পরদিন সন্ধেবেলা চেতলায় মণিময় চ্যাটার্জির সঙ্গে দেখা করতে গেল রণিতা আর অমিতেশ। মৃণালেরও আসার কথা ছিল কিন্তু আসানসোলে দুই পলিটিক্যাল পাটির ওয়াকারদের মধ্যে প্রচণ্ড মারদাঙ্গা বাধায় চারজন খুন হয়েছে। চিফ রিপোর্টার অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে তাকে সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছেন। রাত দশটার আগে তার ফেরার সম্ভাবনা নেই।
মণিময়দের দোতলা বাড়িটা বড় না হলেও বেশ ছিমছাম। সামনে পেছনে ছোট্ট বাগানও রয়েছে। বাগান পেরিয়ে পাঁচটা সিঁড়ি ভেঙে বাইরের বারান্দায় উঠে কলিং বেল টিপতেই একটি কাজের লোক একতলার ড্রইং রুমে রণিতাদের পোঁছে দেয়।
বসার এই ঘরটা সোফা, সেন্টার টেবল, ডিভান, বুক-কেস, ওয়াল ক্লক, এয়ারলাইনসের সুদৃশ্য ক্যালেন্ডার আর পেতলের চকচকে নটরাজ দিয়ে সাজানো। ডিভানে বালিশের ওপর ভর দিয়ে আধশোয়া মতো হয়ে ছিলেন মণিময়। রণিতাদের দেখে আস্তে আস্তে উঠে বসেন। মৃণালের বন্ধু হিসেবে অমিতেশকে তিনি চেনেন। বলেন, তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করছি অমিত। এই বুঝি রণিতা?
হ্যাঁ বড়মামা–মৃণালের দেখাদেখি অমিতেশও মণিময়কে বড়মামা বলে।
বসো, বসো–
অমিতেশ আর রণিতা মণিময়কে প্রণাম করে সোফায় বসে।
যদিও সত্তরের কাছাকাছি বয়স এবং একটা বড় ধরনের স্ট্রোক হয়ে গেছে তবু মণিময়কে এখনও সুপুরুষ বলা যায়। গড় বাঙালির তুলনায় তাঁর হাইট বেশ ভাল, ছ ফিটের মতো। চুলের বেশির ভাগই কালো। চওড়া কপাল, ভারি চোয়াল, ধারালো নাক। এই বয়সেও চোখে ছানি পড়ে নি, দৃষ্টি উজ্জ্বল এবং গভীর। তাঁর পরনে ধবধবে পাজামা পাঞ্জাবি।
কাজের সেই লোকটি একধারে দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে অমিতেশদের জন্য চা আর মিষ্টি টিষ্টি আনতে বলে রণিতার দিকে তাকান মণিময়, তোমার কথা টাবু আমাকে সব জানিয়েছে।
রণিতা জিজ্ঞেস করে, টাবু কে?
ওটা মৃণালের ডাকনাম। একটি বাঙালি মেয়ে ফিল্মকে কেরিয়ার হিসেবে নিয়েছে, শুনে কী ভাল যে লাগল! তার ওপর নয়নতারার ওপর ডকু-ফিচার করতে চাইছ। ইটস রিয়ালি থ্রিলিং। এখন বল কতটা কী করেছ। মেটিরিয়াল কিছু জোগাড় হয়েছে?
সব জানিয়ে রণিতা মণিময়ের মুখের দিকে তাকায়।
মণিময় বলেন, ফাইন। নয়নতারা যখন বেঁচে আছে, তাকে বাদ দিয়ে তার ওপর ভাল ছবি হতে পারে না। পুলিশের কাছে গিয়ে ভালই করেছ। ওরা চেষ্টা করলে ওর ঠিকানা হয়তো খুঁজে বার করতে পারবে। যতদিন না ঠিকানাটা পাওয়া যাচ্ছে অন্য ব্যাপারগুলো এগিয়ে রাখো।
কাজের লোকটি রণিতা আর অমিতেশের জন্য চা সন্দেশ এবং কেক নিয়ে আসে। মণিময়ের জন্য আনে শুধু আধ কাপ পাতলা লিকার।
খাও। খেতে খেতে কথা হোক। বলে নিজের কাপটি তুলে নিয়ে হালকা চুমুক দেন মণিময়। তারপর বলেন, নয়নতারার ছবিগুলো এর মধ্যে দেখে নাও। ওর নাটকের ভিডিও ক্যাসেট বা ফিল্ম যদি কেউ করে থাকে সে সবও দেখবে। ওগুলো থেকে কোন কোন অংশের ক্লিপিং তোমার ডকু-ফিচারে লাগাবে তার নোট করে রাখবে, নইলে পরে মনে থাকবে না।
কিন্তু—
বল।
ওঁর ছবি কোথায় পাব? আজকাল তো রেগুলারলি সিনেমা হলে ওগুলো দেখানো হয় না। মাঝে মাঝে দুচারটে নতুন করে রিলিজ করে। টিভিতে অবশ্য প্রায়ই দেখা যায়, তবে সব ছবি নয়।
একটু চিন্তা করে মণিময় বলেন, যে সব প্রোডাকশন কোম্পানি নয়নতারার ছবি করেছে তোমাকে তাদের কাছে যেতে হবে।
রণিতা জিজ্ঞেস করে, ওদের ঠিকানা কোথায় পাব?
আমার পুরনো ডায়েরিতে নয়নতারার কোন ছবি কবে রিলিজ করেছে, তার ডাইরেক্টর কে, কারা তার সঙ্গে অভিনয় করেছে, প্রোডিউসার কারা, তাদেব ঠিকানা, সব ডেট আর ইয়ার অনুযায়ী লেখা আছে। আমি একটা লিস্ট করে রাখব। নেক্সট উইকে এসে নিয়ে যেও।
আচ্ছা।
হঠাৎ কী মনে পড়ে যাওয়ায় মণিময় এবার বলে ওঠেন, তবে রণিতা জিজ্ঞাসু চোখে তাঁর দিকে তাকায়।
মণিময় বলেন, ওই সব প্রোডিউসারদের অনেকেই বেঁচে নেই, কেউ কেউ ছবির রাইটসুষ্ঠু প্রিন্ট বেচে কোম্পানি তুলে দিয়েছে।
রণিতা চিন্তিতভাবে বলে, তা হলে–
মণিময় বলেন, যাদের কাছে রাইট আছে তাদের সঙ্গে তোমাদের দেখা করতে হবে। যদি কিছু অসুবিধে হয় আমি ব্যবস্থা করে দেব। কিন্তু ওর নাটকের ভিডিও কারো কাছে আছে কিনা এক্ষুণি মনে পড়ছে না। আমার ডায়েরিতে যদি কোনো নোট থাকে, খুঁজে দেখতে হবে।
রণিতা জানায় নয়নতারার নাটকের ব্যাপারে তার বাবা অর্থাৎ ইন্দ্রনাথ তাকে সাহায্য করবেন।
মণিময় বলেন, তা হলে তো খুবই ভাল হয়। এর পাশাপাশি তোমাকে আরো কিছু জরুরি কাজ করতে হবে।
রণিতা বলে, কী?
নয়নতারার সঙ্গে কাজ করেছে এমন অনেক আর্টিস্ট, ডিরেক্টর এখনও বেঁচে আছেন, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কথা বলবে। তাছাড়া ওর আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গেও কথা বলা দরকার। এঁদের কাছ থেকে জেনে নিতে হবে নয়নতারা মানুষ এবং শিল্পী হিসেবে কেমন। আর ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে অভিনয় জীবনকে ভালভাবে মেশাতে না পারলে ডকু-ফিচারটা কিন্তু জমবে না। আমি তোমাকে যে লিস্টটা দেব তাতে নয়নতারার কো-অ্যাক্টর, কো-অ্যাকট্রেস আর ডিরেক্টরদের নাম ঠিকানা থাকবে। তুমি অবশ্যই তাদের সঙ্গে কনট্যাক্ট করবে।
কো-আর্টিস্ট আর ডিরেক্টরদের না হয় পাওয়া গেল কিন্তু ওঁর আত্মীয়স্বজনদের ঠিকানা কোথায় পাব?
অন্য আত্মীয়রা কোথায় থাকেন জানি না, তবে নয়নতারার শ্বশুরবাড়ির লোকজনেরা থাকতেন টালিগঞ্জে। আমার ধারণা এখনও ওঁরা ওখানেই আছেন। ওঁদের ঠিকানাটা বোধহয় দিতে পারব।
একটু চুপচাপ।
তারপর মণিময় জিজ্ঞেস করেন, বল, আমার কাছে আর কী সাহায্য চাও।
রণিতা হাসিমুখে, কিছুটা মজা করেই বলে, আপনি বলেছেন, যাঁরা নয়নতারাকে দেখেছেন বা ওঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছেন তাঁদের সঙ্গে ওঁর বিষয়ে যেন খুটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিই। এ কাজটা আপনাকে দিয়েই শুরু করতে চাই।
মণিময় হেসে ফেলেন, আমাকে দিয়েই? ঠিক আছে, আরম্ভ কর।
হঠাৎ মৃণালের হুঁশিয়ারি মনে পড়ে যায় রণিতার। স্ট্রোক হবার পর থেকে মণিময়ের বেশি কথা বলা বারণ। সে বলে, আপনাকে অনেকক্ষণ বকাচ্ছি। যদি ক্লান্তি লাগে আজ থাক, পরে একদিন বসা যাবে।
মণিময় জোরে জোরে দুহাত নেড়ে ক্লান্তির প্রসঙ্গটা উড়িয়ে দিয়ে বিপুল উৎসাহে বলেন, আমি ঠিক আছি, পারফেক্টলি অল রাইট। তোমাদের সঙ্গে নয়নতারার সম্বন্ধে কথা বলতে ভীষণ ভাল লাগছে।
প্রশ্নগুলো মনে মনে সাজিয়েই রেখেছিল রণিতা। সে বলে, খবরের কাগজ আর নানা ম্যাগাজিন থেকে জানতে পেরেছি, পাটিসানের পর নয়নতারা শশুর, শাশুড়ি, স্বামী, দুই দেওর আর এক ননদের সঙ্গে ইস্ট পাকিস্তান থেকে কলকাতায় চলে আসেন। তখন অবশ্য ওঁর নাম ছিল লক্ষ্মী রায়। দেশে কিছু প্রপার্টি ছিল, একটা পয়সাও আনতে পারেন নি। কলকাতায় প্রথমে উঠেছিলেন কালিঘাটে। অবস্থা খুবই খারাপ, দুবেলা খাওয়া জুটত না। কালিঘাটে ওঁদের প্রতিবেশী ছিলেন ফিল্মের একজন অ্যাসিস্টান্ট ডিরেক্টর। লক্ষ্মী ছিলেন অসাধারণ সুন্দরী। অ্যাসিস্টান্ট ডিরেক্টরটি বোঝাল সিনেমায় নামলে ভাল পয়সা পাওয়া যাবে। লক্ষ্মীদের রক্ষণশীল ফ্যামিলিতে গোড়ার দিকে এ নিয়ে প্রচণ্ড আপত্তি ছিল। কিন্তু পভার্টি, হাঙ্গার এমনই ব্যাপার যার সামনে কোনো বাধা কোনো ওজরই টেকে না। লক্ষ্মী সিনেমায় নামলেন। তবে ওরকম পুরনো ধাঁচের নাম গ্ল্যামার ওয়ার্ডে অচল, ওটা পালটে রাখা হল নয়নতারা। যে ডিরেক্টর এই নামকরণটা করেছেন তিনি নাকি বলেছিলেন, একদিন দর্শকদের চোখের মণি হয়ে উঠবেন লক্ষ্মী। সেই জন্যে এই নাম দেওয়া হল। নয়নতারার প্রথম চারটে ছবি ফ্লপ। ফিফথটা অ্যাভারেজ হিট, সিলথটা সুপারহিট, এই ছবি থেকেই তিনি স্টার। এর বেশি ইনফরমেশন আর পাওয়া যায় নি। এবার আপনি বলুন–
মণিময় বলেন, একেবারে প্রথম ছবি থেকেই নয়নতারার সঙ্গে আমার আলাপ। আজকের কথা নয়, সেই নাইনটিন ফিফটিতে একদিন স্টুডিওতে ওর শুটিং দেখতে গিয়ে চমকে উঠেছিলাম। এমন বিউটি ইন্ডিয়ান স্ক্রিনে আগে আর দেখা গেছে কিনা সন্দেহ। তবে সেই সময় ওর সৌন্দর্যের মধ্যে একটা গ্রাম্য ভাব মেশানো ছিল। উচ্চারণে ছিল পূর্ব বাংলার টান। দু-তিনটে ছবির পর এই দোষটা কাটিয়ে নেয় নয়নতারা, তার চেহারায় আসে সফিস্টিকেশন। এরপর তিনি যা বলে যান তা এইরকম। উচ্চারণ যেমনই হোক, প্রথম ছবিতেই নয়নতারা বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি একজন দুর্ধর্ষ অভিনেত্রী। তাঁর চলা, চোখমুখের অভিব্যক্তি এক কথায় অভাবনীয়। মণিময়ের তখনই মনে হয়েছিল, মেয়েটি অনেক দূর যাবে। অন্য কাগজ কিছু করার আগে তিনি মর্নিং স্টার-এ নয়নতারার পুরো এক পাতা ইন্টারভিউ ছেপেছিলেন। লিখেছিলেন এই অভিনেত্রীটি ভারতীয় দর্শকদের মাতিয়ে দেবে। তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছিল।
মণিময় একটানা কথা বলে কিছুটা হাঁফিয়ে পড়েছেন। আর তাঁকে দিয়ে বকানো ঠিক হবেনা। বিব্রতভাবে রণিতা বলে, আপনাকে অনেক কষ্ট দিলাম। যাবার আগে শুধু একটা প্রশ্নই করব। যদি উত্তর দিতে ইচ্ছে না হয়, দেবেন না।
মণিময় হাসেন, ঠিক আছে, কর।
রণিতা বলে, কাগজপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে নয়নতারা সম্পর্কে প্রচুর স্ক্যান্ডালও চোখে পড়ল।
মণিময় বলেন, অত বড় একজন অ্যাকট্রেস, তার ওপর প্যারাগন অফ বিউটি। ওর লাইফে স্ক্যাশ্যাল থাকবে না? ফিল্ম অ্যাকট্রেস মিশনারি নান নয়। স্ক্যাণ্ডালটা তার লাইফের সস–চাটনি। ওটা না থাকলে নয়নতারার এত চার্ম কি থাকত?
