসের মাথাব্যথা তা বুঝলাম না।
গুপি চলে গেলে, অনেকক্ষণ বসে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবলাম। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখতে পেলাম বড়ো মাস্টার হাত নেড়ে বউকে কী বোঝাচ্ছেন আর বউ ঘন ঘন মাথা নেড়ে আপত্তি জানাচ্ছে। কিছুদিন আগে বড়ো মাস্টারের বউ পোড়ার লোমহর্ষক কাহিনি শুনেছিলাম। বড়ো মাস্টার-ই বলেছিলেন। ঠিক যেন পরিদের গল্প। বর্মার ঘন জঙ্গলে বড়ো মাস্টারের বাবা সেগুন গাছের ইজারা নিয়েছিলেন। সেখানে যত সেগুন গাছ ছিল সব তার কেটে আনার অধিকার ছিল। কিন্তু বনে গিয়ে সে গাছের শোভা দেখে আর কাটতে ইচ্ছা করত না। ভাবলেন তার চাইতে বড়ো বড়ো ডাল কেটেও তো কাজ চালানো যায়।
সারাদিন বনে বনে ঘুরেছেন। সঙ্গের লোকেরা অনেক ছড়িয়ে পড়েছে। চারদিক ছায়া-ছায়া থমথম করছে। লোকের মুখে শোনা নানারকম ভয়ের গল্প মনে পড়ছে। তার উপর ওই বনে বিখ্যাত ডাকাতের সর্দার রামুর কথাও মাঝে মাঝে কানে আসত। মাস্টারমশাইয়ের বাবা ভাবছিলেন অশরীরীদের চেয়ে বরং ডাকাতের সর্দারই ভালো। এমন সময় করুণ কান্নার শব্দ কানে এল।
মাস্টারমশাইয়ের বাবা চমকে উঠলেন। তীক্ষ্ণ বিষয়বুদ্ধি থাকলেও, মনটা তাঁর বড়ো নরম ছিল। কান্না শুনে আর থাকতে না পেরে খোঁজাখুঁজি লাগিয়ে দিলেন। হঠাৎ মনে হল তারই একটা সেগুন গাছের তলা আলো করে কে যেন বসে হাপুসনয়নে কাঁদছে। কাছে গিয়ে দেখেন সাত-আট বছরের একটি ছোট্ট সুন্দর মেয়ে, দুধে-আলতা গায়ের রং, আঙুরের থোপারমতো কোঁকড়া চুল। কার মেয়ে কোথায় বাড়ি কিছু বলতে পারে না।
জিজ্ঞাসা করলেই মা-মা বলে কাঁদে।
বাবা তাকে অভয় দিয়ে, সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে এলেন। মাস্টারমশাইয়ের মা ছিলেন না, কিন্তু বুড়ি পিসি ছিলেন। তিনিই অনেক যত্নে ওই মেয়েটিকে মানুষ করে মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে বিয়ে দিলেন। সবাই তখন মানা করেছিল, বলেছিল বন থেকে কুড়িয়ে-আনা মেয়ে, কে জানে দৈত্যদানোর ঘরের কি না। কিন্তু পিসিমা কারো কথা শোনেননি।
তারপর বউয়ের একটু বয়স হলে রাতে বাড়িতে নানান উপদ্রব হতে লাগল। বাইরে থেকে কারা গোরু-ছাগল চুরি করে। কারা যেন ছোরা ছুঁড়ে মারে। শেষটা বউ একদিন আর থাকতে না পেরে সব ফাঁস করে দিলে। সে আসলে রামু ডাকাতের নাতনি। রামুই ওকে বনের মধ্যে ওইভাবে ফেলে রেখেছিল। যাতে বড়ো হয়ে মাস্টারমশাইয়ের বাবার বাড়ি থেকে ধনরত্ন নিয়মিত পাচার করতে পারে। এইরকম অনেক ছেলে-মেয়েকে রামু এবাড়ি-ওবাড়ি পাচার করে, ফলাও করে ডাকাতি ব্যাবসা চালাত। এতে করে মাসে গড়ে হাজার দুই উপায় হত।
কিন্তু মুশকিল হল যে পিসির উপর মাস্টারমশাইয়ের বউয়ের বড়ো টান। কিছু পাচার করা দূরে থাকুক, এতটুকু শব্দ শুনলেই হাউমাউ করে ওঠে। শেষে ওর জন্যেই দলের দু-চারজন ধরাও পড়ল। তখন রামুর দল ওদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে সে অঞ্চল থেকে সরে পড়ল। ওই আগুনে জিনিসপত্রের অনেক ক্ষতি হয়েছিল বটে, কিন্তু প্রাণে কেউ মরেনি। দুঃখের বিষয় বউয়ের মুখের এক দিকটা ঝলসে গেছিল। সেই অবধি বউ আর কারো সামনে বেরোয় না। কিন্তু পিসিদের বাঁচাতে গিয়েই বউয়ের এই দশা, তাই হাজার খিটখিটে হলেও মাস্টারমশাই ওর যত্ন করেন। পিসি তো ওর কোলেই মাথা রেখে নব্বই বছর বয়সে স্বর্গে গেছেন।
গল্প শুনে গুপির আর আমার খুব দুঃখ হয়েছিল। বউয়ের জন্যে গুপি কিছু ফুল এনে দিয়েছিল। মাস্টারমশাই খুব খুশি হয়েছিলেন মনে হল।
তবু রোজ রোজ এত কীসের তর্কাতর্কি ভেবে পেলাম না। আগে এমন ছিল না। জানলা দিয়ে শুধু বউয়ের ঘোমটাপরা মাথাটুকু দেখা যেত। আজকাল মনে হয় বেশ ঘুসি পাকিয়ে মাস্টারমশাইকে ভয় দেখাচ্ছে।
তার পরদিন বিকেলে ছোটো মাস্টার আমাকে হাতের কাজ শেখাতে এসে বললেন, চাঁদে যাবার রকেটের এই মডেলটা বানিয়েছি দেখো।
আমি তো অবাক। সব আছে দেখলাম। লঞ্চিং প্যাড পর্যন্ত। নাকি সত্যি ওড়ানো যায়। তবে খোলা জায়গা দরকার।
আমি বড়ো মাস্টারের ঘরের সামনে খোলা ছাদের দিকে তাকিয়ে বললাম, ওইখানে যেতে পারলে বেশ হত।
ছোটো মাস্টার একটু যেন থতমতো খেয়ে গেলেন। হঠাৎ বললেন, ছোটোমামার কাছ থেকে কি কোনো খবর আসেনি?
আমি বললাম, না তো।
–মানে তিনি আছেন তো?