রণিতা বুঝতে পারছিল, মণিময় খুবই ঝকঝকে আধুনিক মানুষ, তাঁর মধ্যে বিন্দুমাত্র শুচিবাই নেই। সুনাম দুর্নাম নীচতা মহত্ত্ব, সব মিলিয়ে নয়নতারার যে জীবন, পুরোপুরি সেটাই তিনি সেলুলয়েডে দেখতে চান। এদেশে নামকরা মানুষদের নিয়ে যখন কেউ বায়োগ্রাফি লেখে কিংবা ডকুমেন্টারি ছবি করে, সেখানে শুধু ভাল ভাল দিকগুলোই ফুটিয়ে তোলা হয়। অর্থাৎ মানুষকে স্রেফ দেবতা বানাও। কোনো জননেতা যদি রক্ষিতা পোষে কিংবা অবৈধ প্রেমে ডুবে যায় বা কোনো ধর্মগুরু যদি ক্ষণিকের দুর্বলতায় নারীসঙ্গ করে বসে, তা হলে চোখ বুঝে থাকে। ফলে জীবনীগ্রন্থ আর ডকুমেন্টারিগুলোতে থাকে শুধু চড়া, উজ্জ্বল রং। অন্ধকার না থাকলে আলোর কনট্রাস্ট যে ফোটে না, সেটা এই সব জীবনীলেখক আর ডকুমেন্টারি করিয়েদের মাথায় কিছুতেই ঢোকানো যাবে না। তাদের ধারণা, খারাপ দিকগুলো দেখালে বিখ্যাত মানুষদের ইমেজ নষ্ট হবে, তাঁরা ভাববেন, তাঁদের চরিত্রহনন করা হচ্ছে।
মণিময় বলেন, নয়নতারার জন্যে একজন হিরো বিষ খেয়ে মরেছে, দুজন পিস্তল নিয়ে লড়াই করেছে, এই ইনফরমেশনগুলো নিশ্চয়ই পেয়েছ!
রণিতা আস্তে মাথা নাড়ে–পেয়েছে।
এক সময় এই নিয়ে সারা দেশ জুড়ে তুমুল সেনসেশন ঘটে গেছে। সে যাক, শেষের দুই হিরো এখনও বেঁচে আছে। ওদের সঙ্গে দেখা করে দেখো কিছু বার করতে পার কিনা।
নিশ্চয়ই দেখা করব। আজ তা হলে আসি।
এস।
রণিতা আর অমিতেশ উঠে দাঁড়ায়।
.
০৭.
আরও দু সপ্তাহ পার হল।
কদিন আগে সম্পাদক পরাশর বসুর পরামর্শমতো বক্স নাম্বার দিয়ে দৈনিক দিনকাল-এ নয়নতারা সম্পর্কে একটা নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। তার ফলে অভাবনীয় সাড়া পাওয়া গেছে। আড়াইশর মতো চিঠি পেয়েছে রণিতারা। পত্রদাতাদের দাবি, তারা খুব কাছ থেকে নয়নতারাকে দেখার সুযোগ পেয়েছে, কেউ কেউ ঘনিষ্ঠভাবে তাঁর সঙ্গে মেলামেশার কথাও বলেছে। কিন্তু তাদের চিঠি থেকে নতুন বা চমকপ্রদ কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি, সবগুলোই উচ্ছ্বাসের রঙিন ফেনায় ভর্তি।
এর মধ্যে প্রায় রোজই লালবাজারে রণজয়কে ফোন করেছে রণিতা কিন্তু এখনও ওঁরা নয়নতারার সন্ধান পাননি। চারদিকে লোক লাগানো রয়েছে, খোঁজ পেলেই জানিয়ে দেওয়া হবে।
যে প্রোডাকশন কোম্পানিগুলো নয়নতারাকে নিয়ে ছবি করেছে, গত দুসপ্তাহে তাদের অফিসে অফিসে অমিতেশকে সঙ্গে করে বোজ দুপুরে হানা দিয়েছে রণিতা। বেশির ভাগ কোম্পানি এখনও টিকে আছে, অবশ্য আগের রমরমা আর নেই। বেশ কটা উঠেও গেছে। চালু কোম্পানিগুলো ডকু-ফিচারের কথা শুনে খুব খুশি, জানিয়েছে রণিতাকে সবরকম সাহায্য করবে এবং যখনই সে নয়নতারার ছবি দেখতে চাইবে তখনই দেখানো হবে। বন্ধ হওয়া কোম্পানিগুলো তাদের ছবির নেগেটিভ আর প্রিন্ট যাঁদের কাছে বেচে দিয়েছে তাঁদেরও খুঁজে বার করেছে রণিতারা।নতুন স্বত্বাধিকারীরাও ওদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। এর ভেতর দশ-বারোটা ছবি দেখে ক্লিপিং এর জন্য ডায়েরিতে কিছু কিছু নোটও নিয়েছে ওরা।
প্রোডিউসারদের সঙ্গে নয়নতারা সম্পর্কে প্রচুর আলোচনাও হয়েছে রণিতার। তাঁদের সবাই জানিয়েছে, কাজের ব্যাপারে নয়নতারা ছিলেন ভীষণ খুঁতখুঁতে, সিরিয়াস। কোনো দৃশ্যে নিজের অভিনয় পছন্দ না হলে বার বার সেটা করে যেতেন, ফলে বার বার শট নিতে হত। অভিনয়টা নিখুঁত না হওয়া পর্যন্ত তাঁর তৃপ্তি নেই। ডিসিপ্লিনড় বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন তা-ই। তা ছাড়া অত্যন্ত সময়ানুবর্তীও। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে নয়নতারা কাজে লাগাতেন প্রায় কমপিউটারের দক্ষতায়। স্টুডিওতে দশটায় শিফট শুরু হলে ঠিক দশটাতেই চলে আসতেন। পাঁচ মিনিট আগেও না, পাঁচ মিনিট পরেও না। খুবই অমায়িক, মিশুক, সকলের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার ছিল এক কথায় চমৎকার। সবাই তাঁকে ভালবাসত, শ্রদ্ধা করত। টাকাপয়সার ব্যাপারে ছিলেন ভীষণ সচেতন, চুক্তি অনুযায়ী পাওনা মেটানো না হলে কাজ করতেন না।
নয়নতারার ব্যক্তিগত জীবন কেমন ছিল? প্রায় সব প্রোডিউসারই জানিয়েছেন এ নিয়ে তাঁরা কখনও মাথা ঘামান নি, অতএব কোনো মতামত দেওয়া সম্ভব নয়। দু-একজন বলেছেন, অনেক গোলমাল ছিল। মহিলাকে নিয়ে কত যে স্ক্যাশ্যাল বলে বোঝাতে পারব না। সেজন্য কাজের কিন্তু কোনো ক্ষতি হয়নি। ওঁকে দেখে টাকা লাগিয়েছি। ষোল আনার জায়গায় আঠারো আনা প্রফিট উঠে এসেছে। আমরা বিজনেস করি। আর্টিস্টরা কে কী করল, না করল তা নিয়ে টেনসন বাড়িয়ে আমাদের কী লাভ?