আমি আঁতকে উঠলাম। আছেন তো আবার কী? কতসময় তাকে দিনের-পর-দিন দেখা যায় না। ইচ্ছা করেই উনি গা ঢাকা দিয়ে থাকেন, যাতে পুলিশের নজরে না পড়েন।
ছোটো মাস্টার হাত থেকে মডেলটা নামিয়ে রেখে বললেন, কিন্তু চোঙার মুখের ঢাকনিটা কাল রাত থেকেই খোলা।
আমি চমকে উঠলাম। সে কী! তাহলে কি ছোটোমামা। নাঃ, উনি তো রাতে বেরুতে ভয় পান।
ছোটো মাস্টার হাসলেন, উচ্চাকাঙ্ক্ষার কাছে ভয়-ডর টেকে না, তাও জান না। ভদ্রলোক কোনোরকম বিপদে-টিপদে পড়েননি তো? এক রকম আমার কথাতেই চোঙায় সেঁদোলেন। আচ্ছা আজ ঠকঠক শব্দটব্দ কিছু শুনেছ কি?
তাই তো! আজ তো ঠান্ডা ঘর একেবারে চুপ। তাকিয়ে দেখলাম বড়ো মাস্টারের নাইট স্কুলের শেডে একটা নোটিস লটকানো রয়েছে!
ছোটো মাস্টার বললেন, আজ স্কুল বন্ধ। বড়ো স্যারের বাড়িতে নাকি কী গোলমাল হয়েছে। বউটিকে কিন্তু বড়ো বদমেজাজী মনে হয়। যদিও খাসা রাঁধে। ঙাপ্পি খেয়েছ কখনো?
আমি বললাম, ওয়াক্ থুঃ!
ছোটোমাস্টার চটে গেলেন। ও আবার কী হল? যে-জিনিস সম্বন্ধে কিছু জান না, তাকে ওয়াক থুঃ করার কোনো মানে হয় না। খুব ভালো জিনিস। এক থালা ভাতে এক চিমটি মাখলেই অমৃতের মতো লাগে। বড়ো স্যারের নিজের মুখে শোনা। ছাদের ঘরে ওঁর বউ ঙাপ্পি বানায়। ফুলের টবের মাটিতে পুঁতে রাখে। একদিন একটু চেয়ে নেব।
তারপর ছোটো মাস্টার যাবার জন্যে তৈরি হয়ে বললেন, নাঃ, মনটা বড়ো খুঁতখুঁত করছে। গুপির দূরবিনটা দাও তো একটু দেখি।
অনেকক্ষণ দেখলেন। সব ভোঁ-ভাঁ। ছাদে সেই ছোটো ছোটো সাদা কালো জানোয়াররাও চরছে, তা সে পেঙ্গুইন-ই হোক, কি বেড়ালই হোক। শেষটা দূরবিন নামিয়ে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ছোটো মাস্টার চলে গেলেন।
যেই-না সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়েছেন, দরজা তখনও ভালো করে বন্ধ হয়নি, খাবারঘরের মধ্যে দিয়ে গুপি এসে হুড়মুড় করে ঢুকে বলল, পানু, সর্বনাশ হয়েছে!
১০.
গুপি পকেট থেকে কিলবিলে গোলাপি রঙের কী একটা বিশ্রী জানোয়ার আমার কোলের উপর ফেলে দিয়ে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেবলি হাঁপাতে লাগল। আমার তো চক্ষুস্থির। মনে হল নতুন ধরনের ব্যাং। আমি আবার ব্যাং দেখতে পারি না। তাই বলে যে ভয় পাই তা যেন কেউ মনে না করে। খুদে একটা গোলাপি ব্যাং; তাও যদি মস্ত পায়রাখেকো ব্যাং হত। ফেলেই দিচ্ছিলাম কোল থেকে, এমন সময় ছোটো মাস্টার আবার ঘরে ঢুকেই চেঁচিয়ে উঠলেন, ওর পায়ে বাঁধা ওটা কী?
বলে আমার কোল থেকে ব্যাংটাকে তুলে নিয়ে ভালো করে দেখতে লাগলেন। বাঁ-পায়ে ছোট্ট একটা অ্যালুমিনিয়ামের খাপের মতো। ব্যাংটা থরথর করে কাপছিল। মাঝে মাঝে কালো ঠোঁট দুটো খুলছিল আর বন্ধ করছিল। ভারি অদ্ভুত লাগল। ব্যাঙের আবার ঠোঁট হয় জানতাম না।
গুপি গোল গোল চোখ করে এক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে, বলল, ওটা ব্যাং নয়, ও আমাদের বার্তাবাহী পায়রা, বিদ্যুৎ। বলে কী! পায়রা কখনো ব্যাঙের মতো হয়? গুপি বলল, হয় হয়। সব জানোয়ারের নোম ছাড়ালেই ব্যাঙের মতো। মানুষও। আমার ছোটো বোনটা একেবারে ব্যাঙের মতো, শুধু একটু বড়ো, এই যা।
ছোটো মাস্টার ততক্ষণে পায়ের খাপটা খুলে ছোটো একটা চিঠি বের করে ফেলেছেন। চিঠি খুলে চমকে উঠে সেটা গুপিকে দিলেন। গুপিও চিঠি পড়ে দারুণ ব্যস্ত হয়ে উঠে, আমাকে দিল। দেখি ফিকে পেনসিল দিয়ে লেখা, গুপে চলে আয়। লোমহর্ষক ব্যাপার। নামটাই নেই।
ছোটো মাস্টার বললেন, চাঁদুর লেখাই তো?
গুপি বলল, সে আর বলতে হবে না। অমন খারাপ হাতের লেখা আর কার হবে?
ছোটো মাস্টার বললেন, কিন্তু কোথায় চলে যেতে হবে? একেবারে শত্রুর খপ্পরে পড়ে যাবি না তো? ওরা যদি চিঠির কথা না-ই জানবে তো পায়রার পালক ছাড়াল কে?
গুপি বলল, তাই তো, যে পালক ছাড়িয়েছে, সেখাপটাকেও দেখেছে। আর খাপ দেখেছে যখন তখন কি আর চিঠি খুলে পড়েনি। পড়ে আবার খুঁজে রেখেছে। যাতে সবাইকে একসঙ্গে ধরতে পারে। কে জানে ছোটোমামা এতক্ষণ বেঁচে! গুপি থেমে গিয়ে মুখ ঢাকল। হঠাৎ আমি হেসে উঠলাম। ওরা তো অবাক।
ছোটো মাস্টার ভারি বিরক্ত হয়ে বললেন, একটা মানুষের মরণ-বাঁচন সমস্যা আর তোমার কি না হাসি পাচ্ছে!
খুব লজ্জা পেয়ে বললাম, না, না, সেজন্যে নয়, তা ছাড়া ছোটোমামা যে সহজে মরবেনা সেটা ঠিক। আমি হাসছিলাম কারণ নেপো যে বেঁচে আছে সেটা এবার প্রমাণ হল। পাখি ধরতে পারলেই ও তাদের পালক ছাড়ায়। পায়রা যেখান থেকে এসেছে, সেখানে নেপোও আছে।
গুপি বলল, তার মানে সেখানে ছোটোমামাও আছে। চলুন, ছোটো স্যার, তাকে উদ্ধার করতে হবে। বিপদ-আপদ দেখলে ছোটোমামার দাঁতকপাটি লেগে যায়।
ছোটো মাস্টার কাষ্ঠহেসে বললেন, তাহলে চাঁদে যাবার খুবই উপযুক্ত পাত্র দেখছি। তুমি বরং এগোও, আমি একটু কাজ সেরে আসছি।
গুপি বলল, কার কত সাহস বোঝাই যাচ্ছে।
ওই ওর দোষ, অল্পতেই রেগে যায়।
ছোটো মাস্টার কিছু মনে করলেন না। তা ছাড়া বড়ো মাস্টারের কাছে তো দিন-রাতই এই ধরনের কথা শোনেন। নরম গলায় বললেন, মন্দ বলনি। দু-জনে গেলে বেশি কাজ দেবে। তাহলে তোমরা এখানে একটু অপেক্ষা করো, আমি কাজ দুটো সেরে আসি। ততক্ষণে এই বইটা থেকে চাঁদের বিষয়ে আরও কিছু তথ্য শেখো, কেমন?