নয়নতারা যে পরিচালক এবং শিল্পীদের সঙ্গে কাজ করেছেন তাঁদের সঙ্গে কথা বলা যায়নি, পরে তাঁদের কাছে যাবে রণিতা।
তবে মুনলাইট থিয়েটারে-এর মালিক রমেন লাহার সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা হয়েছে। নয়নতারা যে সব নাটকে অভিনয় করেছেন তার বেশির ভাগেরই প্রযোজক তিনি। তাঁর যথেষ্ট বয়স হয়েছে, এখন আর হল-এ আসেন না, তাঁর ছেলে সুবিমল কবছর ধরে ব্যবসাপত্র দেখছেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে ইন্দ্রনাথ একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দিয়েছেন। আজ সকালে রমেন লাহার নর্থ ক্যালকাটার বাড়িতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাবে রণিতারা।
হেদুয়া আর স্কটিশ চার্চ কলেজ ডান ধরে রেখে কর্নওয়ালিস স্ট্রিট ধরে শ্যামবাজারের দিকে আরো খানিকটা এগিয়ে বাঁয়ে একটা মাঝারি রাস্তায় ঢুকে প্রথম দুটো বাড়ি ছেড়ে তিন নম্বরটাই হল লাহা ক্যাসল। সামনে পেছনে ফুলের বাগান। মাঝখানে বিবাট বিরাট থামওলা গোলাপি রঙের প্রকাণ্ড বাড়িটার দিকে তাকালে নাইনটিনথ সেঞ্চুরির বনেদিআনার কথা মনে পড়ে যায়।
সে আমলের পুরনো বড়লোকেরা আর নেই, লুপ্তপ্রায় প্রজাতির মতো তারা নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে। বিশাল প্যালেসের মতো তাদের বিরাট বিরাট বাড়িগুলো ভেঙেচুরে এখন প্রায় ধ্বংসস্তূপ। কিন্তু রমেন লাহারা তার ব্যতিক্রম। নতুন রং-করা হয়েছে তাঁদের বাড়িটায়, কোথাও এতটুকু ফাটল বা চিড়ের দাগ নেই। সব নিখুঁত, পরিচ্ছন্ন, অটুট। লাহা ক্যাসেলের পেছনে যে নিয়মিত প্রচুর টাকা খরচ করা হয়, দেখামাত্র তা টের পাওয়া যায়। সামনের দিকে বাগানের গা ঘেঁষে নতুন মডেলের ঝকঝকে গোটা চারেক মোটর যেমন রয়েছে তেমনি আছে দুটো ঘোড়ায় টানা ফিটন। ঘোড়া অবশ্য গাড়ির সঙ্গে জোতা নেই, সাদা ধবধবে স্বাস্থ্যবান একজোড়া প্রাণী পাশে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে পা ঠুকছে। বোঝা গেল, লাহারা নতুনের সঙ্গে পুরনো চালও বজায় রাখার পক্ষপাতী।
নটা নাগাদ লাহা ক্যাসেলে পৌঁছে যায় রণিতা আর অমিতেশ। তাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন সুবিমল। চল্লিশের কাছাকাছি বয়স। টকটকে রং, মাথার মাঝখান দিয়ে সিঁথি, বড় বড় চোখ, ভুরু দুটো যেন তুলিতে টানা। পাতলা নাকের নিচে বাহারে গোঁফ। এই সকাল বেলাতেই তিনি একেবারে ফিটফাট। পরিপাটি করে চুল আঁচড়ে নিয়েছেন। পরনে কারুকাজ-করা সাদা পাঞ্জাবি এবং জলচুড়িওলা কুঁচনো ধুতি, পায়ে হরিণের চামড়ার চটি, গা থেকে ভুর ভুর করে দামি সেন্টের গন্ধ উঠে আসছে। পুরনো বইয়ের পাতায় উনিশ শতকের বাবুদের যে ছবি থাকে তাদের একজন যেন সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
হাতজোড় করে সুবিমল বললেন, আসুন–
তাঁর পেছন পেছন বিশাল অলিন্দ এবং অনেকগুলো ঘর পেরিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে দোতলায় উঠে এল রণিতারা। চলতে চলতে ওদের চোখে পড়ছিল ঘরের দেওয়ালগুলো কম করে ষাট ইঞ্চি চওড়া। শ্বেতপাথরের ফ্লোর, বিশাল বিশাল ঝাড়বাতি, পার্সিয়ান কার্পেট, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড সোফা, খাট, টেবল, চেয়ার, অয়েল পেন্টিং, ব্রোঞ্জ আর পাথরের দুষ্প্রাপ্য ভাস্কর্য ইত্যাদি দেখতে দেখতে রণিতার মনে হচ্ছিল সত্যিকারের বড়লোকির সঙ্গে বনেদি চাল মেশালে তার ফলটা কী দাঁড়ায় তা বুঝতে হলে লাহা ক্যাসল-এ একবার আসা উচিত। তাদের বাড়িতেও মেহগনির আসবাব, শ্যান্ডেলিয়ার টিয়ার আছে, কিন্তু এ বাড়ির তুলনায় সে সব কিছুই না। মনে হল, ঝাড়লণ্ঠন, রুপোর ফুলদানি, কার্পেট, স্কালপচার, আসবাব, গালিচা মিলিয়ে কম করে তিরিশ চল্লিশ লাখ টাকার জিনিস আছে লাহা ক্যাসল-এ।
কিছুক্ষণের মধ্যে পাঁচশ স্কোয়ার ফিটের মতো বিশাল একটা ঘরে পৌঁছে যায় রণিতারা। ঘরটা আলমারি, ওয়ার্ডরোব, বুক-র্যাক, লেখাপড়ার জন্য চেয়ার টেবল, ওয়াল-ক্লক, ইত্যাদি দিয়ে সাজানো। সিলিং থেকে পুরনো আমলের চার ব্লেডওলা চারটে পাখা ঝুলছে। দুই দেওয়ালে দুটো এয়ার কুলার। ঘরের ঠিক মাঝখানে কারুকাজ করা মেহগনির খাট। খাটটা ঘিরে বেশ কটি সোফা আর একটা টিপয়ের ওপর গোটা চারেক রঙিন টেলিফোন। খানিকটা দূরে সুদৃশ্য স্ট্যান্ডে দামি কালার টিভি।
খাটের ওপর তিন ফুট উঁচু গদির ওপর যিনি শুয়ে আছেন তিনি যে রমেন লাহা সেটা বলে না দিলেও চলে। বয়সটা কম আর স্বাস্থ্যটা ভাল হলে অবিকল সুবিমলের জোড়া মনে হত। দেখেই বোঝা যায় রোগে যথেষ্ট কাবু হয়ে পড়েছেন। মুখ শীর্ণ, চামড়া কুঁচকে গেছে, চুলের বেশিটাই সাদা, তবু এই অবস্থাতেও পোশাকে আশাকে নাইনটিনথ সেঞ্চুরির পরিপাটি বাবুটি।
সুবিমল আলাপ করিয়ে দিতে রমেন লাহা হাতজোড় করে বললেন, বসুন মা, আপনিও বসুন বাবা–বলে সোফাগুলো দেখিয়ে দেন। তাঁর কাছে যে দর্শনার্থীরা আসে, ওগুলো যে তাদের জন্য বুঝতে অসুবিধা হয় না।
রণিতা আর অমিতেশ নমস্কার জানিয়ে বসে পড়ে। রণিতা বলে, আমরা অনেক ছোট। তুমি করে বলুন।
রমেন একটু হাসেন শুধু। তারপর বলেন, অপরাধ ক্ষমা করবেন। কোমর থেকে নিচের দিকের পুরোটাই আথারাইটিসে পঙ্গু হয়ে আছে। বসতে পারি না, শুয়ে শুয়েই আমাকে কথা বলতে হবে।
বোঝা যায় যে কোনো বয়সের অনাত্মীয়দের আপনি করে বলাটা রমেন লাহার অভ্যাস। আপত্তি করলেও শুনবেন না। রণিতা আর অমিতেশ ব্যস্তভাবে বলে, না না, আপনাকে উঠে বসতে হবে না। শুয়ে শুয়ে কথা বলুন, আমরা কিছু মনে করব না।
একটি বয়স্ক কাজের মেয়ে বড় সাইজের সন্দেশ, রাজভোগ, কাজু বাদাম আর কফি দিয়ে যায়। খুব সম্ভব আগেই বলা ছিল।
দারুণ বনেদি শিষ্টাচার বাবা এবং ছেলের। বিনীতভাবে বলেন, খান।
কয়েকটা করে কাজু, একটা করে সন্দেশ আর কফির কাপ তুলে নেয় রণিতারা। রমেন বা সুবিমল আরও মিষ্টি-টিষ্টি নেবার জন্য জোর করেন না। তাঁরা জানেন পীড়াপীড়ি করাটা অশিষ্টতা।
রমেন রণিতাকে বলেন, আমার হাল তো দেখছেন। আজকাল বাইরের লোকজনের সঙ্গে দেখা করি না, আসলে শরীরটা সব গোলমাল করে দিয়েছে কিন্তু আপনার বাবা মানে ইন্দ্রনাথবাবু ছেলের মারফত অনুরোধ করেছেন আপনাকে খানিকটা সময় দিতে হবে। তাঁর হুকুম অমান্য করার সাধ্য আমার নেই।
অভিভূত রণিতা বলে, আপনাকে কী বলে যে কৃতজ্ঞতা জানাব।
হাত তুলে তাকে থামিয়ে দেন রমেন, কৃতজ্ঞতার প্রশ্ন নেই।ইন্দ্রনাথবাবুঅতি সজ্জন, পণ্ডিত মানুষ। তাঁকে আমরা শ্রদ্ধা করি। যতদিন সুস্থ ছিলাম প্রায়ই মুনলাইট এ থিয়েটার দেখতে আসেতেন। নাটকের দুর্দান্ত সমঝদার। ছেলে যখন ওঁর কথা বলল আমি তক্ষুনি রাজি হয়ে গেলাম। একটু চুপ করে থেকে ফের শুরু করেন, সুবিমল বলছিল, আপনারা আমার কাছে নয়নতারা সম্পর্কে জানতে চান।
রণিতা বলে, আজ্ঞে হ্যাঁ।
সুবিমল দাঁড়িয়ে ছিলেন, বললেন, আপনারা বাবার সঙ্গে কথা বলুন। আমার জরুরি একটা কাজ আছে। বেরুতে হবে।
রমেন বলেন, ড্রাইভারদের কাউকে বলে দিও, কথা হয়ে গেলে ওঁরা যেখানে যেতে চান সেখানে যেন পৌঁছে দেয়।
এটাই হয়তো এ বাড়ির নিয়ম, তাই রণিতারা আপত্তি করে না। সুবিমল বলেন, জগমোহনকে বলে যাচ্ছি।
সুবিমল চলে গেলে রমেন রণিতাদের দিকে চোখ ফেরান, কী জানতে চান বলুন–
রণিতা ডকু-ফিচারটা সম্পর্কে সব জানিয়ে বলে, নয়নতারা যে একুশটা নাটকে অভিনয় করেছিলেন তার পনেরো ষোলটা তো আপনারা প্রোডিউস করেছেন?