এই বলে ছোটো একটা বই আমার হাতে দিয়ে ছোটো মাস্টার একরকম ছুটে বেরিয়ে গেলেন।
ভারি ভালো বইটা। নাম চাঁদের রহস্য। খুলে দেখলাম লেখা রয়েছে সম্ভবত সাড়ে চার-শো কোটি বছর আগে গ্যাস আর ধুলো একসঙ্গে জমে চাঁদের সৃষ্টি হয়েছিল, এইরকম মত কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ পোষণ করে থাকেন। অর্থাৎ চাঁদ পৃথিবীর চেয়েও পুরোনো। কেউ কেউ আবার বলেন পৃথিবীর টুকরো ছিঁড়ে উড়ে গিয়ে উঁদ তৈরি হয়েছে।
চাঁদ নিজের অক্ষ দণ্ডে ২৭ ১/৩ দিনে এক বার পাক খায়। পৃথিবীর চারদিকে ২৯ ঘণ্টা ৪৪ মিনিটে এক বার ঘুরে আসে। চাঁদের ব্যাসের মাপ ৩৪৫৬ কিলোমিটার। মাঝে মাঝে চাঁদে রঙের পরিবর্তন দেখা যায়, তার কারণ সম্ভবত নিবে-যাওয়া আগ্নেয়গিরির গহ্বর থেকে গ্যাস বেরোয়।
এই অবধি পড়ে গুপি বইটাকে ছুঁড়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে, ঘরময় পাইচারি করতে লাগল। দেখলাম মুখটা খুব লাল। বোধ হয় কান্না চাপছিল। ঠিক সেই সময় হন্তদন্ত হয়ে ছোটো মাস্টার ফিরে এসে বললেন, গুপি, চল।
তারপর একটা ছোট্ট কার্ডে একটি গোপন টেলিফোন নম্বর লিখে আমার হাতে দিয়ে বললেন, যদি দেখো রাত দশটার মধ্যেও আমরা কেউ ফিরে এলাম, তাহলে এই নম্বরে ফোন করে শুধু বলবে–ফু-মন্তর, ব্যস্ আর কিছুনয়। কার্ডটি তখুনি ছিঁড়ে ফেলো আর কখনো কাউকে বোলো না। বলিওনি কাউকে, তা ছাড়া এখন ভুলেও গেছি। অবিশ্যি ফোন করার দরকার-ও হয়নি। কার্ডটাকে ছিঁড়েও ফেলেছি।
ওরা চলে গেলে পর আমার নানান কথা মনে হতে লাগল। পা দুটোর উপর এমনি রাগ হতে লাগল যে আর কী বলব। তার উপর রামকানাই এসে ইনিয়েবিনিয়ে ওর পিসেমশাইয়ের কত বার কী অসুখ হয়েছিল তাই বলতে লাগল। ওকে বললাম, জান, নেপো বেঁচে আছে।
রামকানাই তো অবাক। ওকী কথা পানুদা, যারা অনেকদিন সঙ্গ ভোগ করছে, তাদের বিষয় অমন কথা বলতে হয় না। অবিশ্যি সঙ্গ কি না সে বিষয়েও ঠিক বলা যায় না।
আমি বললাম না, রামকানাইদা, না। নেপো ছাড়া কে বিদ্যুতের পালক ছাড়িয়েছে বলো। বুক পকেট থেকে বিদ্যুৎকে বের করে দেখালাম। রামকানাই তো হাঁ।
হঠাৎ বড়ো মাস্টারের জানলার দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম। ঘরে আলো জ্বলছে না। এই বাড়িতে আমরা চার বছর আছি, কখনো ও-ঘর অন্ধকার দেখিনি। যেই-না সূর্য ডোবে ও-ঘরেও বাতি জ্বলে। একবার অনেকক্ষণ পাড়ার আলো নিবে গেছিল। নেবার সঙ্গেসঙ্গে ও-ঘরে মোমবাতির আলো দেখতে পেয়েছিলাম। বউ বোধ করি অন্ধকারকে ভয় পায়। অথচ একদিন ওই বউই বনে বাস করত।
জানলার কাছে গিয়ে দেখলাম ছাপাখানার আর ঠান্ডাঘরের কোনো আলোই জ্বলছে না। নীচে বড়ো মাস্টারের নাইট স্কুলের শেডের সামনের বড়ো আলোও নেবানো। কোথাও একটা লোক দেখা যাচ্ছে না। তবু আমার ঘরে বসেই টের পাচ্ছিলাম যে ওই দুটো বাড়িতে সাংঘাতিক কিছুএকটা পাকিয়ে উঠছে।
রামকানাইকে বললাম, তুমি এক বার যাও-না, গুপি আর ছোটো মাস্টারের সাহায্য দরকার হতে পারে।
রামকানাই ফোঁস করে উঠল, ও বাবা, সে আমি পারব না। কেউটে সাপের বাসায় নাক গলানো আমার কম্ম নয়। তা ছাড়া আমি গেলে তোমার দেখাশুনো করবে কে! তোমাকে একা ফেলে যাই, আমার চাকরিটাও যাক আর কী। যাই, মাংসটা চাপিয়ে এসেছি। এই বলে রামকানাই সত্যি সত্যি দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
দরজার কাছে পৌঁছে, ফিরে বলল, কোনো ভয় নেই, ওই যে সামন্তবাবুও একদল প্যায়দা নিয়ে গলিতে ঢুকল। যাই, মাংস না ধরে যায়। চোর ধরার চেয়ে সে অনেক খারাপ হবে।
আরও অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। রামকানাই একবার উঁকি মেরে দেখতে এল কী করছি। বললাম, সব শুনেও নেপোকে খুঁজতে যাবে না?