শুধরে দিয়ে রমেন বলেন, সতেরোটা।
নয়নতারা কিভাবে স্টেজে এলেন, থিয়েটারে তাঁর পারফরমেন্স কেমন, কিরকম ছিল তাঁর ব্যক্তিজীবন, এ সব সম্পর্কে আপনার যা যা মনে আছে বলুন। কিছু বাদ দেবেন না।
কিছুক্ষণ চুপ করে ভেবে নিলেন রমেন লাহা। তারপর শুরু করলেন। তাঁর বলার ভঙ্গিটি চমৎকার, কোনোরকম তাড়াহুড়ো নেই। ধীরে ধীরে নয়নতারার অন্য এক ছবি চোখের সামনে ফুটে উঠতে লাগল।
নয়নতারা তাঁর অভিনয় জীবন আরম্ভ করেছিলেন ফিল্ম দিয়ে। প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশটা ছবিতে নায়িকার রোল করার পর তাঁকে স্টেজে নিয়ে আসেন রমেন লাহা। নয়নতারার বিপুল জনপ্রিয়তা আর গ্ল্যামারকে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন তিনি। সেদিক থেকে তাঁর পরিকল্পনা শতকরা একশ ভাগ সফল।
নয়নতারা স্টেজে যোগ দেবার আগে বেশ কয়েক বছর থিয়েটারের হাল খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে মুনলাইট এর অবস্থা কহতব্য নয়। পর পর নাটক মার খাচ্ছিল। টায়টোয় প্রোডাকশনের খরচটাও উঠত কিনা সন্দেহ। আসলে দর্শকরা নাটক সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল। নয়নতারা স্টেজে আসার সঙ্গে সঙ্গে থিয়েটারে একটা চনমনে ভাব দেখা দিল। এর সুফল শুধু রমেনবাবুরাই নন, অন্য থিয়েটার কোম্পানিগুলোও পেল। ঝাঁকে ঝাঁকে দর্শক থিয়েটার পাড়ার দিকে আসতে লাগল। মুনলাইট-এর যে সতেরোটা নাটকে নয়নতারা অভিনয় করেছেন তার প্রত্যেকটা রেকর্ড ব্যবসা করেছে। পরে অবশ্য এপিক থিয়েটার অনেক বেশি টাকা দিয়ে তাঁকে ভাঙিয়ে নিয়ে যায়। ওদের চারটে নাটকও চুটিয়ে ব্যবসা করেছে।
ফিল্ম থেকে স্টেজে এসে গোড়ার দিকে একটু অসুবিধা হয়েছিল নয়নতারার। কেননা থিয়েটার অ্যাক্টিংটা একেবারে ভিন্ন ধরনের। ফিল্মে ভুলচুক হলে শুধরে নেওয়া যায় কিন্তু স্টেজে তার সুযোগ নেই। উন্মুখ দর্শকের সামনে দাঁড়িয়ে বা বসে একবারেই যা করার করতে হবে। প্রথম তিনটে শো-এ সংলাপ ভুলে গিয়েছিলেন নয়নতারা, প্রম্পটার উইংসের পাশ থেকে খেই ধরিয়ে দেবার পর অবশ্য তাড়াহুড়ো করে সেগুলো বলেছেন কিন্তু অভিব্যক্তিতে গোলমাল হয়ে গিয়েছিল। তিনটে শো-এর পর আর কোনো ত্রুটি ছিল না। অসীম একাগ্রতায় স্টেজ অ্যাক্টিংটা চমৎকার রপ্ত করে নিয়েছিলেন নয়নতারা। অভিনয় বলতে তাঁর কাছে শুধু পরিচালকের নির্দেশমতো নিখুঁতভাবে হাত-পা নাড়া বা সংলাপ বলে যাওয়া নয়, তার সঙ্গে তিনি মেশাতেন আশ্চর্য এক ব্যক্তিত্ব আর সৃজনশীলতা যা শুধু একজন মহান শিল্পীর পক্ষেই সম্ভব।
কাজের প্রতি নয়নতারার নিষ্ঠা ছিল অভাবনীয়। যে চরিত্রেই তিনি অভিনয় করতেন, তাতে একেবারে মগ্ন হয়ে যেতেন। সেখানে এতটুকু ফাঁকি নেই। ফিল্ম প্রোডিউসারদের মতো বমেনবাবুও জানালেন, নয়নতারা ছিলেন অত্যন্ত ডিসিপ্লিনড আর পাংচুয়াল। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে সময় মিলিয়ে তিনি শো টাইমের আগে হল-এ আসতেন, নিজের সাজঘরে বসে মেক-আপ নিতেন। শো এর পর এক মিনিটও নষ্ট না করে বাড়ি ফিরে যেতেন। দশ বছরে সতেরোটা নাটক করেছেন কিন্তু নেহাত অসুস্থ হয়ে না পড়লে সময়ের এতটুকু হেরফের কখনও হয়নি।
রমেনবাবু প্রায় পঞ্চাশ বছর থিয়েটারে ছিলেন, তাঁর হাড়ে-মজ্জায় নাটক। পুরনো আমলের তিনকড়ি দাসী, বিনোদিনী বা তারাসুন্দরীদের কথা বলতে পারবেন না, তবে তাঁর দেখা অভিনেত্রীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছেন নয়নতারা। এর মতো শিল্পী গত অর্ধ শতাব্দীতে আর দেখা যায়নি।
মুন লাইট-এ যোগ দেবার পরও ফিল্ম ছাড়েননি নয়নতারা। এই সময়টা তাঁর জীবনের পিক পিরিয়ড। একদিকে যেমন অজস্র টাকা, খ্যাতি আর । জনপ্রিয়তা, অন্যদিকে তাঁকে ঘিরে তখন প্রচুর কুৎসা। তা গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডের মক্ষীরানীদের নিয়ে এসব তো বটেই। তবে সত্যমিথ্যা জানেন না রমেনবাবু।
বোঝা যাচ্ছিল, মেয়ের বয়সী রণিতাকে নয়নতারার স্ক্যাশাল নিয়ে কিছু বলতে তাঁর রুচিতে বাধছিল। প্রসঙ্গটা তিনি দ্রুত থামিয়ে দেন।
রণিতা এ ব্যাপারে আর কোনো প্রশ্ন করে না। বলে, আচ্ছা, এতগুলো নাটকে যে নয়নতারা অভিনয় করেছেন তার কোন ভিডিও বা ফিল্ম করে কি রাখা হয়েছে?
চোখ কুঁচকে মনে করতে চেষ্টা করেন রমেনবাবু। তারপর বলেন, কেষ্টপদ ঘোষাল বলে একজন নয়নতারার দুটো নাটকের ভিডিও করেছিল বছর দশেক আগে।
সে দুটো কি এখনও ঠিক আছে? নষ্ট হয়ে যায়নি?
ও প্রতি বছর ক্যাসেট পালটে পালটে প্রিজার্ভ করে যাচ্ছিল। লাস্ট ইয়ারে কি তার আগের ইয়ারে প্রোজেকসান করে এই ঘরে আমাকে দেখিয়েও গিয়েছিল। তবে সেগুলোর হাল এখন কী দাঁড়িয়েছে, বলতে পারব না।
কেষ্টপদবাবুর ঠিকানা পাওয়া যেতে পারে?
নিশ্চয়ই। ওর ফোনও আছে। বলে পড়ার টেবলের ওপর একটা লাল রঙের ডায়েরির দিকে আঙুল বাড়িয়ে দেন রমেনবাবু, একটু কষ্ট করে যদি ওটা আনেন–
অমিতেশ ডায়েরিটা নিয়ে আসে। সেটার পাতা উলটে উলটে একটা নম্বর বার করে অমিতেশকে বলেন, এটা ধরে দয়া করে ফোনটা আমাকে দিন।
একবার ডায়াল করেই কেষ্টপদকে পাওয়া গেল। রমেনবাবু তার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলেন, ক্যাসেট দুটো ভালই আছে। রণিতাদের জিজ্ঞেস করলেন, কবে আপনারা দেখতে চান?
রণিতা বলে, কেষ্টপদবাবুর অসুবিধে না হলে আজই দেখতে পারি।
কখন দেখবেন?
উনি রাজি হলে আপনার এখান থেকে বেরিয়ে সোজা ওঁর কাছে চলে যাব।
কেষ্টপদকে সেই কথাই বলা হল। সেই সঙ্গে নাটক দেখার উদ্দেশ্য ও। কেষ্টপদ জানাল, রণিতাদের জন্য অপেক্ষা করবে। যতক্ষণ না তারা যাচ্ছে, বাড়ি থেকে বেরুবে না।
রমেনবাবু ফোন নামিয়ে রেখে বলেন, আমার কাছে আর কিছু জানার আছে?
এক্ষুনি মনে পড়ছে না। তবে একটা ব্যাপারে আমাদের আরেক দিন আসতে হবে।
যখন ইচ্ছা ফোন করে চলে আসবেন। কিন্তু যে ব্যাপারের কথা বললেন সেটা কী?
আমার ডকু-ফিচারের শুটিং যখন শুরু হবে তখন নয়নতারার স্টেজ কেরিয়ার সম্পর্কে আপনার একটা ইন্টারভিউ নেব। ওটা ছবিতে থাকবে।
রমেন লাহা মৃদু হাসেন। বলেন, আবার আমাকে কেন?
রণিতা বলে, আপনাকে বাদ দিয়ে নয়নতারার লাইফ ইনকমপ্লিট। আমার ছবিতে আপনাকে থাকতেই হবে।
রমেন আর কিছু বলেন না।
রণিতা এবার বলে, আট বছর নয়নতারা নিরুদ্দেশ হয়ে আছেন। ওঁকে কোথায় পাওয়া যেতে পারে, আপনার ধারণা আছে?
রমেন লাহা অস্তে মাথা নাড়েন, না, একেবারেই না। আমি তো শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে আছি দুবছর। বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ একরকম নেই বললেই হয়। নয়নতারার খবর কিভাবে পাব? একটু থেমে বলেন, ওঁর মতো আর্টিস্ট অভিনয় ছেড়ে দিলেন, এটা আমাদের মস্ত বড় ক্ষতি। তাঁর মুখে বিষাদের ছায়া পড়ে।
আরো কিছুক্ষণ পর কেষ্টপদ ঘোষালের ঠিকানা নিয়ে অমিতেশ আর রণিতা বিদায় নেয়।
.
সুবিমল আগেই ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। ওঁদের ড্রাইভার জগমোহন বেলেঘাটার এক গলিতে কেষ্টপদ ঘোষালদের শ্যাওলা-ধরা, পুরনো, ভাঙাচোরা একতলা বাড়ির সামনে রণিতাদের নামিয়ে দিয়ে ফিরে যায়।
সামনের শান-ধাঁধানো রোয়াকে তাদের জন্য বসে ছিলেন কেষ্টপদ। গায়ের রং বেশ কালো। মাঝারি হাইটের তেউড়ে-যাওয়া, ক্ষয়টে চেহারা ভদ্রলোকের। বিখ্যাত থিয়েটার হল-এর মালিক এবং প্রোডিউসার রমেন লাহা ফোন করে রণিতাদের কথা বলেছেন, তাই যথেষ্ট খাতির করে একটা ঘরে এনে ওদের বসান। কেষ্টপদ।
কথায় কথায় জানা যায়, কেষ্টপদ ঘোষাল নাটক এবং ফিল্মের একজন স্টিল ফোটোগ্রাফার। নানা ম্যাগাজিন আর খবরের কাগজে ফোটো বিক্রি করাটাই তাঁর জীবিকা। তবে কবছর ধরে নানা অনুষ্ঠনের ভিডিও ক্যাসেটও করছেন। এতে রোজগারটা অনেক বেড়েছে। কেষ্টপদ বেশ দূরদর্শী। তাঁর মনে হয়েছিল নয়নতারার নাট্যাভিনয়ের ক্যাসেট করে রাখা দরকার, ভবিষ্যতে এর চাহিদা হবে বিপুল, দামও পাওয়া যাবে প্রচুর। তবে নানা কারণে দুটোর বেশি ক্যাসেট করা যায়নি। আর সে দুটো সম্ভব হয়েছিল রমেন লাহার অনুগ্রহে। সেজন্য তিনি কোনো অনুরোধ করলে না বলতে পারেন না কেষ্টপদ।
এরপর দুই নাটকের ক্যাসেট দেখানো হয়। কী বিরাট ক্ষমতাময়ী অভিনেত্রী যে নয়নতারা সেটা ক্যাসেট দেখতে দেখতে টের পাচ্ছিল রণিতারা। স্ক্রিন পার্সোনালিটির মতো তাঁর স্টেজ পার্সোনালিটিও এক কথায় দুর্দান্ত।
নাটক দেখা শেষ হল বিকেল পাঁচটায়। এর ভেতর কোন কোন অংশ ডকু-ফিচারে কাজে লাগাবে, টুকে নিয়েছে রণিতা। সে বলে, আপনার ক্যাসেট থেকে দুচারটে ঘোট ক্লিপিং আমাদের ছবিতে ব্যবহার করতে চাই। আপনার আপত্তি নেই তো?
কেষ্টপদ বলে, না না। রমেনবাবু আপনাদের পাঠিয়েছেন। যতগুলো ইচ্ছা নিতে পারেন।
রণিতা বলে, এর জন্যে আমরা কিছু টাকা দেব। আপনি কিরকম আশা করেন?
কেষ্টপদ একমুখ হাসে। বলে, আবার টাকা কেন? তা আপনাদের যখন ইচ্ছে যা ভাল মনে করেন দেবেন।
কতটা কী দেওয়া যায়, আমরা একটু ভাবি। তারপর পেমেন্টের ব্যবস্থা করব।
.
০৮.
আরো দশ দিন পরও অবস্থার কোনোরম হেরফের নেই। পুলিশ এখনও অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছে কিন্তু নয়নতারাকে পাওয়া যায়নি। তবে রণজয় আগের মতোই আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন, তাঁকে খুঁজে বার করবেনই।
দিনকাল-এর বক্স নাম্বারে দ্বিতীয় নোটিশটাও এর ভেতর বেরিয়ে গেছে। ফলে চিঠির বান ডেকেছে। রোজ পঞ্চাশ ষাটটা করে চিঠি আসছে। তবে প্রয়োজনীয় তথ্য তার কোনোটাতেই নেই। অবশ্য একজন ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টের স্ত্রী আর একজন বড় কনট্রাক্টর-কাম-প্রামোটারের স্ত্রী দুটো চমকপ্রদ চিঠি লিখেছেন। ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টের স্ত্রী মল্লিকা আগরওয়ালের বক্তব্য, নয়নতারার একটা হিপনোটিক পাওয়ার আছে, সেকালের মোহিনীদের মতো সে ছলাকলা তুকতাক জানে। সে এমনই বশীকরণ করেছিল যে মল্লিকার স্বামী কিষেণলাল আগরওয়াল একেবারে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন, তাকে পাবার জন্য তিনি যাবতীয় প্রোপার্টি আর কোম্পানির শেয়ার তার নামে লিখে দেবার ব্যবস্থা করেছিলেন। ইন্ডাস্ট্রি সার্কেলে এই নিয়ে প্রচণ্ড হই-চই শুরু হয়ে গিয়েছিল। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের কাছে মুখ দেখানো যাচ্ছিল না। নিরুপায় মল্লিকা তখন পুলিশ কমিশনার, হোম সেক্রেটারি আর মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। তাঁরা বুঝিয়ে সুঝিয়ে, কখনও ভয় দেখিয়ে উদ্ভ্রান্ত কিষেণলালের মোহ কাটিয়ে দেন। আগরওয়াল বংশ একটা বড় রকমের কেলেঙ্কারি থেকে রক্ষা পায়। তাঁদের বিষয় সম্পত্তিও হাতছাড়া হয় না। এরপর থেকে মল্লিকা তাঁর স্বামীকে চোখে চোখে রাখছেন, এক পলকের জন্য হাতের মুঠো থেকে বেরুতে দেন না।
কনট্রাক্টর-কাম-পোমোটারের স্ত্রী রাজেশ্বরী তরফদার জানিয়েছেন, তাঁর স্বামী উমাপতি তরফদারও নয়নতারার জন্য ঘাড় গুঁজে পড়েছিলেন। তিনি কিন্তু পুলিশ কমিশনার বা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ছোটাছুটি করেন নি, কোমরে আঁচল জড়িয়ে সোজা নয়নতারার বাড়িতে চড়াও হয়েছিলেন, আক্ষরিক অর্থেই নাকি জুতা পেটা করে তাঁর বিষ ঝেড়ে দিয়েছিলেন। স্বামীকেও রেয়াত করেন নি, নিজেদের পাড়ায় তুমুল চেঁচামেচি করে লোকজন জড়ো করে ফেলেছিলেন। তারপর উমাপতির কুকীর্তি সাতকাহন করে তাদের জানিয়েছিলেন। এই ঘটনার পর উমাপতি এক মাস বাড়ির বার হতে পারেন নি। রাজেশ্বরীর আগুনখাকির মত চেহারা দেখে নয়নতারা আর উমাপতি নাকি একেবারে মিইয়ে গিয়েছিলেন।
এর মধ্যে সাতজন পরিচালকের সঙ্গে দেখা করেছে রণিতা আর অমিতেশ। তাঁদের কাছ থেকেও বিশেষ কিছু পাওয়া যায়নি। থিয়েটারের রমেন লাহা বা সিনেমার প্রোডিউসাররা যা বলেছেন হুবহু তাই জানিয়েছেন ওঁরা।
ফিল্মের যে দুই হিরো একদা নয়নতারার জন্যে ডুয়েল লড়েছিলেন তাঁরা হলেন চিরঞ্জীব এবং অমলকুমার। দুজনেই একসময় ছিলেন ম্যাটিনি আইডল। ওঁদের সঙ্গেও দেখা করেছে রণিতারা।
চিরঞ্জীব আর অমলকুমার, দুজনেরই বয়স সত্তরের কাছাকাছি। দুটো ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকের পর চিরঞ্জীব অভিনয় ছেড়ে দিয়েছেন। স্ত্রী মারা গেছেন ক বছর আগে। এখন দুই ছেলে, দুই পুত্রবধু, নাতি-নাতনি আর পুরনো সোনালি দিনের স্মৃতি নিয়ে তাঁর সম্পূর্ণ অবসরের জীবন। বই পড়ে, টিভি দেখে, নাতি নাতনিদের সঙ্গে খুনসুটি করে সময় কেটে যায়।
অমলকুমার অবশ্য অভিনয় ছাড়েন নি। ছোট্ট ফ্যামিলি তাঁদের। তিনি আর স্ত্রী। একমাত্র ছেলে কানাডার ন্যাশনালিটি নিয়েছে, এদেশে ফেরার আর সম্ভাবনা নেই। সওরেও পুরোপুরি সুস্থ আছেন, মজবুত স্বাস্থ্য, একটা দাঁতও পড়েনি। চুল অবশ্য সাদা হয়ে গেছে। টাকা-পয়সার অভাব নেই কিন্তু সময় তো কাটাতে হবে, তাই অভিনয়টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এই বয়সে সিনেমার নায়ক হওয়া যায় না। নায়কের কাকা, বাবা ইত্যাদি রোল নিয়েই তাঁকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়।
চিরঞ্জীবের সঙ্গে দেখা করে রণিতারা নয়নতারার প্রসঙ্গ তুলতে তিনি তাঁর এক কালের নায়িকার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন। কিন্তু অমলকুমারের সঙ্গে সেই পিস্তলের লড়াই সম্পর্কে জানতে চাইলে একেবারে হকচকিয়ে যান। বিব্রতভাবে বলেন, পাস্ট ইজ পাস্ট। প্লিজ ও ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করো না। ছেলে, ছেলের বউ, নাতি-নাতনি নিয়ে শেষ জীবনে শান্তিতে আছি। সবাই আমাকে ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে। পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ বছর আগে কী হয়েছিল, কী করেছিলাম, সে সব এতদিন বাদে খুঁচিয়ে বার করে পারিবারিক শান্তি নষ্ট করে কী লাভ?
কাজেই আর কোনো প্রশ্ন করেনি রণিতা।
অমলকুমারের জীবনদর্শন একেবারে উলটো। তাঁর কাছে গিয়ে নয়নতারার কথা তুলতে প্রায় লাফিয়ে ওঠেন। বলেন, মিডিয়া শুধু নায়ক নায়িকাদের নিয়ে মাতামাতি করে। আমরা ক্যারেক্টার আর্টিস্টরা তাদের চোখে ফালতু। লোকে আমাকে প্রায় ভুলেই গেছে কিন্তু আমিও একদিন হিরো ছিলাম রে বাবা-মাকে বলে ম্যাটিনি আইডল। এই সুযোগে একটা জব্বর পাবলিসিটি পেয়ে যাব, না কী বল?
রণিতা একটু হাসে।
অমলকুমার বলেন, আই অ্যাম নট আ পিউরিটান। আমার কোনো শুচিবাই নেই। নয়নতারা ছিল সেক্স বম্ব। এমন ভোলাপচুয়াস উইম্যান আমার জীবনে আর কখনও দেখিনি। এর জন্যে মানুষ সর্বস্ব বাজি ধরতে পারে। আমিও ধরেছিলাম। কিন্তু আমার একজন রাইভাল ছিল–অ্যানাদার ম্যাটিনি আইডল চিরঞ্জীব। সেই সময়ের কাগজপত্র যদি নাড়াচাড়া কর দেখতে পাবে নয়নতারার জন্য আমরা ডুয়েল লড়েছিলাম। আমি সিরিয়াসলি উডেড হয়েছি। নয়নতারার মতো একটি নারীর জন্যে প্রাণ দিয়েও সুখ। এক হিরোইনকে নিয়ে দুই হিয়োর পিস্তল-যুদ্ধ হয়েছে। তার ফলে সারা দেশ জুড়ে কী ধরনের সেনসেসন হতে পারে, নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছ।
রণিতা মাথা হেলিয়ে বলে, তা পারছি। তারপর কী হল?
ঠোঁট টিপে, চোখ আধাআধি বুজে, মুখে ফিচেল হাসি ফুটিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে অমলকুমার বলেন, অশ্বডিম্ব, কিছুই হল না। পুলিশ ভয় দেখালে নয়নতারার আশা ছেড়ে দিয়ে চিরঞ্জীব আর আমি যদি নিজেদের মধ্যে আপস করে না নিই, কেসটা কোর্ট পর্যন্ত গড়াবে। দুজনেরই জেল-টেল হয়ে যেতে পারে। সুনাম তো যথেষ্টই নষ্ট হয়েছে, ভবিষ্যৎ ও নষ্ট হয়ে যাবে। জেলফেরত দাগী লোকেদের সোসাইটিতে জায়গা নেই। সুড় সুড় করে দুজনে যে যার ফ্যামিলির খাঁচায় ঢুকে পড়লাম। মাঝখান থেকে নয়নতারার সঙ্গে ছবি করা বন্ধ হয়ে গেল। সে অন্য হিরোর সঙ্গে কাজ করতে লাগল।
এরপর নয়নতারার সঙ্গে আর দেখা হয় নি?
হয়েছে কয়েক বার। কিন্তু সে কথা বলে নি।
একটু চুপচাপ।
তারপর রণিতা জিজ্ঞেস করে, আপনি যা বললেন তা কি আমার ডকু ফিচারে রাখতে পারি?
অমলকুমার বলেন, সবটা। একটা কমা, সেমিকোলনও বাদ দেবে না। আজকের জেনারেশন জানুক এক সময় আমার মধ্যেও বারুদ ছিল।
মণিময়ের কাছ থেকে ঠিকানা জোগাড় করে এর মধ্যে রণিতা আর অমিতেশ টালিগঞ্জে কুঘাটের কাছে নয়নতারার শ্বশুরবাড়িতেও গিয়েছিল কিন্তু ভেতরে ঢুকতে পারেনি।
একটি লোক– পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স, থলথলে ভারি চেহারা, নাকের নিচে চৌকো গোঁফ, চোয়াড়ে মুখ, চোখে চতুর চাউনি–দরজা খুলে জিজ্ঞেস করেছিল, কাকে চান?
মণিময় জানিয়ে দিয়েছিলেন, নয়নতারার শ্বশুর এবং স্বামী বেঁচে নেই। তাঁর এক দেওর, নাম অবিনাশ, এখন বাড়ির কর্তা। রণিতারা যেন তার সঙ্গে দেখা করে, তবে লোকটা খুব সুবিধার নয়।
রণিতা বলে, অবিনাশবাবুর সঙ্গে দেখা করব।
আমিই অবিনাশ। কী দরকার?
ফেমাস অ্যাকট্রেস নয়নতারা দেবী তো আপনাদের আত্মীয়। ওঁর সম্বন্ধে আপনার কাছে কিছু প্রশ্ন আছে।
অবিনাশের জোড়া লোমশ ভুরু কুঁকড়ে যায়। কর্কশ গলায় সে বলে, ওই বেশ্যার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আপনারা যেতে পারেন। বলে দড়াম করে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেয়।
এমন অভদ্র, ইতর লোক আগে আর কখনও দেখেনি রণিতারা। ছবির জন্য মেটিরিয়াল জোগাড় করতে এসে ভালই অভিজ্ঞতা হল।
দাঁতে দাঁত চেপে অমিতেশ শুধু বলে, স্কাউন্ড্রেল।
.
০৯.
ডকু-ফিচারের কাজ কতটা এগুচ্ছে, সারা দিনে কার কার সঙ্গে দেখা হয়েছে, তাদের কাছ থেকে কী ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে, তার খুঁটিনাটি বিবরণ রোজ রাতে খাবার টেবলে বসে রণিতাকে দিতে হয়। সব শোনার পর নানারকম পরামর্শ দেন ইন্দ্রনাথ। আজ খাওয়ার পর দোতলায় উঠে সোজা রণিতার সঙ্গে তার ঘরে চলে এলেন তিনি। বলেন, তোর সঙ্গে একটা দরকারি কথা আছে।
রণিতা জিজ্ঞেস করে, কী কথা বাবা?
সেই ছেলেটিকে কবে আমার কাছে নিয়ে আসতে পারবি?