রামকানাই বলল, না, আমার গুরুদেব শুনলে দুঃখিত হবেন! এই বলেই চলে গেল। একটু পরে আবার এসে বলল। অত নেপো-নেপো করো কেন? মহা পাজি বেড়াল। অমন ঢের ঢের বেড়াল পাওয়া যায়। চাও তো দুটো-একটাকে এনেও দিতে পারি। চাঁদের বইটা ছুঁড়ে মারলাম। সঙ্গেসঙ্গে সে কী চিৎকার!! শুনে আমার গায়ের সব লোম খাড়া হয়ে উঠল। মনে হল কে চাঁচাচ্ছে, পানু পানু পানু ওরে পানু– বাঁচা– রে! মি–অ্যাঁ–ও মি–অ্যাঁও। আর এক মিনিটও অপেক্ষা করলাম না, পাঁই পাঁই গাড়ি চালিয়ে একেবারে পেছনের বারান্দার ঘোরানো সিঁড়ির মুখের কাছে চলে গেলাম। মনে হল ওদিকে ওদের ঘোরানো সিঁড়ির মাথার দরজাটায় কারা যেন আছড়ে পড়ল। পানু পানু বাঁচা। আর সে কী মাও-মাও শব্দ।
–ও রামকানাই দা! ও রামকানাই দা! বলে চাঁচাতে লাগলাম। উত্তর নেই। হঠাৎ দেখি রঙের মিস্ত্রিদের তক্তাটা আমাদের রেলিঙের ধারে পড়ে আছে। এক মাথা সিঁড়ির রেলিঙে বাঁধা। নিশ্চয় গুপির কাজ। হাত বাড়িয়ে সেটাকে তুলে নিলাম। বেশ ভারী। গাড়ি থেকে নেমে সিঁড়ির রেলিঙের ফঁক দিয়ে ঠেলে ঠেলে যেই-না ওদের সিঁড়ির সঙ্গে জুড়ে দিলাম, অমনি ওদিকের দরজা খুলে হুড়মুড় করে দাড়িওয়ালা একটা লোক বেড়াল বগলে তক্তা পেরিয়ে চলে এল। সঙ্গেসঙ্গে গুপি এসেই তক্তা টেনে নিল। কিন্তু ততক্ষণে আরও গোটা দশেক বেড়াল আমাদের বারান্দায় এসে উঠেছে। উঠেই কার্নিশ বেয়ে হাওয়া।
আমি মাটিতে পড়ে গিয়েছিলাম। এবার উঠে গাড়িতে চেপে খাবার ঘরে এলাম। গুপি বারান্দার দরজাটা বন্ধ করে দিল। আমি কেবল বলতে লাগলাম, ওরে নেপো! আবার ফিরে এসেছিস!আর নেপো আমার কোলে উঠে কেবলই আমাকে চাটতে লাগল। নেপোর গলায় দেখলাম একটা সাদা টিকিট ঝুলছে। তাতে লেখা—A।
ছোটোমামা আর গুপি আমার বিছানায় বসে বসে খালি হাঁপাতে লাগল। তাদের মুখগুলো কাগজের মতো সাদা, হাত-পা কাঁপছে।
রামকানাইকে কিছু না বলতেই ওদের জন্যে গরম চা আর নেপোর জন্যে বাটি করে দুধ নিয়ে এল। টানতে টানতে নেপোকে আমার কাছ থেকে নিয়ে দুধের বাটির সামনে বসিয়ে দিল এবং বলা বাহুল্য নেপোও তৎক্ষণাৎ দুধের সদ্ব্যবহার করতে লেগে গেল।
এমন সময় দরজা ঠেলে মেজোকাকু ঢুকেই, ওদের দেখে বললেন, এই যে তোমরা এখানে! ওটা কে? উঁদু না? তুই আবার দাড়ি রেখেছিস কেন? চেঁচে ফেল, বিশ্রী দেখাচ্ছে, স্রেফ আইন-ভঙ্গকারী! তোরা এখানে কী কচ্ছিস? এদিকে পাশের বাড়িতে বিনু তালুকদার যে কেল্লা ফতে করে দিয়েছে তাও জানিস না বুঝি? চাঁদু, এবার তুই বাড়ি ফিরে নিশ্চিন্ত মনে পড়াশুনো করগে যা। বুড়ো বাপকে আর জ্বালাস নি।
গড়গড় করে কী যে বকছেন কাকু আমি ভালো করে বুঝতেই পারছিলাম না। কিন্তু গুপি আর ছোটোমামা কোনো কথা না বলে পাশাপাশি আমার খাটের উপর শুয়ে পড়ল। কাকু ব্যস্ত হয়ে রামকানাইকে বললেন, হাঁ করে বসে আছিস যে? ও-দুটোর দাঁতকপাটি লেগেছে দেখছিস না? মাথায় জলের ঝাপটা দে!
কিন্তু রামকানাইয়েরও এমনি হাত-পা কাঁপছিল যে সেও নড়তে পারছিল না। শেষপর্যন্ত আমিই তাক থেকে কুঁজো নামিয়ে জলের ঝাপটা দিতে লাগলাম। তাই দেখে কাকু আবার ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে বললেন, অ্যাঁ! তু-তু-ই হাঁটছিস্?
তাই তো, দিব্যি হাঁটাহাঁটি করছি, এতক্ষণ তো টের পাইনি! বাবাও এসে ঘরে ঢুকে হাঁ করে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। কেন জানি হাউ মাউ করে কেঁদে ফেললাম। বাবাও নাক টানতে টানতে আমার হাত ধরে আবার বসিয়ে দিলেন। পকেটে বোধ হয় চিপকে গিয়ে বিদ্যুৎ বকবকম করে উঠল। মা এসে কিছু না বলে মহা কান্নাকাটি লাগালেন। এ তো বড়ো জ্বালা।
অনেক পরে বাবা বললেন, ডাক্তারবাবুকে ফোন করে দেওয়া হয়েছে, এখুনি আসবেন। বললেন এইরকম একটা উত্তেজনারই দরকার। কিন্তু এরা দু-জন এখনও ভিজে বালিশে শুয়ে কেন? সর্দি লাগবে না?
গুপি আর ছোটোমামার দু-জনারই সর্দির বড় ভয়। বাবার কথা শুনেই তড়াক করে উঠে বসে আমার তোয়ালে দিয়ে তারা মাথা মুছতে লেগে গেল।
তারপর বাবা মেজোকাকুকে বললেন, কী ব্যাপার খুলে বল দিকিনি।
কাকু বললেন, নিতাই সামন্ত এক্ষুনি এল বলে, এদের স্টেটমেন্ট নিতে। তার কাছেই সব শুনো। আমার বুদ্ধিসুদ্ধি গুলিয়ে গেছে। নিতাই ফোন করে বলল তোমার বাড়ি থেকে পাখি যেন না পালায়। তাই এলাম।
একথা যেই-না বলা, ছোটোমামা আর গুপি দু-জনাই লাফ দিয়ে উঠে পড়ল। মেজোকাকু বললেন, ও কী হচ্ছে? ওসব চলবে না। চুপ করে বসে থাকো। আমি কথা দিয়েছি সে না আসা অবধি তোমাদের এখানে আটক রাখব।
গুপি বলল, কী, কী করে জানলেন আমরা এখানে?