ইন্দ্রনাথ যে অমিতেশের কথা বলছেন, বুঝতে অসুবিধা হয় না রণিতার। তার মতো ঝকঝকে, স্মার্ট মেয়েও বেশ একটু লজ্জা পায়, তার মুখে পলকের জন্য রক্তাভা ফুটে ওঠে। মুখ নামিয়ে নিচু গলায় বলে, তুমি যেদিন বলবে।
একটু চিন্তা করে ইন্দ্রনাথ বলেন, ধর, পরশু দিন।
আচ্ছা।
একটু চুপচাপ।
তারপর রণিতা জিজ্ঞেস করে, অমিতেশকে বাড়িতে নিয়ে আসব?
ইন্দ্রনাথ চকিত হয়ে ওঠেন, না না, বাড়িতে না। তোর মা আছে এখানে, মুশকিল হয়ে যাবে।
তবে?
কোনো ভাল রেস্তোরাঁয়। ধর, আমি ছেলেটিকে চা খেতে ইনভাইট করছি।
বাবার মুখের দিকে তাকায় রণিতা। মজার গলায় বলে, তুমি খুব মডার্ন হয়ে গেছ বাবা।
মানে?
নইলে কেউ রেস্তোরাঁয় ইনভাইট করে!
ইন্দ্রনাথ সামান্য হেসে বলেন, বাড়িতে আনার উপায় নেই। তোর কাকা কি পিসিদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। হাজার রকমের কৌতূহলের। জবাব দিতে হবে। পার্কে কি ভিক্টোরিয়ার বাগানে নিয়েও ছেলেছোকরাদের মতো বসতে পারি না। তাই–
বুঝেছি–রণিতাও হেসে ফেলে। পরক্ষণে তাকে বেশ চিঙ্গিত দেখায়। বলে, আচ্ছা বাবা
কী রে?
তুমি বলেছিলে আমাদের রিলেটিভদের সব জানিয়ে অমিতেশের সঙ্গে কথা বলবে–
হাঁ, বলেছিলাম। পরে ভেবে দেখলাম, অমিতেশের সঙ্গে আগেই কথাটা বলি। একটা কাজ এগিয়ে রাখি।
পরশু কোন রেস্তোরাঁয় ওকে যেতে বলব?
তোরাই ঠিক করে আমাকে বলিস। আমি চলে যাব। বিকেলের দিকে হলে ভাল হয়।
ঠিক আছে।
একটু চুপচাপ।
তারপর রণিতা বলে, একটা কথা জিজ্ঞেস করব বাবা?
ইন্দ্রনাথ বলেন, কর না–
তুমি বোধ হয় দেখে নিতে চাইছ আমার সিলেকসান ঠিক হয়েছে কিনা–
ইন্দ্রনাথ উত্তর দেন না, শুধু একটু হাসেন।
.
এক দিন পর সেন্ট্রাল ক্যালকাটার একটা ছিমছাম, পরিচ্ছন্ন রেস্তোরাঁর এক কোণে অমিতেশের সঙ্গে ইন্দ্রনাথের আলাপ করিয়ে দেবার জন্য একটা টেবল বুক করে রেখেছিল রণিতা। পাঁচটায় ইন্দ্রনাথের আসার কথা। তার অন্তত মিনিট পনের আগে এসে অমিতেশ আর সে বাবার জন্য অপেক্ষা করছে। রণিতা খুব ভাল করেই জানে ইন্দ্রনাথ খুবই সময়ানুবর্তী মানুষ, ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে তাঁর দৈনন্দিন রুটিন ঠিক করা থাকে, সময়ের এতটুকু এদিক ওদিক হলে তিনি বিরক্ত হন।
কাঁটায় কাঁটায় পাঁচটায় চলে এলেন ইন্দ্রনাথ। তাঁর সঙ্গে অমিতেশের আলাপ করিয়ে দিতে অমিতেশ ঝুঁকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করল।
ছেলেটা যে দুর্বিনীত নয়, বরং যথেষ্ট বিনয়ী, এক নজর দেখেই ইন্দ্রনাথের মনে হল। আজকালকার ছোকরারা পরিচয় করিয়ে দিলে হ্যালো বলে, বড় জোর হাতজোড় করে নমস্কার করে। অমিতেশ তাদের মতো নয়। প্রণামটা ইন্দ্রনাথকে খুশি করেছে। সঙ্গে সঙ্গে একটু খটকাও লাগে। তাঁর মেয়ে খুবই ধুরন্ধর, হয়তো সে-ই অমিতেশকে আগে থেকে প্রণামের ব্যাপারটা জানিয়ে রেখেছে। কোনটা তাঁর পছন্দ, কোনটা অপছন্দ, রণিতা তা ভালই জানে। ইন্দ্রনাথ একটা চেয়ারে বসে তাঁর দুপাশে অমিতেশ আর রণিতাকে বসালেন। বললেন, কী খাবি বল?
রণিতা বলে, তুমি খাওয়াবে মানে! তুমি তো আমাদের গেস্ট। আমরা তোমাকে খাওয়াব–
হেসে হেসে হাত নাড়তে নাড়তে ইন্দ্রনাথ বলেন, ঠিক আছে।
ফ্রায়েড প্রন তো তোমার খুব পছন্দ। অডার দিই?
দে।
স্টুয়ার্ডকে ডেকে ইন্দ্রনাথের জন্য প্রণ আর নিজেদের জন্য চিকেন কাটলেট আর কফির অর্ডার দেয় রণিতা।
খাবার আসার আগেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অমিতেশ এবং তার মা এবং বোন সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে নেন ইন্দ্রনাথ। তাঁর মনে হয় পরিবারটি ভাল, শিক্ষিত এবং কালচারড। ওখানে গেলে রণিতার কোনোরকম অসুবিধা হবে না, বরং সে যেভাবে নিজের কেরিয়ার গড়ে তুলতে চায় তার পুরোপুরি সুযোগ পেয়ে যাবে। তবু নিশ্চিত হবার জন্য জিজ্ঞেস করলেন, তোমার আর ছোট খুকির ব্যাপারটা আমি জানি। ছোট খুকি আমার কাছে কিছু গোপন করে নি।
অমিতেশের মুখে লালচে একটু আভা ফুটে ওঠে। লাজুক হেসে সে ইন্দ্রনাথের দিকে তাকায়।
ইন্দ্রনাথ বলেন, ছোট খুকি যে ফিল্মটাকেই কেরিয়ার করতে চায়, সেটা কি তোমার মা জানেন?
অমিতেশ বলে, হ্যাঁ, জানে।
এ এমন একটা কাজ যাতে অনেক সময় বাইরে বাইরে থাকতে হয়। বাড়ি থেকে বেরুনো বা ফিরে আসার ঠিক থাকে না। তা ছাড়া আউটডোরে শুটিং থাকলে দশ পনের দিন কি তারও বেশি বাড়িতে আসাই হল না। এ সব কি তোমার মা আর আত্মীয়স্বজনরা মেনে নেবেন?
অমিতেশ জানায়, রণিতা মাঝে মাঝেই তাদের বাড়ি যায়। তার কাজকর্মের পদ্ধতি মায়ের অজানা নয়। মা একেবারেই পুরনো ধ্যানধারণাকে প্রশ্রয় দেন না। তিনি আধুনিক, সংস্কারমুক্ত, ঝকঝকে মানুষ। মেয়েরা নানা ব্যাপারে পুরুষদের সমকক্ষ হয়ে উঠছে, তাদের পাশাপাশি এমন সব দুঃসাহস এবং পরিশ্রমের কাজ করছে যা কুড়ি পঁচিশ বছর আগে ভাবাও যেত না। এদের সম্বন্ধে মায়ের খুব শ্রদ্ধা। মেয়েরা ঘরের কোণে ঘাড় গুঁজে পড়ে থাকবে, এটা তিনি একেবারেই চান না। তারা কারো স্ত্রী, কারো মা, কারো পুত্রবধূ তো হবেই, সেই সঙ্গে নিজেদের আলাদা আলাদা আইডেনটিটি গড়ে তুলুক, সোসাইটিতে তাদের নিজস্ব পরিচিতি হোক–এর ওপর মা খুব জোর দেন।
অমিতেশ বলে, রণিতা যখনই আমাদের বাড়ি যায়, মা ওকে কাছে বসিয়ে ও কী করছে, ফিউচার পরিকল্পনা কী, সব জিজ্ঞেস করে। ফিল্মের ব্যাপারে মায়ের ভীষণ উৎসাহ। মা মনে করে এর চেয়ে পাওয়ারফুল মিডিয়াম এখন আর কিছু নেই। সেলুলয়েডে অনেক বড় বড় কাজ করা যায় যা কিনা সোসাইটিকে আগাগোড়া নাড়িয়ে দিতে পারে।
ঠিকই বলেছেন।
মায়ের যেরকম ইন্টারেস্ট, শুরীরটা ভাল থাকলে হয়ত রণিতার সঙ্গে ক্যামেরা নিয়ে নেমে পড়ত।
ইন্দ্রনাথ হাসেন। খাওয়া হয়ে গিয়েছিল, কফিতে চুমুক দিয়ে বলেন, এবার তোমার কথা বল–
একটু থতমত খেয়ে যায় অমিতেশ। বলে, আমার কী কথা?
তুমি কি জানালিজমেই স্টিক করবে?
হ্যাঁ, প্রিন্ট মিডিয়া আমি ছাড়তে চাই না।
অভিও-ভিসুয়াল মিডিয়ার সঙ্গে তোমরা পেরে উঠবে?
নিশ্চয়ই পারব। টেলিভিসন অনস্লট শুরু হয়ে গেছে, নতুন নতুন চ্যানেল ওপেন করা হচ্ছে, তার জন্য একটা খবরের কাগজও কি বন্ধ হয়েছে? উলটে সারা দেশে নতুন নতুন কাগজ বেরুচ্ছে। অডিও-ভিসুয়াল মিডিয়ার দাপট যতই হোক না, প্রিন্ট মিডিয়াকে দাবিয়ে রাখা যাবে না। মানুষের পড়ার হ্যাবিট চিরকালই থাকবে।
কেরিয়ার হিসেবে জার্নালিজম কি খুব লুক্রেটিভ?
আমার তো সেই রকমই ধারণা।
একজন আই এ এস, আই পি এস-এর মতো?
যদি আর্থিক দিক থেকে বলেন তা হলে বলব তার চেয়েও বেশি লুক্রেটিভ এবং গ্ল্যামারাস।
যেমন?
একজন ভাল জার্নালিস্ট বিশ পঁচিশ ত্রিশ হাজার টাকা পর্যন্ত স্যালারি পেতে পারে। ইংলিশ ডেইলিগুলো রিজিওন্যাল লাংগুয়েজ ডেইলির চেয়ে অনেক বেশি পে করতে পারে, কেননা সারা দেশ জুড়ে ওগুলোর মার্কেট। কোনো কোনোটার তো বিদেশেও প্রচুর ডিম্যান্ড রয়েছে। আপনি শুনলে অবাক হবেন, রিসেন্টলি আমার এক বন্ধু দিল্লির একটা কাগজে চল্লিশ হাজার টাকা মান্থলি স্যালারির অফার পেয়েছে।
খবরের কাগজ যে এতটা এগিয়েছে, ইন্দ্রনাথের ধারণা ছিল না। সত্যিই তিনি অবাক হয়ে যান।
অমিতেশ বলে, তা ছাড়া কোনো জানালিস্ট সেনসেসানাল বা সিরিয়াস কিছু লিখলে রাতারাতি তার নাম ছড়িয়ে যায়। একজন আই এ এস বা আই পি এস সারা জীবন চেষ্টা করলেও সেরকম ফেমাস হতে পারবে না। একে আপনি লুক্রেটিভ বা গ্ল্যামারাস বলবেন না?
আস্তে মাথা নাড়েন ইন্দ্রনাথ।
অমিতেশ থামে নি, আই এ এস, আই পি এস-এর মতো ছেলেমেয়েরা আজকাল জানালিজমে আসছে। একটু খোঁজ করলে জানতে পারবেন কোনো ফাস্ট ক্লাস ডেইলিতে ফার্স্ট ক্লাস না থাকলে আজকাল কাজ পাওয়া যায় না।
রণিতা মজার চোখে বাবাকে লক্ষ করছিল। কৌশলে ইন্দ্রনাথ যে অমিতেশ সম্পর্কে সব জেনে নিচ্ছেন, সেটা বুঝতে তার অসুবিধা হয় নি। ইন্দ্রনাথের মুখচোখ দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি খুশিই হয়েছেন। মেয়ে যে অপাত্রে হৃদয় সঁপে দেয় নি সে সম্বন্ধে তিনি নিশ্চিত।
কফি খাওয়া হয়ে গেলে ইন্দ্রনাথ বলেন, তুমি হয়তো শুনেছ, আমাদের ফ্যামিলি এবং আত্মীয়স্বজনেরা এখনও যথেষ্ট অর্থোডক্স। সে জন্যে তোমাদের কিছুদিন ধৈর্য ধরতে হবে।
মুখ নামিয়ে অমিতেশ বলে, রণি আমাকে সব বলেছে।
আশা করি, ধৈর্যর ফল ভালই হবে। আচ্ছা, আমি এবার উঠি। এনজয় ইওরসেলভস। বলতে বলতে উঠে পড়েন ইন্দ্রনাথ।
.
১০.
ছবি এবং নাটক দেখা, খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিন ঘাঁটাঘাঁটি করে তথ্য সংগ্রহ, ফিল্ম ট্রেডের সঙ্গে যুক্ত নানা লোকের ইন্টারভিউ নেওয়া, সবই হয়ে গেছে কিন্তু যাঁকে ছাড়া ডকু-ফিচারটা হওয়া একেবারেই সম্ভব নয় সেই নয়নতারা এখনও নিখোঁজ।
দিল্লি থেকে রজনী মাঝখানে বার চারেক ফোন করেছিল। মাণ্ডি হাউস তাড়া দিচ্ছে, রণিতা যত তাড়াতাড়ি পারে একবার দিল্লি এসে যেন ডকুমেন্টারির কনট্রাক্টটা ফাইনাল করে যায়। কিন্তু সে ঠিক করেছে, নয়নতারাকে খুঁজে বার না করা পর্যন্ত কোথাও যাবে না। আরো কয়েক দিন দেখবে সে, তার মধ্যে সন্ধান না পেলে প্রোজেক্টটা বন্ধ করে দিতে হবে।
ক্রমশ যখন হতাশ হয়ে পড়ছে রণিতা, সেই সময় বক্স নাম্বারে অদ্ভুত এক চিঠি এল। পুরনো আলিপুর থেকে লিখেছেন জনৈকা বিন্দুবাসিনী দেবী।
মহাশয় বা মহাশয়া,
আমি একজন বৃদ্ধা, বয়স পঁচাত্তর। দীর্ঘকাল আমরা পুরাতন আলিপুরের বাসিন্দা। আমার স্বামী দশ বছর আগে স্বর্গীয় হইয়াছেন। আমার এক ছেলে, এক মেয়ে। দুজনেই বিবাহিত এবং প্রবাসী। ছেলে থাকে আমেরিকায়, মেয়ে জামানিতে। আলিপুরের বাড়িতে আমার এক অবিবাহিত দেওর এবং আমি থাকি। দেওর আমারই সমবয়সী।
আমি চলৎশক্তিহীন মানুষ, কয়েক বছর আগে এক দুর্ঘটনায় ডান পাটি হারাই। তার উপর বাতে এবং ব্লাড সুগারে পঙ্গু হইয়া আছি। সারাদিনই হুইল চেয়ারে বসিয়া কাটিয়া যায়। ক্কচিৎ ক্রাচও ব্যবহার করি। মাঝে মাঝে বই পড়ি, টিভি দেখি। আমার একটি দুরবীন আছে, বাহিরের পৃথিবীর সঙ্গে ওটার মাধ্যমে আমার যেটুকু যোগাযোগ। এই শক্তিশালী বাইনোকুলারটা চোখে লাগাইয়া গাছগাছালি দেখি, পাখি দেখি, রাস্তাঘাট বাড়িঘর মানুষের জীবনযাত্রা লক্ষ করি।
এবার কাজের কথায় আসা যাক। আপনারা খবরের কাগজে যে বিজ্ঞপ্তি দিয়াছেন সেই প্রসঙ্গে জানাই, সম্প্রতি কয়েক মাস হইল আমাদের পাশের বাড়িতে নূতন লোকজন আসিয়াছে। সেদিন দুরবীন দিয়া ওই বাড়ির ভিতরটা দেখিতে ছিলাম। এভাবে দেখাটা অন্যায় এবং কুরুচিকর কিন্তু যাহা করিয়াছি সম্পূর্ণ কৌতূহল বশেই, ইহার মধ্যে কোনোরকম দুরভিসন্ধি ছিল না। লক্ষ করিতে করিতে হঠাৎ একটি মহিলাকে দেখিয়া চমকিত হইলাম। একদা সিনেমায় এবং মঞ্চে যাঁর অভিনয় আমাকে মুগ্ধ করিয়াছে এবং এখনও টিভি-তে যাঁর ছবি দেখিয়া আগের মতোই তৃপ্তি পাই সেই নয়নতারা দেবীর সঙ্গে তাঁহার যথেষ্ট মিল আছে। জানি না, আমাদের নূতন প্রতিবেশিনী নয়নতারাই কিনা।
এই খবরটি আপনাদের কতদূর কাজে লাগিবে, বুঝিতে পারিতেছি না। যদি দরকারি মনে করেন যে কোনোদিন সকাল নটা হইতে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত আমাদের বাড়িতে আসিতে পারেন। তখন বিস্তারিত কথা হইবে। আপনাদের কুশল কামনা করি।
নমস্কারান্তে,
বিন্দুবাসিনী দেবী
১২ রবিনসন স্ট্রিট
আলিপুর, কলিকাতা
বক্স নাম্বারের রোজকার চিঠি রোজ বিকেলে একটা প্যাকেটে পুরে রণিতাকে দেওয়া হয়। সে আর অমিতেশ সেগুলো নিয়ে দৈনিক দিনকাল-এর লাইব্রেরিতে গিয়ে বসে।
আজ বিন্দুবাসিনী দেবীর চিঠিটা দুজনে বার তিনেক করে পড়ে। তারপর অমিতেশ বলে, সেই মহিলাটি যে নয়নতারা সেটা কিন্তু বিন্দুবাসিনী জোর দিয়ে লেখেন নি। বুড়ো মানুষ, ভুলও তো হতে পারে।
রণিতা বলে, নিশ্চয়ই পারে। তবু হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার চেয়ে চান্স একটা নেওয়াই যাক না।
ঠিক আছে। কবে যেতে চাও?
ঘড়ি দেখে রণিতা বলে, এখন চারটে পঁয়ত্রিশ। বিন্দুবাসিনী পাঁচটার ভেতর দেখা করতে লিখেছেন। আজ গিয়ে লাভ নেই। কাল সকালে নটায় যাব। তুমি রাসবিহারীর মোড় মেট্রো রেল স্টেশনের কাছে সাড়ে আটটায় ওয়েট কোরো। আমি ওখানে চলে আসব। অটো-টটো কিছু একটা ধরে ওল্ড আলিপুরে দশ পনেরো মিনিটের ভেতর পৌঁছে যাব। বিন্দুবাসিনীর বাড়িটা খুঁজে বার করতে ম্যাক্সিমাম আরো পনেরো মিনিট।
পরদিন অটো থেকে নেমে পনেরো নয়, পাঁচ মিনিটের ভেতর বারো নম্বর রবিনসন স্ট্রিট বার করে ফেলে রণিতারা। বিরাট কমপাউণ্ডওলা বাড়িটার গেটে যে বিহারী দারোয়ানটি অ্যাটেনশানের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল তার হাতে নিজেদের নাম লিখে একটা স্লিপ বিন্দুবাসিনী দেবীর কাছে পাঠিয়ে দেয় রণিতা। কিছুক্ষণের মধ্যে সে ফিরে এসে তাদের সঙ্গে করে দোতলার ব্যালকনিতে পৌঁছে দিয়ে চলে যায়।
চিঠিতে নিজের ডেসক্রিপশনটা মোটামুটি ঠিকই দিয়েছিলেন বিন্দুবাসিনী। হুইল চেয়ারে এই মুহূর্তে তিনি বসে আছেন। শীর্ণ রুগণ চেহারা, পরনে ধবধবে সাদা ফিজে-পাড় শাড়ি থাকলেও বোঝা যায় ডান পাটা নেই। চোখেপুরু লেন্সের চশমা, হাতে চওড়া সোনার চুড়ি, গলায় সরু হার। ডান পাশে একটা মাঝারি টেবলে খবরের কাগজ, কিছু বই, ট্রানজিস্টর, বাইনোকুলার, ম্যাগাজিন, কলম, ডট পেন, প্যাড, টেলিফোন ইত্যাদি। বোঝা যায় এসব নিয়েই তাঁর দিন কাটে। হুইল চেয়ারের বাঁ পাশে দড়ির তৈরি নিচু নিচু কটা গুজরাতি চেয়ার, ওগুলো দর্শনার্থীদের জন্য।
বিন্দুবাসিনী রণিতাদের বলেন, বসো। তাঁর টেবলে সুইচ লাগানো রয়েছে। তিনি সেটা টিপতেই একটা কাজের লোক ছুটে আসে। তাকে দিয়ে রণিতাদের জন্য কফি আর বিস্কুট আনিয়ে বলেন, খাও–
রণিতারা শুধু কফির কাপ তুলে নেয়।
বিন্দুবাসিনী এবার বলেন, চিঠিতে তোমাদের জানিয়েছি, এখন মুখেও বলছি, আমি যাঁকে দেখেছি তিনি হুবহু নয়নতারার মতো। একরকম চেহারার মানুষ কম হলেও মাঝে মাঝে দেখা যে যায় না তা নয়। আমার যদি ভুল হয়ে থাকে তোমাদের ছোটাছুটি কিন্তু সার হবে।
অমিতেশ বলে, এ নিয়ে সঙ্কোচ বোধ করবেন না। মহিলা নয়নতারা না হলে কী আর করা যাবে। আপনি নিজের থেকে সাহায্য করতে চেয়েছেন, সে জন্যে আমরা কৃতজ্ঞ।
বিন্দুবাসিনী সামান্য হাসেন।
রণিতা জিজ্ঞেস করে, কবার ওঁকে দেখেছেন?
বিন্দুবাসিনী বলেন, মাস চারেক ওঁরা এখানে এসেছেন, তার ভেতর বার তিনেকের বেশি নয়। প্রতিবারই দূরবীন দিয়ে।
মহিলা বাইরে বেরোন না?
আমি অন্তত দেখিনি।
আর কেউ ওঁকে দেখেছে বলে জানেন?
বিন্দুবাসিনী অল্প হাসেন, এ পাড়ার লোকজনেরা প্রতিবেশীদের বাড়িতে কদাচিৎ যায়, আমাদের বাড়িতেও বড় একটা আসে না। অন্য কেউ মহিলাকে দেখে থাকলে আমি জানি না।
কলকাতার এই নিরিবিলি অভিজাত অঞ্চলে বিশাল বিশাল কম্পাউণ্ডের মাঝখানে একেকটা বাড়ি দ্বীপের মতো দাঁড়িয়ে আছে। পাশাপাশি, কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক নেই। বিন্দুবাসিনী যা বলেছেন সেটাই হয়তো ঠিক। এখানকার বাসিন্দাদের অন্যের সম্বন্ধে মধ্যবিত্তসুলভ কৌতূহল নেই, কেউ কারো সঙ্গে বিশেষ মেশেটেশে না। রণিত জিজ্ঞেস করে, ওই মহিলার বাড়িতে কাউকে যাতায়াত করতে দেখেছেন?