মেজোকাকু তো অবাক! কী করে জানলাম? শুধু আমি না, পাড়াসুদ্ধ যত লোক অন্ধকার গলিতে খাপে দাঁড়িয়েছিল, সবাই দেখেছে তক্তা পার হয়ে দু-জন আইনভঙ্গকারী এখানে আশ্রয় নিচ্ছে। খবরদার যদি নড়েছ!! আর সামন্ত আসার আগে ঠোঁট ফাঁক করবেনা। তোমরাই পুলিশের সবচেয়ে বড়ো সাক্ষী। ভিতরের ব্যাপার স্বচক্ষে দেখে এসেছ। ছোটো মাস্টার কোথায়? যাকগে, পুঁটিমাছ বোধ হয় বিনু তালুকদারের জালে পড়েছে।
এই বলে মেজোকাকু বেদম হাসতে লাগলেন। খুব রাগ হল!
তারপর গম্ভীর মুখ করে ছোটোমামার দিকে চেয়ে বললেন, তুমি সত্যি এর মধ্যে জড়িয়ে আছ দেখে বড় দুঃখিত হলাম। তোমার বাবা এত ভালো লোক, গেলেই কী ভালো তামাক খাওয়ান। তবে নিতাই সামন্ত যেই তোমার ঘরে চোরাই গাড়ির নম্বর প্লেট পেয়েছিল, তখনই সব আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছিল। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি তুমি দুষ্টলোকের–
ছোটোমামা হঠাৎ রেগে গেলেন। ওসব আমি গোমেস ব্রাদার্স থেকে সের দরে কিনেছি, তার ভাউচার আছে মার হাতবাক্সে, গিয়ে দেখতে পারেন।
শুনে মেজোকাকু অবাক!
বাবা হেসে বললেন, ও হে, তোকে বলা হয়নি। চাঁদু যে স্পেসশিপ বানিয়ে গুপি আর পানুকে চাঁদে নিয়ে যাবে। সেখানে জমি কিনে ওরা স্পেসশিপ সারাবার কারখানা করবে। দ্যাখ চাদু, মাটির তলার জমি কিনিস কিন্তু, ওপরের জমি বাজে। হা কী বলছিলাম, তা চাদে যাবার খরচা কম নয়, ওরা পারবে কেন? তাই চাঁদু নিজেই স্পেসশিপ বানাবে। তাই নিয়ে এত ভাবতে হয় যে পড়া করার সময় পায় না। ফলে বি.এসসি.-তে সুবিধা করতে পারে না।
এই অবধি বলে বাবা আর মেজোকাকু যে-যার নিজের হাতঘড়ি দেখলেন। মেজোকাকু জানলার কাছে গিয়ে বললেন, দশটা বাজতে দশ মিনিট, আমাদের সকলের জন্যে রাঁধতে দিয়েছ আশা করি, বড়দা?
রামকানাই দরজার কাছ থেকে বলল, খিচুড়ি, মাংস, আলুভাজা, বেগুনভাজা।
গুপি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। আমি বললাম, ছি, মেজোকাকু, তোমার শুধু খাওয়ার ভাবনা।
গুপি আর ছোটোমামা একসঙ্গে বলল, খাওয়ার ভাবনা খারাপ নাকি? উঃ পেটে চড়া পড়ে গেছে!
ডাক্তারবাবু এলেন। আমার পা পরীক্ষা করলেন। হাঁটালেন, চলালেন, ওঠ-বোস করালেন! তারপর ওষুধপত্র মালিশের ব্যবস্থা করে দিয়ে বললেন, পানু, এও তোমার একরকম পরীক্ষা শেষ হল। তুমি খুব ভালো ভাবে পাস করেছ। এক মাস এক্সারসাইজ করবে, বাড়াবাড়ি করবেনা! তারপর স্কুলে যেতে পারবে। কেমন, খুশি তো?
আমার খুব সর্দি এসে গেল, কিছুই বলতে পারলাম না।
এমন সময় নিতাই সামন্ত এসে ঢুকলেন। সবাই চুপ।
মেজোকাকু একটু কেশে বললেন, এই যে কানু, তোমার সাক্ষী-সাবুদ, অনেক কষ্টে আটকে রাখা গেছে।
বাবা বললেন, তা ছাড়া অবিশ্যি দৌড়ঝাঁপ করার মতো ওদের ক্ষমতাও নেই।
ছোটোমামা ভাঙা গলায় বললেন, দু-দিন খাইনি। খাঁচায় বন্ধ করে রেখেছিল।
নিতাই সামন্ত বললেন, তাই নাকি? ভাগ্যিস গুপিরা গেছিল।
ছোটোমামা চিঁচিঁ করে বললেন, মোটেই ওরা আমাকে উদ্ধার করেনি। আমিই বরং—
গুপি বলল, ফের।
ছোটোমামা থেমে গিয়ে ঢোক গিলতে লাগলেন।
বাবা আর মেজোকাকু একসঙ্গে বললেন, এবার তাহলে রহস্য উদ্ঘাটন হোক।
নিতাই সামন্ত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, ধৈর্য ধরুন। বিনু তালুকদার হয়তো রিং লিডারদের নিয়ে এখানে আসবেন, মোকাবিলা করতে। অর্থাৎ সবাইকে মুখোমুখি এনে ব্যাপার খোলসা করতে। তেওয়ারি রাখুর দলও আসবে, কিছু আসবাব সরালে ভালো হয়।
আমি বললাম, আমার ঘরে কেন? তার চেয়ে সবাই মিলে বসবার ঘরে গেলে হয় না?
সামন্ত বললেন, আরও ভালো হয় একদল যদি এখনই খেয়ে নেয়। চাঁদু, গুপি, পানু, এরা খেয়ে নিক। দেখো, আবার পালাবার চেষ্টা করলে হুলিয়া লাগিয়ে ধরিয়ে এনে ফাটকে দেব কিন্তু। আর ভালোমানুষের মতো খেয়ে নিলে, তোমাদের স্টেটমেন্ট নিয়ে, আমার জিপে করে যার যার বাড়ি পাঠিয়ে দেব! তোমরা কিছু আসামি নও, তোমরা হলে পুলিশের পক্ষের সাক্ষী।
দরজার কাছ থেকে রামকানাই বলল, কোনো ভয় নেই। খাবার ফেলে ওনারা সগগেও যাবেন। রান্না তৈরি।
বাবা বললেন, চোপ।
ছোটোমামা বললেন, খেয়ে এসে সব বলব। কিন্তু আমাকেও গুপিদের ওখানে পাঠাবেন। বাবার কাছে এমনি গেলে, বাবা দাড়ি ছিঁড়ে দেবেন।
খেয়ে-দেয়ে সবে এসেছি অমনি আমাদের সদর দরজার ঘন্টি তিন বার বেজে উঠল। নিতাই সামন্ত লাফিয়ে উঠলেন, ওই ওই বিনু তালুকদারের লোকের সংকেত। আপনারা তিনটে বড়ো বড়ো শকের জন্য প্রস্তুত হোন।
আমার পকেট থেকে বিদ্যুৎ আবার বকম-বকম করতে লাগল। আর নেপো তার পিঠটাকে কুলোর মতো করে, লোম ফুলিয়ে তিনগুণ বড়ো হয়ে, দাঁতের ফাঁক দিয়ে অদ্ভুত একটা ট স্ স্ স্ স্ শব্দ করতে লাগল।
১১.