কেন বল তো?
তা হলে তাদের সঙ্গে দেখা করতাম।
বুঝেছি। দেখা করে জেনে নিতে ওই মহিলা সত্যিই নয়নতারা কিনা?
হ্যাঁ।
একটু চুপ করে থেকে বিন্দুবাসিনী বলেন, না, তেমন কেউ আমার চোখে পড়ে নি। অবশ্য ওদের গেটটা উলটো দিকে। আমাদের এখান থেকে ভাল দেখা যায় না। বলতে বলতে হঠাৎ কী মনে পড়ে যায় তাঁর, সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন, আরে, তোমাদের তো মহিলার বাড়িটাই দেখানো হয়নি। চল–
বিন্দুবাসিনীদের দোতলার ব্যালকনিটা আধখানা বৃত্তের মতো দক্ষিণ দিক থেকে পশ্চিমে ঘুরে গেছে। বিন্দুবাসিনী হ্যাঁন্ডেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হুইল চেয়ারটা পশ্চিম দিকে নিয়ে আসেন। তাঁর পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে রণিতারাও চলে আসে।
ডান দিকে আঙুল বাড়িয়ে বিন্দুবাসিনী বলেন, ওই যে বাড়িটা–
রণিতারা লক্ষ করল, বাড়িটা দোতলা। ইওরোপে গ্রীষ্মকালীন অবসর কাটানোর জন্য যে ধরনের ভিলা দেখা যায়, অনেকটা সেইরকম। এ অঞ্চলের অন্য সব বাড়ির মতো ওই বাড়িটা ঘিরেও বিশাল বাগান। বাগানের এধারে প্রায় পনেরো ফুট উঁচু মজবুত কমপাউন্ড ওয়াল। তার ওপর আবার পাঁচ লাইন করে কাঁটাতার বসানো। পাঁচিল টপকে চট করে ভেতরে ঢোকা প্রায় অসম্ভব।
বাগানের গাছপালা এত ঘন যে বাড়ির ভেতরটা বিশেষ দেখা যায় না। বিন্দুবাসিনীদের মতো ওই বাড়িটারও দোতলার অর্ধেক জুড়ে টানা ব্যালকনি। সেটা এখন ফাঁকা। লোহার পাল্লার সামান্য একটু অংশ ছাড়া গেটটা প্রায় চোখেই পড়ে না, বাড়ির আড়ালে সেটা ঢাকা পড়ে গেছে।
রণিতার কেমন সংশয় হয়, যত উদ্দীপনাই থাক, বিন্দুবাসিনীর মত একজন বৃদ্ধার পক্ষে পঁচাত্তর বছরের জ্যোতিহীন চোখ দিয়ে গাছগাছালির বাধা পেরিয়ে পাঁচ শ ফুট দূরের এক মহিলাকে নয়নতারা বলে শনাক্ত করা সম্ভব কিনা। মনে মনে কিছুটা হতাশা বোধ করে সে।
বিন্দুবাসিনী বলেন, আমার একটা পরামর্শ আছে।
বলুন- রণিতা উৎসুক চোখে তাকায়।
ভদ্রমহিলা বোধহয় থট-রিডার, মুখ দেখে মনের কথা পড়তে পারেন। বললেন, প্রথমে তোমরা নিশ্চিত হয়ে নাও, মহিলাটি সত্যিই নয়নতারা কিনা।
কীভাবে?
সে জন্যে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হবে। তোমাদের যুবা বয়সের চোখ, যথেষ্ট তেজ আছে। এখানে বসে বসে ওই বাড়িটার ওপর নজর রাখো। দরকার হলে বাইনোকুলারটা ব্যবহার করো। যদি তোমাদের মনে হয় মহিলা নয়নতারাই তখন ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করবে। অবশ্য–
কী?
শুনেছি ও বাড়িতে নিজেদের ঘনিষ্ঠ লোকজন ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। তোমরা ভেতরে যাবার সুযোগ পাবে কি? অবশ্য সেটা পরের কথা।
আগে নয়নতারা সম্পর্কে সব সংশয় দূর করে নিতে হবে।
সে তো ঠিকই। কিন্তু–
কী?
একটু ভেবে রণিতা বলে, আপনি বলেছেন চার মাসে মাত্র তিনবার ওঁকে দেখেছেন। আমাদের কত দিন ওঁদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে হবে?
এ দিকটা আগে বোধহয় চিন্তা করেন নি বিন্দুবাসিনী। ভুরু সামান্য কুঁচকে বলেন, এটা একটা সমস্যা বটে। কিন্তু কী আর করা, যতদিন না ওঁকে দেখতে পাচ্ছ তাকিয়ে থাকতেই হবে।
সেটা করতে হলে আপনার বাড়িতে তো রোজই আসতে হয়।
তা তো হয়ই। একটা বড় কাজ করতে চাইছ, তার জন্যে এটুকু পরিশ্রম করবে না? রোজ সকালে এখানে চলে আসবে। সন্ধে পর্যন্ত ওই বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকবে। লাঞ্চ, ব্রেক ফাস্ট, সব এখানে করবে। যখন যা সাহায্য দরকার, আমি করব।
রণিতারা বুঝতে পারছিল, এই বয়সে, পানসে কর্মহীন জীবন আর ভাল লাগছে না বিন্দুবাসিনীর। তাদের দেখে রীতিমত উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছেন। নয়নতারাকে খুঁজে বার করার মতো দারুণ রোমাঞ্চকর এবং রহস্যময় এক অভিযানে তিনি তাদের সঙ্গে থাকতে চান।
অমিতেশ মজার গলায় বলে, বার্ড ওয়াটারদের মতো তাকিয়ে থাকার কথা বলছেন?
বিন্দুবাসিনী বলেন, নিশ্চয়ই।
রণিতা বলে, ব্রেকফাস্ট আর লাঞ্চের ব্যাপারে ভাববেন না। আমরা ব্যবস্থা করে নেব।
বিন্দুবাসিনী রেগে যান, তা হলে তোমাদের আসার দরকার নেই।
রণিতা হকচকিয়ে যায়, মানে–
সারাদিন চুপচাপ বসে থাকি। কতকাল তামাদের বাড়িতে লোকজন আসে না। তোমরা আমার নাতি-নাতনির বয়সী। বলে কিনা খাওয়ার ব্যবস্থা করে নেবে। আন্তরিকতার দাম নেই তোমাদের কাছে? এমন হৃদয়হীন ছেলেমেয়ে আমি কখনও দেখিনি। ক্ষুব্ধ, অভিমানী মুখে বসে থাকেন বিন্দুবাসিনী।
হাতজোড় করে শশব্যস্তে রণিতা বলে, অন্যায় হয়ে গেছে, ক্ষমা করবেন। আমরা এখানেই খাব।
বিন্দুবাসিনী খুব সম্ভব বেশিক্ষণ রাগ বা অভিমান করে থাকতে পারেন না। হাসিমুখে বলেন, ঠিক আছে, ক্ষমা করা গেল। তোমরা এখানে বসে বসে ওই বাড়িটা দেখতে থাকো। আমি ওষুধ খেয়ে আসছি। বলে হাতল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চলে যান।
এখানেও কয়েকটা খাটো গুজরাতি চেয়ার সাজানো রয়েছে। রণিতা আর অমিতেশ বসে পড়ে।
মিনিট পাঁচেক বাদে বিন্দুবাসিনী ফিরে আসেন। তাঁর কোলে বাইনোকুলারটা রয়েছে। এবার পালা করে করে তিনজনে দূরবীনটা চোখে লাগিয়ে ওই বাড়িটা দেখতে থাকে। কিন্তু কাউকেই দেখা যায় না। বাড়িটা এমনই নিঝুম যে মানুষজন আছে কিনা সন্দেহ।
দুপুরে দোতলারই আরেক মাথায় ডাইনিং রুমে রণিতাদের নিয়ে যান বিন্দুবাসিনী। সেখানে তাঁর দেওর সুধীরেশ মল্লিকের সঙ্গে আলাপ হয়। বিন্দুবাসিনীর প্রায় সমবয়সী, ভারি চেহারার এই মানুষটির প্রায় গোটা মাথা জুড়ে টাক, এক কান থেকে আরেক কান পর্যন্ত মাথার পেছন দিকটা ঘিরে ধবধবে সাদা কিছু চুল এখনও অবশ্য টিকে আছে। মোটা ভুরু, শান্ত চোখ, গোল মাংসল থুতনি। পরনে পাজামার ওপর ঢলঢলে ফতুয়া ধরনের পকেটওলা জামা। চোখে পুরু লেন্সের চশমা।
ভদ্রলোক যে অত্যন্ত স্বল্পভাষী সেটা বোঝা গেল, যখন বিন্দুবাসিনী রণিতাদের এ বাড়িতে আসার কারণটা সাতকাহন করে জানালেও তিনি শুধু নিরাসক্তভাবে বললেন, ও। তারপর প্লেটের ওপর ঝুঁকে অপরিসীম মনোযোগ খাওয়া শুরু করলেন।
তাঁর মুখে মাত্র এক অক্ষরের একটি শব্দ উচ্চারিত হওয়ায় বুঝিবা বিব্রত বোধ করছিলেন বিন্দুবাসিনী। সুধীরেশের ব্যবহারে পাছে রণিতারা কিছু মনে করে তাই নিজেই দেওর সম্পর্কে প্রচুর কথা বলতে লাগলেন। সুধীরেশের স্বভাবটাই ওরকম। ভীষণ চুপচাপ মানুষ। রিটায়ারমেন্টের পর সকালে ঘণ্টা দেড়েকের মর্নিং ওয়াক ছাড়া বাকি দিনটা বই নিয়েই তাঁর কেটে যায়। ওঁর অবশ্য পঞ্চাশ ষাটটা নানা জাতের পাখি আছে, তাদের নিয়েও খানিকটা সময় কাটে, ইত্যাদি ইত্যাদি। এইসব কথা যখন হচ্ছে তখন মাঝে মাঝে মুখ তুলে সামান্য হেসে, গলার ভেতর অস্পষ্ট আওয়াজ করে ফের খাওয়ায় মগ্ন হয়ে গেছেন সুধীরেশ। আওয়াজটা সন্তোষসূচক কিনা বোঝা যায়নি।
লাঞ্চের পর আবার রণিতারা তিনজন পশ্চিমের ব্যালকনিতে এসে বসেছে। কিন্তু চকিতের জন্য ও বাড়ির ঝুল বারান্দায় একটি কাজের মেয়ে ছাড়া আর কাউকে দেখা যায়নি।
পাঁচটা বাজলে চা খেয়ে রণিতারা আজকের মত বিদায় নিতে যাবে, সেই সময় একটা কথা মনে পড়ে যায়। এভাবে তো ব্যালকনিতে অনিশ্চিতভাবে বসে থেকে দিনের পর দিন কাটিয়ে দেওয়া যায় না। হয়তো মহিলাকে একমাস কি দু মাস পর দেখা গেল এবং নিঃসংশয় হওয়া গেল তিনি নয়নতারা নন। তখন এই এক দু মাস পুরোপুরি নষ্ট। তাই অন্যভাবেও চেষ্টা করতে হবে।
তাই, রণিতা জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা, ও বাড়ির ফোন নাম্বার আপনি জানেন?
বিন্দুবাসিনী বলেন, না!
বাড়ির নম্বরটা বলতে পারবেন?
তা পারব। চোদ্দ নম্বর রবিনসন স্ট্রিট। নম্বর জানতে চাইছ কেন?
দেখি যদি ঠিকানা থেকে ফোনের কোনো হদিশ পাওয়া যায়।
দেখো। কাল কখন আসছ?
নটায়।