শেষপর্যন্ত সে-রাত্রে আর কিছু শোনা হল না। ডাক্তারবাবু নিশ্চয় আমাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়েছিলেন। হঠাৎ কেমন ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে গুপি আমাকে ঠেলে তুলল। রাতে সে বাড়ি যায়নি। আমার ঘরের কৌচে ঘুমিয়েছিল। অথচ আমি সে-বিষয় কিছুই জানি না। ছোটোমামার দেখা নেই।
চোখ খুলতেই গুপি আমার হাতে আমার হারানো খাতা গুঁজে দিল। দুমড়োনো মুচড়োনো আঁচড়ানো কামড়ানো। এই আমার সেই আদি নেপোর বই। পরে গুপি নিয়ে গিয়ে মোড়ের মাথায় দোকান তেকে বাঁধিয়ে দিয়েছে। এতে আমি সমস্ত ব্যাপারটার যতখানি মনে আছে লিখে রেখেছি। যেমন মলাটে নেপোর বই নাম লেখা ছিল, তেমনি আছে। ভেবেছিলাম কেমন বাড়েটাড়ে বাচ্চা বয়স থেকে সব লিখে রাখব। সে আর নানা কারণে হয়ে ওঠেনি। তা ছাড়া সব কথা লেখাও যায় না। মহা পাজি।
খাতা পেয়ে অবাক হয়ে উঠেবসে গুপির দিকে তাকালাম। গুপি বলল, কাল বড়ো মাস্টারের ঘর থেকে ছোটোমামা ওটাকে উদ্ধার করেছিল।
এমনি অবাক হলাম যে পায়ের জোর চলে গেল, খাট থেকে পড়ে গেলাম, নিজেই খচমচ করে উঠে বললাম, তা-তার মানে?
খানিকটা তোতলামি এসে গেল। পা জখম হবার পর থেকে একটু তোতলাই। আজকাল প্রায় সেরে গেছে।
গুপি বলল, সে অনেক কথা।
বলে মুচকি হাসতে গিয়ে ভ্যাঁ-ভ্যাঁ করে কাঁদতে লাগল।
আমি হাঁ করে চেয়ে রইলাম। তারপর বললাম, পোড়া বউ মরেছে বুঝি?
গুপি মাথা নেড়ে বলল, পোড়া নয়। বউ নয়।
–তবে?
–ওঁর দাদা।
আমি বললাম, দাদা মরেছে তো তুই কাঁদছিস কেন? তাকে তো চিনিসও না।
গুপি বলল, মরেনি। সামন্ত তিনটে শকের কথা বলেছিল। ওই হল এক নম্বর।
তবে কেন কাদছিস্?
–উনি বর্মায় যাননি কখনো, জাহাজডুবি হয়নি, বাঁদরদের দ্বীপ থেকে কেউ তাড়ায়নি, ডুবো জাহাজে নেমে সোনা তোলেননি, বনের দেউয়ের পাহাড়ে ওঠেননি। ম্যাও নামে বেড়াল ছিল না। সব বানানো কথা। ওই হল দুনম্বরের শক্! ওঁর দাদা বলেছে।
তাই শুনে আমারও কেমন পেট কামড়াতে লাগল। তবে কি বউ রামু ডাকাতের মেয়ে নয়?
গুপি বলল, না, না, কারো মেয়ে নয়, বউই নয়, ও-ই দাদা।
কেমন গোলমাল লাগতে লাগল। কার দাদা?
–বড়ো মাস্টারের দাদা! মোটর চুরির ব্যাবসা ওঁর। ঠান্ডাঘরের মালিক উনি!
তারপর আরও খানিকটা কেঁদে বলল, স্পেসশিপ তৈরি হয় না ওখানে! চোরাই গাড়ির চেহারা বদলি করা হয়। বিনু তালুকদার সবাইকে ধরেছে। তাই কাল তার আসতে দেরি হল। এসে সব বলে গেল। তুই তখন হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়লি! আজ আবার আসবে, তোর জবানি নেবে।
আমি বললাম, আ–আ–আমি কী কী–কী–কীসের বিষয় জবানি দেব?
গুপি অবাক হয়ে বলল, বেড়ালের।
–কী বেড়ালের জবানি?
–নেপো বেড়ালের।
আমি হাঁ করে তাকিয়েই রইলাম। নেপো ঘরে ঢুকে গুপিকে দেখে রেগে গর-র-র-গ র–র করতে লাগল। গুপি দুঃখিত হয়ে বলল, একরকম বলতে গেলে আমিই ওকে বাঁচালাম আর আমার উপর রাগ দেখাচ্ছে দেখো!
–না না, তোর উপরে ঠিক নয়। তুই আমার আলোয়ানের উপর বসেছিস কি না, ওইখানে ও বসে।
গুপি সরে বসে বলল, মাস্টারের দাদা অবসর সময় হার্মোনিয়ম বানাত। অনেক জায়গায় নাকি তার খুব চাহিদা। অনেক পয়সা কামাত।
আমি বললাম, কীরকম হার্মোনিয়ম?
গুপি অবাক হয়ে গেল। কেন, বেড়ালের হার্মোনিয়ম নিশ্চয়। নাকি সন্দেশ পড়ে শিখেছিল। খালি ওই বেড়াল ধরা যা একটা সমস্যা হয়েছিল। সব বেড়ালের সারেগামার সুর ঠিক থাকে না। সুর ঠিক না হলে লোকে কিনবে কেন। বেসুরো গান কে শুনতে চায়?
কখন যেন বাবা এসে দাঁড়িয়েছিলেন টের পাইনি। বেজায় আশ্চর্য হয়ে বললেন, বেড়ালের হার্মোনিয়ম আবার কী?
আমি বললাম, সেই যে সুবিমল রায় সন্দেশে লিখেছিলেন, কে যেন বানিয়েছিল। কাঠের খোপে খোপে বেড়াল বসাতে হয়, তলা দিয়ে ল্যাজ ঝোলে। একেক বেড়ালের একেক সুর হওয়া চাই, সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি-সা। ল্যাজ ধরে টানলেই বেড়াল ওই সুরে ম্যাও ধরে। দিব্যি গানটান বাজানো যায়।
বাবা বললেন, পাগল নাকি?
গুপি একটু চটে গেল। না কাকা, পাগল নয়। অনেক বেড়াল জোগাড় করতে হত, তাদের সুর ঠিক চিনে গলায় টিকিট ঝোলানো হত। টিকিট তো সবাই দেখেছে। নেপোর গলাতেও ছিল।
বড়ো মাস্টার ওর ল্যাজে পা দিতেই ও একেবারে এক টানে সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি সা আ-আ করে চেঁচিয়ে উঠে দেপিট্টান। বড়ো মাস্টার বাড়ি গিয়ে দাদার কাছে ওই কথা বললেন! শুনে অবধি দাদা আর বড়ো মাস্টারকে ছাড়ান দেয়নি। ওটি আমার চাই, ডি লুক্স হার্মোনিয়ম বানাব। বড়ো মাস্টার দাদাকে ঘরে আটকে রাখার জন্যে বেড়াল জোগাড় করে দিতেন। নইলে দাদা কোথায় কী করে বসবে তার ঠিক কি। নাকি সতেরো বার জেল খেটেছে, পৃথিবীর নানান দেশে, নানান নামে। ওই ছাদে বেড়ালরা চরত। মাছ আসত ওদেরই জন্যে। কিন্তু বেশি খেলে গলার সুর খোলে না। তাই খাওয়া কমানো হয়েছিল। ঠান্ডাঘরের চোরাই গাড়ির কারখানায় ওরা থাকত। খাওয়া কমানোতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। অমনোনীতরা ছাড়াই থাকত। তেওয়ারি তাদের গলা সাধাত। মহা দৌড়ঝাঁপ করত ওরা। সেদিন ছোটোমামা চোঙা খুলতেই ওরাইনদীর স্রোতের মতো বেরিয়ে এসেছিল। চোঙার বাইরে থেকে মাছের গন্ধ একটুখানি নাকে ঢুকতে-না-ঢুকতেই।
আমি বললাম, আর ছোটোমামা?
গুপি একটু হাসল। ছোটোমামাই তো চোঙা দিয়ে কারখানায় ঢুকে, বেড়ালদের খাঁচা আবিষ্কার করে, নিজেই একেবারে থ। ছোটোমামা একটা হিরো।
এই বলে গুপি আরও খানিকটা কেঁদে নিল।
আমি বললাম, ওরকম করিস না। তাহলে আরেকটা দামোদর ভ্যালি তৈরি হয়ে যাবে।
গুপি বলল, চাঁদে যাবে না বলছে যে। নাকি বড্ড হাঙ্গামা।
বেজায় রাগ হল। চেঁচিয়ে বললাম, চাদে যাবে না তো করবেটা কী শুনি?
গুপি বলল, পুলিশে চাকরি নেবে। ওই হল তিন নম্বরের শক!
–পু-পুলিশে চাকরি নেবে? সে আবার কী?
–বিনু তালুকদার ওকে হাত করেছে বুঝলি-না। ওকে দিয়ে কাজ হাসিল করেছে, এখন আর কি ওকে ছাড়ে।
বাইরের দরজার ঘন্টি পড়ল। বাবা লাফিয়ে উঠে বললেন, ওই যে মি. তালুকদারের দল এলেন বোধ হয়।
সঙ্গেসঙ্গে মেজোকাকু আর নিতাই সামন্ত ঘরে ঢুকে ধপাধপ করে একেকটা চেয়ারে বসে, কপালের ঘাম মুছতে লাগলেন। মেজোকাকু বলেলন, উঃ, সাধে লোকে ওর নাম দিয়েছিল গোরিলা ঘোষাল! গায়ে কী জোরটা দেখলে? একবার গা ঝাড়া দেয় তো তোমাদের সব চাইতে জোরালো পাঁচ-ছয়টা ছিটকে পড়ে! আবার তেজ কত! বুক চাপড়ে বলল, কী করবি রে তোরা আমার? বউ সেজে ঘোমটা দিয়ে সাত বছর কাটালাম, এখন আর আমার ভয়ডর বলে কিছু নেই। দে না পাঁচ বচরের জন্যে জেলে। পায়ের উপর পা দিয়ে তোদের পয়সায় দু-বেলা খাব আর আমার হার্মোনিয়মের বইটা এই অবসরে লিখে ফেলব!–চাদু এল না; কালকের অত উত্তেজনার ফলে ওর পেটের অসুখ করেছে। গুপিদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। বাড়ি গেলে বুড়ো ওকে মাটিতে বিছিয়ে দেবে।
নিতাই সামন্ত বললেন, কী জানি শেষপর্যন্ত গাড়ি চুরির কেসটা টিকবে কিনা। ওখানে তো ওই দুটো ভাঙা গাড়ি ছাড়া কিছু পাওয়া গেল না। নাকি গাড়ি সারাবার কারখানা। ও দুটোকে সের দরে কিনেছে। লাইসেন্স নেই বলে লুকিয়ে কাজ করে। এদিকে বেড়ালের হার্মোনিয়ম তৈরি করা কিছু বেআইনি নয়। ওই লাইসেন্স নেই বলেই যা খানিকটা জরিমানা করা যেতে পারে।
বাবা বললেন, সবটা খুলে না বললে ঠিক বুঝতে পারছি না।
সামন্ত বললেন, তাও বুঝলেন না? এর মধ্যে দুটো ব্যাপার জড়িত, এক গাড়ি চুরি, দুই বেড়াল চুরি। চোরের সর্দার কিন্তু একজনই। ওই যে বললাম গোরিলা ঘোষাল, বড়ো মাস্টারের দাদা। ঠান্ডাঘরটা একটা ভাঁওতা। ওটা আসলে মোটরের কারখানা। আমাদের বিশ্বাস চোরাই গাড়ির, কিন্তু তার কোনো প্রমাণ পাচ্ছিনা। তা ছাড়া হামোনিয়মের কাঠের খোল তৈরি হয় ওখানে। তারইঠক ঠক শোনা যায়। এঁয়ারা তাই শুনে ওই স্পেসশিপ বানাচ্ছে, বলে আহ্লাদে আটখানা!
দেখলাম চমৎকার ব্যবস্থা। ঠান্ডাঘরের ছাদে ওঠার সিঁড়ি আছে ভিতরে। ছাদের কোনা দিয়ে নাইলনের দড়িরমই বেয়ে ঘুলঘুলির ভিতর দিয়ে বড়ো মাস্টারের ঘরে যাওয়া যায়। আবার সেখান থেকে বড়ো সিঁড়ি দিয়ে ছাপাখানার ভিতরে নামা যায়। নাইট ওয়াচম্যানের ঘরেও ঢোকা যায়। তাড়া খেয়ে গুপিরা তাই করেছিল। তারপর পানু তক্তা ফেলে দিতেই এ-বাড়িতে পালিয়ে আসতে পেরেছিল। নইলে গোরিলা ওদের মেরে পাট করে দিত! তার আগে কী হয়েছিল সেকথা গুপিই ভালো বলতে পারবে। আমি তো তখনও পৌঁছোইনি।
গুপি দেখলাম খুব খুশি। হাসতে হাসতে বলল, ছোটো স্যারের সঙ্গে গলি দিয়ে ঢুকে ও মাথায় গিয়ে দেখি ঠান্ডাঘরের গায়ের ছোটো দরজাটা খোলা, হাওয়ায় দুলছে। ওইখানে গিয়ে ঢুকলাম। একটা প্যাসেজ দিয়ে যেতেই কারখানা। লোহালক্কড়, কাঠের উঁই, যন্ত্রপাতি। তেলে প্যাঁচপেচে বিশ্রী জায়গা। একটা নিয়নবাতি জ্বলছে। কেউ কোথাও নেই। তারপর একটা ফাঁস ফাস ফোঁস ফোঁস ম্যাও ম্যাও মিউ মিউ শুনে দেখি বিরাট এক খাঁচার খোপে খোপে শত শত বেড়াল। এমন সময় কাতরকণ্ঠে কে বলল, বাঁচাও! এ ছোটোমামা না হয়ে যায় না। দেখি মস্ত খাঁচার এক ধারে আলাদা খোপে গুঁড়ি মেরে ছোটোমামা বসে। ভয়ে আধমরা। চোঙা দিয়ে ওকে নামতে দেখেই কারখানায় যারা কাজ করছিল তারা নাকি ভূত ভূত বলে খিড়কি দোর খুলে দে দৌড়। ছোটোমামা ঘরটা পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখেন ছাদ অবধি সিঁড়ি উঠে গেছে।
সিঁড়ি বেয়ে ঠান্ডাঘরের ছাদে গিয়ে দেখেন, সামনে নাইলনের মই ঝুলছে। তাই বেয়ে একেবারে বড়ো মাস্টারের ঘরে, পোড়া বউয়ের মুখোমুখি। কিন্তু সে পোড়া বউ নয়। একহাত ঘোমটা, ঝোলা গোপ, মোটা বেঁটে গোরিলা ঘোষাল হার্মোনিয়ম পালিশ করছে। ওকে দেখে সে হুংকার দিয়ে লাফিয়ে উঠল। তারপর এক মিনিটের মধ্যে বগলদাবা করে, স্বচ্ছন্দে দড়ির মই বেয়ে, সিঁড়ি দিয়ে নেমে একেবারে ঠান্ডাঘরে। তারপর বেড়ালের খাঁচার অন্য অর্ধেকে পুরে বাইরে থেকে শিকল তুলে, কাষ্ঠ হেসে, কোনো কথা না বলে, আবার সিঁড়ি বেয়ে অদৃশ্য। সেই ইস্তক ছোটোমামা ওইখানে বন্ধ, চাঁচাবারও জো নেই। শব্দ করলেই বেড়ালেরা নাকি নখ বার করে। তারপর সামন্ত সাত-আট জন পুলিশ নিয়ে ঢুকলেন। এসেই আগে খাঁচার দরজা খুলে দিলেন।
নিতাই সামন্ত খুব হাসতে লাগলেন। আর বলেন কেন, দাদা, খাঁচা খুললেও বেরোয় না। টেনে বের করতে হল। তখন আবার কিছুতেই নড়ে না, দ্বিতীয় খাঁচার বেঁড়ে ল্যাজের বেড়ালটাই নাকি নেপো। ওকে না নিয়ে নড়বে না। অগত্যা তাদের সবাইকে ছাড়া হল। তারা আবার আমাদের পা ঘেঁষে সঙ্গেসঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠল। তারপর সে যা হই হই! গোরিলা ঘোষাল লাঠি হাতে তেড়ে এল। গুপি আর চাঁদুতখুনি দুদ্দাড় দৌড়। পিছন পিছন গোরিলা ছুটল। পানুই শেষটা ওদের বাঁচাল এ আমি বলতে বাধ্য।
একটু খুশি না হয়ে পারলাম না। নিতাই সামন্ত বললেন, অনেক কষ্টে গোরিলাকে ধরা হল। তারপর তাকে আমাদের ভ্যানে তুলে বড়ো মাস্টারের খোঁজে ছাপাখানায় গিয়ে দেখি তিনি চোখে ম্যাগনিফাইং চশমা এঁটে প্রুফ দেখছেন। এতসব কাণ্ড হল, তার কিছুই নাকি টের পাননি! বুঝলেন দাদা, ওই নাইট স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে বিনু তালুকদারের চর ছিল। দোকানের বুড়ি সেজে ঘুঘু সমাদ্দার খবর সংগ্রহ করে দিত। বিনু তালুকদার একবার ধরলে কাউকে ছাড়ে না। এসব প্ল্যান তারই।
এই অবধি বলে নিতাই সামন্ত হাতঘড়ির দিকে তাকালেন।
এর মধ্যে বিনু তালুকদার কোত্থেকে এল বুঝলাম না।
বাবা আবার ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।
মি. তালুকদার তো কই এখনও এলেন না?
আসবেন, আসবেন। ওই বড়ো মাস্টারটিকে নিয়েই হয়েছে মুশকিল। সব দেখে-শুনে মনে হয় দাদার সঙ্গে হ্যাঁন্ড-ইন-গ্লভ যাকে বলে। অথচ বেআইনি কিছু করছেন বলে প্রমাণ খুঁজে পাচ্ছি না। এদিকে কী বলছেন জানেন, ওঁর দাদার নাকি একা জেলে কষ্ট হবে, ওঁকে সাকরেদ বলে ধরতে হবে। তা হলে নাকি বর্মার জঙ্গলে নাম দিয়ে অদ্ভুত স্মৃতিকথা লেখার সময় পাবেন।
মেজোকাকুও হেসে কুটোপাটি। শোন একবার কথা! লোকটা চব্বিশ পরগনার বাইরে কখনো পা দিল না, উনি আবার বর্মার জঙ্গলে লিখবেন।
ভীষণ রাগ হল! আমি কিছু বলার আগেই গুপি চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে বলতে লাগল, কিছু দরকার নেই বর্মা যাবার। লিখতে হলে যাবার দরকার করে না, লিখবার ক্ষমতা থাকলেই হল।
ঠিক এই সময় সুড়সুড় করে ছোটো মাস্টার ঘরে ঢুকলেন। তাঁকে দেখেই গুপি রেগে চতুর্ভুজ হয়ে উঠল। কাল আমাকে শত্তরের গর্তে ঠেলে দিয়ে কোথায় কেটে পড়লেন, স্যার? আমি
কানু সামন্ত ছুটে এসে গুপির মুখ চেপে ধরে বলল, স্স্স্ কাকে কী বলছ! উনিই বিনু তালুকদার, ছোটো মাস্টারের ভেক ধরে এমনকী আমার পর্যন্ত চোখে ধুলো দিয়েছিলেন।
গুপি আমার দিকে তাকাল। আমি গুপির দিকে তাকালাম। তারপর গুপি ছুটে গিয়ে ছোটো মাস্টারের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে বলল, স্যার, আমিও পুলিশে চাকরি করব।
বিনু তালুকদার ওর পিঠ চাপড়ে, আমার দিকে চেয়ে বললেন, স্পেসশিপের মডেলটা
আমি বললাম, বি.এসসি. পাস করে আমিও পুলিশে ঢুকব। চাঁদে গিয়ে কাজ নেই। যাওয়া হবেও না।
–হবে না মানে? এই হল বলে! তারপর স্পেসশিপেও গুপ্ত গোয়েন্দা রাখা হবে। ওঃ, বলতেই ভুলে যাচ্ছিলাম, তোমাদের বড়ো স্যার রবিবারে এসে তোমাদের গল্প বলবেন। বর্মার সব ভালো ভালো অভিজ্ঞতা মনে পড়েছে, এক দিন ফাটকে বসে বসে। এখন স্নান-খাওয়া করতে বাড়ি গেছেন।
তখন গুপি আর আমি উঠে গিয়ে খাবার ঘরের দিকে চললাম। সঙ্গেসঙ্গে নেপোও চলল। বেঁড়ে ল্যাজ খাড়া করে।